তায়ালার উপাসনা নিয়ে কারো মধ্যে খুব একটা বিরোধ নেই। আজকের বাংলাদেশেও নেই। রাসূল সা.-এর আমলে মক্কার কুরাইশদেরও বিরোধ ছিল না। কুরাইশরা আবু তালিবের মাধ্যমে রাসূল সা.-এর কাছে প্রস্তাব পাঠিয়েছে, মুহাম্মদ শুধু আল্লাহর ইবাদত করতে চায় করুক তবে আমাদের উপাস্যদের বিরুদ্ধে যাতে কোনো কথা না বলে। তাহলে মুহাম্মদকে আমরাও কিছু বলবো না।
মুহাম্মদ সা. এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছেন কারণ আল্লাহ তায়ালার সার্বভৌমত্ব মানা মানেই বাকি সবার ক্ষমতাকে অস্বীকার করা। আল্লাহর নিয়মের বাইরে সব নিয়মকে অস্বীকার করা। আল্লাহর নিয়মের বাইরে অন্য সকল নিয়ম হলো তাগুত। মুসলিম হিসেবে তাগুতের কাফির হওয়া আবশ্যক।
আল্লাহ তায়ালা সূরা নাহলের ৩৬ নং আয়াতে বলেন, “আর নিশ্চয়ই আমি প্রত্যেক জাতির কাছে রাসূল পাঠিয়েছি এ কথা বলে যে, তোমরা শুধু আল্লাহর উপাসনা কর এবং তাগুতকে পরিত্যাগ কর।”
আপনি যদি শুধু আল্লাহর উপাসনার কথা বলেন, তবে সেটা হবে অপূর্ণাঙ্গ তাবলীগ। আর অপূর্নাঙ্গ তাবলীগ মানেই হলো আপনি মুশরিকদের সাথে সমন্বয় করে নিয়েছেন। আর তাই যদি হয়ে থাকে তবে অপূর্ণাঙ্গ তাবলীগ মানেই হলো শিরক। তবে কৌশলগত কারণে কিছুসময়ের জন্য অবস্থার প্রেক্ষাপটে অপূর্ণাঙ্গ দাওয়াত হয়তো দেওয়া যেতে পারে। তবে অবশ্যই সেটা হবে প্রাথমিকভাবে এবং কোনোভাবেই স্থায়ী নীতি হবে না।
আপনার দাওয়াতে যদি আল্লাহর আইনের বাইরে চলা মানুষের মধ্যে প্রতিক্রিয়া তৈরি না করে তবে বুঝবেন আপনার দাওয়াত সঠিক নয়। অর্থাৎ আপনার তাবলীগ ইকামাতে দ্বীনের জন্য হচ্ছে না। আর ইকামাতে দ্বীনের তাবলীগ ছাড়া অন্য তাবলীগ ইসলামের তাবলীগ নয়। আল্লাহ তায়ালা সূরা তাওবার ৩৩, সূরা ফাতহর ২৮ ও সূরা সফের ৯ নং আয়াতে বলেছেন ইকামাতে দ্বীনের কাজে অবশ্যই মুশরিকরা অপছন্দ করবে, বাধা দিবে। আমাদের দেশের কথাই বলি। এদেশে আল্লাহর নিয়মকানুন প্রতিষ্ঠিত নেই। তবে ব্যক্তিগতভাবে যে কেউ ইসলাম পালন করতে পারে।
এদেশের সংবিধানের অনেকগুলো ধারা ও উপধারা ইসলাম পরিপন্থী। এখন যদি আমার আপনার দ্বীনের তাবলীগ এই তাগুতকে অস্বীকার না করে তবে এই তাবলীগ আল্লাহর রাসূলের তাবলীগ নয়, ইসলামের তাবলীগ নয়। আল্লাহর রাসূল সা. যখন প্রকাশ্যে লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ প্রচার করছিলেন তখনই তাঁর সাথে তাগুতের দ্বন্দ্ব হয়।
উপহাস; বিরোধীতার ১ম পর্যায়
যখন আল্লাহর রাসূলের দল ছোট ছিল তখন তারা হাসি ঠাট্টা, বিদ্রূপ উপহাস এবং মিথ্যাবাদী বলে তাকে অভিহিত করতো। এর উদ্দেশ্য ছিল মুসলমানদের মনোবল নষ্ট করা। এ লক্ষ্য অর্জনের জন্য মুশরিকরা নবী সা.-কে অহেতুক অপবাদ এবং গালাগাল দিতে শুরু করে। কখনো তারা প্রিয় নবীকে পাগল বলতো। কখনো তাঁর ওপর যাদুকর এবং মিথ্যাবাদী হওয়ার অপবাদ দেওয়া হতো। চোখ গরম করে তাকাতো। তাদের বিরোধীতার এই পর্যায়ে তারা সফল হতে সক্ষম হয়নি।
বিকৃতি; বিরোধীতার ২য় পর্যায়
মুহাম্মদ সা. মুশরিকদেরদের হাসি ঠাট্টা ও অপমানে কর্ণপাত করলেন না। তিনি তাঁর তাবলীগ কন্টিনিউ করলেন। ধীরে ধীরে কিছু মানুষ ইসলামে দাখিল হতে শুরু করলেন। তখন মুশরিকরা নতুন কৌশল অবলম্বন করলো। তারা এবার আল্লাহর রসূলের শিক্ষাকে বিকৃত করা, সন্দেহ অবিশ্বাস সৃষ্টি করা, মিথ্যা প্রোপাগান্ডা করা, দ্বীনের শিক্ষা এবং দ্বীন প্রচারকারীদের ঘৃণ্য সমালোচনা করা শুরু করলো। মুসলিমদের মুরতাদ ও ফাসাদ সৃষ্টিকারী হিসেবে উল্লেখ করতে লাগলো। ভাইদের মধ্যে, পিতা-ছেলের মধ্যে ও স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে সম্পর্ক নষ্টকারী হিসেবে মুহাম্মদ সা.কে দোষারোপ করলো। মুশরিকদের এই প্রচারণা মক্কায় প্রভাব তৈরি করলো। মক্কার সাধারণ মানুষ অনুভব করলো মক্কায় বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি ও যারা মুসলিম হচ্ছে তাদের পরিবারে সৃষ্ট সমস্যার জন্য মুহাম্মদ দায়ি। মুহাম্মদ সা. এর বিপরীতে মক্কার মানুষদের বুঝালেন মূলত মিথ্যাকে আঁকড়ে ধরে রাখার জন্যই সমস্যা হচ্ছে।
সমন্বয়; বিরোধীতার ৩য় পর্যায়
এরপরও যখন মুসলিমদের ও মুহাম্মদ সা.-কে দ্বীনের তাবলীগ থেকে সরানো যাচ্ছিল না, তখন মুশরিকরা মিল মহব্বত ও সমন্বয়ের পথ ধারণ করলো। তারা মুসলিমদের বন্ধু সেজে তাদের পেছনে বেহায়া দাসীদের লেলিয়ে দিত। তারা রংঢং করতো। এর মাধ্যমে তারা মুসলিমদের ইসলামের শিক্ষা থেকে দূরে রাখতে চেয়েছিলো। মুহাম্মদ সা. তাবলীগ বন্ধ করবেন এর বিনিময়ে তারা মুহাম্মদ সা.-কে সমাজের নেতৃত্ব, প্রচুর সম্পদ ও অনেক সুন্দরী নারী অফার করেছে। আল্লাহর রাসূল তাদের অফার ফিরিয়ে দিয়েছেন এই বলে আমার এক হাতে চন্দ্র আরেক হাতে সূর্য এনে দিলেও আমি তাবলীগ বন্ধ করবো না। এর পর তারা এক অভিনব প্রস্তাব করলো, তারা কিছুদিন ইসলামের নিয়মে চলবে। আর মুসলিমরা কিছুদিন মুশরিকদের নিয়মে চলবে। এভাবে তারা ভালোবেসে পথ চলবে।
এই প্রেক্ষিতে ইবনে ইসহাক বলেন, রাসূলুল্লাহ সা. কাবাঘরের তাওয়াফ করছিলেন এমন সময় আসওয়াদ ইবনে মুত্তালিব, ওলীদ ইবনে মুগীরা, উমাইয়া ইবনে খালফ ও আসা ইবনে ওয়ায়েল ছাহমী তাঁর কাছে এলো। এরা ছিল নিজ নিজ গোত্রের বিশিষ্ট ব্যক্তি। তারা বললো এসো মুহাম্মদ, তুমি যার পূজা করছো, আমরা তার পূজা করবো। আর আমরা যাকে পূজা করছি, তুমিও তার পূজা করবে। এতে আমরা উভয়ে সমপর্যায়ে উন্নীত হবো। যদি তোমাদের মাবুদ আমাদের মাবুদের চেয়ে ভালো হন তবে আমরা তার কাছ থেকে কল্যাণ লাভ করবে আর যদি আমাদের মাবুদ তোমাদের মাবুদের চেয়ে ভালো হন তবে তোমরা তার কাছ থেকে কল্যাণ লাভ করবে। তাদের এ হাস্যকর কথার প্রেক্ষিতে আল্লাহ তায়ালা সূরা কাফিরুন নাজিল করেন। মুহাম্মদ সা. তাদের এই প্রস্তাবও প্রত্যাখ্যান করেন।
মুশরিকদের এই পদ্ধতি রাসূল সা. প্রত্যাখ্যান করলেও এতে মুসলিমরা বহুবার ধরা খেয়েছে। এটা মুশরিকদের একটি বড় অস্ত্র। মুসলিমদের থিওরি হলো এক উপাস্য। মুশরিকদের থিওরি হলো বহু উপাস্য। তাই মুশরিকদের সাথে আপোস করা মানেই আপনি বহু উপাস্যকে স্বীকার করে নেওয়া। আর এতেই মুশরিকদের জয় হয়। রাসূল সা.-এর পর মুসলিমদের যত জায়গায় পরাজয় হয়েছে তার অন্যতম কারণ ছিল মুশরিকদের সাথে বন্ধুত্ব করা।
আমাদের বাংলার ইতিহাসের দিকেও যদি আমরা তাকাই তাহলে দেখতে পারো গণেশের উত্থান, শ্রীচৈতন্যের উত্থান এগুলো হয়েছে সেসময়ের শাসকের মুশরিকদের সাথে বন্ধুত্ব করার নিমিত্তে। ১৭৫৭ সালে বাংলার মুসলিম নবাবদের পরাজয়ও হয়েছে হিন্দু বণিকদের সাথে বন্ধুত্ব করার কারণে। একইভাবে বাংলাদেশ ভারতের করায়ত্বে চলে আসা ও অধীনস্ত হয়ে পড়ার জন্যও দায়ি এই অঞ্চলের শাসকদের মুশরিকদের সাথে বন্ধুত্বের কারণে। যার ফলশ্রুতিতে এদেশে বহু মুসলিম থাকা সত্ত্বেও এদেশের নিয়মকানুন ইসলাম বিদ্বেষী। এখানে মূর্তির বিরুদ্ধে, সুদের বিরুদ্ধে কথা বললে শাস্তি পেতে হয়।
নির্যাতন; বিরোধীতার ৪র্থ পর্যায়
মুশরিকরা যখন লক্ষ্য করলো যে, তাদের তৎপরতা ইসলামের তাবলীগের পথে বাধা সৃষ্টি করতে ব্যর্থ হচ্ছে তখন তারা পুনরায় সমবেত হয়ে পঁচিশজন কাফেরের সমন্বয়ে একটি কমিটি গঠন করলো। এরা ছিল কুরাইশ বংশের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি। এ কমিটির প্রধান ছিল আবু জাহেল। আবু জাহেলের আসল নাম আমর ইবনে হিশাম। মক্কার মানুষ তাঁর পাণ্ডিত্যের কারণে তাকে উপাধি দিয়েছে আবুল হাকাম অর্থাৎ জ্ঞানের পিতা। কিন্তু মুসলিমদের নির্যাতন করে অভিশপ্ত হওয়ায় মুসলিমরা তাকে উপাধি দিয়েছে আবু জাহেল বা মূর্খের পিতা।
যাই হোক পারস্পরিক পরামর্শ ও চিন্তা ভাবনার পর কমিটি রাসূলুল্লাহ সা. এবং সাহাবাদের বিরুদ্ধে একটি সিদ্ধান্তমূলক প্রস্তাব অনুমোদন করলো। তারা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলো যে, ইসলামের বিরোধিতা করতে যেয়ে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে কষ্ট দেওয়া এবং ইসলাম গ্রহণকারীদের নির্যাতন করার ব্যাপারে কোন প্রকার শিথিলতার পরিচয় দেওয়া হবে না।
মুশরিকরা এ প্রস্তাব গ্রহণ করার পর সর্বাত্মকভাবে তা বাস্তবায়নের দৃঢ় সংকল্প গ্রহণ করলো। মুসলমান বিশেষত দুর্বল মুসলমানদের ক্ষেত্রে মুশরিকদের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন সহজ ছিল। তারা আবু লাহাবের নেতৃত্বে নবী সা.-এর ওপর নির্যাতন শুরু করলো। মুহাম্মদ সা. নবুয়্যত পাওয়ার আগে আবু লাহাব তার দুই পুত্র ওতবা ও ওতাইবাকে নবী সা.-এর দুই কন্যা রুকাইয়া ও উম্মে কুলসুমের সাথে বিয়ে দিয়েছিলো। আবু লাহাব নবীর দুই কন্যাকে তালাক দিতে তার দুই পুত্রকে বাধ্য করেছিলো।
হজ্জ মৌসুমে আবু লাহাব নবী সা.-কে মিথ্যাবাদী সাব্যস্ত করতে বাজার এবং বিভিন্ন জনসমাবেশে তাঁর পেছনে লেগে থাকতো। সে নবী সা.-এরর কথা মিথ্যা প্রমাণ করতেই শুধু ব্যস্ত থাকত না বরং তাঁকে পাথরও নিক্ষেপ করতো এতে তার পায়ের গোড়ালি রক্তাক্ত হয়ে যেতো।
আবু লাহাবের স্ত্রীও কোন অংশে কম ছিলোনা। নবী সা. যে পথে চলাফেরা করতেন, ঐ পথে এবং তার দরজায় সে কাঁটা বিছিয়ে রাখতো। সে অত্যন্ত অশ্লীল ভাষী এবং ঝগড়াটে ছিলো। এ নোংরা মহিলা নবী সা.-কে গালাগাল দেওয়া এবং কুটনামি নানা ছুতোয় ঝগড়া, ফেতনা ফ্যাসাদ সৃষ্টি এবং সংঘাতময় পরিস্থিতি সৃষ্টি করা ছিলো তার কাজ, এ কারণে আল্লাহ তায়ালা সূরা লাহাব নাজিল করেছেন।
রাসূলুল্লাহ সা. যখন নামায আদায় করতেন তখন মুশরিকরা বকরির নাড়িভুঁড়ি এমনভাবে ছুড়ে মারতো যে, সেসব গিয়ে তাঁর গায়ে পড়তো, আবার চুলার ওপর হাড়ি চাপানো হলে বকরির নাড়ি ভুড়ি এমনভাবে নিক্ষেপ করতো যে, সেগুলো গিয়ে সেই হাড়িতে পড়তো।
হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. বলেন, একদিন নবী সা. কাবাঘরের পাশে নামায আদায় করছিলেন। আবু জাহেল এবং তার কয়েকজন বন্ধু সেখানে বসেছিলো। এমন সময় একজন অন্যজনকে বললো, কে আছো? অমুকের উটের নাড়িভুঁড়ি এনে মোহাম্মাদ যখন সেজদায় যাবে, তখন তার পিঠে চাপিয়ে দিতে পারবে? এরপর ওকবা ইবনে আবু মুঈত উটের নাড়িভুঁড়ি এনে অপেক্ষা করতে লাগলো। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সেজদায় যাওয়ার পর সেই নাড়িভুঁড়ি তার উভয় কাঁধের দু'দিকে ঝুলিয়ে দিল।
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ আরো বলেন, এরপর দুর্বৃত্তরা হাসতে হাসতে একজন অন্যজনের গায়ে ঢলে পড়ছিলো, এদিকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সেজদায় পড়ে রইলেন, মাথা তুলতে পারছিলেন না। হযরত ফাতিমা রা. খবর পেয়ে ছুটে এসে নাড়িভুঁড়ি সরিয়ে ফেললেন। এরপর রাসূলুল্লাহ সা. সেজদা থেকে মাথা তুললেন। এরপর তিনবার বললেন, আল্লাহুমা আলাইকা বি কুরাইশ অর্থাৎ হে আল্লাহ কুরাইশদের দায়িত্ব তোমার ওপর। এরপর রাসূলুল্লাহ সা. নাম ধরে বদদোয়া করলেন, হে আল্লাহ আবু জাহেলকে পাকড়াও করো, ওতবা ইবনে রবিয়া, শায়বা ইবনে রাবিয়া, ওলীদ ইবনে ওতবা, উমাইয়া ইবনে খালফ এবং ওকবা ইবনে আবু মুঈতকেও পাকড়াও করো।
কোনো উচ্চ বংশীয় ও সম্মানিত মানুষের ইসলাম গ্রহণের কথা শুনলে আবু জাহেল তাকে গালমন্দ ও অপমান করতো। এছাড়া সামাজিক এবং অর্থনৈতিক দিক থেকেও ক্ষতিগ্রস্ত কারার হুমকি দিতো। কোন দুর্বল ও দাস মানুষ ইসলাম গ্রহণ করলে তাকে ধরে প্রহার করতো এবং অন্যদেরও প্রহার করতে অন্যদের উৎসাহিত করতো।
হযরত বিলাল রা. ছিলেন উমাইয়া ইবনে খালফের ক্রীতদাস, ইসলাম গ্রহণের পর উমাইয়া বিলাল রা.-কে গলায় দড়ি বেঁধে উচ্ছৃঙ্খল বালকদের হাতে তুলে দিত। বালকেরা তাকে মক্কার বিভিন্ন স্থানে নিয়ে যেতো, এ রকম করায় তার গলায় দড়ির দাগ পড়ে যেতো। উমাইয়া নিজেও তাকে বেঁধে নির্মম প্রহারে জর্জরিত করতো। এরপর উত্তপ্ত বালির ওপর জোর করে শুইয়ে রাখতো। এ সময়ে তাকে অনাহারে রাখা হতো। কখনো কখনো দুপুরের রোদে মরু বালুকার ওপর শুইয়ে বুকের ওপর ভারি পাথর চাপা দিয়ে রাখতো। এ সময় বলতো, তোমার মৃত্যু হওয়া পর্যন্ত এভাবে ফেলে রাখা হবে। তবে বাঁচতে চাইলে মুহাম্মাদের পথ ছাড়ো। কিন্তু তিনি এমনি কষ্টকর অবস্থাতেও বলতেন, আহাদুন আহাদ! তার ওপর নির্যাতন চলতে দেখে হযরত আবু বকর রা. একদিন খুবই ব্যথিত হলেন। তিনি হযরত বিলাল রা.-কে একটি দু'শো দিরহামের পরিবর্তে ক্রয় করে মুক্ত করে দেন।
হযরত আম্মার ইবনে ইয়াসির রা. ছিলেন বনু মাখযুমের ক্রীতদাস, তিনি এবং তার পিতামাতা ইসলাম গ্রহণের পর তাদের ওপর ভয়াবহ নির্যাতন শুরু করা হলো। আবু জাহেলের নেতৃত্বে মুশরিকরা তাদেরকে উত্তপ্ত রোদে মরুভূমিতে শুইয়ে কষ্ট দিতো। একবার তাদের শাস্তি দেয়া হচ্ছিলো। এমন সময় নবী সা. সে পথ দিয়ে যাচ্ছিলেন। তিনি বললেন, হে ইয়াসিরের পরিবার! ধৈর্যধারণ করো, তোমাদের ঠিকানা হচ্ছে জান্নাত।
একদিন আম্মার রা. এর মা ও ইয়াসির রা.-এর স্ত্রী সুমাইয়া রা.-এর লজ্জাস্থানে সন্ত্রাসী আবু জাহেল বর্শা নিক্ষেপ করে। এতে তিনি শাহাদাতবরণ করেন। এর মাধ্যমে নবী সা.-এর সাহাবীদের খুন করার ইতিহাস চালু হলো। তিনি ছিলেন ইসলামের প্রথম শহীদ। এরপর অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে হযরত ইয়াসির রা. শাহদাতবরণ করেন। স্বামী-স্ত্রী দুজনই আল্লাহর রাহে প্রাণ কুরবানী করে ইতিহাসে শহীদ হিসেবে স্থান করে নিলেন।
আম্মার রা.-এর ওপর তখনো অব্যাহতভাবে অত্যাচার চালানো হচ্ছিল। তাকে কখনো গরম বালুর ওপর শুইয়ে রাখা হতো। কখনো বুকের ওপর ভারি পাথর চাপা দেয়া হতো। কখনো পানিতে চেপে ধরা হতো। মুশরিকরা তাকে বলতো, যতক্ষণ পর্যন্ত তুমি মুহাম্মাদকে গালি না দেবে এবং লাত-উজ্জা সম্পর্কে প্রশংসনীয় কথা না বলবে, ততক্ষণ পর্যন্ত আমরা তোমাকে ছাড়তে পারবো না।
আম্মার রা. বাধ্য হয়ে তাদের কথা মেনে নেন। এরপর রাসূলুল্লাহ সা.এর কাছে কাঁদতে কাঁদতে হাযির হন। আল্লাহ তায়ালা তখন আয়াত নাযিল করে বলেন, কেউ ঈমান আনার পর আল্লাহকে অস্বীকার করলে ও কুফরির জন্য হৃদয় উন্মুক্ত রাখলে তার ওপর আল্লাহর আজাব পতিত হবে। আর তার জন্য রয়েছে মহাশাস্তি। তবে ওই ব্যক্তির জন্য নয়, যাকে কুফরি করতে বাধ্য করা হয়েছে; কিন্তু তার অন্তর ঈমানে অবিচল। (সূরা নাহল - ১০৬)
খাব্বাব রা. ছিলেন খোজায়া গোত্রের উম্মে আনসার নামে এক মহিলার ক্রীতদাস। মুশরিকরা তার ওপর নানাভাবে নির্যাতন চালাতো। তাকে মাটির ওপর টানতো, তার মাথার চুল ধরে টানতো এবং ঘাড় মটকে দিতো। কয়েকবার জ্বলন্ত কয়লার ওপর তাকে শুইয়ে বুকে পাথর চাপা দিয়ে রাখা হয়েছিলো যাতে তিনি উঠতে না পারেন। এই কারণে তাঁর পিঠে গর্ত হয়ে গিয়েছিল। তাঁর মাংশ ও চর্বি গলে সেই কয়লার আগুন নিভতো।
যিন্নীরাহ, নাহদিয়া এবং তাদের কন্যা উম্মে উবাইস ছিলেন ক্রীতদাসী, এরা ইসলাম গ্রহণ করে পৌত্তলিকদের হাতে কঠোর শাস্তি ভোগ করেন। পরিশেষে আবু বকর সিদ্দিক রা. বিলাল রা.-এর এসব দাস-দাসীদের চড়া দামে কিনে মুক্ত করে দিয়েছেন।
মুশরিকরা আরো বীভৎস উপায়েও ইসলাম গ্রহণকারীদের শাস্তি দিতো, তারা কোন কোন সাহাবীকে উট এবং গাভীর কাচা চামড়ার ভেতর জাড়িয়ে বেধে রোদে ফেলে রাখতো, কাউকে লোহার বর্ম পরিয়ে তপ্ত পাথরের ওপর শুইয়ে রাখতো, কারো ইসলাম গ্রহণের খবর পেলে দুর্বৃত্ত পৌত্তলিকরা নানা উপায়ে তার ওপর অত্যাচার এবং নির্যাতন চালাতো, মোট কথা আল্লাহর মনোনীত দ্বীন গ্রহণকারীদের ওপর যে সব নির্মম অত্যাচার ও নির্যাতন করা হয়েছিলো তার তালিকা খুবই দীর্ঘ এবং বড়োই বেদনাদায়ক।
সাহাবারা নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে মুহাম্মদ সা.-এর কাছে এসে বলতেন, আপনি আমাদের নিরাপত্তার জন্য কিছুই করবেন না? আল্লাহর রাসূল সা. তাঁদের ধৈর্যের উপদেশ আর বলতেন পূর্বেকার সকল নবী ও সাহাবীরদের ওপর এমন নির্যাতন হয়েছে।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন