মক্কার মুসলিমরা সব ছেড়ে চলে আসলো মদিনায়। সেখানে মুসলিম মদিনাবাসীর সহায়তায় প্রতিষ্ঠিত হলো মুসলিমদের কাঙ্ক্ষিত ইসলামিক স্টেট। মক্কার মুশরিকরা মুসলিমদের হিজরত ঠেকাতে প্রাণপণ চেষ্টা করেছিল। কিন্তু তারা ব্যর্থ হয়েছিল। তবে তাদের চেষ্টা থেমে থাকেনি। তারা মদিনার এই নতুন আধুনিক রাষ্ট্রটিকে ধ্বংস করার জন্য পরিকল্পনা করতে থাকলো।
আবদুল্লাহ ইবনে উবাইর সাথে পত্র বিনিময়
আবদুল্লাহ ইবনে উবাই তখনো ইসলামগ্রহণ করেনি। মদিনায় আবদুল্লাহ ইবনে উবাই ছিলো খাজরাজদের নেতা। মক্কার কুরাইশরা আবদুল্লাহকে হুমকিপূর্ণ একটি চিঠি লিখলো। সেই সময় মদিনায় আবদুল্লাহর যথেষ্ট প্রভাব ছিলো। এমনও হওয়ার সম্ভাবনা ছিল যে, নবী সা. যদি মদিনায় না যেতেন, তবে ইয়াসরিববাসীরা তাকে তাদের বাদশাহ হিসাবে গ্রহণ করতো।
মক্কার মুশরিকরা তাদের চিঠিতে আবদুল্লাহ ইবনে উবাইকে লিখলো যে, আপনারা আমাদের বিধর্মী লোককে আশ্রয় দিয়েছেন। তাই আমরা কসম খেয়ে বলছি যে, হয়তো আপনারা তার সাথে লড়াই করুন অথবা তাকে ইয়াসরিব থেকে বের করে দিন। যদি না করেন তবে আমরা সর্বশক্তিতে আপনাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে যোদ্ধা পুরুষদের হত্যা এবং আপনাদের মহিলাদের দাসী বানাবো।
এই চিঠি পাওয়ার পরই আবদুল্লাহ ইবনে উবাই মক্কার মুশরিকদের নির্দেশ পালনের জন্যে প্রস্তুত হলো। নবী সা.-এর বিরুদ্ধে আবদুল্লাহ ইবনে উবাইয়ের মনে আগে থেকেই প্রবল ঘৃণার সৃষ্টি হয়েছিলো। কেননা তার মনে এ ধারণা বৃদ্ধমূল হয়েছিলো যে, তিনি ইয়াসরিবের রাজমুকুট তার কাছ থেকে কেড়ে নিয়েছেন। এছাড়াও তার গোত্রের লোকেরা কখনোই তার সাথে পরামর্শ করা ছাড়া কোনো সিদ্ধান্ত নেয়নি। অথচ তারা মুহাম্মদ সা.-এর কাছে বাইয়াত নিয়ে মদিনা রাষ্ট্র পর্যন্ত করে ফেলেছে অথচ তার সাথে পরামর্শ করে নি। এগুলো তার মনে ক্ষোভের সঞ্চার করেছে।
মক্কার মুশরিকদের চিঠি পাওয়ার পরপরই আবদুল্লাহ ইবনে উবাই এবং মদিনার মুশরিকরা রাসূল সা.-এর সাথে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হলো এবং তারা সমাবেশ করছিলো। সেখানে মদিনার বিপদ নিয়ে আব্দুল্লাহ বক্তব্য দিচ্ছিল। নবী সা. এ খবর পেয়ে দ্রুত দলবল নিয়ে আবদুল্লাহর সমাবেশে গেলেন। সেখানে তিনি তাঁর বক্তব্যে বললেন, তোমরা কুরাইশদের হুমকিতে যথেষ্ঠ প্রভাবিত হয়েছো মনে হচ্ছে। শোনো! তোমরা নিজেরা নিজেদের যতো ক্ষতি করতে উদ্যত হয়েছো, মক্কার কুরাইশরা তার চেয়ে বেশি ক্ষতি করতে পারবে না। তোমরা কি নিজেদের সন্তান এবং ভাইয়ের সাথে নিজেরাই যুদ্ধ করতে চাও? নবী সা. এর বক্তব্যের পর যুদ্ধের জন্যে প্রস্তুত আবদুল্লাহর অনুসারীরা ছত্রভঙ্গ হয়ে গেলো।
সমর্থক ও সহযোগিরা ছত্রবঙ্গ হওয়ায় আবদুল্লাহ ইবনে উবাই তখনকার মতো যুদ্ধ থেকে বিরত হলো। কিন্তু কুরাইশদের সঙ্গে যোগাযোগ অব্যাহত ছিলো। কেননা এই দুর্বৃত্ত মুসলমান ও কাফেরদের সাথে সংঘাতের কোন ক্ষেত্রেই নিজের জড়িত হওয়ার সুযোগকে হাতছাড়া করেনি। উপরন্তু মুসলমানদের বিরোধিতার শক্তি অর্জনের জন্যে ইহুদীদের সাথেও সে যোগাযোগ রক্ষা করতো যেন, প্রয়োজনের সময় ইহুদীরা তাকে সাহায্য করে। কিন্তু নবী সা. কৌশলে সবসময় তাকে কন্ট্রোল করেছিলেন।
মুসলমানদের জন্যে মসজিদে হারাম বন্ধ ঘোষণা
আবু জাহল নতুন রাষ্ট্রের ব্যাপারে মক্কা ও মক্কার আশে পাশের সব আরব গোত্রগুলোর সাথে যোগাযোগ করলো। তারা সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নিলো মদিনাবাসীর জন্য কা'বাকে নিষিদ্ধ করা হলো। মুসলিমদেরকে ধর্মদ্রোহী ও মুরতাদ হিসেবে ঘোষণা দেওয়া হলো। উল্লেখ্য যে, কা'বায় তখন খ্রিস্টান, ইহুদি ও বিভিন্ন প্রকার পূজারীদের জন্য উন্মুক্ত ছিল। শুধু মুসলিমদের মুরতাদ আখ্যা দিয়ে হজ্ব ও কা'বা তাওয়াফ থেকে মাহরুম করা হয়েছিলো।
যেহেতু মুরতাদ হিসেবে মদিনাবাসীদের আখ্যা দেওয়া হয়েছে। তাই মুরতাদদের দমনে সকল গোষ্ঠীকে এক করার চেষ্টাও করে যাচ্ছিল আবু জাহল। তার এই প্রচেষ্টায় সে মদিনার মুশরিক ও মদিনার ইহুদিদেরও ইনক্লুড করা চেষ্টা করেছিল। তার চেষ্টা সফল হয়েছিল। যেহেতু এই দুই গোষ্ঠী মুহাম্মদ সা.-সাথে মদিনা সনদের চুক্তিতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ছিল তাই তারা গোপনে আবু জাহলদের সাহায্য করতো। আর চূড়ান্ত যুদ্ধ হলে তারা ভেতরে থেকেই মদিনার ইসলামী রাষ্ট্রের ক্ষতি করার সিদ্ধান্ত নিল।
মুসলিমদের প্রতি সরাসরি হুমকি
মক্কার মুশরিকরা মুহাম্মদ সা.-কে খবর পাঠালো যে, তোমরা মনে করো না যে, মক্কা থেকে গিয়ে নিরাপদে থাকবে। বরং মদীনায় পৌঁছে আমরা তোমাদের সর্বনাশ করে ছাড়বো। এটা শুধু হুমকি ছিলো না। রাসূল সা. নানান সূত্রে মুশরিকদের যাবতীয় ষড়যন্ত্র সম্পর্কে অবহিত হন। ফলে তিনি কখনো সারারাত জেগে কাটাতেন, আবার কখনো সাহাবায়ে কেরামের প্রহরাধীনে রাত্রি যাপন করতেন।
এই প্রসঙ্গে আয়িশা রা. বলেন, মদীনা আসার পর এক সন্ধ্যায় নবী সা. বললেন, ভালো হতো যদি আমার সাহাবাদের মধ্যে কোনো বিশ্বস্ত সাহাবি আমার এখানে পাহারা দিতো। একথা বলার সাথে সাথে অস্ত্রের শব্দ শোনা গেলো। নবী সা. জিজ্ঞাসা করলেন, কে ওখানে? জবাব এলো সা’দ ইবনে আবি ওয়াক্কাস। বললেন, কি জন্য এসেছো? তিনি বললেন, হে আল্লাহ রাসূল! আপনার নিরাপত্তা প্রশ্নে আমার মনে হঠাৎ একটা সংশয়ের উদ্রেক হওয়ায় আমি আপনাকে পাহারা দিতে এসেছি। একথা শুনে রাসূল সা. তার জন্যে দোয়া করে শুয়ে পড়লেন।
মা আয়িশা রা. আরো বলেন, পাহারার ব্যবস্থা বিশেষ কয়েকটি রাতের জন্যে নির্দিষ্ট ছিলো না। বরং অব্যাহতভাবেই তা রাখা হয়েছিলো। অতঃপর পবিত্র কোরআনের এই আয়াত নাযিল হলো- ‘আল্লাহ তায়ালা তোমাকে মানুষদের থেকে হেফাজত রাখবেন।’ এই আয়াত নাযিল হওয়ার পর নবী সা. জানালায় মাথা বের করে বললেন, ‘হে লোকেরা তোমরা ফিরে যাও, আল্লাহ তায়ালা আমাকে নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দিয়েছেন।’
নিরাপত্তাহীনতার আশঙ্কা শুধুমাত্র রাসূল সা. পর্যন্ত সীমাব্দ্ধ ছিলো না। সকল মুসলমানের ক্ষেত্রেই ছিলো এটা প্রযোজ্য ছিলো। হযরত উবাই ইবনে কা’ব রা. বলেন, নবী সা. এবং তাঁর সাহাবারা মদিনায় আসার পর আনসাররা তাদের আশ্রয় প্রদান করেন। এতে সমগ্র আরব তাদের বিরুদ্ধে ক্ষেপে যায়। ফলে মদিনার আনসাররা অস্ত্র ছাড়া রাত্রি যাপন করতেন না এবং সকালেও তাদের কাছে সবসময় অস্ত্র থাকতো।
এমন একটি পরিস্থিতি তৈরি হলো, মুসলিমরা নিরাপদ আশ্রয়ে এসেও আতংকে দিন কাটাতে লাগলো। সারাক্ষণ একটি আতংক মুসলিমদের স্বাভাবিক কাজের বাধা হয়ে দাঁড়ালো। মদিনার মুসলমানদের অস্তিত্বের জন্যে অমুসলিমদের পক্ষ থেকে নিরাপত্তাহীনতা ছিলো বিশেষ হুমকি। অন্য কথায় বলা যায় যে, এটা ছিলো তাদের টিকে থাকা না থাকার জন্যে বিরাট চ্যালেঞ্জ। এর ফলে মুসলমানরা স্পষ্টভাবে বুঝে ফেলেছিলেন যে, কুরায়শরা মুসলমানদের ক্ষতি করার জন্যে সংকল্প থেকে বিরত হবে না।
সশস্ত্র প্রতিরোধ তথা যুদ্ধের অনুমতি
মক্কায় থাকাকালীন ১৩ বছরে আল্লাহর রাসূল বহু নির্যাতনের মুখোমুখি হয়েছেন। সাহাবাদের কঠিন ও ভয়াবহ নির্যাতন করা হয়েছে। কয়েকজনকে শহীদ করা হয়েছে। শারিরীক আঘাত নিত্য নৈমিত্তিক ব্যাপার ছিল। এই আঘাত থেকে বাঁচতে পারেন নি স্বয়ং মুহাম্মদ সা.। সব সাহাবীই কোনো না কোনো শারিরীক নির্যাতনের মুখোমুখি হয়েছেন। এরপর তিন বছর মুসলিমদের শিয়াবে আবু তালিবে অবরুদ্ধ করে রাখা হয়েছে। খাদ্য ও পানীয়ের অভাবে জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছিলো।
সাহাবারা নির্যাতিত হয়ে মুহাম্মদ সা.-এর কাছে এসে বলতেন, ইয়া রাসূলুল্লাহ! আপনি কি আমাদের জন্য কিছুই করবেন না? আমরা তো বড় অসহায় হয়ে যাচ্ছি। আল্লাহর রাসূল সেসময় ধৈর্য ধরার উপদেশ দিতেন, পূর্বেকার নবীদের নির্যাতনের কথা স্মরণ করিয়ে দিতেন। আল্লাহর সাহায্যের আশ্বাস দিতেন। হজরত ওমর রা. ইসলাম গ্রহণ করার পর দাওয়াতী কাজ ও অন্যান্য কর্মকাণ্ড প্রকাশ্যে শুরু করলেও নির্যাতনের বিরুদ্ধে কোনো সশস্ত্র প্রতিরোধ করা হয় নি। আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা এর অনুমতি দেননি।
এর কারণ ছিল আল্লাহর রাসূলের কোনো রাষ্ট্র ছিল না। কোনো একটি গোষ্ঠীর নেতৃত্ব তার কাছে ছিল না। কোনো নিরাপদ এলাকা ছিল না। এমতাবস্থায় সশস্ত্র প্রতিরোধ মানে বিশৃঙ্খলা তৈরি করা, যে ক'জন মুমিন আছেন তাদের নিশ্চিহ্ন হওয়ার ঝুঁকি তৈরি হওয়া। এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যা ইসলামী আন্দোলনের কর্মীদের জানা অপরিহার্য। অস্ত্র কখন হাতে তোলা যাবে তার একটা গাইডলাইন সীরাতে রয়েছে। আল্লাহর রাসূল তাঁর মাক্কী জীবনে নির্যাতনে পর নির্যাতন সহ্য করেছেন কিন্তু কখনোই পাল্টা প্রতিরোধ করেননি।
যখন মদিনায় ইসলামী স্টেট কায়েম হলো তখন আর এই যুক্তি থাকলো না। তদুপরি মুসলমানদের বিরুদ্ধে মুশরিকদের পক্ষ থেকে বার বার নিরাপত্তাহীনতার হুমকি আসছিলো। ফলে নিরাপত্তাহীনতা তৈরি হয়েছে। এই প্রেক্ষিতে আল্লাহ তায়ালা মুসলমানদের যুদ্ধ করার অনুমতি দিলেন। সূরা হজ্বের ৩৯ নং আয়াতে আল্লাহ বলেন, //যুদ্ধের অনুমতি দেওয়া হল তাদেরকে, যাদেরকে আক্রমণ করা হচ্ছে। কারণ তাদের ওপর নির্যাতন করা হয়েছে। নিশ্চয় আল্লাহ তাদেরকে বিজয় দানে সক্ষম।//
যুদ্ধের অনুমতি পাওয়ার পর মুসলিমরা অত্যন্ত খুশি হলো। এতোদিনের একতরফা আক্রমণের অবসান হলো। আর এই অবসানের কারণ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা। এর দ্বারা বুঝা যায় 'ইকামাতে দ্বীন' অর্থাৎ যে কাজের জন্য মুহাম্মদ সা.-কে আল্লাহ তায়ালা দুনিয়ায় নিযুক্ত করেছেন, সেই ইকামাতে দ্বীনের জন্য রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা অপরিহার্য। রাষ্ট্র ছাড়া দ্বীন বা ইসলাম পূর্ণাঙ্গ হয় না।
এরপর যুদ্ধ করার গ্রাউন্ড হিসেবে আল্লাহ তায়ালা পরবর্তী আয়াতে বলেন, //যাদেরকে তাদের নিজ বাড়ী-ঘর থেকে অন্যায়ভাবে শুধু এ কারণে বের করে দেয়া হয়েছে যে, তারা বলে, ‘আমাদের রব আল্লাহ’। আর আল্লাহ যদি মানবজাতির একদলকে অপর দল দ্বারা দমন না করতেন, তবে বিধস্ত হয়ে যেত খৃস্টান সন্ন্যাসীদের আশ্রম, গির্জা, ইয়াহূদীদের উপাসনালয় ও মসজিদসমূহ- যেখানে আল্লাহর নাম অধিক স্মরণ করা হয়। আর আল্লাহ অবশ্যই তাকে সাহায্য করেন, যে তাকে সাহায্য করে। নিশ্চয় আল্লাহ শক্তিমান, পরাক্রমশালী।//
এখানে আল্লাহ তায়ালা ঘোষণা দিয়েছেন, তিনি মাঝে মাঝে ছাড় দেন তবে তাঁর নাম ঘোষণার স্থানসমূহকে অটুট রাখতে তিনি ইসলামপন্থীদের সাহায্য করবেন ও বিজয় দিবেন। যারা আল্লাহর পক্ষ হয়ে কাজ করে অর্থাৎ আল্লাহর বিধিবিধান বাস্তবায়নে সাহায্য করে আল্লাহ অবশ্যই তাদের সাহায্য করবেন। এরপর আল্লাহ সাহায্য করে ইসলামপন্থীদের যদি বিজয় দান করেন তবে তাদের বেসিক কাজ কী হবে তার নির্দেশনা পরবর্তী আয়াতে ঘোষণা করেন।
আল্লাহ তায়ালা সূরা হজ্বের ৪১ নং আয়াতে বলেন, //এরা এমন সব লোক যাদেরকে আমি যদি পৃথিবীতে কর্তৃত্ব দান করি তাহলে এরা নামায কায়েম করবে, যাকাত দেবে, ভালো কাজের আদেশ দেবে এবং খারাপ কাজে নিষেধ করবে। আর সমস্ত বিষয়ের পরিণাম আল্লাহর হাতে।// মহান প্রভু এখানে ইসলামী রাষ্ট্রের ৪ দফা কাজের কথা উল্লেখ করেছেন।
আল্লাহর পক্ষ থেকে যুদ্ধের অনুমতি পেয়ে আতংকে থাকা মুসলিমরা ডিফেন্সিভ কৌশল থেকে বের হয়ে এসে অফেনসিভ কৌশল গ্রহণ করলো। মুসলিমরা দেখলো মক্কার মুশরিকরা ভৌগলিকভাবে ভালো অবস্থানে আছে। এ কারণে মুহাম্মদ সা. শুরার সাথে আলোচনা করে কিছু প্রতিরক্ষা বিষয়ক সিদ্ধান্ত নিলেন ও বাস্তবায়ন করলেন।
১- মুসলমানরা নিজেদের নিয়ন্ত্রনের সীমানা অর্থাৎ মদিনার সীমানা বৃদ্ধি করলেন। বৃদ্ধি করে মক্কা থেকে সিরিয়ার মধ্যবর্তী পথকে মদিনার অন্তর্ভুক্ত করে নিলেন।
২- ১ম সিদ্ধান্তকে বাস্তবায়ন করার জন্য মক্কা থেকে সিরিয়া ও মদিনার যাতায়াতকারী বাণিজ্য কাফেলার পথের পাশে যেসব গোত্র রয়েছে তাদের সাথে মৈত্রী চুক্তি করলেন।
৩- মক্কা থেকে সিরিয়ার যাওয়ার মহাসড়কে টহলদানকারী কাফেলা প্রেরণ।
৪- কুরাইশদের ও আরবের বিভিন্ন গোত্রের গতিবিধি ও তথ্য জানার জন্য গোয়েন্দা নিয়োগ।
প্রথম পরিকল্পনার আলোকে একথা গুরুত্বপূর্ণ যে, ইতিপূর্বে ইহুদীদের সাথে সম্পাদিত যে সকল চুক্তির কথা তুলে ধরা হয়েছে, তার মধ্যে উল্লেখ রয়েছে যে, অনুরূপ একটি অনাক্রমণ চুক্তি জুহাইনা গোত্রের সাথেও সম্পাদিত হয়। এ গোত্র মদীনা থেকে তিন মনযিল অর্থাৎ ৫১ মাইল দূরে বাস করতো। এছাড়া আরো কয়েকটি গোত্রের সাথেও নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম চুক্তি সম্পাদন করেছিলেন।
পরিকল্পনার বাস্তবায়নের জন্যে মুসলমানদের পর্যায়ক্রমিক অভিযান শুরু হয়। অস্ত্র সজ্জিত কাফেলা টহল দিতে থাকে। এর উদ্দেশ্য ছিলো
১. মদীনার আশপাশের রাস্তায় সাধারণভাবে এবং মক্কার আশপাশের রাস্তায় বিশেষভাবে লক্ষ্য রেখে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করা
২. মদিনার মুশরিক, ইহুদী এবং আশেপাশের বেদুইনদের মনে এ বিশ্বাস স্থাপন করানো যে, বর্তমানে মুসলমানেরা যথেষ্ট শক্তিশালী । অতীতের দুর্বলতা ও শক্তিহীনতা তারা কাটিয়ে উঠেছে।
৩. মক্কার মুশরিকদের ঔদ্ধত্বপূর্ণ সাহসিকতা সম্পর্কে তাদের ভীত করে দেওয়া। তাদের বুঝিয়ে দেওয়া যে, তারা যেসব চিন্তা এবং ক্রোধ প্রকাশ করেছে, তার পরিণাম হবে ভয়াবহ।
৪. মক্কার ব্যবসায়ের পথ বন্ধ করে দিয়ে মুশরিকদের সমঝোতায় নত হতে বাধ্য করা।
পরিকল্পনা অনুযায়ী আল্লাহর রাসূল সা. অনেকগুলো সারিয়্যা ও গাজওয়া পরিচালনা করেন। সীরাতের পরিভাষায় সারিয়্যা হলো সেসব সামরিক অভিযান যেগুলোতে রাসূল সা. উপস্থিত ছিলেন না। আর গাজওয়া হলো যেসব সামরিক অভিযান আল্লাহর রাসূল সা. নিজে পরিচালনা করেছেন। এসব অভিযান পরিচালনার উদ্দেশ্য ছিল মক্কার বাণিজ্যিক যাত্রা বন্ধ করে দেওয়া। এসব অভিযানের ফলে মক্কার লোকদের সিরায়া ও ইরাকে যাওয়া প্রচণ্ড নিরাপত্তা হুমকিতে গেছে।
১. সারিয়্যা সিফুল বাহার
সিফুল বাহার মানে সমুদ্র সৈকত। সমুদ্রের পাশে রাগিব প্রান্তরে মুসলিম ও মুশরিক বাহিনী মুখোমুখি হয়। মক্কার আবু সুফিয়ানের নেতৃত্বে একটি কাফেলা মূল রাস্তা বাদ দিয়ে সমুদ্রের পাশ ঘেঁষে যাত্রা শুরু করেছিল। খবর পেয়ে রাসূল সা. হামজা রা.কে প্রধান করে একটি বাহিনী পাঠিয়েছেন। রাগিব প্রান্তরে উভয়পক্ষ মুখোমুখি হয়। আবু সুফিয়ানের কাফেলা বাধা পেয়ে ফিরে যায়। এখানে শুধু তীর বিনিময় ছাড়া আর কিছু হয়। উল্লেখযোগ্য অর্জন হলো মিকদাদ ও উতবা নামে দুজন সাহাবী মুশরিকদের কাফেলার সাথে এসেছিল। তারা মক্কা থেকে মদিনায় হিজরত করতে সক্ষম হয়নি। তাই ব্যবসায়ের বাহানা করে কাফেলায় যোগ দিয়েছে। মুসলিমদের পেয়ে তাদের সাথে যোগ দিয়েছে। যেহেতু এখানে হামজা রা. ছিলেন তাই আবু সুফিয়ান তাদের ফেরাতে সাহস করেনি।
২. সারিয়্যা খাররার
মুশরিকদের আরেকটি বাণিজ্য কাফেলার সন্ধান পেয়ে রাসূল সা. সা’দ ইবনে আবি ওয়াক্কাসকে এর আমীর নিযুক্ত করে একটি বাহিনী খাররারের উদ্দেশ্যে প্রেরণ করেন। তাঁকে বিশজন সেনা দেওয়া হয়। তাঁরা ঐ কাফেলা ধরতে সক্ষম হন নি। তার আগেই তারা খাররার অতিক্রম করতে সক্ষম হয়েছিল। এই অভিযানে মুসলিম বাহিনী পতাকা প্রদর্শন করেছিলো। পতাকার রঙ ছিল সাদা। আর বহন করেছিলেন আগের অভিযানের অর্জন মিকদাদ ইবনে আমর রা.। এরপর থেকে প্রতিটি অভিযানের সাদা পতাকা বহন করা হয়।
৩. গাজওয়ায়ে আবওয়া
এই অভিযান আল্লাহর রাসূল সা.-এর নেতৃত্বে ১ম সামরিক অভিযান। উদ্দেশ্য একই, মুশরিকদের বাণিজ্য কাফেলা রুখে দেওয়া। আবওয়া সমুদ্রের কাছে একটি স্থান। ৭০ জনের বাহিনী নিয়ে নবী সা. এই অভিযান পরিচালনা করেছেন। এই সময় মদিনায় অস্থায়ী দায়িত্বশীল হিসেবে সা'দ বিন উবাদা রা.-কে নিযুক্ত করেন। মুশরিকদের বাণিজ্য কাফেলা রাসূল সা.-এর মুখোমুখি হতে সাহস করেনি। এই অভিযানের বাড়তি অর্জন হলো রাসূল সা. স্থানীয় গোত্র বনু জামরার সাথে মৈত্রি চুক্তি করেন। রাসূল সা. পনের দিন সেখানে থাকার পর মদিনায় ফিরে আসেন।
৪. গাজওয়ায়ে বুয়াত
একটি বড় বাণিজ্য কাফেলাকে ধরার জন্য এই অভিযান পরিচালনা করা হয়। মুশরিকদের নেতৃত্বে ছিল উমাইয়া ইবনে খালফ। রাসূল সা. দুইশত সাহাবা নিয়ে এই অভিযান পরিচালনা করেন। এবারো মুশরিকরা ফিরে যায়। এই অভিযানের সময় মদিনায় অস্থায়ী আমীর নিযুক্ত করা হয় সা'দ বিন মুয়াজ রা.-কে।
৫. গাজওয়ায়ে সাফওয়ান
এই অভিযানের কারণ ছিলো, কারজ ইবনে জাবির নামে এক মুশরিকের নেতৃত্বে একদল লোক মদীনার চারণভূমিতে হামলা করে কয়েকটি গবাদি পশু অপহরণ করে। রাসূল সা. সত্তরজন সাহাবাকে সঙ্গে নিয়ে লুটেরাদের ধাওয়া করেন। কিন্তু কারজ এবং তার সঙ্গীদের পাওয়া যায়নি। কোনো প্রকার সংঘাত ছাড়াই তারা ফিরে আসেন। এই অভিযানের সময় মদিনার আমীর হিসেবে যায়েদ বিন হারেসা রা.-কে নিযুক্ত করা হয়েছিলো।
৬. গাজওয়ায়ে যুল উশাইরা
এই অভিযানে রাসূল সা.-এর সাথে দেড় শতাধিক সাহাবা ছিলেন। মক্কা থেকে সিরিয়া অভিমুখে রওয়ানা হয়ে গেছে মুশরিকদের একটি কাফেলা। এই খবর পেয়ে ঐ কাফেলাকে ধাওয়া করতে এ অভিযান চালানো হয়। এই কাফেলায় কুরাইশদের প্রচুর মালামাল ছিলো। নবী সা. এই কাফেলাকে ধাওয়া করতে যুল উশাইরা নামক জায়গা পর্যন্ত পৌ্ছেন। কিন্তু কয়েকদিন আগেই কাফেলা চলে গিয়েছিলো। ঐ কাফেলার নেতৃত্বে ছিল আবু সুফিয়ান। এই কাফেলাই সিরিয়া থেকে ফেরার সময় নবী সা. তাদের গ্রেফতার করার চেষ্টা চালান। কিন্তু তারা মক্কায় পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়। এই ঘটনার জের হিসাবে পরবর্তীকালে বদরের যুদ্ধ সংঘটিত হয়।
৭. সারিয়্যা নাখলা
এই অভিযানে রাসূল সা. আবদুল্লাহ ইবনে জাহাশ রা.-কে প্রধান করে বারোজন মুহাজিরের একটি দল প্রেরণ করেন নাখলায়। তারা সেখানে একটি বাণিজ্য কাফেলাকে পেলেন। সেদিন ছিল রজব মাসের শেষ দিন। আরব রীতি অনুসারে রজব মাসে যুদ্ধ নিষিদ্ধ থাকে। কিন্তু আব্দুল্লাহ বিন জাহাশ কাফেলা ঠেকাতে আর অপেক্ষা করেন নি। তিনি হামলা চালান। এতে আমর ইবনে হাদরামি মারা যায়। দুইজন মুশরিককে আটক করেন। কাফেলার সম্পদ অধিকার করেন।
অতঃপর সাহাবারা উভয় বন্দী এবং জিনিসপত্র নিয়ে মদিনায় হাজির হন। এটা ছিলো ইসলামের ইতিহাসে প্রথম গণিমতের মাল, প্রথম নিহত এবং প্রথম বন্দী। রাসূল সা. সব কথা শোনার পর বললেন, আমি তো তোমাদেরকে নিষিদ্ধ মাসে যুদ্ধ করতে বলিনি। এই ঘটনায় অমুসলিমরা এ প্রোপাগান্ডার সুযোগ পায় যে, মুসলমানরা আল্লাহর হারাম করা মাসকে হালাল করে নিয়েছে। এ নিয়ে নানারকম অপপ্রচার চালানো হয়। রাসূল সা. দ্বিধায় পড়ে যান। তাই তিনি বন্দী ও গনিমত রিসিভ করেন নি। রাজনৈতিকভাবে বেকায়দায় পড়ে যান। অবশেষে আল্লাহ তায়ালা আয়াত নাযিল করে এই সমস্যার সমাধান করে দেন।
আল্লাহ তায়ালা সূরা বাকারার ২১৭ নং আয়াতে বলেন, //পবিত্র মাসে যুদ্ধ করা সম্পর্কে লোকে তোমাকে জিজ্ঞাসা করে। বলো, তাতে যুদ্ধ করা ভীষন অন্যায়। কিন্তু আল্লাহর পথে বাধা দান করা, আল্লাহকে অস্বীকার করা, মসজিদুল হারামে বাধা দেয়া এবং তার বাসিন্দাকে তা থেকে বহিস্কার করা আল্লাহর কাছে তদপেক্ষা বড় অন্যায়। ফেতনা হত্যা অপেক্ষা ভীষন অন্যায়।//
এই আয়াতের মাধ্যমে আল্লাহ তায়ালা মুসলিমদের হীনমন্য ও দ্বিধান্বিত হতে নিষেধ করেছেন এবং মুশরিকদের অভিযোগ পাত্তা না দিয়ে উড়িয়ে দিয়েছেন। অবশেষে রাসূল সা. আল্লাহর শেখানো মোক্ষম জবাব দিয়ে মুশরিকদের মুখ বন্ধ করে দেন। হারাম মাসের সম্মানে তিনি বন্দিদের ছেড়ে দেন ও নিহতের জন্য রক্তপণ দেন। তবে যুদ্ধলব্ধ সম্পদ গ্রহণ করেন।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন