মুহাম্মদ সা. ছিলেন অনন্য রাষ্ট্রনায়ক। তাঁর প্রতিষ্ঠিত ক্ষুদ্র ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠাকালীন থেকেই হুমকির মুখে পড়েছে। নানানভাবে মক্কার মুশরিকরা এই রাষ্ট্রকে ধ্বংস করার জন্য রাষ্ট্রের ভেতর ও বাইরের বিভিন্ন গোষ্ঠীকে সাথে নিয়ে ষড়যন্ত্র শুরু করেছিল। এক পর্যায়ে মুসলিমরা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগতে থাকে। আল্লাহ তায়ালা এই সময় মুসলিমদের সশস্ত্র প্রতিরোধের অনুমতি দেন। এর প্রেক্ষিতে মুহাম্মদ সা. অফেনসিভ ভূমিকা গ্রহণ করেন।
তিনি মক্কার মুশরিকদের থেকে মদিনাকে হিফাজত করার জন্য মক্কাকে সমস্যার মধ্যে ফেলে দেন। তিনি তাদের ব্যবসায়িক পথ অবরুদ্ধ করেন। সারা আরবে গোয়েন্দা জাল বিস্তার করেন। এমন সময়ে আবু সুফিয়ানের নেতৃত্বে একটি বাণিজ্যিক কাফেলা সিরিয়ার উদ্দেশ্যে গোপনে রওয়ানা হলে তিনি প্রায় দেড় শতাধিক সৈন্য নিয়ে ধাওয়া দেন। তবে কৌশলী আবু সুফিয়ান ও তার কাফেলা সে যাত্রা বেঁচে যায়। সে রাস্তা পরিবর্তন করে মদিনার আশ পাশের এলাকা দ্রুত পাড়ি দেয়। মুহাম্মদ সা. সে কাফেলার জন্য গোয়েন্দা তৎপরতা অব্যাহত রাখেন।
এরপর মুহাম্মদ সা. খবর পেলেন তারা সিরিয়া থেকে মক্কার দিকে রওনা হচ্ছে। তাদের আটকানোর সিদ্ধান্ত নিলেন মুহাম্মদ সা.। এরকম একটি বড় কাফেলা আটকাতে পারলে মক্কার মুশরিকরা নমনীয় হবে এবং তাদের ব্যবসায়ের পথ বিপদমুক্ত রাখতে তারা সচেষ্ট হবে। মুহাম্মদ সা. ভেবেছিলেন এর ফলে তারা মদিনা রাষ্ট্রের সাথে সহবস্থানে বিশ্বাসী হবে।
মহাম্মদ সা. তাঁর সাহাবীদেরকে এই কাফেলায় আক্রমণের জন্য আহ্বান জানান। তবে তিনি ভাবেননি তিনি একটি বড় যুদ্ধের মুখোমুখি হতে যাচ্ছেন। তাই তিনি কাউকে নির্দিষ্ট করে দেননি। যার যার ইচ্ছেনুযায়ী মুহাম্মদ সা.-এর সাথে অভিযানে শরিক হয়েছিল। মুহাম্মদ সা. এতে সকলের অংশগ্রহণ জরুরি বলে উল্লেখ করেননি। ফলে অনেক মুসলিম মদিনায় থেকে যায়। গোয়েন্দা তথ্যানুযায়ী ধারণা করা হয় আবু সুফিয়ান বদর প্রান্তর দিয়ে যাবে। তাই মুহাম্মদ সা. বদরের দিকে অগ্রসর হন। আব্দুল্লাহ ইবনে উম্মে মাকতুমকে এই সময় মদিনার অস্থায়ী আমীর নিযুক্ত করা হয়।
মুহাম্মাদ সা.-এর সাথে মুসলিম বাহিনীতে ছিলেন আবু বকর, উমর ইবনুল খাত্তাব, আলি ইবনে আবি তালিব, হামজা ইবনে আবদুল মুত্তালিব, মুসআব ইবনে উমাইর, যুবাইর ইবনুল আওয়াম, আম্মার ইবনে ইয়াসির ও আবু যার আল-গিফারী। স্ত্রীর অসুস্থতার কারণে উসমান ইবনে আফফান যুদ্ধে যেতে পারেননি। বাহিনীতে সৈন্য সংখ্যা ছিল ৩১৩ জন। এর মধ্যে মুহাজির ছিলেন ৮২ জন এবং আনসারদের মধ্যে আওস গোত্রের ছিলেন ৬১জন ও খাজরাজ গোত্রের ছিলেন ১৭০ জন। মুসলিমদের সাথে ৭০টি উট ও দুইটি ঘোড়া ছিল। ফলে তাদের সামনে পায়ে হেঁটে যাওয়া বা প্রতি দুই বা তিনজনের জন্য একটি উট ব্যবহার ছাড়া উপায় ছিল না। একটি উটে পালাক্রমে দুই বা তিনজন আরোহণ করতেন। এই ব্যবস্থায় মুহাম্মাদ সা., আলী রা. ও মারসাদ রা. এই তিনজনের জন্য একটি উট বরাদ্দ হয়েছিল।
মুহাম্মাদ সা. সার্বিক নেতৃত্বের জন্য মুসআব ইবনে উমাইরকে একটি সাদা পতাকা প্রদান করেন। মুহাজিরদের ও আনসারদের জন্য একটি করে কালো পতাকা যথাক্রমে আলি ইবনে আবি তালিব এবং সাদ ইবনে মুয়াজকে প্রদান করা হয়। বাহিনীর ডান ও বাম অংশের প্রধান হিসেবে যথাক্রমে যুবাইর ইবনুল আওয়াম রা. ও মিকদাদ ইবনে আমর রা.-কে নিযুক্ত করা হয়। মুসলিম বাহিনীতে থাকা দুইটি ঘোড়ায় তারা আরোহণ করেছিলেন। পেছনের অংশের প্রধান হিসেবে কাইস ইবনে আবিকে নিয়োগ দেয়া হয়। মুহাম্মাদ সা. সমগ্র বাহিনীর প্রধান হিসেবে দায়িত্ব নেন।
এদিকে আবু সুফিয়ানও বেশ সতর্কতার সাথে পথ অতিক্রম করছিল। সেও তার পদ্ধতিতে মুসলিমদের ব্যাপারে খবর নিচ্ছিলো। ফলে সে মুসলিমদের আক্রমণের খবর পায়। তাই সাহায্য চেয়ে জমজম ইবনে আমর গিফারিকে বার্তা বাহক হিসেবে মক্কা পাঠায়। সে দ্রুত মক্কা পৌঁছায় এবং তৎকালীন আরব রীতি অনুযায়ী উটের নাক চাপড়ায়, আসন উল্টিয়ে দেয়, নিজের জামা ছিড়ে ফেলে এবং উটে বসে ঘোষণা করে যে মক্কার কাফেলা মুসলিমদের হাতে পড়তে যাচ্ছে।
এই খবর শোনার পর মক্কায় আলোড়ন শুরু হয়। দ্রুত ১,৩০০ সৈনিকের এক বাহিনী গড়ে তোলা হয় এবং আবু জাহল বাহিনীর প্রধান হন। এই বাহিনীতে অসংখ্য উট, ১০০ ঘোড়া ও ৬০০ লৌহবর্ম ছিল। নয়জন সম্ভ্রান্ত কুরাইশ রসদ সরবরাহের দায়িত্ব নেন। বাহিনীর জন্য দৈনিক কখনো ৯টি এবং কখনো ১০টি উট জবাই করা হত।
আবু জাহল, উতবা ইবনে রাবিয়া, শাইবা ইবনে রাবিয়া, আবুল বাখতারি ইবনে হিশাম, হাকিম ইবনে হিজাম, নওফেল ইবনে খুয়াইলিদ, হারিস ইবনে আমির, তুয়াইমা ইবনে আদি, নাদার ইবনে হারিস, জামআ ইবনে আসওয়াদ ও উমাইয়া ইবনে খালাফসহ মক্কার অনেক অভিজাত ব্যক্তি মক্কার বাহিনীতে যোগ দেন। এর কয়েকটি কারণ ছিল। কেউ কাফেলায় নিজেদের সম্পদ রক্ষা করতে চেয়েছিলেন। অন্যরা ইবনে আল-হাদরামির মৃত্যুর বদলা নিতে চেয়েছিলেন। এছাড়া মুসলিমদের বিরুদ্ধে সহজে জয়ী হওয়া যাবে এই বিশ্বাসেও কেউ কেউ যোগ দেয়। আবু লাহাব নিজে যুদ্ধে অংশ না নিয়ে তার কাছে ৪,০০০ দিরহাম ঋণগ্রস্থ আসি ইবনে হিশাম ইবনে মুগিরাকে ঋণের বিনিময়ে পাঠায়। উমাইয়া ইবনে খালাফ প্রথমে যুদ্ধে অংশ না নেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। এসময় উকবা ইবনে আবু মুয়াইত তাকে নারী হিসেবে সম্বোধন করে। এর ফলে উমাইয়া ইবনে খালাফ লজ্জিত হয়ে যুদ্ধের প্রস্তুতি শুরু করে। তবে কুরাইশদের মধ্যে বনু আদি গোত্রের (উমার রা.-এর গোত্র) কেউ এই যুদ্ধে অংশ নেয় নি।
অন্যদিকে আবু সুফিয়ান ক্রমাগত খবরাখবর সংগ্রহ করছিলো। বদরের নিকটে পৌঁছার পর মাজদি ইবনে আমর নামক এক ব্যক্তির সাথে তার সাক্ষাত হয়। তাকে তিনি মদিনার বাহিনী সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলে মাজদি স্পষ্ট কিছু বলতে পারেননি। তবে জানান যে দুইজন উষ্ট্রারোহীকে তিনি টিলার পাশে উট বসিয়ে মশকে পানি পূর্ণ করতে দেখেছেন। তাই আবু সুফিয়ান সতর্কতা হিসেবে সেখানে যান এবং উটের গোবর ভেঙে দেখেন। বিচক্ষণ আবু সুফিয়ান গোবর থেকে প্রাপ্ত খেজুরের বিচি দেখে বুঝতে পারেন এগুলি মদিনার খেজুর। ফলে মুসলিমদের আগমনের ব্যাপারে তিনি সন্দেহমুক্ত হন। এরপর তিনি কাফেলাকে নিয়ে সমুদ্র উপকূলের দিকে ইয়ানবুতে চলে যান। মক্কার বাহিনী জুহফা নামক স্থানে পৌঁছার পর আবু সুফিয়ানের প্রেরিত বার্তাবাহক এসে জানায় যে কাফেলা নিরাপদ আছে তাই আর অগ্রসর না হয়ে ফিরে যাওয়া উচিত।
এই খবর পাওয়ার পর মক্কার বাহিনীর অধিকাংশ ফিরে যাওয়ার পক্ষে মত দেয়। কিন্তু বাহিনীর প্রধান আবু জাহল যুদ্ধ না করে ফিরে যেতে অসম্মতি দেখান। এরপর বনু জুহরা গোত্রের মিত্র ও গোত্রটির সেনাপ্রধান আখনাস ইবনে শারিক ফিরে যাওয়ার পরামর্শ দেন। কিন্তু অধিকাংশ তার পক্ষে সায় না দেয়ায় তিনি বনু জুহরা গোত্রের ৩০০ সদস্য নিয়ে মক্কা ফিরে আসেন। এর ফলে মক্কার বাহিনীতে সেনাসংখ্যা কমে দাঁড়ায় ১,০০০। পরবর্তীতে বনু জুহরা গোত্রের সদস্যরা আখনাসের এই সিদ্ধান্তের কারণে আনন্দ প্রকাশ করেছিল। একইভাবে বনু হাশিমও মক্কায় ফিরে যেতে চায়। কিন্তু আবু জাহলের জেদের কারণে তারা যুদ্ধে অংশ নেয়। মক্কার বাহিনী অগ্রসর হয়ে বদর উপত্যকার একটি টিলার পেছনে আশ্রয় নেয়।
যুদ্ধের ময়দানে এখন আছে মুহাম্মদ সা. নেতৃত্বে মুসলিম বাহিনী ও আবু জাহলের নেতৃত্বে মুশরিক বাহিনী। যে আবু সুফিয়ানের বাণিজ্যিক কাফেলা এতো কাণ্ড সেই বাণিজ্যিক কাফেলা যুদ্ধ থেকে ফসকে গিয়েছে। তারা নিরাপদে মক্কার কাছাকাছি পোঁছে গেছে। এই প্রসঙ্গে আল্লাহ তায়ালা বলেন, //আর স্মরণ করো, আল্লাহ তোমাদের প্রতিশ্রুতি দেন যে দুই দলের এক দল তোমাদের আয়ত্তে আসবে। অথচ তোমরা চাইছিলে যে, নিরস্ত্র দলটি তোমাদের আয়ত্তে আসুক। আর আল্লাহ চাইছিলেন সত্যকে তার বাণী দিয়ে প্রতিষ্ঠিত করতে এবং অবিশ্বাসীদেরকে নির্মূল করতে। ” -সূরা আল-আনফাল, আয়াত : ৭
মুসলিমরা মক্কার বাহিনীর অগ্রযাত্রার খবর পায়। মুসলিম বাহিনীটি মূলত কাফেলা আক্রমণের জন্য গঠিত হয়েছিল, ব্যাপক যুদ্ধের জন্য তারা প্রস্তুত ছিল না। মুসলিমরা এসময় কুরাইশদের মুখোমুখি না হয়ে ফিরে যেতে পারত কিন্তু এর ফলে কুরাইশদের ক্ষমতা অনেক বৃদ্ধি পেত এবং তারা অগ্রসর হয়ে মদিনা আক্রমণ করারও সম্ভাবনা ছিল। অন্যদিকে বাহিনীতে সংখ্যাগরিষ্ঠ মদিনার আনসাররা আকাবার বাইয়াত অনুযায়ী মদিনার বাইরে গিয়ে যুদ্ধ করতে বাধ্য ছিল না এবং অভিযানের ব্যয়ভার তাদের উপর বেশি ছিল। তাই উদ্ভূত পরিস্থিতি সম্পর্কে আলোচনার জন্য মুহাম্মাদ সা. জরুরি শুরার বৈঠকে বসলেন। সভায় মুহাজির, আনসার সকলেই কুরাইশদের মুখোমুখি হওয়ার ব্যাপারে মত দেয়। তারা বহুদিনের নির্যাতনের প্রতিবিধানের জন্য উন্মুখ হয়েছিলেন। এরপর মুসলিমরা অগ্রসর হয়ে বদরের নিকটে পৌঁছায়।
মুহাম্মদ সা. মুশরিকদের ব্যাপারে খোঁজ নেন। জানতে পারেন তারা উপত্যকার শেষ প্রান্তের টিলার অবস্থান করছে এবং প্রতিদিন নয় বা দশটি উট তাদের জন্য জবাই করা হয়। একথা শোনার পর মুহাম্মাদ সা. অনুমান করেন তাদের সংখ্যা ৯০০ থেকে ১০০০ এর মতো হতে পারে। প্রতিপক্ষের আগেই বদর প্রান্তরে পৌঁছানোর জন্য মুহাম্মাদ সা. দ্রুত বদরের দিকে যাত্রা করার নির্দেশ দেন। তাঁর লক্ষ্য ছিল যাতে কুরাইশরা সেখানের একমাত্র কুয়ার দখল নিতে না পারে। রাতে মুসলিমরা বদরের নিকট থামে।
এসময় হুবাব ইবনে মুনজির রা. বলেন, এটি যদি আল্লাহর নির্দেশ হয় তবে তা যেন বাস্তবায়িত হয়। কিন্তু যদি মুহাম্মাদ সা. কৌশল হিসেবে এখানে থেমে থাকেন তবে তার মত হলো যাতে এখানে অবস্থান না করে মুশরিকদের সবচেয়ে নিকটের কূয়ার কাছে অবস্থান নিয়ে বাকি সব কূপ বন্ধ করে দেওয়া হয় এবং নিজেদের কূয়ার উপর চৌবাচ্চা তৈরী করে তাতে পানি জমা করা হয়। এর ফলে মুসলিমরা পানি পেলেও কুরাইশরা পানি থেকে বঞ্চিত হবে। একথা শোনার পর মুহাম্মাদ সা. পরামর্শ মেনে নিয়ে নির্দেশ দেন যাতে রাত অর্ধেক পার হওয়ার পূর্বেই কুরাইশদের সবচেয়ে নিকটের কূয়ার কাছে গিয়ে শিবির স্থাপন করা হয়। এরপর সেখানে পৌছে চৌবাচ্চা তৈরী করে অবশিষ্ট সব কূপ বন্ধ করে দেয়া হয়।
মুসলিমরা পরিকল্পনা অনুযায়ী কূয়া দখল করার পর সাদ ইবনে মুয়াজের পরামর্শক্রমে যুদ্ধক্ষেত্রের উত্তরপূর্বের টিলার উপর মুহাম্মাদ সা. এর জন্য একটি তাবু নির্মিত হয়। এখান থেকে যুদ্ধের পরিস্থিতি ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করা যেত।
যুদ্ধ শুরুর প্রাক্কালে কুরাইশদের আসওয়াদ ইবনে আবদুল আসাদ মাখজুমি এগিয়ে এসে মুসলিমদের পানির জলাধার দখল করে নেবে না হয় এজন্য জীবন দেবে বলে ঘোষণা দেয়। এরপর হামজা ইবনে আবদুল মুত্তালিব অগ্রসর হয়ে তার সাথে লড়াই করেন। লড়াইয়ে আসওয়াদের পা বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। আহত অবস্থা আসওয়াদ চৌবাচ্চার দিকে এগিয়ে যায় এবং প্রতিজ্ঞা রক্ষার জন্য চৌবাচ্চার সীমানার ভেতর ঢুকে পড়ে। এরপর হামজা তাকে হত্যা করেন। এটি ছিল বদরের প্রথম মৃত্যু।
এই সময় মুহাম্মদ সা. আল্লাহর দরবারে বার বার দোয়া করছিলেন : হে আল্লাহ্ ! তুমি আমার সঙ্গে যে ওয়াদা করেছো তা পূর্ণ করো, হে রাব্বুল আলামিন আজ যদি এই মুষ্টিমেয় লোকের অস্তিত্ব বিলুপ্ত হয়ে যায় তাহলে কিয়ামত পর্যন্ত তোমার ইবাদত করবার কেউ থাকবে না।
এরপর তৎকালীন রীতি অনুযায়ী দ্বন্দ্বযুদ্ধের মাধ্যমে লড়াই শুরু হয়। কুরাইশদের মধ্য থেকে উতবা ইবনে রাবিয়া, শাইবা ইবনে রাবিয়া ও ওয়ালিদ ইবনে উতবা লড়াইয়ের জন্য অগ্রসর হন। তাদের লড়াইয়ের আহ্বান শুনে আনসারদের মধ্য থেকে আওফ ইবনে হারিস, মুয়াব্বিজ ইবনে হারিস ও আবদুল্লাহ ইবনে রাওয়াহা এগিয়ে আসেন। কিন্তু কুরাইশ যোদ্ধারা তাদেরকে কটাক্ষ করে বলেন যে তারা তাদের যোগ্য না এবং যেন কুরাইশদের সমশ্রেণীর কাউকে লড়াইয়ের জন্য পাঠানো হয়। এরপর তাদের বদলে হামজা ইবনে আবদুল মুত্তালিব, উবাইদা ইবনে হারিস ও আলি ইবনে আবি তালিবকে পাঠানো হয়। হামজার সাথে শাইবা, আলির সাথে ওয়ালিদ ও উবাইদার সাথে উতবা লড়াইয়ে অবতীর্ণ হয়। কুরাইশ পক্ষের তিনজনই লড়াইয়ে নিহত হয়। লড়াইয়ে উবাইদা আহত হন তাই তাকে সেখান থেকে সরিয়ে নেয়া হয়েছিল। যুদ্ধের কয়েকদিন পর তার মৃত্যু হয়। তিনজন নেতৃস্থানীয় যোদ্ধার মৃত্যুর ফলে কুরাইশদের মনোবলে ফাটল ধরে।
দ্বন্দ্বযুদ্ধের পর কুরাইশরা মুসলিমদের উপর আক্রমণ শুরু করে। যুদ্ধের পূর্বে মুহাম্মাদ সা. নির্দেশ দেন শত্রুরা বেশি সংখ্যায় কাছে এলেই যাতে তীর চালানো হয়। মুসলিমরা তাকবির স্লোগান দিয়ে প্রতিপক্ষের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। যুদ্ধে মক্কার কুরাইশরা ছত্রভঙ্গ হয়ে যায় এবং পিছু হটতে বাধ্য হয়। মুয়াজ ইবনে আমর ও মুয়াজ ইবনে আফরা কুরাইশ পক্ষের সর্বাধিনায়ক আবু জাহলকে হত্যা করেন। বিলালের হাতে তার সাবেক মনিব উমাইয়া ইবনে খালাফ নিহত হয়। উমর ইবনুল খাত্তাব তার মামা আস ইবনে হিশাম ইবনে মুগিরাকে হত্যা করেন। বিকেলের মধ্যে যুদ্ধ শেষ হয়ে যায়। কুরআনে উল্লেখ রয়েছে যে এই যুদ্ধে হাজারো ফেরেশতা মুসলিমদের সহায়তার জন্য এসেছিল। আল্লাহ তায়ালা বলেন, স্মরণ করো, তোমরা তোমাদের রবের নিকট সাহায্যের জন্য দোয়া করেছিলে। তিনি তা কবুল করেন এবং বলেন : আমি তোমাদের সাহায্য করবো সহস্র ফেরেশতা দ্বারা যারা একের পর এক আসবে। (সূরা আনফাল : আয়াত ৯)।
যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর নিহত মুসলিমদেরকে যুদ্ধক্ষেত্রে দাফন করা হয়। নিহত কুরাইশদের লাশ ময়দানের একটি কূয়ায় নিক্ষেপ করা হয়। এসময় চব্বিশজন প্রধান কুরাইশ নেতার লাশ কূয়ায় নিক্ষেপ করা হয়েছিল। আরবের রীতি অনুযায়ী মুসলিমরা তিনদিন যুদ্ধক্ষেত্রে অবস্থান করার পর মদিনায় ফিরে আসে।
বদর যুদ্ধে শহীদ :
বদরের যুদ্ধে যাঁরা শহীদ হয়েছেন, তাদের পরিচয় হল,
১. হযরত উবায়দা ইবনে হারিছ (রা) - মুহাজির।
২. হযরত উমায়ের ইবনে আবু ওয়াক্কাস (রা) - মুহাজির।
৩. হযরত যুশ-শিমালাইন (রা) - মুহাজির।
৪. হযরত আকিল ইবনে বুকাইল (রা) - মুহাজির।
৫. হযরত মাহজা ইবনে সালেহ (রা)- মুহাজির। তিনি ছিলেন হযরত ওমর (রা.) এর আযাদকৃত ক্রীতদাস।
৬. হযরত সাফওয়ান ইবনে বায়দা (রা) - মুহাজির।
৭. হযরত সাদ ইবনে খায়সামা (রা) - আনসার।
৮. হযরত মুবাশ্বর ইবনে আবদুল মুনযির (রা) - আনসার।
৯. হযরত উমায়ের ইবনে হুমাম (রা) - আনসার।
১০. হযরত ইয়াযিদ ইবনে হারিছ (রা) - আনসার।
১১. হযরত রাফি ইবনে মুয়াল্লাহ (রা) - আনসার।
১২. হযরত হারিছা ইবনে সুরাকা (রা) - আনসার।
১৩. হযরত আওফ ইবনে হারিছ (রা) - আনসার।
১৪. হযরত মুআওবিয ইবনে হারিছ (রা) - আনসার।
যুদ্ধের পর মুসলিমরা মদিনায় ফিরে আসে। এতে কয়েকজন কুরাইশ নেতাসহ ৭০ জন বন্দী হয়। বন্দীদের সাথে মানবিক আচরণ করা হয়েছিল। মুসলিমরা নিজেরা খেজুর খেয়ে বন্দীদের রুটি খেতে দেয়। বদর যুদ্ধের পর নবীজির অবস্থান ছিল পরাজিত আত্মসমর্পণকারীদের হত্যা না করা ও কষ্ট না দেওয়া। তাঁর আদেশে মদিনায় আনসার এবং মুহাজিররা সাধ্যানুসারে বন্দিদেরকে নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নিয়ে আপন আপন গৃহে স্থান দিলেন এবং আত্মীয়-স্বজনের মতোই তাদের সঙ্গে আচরণ করেন। বন্দীদের স্বগতোক্তি ছিল—‘মদিনাবাসীদের ওপর আল্লাহর রহমত নাজিল হোক। তারা আমাদের উটে চড়তে দিয়ে নিজেরা পায়ে হেঁটে গেছে, নিজেরা শুষ্ক খেজুর খেয়ে আমাদের রুটি খেতে দিয়েছে।
বন্দীদের ব্যাপারে করণীয় সম্পর্কে মুহাম্মাদ সা. নেতৃস্থানীয় সাহাবীদের সাথে পরামর্শ করেন। সভায় আবু বকর মত দেন যে বন্দীদের সবাই মুসলিমদেরই ভাই, একই বংশের সদস্য অথবা আত্মীয়। তাই তাদের কাছ থেকে মুক্তিপণ নিয়ে ছেড়ে দেয়া উচিত যাতে মুসলিমদের তহবিলে অর্থ সঞ্চিত হয় এবং বন্দীরা ভবিষ্যতে ইসলাম গ্রহণের সুযোগ পায়। উমর ইবনুল খাত্তাবের মত ছিল বন্দীদের প্রতি কোনো প্রকার অনুকম্পা প্রদর্শন না করে মুসলিমদের প্রত্যেকে বন্দীদের মধ্যে নিজ নিজ আত্মীয়কে হত্যা করে যাতে এটা প্রমাণ হয় যে, মুশরিকদের ব্যাপারে মুসলিমদের মনে কোনো দুর্বলতা নেই।
যাই হোক শুরার অধিকাংশদের মতামত আবু বকরের পক্ষে থাকায় আল্লাহর রাসূল সা. মুক্তিপণ আদায়ের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিলেন। তবে আল্লাহ তায়ালা এই সিদ্ধান্ত পছন্দ করেন নি। তিনি পছন্দ করেছেন উমার রা.-এর সিদ্ধান্ত। যেহেতু এটা সম্মিলিত সিদ্ধান্ত ছিল তাই আল্লাহ এই সিদ্ধান্তের কারণে মুসলিমদের শাস্তি না দিয়ে বরকত দিয়েছেন। আল্লাহ তায়ালা সূরা আনফালের ৬৭ ও ৬৮ নং আয়াতে বলেন,
কোন নবীর জন্য উচিত নয় যে, তার নিকট যুদ্ধবন্দি থাকবে (এবং পণের বিনিময়ে তিনি তাদেরকে মুক্ত করবেন) যতক্ষণ না তিনি জমিনে (তাদের) রক্ত প্রবাহিত করেন। তোমরা দুনিয়ার সম্পদ কামনা করছো, অথচ আল্লাহ চাচ্ছেন আখিরাত। আর আল্লাহ পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাবান। আল্লাহ্র পূর্ব বিধান (মুক্তিপণ বৈধ করার বিধান) না থাকলে তোমরা যে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছ সে জন্য তোমাদের উপর বড় আজাব আপতিত হতো।
এই বিজয় আল্লাহর ভাষায় ছিল সত্য প্রতিষ্ঠার বিজয়। তিনি সূরা আনফালের ৮ নং আয়াতে তা বলেছেন। এই বিজয়ের সবচেয়ে ভালো ফলাফল ছিল মদিনাতে। মদিনার মুশরিকরা যারা তখনো ইসলাম গ্রহণ করেনি তারা আল্লাহর রাসূলের অভাবনীয় বিজয়ে বুঝতে সক্ষম হয়েছিল যে, আল্লাহর নবী সা. সত্য নবী। আব্দুল্লাহ ইবনে উবাইসহ বহু মুশরিক ইসলাম গ্রহণ করে। মদিনার ইহুদীরাও মুহাম্মদ সা.-এর প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করে। অর্থাৎ মদিনার ভেতরে থাকা শত্রুদের মনোবল নষ্ট হয়ে যায়। মদিনা রাষ্ট্র আগের চাইতে বেশি সুসংহত হয়।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন