৭ জুন, ২০২১

কেন উল্টে গেল মিয়ানমারের নেতারা?

ছবি : NUG এর প্রেসিডেন্ট


এইতো কিছুদিন আগের ব্যাপার। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের পক্ষ থেকে প্রবল চাপ সত্ত্বেও মিয়ানমারের যে রাজনীতিক নেতারা রোহিঙ্গাদের অধিকারের বিন্দুমাত্র স্বীকৃতি দিতে রাজী হয়নি, হঠাৎ করে তাদের অবস্থান উল্টে গেল। এটা বেশ নাটকীয়তার জন্ম দিয়েছে।

সেনাবাহিনীর ক্যু-তে ক্ষমতা হারানো অং সান সুচির দল এনএলডিসহ বিরোধী দলগুলোর জোট থেকে গত বৃহস্পতিবার রোহিঙ্গাদের ব্যাপারে একটি নাটকীয় ঘোষণা দেওয়া হয়। এতে রোহিঙ্গাদের অধিকারের স্বীকৃতি শুধু নয়, ১৯৮২ সালের যে নাগরিকত্ব আইনের বলে তাদের অধিকার হরণ করা হয়, সেটি বিলোপের অঙ্গীকারও রয়েছে।

গণতন্ত্রের দাবিতে আন্দোলনরত মিয়ানমারের বিরোধী দলগুলো এখন গড়ে তুলেছে একটি সমান্তরাল সরকার, যেটি ন্যাশনাল ইউনিটি গভর্নমেন্ট বা এনইউজি নামে পরিচিত। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছ থেকে স্বীকৃতি লাভের জন্য এই এনইউজি এখন সর্বাত্মক চেষ্টা চালাচ্ছে।

রোহিঙ্গাদের ব্যাপারে ঘোষণাটি দেয়া হয়েছে এই এনইউজির তরফ থেকে। ঘোষণাটিকে বেশ ইতিবাচক একটি পদক্ষেপ হিসেবে দেখছে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়। রোহিঙ্গাদের অধিকারের পক্ষে সোচ্চার বিভিন্ন সংগঠনও এটিকে স্বাগত জানিয়েছে। তবে তাদের অবস্থান কতটা আন্তরিক অথবা রোহিঙ্গাদের অধিকারের পূর্ণাঙ্গ স্বীকৃতি এই ঘোষণায় আছে কিনা- তা নিয়ে অনেক প্রশ্ন রয়ে গেছে।

কী ছিল এনইউজি'র ঘোষণায়?
গত ৩ জুন এনইউজি রোহিঙ্গাদের ব্যাপারে যে নীতি ঘোষণা করেছে, তাতে বেশ কয়েকটি অঙ্গীকার করেছে তারা।

প্রথমত, এতে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর হাতে রোহিঙ্গারা যে হত্যা-নির্যাতন-নিপীড়নের শিকার হয়েছে, তার স্বীকৃতির পাশাপাশি যারা এর জন্য দায়ী, তাদের বিচারের কথা বলা হয়েছে। প্রয়োজনে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতকে মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে সংগঠিত অপরাধের বিচারের এখতিয়ার দেয়ার প্রক্রিয়া শুরুর অঙ্গীকার করা হয়েছে।

দ্বিতীয়ত: এতে ১৯৮২ সালের নাগরিকত্ব আইন সংশোধন/বিলোপের অঙ্গীকার করা হয়েছে। রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব হরণের ক্ষেত্রে এই আইনটিকে ব্যবহার করে মিয়ানমারের সামরিক কর্তৃপক্ষ।

তৃতীয়ত: এই ঘোষণায় মিয়ানমার থেকে পালিয়ে যাওয়া রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে আনার জন্য প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে করা চুক্তি মেনে চলার অঙ্গীকার রয়েছে।

যদিও আপাত দৃষ্টিতে মনে হচ্ছে এই ঘোষণায় কোনো লাভ নেই। তবে আমি মনে করি দীর্ঘ মেয়াদে এর একটি ভালো প্রভাব তৈরি হতে পারে। কারণ ২০১৭ সাল থেকে কোনো রাজনৈতিক দল বা নেতা রোহিঙ্গাদের নাগরিক স্বীকৃতি তো পরের ব্যাপার তাদের মানবাধিকার নিয়েও কথা বলতে কেউ রাজি ছিল না। এই ঘোষণার পর থেকে এই পরিস্থিতির উন্নয়ন হবে। রোহিঙ্গাদের নাগরিক স্বীকৃতির পক্ষে এটি একটি জোরালো যুক্তি হিসেবে উপস্থাপিত হবে।

মিয়ানমারের প্রায় সব প্রধান বিরোধী দলগুলোর রাজনীতিকদের নিয়ে এনইউজি গঠিত হয় গত ১৬ই এপ্রিল। ফেব্রুয়ারিতে সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা হারানো এনএলডির নির্বাচিত পার্লামেন্টারিয়ানরা আছেন এই সরকারে। আছেন আরও বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর প্রতিনিধি এবং দলের রাজনীতিকরা। ফলে দেখা যাচ্ছে সামরিক জান্তা ছাড়া সকল রাজনৈতিক নেতারাই রোহিঙ্গাদের নাগরিক অধিকার মেনে নিয়েছেন। তাদের ওপর গণহত্যার বিষয়টি স্বীকার করে নিয়েছেন। এনইউজি যে মিয়ানমারের মূলধারার গণতান্ত্রিক আন্দোলনের প্রতিনিধিত্ব করছে তাতে কোন সন্দেহ নেই। সেদিক থেকে এই স্বীকৃতির একটা মূল্য অবশ্যই আছে।

তারা এটা কেন করেছে?
আমি মনে করি না মিয়ানমারের ন্যাশনাল ইউনিটি গভর্নমেন্ট বা এনইউজি মানবিক বিবেচনায় রোহিঙ্গাদের ব্যাপারে পজেটিভ সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এই অবস্থান তাদের কৌশলগত। তারা মূলত সামরিক সরকারের বাইরে আরেকটি সরকার প্রতিষ্ঠা করেছে। আর এখন তাদের প্রয়োজন আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি। এই স্বীকৃতি পেতে সুবিধা হওয়ার জন্যই তারা রোহিঙ্গাদের অধিকার ফিরিয়ে দিতে চাইছে।

অং সান সুচি যতদিন ক্ষমতায় ছিল, ততদিন শুধু রোহিঙ্গাদের অধিকারের বিপক্ষে একটি অনমনীয় কঠোর অবস্থানই শুধু নেয়নি, আন্তর্জাতিক আদালতে বিচারের মুখোমুখি হওয়া থেকে মিয়ানমারের জেনারেলদের রক্ষা করতে সশরীরে সেখানে গিয়েছিলো তাদের পক্ষে কথা বলতে। হঠাৎ করে রোহিঙ্গা প্রশ্নে এভাবে ১৮০ ডিগ্রি অবস্থান বদলানোর এই সিদ্ধান্তের পেছনে তার সায় কতটা আছে? এটি একটি বড় প্রশ্ন। তবে আশা করা যায় তিনি জেলে থাকলেও তার সায় নিয়েই এই ঘোষণা দেওয়া হয়েছে।

মিয়ানমারের রাজনৈতিক নেতারা তাদের সুবিধার জন্যে ও সামরিক নেতাদের আন্তর্জাতিক আদালতে গণহত্যাকারী হিসেবে প্রমাণ করতে তারা এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তবে কি তাদের এই ঘোষণায় রোহিঙ্গারা ভরসা করতে পারে? আমার মনে হয় যে কারণেই ঘোষণা দিক না কেন, তারা তাদের এই ঘোষণা থেকে ভবিষ্যতে পিছিয়ে আসবে না। কারণ এই বিষয়টি তাদেরকে পৃথিবীর পক্ষ থেকে সুরক্ষা দিবে ভবিষ্যতে। বাকীটা সময় বলবে।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন