উহুদ যুদ্ধের চার মাস পরের ঘটনা। একদিন নজদের নেতা আবু বারা আমির বিন মালিক মদিনায় মুহাম্মদ সা.-এর কাছে উপস্থিত হলেন। মুহাম্মদ সা. তাকে ইসলামের দাওয়াত দিলেন কিন্তু তিনি ইসলাম গ্রহণ করলেন না আবার প্রত্যাখ্যানও করলো না। তিনি বললেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল! যদি আপনি দ্বীনের দাওয়াত দেওয়ার জন্য একদল সাহাবীগণকে নাজদবাসীদের নিকট প্রেরণ করেন তাহলে তারা আপনার দাওয়াত গ্রহণ করবে বলে আশা করি।
মুহাম্মদ সা. বললেন, নাজদবাসীদের সম্পর্কে আমি ভয় করছি। তারা যদি আমার সাহাবীদের খুন করে!
আবু বারা তখন বললেন, ‘তারা আমার আশ্রয়ে থাকবেন।’
মুহাম্মদ সা. মুসলমানদের মধ্য থেকে বাছাই করা চল্লিশজন মতান্তরে সত্তরজন সুযোগ্য সাহাবীকে বনু সাঈদা গোত্রের বিশিষ্ট সাহাবী মুনযির ইবনে আমর রা.-এর নেতৃত্বে পাঠিয়ে দিলেন। তাঁর সঙ্গী ছিলেন বিশিষ্ট সাহাবী হারেস রা., হারাম ইবনে মিলহান রা., উরওয়া ইবনে আসমা রা., নাফে ইবনে বুদাইল ইবনে ওয়ারকা রা.ও আবু বকর সিদ্দীকের রা. মুক্ত গোলাম আমের ইবনে ফুহাইরা। এ সাহাবাবৃন্দ ছিলেন বিজ্ঞ, ক্কারী, এবং শীর্ষ স্থানীয়। তাঁরা দিনের বেলা জঙ্গল থেকে জ্বালানী সংগ্রহ করে তার বিনিময়ে আহলে সুফফাদের জন্য খাদ্য ক্রয় করতেন ও কুরআন শিক্ষা করতেন এবং শিক্ষা দিতেন এবং রাত্রি বেলা আল্লাহর সমীপে মুনাজাত ও সালাতের জন্য দন্ডায়মান থাকতেন।
আল্লাহর রাসূল সা.-এর নির্দেশে তাঁরা নজদের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলেন। একসময় তারা নজদের বীরে মাউনা নামক জলাশয়ের কাছে গিয়ে অবস্থান করলেন। এই জলাশয়টি বনু আমেরের আবাসভূমি ও বনু সুলাইমের প্রস্তরময় এলাকার মাঝখানে অবস্থিত। উভয় এলাকাই জলাশয়টির নিকটবর্তী হলেও বনু সুলাইমের এলাকা ছিল অধিকতর নিকটবর্তী। আবু বারা নামে যার আহবানে তারা নজদে পৌঁছালেন তার গোত্রের নাম বনু আমের।
নজদের নেতাদের দাওয়াতের উদ্দেশ্যে রাসূল সা. একটি চিঠি দিয়েছিলেন। নজদের মুশরিক নেতা আমির বিন তুফাইলের নিকট রাসূলুল্লাহ সা.-এর সেই চিঠি নিয়ে গেলেন হারাম ইবনে মিলহান রা.। তিনি যখন তার কাছে উপস্থিত হলেন, তখন সে চিঠির দিকে ভ্রুক্ষেপমাত্র না করে হারাম ইবনে মিরহান রা.-কে হত্যা করলো। তারপর বাদবাকী সাহাবীদেরকেও হত্যা করার জন্য সে বনু আমেরের সাহায্য চাইলো। কিন্তু বনু আমের তার অনুরোধ এই বলে প্রত্যাখ্যান করলো যে, “আমরা আবু বারার প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করতে চাই না। আবু বারা তাদের নিরাপত্তার প্রতিশ্রুতি দিয়ে এসেছে।”
আমির বিন তুফাইল অগত্যা বনু সুলাইমের কয়েকটি উপগোত্রের সাহায্য চাইল। তারা সঙ্গে সঙ্গে সম্মত হলো এবং মুসলিমদেরকে চারদিক থেকে ঘেরাও করে ফেললো। সাহাবাগণ তাদেরকে দেখে তরবারী হাতে নিলেন এবং লড়াই করতে করতে শহীদ হলেন। শুধু কা’ব ইবনে যায়িদ রা. রক্ষা পেলেন। কাফিররা তাঁকে মৃত মনে করে ফেলে রেখে যায়। অথচ তিনি বেঁচে ছিলেন। অনেক রক্তপাতের দরুণ দুর্বল হয়ে যাওয়া সত্ত্বেও নিহতদের স্তূপের মধ্য থেকে প্রাণ নিয়ে কোন রকমে পালিয়ে যান এবং পরে খন্দকের যুদ্ধে শাহাদাত বরণ করেন।
আক্রান্ত হবার সময় দু’জন সাহাবী আমর ইবনে উমাইয়া যামরি ও মুনযির বিন মুহাম্মাদ বিন উকবা রা. উটের খাবারের সন্ধানে দলের বাইরে ছিলেন। তাঁরা তাঁদের সঙ্গীদের বিপদের কথা জানতেন না। কিন্তু তাঁদের মাথার ওপর কতকগুলো পাখী উড়তে দেখে তাঁদের মনে সন্দেহ জাগে। তাঁরা ভাবলেন, পাখীগুলোর ওড়ার পেছনে নিশ্চয়ই কোন রহস্য আছে। তাঁরা তাঁদের অবস্থা দেখবার জন্য এগিয়ে গেলেন। দেখলেন সবাই রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে আছে। আর তাঁদের ওপর আক্রমণকারী দলকেও উপস্থিত দেখলেন।
মুনযির রা. আমর ইবন উমাইয়া রা.-কে বললেন, “এখন আমাদের কি করা উচিত বলে মনে করেন?” তিনি বললেন, “আমার ইচ্ছা, দ্রুত রাসূল সা.-এর সঙ্গে গিয়ে দেখা করি এবং সমস্ত ব্যাপার তাঁকে জানাই।” মুনযির রা. বললেন, “যে রণক্ষেত্রে মুনযির ইবনে আমর শহীদ হয়েছেন সেখান থেকে প্রাণ নিয়ে আমি পালাতে চাই না। অতঃপর তিনি লড়াই করে শহীদ হলেন।
আমর ইবনে উমাইয়া রা.-কে কাফিররা আটক ও বন্দী করলো। তিনি মুদার গোত্রের লোক একথা শুনে আমের ইবনে তুফাইল তাঁর কপালের চুল কেটে নিল এবং তাঁর মায়ের একটা দাস মুক্ত করার মানত ছিল মনে করে তাঁকে সেই বাবদে মুক্তি দিল। এরপর আমর ইবনে উমাইয়া মদীনার উদ্দেশ্যে যাত্রা করলেন। মদীনার অনতিদূরে অবস্থিত একটি স্থানে পৌঁছলো বনু আমেরের দুই ব্যক্তি এসে তাঁর সাথে একই ছায়ায় বিশ্রাম নিতে লাগলো। তিনি তাদেরকে জিজ্ঞেস করে জানতে পারলেন যে, তারা বনু আমের গোত্রের লোক।
যেহেতু আমর ইবনে উমাইয়া রা. দলের বাইরে ছিল তাই তিনি প্রকৃত ঘটনা জানতেন না। তিনি ভেবেছেন সাহাবাদের ওপর যারা আক্রমণ করেছিল এর মধ্যে বনু আমের গোত্রের লোকেরাও ছিল। তাই তিনি প্রতিশোধ নিতে চাইলেন ও একটু অপেক্ষা করলেন। যেই তারা তন্দ্রাচ্ছন্ন হলো অমনি উভয়ের ওপর হামলা চালিয়ে হত্যা করলেন।
মুহাম্মদ সা. নিকট উপনীত হয়ে আমর ইবনে উমাইয়া সমস্ত ঘটনা জানালেন। মুহাম্মদ সা. বললেন, “তুমি যে দু’জনকে হত্যা করেছো, তাদের জন্য আমাকে রক্তপণ (দিয়াত) দিতে হবে।” অতঃপর রাসূলুল্লাহ সা. বললেন, “এ ঘটনা আবু বারাই ঘটালো। আমি এটা অপছন্দ করেছিলাম এবং শংকিত ছিলাম।”
বীরে মাউনার ঘটনার পর মদিনায় মুনাফিকদের দৌরাত্ম বেড়ে যায় এবং মুহাম্মদ সা. বিরূপ প্রতিক্রিয়ার মুখোমুখি হন। এমনিতেই উহুদ যুদ্ধে মুসলিমরা বিপর্যয়ের মুখোমুখি হয়েছে। মুনাফিক ও দুর্বল ঈমানের মুসলিমরা মদিনায় অস্থিরতা শুরু করেছে। উহুদ যুদ্ধে ৬৫ জন আনসার শাহদাত বরণ করছেন। এর চার মাস পর রাজি ও বীরে মাউনার ঘটনা ঘটে। এখানেও প্রায় ৪৭ জন সাহাবী শাহদাত বরণ করেন। এদের মধ্যেও বেশিরভাগ ছিল আনসার। মুনাফিকরা শহীদ পরিবারদের আল্লাহর রাসূল সা.-এর বিরুদ্ধে উস্কে দিয়েছিল। তারা প্রচারণা চালিয়েছে মুহাম্মদ সা.-এর নির্বুদ্ধিতা ও প্রজ্ঞার অভাবে আনসারদের এভাবে খুন হতে হচ্ছে।
তারা বলতো, এর আগে মদিনার অবস্থা ভালো ছিল। মদিনা কখনোই বাইরের আক্রমণের আশংকা করতো না। মুহাম্মদ তাদের বিপদ বাড়িয়ে দিয়েছে। এই মুনাফিকদের বড় ইন্ধনদাতাদের মধ্যে ইহুদিরা। মুনাফিকদের ষড়যন্ত্রে অনেক ঈমানদার আনসার সাহাবীও রাসূল সা.-কে নানাবিধ প্রশ্ন করে বিব্রত করতেন। সব মিলিয়ে শক্তিশালী ঈমানের অধিকারী সাহাবী ও মুহাম্মদ সা.-কে বেকায়দা অবস্থার মধ্যে ফেলে দেওয়া হয়েছে। তবে মুহাম্মদ সা. ধৈর্য ও ক্ষমার নীতি অবলম্বন করে এই অবস্থা কাটিয়ে ওঠেন। খন্দকের যুদ্ধের মাধ্যমে মুনাফিকদের দৌরাত্ম ফিকে হতে থাকে।
আল্লাহর রাসূল সা.-এর কাছে মুনাফিকরা চিহ্নিত হওয়া সত্ত্বেও মহানবী সা. ধৈর্য ধরেছেন রাজনৈতিক কারণে। এমনিতেই মুসলিমদের মধ্যে নানান হতাশা কাজ করছে। এর মধ্যে রাসূল সা. যদি মুনাফিকদের চিহ্নিত করে তাদের শাস্তির ব্যবস্থা করতেন তবে মদিনার সমাজ ভেঙে পড়ার সম্ভাবনা তৈরি হতো। মুসলিমদের মধ্যে স্থায়ী বিভেদ তৈরি হতো। তাই রাসূল সা. মুনাফিকদের প্রতি ক্ষমার নীতি অবলম্বন করেন। তবে মুনাফিকরা আল্লাহর নিকট তাদের প্রতিদান পাবে। আল্লাহ তায়ালা সূরা নিসার ১৪৫ নং আয়াতে বলেন, মুনাফিকরা তো জাহান্নামের নিম্নতমস্তরে থাকবে।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন