১২ জুল, ২০২১

পর্ব : ২৪ - ইহুদি গোত্র বনু নাদিরের বহিষ্কার


মদিনায় ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর থেকেই ইহুদীরা নানান বিদ্রূপ ও ষড়যন্ত্র করে আসছিল। তারা সমসময় ঈমানদার মুসলিমদের নানানভাবে কষ্ট ও বেকায়দায় ফেলে দেওয়ার চেষ্টা করতো। তারা মক্কার মুশরিকদের সাথে ষড়যন্ত্র করে মদিনা রাষ্ট্র ভেঙে দেওয়ার চেষ্টায় লিপ্ত ছিল।
 
তারা মুসলমানদের সাথে চুক্তি ও অঙ্গীকার থাকা সত্ত্বেও তাদের কষ্ট দিতেও তাদের ওপর নির্যাতন চালাতে নানা প্রকার অজুহাত খুঁজে বেড়াতো। বনু কাইনুকা গোত্রের বহিষ্কার এবং কাব ইবনে আশরাফের হত্যাকাণ্ডের পর ইহুদিদের সাহস কমে যায়। তারা একটু চুপচাপ থাকে। কিন্তু উহুদের যুদ্ধ তাদের আবার চাঙ্গা করে। তারা মুসলমানদের বিরুদ্ধে প্রকাশ্য শত্রুতা এবং বিশ্বাসঘাতকতা করতে শুরু করে। মদীনার মুনাফেকরা ও মক্কার মুশরেকদের সাথে গোপনে গাঁটছড়া বাঁধে এবং ইহুদীরা মুশরেকদের সহায়তা করতে থাকে।

মুহাম্মদ সা. সব কিছু জেনেও ধৈর্য ধরেন। কিন্তু রাজি এবং বিরে মাউনার মর্মান্তিক ঘটনার পর তাদের সাহস বহুলাংশে বেড়ে যায় এবং তারা মুহাম্মদ সা.-কে শেষ করে দেওয়ার কর্মসূচী গ্রহণ করে। এরই প্রেক্ষিতে তাদের মদিনা থেকে বহিষ্কার করা হয়।
ঘটনা হলো আল্লাহর রাসূল সা. একটি পলিটিক্যাল বিষয়ে তাদের বনু নাদির গোত্রের সাহায্য চাইলেন। বীরে মাউনার ট্রাজেডি থেকে বেঁচে যাওয়া একমাত্র সাহাবী ভুলবশত নজদের বনু আমের গোত্রের দুইজন ব্যক্তিকে হত্যা করেন। মুহাম্মদ সা. এর রক্তপণ দিতে চেয়েছিলেন এবং নজদের বনু আমেরের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক রাখতে চেয়েছিলেন। যেহেতু বনু আমেরের সাথে বনু নাদিরের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ছিল তাই মহানবী চেয়েছেন বনু আমেরের সাথে মধ্যস্থতায় যেন বনু নাদির থাকে।
 
এছাড়াও মদিনা সনদে ইহুদীদের সাথে সম্পাদিত চুক্তি অনুযায়ী হত্যার উল্লিখিত ক্ষতিপূরণে মুসলমানদের সহায়তা করতে তারা বাধ্য ছিলো। রাসূল সা. বনু নাদিরের নেতাদের সেকথা বলা পর তারা বললো, হে আবুল কাসিম, আমরা তাই করবো। আপনি আপনার সঙ্গীদের নিয়ে এখানে অপেক্ষা করুন, আমরা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করছি। একথার পর মুহাম্মদ সা. ইহুদিদের একটি দেয়ালের সাথে হেলান দিয়ে বসে অপেক্ষা করছিলেন। এসময় মুহাম্মদ সা.-এর সাথে তিন শীর্ষ সাহাবি আবু বকর রা., উমার রা., আলী রা. সহ আরো কয়েকজন সাহাবা ছিলেন।

ইহুদিরা এটা নিজেদের জন্য একটি মহাসুযোগ মনে করলো। উহুদ, রাজি ও বীরে মাউনার ঘটনার পর তাদের আত্মবিশ্বাস বেড়ে গেল। তারা দেখলো যে মুসলিমরাও পরাজিত হয়। তাই তারা নিজেদের মধ্যে পরামর্শ করলো যে, এই চমৎকার সুযোগ, চলো আমরা মুহাম্মদকে মেরে ফেলি। দেয়ালের ওপর থেকে ভারি চাক্কি ফেলে মুহাম্মদকে মেরে ফেলতে কে রাজি আছ? যদিও এটা সুবর্ণ সুযোগ মনে করছে তবে কেউ হত্যার কাজটা নিজে করতে রাজি হচ্ছিল না, কারা তারা জানে মুহাম্মদ সা.-ই সত্য নবী।
যাই হোক অবশেষে আমর ইবনে জাহাশ নামে একজন ইহুদি রাজি হলো। সালাম ইবনে মাশকাম নামের একজন ইহুদি তাদের সতর্ক করে বললো, সাবধান! অমন কাজ করো না। আল্লাহর কসম, তোমার ইচ্ছার খবর আগেই মুহাম্মদ সা. পেয়ে যাবেন। আল্লাহ তায়ালাই তাঁকে খবর দেবেন। তাছাড়া মুসলমানদের সাথে আমাদের যে অঙ্গীকার রয়েছে, তাও লংঘন করা হবে। কিন্তু কেউ তার কোনো কথাই কানে তুললো না, তারা নিজেদের অসদুদ্দেশ্য বাস্তবায়নে অটল রইলো।

এদিকে আল্লাহ তায়ালা মুহাম্মদ সা.-এর কাছে জিবরাইল আ.-কে প্রেরণ করলেন এবং সব খবর জানালেন। মুহাম্মদ সা. দ্রুত সেই জায়গা থেকে উঠে নিজের এলাকার দিকে রওয়ানা হলেন। সাহাবার প্রথমে ভেবেছেন তিনি হয়তো প্রাকৃতিক কাজ সারতে গিয়েছেন। কিন্তু তিনি দীর্ঘক্ষণ না আসায় তারা মসজিদে নববি দিকে গেলেন। সেখানে পেরে নবী সা.-কে বললেন, হে রাসূল সা. আপনি এতো দ্রুত চলে এলেন যে, আমরা কিছুই বুঝতে পারিনি। মুহাম্মদ সা. বনু নাদিরের ইহুদীদের ষড়যন্ত্র সম্পর্কে সাহাবাদের অবহিত করলেন।

রাসূল সা. মুহাম্মদ ইবনে মুসলিম রা.-কে বনু নাদিরের নিকট পাঠালেন সিদ্ধান্তসহ। যেহেতু তোমরা মুহাম্মদ সা.-কে হত্যা ষড়যন্ত্র করে মদিনা সনদ লঙ্ঘন করেছো অতএব এই রাষ্ট্রে থাকার অধিকার তোমরাদের নেই। তোমদের ১০ দিন সময় দেওয়া হলো। এরপর যাদের এই এলাকায় পাওয়া যাবে তাদের মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হবে।
 
ইন্টারেস্টিং বিষয় হলো, তারা কেউ প্রতিবাদ করলো এই বলে যে, আমরা যে মুহাম্মদকে হত্যা করার পরিকল্পনা করেছি তার প্রমাণ কী? তারা অস্বীকার করেনি তাদের ষড়যন্ত্রের ব্যাপারে। তারা নবী সা.-কে সত্যিকারভাবেই নবী হিসেবে জানতো। এবং তারা এটাও জানতো যে, তাদের খবর আল্লাহ মুহাম্মদ সা.-কে পৌঁছে দেবেন।
 
যাই হোক, নোটিশ পেয়ে কয়েক দিনের মধ্যে তারা সফরের প্রস্তুতি তারা শুরু করলো। কিন্ত মুনাফেক নেতা আবদুল্লাহ ইবনে উবাই ইহুদিদের খবর পাঠালো যে, তোমরা নিজের জায়গায় অটল থাকো, বাড়িঘর ছেড়ে যেও না। আমর নিয়ন্ত্রণে ২ হাজার যোদ্ধা রয়েছে যারা তোমাদের দুর্গে প্রবেশ করবে। এরা তোমাদের সাথে যুদ্ধ করবে। তোমাদের ব্যাপারে কারো হুমকিতে আমরা প্রভাবিত হব না। তোমাদের সাথে যুদ্ধ করা হলে আমরা তোমাদের সাহায্য করবো। এছাড়া মদিনার আরেক ইহুদি গোত্র বনু কুরাইজা এবং নজদের বনু গাতফান গোত্র তোমাদের মিত্র। তারাও তোমাদের সাহায্য করবে।

আবদুল্লাহ ইবনে উবাই-এর এই বার্তায় বনু নাদিরের ইহুদিরা চাঙ্গা হলো। তারাপর তারা সিদ্ধান্ত নিলো যে, বহিষ্কৃত হওয়ার বিপরীতে তারা যুদ্ধ করবে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে। বনু নাদিরের মূল নেতা হুয়াই ইবনে আখতাব তার মিত্রদের সাথে আলোচনা করলো। সবাই তাকে সাহায্য করার ব্যাপারে নিশ্চিত করলো। সে আশা করেছিলো যে, আব্দুল্লাহ বিন উবাই, বনু গাতফান ও বনু কুরাইজা তাদের প্রতিশ্রুতিতে অটল থাকবে। তাই সে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে খবর পাঠালো যে, আমরা বাড়ীঘর ছেড়ে যাব না। আপনার যা ইচ্ছে তাই করুন।

মুসলমানদের জন্যে এই চ্যালেঞ্জ ছিলো রিস্কি। যদি সত্যিই বনু নাদিরের বিরুদ্ধে লড়াই শুরু হয় এবং সেখানে যদি মুনাফিকরা যোগ দেয় তবে মদিনায় গৃহযুদ্ধ লেগে যাবে। যা মদিনার জন্য অত্যন্ত বিপদজনক। এর সুবিধা নিবে নজদের বনু গাতফান ও মক্কার কুরাইশরা। তাছাড়া তখন সমগ্র আরব ছিলো মুসলমানদের বিরুদ্ধে সোচ্চার। মুসলমানদের দু’টি তাবলীগী প্রতিনিধিদলকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছিলো। এরও যথাযথ প্রতিশোধ নিতে সক্ষম হচ্ছে না মুসলিমরা।

বনু নাদির গোত্রের ইহুদিদের দুর্গগুলো এতো বেশি শক্তিশালী ছিলো যে, তাদের অস্ত্র সমর্পণ করানো সহজ কাজ ছিলো না। আবার যদি বনু নাদিরকে ছেড়ে দেওয়া হয় তবে তাও হবে আত্মঘাতী। এতে মুনাফিক ও ইহুদিরা আর বেশি অফেনসিভ হয়ে যাবে। তাই মুহাম্মদ সা. তাঁর শীর্ষ সাহাবাদের নিয়ে শুরা মিটিং করলেন। শুরার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বনু নাদিরের বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হয়ে গেল মুসলিমরা। এখানে উল্লেখ্য যে, আগে মদিনার খাজরাজদের নেতা হিসেবে আব্দুল্লাহ ইবনে উবাই শুরা মেম্বার ছিলেন। উহুদের ঘটনার পর তাকে কোনো দৃশ্যমান শাস্তি না দিলেও তাকে আর পরামর্শের জন্য ডাকা হতো না।
 
যাই হোক মুহাম্মদ সা. রাষ্ট্রের স্বাভাবিক কর্মকান্ড অব্যাহত রাখার জন্য আবদুল্লাহ ইবনে উম্মে মাকতুমকে মদিনার দায়িত্ব অর্পন করে তিনি একদল সাহাবাকে সাথে নিয়ে বনু নাদিরের বিরুদ্ধে যাত্রা শুরু করেন। মুসলিমরা মদিনায় বেশ অগ্নিমূর্তি ধারণ করে রওনা হয় যাতে মুনাফিকরা ভয় পায়। বনু নাদিরের এলাকা ছিল শহর থেকে একটু বাইরে। এই অভিযানে আলী রা.-কে পতাকা বহন করার জন্য দেওয়া হয়।
 
এদিকে বনু নাদির মুসলিমদের তৎক্ষণাৎ প্রতিক্রিয়ায় হতচকিত হয়ে তাদের দুর্গের ভেতর আশ্রয় নিয়ে অবরুদ্ধ হয়ে পড়েছিলো। দুর্গের দরোজা বন্ধ করে দিয়ে তারা তীর ও পাথর নিক্ষেপ করতে শুরু করে। তাদের দূর্গের চারদিকে থাকা খেজুর গাছগুলোকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করেছিল মুসলিমরা। মদিনার আরেক দিকে থাকা অন্য ইহুদি গোত্র বনু কুরাইজা যাতে এদের সাহায্যে আসার সাহস না পায় সেজন্য একটি ঘোড়সওয়ার দলকে সেদিকে টহলে পাঠালেন। টহল দেখে বনু কুরাইজা ভেবেছে তাদের পরিকল্পনার খবর পেয়ে মুহাম্মদ সা. তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। তাই তারা আগে থেকেই জানিয়ে দেয়, তারা মদিনা সনদের চুক্তিতে আস্থাশীল এবং বনু নাদিরকে তারা সহায়তা করবে না।
 
বনু কুরাইজার এই আত্মসমর্পন দেখে আব্দুল্লাহ ইবনে উবাই দমে যায়। বনু নাদিরের স্বজাতিরাই যেহেতু পিছিয়ে গেছে তাই সেও পিছিয়ে গেছে। বনু গাতফানও দেখলো আব্দুল্লাহ বিন উবাই ও বনু কুরাইজা কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না তাই তারাও আর এগিয়ে আসে নি। এদিকে মুসলিমরাও বনু নাদিরকে আত্মসমর্পণ করাতে পারছে না। তাদের দুর্গ ছিলো সুরক্ষিত। সেগুলো ভাঙাও যাচ্ছে না।
 
বনু নাদির চিন্তা করেছে তাদের কাছে পর্যাপ্ত খাবার মজুদ রয়েছে। এভাবে দীর্ঘদিন অবরোধ করে এক পর্যায়ে মুহাম্মদ সা. ধৈর্য হারিয়ে অবরোধ তুলে নিবেন অথবা সন্ধির প্রস্তাব দিবেন। এদিকে রাসূল সা. চিন্তা করলেন, অবরোধ দীর্ঘ হলে তাদের সাহস বেড়ে যাবে। মুসলিম সৈন্যদেরও মনোবল কমে যাবে। বাইরের দুশমনরা একত্রিত হওয়ার সুযোগ পাবে। তাই তিনি তাদের কনফিডেন্সের উৎসে আঘাত হানলেন। তাদের খেজুর বাগানের একটা অংশ তিনি কেটে ফেলতে নির্দেশ দিলেন। তাদের খেজুর বাগান নষ্ট হচ্ছে দেখে তারা সাহস হারিয়ে ফেললো। আগামী বছর তারা কী খাবে এই নিয়ে আতংক তৈরি হলো।
 
এই আতংক থেকে তারা আত্মসমর্পনের সিদ্ধান্ত নিলো। ফলে অবরোধ দীর্ঘায়িত হয়নি। ছয়-সাত রাত, মতান্তরে পনেরো রাত। এই সময়ের মধ্যে তারা স্বেচ্ছায় অস্ত্র সমর্পণ করতে রাজি হয়। রাসূল সা. তাদের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে গেলে আব্দুল্লাহ ইবনে উবাই তাদের পক্ষে সাফাই করতে থাকে। রাসূলের সিদ্ধান্ত অমান্য করার শাস্তি যাতে তাদের দেওয়া না হয় এজন্য নান্ন কথা বলে তদবির শুরু করে। রাসূল সা. এই আবেদন অনুমোদন করেন। তিনি সিদ্ধান্ত দেন, বনু নাদির মদিনা থেকে বের হয়ে যাবে। সাথে অস্ত্র ও যুদ্ধ সরঞ্জাম বাদে যা কিছু নেওয়া সম্ভব তা নিতে পারবে।
 
বনু নাদিরের অধিকাংশ ইহুদি খাইবারে আশ্রয় নেয়। বাকীরা সিরিয়ার পথে রওয়ানা দেয়। তবে হাতে গোণা কয়েকজন ইসলাম গ্রহণ করেন। মুসলিমরা তাদের স্বাগত জানায়। তাদের সম্পদ তাদের কাছেই থাকে। এটা ছাড়া শর্তানুযায়ী বাকি ইহুদীদের অস্ত্রশস্ত্র, জমি, ঘর ও বাগান নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নেয় মুসলিমরা। অস্ত্রের মধ্যে ৫০টি বর্ম, ৫০টি খুদ ৩৪০টি তরবারি ছিলো।
এই ঘটনাকে উদ্দেশ্য করে মহান রাব্বুল আলামীন সূরা হাশর নাজিল করেছেন। আল্লাহ তায়ালা সূরা হাশরের ২ - ৪ নং আয়াতে বলেন,

//তিনিই আহলে কিতাবদের মধ্যে যারা কাফের, তাদেরকে প্রথমবার একত্রিত করে তাদের বাড়ী-ঘর থেকে বহিস্কার করেছেন। তোমরা ধারণাও করতে পারনি যে, তারা বের হবে এবং তারা মনে করেছিল যে, তাদের দূর্গগুলো তাদেরকে আল্লাহর কবল থেকে রক্ষা করবে। অতঃপর আল্লাহর শাস্তি তাদের উপর এমনদিক থেকে আসল, যার কল্পনাও তারা করেনি। আল্লাহ তাদের অন্তরে ত্রাস সঞ্চার করে দিলেন। তারা তাদের বাড়ী-ঘর নিজেদের হাতে এবং মুসলমানদের হাতে ধ্বংস করছিল। অতএব, হে চক্ষুষ্মান ব্যক্তিগণ, তোমরা শিক্ষা গ্রহণ কর।

আল্লাহ যদি তাদের জন্যে নির্বাসন অবধারিত না করতেন, তবে তাদেরকে দুনিয়াতে শাস্তি দিতেন। আর পরকালে তাদের জন্যে রয়েছে জাহান্নামের আযাব। এটা এ কারণে যে, তারা আল্লাহ ও তাঁর রসূলের বিরুদ্ধাচরণ করেছে। যে আল্লাহর বিরুদ্ধাচরণ করে, তার জানা উচিত যে, আল্লাহ কঠোর শাস্তিদাতা।//

এখানে এটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল যে, তারা ভয় পেয়ে গিয়েছিল। এমন পরিস্থিতি হবে তা ইহুদিরাতো কল্পনা করেনি, মুসলিমরাও ভাবতে পারে নি এত সহজে বনু নাদির আত্মসমর্পন করবে। এখানে আল্লাহ তায়ালা আরো বলেছেন তারা যদি আত্মসমর্পন না করে, দেশান্তরী না হয়ে যুদ্ধ করতো তবে তাদের জন্য আরো ভয়ংকর শাস্তি অপেক্ষা করতো। যেমন শাস্তি পেয়েছে খন্দক যুদ্ধের পরে বনু কুরাইজা।
 
সূরা হাশরের ৪ নং আয়াতে আল্লাহ তায়ালা আরেকটি প্রসঙ্গ টেনে এনেছেন যাতে করে মুসলিমরা হীনমন্যতায় না ভুগে। বনু নাদির যাতে দ্রুতই আত্মসমর্পন করে সেজন্য রাসূল সা.-এর নির্দেশে মুসলিম সেনাবাহিনী বনু নাদিরের কিছু খেজুর গাছ কেটে ফেলে। আল্লাহ বলেন,

//তোমরা যে কিছু কিছু খেজুর গাছ কেটে দিয়েছ এবং কিছু না কেটে ছেড়ে দিয়েছ, তা তো আল্লাহরই আদেশ এবং যাতে তিনি অবাধ্যদেরকে লাঞ্ছিত করেন।//

বনু নাদিরের ইহুদীরা সম্পদশালী ছিল। তাদের গর্বের একটি বড় কারণ ছিল তারা অনেক খেজুর বাগানের মালিক। অর্থাৎ তাদের খাদ্যের অভাব হবে না। কিন্তু তারা যখন দেখলো মুহাম্মদ সা. তাদের গাছগুলোর কিছু কিছু কেটে ফেলতে শুরু করেছে তখন তারা বিচলিত হয়ে পড়লো। কারণ তারা জানতো মুসলিমদের যুদ্ধনীতিতে ফসলের গাছ কাটা নিষেধ।
 
যখন মুসলিম বাহিনী খেজুর গাছ নষ্ট করে দিচ্ছিলেন তখন মদিনার মুনাফিকরা ও বনু নাদির গোত্রের লোকও হৈ চৈ করতে শুরু করলো যে, মুহাম্মাদ সা. "ফাসাদ ফিল আরদ" বা পৃথিবীতে বিপর্যয় সৃষ্টি করতে নিষেধ করেন; কিন্তু দেখো, তরুতাজা শ্যামল ফলবান গাছ কাটা হচ্ছে ৷ এটি কি "ফাসাদ ফিল আরদ" নয়? এই সময় আল্লাহ তা'আলা এই নির্দেশ নাযিল করেলেন, "তোমরা যেসব গাছ কেটেছো এবং যা না কেটে অক্ষত রেখেছো এর কোন একটি কাজও নাজায়েয নয় ৷ বরং এ উভয় কাজেই আল্লাহর সম্মতি রয়েছে।"
 
এ থেকে শরীয়াতের এ বিধানটি পাওয়া যায় যে, সামরিক প্রয়োজনে যেসব ধ্বংসাত্মক ও ক্ষতিকর তৎপরতা অপরিহার্য হয়ে পড়ে তা "ফাসাদ ফিল আরদ" বা পৃথিবীতে বিপর্যয় ও অশান্তি সৃষ্টির সংজ্ঞায় পড়ে না ৷ "ফাসাদ ফিল আরদ" হলো কোন সেনাবাহিনীর মাথায় যদি যুদ্ধের ভূত চেপে বসে এবং তারা শত্রুর দেশে প্রবেশ করে শস্যক্ষেত, গবাদি পশু, বাগান, দালানকোঠা, প্রতিটি জিনিসই নির্বিচারে ধ্বংস ও বরবাদ করতে থাকে। হযরত আবু বকর সিদ্দিক সিরিয়ায় সেনাবাহিনী পাঠানোর সময় যে নির্দেশ দিয়েছিলেন যুদ্ধের ব্যাপারে সেটিই সাধারণ বিধান। তিনি নির্দেশ দিয়েছিলেন, ফলবান বৃক্ষ কাটবে না, ফসল ধ্বংস করবে না এবং তিনি জনবসতি বিরাণ করবে না।
 
কুরআনে বিপর্যয় সৃষ্টিকারী মানুষদের নিন্দা ও সমালোচনা করতে গিয়ে এ কাজের জন্য তাদের তিরষ্কার ও ভীতি প্রদর্শন করে বলা হয়েছেঃ "যখন তারা ক্ষমতাসীন হয় তখন শস্যক্ষেত ও মানব বংশ ধ্বংস করে চলে।" (বাকারাহ : ২০৫) হযরত আবু বকরের রা. এর নীতি ছিল কুরআনের এ শিক্ষারই হুবহু অনুসরণ। তবে সামরিক প্রয়োজন দেখা দিলে বিশেষ নির্দেশ হলো, শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধে জয়লাভের জন্য কোনো ধ্বংসাত্মক কাজ অপরিহার্য হয়ে পড়লে তা করা যেতে পারে।
 
এরপর আল্লাহ তায়ালা সূরা হাশরের ৬ থেকে ১০ নং আয়াতে বনু নাদির থেকে প্রাপ্ত সম্পদ কীভাবে বন্টিত হবে তা নিয়ে আলোচনা করেছেন। অবরোধের একটা পর্যায়ে যখন বনু নাদির বুঝতে পারলো কেউ তাদের সাহায্যে এগিয়ে আসবে না তখন তারা ভীত হয়ে পড়লো। তারা মুহাম্মদ সা.-এর কাছে প্রাণভিক্ষা চাইলো। মুহাম্মদ সা. তাদের প্রাণের নিরাপত্তা দিতে রাজি হলেন এবং মদিনা থেকে তাদের চলে যাওয়ার নির্দেশ দিলেন। সেই সাথে তাদের জানালেন তারা শুধু ততটুকু সম্পদ নিতে পারবে যতটুকু উটের পিঠে বোঝাই করা সম্ভব। তবে কোনো অস্ত্র নেওয়া যাবে না। সব অস্ত্র রেখে যেতে হবে।
 
বনু নাদির যখন চলে যায় তখন মুসলিমরা অনেক সম্পদ পায়। এই সম্পদ পাওয়ার জন্য মুসলিমদের যুদ্ধ করতে হয় নি। তাই এই সম্পদকে গণিমত না বলে ফাই বলা হয়। গণিমতের বিধান আর ফাইয়ের বিধান একই রকম নয়। আল্লাহ তায়ালা বলেন,
 
// আল্লাহ তাদের কাছ থেকে তাঁর রসূলকে যে ধন-সম্পদ দিয়েছেন, তজ্জন্যে তোমরা ঘোড়ায় কিংবা উটে চড়ে যুদ্ধ করনি, কিন্তু আল্লাহ যার উপর ইচ্ছা, তাঁর রসূলগণকে প্রাধান্য দান করেন। আল্লাহ সবকিছুর উপর সর্বশক্তিমান। আল্লাহ জনপদবাসীদের কাছ থেকে তাঁর রসূলকে যা দিয়েছেন, তা আল্লাহর, রসূলের, তাঁর আত্নীয়-স্বজনের, ইয়াতীমদের, অভাবগ্রস্তদের এবং মুসাফিরদের জন্যে, যাতে ধনৈশ্বর্য্য কেবল তোমাদের বিত্তশালীদের মধ্যেই পুঞ্জীভূত না হয়। রসূল তোমাদেরকে যা দেন, তা গ্রহণ কর এবং যা নিষেধ করেন, তা থেকে বিরত থাক এবং আল্লাহকে ভয় কর। নিশ্চয় আল্লাহ কঠোর শাস্তিদাতা। এই ধন-সম্পদ দেশত্যাগী নিঃস্বদের জন্যে, যারা আল্লাহর অনুগ্রহ ও সন্তুষ্টিলাভের অন্বেষণে এবং আল্লাহ তাঁর রসূলের সাহায্যার্থে নিজেদের বাস্তুভিটা ও ধন-সম্পদ থেকে বহিস্কৃত হয়েছে। তারাই সত্যবাদী //

মহান রাব্বুল আলামীন এখানে বিস্তারিত বলে দিয়েছেন ফাইয়ের সম্পদ কীভাবে বন্টিত হবে। রাসূল সা. এই সম্পদ থেকে যৎসামান্য নিজের ও তার পরিবারের জন্য গ্রহণ করেন। এই সম্পদ দেওয়া হয়েছে মূলত মুহাজিরদেরকে যারা তাদের সর্বস্ব ত্যাগ করে মদিনায় এসেছেন। একইসাথে মুহাজিররা এতোদিন আনসারদের যেসব সম্পদ ব্যবহার করতো সেগুলোও আনসার ফেরত দিয়ে নিজেরাই স্বাবলম্বী হতে থাকেন।
 
এখান থেকে আমরা এই বিধান 'ফাই' যোদ্ধাদের মধ্যে বন্টিত হবে না গণিমতের মতো। এটা রাষ্ট্রীয় সম্পত্তি। রাষ্ট্র এটি অভাবগ্রস্থ, যুদ্ধাহত, মুসাফির অর্থাৎ রাষ্ট্রের মধ্যে যারা অসহায় তাদের মধ্যে বন্টন করবে।
 
এরপর মহান রাব্বুল আলামীন মুনাফিকদের চরিত্র সম্পর্কে আমাদের জানান। তিনি হাশরের ১১ থেকে ১৭ নং আয়াতে আব্দুল্লাহ বিন উবাইদের বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করেন,
 
//আপনি কি মুনাফিকদেরকে দেখেন নি? তারা তাদের কিতাবধারী কাফের ভাইদেরকে বলে, তোমরা যদি বহিস্কৃত হও, তবে আমরা অবশ্যই তোমাদের সাথে দেশ থেকে বের হয়ে যাব এবং তোমাদের ব্যাপারে আমরা কখনও কারও কথা মানবো না। আর যদি তোমরা আক্রান্ত হও, তবে আমরা অবশ্যই তোমাদেরকে সাহায্য করব। আল্লাহ তা’আলা সাক্ষ্য দেন যে, ওরা নিশ্চয়ই মিথ্যাবাদী।

যদি তারা (বনু নাদির) বহিস্কৃত হয়, তবে মুনাফিকরা তাদের সাথে দেশত্যাগ করবে না আর যদি তারা আক্রান্ত হয়, তবে তারা তাদেরকে সাহায্য করবে না। যদি তাদেরকে সাহায্য করে, তবে অবশ্যই পৃষ্ঠপ্রদর্শন করে পলায়ন করবে। এরপর কাফেররা কোন সাহায্য পাবে না। নিশ্চয়ই তারা আল্লাহর চাইতে তোমাদের বেশি ভয় করে। এটা এ কারণে যে, তারা এক নির্বোধ সম্প্রদায়।
 
তারা সংঘবদ্ধভাবেও তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে পারবে না। তারা যুদ্ধ করবে কেবল সুরক্ষিত জনপদে অথবা দুর্গ প্রাচীরের আড়াল থেকে। তাদের পারস্পরিক কোন্দল প্রচন্ড হয়ে থাকে। আপনি তাদেরকে ঐক্যবদ্ধ মনে করবেন; কিন্তু তাদের অন্তর শতধাবিচ্ছিন্ন। এটা এ কারণে যে, তারা এক কান্ডজ্ঞানহীন সম্প্রদায়।

তারা সেই লোকদের মত, যারা তাদের নিকট অতীতে নিজেদের কর্মের শাস্তিভোগ করেছে। তাদের জন্যে রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি। তারা শয়তানের মত, যে মানুষকে কাফের হতে বলে। অতঃপর যখন সে কাফের হয়, তখন শয়তান বলেঃ তোমার সাথে আমার কোন সম্পর্ক নেই। আমি বিশ্বপালনকর্তা আল্লাহ তা’আলাকে ভয় করি। অতঃপর উভয়ের পরিণতি হবে এই যে, তারা জাহান্নামে যাবে এবং চিরকাল তথায় বসবাস করবে। এটাই জালেমদের শাস্তি।//
 
যারা দ্বীন কায়েমের জন্য কাজ করে যাচ্ছেন তাদের জন্য এখানে বড় শিক্ষা রয়েছে। মুনাফিক, কাফিরদের ও ইসলামী রাষ্ট্রের শত্রুদের কীভাবে কন্ট্রোল করতে হবে তার শিক্ষা এই ঘটনায় বিশদভাবে রয়েছে। এছাড়া সূরা হাশরেও আল্লাহ তায়ালা কর্তৃক এই ঘটনার পর্যালোচনা রয়েছে। আমাদের বেশি বেশি এসব পর্যালোচনা পড়া ও শিক্ষাগ্রহণ করা উচিত। মহান রাব্বুল আলামীন আমাদের শিক্ষাগ্রহণ করার তাওফিক দান করুন। আমিন।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন