৯ জুল, ২০২১

হাইতিতে কী হচ্ছে?


সম্প্রতি হাইতির প্রেসিডেন্ট নিজের বাসায়ই গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা গেছেন। এটা শুনতে বেশ আশ্চর্যজনক হলেও যারা হাইতির খোঁজখবর রাখেন তাদের জন্য এটা খুব বেশি অবাক কাণ্ড মনে হবে না।

স্পেনের নাবিক ক্রিস্টোফার কলম্বাস আনুমানিক ১৪৯১ সালে এই ভূখণ্ডটির সন্ধান পান। তখন থেকেই স্পেনীয়রা এখানে উপনিবেশ তৈরি করে ও এখানকার আদিবাসীদের দাস বানিয়ে রাখে। পরে ফরাসিরা এখানে উপনিবেশ গড়ে তোলে। ফরাসীরা এখানে খনিজ সম্পদের সন্ধান করে। এখানে সোনা, কয়লা ও তেলের সন্ধান পাওয়া যায়। ফ্রান্স এগুলো লুট করে। ১৭ ও ১৮ শতকের শিল্প বিপ্লবের সময় পশ্চিম আফ্রিকা থেকে প্রায় আট লাখ মানুষ হাইতিতে ধরে এনে দাস বানিয়ে খামারে ও খনিতে অমানবিক পরিশ্রম করায়। ১৭৯১ সাল থেকে হাইতির দাসেরা তাদের মালিকদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে।

১৮০৪ সালে আফ্রিকা থেকে আসা দাসেরা সফল বিপ্লব করতে সক্ষম হয়। হাইতি লাতিন আমেরিকার প্রথম স্বাধীন দেশ হিসেবে আবির্ভূত হয়। যদিও দাসেরা বিপ্লব করে তারপরও এখানকার মানুষের ভাগ্যের উন্নয়ন হয়নি। এনিমেল ফার্মের মতো ঘটনা ঘটে। বিপ্লবীদের মধ্যে অভিজাত শ্রেণি গড়ে ওঠে। তারা সংখ্যায় ক্ষুদ্র হলেও তারাই প্রভাবশালী ও হাইতির সকল সম্পদের মালিক হিসেবে আবির্ভূত হয়।

অন্যদিকে আছে বিশাল নিম্নবিত্ত শ্রেণী যাদের কোন ক্ষমতা নেই। সম্পদ নেই। তারা চিকিৎসাও পায় না। বর্তমানে হাইতি আমেরিকা মহাদেশের সবচেয়ে দরিদ্র দেশ। অনেক হাইতীয় দেশ ছেড়ে চলে গেছেন। হাইতির শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখতে বাংলাদেশি শান্তিরক্ষীরা সেখানে কাজ করে। হাইতিতে কিছু বাংলাদেশ-ভিত্তিক এনজিও (যেমন গ্রামীণ ব্যাংক, ব্রাক ইত্যাদি) কাজ করে চলেছে। হাইতির এই গোলযোগ অবস্থা তৈরি করে রেখেছে ফ্রান্স। তারাই একনায়কদের হাতের পুতুল বানিয়ে রেখেছে।

গরীবরা দীর্ঘদিন শোষিত হওয়ায় তাদের মধ্যে ক্রিমিনাল গ্যাং তৈরি হয়েছে। প্রায় প্রতিটি এলাকায় ক্রিমিনাল গ্যাং-এর দৌরাত্ম রয়েছে। এ কারণে এখানে চুরি, ডাকাতি, খুন খুবই অহরহ। জান-মালের নিরাপত্তা এখানে ক্রিমিনাল গ্যাং দিয়েও যেমন লুন্ঠিত হয়, তেমনি সরকারি গুম, খুন, বিনা বিচারে আটক ইত্যাদিও অব্যাহত আছে। জেল ভেঙ্গে অপরাধীদের পালিয়ে যাওয়াও কমন ঘটনা এখানে। গত ফেব্রুয়ারি মাসে একটা ক্রিমিনাল গ্যাং জেল আক্রমণ করে তাদের গ্যাং-এর সবাইকে মুক্ত করে নিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছে।

গত পরশু হাইতির প্রেসিডেন্ট জোভনেল ময়েজকে বুধবার তার বাড়িতে হত্যা করা হয়েছে৷ ময়েজের ক্ষমতা গ্রহণ থেকেই সে প্রতিরোধের মুখে পড়েছে তার বিরোধীদের দ্বারা। ময়েজ ২০১৫ সালে নির্বাচনে জিতেছিলেন৷ কিন্তু কারচুপির অভিযোগে সেটা বাতিল করে আবারও তাকে নির্বাচনে অংশ নিতে বাধ্য করা হয়। ময়েজ সেটিও জেতেন৷ অবশেষে ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে তিনি শপথ গ্রহণ করেন৷ দায়িত্ব নিয়ে ময়েজ সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে শক্তিশালী করা ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই করতে চেয়েছিলেন৷

ময়েজ কতটুকু আন্তরিক ছিলেন দেশরক্ষার ব্যাপারে সেটা বলা মুশকিল, তবে তিনি দেশি-বিদেশি সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। পুলিশে চরম দুর্নীতি ও বিশৃঙ্খলা থাকায় তিনি আবার সেনাবাহিনী গঠন করেছিলেন। সম্ভবত এই সিদ্ধান্তই তাকে বিপদের দিকে ঠেলে দেয়। পুলিশ ও বিচার বিভাগ তার বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। ২০২০ সালের জানুয়ারিতে সংসদ ভেঙে দেয়ার পর থেকে তিনি ডিক্রি জারির মাধ্যমে দেশ পরিচালনা করে আসছিলেন৷

তখন থেকেই তার বিরোধীরা তার বিরুদ্ধে বিক্ষোভ ও আন্দোলন শুরু করে। এ বছরের ফেব্রুয়ারিতে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদকে ময়েজ জানিয়েছিলেন যে, ক্ষমতা থেকে তাকে সরাতে এ পর্যন্ত সাতবার চেষ্টা করা হয়েছে৷ একই মাসে তিনি জানিয়েছিলেন, তাকে হত্যাচেষ্টার দায়ে ২০ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে৷ তবে আদালত পরবর্তীতে ময়েজের অভিযোগ খারিজ করে গ্রেপ্তারকৃতদের মুক্তি দিয়েছিল৷ এদের মধ্যে একজন বিচারক ও পুলিশের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ছিলেন৷

হাইতির ১ম নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট অ্যারিস্টাইডের বিরুদ্ধেই একনায়কতন্ত্রের অভিযোগ সবচেয়ে বেশি। তিনি সেনাবাহিনী দিয়ে দেশ পরিচালনা করতেন। ১৯৯৫ সালে তার বিরুদ্ধে বিপ্লব করে তার বিরোধীরা। তাকে ক্ষমতাচ্যুত করে। সেই সময়ে বিদেশী যারা সমঝোতা করেছিল তাদের পরামর্শে হাইতিতে সেনাবাহিনী বাতিল হয়। হাইতিয়ানরা ভেবেছে এর মাধ্যমে তারা একনায়ক থেকে বাঁচবে। কিন্তু সেনাবাহিনী বিলুপ্ত হওয়ার হাইতির আইন-শৃঙ্খলা ও সার্বভৌমত্ব আরো বিনষ্ট হয়েছে।

ময়েজ সেনাবাহিনী পুনর্গঠন করে পুলিশের কিছু উর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও বিচার বিভাগের বিরাগভাজন হয়েছে। ময়েজ খুনের পর রাষ্ট্রের দায়িত্ব নেন প্রধানমন্ত্রী ক্লদ জোসেফ। ক্লদ জোসেফও নতুন নিয়োগ হয়েছেন। এই এপ্রিলে তিনি প্রধানমন্ত্রী হন। আগের প্রধানমন্ত্রী জোসেফ জুট হাইতিতে চলা অব্যাহত বিক্ষোভ ও সঙ্ঘর্ষের মুখে পদত্যাগ করেন।

প্রধানমন্ত্রী ক্লদ জোসেফ জানায়, নিরাপত্তা রক্ষীরা চার সন্দেহভাজনকে হত্যা করেছে এবং দুইজনকে গ্রেপ্তার করেছে৷ তবে তাদের পরিচয় বা প্রেসিডেন্টকে হত্যার উদ্দেশ্য সম্পর্কে বিস্তারিত কিছু জানানো হয়নি৷ তবে যতদূর বুঝা যাচ্ছে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষরা ময়েজকে খুন করেনি যদিও তারা শক্ত আন্দোলন করে যাচ্ছে। খুনী হিসেবে সন্দেহ করা হচ্ছে পুলিশের মধ্যে থাকা বিদ্রোহী দলকে যারা আগেও অভ্যুত্থানের চেষ্টা করেছিল।

গত ৭ ফেব্রুয়ারি থেকে দ্বন্দ্ব বাড়ছিল৷ কারণ বিরোধীরা দাবি করছিলেন যে, প্রেসিডেন্ট হিসেবে ময়েজের মেয়াদ শেষ৷ কিন্তু ময়িজের যুক্তি ছিল তিনি ২০১৫ সালে নির্বাচনে জিতলেও শপথ নিয়েছেন ২০১৭ সালে৷ সুতরাং তার মেয়াদ ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে শেষ হবে বলে দাবি করেছিলেন তিনি৷ এরপরও বিরোধীদের দাবির মুখে ময়েজ চলতি বছরের সেপ্টেম্বরে নির্বাচনের ঘোষণা দিয়েছিলেন৷ রাজনৈতিক অস্থিরতার সুযোগ নিয়েছে পুলিশের মধ্যে থাকা বিদ্রোহীরা।

প্রেসিডেন্ট খুন হওয়ায় সংবিধান অনুযায়ী সুপ্রিম কোর্টের সভাপতির এখন দায়িত্ব নেয়ার কথা৷ কিন্তু তিনি সম্প্রতি করোনায় মারা গেছেন৷ ফলে নতুন নেতা হিসেবে একজনকে নির্বাচিত করার কথা সংসদের৷ কিন্তু সেটাও সম্ভব নয়৷ কারণ সংসদ ভেঙে দেওয়া হয়েছে এবং সংসদের মেয়াদও শেষ। এখন প্রধানমন্ত্রী ক্লদ জোসেফকেই সব দায়িত্ব নিতে হবে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এনে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ব্যবস্থা করতে হবে।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন