৫ জুল, ২০২১

সূরা কাফিরুন ও ধর্মনিরপেক্ষতা



ঘটনাটা মক্কায়! উমার রা. ইসলাম গ্রহণ করলেন। এরপর মুসলিমরা সাফা পর্বতের পাদদেশ থেকে মিছিল বের করলেন। এই প্রসঙ্গে উমার রা. বলেন, আমরা দুই কাতারে বিভক্ত হয়ে মিছিল শুরু করলাম। এক কাতারে ছিলেন হামজা, অন্য কাতারে আমি, আমাদের চলার পথে যাঁতার পেষা আটার মতো ধুলো উড়ছিলো। আমরা মসজিদে হারামে প্রবেশ করলাম। মুশরিকরা আমাদের মিছিল দেখে মনে এত বড় কষ্ট পেলো, যা ইতিপূর্বে পায়নি। সেই দিন কা'বা চত্বরে রাসূলুল্লাহ সা. আমাকে 'ফারুক' উপাধি দিলেন।

হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. বলেন, এর আগে আমরা কাবাঘরের কাছে নামায আদায়ে সক্ষম ছিলাম না। সুহাইব রুমি রা. বলেন, হযরত উমার ফারুক রা. মুসলমান হওয়ার পর ইসলাম পর্দার বাইরে এলো এবং ইসলামের দাওয়াত প্রকাশ্যে দেয়া শুরু হলো। আমরা কাবাঘরের সামনে গোল হয়ে বসতে লাগলাম এবং কাবাঘর তওয়াফ করতে লাগলাম, যারা আমাদের ওপর এতোদিন বাড়াবাড়ি করেছিলো, তাদের উপর আমরা এভাবেই প্রতিশোধ নিলাম এবং অত্যাচারের জবাব দিলাম।

যখন হযরত উমার রা. ঈমান আনলেন তখন কুরাইশ নেতারা কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে পড়েছিল। মুশরিক কুরাইশরা প্রথমেই এ দৃশ্য দেখে ভীত হয়ে পড়েছিল যে, ইসলামের দাওয়াতের নিয়ে তাদের মধ্য থেকে এমন এক ব্যক্তি উঠেছেন যিনি নিজের পারিবারিক আভিজাত্য, নিষ্কলংক চরিত্র, বুদ্ধিমত্তা, প্রজ্ঞা ও বিচার বিবেচনার দিক দিয়ে সমস্ত জাতির মধ্যে অদ্বিতীয়। তারপর আবু বকরের মতো লোক তাঁর ডানহাত, যাকে মক্কা ও তার আশপাশের এলাকার প্রত্যেকটি শিশুও একজন অত্যন্ত ভদ্র, বিবেচক, সত্যবাদী ও পবিত্র পরিচ্ছন্ন মানুষ হিসেবে জানে। এখন যখন তারা দেখলো, উমর ইবনে খাত্তাবের মতো অসম সাহসী ও দৃঢ় সংকল্প ব্যক্তিও এ দু’জনের সাথে মিলিত হয়েছেন তখন নিশ্চিতভাবেই তারা অনুধাবন করতে সক্ষম হলো যে, বিপদ সহ্যের সীমা অতিক্রম করে যাচ্ছে। তারা মুহাম্মদ সা.-এর দাওয়াত বন্ধ করার জন্য পরিকল্পনা করতে থাকলো।

এদিকে চাচা আবু তালিব ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়লেন। মুশরিক কুরাইশ সরদাররা মনে করলো, এবার বুঝি আবু তালিবের শেষ সময় এসে গেছে। তখন তারা নিজেদের মধ্যে পরামর্শ করলো, হয় মুহাম্মদ সা.-এর সাথে তাদের বিবাদ মিটানো হবে নতুবা তাকে শেষ করে দেওয়া হবে। তারা মনে করলো এই বিষয়ে আবু তালিবের কাছে গিয়ে তার সাথে কথা বলা উচিত। তিনি আমাদের ও তাঁর ভাতিজার বিবাদ মিটিয়ে দিয়ে গেলে ভালো। নয়তো এমন ও হতে পারে, তার মৃত্যু হয়ে যাবে এবং আমরা পরে মুহাম্মাদ সা.-এর সাথে কোনো কঠোর ব্যবহার করবো। আর আরবের লোকেরা এ বলে আমাদের খোঁটা দেবে যে, যতদিন আবু তালিব জীবিত ছিলেন ততদিন এরা তাকে সমীহ করে চলেছে, এখন তার মৃত্যুর পর তার ভাতিজার গায়ে হাত তুলেছে।

তারা সবাই একমত হলো। আপোষ প্রস্তাব নিয়ে প্রায় ২৫ জন কুরাইশ নেতা আবু তালিবের কাছে গেল। এদের অন্যতম ছিলো আবু জাহেল, আবু সুফিয়ান, উমাইয়াহ ইবনে খালফ, আস ইবনে ওয়ায়েল, আসওযাদ ইবনুল মুত্তালিব, উকাবাহ ইবনে আবী মু’আইত, উতবাহ ও শাইবাহ। তারা যথারীতি প্রথমে আবু তালিবের কাছে মুহাম্মদ সা.-এর বিরুদ্ধে নিজেদের অভিযোগ পেশ করলো। তারপর বললো, আমরা আপনার কাছে একটি ইনসাফপূর্ণ আপোষের কথা পেশ করতে এসেছি। আর তা হলো আপনার ভাতিজা আমাদেরকে আমাদের ধর্মের ওপর ছেড়ে দিক আমরাও তাকে তার ধর্মের ওপর ছেড়ে দিচ্ছি। সে যে মাবুদের ইবাদত করতে চায় করুক, তার বিরুদ্ধে আমাদের কোনো আপত্তি নেই। কিন্ত সে আমাদের মাবুদদের নিন্দা করবে না এবং আমরা যাতে আমাদের মাবুদদেরকে ত্যাগ করি সে প্রচেষ্টা চালাবে না। এ শর্তের ভিত্তিতে আপনি তার সাথে আমাদের আপোষ করিয়ে দিন।

চাচা আবু তালিব নবী সা.-কে ডাকলেন। তাঁকে বললেন, ভাতিজা! এই যে তোমার সম্প্রদায়ের লোকেরা আমার কাছে এসেছে। তাদের ইচ্ছে, তুমি একটি ইনসাফপূর্ণ আপোষের ভিত্তিতে তাদের সাথে একমত হয়ে যাবে। এভাবে তোমার সাথে তাদের বিবাদ শেষ হয়ে যাবে। তারপর কুরাইশ সরদাররা তাঁকে যে কথাগুলো বলেছিল সেগুলো তিনি মুহাম্মদ সা.-কে বললেন। মুহাম্মদ সা. জবাবে বেশ কৌশলী হয়ে হিকমত সহকারে বললেন, “চাচাজান! আমি তো তাদের সামনে এমন একটি কথা পেশ করছি তা যদি তারা মেনে নেয় তাহলে সমগ্র আরব জাতি তাদের হুকুমের অনুগত হয়ে যাবে এবং অনারবরা তাদেরকে কর দিতে থাকবে।” একথা শুনে প্রথমে তো তারা হতভম্ব হয়ে গেল।

এবার আবু তালিব কুরাইশ নেতাদের বললেন, তোমরা আমার ভাতিজার কথা শুনলে তো আরব ও পৃথিবীর মালিক হয়ে যাবে। তাহলে বলো, মুহাম্মদের প্রস্তাব বেশি ভালো, না তোমরা ইনসাফের নামে যে কথাটি আমার সামনে পেশ করছো সেটি বেশি ভালো? রাসূল সা. আরো বললেন, তোমরা আমার কথাটি মেনে নেবে অথবা যে অবস্থার মধ্যে তোমরা এখন পড়ে রয়েছো তার মধ্যেই তোমাদের পড়ে থাকতে দেবো এবং নিজের জায়গায় বসে আমি নিজের আল্লাহর ইবাদত করতে থাকবো কোনটির মধ্যে তোমাদের কল্যাণ রয়েছে? আমি তো তোমাদের কল্যাণের জন্যই কাজ করছি।

তারা বুঝতে পারছিল না এমন একটি লাভজনক কথার প্রতিবাদ কীভাবে করবে? কাজেই তারা নিজেদের বক্তব্য থেকে সরে এসে বললো, তুমি একটি কথা বলছো কেন, আমরা তো এমন দশটি কথা মানতে রাজি কিন্তু সেই কথাটি কি তাতো একবার বলো। মুহাম্মদ সা. বললেন, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ। একথা শুনেই তারা সবাই একসাথে উঠে দাঁড়ালো এবং সে কথাগুলো বলতে বলতে চলে গেলো যা আল্লাহ সূরা সোয়াদের শুরুতে উদ্ধৃত করেছেন।

সূরা সোয়াদের ৪ থেকে ৮ নং আয়াতে রয়েছে, মুশরিকরা আল্লাহর রাসূল সা. সম্পর্কে বলেছিলো, “এ হচ্ছে যাদুকর, বড়ই মিথ্যুক। সকল প্রভুর বদলে সেকি মাত্র একজনকেই প্রভু বানিয়ে নিয়েছে? এতো বড় বিস্ময়কর কথা! নেতারা একথা বলতে বলতে বের হয়ে গেলো, “চলো, অবিচল থাকো নিজেদের প্রভুদের উপাসনায়। একথা তো (রাসূল সা.-এর প্রস্তাব) বিভ্রান্ত করার উদ্দেশ্যেই বলা হচ্ছে। আমরা অতীতের জাতিগুলোর মধ্য থেকে কারো কাছ থেকে তো এ ধরনের কথা শুনিনি। এটি একটি মনগড়া কথা ছাড়া আর কিছুই নয়। আমাদের মধ্য থেকে কেবল এ ব্যক্তির ওপরই কি আল্লাহর কুরআন নাযিল করা হল?

মুশরিকদের পরিকল্পনা কাজ না করায় তারা নতুন প্রস্তাব নিয়ে মুহাম্মদ সা.-এর কাছে এলো। এই প্রসঙ্গে আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. বলেন, মুশরিকরা মুহাম্মদ সা.-কে বললো, আমরা আপনাকে এত বেশী পরিমাণ ধন- সম্পদ দেবো যার ফলে আপনি মক্কার সবচেয়ে ধনাঢ্য ব্যক্তি হয়ে যাবেন। যে মেয়েটিকে আপনি পছন্দ করবেন তার সাথে আপনার বিয়ে দিয়ে দেবো। আমরা আপনার নেতা মেনে আপনার পিছনে চলতে প্রস্তুত। আপনি শুধু আমাদের একটি কথা মেনে নেবেন।

মুহাম্মদ সা. বললেন, কী সেই কথা?

তারা বললো, আমাদের উপাস্যদের নিন্দা করা থেকে বিরত থাকবেন। আপনি হয়তো এ প্রস্তাবটি পছন্দ করবেন না। আপনার পছন্দ না হলে আমরা আরো একটি প্রস্তাব পেশ করছি। এ প্রস্তাবে আপনার লাভ এবং আমাদেরও লাভ।

মুহাম্মদ সা. বললেন, বলো তোমাদের সেই প্রস্তাব।

তারা বললো, এক বছর আপনি আমাদের উপাস্যদের ইবাদাত করবেন এবং আমরাও এক বছর আপনার উপাস্যের ইবাদাত করবো।

এই প্রস্তাবের প্রেক্ষিতে আল্লাহ তায়ালা সূরা কাফিরুন নাজিল করে জানিয়ে দিয়েছেন মুসলিম এবং মুশরিকের রাস্তা আলাদা। এরকম মিল সমন্বয়ের কোনো স্থান ইসলামে নেই।

//আল্লাহ তায়ালা মুহাম্মদ সা.-কে বলেন, বলে দাও, হে কাফেররা! তোমরা যার ইবাদাত করো আমি তার ইবাদাত করি না এবং আমি যার ইবাদাত করি তোমরা তার ইবাদাতকারী নও। তোমরা যার ইবাদত করছো, আমি তার ইবাদাতকারী হবো না। আর আমি যার ইবাদাত করি তোমরা তার ইবাদাতকারী হবে না। তোমাদের দ্বীন তোমাদের জন্য এবং আমার দ্বীন আমার জন্য।//

আল্লাহ তায়ালা এই সূরার মাধ্যমে আমাদেরকে কাফেরদের থেকে আলাদা করে দিয়েছেন। মুসলিমদের দ্বীন আলাদা এবং কাফেরদের দ্বীন আলাদা। আমরা তোমাদের মাবুদদের পূজা-উপাসনা-বন্দেগী করি না এবং তোমরাও আমাদের মাবুদের পূজা-উপাসনা করো না। আমরা তোমাদের মাবুদদের বন্দেগী করতে পারি না এবং তোমরা আমাদের মাবুদের বন্দেগী করতে প্রস্তুত নও। তাই আমার ও তোমার পথ কখনো এক হতে পারে না। এটা কাফেরদের প্রতি উদারনীতি নয় বরং তারা কাফের থাকা অবস্থায় চিরকালের জন্য তাদের ব্যাপারে দায়মুক্তি, সম্পর্কহীনতা ও অসন্তোষের ঘোষণাবাণী।

আর আল্লাহ‌ ও তাঁর রসূলের প্রতি যারা ঈমান এনেছে তারা দ্বীনের ব্যাপারে কখনো তাদের সাথে সমঝোতা করবে না। এ ব্যাপারে তাদেরকে সর্বশেষ ও চূড়ান্তভাবে নিরাশ করে দেয়াই এই সূরার উদ্দেশ্য। অথচ স্বৈরাচারি হাসিনা গত ৩ জুলাই সংসদে দেওয়া বক্তব্যে এই সূরা উল্লেখ করে বলতে চায় আল্লাহ নাকি ধর্মনিরপেক্ষতাকে বৈধতা দিয়েছেন। অথচ এই সূরার মাধ্যমে স্পষ্ট করা হয়েছে মুসলিমরা ধর্মের ব্যাপারে নিরপেক্ষ থাকতে পারবে না। সে ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় সর্বক্ষেত্রে আল্লাহর ইবাদত করতে বাধ্য। ইসলাম শুধু ব্যক্তিগত বিধান দেয়নি, রাষ্ট্রীয় বিধানও দিয়েছে।

ধর্মনিরপেক্ষতার মূল কথা হলো রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় ধর্মীয় বিধানকে দূরে রাখা। যা স্পষ্টত কুফরি। রাষ্ট্র পরিচালনায় ইসলামকে দূরে রাখার মানে আল্লাহর দেওয়া বিধানের লাঞ্ছনা ও অবমাননা। এটা আল্লাহর সাথে যুদ্ধ ঘোষণার শামিল। 

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন