৭ জুল, ২০২১

পর্ব : ২২ - রাজি'র মর্মান্তিক ঘটনা ও খুবাইব রা.-এর শাহদাত



উহুদ যুদ্ধের পরপরই বনু আসাদ ইবনে খুজাইমা গোত্র মুসলিমদের বিরুদ্ধে আগ্রাসনের প্রস্তুতি নেয়। তারা ভেবেছিল যেহেতু মুহাম্মদ সা. আহত হয়েছিলেন ও অনেক ক্ষতির সম্মুখিন হয়েছে তাই এখনই সুযোগ দুর্বল মুসলিমদের ওপর আঘাত হানা। মুহাম্মদ সা.-এর গোয়েন্দারা এই খবর দেওয়ার সাথে সাথেই তিনি পাল্টা প্রস্তুতি গ্রহণ করেন। ১৫০ জন আনসার ও মুহাজিরের সমন্বয়ে একটি বাহিনী তৈরি করেন। হযরত আবু সালমা রা.-কে সেই বাহিনীর অধিনায়কত্ব প্রদান করা হয়।

বনু আসাদ গোত্র অভিযান শুরুর আগেই আবু সালমা রা. তাদের ওপর এমন অতর্কিত হামলা করেন যে, তারা ছত্রভঙ্গ হয়ে পালিয়ে যায়। তাঁদের মুখোমুখি সংঘর্ষে অবতীর্ণ হতে হয়নি। মুসলমানরা তাদের উট এবং তাঁবুর ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করেন। গনীমতের মালসহ নিরাপদে তারা মদীনায় ফিরে আসেন। মদীনায় ফেরার পর আবু সালমা রা. গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন। ওহুদের যুদ্ধে তিনি আহত হয়েছিলেন এবং ক্ষতস্থানে ইনফেকশন হয়ে যায়। কিছুদিন পরেই তিনি শাহদাত বরণ করেন।

এই ঘটনার পর আরবের মুশরিকরা নতুন পলিসি গ্রহণ করলো। তারা মুসলিমদের বন্ধুবেশে মুসলিমদের ক্ষতি করলো। আজাল ও কারাহ গোত্রদ্বয় থেকে এ দল লোক রাসূলুল্লাহ সা.-এর নিকট উপস্থিত হলো। তারা বললো, “ইয়া রাসূলুল্লাহ সা., আমাদের লোকেরা ইসলাম গ্রহণ করেছে। কাজেই আপনার সহচরদের মধ্য থেকে একটি দলকে আমাদের সাথে পাঠিয়ে দিন, যারা আমাদেরকে ইসলামের বিস্তারিত বিধান শিক্ষা দেবে ও কুরআন পড়াবে।”

মুহাম্মদ সা. তাদের সাথে মুরসাদ ইবনে আবু মুরসাদ, খালিদ ইবনে বুকাইর, আসিম ইবনে সাবিত, খুবাইব ইবনে আদি, যায়িদ ইবনুদ দাসিনা ও অবদুল্লাহ ইবনে তারিককে পাঠিয়ে দিলেন। আমীর মনোনীত করলেন মুরসাদ ইবনে আবু মুরসাদকে। তিনি সবাইকে সাথে নিয়ে রওনা হলেন। হিজাজের এক প্রান্তে উসফান ও মক্কার মধ্যবর্তী হুদয়ার ওপর অবস্থিত হুযাইল গোত্রের জলাশয় 'রাজি'তে পৌঁছালে তারা বিশ্বাসঘাতকতা করলো। বিশ্বাসঘাতকরা হুযাইল গোত্রকেও সাহায্যের জন্য ডাকলো।

সাহাবীগণ তখনও সওয়ারীর পিঠে। তারা দেখলেন, অস্ত্রধারী লোকজন তাদেরকে চারদিক থেকে ঘেরাও করে ফেলেছে। তাঁরা নিজ নিজ তরবারী নিয়ে লড়াই করতে প্রস্তুত হয়ে গেলেন। তখন কাফিররা বললো, “আল্লাহর কসম, আমরা তোমাদেরকে হত্যা করতে চাই না। আমরা তোমাদের দ্বারা মক্কাবাসীর কাছ থেকে কিছু অর্থ আদায় করতে চাই। আল্লাহর কসম করে প্রতিজ্ঞা করছি, তোমাদেরকে হত্যা করবো না।” কিন্তু মুরসাদ ইবন আবু মুরসাদ, খালিদ ইবনে বাকাইর এবং আসিম ইবনে সাবিত বললেন, “আমাদের কোন মুশরিকের প্রতিজ্ঞা বা অঙ্গীকারে আস্থা নেই।”

আসিম বিন সাবিত নিহত হলে হুযাইল গোত্রের লোকজন তার মাথা সুলাফা বিনতে সা’দের নিকট বিক্রি করতে মনস্থ করলো। ঐ মহিলার দুই ছেলে উহুদ যুদ্ধে আসিমের হাত মারা যাওয়ার পর সে প্রতিজ্ঞা করেছিলো যে, আসিমের মাথা পেলে সে তার খুলিতে মদ পান করবে। হুযাইল গোত্রের সন্ত্রাসীরা এই উদ্দেশ্যে আসিমের মাথা আনতে গেলে ভিমরুল ও মৌমাছি তার লাশ ঘিরে রাখায় আনতে পারলো না। তারা বললো, “এখন ওটা এখানেই থাক। বিকাল বেলা ভিমরুল ও মৌমাছি চলে যাবে। তখন আমরা তার মাথা কেটে আনবো।” এই বলে তারা চলে গেল। ইত্যবসরে আল্লাহ ঐ এলাকায় বন্যার তাণ্ডব বইয়ে দিলেন এবং সেই বন্যায় আসিমের লাশ ভেসে উধাও হয়ে গেল। আল্লাহ তায়ালা আসিমের মাথাকে অপমানের হাত থেকে রক্ষা করলেন।

শাহাদাতের পূর্বে আসিম আল্লাহর কাছে দোয়া করেছিলেন যে, তাঁর লাশ যেন কোন মুশরিক স্পর্শ করতে না পারে এবং তিনি নিজেও যেন কোন মুশরিককে স্পর্শ না করেন। কোননা তিনি মুশরিকদেরকে মনে প্রাণে অপবিত্র মনে করতেন ও ঘৃণা করতেন। উমার ইবনুল খাত্তাব রা. যখন শুনলেন যে, ভিমরুল ও মৌমাছি ঘিরে রাখার কারণে মুশরিকরা আসিমের লাশ স্পর্শ করতে পারেনি, তখন বললেন, “আল্লাহ তাঁর মু’মিন বান্দাকে এভাবেই হিফাজত করেন। আসিম তাঁর জীবদ্দশায় প্রতিজ্ঞা করেছিলেন যে, কোন মুশরিককে তিনি স্পর্শ করবেন না এবং কোন মুশরিককেও তাঁর দেহ স্পর্শ করতে দেবেন না। আল্লাহ তাঁর মৃত্যুর পর তাকে ঠিক তেমনিভাবে রক্ষা করেছেন, যেমন জীবদ্দশায় তিনি নিজেকে রক্ষা করে চলেছেন।” আল্লাহু আকবার।

যায়িদ ইবনে দাসিনা, খুবাইব ইবনে আদি ও আবদুল্লাহ ইবনে তারিক এরা তিনজন নমনীয় মনোভাব গ্রহণ করে যুদ্ধ বন্ধ করতে আগ্রহী হলেন। তাঁরা হাত বাড়িয়ে দিয়ে গ্রেফতারী বরণ করলেন। কাফিররা তাঁদেরকে গ্রেফতার করে বিক্রির জন্য মক্কায় নিয়ে চললো। যাহরান পর্যন্ত পৌঁছলে আবদুল্লাহ ইবনে তারিক কোনোভাবে নিজের হাতের বাঁধন খুলে ফেলতে সক্ষম হন। তিনি মুক্ত হলেন এবং তরবারী ধারণ করলেন। কাফিররা তাঁকে ধরতে পারলো না। কিন্তু দূর থেকে পাথর ছুঁড়ে তাকে শহীদ করলো।

অতঃপর খুবাইব ইবনে আদি ও যায়িদ ইবনে দাসিনাকে নিয়ে তাঁরা মক্কায় উপনীত হলো। কুরাইশদের কাছে হুযাইল গোত্রের দু’জন বন্দী ছিল। তাদের বিনিময়ে তারা ঐ দুই সাহাবীকে কুরাইশদের কাছে বিক্রি করলো। খুবাইবকে কিনলো উকবা ইবনে হারেসের পক্ষে হুজায়ের ইবনে আবু ওহাব, যাতে উকবা তার পিতৃহত্যার প্রতিশোধ স্বরূপ তাঁকে হত্য করতে পারে। আর যায়িদ ইবনে দাসিনাকে নিল সাফওয়ান ইবনে উমাইয়া স্বীয় পিতা উমাইয়া ইবনে খালফের হত্যার বদলে হত্যা করার জন্য। সাফওয়ান তার গোলাম নাসতাসের সাথে তাঁকে হারাম শরীফের বাইরে তানয়ীমে পাঠিয়ে দিল হত্যার উদ্দেশ্যে। সেখানে আবু সুফিয়ান সহ কুরাইশদের এক বিরাট জনতা যায়িদকে ঘিরে ধরলো।

যায়িদকে যখন হত্যা করার জন্য এগিয়ে নিয়ে যাওয়া হলো তখন আবু সুফিয়ান বললো, “হে যায়িদ, তোমার বদলে আজ যদি আমরা মুহাম্মাদকে হাতে পাই এবং তাকে হত্যা করি ও তোমাকে তোমার পরিজনের কাছে পাঠিয়ে দিই তাহলে তুমি কি তা পছন্দ করবে?” যায়িদ বললেন, “আল্লাহর কসম, আমি এতটুকুও পছন্দ করবো না যে, মুহাম্মাদ সা. যেখানে আছেন সেখানে থাকা অবস্থাতেই তাঁর গায়ে কাঁটা ফুটবে, তিনি তাতে যন্ত্রণায় ভুগবেন আর আমি নিজের পরিজনের মধ্যে আরামে বসে থাকবো।” আবু সুফিয়ান তখন বললো, “মুহাম্মাদকে তার সঙ্গীরা যেরূপ ভালোবাসতো এমন গভীর ভালোবাসা আর কারো মধ্যে আমি দেখিনি।” এরপর নাসতাস যায়িদকে হত্যা করলো।

হুজাইর ইবনে আবু ওহাবের দাসী মাবিয়ার কাছে খুবাইব রা. বন্দি ছিলেন। মাবিয়া পরে ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। তিনি বলেন, খুবাইব আমার কাছেই ছিলেন। তাঁকে আমার ঘরেই বন্দি করে রাখা হয়েছিলো। আল্লাহর শপথ! আমি একদিন দেখলাম, তিনি লোহার শিকলে আবদ্ধ অবস্থায় ছড়া হ’তে আঙ্গুর খাচ্ছেন, যা তাঁর হাতেই ছিল। অথচ এ সময় মক্কায় কোন ফলই পাওয়া যাচ্ছিল না। এ তো ছিল আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ হ’তে প্রদত্ত জীবিকা, যা তিনি খুবাইবকে দান করেছেন।

তাঁর হত্যার সময় যখন ঘনিয়ে এলো তখন মৃত্যুর প্রস্তুতিস্বরূপ পাক সাফ হবার জন্য আমার কাছে একখানা ক্ষুর চাইলেন। আমার ছেলেকে দিয়ে আমি তাকে ক্ষুর আনিয়ে দিলাম। ক্ষুর নিয়ে ছেলেকে খুবাইবের ঘরে ঢুকতে বললাম। সে খুবাইবের ঘরে গেলে সহসা আমার মনে হলো, একি করলাম! সর্বনাশ! এই লোকটি যদি ছেলেটিকে হত্যা করে প্রতিশোধ নেয় তাহলে কি হবে? সে তো নিজের জীবন নাশের বদলে একজনের জীবন নিয়ে আগাম প্রতিশোধ নিয়ে নেবে।

আমি দেখলাম যে, আমার ছেলে খুবাইবের উরুর উপর বসে রয়েছে এবং খুবাইবের হাতে রয়েছে ক্ষুর। আমি খুব ভয় পেয়ে গেলাম। খুবাইব আমার চেহারা দেখে তা বুঝতে পারলেন। তখন তিনি বললেন, তুমি কি এ ভয় করছ যে, আমি এ শিশুটিকে হত্যা করে ফেলব? কখনো আমি তা করব না। মাবিয়া বলেন, আল্লাহর কসম! আমি খুবাইবের মত উত্তম বন্দী কখনো দেখিনি।

এরপর খুবাইবকে কুরাইশরা তানয়ীমে নিয়ে গেল হত্যা করতে। খুবাইব বললেন, “তোমাদের যদি আপত্তি না থাকে তাহলে আমাকে দু’রাকাত নামায পড়তে দাও। ”তারা বললো, “ঠিক আছে, পড়ো।” তিনি দু’রাকাত নামায পড়ে নিলেন। অতঃপর মক্কার মুশরিকদের সামনে গিয়ে বললেন, “তোমরা যদি মনে না করতে যে, আমি মরার ভয়ে দীর্ঘক্ষণ নামায পড়ে সময় কাটাচ্ছি তাহলে আমি আরো কিছুক্ষণ নামাজ পড়তাম।”

শহীদ খুবাইব রা. পৃথিবীর অনাগত সকল বন্দি শহীদদের জন্য একটি সুন্নাত চালু করে গেছেন। এরপর থেকে যখনি কোনো মুসলিমের মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে জালিমেরা প্রায় প্রত্যেকেই খুবাইবের মতো করে দুই রাকায়াত নামাজ আদায় করে নিয়েছেন। সেই সিলসিলা অনুসরণ করে আমাদের শহীদ নেতৃবৃন্দ (আব্দুল কাদের মোল্লা রহ., কামারুজ্জামান রহ., মুজাহিদ রহ., নিজামী রহ. ও মীর কাশেম আলী রহ.) তাঁদের ফাঁসীর পূর্বে দুই রাকায়াত নামাজ আদায় করেছিলেন। আল্লাহ তাঁদেরকে খুবাইব রা.- এর মতো সম্মানিত করুন।

অতঃপর মুশরিকরা তাঁকে একটা কাঠের ওপর চড়িয়ে কষে বাঁধলো। এই সময় খুবাইব রা. আল্লাহর উদ্দেশ্যে বললেন, “হে আল্লাহ! আমরা আপনার রাসূলের বার্তা পৌঁছিয়ে দিয়েছি। সুতরাং আগামীকাল সকালের মধ্যে রাসূলুল্লাহ সা.-এর নিকট আমাদের সাথে যে আচরণ করা হলো তার খবর পৌঁছিয়ে দিন। এরপর তিনি তার আশে পাশে থাকা মুশরিক দলের জমায়েতকে উদ্দেশ্য করে লা'নত করলেন। তিনি বললেন, হে আল্লাহ! এই দুশমনদেরকে আপনি গুনে গুনে এক এক করে হত্যা করুন এবং এদের কাউকে ছেড়ে দেবেন না।” অতঃপর তারা খুবাইব রা.-কে হত্যা করলো। আল্লাহ তাঁর ওপর রহমত নাযিল করুন।

মুশরিক নেতা নেতা আবু সুফিয়ানের পুত্র মুয়াবিয়া বলেন, খুবাইবের এই কথা শুনে আমার পিতা আমাকে কাত করে শুইয়ে দিলেন। সেদিন খুবাইবের চারপাশে যারা জমায়েত হয়েছিলো তাদের মধ্যে আবু সুফিয়ানের সাথে আমিও ছিলাম। তখন এরূপ জনশ্রুতি প্রচলিত ছিল যে, কারোর ওপর অভিশাপ দেওয়া হলে সে যদি তৎক্ষনাৎ কাত হয়ে শুয়ে পড়ে তাহলে এ অভিশাপ থেকে সে বেঁচে যায়।

জুমাহী গোত্রের সাঈদ ইবনে আমেরকে উমার ইবনুল খাত্তাব রা. সিরিয়ায় প্রশাসক নিয়োগ করেছিলেন। তিনি আকষ্মিকভাবে লোকজনের সামনে মূর্ছা যেতেন। উমার ইবনুল খাত্তাবকে রা.-কে একথা জানানো হলো। উমার রা. তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘হে সাঈদ, তোমার কী হয়েছে? ” সাঈদ বললেন, “আমীরুল মু’মিনীন, আমর কোন অসুখ-বিসুখ হয়নি। তবে আমি খুবাইব রা.-কে হত্যার সময় সেখানে উপস্থিত ছিলাম এবং খুবাইবের বদদোয়া শুনেছিলাম। সেই বদদোয়ার কথা যখনই আমার মনে পড়ে তখনই আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলি।”

যেহেতু জেদ্দার কাছে 'রাজি'-তে এই মুসলিমদের দাওয়াত ও তারবিয়াতের দল আক্রান্ত হয়েছে তাই এই মর্মান্তিক ঘটনাকে রাজি'র ঘটনা হিসেবে উল্লেখ করা হয়। তাবলিগ ও তারবিয়াত মুসলিমদের চলমান কর্মসূচি। মদিনায় এই কর্মসূচি রাসূল সা. নিজেই পরিচালনা করতেন। আর মদিনার বাইরে তিনি সাহাবাদের প্রতিনিধি করে পাঠাতেন তাবলিগ ও তারবিয়াতের জন্য। মদিনা রাষ্ট্র গঠনের পর থেকেই এই কর্মসূচি চলমান ছিল।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন