৩০ সেপ, ২০২২

খিলাফত পর্ব-২৭ : মুসলিমদের জেরুজালেম বিজয়

সেনাপতি আমর ইবনুল আস রা. রামাল্লার অভিযান শেষে জেরুজালেমের দিকে এগিয়ে যান। তখন ফিলিস্তিনের শাসনে ছিল আর্তাবুন নামক এক বাইজেন্টাইন। তিনি ছিলেন সম্রাট হেরাক্লিয়াসের দ্বিতীয় প্রধান সেনাপতি। এ ব্যক্তি ছিলেন বাইজেন্টাইনদের (রোমান) মধ্যে সবচেয়ে চতুর ও বুদ্ধিমত্তার অধিকারী। সে রামলা (রামাল্লা) এবং আলিয়ায় (জেরুজালেম) প্রচুর সৈন্য সমবেত করে রেখেছিল। আমর ইবনুল আস আবু উবাইদাহ মারফত খলীফা উমার রা.-কে এ সম্পর্কে জানালেন এবং পরবর্তী নির্দেশের জন্য অনুরোধ করলেন। উমার রা. এ সময়েই তার সেই বিখ্যাত মন্তব্যটি করেছিলেন,

“আমরা রোমান আর্তাবুনের বিরুদ্ধে আরব আর্তাবুনকে পাঠিয়েছি; দেখি কী ঘটে।” 

তিনি বুঝাতে চেয়েছিলেন, উভয় সেনাপতিই তাদের নিজ জাতির মধ্যে বিচক্ষণ ও রণকৌশলী। আর্তাবুন রামলা ও আলিয়ায় বেশ বড় এক সেনাবাহিনী প্রেরণ করেছিল। কেননা, জেরুজালেমের এ দুটি শহর আমর ইবনুল-“আসের সেনাবাহিনী দ্বারা আক্রান্ত হওয়া সমূহ আশঙ্কা ছিল। তা ছাড়া এ দুটি ছিল ফিলিস্তিনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শহর। ফিলিস্তিনের রাজধানী তখন রামলা আর বৃহত্তম শহর আলিয়া। শহর দুটির মধ্যে দূরত্ব ছিল ১৮ মাইল। আলিয়ার ক্ষমতা ছিল আর্তাবুনের হাতে। অন্যদিকে রামলার গভর্নর ছিল তাদহারিক।

খলীফা উমার ইবনুল খাত্তাব রা.-এর পরিকল্পনা ছিল আজনাদইনে যুদ্ধের সময় ফিলিস্তিনে ‘আমরের অবস্থান গ্রহণের ব্যাপারে রোমানদের বেখবর রাখা। এতে করে পরবর্তীকালে জেরুজালেম ও সিরিয়ার বাকি অঞ্চল জয় করা সহজতর হবে। তিনি মুয়াবিয়া ইবনু আবু সুফিয়ান রা.-কে তার অশ্বারোহী বাহিনী নিয়ে সিজারিয়ায় যাওয়ার নির্দেশ দেন। এর দ্বারা তিনি চেয়েছেন ‘আমরের ওপর থেকে শত্রুপক্ষের দৃষ্টি সরিয়ে রাখতে। 

আমর রা. খলীফার পরিকল্পনা অনুসরণ করে ‘আলিয়ায় বাইজেন্টাইন সৈন্যবাহিনীকে বিভ্রান্ত করার জন্য ‘আলকামা ইবনু হাকিম ফিরাসি ও মাসরূক ইবনু ফুলআন মাক্কিকে “আলিয়ায় প্রেরণ করেন। এরপর তিনি আবু আইয়ুব মালিকিকে রামলায় পাঠান আরেক বাইজেন্টাইন বাহিনীকে বিভ্রান্ত করার জন্য। আমরের সাহায্যে অতিরিক্ত মুসলিম সেনা পৌঁছানোর সাথে সাথেই তাদেরকে মুহাম্মাদ ইবনু 'আমরের অধীনে আলিয়ায় আক্রমণকারী বাহিনীর সাহায্যে পাঠিয়ে দেন। একই সাথে তিনি আমারাহ ইবনু আমর ইবনু উমাইয়া আদ-দুমারীকে সৈন্য নিয়ে রামলায় আক্রমণকারী বাহিনীর সাহায্যে পাঠান। এদিকে তিনি আজনাদইনে নিজ বাহিনী নিয়ে আর্তাবুনের সাথে চুড়ান্ত যুদ্ধের জন্য অপেক্ষা করতে থাকেন।

অন্যদিকে বাইজেন্টাইন বাহিনী ‘আলিয়ার নগর প্রাচীরকে মুসলমানদের থেকে রক্ষায় আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছিল। নগরীর চারপাশে ঘোরতর যুদ্ধ বেঁধে যায়। একইসাথে আজনাদইনে মুসলিম ও বাইজেন্টাইন বাহিনী সমবেত হওয়া শুরু করে। তাবারী এ ব্যাপারে বলেন, “মুসলিম এবং বাইজেন্টাইন বাহিনী এমন এক যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ল যার তুলনা হতে পারে কেবল ইয়ারমুকের যুদ্ধের সাথে। এতে অসংখ্য মানুষ নিহত হয়েছিল। এ ছিল আরব আর্তাবুনের সাথে বাইজেন্টাইন আর্তাবুনের শ্রেষ্ঠত্বের লড়াই। অবশেষে বাইজেন্টাইন সেনাপতি হেরে গিয়ে সৈন্যসামন্ত নিয়ে পালিয়ে গিয়ে আলিয়া শহরে আশ্রয় গ্রহণ করে। মুসলিমরাও পরিকল্পিতভাবে শহরে প্রবেশ করার জন্য তাদেরকে সময় দেয়।”

আমর ইবনুল আস তাঁর বাহিনী নিয়ে অগ্রসর হয়ে ‘আলিয়ার ওপর অবরোধ আরোপ করেন। আমর ইবনুল-আসের নেতৃত্বে মুসলিম বাহিনী আলিয়া শহর ঘেরাও করে ফেলে। এর নগরপ্রাচীর ছিল অত্যন্ত সুরক্ষিত। শহরের দেয়ালগুলোর বর্ণনা দিয়ে ওয়াক্বিদী বলেন, “দেয়ালগুলো মিনজানিক, তলোয়ার, ঢাল এবং শেকল দ্বারা সুরক্ষিত ছিল। অবশেষে তিন দিনের অবরোধের পর মুসলিম বাহিনী নগরপ্রাচীর আক্রমণ করে। রক্ষীসেনার দল দেয়ালের ওপর থেকে তীর ছুড়তে শুরু করলে মুসলিমরা ঢাল দিয়ে নিজেদেরকে রক্ষা করে। সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত অবিরাম যুদ্ধ চলে টানা বেশ কয়েকদিন পর্যন্ত। ১১ তম দিনে আবু উবাইদা, খালিদ ও আবদুর-রাহমান ইবনু আউফ মুসলিম অশ্বারোহী বাহিনী ও সেনাদল নিয়ে যোগ দিলেন। এ দৃশ্য দেখে আলিয়াবাসীর মাঝে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে।

এ অবরোধ দীর্ঘ চার মাস যাবৎ অব্যাহত থাকে। প্রতিটি দিন অতিবাহিত হয় রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্য দিয়ে। মুসলিম বাহিনী ধৈর্যের সাথে শীত-বৃষ্টি-তুষার উপেক্ষা করে অবরোধ অব্যাহত রাখে। অবশেষে বাইজেন্টাইন বাহিনী জয়ের আশা ছেড়ে দেয়। জেরুজালেমের গোত্রপতি সাফ্রোনিয়াস শেষ চেষ্টা হিসেবে আমর ইবনুল-আসের নিকট অবরোধ উঠিয়ে নেওয়ার জন্য চিঠি পাঠান। তবে এ চিঠিতেও সে লিখেছিল যে, মুসলিমরা কখনোই এ শহর দখল করতে পারবে না। 

আলিয়ায় থাকা রোমান সেনাপতি আর্তাবুন ‘আমর ইবনুল-“আসকে লিখে পাঠায়,
“আপনি আমার বন্ধু এবং যুগপৎ প্রতিদ্বন্দ্বীও বটে। আপনার জাতির মাঝে আপনার অবস্থান যেমন, আমার জাতির মাঝে আমার অবস্থানও তেমনই। আল্লাহর কসম, আজনাদইনই শেষ এলাকা। এরপর ফিলিস্তিনের আর কোনো এলাকা আপনি জয় করতে পারবেন না। নিজেকে প্রতারিত করছেন। ফিরে গেলেই আপনার ভালো হবে। নাহলে আপনার পূর্বে যারা এসেছিল, তাদের মতো আপনিও পরাজিত হবেন।”

এর জবাবে ‘আমর লিখে পাঠান, তার হাতেই এ ভূখণ্ড বিজিত হবে। আর্তাবুন "আমরের চিঠি পড়ে হেসে ওঠে এবং ‘আমরের পত্রবাহককে বলে, “বাইতুল-মাকদিস তো উমার নামে এক ব্যক্তির জয় করার কথা।” বার্তাবাহক আর্তাবুনের এ কথা তাঁকে জানান। আর বুঝতে পারলেন, আর্তাবুন যে ‘উমারের কথা বলেছে, তিনি স্বয়ং খলীফা উমার ইবনুল খাত্তাব। আমর ইবনুল আস খলীফার কাছে চিঠি লিখে আর্তাবুনেরে এ কথা অবহিত করেন। একইসাথে সেখানকার কঠিন পরিস্থিতি সম্পর্কেও খলীফাকে জানান এবং তার জরুরি নির্দেশনা কামনা করেন।

মুসলিম বাহিনীর প্রধান হিসেবে আবু উবাইদাহ রা. জেরুজালেমবাসীর নিকট পত্র লিখেন। জেরুজালেমের গোত্রপতি সাফ্রোনিয়াস আত্মসমর্পন করতে রাজি হন তবে এর জন্য খলিফা উমার রা.-এর উপস্থিতি শর্ত হিসেবে জুড়ে দেন। সম্ভবত তাদের জোত্যিষ শাস্ত্র অনুসারে উমারের নাম তারা জানতো। তাদের কাছে এই জ্ঞানও ছিল যে, উমার রা. উপস্থিত থাকলে তাদের প্রাণের নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে। 

খলীফা শুরা পরামর্শ শেষে সৈন্যদল নিয়ে সিরিয়ার উদ্দেশে রওনা দেওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। তার অনুপস্থিতিতে আলী ইবন আবু তালিব রা. মদিনার দায়িত্বে নিয়োজিত থাকেন। উমার রা. জাবিয়ার প্রান্তরে এসে শিবির স্থাপন করেন। এখানেই আলিয়াবাসী তাঁর সাথে শান্তিচুক্তি করে। 

ইমাম তাবারীর বর্ণনামতে শান্তিচুক্তি ছিল নিন্মরূপ 
“পরম করুণাময় অসীম দয়ালু আল্লাহর নামে শুরু করছি। 
আল্লাহর বান্দা, আমীরুল মুমিনীন উমার ‘আলিয়াবাসীর সাথে এ মর্মে নিরাপত্তা-চুক্তি করছেন যে, তিনি তাদেরকে তাদের সম্পদ, তাদের গির্জা ও ক্রুশ, তাদের অসুস্থ ও সুস্থ এবং তাদের সকল ধর্মীয় গোষ্ঠীকে নিরাপত্তা প্রদান করেন। তাদের গির্জা ও সেগুলোর পার্শ্ববর্তী এলাকা বসবাসের জন্য কেড়ে নেওয়া হবে না এবং ধ্বংসও করা হবে না, এসবের কোনো কিছুরই ক্ষতিসাধন করা হবে না, তাদের ক্রুশ সরিয়ে ফেলা হবে না, তাদের সম্পত্তি থেকে কিছু কেড়ে নেওয়াও হবে না। তাদের ধর্মের কারণে তাদের কোনো হয়রানি কিংবা কোনো ক্ষতি করা হবে না। তবে ‘আলিয়ায় কোনো ইহুদিকে বসবাসের অনুমতি দেওয়া হবে না। আলিয়াবাসীকে জিজিয়া পরিশোধ করতে হবে, যেমনটি অন্য শহরবাসীরা পরিশোধ করে থাকে। বাইজেন্টাইন ও লুটেরাদের আলিয়া থেকে বহিষ্কার করা হবে। তাদের মধ্য থেকে যারা চলে যেতে চায়, তারা নিজেদের এবং তাদের সম্পদের নিরাপত্তা পাবে যতক্ষণ পর্যন্ত না তারা একটি নিরাপদ স্থানে পৌঁছায়। তাদের মধ্যে যারা ‘আলিয়ায় থাকতে চায় তারাও নিরাপত্তা পাবে এবং আলিয়াবাসীর মতো তাদেরকে জিজিয়া প্রদান করতে হবে।

‘আলিয়াবাসীর কেউ বাইজেন্টাইনদের সাথে নিজ সম্পদ নিয়ে চলে যেতে চাইলে তারা যেতে পারবে এবং তারা, তাদের গির্জা ও ক্রুশ নিরাপদ স্থানে পৌঁছানো পর্যন্ত নিরাপদ থাকবে। আলিয়ার ভূমিতে বসবাসকারী অন্যান্য গোত্র ; যাদের শেষ নেতাও মারা গিয়েছে, তাদেরকে এ সুযোগ দেওয়া হচ্ছে যে, তারা ‘আলিয়াবাসীর মতো জিজিয়া প্রদান করে আলিয়ায় অবস্থান করতে পারবে কিংবা তারা চাইলে বাইজেন্টাইনদের সাথে চলে যেতে পারবে অথবা তাদের মূল ভূমিতেও ফিরে যেতে পারবে। তাদের থেকে ততক্ষণ পর্যন্ত কোনো জিযিয়া সংগ্রহ করা হবে না, যে পর্যন্ত তারা তা পরিশোধে সক্ষম হয়।

মহান আল্লাহ, রাসূল, খলীফা এবং মুমিনদের চুক্তির শর্তাদি মেনে চলার এ অঙ্গীকার ততদিন পর্যন্ত বহাল থাকবে যতদিন পর্যন্ত এখানকার মানুষ জিযিয়া প্রদান করবে"।
সাক্ষী : খালিদ বিন ওয়ালীদ, ‘আমর ইবনুল-‘আস, আবদুর-রাহমান ইবনু ‘আউফ এবং মুয়াবিয়া ইবনু আবু সুফিয়ান।

এরপর উমার রা. জাবিয়াতে মুসলিম সেনাদের উদ্দেশ্যে বক্তব্য রাখেন। যে বক্তব্যের উদ্দেশ্য ছিল ঈমানের ওপর অবিচল থাকা, জামায়াতবদ্ধ থাকা, বিচ্ছিন্ন না হওয়া এবং চরিত্র হিফাযত করা। তিনি মুসলিমদের স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলেন, একজন পুরুষ ও একজন মহিলা কখনোই এক হতে পারে না তৃতীয়জনের উপস্থিতি ছাড়া। আর সে হলো শয়তান। 

শান্তিচুক্তির পর আলিয়াবাসী তথা খৃস্টানরা নগরীর গেট খুলে দেয়। আর্তাবুন তার বাহিনী নিয়ে মিসরে পালিয়ে যায়। উমার রা. মুসলিম সেনাদল নিয়ে মসজিদুল আকসায় প্রবেশ করেন। মুসলিমদের সহায়তায় মসজিদ পরিষ্কার করেন ও সেখানে নামাজ পড়েন। বাইতুল মাকদিসের পাশে আরেকটি মসজিদ নির্মান করেন। ইহুদিদের কাছে সম্মানিত বিশেষ পাথরকে (সাখরা) খ্রিস্টানরা ময়লার ভাগাড়ে পরিণত করেছে। উমার রা. নিজে তা পরিষ্কারের উদ্যোগ নেন। ফিলিস্তিনে/ জেরুজালেমে / আলিয়ায় উমার রা. শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করেন। নিজ নিজ ধর্ম পালনের অধিকার ও মুসলিমদের শান্তিপূর্ণ আচরণে এলাকাবাসী প্রভাবিত হতে থাকে। ধীরে ধীরে এই অঞ্চলের খ্রিস্টানরা মুসলিম হতে থাকে। 

এখানে উল্লেখ্য যে, আমাদের কাছে একটি কাহিনী বহুল প্রচলিত আছে যে, উমার রা. একজন ভৃত্য নিয়ে জেরুজালেমের গেইটে পৌঁছান। তখন উটের ওপর ছিল ভৃত্য এবং উমার রা. রশি টেনে যাচ্ছিলেন। খৃস্টানরা এই ঘটনা দেখে উটের ওপর থাকা ভৃত্যকে উমার রা. ভেবেছিল। পরে আসল কথা জেনে অবাক হয়েছিল।

এই ঘটনার ঐতিহাসিক ভিত্তি দুর্বল। বেশিরভাগ বর্ণনায় পাওয়া যায় উমার রা. ছোট একদল সৈন্য নিয়ে ঘোড়ায় করে দ্রুত জেরুজালেমের উদ্দেশ্যে রওনা হন। কিছু বর্ণনা অনুসারে তিনি একজন ভৃত্যকে নিয়ে আসলেও অবশ্যই তিনি এই অবস্থায় জেরুজালেম যাননি ও খৃস্টানদের মুখোমুখি হননি। তিনি জেরুজালেমের অদূরে জাবিয়ায় তাঁবু স্থাপন করেন। এখানে তাঁকে অভ্যর্থনা জানান আবু উবাইদা রা.-এর নেতৃত্বে সমস্ত কমান্ডারগণ। আমর ইবনুল আস রা. অবরোধের নেতৃত্বে থাকায় তিনি আসেননি। 

উমার রা. সেনাদের সাথে পরামর্শ করেন। এরপর আলিয়াবাসী অর্থাৎ জেরুজালেমের প্রতিনিধিদের সাথে সাক্ষাত ও চুক্তি করেন। চুক্তির পর তিনি আবু উবাইদা রা., খালিদ রা. ও অন্যান্য নেতাদের সাথে নিয়ে জেরুজালেম যান। তাই খৃস্টানরা তাঁকে না চেনা বা ভৃত্যকে উমার মনে করার কোনো কারণ নেই। তবে একটি ঘটনার বর্ণনা পাওয়া যায়, আবু উবাইদা রা. খলিফার বেশভূষা দেখে তা পরিবর্তনের জন্য বলেছেন। তিনি বলেছেন ভালো কাপড় পড়লে উমার রা.-এর ব্যাপারে তারা সমীহ করবে। উমার রা. এর দৃঢ় প্রতিবাদ করেন। 

চুক্তির পর জেরুজালেমে প্রবেশের সময় উমার রা. উটে করে যেতে চাইলে স্থানীয়রা খচ্চরের পিঠে চড়ে যাওয়ার পরামর্শ দেন। উমার রা. সেই পরামর্শ গ্রহণ করেন। কিন্তু খচ্চরের লাফালাফিতে উমার রা. তার পিঠে করে যেতে পারেন নি। অবশেষে উটে চড়েই গিয়েছেন। জেরুজালেমে ১০ দিন থেকে তিনি মদিনায় ফেরত যান।   


২৬ সেপ, ২০২২

ভয়াবহ নিরাপত্তা সংকটে ইডেনের মেয়েরা!

গত কয়েকদিন ধরে ইডেন মহিলা কলেজে ছাত্রলীগের নেত্রীদের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনায় দেশ তোলপাড়। পাল্টাপাল্টি অভিযোগের মধ্য দিয়ে উঠে এসেছে ভয়ংকর সব অভিযোগ। ইডেন মহিলা কলেজের মেয়েদের মধ্যে যাদের ঢাকায় থাকার ব্যবস্থা নেই এবং যারা বাসা ভাড়া করে থাকার সামর্থ রাখে না তারাই বাধ্য হয়ে কলেজের হোস্টেলে থাকতে হয়। হোস্টেলে থাকতে বাধ্য হওয়া মেয়েদের ছাত্রলীগের কাছে জিম্মি হয়ে থাকতে হয়। ছাত্রলীগের কথামত না চললে তারা হোস্টেলে থাকতে পারে না।


ছাত্রলীগের নেত্রীরা প্রথমত নতুন ছাত্রীদের থেকে চাঁদা কালেকশন করে। বিভিন্ন মিছিল সমাবেশে তাদের যেতে বাধ্য করে। দ্বিতীয়ত তাদের মধ্যে যাদের চেহারা ভালো তাদেরকে ছাত্রলীগ, যুবলীগ ও আওয়ামীলীদের নেতাদের বাসায় এবং আবাসিক হোটেলে যেতে বাধ্য করে। তৃতীয়ত নতুন ছাত্রীদের মধ্যে যারা রাজনৈতিক সচেতন তাদেরকে বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা ও দেহব্যবসার লভ্যাংশ দিয়ে লাঠিয়াল বানায়। এই লাঠিয়ালরাই কয়েকবছর পর নেত্রী হয়ে যায় ও উপরোক্ত কাজগুলো করে।

ইডেনের এই ভয়াবহ অবস্থার খবর প্রথম সংবাদ মাধ্যমে আসে ২০১০ সালের মার্চ মাসে। সেসময় ধারণা করা হয়েছে এই টোটাল সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ করতো ওবায়দুল কাদের। সেসময় এই নিয়ে ব্যাপক তোলপাড় হয় কিন্তু এর কোনো সমাধান হয় না। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর থেকে এখন পর্যন্ত ভয়াবহ নিরাপত্তা সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে ইডেনের ছাত্রীরা। ১৩ মার্চ ২০১০ সালে আমার দেশ পত্রিকায় এই ঘটনা নিয়ে প্রতিবেদনে জানা যায়,

//রাজধানীর সরকারি ইডেন কলেজে এবার দেহব্যবসার ঘটনা নিয়ে ছাত্রলীগের দুগ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষ হয়েছে। এ নিয়ে গতকাল দু'পক্ষের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া, ভাংচুর ও সংঘর্ষ হয়। এতে উভয় গ্রুপের কমপক্ষে ১৫ জন আহত হয়েছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ক্যাম্পাসে পুলিশ মোতায়েন করা হয়।

কলেজ সূত্রে জানা গেছে, সকাল সাড়ে ১১টার দিকে দু'পক্ষের নেতাকর্মীরা হকিস্টিক, রড, স্ট্যাম্প নিয়ে প্রশাসনিক ভবনের সামনে অবস্থান নেয়। দু'পক্ষের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। এতে অনু, তানিয়া, রূপা, রুমানা, কণা, লুচি, স্বর্ণা, লাবনীসহ কমপক্ষে ১৫ জন আহত হয়েছে। এছাড়া জেবুন্নেসা হলের ২০৮, খোদেজা বেগম হলের ২০৫ ও পুরাতন হলের ২ (ক) নম্বর কক্ষটিতে ভাংচুর করে মালামাল লুট করা হয়েছে।

ছাত্রলীগের জুনিয়র কর্মী ছাড়াও সাধারণ ছাত্রীদের দিয়ে দেহব্যবসা ও ভর্তি বাণিজ্যকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষের সূত্রপাত। দীর্ঘদিন ধরেই ছাত্রীদের জোরপূর্বক ছাত্রলীগ, যুবলীগ নেতাদের বাসায় নেয়া ছাড়াও রাজধানীর কাকরাইল, গুলিস্তান, এলিফেন্ট রোড, মালিবাগ, মতিঝিল, মোহাম্মদপুর, নাখালপাড়া, মীরপুরের আবাসিক হোটেলগুলোতে সংগঠনের জুনিয়র কর্মী ছাড়াও প্রথম বর্ষ ও দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রীদের বাধ্য করে নিয়ে যাওয়া হতো।

এছাড়া চলতি শিক্ষাবর্ষে ৩ শতাধিক ভর্তিচ্ছু এবং শতাধিক ছাত্রীর সাবজেক্ট পরিবর্তনের মাধ্যমে কয়েক লাখ টাকা ব্যবসা করেছে ছাত্রলীগ। এ সম্পর্কে পরস্পরবিরোধী বক্তব্য পাওয়া গেছে। একটি পক্ষ বলছে, কলেজের সভাপতি জেসমিন শামীমা নিঝুম ও সাধারণ সম্পাদক ফারজানা ইয়াসমিন তানিয়াসহ কয়েকজন প্রথম সারির নেত্রী ছাত্রীদের দিয়ে দেহব্যবসা ও ভর্তি বাণিজ্যের সঙ্গে জড়িত। আবার সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক পক্ষ বলছে, যারা ছাত্রীদের দিয়ে দেহব্যবসা করায় তার প্রতিবাদ করায়ই আমাদের ওপর হামলা হয়েছে।

নিঝুম গ্রুপের তানিয়া বলেন, আমি রাজিয়া হলের ২১০ নম্বর কক্ষে থাকি। বেশ কিছুদিন ধরে ছাত্রলীগের বড় আপা চম্পা ও কানিজ আমাকে অবৈধ কাজে অফার করে। এতে আমি রাজি না হলে গতকাল আমাকে রুমেই মারধর করে চম্পা ও কানিজ। জানা গেছে, কলেজের জেবুন্নেসা হলের ২০৮ নম্বর কক্ষের এক ছাত্রীকে ও খোদেজা বেগম হলের ২০৫ নম্বর কক্ষের এক ছাত্রীকে ছাত্রলীগ ও এক মন্ত্রীর বাসায় যাওয়ার প্রস্তাব দেয় সভাপতি নিঝুম ও সাধারণ সম্পাদক তানিয়া গ্রুপ। প্রস্তাবে রাজি না হয়ে ওই দুই ছাত্রী বিষয়টি অন্যদের কাছে প্রকাশ করে দেন। সমাজকর্ম বিভাগের ফাইনাল ইয়ারের ছাত্রী মাহফুজা খানম স্বর্ণা বলেন, সভাপতি নিঝুম ও সাধারণ সম্পাদক তানিয়া আমাকে সব ধরনের অফার করেছে।

বিভিন্ন নেতার বাসায় যাওয়ার জন্য চাপ প্রয়োগ করেছে। আমি তাদের কথা না শোনায় আমার রুম ভাঙচুর করে তালা দিয়ে সবকিছু নিয়ে গেছে। তিনি বলেন, বৃহস্পতিবার রাতেও আমাকে এক মন্ত্রীর বাসায় যেতে বলেছিল নিঝুম। তার কথা না শোনায় আমাকে তার কর্মীরা মারধর করেছে।

অর্থনীতি বিভাগের তৃতীয় বর্ষের ছাত্রী লাবনী আক্তার বলেন, আমার চৌদ্ধগোষ্ঠী আওয়ামী লীগের রাজনীতি করে। আমি সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের কথামতো না চলায় আমাকে শিবির বানিয়ে হল থেকে বের করে দিয়েছে। আমাকে সব ধরনের অফার করা হয়েছিল। তিনি বলেন, সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক টাকার বিনিময়ে নবম শ্রেণীর মেয়েদেরও হলে রেখে তাদের দিয়ে দেহব্যবসা করাচ্ছে। কেউ প্রতিবাদ করলে তাকে শিবির বলে হল থেকে বের করে দেয়া হচ্ছে। এ নিয়ে বৃহস্পতিবার রাত থেকেই দু'পক্ষের মধ্যে দ্বন্দ্ব চলছিল।

গতকাল সকাল সাড়ে ১১টার দিকে দু'গ্রুপের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া শুরু হয়। জানা গেছে, ২০০৮-০৯ শিক্ষাবর্ষে সভাপতি নিঝুম ও তানিয়া ইডেনে কয়েকশ ছাত্রীকে অবৈধভাবে ভর্তি করায়। প্রত্যেকের কাছ থেকে সর্বনিম্ন ১০ হাজার থেকে সর্বোচ্চ ৫০ হাজার টাকা নেয়া হয়। এছাড়া কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক মাহফুজা চৌধুরীর সঙ্গে সমঝোতা করে কয়েকশ ছাত্রীর সাবজেক্ট পরিবর্তনের মাধ্যমে তারা ব্যবসা করে। এদের প্রত্যেকের কাছ থেকে সর্বোচ্চ ৫০ হাজার থেকে শুরু করে সর্বনিম্ন ১০ হাজার টাকা নেয়া হয়।

ভাগ-বাটোয়ারার ক্ষেত্রে জুনিয়রদের একটি করে ছাত্রী ভর্তি করার সুযোগ দেয়া হয়। প্রত্যাশিত ভাগ না পেয়ে এর প্রতিবাদ করায় তিন মাস আগে সাংগঠনিক সম্পাদক শর্মী ও হ্যাপিকে সংগঠন থেকে বহিষ্কার করা হয়। তবে সভাপতি জেসমিন শামীমা নিঝুম বলেছেন, ওই দুই নেত্রী ছাত্রীদের দিয়ে দেহব্যবসার মতো কাজ করিয়েছে। এজন্য তাদেরকে বহিষ্কার করা হয়েছে। তিনি বলেন, আমি সব ধরনের অনিয়মের বিপক্ষে। এসব অনিয়মের প্রতিবাদ করায় আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে। আমাকে সরাতে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নেতা সিদ্দিকী নাজমুল আলম ষড়যন্ত্র করছেন। সভাপতি নিঝুম গ্রুপের ছাত্রলীগ কর্মীরা বলেন, কিছুদিন আগে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নেতা সিদ্দিকী নাজমুল আলম ও ইডেনের সহ-সভাপতি চম্পা খাতুন দীর্ঘদিন ধরে অবৈধ সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন। এক পর্যায়ে তারা বিয়ে করে মিরপুরে বাসা নিয়ে থাকছেন। ওই বাসায় আরও পাঁচ থেকে ছয়জন ছাত্রীকে রেখে তারা দেহব্যবসা করাচ্ছে।

এর সঙ্গে বহিষ্কৃত নেত্রী হ্যাপী, শর্মী, চম্পা, কানিজ জড়িত। আমরা ওই ঘটনার প্রতিবাদ করায় আমাকে সরাতে ষড়যন্ত্র করছে। শর্মী ও হ্যাপি, সহ-সভাপতি চম্পা খাতুন, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের হ্যাপী, ইতিহাস বিভাগের কানিজ, অর্থনীতি বিভাগের লিজা, বি.কমের মিশু, সমাজকর্ম বিভাগের স্বর্ণা, ইতিহাস বিভাগের মিনাসহ আরও ক'জন আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে। সহ-সভাপতি চম্পা খাতুন বলেন, ইডেনের বর্তমান কমিটির মেয়াদ শেষ হয়েছে অনেকদিন আগেই। সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক পদে থাকতে সম্প্রতি ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি মাহমুদ হাসান রিপনকে ১০ লাখ টাকা দিয়েছে নিঝুম ও তানিয়া।

এছাড়া তারা ছাত্রীদের দিয়ে দেহব্যবসা, ভর্তি বাণিজ্যসহ সব ধরনের অপকর্ম করছে। হলের ছাত্রীদের জিম্মি করে রেখেছে। তাদের কবল থেকে বের হয়ে ছাত্রীরা অন্যায়ের প্রতিবাদ করে আমাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছে। এছাড়া এই চক্রটি ভর্তি বাণিজ্যের সঙ্গেও জড়িত।//

২৫ জানুয়ারি ২০১৫ সালে জাগো নিউজে প্রকাশিত সংবাদে জানা যায়,
//২০১২ সালের ৬ ডিসেম্বর জেসমিন আক্তার নিপাকে সভাপতি ও ইশরাত জাহান অর্চিকে সাধারণ সম্পাদক করে শাখা ছাত্রলীগের কমিটি ঘোষণা করা হয়। এছাড়া ৯ জনকে সহ-সভাপতি, পাঁচজনকে যুগ্ম সম্পাদক, চারজনকে সাংগঠনিক সম্পাদক করা হয়। নতুন কমিটি ঘোষণার পর থেকেই বিনা কারণে ছাত্রীদেরকে মারধর, ব্যক্তিগত কাজে ছাত্রীদেরকে কাজে লাগানো, বাহির থেকে ছেলে নিয়ে এসে হলে ফুর্তি করা, হলে মাদকের আড্ডা, প্রশ্ন ফাঁস ও ভর্তি বাণিজ্য, অজ্ঞাত স্থানে যাওয়া-আসাসহ নানা অভিযোগ ওঠে নেত্রীদের বিরুদ্ধে।

কলেজ প্রশাসন জানায়, কলেজের ৬টি হলেই সিট দেয়া থেকে শুরু করে যাবতীয় বিষয় নিয়ন্ত্রণ করে ছাত্রলীগ। অনেক ক্ষেত্রে বহিরাগতদের অবৈধভাবে হলে রেখে ভাড়া আদায় করেন তারা। এছাড়া কলেজের আশপাশে থাকা দোকানগুলো থেকে নিয়মিত চাঁদা আদায়ের অভিযোগও রয়েছে শাখা ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে। বিভিন্ন প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় ডিজিটাল জালিয়াতির মাধ্যমে প্রশ্ন ফাঁসেরও অভিযোগ রয়েছে তাদের বিরুদ্ধে।

২০১৩ সালের ৬ সেপ্টেম্বর কলেজের অধ্যক্ষ বরাবর একটি আবেদনপত্র দেয় রাজিয়া বেগম ছাত্রীনিবাসের ছাত্রীরা। আবেদনপত্রে বলা হয়, আমরা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছি। বৃহস্পতিবার বিকাল ৩টা থেকে সাড়ে ৪টা পর্যন্ত ঢাকা কলেজ শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক সাকিব হাসান সুইম, ইডেন কলেজ ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ইশরাত জাহান অর্চির ২০১ নম্বর রুমে অবস্থান করেন। এ অবস্থায় তারা বিষয়টির সুষ্ঠু তদন্তের দাবি জানান।

হলের একাধিক ছাত্রী জানিয়েছেন, রাজিয়া বেগম হলের ২১০ এবং ২১২ নম্বর কক্ষে অর্চি তার সহচরদের নিয়ে থাকে। এর মধ্যে ২১২ নম্বর কক্ষটি খুবই গোপনীয়। এ কক্ষটিই তাদের মাদক গ্রহণের নিরাপদস্থান হিসেবে পরিচিত। অভিযোগ রয়েছে বিভিন্ন সময়ে অনেক রাত করে হলে ফেরেন কলেজের নেত্রীরা। গেটের দারওয়ান বাধা দিলে তাকে চাকরিচ্যুত করারও হুমকি দেন তারা।

ইডেন কলেজ শাখা ছাত্রলীগ সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক গ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনায় গত বছরের ২৩ জুন কলেজে ছাত্রলীগের কার্যক্রম স্থগিত ঘোষণা করে কেন্দ্রীয় কমিটি। কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করা হয়- স্থগিতাদেশের পর ছাত্রলীগের পদ-পদবি ও নাম ব্যবহার করে কেউ কোনো কর্মকাণ্ড করলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। এ ঘোষণার পরেও ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগ সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক নিয়মিত কার্যক্রম পরিচালনা করে যাচ্ছেন। সর্বশেষ গত ৩ জানুয়ারি ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর অনুষ্ঠানেও তারা যোগ দিয়েছেন। এ ঘটনার পর গত ১১ জানুয়ারি রাজিয়া বেগম হল থেকে ১৪, জেবুন্নেছা হল থেকে ২৫ এবং হাসনা বেগম হল থেকে ১৫ জনসহ মোট ৫৪ জন ছাত্রীকে বেআইনিভাবে হল থেকে বের করে দেন সাধারণ সম্পাদক অর্চি।

শাখা ছাত্রলীগ সভাপতি নিপার তিন বছর আগে ছাত্রত্ব শেষ হলেও এখনও সে অবৈধভাবে হলে অবস্থান করে সিট বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ করছে বলে জানা গেছে। এদিকে সাধারণ সম্পাদক মাস্টার্সে উঠলেও গত তিন সেশনে পরীক্ষা দেয়নি বলে তার ঘনিষ্ঠ সূত্র জানিয়েছে। এ ব্যাপারে কথা বলতে জেসমিন আক্তার নিপাকে ফোন করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি। এছাড়া ইশরাত জাহান অর্চির সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি পরে ফোন করতে বলেন। ছাত্রলীগ সাধারণ সম্পাদক সিদ্দিকী নাজমুল আলম জানান, তিনি অসুস্থ ছিলেন তাই এ বিষয়ে নির্দিষ্টভাবে কিছু বলতে পারছেন না।//

এভাবে সরকারের উচ্চপর্যায়ের প্রত্যক্ষ মদদে ইডেন মহিলা কলেজে ছাত্রলীগ মেয়েদের জিম্মী করে ভয়ানক বিপদে ফেলে দিচ্ছে। কারো সম্মান নষ্ট, কারো ক্যারিয়ার নষ্ট, কাউকে মাদকাসক্ত, সন্ত্রাসী ও দেহব্যবসায়ী বানাচ্ছে। ইডেনে ছাত্রীনিবাসে থেকে পড়াশোনার বিষয়টা এক দুঃস্বপ্নে পরিণত হয়েছে। সারা বাংলাদেশ থেকে বাছাই করা মেধাবী ছাত্রীরা এখানে এসে সন্ত্রাসীতে পরিণত হচ্ছে, জীবন বিপন্ন করছে এর চেয়ে দুর্ভাগ্য একটি দেশের জন্য আর কী হতে পারে!

২৫ সেপ, ২০২২

খিলাফত পর্ব-২৬ : উমার রা.-এর শাসনামলে সিরিয়া অভিযান

 

আবু বকর রা.-এর আমলে দুইটি ফ্রন্টে যুদ্ধ চলছিল মুসলিম বাহিনীর। এক সিরিয়া ফ্রন্টে দুই ইরাক ফ্রন্টে। আমরা আগের পর্বগুলোতে ইরাক ফ্রন্টের যুদ্ধ নিয়ে আলোচনা করেছিলাম। এখন আমরা সিরিয়া ফ্রন্টে যুদ্ধের ধারাবাহিক অগ্রগতি নিয়ে আলোচনা করবো। ইনশাআল্লাহ। 

আবু বকর রা. যখন মৃত্যুশয্যায় তখন সিরিয়ায় ইয়ারমুকের ভয়াবহ যুদ্ধ চলছিল। এই অবস্থায় রাজধানী মদিনা থেকে চিঠি আসে খবর ও নির্দেশনাসহ। খবর ছিল, আবু বকর রা. ইন্তেকাল করেছেন। আর নতুন খলিফা নির্বাচিত হয়েছেন উমার রা.। নির্দেশনা ছিল আবু উবাইদা রা.-এর প্রতি। তিনি এখন থেকে সিরিয়ায় অবস্থিত মুসলিম বাহিনীর সর্বাধিনায়কের দায়িত্ব পালন করবেন। 

ইয়ারমুকের যুদ্ধ চলাকালে এই খবর ও নির্দেশনা আবু উবাইদাহ রা.-এর কাছে পৌঁছলেও তিনি বিভিন্ন দিক বিবেচনায় তিনি এসব খবর ও নির্দেশনা গোপন রাখেন। আল্লাহর ইচ্ছায় ও সহায়তায় ইয়ারমুকের যুদ্ধে বিজয় আসলে তিনি সবাইকে এসব বিষয়ে অবহিত করেন। 

খালিদ বিন ওয়ালিদ রা. যখন জানতে পারলেন তাকে সর্বাধিনায়কের দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে তখন তিনি আবু উবাইদাহর নিকট এসে বললেন, আল্লাহ আপনাকে ক্ষমা করুন। খলিফা আপনাকে পত্র মারফত নিয়োগ দিয়েছেন, কিন্তু আমাকে তা আপনি জানাননি। জবাবে আবু উবাইদাহ রা. বললেন, আমি আপনাকে জানাইনি কারণ আমি চেয়েছিলাম অন্য কেউ এটা জানাক। মুসলিম বাহিনীর ব্যাপারে যুদ্ধ চলাকালে কোনো পরিবর্তন হোক তা চাইনি। বরং আপনার পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য অপেক্ষা করছি। 

খালিদ রা. বিনাবাক্যে কমান্ড থেকে সরে আসলেন এবং আবু উবাইদাহ রা.-এর আনুগত্য মেনে নিলেন। আবু উবাইদাহ রা. প্রতিটা সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে খালিদ রা.-এর পরামর্শ নিয়ে অভিযান পরিচালনা করতে থাকেন। ইয়ারমুকের যুদ্ধের পর আবু উবাইদাহ রা.-এর নেতৃত্বে মুসলিম বাহিনী দামেশকের দিকে যাত্রা শুরু করে। আবু উবাইদাহর টার্গেট ছিল দামেশক অবরোধ করা। কিন্তু পথিমধ্যে খবর আসলো, রোমান সৈন্যরা হোমস থেকে বিশাল সৈন্য সাহায্য পেতে যাচ্ছে। একইসাথে ফিলিস্তিনেও রোমানরা বড় সৈন্য সমাবেশ করেছে। 

কোন বাহিনীকে আগে সামলাবেন তা তিনি নিয়ে কিছুটা দ্বিধাগ্রস্থ হয়ে পড়লেন  সেনাপতি। উমার রা.-এর কাছে পত্র লিখে সিদ্ধান্ত চাইলেন আবু উবাইদাহ রা.। উমার রা. জানালেন, আপনি দামেশকের উদ্দেশ্যে যাত্রা অব্যাহত রাখেন। হিমস থেকে রোমানরা সাহায্য পাওয়ার আগেই দামেশক বিজয়ের চেষ্টা করুন। একদল অশ্বারোহীকে পাঠিয়ে দিন ফিহলের উদ্দেশ্যে। যাতে তারা হিমসের বাহিনীকে আটকাতে পারে। আমাদের আশা অশ্বারোহীরা ফিহলে হিমসের বাহিনীর বিরুদ্ধে বিজয়ী হবে। আর যদি আগেই দামেশক বিজয় হয় তবে দামেশকে কাউকে দায়িত্ব দিয়ে আপনি ও খালিদ উভয়ে হিমসের উদ্দেশ্যে রওনা হবেন। আমর ও শুরাহবিলকে জর্ডান ও ফিলিস্তিনের উদ্দেশ্যে প্রেরণ করুন।  

সাহাবী আম্মারা ইবনে মুখশী রা. নেতৃত্বে একদল সেনাবাহিনীকে আবু উবাইদাহ রা.ফিহলের উদ্দেশ্যে প্রেরণ করেন। তারা ফিহলে ৮০০০০ সৈন্যের এক বিশাল বাহিনীকে দেখতে পান। মুসলিমরা ছিল উজানে আর রোমানরা ছিল ভাটির দিকে। মুসলিমরা খাল কেটে রোমানদের দিকে পানি প্রবাহিত করে দিল। রোমানদের মাঠ, তাঁবু, চুলা সব ভেসে গিয়ে নষ্ট হয়ে গেল। মুসলিমরা আল্লাহর ইচ্ছায় ও সাহায্যে অল্প ক্লেশে যুদ্ধে বিজয় লাভ করলো। রোমানরা পিছিয়ে গেল হিমসের দিকে।   

মুসলিম বাহিনী দামেশক অবরোধ করলেন। রোমানরা শহরে প্রবেশের সমস্ত পথ বন্ধ করে রাখলো। কিছু স্থানে উঁচু দেওয়াল, কিছু স্থানে পরিখার মাধ্যমে তারা আত্মরক্ষা করলো। খালিদ রা. তাদের এই বাধা ভাঙ্গার জন্য নানান কৌশল করলেন। ছোট ছোট দলে বিভক্ত করলেন। ঝটিকা আক্রমণ করে পুরো দামেশকের প্রতিরক্ষা নিয়ে অবগত হলেন। দুর্বল প্রতিরক্ষার স্থানে আক্রমণ করতে করতে তিনি দামেশকের প্রতিরক্ষা ভেদ করে খন্ড যুদ্ধ শুরু করে দিলেন। দীর্ঘদিন অবরুদ্ধ থেকে যখন প্রতিরক্ষা ভেঙ্গে গেল তখন তারা আর যুদ্ধ না করে সন্ধির প্রস্তাব দিল। মুসলিমরা জিজিয়ার বিনিময়ে যুদ্ধ বন্ধ করে দামেশক অধিকার করলো। 

দামেশক বিজয় হয় ১৩ হিজরিতে। বিজয়ের পর আবু উবাইদাহ রা. খালিদ রা.-কে বিকা জয় করার জন্য পাঠান। তিনি সফলভাবে তা জয় করেন। আরেকটি বাহিনীকে পাঠান আইন মিসনুনে। লেবাননের রোমান বাহিনী তাদের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হয়। এই যুদ্ধে মুসলিমরা বিজয় লাভ করলেও একটা বড় অংশ শাহদাতবরণ করেন। এই কারণে আইন মিসনুনকে আইন আশ শুহাদা বলা হয়। 

আবু উবাইদা ইয়াজিদ ইবনু আবু সুফিয়ানকে দামেশকের দায়িত্ব প্রদান করেন। দিহাইয়া ইবনে খলিফাকে তামদূর জয় করার জন্য প্রেরণ করেন। শুরাহবিল রা.-কে জর্দান জয় করার জন্য প্রেরণ করেন। এরপর আবু উবাইদা রা. ও খালিদ রা. ফিহল অবরোধ করেন। দীর্ঘদিন অবরুদ্ধ থাকার পর তারা বাধ্য হয়ে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয় এবং পরাজয়বরণ করে। মুসলিমরা দখলকৃত অঞ্চলে ইসলামী শাসন, তাবলীগ, মসজিদ স্থাপন ও প্রশিক্ষণের কাজ করতে থাকেন। 

১৫ হিজরিতে রোমানরা হিমসে একত্রিত হতে থাকে। আবু উবাইদাহ রা. মুসলিম বাহিনী নিয়ে হিমস অবরোধ করেন। তখন তীব্র শীল চলছিল। হিমসের অধিবাসীরা ভেবেছে তীব্র শীতে খোলামাঠে থাকতে না পেরে মুসলিমরা ফিরে যাবে। কিন্তু মুসলিমরা আল্লাহর রহমতে তীব্র শীতের মধ্যেও অবরোধ চালিয়ে যাচ্ছিল। অবশেষে তারা সন্ধি করতে সম্মত হয়। মুসলিমরা বিনাযুদ্ধে হিমস দখল করে নেয়। 

এরপর আবু উবাইদাহ রা. খালিদ রা.-কে কিন্নাসরিনে পাঠান। সেখানে ভয়াবহ যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে আল্লাহর রহমতে মুসলিমরা বিজয় লাভ করে। এই ভয়াবহ যুদ্ধে খালিদ রা.-এর সাহস, নৈপুণ্য ও আত্মত্যাগের কথা উমার রা.-এর কাছে পৌঁছে। তিনি বলেন, মহান আল্লাহ আবু বকরের প্রতি দয়া করুন। তিনি মানুষ চিনতেন আমার চাইতে বেশি। আমি খালিদকে এই কারণে বরখাস্ত করিনি এজন্য যে, সে কোনো অপরাধ করেছে। বরং এজন্য যে, লোকেরা তার ওপর নির্ভরশীল হয়ে যাচ্ছিল। 

১৫ হিজরিতে রোমান সম্রাট হেরাক্লিয়াস তার সৈন্যবাহিনী নিয়ে সিরিয়া ছেড়ে রোমে চলে গেল। এরপর উমার রা. মুয়াবিয়া রা.-কে কায়সারিয়ায় সেনাপতি হিসেবে প্রেরণ করেন। মুয়াবিয়া রা. সেখানে গিয়ে শহর অবরোধ করেন। তাদের সাথে ভয়াবহ যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে মুসলিমরা বিজয়ী হয়। একইসাথে উমার রা.-এর নির্দেশে আমর ইবনুল আস রা. জেরুলাজালেমের উদ্দেশ্যে রওনা হন। পথমধ্যে রামাল্লার আজনাদায়নে রোমান বাহিনীর সাথে যুদ্ধ হয়। আমর ইবনুল আস বীর বিক্রমে যুদ্ধ করতে থাকলেন এবং সাহায্য চেয়ে উমার রা. এবং আবু উবাইদাহ রা.-এর নিকট পত্র লিখলেন। হিমস থেকে আবু উবাইদাহ রা. আমর ইবনুল আস রা.-কে সাহায্য করার জন্য এগিয়ে গেলেন। ইতোমধ্যে আমর ইবনুল আস যুদ্ধে জয় লাভ করলেন এবং আরো দ্রুত সামনে এগিয়ে গিয়ে জেরুজালেম অবরোধ করলেন।  

২৪ সেপ, ২০২২

আদম সৃষ্টির হাকিকত

 

শহীদ গোলাম আযম তখন তাবলীগ জামায়াতের আন্দোলনের সাথে জড়িত। ইসলামের অনেক বিষয় নিয়ে তাঁর মধ্যে প্রশ্ন তৈরি হতো। কিন্তু তিনি এর যুৎসই জবাব পেতেন না। এর জবাবের জন্য তিনি হন্যে হয়ে বই পুস্তক পড়তেন। তেমনি একটি বিষয় ছিল আদম আ.-এর ইতিহাস। ওয়াজ মাহফিলে ও ধর্মীয় মুরুব্বিদের কাছ থেকে পাওয়া ভুল ব্যাখ্যা তাঁকে কষ্ট দিয়েছিল।

১৯৫৫ সালে এমন পরিস্থিতিতে তার হাতে পড়ে মাওলানা মওদূদী রহ.-এর লেখা তাফহীমুল কুরআনের সূরা বাকারার তাফসীর। তিনি মাওলানার ব্যাখ্যা পড়ে অত্যন্ত সন্তুষ্ট হন। এরপর তিনি মাওলানা মওদূদীর প্রতি আগ্রহী হন। তাঁর কিতাবাদি ও পত্রিকা পড়তে থাকেন। অল্প সময়ের তিনি ইকামাতে দ্বীনের কাজে যুক্ত হয়ে জামায়াতে ইসলামীতে যোগ দেন।

এরপর তো বহু ঘটনা পার হলো। ১৯৮৯ সালে তাঁর প্রস্তাবিত 'কেয়ারটেকার সরকার ব্যবস্থা' মেনে নিয়ে সমস্ত বিরোধীদল আন্দোলন শুরু করলো এরশাদের বিরুদ্ধে। এরশাদ পদত্যাগ করতে বাধ্য হলো। ১৯৯১ সালে কেয়ারটেকার সরকারের অধীনে নির্বাচনে বিএনপি সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়। তবে সরকারের গঠনের জন্য আরো কিছু সিট তাদের প্রয়োজন ছিল। জামায়াত একটি সুন্দর জনগণের সরকার গঠনের পরামর্শ দিয়ে বিএনপিকে বিনাশর্তে সমর্থন জানালো।

কিন্তু বিএনপি সে মর্যাদা রাখতে সক্ষম হয়নি। ১৯৯২ সালে প্রথম আঘাতটা আসে জামায়াতের আমীর অধ্যাপক গোলাম আযমের বিরুদ্ধে। তাঁর নাগরিকত্ব নেই এই মর্মে 'ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি' একটি আন্দোলন শুরু করে অধুনা শাহবাগের আদলে। জামায়াত সরকারের অংশ হওয়ার পরও বহুস্থানে ঘাদানিক জামায়াত-শিবিরের ওপর হামলা করে। অফিস ভাংচুর করে। অন্তত তিরিশজনকে হত্যা করে। বিএনপি সরকার এর বিহিত করা তো দূরের কথা উল্টো ঘাদানিকের প্ররোচনায় অধ্যাপক গোলাম আযমকে গ্রেপ্তার করে ও আদালতের মুখোমুখি করে।

যাই হোক, আমরা মূল আলোচনায় ফিরে আসি। কারাগারে যাওয়ার পর শহীদ অধ্যাপক গোলাম আযম আবার তাঁর পুরনো বিষয় নিয়ে পড়াশোনা শুরু করেন। ১৯৯২ সালে তিনি কারাগারে একটি বই লিখেন 'আদম সৃষ্টির হাকিকত' নামে। এই বইতে তিনি আদম আ.-এর সৃষ্টি এবং কারণ নিয়ে নাতিদীর্ঘ আলোচনা করেন। বইটির ভূমিকাতে তিনি বলেন, সূরা বাকারার ৪র্থ রুকুর প্রচলিত ভুল ব্যাখ্যার কারণেই মুসলিমদের মধ্যে ইসলাম একটি আচার সর্বস্ব ধর্ম হিসেবে পরিচিত হয়েছে। এর সঠিক ব্যাখ্যা ছাড়া কুরআনের বিপ্লবী দাওয়াত ও রাসূল সা.-এর সংরামী জীবনের সন্ধান পাওয়া অসম্ভব।

সূরা বাকারার ৪র্থ রুকুতে মূলত আদম আ.-এর সৃষ্টি ও পৃথিবীতে তাঁর কাজ অর্থাৎ মানবজাতির কাজ উল্লেখ করা হয়েছে।

কুরআনে মোট আটটি সূরায় আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা আদম আ.-এর সৃষ্টির ইতিহাস ও উদ্দেশ্য বর্ণনা করেছেন। 'আদম সৃষ্টির হাকিকত' বইয়ের লেখক শহীদ অধ্যাপক গোলাম আযম বইয়ের শুরুতেই আটটি অংশের সরল অনুবাদ করেছেন। এরপর তিনি টোটাল ঘটনা ও উদ্দেশ্যের একটি সামারি টেনেছেন।

এরপর তিনি সূরা বাকারা কেন পরে নাজিল হয়েও আগে স্থান পেয়েছে তার একটি ব্যাখ্যা দেন। লেখকের মতে সূরার বাকার ৪র্থ রুকুর গুরুত্বের কারনেই এমনটা হতে পারে।

এরপর তিনি সূরা বাকারার ৪র্থ রুকুর ভুল ব্যাখ্যা যা সমাজে চালু রয়েছে সেগুলো নিয়ে বর্ণনা ও আলোচনা করেন। এসব ব্যাখ্যা যে ইসলামের মূলনীতির সাথে সাংঘর্ষিক তা আলোচনা করেন।

লেখক গোলাম আযম এরপর সূরা বাকারার ৪র্থ রুকুর সঠিক ব্যাখ্যা কী হতে পারে তা নিয়ে বিশদ আলোচনা করেন। তিনি এখানে ১১ টি পয়েন্টে কথা বলেন।
১. খলিফা ও খিলাফত
২. খিলাফতের দায়িত্ব কী?
৩. ফেরিশতাদের সহযোগিতা
৪. ফেরেশতাদের আশংকা
৫. তাসবিহ ও তাকদিস
৬. আদম আ.-কে জ্ঞান দান
৭. আদম আ.-কে সিজদা করার বিষয়
৮. ইবলিসের নাফরমানি থেকে শিক্ষা
৯. আদম আ.-কে কেন বেহেশতে পাঠানো হলো?
১০. আদম আ.-এর তওবা
১১. জান্নাত থেকে আদম আ.-এর বিদায়

এরপর শহীদ গোলাম আযম এই ইতিহাস বর্ণনার প্রয়োজনীয়তা উল্লেখ করেন। একই কাহিনী থেকে ৫ টি শিক্ষা উল্লেখ করেন ও সেগুলো নিয়ে আলোচনা করেন।

১. দুনিয়ায় আল্লাহর প্রতিনিধির দায়িত্ব পালনই আমাদের বড় কর্তব্য
২. এই কর্তব্যকে উপেক্ষা করে অন্য লক্ষ্যের কাজ মূলত ইবলিসের কুমন্ত্রণা।
৩. ইবলিস ও তার প্রতিনিধিরা আল্লাহর বিধানের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে।
৪. লজ্জাশীলতা ও পর্দা মানুষের স্বাভাবিক আচরণ। ইবলিস এটা নষ্ট করে দিতে চায়।
৫. মানুষের জন্য ভুল করা স্বাভাবিক, কিন্তু ভুলের পর তওবা করা আবশ্যক।

এরপর লেখক মানুষের মর্যাদার কারণ নিয়ে আলোচনা করেন। খিলাফতের দায়িত্বের কারণেই মানুষ সৃষ্টির সেরার মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত হয়েছে। এই বিষয়ে তিনি বিস্তারিত আলোচনা করেন।

লেখক উল্লেখ করেন, মানুষের দায়িত্ব হলো আল্লাহর খিলাফত অর্থাৎ আল্লাহর প্রতিনিধিত্ব করা। আর এই দায়িত্বে ব্যর্থ হওয়া মানেই ইবলিসের খিলাফত বা প্রতিনিধিত্ব করা। সমগ্র মানুষ মূলত দুইটি দলে বিভক্ত। এক. আল্লাহর খলিফা, দুই. ইবলিসের খলিফা।

বইটির শেষে তিনি বাংলাদেশের প্রসঙ্গ আনেন। তিনি প্রশ্ন রাখেন বাংলাদেশে কি আল্লাহর খিলাফত কায়েম আছে? বাংলাদেশ বহু মুসলিমের দেশ হলেও এদেশে আল্লাহর আইন প্রচলিত নয়। যারা এই বাংলাদেশের আইন পরিবর্তনে ভূমিকা রাখছে না, চিন্তা ও ফিকির করছে না তাদেরকে দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন হওয়ার জন্য আহবান করেন।

অনেক আলেম ওলামা ও ইসলামী ব্যক্তিত্বকে দেখা যায় তারা ব্যক্তিগতভাবে খুবই ইসলামপ্রিয় ও তাকওয়াবান। কিন্তু সমাজে ও রাষ্ট্রে আল্লাহর আইন বাস্তবায়নে অর্থাৎ খিলাফতের দায়িত্ব পালনে তাদের সচেষ্ট দেখা যায় না। বরং তাদেরকে বর্তমান প্রচলিত অনৈসলামিক ব্যবস্থায় সন্তুষ্ট থাকতে দেখা যায়। তাদের কথা উল্লেখ করে লেখক বলেন আল্লাহর প্রতিনিধির দায়িত্ব পালন না করা মানেই শয়তানের প্রতিনিধির দায়িত্ব পালন করা। এই কথা লেখক আমাদের সকলকে মনে করিয়ে দেন। এই নিয়ে সতর্ক করেন। আমাদের প্রতি আহবান করেন, আমরা যেন আমাদেরকে দুনিয়ায় পাঠানোর উদ্দেশ্য অর্থ্যাৎ আল্লাহর খিলাফতের দায়িত্ব পালনে সচেষ্ট হই।

মহান রাব্বুল আলামিন আমাদের দায়িত্ব পালনে সচেষ্ট হওয়ার তাওফিক দান করুন। আমিন।

#বুক_রিভিউ
বই : আদম সৃষ্টির হাকিকত
লেখক : অধ্যাপক গোলাম আযম
প্রকাশনী : আধুনিক প্রকাশনী
পৃষ্ঠা : ৬৬
মুদ্রিত মূল্য : ২৫
জনরা : ইডিওলজি



৯ সেপ, ২০২২

জাতীয় ঐক্য ও গণতন্ত্রের ভিত্তি

 


মুসলিম লীগ ১৯৪৭ সালে এই উপমহাদেশের মুসলিমদের জন্য পাকিস্তান রাষ্ট্র আদায় করে দিয়েছে ইংরেজদের কাছ থেকে। এই রাষ্ট্র মুসলিমদের নিরাপত্তায় ব্যাপক ভূমিকা রাখে। মুসলিমরা স্বতন্ত্র জাতির পরিচয় পায়। ১৯২৩ সালে তুর্কি খিলাফত বিলুপ্ত হলে মুসলিম পরিচয়ে আর কোনো রাষ্ট্র অবশিষ্ট থাকে নি। এর কয়েকবছর পর ৬/৭টি ভিন্ন ভাষাভাষি মানুষ শুধুমাত্র মুসলিম পরিচয়ে একত্রিত হয় ও উম্মাহ চেতনায় মুসলিম লীগের নেতৃত্বে পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠন করে। 

কিন্তু মুসলিম লীগের এই বিশাল অর্জন ম্লান হতে থাকে কারণ তারা একটি স্থিতিশীল রাষ্ট্র পরিচালনা করতে সক্ষম হয় নি। একটি সংবিধান বা শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করতে পারেনি। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আগে, আন্দোলনের সময় তারা জাতিকে একটি ইসলামী রাষ্ট্রের কথা বলেছে। কিন্তু রাষ্ট্র গঠন হলে ধর্মনিরপেক্ষ হওয়ার চেষ্টা করেছে। এছাড়াও নাস্তিক্যবাদের চিন্তার হামলা, কমিউনিজম চিন্তার হামলা পাকিস্তানের মুসলিমদের অশান্ত করে তুলেছিল। মুসলিম নেতারা তাদের দায়িত্ব পালনে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছিল। 

এই ব্যর্থতার কথা অনুমান করে মাওলানা সাইয়েদ আবুল আ'লা মওদূদী ১৯৪০ সাল থেকে সতর্ক করে আসছিলেন। যাই হোক তারপরও তিনি পাকিস্তানে চিন্তার ঐক্য প্রতিষ্ঠার জন্য ও পাকিস্তানকে ব্যর্থতার হাত থেকে রক্ষা করার জন্য একটি বক্তব্য দেন ষাটের দশকে। সেখানে জাতীয় ঐক্যের দিকে আহবান জানিয়েছেন সবাইকে। যেভাবে সবাই একত্র হয়েছিল পাকিস্তান আন্দোলনের সময়। 

এই বক্তব্যটি বই আকারে প্রকাশ হয়। পাকিস্তানে বরাবরের মতো এই বইটি বেশ সমাদৃত হয়। বাংলাদেশে এরশাদ ক্ষমতায় আসার পর তার স্বৈরাচারী আচরণ শুরু হয়। জনগণের নেতারা সঠিক নির্দেশনা দিতে ব্যর্থ হতে থাকে। এই পরিস্থিতিতে ১৯৮৪ সালে আব্বাস আলী খান মাওলানা মওদূদীর এই বইটি বাংলায় অনুবাদ করেন। বাংলায় এর নামকরণ হয় জাতীয় ঐক্য ও গণতন্ত্রের ভিত্তি। ছোট বই, কিন্তু নির্দেশনা পরিষ্কার। 

বইটির ভূমিকায় মাওলানা মানুষের প্রকৃতি তুলে ধরে বলেন, সব মানুষ সব বিষয়ে একমত হবে না। হওয়া জরুরীও নয়। তবে মৌলিক কিছু বিষয়ে তাকে একমত হতে হবে জাতির প্রয়োজনে, রাষ্ট্রের প্রয়োজনে, শান্তির প্রয়োজনে, স্বাধীনতার প্রয়োজনে, ধ্বংস থেকে বাঁচার প্রয়োজনে। মাওলানা এরপর স্বাধীনতাত্তর পাকিস্তানের অবস্থা বর্ণনা করেন। এরপর তিনি ঐক্যের জন্য গঠনমূলক উপাদান খুঁজে বের করার আহবান জানান। 

মাওলানা মওদূদী জাতীয় ঐক্যের জন্য পাঁচটি মূলনীতি নির্ধারণ করেন ও সেগুলো ব্যাখ্যা করেন। সেগুলো হলো, 
১. সর্বাবস্থায় সততা ও সুবিচারের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন। 
২. পারস্পরিক সহনশীলতা এবং অন্যের মত প্রকাশের অধিকার মেনে নেওয়া। 
৩. বিরোধীতার খাতিরে বিরোধীতা পরিহার করতে হবে। 
৪. বলপ্রয়োগ ও প্রতারণার পরিবর্তে যুক্তি প্রদর্শন। 
৫. ছোটখাটো ব্যাপারে বিদ্বেষ ও গোঁড়ামি পরিহার করা।   

এরপর মাওলানা পাকিস্তান রাষ্ট্রের শাসন ব্যবস্থার ভিত্তি/ মূলনীতি নিয়ে আলোচনা করেন। মূলনীতিগুলো হলো, 
১. সর্বক্ষেত্রে কুরআন ও সুন্নাহর প্রাধান্য দেওয়া। 
২. গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা। মুসলিমদের মতামত দেবার ও শাসক বাছাইয়ের অধিকার প্রতিষ্ঠা করা। 
৩. গণতন্ত্রের প্রকৃত প্রাণশক্তি ও এর ৫ মূলনীতি 

প্রথমত, রাষ্ট্রের তিনিটি বিভাগ শাসন বিভাগ, বিচার বিভাগ ও আইনসভাকে পৃথক করে দেওয়া। তাদের ক্ষমতার সীমারেখা সুষ্পষ্টভাবে নির্ধারণ করা। 

দ্বিতীয়ত, নাগরিক অধিকার ও স্বাধীনতার নিশ্চয়তা প্রদান এবং তা সংরক্ষণের জন্য বিচার বিভাগকে ক্ষমতা প্রদান। 

তৃতীয়ত, স্বাধীন নির্বাচন কমিশন গঠন ও নির্বাচনের ফলাফল যাতে মুসলিমদের জনমতের ভিত্তিতেই হয়। 

চতুর্থত, আইনের শাসন। শাসক ও শাসিতের জন্য একই আইন হবে। সকলে আইন মানতে বাধ্য থাকবে। আদালত আইন সবার ওপর সমানভাবে প্রয়োগ করবে। 

পঞ্চমত, সরকারি সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তারা রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করবে না। তারা শাসনপদ্ধতি অনুযায়ী কাজ করবে। জনগণ যাদের শাসক মনোনীত করবে তাদের আনুগত্য করবে। 

৪. নির্বাচন হতে হবে অবাধ ও সুষ্ঠু। 

মাওলানা সবশেষে বলেন। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার সাফল্য ও স্থিতিশীলতা নির্ভর করবে সরকারের ওপর। যারা সরকার পরিচালনা করবে তারা যদি গণতন্ত্রের মূলনীতি ও শাসন ব্যবস্থার মূলনীতি মেনে চলে ও সংরক্ষণ করে তবে রাষ্ট্রে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হবে। মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হবে। জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হবে। 


#বুক_রিভিউ
বই : জাতীয় ঐক্য ও গণতন্ত্রের ভিত্তি
লেখক : সাইয়েদ আবুল আলা মওদূদী
অনুবাদক : আব্বাস আলী খান  
প্রকাশনী : মওদূদী রিসার্চ একাডেমি, ঢাকা 
পৃষ্ঠা : ২৬
মুদ্রিত মূল্য : ৯
জনরা : রাজনীতি