৭ ডিসে, ২০২২

খিলাফত পর্ব-৩৮ : উসমান রা.-এর আফ্রিকা অভিযান


উসমান রা.-এর শাসনামলে তিনটি ফ্রন্টে রাষ্ট্রের সীমানা বাড়ে। পূর্বে আফগানিস্তানের কাবুল পর্যন্ত ইসলামী রাষ্ট্রের সীমানা বিস্তৃত হয়। ইউরোপের দিকে ইস্তাম্বুলের প্রণালি পর্যন্ত আর আফ্রিকার দিকে মিশর ছাড়িয়ে লিবিয়া, আলজেরিয়া ও ভূমধ্যসাগরের নিয়ন্ত্রণ নেয় ইসলামী রাষ্ট্র।  


দ্বিতীয় খলিফা উমার রা.-এর আমলে মিসরের রোমান রাজধানী আলেকজান্দ্রিয়া মুসলিমদের অধিকারে আসে। তবে মুসলিমরা ঐ শহরে বসবাসরত রোমানদেরকে বহিষ্কার করেননি। তাছাড়া বিপুল সংখ্যক মুসলিমও আলেকজান্দ্রিয়ায় হিজরাত করেননি। কেবল সীমান্ত পাহারার দায়িত্বে ছিল কিছু মুসলিম সৈনিক। ফলে শহরটিতে অনারব-অমুসলিম নাগরিকের আধিক্য ছিল। অপরদিকে উসমান রা. মিসরের শাসনকর্তার পদে পরিবর্তন আনেন। তিনি আবদুল্লাহ ইবনু সা'দ-কে মিসরের শাসক নিয়োগ করেন। 

আলেকজান্দ্রিয়ায় বসবাসরত রোমানরা এটিকে মুসলিমদের দুর্বলতা হিসেবে চিহ্নিত করে। তারা রোমান সম্রাট কন্সট্যান্টাইনকে হারানো সাম্রাজ্য পুনরুদ্ধারে উস্কানি দিতে থাকে। এদের আবেদনে সাড়া দিয়ে রোমান সম্রাট সেনাপতি মানাভীলের নেতৃত্বে ৩০০ রণতরী সজ্জিত একটি বিরাট বাহিনী আলেকজান্দ্রিয়া পুনরুদ্ধারের মিশনে প্রেরণ করেন। রোমানদের প্রস্তুতির খবর পেয়ে মিসরের মুসলিমরা খালীফা উসমান রা.-কে পরিস্থিতি অবহিত করে পত্র দিল। তারা ও আবদুল্লাহ ইবনু সা'দ মনে করলো আমর ইবনুল আস রা.-কে পুনরায় শাসক নিয়োগ করা দরকার। কারণ রোমানদের যুদ্ধকৌশল সম্পর্কে তিনি সবচেয়ে বেশি ধারণা রাখতেন। 

খলিফা তাদের অনুরোধে সম্মত হয়ে আমর রা.-কে পুনরায় মিসরে প্রেরণ করলেন। রোমান সেনাপতি মানাভীল আলেকজান্দ্রিয়ায় লুটপাটের মাধ্যমে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে কায়রোর দিকে রওয়ানা করল। মানাভীলকে পশ্চাদ্ধাবনের পরামর্শ দিলেন সহযোদ্ধারা; কিন্তু আমর রা.-এর চিন্তা ছিল ভিন্ন। তিনি মানাভীলের লাগাম ছেড়ে দিলেন, তাকে ধ্বংসযজ্ঞ চালানোর সুযোগ দিলেন। প্রকারান্তরে তিনি মিসরবাসীকে তুলনার সুযোগ দিলেন। মিসরবাসী যেন রোমান খৃস্টান ও মুসলিম শাসনের মাঝে তফাৎ উপলব্ধির প্রত্যক্ষ সুযোগ পায়, সে লক্ষ্যে 'আমর ইবনুল আস রা. মানাভীলকে একটু সুযোগ দিলেন। মানাভীল বিনা বাধায় এগিয়ে গেল।  

ইতোমধ্যে আমর রা.-এর সেনাপতিত্বে মুসলিম বাহিনী এগিয়ে গেল নীল নদের তীরে দু'বাহিনীর মাঝে প্রচণ্ড যুদ্ধ হলো। প্রচণ্ড যুদ্ধে আমর রা.-এর ঘোড়া তীরবিদ্ধ হলে তিনি বাহন ছেড়ে দিয়ে পদাতিক বাহিনীতে ঢুকে পড়েন। তীব্র লড়াইয়ের পর রোমান বাহিনী পরাজিত হলো। বিপুল সংখ্যক রোমান সৈনিক নিহত হল। অবশিষ্ট সৈনিক নিয়ে মানাভীল পিছু হটে আলেকজান্দ্রিয়ায় অবস্থান নিল। 

যদিও স্থানীয় খ্রিস্টানদের আহ্বানে রোমান বাহিনী এসেছিল কিন্তু স্থানীয়রা মুসলিমদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেনি। যুদ্ধ শেষে মুসলিমরা জরুরি কিছু সংস্কার কাজ সম্পন্ন করল। রোমানরা পলায়ন-পথে রাস্তাঘাট ও পুল-ব্রিজ ধ্বংস করে দিয়েছিল। মুসলিম বাহিনী বিধ্বস্ত অবকাঠামো জরুরিভিত্তিতে সংস্কার করল। এই কাজে তারা মিসরীয়দের সমর্থন ও সহযোগিতা লাভ করল। এরপর স্থানীয়রা মুসলিম বাহিনীকে প্রয়োজনীয় অস্ত্রশস্ত্র ও রসদ সরবরাহ করল।

আলেকজান্দ্রিয়ায় পৌঁছে মুসলিম বাহিনী শহর অবরোধ করে মিনজানিক দিয়ে হামলা শুরু করল। কয়েকদিন প্রতিরোধের পর স্থানীয়রা গেইট খুলে দিতে বাধ্য হলো। শহরের অভ্যন্তরে দু'বাহিনীর মাঝে তীব্র লড়াই চলল কয়েকদিন। মানাভীলসহ বহু সংখ্যক খৃস্টান সৈন্য নিহত হল, অনেকে পালিয়ে গেল। যুদ্ধ বন্ধ হওয়ার পর আমর ইবনুল আস রা. 'মাসজিদুর রাহমাহ' নামে একটি মাসজিদ নির্মাণ করল। এরপর তিনি অবকাঠামো পুনঃনির্মাণে মনোযোগ দিলেন। আলেকজান্দ্রিয়ায় শান্তি ফিরে এলো। খ্রিস্টান বিশপ বেঞ্জামিন পলায়ন করেছিলেন। শহরের খৃস্টানরা চুক্তিভঙ্গ করেনি; অতএব তাদেরকে নিরাপত্তা দেওয়া হয় এবং নিরাপদে ধর্মকর্ম পালনের সুযোগ দেওয়া হয়। 

দলে দলে মিসরীয়রা এসে আমর রা.-এর কাছে অভিযোগ করল, রোমানরা তাদের গবাদিপশু থেকে শুরু করে সবকিছু লুট করেছে, তাদের লুণ্ঠিত সম্পদ যেন ফেরত দেওয়া হয়। আমর রা. এদের অনুরোধ রাখলেন, রোমানদের ফেলে যাওয়া সম্পদ প্রমাণসাপেক্ষে মিসরীয় মালিকদের কাছে ফেরত দিলেন। এটি মুসলিমদের পরম ঔদার্যের দৃষ্টান্ত হিসেবে উপস্থাপিত হয়। মজলুম মিসরীয়দের অনুরোধের প্রেক্ষিতে আমর রা. দখলদার রোমান বাহিনীর পরিত্যক্ত সম্পদ মালে-গানীমাত হিসেবে বণ্টন না করে মিসরীয়দের মধ্যে বিতরণ করে দিলেন। 

দ্বিতীয় খালীফা উমার রা.-এর সময়ে আমর রা. নুবায় (বর্তমানে সুদান) অভিযান পরিচালনা করেছিলেন। তবে এই অভিযানে মুসলিমরা সুবিধা করতে পারেনি। নুবা-এর কৃষ্ণাঙ্গ যোদ্ধাদের কাছ থেকে তারা তীব্র প্রতিরোধের সম্মুখীন হন। মুসলিমরা অভিনব এক যুদ্ধকৌশলের কাছে পরাস্ত হন। নুবার কালো যোদ্ধা তীর নিক্ষেপে খুবই দক্ষ ছিল। তারা মুসলিম মুজাহিদদের চোখ লক্ষ্য করে তীর নিক্ষেপ করতে থাকে। প্রথম যুদ্ধেই কমপক্ষে ১৫০ জন মুসলিম যোদ্ধা চোখ হারান। বাধ্য হয়ে আমর রা. নুবা-এর অধিবাসীদের সাথে সন্ধি করে ফিরে আসেন।

মিসরের শাসক হিসেবে নিয়োগ লাভের পর আবদুল্লাহ ইবনু সা'দ ৩১ হিজরীতে আবার নুবা'য় অভিযান পরিচালনা করেন। এই যুদ্ধেও বিপুল সংখ্যক মুসলিম যোদ্ধা চোখ হারান। তীব্র লড়াইয়ের পর নুবা'র অধিবাসীরা সন্ধির প্রস্তাব দেয়। প্রস্তাব মেনে নিয়ে ইবনু সা'দ তাদের সাথে সন্ধি করেন যা ছয় শতাব্দী স্থায়ী ছিল। খিলাফাতের ইতিহাসে বিরল এই চুক্তিটি কর বা জিইয়ার বিনিময়ে সম্পাদিত হয়নি। 

নুবা বা সুদান ছিল মরুময় এলাকা; সেখানে শস্য উৎপাদন হত না বললেই চলে। ফলে কর হিসেবে নগদ অর্থ বা শস্য প্রদান তাদের পক্ষে একেবারেই অসম্ভব ছিল। পক্ষান্তরে দারিদ্রের কারণে সেখানে দাস কেনাবেচা হত। অভিভাবকরা স্বেচ্ছায় নিজেদের সন্তান-সন্ততিকে বিক্রি করে দিত। বিক্রি হওয়াকে তারা চাকুরি পাওয়ার মতো সেলিব্রেট করতো। ধরে নেওয়া হতো যে বিক্রি হয়েছে তার আর খাবারের অভাব হবে না। 

মুসলিমদের সাথে সম্পাদিত চুক্তিতে এই দাস হওয়ার প্রতিফলন ছিল। চুক্তির শর্ত ছিল এই: প্রতি বছর নুবাবাসী ৩০০ দাস প্রদান করবে, বিনিময়ে মুসলিমরা (সমমূল্যের) গম ও যবসহ প্রয়োজনীয় খাদ্যশস্য সরবরাহ করবে। পাশাপাশি নুবা'র অধিবাসীদের স্বাধীনতা মেনে নেওয়া হয় এবং মুসলিমদের অবাধ যাতায়াত ও ব্যবসা-বাণিজ্যের সুযোগ স্বীকার করা হয়। এই চুক্তি নুবা'য় ইসলাম প্রচারের বিরাট সুযোগ এনে দেয়; মুসলিমদের সাহচর্যে বিপুল সংখ্যক নুবাবাসী(সুদানবাসী) ইসলাম গ্রহণ করেন।

মিসর-গভর্ণর 'আমর ইবনুল আস রা. আফ্রিকা বিজয়ের সূচনা করেছিলেন। আলেকজান্দ্রিয়ার রোমান বিদ্রোহ দমনের পরই তিনি বারকাহ, যুওয়াইলাহ ও লিবিয়ার ত্রিপলিসহ উত্তর আফ্রিকার কিছু অংশ বিজয় করেছিলেন। আবদুল্লাহ ইবনু সা'দ মিসরের শাসনকর্তা নিযুক্ত হওয়ার পর আফ্রিকা সীমান্তে ক্ষুদ্র অশ্বারোহী বাহিনী প্রেরণ করতেন। ক্ষুদ্র অভিযানসমূহ সাফল্যের সাথে প্রত্যাবর্তন করত। প্রতিবারই গানীমাত অর্জিত হত এবং ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র এলাকা বিজিত হত।

আফ্রিকার মানবসম্পদ, প্রাকৃতিক সম্পদ, প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাসহ বিভিন্ন বিষয়ে সবিস্তারে সংবাদ সংগ্রহের পর 'আবদুল্লাহ ইবনু সা'দ গোটা আফ্রিকায় বড় অভিযান পরিচালনার অনুমতি চেয়ে উসমান রা.-এর কাছে লিখলেন। খালীফা উসমান রা. নেতৃস্থানীয় সাহাবায়ে কিরামের সাথে পরামর্শ করলেন; দুয়েকজন ছাড়া বেশির ভাগ সাহাবী অভিযানের পক্ষে মত দিলেন। আফ্রিকা অভিযানের পক্ষে ইতিবাচক সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর উসমান রা. জিহাদের অংশগ্রহণের জন্য উদাত্ত আহ্বান জানালেন। বিপুল সংখ্যক মুজাহিদ খালীফার ডাকে সাড়া দিলেন। অল্প সময়ের মাঝেই খিলাফাতের রাজধানী মাদীনাতেই বিশাল স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী প্রস্তুত হল। 

বিশিষ্ট ব্যক্তিদের মাঝে রাসূলুল্লাহ সা.-এর নাতি হাসান রা. ও আল-হুসাইন রা., মা'বাদ ইবনু 'আব্বাস, আবদুর রহমান ইবনু যায়িদ ইবনিল খাত্তাব, আবদুল্লাহ ইবনু উমার রা., আসিম ইবনু উমার, উবাইদুল্লাহ ইবনু 'উমার, আবদুর রহমান ইবনু আবি বাকর, আবদুল্লাহ ইবনু আমর ইবনিল আস প্রমুখ সেনাবাহিনীতে যোগ দিলেন। 

উসমান রা. নিজেও যুদ্ধ প্রস্তুতিতে অংশগ্রহণ করলেন। তিনি এক হাজার উট দিলেন। রওয়ানা করার প্রাক্কালে খালীফা সৈনিকদের উদ্দেশ্যে উদ্দীপক ভাষণ দিলেন। আল-হারিছ ইবনুল হাকামকে সেনাপতি নিয়োগ করা হল। মাদীনার বাহিনী মিসরীয় বাহিনীর সাথে যোগ দিল। যৌথ বাহিনী আবদুল্লাহ ইবনু সা'দ-এর নেতৃত্বে ফুসতাত হতে বের হয়ে মিসর ও লিবিয়া সীমানা ধরে এগিয়ে গেল। 

২০ হাজার সৈন্য নিয়ে মুসলিম বাহিনী বারকাহ-এ পৌঁছলে উকবা ইবনু নাফি আল-ফিহরী তাদের সাথে যোগ দিলেন। তিনি আগে থেকেই এই অঞ্চলে অবস্থান করছিলেন। বারকাহ অঞ্চল মুসলিম বাহিনী নির্বিঘ্নে অতিক্রম করল। আবদুল্লাহ ইবনু সা'দ সেনাবাহিনীকে নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার পথে সতর্কতামূলক পদক্ষেপ হিসেবে অগ্রবর্তী গোয়েন্দা বাহিনী প্রেরণ করলেন। এদের কাজ ছিল যাত্রাপথের কোথাও শত্রুবাহিনী লুকিয়ে থাকলে তার সংবাদ দেওয়া। এই পদক্ষেপের সুফল অতি দ্রুতই পাওয়া গেল। অগ্রবর্তী গোয়েন্দা দল ত্রিপলীর উপকূলে ভূমধ্যসাগরের তীরে কয়েকটি রোমান রণতরী দেখতে পেল। আবদুল্লাহ অতি দ্রুত একদল সৈনিক উপকূল পানে প্রেরণ করলেন, তারা শতাধিক রোমান সৈন্যকে আটক করল এবং অস্ত্রশস্ত্র ও রসদ সামগ্রীসহ বিপুল পরিমাণ গনীমাতের সম্পদ লাভ করলেন। 

অগ্রবর্তী গোয়েন্দা বাহিনী কর্তৃক সরবরাহকৃত তথ্যের আলোকে পদক্ষেপ গ্রহণ করে 'আবদুল্লাহ ইবনু সা'দ এগিয়ে গেলেন। আফ্রিকার তৎকালীন রাজধানী সুবাইতালাহ শহরে পৌঁছে শত্রু বাহিনীর দেখা মিলল। এক পক্ষে আবদুল্লাহ ইবনু সা'দ-এর নেতৃত্বাধীন মুসলিম বাহিনী, অপরপক্ষে আফ্রিকার রোমীয় শাসক জারজির নেতৃত্বাধীন এক লক্ষ বিশ হাজার সৈন্যের রোমান বাহিনী। চূড়ান্ত যুদ্ধ শুরুর পূর্বে দু'সেনাপতির মাঝে কয়েক দফা পত্র ও দূত বিনিময় হয়। আবদুল্লাহ ইবনু সা'দ এই সুযোগে ইসলামের সুমহান দাওয়াত উপস্থাপন করলেন। 

তিনি জারজিরকে ইসলামের দিকে আহ্বান জানালেন। বিকল্প হিসেবে জিজিয়া আদায় করে ইসলামী খিলাফাত-এর কর্তৃত্বের অধীনে স্বধর্মে বহাল থাকার এবং স্বশাসন বজায় রাখার সুযোগ গ্রহণের আহ্বান জানালেন। জারজির ও তার বাহিনী দম্ভভরে এই দাওয়াত প্রত্যাখ্যান করল, ফলে যুদ্ধ অনিবার্য হয়ে পড়ল। কয়েকদিন ঘোরতর যুদ্ধ চলল। অমীমাংসিত এই যুদ্ধে নির্ণায়কের ভূমিকা পালন করলেন আবদুল্লাহ ইবনে যুবাইর রা.। স্বীয় বাহিনী নিয়ে তিনি মুসলিম বাহিনীর সাথে যোগদান করলে মুসলিমদের শক্তিবৃদ্ধি হয়। তাঁর হাতেই রোমান শাসক জারজির প্রাণ হারান।
 
রোমান শাসক জারজিরের পরিণতি দেখে উপকূলের অধিবাসীরা রণে ভঙ্গ দিল। তারা কর দেওয়ার বিনিময়ে মুসলিমদের সাথে সন্ধি করার প্রস্তাব দিল। আবদুল্লাহ ইবনু সা'দ তাদের প্রস্তাব মেনে নিলেন। বার্ষিক জিযইয়া হিসেবে তারা ৩০০ কিনতার স্বর্ণ নির্ধারণ হলো। তবে শর্ত ছিল মুসলিমরা তাদের এলাকা ছেড়ে চলে যাবে এবং চুক্তি ভঙ্গ না করলে পুনরায় হামলা করবে না। চুক্তির পূর্বে যা মুসলিমদের হস্তগত হয়েছে তা ফেরত দিতে হবে না, তবে চুক্তির পর যা মুসলিমরা নিয়েছে তা ফেরত দেবে। আবদুল্লাহ তাদের প্রস্তাব মেনে নিলেন এবং মিসরে ফিরে গেলেন। 

ইসলামের ইতিহাসে যাতুস সাওয়ারী যুদ্ধ অবিস্মরণীয় হয়ে আছে। এটি প্রথম নৌযুদ্ধ- যাতে মুসলিমরা রোমানদেরকে পর্যুদস্ত করেছিল। আফ্রিকায় সাম্রাজ্য হারানোর পর রোমানরা ভূমধ্যসাগরের কিছু অংশের কর্তৃত্বও মুসলিমদের কাছে হারায়। রাদূস থেকে বারকাহ পর্যন্ত দীর্ঘ উপকূলজুড়ে মুসলিমদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়। রোমান সম্রাট কস্ট্যান্টাইন-এর নিকট ব্যাপারটি ছিল অত্যন্ত লজ্জাজনক। তিনি আফ্রিকার হারানো সাম্রাজ্য পুনরুদ্ধারে সংকল্পবদ্ধ হলেন। আলেকজান্দ্রিয়া ছিল রোমান মিসরের রাজধানী; এটি পুনরুদ্ধার করাও ছিল তাঁর নিকট অনেক গুরুত্বপূর্ণ। 

রোমান সম্রাট ১০০০ যুদ্ধজাহাজ সমৃদ্ধ একটি নৌবহর প্রস্তুত করলেন। রোমানদের প্রস্তুতির সংবাদ মুসলিমদের কাছে পৌঁছলে উসমান রা. আক্রমণকারী শত্রুর প্রতিরোধে পর্যাপ্ত প্রস্তুতি নিতে সংশ্লিষ্ট শাসকদেরকে নির্দেশ দিলেন। খালীফার আদেশ পেয়ে মু'আবিয়া রা. সিরিয়ার নৌযানগুলো বুসর ইবনু উরতা-এর নেতৃত্বে আলেকজান্দ্রিয়ায় পাঠিয়ে দিলেন। অন্যদিকে মিসরের নৌযানগুলো 'আবদুল্লাহ ইবনু সা'দ রণসাজে সজ্জিত করলেন। সিরিয়া ও মিসরের নৌবহরের সম্মিলিত নৌযান সংখ্যা ছিল দুইশ। মিসর শাসনকর্তা আবদুল্লাহ ইবনু সা'দের নেতৃত্বে মুসলিম নৌবহর রওয়ানা করল। 

রোমানরা তীরে নামতে অস্বীকার করল আর ভূমধ্যসাগরের বিশাল জলরাশিতে নৌযুদ্ধে অবতীর্ণ হতে মুসলিমদের বাধ্য করলো। যেহেতু সমুদ্রের যুদ্ধে রোমানরা পারদর্শী ছিল তাই তারা ছিল খোশমেজাজে। রোমানরা সারারাত বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে আনন্দ করল। পক্ষান্তরে মুসলিমগণ সালাত, দু'আ ও যিকরে রাত কাটিয়ে দিলেন। কনস্ট্যান্টাইন খুব সকালে যুদ্ধ শুরু করতে চাইলেন। অন্যদিকে 'আবদুল্লাহ ইবনু সা'দ জামাআতের সাথে ফাজর সালাত আদায়ের পর শীর্ষ কমাণ্ডারদের সাথে পরামর্শ করলেন; আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে অত্যন্ত চমৎকার একটি কৌশল বেরিয়ে এল। মুসলিমগণ সিদ্ধান্ত নিলেন তারা সাগরকে স্থলভাগ বানিয়ে যুদ্ধ করবেন। 

প্রথমে তারা নিজেদের নৌযানগুলো শত্রুর নৌযানের কাছাকাছি নিয়ে গেলেন। তারপর কমাণ্ডো বাহিনী সাগরে নেমে পড়লেন। অতঃপর শক্ত দড়ি দিয়ে মুসলিম বাহিনীর নৌযানের সাথে রোমান বাহিনীর নৌযানগুলো বেঁধে ফেলা হল। সাগরে ১২০০ নৌযান, প্রতি ১০ টি বা ২০ টি নৌযান একত্রে বাঁধা; সাগরে সৃষ্টি হল কয়েক টুকরা ভূখণ্ড। এভাবে অথৈ জলরাশিতে অবস্থান করেও স্থলযুদ্ধ পরিচালনার পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হল। যুদ্ধজাহাজের চার কিনারায় সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে মুসলিমগণ প্রস্তুত হলেন। 'আবদুল্লাহ ইবনু সা'দ দিকনির্দেশনামূলক উজ্জীবনী বক্তৃতা দিলেন। তিনি যোদ্ধাদেরকে সূরাতুল আনফাল তিলাওয়াত করতে বললেন।

নৌযুদ্ধে সাফল্য লাভের ব্যাপারে রোমানরা অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসী ছিল। ভূমধ্যসাগরে তারা দোর্দণ্ড প্রতাপে দীর্ঘদিন আধিপত্য বিস্তার করে আসছে, অন্যদিকে মুসলিমদের জন্য ছিল এটিই প্রথম নৌযুদ্ধ। আত্মবিশ্বাসী রোমানরা প্রথমে আক্রমণ চালাল। তারা মুসলিমদের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ধ্বংস করে দিতে চাইল, অপর পক্ষে মুসলিমরাও তীব্র প্রতিরোধ চালিয়ে গেল। দু'পক্ষ কয়েকদিন ধরে লড়াই চালিয়ে গেল। বিপুল সংখ্যক যোদ্ধা হতাহত হল। বহু লাশ সাগরে ভেসে গেল। ভয়ংকর যুদ্ধ বেধে গেল। নানান প্রতিকূলতা সত্ত্বেও মুসলিমরা যুদ্ধে তাদের অবস্থান ধরে রাখলো। 

অবশেষে আল্লাহর সাহায্যে মুসলিমরা যুদ্ধে জয়ী হয়। সম্রাট কনস্ট্যান্টাইন নিজেও আহত হলেন। স্বীয় বাহিনীর দুরবস্থা দেখে তিনি কিছু অনুচর সহযোগে পালিয়ে সিসিলি দ্বীপে আশ্রয় নিলেন। রোমান সম্রাট আশ্রয় নেওয়ার পর দ্বীপটিতে প্রচণ্ড ঝড় শুরু হল। দ্বীপবাসী আশ্রিতদের কাছে জানতে চাইল কেন তারা পালিয়ে এসেছে। তারা প্রকৃত ঘটনা জানিয়ে দিলে সিসিলিবাসী বলল, ‘আপনি খৃস্টবাদকে ধ্বংস করেছেন এবং এর অনুসারীদেরকে নিঃশেষ করেছেন, মুসলিমরা যদি এখানে আসে তবে কেউ তাদেরকে ঠেকাতে পারবে না।' মুসলিমদের হাতে পরাজিত খৃস্টান শাসককে আশ্রয় দেয়নি সিসিলিবাসী; তারা কনস্ট্যান্টাইনকে হত্যা করল। 

ইতিহাসে বিখ্যাত এই যুদ্ধের পূর্ব পর্যন্ত দোর্দণ্ড প্রতাপে ভূমধ্যসাগর নিয়ন্ত্রণ করত রোমানরা। যাতুস সাওয়ারী যুদ্ধের পূর্বেই মিসর ও আফ্রিকা তাদের হাতছাড়া হয়। এই যুদ্ধের পর ভূভাগের পাশাপাশি সমুদ্রও তাদের নিয়ন্ত্রণমুক্ত হয়। সমগ্র ভূমধ্যসাগরে মুসলিম কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়। ইতোপূর্বে যে অঞ্চলগুলোতে ইসলামের বিজয় হয়েছিল সেগুলো ছিল স্থলভাগের এলাকা। ভূমধ্যসাগরে মুসলিম কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর বিভিন্ন দ্বীপে ইসলামের দাওয়াত সম্প্রসারণের সুযোগ সৃষ্টি হয়। মুসলিম দা'ঈগণ এই সুযোগ গ্রহণ করলেন এবং দূর-দূরান্তের দ্বীপগুলোতে ইসলামের আদর্শ পৌঁছে দিলে লাগলেন। 

ক্রীট, কোর্সিকা, সার্দিনিয়া, সিসিলিসহ ভূমধ্যসাগরীয় অন্যান্য দ্বীপ মুসলিম অধিকারে আসল এবং তথায় ইসলামের সুমহান দাওয়াত পৌঁছে গেল। ভূমধ্যসাগর, লোহিত সাগর, আরব সাগর, ভারত মহাসাগরে মুসলিমদের আধিপত্য ধরে রাখার জন্য ব্যাপকহারে নৌবিদ্যা ও তৎসংশ্লিষ্ট বিষয়গুলোর চর্চা শুরু হয়। বাণিজ্যতরী ও যুদ্ধজাহাজ নির্মাণশিল্পের বিস্তার ঘটে। নৌযান সংক্রান্ত জ্ঞানবিজ্ঞানের সকল শাখায় মুসলিম নাবিকরা শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করেন। আরব নৌবহরের এই আধিপত্য ষোড়শ শতকে ইউরোপীয়দের সমুদ্রাভিযানের পূর্ব পর্যন্ত অব্যাহত ছিল। মুসলিমদের নৌবিদ্যায় শ্রেষ্ঠত্বের সূচনা হয়েছিল যাতুস সাওয়ারী যুদ্ধে বিজয়ের মাধ্যমে।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন