উসমান রা. অবরুদ্ধ থাকা অবস্থায় মদিনাবাসী বিদ্রোহীদের অবস্থানকে অন্যায্য মনে করেনি। সবাই ভেবেছিল মারওয়ানকে শাস্তি দেওয়া কিংবা বিভিন্ন প্রদেশে থাকা উমাইয়া গভর্নরদের প্রত্যাহারের মাধ্যমে এই সমস্যার সমাধান হবে। কিন্তু উসমান রা.সহ সাহাবাদের একটা অংশ ভেবেছে আন্দোলনকারীরা মিথ্যা ও জাল চিঠি দিয়ে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে চাইছে। কেউ কেউ ভেবেছেন এটা মারওয়ানের কাজ। আবার কেউ ভেবেছেন উসমান রা. নিজেই বিদ্রোহীদের হত্যার আদেশ দিয়েছেন।
এই অচলাবস্থার মধ্যে বিদ্রোহীদের কয়েকজন উসমান রা.-কে হত্যা করে। এর ফলে বিদ্রোহীদের কেউ কেউ অনুতপ্ত হলেও মদিনা কার্যত বিদ্রোহীদের অধীনে চলে যায়। বিদ্রোহীরা আরো শক্তিশালী হয়ে ওঠে। আর মদিনার লোকেরা কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে যায়। তারা ভাবতেই পারে নি উসমান রা.-কে খুন করে ফেলা হবে। এতে মদিনাবাসী বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে।
ঘটনা খুনোখুনি পর্যন্ত গড়াতে পারে এমন আশংকা কেউ কেউ তো অবশ্যই করেছেন। এর মধ্যে আলী রা. অন্যতম। তিনি তাঁর দুই ছেলে ও ৭০০ সেনাকে উপস্থিত থেকে খলিফাকে নিরাপত্তা দেয়ার জন্য আদেশ করেছেন। এর মধ্যে হাসান রা. ও হুসাইন রা. উভয়ে উসমান রা.-এর ঘরের অভ্যন্তরে ছিলেন। উসমান রা. নিজের নিরাপত্তা বাদ দিয়ে নিজেকে বিদ্রোহীদের কাছে সমর্পন করেছেন। তিনি বুঝেছিলেন তিনি খুন হবেনই। তাই এই খুনোখুনিকে তিনি বাড়াতে চান নি। নিজের খুনের মাধ্যমেই বিশৃঙ্খলার পরিসমাপ্তি চেয়েছিলেন।
তিনি তার বাড়ি থেকে সমস্ত প্রতিরক্ষার ব্যবস্থা তুলে দেন। এই প্রতিরক্ষা মূলত আলী রা.-এর নির্দেশে তৈরি হয়েছিল। সর্বশেষ যিনি উসমান রা.-এর বাড়ি থেকে বের হন তিনি হলেন হাসান রা.। এরপর বিদ্রোহীরা উসমান রা.-কে হত্যা করে। হত্যার ফলে মুসলিমরা মোটাদাগে দুই পক্ষ হয়ে গেল। এক পক্ষ বিদ্রোহী, যারা মিশর, কুফা ও বসরা থেকে মদিনায় এসেছে। এদের সমর্থনে মদিনার কিছু লোককেও দেখা যায়। এরা উসমান রা.-এর খুনকে বৈধ ভেবেছে। তাদের দাবি উসমান রা. প্রতারণা করে তাদের হত্যার নির্দেশ হত্যাযোগ্য অপরাধ করেছে। অন্য পক্ষ হলো যারা খলিফা উসমান রা.-এর খুনকে ভয়ংকর অপরাধ বলে বিবেচনা করেছে। তারা এর শাস্তি ও বিদ্রোহীদের দমন চেয়েছিল। বেশিরভাগ সাহাবী ও মদিনাবাসী এই পক্ষে ছিলেন। এই পক্ষের অনেকে মারওয়ান ও উসমান রা.-এর ওপর বিরক্ত থাকলেও তাকে খুন করা বরদাশত করতে পারেন নি।
এই ফিতনার মধ্যেও দুই পক্ষ এক বিষয়ে মোটামুটি একমত হয়ে গিয়েছে। আর তা হলো আলী রা.-কে নেতা হিসেবে মেনে নেওয়া। ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় আলী রা. নিজেকে গুটিয়ে ফেলেন। তিনি ঘরের মধ্যে দরজা বন্ধ করে অবস্থান করেন। মদিনাবাসী বিশেষ করে সাহাবীদের ডাকে তিনি দরজা খুলতে বাধ্য হন। সাহাবারা তাঁর ব্যাপারে ঐক্যমত পোষণ করে বাইয়াত নিতে থাকেন। এদিকে আমরা আগ থেকেই জানি উসমান রা.-কে প্রত্যাখ্যান করে মিসরের বিদ্রোহীরা আলী রা.-কে খলিফা হিসেবে প্রস্তাব করেছিল। কুফার বিদ্রোহীরা যুবাইর রা.-কে খলিফা হিসেবে দেখতে চেয়েছে আর বসরার বিদ্রোহীরা তালহা রা.-কে খলিফা হিসেবে দেখতে চেয়েছিল।
তালহা রা. ও যুবাইর রা. প্রথমেই আলী রা.-এর কাছে বাইয়াত নেন। ফলে বসরা ও কুফার লোকদের আলী রা.-কে নেতা মানতে কোনো অসুবিধা হয়নি। আসলে নতুন খলিফা কে হবে এই নিয়ে বিদ্রোহীদের কোনো মাথাব্যথা ছিল না। তারা উসমান রা. ও তার পরিবারের সদস্যদের ব্যাপারে ক্ষুব্ধ ছিল। সর্বসম্মতিক্রমে আলী রা.-এর কাছে মুসলিমরা আনুগত্যের বাইয়াত নিল। তালহা রা. ও যুবাইরা রা.-কে আলী রা. তাঁর পাশে থাকতে বলেছেন। তিনি বলেছেন, তোমরা আমার কাছে অবস্থান করো, আর এতে আমি স্বস্তি বোধ করবো।
কিছু বর্ণনায় পাওয়া যায়, শুরুতে কয়েক ব্যক্তি আলী রা.-এর কাছে বাইয়াত নেন নি। তারা হলেন, হাসসান বিন সাবিত রা., কা'ব বিন মালিক রা., আসলামা ইবনে মাখলাদ, মুহাম্মদ বিন মাসলামা, নুমান ইবনে বশীর রা., যায়দ বিন সাবিত রা., রাফি বিন খাদিজ এবং কা'ব বিন উজরা রা.। তবে এই কথা কেউ কেউ অস্বীকার করেছেন। তারা বলেছেন ফিতনার সময়ে তারা আলী রা.-কে সাহায্য করেন নি তবে আনুগত্যের বাইয়াত নিয়েছেন। তবে এই কথা নিশ্চিত আলী রা.-এর প্রতি বাইয়াতের ব্যাপারে কেউ বিরোধীতা করেননি।
সাহাবাদের বাইয়াত গ্রহণের পর আলী রা. জনগণের রায় নিতে চান। এই কারণে তিনি জনগণের উদ্দেশে ভাষণ দেন। তাঁর এই ভাষণ মদিনাবাসী ও তিন প্রদেশ থেকে আগত বিদ্রোহীরা একইসাথে শুনেছে। এর আগে তাঁরা একইসাথে বাইয়াত গ্রহণ করেছেন। আলী রা.-এর খিলাফত গ্রহণ মূলত একটি সমাধানমূলক ও রাষ্ট্রকে স্থিতিশীলতার দিকে নিয়ে গিয়েছিল।
ভাষণে আলী রা. প্রথমে আল্লাহর প্রশংসামূলক বাক্য উচ্চারণ করেন। যেসব সাহাবী তাঁকে খিলাফত গ্রহণের ব্যাপারে পীড়াপীড়ি করেছিলেন তাদের কথা উল্লেখ করে বলেন, আমি খিলাফতের দায়িত্ব নিতে মোটেই আগ্রহী ছিলাম না। তোমরাই আমাকে এই পদে আসিন হতে বাধ্য করেছ। তোমাদের সাহায্য ছাড়া আমি কোনো কাজই সঠিকভাবে করতে পারবো না।
হে লোকসকল! খলিফা নির্বাচনের ব্যাপারটি কেবলই তোমাদের নিজস্ব ব্যাপার! তোমাদের মনোনয়ন ছাড়া এতে কারো হস্তক্ষেপ নেই। যে সিদ্ধান্তের ওপর সাহাবাদের বৈঠক শেষ হয়েছে, তোমরা যদি রাজি থাকো তবে সেই সিদ্ধান্ত বহাল থাকতে পারে। অন্যথায় আমার কারো প্রতি কোনো অভিযোগ নেই। তোমরা তোময়াদের নেতা অন্য কাউকে নির্ধারণ করতে পারো। এরপর তিনি সবার উদ্দেশে বলেন, তোমরা কি আমার প্রতি রাজি আছো? উপস্থিত জনগণ সমস্বরে উত্তর করলো, হ্যাঁ। আমরা আপনার ওপর রাজি।
আলী রা. বললেন। হে আল্লাহ! তুমি সাক্ষী থাকো।
এরপর সর্বস্তরের জনগণ দলে দলে বাইয়াত নিতে থাকলো। বাইয়াত শেষ হলে তিনি বলেন, তোমরা আমার কাছ থেকে এমন বিষয়ের ওপর বাইয়াত গ্রহণ করেছ যে বিষয়ে তোমরা আমার পূর্বে আমার তিন সুহৃদের (পূর্বের তিন খলিফা) কাছ থেকে নিয়েছ। যেহেতু তোমরা আমার কাছে বাইয়াত নিয়েছ অতএব আমার ব্যাপারে আনুগত্যহীনতার অধিকার নেই তোমাদের। ইমামের জন্য অবিচলতা জরুরি। আর জনগণের জন্য আনুগত্য জরুরি।
তারপর তিনি তার ভাষণে বলেন,
নিঃসন্দেহে আল্লাহ তায়ালা এক পথপ্রদর্শক কিতাব নাজিল করেছেন এবং তাতে ভালো-মন্দ স্পষ্ট করে দিয়েছেন। সুতরাং তোমরা ভালোটা গ্রহণ করবে ও মন্দ পরিত্যাগ করবে। আল্লাহ তায়ালা কিছু জিনিস হারাম করেছেন তা স্পষ্ট। মুসলিমদের মর্যাদা ও পবিত্রতাকে হারামের ওপর প্রাধান্য দিয়েছেন। আর মুসলিমদের অধিকারকে বেঁধে দিয়েছেন ইসলাম ও তাওহীদের সঙ্গে।
আর মুসলিম তো সে ব্যক্তি যার হাত ও জিহবা থেকে অপর মুসলমান নিরাপদ থাকে। অবশ্য সত্য ও ন্যায়ের জন্য তা লঙ্ঘিত হতে পারে। কোনো মুসলিমকে কষ্ট দেওয়া অপর মুসলিমের জন্য বৈধ নয়। কষ্ট দেওয়া অপরিহার্য হলে ভিন্ন কথা। তোমরা মৃত্যুর কথা বেশি করে চিন্তা করবে। লোকেরা রয়েছে তোমাদের সম্মুখে আর তোমাদের পেছনে রয়েছে কিয়ামত। কিয়ামতই তোমাদের পেছন থেকে হাঁকিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। তোমরা হালকা থাকবে, তাহলে মিলিত হয়ে যাবে। কারণ মানুষের শেষ ঠিকানা তার প্রতিক্ষায় রয়েছে।
মানুষের (হকের) ব্যাপারে আল্লাহকে ভয় করে চলবে। তাদের (হকের) ব্যাপারে তোমাদের জিজ্ঞাসা করা হবে। এমনকি চতুষ্পদ জন্তু ও জায়গা-জমির ব্যাপারেও জিজ্ঞাসিত হবে তোমরা। অতএব তোমরা আল্লাহর আনুগত্য করবে তার অবাধ্যতা করবে না। ভালো কিছু দেখলে গ্রহণ করবে আর মন্দ দেখলে তা পরিত্যাগ করবে।
স্মরণ করো, যখন তোমরা ছিলে অল্প। পরাজিত অবস্থায় ছিলে, ভীত সন্ত্রস্ত ছিলে। বিভিন্ন অন্যায় তোমাদের ছোঁ মেরে নিয়ে যেত। তারপর আল্লাহ তোমাদের আশ্রয়ের ঠিকানা দিয়েছেন। স্বীয় সাহায্য দ্বারা তোমাদের শান্তি দিয়েছেন। পরিচ্ছন্ন জীবিকা দিয়েছেন, যাতে তোমরা শুকরিয়া আদায় করো।
এরপর আলী রা. আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করে ভাষণ শেষ করেন। অস্বস্তিকর মদিনায় স্বস্তির হাওয়া বইতে শুরু করলো। মুসলিমদের মধ্যে যুদ্ধংদেহী মনোভাব দূর হলো। কিন্তু এরপরও স্বস্তির মধ্যে খচ খচ করছে উসমান রা.-এর শাহদাত। হত্যাকারীরা তো নিরাপদে পার পেয়ে যাচ্ছে। উসমান রা.-এর হত্যার বদলা নেওয়ার কথা সাহাবাদের কেউ কেউ উচ্চারণ করছিলেন। উমাইয়া বংশের লোকেরা আলী রা.-কাছে বাইয়াত নিয়েছে। কিন্তু তারা দ্রুতই বিদ্রোহীদের শাস্তি ও হত্যাকারীদের কিসাসের জন্য দাবি তুলেছিল।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন