৭ ফেব, ২০২৪

যেভাবে ছাত্রশিবির এলো দুনিয়ায় || ১ম পর্ব



১৯৪১ সালের ২৬ আগস্ট ৭৫ জন নিয়ে জামায়াত যখন প্রতিষ্ঠা হয় তখন একজনমাত্র বাঙালি সেখানে উপস্থিত ছিলেন। তাঁর নাম মাওলানা আতাউল্লাহ বুখারী। তিনি তৎকালীন বাকেরগঞ্জ জেলার পটুয়াখালী শহরের বাসিন্দা ছিলেন। মাওলানা ৭৫ জনের মধ্যে ১৬ জনকে নিয়ে মজলিসে শুরা গঠন করেছিলেন সেই মজলিশে শুরাতেও ছিলেন মাওলানা আতাউল্লাহ বুখারী। সেই হিসেবে ১ম বাঙালি রুকন ও ১ম বাঙালি শুরা সদস্য ছিলেন তিনি। তবে তিনি দুই বছরের মধ্যে জামায়াত ত্যাগ করেন।

১৯৪৬ সালে জামায়াতের সম্মেলনে যোগ দেন মাওলানা আব্দুর রহীম। তিনি কলকাতা থেকে সেখানে গিয়েছেন। তখন তার বয়স ২৮ বছর। তিনি মাওলানার সাথে দেখা করেন ও রুকন শপথ নেন। সেই হিসেবে ২য় বাঙালি রুকন হলেন মাওলানা আব্দুর রহীম। তিনি সেখান থেকে ফিরে এসে নিজ গ্রামে অর্থাৎ পিরোজপুর জেলার কাউখালী থানার শিয়ালকাঠি গ্রামে দাওয়াতী কাজ করেন। সেখানে তিনি ১০-১২ জন যুবককে ইকামাতে দ্বীনের কাজের জন্য রাজি করান। এদেরকে নিয়ে গঠিত হয় বাংলার ১ম ইউনিট। ইউনিট সভাপতি ছিলেন মাওলানা লেহাজ উদ্দিন।

মাওলানা আব্দুর রহীম নাজিরপুরে একটি মাদ্রাসার হেড মাওলানা পদে চাকুরি শুরু করেন। এই মাদ্রাসাতেও আরেকটি ইউনিট তিনি গঠন করেন। এখানে স্থানীয় অতুল চন্দ্র ও ভবানীসেন নামে দুই বাম কমরেডের সাথে প্রায়ই মাওলানা আব্দুর রহীমের বিতর্ক হতো। সেই সূত্রে তিনি ইসলাম, কমিউনিজম ও অর্থনীতি নিয়ে 'ইসলামে অর্থনীতি' নামে একটি বই লিখে ফেলেন।

১৯৪৮ সালেও ঢাকায় কাজ শুরু করা যায়নি। ততক্ষণে পাকিস্তান গঠিত হয়েছে। ইংরেজমুক্ত হয়েছে উপমহাদেশ। ঢাকায় কাজ নিয়ে কেন্দ্র বেশ কয়েকটি উদ্যোগ গ্রহণ করেছে, কিন্তু সেভাবে সফল হওয়া যায়নি। ১৯৪৮ সালে খুরশিদ আহমদ বাট নামে একজন সরকারি কর্মকর্তা করাচি থেকে ঢাকায় ট্রান্সফার হয়েছিলেন। তিনি রুকন ছিলেন। তিনি খুব করে চেয়েছিলেন যাতে ঢাকায় কাজ শুরু করা যায়। এজন্য তিনি কেন্দ্রকে জানিয়েছেন। কেন্দ্র তাকে মাওলানা আব্দুর রহীমের ঠিকানা দেন।

খুরশিদ আহমদ বাট ঢাকায় এসে চাকুরিতে জয়েন করেন। তিনি মাওলানা আব্দুর রহীমকে চিঠি লিখেন। চিঠিতে তিনি তাঁকে ঢাকায় আসতে অনুরোধ করেন। জবাবে মাওলানা আব্দুর রহীম জানান, ঢাকায় শুধু থাকার একটি জায়গা দিতে পারলে তিনি নির্দ্বিধায় চলে আসবেন। খুরশিদ আহমদ বাট একটি প্রশস্ত রুম ভাড়া করেন আব্দুর রহীম সাহেবের জন্য। এপ্রিলেই আব্দুর রহীম সাহেব ঢাকায় চলে আসেন। তাঁরা দুইজন ঢাকার কাজ নিয়ে পরিকল্পনা করতে থাকেন।

১৯৪৮ সালের মাঝামাঝিতে মাওলানা মওদূদী রহ. ঢাকায় কাজ করার জন্য বাগ্মী ও বিখ্যাত দায়ি রফি আহমদ ইন্দোরিকে ঢাকায় প্রেরণ করেন। ইতোমধ্যে ১৯৪৭ সালে স্বাধীনতা লাভের পরে আলিয়া মাদ্রাসা কলকাতা থেকে ঢাকায় স্থানান্তরিত হয়। সেখানের একজন শিক্ষক ছিলেন মাওলানা কারি জলিল আশরাফ নদভী। রফি আহমদ ইন্দোরীর নেতৃত্বে ঢাকায় এখন রুকন চারজন।
১. রফি আহমদ ইন্দোরি
২. কারি জলিল আশরাফ নদভী
৩. খুরশিদ আহমদ বাট
৪. মাওলানা আব্দুর রহীম

এর মধ্যে শুধু আব্দুর রহীম ছাড়া বাকিরা ছিল অবাঙালী। ঢাকায় কাজের সম্প্রসারণ বেশি হয় মুহাজিরদের মধ্যে। লালবাগ, নবাবপুর, মিরপুর ও মোহাম্মদপুরে মুহাজিরদের মধ্যে জামায়াতের কাজ দ্রুত বাড়তে থাকে।

এরমধ্যে মাওলানা আব্দুর রহীম দাওয়াতী কাজে ভীষণ পারদর্শী হয়ে উঠলেন। তাকে সামনে রেখেই রফি আহমদ ইন্দোরি ঢাকাকে জামায়াতের শহরে পরিণত করার পরিকল্পনা হাতে নিয়েছেন। ১৯৪৯ সালে পিতার অসুস্থতার কারণে আব্দুর রহীম সাহেবকে নিজ গ্রামে ফিরে যেতে হয়। তাকে পরিবারের দায়িত্ব নিতে হয় এবং জীবিকার জন্য কাজ করতে বাধ্য হন। মাওলানা মওদূদী তাঁকে অনুরোধ করে ঢাকায় নিয়ে আসেন এবং উর্দু ভাষায় রচিত সাহিত্যগুলো বাংলায় অনুবাদ করার কাজ দেন। এভাবে তার জীবিকার ব্যবস্থা হয়। তিনি পূর্ণ মনোযোগের সাথে ঢাকার সাংগঠনিক বিস্তৃতির জন্য কাজ করতে থাকেন।

অবশেষে কাজের বিস্তৃতি মোটামুটি হলে মাওলানা মনজুর আহমেদ জামেয়ীর নেতৃত্বে ঢাকা শহরের ইমারত গঠিত হয়। তিনি হন ঢাকার প্রথম আমীর। ঢাকায় জামায়াতের কাজ প্রতিষ্ঠায় যাদের অসামান্য ভূমিকা রয়েছে তাদের মধ্যে পূর্বে বর্ণিত চার জন, মনজুর আহমেদ জামেয়ী ছাড়াও আরো রয়েছেন,

১. সাইয়্যেদ হাফিজুর রহমান, হেড মাস্টার, রহমতুল্লাহ মডেল হাই স্কুল
২. খাজা মাহবুব এলাহী, প্রথম সভাপতি, জমিয়তে তলাবা, পূর্ব পাকিস্তান
৩. শেখ আমিনুদ্দিন, (বিহার থেকে দাওয়াতের উদ্দেশ্যে বাংলায় আসেন)
৪. মাওলানা সাইয়্যেদ মুহাম্মদ আলী, সভাপতি, জমিয়তে তলাবা, পূর্ব পাকিস্তান
৫. মাওলানা আব্দুস সুবহান, সাবেক এমপি, পাবনা।
৬. ব্যারিস্টার কোরবান আলী।

এদিকে দেখা গেল, জামায়াতের ছাত্র ও যুবকদের কাজের গতির সাথে তাল মেলাতে পারছে না মুরুব্বি ও বয়স্করা। তখন জামায়াতে ইসলামী ছাত্রদের জন্য আলাদা সংগঠনের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে। তার সূত্র ধরে ছাত্রদের জন্য নতুন সংগঠন অনুমোদন করে জামায়াতে ইসলামী। এই সংগঠনের নাম রাখা হয় ইসলামী জমিয়তে তালাবা (ইসলামী ছাত্রসংঘ)। ১৯৪৭ সালের ২৩ ডিসেম্বর লাহোরে এই সংগঠনের যাত্রা শুরু হয়। ইসলামী জমিয়তে তালাবার ১ম কেন্দ্রীয় সভাপতি ছিলেন জাফরুল্লাহ খান।   

ইসলামী ছাত্র সংঘের কর্মসূচি ছিল নিম্নরূপ :
১. ছাত্র সমাজের কাছে ইসলামের আহ্বান পৌঁছিয়ে তাদের মাঝে ইসলামী জ্ঞান অর্জন এবং বাস্তব জীবনে ইসলামের পূর্ণ অনুশীলনের দায়িত্বানুভূতি জাগ্রত করা 
২. যেসব ছাত্র ইসলামী জীবন বিধান প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে অংশ নিতে প্রস্তুত তাদেরকে সংগঠনের অধীনে সংঘবদ্ধ করা।
৩. এই সংগঠনের অধীনে সংঘবদ্ধ ছাত্রদেরকে ইসলামী জ্ঞান প্রদান এবং আদর্শ চরিত্রবানরূপে গড়ে তোলে জাহেলিয়াতের সমস্ত চ্যালেঞ্জের মুকাবিলায় ইসলামের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করার যোগ্যতা সম্পন্ন কর্মী হিসাবে গড়ার কার্যকরী ব্যবস্থা করা 
৪. আদর্শ নাগরিক তৈরির উদ্দেশ্যে ইসলামী মূল্যবোধের ভিত্তিতে শিক্ষা ব্যবস্থার পরিবর্তন সাধনের দাবিতে সংগ্রাম।
৫. ছাত্র সমাজের প্রকৃত সমস্যা সমাধানের সংগ্রামে নেতৃত্ব প্রদান।

১৯৫৫ সালে খাজা মাহবুবে এলাহীর নেতৃত্বে তৎকালীন পূর্ব-পাকিস্তানে অর্থাৎ বাংলায় ইসলামী ছাত্র সংঘের কার্যক্রম শুরু হয়। খাজা মাহবুবে এলাহীরা ছিলেন মূলত পাঞ্জাবের ঝিলাম জেলার অধিবাসী। ওনার নানা মোহাম্মদ আমিন ছিলেন পাঞ্জাবের ধনী ব্যক্তি। পাকিস্তান স্বাধীন হলে এদেশের রাজনীতিবিদেরা সারা পাকিস্তানের ধনীদের এদেশে এসে শিল্প কারখানা গড়ে তোলার জন্য আহবান করেন। 

যেহেতু এই এলাকায় পাট বেশি হতো তাই পাটকলের চাহিদা পূর্ব পাকিস্তানে বেশি ছিল। পাকিস্তানের বিভিন্ন সরকারও বাংলা যাতে শিল্পোন্নত হয়, সেজন্য ব্যবসায়ীদের এখানে আহবান জানান ও শিল্প-কারখানা গড়ার জন্য তাদের নানাবিধ সুবিধা প্রদান করেন। সেই প্রেক্ষিতে খাজা মাহবুব এলাহীর নানা মোহাম্মদ আমীন ১৯৫০ সালে পূর্ব পাকিস্তানে আসেন। তিনি চট্টগ্রামের ষোলশহরে আমিন জুট মিলস প্রতিষ্ঠা করেন। এদেশের মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করেন। পরে ১৯৭২ সালে স্বৈরাচারী আওয়ামী সরকার / শেখ মুজিবের সরকার আমিন জুট মিলসসহ মোহাম্মদ আমীনের সমস্ত সম্পত্তি দখল করে।    

নানার সূত্র ধরে খাজা মাহবুব এলাহীও এদেশে আসেন। খাজা মাহবুবে এলাহী ইসলামী ছাত্র সংঘের তলাবার প্রতিষ্ঠাকালীন রুকন/ সদস্য ছিলেন। তার নেতৃত্বে এদেশের ছাত্র সমাজের কাজে ইসলামের দাওয়াত ও ইকামাতে দ্বীনের দাওয়াত পৌঁছতে শুরু করে। বাংলায় ছাত্রদের একটি অংশ ইসলামী আন্দোলনে যুক্ত হলে ১৯৫৫ সালে খাজা মাহবুবে এলাহীর নেতৃত্বে আনুষ্ঠানিকভাবে ইসলামী ছাত্রসংঘের যাত্রা শুরু হয়। 

চলবে...


0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন