বাংলাদেশ মুসলিমদের দেশ। এদেশ পরিচালনার জন্য গঠিত সংবিধান অবশ্যই মুসলিমদের চেতনার আলোকেই হতে হবে।
নাগরিকত্ব
বর্তমান সংবিধানের ৬ষ্ঠ অনুচ্ছেদে রয়েছে,
বাংলাদেশের জনগণ জাতি হিসেবে বাঙালি ও নাগরিকগণ বাংলাদেশী বলিয়া পরিচিত হবেন।
আমি মনে করি এখানে বাঙালি পরিচয় অনর্থক। বাঙালি মানে হলো যারা বাংলা ভাষাভাষী। 'বাংলাদেশের জনগণ জাতি হিসেবে বাঙালি' এই কথাটি বাংলা ভাষায় যারা কথা বলেন না, তাদের জন্য অবমাননাকর। যদি রাষ্ট্রীয় সংহতি আমরা ধরে রাখতে চাই। সকল ভাষার জনগণকে সাথে নিয়ে সমন্বিত রাষ্ট্র গঠন করতে চাই, তবে আমাদের রাষ্ট্রীয় পরিচয় বাঙালি থাকা যাবে না।
সংবিধানের প্রথম অধ্যায়ের ৬ষ্ঠ অনুচ্ছেদে তাই নাগরিকত্বের সংজ্ঞায় বলা উচিত, "বাংলাদেশের নাগরিকগণ বাংলাদেশী বলিয়া পরিচিত হবেন"।
সংবিধান সংশোধন
বর্তমান সংবিধানের ৭ম খ অনুচ্ছেদে বলা আছে,
সংবিধানের ১৪২ অনুচ্ছেদে যাহা কিছুই থাকুক না কেন, সংবিধানের প্রস্তাবনা, প্রথম ভাগের সকল অনুচ্ছেদ, দ্বিতীয় ভাগের সকল অনুচ্ছেদ, নবম-ক ভাগে বর্ণিত অনুচ্ছেদসমূহের বিধানাবলী সাপেক্ষে তৃতীয় ভাগের সকল অনুচ্ছেদ এবং একাদশ ভাগের ১৫০ অনুচ্ছেদসহ সংবিধানের অন্যান্য মৌলিক কাঠামো সংক্রান্ত অনুচ্ছেদসমুহের বিধানাবলী সংযোজন, পরিবর্তন, প্রতিস্থাপন, রহিতকরণ কিংবা অন্য কোন পন্থায় সংশোধনের অযোগ্য হইবে।
এটা কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না যে, সংবিধানের মূলনীতি পরিবর্তিত হবে না। সময়, চাহিদা ও প্রয়োজনের আলোকে সংবিধান যেভাবে সংশোধন হয় সেভাবে নিয়মতান্ত্রিকভাবে জনগণের রায়ে অবশ্যই সংবিধানের মূলনীতিসহ সবকিছুই পরিবর্তন হওয়ার দাবি রাখে। তাই আমি মনে করি বর্তমান সংবিধানের ৭খ অনুচ্ছেদ বিলুপ্ত হওয়া দরকার।
জনস্বাস্থ্য ও নৈতিকতা
বর্তমান সংবিধানের ১৮ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে,
(১) জনগণের পুষ্টির স্তর-উন্নয়ন ও জনস্বাস্থ্যের উন্নতিসাধনকে রাষ্ট্র অন্যতম প্রাথমিক কর্তব্য বলিয়া গণ্য করিবেন এবং বিশেষতঃ আরোগ্যের প্রয়োজন কিংবা আইনের দ্বারা নির্দিষ্ট অন্যবিধ প্রয়োজন ব্যতীত মদ্য ও অন্যান্য মাদক পানীয় এবং স্বাস্থ্যহানিকর ভেষজের ব্যবহার নিষিদ্ধকরণের জন্য রাষ্ট্র কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করিবেন৷
(২) গণিকাবৃত্তি ও জুয়াখেলা নিরোধের জন্য রাষ্ট্র কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করিবেন৷
ক. এখানে ১ নং পয়েন্টে 'আইনের দ্বারা নির্দিষ্ট অন্যবিধ প্রয়োজন ব্যতীত' এই কথা বলে মাদক ব্যবহারের ফাঁক সৃষ্টি করা হয়েছে। এই অংশকে ভিত্তি করে পৃথিবীর অন্যতম বৃহৎ মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশে মাদকের লাইসেন্স দেওয়া হচ্ছে। এটা আল্লাহর আইনের বিরুদ্ধে।
আল্লাহ তায়ালা মোট চারটি ধাপে মদ হারাম করেন।
প্রথম পর্যায়
আল্লাহ তায়ালা কোরআনের আয়াত নাজিলের মাধ্যমে ঘোষণা দিলেন যে, তোমরা খেজুর ও আঙ্গুর দ্বারা মাদক তৈরির পাশাপাশি উত্তম খাদ্য বস্তুও তৈরি করে থাক। যেমন পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘আর খেজুর গাছের ফল ও আঙ্গুর হতে তোমরা মাদক ও উত্তম খাদ্য গ্রহণ করে থাক।’ (সূরা নাহল, আয়াত: ৬৭)
এই আয়াতে আল্লাহ তায়ালা সরাসরি মাদক হারাম করেননি, তবে জানিয়ে দিলেন, মাদক ভিন্ন জিনিস। আর উত্তম খাদ্যবস্তু ভিন্ন জিনিস। এই আয়াত নাজিল হওয়ার পর সাহাবায়ে কেরাম ধারণা করে নিলেন যে, মাদক সম্পর্কে কোনো বিধান আল্লাহ তায়ালা অচিরেই নাজিল করবেন।
দ্বিতীয় পর্যায়
এরপর সাহাবায়ে কেরাম যখন মাদক সম্পর্কে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞাসা করেন তখন আল্লাহ তায়ালা কোরআনের আয়াত নাজিলের মাধ্যমে তার প্রিয় হাবীবকে জানিয়ে দিলেন যে, মদের মাঝে উপকার ক্ষতি উভয়ই রয়েছে। তবে উপকারের চেয়ে ক্ষতির পরিমাণটা বেশি।
কোরআনে এসেছে,‘তারা তোমাকে মদ ও জুয়া সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করে। বল, এ দু’টোয় রয়েছে বড় পাপ ও মানুষের জন্য উপকার। আর তার পাপ তার উপকারিতার চেয়ে অধিক বড়।’ (সূরা বাকারা, আয়াত: ২১৯)
এই আয়াতের মাধ্যমে আল্লাহ তায়ালা সাহাবায়ে কেরামের অন্তরে মাদকের প্রতি কিছুটা ঘৃণার সৃষ্টি করে দিলেন। ফলে সাহাবায়ে কেরাম দু’দলে ভাগ হয়ে গেলেন। একদল ক্ষতির দিক বিবেচনায় তা বর্জন করলেন। আরেকদল চিন্তা করলেন, যেহেতু কিছুটা উপকার রয়েছে তাই তা গ্রহণে কোনো সমস্যা হবে না।
তৃতীয় পর্যায়
এ পর্যায়ে আল্লাহ তায়ালা আয়াত নাজিল করে জানিয়ে দিলেন, নেশাগ্রস্ত অবস্থায় নামাজের কাছেও যাওয়া যাবে না। যেমনটি ইরশাদ হয়েছে,
‘হে মুমিনগণ, নেশাগ্রস্ত অবস্থায় তোমরা নামাজের নিকটবর্তী হয়ো না।’ (সূরা নিসা, আয়াত: ৪৩)
চতুর্থ পর্যায়
এই আয়াতে সবসময়ের জন্য মদকে পরিষ্কার হারাম ঘোষণা না করায় অনেকেই নামাজের সময় বাদে অন্য সময় মদ গ্রহণ করতেন। ইতিমধ্যে ঘটে যায় আরও একটি ঘটনা। আতবান ইবনে মালেক (রা.) কয়েক সাহাবিকে দাওয়াত করেন। যাদের মধ্যে অন্যতম একজন অতিথি ছিলেন সাদ বিন আবি ওয়াক্কাস (রা.)। খাবার শেষে মদপানের প্রতিযোগিতা আরম্ভ হয়। সেখানে আরবের প্রথা অনুপাতে কবিতা পাঠ ও নিজ নিজ বংশের গৌরবগাথা বর্ণনা শুরু হলে একজন মুহাজির সাহাবি আনসারদের দোষারোপ করে নিজেদের প্রশংসাকীর্তন করে আবৃত্তি করলেন একটি কবিতা। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে আনসারি এক যুবক উটের গলার একটি হাড় ছুড়ে মারেন তার মাথায়।
মারাত্মকভাবে আহত হয়ে রাসুলের কাছে ছুটে যান তিনি। অভিযোগ করেন সেই যুবকের বিরুদ্ধে। তখন রাসুল (সা.) দোয়া করলেন, ‘হে আল্লাহ! মদ সম্পর্কে আমাদেরকে একটি পরিষ্কার বর্ণনা ও বিধান দান করুন, যাতে সব দ্বিধাদ্বন্দ্ব নিরসন হয়ে যায়। এর পরিপ্রেক্ষিতে আল্লাহ তায়ালা মদ-জুয়াকে সম্পূর্ণরূপে হারাম ঘোষণা করলেন।’ ‘হে ঈমানদাররা! মদ, জুয়া, মূর্তি ও তীর নিক্ষেপ এসব নিকৃষ্ট বস্তু ও শয়তানের কাজ। কাজেই তোমরা এগুলোকে বর্জন করো। যাতে তোমরা সফল হতে পারো।
শয়তান মদ ও জুয়ার মাধ্যমে তোমাদের মধ্যে পারস্পরিক শত্রুতা ও তিক্ততা ঘটাতে চায় এবং তোমাদের আল্লাহর স্মরণ ও নামাজ থেকে বিরত রাখতে চায়। তবুও কি তোমরা তা থেকে বিরত থাকবে না!’ (সুরা মায়েদা : ৯০-৯১)। এই আয়াতে মদ ও জুয়াকে নিকৃষ্ট বস্তু ও ক্ষতিকর কাজ উল্লেখ করে সম্পূর্ণ হারাম ঘোষণা করা হয়েছে।
হজরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) বলেন, ‘যখন নবীজির পক্ষ থেকে একজন ঘোষক মদিনার অলিগলিতে প্রচার করতে লাগলেন যে, মদপান হারাম ঘোষণা করা হয়েছে, তখন যার হাতে মদের যে পাত্র ছিল, তা তারা সেখানেই ফেলে দিয়েছিলেন। সেদিন মদিনায় এত পরিমাণ মদ নিক্ষিপ্ত হয়েছিল যে, মদিনার অলিগলিতে বৃষ্টির ফলে সৃষ্ট কাদাপানির মতো অবস্থা হয়েছিল।
ইসলামে মদ পানের শাস্তি
মদ ক্রয়-বিক্রয়, পান-বহন মদের ব্যবসার অনুমোদন সবই ইসলাম ধর্মে নিষিদ্ধ। মদ্যশালার বৈধতা রেখে মাদকতামুক্ত সুস্থ সমাজ গড়া সম্ভব নয়। মাদকতায় শুধু শারীরিক ও সামাজিক ক্ষতিই নয় পরকালের সুখময় জীবনকেও নরকে পরিণত করে। রসুল সা. এর বদদোয়া রয়েছে মাদকতায় জড়িতদের প্রতি। যারা এর অনুমোদন করে তাদের প্রতি। যারা সরবরাহ করে তাদের প্রতি।
হযরত আনাস রা. বলেন, রসুল সা. মদের সাথে সম্পৃক্ত দশ ব্যক্তিকে লানত করেছেন। ১. মদ প্রস্তুতকরী। ২. মদের ফরমায়েশ দানকারী। ৩. মদ পানকারী। ৪. মদ বহনকারী। ৫. যার কাছে মদ নিয়ে যাওয়া হয় সে ব্যক্তি। ৬. যে মদ পান করায়। ৭. মদ বিক্রেতা। ৮. মদের মূল্য ভোগকারী। ৯. মদ ক্রয়কারী। ১০. যার জন্য মদ ক্রয় করা হয়। (মেশকাত ২৭৭৬)
রসুল সা. বলেন, ‘যখন কেউ (কোন নেশাকর দ্রব্য সেবন করে) নেশাগ্রস্ত হয় অন্য বর্ণনায় রয়েছে, যখন কেউ মদ পান করে তখন তোমরা তাকে বেত্রাঘাত করবে। আবারো নেশাগ্রস্ত হলে আবারো বেত্রাঘাত করবে। আবারো নেশাগ্রস্ত হলে আবারো বেত্রাঘাত করবে। রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম চতুর্থবার বললেন আবারো নেশাগ্রস্ত হলে তার গর্দান উড়িয়ে দিবে।’ (আবু দাউদ ৪৪৮২, তিরমিজি ১৪৪৪, ইব্নু মাজাহ ২৬২০, নাসায়ি ৫৬৬১, আহমাদ ৪/৯৬)
হযরত ওমর রা.-এর শেষ যুগে মদ পান করলে তিনি ৪০ বেত্রাঘাত করতেন। কিন্তু যখন মদপান বৃদ্ধি পেতে লাগলো তখন তিনি ৮০ বেত্রাঘাত করতেন। (মেশকাত-৩৬১৬) দুনিয়ায় যে আল্লাহর বিধান মেনে নেশা আর জুয়া থেকে বিরত থাকবে। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন তাদের জন্য জান্নাতে শরাবের ব্যবস্থা করবেন। দুনিয়ায় মদ পান হারাম। নিষিদ্ধ। কিন্তু জান্নাতে মদ সুপেয় পানীয়। যারা দুনিয়ায় মদ পান করবে তারা আখেরাতে তা থেকে বঞ্চিত হবে। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমর রা. হতে বর্ণিত রসুল সা. বলেন, যে ব্যক্তি দুনিয়াতে মদ পান করলো অথচ তওবা করলো না। আখেরাতে সে থেকে বঞ্চিত হবে। (মুসলিম ২০০৩)
হযরত জাবের বিন আব্দুল্লাহ রা.বলেন রসুল সা. বলেছেন, আল্লাহ ঐ ব্যক্তির জন্য ওয়াদাবদ্ধ যে ব্যক্তি নেশাজাতীয় বস্তু পান করে তাকে ‘তিনাতুল খাবাল’ পান করাবেন। আরজ হলো হে আল্লাহর রসুল সেটা কী? তিনি বললেন, জাহান্নামিদের দেহের ঘাম অথবা দেহনিঃসৃত রক্ত-পুঁজ। (মেশকাত ৩৬৩৯)
কারোর ব্যাপারে মদ অথবা মাদকদ্রব্য পান কিংবা সেবন করে নেশাগ্রস্ত হওয়া প্রমাণিত হয়ে গেলে তাকে আশিটি বেত্রাঘাত করা হবে। সে যতবারই পান করে ধরা পড়বে ততবারই তার উপর উক্ত দণ্ডবিধি প্রয়োগ করা হবে। তবে তাকে এ জন্য কখনোই হত্যা করা হবে না। ’উলামাদের ঐকমত্যে প্রমাণিত এ শাস্তি।
অতএব বাংলাদেশে কোনো অবস্থাতেই মুসলিমদের জন্য মাদকের অনুমোদন করা যাবে না। তবে অমুসলিমদের জন্য সীমিত আকারে তাদের ঘরের অভ্যন্তরে তৈরি ও সেবনের অনুমোদন করা যেতে পারে। তারা শর্ত মেনে অনুমোদন পেতে পারে।
খ. ১৮ অনুচ্ছেদের ২ নং পয়েন্টে বলা হয়েছে গণিকাবৃত্তি ও জুয়াখেলার কথা বলা হয়েছে। এর পাশাপাশি বিবাহ বহির্ভূত যৌন সম্পর্ক ও সমকামের কথা যুক্ত করে এই চারটি অপরাধ বন্ধ করার নিমিত্তে রাষ্ট্র সকল ব্যবস্থা গ্রহণ করার বিষয় উল্লেখ করা দরকার। এখানে উল্লেখ্য যে, এসব অপরাধকে ফৌজদারি অপরাধ বিবেচনা করে ইসলামের বিধান অনুযায়ী শাস্তির ব্যবস্থা করা দরকার।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন