৪ অক্টো, ২০১৫

ইসলামী ব্যাংকিং ব্যবস্থা ও কিছু বিরোধীতা


“অন্যান্য ব্যাংক সরাসরি খায় আর ইসলামী ব্যাংক একটু ঘুরায়া খায়। সবি এক জিনিস”। এটি বাজারে সর্বাধিক প্রচলিত কথা। আজ এই বিষয়ে কিছু কথা বলবো। 

সুদ কিঃ

সুদের সংজ্ঞা বুঝতে হলে প্রথমেই আমাদের বুঝতে হবে ইসলামী অর্থনীতিতে মুদ্রার ধারণা। ইসলামী অর্থনীতিতে টাকা বা মুদ্রা কোন পণ্য নয়, কারণ তা সরাসরি ব্যবহার করা যায় না। একটি পণ্য (ধরি মোটরবাইক) এর সাথে টাকার পার্থক্য হল টাকা আপনি সরাসরি খেয়ে ফেলতে বা ব্যবহার করতে পারবেন না। একে বিনিময়ের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করে কোন পণ্যে পরিণত করে তবেই ব্যবহার করতে পারবেন।( টাকা দিয়ে এক প্যাকেট বিরিয়ানি কিনে তারপর খেয়ে ফেললেন) আর যেহেতু মুদ্রা কোন পন্য নয়, তাই এটা আপনি বেচতে পারবেন না, বেচে কোন লাভও করতে পারবেন না। এই তত্ত্বের মাধ্যমে ইসলাম প্রচলিত অর্থনীতিতে সুদের যে সংজ্ঞা- Price of credit- তার মূলে আঘাত করেছে কারণ টাকা ধার দেয়া কোন পণ্য নয় যে তার দাম নিবেন।

টাকা বাড়ানোর একমাত্র এবং একমাত্র বৈধ উপায় হল একে বিনিময়ের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করা। নিচে এটা চিত্রের সাহায্যে দেখানো হল-

(১) টাকা-----পণ্য-----বিক্রি----টাকা

(২) টাকা-----পণ্য-----ভাড়া-----টাকা

এভাবে টাকাকে একটি চক্রের মাধ্যমে প্রবাহিত করে আপনি তাকে বাড়াতে কমাতে পারেন। তা না করে যদি আপনি সরাসরি টাকার লেনদেনে কম বেশি করেন, তবে তা হবে সুদ।

আবু হুরায়রা রাঃ হতে বর্ণিত রাসূল সঃ বলেন, স্বর্ণের বিনিময়ে স্বর্ণ কিংবা রুপার বিনিময়ে রুপা পরিবর্তন করলে অবশ্যই তা যেন সমান সমান হয়। বেশী দিলে কিংবা বেশী নিলে হবে সুদের কারবার। যে দিবে এবং যে নিবে উভয়ই অপরাধী হবে। (সহীহ মুসলিম)

যখনই কোন মানুষকে প্রশ্ন করা হয় সুদ কি? তখনই তারা বলেন মাসে মাসে নির্ধারিত একটা পরিমাণ দেয়াই হল সুদ। প্রতিউত্তরে যদি প্রশ্ন করা হয় তাহলে বাড়িভাড়ার পরিমাণতো নির্ধারিত, সেটা কেন সুদ নয়? তখন যে বাক্যাংশটি যোগ করা হয় তা হল লাভ ক্ষতি যাই হোক, তারপরও যদি দিতে হয়, তবে তা সুদ। এগুলো আসলে সুদের কোন সংজ্ঞা নয়। এগুলো মনগড়া চিন্তা ভাবনা। 

ইসলামী ব্যাংকগুলো কিভাবে টাকা বৃদ্ধি করে?ইসলামী ব্যাংকগুলো টাকা বৃদ্ধি করে মূলত তিনটি উপায়ে-১) কেনা বেচা২) ভাড়া৩) অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে ব্যবসা

১) কেনাবেচাঃ কোন পণ্য কিনে তা লভ্যাংশ রেখে বিক্রয় করা।

২) ভাড়াঃএক্ষেত্রে ব্যাংক কোন মেশিনারীস বা অন্য কোন ভাড়া দেয়ার যোগ্য পণ্য কিনে তা গ্রাহকের কাছে ভাড়া দেয়।

৩) অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে ব্যবসাঃইসলামী ব্যাংক মুদারাবা বা মুশারাকা পদ্ধতিতে অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে গ্রাহকের সাথে ব্যবসা করে থাকে। এই দুই পদ্ধতির সারমর্ম নিচে চিত্রের সাহায্যে নিচে দেখান হল-
ক্রয়ের চুক্তিতে ভাড়াঃঋণ দিয়ে যেহেতু অতিরিক্ত কিছু নেয়া যাবে না, তাই ইসলামী ব্যাংকগুলোর পক্ষে কার লোন, হোম লোন এগুলো দেয়া সম্ভব নয়। তারা যেটা করে সেটা হল ক্রয়ের চুক্তিতে ভাড়া। এক্ষেত্রে ইসলামী ব্যাংক ও গ্রাহক অংশীদারী ভিত্তিতে কোন পণ্য কেনে। ধরুন একটি মোটর সাইকেলের দাম ২০০০০ টাকা। আপনি ১০০০০ টাকা দিলেন, ব্যাংক দিল ১০০০০ টাকা। মোটর সাইকেলটির মালিকানা ৫০% আপনার , আর বাকিটা গ্রাহকের। পুরো মোটর সাইকেলটা এখন আপনি যদি বাজার দরে কাউকে ভাড়া দেন, তাহলে এটার মাসিক ভাড়া হবে ধরুন ১০০০০ টাকা। ব্যাংক পুরো মোটর সাইকেলটি আপনাকেই ভাড়া দিবে। যেহেতু ব্যাংক এর ৫০% র মালিক সেহেতু আপনি তাকে ভাড়া দিবেন ৫০০০ টাকা। আর সাথে মাসে মাসে ব্যাংকের অংশের কিছু টাকা শোধ করবেন। এভাবে ক্রমান্বয়ে আপনার মালিকানার অনুপাত বাড়তে থাকবে, ফলে প্রদেয় ভাড়ার পরিমাণও কমতে থাকবে। আরেকটি ভিন্ন চুক্তিতে ব্যাংক এই মর্মে গ্রাহকের সাথে অঙ্গীকারাবদ্ধ হবে যে গ্রাহক যদি তার দায় নির্ধারিত সময়ের মাঝে পরিশোধ করে দেয়, তবে ব্যাংক বস্তুটির মালিকানা তাকে দিয়ে দেবে। অনেকের মনে হতে পারে যে এখানে শর্তযুক্তভাবে একাধিক চুক্তি একটি চুক্তির মাঝে করা হচ্ছে। কিন্তু ব্যাপারটি আসলে তা নয়, এটি একই চুক্তির বিভিন্ন অংশ।

(১) আমাদের দেশের ইসলামী ব্যাংকগুলোর বিনিয়োগের পোর্টফোলিওর প্রায় পুরোটাই বাই মোড দ্বারা পূর্ণ। লাভ ক্ষতির ভিত্তিতে এই অংশীদারিত্বের ব্যবসার মাঝেই ইসলামী ব্যাংকিং এর প্রাণশক্তি ও স্বাতন্ত্র্য নিহিত। কিন্তু তা খুব কম করাতে ইসলামী ব্যাংকগুলোর ব্যাপারে মানুষকে বিভ্রান্ত বা সন্দিহান করা খুব সহজ হয়।

(২) মাল যে গ্রাহককেই ভাড়া দিতে হবে এমন নয়, তৃতীয় পক্ষকেও দেয়া যেতে পারে।

সঞ্চয়কারীদের সাথে ইসলামী ব্যাংকের সম্পর্কঃ
ইসলামী ব্যাংক নিয়ে দ্বিধা সংশয়ের অন্যতম মূল উৎস হল বিপুল সংখ্যক গ্রাহকের ব্যাংকের বিনিয়োগ কার্যক্রম সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা না থাকা। সঞ্চয়কারীদের মূল অভিযোগ যে ইসলামী ব্যাংকও লাখে একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ দেয়, প্রচলিত ব্যাংকও তাই করে। তাহলে পার্থক্যটা কোথায় থাকল?ইসলামী ব্যাংকের সাথে অন্যান্য ব্যাংকের পার্থক্যটা নির্ধারিত পরিমাণ দেয়াতে নয়, বরং টাকাটা নিয়ে ব্যাংকগুলো কি করে, টাকার ব্যাপারে তাদের দৃষ্টিভঙ্গি কি সেটাতে। আর কিসের নির্ধারিত পরিমাণ সেটা হল বিবেচ্য। যদি লাভের নির্ধারিত অংশ হয় এবং মূলধন সুরক্ষার নিশ্চয়তা না দেয়া হয় তবে সমস্যা নেই। কারণ লাভ অনির্ধারিত, তাই তার নির্ধারিত অংশও অনির্ধারিত।

ইসলামী ব্যাংকের গ্রাহকদের সাথে সম্পর্ক হচ্ছে মুদারাবা চুক্তি, অর্থ্যাৎ এখানে গ্রাহকরা পুঁজি সরবরাহ করেন, ব্যাংক সেটা বিনিয়োগের বিভিন্ন পদ্ধতি প্রয়োগ করে খাটিয়ে যে লাভ করে তা পূর্বনির্ধারিত অনুপাতে ভাগ করে নেয়। ব্যবসায়ে অভিজ্ঞতাপ্রসূত ধারণা থেকে তারা একটি অনুমিত পরিমাণ গ্রাহকদের বলে দেয়। এখানে একটি বিষয় স্মর্তব্য যে গ্রাহকদের কাছে উল্লেখিত শতকরা অংশ একটি অনুমিত মান, যা বছর শেষে সমন্ব্য় সাধন করা হয়। এখন এই পরিমাণ যখন বছর বছর হেরফের হয়, তখন পার্থক্যটা এত সামান্য হয় যে তা অনেকসময় চোখেই পড়ে না। কিন্তু আমাদের বুঝতে হবে যে একজন গ্রাহকের একাউন্ট ১০-১৫ টাকার কমবেশি আসলে বিপুল অংকের লাভ-ক্ষতির ফলাফল যা লাখ লাখ গ্রাহকের মাঝে ছড়িয়ে গিয়ে সামান্য আকার ধারণ করেছে।

**ইসলামী ব্যাংকগুলো কি সম্পূর্ণ সুদমুক্ত হতে পেরেছে?

এই জনপ্রিয় প্রশ্নের উত্তর হল, "না"। 
ইসলামী ব্যাংকগুলো সুদভিত্তিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থার মাঝে কার্যক্রম পরিচালনা করে বিধায় তারা দুটি ক্ষেত্রে সুদমুক্ত লেনদেন করতে পারে না-

১) কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাথে যে বাধ্যতামূলক সঞ্চিতি (SRR) এবং Foreign Currency Clearing Account এ জমাকৃত বৈদেশিক মুদ্রার উপরে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সুদ দেয়।

২) বিদেশী ব্যাংকগুলোর সাথে ইসলামী ব্যাংকের যে Nostro Account থাকে, সেটা চলতি হিসাব হলেও Overnight lending থেকে তারা সেখান থেকে সুদ পায়।

তবে ইসলামী ব্যাংকগুলো কল মানি মার্কেটে অংশগ্রহণ করে না, দেশীয় সুদী ব্যাংকে একান্ত প্রয়োজনে আকাউন্ট খুলতে হলে চলতি হিসাবে লেনদেন করে, যথেষ্ট পরিমাণ তারল্য বজায় রাখার চেষ্টা করে যেন আন্তঃব্যাংক ঋণ না করতে হয়। আর নিতান্ত অপরিহার্য হলে আন্তঃব্যাংকে লেনদেন করে অন্যান্য ইসলামী ব্যাংকের সাথে, মুদারাবা পদ্ধতিতে।

**ইসলামী ব্যাংকের ব্যাপারে আরেকটি অভিযোগ হল যে তারা খেলাপী গ্রাহকের উপর ক্ষতিপূরণ আদায় করে। 

এক্ষেত্রে যে বিষয়টি বিবেচ্য যে গ্রাহক কি আসলেই অসমর্থ নাকি এটা তার স্বভাবগত সমস্যা। আমাদের দেশের প্রেক্ষিতে দ্বিতীয়টি হবার সম্ভাবনা প্রবল। খেলাপী গ্রাহক, যারা গড়িমসি করে দেনা শোধ করছেন না, তাদের কাছ থেকে দ্রুত টাকা আদায়ের ব্যবস্থা না হওয়া পর্যন্ত ইসলামী ব্যাংক অস্থায়ীভাবে ক্ষতিপূরণ আদায় করতে পারে। এটি শাস্তিমূলক ব্যবস্থার একটি প্রকার। শরীয়াহ বিশেষজ্ঞরা বা বিচারপতিরা পরিস্থিতি অনুযায়ী অন্য ব্যবস্থাও নিতে পারেন। তবে এধরণের ক্ষতিপূরণ আদায় করার এখতিয়ার ব্যাংকের হাতে না থেকে তৃতীয় পক্ষের হাতে থাকে যারা ঠিক করেন যে কে সঙ্গত কারণে দেন শোধে দেরী করেছে আর কে গড়িমসির কারণে করেছে।

কিন্তু এইসব উৎসের কোনটি থেকে আসা অর্থ ব্যাংক কখনো তার মূল আয়ের মাঝে অন্তর্ভুক্ত করে না। ফলে তা গ্রাহকদের বা শেয়ারহোল্ডারদের মাঝে বণ্টিত হয় না। এই আয় ব্যাংক শরীয়াহ কাউন্সিলের নির্দেশিত পন্থায় ব্যয় করে।

এ সংক্রান্ত একটি জরিপে আমি দেখেছি যে গ্রাহকদের ইসলামী ব্যাংকের স্বাতন্ত্র্য জিজ্ঞেস করা হলে সাধারণ গ্রাহকরা সঠিক উত্তর দিতে পারেন না কিন্তু বিনিয়োগ গ্রাহকরা এ ব্যাপারে খুব স্বচ্ছ ধারণা পোষণ করেন। এর একটি কারণ হল তারা ব্যাংকের অভ্যন্তরীণ কার্যক্রমের সাথে সুপরিচিত।

আপনারা যারা ইসলামী ব্যাংকিং এর বিরোধীতা করেন তাদের উদ্দেশ্য... 

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম লা’নত করেছেন, সুদখোরের উপর, সুদদাতার উপর, এর লেখকের উপর ও উহার সাক্ষীদ্বয়ের উপর এবং বলেছেন এরা সকলেই সমান । (মুসলিম, আবু দাউদ, তিরমিজি)

১)কোন স্কলাররা এমনটা অনুমোদন করেন কিনা আমার জানা নেই। সুদী ব্যাংকের দারোয়ানের চাকরিও যেখানে হারাম সেখানে তাদের সাথে লেনদেন কিভাবে বৈধ হতে পারে?

২) আপনি যদি ইসলামী ব্যাংকগুলো পরিহার করে সুদী ব্যাংকের সাথে লেনদেন চালিয়ে যান, তাহলে আগামী ৫০ বছরেও সুদভিত্তিক ব্যবস্থার অবসান হবে না।কিন্তু আমরা সবাই যদি ইসলামী ব্যাংকের সাথে লেনদেন করার ব্যাপারে উদ্যোগী হই তাহলে পরিস্থিতির অভূতপূর্ব পরিবর্তন সম্ভব। সেক্ষেত্রে গ্রাহক চাহিদার চাপে ইসলামী ব্যাংকগুলোর সংখ্যা প্রচুর বৃদ্ধি পেতে পারে এবং সেইসাথে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও আন্তর্জাতিক ব্যাংকগুলো ইসলামী ব্যাংকের সাথে লেনদেনের ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ ভিন্ন নিয়ম বেছে নিতে বাধ্য হতে পারে।

৩) প্রচলিত ব্যাংকের চলতি হিসাবের(যাতে সুদের ব্যাপার নাই) সাথে লেনদেন সমাজের একটি ক্ষুদ্র অংশের জন্য গ্রহণযোগ্য বিকল্প হতে পারে (যারা ব্যবসা করেন না)। কিন্তু সামষ্টিক অর্থনীতির কল্যাণে এটা কোন সমাধান নয়।

৪) আল্লাহ মুসলিমদের এমন একটি সময়ে রেখেছেন যখন মায়ের সাথে ব্যভিচার করার সমতুল্য পাপ থেকে বাঁচার কোন উপায় রাখেন নি, এটা আল্লাহ নাম ও গুণাবলীর পরিপন্থী। কারণ আল্লাহ কাউকে সাধ্যের অতিরিক্ত বোঝা দেন না।

৫)আমরা অবশ্যই এমন পন্থা অনুসরণ করব যাতে আল্লাহকে পরকালে বলতে পারি যে আল্লাহ আমি আমার সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছিলাম। ইসলামী ব্যাংকের কার্যক্রম অনুধাবন, তাদের শরীয়াহ প্রতিপালনের সর্বোচ্চ মান নিশ্চিত করার ব্যাপারে সংশ্লিষ্টদের চাপ প্রয়োগ, অন্যদের ইসলামী ব্যাংকের সাথে লেনদেন করতে উৎসাহিত করা——এগুলো সর্বোচ্চ চেষ্টার উদাহরণ নাকি ইসলামী ব্যাংকের কার্যক্রম সম্পর্কে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা সঞ্চয় না করে ভাসা ভাসা জ্ঞান দিয়ে সন্দিহান হয়ে সুদী ব্যাংকের সাথে লেনদেন করা সর্বোচ্চ চেষ্টা—-তা বিবেচনার ভার পাঠকদের উপর রইল।

৬) যারা হালাল হারামের কোন বাছ বিচার না করে অর্থ উপার্জনের নেশায় উন্মত্ত এবং আর যারা সুদী ব্যাংকের হাই প্রোফাইল চাকরি, শেয়ার বাজারে ঝুঁকিপূর্ণ বিনিয়োগ- সব কিছু থেকে বিরত থেকে নিজের অত্যন্ত কষ্টে উপার্জিত টাকা ইসলামী ব্যাংকে রাখছেন সুদ থেকে বাঁচার আশায়, ইসলামী ব্যাংকগুলোর সাথে লেনদেনকে হারাম হিসেবে আখ্যায়িত করে তাদেরকে যে একই কাতারে ফেলা হচ্ছে, আর বিশাল একটি জনগোষ্ঠী যারা অর্থনীতির এত ঘোরপ্যাঁচ বুঝেন না, কিন্তু হারাম থেকে বেঁচে থাকতে চান, তাদেরকে গোলকধাঁধার মাঝে ফেলা হচ্ছে, তার দায় কে নিবে?

বঙ্গসমাজে কিছু পন্ডিত ব্যাক্তি রয়েছেন যারা মনে করেন ব্যাংক ব্যবস্থা একটি কাফির / তাগূতী সিস্টেম, যা ইসলামীকরণই শরীয়াহসম্মত নয়। 

ইসলামী ব্যাংকের বিরোধিতাকারীদের মাঝে আরেকটি দল আছেন যারা মত পোষণ করেন যে “আংশিক তহবিল ব্যাংকিং” এর উপস্থিতি কারণে ব্যাংকিং ব্যবস্থাই একটি তাগূতী সিস্টেম, কেউ কেউ একে দাজ্জালের সিস্টেমের সাথে তুলনা করেন। 

কাগুজে মুদ্রার ধারণাকেই তারা সুদের একটি প্রকার বলে মনে করেন। শেষোক্ত এই মতটি (কাগুজে মুদ্রার ব্যবহার নিজেই সুদ) ইসলামী অর্থনীতির আলোকে কিছুটা গ্রহণযোগ্যতা পাবে যদি কেউ কাগুজে মুদ্রা প্রচলনের ইতিহাস পড়েন। 

ইসলামী অর্থনীতিতে মুদ্রার অন্তর্নিহিত মূল্য থাকা উচিৎ (যেমন সোনা, রূপা ইত্যাদি) এবং বাস্তব সম্পদ হওয়া উচিৎ। আজকের টাকার মত নয়, যার পুরো মূল্যটাই আরোপিত (সরকার বলছে এটি ১০০ টাকা তখনই ঐ কাগজের মূল্য ১০০ টাকা হয়ে যায়) ও তা একটি আর্থিক সম্পদ।

কিন্তু এক্ষেত্রে প্রশ্ন উঠে যে কাগুজে মুদ্রা ব্যবহারের মাঝে যে প্রচ্ছন্ন সুদ রয়েছে তা থেকে বাঁচার উপায় কি? ইসলামিক খিলাফাহকে যেমন আমরা শ্রেষ্ঠ রাজনৈতিক ব্যবস্থা বলে বিশ্বাস করি, তেমনি সোনা রূপাকেই আমরা আসল মুদ্রা হিসেবে মনে করি। 

কিন্তু এই অন্তর্বর্তীকালীন সময়ে কি আমরা হাত পা গুটিয়ে বসে থাকব? যেসব রাজনৈতিক দল ইসলামী ব্যাংককে তাগূতী সিস্টেম বলে তার সাথে লেনদেন করা থেকে বিরত থাকেন, তারাও সুদী ব্যাংকের চলতি হিসাবের সাথে লেনদেন করার চাইতে উন্নততর কোন বিকল্প বা সমাধান দিতে পারেন নাই। 

অথচ “আংশিক তহবিল ব্যাংকিং” সম্পর্কে পড়াশোনা আমাকে এই ধারণাই দেয় যে বাজারে অর্থের (Fiat money) যোগান দিয়ে মুদ্রাস্ফীতি সৃষ্টি করার ক্ষেত্রে একটি অন্যতম নিয়ামক হল Current Account.

** আংশিক তহবিল ব্যাংকিং (Fractional-reserve banking) এক ধরনের ব্যাংকিং যাতে ব্যাংকসমূহ তাদের ডিপোজিটের অংশবিশেষ তহবিলে বা রিজার্ভে রাখে এবং বাকীটুকু ধার দিয়ে দেয়। তবে চাহিদার সময় ব্যাংককে সমস্ত ডিপোজিট ফেরত দিতে হয়। এই পদ্ধতিটি সারা বিশ্বজুড়ে প্রচলিত এবং এটিই প্রামাণ্য ব্যাংকিং ব্যবস্থা হিসেবে স্বীকৃত।

আমাদের করণীয়ঃ
এত লম্বা আলোচনা থেকে আমাদের করণীয় পরিষ্কার- ইসলামী ব্যাংকগুলোর সাথে লেনদেন করা এবং শরীয়াহ প্রতিপালনের ব্যাপারে তাদের মাঝে চাপ প্রয়োগ করা। একটি ইসলামী ব্যাংকের মান যাচাই এর ক্ষেত্রে নিম্নোক্ত চলকগুলো বিবেচনা করা যেতে পারে-

১) শরীয়াহ বোর্ডের সদস্য কারা এবং শরীয়াহ প্রতিপালনের ব্যাপারে তারা কতটুকু কঠোর?

২) ব্যাংকের কর্মচারীরা কতটুকু ইসলামিক। তারা নিয়মিত সালাত আদায় করে নাকি, মহিলা কর্মচারীরা পর্দা মেনে চলেন নাকি, নারী পুরুষের অবাধ এবং অপ্রয়োজনীয় মেলামেশা হয় নাকি এবং সবচেয়ে বড় কথা হল তারা সুদের পাপের ভয়াবহতা উপলব্ধি করে নাকি! সুদের প্রতি ঘৃণা একজন ইসলামী ব্যাংকারের অপরিহার্য বৈশিষ্ট্য হওয়া উচিৎ। 

৩)ব্যাংকের কর্মচারীরা ইসলামী অর্থনীতির স্বাতন্ত্র্য ও সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বিষয়াবলী সম্পর্কে সম্যকরূপে অবগত কিনা এবং এটাকেই শ্রেষ্ঠ পদ্ধতি মনে করেন কি না।

৪) ব্যাংকের কর্মীদের যথাযথ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা আছে কি না।

উপসংহারে বলা যায় ইসলামী ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠার পূর্বশর্ত ইসলামী ব্যক্তিত্ব। আর সেটার চরম অভাব আমাদের দেশে রয়েছে ইসলামী শিক্ষার ব্যাপারে বিশাল অজ্ঞতার কারণে। এক্ষেত্রে গ্রাহকদের বিশাল ভূমিকা রয়েছে। তাদের পক্ষ থেকে সচেতনতা ব্যাংকগুলোকে সেবার মান বৃদ্ধি করতে বাধ্য করবে। 

আল্লাহ আমাদের নিজ নিজ অবস্থানে থেকে সামর্থ্য অনুযায়ী ইসলামী অর্থব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করার তৌফিক দান করুন, আর সেই সাথে অন্যের প্রচেষ্টাকে সমালোচনা না করে উদ্যোগী মুসলিম হবার মত মানসিকতা দান করুন। আমীন।

কল্যাণমুখী রাষ্ট্রের স্বরুপ/ খিলাফত ভিত্তিক রাষ্ট্রের নীতি।



শুধু ইসলামী রাষ্ট্র নয়, যে কোন রাষ্ট্রেই নেতৃত্ব অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাই নেতৃত্ব নির্বাচনে সর্বাধিক যোগ্য ব্যক্তিকেই বাছাই করা জরুরী।

আল্লাহ্‌ তায়ালা সূরা ইমরানের ১৫৯ আয়াতে নেতার গুণাবলী বর্ণনা করেছেন ১। কোমল হৃদয় সম্পন্ন ২। অনুসারীদের ত্রুটিকে ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখা। ৩। পরামর্শ করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ। ৪। দৃঢ় সংকল্প ৫। আল্লাহ্‌র উপর ভরসা রাখা।

নেতার গুণাবলী সম্পর্কে আরো বলেছেন আরো বলেছেন, লুকমান ২৩, তাওবা ১২৮, আশ শোয়ারা ২১৫, আহকাফ ৩৫।

নেতৃত্বের পরই নেতার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে কর্তৃত্ব প্রদান। মানে যোগ্য ব্যক্তিদের কে তাদের যোগ্যতা অনুযায়ী রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব প্রদান।

এই ব্যাপারে রাসূল সঃ বলেন, যে সেনাবাহিনীতে এমন ব্যক্তিকে নেতা নির্ধারণ করলো, যার চাইতে সেনাবাহিনীতে আরো যোগ্যতর ব্যক্তি রয়েছে, সে আল্লাহ্‌ ও তার রাসূলের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করলো। বিশ্বাসঘাতকতা করলো মুসলিমদের সাথে। (আল হাকিম)

এখানে স্বজনপ্রীতি পুরোপুরি অগ্রহণযোগ্য।

ওমর ফারুক রাঃ বলেন, যে মুসলিমদের কোন ব্যাপারে (নির্বাহী) দায়িত্ব পেয়ে এমন ব্যক্তিকে কর্মকর্তা নিযুক্ত করে, যার সঙ্গে তার স্নেহের সম্পর্ক আছে। কিংবা সে তার স্বজন। তবে সে আল্লাহ্‌ ও তার রাসূল এবং মুসলিমদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করলো। (শরিয়তী রাষ্ট্রব্যবস্থাঃ ইবনে তাইমিয়া)

কর্তৃত্ব বা নেতৃত্ব চাওয়ার বিষয় নয়। আর যে তা চাইবে সে সবচেয়ে বেশী অযোগ্য।

একদা রাসূল সঃ দরবারে কিছু লোক উপস্থিত হয়ে তাঁর পক্ষ হতে শাসন কতৃত্ব প্রাপ্তির অনুরোধ জানালো। জবাবে রাসূল সঃ বললেন, যারা স্বেচ্ছায় কর্তৃত্ব চায়, আমরা এমন লোককে কোন কিছুরই কর্তৃত্ব দেই না। (বুখারী ও মুসলিম)

কল্যাণমুখী রাষ্ট্রের স্বরুপঃ ০১ রাষ্ট্রের কর্তৃত্বে যারা থাকবে তাদের প্রধানত কাজ হবে দায়িত্বের ব্যাপারে সজাগ থাকা।

সূরা মায়েদায় ১০৫ নং আয়াতে আল্লাহ্‌ তায়ালা বলেন, হে মুমিন গণ! তোমরা নিজেদের দায়িত্বের ব্যাপারে সচেতন থাকো। তোমরা সঠিক পথে থাকলে গোমরাহ ব্যক্তিরা তোমাদের ক্ষতি করতে পারবে না।

কর্তা ব্যাক্তিরা হবে আমানতদার, বিশ্বস্ত, তাকওয়ার গুনে আলোকিত। তারা পার্থিব সামান্য চাহিদার বিনিময়ে হক্কুল্লাহকে কখনোই বিসর্জন দেবে না। তারা তাদের মন থেকে অবশ্যই মানুষের ভয় সম্পূর্ণ বের করে দিবে।

আল্লাহ্‌ তায়ালা বলেন, তোমরা মানুষকে ভয় করো না বরং আমাকে ভয় করো এবং সামান্য তুচ্ছ মূল্যের বিনিময়ে আমার আয়াত বিক্রি করা পরিহার করো। আল্লাহর নাযিল করা আইন অনুযায়ী যারা ফায়সালা করে না তারাই কাফের। (সূরা মায়েদাঃ ৪৪)

সব ধরণের সিদ্ধান্ত কিংবা ফয়সালা আল্লাহ্‌ এবং তাঁর রাসূলের প্রদর্শিত বিধান অনুযায়ী হতে হবে। নতুবা কর্তা ব্যক্তিদের জাহান্নামী হতে হবে।

এই সম্পর্কে রাসূল সঃ বলেন, শাসক ও বিচারকদের তিন ভাগে ভাগ করা হবে। এর মধ্যে দু’ভাগই জাহান্নামী হবে, এক ভাগ হবে জান্নাতি। অতঃএব যে ব্যক্তি সত্য কে অনুধাবন করে ন্যায়বিচার করবে সে জান্নাতী হবে। (আহলুস সুন্নাহ)

কর্তা ব্যক্তিরা কখনোই ভীরু, পাপাচারী এবং নিষ্ঠুর হবে না।

হযরত ওমর রাঃ এই দোয়া সবসময় করতেন, হে আল্লাহ্‌ তোমার কাছে পাপাচারীর নিষ্ঠুরতা এবং ভীরুর অক্ষমতা থেকে পানাহ চাই।

কুরআনের নির্দেশনা অনুযায়ী মুসলিম শাসকের ৪টি কাজ

১। নামাজ কায়েম করা ২। যাকাত আদায় ও বন্টন ৩। সৎ কাজের আদেশ ৪। অসৎ কাজের নিষেধ।

ওমর রাঃ ইসলামী রাষ্ট্রের বিভিন্ন এলাকায় নিয়োজিত কর্মচারী ও গভর্ণরদের উদ্দেশ্যে যে সরকারী ফরমান লিখে পাঠাতেন সেগুলো তে লেখা থাকতো, “আমার কাছে তোমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল নামাজ। যে ব্যাক্তি নামাজের হেফাযত করলো সে দ্বীনের হেফাযত করলো। যে নামাজ নষ্ট করলো সে অন্যান্য কাজও বেশী নষ্ট করবে। ” আল্লাহ্‌র রাসূল বলেন, “নামাজ হচ্ছে দ্বীনের স্তম্ভ”।

প্রশাসনিক কর্মকর্তারা যখন এই স্তম্ভটির হেফাযত করবে তখন নামাজ তাকে অশ্লীলতা এবং সকল গর্হিত কাজ ও দূর্ণীতি থেকে রক্ষা করবে। অন্যান্য ইবাদতের কাজেও নামাজ সহায়তাকারী হবে।

আল্লাহ্‌ তায়ালা বলেন “নিশ্চয়ই নামাজ সকল প্রকার অশ্লীলতা ও খারাপ কাজ হতে দূরে রাখে।” এই ব্যাপারে আল্লাহ্‌ আরো বলেছেন সূরা বাকারার ১৪৫ ও ৫৩ নং আয়াতে।  কল্যাণমুখী রাষ্ট্রের স্বরুপঃ ০২





ইসলামী রাষ্ট্রের আয়ের উৎস গুলো নিন্মরুপ। 

১। অর্থ সম্পদ ও গবাদি পশুর যাকাত ২।সদাকাতুল ফিতর ৩। কাফফারাহ ৪। ওশর ৫। খারাজ ৬। গণীমতের মাল ও ফাই ৭। জিজিয়া ৮। খনিজ সম্পদের আয় ৯। নদী ও সমুদ্র হতে প্রাপ্ত সম্পদের এক-পঞ্চামাংশ ১০। ইজারার  অর্থ ১১। মালিক ও উত্তরাধিকারহীন সম্পদ ১২। আমদানী ও রফতানী শুল্ক ১৩। রাষ্ট্রের মালিকানা ও কর্তৃত্বধীন জমি, বন ব্যবসায় ও শিল্পের মুনাফা ১৪। শরীয়াহ মোতাবেক আরোপিত কর ১৫। বন্ধু রাষ্ট্রসমূহের অনুদান ও উপটৌকন। ১৬। ইনফাক ফি সাবিলিল্লাহ।

যে সমস্ত খাতে বায়তুলমালের অর্থ ব্যয়ের সুস্পষ্ট বিধান রয়েছে সেগুলি হচ্ছে :
১। রাষ্ট্রপ্রধান ও সরকারি কর্মচারীদের বেতন ২। বন্দী ও কয়েদীদের ভরণ-পোষণ ৩। ইয়াতিম শিশুদের প্রতিপালন ৪। অমুসলিমদের আর্থিক নিরাপত্তা ৫। করযে হাসানা প্রদান এবং ৬। সামাজিক কল্যাণ

বেতন নির্ধারণ সম্পর্কে উমর ফারুক (রা) এর গৃহীত নীতি এ প্রসঙ্গে সবিশেষ মনোযোগের দাবী রাখে। সে নীতিতে মূখ্য বিচার্য বিষয় ছিল একজন ব্যক্তি-

১। ইসলামের জন্যে কি পরিমাণ দু:খ ভোগ করেছে। ২। ইসলাম প্রচারের ব্যাপারে কতখানি অগ্রসর হয়েছে ৩। ইসলাম প্রতিষ্ঠার কতখানি কষ্ট স্বীকার করেছে ৪। ইসলামী জীবন যাপনের জন্যে প্রকৃত প্রয়োজন কতখানি এবং ৫। কতজন লোকের ভরণ-পোষণের দায়িত্ব তার উপর অর্পিত রয়েছে।

কল্যাণমুখী রাষ্ট্রের স্বরুপঃ ০৩


ইসলামী রাষ্ট্রে শ্রমিকদের অবস্থান।

রাসূল সঃ মজুরদের অধিকার সম্বন্ধে বলেন- “তারা তোমাদের ভাই আল্লাহ্‌ তাদের দায়িত্ব তোমাদের উপর অর্পণ করেছেন। কাজেই আল্লাহ যাদের উপর এরূপ দায়িত্ব চাপিয়ে দিয়েছেন তাদের কর্তব্য হলো তারা যে রকম খাবার খাবে তাদেরকেও সেরকম খাবার দেবে, তারা যা পরিধান করবে তাদেরকে তা পরাবার ব্যবস্থা করবে। যে কাজ করা তাদের পক্ষে কষ্টকর ও সাধ্যতীত তা করার জন্যে তাদেরকে কখনও বাধ্য করবে না। যদি সে কাজ তাদের দিয়েই করাতে হয় তা হলে সে জন্যে তাদের প্রয়োজনীয় সাহায্য অবশ্যই করতে হবে। (বুখারী)

অন্যত্র রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম শ্রমিকদের সম্পর্কে বলেছেন, শ্রমিককে এমন কাজ করতে বাধ্য করা যাবে না, যা তাদেরকে অক্ষম ও অকর্মণ্য বানিয়ে দেবে। (তিরমিয)

তাদের উপর ততখানি চাপ দেওয়া যেতে পারে, যতখানি তাদের সামর্থ্যে কুলায়। সাধ্যাতীত কোন কাজের নির্দেশ কিছুতেই দেওয়া যেতে পারে না। (মুয়াত্তা, মুসলিম)

মজুরদের বেতন, উৎপাদিত পণ্যে তাদের অংশ ইত্যাদি সম্পর্কে তিনি সুস্পষ্টভাবে ঘোষণা করেছেন- মজুরের মজুরী তার গায়ের ঘাম শুকাবার পূর্বেই পরিশোধ কর। (ইবনে মাজাহ, বায়হাকী)

মজুরকে তার কাজ হতে অংশ দান কর। কারণ,আল্লাহ মজুরকে কিছুতেই বঞ্চিত করা যেতে পারে না। (মুসনাদে আহমদ বিন হাম্বল)

উপরোক্ত হাদীসসমূহ হতে যেসব মূলনীতি পাওয়া যায় সেগুলোই রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রবর্তিত মানবিক শ্রমনীতি। সংক্ষেপে এগুলো হচ্ছে-
১। উদ্যোক্তা বা শিল্প মালিক মজুর-শ্রমিককে নিজের ভাইয়ের মতো মনে করবে।সহোদর ভাইয়ের মধ্যে যে সম্পর্ক বিদ্যমান থাকে এ ক্ষেত্রেও সে রকম সম্পর্ক থাকবে।
২। অন্ন বস্ত্র-বাসস্থান প্রভৃতি মৌলিক প্রয়োজনের ক্ষেত্রে শ্রমিক ও।মালিক উভয়ের মান সমান হবে। মালিক যা খাবে ও পরবে শ্রমিককেও তাই খেতে ও পরতে দেবে।
৩। সময় ও কাজ উভয় দিক দিয়েই শ্রমিকদের সাধ্য মতো দায়িত্ব দেওয়া যেতে পারে, তার বেশী নয়। শ্রমিককে এত বেশী কাজ দেওয়া উচিৎ হবে না যাতে সে ক্লান্ত ও পীড়িত হয়ে পড়ে। এত দীর্ঘ সময় পর্যন্ত তাকে শ্রম দিতে বাধ্য করা যাবে না, যার ফলে সে অক্ষম হয়ে পড়ে। শ্রমিকের কাজের সময় নির্দিষ্ট হতে হবেএবং বিশ্রামের সুযোগ থাকতে হবে।
৪। যে শ্রমিকের পক্ষে একটি কাজ করা অসাধ্য তা সম্পন্ন হবে না এমন কথা ইসলাম বলে না। বরং সে ক্ষেত্রে আরও বেশী সময় দিয়ে বা বেশী শ্রমিক নিয়োগ করে তা সম্পন্ন করা যেতে পারে।
৫। শ্রমিকদের বেতন শুধুমাত্র তাদের জীবন রক্ষার জন্যে যথেষ্ট হলে হবেনা। তাদের স্বাস্থ্য, শক্তি ও সজীবতা রক্ষার জন্যে ন্যূনতম প্রয়োজনীয় ব্যয়ের ভিত্তিতেই বেতন নির্ধারণ করতে হবে।
৬। উৎপন্ন দ্রব্যের অংশবিশেষ বা লভ্যাংশের নির্দিষ্ট অংশও শ্রমিকদের দান করতে হবে।
৭। শ্রমিকদের কাজে কোন ত্রুটি-বিচ্যুতি ঘটলে তাদের প্রতি অমানুষিক আচরণ বা নির্যাতন করা চলবে না। বরং যথাযথ সহানুভূতি পূর্ণ ব্যবহার করতে হবে। ৮। চুক্তিমত কাজ শেষ হলে অথবা নির্দিষ্ট সময় অতিবাহিত হলে শ্রমিককে দ্রুত মজুরী বা বেতন পরিশোধ করতে হবে। এ ব্যাপারে কোন ওজর-আপত্তি বা গাফলতি করা চলবে না।
৯। পেশা বা কাজ নির্বাচন করার ও মজুরীর পরিমাণ বা হার নির্ধারণ সম্পর্কেও দর-দস্তর করার পূর্ণ স্বাধীনতা ও অধিকার শ্রমিকের রয়েছে। বিশেষ কোনকাজে বা মজুরীর বিশেষ কোন পরিমাণের বিনিময়ে কাজ করতে জবরদস্তি করা যাবে না।
১০। কোন অবস্থাতেই মজুরদের অসহায় করে ছেড়ে দেওয়া চলবে না। তারা অক্ষম ও বৃদ্ধ হয়ে পড়লে পেনশন বা ভাতার ব্যবস্থা করতে হবে। এ উদ্দেশ্যে বায়তুলমালের তহবিল ব্যবহৃত হতে পারে।
কল্যাণমুখী রাষ্ট্রের সরূপঃ ০৪ 

শিক্ষা ব্যবস্থা কীরূপ হবে?

১) ইসলামী আক্বীদাকে ভিত্তি করে শিক্ষানীতি প্রণয়ন করতে হবে। পাঠ্যসূচি এবং শিক্ষাদান-পদ্ধতি এমনভাবে সাজাতে হবে যাতে এ ভিত্তি থেকে যে কোন ধরনের বিচ্যুতি প্রতিরোধ করা সম্ভব হবে। [ইসলামী শিক্ষাব্যবস্থা সম্পূর্ণরূপে শিক্ষা সম্পর্কিত শরিয়া নিয়মকানুন ইসলামী আক্বীদা থেকে উৎসারিত এবং এদের প্রত্যেকের শরীয়া প্রমাণাদি বিদ্যমান থাকবে।

২) ইসলামী শিক্ষাব্যবস্থার উদ্দেশ্য হবে চিন্তা এবং স্বভাবগত দিক থেকে ইসলামী ব্যক্তিত্ব গঠন করা। সুতরাং এই নীতির উপর ভিত্তি করে কারিকুলামের বিষয়সমূহ নির্ধারণ করতে হবে।

৩) শিক্ষার লক্ষ্য হবে ইসলামী ব্যক্তিত্ব তৈরি করা এবং তাদেরকে জীবনের বিভিন্ন সমস্যার সমাধান সম্পর্কিত ইসলামী জ্ঞান সরবরাহ করা। এই লক্ষ্যকে সামনে রেখে শিক্ষাদান-পদ্ধতি ঠিক করতে হবে এবং এ লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত করে ফেলে এমন যে কোনো পদ্ধতিকে প্রতিরোধ করতে হবে।

৪) গবেষণালব্ধ বিজ্ঞান যেমন- গণিত (বা পদার্থবিদ্যা) এবং সাংস্কৃতিক জ্ঞান (যেমন আইনশাস্ত্র, সাহিত্য, ইতিহাস)- এ দুটোর মধ্যে পার্থক্য থাকতে হবে। গবেষণালব্ধ বিজ্ঞান এবং এর সাথে সম্পর্কিত অন্যান্য বিষয়াদি প্রয়োজনের সাথে সঙ্গতি রেখে শিক্ষাদান করতে হবে এবং শিক্ষার কোন পর্যায়েই এটা বাধাগ্রস্ত করা যাবে না। অন্যদিকে সাংস্কৃতিক জ্ঞানকে প্রাথমিক এবং মাধ্যমিক পর্যায়ে একটা নির্দিষ্ট নীতির মাধ্যমে শিক্ষাদান করতে হবে যাতে এটা ইসলামী চিন্তা এবং নিয়মকানুনের সাথে সাংঘর্ষিক না হয়। এছাড়া এই সাংস্কৃতিক জ্ঞানকে বিজ্ঞানের অন্যান্য বিষয়ের মতো উচ্চশিক্ষার অন্যান্য পর্যায়েও এমনভাবে শিক্ষাদানের ব্যবস্থা থাকতে হবে যাতে সেটা শিক্ষানীতির এবং শিক্ষার উদ্দেশ্য থেকে বিচ্যুতি প্রদর্শন না করে।

৫) ইসলামী সংস্কৃতিকে অবশ্যই শিক্ষাব্যবস্থার সমস্ত পর্যায়ে শিক্ষাদান করতে হবে। উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে চিকিৎসা, প্রকৌশল বা পদার্থবিদ্যা পাশাপাশি বিভিন্ন ইসলামী জ্ঞানের জন্য ডিপার্টমেন্ট খুলতে হবে।

৬) শিল্পকলা (Arts) এবং হস্তশিল্প (crafts) যদি বাণিজ্য, নৌযানবিদ্যা বা কৃষিবিদ্যার সাথে সম্পর্কিত হয়, তবে সেগুলো কোনরকম বাধা বা শর্ত ছাড়াই শিখা হবে। কিন্তু কখনো কখনো শিল্পকলা এবং হস্তশিল্প সংস্কৃতির সাথে সম্পর্কিত হতে পারে এবং জীবন সম্পর্কে একটি নির্দিষ্ট দৃষ্টিভঙ্গিও দ্বারা প্রভাবিত হতে পারে।

৭) রাষ্ট্রের একটিমাত্র নির্দিষ্ট শিক্ষাসূচি (কারিকুলাম) থাকবে এবং এটি বাদে অন্যকোন কারিকুলামের শিক্ষাদান অনুমোদন করা যাবেনা।

৮) বিদেশী রাষ্ট্র কর্তৃক পরিচালিত না হলে বেসরকারি স্কুলের অনুমোদন দেওয়া হবে যদি এসব স্কুল রাষ্ট্রের কারিকুলাম গ্রহণ করে, রাষ্ট্রেও শিক্ষানীতির আওতায় প্রতিষ্ঠিত হয় এবং রাষ্ট্রের শিক্ষানীতির লক্ষ্যকে যথাযথভাবে সম্পাদন করে। এসমস্ত স্কুলসমূহে নারী এবং পুরুষ একত্রে রাখা যাবেনা- এটা শিক্ষক বা শিক্ষার্থী উভয়ের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। এসমস্ত স্কুল নির্দিষ্ট কোন ধর্ম, মাযহাব, বংশ বা বর্ণের জন্য প্রতিষ্ঠিত হতে পারবেনা।

৯) যেসমস্ত বিষয় জীবনের মূলধারার জন্য প্রয়োজনীয়, সেগুলো নারী এবং পুরুষ প্রত্যেক নাগরিককে শিক্ষাদান করা রাষ্ট্রের অত্যাবশ্যকীয় কর্তব্য। প্রাথমিক এবং মাধ্যমিক স্তরে বিনামূল্যে এ শিক্ষার ব্যবস্থা করা রাষ্ট্রের জন্য বাধ্যতামূলক। রাষ্ট্র তার সাধ্যমতো সবার জন্য বিনা বেতনে উচ্চশিক্ষার সুযোগ তৈরির চেষ্টা করবে।

১০) স্কুল এবং বিশ্ববিদ্যালয় তৈরির পাশাপাশি রাষ্ট্র জ্ঞানের বিস্তার মান্নোয়নের জন্য বিভিন্ন উপকরণ; যেমন- লাইব্রেরি এবং লাইব্রেরি সরবরাহ করবে যাতে জ্ঞানের বিভিন্ন শাখা যেমন ফিকহ, হাদীস, কুরআনের তাফসীর এবং চিন্তা, চিকিৎসা, প্রকৌশল ও রসায়ন প্রভৃতি নিয়ে যারা গবেষণা করতে আগ্রহী তারা যেন উদ্ভাবন এবং আবিষ্কারে সক্ষমতা লাভ করতে পারে। এর ফলে পর্যাপ্ত পরিমাণে মুজতাহিদ, মানসম্পন্ন বৈজ্ঞানিক এবং উদ্ভাবক তৈরি হবে।

কল্যাণমুখী রাষ্ট্রের স্বরুপঃ ০৫


খিলাফত রাষ্ট্র অমুসলিমদের যে অধিকারগুলো বিশেষভাবে বাস্তবায়ন করে তা হচ্ছেঃ

১. খাদ্য-বস্ত্র-বাসস্থানের অধিকারঃ

খাদ্য-বস্ত্র-বাসস্থানের মৌলিক চাহিদা পূরণের ক্ষেত্রে খিলাফত রাষ্ট্র মুসলিম-অমুসলিম সকল নাগরিককে সমানভাবে বিচার করে। মুসলিম-অমুসলিম নির্বিশেষে রাষ্ট্রের প্রত্যেকটি নাগরিকের এ তিনটি মৌলিক চাহিদা পূরণ খিলাফত রাষ্ট্রের উপর অবশ্য পালনীয় কর্তব্য। এক্ষেত্রে ইসলাম সামগ্রিকভাবে মুসলিম-অমুসলিম সকল নাগরিককে নিশ্চয়তা দেয়। কারণ রাসূল (সাঃ) বলেনঃ

তিনটি বস্তু ছাড়া আদম সন্তানের আর কিছুর অধিকার নেই। তাহলোঃ বসবাসের জন্য একটি ঘরদেহ ঢাকার জন্য কিছু বস্ত্র এবং কিছু রুটি ও পানি।

এখানে ‘আদম সন্তান’ বলতে মুসলিম-অমুসলিম সকলকে বোঝানো হয়েছে। খলিফা ওমর (রাঃ) মিসরের গভর্ণর আমর ইবনুল আসকে (রাঃ) লেখা এক চিঠিতে বলেছেনঃ

কসম আল্লাহরআমার ভয় হয় তোমার শাসনাধীন এলাকার দূরতম কোণায় যদি একটি উট অবহেলায় মারা পড়ে তবে কিয়ামতের দিন আমাকে এরও জবাবদিহি করতে হবে।

২. ধর্মপালন বা বিশ্বাসের অধিকারঃ

ইসলামী রাষ্ট্র কখনও কোন অমুসলিমকে নিজের ধর্মপালনে বাধা দেয়না। কিংবা জোর করে ইসলাম গ্রহণ করতে বাধ্য করেনা। পবিত্র কুরআন এ ব্যাপারে পরিষ্কার ঘোষণা দিয়েছেঃ-

দ্বীন গ্রহণের ব্যাপারে কোন জোর-যবরদস্তি নেই।” (আল-বাকারাঃ ২৫৬)

স্যার থমাস তাঁর বইতে উল্লেখ করেছেন “আমাদের এমন কোন তথ্য জানা নেই যে, খিলাফত শাসন চলাকালীন ইসলামী কর্তৃপক্ষ কিংবা কোন সংগঠন কোন অমুসলিমকে জোর করে মুসলমান বানানোর প্রচেষ্টা চালিয়েছে কিংবা খৃীষ্টানদেরকে উত্যক্ত করার কোন পরিকল্পনার বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছে।” তিনি উদাহরণ দিয়ে বলেন, “যদি এমনটি হতো- তাহলে রাজা ফার্ডিনেন্ড এবং রাণী ইসাবেলার নিষ্ঠুর পদক্ষেপের দরুণ যেমন স্পেন মুসলিম শূণ্য হয়ে পড়েছিল এবং সাড়ে তিন শত বছর যাবত বৃটেনে ইয়াহুদীদের কোন নিবাস ছিল না, তেমনি জেরুজালেমও খৃষ্টান ইয়াহুদী শূন্য হয়ে যেত।”


৩. জান-মালের নিরাপত্তাঃ

খিলাফত রাষ্ট্রে একজন মুসলমানের মতই একজন অমুসলিম মুআ‘হিদের জীবন পবিত্র ও সুরক্ষিত থাকে। আল্লাহর রাসূল (সাঃ) বলেনঃ-

যদি কোন ব্যক্তি কোন মুআহিদকে হত্যা করে তবে সে জান্নাতের ঘ্রাণও পাবেনা। যদিও চল্লিশ বছরের দূরত্ব থেকেই জান্নাতের ঘ্রাণ পাওয়া যায়।” (বুখারী শরীফ)

তিনি আরো বলেন- সাবধান! কেউ যদি কোন মুআহিদের প্রতি যুলুম করে কিংবা তার অধিকার হতে কিছু কমিয়ে দেয়অথবা তার সাধ্যাতিত কোন কাজ তার উপর চাপিয়ে দেয়বা তার স্বতস্ফূর্ত অনুমতি ছাড়া তার কোন সম্পদ নিয়ে নেয়- তাহলে আমি কিয়ামত দিবসে তার বিরুদ্ধে মামলা করব এবং সে মামলায় জিতব।” (আবু দাউদ)

রাসূল (সাঃ) এর যুগে এক মুসলিম ব্যক্তি অপর এক অমুসলিমকে হত্যা করলে বিচারে তিনি হত্যাকারী মুসলিম ব্যক্তিকে মৃত্যুদণ্ড দেন এবং তা কার্যকর করেন।

৪. বিচার প্রাপ্তির অধিকারঃ

পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হয়েছেঃ-

যখন তোমরা মানুষের মাঝে বিচার কার্য পরিচালনা করবে তখন ন্যায়পরায়ণতার সাথে বিচার করবে। আল্লাহ্ তোমাদেরকে যে উপদেশ দেন তা কতই না উত্তম।” (সুরা নিসাঃ ৫৮)

অন্য আয়াতে ইয়াহুদীদের প্রসঙ্গে আল্লাহ্ তাঁর রাসুলকে নির্দেশ দিয়েছেন এই বলে যেঃ

যদি ফয়সালা করেন তবে ন্যায়ভাবে ফয়সালা করুন। নিশ্চয় আল্লাহ্ সুবিচারকারীকে ভালবাসেন।” (মায়িদাঃ ৪২)

খিলাফতের ইতিহাসে এমন অনেক অবিস্মরনীয় বিচারের ঘটনা ঘটেছে যা একদিকে ন্যায়বিচারের ভান্ডারকে করেছে সমৃদ্ধ অন্যদিকে সর্বকালের অমুসলিমদের জন্য হয়ে আছে অনুপ্রেরণার উৎস। আলোচনা দীর্ঘ না করার স্বার্থে শুধুমাত্র একটি দৃষ্টান্ত উপস্থাপন করছি। সপ্তম শতাব্দির ঘটনা। তখন খিলাফতের মসনদ অলংকৃত করে আছেন মহাবীর হযরত আলী (রাঃ)। একজন ইয়াহুদী নাগরিক খলীফা আলীর (রাঃ) একটি ঢাল চুরি করলে বিষয়টি বিচারালয়ে উত্থাপিত হয়। তখন কাজী অর্থাৎ বিচারক খলীফাকে তার পক্ষে স্বাক্ষী উপস্থিত করতে বলেন। হযরত আলী তাঁর পুত্রকে স্বাক্ষী হিসাবে হাজির করেন। বিচারক মামলাটি খারিজ করে দেয় এই বলে যে, কোন পিতার পক্ষে পুত্রের স্বাক্ষী গ্রহণযোগ্য নয়। ন্যায় বিচারের এই চমৎকারিত্য দেখে ইয়াহুদী লোকটি দারুণভাবে অভিভূত হয় এবং চুরির কথা স্বীকার করে নিজেই মুসলমান হয়ে যায়। এমন অনেক ঘটনা খোদ রাসূল (সাঃ) এর জীবনেও ঘটেছে। যেখানে অমুসলিমরা নিজেদের ধর্মীয় নেতার কাছে না গিয়ে মুকাদ্দমা নিয়ে ইসলামের আদালতে এসেছে এই আশায় যে এখানেই পাওয়া যাবে প্রকৃত ন্যায় বিচার। আমরা আশা করি, ইসলামের এই ইনসাফ ভিত্তিক শাসন ব্যবস্থা এদেশের অমুসলিমদেরকে আশ্বস্ত করবে এবং ইসলাম সম্পর্কে জানার আগ্রহকে তীব্র করবে। আর অপপ্রচারকারীদের চেহারাকে করবে মলিন।

৫. শিক্ষার অধিকারঃ

একটি শক্তিশালী রাষ্ট্র হওয়ার লক্ষ্যে খিলাফত রাষ্ট্র তার নাগরিকদেরকে শিক্ষিত করে তুলবে। নাগরিকগণ তাদের ইচ্ছা অনুযায়ী বিজ্ঞান, ব্যবসা, আইন, শিল্পকলার মত যেকোন শাখায় উচ্চ শিক্ষা গ্রহণ করতে পারে। রাসূল (সাঃ) বদরের যুদ্ধে বিভিন্ন রকম মুক্তিপণের বিনিময়ে যুদ্ধবন্দিদের মুক্তি দিয়েছিলেন। তার মধ্যে একটি ছিল একজন শিক্ষিত যুদ্ধবন্দির মুক্তিপণ হিসেবে দশজন মুসলিমকে শিক্ষাদান।

৬.অর্থনৈতিক অধিকারঃ

খিলাফত রাষ্ট্র মুসলমানদের তুলনায় অমুসলমানদের অনেক বেশী সুবিধা দিয়ে থাকে। কারণ মুসলমানদের যাকাত নামক একটি বিশেষ কর দিতে হয় যা অমুসলিম ব্যক্তি বা কোম্পানীকে দিতে হয়না। এমন আরও কিছু বিষয় আছে যা মুসলিম নাগরিকদের উপর বর্তায় কিন্তু অমুসলিমদের উপর বর্তায় না। এখানে আরও উল্লেখ্য যে, অমুসলিমদের কাছ থেকে নাগরিক নিরাপত্তা বাবৎ যে জিযিয়া আদায় করা হয় তার হার মুসলমানদের যাকাতের হারের চেয়ে অনেক কম। রাসূল (সাঃ) বলেনঃ

যে ব্যক্তি কোন মুআহিদের উপর জুলুম করবেতার শক্তির বাইরে খারাজ ও জিযিয়া ধার্য করবে কেয়ামতের দিন আমি তার গর্দান পাকড়াও করব।


৭. নাগরিক ও সামাজিক অধিকারঃ

অমুসলিমরা খিলাফত রাষ্ট্রের বিশেষ সম্মানিত নাগরিক। তারা সবসময় নিরাপদ ও মর্যাদাপূর্ণ জীবন-যাপন করবে।
সকল মুসলমান তাদের সাথে সৎ ও বন্ধুত্বপূর্ণ প্রতিবেশীসুলভ আচরণ করতে বাধ্য থাকবে। আল্লাহর রাসূল (সাঃ) বলেনঃ

যে ব্যক্তি কোন চুক্তিবদ্ধ অমুসলিমের ক্ষতি করল সে যেন আমাকে ক্ষতিগ্রস্থ করল।
কল্যাণমুখী রাষ্ট্রের স্বরুপঃ ৬




ইসলামের বিচার ব্যবস্থা

যে কোন বিষয়ে ইসলামের সিদ্ধান্ত বা রায় কে বাধ্যতামূলকভাবে প্রয়োগ করাকে ইসলামের বিচার ব্যবস্থার মূলনীতি হিসাবে গ্রহণ করা হয়েছে। এটি নিম্নলিখিত দায়িত্বগুলো পালন করবে: 

১) জনগণের মধ্যে বিরোধ নিষ্পত্তি; 

২) সামাজিক অধিকারের জন্য ক্ষতিকর সবকিছু প্রতিহত করা; 

৩) জনগণ এবং সরকারের (যথা- খলীফা, ওয়ালী’র ইত্যাদির) মধ্যে উদ্ভুত বিরোধ নিষ্পত্তি করা। 

ইসলামের জন্মলগ্ন থেকেই আদালত এবং বিচার ব্যবস্থা বিদ্যমান রয়েছে যা ইসলামের আইনের মৌলিক উৎস যথা- কুরআন, সুন্নাহ, ইজমা এবং কিয়াস দ্বারা পরিবেষ্টিত (নিয়ন্ত্রিত)। 

একজন প্রধান বিচারক নিয়োগের মাধ্যমে বিচারিক অঙ্গনের কাঠামো প্রতিষ্ঠা করা হয়, যিনি অন্যান্য সকল বিচারক নিয়োগ এবং স্তর/ কার্য পরিধি নির্ধারণের দায়িত্ব পালন করেন। 

ইসলামের তিন ধরণের বিচারকের অস্তিত্ব : ১. কাযী-উল্-খুসুমাত - কাযী উল খুসুমাত পারিবারিক আইন, চুক্তি আইন, ক্রিমিনাল আইন ইত্যাদি ব্যাপারে বিচারকার্য পরিচালনা করেন। 

২. কাযী-উল্-মুহতাসিব - কাযী উল মুহতাসিব ব্যবসা পরিদর্শক, অসামাজিক কার্যকলাপ বিরোধী পরিদর্শক, পরিবেশ ও স্বাস্থ্য পরিদর্শক তথা জনস্বার্থ দেখাশুনাকারী বিচারক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। কাযী মুহতাসিবের রায় প্রদান করার জন্য কোন বিচারালয় প্রয়োজন হয় না। তিনি যেকোন সময়ে যেকোন জায়গায় অপরাধ সনাক্ত করতে পারলে সাথে সাথে সেখানেই রায় প্রদান করে তা পুলিশের সাহায্যে বাস্তবায়ন করতে পারেন। 

৩. কাযী-উল্-মাযালিম - কাযী-উল-মাযালিম খলীফা থেকে শুরু করে শাসকগোষ্ঠীর যেকোন ব্যক্তির যে কোন ধরণের অন্যায় আচরণের ব্যাপারে আইনী কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারেন। তিনি বাদি ছাড়াই নিজে উদ্যোগী হয়ে রাষ্ট্রের যে কোন দোষী ব্যক্তির বিরুদ্ধে মামলা করে বিচারকার্য পরিচালনা করতে পারেন। খলীফার বিরুদ্ধে মামলা চলাকালীন সময়ে এই আদালতের বিচারককে পদচ্যুত করা যাবেনা। 



বিচার প্রাপ্তির নিশ্চয়তা 

· ইসলামী রাষ্ট্রে শরিয়াহ্ অনুযায়ী বিচার বিভাগ নির্বাহী বিভাগ থেকে আলাদা । যেহেতু খিলাফত রাষ্ট্রে বিচার ব্যবস্থা স্বাধীন, সেহেতু বিচার বিভাগ জনগণের উপর ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করতে করে। 

· খিলাফত রাষ্ট্রের বিচার ব্যবস্থা নিরপেক্ষ ও দুর্নীতিমুক্ত। বিচারকের অন্যায়ের ব্যাপারে ইসলাম কঠোর হুঁশিয়ারী উচ্চারণ করেছে। এজন্য বিচারকগণ শরীয়াহর প্রত্যেকটি আইন বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করবেন এবং পরিপূর্ণ দায়িত্ববোধ থেকে কর্তব্য পালন করেন। 

· খিলাফত রাষ্ট্রের বিচার ব্যবস্থায় দীর্ঘসূত্রিতার কোন অবকাশ নাই। নির্দিষ্ট অপরাধের জন্য নির্দিষ্ট আইন বিদ্যমান থাকায় দ্রুত বিচার কার্যক্রম এই শাসন ব্যবস্থার একটি গতিশীল দিক। 

· বিচার প্রাপ্তি সহজলভ্য করার উদ্দেশ্যে রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে প্রতিটি নাগরিকের জন্য ন্যূনতম সরকারী ফি নির্ধারণ ও নিশ্চিতকরণ করা হয়ে থাকে। 

· বিচার প্রাপ্তির নিশ্চয়তা বিধানের লক্ষ্যে খিলাফত রাষ্টের বিচার ব্যবস্থা রাষ্ট্রের প্রান্তিক পর্যায় পর্যন্ত প্রতিটি নাগরিকের হাতের নাগালের মধ্যে নিয়ে যাওয়া খলিফার দায়িত্ব। তাই জনগণকে বিচার প্রাপ্তির জন্য অযথা হয়রানিমূলকভাবে এদিক ওদিক ছোটাছুটি করে আর্থিক, শারীরিক ও মানসিক কষ্ট স্বীকার করতে হয় না। 

কল্যাণমুখী রাষ্ট্রের স্বরুপঃ ৭  

ইসলামের শাস্তির ব্যবস্থা: (নিজাম আল উকুবাত) 

ইসলামের শাস্তির ব্যবস্থা তথা দন্ডবিধি হচ্ছে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলার দয়ার প্রমাণ এবং ইসলামের সৌন্দর্য্য। দন্ডবিধির মূলনীতি সমূহ নিম্নরূপ: 

১) একজন মুসলিম (পুরুষ বা নারী) তার প্রত্যেকটি কাজের জন্যই দায়িত্বশীল। শরীয়াহতে যে সকল অপরাধের শাস্তি নির্দিষ্ট করা আছে তা রাষ্ট্র কার্যকর করবে। সমাজকে রক্ষা করে শুধুমাত্র এই কারণেই এই নীতি গুরুত্বপূর্ণ নয়, বরং শরীয়াহ্ আদালতের মাধ্যমে কোন অপরাধের শাস্তি হয়ে গেলে ঐ একই অপরাধের জন্য আখিরাত তথা পরকালের শাস্তি থেকে পরিত্রাণ পাওযা যায়।

২) দন্ডবিধির নীতি হল “শাস্তিকে যথাসম্ভব নিবৃত্ত করা”, যেহেতু শাস্তির কঠোরতা নিবৃত্তির প্রাথমিক কাজ করে। কোন প্রমাণের অংশ বিশেষ ও যদি সন্দেহজনক হয় তা শাস্তি নিবৃত্ত করবে। যখন রাসূল (সাঃ) এর নিকট কোন লোক এসে তাদের অপরাধ স্বীকার করে তাদের উপর শাস্তি কার্যকর করার আবেদন জানাতো তখন রাসূল (সাঃ) শাস্তি প্রয়োগ করা হতে নিজেকে সরিয়ে রাখতে কিভাবে চেষ্টা করতেন তা সীরাতে বর্ণিত আছে। তিনি (সাঃ) বলেছেন, “একজন নিরপরাধীকে শাস্তি প্রদান করার চেয়ে একজন অপরাধীকে মুক্তি দেয়া উত্তম।” একজন ইমামের জন্য ভুলক্রমে একজনকে শাস্তি দেয়ার চেয়ে ভুলক্রমে একজনকে ক্ষমা করা উত্তম।” 


৩) ইসলাম পাঁচটি বিষয় সংরক্ষণ করে যা জিম্মিদের (অমুসলিম নাগরিক) ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। রাসুল (সাঃ) বলেছেন, “যে কোন জিম্মির ক্ষতি করলো, সে যেন আমারই ক্ষতি করলো।” তাছাড়া ইসলামী রাষ্ট্রের মধ্যে সকল নাগরিককে সমান দৃষ্টিতে দেখা হয় এবং এক্ষেত্রে কোনরূপ বৈষম্য বৈধ নয়।

ইসলামের দন্ডবিধি চার ভাগে বিভক্ত: 

১) হুদুদ: এই শাস্তি হচ্ছে “আল্লাহর (সুবহানাহুতা ওয়া তা’আলা) অধিকার এবং তা কেউ ক্ষমা করতে পারে না।” ছয়টি ক্ষেত্র এর অন্তর্ভূক্ত: 

ক) অবিবাহিত পুরুষ/ নারীর ব্যভিচার: (১০০ দোররা বা চাবুকের আঘাত), বিবাহিত পুরুষ/ নারীর ব্যভিচার: (পাথর নিক্ষেপ করে হত্যা), সমকামিতা: (মৃত্যুদন্ড)। 

খ) অপবাদ দেওয়া, সম্মান নষ্ট করা, মিথ্যা কথা প্রচার করা এবং উড়ো খবর রটানো (৮০ দোররা)। 

গ) চুরি (হাত কাটা) 

ঘ) মদ পান করা এবং নেশা করা (৮০ দোররা) 

ঙ) দুই দল মুসলিম দ্বারা আইন লঙ্ঘন এবং রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে আইন লঙ্ঘন। যথাঃ খলীফা আবু বকর (রাঃ) এর সময় মুরুতাদদের যাকাত অস্বীকার করার বিষয়। 

চ) মুরতাদ, অর্থাৎ কোন মুসলিম ইসলাম ত্যাগ করা (মৃত্যুদন্ড)। 

২) আল-জিনায়াত: “ব্যক্তির অধিকার এবং ক্ষমা করারও অধিকারী”। মূলতঃ হত্যাকান্ড সংক্রান্ত ঘটনাগুলো হতে পারে তা বেআইনীভাবে কিংবা দূর্ঘটনাবশতঃ, এবং নিহত ব্যক্তির স্বজন বা পরিবারের দিয়তের বিনিময়ে ক্ষমা করার অধিকার এই ক্ষেত্রের অন্তর্ভূক্ত।

ক) যে ব্যক্তি উদ্দেশ্যমূলকভাবে খুন করে তার ক্ষেত্রে দিয়ত হচ্ছে ১০০ উটের সমপরিমাণ যার মধ্যে ৪০টি হতে হবে গর্ভবতী। 

খ) যদি কোন ব্যক্তি অনিচ্ছাকৃতভাবে কাউকে খুন করে সেক্ষেত্রে তার দিয়ত হচ্ছে ১০০ উটের সমপরিমাণ। 

ইমাম আন-নাসায়ী তার বর্ণিত হাদীসে উল্লেখ করেন যে, শরীরের প্রত্যেকটি অঙ্গের জন্য দিয়ত রয়েছে, যেমন চোখের জন্য রক্ত পণ হচ্ছে ৫০টি উটের সমপরিমাণ। 

৩) আল-তা’জির: এটি হচ্ছে “সমাজের অধিকার”। যা কিছু সমাজের দৈনন্দিন জীবনে প্রভাব ফেলে তা এই ক্ষেত্রের অন্তর্ভূক্ত, যেমন- রাস্তায় দাঁড়িয়ে চিৎকার-চেচাঁমেচি করা বা রাস্তায় আবর্জনা ফেলা ইত্যাদি। রাষ্ট্রই এই ধরণের অপরাধের শাস্তি নির্ধারণ করে। 

৪) আল-মুখালাফাত: এটি হচ্ছে “রাষ্ট্রের অধিকার”। এই ক্ষেত্রের অন্তর্ভূক্ত বিষয়ে রাষ্ট্র নিজেই নিয়ম/ আইন তৈরী করে থাকে। যেমন- রাস্তায় গাড়ির গতিসীমা অতিক্রম, যেখানে গাড়ি রাখার নিয়ম নেই সেখানে রাখা ইত্যাদি। 

২২ মার্চ, ২০১৫

বাংলাদেশের আদিবাসী কারা?

 সুলতানা কামাল ইনু মেননরা বলে, বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামে বাস করা উপজাতিরা নাকি আদিবাসী। ইদানিং ছাগলের তিন নং বাচ্চার মত কিছু নব্য আওয়ামীলীগ নেতাও তা বলে। ওরা আসলে রাজনীতি বুঝে না। ছাগলেরা মনে করে বামদের মত করে বলাই হল প্রগতি। 

বামরা বলে এই কারণে নয় যে তারা চাকমা মারমাদের খুব ভালোবাসে। বরং তারা বলে উপজাতিদের ফুসলিয়ে স্বাধীকার আন্দোলনে নামানোর জন্য। এরপর তারা এই আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়ে স্বাধীন পার্বত্য চট্টগ্রামে, সম্ভব হলে বৃহত্তর চট্টগ্রামে বাম রাজত্ব কায়েম করবে। যুগ যুগ ধরে তারা এই হটকারী রাজনীতিই করে আসছে।

চাকমা-মারমারা বড় জোর সাড়ে তিনশ বছর পূর্বে মগদের হামলায় টিকতে না পেরে আরাকান ও বার্মার নানা অঞ্চল হতে এসে এদেশের পাহাড়ে অবস্থান নেয়। তাহলে কি করে তারা বঙ্গের আদিবাসী হয়? অথচ এদেশের নাম বঙ্গ হাজার হাজার বছর ধরে। জ্ঞানী গুনী ঐতিহাসিক তো দূরে থাকুক কোন নব্য ঐতিহাসিকও বলেন নি, তারা (পাহাড়ি) এদেশের আদিবাসী। এরা মূলত বহিরাগত অভিবাসী।

তারা যদি আদিবাসী না হয় তাহলে আদিবাসী কারা? অনেকে মনে করেন বৌদ্ধরা এদেশের আদিবাসী, প্রমাণ হিসেবে পাহাড়পুর, ময়নামতি, ইত্যাদি অনেক বৌদ্ধবিহারের নাম করে বলতে চান বঙ্গের প্রথম সভ্যতা স্থাপন কারী হল বৌদ্ধারা।

ঐতিহাসিকরা এটাও ভুল প্রমাণ করেছেন। কারণ বুদ্ধের ধর্ম প্রচারের আগেই এদেশের নাম বঙ্গ ছিল। বহু শক্তিশালী ঐতিহাসিক বলে থাকেন বৈদিক ধর্মের প্রচারক আর্যরা হলেন এদেশের আদিবাসী। এই বৈদিক ধর্মই বর্তমানে পরিবর্তিত হয়ে সনাতন বা হিন্দু ধর্মে পরিণত হয়েছে। এটা ছাড়াও আমরা অনেকেই মনে করি এই পুরো ভারতবর্ষই ছিল হিন্দুদের। আমরা মানে তাওহীদপন্থিরা পরে এসে অবস্থান নিয়েছি।

অথচ মজার বিষয় হল ড. নীহাররঞ্জন রায় সহ প্রায় সকল প্রথিতযশা ঐতিহাসিক বলে থাকেন, সাদা বর্ণের আর্যরা হল অনুপ্রবেশকারী। এখানে ছিল দ্রাবিড় জাতির বসবাস। তারা পুরো হিন্দ হতে দ্রাবিড় দের তাড়িয়ে দিলেও দ্রাবিড়রা অবস্থান নেয় এই বঙ্গে। সুতরাং দ্রাবিড়রাই যে বঙ্গের আদিবাসী এতে কোন সন্দেহ বেশীরভাগ ঐতিহাসিকদের নেই।

আর দ্রাবিড়রা যে তাওহীদপন্থী ছিল এই বিষয়ে মতামত প্রকাশ করেছেন, ড. কাজী দ্বীন মোহাম্মদ, ড. আব্দুল করিম, মো আব্দুল মান্নান, ড. এম এ আযীয , ড. আহমাদ আনিসুর রহমান, গোলাম হোসাইন সালিম, আব্বাস আলী খান।

সুতরাং এই বঙ্গের আদিবাসী তাওহীদপন্থীরাই। আমাদের বঙ্গকে রক্ষার জন্য সবচেয়ে বেশী ভূমিকা রাখতে হবে আমাদেরই। কারণ আমরাই আদিবাসী।

১১ ফেব, ২০১৫

ধান্ধা

১.
-- দোস্ত দেশের যা অবস্থা ধান্ধা- মান্ধা তো সব বন্ধ।
-- শালার খালেদা যা শুরু করছে। সরকার পইড়া গেলে তো পলান লাগবো।
-- হ দোস্ত যে ক’দিন আছি আরো কিছু কামানো লাগবো
-- বিদেশ যাইবার পয়সা তো অন্তত তুলতে হইবো
-- আমার মাথায় একখান জোশ বুদ্ধি আইছে।
-- কি বুদ্ধি দোস্ত?
-- শিবির ধরায়া দিমু। লাখ টাকা পামু।
-- আরে শিবির কই থাকে এডা তার বাপেরাই জানে না, তুই ক্যামনে বাহির করবি।
-- আরে বেটা ! তোর মাথায় একটু ঘিলু কম আছে। জীবনে কোন সলিড কাম করছি বলে তো আমার জানা নাই। এটা সলিড হওনের কি দরকার?
-- বুঝলাম না।
-- আরে রাস্তা থেকে সুন্দর, দাঁড়িওয়ালা হইলে আরো ভালা। এরকম কিছু পোলারে ধইরা সুমনের কক্টেল ধরায়া দিমু। ব্যাস! ভাই পুলিশ ডাইকা দিবে।
-- ওরে জোশ মাম্মা! এমন বুদ্ধি লই ঘুমাস ক্যামনে?
-- চল! ভাইর কাছে চল।
(কথোপকোথন গুলো দুই ছাত্রলীগ কর্মীর)
২.
তিন দিন ধরে কোচিং এ যায় নি মাসুদ। মা তাকে বের হতে দেয় না। রাস্তা-ঘাটে কখন কি ঘটে। দেশে অস্থিতিশীল পরিবেশ। মাসুদ তার বন্ধুদের ফোন করে পড়ার খোঁজখবর করে। পরদিন সে তার মাকে বলে, সবাই পড়ছে। আমি এভাবে কোচিং এ না গেলে পিছিয়ে পড়বো। আর তাছাড়া গাড়ি তো সব চলছে। যা দূর্ঘটনা ঘটছে সব ঢাকার বাইরে। অবশেষে তার মা তাকে যেতে দেয়।
কোচিং থেকে বের হলেই মসজিদ। মাসুদ বের হয়েই আসরের আযান শুনলো। চিন্তা করলো, নামাযটা পড়ে যাই। যেই মসজিদ থেকে বের হলো অমনি দুইজন লোক তাকে ডেকে রাস্তার পাশে নিয়ে গেলো। হঠাৎ একটি মাইক্রোবাস এসে তাকে তুলে নিয়ে গেলো।
মাসুদের মা অপেক্ষা করছেন কখন তার ছেলে ফিরবে। সন্ধ্যা হয়ে গেলো অথচ সে ফিরলো না। মোবাইলটাও বন্ধ। একটি কল আসলো মাসুদের মায়ের নাম্বারে। থানা থেকে বলা হল আপনার ছেলে ককটেল সহ ধরা পড়েছে।
পরদিন মাসুদের বাবা পত্রিকা হাতে স্তব্ধ হয়ে বসে আছেন। মাসুদের হাতবাঁধা ছবি আর ককটেল গুলোর দিকে তাকিয়ে ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে আছেন। বুঝতে পারছেন না কি থেকে কি হয়ে গেলো। বারবার মূর্ছা যাচ্ছেন মাসুদের মা।
৩.
ছাত্রলীগ থানা সেক্রেটারী মন্টুর আস্তানায় চলছে মদের ফোয়ারা উৎসবের আমেজ। মধ্যমণি রিংকু। কারণ তার এই অসাধারণ বুদ্ধিতে নতুন ধান্ধার খোঁজ পাওয়া গেছে। আজকের ইনকামের অর্ধেকই রিংকুকে দিয়ে হল। রিংকু কৃতজ্ঞতায় মন্টুর পা ধরে সালাম করলো। উৎসব নাচগানের পাশাপাশি চলছে ভবিষ্যত পরিকল্পনা।
সুমনকে বললো দুই’শ ককটেল বানাতে। সেতুকে বললো পঞ্চাশটা পেট্রোল বোমা বানাতে। রিংকু বললো, ওস্তাদ এতগুলান দিয়ে কাম কি? একটা দুইটা হলেও তো হয়। মন্টু বললো,
প্রথমে আমরা কোন এক এলাকায় প্রচুর ককটেল ফাটাবো। দুইটা বাস পোড়া দিব। তারপর পুলিশ ঐ এলাকার শিবির ধরার জন্য উইঠা পইড়া লাইগবো। তখনই আমরা গোবেচারা কাউকে আবার ধইরা পুলিশেরে দিমু। ব্যাস এলাকা ঠান্ডা হইয়া যাইবো। এই এলাকায় আমরা আর ককটেল ফাটামু না। মিডিয়া মনে কইরবো ঐ বেচারা পোলাই মূল হোতা। হেই এরেস্ট তো এলাকা ঠান্ডা।
আর প্রতিটা কাজে চেষ্টা করতে হবে, দুই একটা মানুষ যাতে মারা পড়ে। মানুষ না মরলে কাম হইবো না। মানুষ না মরলে মিডিয়া কাভারেজ পাওন যাইবো না।
শিবির-বিএনপিরাও তো ফুটায়। সেগুলাতে মানুষ মরে না। মিডিয়ায়ও আসে না।
সুমন বলে উঠলো, ভাই পুলিশ তো ঝামেলা কইরতে পারে। মন্টু অট্টহাসি দিয়ে বললো, আরে ব্যাটা পুলিশ ঝামেলা করলে আমি আছি ক্যান? পুলিশ আমার পকেটে থাকে। চিন্তা করিস না।
৪.
থানা সভাপতি মারুফের মুখ অন্ধকার। ঝাড়ছে তার সাঙ্গপাঙ্গদের। মন্টু সমানে ধান্ধা কইরা যাইতেছে। কি করস তোরা? কোন কামের না তোরা ...... পুতেরা!!
কবির হন্তদন্ত হয়ে ঢুকে।
-- কি হইছেরে কবির? যে কামে পাঠাইছি, হইছে?
-- ওস্তাদ এক্কেরে পাকা খবর নিয়া আসছি।
কবির মন্টুদের সব পরিকল্পনা জানায় মারুফকে।
মারুফের মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠে। পাইছি। ধান্ধা পাইছি। এবার শুধু ধান্ধা না। মন্টুরে ভ্যানিশ করার উপায় পাইছি। কবির তুই যা। কাল মন্টুরা কই কই ককটেল ফাটাইবো একটু খোঁজখবর কর।
৫.
পরদিন কিছু পত্রিকার নিউজ। ককটেল ফাটানো ও গাড়িতে অগ্নিসংযোগের সময় ছাত্রলীগ সেক্রেটারী মন্টুসহ ৫ জন হাতেনাতে ধৃত। মারুফ সব পত্রিকাকে ম্যানেজ করতে পারে নি। সরকারের এসব নিউজ চাপানোর ব্যাপারে কঠোর নিষেধাজ্ঞা আছে।

৫ ফেব, ২০১৫

অনিবার্য বিপ্লব

(শহীদ মোল্লাহ আব্দুল কাদের রাহিমাহুল্লাহ স্মরনে)

আমার সমগ্র সত্তা আজ হাহাকার করছে
না, কোন নারীর জন্য নয়।
কোটি কোটি টাকার সম্পত্তির জন্য নয়
এক সর্বাত্মক বিপ্লবের জন্য।
আমার চোখ দুটো আজ সূর্য দেখছে
এক বিপ্লবস্নাত সোনালী সূর্য
আমার এতদিনকার স্বপ্ন গুলো গতি হারিয়ে ফেলছে
এলোমেলো হয়ে বলছে, বিপ্লব চাই ! বিপ্লব !!
আমার শ্রবনেন্দ্রিয় চিৎকার করে বলছে
আমি আর পারছি না
আমি শুনতে পাচ্ছি, আমি শুনতে পাচ্ছি।
এক অনিবার্য বিপ্লবের প্রতিধ্বনি।
আমার নাসারন্ধ্র উন্মাদের মত বলছে
আমি এক বিপ্লবের কথা বলছি,
যার থেকে আসে শুধু তাজা রক্তের গন্ধ।
আমি কোনভাবেই তা অতিক্রম করতে পারছি না।
আমার সমগ্র লোহিত কণিকা আর্তনাদ করছে
বলছে, আমরা আর পারছি না
আমাদের মুক্ত করে দাও
রঞ্জিত করে দেব কালো রাজপথ ।।
এতক্ষণে বিবেক বলে উঠলো
ঐ তো ঐ শুরু হয়ে গেল
কাদের মোল্লাহ শুরু করে দিল
তুমি যাচ্ছ কবে?

২৯ জানু, ২০১৫

শপথ (শহীদ নুরুল ইসলাম শাহিন ভাইয়ের স্মরনে)



১.


কবির ক্লাসের মধ্যম মানের ছাত্র। কয়েকদিন ক্লাসে আসছে না সে। এই বিষয়টা নজর এড়ায়নি অধ্যাপক নুরুল ইসলাম সাহেবের। অধ্যাপক সাহেবের ছেলেপুলে নেই। ইসলামীয়া কলেজের সব ছাত্রকেই উনি সন্তানের মত করে দেখেন। বাজারে মুরগী কিনতে গিয়েই দেখা কবিরের সাথে। হাতে দুটো মুরগী। বিক্রী করার জন্যই এনেছে বোধহয়। কিন্তু স্যারকে দেখে সহসা এমন ভাব করলো যেন সে মুরগী দুটো কিনেছে। অধ্যাপক সাহেব সব বুঝেও না বুঝার ভান করলেন।


তাকে ডেকে বললেন, তুমি কয়দিন কলেজে যাচ্ছ না। ঘটনা কি? কবির আমতা আমতা করে বললো স্যার,ফরম ফিলাপের টাকা যোগাড় হয় নি। পরীক্ষা আগামী বার দেব। অধ্যাপক সাহেব বললেন, আচ্ছা ঠিক আছে। মুরগী দুটোতো বেশ সুন্দর। শোন আমার জরুরী কাজ আছে এই বলে তাকে এক হাজার টাকা গুঁজে দিয়ে বললো, তুমি আবার দুটো কিনে নিও। তোমারগুলো আমাকে দিয়ে দাও। এই বলে তিনি তার হাত থেকে ছিনিয়ে নিয়ে হাঁটা শুরু করলেন। বললেন কাল ক্লাসে এসে বাকী টাকা দিয়ে যাবে।


বাসায় থাকতে পারেন না অধ্যাপক সাহেব। তিনি জামায়াত করেন। তাই পুলিশ সর্বদা তাড়িয়ে বেড়ায়। একবার গ্রেপ্তারও করেছিলো। মাস চারেকের মত ছিলেন কারাগারে। আজ তিনি বাসায় যাচ্ছেন, তাই অনেক বাজার করলেন। বাসায় গিয়ে সন্ধ্যা পর্যন্ত থাকলেন। তাঁর স্ত্রী তাঁকে প্রায় ঠেলে ঘর থেকে বের করে দেন কারণ যে কোন সময় পুলিশ চলে আসবে। স্ত্রীকে সালাম জানিয়ে অধ্যাপক সাহেব একটি বাজারের একটি ভাঙ্গা দোকানের দিকে যাচ্ছেন। সেখানেই তিনি পালিয়ে থাকেন।


২.

কবিরের আর্থিক দৈন্যতার কথা তিনি আগে থেকেই জানতেন। তাকে কয়েকবার সহযোগিতা করতে চেয়েছেন। কিন্তু কবিরের প্রবল আত্মসম্মান বোধ থাকায় তিনি পারেন নি। তাই কবিরকে বাকী টাকা ফেরত দিতে বলে ক্লাসে ডেকে নিয়ে আসছেন। যথারীতি কবির ক্লাসে আসলো, কবিরকে বুঝিয়ে তিনি পরীক্ষা দিতে রাজী করালেন। টাকার ব্যবস্থা করলেন তিনি। আর খুব শক্ত করে বলে বিষয়টি যাতে কেউ না জানে।


প্রায় মাসখানেক অধ্যাপক সাহেব বাসায় যেতে পারেন নি, পুলিশের সমস্যা তো আছেই তাছাড়া এই মাসে ওনার কাজের চাপও ছিল বেশী। আগে কখনোই তিনি বাইরে খেতেন না। দুপুরের খাবারও বাসা থেকে নিয়ে যেতেন। অথচ সেই নুরুল ইসলাম সাহেব গত এক মাস বাসায় আসেন নি। মিসেস নুরুল ইসলাম এই নিয়ে খুব চিন্তায় থাকেন। ইচ্ছে করে অধ্যাপক সাহেবের খাবার রান্না করে পাঠিয়ে দিতে। কিন্তু নিরাপত্তা জনিত কারণে পারা যায় না।


মিসেস নুরুল ইসলাম খুব চাপাচাপি করে একদিন বিকেলে ডেকে নিয়ে আসলেন তাকে। বললেন কি খাও না খাও। একটা দিন ভালো-মন্দ খাও। জমানো অনেক কথা বলতে বলতে রাত হয়ে গিয়েছে অনেক বেশী। তাই অধ্যাপক সাহেব আজ বাসায় থেকে গেলেন। মধ্যরাতে দরজায় লাথির শব্দে ঘুম ভাঙ্গলো।


৩.

যেখানে বাঘের ভয়, সেখানে রাত হয়। কথাটাই ঠিক। যেদিন তিনি বাসায় সে দিনই পুলিশ আসলো। হাতে হাতকড়া পরিয়ে থানায় নিয়ে গেলো। তখন রাত দুটো। মিসেস নুরুল ইসলাম পুলিশের গাড়ির সাথে সাথে চললেন CNG তে চড়ে। থানায় ওসির আর শুধু পা ধরা বাকী। অনুনয় করতে থাকলেন ছেড়ে দেয়ার জন্য। অবশেষে পুলিশ বলে আপনার কাছে কত আছে? হাতে খুব বেশী টাকা ছিল না তাই সব স্বর্ণালংকার নিয়ে আসলেন। অন্তত সাত ভরি তো হবেই।


ওসি সাহেব বললেন ঠিক আছে আমাদের কিছু জিজ্ঞাসা আছে ওনার কাছে। জিজ্ঞাসা শেষ হলে ওনাকে ছেড়ে দেব। কাল সকাল সাতটায় দুই লাখ টাকা ক্যাশ নিয়ে আসবেন। স্বর্ণ গুলো রেখে যান। খুব খুশী হলেন মিসেস। এবার অন্তত কারাগারে যেতে হচ্ছে না।


ওসির রুম থেকে বের হয়ে কাস্টোডিতে অধায়পক সাহেব কে দেখতে এসে দেখলেন তিনি নোংরা মেঝেতে একটি পানির বোতলের উপর মাথা রেখে দিব্যি ঘুমাচ্ছেন। গায়ে অজস্র মশা মনের সুখে কামড়াচ্ছে। তিনি ডাক দিয়ে উঠালেন।

- আচ্ছা তোমার কখনোই কোন দুঃচিন্তা হয় না? এমন পরিবেশে কেউ ঘুমাতে পারে?

- (হেসে বললেন) শোন আমি আমার ভাগ্য রবের কাছে ছেড়ে দিয়েছি। তিনি থাকতে আমার চিন্তা কিসের?


এরপর মিসেস নুরুল ইসলাম ওসির সাথে হওয়া সব কথা বললেন তাকে। তিনি তার স্ত্রীকে বললেন কে বলেছে তোমাকে এসব করতে। পুলিশকে বিশ্বাস কুরতে নেই। তুমি সব অলংকার নিয়ে বাসায় যাও। আর তাছাড়া আমি একটু আগে খুব ভালো স্বপ্ন দেখেছি।


৪.

বাকী রাতের মধ্যেই মিসেস নুরুল ইসলাম প্রতিবেশীদের আত্মীয়দের মাধ্যমে টাকা যোগাড় করে ফেললেন। তাহাজ্জুদ নামাজ পড়ে অনেক কাঁদলেন আল্লাহর কাছে। সকালে নিজে নাস্তা তৈরী করলেন। যাতে থানা থেকে এসেই অধ্যাপক সাহেব কে নাস্তা দেয়া যায়। তারপর বের হওয়ার আগে TV টা একটু অন করলেন। স্ক্রলে বড় বড় করে লিখা “জামায়াত নেতা অধ্যাপক নুরুল ইসলাম পুলিশের সাথে বন্দুকযুদ্ধে নিহত”


মিসেস ইসলাম দৌড়ে গেলেন থানায়, সেখানে মরদেহ নেই। চলে গেছে হাসপাতালে। মর্গের সামনে কিছুক্ষন একদৃষ্টে তাকিয়ে ছিলেন। তারপর গগনবিদারী চিৎকার করে লাশের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে বললেন, আমি! আমি খুন করেছি তোমাকে। আমাকে তুমি ক্ষমা কর নি। সারা জীবনের শাস্তি তুমি দিয়ে গেলে। আমি তোমাকে বাসায় ডেকে এনেছি। বেঁহুশ হয়ে পড়লেন মিসেস।


জানাজা শেষে কবির ছুটে আসলো কফিনের কাছে। ঈমাম সাহেবের কাছ থেকে মাইক নিয়ে বললো, আমরা সবাই স্যার কে চিনি। তিনি যদি সন্ত্রাসী হন তবে পুরো দেশ সাক্ষী থাকো আমি কফিন ছুঁয়ে শপথ নিলাম আমিও স্যারের মত সন্ত্রাসী হলাম।


একে একে হাজার হাজার জনতা সবাই অশ্রুসিক্ত নয়নে শপথ নিল আমরাও স্যারের মত সন্ত্রাসী হয়ে গেলাম। হে পুলিশ, আমাদের গুলি কর। আমরা সবাই মরার জন্য প্রস্তুত।

১০ জানু, ২০১৫

দিন দিন বিপ্লবী হয়ে উঠছি


বাবার আদরে হয়েছি বড়ো।
মায়ের শাসন করে জড়ো।
বোনের মিষ্টি আদুরে হাসিতে
পেয়েছি প্রশ্রয় অতি বড়।
না ছিল ক্ষুদা, না ছিল জরা।
না ছিল অভাব, কেবলি সুখের পারা।
কবিতা গল্প উপন্যাস পড়ে কাটিয়েছি দিন।
বিপ্লবী হবো, ভাবিনি কোন দিন।
আমি দেখেছি আশীতিপর বৃদ্ধের কষ্ট
আমি দেখেছি মায়ের কান্না
আমি দেখেছি বোনের আহাজারি
দেখেছি কোর্টের প্রাঙ্গনে বিচারের প্রহসন
নিরাপরাধ শিক্ষককে বানানো হয়েছে
হাজারো নারীর ধর্ষনকারী।
কক্সবাজারে আমি নীল সমুদ্র দেখিনি।
দেখেছি লাল স্রোতধারা
নিজের ছোট দোকানখানা বাঁচাতে
ছুটিয়েছে রক্তের ফোয়ারা।
দেখেছি মায়ের সামনে ছেলেকে
রাষ্টীয় বাহিনীর মার খেয়ে যাওয়া
প্রিয়তমা স্ত্রী থেকে বিদায় না নিয়ে
পৃথিবী থেকে হারিয়ে যাওয়া।
আমি দেখেছি নিরপরাধ একজন মানুষ
যিনি ধীরে ধীরে হেঁটে চলছেন
তুলে নিতে গলায় ফাঁসির দড়ি।
বিবেকের চাপে সব আয়েশ ভুলে
ধীরে ধীরে হয়ে গেলাম এক বিপ্লবী
ভেঙ্গে দিতে সকল শৃঙ্খল, স্বৈরাচারী।

৭ জানু, ২০১৫

মানুষ না, মেশিন

 হে অস্ত্রধারী শিকারী 
তুমি কাকে শিকার করছো? 
কাকে নিশানা করে তুমি চালাচ্ছ গুলি?
তোমার এই উর্দি, এই অস্ত্র
এগুলো তো আমার টাকায় কেনা!!
তোমাকে অস্ত্র দেয়া হয়েছে
তুমি সীমান্ত পাহারা দেবে
বহিঃশত্রুদের মারবে।
অথচ, অথচ তুমি মারছো
তোমার বাবাকে, তোমার মা কে
তোমার ভাইকে তোমার বোন কে।
তোমাকে জিন্দানখানা দেয়া হয়েছে
কথা ছিল তুমি বন্দি করবে
সন্ত্রাসীদের, মাস্তানদের, মদখোরদের
আজ তুমি তাদের দিচ্ছ ছেড়ে
বন্দি করছো মানবতাবাদীদের
বেড়ি নামের লোহার শিকল
পরিয়ে দিচ্ছ সূর্যসন্তানদের পায়ে।
তুমি কাঁদানো গ্যাস ছুঁড়ছো,
পীপার স্প্রে করছো
জাতির বিবেকের চোখে
দেখো, দেখো কি লাল হয়েছে
তাদের সম্ভাবনাময় চোখ।
আমি স্পষ্টই দেখতে পাচ্ছি
সেই চোখে জাতির সর্বনাশ।
আমি জানি তুমি অসহায়
সামান্য কিছু পাবার আশায়
নাদান পেটকে শান্তিতে রাখার আশায়
তুমি করেছ বিবেক বিসর্জন।
আজ তোমার পা বাকশালের পা
তোমার হাত স্বৈরাচারের হাত
তোমার আঙ্গুল যা দিয়ে ট্রিগার টানো
সেটা ফ্যাসিবাদের আঙ্গুল।
তুমি মানুষ না, মেশিন।