১৫ জুন, ২০১৯

বঙ্গকথা পর্ব-০৫ : কুষাণ সাম্রাজ্য ও বৌদ্ধধর্মের বিকৃতির ইতিহাস

কুষাণ ও সাতবাহন সাম্রাজ্যের মানচিত্র
গত পর্বে সাতবাহন সাম্রাজ্য পর্যন্ত এসেছিলাম। সাতবাহনরা মূলত অন্ধ্রপ্রদেশ ভিত্তিক হিন্দুস্থানের দক্ষিণ অংশে শাসন করতো। তারা বাংলা অধিকার করলেও বাংলায় তাদের ভালো প্রভাব কখনোই স্থায়ী হয়নি। তবে তারা ভারতের দক্ষিণ অংশে বহু বছর শাসন করেছে। এই অংশে যাতায়াতের ভালো সুবিধে না থাকায় বিদেশী কোনো গোষ্ঠীই সাতবাহনদের পরাজিত করতে সক্ষম হয়নি বহু বছর। ঈশা আ. জন্মের ২৩০ বছর আগে থেকে শুরু হওয়া এই সাম্রাজ্য ইশা আ. জন্মের পরে আরো ২২০ বছর রাজত্ব করে। তাদের ইতিহাস প্রায় সাড়ে পাঁচশত বছরের ইতিহাস। আমরা যেহেতু বাংলার শাসকদের নিয়ে আলোচনা করবো তাই তাদের নিয়ে আর বিস্তারিত বলতে আগ্রহী নই। তবে ভারতের দক্ষিণ অঞ্চলের দ্রাবিড় গোষ্ঠীর কৃষ্টি কালচার ভুলিয়ে দিতে এই সাম্রাজ্য ভালো ভূমিকা রেখেছিলো।

সাতবাহনের পাশাপাশি বাংলার শাসক হিসেবে কুষাণ সাম্রাজ্যের কথাও শোনা যায়। মৌর্য সম্রাজ্যের পতনের পর যে সমস্ত বৈদেশিক জাতি ভারতে অনুপ্রবেশ করে ছিল, তাদের মধ্যে কুষাণরাই ছিল একমাত্র আলোচনাযোগ্য। চিনের উত্তর-পশ্চিম অংশে ইউ-চি নামে এক যাযাবর জাতি বাস করতো। হিউঙ-নু নামে অপর এক যাযবর জাতির তাড়া খেয়ে তারা সির দরিয়া নদী তীরবর্তী অঞ্চলে এসে সেখান থেকে শকদের বিতাড়িত করে বসবাস করতে শুরু করে । কিন্তু হিউঙ-নুরা এই অঞ্চল থেকেও তাদের উৎখাত করায় তারা আবার শকদের যারা ইতিপূর্বে তাদের তাড়া খেয়ে ব্যাকট্রিয়ায় বসতি স্থাপন করেছিল তাদের উৎখাত করে। পূর্বের সেই ব্যাকট্রিয়ার বর্তমান নাম বলখ। এটি বর্তমানে আফগানিস্তানের উত্তর দিকের একটি প্রদেশ।

ব্যাকট্রিয়ায় আসার পর ইউ-চিদের দলগত সংহতি বিনষ্ট হয় ও তারা পাঁচটি পৃথক শাখায় বিভক্ত হয়ে যায়। কুষাণরা ছিল এই পাঁচ গোষ্ঠীর অন্যতম । চৈনিক ঐতিহাসিক সুমা-কিয়েনের মত অনুযায়ী কুজল কদফিসেস নামে জনৈক ইউ-চি ঐ পাঁচটি গোষ্ঠীকে পুনরায় ঐক্যবদ্ধ করেন ও ভারতে প্রবেশ করে কাবুল ও কাশ্মীর দখল করেন । এই কুজুল কদফিসেস ছিলেন কুষাণ সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা । কুজুল কদফিসেস মারা গেলে তাঁর পুত্র বিম কদফিসেস রাজা হন ।

কণিষ্ক ছিলেন কুষাণ বংশের শ্রেষ্ঠ রাজা। তাঁর সঙ্গে কুজুল ও বিম কদফিসেসের কী সম্পর্ক ছিল, তা সঠিকভাবে জানা যায় না। অনেকে মনে করেন তাঁর সঙ্গে এই বংশের প্রথম দুটি রাজার সঙ্গে কোনো রক্তের সম্পর্ক ছিল না। কণিষ্কের আমলেই কুষাণ সাম্রাজ্য সর্বাপেক্ষা বেশি বিস্তার লাভ করে ও উত্তর ভারতের ইতিহাসে এক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে । কণিষ্কের সিংহাসন আরোহণের তারিখ সম্পর্কে ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতপার্থক্য আছে। তবে অধিকাংশ পণ্ডিতই মনে করেন ৭৮ খ্রিস্টাব্দে “শকাব্দ” নামে যে বর্ষগণনা শুরু হয়, কণিষ্ক ছিলেন তার প্রবর্তক। এই সূত্র অনুসারে কণিষ্ক ৭৮ খ্রিস্টাব্দেই সিংহাসনে আরোহণ করেন।

কণিষ্কের শাসনের সময়ই বাংলা কুষাণদের অধিকারে আসে। হিউয়েন সাঙের মতে কণিষ্কের বিশাল সাম্রাজ্যের রাজধানী ছিল পুরুষপুর বা বর্তমান পেশোয়ার এবং এর বিস্তৃতি ছিলো উত্তরে কাশ্মীর থেকে দক্ষিণে সাঁচী ও পশ্চিমে সিন্ধু উপত্যকা থেকে পূর্বে বারাণসী পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল।

বলা চলে সাতবাহন সাম্রাজ্য ও কুষাণ সাম্রাজ্যের মাঝামাঝি অবস্থান করেছে বাংলা অঞ্চল। ফলশ্রুতিতে কোনো সাম্রাজ্যেরই ভালো প্রভাব বিস্তার হয়নি এখানে। কেন্দ্রীয় শাসনের দূর্বলতার সুযোগে এখানে স্থানীয় জমিদার প্রথা চালু হয়েছে। কিছু অংশ প্রাচীন দ্রাবিড় গোষ্ঠী, কিছু বৌদ্ধরা ও কিছু অংশ ব্রাহ্মণ জমিদাররা শাসন করতো।

ভারতের ইতিহাসে কণিষ্কের স্থান ও গুরুত্ব অবশ্য কেবল মাত্র একজন কৃতি ও দক্ষ সেনানায়ক হিসাবে নয়। বৌদ্ধধর্মের পৃষ্ঠপোষক হিসাবে ও ভারতীয় সংস্কৃতিতে তাঁর অবদানের জন্যই কণিষ্ক চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন । তিনি নিজে বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করেন ও পুরুষপুরে একটি বহতল চৈত্য নির্মাণ করেন। অশোকের পর তার সময়েই বৌদ্ধধর্ম পুনরায় রাজানুগ্রহ লাভ করে। এর ঢেউ পড়ে বাংলাতেও। শুঙ্গ ও কাণ্ব শাসনের সময় পালিয়ে যাওয়া বৌদ্ধরা আবার বাংলায় ফিরে আসে এবং বগুড়ার মহাস্থানগড় তথা পুন্ড্রনগরে পুনরায় শক্তিশালী হয়ে ওঠে।

ভারতের বাইরে বৌদ্ধধর্ম প্রচারে কণিষ্ক সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। তাঁর প্রচেষ্টায় বৌদ্ধধর্ম খোটান, চিন, জাপান ও কোরিয়ায় ছড়িয়ে পড়ে। বৌদ্ধধর্মের ইতিহাসে কণিষ্ক ছিলেন দ্বিতীয় অশোক। এর প্রভাব বৌদ্ধধর্মের পৃষ্ঠপোষক হলেও কণিষ্ক অন্য ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ও সহনশীল ছিলেন বলে ইতিহাসে স্বীকৃত।

সাহিত্য ও সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষক হিসেবে কণিষ্ক উল্লেখযোগ্য কৃতিত্ব দাবি করতে পারেন। বুদ্ধচরিত রচয়িতা অশ্বঘোষ, বৌদ্ধ দার্শনিক নাগার্জুন, বৌদ্ধ সাহিত্যিক বসুমিত্র, স্বনামধন্য চিকিৎসক চরক, স্থপতি এজেসিলাস রাজনীতিবিদ মাথর প্রভৃতি মনীষীগণ তাঁর রাজত্ব কালেই আবির্ভুত হয়েছিলেন। তিনি অসংখ্য বৌদ্ধ বিহার, স্তুপ ও চৈত্য নির্মাণে উদ্যোগী হয়েছিলেন। তাঁরই সময়ে সারনাথ, মথুরা, গান্ধার ও অমরাবতীতে চারটি পৃথক শিল্পরীতির আবির্ভাব ঘটেছিল। তবে বৌদ্ধ ধর্মের বিকৃতিও ঘটে কুষাণদের সময়ে। একেশ্বরবাদে বিশ্বাসী কিছু কিছু বৌদ্ধ গোষ্ঠী বহু-ঈশ্বরবাদে বিশ্বাসী হয়ে পড়ে। কুষাণ আমলেই বুদ্ধের প্রতিমা তৈরির রীতি শুরু হয়।

কুষাণ আমলে মানবপুত্র বুদ্ধকে বসানো হয় ভগবানের আসনে। বুদ্ধের মূল দর্শনে আনা হয় দেবতা এবং মিথের সমষ্টি। বুদ্ধের দর্শন বিকৃতিতে যোগ হল স্বর্গ নরক, জাতক, বুদ্ধের জন্ম মৃত্যুর নানা কাহিনী নিয়ে হাজারো মিথ। তৎকালীন মানুষ ধ্যান সাধনা পরিত্যাগ করে জাঁকজমকভাবে বুদ্ধের পূজায় লিপ্ত হলেন। শুরু হল মহাজন এবং তন্ত্রজান বুদ্ধ ধর্মের ধারনি, মঞ্জুশ্রী মূল কল্প, গুহ্য সমাজ, চক্র সংবর, তৎকালীন ব্রতশ্চারন, বলি পূজা, পুরশ্চরন ইত্যাদি তপ-জপ ও তন্ত্র-মন্ত্রের প্রভাবে বৌদ্ধ ধর্ম আজকের রূপে এসে পৌছাল। যাতে হারিয়েছে গেছে বৌদ্ধ দর্শনের প্রকৃত সত্তা। সেখান থেকে উদ্ভব হয় স্তবিরবাদ এবং মহাসঙ্ঘবাদ। যে কারনে রচিত হয় বুদ্ধের নামে নানা সূত্র এবং পার্থক্য দেখা যায় সূত্র-পিটক এবং বিনয়-পিটকের মাঝে।

ধারণা করা হয় এই বিকৃতির কারণ বৌদ্ধদের কিছু পণ্ডিত ব্যক্তি যারা আর্য দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন এবং ব্রাহ্মণদের সেরা মানুষ বা অভিজাত শ্রেণীর মানুষ মনে করতেন। আর এসব পণ্ডিতরা কুষাণ সাম্রাজ্যের রাজাদের আনুকূল্য পেয়েছিলেন।

1 টি মন্তব্য: