২০ জুন, ২০১৯

বঙ্গকথা পর্ব-০৬ : শোষণের যে যুগকে স্বর্ণযুগ বলা হয়

গুপ্ত সাম্রাজ্যের অধিকৃত এলাকা
উত্তর ভারতে কুষাণরা ও দাক্ষিণাত্যে সাতবাহন রাজারা কিছুটা রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি স্থাপনে সক্ষম হয়েছিল। কিন্তু খ্রিস্টীয় তৃতীয় শতকের মধ্যভাগে উভয় সাম্রাজ্যের পতন হয়। এর জন্য উল্লেখযোগ্য কারণ হলো শাসকদের ব্যর্থতা ও বৈদেশিক আক্রমণ। এরপর এই অঞ্চলে গুপ্ত শাসন প্রতিষ্ঠা হয়। গুপ্ত সাম্রাজ্যকে এদেশের বাহ্মণ্যবাদীরা ও বর্তমান প্রতিষ্ঠিত ইতিহাসে গুপ্ত যুগকে স্বর্ণযুগ বলা হয়। কিন্তু আসলে সেটা ছিলো একটি শোষণের যুগ।

৩২০ খ্রিস্টাব্দে রাজা ১ম চন্দ্রগুপ্তের অভ্যুত্থানের ফলে এই রাজনৈতিক শুন্যতার অবসান হয় । কুষাণ ও সাতবাহন উভয় সাম্রাজ্যের বেশ কিছু অংশ গুপ্ত সাম্রাজ্যের অন্তর্ভূক্ত হলেও অয়তনের দিক থেকে গুপ্ত সাম্রাজ্য মৌর্য সাম্রাজের তুলনায় ছোটো ছিল । গুপ্ত সাম্রাজ্য প্রধানত বিহার ও উত্তর প্রদেশেই সীমাবদ্ধ ছিল । বিহার অপেক্ষা উত্তর প্রদেশই ছিল এই সভ্যতার প্রাণকেন্দ্র। গুপ্ত সাম্রাজ্যের মুদ্রা ও শিলালিপি প্রধানত এখান থেকেই পাওয়া গেছে। গুপ্ত রাজারা সম্ভবত আর্য তথা ব্রাহ্মন্যবাদী ছিলো। এরা কুষাণ রাজাদের সামন্ত হিসাবে উত্তর প্রদেশে শাসন করতেন। গুপ্ত সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন শ্রীগুপ্ত । তিনি ২৭৫ খ্রিস্টাব্দে সিংহাসনে আরোহণ করেন। গুপ্ত সাম্রাজ্য ২৭৫ সালে প্রতিষ্ঠিত হলেও মূলত ৩২০ খ্রিস্টাব্দেই এটি এই অঞ্চলে সাম্রাজ্য হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে এবং কুষাণদের অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যায়।

প্রথম চন্দ্রগুপ্ত গুপ্ত সাম্রাজ্যের প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন প্রথম চন্দ্রগুপ্ত । তিনি লিচ্ছবি রাজকন্যা কুমারদেবীকে বিবাহ করে গাঙ্গেও উপত্যকায় নিজ প্রাধান্য স্থাপন করেন । তাঁর রাজ্য উত্তর প্রদেশের পূর্বাংশ, বিহার, এমনকি বাংলা পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল । মৃত্যুর পূর্বে তিনি পুত্র সমুদ্রগুপ্তকে নিজ উত্তরাধিকারী বলে ঘোষণা করে যান ।

গুপ্ত রাজাদের মধ্যে সমুদ্রগুপ্ত ছিলেন শ্রেষ্ঠ ও শক্তিশালী। তিনি ৩৮০ সাল পর্যন্ত শাসন করেন। শৌর্য-বীর্য, চারিত্রিক দৃঢ়তা ও সংস্কৃতির প্রতি পৃষ্ঠপোষকতার জন্য তিনি ভারত ইতিহাসে একটি অত্যন্ত মর্যাদাপূর্ণ স্থান অধিকার করে আছেন। তিনি ৩৩৫ সালে পিতৃ সিংহাসন লাভ করেন। তার আমলে নোয়াখালী ও কুমিল্লা (সমতট) অঞ্চল ছাড়া পুরো বাংলা গুপ্ত শাসনের অধীনে চলে আসে। কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র এই রাজার প্রশংসা করেছে তাকে বলেছেন–বিজিগীষু, অর্থাৎ যে আশপাশের রাজ্যগুলোর সঙ্গে যুদ্ধ করে সেগুলো নিজের দখলে আনতে পারে। সমুদ্রগুপ্ত ছিলেন এমনই এক বিজিগীষু রাজা যিনি অনেক রাজার ও অনেক জাতের মানুষের সঙ্গে অনেক দিন ধরে যুদ্ধ করেন ও জয়লাভ করেন। সেই কাহিনি এলাহাবাদের একটি প্রকাণ্ড পাথরের থামে তিনি খোদাই করিয়ে রাখেন। সেটি আজও আছে।

সমুদ্রগুপ্তের পুত্ৰ দ্বিতীয় চন্দ্ৰগুপ্ত (৩৮০-৪১২ খ্রিস্টাব্দ) গুপ্তবংশের বিখ্যাত রাজা। ইনি সরাসরি যুদ্ধ না করে বরং বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন করে নিজের রাজপ্রতাপ প্রতিষ্ঠিত করেন। নিজের মেয়ে প্রভাবতীর বিয়ে দেন মধ্যভারতের ব্রাহ্মণ বাকাটক রাজপুত্রের সঙ্গে, এতে জগতে ওঠাও হল আবার বাক্যটকদের মধ্যে নিজের প্রভাব বিস্তার করাও হল। বাকাটক রাজপুত্রের মৃত্যুর পরে প্রভাবতীই বাকাটক মহিষী হয়ে রাজত্ব করেন।

গুপ্ত আমলে কেন্দ্রীয় শাসন সারা রাজ্যে সমান ছিল না। রাজধানী থেকে যে অঞ্চল যত দূরে, শাসনব্যবস্থা সেখানে ততই শিথিল। রাজস্ব আদায় গুপ্তরা খুবই অত্যাচারী ছিলো। ফসলের এক চতুর্থাংশ রাজস্ব বলে আদায় করা হতো। সৈন্যদল খুব শক্তিশালী ছিল, রাজকোষ থেকে প্রতিরক্ষা খাতে বিস্তর খরচ হত। যুদ্ধে রথ ক্রমে অপ্রচলিত হয়ে পড়ছিল, তার বদলে অশ্বারোহী সৈন্যই প্রাধান্য পাচ্ছিল। ঘোড়সওয়ার তীরন্দাজরাই এ সময়ে সৈন্যদলে যোদ্ধা ছিল। রাজার সৈন্যদল রাজ্যের যে অঞ্চল দিয়ে যাত্রা করত, সেই সব স্থানীয় লোকজনদের সৈন্যদল এবং ঘোড়াদের খাবারের ব্যবস্থা করতে হত। সেনাপতি এবং উচ্চপদস্থ কর্মচারীদের খাওয়াদাওয়া, বিশ্রাম ও বিলাসের সব ব্যবস্থাই করতে হত সাধারণ গ্রামবাসীদের। রাজার সৈন্যদল ও কর্মচারীদের পরিচর্যা করতে হত জনগণের। চাষিদের আর্যদের ক্ষেতখামারে কাজ করতে হতো বাধ্যতামূলকভাবে এবং বিনা পারিশ্রমিক বা যৎসামান্য বেতনে।

গুপ্ত আমল ছিলো দ্রাবিড় নির্মূলের স্বর্ণযুগ। গুপ্ত আমলের পরে দ্রাবিড়রা তাদের জাতিসত্তা হারিয়ে ফেলে। জাতিসত্তার বিকাশধারা বইয়ে মোহাম্মদ আব্দুল মান্নান বলেন, বাংলায় দ্রাবিড়দের প্রতিরোধের ফলে দীর্ঘ দিন আর্য-প্রভাব ঠেকিয়ে রাখা সম্ভব হয়। এরপর খ্রিস্টীয় চার ও পাঁচ শতকে গুপ্ত শাসনে আর্য ধর্ম, আর্য ভাষা ও আর্য সংস্কৃতি বাংলাদেশে প্রত্যক্ষভাবে শিকড় গাড়ে। তৃতীয় ও চতুর্থ শতক পর্যন্ত বাংলাদেশে আর্য বৈদিক হিন্দু ধর্মের কিছুই প্রসার হয়নি। ষষ্ঠ শতকের আগে বঙ্গ বা বাংলার পূর্ব-দক্ষিণাঞ্চলে ব্রাহ্মণ্য ধর্ম ঢুকতেই পারেনি। উত্তর-পূর্ববাংলায় ষষ্ঠ শতকের গোড়াতেই ব্রাহ্মণ্য সমাজ গড়ে ওঠে। পঞ্চম ও অষ্টম শতকের মধ্যে ব্যক্তি ও জায়াগার সংস্কৃতি নাম পাওয়া যায়।

এই প্রসঙ্গে ড. নীহাররঞ্জন রায় অনুমান করেন যে, গুপ্ত আমলে বাংলার আর্যকরণ দ্রুত এগিয়ে চলছিল। বাঙালি সমাজ উত্তর ভারতীয় আর্য-ব্রাহ্মণ্য বর্ণ-ব্যবস্থার অন্তর্ভূক্ত হচ্ছিল। অযোধ্যাবাসী ভিণ প্রদেশী বাহ্মণ, শর্মা বা স্বামী, বন্দ্য, চট্ট, ভট্ট, গাঙি নামে ব্রাহ্মণেরা জেঁকে বসেছিল। তিনি বলেন,

“বাংলাদেশের নানা জায়গায় ব্রাহ্মণেরা এসে স্থায়ী বাসিন্দা হতে লাগলেন, এরা কেই ঋগ্বেদীয়, কেই বাজসনেয়ী, কেউ শাখাব্যয়ী, যাজুর্বেদীয়, কেই বা সামবেদীয়, কারও গোত্র কান্ব বা ভার্গব, বা কাশ্বপ, কারও ভরদ্বাজ বা অগস্ত্য বা বাৎসা বা কৌন্ডিন্য। এমনি করে ষষ্ঠ শতকে আর্যদের বৈদিক ধর্ম ও সংস্কৃতির ঢেউ বাংলার পূর্বতম প্রান্তে গিয়ে পৌঁছল”। (ডক্টর নীহাররঞ্জন রায় : বাঙালির ইতিহাস, আদি পর্ব, পৃষ্ঠা ১৩২)

ঐতিহাসিক সুকুমারী ভট্টাচার্যের 'প্রাচীন বাংলা' বইয়ে সেসময়ের সমাজচিত্র, নারী ও ধর্মীয় বিদ্বেষ নিয়ে যে চিত্র ফুটে উঠেছে তা উল্লেখ করা হলো, এই সময়ে বহিরাগত আগস্তুক গোষ্ঠী বিজয়ী হলে যেমন সমাজে ‘ক্ষত্রিয়’ পরিচয় পাচ্ছিল, তেমনি প্ৰাস্তিক দ্রাবিড় আদিবাসীরা ব্ৰাহ্মাণ্য সমাজে নিম্নবর্ণের মানুষ হিসাবে ঠাঁই পেয়েছিল। জাতি-উপজাতির সংখ্যা বেড়েই চলেছে। এদের মধ্যে নতুন নতুন গোষ্ঠীকে আঙ্গুত বা অস্পৃশ্য নাম দেওয়া হচ্ছে। সাধারণ ভাবে এদের চণ্ডাল বলা হয়। পঞ্চম শতকে ফাক শিয়েন এ দেশের সমাজে বিপুল সংখ্যক চণ্ডাল দেখেছিলেন। এরা মাছ মাংস বিক্রি করত, অন্যান্য নিচু কাজ করত এবং সমাজে এদের ঠাঁই ছিল না; তাই এদের গ্রামের বাইরে থাকতে হত। শহরে এলে উচ্চবর্ণের মানুষ এদের ছোঁয়া বঁচিয়ে রাস্তায় হাঁটত, যাতে এদের অশুচিতা কোনওভাবেই তাদের স্পর্শ না করে।

সমাজে রাজা ও রাজন্যদের প্রসাদে ব্ৰাহ্মণদের আধিপত্য প্রবল ছিল, দানে পাওয়া নিষ্কর জমিতে নিচু বর্ণের প্রজাদের কাছে খাজনা আদায় করে তাদের দণ্ডমুণ্ডের কর্তা হয়ে ব্রাহ্মণরা নিজেদের প্রতিপত্তি ঘোষণা করত। দেশে এবং বিদেশে বাণিজ্যের দরুণ বৈশ্যদের হাতে বিস্তর টাকা জমত। ফলে সমাজে তাদের প্রতিপত্তিও যথেষ্ট ছিল। এ সময়ে নারী ও শূদ্রদের বেদে কোনও অধিকার ছিল না। গুপ্ত যুগে সমাজ ক্রমশই রক্ষণশীল হয়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে নারী ও শূদ্রের স্বাধীনতা ক্রমে সংকুচিত হয়ে এল।

কৃষ্ণ-কেন্দ্ৰিক উপাসনার চল হওয়াতে আগে শূদ্র সম্প্রদায় বৈষ্ণব ধর্মে ধর্মাচরণে একটা অধিকার পেল, কিন্তু তাও অধিকাংশ ক্ষেত্রে ব্রাহ্মণদের নিয়ন্ত্রণে শাস্ত্রকার পুরোহিতের নির্দেশ অনুসারে তাদের অধিকার নির্ধারিত হত। সংখ্যায় অর্ধেক হলেও নারীর অধিকার, সমস্ত শাস্ত্রে ক্রমশই খর্ব করার চেষ্টা হয়েছে। নানা কাহিনি ও তত্ত্বকথা শোনানো হল সাধারণ মানুষকে, যাতে দেখানো হয়েছে নারী স্বভাবত পাপিষ্ঠ, পুরুষের অধঃপতনের হেতু, তার প্রকৃতিইহীন, তার একমাত্র কর্তব্য স্বামী ও শ্বশুরবাড়ির দাস্য। এই সময়ে রচিত নাটক অভিজ্ঞানশকুন্তলম-এ পড়ি, দুষ্যন্ত শকুন্তলাকে অকারণে পরিত্যাগ করবার পর কণ্বের শিষ্য শার্ঙ্গরব রাজাকে বলছে: ‘এ তোমার স্ত্রী, একে ত্যাগ কর বা গ্রহণ কর (যা তোমার ইচ্ছা), কারণ স্ত্রীর ওপরে স্বামীর সর্বতোমুখী প্ৰভুত্ব আছে।’

একেবারে ওপরতলার মেয়েরা অলংকার, সম্পত্তি ও জমির মালিকানা পেত; শ্বশুরবাড়ির লোকেরা সজন হলে স্ত্রীধান, যৌতুক ও অন্যান্য সম্পত্তিতেও নারীরা অধিকারও পেত। কিন্তু শাস্ত্র বলেছে, দেহ বা ধনের ওপরে নারীর কোনও অধিকার থাকবে না। ফলে নারীর নিগ্রহ শাস্ত্রসম্মত, পুরোপুরি মানুষের মর্যাদা না পাওয়াই গুপ্ত সমাজে নারীর অবস্থানের যথার্থ চিত্র।

গুপ্ত যুগের শাস্ত্রে ও সাহিত্যে আবার নতুন করে ব্ৰাহ্মণ্য ধর্মের পুনরুজ্জীবনের এক সক্রিয় চেষ্টা চোখে পড়ে। যাগযজ্ঞ নতুন করে বিস্তর জাঁকজমকের সঙ্গে অনুষ্ঠিত হত। বৌদ্ধ, জৈন ও আজীবিক প্রভাবে বৈদিক ধর্ম যেটুকু প্রতিহত হয়েছিল সেই সব ক্ষতিপূরণ করে যজ্ঞ নতুন করে সমাজে এল। এর একটা কারণ হল রাজা ও ধনীদের হাতে বিস্তর সম্পত্তি জন্মেছিল যাতে তাদের এ সব খরচ বহন করবার সামর্থ হয়েছিল। এরই সঙ্গে বৈদিক যুগেরও আগেকার সমাজে যে সব আঞ্চলিক পূজা প্রচলিত ছিল সেগুলো এখন মাথা তুলল। এর সঙ্গে যুক্ত হল নানা আঞ্চলিক দেবতার উপাসনার পদ্ধতি, তৈরি হতে লাগল বিভিন্ন পুরাণ। বিভিন্ন দেবতাকে কেন্দ্র করে নতুন নতুন দেবতার অভ্যুত্থান ঘটল, পূজার বিস্তার হল বৃহৎ গুপ্ত সাম্রাজ্যের পরিসরে।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন