২২ জুন, ২০১৯

বঙ্গকথা পর্ব-০৭ : বঙ্গাব্দের শশাঙ্ক, মাৎস্যন্যায় এবং পাল রাজাদের উত্থান

শশাঙ্ক আমলের মুদ্রা

যখন আরবে আল্লাহর রাসূল সা. দাওয়াতি কাজ করছেন তখন আমাদের বাংলায় শাসক ছিলেন শশাঙ্ক। আমাদের আজকের বঙ্গকথা শুরু হবে শশাঙ্ককে দিয়ে। গত পর্বে আমরা গুপ্ত সাম্রাজ্য নিয়ে আলোচনা করেছিলাম। গুপ্ত সাম্রাজ্যের শেষ দিকে এই সাম্রাজ্যের শক্তি দিন দিন ক্ষয় হতে থাকে। একের পর এক এলাকা তাদের হাতছাড়া হতে থাকে। গুপ্ত রাজাদের একজন সামন্ত রাজা ছিলেন শশাঙ্ক। ততদিনে এই অঞ্চলে দ্রাবিড়দের ভাষা থেকে নানারূপ পরিবর্তিত হয়ে বাংলা ভাষা সৃষ্টি হয়। শশাঙ্ক বাংলা ভাষার একজন রাজা। ধারণা করা হয় তিনিই প্রথম বাঙালি শাসক।

গুপ্ত সাম্রাজ্যের দূর্বলতার প্রেক্ষিতে তিনি বাংলার বিভিন্ন ক্ষুদ্র রাজ্যকে একত্র করে গৌড় নামের জনপদ গড়ে তোলেন। তিনি ৫৯০ হতে ৬২৫ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে রাজত্ব করেন। তাঁর রাজধানীর নাম ছিল কর্ণসুবর্ণ বা কানসোনা। কর্ণসুবর্ণ নগরী মানে বর্তমান পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ জেলায় রাজবাড়িডাঙ্গার সন্নিকটে চিরুটি রেল স্টেশনের কাছে। এটা বহরমপুর থেকে প্রায় ১০ কিলোমিটার দূরে। এটাই ছিলো গৌড় রাজার রাজধানী। গৌড় অঞ্চল বলতে যা বুঝানো হয় তা হলো ভারতের বিহার, উড়িষ্যা, মুর্শিদাবাদ ও বাংলাদেশের চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে বগুড়া পর্যন্ত।

শশাঙ্ক সিংহাসনে আরোহন করে বঙ্গাব্দ চালু করেন। কিন্তু গৌড়ের রাজার শক্তিশালী শাসনের অভাবে এই ক্যালেন্ডার হারিয়ে যায়। বর্তমানে যে বঙ্গাব্দ বা বাংলা সন আমরা ব্যবহার করি তা তৈরি হয়েছে মুঘল সম্রাট আকবরের শাসনামলে। ইরানি গবেষক আমীর ফতুল্লাহ শিরাজী চান্দ্র হিজরি সনকে বাংলা সনে রূপান্তরিত করেন। এখানে উল্লেখযোগ্য যে বিশাল হিন্দুস্থানের জন্য তৈরিকৃত ক্যালেন্ডারের নাম বঙ্গাব্দ কেন হলো। ঐতিহাসিকরা যা বলতে চান তা হলো আমীর ফতুল্লাহ শিরাজী আগের প্রচলিত বঙ্গাব্দকে ঘষে মেজে ঠিক করেছেন ভারতবর্ষের জন্য। রাজা শশাঙ্কের তৈরি ক্যালেন্ডারকে আকবরের আগেও ব্যবহার করেছেন বাংলা বিখ্যাত সুলতান আলাউদ্দিন হুসেন শাহ। তিনিও কিছু সংস্কার করেছেন সেই ক্যালেন্ডারকে।

আমীর ফতুল্লাহ শিরাজী সবচেয়ে বেশি অবদান রাখেন এই ক্যালেন্ডারকে সঠিক অবস্থানে আনতে। তার ক্যালেন্ডার প্রায় নির্ভুল ছিলো। আকবরের নির্দেশে এই ক্যালেন্ডার তৈরির মূল কারণ ছিলো ফসলের হিসাবগুলো ঠিক করার জন্য। এটা চাষিদের জন্য প্রয়োজনীয় বিষয় ছিলো। আমীর ফতুল্লাহ শিরাজী কোন ফসল কবে রোপণ করতে হবে কবে উত্তোলন করতে হবে সবই ঠিক করে দেন। এর ফলে শাসক ও প্রজা উভয়েরই উপকার হয়। শাসকরা এমন সময়ে খাজনা আদায় করতে যেতেন যখন চাষিরা খাজনা দিতে সক্ষম। আমরা বাংলাদেশে এখন যে ক্যালেন্ডার ব্যবহার করি তা আরেকদফা সংশোধিত হয় ১৯৬৬ সালে পাকিস্তান আমলে ড. মুহাম্মদ শহিদুল্লাহর নেতৃত্বে। শিরাজীর ক্যালেন্ডার এখনো হুবুহু ব্যবহার করেন ভারতের বাঙালিরা।

আমরা বঙ্গাব্দ থেকে আবার শশাঙ্কের কাছে ফিরে যাই। শশাঙ্ক থানেসোরের রাজা হর্ষবর্ধনের কাছে পরাজিত হন ও মৃত্যবরণ করেন। থানেসোর মানে হলো উত্তর ভারতের হরিয়ানা রাজ্যের কুরুক্ষেত্র জেলার একটি শহর। হর্ষবর্ধন বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বি ছিলেন বলে জানা যায়। তিনি নালন্দায় বৌদ্ধ বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করেন। যা নালন্দা মহাবিহার নামে পরিচিত। বানভট্ট এবং হিউয়েন সাঙ থেকে জানা যায় হর্ষবর্ধন এই অঞ্চলের ব্রাহ্মনদের উপর অত্যাচার চালিয়েছেন।

হর্ষবর্ধনের পর পাল আমল পর্যন্ত আর কোনো শক্তিশালী শাসক পায়নি বাংলা। ফলে এই অঞ্চলে একতি অরাজক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। এই অবস্থাকে মাৎস্যন্যায়। মাৎস্যন্যায় মানে মাছের ন্যায়। মাছ যেভাবে একটি আরেকটিকে গিলে ফেলে এভাবে এই অঞ্চলে একে অপরকে ঘায়েল করার নেশা চেপে বসেছে। বাংলাপিডিয়ায় এই অরাজক পরিস্থিতি নিয়ে যা জানা যায় তা হলো, ৬৪৭ সালে হর্ষবর্ধনের মৃত্যুর পর নৈরাজ্য ও সংশয় দেখা দিলে, মন্ত্রীরা বলপূর্বক রাজ্য দখল করে নেয়। আনুমানিক ৬৫০ খ্রিস্টাব্দ থেকে ৭৫০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত এক শতক কালেরও বেশি সময় ধরে গৌড়ের ইতিহাস অস্পষ্ট ছিলো। তিব্বতের রাজা শ্রং-ছান-গেমপো বাংলায় পরপর কয়েকটি অভিযান পরিচালনা করেন। সাত শতকের দ্বিতীয়ার্ধে বাংলায় দুটি নতুন রাজবংশ আত্মপ্রকাশ করে:গৌড় ও মগধে (পশ্চিম বাংলা ও দক্ষিণ বিহার) পরবর্তী গুপ্তগণ এবং বঙ্গ ও সমতট (দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব বাংলা) খড়গ রাজবংশ। কিন্তু এ রাজবংশের কোনোটিই বাংলায় ঐক্যবদ্ধ ও শক্তিশালী শাসন প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়নি।

অষ্টম শতকের শুরুর দিকে বার বার বৈদেশিক আক্রমণে বাংলা বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। এর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ছিল কনৌজ রাজ যশোবর্মণের (৭২৫-৭৫২ খ্রি.) আক্রমণ। কাশ্মীরের ললিতাদিত্য যশোবর্মণের গৌরবকে ম্লান করে দেন। গৌড়ের পাঁচ জন রাজা ললিতাদিত্য কর্তৃক পরাজিত হয়েছিলেন বলে কাশ্মীরের ঐতিহাসিক কলহন উল্লেখ করেন। এ থেকে গৌড়ের রাজনৈতিক বিচ্ছিন্নতা সম্পর্কে সুস্পষ্ট ইঙ্গিত পাওয়া যায়। কেন্দ্রীয় শক্তির অভাবে স্থানীয় প্রধানগণ স্বাধীন হয়ে ওঠেন এবং নিজেদের মধ্যে প্রাধান্য প্রতিষ্ঠার লড়াই-এ লিপ্ত হন। বার বার বৈদেশিক আক্রমণ রাজনৈতিক ভারসাম্য বিনষ্ট করে এবং তাতে বিচ্ছিন্নতার প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত হয়। তাই শশাঙ্কের মৃত্যুর পরবর্তী একশ বছর বাংলায় কোনো স্থায়ী সরকার ব্যবস্থা গড়ে উঠতে পারেনি বলা চলে। তিব্বতি সন্ন্যাসী তারনাথ ১৬০৮ খ্রিস্টাব্দে ’ভারতে বৌদ্ধ ধর্মের ইতিহাস’ নামক একটি গ্রন্থ রচনা করেন। তিনি এ মত সমর্থন করে লিখেন: ‘প্রত্যেক ক্ষত্রিয়, সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি, ব্রাহ্মণ ও বণিক স্ব স্ব গৃহে অথবা প্রভাবাধীন এলাকায় ছিলেন এক এক জন রাজা, কিন্তু সমগ্র দেশে কোনো রাজা ছিলেন না’।

সংস্কৃত শব্দ মাৎস্যন্যায়ম বিশেষ অর্থবহ। যখন দন্ডদানের আইন স্থগিত বা অকার্যকর থাকে তখন এমন অরাজক অবস্থার সৃষ্টি হয় যা মাছের রাজ্য সম্পর্কে প্রচলিত প্রবচনের মধ্যে পরিস্ফুট। অর্থাৎ অপেক্ষাকৃত বড় মাছ ছোটটিকে গ্রাস করে, কারণ আইন প্রয়োগকারী সংস্থার অবর্তমানে সবল দুর্বলকে গ্রাস করবেই। সমসাময়িক পাল লিপিতে এ অর্থবহ শব্দটির প্রয়োগ করে বাংলার তৎকালীন রাজনৈতিক অবস্থা বর্ণনা করা হয়েছে। আইন-শৃঙ্খলা বজায় রাখার মতো শক্তিশালী শাসন ক্ষমতার অভাবে সম্পূর্ণ অরাজক অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল।

গোপাল ছিলেন পাল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা। তার উত্থানের মাধ্যমেই অরাজক পরিস্থিতির অবসান হয়। তিনি ৭৫০ থেকে ৭৭০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত রাজত্ব করেন। পাল রাজাদের নামের শেষে "পাল" শব্দাংশটির অর্থ "রক্ষাকর্তা"। তাদের সঠিক জাতি-পরিচয় জানা যায় নি। গোপাল কিভাবে ক্ষমতায় আসেন তা নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতভেদ আছে। কেউ কেউ যুক্তি দেখান যে, জনগণই গোপালকে রাজা নির্বাচিত করেন। তিনি কিছু সংখ্যক প্রভাবশালী ব্যক্তি বা নেতার সমর্থন লাভ করেই রাজা হন ও মাৎস্যন্যায়ের অবসান ঘটিয়ে জনসমর্থন লাভ করেন। পাল লিপিতে দাবি করা হয়েছে যে, গোপাল ‘বেপরোয়া ও স্বেচ্ছাচারী লোকদের পরাভূত করে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠা করেন’।

অন্য কথায় বলা যায়, যারা বাংলায় মাৎস্যন্যায় অবস্থার সৃষ্টি করেছিল তাদের তিনি সমূলে উৎপাটন করেন। মাৎস্যন্যায় সময়ে আসলে কী ধরণের সামাজিক অবস্থা বিরাজ করেছিলো তার প্রত্যক্ষ কোনো সাক্ষ্য ইতিহাসে পাওয়া যায় না। আমরা একথা বলতে পারি গোপালের উত্থানের মাধ্যমে এই অঞ্চল শাসক পেয়েছিলো। প্রতিষ্ঠিত হয়েছে প্রায় সাড়ে চারশত বছরের পাল সাম্রাজ্য। পাল সাম্রাজ্যের রাজারা যখন বাংলা শাসন করে তখন পৃথিবীতে সবচেয়ে ক্ষমতাবান গোষ্ঠী ছিলো মুসলিমরা। আগামী পর্বে পাল সাম্রাজ্য নিয়ে আলোচনা হবে ইনশাআল্লাহ।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন