১২ মার্চ, ২০২০

বঙ্গকথা পর্ব-৩১ : সৈয়দ আহমদ এবং তাঁর আলিগড় আন্দোলন



আলিগড় আন্দোলনের প্রবর্তক ছিলেন স্যার সৈয়দ আহমেদ খান। পিছিয়ে পড়া মুসলমান সম্প্রদায়কে যুক্তিবাদী আধুনিক পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত করে তোলার জন্য স্যার সৈয়দ আহমেদ খান উত্তরপ্রদেশের আলিগড়ে যে আন্দোলনের সূচনা করেন তা আলিগড় আন্দোলন নামে খ্যাত। ইতোপূর্বে ওয়াহাবি ও ফরায়েজি আন্দোলন হলেও তা সাধারণ মুসলিম সমাজকে স্পর্শ করেনি। ১৮৫৭ সালের বিদ্রোহের পর অনগ্রসর মুসলিম সমাজে কিছু কিছু সংস্কারের প্রয়োজন অনুভূত হয় । হিন্দুদের তুলনায় অনগ্রসর পাশ্চাত্য শিক্ষায় উদাসীন মুসলিম সমাজের দুরবস্থার কথা সৈয়দ আহমেদ খান অবগত ছিলেন। তিনি ইংরেজি ভাষার মাধমে পাশ্চাত্য শিক্ষাকে প্রগতির যথার্থ সোপান বলে মনে করতেন, তাই তিনি মুসলমানদের মধ্যে পাশ্চাত্য শিক্ষা ও পাশ্চাত্য সংস্কৃতির প্রসারে উদ্যোগী হন ।

সৈয়দ আহমদ খান ব্রিটিশ সরকারের অধীনে উচ্চপদের চাকুরীতে নিয়োজিত ছিলেন। তিনি মনে করতেন, মুঘল সাম্রাজ্যের ধ্বংসস্তূপের উপরে ভারতে এক সুশৃংখল ব্রিটিশ শাসন সুপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে। আধুনিক জ্ঞান বিজ্ঞান ও আধুনিক যুদ্ধবিদ্যায়ও ইউরোপিয়ানরা মুসলমানদের চেয়ে বহুগুণে উন্নত। তাই এদেশ থেকে সহসা তাদেরকে উৎখাত করা সহজসাধ্য ব্যাপার নয়। বিদ্রোহ না করে রাজনৈতিকভাবে তাদের মোকাবেলা করাকেই তিনি উত্তম মনে করতেন। ইংরেজদের সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হওয়া মুসলমানদের আত্মহত্যারই শামিল হবে বলে তিনি মনে করতেন। ১৮৫৭ সালের বিদ্রোহের সকল দোষ শুধুমাত্র মুসলমানদের ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে তাদের উপর পাইকারী হারে যে অমানুষিক নিষ্পেষণ চালানো হচ্ছিল, তাতে তিনি অত্যন্ত মর্মাহত হন। তিনি তাঁর প্রসিদ্ধ পুস্তিকা ‘আসবাব-ই-বাগাওয়াতে হিন্দু’ ও ‘ভারতীয় মুসলমান’ নামক পুস্তিকার মাধ্যমে মুসলমানদের বিরুদ্ধে ব্রিটিশের কঠোর মনোভাব দূর করার চেষ্টা করেন। জ্ঞান বিজ্ঞানে মুসলমানদের পশ্চাদপদতাকেই তিনি তাদের পরাজয়ের মূল কারণ বলে উল্লেখ করেন। তাঁর বাণী ছিল –‘আগে মূলকে রোগমুক্ত কর। তাহলেই বৃক্ষ বর্ধনশীল হবে’। ১৮৬৫ সালে তিনি আলীপুরের গাজীপুরে একটি অনুবাদ সমিতি প্রতিষ্ঠিত করেন। এ সমিতির মাধ্যমে বহু বিদেশী গ্রন্থ অনূদিত হয়ে প্রকাশিত হয়।

তিনি মুসলমানদের মন থেকে পাশ্চাত্যের ভয় ভীতি দূর করার জন্য ও মুসলমানদের মধ্যে উদারনৈতিক ভাবধারা প্রচারের জন্য ‘তাহজিব-উল-আখলার্ক’ নামে একটি পত্রিকা প্রকাশ করেন । সেই সঙ্গে কমিটি ফর অ্যাডভান্সমেন্ট অফ লার্নিং নামে একটি সংস্থারও তিনি প্রতিষ্ঠা করেন। অক্সফোর্ড ও কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুকরণে ১৮৭৫ খ্রিস্টাব্দে মে মাসে আলিগড়ে তিনি মহামেডান অ্যাংলো ওরিয়েন্টাল কলেজ [Muhammedan Anglo-Oriental College] -এর প্রতিষ্ঠা করেন । এই কলেজটিই পরে আলিগড় বিশ্ববিদ্যালয় [Aligarh Muslim University] নামে পরিচিত হয়। ইংরেজ শিক্ষাবিদগণের তত্ত্বাবধানে এই কলেজে কলা ও বিজ্ঞান শিক্ষার ব্যবস্থা করা হয়। মুসলমান ছাত্রদের মধ্যে পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসার ও প্রগতিমূলক মনোভাবের উন্মেষ ঘটানোর ক্ষেত্রে এই কলেজের অবদান অস্বীকার করা যায় না। তৎকালে সরকারী ইংরেজী বিদ্যালয়গুলিতে ধর্মীয় শিক্ষার ব্যবস্থা না থাকায় মুসলমানরা সেখানে তাদের সন্তানকে পাঠাতে সংকোচ বোধ করতো। আধুনিক শিক্ষালাভের পথ থেকে সে প্রতিবন্ধকতা দূর করা হয় আলীগড় কলেজের মাধ্যমে।

এ কলেজ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে স্যার সৈয়দ আহমদ মুসলিম সমাজ সংস্কার ও শিক্ষা বিস্তারের যে আন্দোলন গড়ে তোলেন তা আলীগড় আন্দোলন’ নামে খ্যাতি লাভ করে। এ মুসলিম রেনেসাঁ আন্দোলনে কবি হালী, মুহসিনুল মুলক, নাজির আহমদ, চেরাগ আলী প্রমুখ মনীষীবৃন্দ যোগদান করে আন্দোলনের অগ্রগতি সাধিত করেন।

রাজনৈতিক ক্ষেত্রে আলিগড় আন্দোলনের ফলাফল ছিল সুদূরপ্রসারী। আলিগড় আন্দোলন মুসলমানদের মধ্যে রাজনৈতিক চেতনার উন্মেষ ঘটাতে সাহায্য করে। মুসলিমরা তাদের অধিকার আদায়ে সচেতন ও সচেষ্ট হয়। এই আন্দোলনের ধারাবাহিকতাই মুসলিমদের আলাদা রাষ্ট্রের কথা ভাবতে শেখায়। 

মুসলিম স্বার্থের রক্ষাকবচ হিসাবে স্বায়ত্তশাসনমূলক প্রতিষ্ঠানগুলিতে স্যার সৈয়দ আহমদ মুসলমানদের জন্যে পৃথক সরকারী মনোনয়নপ্রথার দাবী জানান। তিনি বলেন এসব প্রতিষ্ঠানে সাধারণ যুক্ত নির্বাচন প্রথা প্রবর্তিত হলে মুসলমানদের স্বার্থে পদদলিত হবে। ১৮৮৩ সালের ১২ই জানুয়ারী গভর্নর জেনারেলের কাউন্সিলের নিকটে মুসলমানদেরন জন্যে পৃথক নমিনেশন প্রথার সমর্থনে তিনি বলেনঃ “সাধারণ যুক্ত নির্বাচন প্রথার দ্বারা শুধুমাত্র সংখ্যাগরিষ্ঠের মত ও স্বার্থের প্রতিনিধিত্ব করা হয়। যে দেশে শুধুমাত্র একজাতি ও এক ধর্মের লোক বাস করে সেখানে এ প্রথা গ্রহণযোগ্য। কিন্তু ভারতে বিভিন্ন জাতির বাস, কেউ সংখ্যাগরিষ্ঠ, কেউ সংখ্যালঘু এবং তাদের মধ্যে জাতিভেদ ও ধর্মভেদ বিদ্যমান। এমতাবস্থায় যুক্ত নির্বাচন প্রবর্তন করলে কুফল দেখা দিতে বাধ্য। এ প্রথা প্রবর্তন করলে সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুদের দ্বারা সংখ্যালঘুদের স্বার্থ পদদলিত হবে। তাতে জাতি বিদ্বেষ ও ধর্ম বিদ্বেষ প্রবল আকার ধারণ করবে। এর জন্যে সরকারকেই দায়ী হতে হবে”।

তার এ যুক্তিপূর্ণ প্রস্তাব মুসলিম সমাজের জন্যে এক চিন্তার দ্বার উন্মুক্ত করে এবং তার এ প্রস্তাব কার্যকর হয় ছাব্বিশ বছর পর। ১৯০৬ সালের ১লা অক্টোবর আগা খানের নেতৃত্বে ভারতের বিশিষ্ট ৩৬ জন মুসলমানের একটি প্রতিনিধিদল ভারতের গভর্নর জেনারেল লর্ড মিন্টের কাছে পৃথক নির্বাচন প্রথার দাবীতে একটি স্মারকলিপি পেশ করে। ১৯০৯ সালের মর্লি-মিন্টো সংস্কারে এ দাবী স্বীকৃতি লাভ করে। এতে করে ভারতের সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু সমাজ ক্ষিপ্ত হ’য়ে উঠে। কারণ ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের বিঘোষিত নীতি ছিল একজাতীয়তাবাদ। এই নিয়ে বহু বৎসর ধরে হিন্দু মুসলমানের মধ্যে বাকবিতন্ডা ও তিক্ততা চলে। 

অবশেষে ১৯১৬ সালে লক্ষ্ণৌ শহরে কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের বার্ষিক অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়। আলোচনা শেষে উভয় প্রতিষ্ঠানের যথারীতি ক্ষমতাপ্রাপ্ত প্রতিনিধিগণ তাঁদের সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে একটি চুক্তিপত্রে স্বাক্ষর করেন। এটাই ঐতিহাসিক লক্ষ্ণৌ চুক্তি নামে অভিহিত। চুক্তিটি কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ কর্তৃক আনুষ্ঠানিকভাবে অনুমোদিত হয়। লক্ষ্ণৌ চুক্তিতে আইন পরিষদের সদস্য নির্বাচনে মুসলমানদের স্বতন্ত্র নির্বাচনাধিকার স্বীকৃতি লাভ করে। এভাবে হিন্দু কংগ্রেস ভারতে একজাতীয়তার পরিবর্তে দ্বিজাতিত্ব স্বীকার করে নেয়, যা ছিল ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার মূল ভিত্তি।

সৈয়দ আহমদের প্রতিটি নীতি ও কথায় একমত হওয়া কঠিন। তবে তিনি তাঁর তীক্ষ্ণ রাজনৈতিক দূরদৃষ্টির দ্বারা ভারতীয় মুসলমানদেরকে কংগ্রেসে যোগাদান করতে নিষেধ করেছেন এবং  এই বলে সাবধান করে দিয়েছিলেন যে, কংগ্রেস শুধুমাত্র ভারতের হিন্দু স্বার্থেরই প্রতিনিধিত্ব করবে এবং মুসলমানদের স্বার্থ হবে উপেক্ষিত। এ সত্যটি প্রথমে মাওলানা মুহাম্মদ আলী ও মুহাম্মদ আলী জিন্নাহরা মতো ঝানু রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বরা উপলব্ধি করতে না পারলেও সৈয়দের সাবধানবাণীর সত্যতা তাঁদের কাছে পরবর্তীকালে দিবালোকের ন্যায় সুস্পষ্ট হয়িছিল। যার ফলে মুসলমানদের মধ্যে স্বতন্ত্র জাতীয়তার প্রেরণা জাগ্রত হয় এবং মুসলিম নেতারা এ পথেই অগ্রসর হয়। তাই বলতে হয়, ভারতীয় মুসলমাদের স্বতন্ত্র জাতি হিসাবে বেঁচে থাকার মূলমন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে আলীগড় আন্দোলন এবং স্যার সৈয়দ আহমদের হাত ধরেই।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন