১৮ মার্চ, ২০২০

বঙ্গকথা পর্ব-৩২ : মুসলিমদের প্রথম রাজনৈতিক সংগঠনের ইতিকথা



সৈয়দ আহমদ খান ছিলেন ইংরেজদের সাথে উদারনৈতিক আচরণে বিশ্বাসী। আর আব্দুল লতিফ ছিলেন ইংরেজদের সাথে সহযোগিতামূলক আচরণে বিশ্বাসী। আর আমীর আলী ছিলেন ইসলামের আদর্শে উজ্জীবিত হয়ে নিয়মতান্ত্রিক রাজনৈতিক চিন্তাধারার মানুষ।

বাংলার মুসলমানদের পুনঃজাগরণে ও সাংস্কৃতিক পুনর্জন্মে সৈয়দ আমীর আলী অবিস্মরণীয় অবদান রেখেছেন। তার চিন্তাধারার উদারনৈতিক প্রভাব তৎকালীন সমাজব্যবস্থাকে বিশেষভাবে প্রভাবিত করেছিল। সৈয়দ আমীর আলী সম্পর্কে বিপুল রঞ্জন নাথ বলেন, "তিনি মুসলমানদের গৌরময় অতীতকেই রেনেসাঁ আন্দোলনের ভিত্তি হিসাবে গ্রহণ করেন এবং রাজনীতি কৃষ্টি ও বুদ্ধিবৃত্তির ক্ষেত্রে তাঁহাদের অতীত অবদান নূতনভাবে তুলিয়া ধরিতে প্রয়াসী হন।"

১৮৪৯ খ্রিস্টাব্দে সৈয়দ আমীর আলী হুগলী জেলার চুঁচড়া শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তার পরিবার অত্যন্ত উদারপন্থী হওয়ায় তিনি ইংরেজী শিক্ষা ও পাশ্চাত্য শিক্ষা লাভের সুযোগ পান। তিনিই ছিলেন কলিকাতা হাইকোর্টের প্রথম মুসলিম ব্যারিস্টার। এছাড়া ভারতীয়দের মধ্যে তিনিই প্রথম প্রিভি কাউন্সিলের সদস্য হন।

ভারতীয় মুসলমানদের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে সৈয়দ আমীর আলীর অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা পাওয়া যায়। তিনিই প্রথম মুসলিম নেতা যিনি রাজনৈতিক সংগঠনের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন। তিনি রাজনৈতিক অধিকার আদায়ের জন্য গঠনতান্ত্রিক সংগ্রাম করাকে নিজের দায়িত্ব মনে করতেন। ভারতীয় মুসলমানদের স্বার্থরক্ষা এবং রাজনৈতিক সচেতনতা সৃষ্টির উদ্দেশ্যে মুসলিমদের ১ম রাজনৈতিক সংগঠন সেন্ট্রাল ন্যাশনাল মোহামেডান এ্যাসোসিয়েশন গঠন করেন। 

আমীর আলী বিশ্বাস করতেন যে, একজন নেতার ব্যক্তিগত প্রচেষ্টার চেয়ে সংগঠনের মাধ্যমে দলগত প্রচেষ্টা অধিক ফলপ্রসূ। প্রতিটি ক্ষেত্রেই মুসলমানরা তাদের হিন্দু প্রতিবেশীদের চেয়ে পিছিয়ে পড়েছিল। তাদের মধ্যে পাশ্চাত্য শিক্ষার অভাব ছিল এবং তারা হিন্দু জমিদার ও মহাজনদের দ্বারা শাসিত এবং কিছু ক্ষেত্রে শোষিত হতো। তৎকালীন ইন্ডিয়া অ্যাসোসিয়েশন, ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস প্রভৃতি রাজনৈতিক সংগঠনে ছিল হিন্দুদের প্রাধান্য। কাজেই এসব সংগঠন তাঁর ধর্মের লোকদের স্বার্থ সংরক্ষণ করতে পারবে না। তাই মুসলমানদের স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য তিনি গড়ে তোলেন একটি সংগঠন। তিনি চেয়েছিলেন মুসলমানদের মাঝে ব্রিটিশ সরকারের প্রতি আনুগত্যপ্রবণতা সৃষ্টি করতে, যাতে তাদের প্রতি ব্রিটিশ সরকারের সন্দেহ দূর হয়। দেশের অন্যান্য সম্প্রদায়ের সঙ্গে তিনি সম্প্রীতি রক্ষা করতে চেয়েছিলেন। নিয়মতান্ত্রিক পন্থায় মুসলমানদের কল্যাণ সাধনই ছিল সংগঠনটির উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য। এর উদ্দেশ্য ছিল নৈতিক মূল্যবোধ ও বুদ্ধিবৃত্তিক ঐতিহ্যের চেতনা ফিরিয়ে এনে মুসলমানদের পুনরুজ্জীবিত করা।

সৈয়দ আমীর আলীর উদ্যোগে লন্ডনে সর্বভারতীয় মুসলিম লীগের লন্ডন শাখা প্রতিষ্ঠিত হয়। তিনি ভারতীয় মুসলমানদের জন্য পৃথক নির্বাচন ব্যবস্থা প্রবর্তনেও ভূমিকা পালন করেন। তিনি লর্ড মর্লির নিকট জোড়ালোভাবে নিজের মতামত তুলে ধরেন। তিনি নিয়মতান্ত্রিক বা সাংবিধানিক পন্থার উপর গুরুত্ব দিতেন। 

মাত্র ২০০ সদস্য নিয়ে সেন্ট্রাল ন্যাশনাল মোহামেডান অ্যাসোসিয়েশন যাত্রা শুরু করলেও পাঁচ বছরের মধ্যে এর সদস্য সংখ্যা প্রায় ছয়শ-তে পৌঁছে। আমীর আলী তাঁর অক্লান্ত প্রচেষ্টায় বাংলা, বিহার, বোম্বাই, যুক্ত প্রদেশ, পাঞ্জাব, এমনকি লন্ডনে এর প্রায় ৫০টি শাখা খোলেন। সচরাচর শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণির লোকেরাই এই সংগঠনের সদস্য হতেন। সরকারি চাকরিতে নিয়োজিত ব্যক্তিরাও এর সদস্য হতে পারতেন। এটি মুসলমানদের স্বার্থ সংরক্ষণে যেকোন রাজনৈতিক সংগঠনের সঙ্গে সহযোগিতা করতে প্রস্তুত ছিল। তার এই সংগঠনের সদস্যরাই পরবর্তীতে মুসলিম লীগের কলেবর বৃদ্ধিতে সহায়তা করে। 

মুসলমানদের আধুনিক চিন্তাধারায় উদ্বুদ্ধকরণ ও রাজনৈতিক সচেতনতা বৃদ্ধিতে সংগঠনটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এ সংগঠনের কার্যক্রমের মধ্যে অন্যতম ছিল; অ্যাসোসিয়েশরেন উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে সভা, বুদ্ধিবৃত্তিক আলোচনা ও বার্ষিক সম্মেলনের আয়োজন করা, সংবাদপত্র ও জনসভার মাধ্যমে মুসলমানদের সমস্যা ও অধিকার সম্বন্ধে সরকারের মনোযোগ আকর্ষণ করা প্রভৃতি। সৈয়দ আমীর আলী নিজে সংগঠনের ব্যানারে স্মারকলিপি পেশ করতেন এবং কর্তৃপক্ষের নিকট নিয়মিত প্রতিনিধিদল প্রেরণ করতেন। তাছাড়াও গভর্নর জেনারেল ও লেফটেন্যান্ট গভর্নরদের সংবর্ধনা প্রদান করতেন। অ্যাসোসিয়েশন মূলত মুসলমানদের শিক্ষা ও রাজনৈতিক উন্নয়নের জন্য কাজ করত। 

১৮৮১ সালে মুসলমানদের শিক্ষার সমস্যাবলি নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ ছিল অ্যাসোসিয়েশনের একটি উলে­খযোগ্য কাজ। আমীর আলীর নেতৃত্বে অ্যাসোসিয়েশন ১৮৮২ সালে হান্টার কমিশনের নিকট একটি লিখিত বক্তব্য পেশ করে। এ বক্তব্যে বলা হয়, মুসলমানরা ইংরেজি শিক্ষার প্রতি তাদের পূর্ব অনুসৃত ঘৃণা পরিত্যাগ করেছে এবং এখন তারা ইংরেজি শিক্ষা গ্রহণে ইচ্ছুক। কিন্ত চরম দারিদ্র্য এ পথে তাদের সবচেয়ে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। 

সৈয়দ আমীর আলী ১৮৮২ সালে অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষে ‘'A cry from the Indian Muhamedans’ শীর্ষক একটি স্মারকলিপি পেশ করেন। স্মারকলিপিতে আবেদন করা হয় যে, মুসলমানরা ব্রিটিশ সরকারের প্রতি অনুগত, কিন্তু তাদের দুরবস্থার কারণে তারা অসন্তুষ্ট। তারা চাকরির সুযোগ এবং সমাজে সম্মানজনক অবস্থান হতে বঞ্চিত। এভাবে ক্রমাগত চাপ প্রয়োগে অ্যাসোসিয়েশন একটি বড় রকমের সাফল্য অর্জনে সক্ষম হয়। ১৮৮৫ সালে সরকার মুসলিম শিক্ষার ওপর একটি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। সৈয়দ আমীর আলী এই সিদ্ধান্তকে মুসলমানদের জন্য ম্যাগনাকার্টা রূপে গণ্য করেন।

ভারতে ও ইংল্যান্ডে যুগপৎ আই.সি.এস পরীক্ষা অনুষ্ঠান এবং মনোনয়ন পদ্ধতি বলবৎ রাখার জন্য সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জীর দাবির বিরোধিতা করে সেন্ট্রাল ন্যাশনাল মোহামেডান অ্যাসোসিয়েশন। অ্যাসোসিয়েশনের দাবি ছিল ব্যাপক হারে মুসলমানদের নিয়োগ, নির্বাহি পরিষদের সম্প্রসারণ ও ভোটাধিকার নিশ্চিতকরণ। স্থানীয় পরিষদসমূহে মুসলমানদের জন্য পৃথক নির্বাচনের দাবি করা হয়েছিল। সৈয়দ আমীর আলীর নেতৃত্বে অ্যাসোসিয়েশনের আন্দোলন ফলপ্রসু হয় যখন ১৮৯২ সালে ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অ্যাক্ট পাস হয়। এই আইন বিভিন্ন স্বার্থ সংশ্লিষ্ট দলের স্বার্থ রক্ষার নিশ্চয়তা প্রদান করে।

তিনি বিভিন্ন ঐতিহাসিক গ্রন্থ রচনার মাধ্যমে মুসলমানদের ইতিহাস ও কৃষ্টিগত ঐতিহ্য তুলে ধরার চেষ্টা করেন তিনি । তার রচিত গ্রন্থগুলোর মাঝে উল্লেখযোগ্য হলো The Spirit of Islam এবং A Short History of Saracens। এছাড়া তিনি মুসলিম আইনবিষয়ক প্রচুর গ্রন্থও রচনা করেন। 

সৈয়দ আমীর আলী দেশের অর্থনৈতিক সংকটাপন্ন অবস্থা নিয়ে সোচ্চার হন। তিনি রাজস্ব আদায়ে কঠোরতার নিন্দা করেন। তিনি সুতি বস্ত্রের আমদানির উপর শুল্ক হ্রাস, আফগান যুদ্ধে ব্যয় হ্রাস এবং কর্মক্ষেত্রে দেশী কর্মচারীদের নিয়োগের ব্যাপারে শাসকগোষ্ঠীর দৃষ্টি আকর্ষণের প্রচেষ্টা চালান। তিনি জাতি ও ধর্মের ভিত্তিতে পৃথক শিক্ষা ব্যবস্থার সুপারিশ করেন। ১৯০৬ সালে মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পেছনে আমীর আলীর রাজনৈতিক সংগঠন ভূমিকা রাখে। মুসলিম লীগ গঠন হওয়ার পর সেন্ট্রাল ন্যাশনাল মোহামেডান অ্যাসোসিয়েশনের কার্যক্রমের প্রয়োজনীয়তা আর থাকে না। সংগঠনটি বিলুপ্ত হয়। সৈয়দ আমীর আলী ১৯০৮ সালে মুসলিম লীগ লন্ডন শাখার সভাপতি নির্বাচিত হন।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন