২০ এপ্রি, ২০২০

আল্লাহ কী মুসলিমদের বিরুদ্ধে মুশরিকদের বিজয় দান করেছেন?



একটি ঐতিহাসিক ঘটনাকে পুঁজি করে কিছু মুশরিক ইতিহাসবিদ এমন দাবি করেন। আগে সেই ঘটনা ও তার পূর্বাপর কিছু ইতিহাস জেনে নিই। 

৫২৫ সালের। তখন ঈসা আ.-এর অনুসারীদের মুসলিম বলা হতো। তবে বেশিরভাগ মুসলিমই বিকৃতির শিকার হয়ে পড়েছিলেন। তারা ঈসা আ.-কে আল্লাহর সাথে জড়িয়ে শিরকে লিপ্ত ছিল। তখন মক্কার প্রতিবেশী অঞ্চল ইয়েমেনে শাসক ছিলেন জুনুয়াস বা জু নাওয়াস। সে ছিল ইয়াহুদি। সে মুসলিমদের ওপর ব্যাপক নির্যাতন শুরু করে। বহু মুসলিমকে হত্যা করে। ইয়েমেনের একজন মুসলিম যার নাম দাউস জু সালাবান তিনি রোমে (ইতালি) হাজির হন এবং রোমের বাদশাহের কাছে ইয়াহুদিদের নির্যাতনের কথা বর্ণনা করেন। 

ইতালির শাসকদের বলা হতো কায়সার। তারা ছিলেন খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বী অর্থাৎ মুসলিম। তিনি আবিসিনিয়ার বাদশাহ নাজ্জাশীকে লিখলেন, তিনি যেন দাউস জু সালাবানের সঙ্গে একটি বাহিনী পাঠিয়ে দেন এবং ইয়াহুদিদের শায়েস্তা করেন। আবিসিনিয়া মানে বর্তমানের ইথিওপিয়া। ইথিওপিয়া থেকে অল্প সমুদ্র পাড়ি দিলেই ইয়েমেন। ইথিওপিয়াতেও মুসলিমদের শাসন। বাদশাহ নাজ্জাশী আমীর ইবনে ইরবাতকে সৈন্য পরিচালনার দায়িত্ব দিয়ে এক বিরাট সেনাবাহিনী জুনুয়াসের বিরুদ্ধে প্রেরণ করেন। এই সৈন্যদল ইয়েমেনে পৌঁছলো এবং সহজেই ইয়াহুদিদের পরাজিত করলো। জুনুয়াস পালিয়ে গেল এবং সমুদ্রে ডুবে মৃত্যুবরণ করলো। এরপর সমগ্র ইয়েমেন আবিসিনিয়ার কর্তৃত্বে চলে গেল। সৈন্যাধ্যক্ষ হিসেবে আগমনকারী সর্দার ইয়েমেনে বসবাস করতে লাগলো। 

কিন্তু অল্প কিছুদিন পরই তার সাথে তার অধীনস্ত কমান্ডার আবরাহা ইবনে সাহাবের মধ্যে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব দেখা দিলো। আমীর ইবনে ইরবাত আবরাহার ওপর আক্রমণ করলো এবং তরবারীর এক আঘাতে তার চেহারা রক্তাক্ত করে ফেললো। নাক, ঠোট এবং চেহারার বেশ কিছু অংশ কেটে গেল। এই অবস্থা দেখে আবরাহার ক্রীতদাস আদাহ্ এক অতর্কিত আক্রমণ চালিয়ে ইরবাতকে হত্যা করে ফেললো। আবরাহা ইয়েমেনের শাসনকর্তা হয়ে বসলো। আবিসিনিয়ার বাদশাহ নাজ্জাশী এ খবর পেয়ে খুবই ক্রুদ্ধ হলেন এবং পত্রে জানালেন, “আল্লাহর কসম! আমি তোমার শহরসমূহ ধ্বংস করবো এবং তোমার টিকি কেটে আনবো।” 

আবরাহা অত্যন্ত বিনয়ের সাথে এ পত্রের জবাব লিখলো এবং দূতকে নানা প্রকারের উপহার, একটা থলের মধ্যে ইয়েমেনের মাটি এবং নিজের মাথার কিছু চুল কেটে নাজ্জাশীর কাছে পাঠালো। তাছাড়া চিঠিতে সে নিজের অপরাধের ক্ষমা চেয়ে লিখলো, “ইয়ামনে মাটি এবং আমার মাথার চুল হাজির রয়েছে, আপনি নিজের কসম পূর্ণ করুন এবং আমার অপরাধ ক্ষমা করে দিন!" এতে নাজ্জাশী খুশি হলেন এবং ইয়েমেনের শাসনভার আবরাহাকে লিখে দিলেন। তারপর আবরাহা নাজ্জাশীকে লিখলো, “আমি ইয়ামনে আপনার জন্যে এমন একটি গীর্জা তৈরি করছি যে, এরকম গীর্জা ইতোপূর্বে পৃথিবীতে কখনো তৈরি হয়নি। অতি যত্ন সহকারে খুবই মযবুত ও অতি উঁচু করে ঐ গীর্জাটি নির্মিত হলো। ঐ গীর্জার চূড়া এতো উঁচু ছিল যে, চূড়ার প্রতি টুপি মাথায় দিয়ে তাকালে মাথার টুপি পড়ে যেতো। আরববাসীরা ঐ গীর্জার নাম দিয়েছিল কালিস' অর্থাৎ টুপি ফেলে দেওয়া গীর্জা। 
সেসময় মুসলিমরা কাবায় হজ্ব করলেও কাবা ছিলো মুশরিক কুরাইশদের নিয়ন্ত্রণে। এই নিয়ে তৎকালীন মুসলিমদের মধ্যে একটা আক্ষেপ ছিলো। আবার কুরাইশদের একটি ভালো গুণ ছিলো তারা কারো জন্য কাবা বন্ধ করেনি। যে যার বিশ্বাসমতে কাবায় হজ্ব করতো। আবরাহা পরিকল্পনা করলো যে, জনসাধারণ কাবায় হজ্ব না করে বরং এ গীর্জায় এসে হজ্ব করবে। এটলিস্ট যারা ঈসা আ.-কে অনুসরণ করে তারা কাবায় না গিয়ে কালিস গীর্জায় আসবে। কিন্তু আবরাহার এই ঘোষণা ছিলো ইসলামবিরোধী। কারণ হজ্বের জন্য কাবা ফিক্সড। কাবা ছাড়া অন্য কোথাও হজ্ব হবে না। 

আবরাহা ইয়েমেনে ঘোষণা করে দিল এখন থেকে হজ্ব হবে কালীসে। আবিসিনিয়াতেও জানিয়ে দিলো এবং নাজ্জাশীকে সম্মানের সাথে আহবান করা হলো। পুরো অনুষ্ঠান নাজ্জাশীকে সম্মান করে হবে বিধায় নাজ্জাশী ইসলামের বিরুদ্ধে গেলেও এই সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ করেনি। কিন্তু ইয়েমেনের ধর্মপ্রাণ মুসলিম গোত্র আদনানিয়্যাহ ও কাহতা নিয়্যাহ গোত্র এ ঘোষণায় খুবই অসন্তুষ্ট হন এবং কুরায়েশরা ভীষণ রাগান্বিত হয়। অল্প কয়েকদিন পরে দেখা গেল যে, এক ব্যক্তি রাতের অন্ধকারে ঐ গীর্জায় প্রবেশ করে পায়খানা করে এসেছে। প্রহরীরা পরের দিন এ অবস্থা দেখে বাদশাহ আবরাহার কাছে খবর পাঠালো এবং অভিমত ব্যক্ত করলো যে, কুরাইশরাই এ কাজ করেছে। তাদের মর্যাদা ক্ষুন্ন করা হয়েছে বলেই এ কাণ্ড তারা করেছে। আবরাহা তৎক্ষণাৎ কসম করে বললো, “আমি মক্কার বিরুদ্ধে অভিযান চালাবো এবং কাবার প্রতিটি ইট পর্যন্ত খুলে ফেলবো।” ইবনে কাসীর বলেছেন, এমন বর্ণনাও পাওয়া যায় কয়েকজন উদ্যোগী কুরাইশ যুবক ঐ গীর্জায় আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছিল। 

যাই হোক, এর পর ক্রুদ্ধ আবরাহা এক বিরাট বাহিনী নিয়ে মক্কা অভিমুখে রওনা হলো। তাদের সাথে এক বিরাট উঁচু ও মোটা হাতি ছিল। ঐরূপ হাতি ইতোপূর্বে কখনো দেখা যায়নি। হাতিটির নাম ছিল মাহমুদ। বাদশাহ নাজ্জাশী মক্কা অভিযান সফল করার লক্ষ্যে ঐ হাতিটি আবরাহাকে দিয়েছিল। ঐ হাতির সাথে আবরাহা আরো আটটি অথবা বারোটি হাতি নিলো। তার উদ্দেশ্য ছিল যে, সে বায়তুল্লাহর দেয়ালে শিকল বেঁধে দিবে, তারপর সমস্ত হাতির গলায় ঐ শিকল লাগিয়ে দিবে। এতে শিকল টেনে হাতিগুলো সমস্ত দেয়াল একত্রে ধ্বসিয়ে দিবে।

মক্কার অধিবাসীরা এ সংবাদ পেয়ে দিশেহারা হয়ে পড়লো। যে কোনো অবস্থায় এর মুকাবিলা করার তারা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলো। জুনফর নামক ইয়ামনের একজন রাজ বংশীয় লোক নিজের গোত্র ও আশে পাশের বহু সংখ্যক আরবকে একত্রিত করে আবরাহার মুকাবিলা করলেন। জুনফর পরাজিত হলেন এবং আবরাহার হাতে বন্দী হলেন। যুনফরকেও সঙ্গে নিয়ে আবরাহা মক্কার পথে অগ্রসর হলো। খাশআম গোত্রের এলাকায় পৌঁছার পর নুফায়েল ইবনে হাবীব আশআমী একদল সৈন্য নিয়ে আবরাহার মুকাবিলা করলেন। কিন্তু তারাও আবরাহার হাতে পরাজয়বরণ করলেন। নুফায়েলকেও জুনফরের মত বন্দী করা হলো। আবরাহা প্রথম নুফায়েলকে হত্যা করার ইচ্ছা করলো, কিন্তু পরে মক্কার পথ দেখিয়ে নেয়ার উদ্দেশ্যে জীবিতাবস্থায় সঙ্গে নিয়ে চললো। 

তায়েফের উপকণ্ঠে পৌঁছলে সাকীফ গোত্র আবরাহার সাথে সন্ধি করলো যে, লাত মূর্তিটি যে কক্ষে রয়েছে, আবরাহার সৈন্যরা ঐ কক্ষের কোনো ক্ষতিসাধন করবে না। সাকীফ গোত্র আবু রিগাল নামক একজন লোককে পথ দেখিয়ে দেওয়ার জন্যে আবরাহার সঙ্গে দিলো। মক্কার কাছে মুগমাস নামক স্থানে তারা অবস্থান করলো। আবরাহার সৈন্যেরা আশেপাশের জনপদ এবং চারণভূমি থেকে বহু সংখ্যক উট এবং অন্যান্য পশু দখল করে নিলো। এগুলোর মধ্যে রাসূল সা.-এর দাদা আবদুল মুত্তালিবের দুইশত উটও ছিল। 

অতঃপর আবরাহা নিজের বিশেষ দূত হানাতাহ হুমাইরীকে বললো, তুমি মক্কার সর্বাপেক্ষা বড় সর্দারকে আমার কাছে ডেকে নিয়ে এসো এবং ঘোষণা করে দাও আমরা মক্কাবাসীদের সাথে যুদ্ধ করতে আসিনি, কাবা ভেঙ্গে ফেলাই শুধু আমাদের উদ্দেশ্য। তবে হ্যাঁ, মক্কাবাসীরা যদি কাবাগৃহ রক্ষার জন্যে এগিয়ে আসে এবং আমাদেরকে বাধা দেয় তাহলে বাধ্য হয়ে আমাদেরকে তাদের সাথে যুদ্ধ করতে হবে। হানাতাহ মক্কার জনগণের সাথে আলোচনা করে বুঝতে পারলো যে, আবদুল মুত্তালিব ইবনে হাশেমই মক্কার বড় নেতা। হানাতাহ আবদুল মুত্তালিবের সামনে আবরাহার বক্তব্য পেশ করলে আবদুল মুত্তালিব বললেন, “আল্লাহর কসম! আমাদের যুদ্ধ করার ইচ্ছাও নেই এবং যুদ্ধ করার মত শক্তিও নেই।” আল্লাহর সম্মানিত ঘর। তাঁর প্রিয় বন্ধু হযরত ইবরাহীমের জীবন্ত স্মৃতি। সুতরাং আল্লাহ ইচ্ছা করলে নিজের ঘরের হিফাজত নিজেই করবেন। অন্যথায় তাঁর ঘরকে রক্ষা করার সাহসও আমাদের নেই এবং যুদ্ধ করার মত শক্তিও আমাদের নেই। হানাতাহ তখন তাকে বললো, “ঠিক আছে, আপনি আমাদের বাদশাহর কাছে চলুন।” 

আবদুল মুত্তালিব তখন তার সাথে আবরাহার কাছে গেলেন। আবদুল মুত্তালিব ছিলেন অত্যন্ত সুদর্শণ বলিষ্ঠ দেহ সৌষ্ঠবের অধিকারী। আবরাহা তাকে দেখেই সিংহাসন থেকে নেমে এলো এবং তার সাথে মেঝেতে উপবেশন করলো। সে তার দোভাষীকে বললো, 
- তাকে জিজ্ঞেস করো তিনি কি চান? 
- আবদুল মুত্তালিব জানালেন, “বাদশাহ আমার দু’শ উট লুট করেছেন। আমি সেই উট ফেরত নিতে এসেছি।” 
- প্রথম দৃষ্টিতে আপনি যে শ্রদ্ধা আকর্ষণ করেছিলেন, আপনার কথা শুনে সে শ্রদ্ধা লোপ পেয়ে গেছে। নিজের দু’শ উটের জন্যে আপনার এতো চিন্তা অথচ স্বজাতির ধর্মের জন্যে কোন চিন্তা নেই! আমি আপনাদের ইবাদতখানা কা’বা ধ্বংস করে ধূলিসাৎ করতে এসেছি।" 
- শোন, উটের মালিক আমি, তাই উট ফিরে পাওয়ার চেষ্টা করতে এসেছি। আর কাবাগৃহের মালিক হলেন স্বয়ং আল্লাহ। সুতরাং তিনি নিজেই নিজের ঘর রক্ষা করবেন।” 
- আজ স্বয়ং আল্লাহও কাবাকে আমার হাত থেকে রক্ষা করতে পারবেন না।” 
- তা আল্লাহ জানেন এবং আপনি জানেন।” 

আবদুল মুত্তালিব তাঁর উটগুলো নিয়ে ফিরে আসলেন এবং মক্কাবাসীদেরকে বললেন, “তোমরা মক্কাকে সম্পূর্ণ খালি করে দাও। সবাই তোমরা পাহাড়ে গিয়ে আশ্রয় নাও।” তারপর আবদুল মুত্তালিব কুরায়েশের কয়েকজন বিশিষ্ট ব্যক্তিকে সঙ্গে নিয়ে কা'বা গৃহে গিয়ে কাবার খুঁটি ধরে দেয়াল ছুঁয়ে আল্লাহর দরবারে কান্নাকাটি করলেন এবং কায়মনোবাক্যে ঐ পবিত্র ও মর্যাদাপূর্ণ গৃহ রক্ষার জন্যে প্রার্থনা করলেন। আবরাহা এবং তার রক্ত পিপাসু সৈন্যদের অপবিত্র ইচ্ছার কবল থেকে কাবাকে পবিত্র রাখার জন্যে আবদুল মুত্তালিব কবিতার ভাষায় নিম্নলিখিত দুআ করেছিলেন,
"আমরা নিশ্চিন্ত, কারণ আমরা জানি যে, প্রত্যেক গৃহমালিক নিজেই নিজের গৃহের হিফাযত করেন। হে আল্লাহ! আপনিও আপনার গৃহ আপনার শত্রুদের কবল হতে রক্ষা করুন। আপনার অস্ত্রের ওপর তাদের অস্ত্র জয়যুক্ত হবে এমন যেন কিছুতেই না হয়। 

পরদিন প্রভাতে আবরাহার সেনাবাহিনী মক্কায় প্রবেশের উদ্যোগ আয়োজন করলো। বিশেষ করে হাতি মাহমুদকে সজ্জিত করা হলো। পথে বন্দী হয়ে আবরাহার সাথে আগমনকারী নুফায়েল ইবনে হাবীব তখন মাহমুদ নামক হাতিটির কান ধরে বললেন, “মাহমুদ! তুমি বসে পড়ো, আর যেখান থেকে এসেছ সেখানে ভালোভাবে ফিরে যাও। তুমি আল্লাহর পবিত্র শহরে রয়েছ।” একথা বলে নুফায়েল হাতির কান ছেড়ে দিলেন এবং ছুটে গিয়ে নিকট এক পাহাড়ের আড়ালে গিয়ে আত্মগোপন করলেন। মাহমুদ নামক হাতিটি নুফায়েলের কথা শোনার সাথে সাথে বসে পড়লো। বহুচেষ্টা করেও তাকে নড়ানো সম্ভব হলো না। পরীক্ষামূলক ভাবে ইয়ামনের দিকে তার মুখ ফিরিয়ে টেনে তোলার চেষ্টা করতেই হাতি তাড়াতাড়ি উঠে দ্রুত অগ্রসর হতে লাগলো। পূর্বদিকে চালাবার চেষ্টা করা হলে সেদিকেও যাচ্ছিল, কিন্তু মক্কা শরীফের দিকে মুখ ঘুরিয়ে চালাবার চেষ্টা করতেই বসে পড়লো। 

সৈন্যরা তখন হাতিটিকে প্রহার করতে শুরু করলো। হাতিটি যখন আর উঠানো সম্ভব হলো না তখন সৈন্যরা অন্য একটি হাতিকে সামনের দিকে নেয়ার চেষ্টা করলো। এমন সময় দেখা গেল এক ঝাঁক পাখি কালো মেঘের মত হয়ে সমুদ্রের দিক থেকে উড়ে আসছে। চোখের পলকে ওগুলো আবরাহার সেনাবাহিনীর মাথার ওপর এসে পড়লো এবং চতুর্দিক থেকে তাদেরকে ঘিরে ফেললো। প্রত্যেক পাখির ঠোঁটে একটি এবং দুপায়ে দুটি কংকর ছিল। কংকরের ঐ টুকরোগুলো ছিল মসুরের ডাল বা মাসকলাই এর সমান। পাখিগুলো কংকরের ঐ টুকরোগুলো আবরাহার সৈন্যদের প্রতি নিক্ষেপ করছিল। যার গায়ে ঐ কংকর পড়ছিল সেই সঙ্গে সঙ্গে মৃত্যু যন্ত্রণায় ছটফট করতে করতে মারা পড়ছিলো।

অন্য হাতিটি কাবার দিকে পা বাড়াতেই তার মাথায় কংকরের টুকরো পড়লো এবং আর্তনাদ করে পিছনে সরে এলো। অন্যান্য হাতিও তখন এলোপাতাড়ি ছুটতে শুরু করলো। কয়েকটির ওপর কংকর পড়ায় তৎক্ষণাৎ ওগুলো মারা গেল। যারা ছুটে পালাচ্ছিল তাদেরও এক একটি অঙ্গ খসে খসে পড়ছিল। এবং অবশেষে সবগুলোই মারা গেল। আবরাহাও ছুটে পালালো, কিন্তু তারও এক একটি অঙ্গ খসে খসে পড়ছিল। অবশেষে সে ধুঁকতে ধুঁকতে মৃত্যুবরণ করলো। 

এ ঘটনার প্রেক্ষিতে নুফায়েল আরো বলেন, "হাতিওয়ালাদের দুরাবস্থার সময়ে তুমি যদি উপস্থিত থাকতে! যখন প্রান্তরে তাদের ওপর আযাবের কংকর বর্ষিত হয়েছে। তুমি সে অবস্থা দেখলে আল্লাহর দরবারে সিজদায় পতিত হতে। আমরা পাহাড়ের ওপর দাঁড়িয়ে আল্লাহর প্রশংসা করছিলাম। আমাদের হৃৎপিণ্ড কাঁপছিল এই ভয়ে যে, না জানি হয়তো আমাদের ওপরও এই কংকর পড়ে যায় এবং আমাদেরও দফারফা করে দেয়"। 

এখানে একটি মজার বিষয় লক্ষণীয় আল্লাহ তায়ালা তৎকালীন নামধারী মুসলিমদের বিরুদ্ধে সাহায্য করলেন মুশরিকদেরকে। অনেক হিন্দু মুশরিকরা এমনটা দাবী করেন। তারা দাবী করেন কাবা তাদের এবং তাদের সাহায্যে আল্লাহ তায়ালা পাখিদের পাঠিয়েছিলো। আসলে বিষয়টা সেটা নয়। ঐ নামধারী মুসলিমরা স্বয়ং আল্লাহর বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছিলো। আর আল্লাহ তায়ালা তাঁর ঘরকে রক্ষা করেছিলেন। কাবা যে তাদের নয় সেটা প্রকাশ পায় মুশরিকদের নেতা রাসূলের দাদার বক্তব্য থেকে। তিনি দাবী করেছেন এই ঘর ইব্রাহীমের। আর ইব্রাহীম আ. কখনোই মুশরিক ছিলেন না। তিনি তাঁর পিতার শিরকি কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন। অর্থাৎ কাবা ঘর মুসলিমদের। কিন্তু ইব্রাহীমের মুসলিম সন্তানরা বংশ পরম্পরা ইসলাম থেকে বিচ্যুত হয়ে মুশরিক হয়ে গিয়েছে। ঐ সন্তানেরা কাবাঘর তৈরি করেননি। কাবা ঘর মুসলিমদের এবং মুসলিমরা তাই এর দখল নিয়েছে এবং তাদের ঘরে থাকা মুর্তি ধ্বংস করেছে। 

আল্লাহ তায়ালা আবরাহাকে ধ্বংস করে দিয়ে কাবা রক্ষা করেছেন, এর মানে এই না যে সবসময় কাবাঘর রক্ষা পাবে। এর আগেও কাবা নূহ আ.-এর বণ্যার সময় ও ভূমিকম্পে ধ্বংস হয়েছিলো। তারপর ইয়াজিদের বাহিনীও কাবার দেয়াল ধ্বসিয়ে দিয়েছিলো। তাই আল্লাহ তায়াল কখন কী করবেন এটা একমাত্র তাঁরই ইচ্ছে। মহান আল্লাহ তায়ালা এই ঘটনাকে স্মরণীয় করে রাখতে নাজিল করেছেন সূরা ফিল।

//তুমি কি দেখনি তোমার রব হাতিওয়ালাদের সাথে কী করেছিলেন?
তিনি কি তাদের ষড়যন্ত্র ব্যর্থতায় পর্যবসিত করেননি?
আর তিনি তাদের বিরুদ্ধে ঝাঁকে ঝাঁকে পাখি প্রেরণ করেছিলেন।
তারা তাদের ওপর নিক্ষেপ করে পোড়ামাটির কঙ্কর 
অতঃপর তিনি তাদেরকে করলেন ভক্ষিত শস্যপাতার ন্যায়।// 

যে বছর এই অসাধারণ ঘটনা ঘটে সে বছরকে কুরাইশরা বলতো আমুল ফিল বা হস্তিবর্ষ। এই হস্তিবর্ষেই জন্ম নেন আল্লাহর রাসূল মুহাম্মাদ সা.। এটা শেষ নবী হযরত মুহাম্মদ সা. আগমনের ইশারাও ছিলো। সে বছর আল্লাহ তায়ালা মক্কার মুশরিকদেরও শাস্তি দেন কারণ তারা যথাযথভাবে কাবা রক্ষার ব্যবস্থা নেয় নি। ঐ বছরই মক্কায় প্রথম মাহামারি প্লেগ ও কলেরা দেখা দেয়।

বি. দ্র. 
নাজ্জাশী নাম দেখে বিভ্রান্ত হবেন না। আমরা নাজ্জাশী নামে যাকে চিনি তিনি ভালো লোক ছিলেন। সংকটাপন্ন মুসলিমদের শেল্টার দিয়েছেন। বিবেচনাবোধসম্পন্ন ও আল্লাহভীরু লোক ছিলেন। মুহাম্মাদ সা.-এর একটি বিয়েতে তিনি ঘটক ছিলেন এবং ঐ বিয়েতে রাসূলের পক্ষে তিনি চার হাজার দিরহাম মোহর প্রদান করেন। আল্লাহর রাসূল সা. তাঁর জানাজা পড়েছেন। মূলকথা হলো আবিসিনিয়ার বাদশাহদের নাজ্জাশী বলা হয়। যেভাবে আগে মিশরের বাদশাহদের ফিরাউন বলা হতো। আমরা যাকে চিনি তার নাম 'আরমাহ'। কিছু বর্ণনায় এসেছে 'শাহামা'। 

আর এখানে যে নাজ্জাশীর কথা বলা হয়েছে অর্থাৎ আবরাহার সময়কার নাজ্জাশী ছিলেন 'গারসেম'। গারসেম মৃত্যুবরণ করেছে ৬০০ সালে। অর্থাৎ মুহাম্মদ সা. তখনো নবীত্ব লাভ করেন নাই। এর পরেই আরমাহ নাজ্জাশী হন। গারসেমের সাথে আরমাহের সম্পর্ক কী তা নির্ণয় করতে পারিনি।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন