রাসূল সা.-এর জীবনের শেষ রামাদানের ঘটনা। একদিন রাতে রাসূল সা. মসজিদে নববীতে নামাজ পড়তে শুরু করলেন। এরকম আগে করেননি। আসহাবে সুফফার বাসিন্দারা তাঁর সাথে যুক্ত হয়ে নামাজ পড়লেন। রাসূল সা. মধ্যরাত পর্যন্ত নামাজ পড়েছেন। পরদিন এই ঘটনা আরো কয়েকজন সাহাবী জানলেন। তারাও রাতে মহানবীর সাথে যুক্ত হয়ে নামাজ আদায় করলেন। এই দিন আল্লাহর রাসূল আরো লম্বা করলেন নামাজ। প্রায় শেষ রাতের কাছাকাছি সময় চলে গিয়েছেন।
এর পরের দিন রাতে সবাই জেনে গেল মহানবী রাতে মসজিদে এসে নামাজ পড়েন। বরকত হাসিল করার জন্য অনেক সাহাবী জমা হয়ে গেলেন। তারাও রাসূলের সাথে নামাজ আদায় করবেন। কিন্তু তৃতীয় দিন রাসূল সা. তাঁর ঘর থেকে বের হলেন না। সাহাবারা অনেক্ক্ষণ অপেক্ষা করে ফিরে গেলেন। এর পরের বছর রাসূল সা. আরা রামাদান পাননি।
এই ঘটনা থেকে সাহাবারা যে মেসেজ নিয়েছেন তা হলো রামাদানের রাতে নামাজ পড়লে আল্লাহ খুশি হন। এমনিতেই রামাদানে নফলকে ফরজের মান দেওয়া হবে। তাই রামাদানে সৎ কাজ ও ইবাদত করার জন্য সাহাবারা প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হতেন। এর পরের দুই বছর খলিফা ছিলেন আবু বকর রা.। তার সময়ে সাহাবারা সবাই যার যার মতো নামাজ পড়তেন রাতে মসজিদে নববীতে। এভাবে চলতে থাকে।
এরপর খলিফা হন হযরত উমার রা.। তিনি দেখলেন মসজিদে নববীতে কেউ একা আবার কেউ খণ্ড খণ্ড জামায়াত করে রামাদানের রাতে নামাজ পড়ছেন। উমার রা. সুশৃঙ্খল মানুষ। তিনি এলোপাথাড়ি কাজ পছন্দ করতেন না। তাই তিনি অন্যান্য সাহাবাদের নিয়ে পরামর্শ করলেন। সিদ্ধান্ত হলো আমরা যেহেতু মসজিদে সবাই আসি তবে আমরা একসাথে নামাজ পড়ি। তিনি উবাই ইবনে কা'ব রা.-কে ইমাম বানিয়ে সবাইকে একসাথে জামায়াতে নামাজ আদায় করার নির্দেশ দিলেন। ওনার জামানায় বিভিন্ন বর্ণনায় রাকায়াত সংখ্যা বিভিন্ন পাওয়া যায়। ১১, ১৩, ২৩ এবং ৩৯ পর্যন্ত। উবাই ইবনে কা'বকে ইমামতিতে সহায়তা করার জন্য তামিম আদ দ্বারি রা.-কে সহকারি ইমাম নিয়োগ করেছেন এমন বর্ণনাও পাওয়া যায়। উমার রা.-এর শেষ বছরে বিশ রাকায়াত ও বিতর নামাজ যোগে তেইশ রাকায়াত হয়েছিলো বলে জানা যায়।
উসমান রা.-এর সময়ে বিশ রাকায়াত নামাজ পড়া হয়। এ সময় মসজিদে নববীতে ইমামতি করতেন আলী রা.। এই আমলে নতুন যেটা যোগ হয় তা হলো রাতের নামাজে কুরআন শেষ করার প্রচলন শুরু হয়। এরপর আসে হযরত আলী রা.-এর শাসনামল। এই আমলে যেটা পরিবর্তন পাওয়া যায় তা হলো তিনি পুরুষ ও মহিলাদের জন্য আলাদা ইমাম দিয়েছেন। মহিলাদের জন্য মহিলা ইমাম। আর এশা ও বিতর তিনি নিজে পড়াতেন। এ ছাড়া কোনো পরিবর্তন হয়নি। মসজিদে নববী ও কা'বায় বিশ রাকায়াতের মাধ্যমে কুরআন শেষ করার নিয়ম চালু থাকে।
এরপর মুয়াবিয়া রা.-এর আমলে সরকারিভাবে কোনো পরিবর্তন হয়নি বলেই জানা যায়। তবে মক্কা-মদিনাতে একটু পরিবর্তন আসে। এখানে আরো জানা দরকার। মদিনা তখন আর রাজধানী ছিলো না। হযরত আলী রাজধানী পরিবর্তন করে ইরাকের কুফায় নিয়ে গেছেন। তাঁর শাহদাতের পর কুফায় খলিফাতুল মুসলিমিন নির্বাচিত হন ইমাম হাসান রা.। হজরত মুয়াবিয়া রা. কুফা দখল করতে আসলে ইমাম হাসান কিছু শর্ত সাপেক্ষে হযরত মুয়াবিয়া রা.-এর কাছে ক্ষমতা ছেড়ে দেন। এরপর সিরিয়া হয় মুসলিম জাহানের রাজধানী। সেখানে নামাজের কোন পরিবর্তন হয়নি।
তবে মক্কা মদিনায় থাকা সাহাবারা রামাদানে সওয়াব হাসিল করার জন্য প্রতিযোগিতা করতেন। সেই সূত্রে এই পরিবর্তন। তারাবীহ সবসময় দুই রাকায়াত করে পড়া হতো। তবে চার রাকায়াতের পর সাহাবারা কিছুক্ষণ বিশ্রাম করতেন। এসময় তারা দোয়া করতেন ও তাসবিহ পাঠ করতেন। মুয়াবিয়া রা.-এর সময়ে মক্কার সাহাবারা চিন্তা করলেন বসে থেকে কী লাভ! আমরা এই সময়ে কা'বা তাওয়াফ করি। তখন কা'বায় প্রতি চার রাকায়াতের পর তাওয়াফ শুরু হয়। এভাবে তাঁরা নামাজের সময়ে চারবার তাওয়াফ করতেন।
এই খবর মদিনায় চলে যায়। তাঁরা চিন্তা করেন আমরা প্রতিযোগিতায় পেছনে পড়ে যাচ্ছি। তাই তাঁরা রাকায়াত সংখ্যা দিলেন বাড়িয়ে। প্রতি তাওয়াফের জন্য চার রাকায়াত বাড়িয়ে মোট ৩৬ রাকায়াত পড়া শুরু করলেন। এভাবে চলে কিছু বছর। এরপর যখন উমাইয়া খলিফা উমার ইবনে আব্দুল আজিজ ক্ষমতায় আসেন তখন আবার পরিবর্তন হয়। উমার ইবনে আব্দুল আজিজকে ইসলামের পঞ্চম খলিফা হিসেবেও অবিহিত করা হয়। উমাইয়া শাসকদের ভোগ বিলাস তিনি বন্ধ করে আবার খুলাফায়ে রাশেদার নীতিতে রাষ্ট্র পরিচালনা করা শুরু করেন। তিনি মক্কা মদিনাতে এভাবে চলা তারাবীহকে আবার হযরত আলী রা.-এর আমলের মতো করে ফেলেন। মক্কায় আনুষ্ঠানিক তাওয়াফ বন্ধ করেন এবং মদিনায় অতিরিক্ত ১৬ রাকায়াত বাদ দেন।
এরপর থেকে আমার জানামতে আর কোনো পরিবর্তন হয়নি। এভাবেই চলছে। হযরত আলী রা.-এর নিয়ম অনুসারে যিনি মসজিদের নিয়মিত ইমাম তিনি এশা ও বিতর পড়ান। নতুন নিয়োগকৃত হাফেযরা তারাবীহ পড়েন।
তারাবীহ নামাজের নাম তারাবীহ আনুষ্ঠানিকভাবে হয়নি। সাহাবারা বলতে বলতে এর নাম ধীরে ধীরে তারাবীহ হয়ে পড়ে। তারাবীহ মানে হলো বিশ্রাম। যেহেতু তারাবীহ পড়তে গিয়ে বিশ্রাম নিতে হতো তাই তাঁরা বিশ্রামের নামাজ বলতে বলতে এই এর নাম সালাতুত তারাবীহ হয়ে পড়ে।
আমাদের জন্য করণীয় কী?
আমাদের জন্য উত্তম হলো মসজিদে জামায়াতের সাথে তারাবীহ আদায় করা। যে মসজিদে যত সংখ্যক রাকায়াত হয় তত সংখ্যক পড়া। আর মসজিদের কর্তৃপক্ষের জন্য উচিত হলো বিশ রাকায়াত নামাজ কুরআন খতমের সাথে আদায়ের ব্যবস্থা করা। এটা উত্তম। জরুরি নয়। এটা নফল বা অতিরিক্ত নামাজ। কেউ যদি এই নামাজ না পড়েন, কম পড়েন বা বেশি পড়েন তবে তাঁর কোনো সমস্যা নেই এবং রোজার কোনো ক্ষতি হবে না। তবে মসজিদে যত রাকায়াত পড়া হয় আপনি যদি তার সাথে ভিন্নতা করেন তবে উচিত হবে বাসায় পড়া। অবশ্যই মসজিদে ও সমাজে বিতর্ক সৃষ্টি করা, ফিতনা তৈরি করা বড় গুনাহ।
আল্লাহ তায়ালা আমাদের সহীহ বুঝ দান করেন। আমীন।
বি. দ্র.: এ বছর মহামারির জন্য উত্তম হলো বাসায় তারাবীহ আদায় করা।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন