২৯ জুন, ২০২০

নিয়ামতের শুকরিয়া আদায় না করার পরিণাম



ঘটনাটি রাসূল সা. পৃথিবীতে আসার আগেরকার। ইয়েমেনে কিছু লোক খুব ধনী ছিলো। তাদের গ্রাম ছিল যারওয়ান, যা সানাআ হতে ছয় মাইল দূরের অবস্থিত। তারা তাদের বাবার কাছ থেকে পেয়েছিল বিশাল ফলের বাগান। ফলের চাষ ও ব্যবসা করে তারা বিশাল সম্পদের মালিক হয়। তারা যদিও বিশ্বাসী ছিলো তবে তারা ভালো প্রকৃতির লোক ছিলো না। তারা তাদের সম্পদ থেকে ফকির মিসকিনদের জন্য খরচ করতে চাইতো না। তাদের সম্পদে থাকা গরীবদের হক তারা আত্মসাৎ করতো। 

কিন্তু তাদের পিতার নীতি এই ছিলো ভিন্ন। তিনি বাগানে উৎপাদিত ফল ও শস্যের মধ্য হতে বাগানের খরচ বের করে এবং নিজের ও পরিবার পরিজনের সারা বছরের খরচ বের করে নিয়ে বাকীগুলো আল্লাহর নামে সাদাকা করে দিতেন। তাদের পিতার ইন্তেকালের পর তাঁর এই সন্তানরা পরস্পর পরামর্শ করে বললো, “আমাদের পিতা বড়ই নির্বোধ ছিলেন। তা না হলে তিনি এতোগুলো ফল ও শস্য প্রতি বছর এদিক-ওদিক দিয়ে দিতে পারতেন না। 

আমরা যদি এগুলো ফকীর মিসকীনদেরকে প্রদান না করি এবং তা যথারীতি সংরক্ষণ করি তবে দ্রুতই আমরা আরো ধনী হয়ে যাবো।” তারা মিসকিনদের ফসল না দেওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলো। কিন্তু তাদের মধ্যে একজন বারংবার নিষেধ করেছিলো এরকম সিদ্ধান্ত নিতে। তিনি তাদেরকে আল্লাহর শাস্তির করা স্বরণ করিয়ে দিচ্ছিলেন। তিনি অপরাপর সঙ্গীদের সম্পদ দেওয়ার জন্য আল্লাহ তায়ালার নিকট কৃতজ্ঞ থাকতে বলেছিলেন। কিন্তু কেউ তার কথা শোনেনি। 

হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. বলেন যে, তাদের আঙ্গুরের বাগান ছিল। যেহেতু তারা মিসকিনদের কোন ফল দিবে না তাই তারা চেয়েছিলো খুব সকালেই ফল আহরণ করে নিতে। তারা চুপে চুপে কথা বলতে বলতে তাদের বাগানের দিকে চললো যাতে কেউ শুনতে না পায় এবং গরীব মিসকীনরা কোন টের না পায়। তারা একে অপরকে বলেছিলো, 'তোমরা সতর্ক থাকবে, যেন কোন গরীব মিসকীন টের পেয়ে আজ আমাদের বাগানে আসতে না পারে। কোনক্রমেই কোন মিসকীনকে আমাদের বাগানে প্রবেশ করতে দিবে না।’ এভাবে দৃঢ় সংকল্পের সাথে গরীব দরিদ্রদের প্রতি ক্রোধের ভাব নিয়ে তারা তাদের বাগানের পথে যাত্রা শুরু করলো। 
তারা মনে করেছিলো তাদের বাগান চিরদিনই তাদের থাকবে। তাদের দৃঢ় বিশ্বাস ছিল যে, বাগানের ফল তাদের দখলে রয়েছে। সুতরাং তারা ফল আহরণ করে সবই বাড়ীতে নিয়ে আসবে। কিন্তু বাগানে পৌঁছে তারা হতভম্ব হয়ে পড়ে। তারা তাদের বাগানে গিয়ে দেখে সবুজ-শ্যামল শস্যক্ষেত এবং পাকা পাকা ফলের গাছ সব ধ্বংস ও বরবাদ হয়ে গেছে। ফলসহ সমস্ত গাছ পুড়ে কয়লা হয়ে গেছে। এখন এগুলোর কোন মূল্য নেই। গাছগুলো জ্বলে গিয়ে কালো হয়ে গেছে। পুরো বাগানে এক ভয়াবহ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।  

এই দৃশ্য দেখে তারা প্রথমে ভেবেছিলো তারা ভুল করে অন্য কোন বাগানে এসে পড়েছে। আবার দিশেহারা হয়ে তারা বললো, ‘আমাদের বাগান তো এটাই, কিন্তু আমরা হতভাগ্য বলে আমরা বাগানের ফল লাভে বঞ্চিত হয়ে গেলাম। তাদের মধ্যে যে ব্যক্তি সৎ ও ন্যায়পন্থী ছিল সে তাদেরকে বললো, “দেখো, আমি তো তোমাদেরকে পূর্বেই বলেছিলাম যে, তোমরা কেন আল্লাহ্ তা'আলার পবিত্রতা ঘোষণা এবং প্রশংসা করছো না? এ কথা শুনে তারা বললো, আমাদের প্রতিপালক পবিত্র ও মহান। নিশ্চয়ই আমরা নিজেদের উপর যুলুম করেছি। 

যখন শাস্তি পৌঁছে গেল তখন তারা আনুগত্য স্বীকার করলো, যখন আযাব এসে পড়লো তখন তারা নিজেদের অপরাধ মেনে নিলো। অতঃপর তারা একে অপরকে তিরস্কার করতে লাগলো এবং বলতে থাকলো। আমরা বড়ই মন্দ কাজ করেছি যে, মিসকীনদের হক নষ্ট করতে চেয়েছি এবং আল্লাহ্ পাকের আনুগত্য করা হতে বিরত থেকেছি। 

তারপর তারা সবাই বললো, এতে কোন সন্দেহ নেই যে, আমাদের হঠকারিতা সীমা ছাড়িয়ে গেছে। এ কারণেই আমাদের উপর আল্লাহর আযাব এসে পড়েছে। অতঃপর তারা বললোঃ ‘সম্ভবতঃ আমাদের প্রতিপালক আমাদেরকে এর চেয়ে উত্তম বিনিময় প্রদান করবেন। অর্থাৎ দুনিয়াতেই তিনি আমাদেরকে এর চেয়ে ভাল বদলা দিবেন। অথবা এও হতে পারে যে, আখিরাতের ধারণায় তারা এ কথা বলেছিল। এসব ব্যাপারে আল্লাহ তা'আলাই সবচেয়ে ভাল জানেন। 

এই ঘটনার বর্ণনা আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা সূরা ক্বালামের ১৭ থেকে তেত্রিশ নং আয়াতে উল্লেখ করেছেন। আল্লাহ বলেন, 
//আমি তাদেরকে পরীক্ষায় ফেলেছি যেভাবে পরীক্ষায় ফেলেছিলাম বাগানের মালিকদেরকে, যখন তারা শপথ করেছিল যে, তারা খুব ভোরে গিয়ে নিজেদের বাগানের ফল আহরণ করবে। তারা এ ব্যাপারে কোনো ব্যতিক্রমের সম্ভবনা স্বীকার করেছিলো না। অতঃপর তোমার রবের পক্ষ থেকে একটি বিপর্যয় এসে সে বাগানে চড়াও হলো। তখন তারা ছিলো নিদ্রিত। বাগানের অবস্থা হয়ে গেলো পোড়া ফসলের মতো। ভোরে তারা একে অপরকে ডেকে বললো, তোমরা যদি ফল আহরণ করতে চাও তাহলে সকাল সকাল ফসলের মাঠের দিকে বেরিয়ে পড়ো। 

সুতরাং তারা বেরিয়ে পড়লো। তারা নীচু গলায় একে অপরকে বলছিলো, আজ যেন কোনো অভাবী লোক বাগানে না আসতে পারে। তারা কিছুই না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে খুব ভোরে এমনভাবে দ্রুত সেখানে গেল যেন তারা (ফল আহরণ করতে) সক্ষম হয়। কিন্তু বাগানের অবস্থা দেখার পর বলে উঠলো, আমরা রাস্তা ভুলে গিয়েছি। তাও না- আমার বরং বঞ্চিত হয়েছি। 
তাদের মধ্যকার সবচেয়ে ভাল লোকটি বললো, আমি কি তোমাদের বলিনি? তোমরা তাসবীহ করছো না কেন? তখন তারা বলে উঠলো, সুবহানআল্লাহ। বাস্তবিকই আমরা গোনাহগার ছিলাম।

এরপর তারা সবাই একে অপরকে তিরষ্কার করতে লাগলো। অবশেষে তারা বললো, "আমাদের এ অবস্থার জন্য আফসোস! আমরা তো বিদ্রোহী হয়ে গিয়েছিলাম। বিনিময়ে আমাদের রব হয়তো এর চেয়েও ভাল বাগান আমাদের দান করবেন। আমরা আমাদের রবের দিকে রুজু করছি।//  

মুসনাদে আহমাদে হযরত ইবনে মাসউদ রা. হতে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন, “তোমরা গুনাহ হতে বেঁচে থাকো। জেনে রেখো যে, পাপের কারণে বান্দাকে ঐ রিযিক হতে বঞ্চিত রাখা হয় যা তার জন্যে তৈরি করে রাখা হয়েছিল।” অতঃপর তিনি বলেন, ঐ লোকগুলো তাদের পাপের কারণে তাদের বাগানের ফল ও শস্য লাভ হতে বঞ্চিত হয়েছিল। 

১৭ নং আয়াতে আল্লাহ তায়ালা "আমি তাদেরকে পরীক্ষায় ফেলেছি যেভাবে পরীক্ষায় ফেলেছিলাম বাগানের মালিকদেরকে" এখানে তাদের বলতে মক্কাবাসীদের বুঝিয়েছেন এবং উদাহরণ হিসেবে বাগান মালিকদের কথা উল্লেখ করেছেন। আলোচ্য ঘটনা আমাদের জন্য শিক্ষা হয়ে রইলো। আল্লাহর নিয়ামত লাভ করেও তারা সে জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেনি। বরং তাদের মধ্যকার সর্বোত্তম ব্যক্তিটির কথাও তারা যথাসময়ে মেনে নিয়নি। অবশেষে তারা সে নিয়ামত থেকে বঞ্চিত হয়েছে। 

যখন তাদের সবকিছুই ধ্বংস ও বরবাদ হয়ে গিয়েছে তখনই কেবল তাদের চেতনা ফিরেছে। এ উদাহরণ দ্বারা মক্কীবাসীকে এভাবে সাবধান করা হয়েছে যে, রাসুল সা.-কে রসূল করে পাঠানোর কারণে তোমরাও ঐ বাগান মালিকদের মতো পরীক্ষার সম্মুখীন হয়েছো। তোমরা যদি তাকে না মানো তাহলে দুনিয়াতেও শাস্তি ভোগ করতে থাকবে। আর এ জন্য আখেরাতে যে শাস্তি ভোগ করবে তাতো এর চেয়েও বেশি কঠোর। 

আল্লাহ তায়ালা আমাদের হিদায়াতের পথে রাখুন। ঈমানের যে দৌলত দান করেছেন আমরা যেন তার জন্য আল্লাহর নিকট কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করি। আমরা যেন আল্লাহ ও তার রাসূলের যথাযথ আনুগত্য করি। মানুষের হক প্রদানে যাতে কোন কার্পণ্য না করি। আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা আমাদের কবুল করুন। আমীন। 

২৮ জুন, ২০২০

সাইয়্যেদ মুনাওয়ার : ধ্বংসাত্মক রাজনীতি থেকে আলোর পথে



সাইয়্যেদ মুনাওয়ার ছিলেন পাকিস্তান জামায়াতের সাবেক আমীর। যে বছর জামায়াত প্রতিষ্ঠিত হয় সে বছরই দিল্লীতে জন্ম নেন সাইয়্যেদ মুনাওয়ার হাসান। এরপর সাতচল্লিশে দেশভাগের সময় পাকিস্তানের করাচিতে চলে আসে তার পরিবার। মাধ্যমিক থেকেই মুনাওয়ার যুক্ত হয়েছেন সমাজতন্ত্রী আন্দোলনের সাথে। তার ধ্যান জ্ঞান ছিলো কার্ল মার্ক্স, লেনিন এবং তাদের আদর্শ। 

ছোটবেলা থেকে পড়ুয়া ও মেধাবী মুনাওয়ার যুক্ত ছিলে পাকিস্তানের বামপন্থী ছাত্র সংগঠন ন্যাশনাল স্টুডেন্ট ফোরামের (এনএসএফ) সাথে। ১৯৫৯ সালে তিনি করাচি এনএসএফের সভাপতি নির্বাচিত হন। কিন্তু তার পরের বছরই ঘটে যায় উল্টো ঘটনা। তরুণ মুনাওয়ারের কাছে এসে পড়ে মাওলানা মওদূদী ও নঈম সিদ্দিকীর কিছু বই। বইগুলো পড়ে ব্যকুল হয়ে পড়েন সাইয়েদ মুনাওয়ার হাসান। নিজের মুসলিম পরিচয় তার কাছে আবার নতুনভাবে ধরা পড়ে। 

১৯৬০ সালে তিনি তার বামপন্থী আদর্শ ত্যাগ করেন। ঈমান বিধ্বংসী রাজনীতি ছেড়ে দিয়ে যুক্ত হন ইসলামের সুমহান আদর্শে। নতুনভাবে তৈরি করেন নিজেকে। মেধাবী মুনাওয়ার হাসান অল্প সময়ের মধ্যেই নতুন আদর্শকে নিজের মধ্যে ধারণ করেন। শুধু তাই নই ইসলামের সুমহান আদর্শ প্রচার ও প্রতিষ্ঠা করার জন্য যোগ দেন ইসলামপন্থী ছাত্র সংগঠন ইসলামী জমিয়তে তালাবাতে।    

এর চার বছর পর মুনাওয়ার হাসান পাকিস্তান ইসলামী জমিয়তে তালাবার কেন্দ্রীয় সভাপতি নির্বাচিত হন। জীবনের প্রতিটা পদক্ষেপে তিনি তার দক্ষতা ও যোগ্যতার সুস্পষ্ট ছাপ অংকন করেন। ধারাবাহিকভাবে ইসলামী আন্দোলনে ভূমিকা রেখে ২০০৯ সালে তিনি পাকিস্তান জামায়াতে ইসলামীর আমীর নির্বাচিত হন। ২০১৪ সাল পর্যন্ত তিনি পাকিস্তান আমীরে জামায়াত হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। গত শুক্রবার অর্থাৎ ২৬ জুন ২০২০ সালে তিনি মহান প্রতিপালকের ডাকে সাড়া দিয়ে এই নশ্বর দুনিয়া ছেড়ে যান। 

জন্ম ও শৈশব   
সাইয়্যেদ মুনাওয়ার হাসান জন্মগ্রহণ করেন ভারতের দিল্লীতে। ১৯৪১ সালের ৫ আগস্টে মুনাওয়ার হাসান জন্ম নেন। তার শিশুবেলাতেই তিনি তার পরিবারের সাথে ভারত থেকে পাকিস্তানে চলে যান। এটা ছিল দেশ ১৯৪৭ এর দেশ বিভাগের সময়ের ঘটনা। সেসময়ের পাকিস্তানের রাজধানী করাচিতেই তার পরিবার সেটেল হয়। তার শৈশব ও শিক্ষাজীবন সবই কাটে করাচিতে। 

পড়াশোনা 
পড়াশোনায় আগ্রহী ও মেধার সাক্ষর রাখেন সাইয়্যেদ মুনাওয়ার হাসান। তিনি করাচি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দুইটি বিষয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। তার প্রথম বিষয় ছিলো সমাজবিজ্ঞান। পরে ইসলামী আদর্শে পরিবর্তিত হওয়ায় ইসলাম সম্পর্কে আরো বেশি জ্ঞান হাসিল করার উদ্দেশ্যে তিনি ইসলামিক স্টাডিজে মাস্টার্স করেন। এছাড়াও তিনি ভার্সিটিতে একজন ভালো বক্তা হিসেবে সুপরিচিত ছিলেন। একইসাথে তিনি ভালো বিতার্কিকও ছিলেন। 

ছাত্র রাজনীতি
স্কুল জীবন থেকেই মুনাওয়ার হাসান বামপন্থী আন্দোলনের সাথে যুক্ত হয়ে পড়েন। ১৯৫৭ সালে এনএসএফের নেতা হিসাবে রাজনৈতিক ক্যারিয়ার শুরু করেছিলেন। ১৯৫৯ সালে তিনি এনএসএফের করাচি'র সভাপতি নির্বাচিত হন। তবে ১৯৬০ সালে তিনি আদর্শিক মোড় নিয়ে ইসলামী জমিয়তে তালাবাতে যোগ দেন।

১৯৬৭ সালে মূলধারার জাতীয় রাজনীতিতে যোগদান না করা পর্যন্ত তিনি ইসলামী জমিয়তে তালাবার বিভিন্ন পদে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৬২ সালে জমিয়তে তালাবার করাচি বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি হিসাবে নির্বাচিত হন। এর পরের বছর তিনি জমিয়তে তালাবার করাচি শাখার সভাপতি হিসেবে নির্বাচিত হন।

১৯৬৪ সালে সাইয়্যেদ মুনাওয়ার হাসান ইসলামী জমিয়তে তালাবার কেন্দ্রীয় সভাপতি হিসেবে নির্বাচিত হন। তিনি পর পর তিন বছর একই পদে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি পাকিস্তানের ছাত্রদের কাছে ও ইসলামপ্রিয় জনতার কাছে খুবই জনপ্রিয় ছিলেন। করাচির লোকেরা তাকে ভালোবেসে দিল্লিওয়ালা ভাই ও মুন্নু ভাই নামে ডাকতো। 

জাতীয় রাজনীতিতে পদার্পন
১৯৬৭ সালে মুনাওয়ার হাসান জামায়াতে ইসলামীতে যোগদানে মাধ্যমে পাকিস্তানের জাতীয় রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করেন। তিনি ১৯৭৭ সালে জাতীয় নির্বাচনে করাচির একটি আসন থেকে জামায়াতের মনোনয়ন নিয়ে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেন। সাইয়্যেদ মুনাওয়ার হাসান তার আসন থেকে সর্বোচ্চ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হন। কিন্তু এরপর সামরিক শাসন জারি করে এই নির্বাচনের ফলাফল বাতিল করা হয়। 

১৯৮৫ সাল থেকে ১৯৯১ সাল পর্যন্ত মুনাওয়ার হাসান জামায়াতের করাচি শাখার আমীরের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯১ সালে তিনি পাকিস্তান জামায়াতের কেন্দ্রীয় সহকারি সেক্রেটারি হিসেবে নিযুক্ত হন। ১৯৯২ সালে তিনি কেন্দ্রীয় সেক্রেটারি  হিসেবে দায়িত্ব পালন শুরু করেন। সেসময় পাকিস্তানের আমীরে জামায়াত ছিলেন কাজী হুসাইন আহমদ। সেসময় থেকে মুনাওয়ার হাসান করাচি থেকে জামায়াতের সদর দপ্তর লাহোরে চলে আসেন। এরপর ২০০৯ সালে তিনি পাকিস্তান জামায়াতের ৪র্থ আমীর হিসেবে নির্বাচিত হন। ২০১৪ সাল পর্যন্ত তিনি এই দায়িত্ব পালন করেন। 

সাদাসিদে জীবনযাপন
সাইয়্যেদ মুনাওয়ার হাসান তার প্রথম জীবনে একটি কলেজে শিক্ষকতা শুরু করেন। এরপর ইসলামিক রিচার্স একাডেমিতে যোগদান করেন। ১৯৬৯ সালে তিনি রিচার্স একাডেমির সেক্রেটারি হন। এছাড়াও তিনি নানান সময় বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে অতিথি শিক্ষক হিসেবে ক্লাস নেন। সাংগঠনিক দায়িত্ব পালনের নিমিত্তে তিনি স্থায়ীভাবে তার পেশাগত কাজ করতে পারেন নি। শেষদিকে জামায়াত কর্তৃক নির্ধারিত সামান্য ভাতাই ছিল তার জীবিকার উৎস। কয়েক দশক ধরে তিনি করাচিতে জামায়াত নেতা নেয়ামতুল্লাহ খানের বাড়ির দুটি রুম নিয়ে থাকতেন। 

তার স্ত্রী আয়েশা মুনাওয়ারও পুরোদস্তুর জামায়াতের রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলেন। তিনি মহিলা শাখার সেক্রেটারি জেনারেল হিসাবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন। মুনাওয়ার হাসান এতোটাই অনাড়ম্বর ছিলেন যে, তার মেয়ের বিয়েতে পাওয়া সমস্ত উপহার বায়তুল মালে জমা করে দিয়েছিলেন। পরহেজগারীতা ও আমানতদারীতায় তার মতো মানুষ দুনিয়ায় খুবই নগণ্য। তিনি তার সমগ্র জীবনে রাজনীতির চাইতে আদর্শকে বেশি প্রাধান্য দিতেন। 

হাসিনার জুলুমের ব্যাপারে তৎপরতা 
২০১৩ সালে পাকিস্তানের আমীরে জামায়াত ছিলেন সাইয়্যেদ মুনাওয়ার হাসান। তিনি সেসময় আমাদের ওপর হাসিনার জুলুমের ব্যাপারে বিশ্বব্যাপী ক্যাম্পেইন শুরু করেন। বাংলাদেশে জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধনকে অবৈধ ঘোষণা করে হাই কোর্টের আদেশের তীব্র নিন্দা করে বলেছেন, অন্যান্য মুসলিম দেশগুলোর উচিত বাংলাদেশ সরকারের উপর চাপ সৃষ্টি করা। একই সাথে তিনি যুদ্ধাপরাধের দায়ে জামায়াত নেতাদের বিচারের সমালোচনা করে বলেন, এগুলো বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয় নয়। তাঁর মতে, যে কোন মুসলিম দেশের বিষয়ে হস্তক্ষেপ করার অধিকার অন্যান্য মুসলিম দেশের আছে।

তিনি বাংলাদেশের ইসলামী আন্দোলনের ওপর জুলুমের ব্যাপারে মুসলিম রাষ্ট্রগুলোকে এগিয়ে আসার আহবান জানিয়েছেন। আমাদের দুর্দশার খবর সারা পৃথিবীর মুসলিম নেতাদের কাছে পৌঁছে দিয়েছেন। সাইয়্যেদ মুনাওয়ার হাসান আন্তর্জাতিক মিডিগুলোতে বলেছেন, বাংলাদেশের আওয়ামী সরকার তার জনপ্রিয়তা হারিয়েছে, এবং সে ’কারণে তারা জামায়াতে ইসলামীকে রাজনীতি থেকে বিতাড়িত করতে চায়। তিনি বলেন, জামায়াতকে সাহায্য করার জন্য অন্যান্য মুসলিম দেশগুলোর এগিয়ে আসা উচিত। তিনি অর্থনৈতিক চাপের দিকে ইঙ্গিত করে বললেন, এখানে অভ্যন্তরীণ বিষয় বলে কিছু নেই। বিশেষ করে সৌদি আরব এবং তুরস্ক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে বলে তিনি মনে করেন।

মুসলিম ভাইরা সব কিছুই করতে পারবে। বাংলাদেশ যেহেতু একটি মুসলিম রাষ্ট্র, তাই অন্যান্য মুসলিম দেশগুলো সব কিছুই করতে পারে। তবে বাংলাদেশে শুধু জামায়াতের নিবন্ধন অবৈধ করে হাইকোর্টের আদেশই নয়, পাকিস্তান জামায়াত প্রধান মনে করেন চলমান যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়াটা প্রশ্নবিদ্ধ এবং সেটা শুরু করাই উচিত ছিল না। তিনি দাবি করেন সত্তর দশকের শুরুর দিকে, বাংলাদেশ এবং পাকিস্তানের তৎকালীন সরকার প্রধান, অর্থাৎ শেখ মুজিবুর রহমান এবং জুলফিকার আলী ভুট্টোর মধ্যে একটি চুক্তি হয়েছিলো। ‘’চুক্তিতে বলা হয়েছিলো, কোন যুদ্ধাপরাধের বিচার হবে না, বা কোথাও কোন ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হবে না। 

কিন্তু পাকিস্তান সরকার এখনো কোন উচ্চ-বাচ্য করছে না, তারা বাংলাদেশ সরকারকে এই চুক্তি সম্পর্কে মনে করিয়ে দিচ্ছে না। পাকিস্তান সরকারের এই ভূমিকা নিয়ে প্রচন্ড ক্ষোভ প্রকাশ করে সাইয়্যেদ মুনাওয়ার হাসান বলেন, বাংলাদেশে জামায়াতে ইসলামী পাকিস্তানের জন্যই লড়াই করেছিল, কিন্তু এখন ইসলামাবাদ সরকারের নীরব ভূমিকায় জনগণ ক্ষুব্ধ। পাকিস্তানের জনগণ এটা নিয়ে মোটেই খুশি না। যখন যুদ্ধ চলছিল, ঐ দেশ বাংলাদেশ ছিল না, পূর্ব পাকিস্তান ছিল। কাজেই যারা পাকিস্তানের পক্ষে লড়াই করছিল, তারা আইন ও সংবিধান অনুযায়ী সঠিক কাজই করছিল। 

সাইয়্যেদ মুনাওয়ার হাসানের মতে, বাংলাদেশে জামায়াতে ইসলামীর নেতাদের সমর্থনে পাকিস্তান সরকার এবং সেনাবাহিনীর সবার আগে এগিয়ে আসা উচিত ছিল। জামায়াতে ইসলামী পাকিস্তানের আমির মনে করেন বাংলাদেশে জনমত যুদ্ধাপরাধ বিচারের বিপক্ষে চলে গেছে। তবে তাঁর মতে, ১৯৭১ সালে সংঘটিত কোন অপরাধের বিচার করার অধিকার বাংলাদেশ সরকারের নেই।

ইন্তেকাল
তিনি দীর্ঘদিন যাবত জটিল শারীরিক সমস্যায় ভুগছিলেন। সবশেষে চলমান মহামারী কোভিড-১৯-এ তিনি আক্রান্ত হন। ২৬ জুন শুক্রবার পবিত্র দিলে মহান রবের ডাকে সাড়া দিয়ে তিনি ইন্তেকাল করেন। আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা তাঁকে শাহাদাতের মর্যাদা দান করুন।

২৬ জুন, ২০২০

রেশমি রুমাল আন্দোলনের ইতিকথা



তুর্কিতে পায়িতাথ নামে একটি সিরিজ শুরু হয়েছিলো অনেক আগে। এর কিছু অসাধারণ ভিডিও ক্লিপ বাংলা সাবটাইটেল আকারে প্রচার হয়। তা থেকে উৎসাহিত হই। লকডাউনে কিছু পর্ব দেখি। এই সিরিয়ালের কেন্দ্রীয় চরিত্র উসমানীয় সুলতান আব্দুল হামিদ খান দ্বিতীয়। পরে ওনার সম্পর্কে পড়াশোনা করতে আবিষ্কার করি আমাদের উপমহাদেশে ওনার এক ব্যর্থ পরিকল্পনার কাহিনী। এই কাহিনী রেশমি রুমাল আন্দোলন নামে পরিচিত।

আব্দুল হামিদের মূল শত্রু ছিলো ব্রিটিশরা। ব্রিটিশরা বিভিন্ন মুসলিম অঞ্চল তাদের উপনিবেশে পরিণত করছে। এমনকি তুর্কি সালতানাতের অঞ্চলগুলো দখলের চেষ্টা চালায়, বিশৃঙ্খলা ও বিদ্রোহ উস্কে দেয়। শুধু তাই নয়, তারা গোটা তুর্কি সালতানাতই দখলের প্রচেষ্টা চালায় আব্দুল হামিদের সময়। আব্দুল হামিদও তাদের ষড়যন্ত্র দক্ষতার সাথে মোকাবেলা করতে থাকে।

এই মোকাবেলার অংশ হিসেবে আব্দুল হামিদ ব্রিটিশ শাসিত হিন্দুস্থানে ব্রিটিশ বিরোধী বিদ্রোহ করার পরিকল্পনা করে। তাঁর এই পরিকল্পনার সাথে যুক্ত হয় দেওবন্দি আলেম শাইখুল হিন্দ মাহমুদুল হাসান। দীর্ঘদিন থেকে চলে আসা পরিকল্পনার অংশ হিসেবে একটি বিপ্লবী দল গঠন করে মাহমুদুল হাসান তার ছাত্রদের দ্বারা।

এদিকে তুরস্কে ব্রিটিশদের তত্ত্বাবধানে তরুণ তুর্কি নামে একদল সেক্যুলার যুবকদের উত্থান হয়। ১৯০৯ সালে তারা বিভিন্ন বিষয়ে স্বাধীনতার নামে সুলতান আব্দুল হামিদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে। আব্দুল হামিদ তার ছোট ভাইয়ের কাছে ক্ষমতা ছেড়ে দিতে বাধ্য হন। ফলে এদেশের স্বাধীনতা কামীদের সাথে তুরস্কের যোগাযোগে ফাটল সৃষ্টি হয়। ১৯১৪ সালে ১ম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়।

ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে অবস্থান হেতু তুরস্ক মুক্তিবাহিনীতে যোগ দেয়। তুরস্ক ভারতে বিদ্রোহ তৈরি করে ব্রিটিশদের চাপে ফেলার চেষ্টা করে। কিন্তু স্বাধীনতার মূল দাবীদার কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ আগেই ব্রিটিশদের সাথে সমঝোতা করে যদি তারা ব্রিটিশদের অনুগত থাকবে যুদ্ধের সময়। বিনিময়ে ভারতে স্বায়ত্বশাসন দেওয়া হবে। এজন্য তারা চুপ থাকে।

তুরস্ক বাধ্য হয়ে দেওবন্দি আলেম মাহমুদুল হাসানের সাথে যোগাযোগ করে আবার তাদের সংগঠিত করে। ভারতীয়দের মধ্যে স্বাধীনতাকামীর সংখ্যা কম ছিল না। তুর্কিরা জার্মানিতে অধ্যায়নরত কিছু ভারতীয় ছাত্র ও স্বাধীনতাকামী কিছু বুদ্ধিজীবীর মাধ্যমে বিদ্রোহের পরিকল্পনা করে। এই পরিকল্পনা সফল করার জন্য আফগানিস্তানের আমীরের সাথেও তারা যোগাযোগ করে। আফাগানিস্তান যদিও স্বাধীন ছিলো তথাপি তারা ব্রিটিশদের সাথে নানা চুক্তি ও ঘেরাও-এর মধ্যে ছিল। কার্যত অনেকটাই ব্রিটিশ অনুগত থাকতে হতো।

তুরস্ক এ সময় মাওলানা মাহমুদুল হাসানকে তুর্কি ও আফগান সরকারের সাথে প্রত্যক্ষ আলাপ আলোচনার জন্য দায়িত্ব দেয়। তাদের এই কার্যক্রম ব্রিটিশ সরকার টের পেয়ে যায়। মাহমুদুল হাসান ও সঙ্গীদের বিরুদ্ধে গ্রেফতারী পরোয়ানা জারি হয়। মাহমুদুল হাসান তার ছাত্র ওবাইদুল্লাহ সিন্ধিকে পাঠিয়ে দেন কাবুলের পথে এবং নিজে রওনা হন মক্কার পথে। কাবুলে পাঠানোর উদ্দেশ্য ছিল আফগান সরকারের সহযোগিতা নিশ্চিত করা ও আফগান সীমান্তে থাকা স্বাধীনতাকামীদেরকে সংগঠিত করে ভারতের আজাদী আন্দোলনের কাজে লাগানোর ব্যবস্থা করা।

ওবাইদুল্লাহ সিন্ধি কাবুল পৌঁছেন। কাবুল আমীরকে সহযোগিতায় রাজি করান। তিনি তুর্কি ও জার্মানি মিশনের সাথে কাজ করতে রাজি হন। ওবাইদুল্লাহ সিন্ধি সেখানে গিয়ে অনেক স্বাধীনতাকামীদের দেখতে পান এবং সেখানে একটি অস্থায়ী ভারত সরকার গঠন করেন। তুর্কি- জার্মান মিশনের সমন্বয়কারী প্রতিনিধি রাজা মহেন্দ্র প্রতাপকে এই সরকারের প্রেসিডেন্ট, বরকতুল্লাহ প্রধানমন্ত্রী এবং উবায়দুল্লাহ সিন্ধি প্রতিরক্ষা মন্ত্রীর দায়িত্ব নেন।

এদিকে মাহমুদুল হাসান মক্কা পৌঁছেন। মক্কা মদিনা তখন ছিল তুর্কি খেলাফতের অংশ। তিনি গিয়ে তুর্কি গভর্নর গালিব পাশার সাথে সাক্ষাত করেন। গালিব পাশার তখন ধর্মীয় প্রভাব ছিল অনেক। তিনি দুটি পত্র লিখেন। একটি পাঠানো হয় মদিনার গভর্নর বসরী পাশার কাছে আরেকটি আফগান গোত্রপতি মুসলমানদের কাছে। এতে ইংরেজদের বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ সংগ্রামের আহ্বান ছিল।

সেসময় তুর্কি যুদ্ধমন্ত্রী আনোয়ার পাশা মদিনায় এসেছিলেন। মাহমুদুল হাসান তার সাথে সাক্ষাতে করেলেন। তিনি বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনে সহায়তার চুক্তি সাক্ষর করলেন। তিনি শায়খুল হিন্দকে তিনটি চিঠি লিখে দিলেন। একটি ছিল অস্থায়ী ভারত সরকার ও তুর্কি সরকারের মধ্যকার চুক্তিনামা। দ্বিতীয়টি মুসলিম নেতৃবৃন্দের কাছে শায়খুল হিন্দকে সর্বাত্মক সহযোগিতার আহ্বান। তৃতীয়টি ছিল আফগান সরকারের প্রতি।

আনোয়ার পাশার সাথে সাক্ষাতের সময় সেখানেই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় আফগান সরকার সম্মত থাকলে তুর্কি বাহিনী সীমান্তে অবস্থান নিবে। সুযোগমতো সেই বাহিনী ভারতে প্রবেশ করবে এবং অভ্যুত্থান ঘটাবে। সেই সময় শায়খুল হিন্দ আফগানিস্তান থেকে সামগ্রিক দিক নির্দেশনা দিবেন এবং তুর্কি বাহিনীর রসদের যোগান দিবেন এক্ষেত্রে সাহায্য করবেন আফগান আমীর।

ওবাইদুল্লাহ সিন্ধির নেতৃত্বে এই পত্র আফগান সরকারের নিকট পৌঁছানো হল। কিন্তু তিনি ব্রিটিশদের চাপের কথা তুলে প্রথমে সম্মতি দিতে চাইলেন না। পরে এই মর্মে চুক্তি হলো আফগান সরকার নিরপেক্ষ থাকবে সাহায্য যা করার গোপনে করবে এবং তুর্কি বাহিনী আফিগান সীমান্ত দিয়েই ভারতে প্রবেশ করবে। আর যদি কোন আফগানী এই যুদ্ধে যেতে চায় তাহলে সরকারের পক্ষ থেকে কোন নিষেধ থাকবেনা। ইংরেজদেরকে দেওয়ার জন্য কৈফিয়তও প্রস্তুত রাখা হল, “সীমান্তের স্বাধীনতাকামীদের নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যর্থ হয়েছে আফগান সরকার”।

উবাইদুল্লাহ সিন্ধি মাহমুদুল হাসানের বার্তা পাঠান হিন্দুস্থানে অবস্থানরত দেওবন্দীদের কাছে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে এই চিঠি ধরা পড়ে যায় ব্রিটিশ গোয়েন্দাদের কাছে। পুরো প্ল্যান ফাঁস হয়ে যায়। কওমী নেতাদের এরেস্ট করা শুরু করে ব্রিটিশ সরকার। তুর্কিদের একটি প্ল্যান এভাবে ভেস্তে যায়। উবায়দুল্লাহ সিন্ধি আফগানিস্তান থেকে তুর্কিতে পালিয়ে যায়। ফলে তাকে এরেস্ট করা সম্ভব হয়নি। তবে মূল নেতা মাহমুদুল হাসান মক্কায় এরেস্ট হন। মক্কায় তখন শরিফ হুসেইন নামে এক হাশেমীয় নেতা ব্রিটিশদের সহায়তায় বিদ্রোহের প্রস্তুতি নিতে থাকে। শরীফ খুব জনপ্রিয় ছিলো আরবদের কাছে। ব্রিটিশরা শরীফের সাহায্যে মাওলানা মাহমুদুল হাসানকে এরেস্ট করে।

এরপর মাহমুদুল হাসান, হোসাইন আহমেদ মাদানীসহ অপরাপর দেওবন্দী নেতাদের দ্বীপরাষ্ট্র মাল্টায় নির্বাসন দেন। তিন বছর পর ১৯২০ সালের শুরুতে তাদের মুক্তি দেওয়া হয়। মুক্তি পেয়ে তারা খেলাফত আন্দোলনে যোগ দেন। তবে মাহমুদুল হাসান আর বেশিদিন বাঁচেন নি। ওই বছরই নভেম্বরে তিনি ইন্তেকাল করেন। ইন্তেকালের আগে আযাদি আন্দোলনে কংগ্রেসকে সহায়তা ও মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধির সাথে দেওবন্দীদের আন্দোলন করার পরামর্শ দেন।

তার সিদ্ধান্ত অনুসারে দেওবন্দীদের সংগঠন জমিয়তে উলামায়ে হিন্দ সবসময় মুশরিকদের সংগঠন কংগ্রেসকে সাপোর্ট করে এবং মুসলিম লীগের বিরোধীতা করে। তবে এই মতের বিরোধী ছিলেন আরেক দেওবন্দী আলেম হাকিমুল উম্মত আশ্রাফ আলী থানবী রহ.। পাকিস্তান আন্দোলন যখন চরমে তখন মাওলানা থানবী'র অনুসারী সাব্বির আহমেদ ওসমানী জমিয়তে উলামায়ে হিন্দ থেকে আলাদা হয়ে জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম নামে আলাদা আরেকটি সংগঠন তৈরি করেন। এই সংগঠন পাকিস্তান আন্দোলনকে সাপোর্ট করেন এবং মুসলিম লীগের পক্ষে কাজ করেন।

মাওলানা মাহমুদুল হাসানের এই বিদ্রোহ রেশমি রুমাল আন্দোলন নাম দিয়েছে মূলত ইংরেজরা। কারণ উবাইদুল্লা সিন্ধি বার্তাটি লিখে পাঠান একটি রুমালে করে যা রেশমি কাপড়ের ছিলো। অর্থাৎ ইংরেজ গোয়েন্দারা যে চিঠিটি পায় তা লেখা রেশমি কাপড়ের রুমালে। সেখান থেকেই এই আন্দোলনের এরূপ নাম হয়।

রেশমী রুমাল আন্দোলন হিন্দুস্তানে ইংরেজের সাথে যুদ্ধ করার সেনাদল তৈরি করে তার নাম দেয় ‘জুনুদে রব্বানিয়া'। নিম্নোক্ত নেতৃবর্গ ছিলেন এ সেনাদলের প্রথম সারিতে :
প্রধান পৃষ্ঠপোষক : তুরস্কের সুলতান মেহমেদ খান পঞ্চম, ইরানের সুলতান আহমদ শাহ কাচার, আফগানিস্তানের আমীর হাবিবুল্লাহ খান।

সহকারী পৃষ্ঠপোষক : আনোয়ার পাশা, তুরস্কের যুবরাজ, তুরস্কের প্রধানমন্ত্রী, আফগানিস্তানের সহকারী রাষ্ট্রপ্রধান সরদার নসরুল্লাহ খান, হায়দরাবাদের নিজাম, ভূপালের নওয়াব, রামপুরের নওয়াব, বাহাওয়ালপুরের নিজাম, ইয়াগিস্তানের মুজাহিদ দলের প্রধান।
প্রধান সেনাপতি : শায়খুল হিন্দ মওলানা মাহমুদুল হাসান এবং সহকারী সেনাপতি : মওলানা উবাইদুল্লাহ সিন্ধী।

বিভাগীয় সেনাপতিবৃন্দ : মওলানা আবদুর রহীম, মওলানা গোলাম মুহাম্মাদ দীনপুরী, মওলানা তাজ মাহমুদ আনরুজ, মওলবী হুসাইন আহমদ মাদানী, মওলবী হামদুল্লাহ, হাজী তরঙ্গ যই, ডা. মুখতার আহমদ আনসারী, মুল্লা সাহেব বাবড়া, জান সাহেব বাজোড়, মওলবী মুহাম্মাদ মিয়া, হাকিম আবদুর রাজ্জাক, মওলবী উবাইদুল্লাহ গাজীপুর, মওলবী আবদুল বারী ফিরিঙ্গী মহলী, মওলানা আবুল কালাম আযাদ, মওলানা মুহাম্মদ আলী জওহর, মওলানা শওকত আলী, মওলানা জাফর আলী খান, মওলানা হাসরাত মোহানী, মওলবী আবদুল কাদের কাসুরী ও পীর আসাদুল্লাহ শাহ সিন্ধী।

রেশমী রুমাল আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী নেতৃবর্গের সংখ্যা দুশ' বাইশের মতো। সাধারণ লোকেরাও এর মধ্যে ব্যাপকভাবে অংশগ্রহণ করে চলছিল। উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ থেকে শুরু করে সিন্ধু, পাঞ্জাব, দিল্লী, অযোধ্যা পর্যন্ত এর প্রভাব বিস্তার লাভ করতে শুরু করেছিল।

২৪ জুন, ২০২০

বঙ্গকথা পর্ব-৪২ : লাহোর প্রস্তাব থেকে পাকিস্তান আন্দোলন



পাকিস্তানের চিন্তাভাবনা অথবা পরিকল্পনা কোন অভিনব রাজনৈতিক দশর্ন নয়। এটি হুট করে হিন্দুস্থানে নাজিল হয়নি। ধারাবাহিকভাবে এর একটি প্রয়োজনীয়তা তৈরি হয়েছে। লর্ড কার্জন কর্তৃক শুধুমাত্র প্রশাসনিক কারণে ১৯০৫ সালে বাংলাকে ভেঙে আরেকটি প্রদেশ তৈরি করা হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে মুশরিকদের বঙ্গভঙ্গরদ আন্দোলন এবং ১৯১১ সালে তা রহিতকরণ থেকে শুরু। এরপর উপমহাদেশের যত্রতত্র এবং যখন তখন মুসলমাদের গায়ে পড়ে হিন্দুদের পক্ষ থেকে সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষ সৃষ্টি এবং মুসলমানদের জানমালের প্রভূত ক্ষতিসাধন করে মুশরিকরা। মুসলিম লীগের পক্ষ থেকে বার বার সমঝোতা করার চেষ্টা করা হলেও কংগ্রেস তথা হিন্দুত্ববাদীদের হটকারিতায় সেটা সম্ভব হয়নি। সর্বশেষ ১৯৩৭ সালের নির্বাচনের পর সাতটি প্রদেশে আড়াই বছর কংগ্রেসের কুশাসন মুসলিমদের আলাদা রাষ্ট্রের কথা তীব্রভাবে ভাবতে শিখায়। 

হিন্দুস্থানে মুশরিকরা বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ ও শক্তিশালী হওয়ার কারণে মুসলিম জাতিকে হয় তাদের দাসানুদাস বানিয়ে রাখতে অথবা নির্মূল করতে চায়। এ লক্ষ্য হাসিলে জন্যেই কংগ্রেসের দাবী ছিল এই যে এ উপমহাদেশের অধিবাসীদের একমাত্র রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস এবং ব্রিটিশ সরকারকে তার হাতেই ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে। হিন্দু সভ্যতা সংস্কৃতি ও হিন্দুধর্মের পুনর্জাগরণ এবং হিন্দুরামরাজ্য স্থাপনই ছিল কংগ্রেসের একমাত্র লক্ষ্য। কংগ্রেস ও তার কর্মকর্তাদের বিভিন্ন সময়ের বিভিন্ন আচরণে এ বিশ্বাস মুসলমানদের হৃদয়ে বদ্ধমূল হয় এবং এ কারণেই মুসলমানগণ পাকিস্তান আন্দোলন করতে বাধ্য হন।

মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ বলেন, পাকিস্তানের সূচনা তখন থেকে হয় যখন মুহাম্মদ বিন কাসিম বিজয়ীর বেশে হিন্দুস্থানে পদার্পণ করেন। অতঃপর এ উপমহাদেশে কয়েকশত বছর ইসলামী রাষ্ট্র ব্যবস্থা বলবৎ থাকে। বৃটিশ শাসনের শেষের দিকে পুনরায় বৃটিশ ভারতে মুসলিম জাতির স্বাতন্ত্র ও রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠর চিন্তভাবনা ও প্রচেষ্টা শুরু হয়। উপমহাদেশে উত্তর-পশ্চিম ও দক্ষিণ- পূর্ব অঞ্চলগুলোতে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠতা আলাদা রাষ্ট্রের ব্যাপারে প্রেরণা দিয়েছিল। তাই বিশ্ব ইসলামী ঐক্যের অগ্রদূত সাইয়েদ জামালুদ্দীন আগগানী আফগানিস্তান এবং উপমহাদেশের উত্তর পশ্চিমাঞ্চল নিয়ে একটি মুসলিম রিপাবলিক গঠনের সম্ভাবনা সম্পর্কে প্রথম চিন্তাভাবনা করেন।

আল্লামা মুহাম্মদ ইকবাল ১৯৩০ সালে এলাহাবাদে অনুষ্ঠিত মুসলিম লীগের বার্ষিক সম্মেলনে ভারতের বিভিন্ন সমস্যা আলোচনার পর বৃটিশ সাম্রাজ্যের মধ্যেই অথবা বাইরে মুসলমানদের একটি স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনের প্রস্তাব উত্থাপন করেন। আল্লামা ইকবাল তাঁর প্রস্তাবিত মুসলিম রাষ্ট্রের কোনো নাম দেননি। এ কাজটি করেছেন চৌধুরী রহমত আলী। ১৯৩৩ সালের জানুয়ারী মাসে চৌধুরী রহমত আলী এবং তাঁর ক্যাম্ব্রিজের তিনজন সহকর্মী নাউ অর নেভার (Now or Never) শীর্ষক একটি প্রচারপত্র প্রকাশ করেন। চৌধুরী রহমত আলী তাঁর প্রচারপত্র ভারতের মুসলিম নেতৃবৃন্দের কাছে, লন্ডনে অনুষ্ঠিত তৃতীয় গোল টেবিল বৈঠকে যোগদানকারী মুসলিম ডেলিগেটদের কাছে এবং ইংলন্ডের প্রথম সারির রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের নিকটে প্রেরণ করেন। এই প্রচারপত্রেই তিনি পাকিস্তান শব্দটি ব্যবহার করেন। তিনি পাকিস্তান বলতে হিন্দুস্থানের উত্তরাঞ্চলে পাঁচটি প্রদেশ তথা পাঞ্জাব, উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ, কাশ্মীর, সিন্ধু ও বেলুচিস্তানকে বুঝিয়েছেন। এই প্রচারপত্রের মূল বিষয় ছিলো মুসলিমদের জন্য আলাদা রাষ্ট্র। ‘পাকিস্তান’ নামটি চৌধুরী রহমত আলীরই উদ্ভবন- যা লাহোর প্রস্তাবের মাধ্যমে হিন্দুস্থানের রাজনৈতিক অঙ্গনে প্রতিষ্ঠা লাভ করে এবং প্রায় সাত বছর পর তা বাস্তব সত্যে পরিণত হয়।

লাহোর প্রস্তাবের মূল বৈশিষ্ট্যসমূহ :
প্রথমত
 নিখিল ভারত মুসলিম লীগ দৃঢ়তার সাথে পুনঃঘোষণা করছে যে, ১৯৩৫ খ্রীস্টাব্দের ভারত শাসন আইন-এ যে যুক্তরাষ্ট্রের (Federal) পরিকল্পনা রয়েছে, তা এ দেশের উদ্ভূত অবস্থার প্রেক্ষিতে অসঙ্গত ও অকার্যকর বিধায় তা ভারতীয় মুসলমানদের জন্য অগ্রহণযোগ্য।

দ্বিতীয়ত 
সমস্ত সাংবিধানিক পরিকল্পনা নতুনভাবে বিবেচনা না করা হলে মুসলিম ভারত অসন্তুষ্ট হবে এবং মুসলমানদের অনুমোদন ও সম্মতি ব্যতিরেকে সংবিধান রচিত হলে কোন সংশোধিত পরিকল্পনাও তাদের নিকট গ্রহণযোগ্য হবে না।

তৃতীয়ত 
নিখিল ভারত মুসলিম লীগের সুচিন্তিত অভিমত এরূপ যে, ভারতে কোন শাসনতান্ত্রিক পরিকল্পনা কার্যকর হবে না যদি তা নিম্নবর্ণিত মূলনীতির উপর ভিত্তি করে রচিত না হয়:
ভৌগোলিক অবস্থান অনুযায়ী সংলগ্ন বা সন্নিহিত স্থানসমূহকে 'অঞ্চল' হিসেবে চিহ্নিত করতে হবে, প্রয়োজন অনুযায়ী সীমানা পরিবর্তন করে এমনভাবে গঠন করতে হবে যেখানে ভারতবর্ষের উত্তর-পশ্চিম ও পূর্বাঞ্চলের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান এলাকাগুলো 'স্বাধীন রাষ্ট্রসমূহ' (Independent States) গঠন করতে পারে, 'স্বাধীন রাষ্ট্রসমূহের' সংশ্লিষ্ট অঙ্গরাষ্ট্র বা প্রদেশসমূহ হবে স্বায়ত্বশাসিত ও সার্বভৌম।

চতুর্থত 
এ সমস্ত অঞ্চলের সংখ্যালঘুদের ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক, প্রশাসনিক ও অন্যান্য অধিকার ও স্বার্থরক্ষার জন্য তাদের সাথে পরামর্শ সাপেক্ষে সংবিধানের কার্যকর ও বাধ্যতামূলক বিধান রাখতে হবে। ভারতবর্ষের মুসলমান জনগণ যেখানে সংখ্যালঘু সেখানে তাদের সাথে পরামর্শ সাপেক্ষে এবং অন্যান্য সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সাথেও আলোচনা সাপেক্ষে সংবিধানে কার্যকর বিধান রাখতে হবে।

২৪ মার্চ প্রবল উৎসাহের মধ্য দিয়ে প্রস্তাবটি গৃহীত হয়। হিন্দু সংবাদপত্র ও সাময়িকীসমূহ লাহোর প্রস্তাবকে ক্যামব্রিজে বসবাসরত দেশত্যাগী ভারতীয় মুসলমান রহমত আলী কর্তৃক উদ্ভাবিত নকশা অনুযায়ী ‘পাকিস্তানের জন্য দাবি’ হিসেবে আখ্যায়িত করে। হিন্দু সংবাদপত্রসমূহ লাহোর প্রস্তাবকে পাকিস্তান ট্যাগ দিয়ে একটি রাষ্ট্রের ধারণা দেয়। মুসলমান নেতাদের পক্ষে সাধারণ মুসলিম জনগণের নিকট লাহোর প্রস্তাবের ব্যাখ্যা প্রদান এবং এর প্রকৃত অর্থ ও গুরুত্ব বুঝাতে হয়তো দীর্ঘ সময় লেগে যেতে পারতো। কিন্তু হিন্দু সংবাদপত্রসমূহ কর্তৃক প্রস্তাবটিকে ‘পাকিস্তান প্রস্তাব’ হিসেবে নামকরণ করাতে সাধারণ জনগণের মাঝে এর পূর্ণ গুরুত্ব জনে জনে প্রচার করার ব্যাপারে মুসলমান নেতৃবৃন্দের অনেক বছরের পরিশ্রম কমিয়ে দেয়। বিরোধীতা করতে গিয়ে পাকিস্তানের প্রচার হিন্দুরাই বেশি করে। যদিও লাহোর প্রস্তাবে পাকিস্তান শব্দটির উল্লেখ ছিল না। 

যাই হোক, এরপর ১৯৪১ সালের ১৫ এপ্রিল মাদ্রাজে অনুষ্ঠিত অধিবেশনে লাহোর প্রস্তাবকে নিখিল ভারত মুসলিম লীগের গঠনতন্ত্রে একটি মৌল বিষয় হিসেবে সন্নিবেশ করা হয়। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তানের স্বাধীনতা পর্যন্ত এটি লীগের প্রধান বিষয় ছিল। ১৯৪৬ সালের মার্চ মাসে যখন মন্ত্রী মিশন ভারতে পৌঁছে, তখন ৭ এপ্রিল দিল্লিতে নিখিল ভারত মুসলিম লীগ তাদের ‘পাকিস্তান দাবি’র পুনরাবৃত্তি করতে মুসলিম লীগের কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক আইন পরিষদের সদস্যদের তিন-দিনব্যাপী এক সম্মেলন অনুষ্ঠানের সিদ্ধান্ত নেয়। সম্মেলনে উপস্থাপনের জন্য একটি খসড়া প্রস্তাব তৈরি করতে মুসলিম লীগের ওয়ার্কিং কমিটি চৌধুরী খালিকুজ্জামান, হাসান ইস্পাহানি ও অন্যান্যদের সমবায়ে একটি উপ-কমিটি নিয়োগ করে। চৌধুরী খালিকুজ্জামান প্রস্তাবের একটি খসড়া তৈরি করেন। অন্যান্য সদস্যদের সাথে খসড়াটি নিয়ে আলোচনা করা হয় এবং সামান্য পরিবর্তনের পর উপ-কমিটি এবং অতঃপর সাবজেক্ট কমিটি কর্তৃক অনুমোদিত হয়। ‘স্টেটস’ (States) শব্দটিকে একবচন শব্দ ‘স্টেট’ (State)-এ পরিবর্তন করা হয়। 

পাকিস্তান দাবি ভারতের মুসলিমদের মধ্যে দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। এর পিছনে অনেক সুস্পষ্ট কারণ ছিল। বাংলা ও পাঞ্জাবের কৃষকদের নিকট ‘পাকিস্তান’কে হিন্দু জমিদারদের শোষণের অবসান হিসেবে উপস্থাপন করা হয়। বেঙ্গল মুসলিম লীগের সচিব আবুল হাশেম ১৯৪৪ সালে এক ঘোষণার মাধ্যমে জমিদারি উচ্ছেদের অঙ্গীকার করেন। আর একটি তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় ছিল যে, প্রস্তাবিত পাকিস্তান ভারতের অংশ বিশেষকে প্রতিষ্ঠিত হিন্দু ব্যবসায়ী বা পেশাজীবীদের প্রভাব বলয় থেকে পৃথক করবে বলে অঙ্গীকার করে। এতে স্বল্প সংখ্যক মুসলিম ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠা লাভ এবং নতুন গড়ে উঠা মুসলিম বুদ্ধিজীবীগণ চাকরি গ্রহণ করতে পারবে। তুলনামূলকভাবে বড় মুসলিম পুঁজিপতিদের সংখ্যা ছিল খুবই কম। ১৯৪৭ সালের পূর্বে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ পূর্ব বাংলা এবং পশ্চিম পাঞ্জাবে বড় ধরনের কোন শিল্পকারখানা ছিল না বললেই চলে। অবশ্য এতদ্অঞ্চলে উন্নত কৃষি ব্যবস্থার সাথে জড়িত ক্ষুদ্র মাপের কিছু উদ্যোক্তার আবির্ভাব ঘটে। প্রতিষ্ঠিত ভারতীয় বড় পুঁজিবাদের প্রতিযোগিতার কবল থেকে রক্ষা করে পাকিস্তান এ সকল লোকের জন্য আর্থিক সুবিধাদি লাভের ব্যবস্থা করে দেয়।

রাজনীতির পাশাপাশি পাকিস্তান আন্দোলনকে আদর্শিকভাবেও লড়াই করতে হয়েছে। হিন্দু নেতাদের সাথে সুর মিলিয়ে কিছু মুসলমান ব্যক্তিত্বও পাকিস্তান আন্দোলনের সমালোচনায় নেমে পড়লেন। মুসলমান ব্যক্তিত্বের অন্যতম ছিলেন দেওবন্দি মাওলানা হোসাইন আহমদ মাদানী। তিনি যুক্ত জাতীয়তা ও ইসলাম শিরোনামে একটি বই লিখেন। তিনি যুক্ত জাতীয়তার পক্ষে  সাফাই গাইতে গিয়ে পুস্তিকায় লেখেন, “যুক্ত জাতীয়তার বিরোধীতা ও তাকে ধর্ম বিরোধী আখ্যায়িত করা সংক্রান্ত  যে সব ভ্রান্ত ধারণা প্রকাশিত হয়েছে ও হচ্ছে, তার নিরসন করা অত্যাবশ্যক বিবেচিত হলো। ১৮৮৫ সাল থেকে কংগ্রেস ভারতের জনগণের কাছে স্বাদেশিকতার ভিত্তিতে জাতিগত ঐক্য গড়ার আবেদন জানিয়ে অব্যাহতভাবে জোরদার সংগ্রাম চালিয়ে আসছে। আর তার বিরোধী শক্তিগুলি সেই আবেদন অগ্রহণযোগ্য, এমনকি অবৈধ ও হারাম সাব্যস্ত করার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদের জন্য  এ জাতিগত  ঐক্যের চাইতে ভয়ংকর আর কিছুই নেই, এ কথা সুনিশ্চিত। এ জিনিসটা ময়দানে আজ নতুন আবির্ভূত হয়নি,  বরং ১৮৮৭ সাল বা তার পূর্ব থেকে আবির্ভূত। বিভিন্ন শিরোনামে এর ঐশী তাগিদ ভারতীয় জনগণের মন মগজে কার্যকর করা হয়েছে। তিনি আর এক ধাপ  এগিয়ে বলেন,“ আমাদের যুগে দেশ থেকেই জাতির উৎপত্তি ঘটে থাকে। এতএব হিন্দু মুসলিম এক জাতি, আমরা সবাই ভারতীয়”

মওলানা সাহেবের এই পুস্তিকা প্রকাশিত হওয়ার পর নির্ভেজাল তাত্ত্বিক দিক দিয়ে জাতীয়তাবাদের বিষয়ে পুংখানুপুংখ বিচার গবেষণা চালিয়ে মওলানা মওদূদী রহ. রচনা করেন  “ইসলাম ও জাতীয়তাবাদ” পুস্তক। তিনি যুক্ত জাতীয়তাবাদের পক্ষের সব যুক্ত খণ্ডন করে দেখিয়েছেন যে, সমগ্র পৃথিবীর গোটা মানব বসতিতে মাত্র দু’টি দলের অস্তিত্ব রয়েছে; একটি আল্লাহর দল অপরটি শয়তানের দল। তাই এই দুই দল মিলে কখন এক জাতি হতে পারে না, যেমন পারে না তেল ও পানি মিশে এক হয়ে যেতে। মওলানার এই বই তখন রাজনৈতিক অঙ্গনে বিশেষ প্রভাব বিস্তার করে।

//মাওলানা মওদূদী রহ. বলেন, অমুসলিম জাতি সমূহের সাথে মুসলিম জাতির সম্পর্কের দু’টি দিক রয়েছে। প্রথমটি এই যে মানুষ হওয়ার দিক দিয়ে মসলিম-অমুসলিম সকলেই সমান। আর দ্বিতীয়টি এই যে, ইসলাম ও কুফরের পার্থক্য হেতু আমাদেরকে তাদের থেকে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র করে দেয়া হয়েছে। প্রথম সম্পর্কের দিক দিয়ে মুসলিমরা তাদের সাথে সহানুভূতি, দয়া ঔদার্য ও সৌজন্যের ব্যবহার করবে।  কারণ মানবতার দিক দিয়ে এরূপ ব্যবহারই তারা পেতে পারে। এমনকি তারা যদি ইসলামের দুশমন না হয়, তাহলে তাদের সাথে বন্ধুত্ব, সন্ধি এবং মিলিত উদ্দেশ্যের (Common Cause) সহযেগিতাও করা যেতে পারে। কিন্তু কোন প্রকার বস্তুগত ও বৈষয়িক সম্পর্ক তাদেরকে ও আমাদেরকে মিলিত করে ‘একজাতি’ বানিয়ে দিতে পারেনা।

তিনি আরো বলেন, যেসব গন্ডীবদ্ধ, জড় ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য ও কুসংস্কারপূর্ণ ভিত্তির উপর দুনিয়ার বিভিন্ন জাতীয়তার প্রাসাদ গড়ে উঠেছে আল্লাহ ও তাঁর রসুল তা চূর্ণ বিচূর্ণ করে দেন। বর্ণ, গোত্র, জন্মভূমি, অর্থনীতি ও রাজনীতিক অবৈজ্ঞানিক বিরোধ ও বৈষম্যের ভিত্তিতে মানুষ নিজেদের মূর্খতা ও চরম অজ্ঞতার দরুণ মানবতাকে বিভিন্ন ও ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র খন্ডে বিভক্ত করেছিল, ইসলাম তার সবগুলোকে আঘাতে চূর্ণ করে দেয় এবং মানবতার দৃষ্টিতে সমস্ত মানুষকে সমশ্রেণীর সমমর্যাদাসম্পন্ন ও সমানাধিকার প্রধান করেছে। ইসলামী জাতীয়তায় মানুষে পার্থক্য করা হয় বটে, কিন্তু জড়, বৈষয়িক ও বাহ্যিক কোন কারণে নয়। করা হয় আধ্যাত্মিক, নৈতিক ও মানবিকতার দিক দিয়ে। মানুষের সামনে এক স্বাভাবিক সত্য বিধান পেশ করা হয় যার নাম ইসলাম। আল্লাহর দাসত্ব ও আনুগত্য, হৃদয়মনের পবিত্রতা ও বিশুদ্ধতা, কর্মের অনাবিলতা, সততা ও ধর্মানুসরণের দিকে গোটা মানব জাতিকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। তারপর বলা হয়েছে যে, যারা এ আমন্ত্রণ গ্রহণ করবে,তারা এক জাতি হিসাবে গণ্য হবে আর যারা তা অগ্রাহ্য করবে, তারা সম্পুর্ণ ভ্ন্নি জাতির অন্তর্ভুক্ত হবে। অর্থাৎ মানুষের একটি হচ্ছে ঈমান ও ইসলামের জাতি এবং তার সমস্ত ব্যক্তিসমষ্টি মিলে একটি উম্মাহ। অন্যটি হচ্ছে কুফর ও ভ্রষ্টতার জাতি।// 

দ্বি-জাতি তত্ত্ব হঠাৎ করে তৈরি হওয়া কোন তত্ত্ব নয়। এ তত্ত্ব মানুষের সৃষ্টি থেকে, বিশেষ করে ইসলামের আবির্ভাব  থেকে সমাজে সুস্পষ্ট ছিল। রসুল সা. বলেছেন “আল কুফরু মিল্লাতুন ওয়াহেদা”- সমস্ত  কুফর জাতি এক জাতি এবং “আল মুসলেমু আখুল মুসলিম” এক মুসলমান অপর মুসলমানের ভাই। এ এক চরম সত্য। যেহেতু  মুসলিম  ধর্মের মূল শিরক বিবর্জিত ওহদানিয়াতের প্রতি বিশ্বাস  ও তদানুযায়ী জীবনাচার। এই বিশ্বাসের রূপরেখা প্রতিফলিত হয় মুসলিম সংস্কৃতিতে ও এরই সৃষ্ট  শ্রেষ্ঠ চরিত্র দিয়ে। কুরআন ধর্মের একত্বের উপরে জোর দিয়ে একে ঈমানের কেন্দ্র বিন্দুতে পরিণত করেছে। যে কারণে দেশের, ভাষার বিভিন্নতা সত্ত্বেও গোটা বিশ্বের মুসলিম সংস্কৃতিতে ঐক্যের সুর বিরাজমান। সব মুসলমান এক জাতি।

২০ জুন, ২০২০

শতাব্দির পর শতাব্দি দাওয়াতি কাজ করে যাওয়া এক ধৈর্যশীল মহামানব

ছবি : ইরাকের মসুল নগরী। আইএসের সাথে যুদ্ধে এই নগরী এখন ধ্বংসস্তূপ। এখানেই বসবাস করতেন নবী নূহ আ. এবং তাঁর জাতি।  

আদম আ. গত হওয়ার পর প্রায় হাজার বছর পার হয়ে গেল। শেষ শতকে ক্রমবর্ধমান মানবকুলে শিরক ও কুসংস্কারের আবির্ভাব ঘটে এবং তা বিস্তৃতি লাভ করে। ফলে তাদের সংশোধনের জন্য আল্লাহ নূহ আ.-কে নবী ও রাসূল করে পাঠান। তিনি সাড়ে নয়শত বছরের দীর্ঘ বয়স লাভ করেছিলেন এবং সারা জীবন পথভোলা মানুষকে পথে আনার জন্য দাওয়াতে অতিবাহিত করেন। কিন্তু তাঁর কওম তাঁকে পুরোপুরি প্রত্যাখ্যান করে। ফলে আল্লাহর গযবে তারা নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। 

মানবজাতির দ্বিতীয় পিতা বলে খ্যাত নূহ আ. ছিলেন পিতা আদম আ.-এর দশম অথবা অষ্টম অধঃস্তন পুরুষ। নূহ আ.-এর চারটি পুত্র ছিল। তারা হলেন সাম, হাম, ইয়াফিছ ও ইয়ামিন অথবা কেন‘আন। প্রথম তিনজন ঈমান আনেন। কিন্তু শেষোক্ত জন কাফের হয়ে প্লাবনে ডুবে মারা যায়। নূহ আ.-এর দাওয়াতে তাঁর কওমের হাতে গোণা মাত্র কয়েকজন ঈমানদার ব্যক্তি সাড়া দেন এবং তারাই প্লাবনের সময় নৌকারোহণের মাধ্যমে বেঁচে যান। ঐতিহাসিকরা বলেন, আমরা বাঙালিরাও নূহ আ.-এর বংশধর। 

নুহ আ. ছেলে হামের ছিলো ছয় ছেলে। তারা হলো, হিন্দ, সিন্দ, হাবাস, জানাস, বার্বার ও নিউবাহ। এদের মধ্যে হিন্দের মাধ্যমে ভারতবর্ষ আবাদ হয়েছিলো। হিন্দের সন্তানরা এ অঞ্চলে বসতি স্থাপন করেছিলো বলেই এ ভুখন্ড ‘হিন্দুস্তান’ নামে পরিচিত। আল্লাহর নবী নুহ আ. ছেলে ও নাতিদের সকলেই ছিলেন ঈমানদার ও ধর্মপ্রচারক। তাঁরা ছিলেন তাওহীদবাদের পূর্ণ বিশ্বাসী। হামের বড় ছেলে হিন্দের ছিলো চার ছেলে। তারা হলেন পূরব, বঙ্গ, দাখিন ও নাহরাওয়াল। বড় ছেলে পূরবের মোট বিয়াল্লিশজন ছেলে ছিলো। তারা ভারতবর্ষ ও এর আশেপাশে বসতি স্থাপন করে এবং অল্পকালের মধ্যেই তাদের বংশবিস্তার হয়। তারা ভারতের বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে। হিন্দের উল্লেখিত দ্বিতীয় ছেলে বঙ্গ ভারত উপমহাদেশের পূর্বাঞ্চলে বসতি স্থাপন করেন। তাঁর বংশধরের আবাসস্থলই তাঁর নামে অর্থাৎ ‘বঙ্গ’ নামে পরিচিত হয়। 

নূহ আ. ৯৫০ বছর জীবন পেয়েছিলেন। নূহ আ. ইরাকের মসুল নগরীতে স্বীয় সম্প্রদায়ের সাথে বসবাস করতেন। তারা বাহ্যতঃ সভ্য হ’লেও শিরকের অন্ধকারে নিমজ্জিত ছিল। তিনি তাদের হেদায়াতের জন্য প্রেরিত  হয়েছিলেন। উল্লেখ্য যে, হযরত নূহ (আঃ) সম্পর্কে পবিত্র কুরআনের ২৮টি সূরায় ৮১টি আয়াতে বর্ণিত হয়েছে এবং নূহ নামে একটি পূর্ণাঙ্গ সূরাও নাজিল হয়েছে।

আদম (আঃ)-এর সময়ে ঈমানের সাথে শিরক ও কুফরের মুকাবিলা ছিল না। তখন সবাই তওহীদের অনুসারী একই উম্মতভুক্ত ছিল। কিন্তু কালের বিবর্তনে মানুষের মধ্য শিরকের অনুপ্রবেশ ঘটে। নূহের কওম ওয়াদ, সুওয়া‘, ইয়াগূস, ইয়াঊক্ব ও নাসর প্রমুখ মৃত নেককার লোকদের উসিলায় আখেরাতে মুক্তি পাবার আশায় তাদের পূজা শুরু করে। মুহাম্মাদ ইবনু ক্বায়েস বলেন, আদম ও নূহ আ.-এর মধ্যবর্তী সময়কালের এই পাঁচজন ব্যক্তি নেককার ও সৎকর্মশীল বান্দা হিসাবে প্রসিদ্ধ ছিলেন। তাঁদের মৃত্যুর পর ভক্ত অনুসারীগণকে শয়তান এই বলে প্ররোচনা দেয় যে, এইসব নেককার মানুষের মূর্তি সামনে থাকলে তাদের দেখে আল্লাহর প্রতি ইবাদতে অধিক আগ্রহ সৃষ্টি হবে। ফলে তারা তাদের মূর্তি বানায়। অতঃপর উক্ত লোকদের মৃত্যুর পরে তাদের পরবর্তীগণ শয়তানের ধোঁকায় পড়ে ঐ মূর্তিগুলিকেই সরাসরি উপাস্য হিসাবে পূজা শুরু করে দেয়। তারা এইসব মূর্তির উসিলায় বৃষ্টি প্রার্থনা করতো। আর এভাবেই পৃথিবীতে প্রথম মূর্তিপূজার শিরকের সূচনা হয়।

ইবনু আবী হাতেম-এর বর্ণনায় এসেছে যে, ‘ওয়াদ’ ছিল এদের মধ্যে প্রথম এবং সর্বাধিক নেককার ব্যক্তি। তিনি মারা গেলে লোকেরা তার প্রতি ভক্তিতে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে। শয়তান এই সুযোগ গ্রহণ করে এবং লোকদেরকে তার মূর্তি বানাতে প্ররোচনা দেয়। ফলে ওয়াদ-এর মূর্তিই হ’ল পৃথিবীর সর্বপ্রথম মূর্তি, আল্লাহকে বাদ দিয়ে যার পূজা শুরু হয়’।

নূহ আ. স্বীয় কওমকে দিন-রাত দাওয়াত দিতে থাকেন। তিনি তাদেরকে প্রকাশ্যে ও গোপনে বিভিন্ন পন্থায় ও পদ্ধতিতে দাওয়াত দেন। কিন্তু ফলাফল হয় নিতান্ত নৈরাশ্যজনক। তাঁর দাওয়াতে অতিষ্ট হয়ে তারা তাঁকে দেখলেই পালিয়ে যেত। কখনো কানে আঙ্গুল দিত। কখনো তাদের চেহারা কাপড় দিয়ে ঢেকে ফেলতো। তারা তাদের হঠকারিতা ও জিদে অটল থাকত এবং চরম ঔদ্ধত্য প্রদর্শন করত’ (নূহ ৭১/৬-৯)। এক সময় কওমের সর্দাররা লোকদের ডেকে বলল, (খবরদার!) ‘তোমরা তোমাদের পূর্ব পুরুষদের পূজিত উপাস্য ওয়াদ, সুওয়া‘, ইয়াগূস, ইয়াঊক্ব, নাসর-কে কখনোই পরিত্যাগ করবে না’। (এভাবে) ‘তারা বহু লোককে পথভ্রষ্ট করে এবং (তাদের ধনবল ও জনবল দিয়ে) নূহ-এর বিরুদ্ধে ভয়ানক সব চক্রান্ত শুরু করে’ (নূহ ৭১/২১-২৩)।

কওমের অবিশ্বাসী নেতারা জনগণকে বিভ্রান্ত করার জন্য নূহ আ.-এর বিরুদ্ধে পাঁচটি আপত্তি উত্থাপন করেছিল। 
(১) আপনি তো আমাদের মতই একজন মানুষ। নবী হ’লে তো ফেরেশতা হতেন। 
(২) আপনার অনুসারী হলো আমাদের মধ্যকার হীন ও কম বুদ্ধিসম্পন্ন লোকেরা 
(৩) কওমের উপরে আপনাদের কোন প্রাধান্য পরিদৃষ্ট হয় না। 
(৪) আপনার দাওয়াত আমাদের বাপ-দাদাদের রীতি বিরোধী 
(৫) আপনি আসলে নেতৃত্বের অভিলাষী। অতএব আপনাকে আমরা মিথ্যাবাদী মনে করি।

অত্যন্ত ইন্টারেস্টিং বিষয় হলো একই প্রায় একই অভিযোগ করা হয়েছে রাসূল সা.-এর বিরুদ্ধেও। শুধু তাই নয় আজকেও আমরা দ্বীন প্রতিষ্ঠার কাজ করি আমাদের বিরুদ্ধেও প্রথমটি ছাড়া বাকী অভিযোগগুলো জারি রয়েছে।   

আল্লাহ তা‘আলা নূহ আ.-কে সাড়ে নয়শত বছরের সুদীর্ঘ জীবন দান করেছিলেন। তিনি এক পুরুষের পর দ্বিতীয় পুরুষকে অতঃপর তৃতীয় পুরুষকে শুধু এই আশায় দাওয়াত দিয়ে যাচ্ছিলেন যে, তারা ঈমান আনবে। কিন্তু শতাব্দীর পর শতাব্দী অক্লান্তভাবে দাওয়াত দেওয়া সত্ত্বেও তারা ঈমান আনেনি। মূলতঃ এই সময় নূহ (আঃ)-এর কওম জনবল ও অর্থবলে বিশ্বে অপ্রতিদ্বন্দ্বী ছিল। সংখ্যাধিক্যের কারণে ইরাকের ভূখন্ড ও পাহাড়েও তাদের আবাস সংকুলান হচ্ছিল না। 

আল্লাহর চিরন্তন নীতি এই যে, তিনি অবাধ্য জাতিকে সাময়িকভাবে অবকাশ দেন। নূহের কওম সংখ্যাশক্তি ও ধনাঢ্যতার শিখরে উপনীত হয়ে দিগ্বিদিক জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিল। তারা নূহ আ.-এর দাওয়াতকে তাচ্ছিল্য ভরে প্রত্যাখ্যান করেছিল। নূহ আ. তাদেরকে দিবারাত্রি দাওয়াত দেন। কখনো গোপনে কখনো প্রকাশ্যে অর্থাৎ সকল পন্থা অবলম্বন করে তিনি নিজ কওমকে দ্বীনের পথে ফিরিয়ে আনতে চেষ্টা করেন। আব্দুল্লাহ ইবনে আববাস (রাঃ) বলেন, এই সুদীর্ঘ দাওয়াতী যিন্দেগীতে তিনি যেমন কখনো চেষ্টায় ক্ষান্ত হননি, তেমনি কখনো নিরাশও হননি। সম্প্রদায়ের পক্ষ থেকে নানাবিধ নির্যাতনের সম্মুখীন হয়েও তিনি ছবর করেন। 

কাফির নেতারা বলল, হে নূহ! যদি তুমি বিরত না হও, তবে পাথর মেরে তোমার মস্তক চূর্ণ করে দেওয়া হবে’ (শো‘আরা ২৬/১১৬)। তবুও বারবার আশাবাদী হয়ে তিনি সবাইকে দাওয়াত দিতে থাকেন। আর তাদের জন্য দো‘আ করে বলতে থাকেন, ‘হে আমার পালনকর্তা! তুমি আমার কওমকে ক্ষমা কর। কেননা তারা জানে না। 

একদিন নূহ আ. তার জাতির লোকদের ডেকে বললেন,
‘হে আমার জাতি! যদি তোমাদের মাঝে আমার উপস্থিতি ও আল্লাহর আয়াত সমূহের মাধ্যমে তোমাদের উপদেশ দেওয়া ভারি বলে মনে হয়, তবে আমি আল্লাহর উপরে ভরসা করছি। এখন তোমরা তোমাদের যাবতীয় শক্তি একত্রিত কর ও তোমাদের শরীকদের সমবেত কর, যাতে তোমাদের মধ্যে কোনরূপ দ্বিধা-সংকোচ না থাকে। অতঃপর আমার ব্যাপারে একটা ফায়সালা করে ফেল এবং আমাকে মোটেও অবকাশ দিয়ো না’। ‘এরপরেও যদি তোমরা মুখ ফিরিয়ে নাও। তবে জেনে রেখ, আমি তোমাদের কাছে কোনরূপ বিনিময় কামনা করি না। আমার বিনিময় কেবলমাত্র আল্লাহর নিকটেই রয়েছে। আর আমার প্রতি নির্দেশ রয়েছে যেন আমি মুসলিমদের অন্তর্ভুক্ত হই’। ‘কিন্তু তারপরও তারা তাকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করলো’ (ইউনুস ১০/৭১-৭৩)। 

এরপর আল্লাহ তায়ালা ওহী নাযিল করে বলেন, তোমার কওমের যারা ইতিমধ্যে ঈমান এনেছে, তারা ব্যতীত আর কেউ ঈমান আনবে না। অতএব তুমি ওদের কার্যকলাপে বিমর্ষ হয়ো না’ (হূদ ১১/৩৬)। এভাবে আল্লাহর ওহী মারফত তিনি যখন জেনে নিলেন যে, এরা কেউ আর ঈমান আনবে না। বরং কুফর, শিরক ও পথভ্রষ্টতার উপরেই ওরা দৃঢ় থাকবে। 

তখন তিনি প্রার্থনা করলেন,
হে আমার পালনকর্তা! আমাকে সাহায্য কর। কেননা ওরা আমাকে মিথ্যাবাদী সাব্যস্ত করেছে। অতএব তুমি আমার ও তাদের মাঝে চূড়ান্ত ফয়সালা করে দাও এবং আমাকে ও আমার সাথী মুমিনদেরকে তুমি (ওদের হাত থেকে) মুক্ত করো। তিনি আরো দোয়া করেন, হে প্রভু! পৃথিবীতে একজন কাফের গৃহবাসীকেও তুমি ছেড়ে দিয়ো না। যদি তুমি ওদের রেহাই দাও, তাহলে ওরা তোমার বান্দাদের পথভ্রষ্ট করবে এবং ওরা কোন সন্তান জন্ম দিবে না পাপাচারী ও কাফের ব্যতীত।

বলা বাহুল্য, নূহ (আঃ)-এর এই দো‘আ আল্লাহ সাথে সাথে কবুল করেন। এ বিষয়ে সূরা হূদে ৩৭ থেকে ৪৮ আয়াত পর্যন্ত এই ১২টি আয়াত নাযিল হয়েছে। চূড়ান্ত গযব আসার পূর্বে আল্লাহ নূহ (আঃ)-কে বললেন,
//তুমি আমার সম্মুখে আমারই নির্দেশনা মোতাবেক একটা নৌকা তৈরী কর এবং জালেমদের ব্যাপারে আমাকে কোন কথা বলো না। অবশ্যই ওরা ডুবে মরবে’। ‘অতঃপর নূহ নৌকা তৈরী শুরু করলো। তার কওমের নেতারা যখন পাশ দিয়ে যেত, তখন তারা তাকে বিদ্রুপ করত। নূহ তাদের বলল, তোমরা যদি আমাদের উপহাস করে থাক, তবে জেনে রেখো তোমরা যেমন আমাদের উপহাস করছ, আমরাও তেমনি তোমাদের উপহাস করছি। অচিরেই তোমরা জানতে পারবে লাঞ্ছনাকর আযাব কাদের উপরে আসে এবং কাদের উপরে নেমে আসে চিরস্থায়ী গযব। 

আল্লাহ বলেন, ‘অবশেষে যখন আমার হুকুম এসে গেল এবং চুলা উদ্বেলিত হয়ে উঠল, (অর্থাৎ রান্নার চুলা হ’তে পানি উথলে উঠলো), তখন আমি বললাম, সর্বপ্রকার জোড়ার দুটি করে এবং যাদের উপরে পূর্বেই হুকুম নির্ধারিত হয়ে গেছে, তাদের বাদ দিয়ে তোমার পরিবারবর্গ ও সকল  ঈমানদারগণকে নৌকায় তুলে নাও। বলা বাহুল্য, অতি অল্প সংখ্যক লোকই তার সাথে ঈমান এনেছিল। নূহ তাঁদের বলল, তোমরা এতে আরোহণ কর। আল্লাহর নামেই এর গতি ও স্থিতি। নিশ্চয়ই আমার প্রভু অতীব ক্ষমাশীল ও দয়াবান। অতঃপর নৌকাখানি তাদের বহন করে নিয়ে চলল পর্বতপ্রমাণ তরঙ্গমালার মাঝ দিয়ে। এ সময় নূহ তার পুত্রকে (ইয়ামিনকে) ডাক দিল- যখন সে দূরে ছিল, হে বৎস! আমাদের সাথে আরোহণ করো, কাফেরদের সাথে থেকো না। সে বলল, অচিরেই আমি কোন পাহাড়ে আশ্রয় নেব। যা আমাকে প্লাবনের পানি হতে রক্ষা করবে। নূহ বললো, আজকের দিনে আল্লাহর হুকুম থেকে কারো রক্ষা নেই, একমাত্র তিনি যাকে দয়া করবেন সে ব্যতীত।  

এমন সময় পিতা-পুত্র উভয়ের মাঝে বড় একটা ঢেউ এসে আড়াল করল এবং সে ডুবে গেলো। অতঃপর নির্দেশ দেওয়া হলো, হে পৃথিবী! তোমার পানি গিলে ফেল (অর্থাৎ হে প্লাবনের পানি! নেমে যাও)। হে আকাশ! ক্ষান্ত হও (অর্থাৎ তোমার বিরামহীন বৃষ্টি বন্ধ কর)। অতঃপর পানি হ্রাস পেল ও গযব শেষ হলো। ওদিকে জুদি পাহাড়ে গিয়ে নৌকা ভিড়লো এবং ঘোষণা করা হলো, যালেমরা নিপাত যাও’। ‘এ সময় নূহ তার প্রভুকে ডেকে বলল, হে আমার পালনকর্তা! আমার পুত্র তো আমার পরিবারের অন্তর্ভুক্ত, আর তোমার ওয়াদাও নিঃসন্দেহে সত্য, আর তুমিই সর্বাপেক্ষা বিজ্ঞ ফায়ছালাকারী। 

আল্লাহ বললেন, হে নূহ! নিশ্চয়ই সে তোমার  পরিবারভুক্ত নয়। নিশ্চয়ই সে দুরাচার। তুমি আমার নিকটে এমন বিষয়ে আবেদন করো না, যে বিষয়ে তোমার জ্ঞান নেই। আমি তোমাকে সতর্ক করে দিচ্ছি যেন জাহিলদের অন্তর্ভুক্ত হয়ো না। নূহ বলল, হে আমার পালনকর্তা! আমার অজানা বিষয়ে আবেদন করা হতে আমি তোমার নিকটে পানাহ চাচ্ছি। তুমি যদি আমাকে ক্ষমা না কর ও অনুগ্রহ না কর, তাহলে আমি ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাব। বলা হলো, হে নূহ! এখন (নৌকা থেকে) অবতরণ করো আমাদের পক্ষ হতে নিরাপত্তা ও সমৃদ্ধি সহকারে তোমার উপর ও তোমার সঙ্গী দলগুলির উপর এবং সেই (ভবিষ্যৎ) সম্প্রদায়গুলির উপর- যাদেরকে আমরা সত্বর সম্পদরাজি দান করব। অতঃপর তাদের উপরে আমাদের পক্ষ হতে মর্মান্তিক আযাব স্পর্শ করবে।//

এখানে উল্লেখ্য যে খুব সম্ভবত নূহ আ. -এর জাতির লোকেরা নৌকা সম্পর্কে ধারণা রাখতো না। অর্থাৎ নূহ আ. জানতেন না নৌকা কী? এবং এটা কীভাবে বানাতে হয়। তাই নূহ আ.-কে বলা হয়েছে আমাদের নির্দেশনা মোতাবেক নৌকা বানাও। মুফাসসীররা নানান বর্ণনা থেকে দাবী করেন স্বয়ং জীবরাঈল আ.-এর নির্দেশনায় মুসলিমরা নূহ আ.-এর নেতৃত্বে নৌকা তৈরি করে। আর এই আজব জিনিস দেখে কাফিররা উপহাস ও ব্যঙ্গ করতো মুসলিমদের।

নূহ আ. অনুসারী কতজন ছিলো তা নিয়ে কুরআন কিছু বলে না। আল্লাহ বলেন, তারা ছিল অতি নগণ্য। বিভিন্ন ঐতিহাসিক সূত্র থেকে ইবনে আব্বাস রা. দাবি করেন তাদের সংখ্যা ছিল চল্লিশ জন পুরুষ ও চল্লিশ জন নারী। প্লাবনের পর মসুল নগরীর যে স্থানটিতে তারা আবার বসবাস শুরু করেন তার নাম হয় সামানুন বা আশি।  

এখানে জুদি পাহাড়ের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। এ পাহাড়টি আজও ঐ নামেই পরিচিত। এর অবস্থান এখন তুরস্কে। তুরস্ক ও ইরাক সীমান্তে মসুলের পাশে এটি অবস্থিত। বস্তুত এটি একটি পবর্তমালার  অংশ  বিশেষের নাম। এর অপর এক অংশের নাম ‘আরারাত’ পর্বত। প্রাচীন ইতিহাসে উল্লেখ রয়েছে যে, ইরাকের বিভিন্ন স্থানে উক্ত কিশতীর ভগ্ন টুকরা সমূহ অনেকের  কাছে সংরক্ষিত আছে। যা বরকত মনে করা হয় এবং বিভিন্ন রোগ-ব্যধিতে আরোগ্যের উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা হয়।

আরেকটি বিষয় উল্লেখ করার মতো যে, নূহের পুত্র কাফিরদের দলভুক্ত হওয়ায় মহাপ্লাবনে ধ্বংস হয়েছিল। কিন্তু নূহের স্ত্রী সম্পর্কে এখানে কিছু বলা হয়নি। ইবনে কাসির বলেন, এতে স্পষ্ট হয় যে, তিনি আগেই মারা গিয়েছিলেন। তিনি গোপনে কুফরি পোষণ করতেন ও কাফিরদের সমর্থন করতেন। নূহের স্ত্রী ও লূত্বের স্ত্রী স্ব স্ব সঙ্গীর নবুয়াতের উপরে বিশ্বাস স্থাপনের ক্ষেত্রে খেয়ানত করেছিল বলে স্বয়ং আল্লাহ অন্য সূরায় বর্ণনা করেছেন। নবীদের স্ত্রী হওয়া সত্ত্বেও কুফরির কারণে তারা জাহান্নামবাসী হয়েছেন। সম্ভবত মহাপ্লাবনের সময় নূহের স্ত্রী জীবিত ছিলেন না। সেকারণ গযবের ঘটনা বর্ণনায় কেবল পুত্র ইয়ামিনের কথা এসেছে। কিন্তু তার মায়ের কথা আসেনি।

যাই হোক এভাবে নূহ আ. এর জাতি ধ্বংস হলো। পৃথিবী আবার ঈমানদার পদচারণায় মুখরিত হলো। নূহ আ. এর সন্তানেরা ঈমানের সাথে সারা পৃথিবী আবাদ করলেন।

১০ জুন, ২০২০

বঙ্গকথা পর্ব-৪১ : শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হকের সাতকাহন



শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হকের রাজনীতি শুরু হয় মুসলিম লীগের হাত ধরে। তিনি মুসলিম লীগের তারকা নেতা। কিন্তু উপমহাদেশের প্রথম সাধারণ নির্বাচনে তিনি মুসলিম লীগের বিরুদ্ধেই নির্বাচন করেন। নির্বাচনে ভালো ফলাফল করে সরকার গঠন করেন এবং আবারো পুরনো দল মুসলিম লীগের হয়ে কাজ করেন। এটা কেন? এর উত্তর তালাশের চেষ্টা করবো আমরা।

‘শেরে বাংলা’ বা হক সাহেব রূপে পরিচিত আবুল কাশেম ফজলুল হক বাকেরগঞ্জ জেলার সাটুরিয়ায় ১৮৭৩ সালের ২৬ অক্টোবর জন্মগ্রহণ করেন। তবে তাঁর পূর্বপুরুষদের বাড়ি ছিল বরিশাল শহর থেকে চৌদ্দ মাইল দূরে চাখার গ্রামে। তিনি ছিলেন মুহম্মদ ওয়াজিদ ও সায়িদুন্নিসা খাতুনের একমাত্র পুত্র। হক সাহেবের পিতা বরিশাল আদালতের দীউয়ানি ও ফৌজদারি উকিল ছিলেন এবং তাঁর পিতামহ কাজী আকরাম আলী ছিলেন আরবি ও ফারসিতে দক্ষ পন্ডিত ও বরিশালের একজন বিশিষ্ট মোক্তার।

এ.কে ফজলুল হক ১৮৯০ সালে ফজলুল হক বরিশাল জিলা স্কুল থেকে এন্ট্রান্স, ১৮৯২ সালে প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে এফ.এ এবং ১৮৯৪ সালে বি.এ পরীক্ষায় (রসায়ন, গণিত ও পদার্থবিদ্যা তিনটি বিষয়ে অনার্সসহ) উত্তীর্ণ হন। ১৮৯৬ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি গণিত শাস্ত্রে এম.এ ডিগ্রি লাভ করেন।

১৮৯৭ সালে কলকাতার ‘ইউনিভার্সিটি ল কলেজ’ থেকে বি.এল ডিগ্রি লাভ করে ফজলুল হক আশুতোষ মুখার্জীর অধীনে শিক্ষানবিশ হিসেবে আইন ব্যবসা শুরু করেন। পিতার মৃত্যুর পর হক বরিশাল শহরে আইন ব্যবসা শুরু করেন। ১৯০৩-১৯০৪ সময়কালে তিনি এ শহরের রাজচন্দ্র কলেজে খন্ডকালীন প্রভাষক হিসেবেও কাজ করেছিলেন। ১৯০৬ সালে ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে ফজলুল হক সরকারি চাকরিতে যোগদান করেন। ১৯০৬ সালের ৩০ ডিসেম্বর ঢাকায় সর্ব ভারতীয় মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠাতেও তিনি সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়েছিলেন। ১৯০৮ থেকে ১৯১২ সাল পর্যন্ত হক ছিলেন সমবায়ের সহকারী রেজিস্ট্রার। এরপর সরকারি চাকরি ছেড়ে দিয়ে পুরোদস্তুর আইনপেশায় আত্মনিয়োগ করেন।

ঢাকার নবাব খাজা সলিমুল্লাহ ও টাঙ্গাইলের নবাব নওয়াব আলী চৌধুরীর কাছে রাজনীতিতে তাঁর হাতেখড়ি হয়। তাঁদের সহযোগিতায় ১৯১৩ সালে তিনি তাঁর শক্তিশালী প্রতিদ্বন্দ্বী রায়বাহাদুর কুমার মহেন্দ্রনাথ মিত্রকে পরাজিত করে ঢাকা বিভাগ থেকে বঙ্গীয় আইন পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯১৩ সালে হক বাংলার প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সম্পাদক হন এবং ১৯১৬ সাল পর্যন্ত এ পদে বহাল থাকেন। সর্বভারতীয় মুসলিম লীগের যুগ্ম সম্পাদক রূপেও তিনি দায়িত্ব পালন করেছিলেন। ১৯১৬ থেকে ১৯২১ সাল পর্যন্ত ফজলুল হক ছিলেন সর্বভারতীয় মুসলিম লীগের সভাপতি। 

হক সাহেব একইসাথে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সদস্য রূপে তিনি সে সংগঠনের সঙ্গেও সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন। তিনি ছিলেন কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের মধ্যে ১৯১৬ সালে লক্ষ্মৌ চুক্তি প্রণয়নে সহায়কদের অন্যতম। ১৯১৭ সালে হক ছিলেন ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের যুগ্ম সম্পাদক এবং ১৯১৮-১৯১৯ সালে তিনি এ সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক রূপে দায়িত্ব পালন করেন। 

১৯১৯ সালে হক খিলাফত আন্দোলনে যোগদান করেন। কিন্তু অসহযোগের প্রশ্নে কংগ্রেস নেতাদের সঙ্গে তাঁর মতপার্থক্য দেখা দিয়েছিল। ১৯২০ সালে কংগ্রেস-গৃহীত অসহযোগ আন্দোলনের কর্মসূচির সঙ্গে সম্পর্কিত ব্রিটিশ পণ্য ও উপাধি বর্জনের তিনি সমর্থন করেন। কিন্তু মুসলমান সম্প্রদায়ের পশ্চাৎপদ অবস্থার কথা বিশেষভাবে বিবেচনা করে তিনি স্কুল ও কলেজ বর্জনের পরিকল্পনার বিরোধিতা করেছিলেন। বর্জনের সিদ্ধান্ত মুসলমান ছেলেমেয়েদের অগ্রগতিতে বাধার সৃষ্টি করবে এটা তিনি উপলব্ধি করেছিলেন। এই ইস্যুতে তিনি কংগ্রেস ত্যাগ করেন। ১৯২০ সালে ফজলুল হক, কাজী নজরুল ইসলাম ও  মুজাফ্ফর আহমদ মিলে  নবযুগ নামে একটি দৈনিক পত্রিকা প্রকাশ করেন। এর সরকারবিরোধী নীতির কারণে এ পত্রিকার জামানত বহুবারই বাজেয়াপ্ত করা হয়েছিল। ফলে দীর্ঘদিনব্যাপী এ দৈনিক পত্রিকা চালানো তাঁর পক্ষে সম্ভব হয় নি।

সর্বভারতীয় রাজনীতিতে হক অংশগ্রহণ করলেও তাঁর মনোযোগ প্রধানত বাংলাতেই সীমাবদ্ধ ছিল। ১৯৩৪ সালে এম.এ জিন্নাহ্ সর্বভারতীয় মুসলিম লীগের সভাপতি হন। মুসলিম লীগের কর্মসূচিতে হক খুশি ছিলেন না। জিন্নাহর সঙ্গে তার পার্থক্য তীব্রতর হয়ে ওঠে। ১৯৩৫ সালের আইনের অধীনে নির্বাচনের সময় এটা বিশেষভাবে স্পষ্টত প্রতীয়মান হয়। মুসলিম লীগের ইশতেহারে প্রান্তিক কৃষক সমাজ ও স্বাধীনতার বিষয়ে কোন ধারণা না থাকায় হক সাহেব আলাদাভাবে নির্বাচনের সিদ্ধান্ত নেন। ১৯৩৬ সালে ফজলুল হক তাঁর নির্বাচনী ইশতেহারের খসড়া তৈরি করেন এবং তাঁর নির্বাচনী প্রচারাভিযানের সময় তিনি জিন্নাহর নেতৃত্বাধীন মুসলিম লীগের তীব্র বিরোধিতা করেন। ফজলুল হক এক নতুন বাংলা গড়তে চেয়েছিলেন বলে তাঁর নির্বাচনী ইশতেহার বাংলার জনগণের মধ্যে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। কৃষক প্রজা পার্টি নামে একটি দলের ব্যানারে তিনি নির্বাচন করেন। এই দলটির আত্মপ্রকাশ হয় নির্বাচনের ঠিক আগের বছরে। 

কৃষক প্রজা পার্টির পটভূমি :
বিভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শের মুসলমান নেতৃবৃন্দের সমন্বয়ে নিখিলবঙ্গ প্রজা সমিতি প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯২৯ সালে। স্যার আব্দুর রহিম এ সমিতির সভাপতি এবং আরও পাঁচজন সহ-সভাপতি ছিলেন। ফজলুল হক ছিলেন এ পাঁচজনের মধ্যে প্রথম সহ-সভাপতি। প্রজা সমিতির সভাপতির পদ পূরণ নিয়ে একটি বিবাদের সূত্রপাত হয়। ১৯৩৪ সালে ভারতের আইন সভার সভাপতি নির্বাচিত হলে স্যার আব্দুর রহিম নিখিল বঙ্গ প্রজা সমিতির সভাপতির পদ থেকে পদত্যাগ করেন। এরপর সমিতির সদস্যরা পূর্ব বাংলা ও পশ্চিম বাংলা-এ দুই আঞ্চলিক ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে। 

পূর্ব বাংলার পক্ষ থেকে ফজলুল হক সভাপতির পদের প্রত্যাশী ছিলেন, অন্যদিকে পশ্চিম বাংলা দলের পক্ষ থেকে খান বাহাদুর এ. মমিন এ পদের জন্য খুবই আগ্রহ প্রকাশ করেন। এ পরিস্থিতিতে বিতর্ক মীমাংসার জন্য উভয় দল বিদায়ী সভাপতির মধ্যস্থতা মেনে নিতে সম্মত হয়। তিনি খান বাহাদুরের প্রতি সমর্থন দেন। এ প্রেক্ষাপটে ফজলুল হক পূর্ব বাংলায় তার সমর্থকদের নিয়ে প্রজা সমিতি ত্যাগ করলেন। 

একই সাথে দুইটি সংগঠনের সাথে বিরোধ তৈরি হয় ফজলুল হকের। মুসলিম লীগের সাথে ইশতেহার নিয়ে। প্রজা সমিতির সাথে নেতৃত্ব পাওয়া নিয়ে। আবার সামনে প্রাদেশিক নির্বাচন। সবগুলো বিষয় মিলে ১৯৩৬ সালে ফজলুল হক নিজেই নিয়মিত রাজনৈতিক দল কৃষক প্রজা পার্টি (কে.পি.পি.) গঠন করেন। গ্রামীণ সমাজের নেতা হিসেবে ফজলুল হক আসন্ন নির্বাচনে জনগণের মন জয় করার জন্য একটি কৃষি-ভিত্তিক কর্মসূচির ভবিষ্যৎ সম্পর্কে ভালভাবে ওয়াকিবহাল ছিলেন। কৃষক প্রজা পার্টির কর্মসূচিতে কৃষককে জমির একচ্ছত্র মালিকানা দিয়ে জমিদারি প্রথা বিলোপ, খাজনার হার হ্রাস, কৃষক সম্প্রদায়ের ঋণ মওকুফের মাধ্যমে মহাজন শ্রেণির শৃঙ্খল থেকে তাদের মুক্তিদান, কৃষকের মাঝে সুদমুক্ত ঋণ বিতরণ, দেশব্যাপী খাল খননের মাধ্যমে সেচ সুবিধা সৃষ্টি, সর্বগ্রাসী কচুরীপানা পরিষ্কার করে নৌচলাচল সচল করা, বিনাবেতনে প্রাথমিক শিক্ষা চালু ইত্যাদি অন্তর্ভুক্ত করা হয়। 

কৃষককুলের কাছে ফজলুল হকের বক্তৃতা ছিল তার কর্মসূচির মতই আকর্ষণীয়। ফজলুল হকের আবেদন ছিল অসম্প্রদায়িক এবং সে কারণে তিনি নিম্নবর্ণের হিন্দু কৃষক সমাজের কাছেও শ্রদ্ধাভাজন হয়ে ওঠেন। প্রজা পার্টির নির্বাচনী ইশতাহার শেষ পর্যন্ত সকলের জন্য ‘ডাল ভাত’ এ একটি শ্লোগানে পরিণত হয়। ১৯৩৭ সালের নির্বাচনে কে.পি.পি-র প্রধান দু প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল বঙ্গীয় প্রাদেশিক কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ। কৃষক ভোটাররা ফজলুল হকের প্রতি বিশাল সমর্থন জানায়। যদিও তার দল মাত্র এক বছর পূর্বে প্রতিষ্ঠিত হয়, কিন্তু নির্বাচনে প্রাপ্ত আসন হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী রাজনৈতিক দলগুলির মধ্যে কেপিপি তৃতীয় স্থান দখল করে। কংগ্রেস পায় ৫৪টি আসন, মুসলিম লীগ ৪০টি, কে.পি.পি ৩৬টি এবং অন্যান্য খন্ডিত দল ও স্বতন্ত্র প্রার্থীরা ২৫০ আসনের বাকিগুলি দখল করে। কে.পি.পি-র টিকেটে নির্বাচিত ৩৬ আসনের ৩৩টি আসে পূর্ব বঙ্গ থেকে। এর ফলে কে.পি.পি পূর্ব বঙ্গের একটি দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।

ইন্টারেস্টিং বিষয় হলো অভাবনীয় নির্বাচনী বিজয়ের পর পরই কে.পি.পির পতন শুরু হয়। কংগ্রেস কোয়ালিশনে একমত না হওয়ায় মুসলিম লীগ ও কে.পি.পি প্রাদেশিক সরকার গঠন করে। কে.পি.পির পতনে মূল ভূমিকা রাখেন জিন্নাহ। তিনি চাইলে বাংলায় মুসলিম লীগের নেতৃত্বে সরকার গঠন হতে পারতো। কিন্তু তিনি বিরোধ দূর করার লক্ষ্যে ফজলুল হককেই প্রধান হয়ে সরকার গঠন করতে বলেন। এতে ফজলুল হক জিন্নাহর অনুগত হয়ে পড়েন। এ.কে ফজলুল হক মুসলিম লীগ ও আরও কয়েকটি ক্ষুদ্র দল ও স্বতন্ত্র সদস্যের সমর্থনে ও অংশগ্রহণে একটি কোয়ালিশন মন্ত্রিসভা গঠন করেন। 

কে.পি.পি এবং মুসলিম লীগের দূরত্ব ঘুচে যায়। মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে ফজলুল হককে দলকে সংহত করার পরিবর্তে ক্ষমতার রাজনীতিতে বেশি মনোযোগী হতে দেখা যায়। তার মন্ত্রিসভার ১১ জনের মধ্যে মাত্র ২ জন ছিলেন কে.পি.পি এবং বাকিরা মুসলিম লীগ ও সংখ্যালঘু দলগুলি থেকে। দলের সাধারণ সম্পাদক শামসুদ্দীন আহমেদের নেতৃত্বে অসন্তষ্ট কে.পি.পি নেতৃবৃন্দ সংসদে আলাদা দল হিসেবে আসন গ্রহণ করেন। বিদ্রোহী গ্রুপটি ১৯৩৭ সালের ১১ সেপ্টেম্বর গাইবান্ধায় দলের সাধারণ সভা ডাকেন এবং হক ও তার অনুসারীদের দল থেকে বহিষ্কার করেন। পাল্টা পদক্ষেপ হিসেবে ফজলুল হকও বিদ্রোহীদের বহিষ্কার করেন। 

আভ্যন্তরীণ কোন্দল :
১৯৩৭ সালের ২৯ জুলাই তারিখে অনুষ্ঠিত প্রথম বাজেট অধিবেশনে ভোট গ্রহণের সময় কৃষক প্রজা পার্টির বেশ কয়েকজন সদস্য শামসুদ্দীনের নেতৃত্বে কংগ্রেসের পক্ষে ভোট দিলে প্রজা পার্টির অভ্যন্তরীণ কোন্দল চরম আকার ধারণ করে। কিছুদিন পর ফজলুল হক কর্তৃক নির্বাচনী অঙ্গীকার ভঙ্গের অজুহাতে প্রজা পার্টির বাম আদর্শ লালনকারী ২১ জন সদস্য কোয়ালিশন ত্যাগ করেন। দলত্যাগের এ নাটকে লীগ সুবিধা লাভ করে এবং আইন প্রণয়নের ব্যাপারে সমর্থনের জন্য ফজলুল হক লীগের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েন। ফজলুল হক দলত্যাগীদের ইসলামের স্বার্থের বিরোধী বলে ঘোষণা করেন।

বিব্রতকর পরিস্থিতি থেকে নিজেকে মুক্ত করতে ও মুসলিম লীগের খাজা নাজিমুদ্দিনের প্রভাব থেকে নিজেকে বাঁচাতে ফজলুল হক কিছু শর্তে জোট গঠনের প্রস্তাব নিয়ে কংগ্রেসের দ্বারস্থ হন। কিন্তু কংগ্রেস কর্তৃক প্রত্যাখাত হলে ফজলুল হক মুসলিম লীগের আরও বেশি নিয়ন্ত্রণাধীন হয়ে পড়েন। ১৯৩৭ সালের ১৫ অক্টোবর লক্ষ্ণৌতে হক আনুষ্ঠানিকভাবে পুনরায় মুসলিম লীগের মতবাদ গ্রহণ করেন। তিনি বাংলার কোয়ালিশনের সকল মুসলিম সদস্যকে লীগে যোগদানের এবং লীগের পতাকাতলে মুসলমানদের ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহবান জানান। প্রকাশ্যে প্রজাপার্টির সঙ্গে ফজলুল হক সম্পর্ক ছেদ না করলেও তাঁর নেতৃত্ব ছাড়া বস্তুত পার্টি মর্যাদা হারিয়ে ফেলে।

১৯৩৮ সালে দুটি দুটি ভাঙনের মুখে পড়ে কেপিপি। আইনসভায় প্রজা পার্টির উপনেতা ও মন্ত্রী নওশের আলী মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ না করেও কোয়ালিশনের প্রতি সমর্থন প্রত্যাহার করে নিলে লীগের উপর ফজলুল হকের নির্ভরশীলতা আরও বেড়ে যায়। কালক্রমে প্রজা পার্টির অবক্ষয় ঘটলে লীগের আর কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী রইল না। বিরোধীদলের রাজনৈতিক কর্মীর সংখ্যা বৃদ্ধি পেলে ১৯৩৮ সালের আগস্ট মাসে মন্ত্রিসভার বিরুদ্ধে কংগ্রেস-প্রস্তাবিত বেশ কয়েকটি অনাস্থা প্রস্তাব আইনসভায় পেশ করা হয়। অবশ্য ২৫ জন ইউরোপীয় সদস্যের দৃঢ় সমর্থন লাভ করে শেষ পর্যন্ত মন্ত্রিসভা টিকে যায়। বিনিময়ে ইউরোপীয়রা পাটশিল্পে বহু সুবিধা আদায় করে নেয় যা মূল উৎপাদনকারীদের স্বার্থের পরিপন্থি হয়েছিল। 

নতুন এ অবস্থা থেকে নিজেকে মুক্ত করতে ফজলুল হক তাঁর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া প্রজা পার্টির সহকর্মীদের সঙ্গে শান্তি স্থাপনের চেষ্টা করেন। আলোচনার পর হক ১৯৩৮ সালের ১৭ নভেম্বর শামসুদ্দীন ও তমিজউদ্দীনকে মন্ত্রিসভায় যোগদানে রাজি করাতে সক্ষম হন। কিন্তু অল্পদিনের মধ্যেই ফজলুল হক এক নতুন চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হন। ১৯৪১ সালের জুলাই মাসে জিন্নাহর নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও ফজলুল হক ভাইসরয়ের প্রতিরক্ষা পরিষদে যোগদান করলে জিন্নাহ্ তাঁকে মুসলিম লীগ থেকে বহিষ্কার করে এবং কোয়ালিশন দল থেকে লীগকে প্রত্যাহার করে এর পাল্টা ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। অথচ এর আগের বছর জিন্নাহ ফজলুল হকের মাধ্যমে ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাব (পাকিস্তান প্রস্তাব) পেশ করান। এবং এই সুবাদে ফজলুল হক 'শেরে বাংলা' উপাধি পান।

শ্যামা-হক মন্ত্রীসভা :
১৯৪১ সালের ২ ডিসেম্বর ফজলুল হক পদত্যাগ করেন, তবে তিনি প্রজা পার্টির প্রগতিশীল ও অসাম্প্রদায়িক ব্যক্তিবর্গ, কংগ্রেসের বসু গ্রুপ সহ অধিকাংশ হিন্দু সদস্য এবং হিন্দু মহাসভার রক্ষণশীল সংস্কারবাদীদের নিয়ে বিস্তৃত ভিত্তির একটি প্রগতিশীল কোয়ালিশন গঠন করতে সক্ষম হন। নতুন মন্ত্রীসভা শ্যামা-হক মন্ত্রিসভা গঠিত হয় এবং ১৯৪১ সালের ১২ ডিসেম্বর ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়। এই মন্ত্রীসভাকে শ্যামা-হক মন্ত্রীসভা হিসেবে নামকরণ করে মূলত মুসলিম লীগ।

এই রকম এক জটিল পরিস্থিতিতে শ্যামা-হক মন্ত্রিসভার পথ অবশ্যই মসৃণ ছিল না। ফজলুল হকের একমাত্র মূলধন ছিল তার নিজস্ব জনপ্রিয়তা। সেটাতে ধ্বস লাগে যখন তিনি হিন্দুদের নিয়ে মন্ত্রীসভা করেন। এছাড়া সোহরাওয়ার্দী, নাজিমুদ্দিন ও তমিজদ্দিনের মতো দক্ষ নেতা ও সংগঠক সারা প্রদেশ চষে বেড়িয়ে অসংখ্য জনসভায় হকের মুন্ডুপাত করতে থাকেন, হককে বিশ্বাসঘাতক ও মুসলমানদের শত্রু বলে তীব্র ভাষায় আক্রমণ করা হয়। তিনি বাঙালি ও অবাঙালি মুসলমানদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করতে চাইছেন বলেও তার বিরুদ্ধে অভিযোগ করা হয়। মন্ত্রিসভায় হিন্দমহাসভার মাত্র একজন প্রতিনিধি থাকলেও এই মন্ত্রিসভাকে শ্যামা-হক মন্ত্রিসভা নামে চিহ্নিত করা হয়। 

১৯৪২ সালের এপ্রিল মাসে নাটোরের যে উপনির্বাচন হয় তাতে ফজলুল হকের মনোনীত প্রার্থী লীগের প্রার্থীর কাছে শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়। লীগের প্রার্থী পেয়েছিলেন ১০,৪৮৩টি ভোট। হকের মনোনীত প্রার্থী পান মাত্র ৮৪০টি ভোট। তার জামানত বাজেয়াপ্ত হয়।

পায়ের তলায় মাটি পেতে হক উঠে পড়ে লাগেন। তিনি “প্রগতিশীল মুসলিম লীগ” নামে লীগের একটি পাল্টা সংগঠন গড়ে তুলতে সক্রিয় হন। ইসলামের স্বার্থ এর প্রাথমিক লক্ষ্য হলেও অন্যান্য সম্প্রদায়ের অধিকারও রক্ষিত হবার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়। তিনিও পূর্ব বাংলার বিভিন্ন অঞ্চল পরিভ্রমণ করেন। কিন্তু তার এইসব প্রচেষ্টা অনেকাংশে ব্যর্থ হয়। আসলে বাংলার মুসলমানরা তখন সর্বভারতীয় মুসলিম লীগের দিকেই আকৃষ্ট হয়েছিল। ফজলুল হকের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির নীতি অবশ্যই কংগ্রেস, কৃষক-প্রজা পার্টি ও হিন্দু মহাসভার মনঃপূত ছিল। কিন্তু মুসলিমরা এই নীতি প্রত্যাখ্যান করেছিলো।

১৯৪২ সালের ১০ই মে হিন্দুমহাসভা বাংলার বিভিন্ন স্থানে “পাকিস্তান বিরোধী দিবস” পালন করে। বাংলার মুসলমান সম্প্রদায় এতে গভীরভাবে আহত হয় এবং হিন্দুমহাসভার সঙ্গে বন্ধুত্ব রাখার জন্য তারা ফজলুল হককে দায়ী করে। সরকারি চাকরিতে মুসলমানদের জন্য পঞ্চাশ শতাংশ পদ সংরক্ষিত হলেও সেই অনুযায়ী মুসলমানদের নিয়োগ করা হয়নি বলেও হকের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠে। প্রতিকূল এই পরিস্থিতিতে হক জিন্নার সঙ্গে বিরোধ মিটিয়ে নিতে প্রস্তুত ছিলেন। ১৯৪৩ সালের ২৮ মার্চ ফজলুল হক আর মন্ত্রীসভা কন্টিনিউ করতে সক্ষম হননি।

৯ জুন, ২০২০

কুরআন শোনার পর কিছু জ্বিনের উপলব্ধি


আল্লাহর রাসূল সা. নবুয়্যত পাওয়ার আগের ব্যাপার। তখন জ্বিনেরা আসমানের খবর জানতে পারতো ফেরেশতাদের কথোপকথেন শুনে। একটা কথা যখন তাদের কানে যেতো তখন তারা ঐ কথার সাথে আরো দশটি কথা মিলিয়ে দিতো। সুতরাং একটি সত্য হতো এবং বাকী সবই মিথ্যা হয়ে যেতো। এর মাধ্যমে তারা নিজেদের জাহির করতো জ্ঞানী হিসেবে এবং অন্যান্য জ্বিন ও মানুষের ওপর ফায়দা হাসিল করতো। 

হঠাৎ করে তাদের ওপর আক্রমণ শুরু হলো আকাশ থেকে। তারা যখনই খবর নিতে যেত তখনই উপর উল্কাপিণ্ড নিক্ষিপ্ত হতে লাগলো। ফলে তারা কোন খবর পাচ্ছিল না উপর থেকে। তারা এই ব্যাপারে ইবলিসের নিকট এসে অভিযোগ করলো। ইবলিস তখন বললো, অবশ্যই নতুন ব্যাপার কিছু ঘটেছে। তাই সে তার অনুসারী জ্বীনদেরকে এই তথ্য উদঘাটনের জন্যে চতুর্দিকে ছড়িয়ে দিলো। তার অনুসারীরা বেরিয়ে পড়লো।

এদিকে রাসূল সা. তাঁর সাহাবীদের সাথে নিয়ে উকাযের বাজারের দিকে যাচ্ছিলেন। পথিমধ্যে নাখলা নামক স্থানে নামাজের সময় হলো। সেটা ফজর অথবা এশার নামাজ ছিল। আল্লাহর রাসূল সা. নামাজে কুরআন তিলওয়াত করছিলেন। ঠিক সেসময় জ্বীনদের যে দলটি আরব অভিমুখে গেল, তারা সেখানে পৌঁছলো। ঐ জ্বিনদের কানে যখন রাসূল সা.-এর তিলাওয়াতের শব্দ পৌঁছলো তখন তারা সেখানে থেমে গেল এবং কান লাগিয়ে মনোযোগের সাথে কুরআন পাঠ শুনতে লাগলো। 

এরপরে তারা পরস্পর বলাবলি করলো, এটাই ঐ জিনিস, যার কারণে আমাদের আকাশ পর্যন্ত পৌঁছার পথ বন্ধ হয়ে গেছে। এখান হতে ফিরে তারা সরাসরি তাদের কওমের নিকট পৌঁছে যায় এবং তাদেরকে বলেঃ “আমরা তো এক বিস্ময়কর কিতাব শ্রবণ করেছি, যা সঠিক পথ-নির্দেশ করে, ফলে আমরা এতে বিশ্বাস স্থাপন করেছি। আমরা কখনো আমাদের প্রতিপালকের কোন শরীক করবো না।” 

কিন্তু মজার ব্যাপার হলো আল্লাহর রাসূল সা. এই বিষয়ে কিছুই জানতেন না। পরে আল্লাহ তায়ালা মুহাম্মদ সা.-কে এই ঘটনা জানালেন সূরা জ্বিন নাজিলের মাধ্যমে। সূরা জ্বিনে আল্লাহ তায়ালা একদল জ্বিন যারা কুরআন শুনেছিলো তাদের উপলব্ধি বর্ণনা করেছেন। আপনিও সূরা জ্বিন পড়ে তাদের তাদের উপলব্ধি জেনে নিতে পারেন। 

সূরা জ্বিনে যা উল্লেখ রয়েছে তার মধ্যে প্রথম নয় আয়াত আমরা একটু দেখে নিই কী আছে সেখানে,
//বল, আমার প্রতি ওহী করা হয়েছে যে, নিশ্চয়ই জিনদের একটি দল মনোযোগ সহকারে শুনেছে। অতঃপর বলেছে, আমরা তো এক বিস্ময়কর কুরআন শুনেছি। যা সত্যের দিকে হিদায়াত করে; অতঃপর আমরা তাতে ঈমান এনেছি। আর আমরা কখনো আমাদের রবের সাথে কাউকে শরীক করব না। আর নিশ্চয়ই আমাদের রবের মর্যাদা সমুচ্চ। তিনি কোন সংগিনী গ্রহণ করেননি এবং না কোন সন্তান। 

আর আমাদের মধ্যকার নির্বোধেরা আল্লাহর ব্যাপারে অবাস্তব কথাবার্তা বলতো। অথচ আমরা তো ধারণা করতাম যে, মানুষ ও জিন কখনো আল্লাহ সম্পর্কে মিথ্যা আরোপ করবে না। আর নিশ্চয়ই কতিপয় মানুষ কতিপয় জিনের আশ্রয় নিত, ফলে তারা তাদের অহংকার বাড়িয়ে দিয়েছিল। 

আর নিশ্চয়ই তারা ধারণা করেছিল যেমন তোমরা ধারণা করেছ যে, আল্লাহ কাউকে কখনই পুনরুত্থিত করবেন না। আর নিশ্চয়ই আমরা আকাশ স্পর্শ করতে চেয়েছিলাম, কিন্তু আমরা সেটাকে পেলাম যে, তা কঠোর প্রহরী এবং উল্কাপিন্ড দ্বারা পরিপূর্ণ। আর আমরা তো সংবাদ শোনার জন্য আকাশের বিভিন্ন ঘাঁটিতে বসতাম, কিন্তু এখন যে শুনতে চাইবে, সে তার জন্য প্রস্তুত জ্বলন্ত উল্কাপিন্ড পাবে।// 

ঐতিহাসিকরা ধারণা করেন এই ঘটনা তায়েফ থেকে ফিরে আসার সময়ের ঘটনা। এই সফর হতে প্রত্যাবর্তনের পথেই তিনি নাখলায় রাত্রি যাপন করেন এবং ঐ রাত্রেই জ্বিনেরা তাঁর কুরআন-তিলাওয়াত শ্রবণ করে। তবে এটা সুস্পষ্ট নয়। 

এখানে একটি গুরুত্বপূর্ণ কথা বলা হয়েছে, জ্বিনদের খুব বেশী বিভ্রান্ত হওয়ার কারণ এই যে, মানুষ তাদের কাছে আশ্রয় চাইতো। তারা দেখতো যে, যখনই মানুষ কোন জঙ্গলে বা মরু প্রান্তরে যেতো তখনই সে উচ্চস্বরে বলতো, আমি এই জঙ্গলের সবচেয়ে বড় জ্বিনের আশ্রয় গ্রহণ করছি। এ কথা বলার পর সে মনে করতো যে, সে সমস্ত জ্বিনের অনিষ্ট হতে রক্ষা পেয়ে যাবে। যেমন তারা যখন কোন শহরে যেতো তখন ঐ শহরের বড় নেতার শরণাপন্ন হতো। ফলে ঐ শহরের অন্যান্য লোকও তাদেরকে কোন কষ্ট দিতো না, যদিও তারা তার শত্রু হতো।

যখন জ্বিনেরা দেখলো যে, মানুষও তাদের আশ্রয়ে এসে থাকে তখন তাদের ঔদ্ধত্য ও আত্মম্ভরিতা আরো বৃদ্ধি পেলো এবং তারা আরো বেশি বেশি মানুষের ক্ষতি সাধনে তৎপর হয়ে উঠলো। জ্বিনেরা মানুষের এ অবস্থা দেখে তাদেরকে আরো ভয় দেখাতে শুরু করলো ও তাদেরকে নানাভাবে কষ্ট দিতে লাগলো। প্রকৃতপক্ষে জ্বিনেরা মানুষদেরকে ভয় করতো, যেমনিভাবে মানুষ জ্বীনদেরকে ভয় করে এবং তার চেয়েও বেশী। এমনকি যে জঙ্গলে বা মরু প্রান্তরে মানুষ যেতো সেখান থেকে জ্বিনেরা পালিয়ে যেতো। 

কিন্তু যখন থেকে মুশরিকরা জ্বিনদের শরণাপন্ন হতে শুরু করলো এবং বলতে লাগলোঃ “এই উপত্যকার জ্বিন-সরদারের আমরা শরণাপন্ন হলাম এই স্বার্থে যে, সে আমাদের, আমাদের সন্তানদের এবং আমাদের ধন-মালের কোন ক্ষতি সাধন করবে না তখন থেকে জ্বিনদের সাহস বেড়ে গেল। কারণ তারা মনে করলো যে, মানুষই তো তাদেরকে ভয় করে। সুতরাং তারা নানা প্রকারে মানুষকে ভয় দেখাতে, কষ্ট দিতে ও উৎপীড়ন করতে লাগলো।

কারদাম ইবনে আবী সায়েব আনসারী রা. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি আমার পিতার সাথে একটি কাজের জন্য মদীনা হতে বাইরের দিকে যাত্রা শুরু করি। ঐ সময় রাসূলুল্লাহ্ সা. মক্কায় রাসূলরূপে প্রকাশিত হয়েছিলেন। রাত্রিকালে আমরা জঙ্গলে এক রাখালের নিকট অবস্থান করি। অর্ধ রাত্রে একটি নেকড়ে বাঘ এসে ঐ রাখালের একটি বকরি ধরে নিয়ে যায়। 

রাখালটি বাঘটির পিছনে দৌড় দেয় এবং চীৎকার করে বলতে থাকে “হে এই উপত্যকার আবাদকারী! আমি তোমার আশ্রয়ে এসেছি।” সাথে সাথে একটি শব্দ শোনা গেল, অথচ আমরা কোন লোককে দেখতে পেলাম না। শব্দটি হলো, “হে নেকড়ে বাঘ! এ বকরীকে ছেড়ে দাও।” অল্পক্ষণ পরেই আমরা দেখলাম যে, ঐ বকরীটিই পালিয়ে আসলো এবং পালের এসে মিলিত হয়ে গেল। সে একটু যখমও হয়নি। 

হতে পারে যে, নেকড়ে বাঘের রূপ ধরে জ্বিনই এসেছিল, যে বকরীকে ধরে নিয়ে গিয়েছিল এবং এদিকে ঐ রাখালটির দোহাইতে ছেড়ে দিয়েছিল, যাতে রাখালের এবং তার মুখে শুনে অন্যান্য লোকদেরও এ বিশ্বাস জন্মে যে, জ্বিনদের আশ্রয়ে আসলে বিপদ-আপদ হতে নিরাপত্তা লাভ করা যায়। এভাবে জ্বিন মানুষকে পথভ্রষ্ট করে দ্বীন হতে সরিয়ে দিতে পারে। এসব ব্যাপারে আল্লাহ তা'আলাই সবচেয়ে ভাল জানেন।

৪ জুন, ২০২০

বঙ্গকথা পর্ব-৪০ : বাংলার ইতিহাসে প্রথম নির্বাচন ও তার ফলাফল



১৯৩৫ সালে ব্রিটিশ সরকার প্রণীত 'ভারত শাসন আইনে'র ভিত্তিতে সমগ্র ভারতের ১১টি প্রদেশে প্রাদেশিক নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। প্রাদেশিক পরিষদে নির্বাচন সম্পন্ন হয় ১৯৩৭ এর ফেব্রুয়ারিতে। ১৯৩৬ সালের শেষভাগে মুসলিম লীগ ও কংগ্রেস তাদের নির্বাচনী মেনিফেস্টো ঘোষণা করে। উভয় মেনিফেস্টোর সামাজিক পলিসি ছিল প্রায় একই রকমের। রাজনৈতিক ইস্যুতেও কেউ একে অপর থেকে বেশী দূরে অবস্থান করছিল না।

শুধু দুটি বিষয়ে উভয়ের মধ্যে মতপার্থক্য ছিলো। একটি এই যে, মুসলিম লীগ ওয়াদাবদ্ধ ছিল উর্দু ভাষা ও বর্ণমালার সংরক্ষণ এবং সমৃদ্ধি সাধন করতে। পক্ষান্তরে কংগ্রেস বদ্ধপরিকর ছিল হিন্দিকে ভারতের রাষ্ট্রভাষা করার জন্যে। অপরটি হলো মুসলিম লীগ অটল ছিল পৃথক নির্বাচনের উপর। কিন্তু কংগ্রেস ছিল তার চরম বিরোধী। ১৯১৬ সালে কংগ্রেস পৃথক নির্বাচন মেনে নিয়ে মুসলিম লীগের সাথে এক চুক্তিতে স্বাক্ষর করে যা লক্ষ্ণৌ চুক্তি নামে খ্যাত ছিল। অনেক কংগ্রেস নেতা লক্ষ্ণৌ চুক্তির উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেন এবং এটাকে হিন্দু-মুসলিম মিলনের সেতুবন্ধন মনে করেন। কিন্তু পরবর্তীকালে কংগ্রেস এ চুক্তি অমান্য করে পৃথক নির্বাচনের বিরোধিতা শুরু করে।

হিন্দু-মুসলিম মিলনে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টিকারী কোন কথা মুসলিম লীগ মেনিফেস্টোতে ছিলনা। বরং তাদের ছিল সহযোগিতার সুস্পষ্ট আহবান। কংগ্রেস মুসলিম লীগের এ সহযোগিতার আহবান ঔদ্ধত্য সহকারে প্রত্যাখ্যান করে। কংগ্রেসের দাবী ছিল যে, সকল ভারতবাসী এক জাতি এবং ভারতবাসীর প্রতিনিধিত্বকারী একমাত্র রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান কংগ্রেস। সুতরাং মুসলিম লীগ নামে আরেকটি সংগঠনের প্রয়োজন নেই। কিন্তু ১৯৩৭ সালের নির্বাচন তাদের এ দাবিকে ভুল প্রমাণিত করে।

নির্বাচনের যে ফল প্রকাশিত হয় তাতে দেখা যায় সর্বমোট ১৭৭১টি প্রার্থীর মধ্যে কংগ্রেস লাভ করে মাত্র ৭০৬ টি যা অর্ধেকেরও কম। মুসলিম লীগ ৪৮২ টির মধ্যে পায় ১০৬ টি। মুসলিম লীগের ফলাফল খারাপ হলেও মুসলিমদের ফলাফল খুব একটা খারাপ হয়নি। কংগ্রেস ৬টি প্রদেশে জয়লাভ করে, ৪টি তে মুসলিমরা ও ১টি তে ননকংগ্রেস হিন্দুরা সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়।

এই নির্বাচনে কংগ্রেস নিজেদের একমাত্র দল হিসেবে যে দাবী করতো তা ভুল প্রমাণিত হয়েছে। সাড়ে তিন কোটি ভোটারের মধ্যে তারা ভোট পেয়েছে দেড় কোটি। আর কোনো প্রদেশেই মুসলিম লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়নি বলে এটা নিশ্চিত হয়েছে মুসলিমদের মধ্যে ঐক্য তৈরি হয়নি। আর এই অনৈক্যের পেছনে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রেখেছে দেওবন্দি আন্দোলন ও আঞ্চলিক জাতীয়তাবাদ। দেওবন্দি আন্দোলনের ফলে বহু মুসলিম কংগ্রেসের পক্ষাবলম্বন করেছে।

মুসলিমরা যে কয়টিতে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায় এর মধ্যে অন্যতম হলো বাংলা। বাংলায় ২৫০টি আসনের মধ্যে কংগ্রেস ৫৪, মুসলিম লীগ ৪০, কৃষক প্রজা পার্টি ৩৬, স্বতন্ত্র মুসলিম ৪৭, স্বতন্ত্র হিন্দু ৪২, অন্যান্য ৩১। বাংলায় মুসলিম লীগের বাইরে দলীয়ভাবে সফলতা লাভ করেছে শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হকের কৃষক প্রজা পার্টি। বাংলায় কোয়ালিশন ব্যতীত মন্ত্রীসভা গঠনের অন্য কোন পথ ছিলনা। অতএব ১৯৩৭ সালের এপ্রিল মাসে মুসলিম লীগ, কৃষক প্রজা পার্টি, তফসিলী সম্প্রদায় এবং স্বতন্ত্র মুসলিম ও হিন্দুদের নিয়ে কোয়ালিশন মন্ত্রীসভা গঠিত হয়, যার নেতা ছিলেন শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক। তিনি দশ সদস্য বিশিষ্ট মন্ত্রীসভা গঠন করেন যার মধ্যে পাঁচজন মুসলমান এবং পাঁচজন হিন্দু ছিলেন। ফজলুল হক হিন্দু ও মুসলিমদের সহযোগে সম্প্রীতির সাথে বাংলা প্রদেশ চালানোর উদ্যোগ নিয়েছিলেন।

ফজলুল হক কোয়ালিশন মন্ত্রীসভা সহজে কাজ করতে পারেনি। কারণ কংগ্রেস পদে পদে এ মন্ত্রীসভার চরম বিরোধীতা করে। কিন্তু এর ফলে সংসদের ভেতরে ও বাইরে মুসলিম ঐক্য সংহত ও সুদৃঢ় হয়। কোয়ালিশন মন্ত্রীসভা গঠিত হওয়ার পর কৃষক প্রজা পার্টি এবং মুসলিম লীগের মধ্যে সম্পর্ক উন্নত হয়। ১৮৩৭ সালের সেপ্টেম্বরে লক্ষ্ণৌতে অনুষ্ঠিত নিখিল ভারত মুসলিম লীগ অধিবেশনে ফজলুল হক যোগদান করে ঘোষণা করেন যে, তাঁর দলের সদস্যগণ মুসলিম লীগে যোগদান করবেন। তাঁর মন্ত্রীসভায় খাজা নাজিমুদ্দীন ও হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী স্থান পেয়েছিলেন।

ফজলুল হক সাহেবের সাড়ে চার বছরের প্রধানমন্ত্রীত্ব অবিভক্ত বাংলার মুসলিম রাজনৈতিক শক্তিতে বিপ্লব এনে দেয়। তাঁর মন্ত্রীসভা জনগণের মধ্যে বিরাট আশার সঞ্চার এবং মুসলমানদের মধ্যে আত্মবিশ্বাস সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়। তাদের এতদিনের হীনমন্যতা দূরীভূত হয় এবং হিন্দুদেরকে তারা সমকক্ষ মনে করে। সংসদে ফজলুল হক-সোহরাওয়ার্দীর ভাষন, প্রতিপক্ষের কথার দাঁতভাঙ্গা জবাব দান এবং তাঁদের প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব কংগ্রেস ও হিন্দু সহাসভা নেতৃবৃন্দের তুলনায় অধিকতর উচ্চমানের ছিল। তাঁদের প্রাণশক্তি ও প্রজ্ঞা, জ্ঞানবুদ্ধির প্রখরতা, অনর্গল বাগ্মিতা ও সাংগঠনিক যোগ্যতা এবং কঠোর পরিশ্রম ও ধীশক্তির দ্বারা তাঁরা সংসদে হিন্দু সদস্যদের উপর তাঁদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করেন।

বাংলার মুসলিমদের এই অগ্রগতি শুধু রাজনৈতিকভাবেই সীমাবদ্ধ ছিল না। বরং তা সাহিত্য সংস্কৃতিতেও প্রভাব বিস্তার করেছে। ব্রিটিশ শাসনের সুবাদে বাংলা সাহিত্যের উপর হিন্দু কবি সাহিত্যিক তাঁদের প্রাধান্য বিস্তার করে রেখেছিলেন। বাংলায় মুসলিমদের বিজয়ের ফলে মুসলিম সাহিত্যিকরা আবার ঘুরে দাঁড়াতে সক্ষম হন। কাজী নজরুল ইসলামের, কবি জসিম উদ্দীন, গোলাম মোস্তফা, বেনজীর আহমদ প্রমুখের সাহিত্যাঙ্গনে দৃপ্ত পদচারণা মুসলিমদের মধ্যে আশার আলো জাগিয়ে তুলে। সংগীত সম্রাট আব্বাস উদ্দীনের মনমাতানো সুরে গাওয়া ইসলামী, মুর্শেদী, ভাটিয়ালী সংগীত মুসলমানদের মনে ইসলামী প্রেরণা সঞ্চার করে।

শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হকের মন্ত্রীসভা বাংলার সংসদীয় সরকারের ইতিহাসে এক স্বর্ণযুগ বলা যেতে পারে। এ সময়ে তিনি বিহার, উড়িষ্যা ও আসাম প্রদেশগুলোতে সফর করে মুসলিম লীগ সংগঠিত করেন এবং একে একটি শক্তিশালী সংগঠনে রূপান্তরিত করেন। তিনি ১৯৩৭ সালে লক্ষ্ণৌতে, ১৯৩৮ সালে করাচীতে এবং ১৯৩৯ সালে কটকে অনুষ্ঠিত মুসলিম লীগ সম্মেলনগুলোতে ভাষণ দান করেন। ১৯৪০ সালে কায়েদে আজম মুহাম্মদ আলী জিন্নাহর সভাপতিত্বে লাহোরে ২২, ২৩ ও ২৪ মার্চ মুসলিম লীগের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। তার ২৩শে মার্চের অধিবেশনে তিনি ঐতিহাসিক পাকিস্তান প্রস্তাব পেশ করেন।
শিক্ষা খাতে গুরুত্ব দিতে গিয়ে ফজলুল হক তাঁর কোয়ালিশন মন্ত্রীসভায় নিজে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তিনি শিক্ষা ক্ষেত্রে মুসলমানদের উন্নতির জন্যে বহু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কায়েম করেন। কলকাতায় লেডি ব্রাবোর্ন কলেজ, ঢাকায় ইডেন গার্লস কলেজ, তেজগাঁওতে কৃষি কলেজ, ঢাবিতে ফজলুল হক মুসলিম হল, বরিশালে ফজলুল হক কলেজ।

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাধ্যমে শিক্ষায় হিন্দুদের আধিপত্য ও অধকতর হস্তক্ষেপ তিনি কিছুটা নিয়ন্ত্রণ করতে চেয়েছিলেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় উচ্চশিক্ষা নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি প্রবেশিকা এবং মাধ্যমিক পরীক্ষাগুলো নিয়ন্ত্রণ করতো। অতএব উচ্চশিক্ষার উপর তার প্রভাব ছিল শিক্ষামন্ত্রী ও তাঁর বিভাগ অপেক্ষা অনেক বেশী। এ প্রভাব থেকে পরীক্ষার্থীদের রক্ষা করার জন্যে তিনি সেকেন্ডারী এডুকেশন বোর্ড গঠনের উদ্দেশ্যে আইন পরিষদে একটি বিল উত্থাপনের চেষ্টা করেন। ফলে গোটা হিন্দু সম্প্রদায় ভয়ানক ক্ষিপ্ত হয়ে পড়ে এবং পারস্পরিক সকল বিভেদ ভুলে গিয়ে উক্ত প্রস্তাবিত বিলের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হয়।
১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গের পরে এরকম সম্মিলিত প্রচণ্ড বিক্ষোভ আর দেখা যায়নি।

১৯৪০ সালে কলকাতায় প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের মতো এক বিদ্বান ব্যক্তির সভাপতিত্বে এক প্রতিবাদ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সমগ্র প্রদেশ থেকে প্রায় দশ হাজার প্রতিনিধি সম্মেলনে যোগদান করেন। কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তখন বার্ধক্যজনিত অসুস্থতায় ভুগছিলেন। এতদসত্ত্বেও তিনি উক্ত সম্মেলনে তাঁর নাম ও মর্যাদা ব্যবহারের সুযোগ গ্রহণ করেন। সম্মেলনে তিনি যে বাণী পাঠান তার শেষাংশে বলেন, আমার বার্ধক্য এবং স্বাস্থ্য আমাকে সম্মেলনে যোগদানে বাধা দিচ্ছে। কিন্তু যে বিপদ আমাদের প্রদেশের সাংস্কৃতিক অস্তিত্বের প্রতি হুমকি সৃষ্টি করেছে, তা আমাকে ভয়ানক বিচলিত করেছে। সে জন্যে আমি আমার রোগশয্যা থেকে সম্মেলনে একটি কথা না পাঠিয়ে পারলাম না।

হিন্দুদের চরম বিরোধিতার কারণে বাংলার প্রধানমন্ত্রী সেকেন্ডারী এডুকেশন বোর্ড গঠনের যে পরিকল্পনা করেছিলেন তা কার্যকর করা হয়নি। তবে প্রধানমন্ত্রী হিসাবে শেরে বাংলা ফজলুল হক সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণযে পদক্ষেপ গ্রহণ করেন তা এই যে, প্রদেশের সকল সরকারী চাকুরি শতকরা পঞ্চাশ ভাগ হিন্দু ও পঞ্চাশ ভাগ মুসলমান লাভ করবে। সরকারী চাকুরী ক্ষেত্রে হিন্দুদের চিরাপরিত একচেটিয়া অধিকার প্রতিষ্ঠার ফলে মুসলমানদের প্রতি যে চরম অবিচার করা হচ্ছিল, উপরোক্ত পদক্ষেপ গ্রহণে মুসলমান শিক্ষিত যুবকদের মধ্যে আশার সঞ্চার হয়। নিশ্চয়ই এটি ছিল মুসলিম জাতির জন্য বড় খেদমত।
বাংলা ছাড়া যে কয়টি প্রদেশে মুসলিমরা মন্ত্রীসভা গঠন করেছে তার মধ্যে ছিল পাঞ্জাব, সিন্ধু ও আসাম। পাঞ্জাবে ১৭৫টি আসনের মধ্যে কংগ্রেস ১৮, মুসলিম লীগ ১, ইউনিয়নিস্ট পার্টি ৯৫, খালসা বোর্ড ১৪, হিন্দু বোর্ড ১১, অন্যান্য ১৪ এবং স্বতন্ত্র প্রার্থীরা ২২টি আসন লাভ করে।

ইউনিয়নিস্ট পার্টি ছিলো পাঞ্জাবের মুসলিমদের একটি দল যার প্রধান ছিলে সিকান্দার হায়াত খান। খালসা ন্যাশনালিস্ট শিখ দলও স্যার সেকেন্দার হায়াতের প্রতি তাদের সমর্থন জ্ঞাপন করে। তাদের সহযোগে তিনি মন্ত্রীসভা গঠন করেন। ১৯৪২ সালে তাঁর মৃত্যুর পর মালিক খিজির হায়াত খান প্রধানমন্ত্রী হন এবং ১৯৪৫ সালে সকল প্রাদেশিক পরিষদ বিলুপ্ত হওয়া পর্যন্ত এ মন্ত্রীসভা বলবৎ থাকে।

সিন্ধুতে ৬০ টি আসনের মধ্যে কংগ্রেস ৮, অকংগ্রেসী হিন্দু ১৪, মুসলিম স্বতন্ত্র ৯, অন্যান্য মুসলমান দল ৭, সিন্ধু ইউনাইটেড মুসলিম পার্টি ১৮, ইউরোপিয়ান ৪ জন নির্বাচিত হন।  এখানে কেউ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করতে না পারায় কোয়ালিশন করে মন্ত্রীসভা গঠন করতে হয়। ফলে এই মন্ত্রীসভা স্থিতিশীল হতে পারেনি। ভাঙা-গড়ার ভেতর দিয়েই এখানে মন্ত্রীসভাগুলো চলতে থাকে। প্রথমে স্যার গোলাম হোসেন হেদায়েতুল্লাহ মন্ত্রীসভা গঠন করেন। পরে আল্লাহ বখশ ও মীর বন্দে আলী খানের মধ্যে প্রধানমন্ত্রীত্বের পালাবদল হতে থাকে। উল্লেখ্য সিন্ধুতে মুসলিম লীগ কোনো আসন পায়নি।

আসামে ১০৮টি আসনের মধ্যে কংগ্রেস ৩৩, মুসলিম লীগ ১০, আসাম মুসলিম পার্টি ২৪, ননকংগ্রেস হিন্দু ১৪, মুসলিম স্বতন্ত্র ২৭ টি আসন লাভ করে। এখানেও কোন স্থিতিশীল সরকার গঠিত হতে পারেনি। স্যার মুহাম্মদ সা’দুল্লাহ মন্ত্রীসভা গঠন করেন এবং ১৯৩৮ সালের সেপ্টেম্বর পদত্যাগ করেন। অতঃপর গভর্ণরের আমন্ত্রণে কংগ্রেস নেতা গোপীনাথ বারদলই মন্ত্রীসভা গঠন করেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর গোপীনাথ মন্ত্রীসভাও পদত্যাগ করে। অতঃপর পুনরায় স্যার মুহাম্মদ সা’দুল্লাহ মন্ত্রীসভা গঠনের সুযোগ পান। কিন্তু ১৯৪১ সালের শেষভাগে তাঁর মন্ত্রীত্বের পতন ঘটে এবং গভর্নর ১৯৩৫ সালের ভারত সরকার আইনের ৯৩ ধারার বলে প্রদেশের শাসনভার নিজহস্তে গ্রহণ করেন।

বিহারে ১৫২টি আসনের মধ্যে কংগ্রেস ৯২, মুসলিম ইন্ডিপেন্ডেন্ট পার্টি ২০, মুসলিম ইউনাইটেড পার্টি ৫, আহরারে ইসলাম ৩ এবং স্বতন্ত্র প্রার্থীরা ৩২ টি আসন লাভ করে। এখানে কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন মন্ত্রীসভা গঠিত হয়। বোম্বেতে ১৭৫টি আসনের মধ্যে কংগ্রেস ৮৬, মুসলিম লীগ ১৮, অন্যান্য দল ২৯, স্বতন্ত্র প্রার্থীরা ৪২টি আসন লাভ করে। মধ্য প্রদেশে ১১২ টি আসনের মধ্যে কংগ্রেস ৭০, মুসলিম লীগ ৫, মুসলিম বোর্ড ৮, অন্যান্য দল ৮ এবং স্বতন্ত্র প্রার্থীরা ২১টি আসনে জয়লাভ করে।

মাদ্রাজে ২১৫টি আসনের মধ্যে ১৫৯টি কংগ্রেস, মুসলিম লীগ ৯টি, জাস্টিস পার্টি ২১টি, স্বতন্ত্র প্রার্থীরা ২৬টি আসন লাভ করে। উত্তর পশ্চিম প্রদেশে ৫০টি আসনের মধ্যে কংগ্রেস ১৯টি, হিন্দু-শিখ কোয়ালিশন ৭টি এবং স্বতন্ত্র প্রার্থীরা ২৪টি আসন লাভ করে। উড়িষ্যাতে ৬০টি আসনের মধ্যে কংগ্রেস ৩৬টি, মুসলিম লীগ ১৪টি এবং স্বতন্ত্র ১০টি আসন পায়। সর্বশেষ যুক্তপ্রদেশে ২২৮টি আসনের মধ্যে কংগ্রেস ১৩৩টি, মুসলিম লীগ ২৬টি, এগ্রিকালাচারিস্টরা ২২টি এবং স্বতন্ত্র প্রার্থীরা ৪৭টি আসন লাভ করে।

বঙ্গকথা পর্ব-৩৯ : ইংরেজদের থেকে স্বাধীনতার প্রথম ধাপ 'ভারত শাসন আইন-১৯৩৫'



দীর্ঘ আন্দোলন ও অরাজক পরিস্থিতির কারণে ইংরেজরা ভারতে তাদের শাসনকার্য সঠিকভাবে পরিচালনা করতে ব্যর্থ হচ্ছিল। তার উপর প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অংশগ্রহণের কারণে সেনা সংকট, অর্থ সংকট ইত্যাদি পরিস্থিতি ব্রিটিশদের সক্ষমতাকে দূর্বল করে। এই পরিস্থিতিতে ভারতকে নিয়ন্ত্রণ করার লক্ষ্যে ও ব্রিটিশদের পক্ষে রাজনৈতিক নেতাদের সমর্থন আদায়ের লক্ষ্যে ১৯৩৫ সালের 'ভারত শাসন আইন' নামে একটি আইন ব্রিটিশ সরকার তৈরি করে। এটা ছিল নামকাওয়াস্তে স্বায়ত্বশাসন প্রদানের আইন। শুরুতে কংগ্রেস নেতারা এই আইন মেনে না নিলেও পরবর্তীতে এই আইনের অধীনে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে আইন তারা মেনে নেয়। 

১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইন ছিলো যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো বা ফেডারেল গভর্নমেন্ট। এতে বলা হয়, ভারত শাসন আইন অনুসারে ভারতে ব্রিটিশশাসিত প্রদেশ, দেশীয় রাজ্য এবং চিফ কমিশনার শাসিত প্রদেশগুলিকে নিয়ে এক সর্বভারতীয় যুক্তরাষ্ট্র গঠনের ব্যবস্থা হবে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান পরিচালক হন গভর্নর জেনারেল । গভর্নর জেনারেল তাঁর মনোনীত তিনজন সদস্য নিয়ে একটি পরিষদ গঠন করবেন। এই তিন সদস্য বিশিষ্ট পরিষদের সাহায্যে গভর্নর জেনারেল ভারতবর্ষের প্রতিরক্ষা, বৈদেশিক নীতি, খ্রিস্টধর্ম প্রচার সংক্রান্ত বিষয় পরিচালনা করবেন। অন্যান্য বিষয়গুলি পরিচালনার জন্য একটি মন্ত্রিসভা গঠন করা হবে। মন্ত্রীগণ তাঁদের কাজের জন্য আইনসভার কাছে দায়ী থাকবেন। কয়েকটি বিশেষ ক্ষেত্রে, যেমন দেশে শান্তিশৃঙ্খলা বজায় রাখা ইত্যাদি ব্যাপার গভর্নর জেনারেল মন্ত্রিসভার পরামর্শ গ্রহণ নাও করতে পারবেন।

যুক্তরাষ্ট্র ভারতের আইনসভা দুটি পরিষদ নিয়ে গঠিত হবে। উচ্চকক্ষের নাম হবে রাষ্ট্রীয় পরিষদ (Council of States) এবং নিম্নকক্ষের নাম হবে ব্যবস্থা পরিষদ (Federal Assembly)। রাষ্ট্রীয় পরিষদ একটি স্থায়ী সংসদ হবে এবং এর এক তৃতীয়াংশ সদস্যের প্রতি তিন বছর অন্তর কার্যকাল শেষ হবে এবং সেই জায়গায় নতুন সদস্য নেওয়া হবে। অবসর গ্রহণকারী সদস্যরা পুনর্নির্বাচিত হতে পারবেন। রাষ্ট্রীয় পরিষদের সদস্য সংখ্যা হবে অনধিক ২৬০। এদের মধ্যে ১৫৬ জন ব্রিটিশ শাসিত ভারত থেকে নির্বাচিত হবেন এবং অনধিক ১০৪ জন দেশীয় রাজ্যের শাসকদের দ্বারা মনোনীত হবেন। নিম্নকক্ষ ব্যবস্থা পরিষদ (Federal Assembly) পাঁচ বছরের মেয়াদে নির্বাচিত হবে। এর সদস্য সংখ্যা হবে অনধিক ৩৭৫ । ব্রিটিশ শাসিত ভারত থেকে ২৫০ জন এবং দেশীয় রাজ্যগুলি থেকে ১২৫ জন সদস্য পরিষদের জন্য নির্বাচিত হবেন।

আইনটিকে বিশ্লেষন করলে যা পাওয়া যায়
কেন্দ্রীয় সরকারের ক্ষেত্রে-
১- যুক্তরাষ্ট্রীয় ভারত গঠন। এই আইনে ব্রিটিশ ভারত ও দেশীয় রাজ্যগুলিকে নিয়ে একটি যুক্তরাষ্ট্র গঠনের কথা বলা হয়। দেশীয় রাজ্যগুলির যুক্তরাষ্ট্রে যোগ দেওয়া ঐচ্ছিক হিসাবে গণ্য করা হয়।
২- দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভা। কেন্দ্রে পাঁচ বছর মেয়াদি দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভা গঠনের সিন্ধান্ত নেওয়া হয়। নিম্নকক্ষ ফেডারেল এসেম্বলি ৩৭৫ জন এবং উচ্চকক্ষ কাউন্সিল অব স্টেট ২৬০ জন সদস্য নিয়ে গঠিত হবে বলে ঘোষিত হয়।
৩- গভর্নর জেনারেলের অধীনে একটি কেন্দ্রীয় মন্ত্রিপরিষদের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের শাসনভার দেওয়া হবে। মন্ত্রীরা কাজের জন্য আইনসভার কাছে দায়বদ্ধ থাকবেন বলে জানানো হয়।
৪- গভর্নর জেনারেল তাঁর কাজের জন্য সরাসরি ভারত-সচিব ও ব্রিটিশ পার্লামেন্টের কাছে দায়বদ্ধ ছিলেন।
৫- শাসন ক্ষমতা বিভক্তিকরণ। কেন্দ্রীয় সরকারের শাসন ক্ষমতকে সংরক্ষিত ও হস্তান্তরিত এই দুভাগে ভাগ করা হয়। প্রতিরক্ষা, বৈদেশিক, ব্যাংক ইত্যাদি সংরক্ষিত বিষয়ে গভর্নর জেনারেলের হাতে দেওয়া হয়।
৬- গভর্নর জেনারেল শাসন পরিচালনায় চূড়ান্ত ক্ষমতা লাভ করেন। এছাড়া 'সোচ্ছাধীন ক্ষমতা' ও 'স্ববিবেচনাপ্রসূত ক্ষমতা' ভোগ করতেন।
৭- কেন্দ্র ও প্রদেশের ক্ষমতার তালিকা। কেন্দ্র ও প্রদেশের মধ্যে ক্ষমতা বন্টনের উদ্দেশ্যে তিনটি পৃথক তালিকা তৈরি করা হয়। ক) কেন্দ্রীয় তালিকা, খ) প্রাদেশিক তালিকা, গ) যুগ্ম তালিকা।

প্রাদেশিক সরকারের ক্ষেত্রে-
১- প্রদেশগুলিতে দ্বৈত শাসনের অবসান ঘটিয়ে স্বায়ত্তশাসন প্ৰতিষ্ঠা করা হয়।
২- বাংলা-সহ ছয়টি প্রদেশে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট এবং অবশিষ্ট পাচঁটিতে এককক্ষবিশিষ্ট আইনসভা রাখা হয়।
৩- প্রাদেশিক মন্ত্রিসভা তাদের কাজের জন্য প্রাদেশিক আইনসভার কাছে দায়বদ্ধ থাকবেন।
৪- কেন্দ্রের অনুকরণে প্রদেশের আইনশৃঙ্খলা, ধর্ম ইত্যাদির দায়িত্ব গভর্নরের হাতে দেওয়া হয়।
৫- গভর্নরকে চূড়ান্ত ক্ষমতা দেওয়া হয়। প্রদেশের গভর্নর আইন প্রণয়ন ও নাকচ করার অধিকারী হবেন।

১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইন ভারতের শাসনতান্ত্রিক বিবর্তনের ইতিহাসে এক উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ। বৃটিশ ভারতের জনগণের জাতীয়তাবোধের উত্তরোত্তর উন্মেষ, রাজনৈতিক চেতনা বিকাশ, দেশাত্মবোধের ক্রমবিকাশ ও ১৯১৯ সালের আইনের ব্যর্থতার পরিপ্রেক্ষিতে বৃটিশ সরকার শ্বেতপত্র নামক সংস্কার ঘোষণা করে। এটাই ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইন। এ আইনই পরবর্তীকালে ভারতের রাজনৈতিক অগ্রগতি এবং ১৯৪৭ সালের ভারতীয় স্বাধীনতা আইনের ভিত্তি রচনা করে। এসব দিক থেকে বিচার করলে ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনের গুরুত্ব অপরিসীম।

১৯১৯ সালের মন্টফোর্ড আইন ভারতবাসীর আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণে বিফল হয়। ফলে এ আইনের বিরুদ্ধে কংগ্রেস থেকে তীব্র সমালোচনা আসে। এছাড়া ১৯২০-২২ সালের অসহযোগ আন্দোলন এবং ১৯৩০-৩৫ সালের আইন অমান্য আন্দোরন দ্বারা কংগ্রেস যথাক্রমে স্বরাজ ও পূর্ণ স্বরাজ দাবি করে। এতে বৃটিশ সরকার উপলব্ধি করে নতুন সংবিধান প্রবর্তন না করা পর্যন্ত কংগ্রেসের আন্দোলন দমানো যাবে না। ১৯১৯ সালের ভারত শাসন আইনের ত্রুটি-বিচ্যুতি তদন্ত করার জন্য বৃটিশ সরকার ১৯২৮ সালের সাইমনের নেতৃত্বে একটি কমিশন গঠন করে। কিন্তু কমিশনে কোনো ভারতীয় সদস্য না থাকায় কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ উভয় দল এ কমিশন বাতিল করে। সাইমন রিপোর্টের পাশাপাশি মতিলাল নেহুরুর সভাপতিত্বে একটি বেসরকারি কমিটি নেহেরু রিপোর্ট পেশ করে। এতে কংগ্রেসের আন্দোলনের কথাই প্রতিফলিত হলেও হিন্দু-মুসলিম অনৈক্য বড় আকারে দেখা দেয়।

১৯২৯ সালের ২৩ ডিসেম্বর গান্ধী-ডারউইন বৈঠকে ভারতের জন্য একটি সংবিধান প্রণয়ন এবং দায়িত্বশীল সরকার গঠনের ব্যাপারে আলোচনা হয়। কিন্তু এ ব্যাপারে ভাইসরয় কোন আশ্বাস দিতে পারেনি। ফলশ্রুতিতে ২৯ জন অনুসারিকে নিয়ে ১৯৩০ সালের ১২ মার্চ গান্ধী সমুদ্র সৈকতের দিকে যাত্রা শুরু করেন। ২৪ দিনে ২০০ মাইল দূরত্ব অতিক্রম করেন। এ মিছিল ডান্ডি মিছিল নামে পরিচিত। লবণ আইন ভঙ্গের মাধ্যমে গান্ধী দেশব্যাপী গণ-আন্দোলন শুরুর ইঙ্গিত দেন। আইন অমান্য আন্দোলনের মধ্যে ছিল-
(ক) লবণ আইন ভঙ্গ করা
(খ) ছাত্রদের শিক্ষালয় এবং কর্মচারীদের সরকারি অফিস বর্জন
(গ) মদ, অফিম ও বিদেশি পণ্য বর্জন
(ঘ) কর খাজনা প্রদান বন্ধ ইত্যাদি।

ভারতের শাসনতান্ত্রিক সংস্কারের জন্য তিনটি গোলটেবিল বৈঠক ১৯৩০-৩২ সালের মধ্যে অনুষ্ঠিত হয়। ১৯৩৫ সালের আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে গোলটেবিল বৈঠকগুলো গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। এসকল বৈঠকের অনেক প্রস্তাব ও সুপারিশ ১৯৩৫ সালের আইনে রূপ লাভ করে। বৃটিশ সরকার ভারতের সংবিধান সংশোধনের ব্যাপারে তাদের সকল সিদ্ধান্ত ১৯৩৩ সালের মার্চ মাসে এক পার্লামেন্টারী শ্বেতপত্র প্রকাশ করে। এই শ্বেতপত্রে উল্লেখিত বিভিন্ন প্রস্তাবের ভিত্তিতে ১৯৩৪ সালে ভারতের ভবিষ্যৎ শাসনতন্ত্রের একটি খসড়া প্রকাশিত হয়। এই খসড়ার ভিত্তিতেই ১৯৩৪ সালে সুবিখ্যাত ৩২টি ধারা সম্বলিত ভারত শাসন আইন প্রণীত হয়। সবশেষে আমরা বলতে পারি, ভারতের জনগণ এবং রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের ঐকান্তিক দাবির মুখে বৃটিশ সরকার ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইন প্রণয়নে বাধ্য হয়। এই আইনের ভিত্তিতে ১৯৩৭ সালে উপমহাদেশে প্রথম সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।