১৩ জুল, ২০২০

দ্বীন ইসলামের গোপনীয়তা রক্ষা করার গুরুত্ব



তখন মদিনায় দ্বীন ইসলাম কায়েম হয়ে গিয়েছিল। আল্লাহর রাসূল সা. সেই রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপ্রধান। মক্কা বিজয়ের কিছুদিন পূর্বের ঘটনা। মক্কার কুরাইশরা হুদাইবিয়ার সন্ধি লঙ্ঘন করলো, চুক্তি ভঙ্গ করলো। এর প্রেক্ষিতে রাসূল সা. মক্কা জয় করার পরিকল্পনা গ্রহণ করছিলেন। তিনি মক্কা আক্রমণের প্রস্তুতি নিতে থাকলেন। তবে অভিযানের প্রস্তুতি সবাই দেখছিলো, কিন্তু অভিযানটি কি মক্কায় হবে নাকি অন্য কোথাও তা সাধারণ কেউ জানতো না। রাসূল সা. মক্কা অভিযানের ব্যাপারটা সাধারণ মুসলিমদের কাছে প্রকাশ করেননি। শুধুমাত্র বিশেষ পরামর্শ সভার গুরুত্বপূর্ণ সাহাবীরা জানতেন। 


একজন মুহাজির সাহাবী নাম হাতিব ইবনে আবি বালতায়া রা.। তিনি রাসূল সা.-এর মক্কা আক্রমণের বিষয়টি আঁচ করতে পারেন। এরপর থেকেই তার মনে অস্থিরতা শুরু হয়। কারণ মক্কায় তার পরিবার পরিজন রয়েছে।তাঁর সন্তান-সন্ততি, ধন-সম্পদ মক্কাতেই ছিল। তবে তিনি নিজে কুরাইশদের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন না। শুধু তিনি হযরত উসমান রা.-এর মিত্র ছিলেন, এ জন্যেই মক্কায় তিনি নিরাপত্তা লাভ করেছিলেন। অতঃপর তিনি হিজরত করে রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর সাথে মদীনায় অবস্থান করছিলেন। শেষ পর্যন্ত যখন মক্কাবাসী চুক্তি ভঙ্গ করে এবং এর ফলে রাসূলুল্লাহ্ সা. মক্কা-আক্রমণের ইচ্ছা করেন তখন তাঁর মনে বাসনা এই ছিল যে, আকস্মিকভাবে তিনি মক্কা আক্রমণ করবেন, যাতে রক্তপাত বন্ধ থাকে এবং তিনি মক্কার উপর আধিপত্যও লাভ করতে পারেন। এ জন্যেই তিনি মহামহিমান্বিত আল্লাহর নিকট দু'আ করেনঃ “হে আল্লাহ্ ! মক্কাবাসীদের নিকট যেন আমাদের যুদ্ধ প্রস্তুতির খবর না পৌছে।” এদিকে তিনি মুসলমানদেরকে প্রস্তুতির নির্দেশ দিয়েছেন। 


এই যখন পরিস্থিতি তখন মক্কা থেকে একজন মহিলা আসলো। সে আগে মহানবী সা.-এর দাদা আবদুল মুত্তালিবের দাসী ছিল। কিন্তু পরে দাসত্ব শৃঙ্খল মুক্ত হয়ে গানবাদ্য করে বেড়াত। নবীর সা. কাছে এসে সে তার দারিদ্রের কথা বলল এবং কিছু অর্থ সাহায্য চাইলো। নবী সা. বনী মুত্তালিবের লোকদের কাছে থেকে কিছু অর্থ চেয়ে দিয়ে তার অভাব পূরণ করলেন। সে মক্কায় ফিরে যাচ্ছিলো। এ ব্যাপারটির সুযোগ নিয়েছিলেন হাতিব ইবনে আবি বালতায়া রা.। তিনি ঐ মহিলার সাথে দেখা করলেন এবং মক্কার কয়েকজন নেতার নামে লেখা একটি চিঠি তাকে দিলেন। আর সে যাতে এই গোপনীয় বিষয়টি প্রকাশ না করে এবং গোপনে তাদের কাছে পৌঁছে দেয় সে জন্য তিনি তাকে দশটি দিনারও দিলেন। মহিলাটি সবেমাত্র মদিনা থেকে রওনা হয়েছিল। ইতোমধ্যে আল্লাহ তা'আলা এই বিষয়টি নবী সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়া সাল্লামকে অবহিত করলেন। 


রাসূল সা. তৎক্ষণাৎ হযরত আলী, হযরত যুবায়ের এবং হযরত মিকদাদ ইবনে আসওয়াদকে তার সন্ধানে পাঠিয়ে দিলেন। তিনি নির্দেশ দিলেন, তোমরা দ্রুত অগ্রসর হও। মহিলাটিকে ধরো। তার কাছে মুশরিকদের নামে হাতেবের একটি চিঠি আছে। যেভাবেই হোক তার নিকট থেকে সেই চিঠিটি নিয়ে এসো। সে যদি পত্রখানা দিয়ে দেয় তাহলে তাকে ছেড়ে দেবে। আর যদি না দেয় তাহলে তাকে হত্যা করবে। 


আলী রা.-এর দল মদীনা থেকে ১২ মাইল দূরে মহিলাটির দেখা পেলেন। তাঁরা তার কাছে পত্রখানা চাইলেন। কিন্তু সে অস্বীকার করে বললো, আমার কাছে কোনো পত্র নেই। তাঁরা তার থলে তাল্লাশী করলেন। কিন্তু কোন পত্র পাওয়া গেল না। অবশেষে তারা বললেন, পত্রখানা আমাদের দিয়ে দাও তা না হলে আমরা তোমাকে বিবস্ত্র করে তল্লাশী নেব। সে যখন বুঝতে পরলো রক্ষা পাওয়ার কোনো উপায় নেই তখন সে তার চুলের খোঁপার ভেতর থেকে পত্রখান বের করে দিলো। আর আলী রা.-এর দল তা নিয়ে নবী সা.-এর দরবারে উপস্থিত হলেন। চিঠিটি খুলে পড়া হলো। দেখা গেলো তাতে কুরাইশদের জানানো হয়েছে যে, রসূলুল্লাহ সা. তোমাদের বিরুদ্ধে আক্রমণের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। 


মহানবী সা. হযরত হাতেবকে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি একি করেছো? তিনি বললেন, ইয়া রাসূলুল্লাহ আপনি আমার ব্যাপারে দ্রুত সিদ্ধান্ত নেবেন না। আমি যা করেছি তা এ জন্য করি নাই যে, আমি কাফের বা মুরতাদ হয়ে গিয়েছি এবং ইসলামকে পরিত্যাগ করে এখন কুফরকে ভালবাসতে শুরু করেছি। প্রকৃত ব্যাপার হলো, আমার আপনজনেরা সব মক্কায় অবস্থান করছে। আমি কুরাইশ গোত্রের লোক নই। বরং কুরাইশদের কারো কারো পৃষ্ঠপোষকতা ও ছত্রছায়ায় আমি সেখানে বসতি স্থাপন করেছিলাম। অন্য যেসব মুহাজিরের পরিবার-পরিজন মক্কায় অবস্থান করছে তাদের গোত্র তাদের রক্ষা করবে। কিন্তু আমার পরিবার -পরিজনকে রক্ষা করার মত কেউই সেখানে নেই। তাই আমি এই পত্র লিখেছিলাম। আমি মনে করেছিলাম, এটা হবে কুরাইশদের প্রতি আমার একটা অনুগ্রহ। এই অনুগ্রহের কথা মনে করে তারা আমার সন্তানদের ওপর নির্যাতন চালাবে না। 


হযরত হাতেব রা.-এর পুত্র আবদুর রহমান বর্ণনা করেছেন যে, ঐ সময় হযরত হাতেবের সন্তান-সন্তুতি ও ভাই মক্কায় অবস্থান করেছিল। তাছাড়া হযরত হাতেবের নিজের একটি বর্ণনা থেকে জানা যায় যেসময় তার মাও সেখানে ছিলো। হাতেবের এই বক্তব্যে শুনে রসূলুল্লাহ সা. উপস্থিত সবাইকে বললেন, হাতেব তোমাদের কাছে সত্য কথাই বলেছে। অর্থাৎ এটিই তার এই কাজের মূল কারণ। ইসলামকে পরিত্যাগ বা কুফরকে সহযোগিতা করার মানসিকতা থেকে কাজটি হয়নি। 


হযরত উমর উঠে বললেন, হে আল্লাহর রসূল সা.! আমাকে অনুমতি দিন। আমি এই মুনাফিকের শিরচ্ছেদ করি। সে আল্লাহ, তাঁর রসূল এবং মুসলমানদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। 
নবী করিম সা. বললেন, এ ব্যক্তি তো বদর যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিল। তোমরা তো জানো না, হয়তো আল্লাহ তা'আলা বদর যুদ্ধে অংশ গ্রহণকারীদের বিষয় বিবেচনা করে বলে দিয়েছেন, তোমরা যাই করো না কেন আল্লাহ তোমাদের মাফ করে দিয়েছেন। একথা শুনে হযরত উমর রা. বললেন, আল্লাহ এবং তাঁর রসূলই সর্বাধিক জানেন। তাদের কথাই চূড়ান্ত। 


যতদূর জানা যায় হযরত হাতেব রা.-এর এই ওজর শোনার পর তাকে ক্ষমা করে দেওয়া হয়েছিল। তবে মহান রাব্বুল আলামীন এই বিষয়টিকে আমাদের জন্য শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে রেখে দিয়েছেন। তিনি এই ঘটনার প্রেক্ষিতে সূরা মুমতাহিনা নাজিল করেছেন। সেখানে আল্লাহ আমাদের এইসব অপরাধ করা থেকে সতর্ক করে দিয়েছে। হযরত হাতেব রা. শুধু তার পরিবার পরিজনকে রক্ষা করার উদ্দেশ্যে রসূলুল্লাহ সা. এর অতি গুরুত্বপূর্ণ একটি গোপন সামরিক তথ্য শত্রুদের জানিয়ে দেয়ার চেষ্ট করেছিলেন। এটি যথাসময়ের ব্যর্থ করে দেওয়া না গেলে মক্কা বিজয়ের সময় ব্যাপক রক্তপাত হতো। মুসলমানদেরও বহু মূল্যবান প্রাণ নষ্ট হতে পারতো এবং কুরাইশদেরও এমন বহু লোক মারা যেতো, যাদের দ্বারা পরবর্তী সময়ে ইসলামের ব্যাপক খেদমত পাওয়ার গিয়েছিল। 


শান্তিপূর্ণ উপায়ে মক্কা বিজিত হওয়ায় যেসব সুফল অর্জিত হয়েছে তা সবই পণ্ড হয়ে যেতে পারতো। এসব বিরাট ও ব্যাপক ক্ষতি সাধিত হতো শুধু এ কারণে যে, মুসলমানদেরই এক ব্যক্তি যুদ্ধের বিপদ থেকে নিজের পরিবারকে নিরাপদ রাখতে চেয়েছিল। সূরা মুমতাহিনাতে হযরত হাতেব রা.-এর এ কাজের কঠোর সমালোচনা করা হয়েছে। মারাত্মক এই ভুল সম্পর্কে সতর্ক করে দিয়ে আল্লাহ তা’আলা সমস্ত ঈমানদারদের এ শিক্ষা দিয়েছেন যে, কোনো ঈমানদারের কোন অবস্থায় কোন উদ্দেশ্যেই ইসলামের শত্রু কাফেরদের সাথে ভালবাসা ও বন্ধুত্বের সম্পর্ক না রাখা উচিত। এবং এমন কোন কাজও না করা উচিত যা কুফর ও ইসলামের সংঘাতে কাফেরদের জন্য সুফল বয়ে আনে। 


মহান রাব্বুল আলামীন বলেন সূরা মুমতাহিনার ১ ও ২ নং আয়াতে বলেন, 
// হে ঈমানদারগণ, তোমরা আমার ও তোমাদের শত্রুদেরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করে তাদের প্রতি ভালোবাসা প্রদর্শন করো না, অথচ তোমাদের কাছে যে সত্য এসেছে তা তারা অস্বীকার করেছে এবং রাসূলকে ও তোমাদেরকে বের করে দিয়েছে এজন্য যে, তোমরা তোমাদের রব আল্লাহর প্রতি ঈমান এনেছ। তোমরা যদি আমার পথে সংগ্রামে ও আমার সন্তুষ্টির সন্ধানে বের হও (তবে কাফিরদেরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করো না)। তোমরা গোপনে তাদের সাথে বন্ধুত্ব প্রকাশ করো, অথচ তোমরা যা গোপন করো এবং যা প্রকাশ করো তা আমি জানি। তোমাদের মধ্যে যে এমন করবে সে সরল পথ হতে বিচ্যুত হবে। তাদের আচরণ হলো, তারা যদি তোমাদের কাবু করতে পারে তাহলে তোমাদের সাথে শত্রুতা করবে। হাত ও জিহবা দ্বারা তোমাদের কষ্ট দেবে। তারা চায় যে, কোনক্রমে তোমরা কাফের হয়ে যাও।// 


যাদের জন্য এই অপরাধ সংঘটিত হয়েছে তারা কিয়ামতের দিন কোনো কাজে আসবে না এই মর্মে আল্লাহ ৩ নং আয়াতে বলেন, 
//কিয়ামতের দিন তোমাদের আত্মীয়তার বন্ধন কোনো কাজে আসবে না, সন্তান-সন্তুতি কোনো কাজে আসবে না। সেদিন আল্লাহ তোমাদের পরস্পর বিচ্ছিন্ন করে দেবেন। আর তিনিই তোমাদের আমল বা কর্মফল দেখবেন।// 


নিশ্চয়ই আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্ন করা সহজ নয়। এটা খুবই কঠিন। মহান রাব্বুল আলামীন মুমিনদের তাই সান্তনা দেওয়ার উদ্দেশ্যে ৭ ও ৮ নং আয়াতে বলেন,
//অসম্ভব নয় যে, আজ তোমরা যাদের শত্রু বানিয়ে নিয়েছো আল্লাহ তা’আলা তাদের ও তোমাদের মধ্যে কোন এক সময় বন্ধুত্ব সৃষ্টি করে দেবেন। আল্লাহ অত্যন্ত ক্ষমতাবান। আর তিনি ক্ষমাশীল ও দয়াময়। যারা দ্বীনের ব্যাপারে তোমাদের সাথে লড়াই করেনি এবং বাড়ীঘর থেকে তোমাদের তাড়িয়ে দেয়নি তাদের সাথে সদ্ব্যবহার ও ন্যায় বিচার করতে আল্লাহ তোমাদের নিষেধ করেন না। আল্লাহ ন্যায় বিচারকারীদের পছন্দ করেন।//


সবশেষে কোনো অবস্থায়ই জালিমদের বন্ধু বানানো যাবে না এই মর্মে মহান আল্লাহ তায়ালা আবারো ৯ নং আয়াতে সতর্ক করে দিয়েছেন শুধু তাই নয় তিনি বলেছেন যারা জালিমদের সাথে বন্ধুত্ব করবে তারাও জালিম। তিনি বলেন, 
//আল্লাহ তোমাদেরকে শুধু তাদের সাথে বন্ধুত্ব করতে নিষেধ করছেন যারা দ্বীনের ব্যাপারে তোমাদের সাথে লড়াই করেছে, বাড়ীঘর থেকে তোমাদের তাড়িয়ে দিয়েছে এবং তোমাদেরকে তাড়িয়ে দেয়ার ব্যাপারে পরস্পরকে সাহায্য করেছে। যারা তাদের সাথে বন্ধুত্ব করবে তারাই জালিম।// 


মহান রাব্বুল আলামীন আমাদের শিক্ষা গ্রহণ করার তাওফিক দান করুন। আত্মীয়দের দ্বীনের ওপরে স্থান দেওয়া থেকে রক্ষা করুন। জালিমদের বন্ধু বানানো থেকে রক্ষা করুন। আরো বেশি আমানতদার হওয়ার তাওফিক দান করুন। আমাদের খিয়ানত থেকে দ্বীন ইসলামকে রক্ষা করুন। আমীন।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন