১৪ সেপ, ২০২১

পর্ব : ৪১ - পরাশক্তি রোমানদের রুখে দিলেন মুহাম্মদ সা.


মদিনার খ্রিস্টান পাদ্রি আবু আমেরের প্ররোচনায় মুনাফিকরা জোরেসোরে প্রচার করতে লাগলো রোমানরা মদিনা আক্রমণ করতে এগিয়ে আসছে। এর নেতিবাচক প্রভাব মদিনায় পড়তে লাগলো। মুসলিমরা সর্বক্ষণ একটি ভীতির মধ্যে পড়ে গেল। রোমানরা পৃথিবী বিখ্যাত পরাশক্তি। সম্প্রতি তারা আরেক পরাশক্তি পারসিক (ইরান) সাম্রাজ্যকে একদম গুঁড়িয়ে দিয়েছে। তাই  রোমানদের মধ্যে আলাদা আগ্রাসী ভাব ছিল। অন্যদিকে সারা পৃথিবীতে রোমানদের ব্যাপারে ভয় কাজ করছিল। 

মুহাম্মদ সা. গোয়েন্দা মারফত খবর পেলেন আরবের উত্তরাঞ্চলে রোমানরা তাদের অনুগত অঞ্চলে সৈন্য সমাবেশ করছে। এছাড়া সম্রাট হেরাক্লিয়াসের নিজস্ব চৌকস সেনাদের মধ্যে ৪০ হাজারের একটি বাহিনী আসছে আরবে। স্থানীয় আরব সৈন্য ও বিশেষ সৈন্য দিয়ে হেরাক্লিয়াস চেয়েছেন মুসলিমদের উত্থান চিরতরে রুখে দিতে।     

নিশ্চিত খবর পাওয়ামাত্র মুহাম্মদ সা. শুরার মিটিং ডাকলেন এবং সিদ্ধান্ত অনুসারে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিলেন। তবে সিদ্ধান্ত নেওয়া সহজ ছিল না। সেই সময় মদিনায় প্রচণ্ড গরম পড়ছিল। কারো কাছে তেমন খাদ্যের মজুদ ছিল না। অনেক আধবেলা খেয়ে জীবন পার করছে। আর কিছুদিন পরে খেজুর পাকবে। যথাসময়ে ফসল আহরণ করতে না পারলে সারা বছরের ফসল নষ্ট হতে পারে। তদুপরি রোমান সীমান্ত বহুদূরের পথ।    

আবার রোমানরা যদি এগিয়ে আসে এবং আরবের কিছু অঞ্চল দখল করে তা হবে রাষ্ট্রের জন্য ব্যাপক ক্ষতির কারণ। মুসলিমদের মনোবল ভেঙে পড়তে পারে। ফলে রোমানরা অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠতে পারে। তাই মুহাম্মদ সা. দেরি করতে চাননি। তারা সংগঠিত হয়ে আক্রমণ করার আগেই যদি সীমান্তে অভিযান চালানো যায় তাহলে হয়তো রোমানরা আক্রমণ করতে সাহস পাবে না। এমন সঙ্কট সময়ে যদি রোমকদের সাথে যুদ্ধ করার ক্ষেত্রে শৈথিল্য ও অলসতার পরিচয় দেওয়া হয় তাহলে রোমানরা মুসলিম অধিকৃত ও অধ্যুষিত এলাকাসমূহে প্রবেশ করবে। ফলে ইসলামের দাওয়াত, প্রচার এবং প্রসারে মারাত্মক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হবে। মুসলমানরা আরবে সামরিক শক্তির স্বাতন্ত্র হারাবে। 

হুনাইনের যুদ্ধে পর্যুদস্ত, বাতিল ও কুফুরী শক্তি পুনরুজ্জীবিত হয়ে উঠবে। বাইরের শক্তির সাথে গোপনে যোগাযোগ রক্ষাকারী মোনাফেকরা যারা সময় ও সুযোগের অপেক্ষা করছিলো তারা মুসলমানদের পিঠে ছুরিকাঘাত করবে। পেছনে থাকবে শত্রুদল মুনাফেক আর সামনে থাকবে বিধর্মী রোমান সৈন্যদল। এতে ইসলামের প্রচার ও প্রসারে নিয়োজিত শ্রম-সাধনা ব্যর্থতার মুখোমুখি হয়ে পড়বে। নবী এবং সাহাবাদের দীর্ঘদিনের কষ্ট বিফলে যাবে। বহু আলোচনার মধ্য দিয়ে সাহাবারা যুদ্ধের সিদ্ধান্ত নিলেন এবং তা এখনই। 

মুহাম্মদ সা. এই যুদ্ধের প্রস্তুতির কথা প্রকাশ্যে এবং ব্যাপক আয়োজনের মাধ্যমে ঘোষণা দিলেন। যাতে মুসলিমরা উজ্জিবিত হন। একইসাথে রোমানরা ও মুনাফিকরা যাতে একটু দমে যায়। কারণ রোমানদের সাথে আগে হওয়া মুতার যুদ্ধ তাদের স্মরণে আছে। মুসলমানরা যেন যুদ্ধের জন্যে ভালোভাবে প্রস্তুত হতে পারেন। এ জন্যেই প্রকাশ্যে যুদ্ধের ঘোষণা দেয়া হয়েছিলো। যুদ্ধের জন্যে মুসলামনদের প্রস্তুতিতে উদ্ধুদ্ধ করতে সূরা তাওবার একাংশও নাযিল হয়েছিলো।

মদিনার সাধারণ মুসলিমদের মধ্যে অনেকেই তখন যুদ্ধে যাওয়ার ব্যাপারে অনীহা প্রকাশ করেছিল। তারা চেয়েছিল ফল পাকলে ও গরম একটু কমলে তারপর তারা যুদ্ধে যাবে। আর রোমানরা তো এখনই যুদ্ধ শুরু করে দেয়নি। তাহলে আগে যাওয়ার কী দরকার! এছাড়া মুনাফিকদের ব্যাপক প্রচারণাও দুর্বলতা তৈরিতে ভূমিকা রেখেছিলো। মুসলিমদের এই দুর্বলতা পরিলক্ষিত হওয়ায় আল্লাহ তায়ালা সূরা তাওবার ৩৮ থেকে ৭২ পর্যন্ত আয়াত নাজিল করেন। এর মধ্যে ৩৮ থেকে ৪১ পর্যন্ত ছিল মুমিনদের প্রতি হুঁশিয়ারীমূলক। আর বাকীগুলো ছিল দূর্বল ঈমানদার ও মুনাফিকদের মুখোশ উন্মোচক আয়াত। আল্লাহ তায়ালা ঈমানদারদের উদ্দেশ্য করে বলেন, 

//হে ঈমানদারগণ! তোমাদের কি হলো? যখনই তোমাদের আল্লাহর পথে বের হতে বলা হলো, অমনি তোমরা মাটি কামড়ে পড়ে থাকলে? তোমরা কি আখিরাতের মোকাবিলায় দুনিয়ার জীবন পছন্দ করে নিয়েছো? যদি তাই হয় তাহলে তোমরা মনে রেখো, দুনিয়ার জীবনের এমন সাজ সরঞ্জাম আখেরাতে খুব সামান্য বলে প্রমাণিত হবে। 

তোমরা যদি (জিহাদে) না বের হও তাহলে আল্লাহ‌ তোমাদের যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি দেবেন এবং তোমাদের জায়গায় আরেটি দলকে ওঠাবেন। আর তোমরা আল্লাহর কোনো ক্ষতি করতে পারবে না। তিনি সব বিষয়ের ওপর শক্তিশালী। 

তোমরা যদি নবীকে সাহায্য না কর, তাহলে কোন পরোয়া নেই। আল্লাহ‌ তাকে এমন সময় সাহায্য করেছেন যখন কাফেররা তাকে বের করে দিয়েছিল। যখন সে ছিল মাত্র দু’জনের মধ্যে দ্বিতীয় জন, যখন তারা দু’জন গুহার মধ্যে ছিল, তখন সে তার সাথীকে বলেছিল, চিন্তিত হয়ো না, আল্লাহ‌ আমাদের সাথে আছেন। সে সময় আল্লাহ‌ নিজের পক্ষ থেকে তার ওপর মানসিক প্রশান্তি নাযিল করেন এবং এমন সেনাদল পাঠিয়ে তাকে সাহায্য করেন, যা তোমরা দেখনি এবং তিনি কাফেরদের বক্তব্যকে নিচু করে দেন। আর আল্লাহর কথা তো সমুন্নত আছেই। আল্লাহ‌ পরাক্রমশালী ও প্রজ্ঞাময়।

তোমরা হালকা ও ভারী (অস্ত্রসহ) উভয় অবস্থায় যুদ্ধে বের হও এবং তোমাদের মাল ও জান নিয়ে আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ কর। এটা তোমাদের জন্য উত্তম, যদি তোমরা জানতে।// 

এই আয়াতের পর যেসব মুসলিমদের মধ্যে দুর্বলতা ছিল তা তারা ঝেড়ে ফেললো। সবাই যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি নিতে থাকলো। এই যুদ্ধের পেছনে মুনাফিকদের ভূমিকা ছিল। তারা ষড়যন্ত্র করার জন্য একটি মসজিদও তৈরি করে নিয়েছিল। সবমিলিয়ে তারা সিদ্ধান্ত নিল মুহাম্মদ সা. যুদ্ধে যাত্রা করলে ও বিপদে পড়লে তারা মদিনার দখল নিয়ে নেবে এবং তাদের নেতা আব্দুল্লাহ ইবনে উবাইকে নেতা বানাবে। এজন্য তারা সবাই মুহাম্মদ সা.-এর কাছে গিয়ে নানান অজুহাত পেশ করলো যাতে যুদ্ধে যেতে না হয়। মুহাম্মদ সা. তাদের সেই আবেদন কবুল করে নিলেন। এজন্য আল্লাহ তায়ালা সূরা তাওবার ৪৩ নং আয়াতে মৃদু শাসন করে বললেন, // হে নবী! আল্লাহ‌ তোমাকে মাফ করুন, তুমি তাদের অব্যাহতি দিলে কেন? (তাদের অব্যাহতি না দিলে) তুমি জানতে পারতে কারা সত্যবাদী এবং কারা মিথ্যুক।//

সূরা তাওবার আয়াতগুলো দারুণ কাজ দিয়েছে। মুসলিমরা তাদের গাফেলতি অনুভব করতে সক্ষম হয়েছে। সাহাবারা নবী সা.-এর নির্দেশ পাওয়ার পর যুদ্ধের জন্যে প্রস্তুতি শুরু করেন। মদিনার বাইরে থেকেও আগ্রহী মুসলমানরা আসতে থাকেন সেনাবাহিনীতে যুক্ত হওয়ার উদ্দেশ্যে। যাদের মনে মুনাফেকী ছিল এবং যারা মসজিদে দিরারের সাথে জড়িত তারা ছাড়া কেউ এ যুদ্ধ থেকে ‍দূরে থাকার কথা ভাবতেই পারেননি। যেহেতু দূরের পথ তাই সবার জন্য যানবাহন জরুরি ছিল। কিছু কিছু গরিব সাহাবি যানবাহনের অভাবে যুদ্ধে যুক্ত হতে পারেননি।  

দূরের পথ হওয়াতে এই অভিযানে যুদ্ধব্যয়ও ছিল বেশি। অনেক দিনের রশদ জোগাড়ের প্রয়োজন হয়েছিল। আবার মদিনায় তখন অভাব চলছিল। তারপরও সাহাবারা আল্লাহর হুঁশিয়ারী শুনে ও প্রয়োজনের বাস্তবতা উপলব্ধি করে ব্যাপক দান করেছিলেন। সাহাবারা দান করার দিক থেকে একে অন্যকে ছাড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছিলেন।

উসমান রা. সিরিয়ায় ব্যবসার জন্যে প্রেরণের উদ্দেশ্যে একটি কাফেলা তৈরি করেছিলেন। এতে সুসজ্জিত দুইশত উট ছিলো। দুশো উকিয়া অর্থাৎ প্রায় সাড়ে উনত্রিশ কিলো রূপা ছিলো তিনি এই সবই দান করে দিলেন। এরপর পুনরায় একশত উট সুসজ্জিত অবস্থায় দান করলেন। তিনি এক হাজার দিনার অর্থাৎ প্রায় ৫ কিলো সোনা নিয়ে এলেন এবং তা নবী সা. সেসব উল্টেপাল্টে দেখছিলেন আর বলছিলেন, আজকের পর থেকে ওসমান যা কিছুই করুক না কেন, তার কোন ক্ষতি হবে না। এরপর হযরত উসমান রা. আরো দান করেন। সব মিলিয়ে দেখা গেলো যে, তাঁর সদকার পরিমাণ নগদ অর্থ ছাড়াও ছিলো নয়শত উট এবং একশত ঘোড়া।

আবদুর রহমান ইবনে আওফ রা. দু’শো উকিয়া অর্থাৎ প্রায় সাড়ে উনত্রিশ কিলো রূপা নিয়ে আসেন। আবু বকর সিদ্দিক রা. তাঁর ঘর খালি করে সবকিছু নিয়ে আসেন। তাঁর দানের পরিমাণ ছিলো চার হাজার দিরহাম। উমার রা. তার সমুদয় সম্পত্তির অর্ধেক নিয়ে হাজির হন। আব্বাস রা. তাঁর বহু ধন-সম্পদ নিয়ে আসেন। তালহা রা. সা’দ ইবনে উবাদা রা. এবং মুহাম্মদ ইবনে মুসলামাও অনেক ধন-সম্পদ নিয়ে হাজির হন। আসেম ইবনে আদী নব্বই ওয়াসক অর্থাৎ সাড়ে ১৩ হাজার কিলো বা সোয়া তেরো টন খেজুর নিয়ে আসেন। অন্যান্য সাহাবারাও সাধ্যমত অর্থ-সম্পদ নিয়ে আসেন। কেউ এক মুঠো কেউ দুই মুঠোও দেন, তাদের এর বেশি দেওয়ার সামর্থ ছিলো না।

কুরআন নাজিলের পর মহিলা সাহাবিরা তাদের অলংকার দান করতে থাকেন। কেউই মাহরুম থাকেননি, কেউ পিছিয়ে থাকেননি। এরপরও মুনাফিকদের ষড়যন্ত্র থেমে থাকে নি। তারা মুসলিমদের এই বলে উপহাস করছিল, ওরা একটি দু’টি খেজুর দিয়ে কায়সারের দেশ জয় করতে চলেছে। আল্লাহ তায়ালা সূরা তাওবায় ৬৪-৬৮ নং আয়াতে তাদের বিদ্রুপের জবাব দিয়েছেন। আল্লাহ তায়ালা বলেন, 

//হে নবী! তাদের বলে দাও, “বেশ! ঠাট্টা করতেই থাকো, তবে তোমরা যে জিনিসটির প্রকাশ হয়ে যাওয়ার ভয় করছো আল্লাহ‌ তা প্রকাশ করে দেবেন।” যদি তাদের জিজ্ঞেস করো, তোমরা কি এমন কথা বলছিলে? তাহলে তারা ঝটপট বলে দেবে, আমরা তো হাসি-তামাশা ও পরিহাস করছিলাম। তাদের বলো, তোমাদের হাসি-তামাসা কি আল্লাহ, তাঁর আয়াত ও তাঁর রসূলের সাথে ছিল? তোমরা ওযর পেশ করো না। তোমরা তোমাদের ঈমানের পর অবশ্যই কুফরী করেছ। যদি আমি তোমাদের থেকে একটি দলকে ক্ষমা করে দেই, তবে অপর দলকে আযাব দেব। কারণ, তারা হচ্ছে অপরাধী।// 

এখানে একটি দল বলতে দুর্বল ঈমানদারদের বুঝানো হয়েছে আর অপরাধী দল বলতে মুনাফিকদের বুঝানো হয়েছে যারা রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিল। 

এরপর মুহাম্মদ সা. বিপুল উৎসাহ উদ্দীপনার সাথে মুসলিম সেনাদল গঠন করলেন। প্রায় তিরিশ হাজার সৈন্যের বিশাল বাহিনী। মুহাম্মদ সা.-এর অবর্তমানে মদিনার তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব দেন মুহাম্মদ ইবনে মাসলামাহ রা.-কে। মুহাম্মদ সা. মদিনার মুনাফিকদের ষড়যন্ত্র আন্দাজ করতে পেরেছেন। তাই তিনি মদিনার নিরাপত্তা ও রাসূল সা.-এর পরিবারের দেখাশোনা করার জন্য আলী রা.-কে মদিনায় রেখে যান। 

যদিও রোমানদের সাথে যুদ্ধে আলী রা.-এর মতো মহাবীরকে খুবই প্রয়োজন তারপরও তাকে রেখে যাওয়ার এই সিদ্ধান্তের মূলে রয়েছে প্রথমত আলী রা.-কে দেখে যাতে মুনাফিকরা তাদের ইচ্ছা বাস্তবায়ন করতে না পারে। দ্বিতীয়ত রোমানদের সাথে যুদ্ধে মুসলিমদের পরাজয় হলে যাতে মদিনা রক্ষা করা সম্ভব হয়। তৃতীয়ত বিপর্যয় হলে মুনাফিকরা সর্বপ্রথম আক্রমণ করবে মুহাম্মদ সা.-এর পরিবারের সদস্যদের প্রতি। সেটা যাতে সামাল দেওয়া যায়। কিন্তু মুহাম্মদ সা. সাধারণভাবে বললেন, আলীকে যুদ্ধ থেকে ছুটি দেওয়া হয়েছে সে যাতে পরিবার দেখাশোনা করতে পারে।        

বিশাল মুসলিম বাহিনী রওনা হয়ে গেল। ইতোপূর্বে এত বড় মুসলিম বাহিনীর দেখা মিলে নি। আলী রা.-এর মদিনায় অবস্থানে মুনাফিকদের গা-জ্বালা শুরু হয়ে গিয়েছিল। তারা নিজেরা যুদ্ধে যায় নি অথচ আলী রা.-এর বিরুদ্ধে কাপুরুষতার ও ভীরুতার অভিযোগ আনলো। তারা আলী রা.-কে ভীরু বলে উত্যক্ত করতে লাগলো। সাধারণত বীর যোদ্ধারা 'ভীরু' অপবাদ পাওয়া সহ্য করতে পারে না। আলী রা.-এর ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটলো। কয়েকদিন পর তিনি ঘোড়া ছুটিয়ে মুসলিম বাহিনীর সাথে যুক্ত হয়ে গেলেন।      

মুহাম্মদ সা.-এর কাছে তিনি রিপোর্ট করলে মহানবী তাকে পুনরায় মদীনায় ফেরত পাঠান। মুহাম্মদ সা. বলেন, তুমি কি এতে সন্তুষ্ট নও যে, তোমার সাথে আমার সম্পর্ক মুসা এবং হারুনের সম্পর্কের মতো। অবশ্য, আমার পরে কোনো নবী আসবে না। আলী রা. মদিনায় ফেরত এলেন। 

মুহাম্মদ সা. উত্তর দিকে তাবুক অভিমুখে রওনা হলেন। বিশাল বাহিনী। সাহাবাদের উজাড় করা দানেও যুদ্ধব্যয় মিটেনি। রশদ ও বাহনের ব্যাপক অভাব ছিল। মুসলিম সৈন্যরা একবেলা খেয়ে ও বাহন ভাগাভাগি করে বিশাল পথ পাড়ি দিচ্ছিল। মদিনা থেকে তাবুক প্রায় ৭০০ কিলোমিটারের দূরত্ব। বাহন কম এর মধ্যে খাদ্যের চাহিদা পূরণের জন্য উট জবাই করতে হচ্ছে।

যাওয়ার পথে মাদায়েনে সালেহ অর্থাৎ সালেহ আ.-এর এলাকা পড়ে। সাহাবারা সেখানে থাকা কুয়ার পানি পান করতে উদ্যত হলে রাসূল সা. নিষেধ করেন। তিনি সামুদ জাতির এলাকার পানি পান করা ও ব্যবহার করতে নিষেধ করেছেন। আল্লাহর আজাব আপতিত হয়েছে এমন এলাকা দ্রুত পার হয়ে যাওয়ার জন্য বলেছেন। তিনি নিজের মাথা আবৃত করে দ্রুত এই এলাকা ত্যাগ করেন।   

পথে পানির ভীষণ সমস্যা দেখা দিল। মুহাম্মদ সা. সাহাবাদের কষ্ট দেখে আল্লাহর কাছে বৃষ্টির জন্য দোয়া করলেন। আল্লাহ তায়ালা মেঘ পাঠিয়ে দিলেন। প্রচুর বৃষ্টি হলো। সাহাবারা তৃপ্তির সাথে পানি পান করলেন এবং প্রয়োজনীয় পানি সংরক্ষণও করলেন। তাবুকের কাছাকাছি পৌঁছার পর মুহাম্মদ সা. বললেন, ইনশাআল্লাহ আগামীকাল তোমরা তবুকের জলাশয়ের কাছে পৌঁছে যাবে। তাবুকে এসে মুসলিমদের পানির সমস্যা দূর হলো। কিন্তু সে রাতেই প্রচণ্ড মরুঝড় উঠলো। মুহাম্মদ সা. সাহাবাদের নির্দেশ দিলেন ঝড়ের সময় যাতে উঠে না দাঁড়ায়। যাদের কাছে উট আছে তারা যেন শক্ত করে উঠের রশি ধরে রাখে। আর সবাই মাথা ঢেকে বসে থাকে। মোটামুটি ক্ষয়ক্ষতি ছাড়াই ঝড় শেষ হলো। শুধু একজন সৈন্য কোনো কারণে দাঁড়িয়েছিলেন আর বাতাস তাকে উড়িয়ে নিয়ে গেছে। তিনি আহত হয়েছেন। 

এই সফরে মুহাম্মদ সা. নামাজ জমা করে পড়েছেন। অর্থাৎ যুহর-আসর একসাথে এবং মাগরিব-ঈশা একসাথে আদায় করেছেন। সেই থেকে সফরের সময় নামাজ জমা করার বিধান এসেছে। বিশাল মুসলিম বাহিনী তাবুকে আসার পর আর রোমান সীমান্তের দিকে যেতে হয় নি। আরব অঞ্চলে যারা সৈন্য সমাবেশ করেছিলো তারা ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। 

মুসলিম বাহিনীর তাবুকে উপস্থিতির খবর শুনে রোমক ও তাদের মিত্ররা ভীত হয়ে তাদের সীমান্তের অভ্যন্তরে বিভিন্ন শহরে বিক্ষিপ্ত হয়ে ছড়িয়ে পড়ল। তৎকালীন বিশ্বশক্তির এই বিনাযুদ্ধে পলায়নের ফলে সমস্ত আরব উপদ্বীপে মুসলিম শক্তির জন্য বড় রাজনৈতিক সুবিধা এনে দেয়। যেমন-

১. আয়লার খৃষ্টান শাসনকর্তা ইউহান্নাহ বিন রু’বাহ মুহাম্মদ সা.-এর সাথে সন্ধি করেন এবং তাঁকে জিজিয়া প্রদান করেন।
২. আজরুহ ও জারবা -এর নেতৃবৃন্দ এসে জিজিয়া প্রদান করে।
৩. তারা মুহাম্মদ সা.-এর কাছে আনুগত্যের শপথ করে। 
৪. মুহাম্মদ সা. দুমাতুল জান্দালের শাসনকর্তা উকায়দিরের কাছে খালিদ বিন ওয়ালিদের নেতৃত্বে একটি অশ্বারোহী বাহিনী পাঠান। উকায়দির মুহাম্মদ সা.-এর আনুগত্য মেনে নেয়।
৫. সন্ধিচুক্তি সম্পাদনের মাধ্যমে রোমান বাহিনীর সাথে কোনরূপ সংঘর্ষ ও রক্তক্ষয় ছাড়াই বিজয় সম্পন্ন হয়।
৬. যুদ্ধ ছাড়াই রোমানদের পিছু হটে যাওয়ার ঘটনা সারাবিশ্বে মুসলিম শক্তির প্রভাব বাড়িয়ে দেয়।
৭. রোমানদের গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র ও শহর সিরিয়া ও তার আশপাশের সকল খৃষ্টান শাসক ও গোত্রীয় নেতৃবৃন্দ মুসলিম শক্তির সাথে স্বেচ্ছায় সন্ধিচুক্তি স্বাক্ষর করে। ফলে আরব এলাকা বহিঃশক্তির হামলা থেকে নিরাপদ হয়।
৮.শুধু অপ্রতিদ্বন্দ্বী সামরিক শক্তি হিসাবে নয়, সর্বোচ্চ মানবাধিকার নিশ্চিতকারী বাহিনী হিসাবে মুসলমানদের সুনাম সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। দলে দলে খ্রিস্টানরা মুসলমান হয়ে যায় ।

এভাবে তাবুক অভিযানের ফলে রোমানরা আরবে তাদের কর্তৃত্ব হারায়। 

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন