১৫ সেপ, ২০২১

ইসলামে নেতা নির্বাচনের মূলনীতি কী?


হযরত আবু মাসউদ রা. বলেন, রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন : মানুষের নেতা হবে সে-ই, যে কুরআন ভাল পড়ে। যদি কুরআন পড়ায় সকলে সমান হয়, তবে যে সুন্নাহ বেশি জানে। যদি সুন্নাহেও সকলে সমান হয়, তবে যে হিজরত করেছে সে। যদি হিজরতেও সকলে সমান হয়, তবে যে বয়সে বেশি। কেউ যেন অপর ব্যক্তির অধিকার ও সেইস্থলে নেতৃত্ব না দেয় এবং তার বাড়িতে তার সম্মানের স্থলে অনুমতি ব্যতীত না বসে। (মুসলিম)

হযরত আবু সায়ীদ খুদরী রা. বলেন, রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন : যখন তিন ব্যক্তি হবে, তখন যেন তাদের মধ্য হতে একজন নেতৃত্ব দেয় এবং নেতৃত্বের অধিকার তার, যে কুরআন অধিক ভাল পড়ে। (মুসলিম)

এরকম যতগুলো হাদীস এসেছে তা সবই এই হাদীসদ্বয়ের অনুরূপ।

হাদীসটিতে রাসূল সা. নেতা হওয়ার জন্যে প্রয়োজনীয় গুণাগুণ বা যোগ্যতাগুলো যে ক্রম অনুযায়ী উল্লেখ করেছেন, তা হচ্ছে-
ক. শুদ্ধ করে পড়াসহ কুরআনের জ্ঞান থাকা,
খ. সুন্নাহ তথা হাদীসের জ্ঞান থাকা,
গ. হিজরত করা এবং
ঘ. বেশি বয়স/ প্রাজ্ঞতা/ অভিজ্ঞতা

মুসলিম পন্ডিতেরা হিজরতের ব্যাখায় বলেছেন ইসলাম প্রতিষ্ঠায় যারা গুরুত্বপূর্ণ ত্যাগ স্বীকার করেছেন। মদীনার প্রাথমিক সময়ে হিজরত ছিল সবচেয়ে বড় আমল যা করতে সবচেয়ে বেশী ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছে। হিজরত করেছেন তারা যারা দ্বীন কায়েমের জন্য তাদের সকল সহায় সম্পত্তি আত্মীয় স্বজন বিসর্জন দিয়েছেন। এখনো আমাদের দেশে যারা দ্বীন কায়েমের পথে নিয়োজিত আছেন, শ্রম দিচ্ছেন, ত্যাগ স্বীকার করছেন তারা নেতা হওয়ার জন্য অধিকতর যোগ্য।

যাই হোক এগুলো হল নেতার গুণাগুণ।

এবার আমরা আরেকটি হাদীসের দিকে দৃষ্টি দেই।

ইবনু আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত, রসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, তিন ব্যাক্তির সালাত তাদের মাথার এক বিঘত উপরেও উঠে না : যে ব্যাক্তি জনগণের অপছন্দ হওয়া সত্ত্বেও তাদের নেতৃত্ব দেয়, যে নারী তাঁর স্বামীর অসন্তুষ্টিসহ রাত যাপন করে এবং পরস্পর সম্পর্ক ছিন্নকারী দু’ ভাই। [ইবনে মাজাহ ৯৭১]

আবূ উমামা রা. থেকে বর্ণিত, আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, “তিন ব্যক্তির নামায তাদের কান অতিক্রম করে না; প্রথম হল, পলাতক ক্রীতদাস; যতক্ষণ না সে ফিরে আসে। দ্বিতীয় হল, এমন মহিলা যার স্বামী তার উপর রাগান্বিত অবস্থায় রাত্রিযাপন করে এবং তৃতীয় হল, সেই গোষ্ঠীর নেতা যাকে ঐ লোকেরা অপছন্দ করে।” [তিরমিযী ৩৬০, সহীহ তারগীব ৪৮৭]

আলী রা. থেকে বর্ণিত, যে ব্যক্তি কোনো কওমের লোকদের অনুমতি ছাড়াই তাদের নেতা হয় তার উপর আল্লাহ, সকল ফেরেশতা ও মানবকুলের অভিশাপ। তার কোন ফরয বা নাফল ‘ইবাদাত আল্লাহর দরবারে কবুল হবে না। [সুনানে আবু দাউদ ২০৩৪]

উপরিউক্ত আলোচনা থেকে আমরা নেতা নির্বাচনে ইসলামের গাইডলাইন পেয়ে থাকি।

প্রথমত : মুসলিমরা নেতা ছাড়া বিচ্ছিন্ন অবস্থায় থাকবে না। সংখ্যায় মাত্র তিনজন হলেও নেতা নির্বাচন জরুরি।

দ্বিতীয়ত : কিছু বৈশিষ্ট্য দেখে আমরা নেতৃত্ব বাছাই করবো। কুরআন জানা, হাদিসের জ্ঞান থাকা, ইসলামের জন্য ত্যাগ স্বীকার, বয়স বেশি হওয়া।

তৃতীয়ত : এসব বৈশিষ্ট্য থাকা সত্ত্বেও কেউ যদি জোর করে নেতা হয় তবে তা অবৈধ। নেতা হওয়ার জন্য জনগণের সমর্থন বা ভোট লাগবে। অধিকাংশ জনগনের সমর্থন না থাকলে তিনি ইমাম তথা নেতা হওয়ার যোগ্যতা হারান।

রাসূল সা.-এর পরে মাত্র চার শাসককে রাশিদুন খলিফা বলা হয়। রাশিদুন খলিফা মানে সঠিকভাবে পরিচালিত খলিফা। এই চার নেতাকে এই স্বীকৃতি দেওয়ার কারণ তাঁরা জনগণের ম্যান্ডেটের ভিত্তিতে ক্ষমতায় এসেছেন। জোর করে শাসক হননি। এরপর হাসান রা. সঠিকভাবে নির্বাচিত হলেও তিনি রাষ্ট্র পরিচালনা না করে বিদ্রোহীর হাতে ক্ষমতা ছেড়ে দিয়েছেন যাতে রক্তপাত এড়ানো যায়। মুয়াবিয়া রা. এবং এরপরে যারা ক্ষমতায় এসেছেন তারা জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত ভোট নিয়ে আসেননি বিধায় তারা রাশিদুন খলিফা হতে পারেন নি।

আরেকজন শাসক উমর ইবনে আব্দুল আজিজকে ইসলামের পঞ্চম খলিফা বলা হয় অর্থাৎ ওনাকে কেউ কেউ পঞ্চম রাশিদুন খলিফা বলে থাকেন এই কারণে যে, তিনি রাজতান্ত্রিকভাবে ক্ষমতা পেলেও তা ত্যাগ করে জনগণ কর্তৃক মনোনীত হয়েছেন। তাই জনগণ কর্তৃক মনোনীত হওয়া জরুরি। এটা নেতৃত্ব বৈধ কিংবা অবৈধ হওয়ার মানদণ্ড।

হুসাইন রা. ইয়াজিদের আনুগত্য করেননি কিংবা তার শাসনের বিরোধীতা করেছেন শুধুমাত্র এই পয়েন্টে। যেহেতু ইয়াজিদ মুসলিমদের ওপর আনুগত্য বা বাইয়াত চাপিয়ে দিয়েছে তাই হুসাইন রা. এই শাসনকে অবৈধ বলেছেন। আর এজন্যই তিনি জীবন দিয়েছেন। তার এই জীবন দেওয়াটাকে সঠিক হয়েছে বলে জাস্টিফাই করেছেন স্বয়ং মুহাম্মদ সা.। তিনি হুসাইন রা.-কে শহীদ হিসেবে ঘোষণা করে গিয়েছেন।

নেতা বৈধতা পায় দুইভাবে এক. আল্লাহর মনোনীত, দুই. জনগণের মনোনীত। যেহেতু আর নবী আসবেন না সেহেতু ১ম পদ্ধতি বাদ। বর্তমানে নেতা শুধু একটি পদ্ধতিতেই বৈধতা পায় আর তা হলো জনগণ কর্তৃক মনোনীত।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন