৩০ নভে, ২০২১

খিলাফত পর্ব-০২ : আলী রা. ও আবু বকর রা.-এর মধ্যে বিরোধ


উগ্র শিয়াদের অব্যাহত প্রচারণায় একথা সমাজে প্রচলিত হয়েছে যে, আলী রা. খলিফা হিসেবে আবু বকর রা.-কে মেনে নেন নি। তাই তিনি আবু বকর রা.-এর কাছে বাইয়াত নেননি। অতঃপর ছয় মাস পরে বাইয়াত নিতে বাধ্য হয়েছিলেন।

অনেক বর্ণনা থেকে জানা যায় আলী রা. চল্লিশ দিন পর অথবা ছয় মাস পর বাইয়াত নিয়েছেন। ইতিহাসবিদ ও তাফসীরকারক ইবনে কাসীর তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ আল বিদায় ওয়ান নিহায়াতে এসব বর্ণনার অসারতা প্রমাণ করেছেন। [১] প্রকৃত ব্যাপার হলো আলী রা. সোমবার মহানবী সা.-এর কাছে ছিলেন। সালিম ইবনু উবাইদ রা. থেকে বর্ণিত তিনি জানিয়েছেন, আবু বকর রা. আহলে বাইতদের বিশেষত আলী রা.-কে মুহাম্মদ সা.-এর কাছে থাকার জন্য নির্দেশ দিয়েছেন। [২][৩] মুহাম্মদ সা.-এর মৃত্যুর আগে যখন তিনি অসুস্থ ছিলেন তখন থেকেই আবু বকর রা. মুসলিমদের নামাজের ইমামতি ও নেতৃত্ব দিয়ে আসছিলেন। তাই তিনি বনু সাঈদায় যখন আনসারদের একটা অংশ বিশৃঙ্খলা করছিল তখন তিনি সেখানে যাননি। তবে অনেকের বর্ণনা থেকে জানা যায় তিনি দাফনের আগেই এসব ঝামেলায় জড়ানো পছন্দ করেন নি। অন্যদিকে উমার রা. ও আবু বকর রা. মুসলিমদের একতা ধরে রাখার ব্যাপারে গুরুত্ব দিয়েছিলেন। সেটা ঠেকাতে গিয়েই আবু বকর রা. খলিফা হিসেবে নির্বাচিত হয়েছিলেন। এর পরদিন মঙ্গলবার যখন মদিনার প্রায় ৩৩ হাজার মুসলিম আবু বকর রা.-এর কাছে আনুগত্যের শপথ নিয়েছিলেন তখন সবার সাথে আলী রা. শপথ নিয়েছিলেন।[৪][৫] এই প্রসঙ্গে আবু সাঈদ খুদরি রা. বলেন, আবু বকর রা. মিম্বরে বসে প্রথমে জনতার দিকে তাকালেন। আলী রা.-কে দেখতে না পেয়ে তাঁকে ডাকলেন। না পেয়ে তাঁর বাড়িতে লোক পাঠালেন। আলী রা. মসজিদে নববিতে আসলে আবু বকর রা. তাঁকে জিজ্ঞাসা করেন, আপনি রাসূল সা.-এর চাচাতো ভাই ও জামাতা। আপনি কি মুসলিমদের মধ্যে অনৈক্য ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে চান? আলী রা. জবাব দিলেন, ইয়া খলিফাতুর রাসূল! আমাকে আর তিরস্কার করবেন না। এই বলে তিনি আনুগত্যের বাইয়াত নিলেন। [৬][৭] আলী রা. খিলাফতের দাবীদার ছিলেন না। তবে কেউ কেউ মনে করতেন তিনি পরিবারের সদস্য হিসেবে রাসূল সা.-এর খলিফা হওয়ার জন্য উপযুক্ত। আলী রা. সম্পর্কে ভুল ধারণার সৃষ্টি হয়েছিল দুটি কারণে। প্রথমত তিনি বনু সাঈদাতে আলোচনার সময় ছিলেন না। দ্বিতীয়ত ফাতিমা রা.-এর মৃত্যুর পর পুনরায় বাইয়াত নিয়েছেন। ২য় কারণ ছিল মীরাস সংক্রান্ত জটিলতা। আলী রা. ও যুবায়ের রা. বলেন, আমরা পরামর্শ সভায় উপস্থিত হতে পারি নি। তবে আবু বকরকে এই পদের জন্য যোগ্যতম মনে করি। তাঁর মর্যাদা ও শ্রেষ্ঠত্ব সম্পর্কে আমরা সম্যক অবগত। রাসূল সা. জীবিত থাকা অবস্থায় তাঁকে দিয়ে সালাতের ইমামতি করিয়েছেন। [৮] আলী রা. ও আবু বকর রা.-এর পরবর্তী কার্যক্রম থেকে একথা প্রমাণিত হয় যে, তিনি কখনোই খিলাফতের দাবিদার ছিলেন না। তিনি আবু বকরকে নিয়মিত পরামর্শ দিতেন। শুরায় অংশ নিতেন এবং আবু বকর রা.-এর ইমামতিতে নামাজ আদায় করতেন। আবু বকর রা. যখনই তাঁর কাছে কোনো বিষয়ে সাহায্য চাইতেন ও দায়িত্ব দিতেন তিনি নিষ্ঠার সাথে পালন করতেন। আলী রা. ছিলেন আবু বকর রা.-এর একজন উত্তম শুভাকাঙ্ক্ষী। তিনি আবু বকর রা. ও তাঁর খিলাফতের স্থায়িত্ব কামনা করতেন। এর একটি বড় প্রমাণ পাওয়া যায় যুলকাসসার অভিযানের সময়। আবু বকর রা. শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার পরপরই আবস ও যুবইয়ান গোত্রের লোকেরা বিশ্বাসঘাতকতা শুরু করলে তিনি প্রতিহত করার উদ্যোগ নেন। এই উদ্দেশ্যে তিনি নিজেই জিহাদের জন্য রওনা হলেন। তখন আলী রা. বলেন, হে খলিফাতুর রাসূল! আপনি কই যাচ্ছেন? আপনি তারবারি কোষবদ্ধ করুন। নিজের জীবনকে বিপন্ন করে আমাদের বিপদে ফেলবেন না। আপনি মদিনায় ফিরে যান। আল্লাহর কসম! যদি আমরা আপনার কারণে বিপদে পড়ে যাই তাহলে ইসলামে আর কখনোই শৃঙ্খলা আসবে না। [৯][১০] এরপর আবু বকর রা. নিজে অভিযান থেকে বিরত থাকেন অন্যান্য কমান্ডারদের পাঠিয়ে জিহাদ অব্যাহত রাখেন। ভন্ড নবী ও যাকাত অস্বীকারকারীদের বিরুদ্ধে চলা যুদ্ধে আবু বকর রা.-কে নিরঙ্কুশ সাহায্য করেছেন ও যুদ্ধ করেছেন আলী রা.। তবে আলী রা. তথা নবী পরিবারের পরামর্শ ছাড়া খলিফা নির্বাচিত হয়ে যাওয়ায় তিনি মনঃক্ষুন্ন ছিলেন। এই নিয়ে তাঁর ক্ষোভ ছিল। এটা নিশ্চিত যে খলিফা হিসেবে আবু বকর রা.-কে মান্য করতে আলী রা.-এর কোনো দ্বিধা ছিল না। যারা আলী রা.-কে নেতা হিসেবে দেখতে চেয়েছিলেন তারাও আলী রা.-এর এই মনোভাব সম্পর্কে অবগত ছিলেন। তাই তারা কখনো আলী রা.-কে খিলাফতের দাবীদার হতে বলেননি। ব্যতিক্রম ছিল আবু সুফিয়ান। তিনি মক্কা বিজয়ের পর ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন বাধ্য হয়ে। স্বাভাবিকভাবেই ওনার মধ্যে ইসলামের বেসিক শিক্ষার অভাব ছিল। তিনি একদিন আলী রা.-কে বললেন, কী অদ্ভুত কাণ্ড! কুরাইশদের মধ্যে সবচেয়ে ছোট ও নিম্ন গোত্রের লোকই আজ খিলাফতের অধিকারী হয়ে গেল। আল্লাহর কসম! যদি আপনি খলিফা হতে ইচ্ছে করেন তবে আমি তার বিরুদ্ধে সমগ্র মদিনা অশ্বারোহী ও পদাতিক সৈন্য দ্বারা ভরে তুলবো। এই কথার বিপরীতে আলী রা. অত্যন্ত রাগান্বিত হয়ে যান। তিনি বলেন, হে আবু সুফিয়ান! তুমি তো দীর্ঘদিন ইসলামের সাথে শত্রুতা করেছিলে। কিন্তু তোমার সেই শত্রুতা ইসলামের বিন্দুমাত্র ক্ষতি করতে পারেনি। মনে রেখো! আমরা আবু বকরকে খিলাফতের উপযুক্তই পেয়েছি।[১১] অন্য বর্ণনায় আছে, আবু সুফিয়ান আলী রা.-কে বললেন, হে আবুল হাসান! আপনার হাত প্রসারিত করুন। আমি আপনার কাছেই বাইয়াত হবো। এর উত্তরে আলী রা. বলেন, আল্লাহর কসম! তোমার এই কথার উদ্দেশ্যে তো কেবল মুসলিমদের মধ্যে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করা। তুমি দীর্ঘদিন ইসলামের শত্রুতা করেছো। তোমার এই জাতীয় পরামর্শের আমার কোনো দরকার নেই। [১২] আবু সুফিয়ান যখন এই কথা বলছিল তখন আবু বকর রা. এর সাথে আলী রা.-এর ঝামেলা চলছিল। তারই সুযোগ হয়তো নিতে চেয়েছেন আবু সুফিয়ান। তিনি বংশ মর্যাদায় উপরে হওয়ায় আবু বকর রা.-কে নেতা হিসেবে মানতে পারেন নি। আর আলী রা.-এর সাথে ঝামেলা শুরু হয়েছে রাসূল সা.-এর উত্তরাধিকার নিয়ে। মূলত সমস্যাটা আলী রা.-এর সাথে নয়, ফাতিমা রা. ও আবু বকর রা.-এর মধ্যে। আলী রা. এখানে ফাতিমা রা.-এর পক্ষাবলম্বন করেছিলেন। মুহাম্মদ সা.-এর মৃত্যুর কিছুদিন পর ফাতিমা রা. আবু বাকর রা.-এর নিকট খবর পাঠান যে, আল্লাহ তা'আলা রাসূলুল্লাহকে মাদীনায় গানীমাত হিসেবে যে সকল বস্তু দান করেছেন এবং ফাদাক ও খাইবারের এক পঞ্চমাংশের যা কিছু অবশিষ্ট রয়েছে তা থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে আমার যে প্রাপ্য, তা আমাকে প্রদান করুন। আবু বকর রা. জবাব দেন, রাসূলুল্লাহ বলেছেন যে, নবীদের কোনো উত্তরাধিকারী হয় না। আমরা যা ছেড়ে যাবো, তা সাদাকাহ হবে। তবে রাসূলুল্লাহ সা. পরিবারের সদস্যগণ তা থেকে গ্রহণ করতে পারবেন। আল্লাহর কসম রাসূল সা. যেভাবে বলবেন আমি তার বাইরে যেতে পারবো না। ফাতিমা রা. আবু বকর রা.-এর এই মতামত গ্রহন করেন নি। আর তিনি রাসূল সা. এর এই হাদিসের ব্যাপারে অবগত ছিলেন না। এই প্রসঙ্গে আবু হুরাইরা রা. বলেন, ফাতিমা রা. আবু বকর রা. এর নিকট এসে বললেন, আপনার ওয়ারিস কে হবে? তিনি বললেন, আমার পরিবার-পরিজন ও সন্তান-সন্ততি। ফাতিমা রা. বললেন, তবে আমি কেন আমার পিতার ওয়ারিস হবো না? আবু বকর রা. বললেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে বলতে শুনেছি, আমরা নবীরা কাউকে ওয়ারিস করি না। তবে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যাদের ভরণ-পোষণ দিতেন, আমি তা বহাল রাখব এবং যাদের জন্য খরচ করে গিয়েছেন, আমিও তাদের জন্য খরচ করব। [১৩][১৪] আবু বকর রা. আল্লাহর রাসূল সা.-এর সম্পদের কিছু অংশ স্ত্রী-দের খোরপোশ ও খাদেমদের জন্য রেখে বাকীটা সাদকাহ করে দিয়েছিলেন। এই নিয়ে ফাতিমা রা. মনঃক্ষুন্ন হন। তিনি আবু বকর রা.-এর প্রতি অসন্তুষ্ট হন। তিনি আবু বকর রা.-কে বর্জন করেন এবং মৃত্যু পর্যন্ত তাঁর সাথে আর কথা বলেননি। এই নিয়ে স্ত্রীর পক্ষাবলম্বন করেন আলী রা.। তবে তিনি কখনো আবু বকর রা.-এর সাথে এই নিয়ে কথা বলেন নি। তবে তাঁদের মধ্যে কিছুটা দূরত্ব ছিল। ফাতিমা রা. রাসূলুল্লাহ সা.-এর মৃত্যুর পরে ছয়মাস জীবিত ছিলেন। যখন তিনি মৃত্যুবরণ করেন, তখন তাঁর ওসিয়ত অনুসারে স্বামী ‘আলী রা. তাঁকে রাতের বেলা সমাহিত করে ফেলেন এবং আবু বাকর রা.-কে কোনো সংবাদ দেননি। আলী রা.-এর নেতৃত্বে কিছু নিকটাত্মীয় তার জানাযার নামায পড়েন। ফাতিমা রা.-এর মৃত্যুর পরে আলী রা. চেয়েছিলেন আবু বকর রা.-এর সাথে দূরত্ব মিটিয়ে ফেলতে। এই উদ্দেশ্যে তিনি তাঁকে নিজ বাড়িতে দাওয়াত করেন। সাথেও এটাও বলেন যেন তিনি একা আসেন। এখানে উল্লেখ্য যে, উমার রা. এসব বিষয় নিয়ে রাগান্বিত ছিলেন এবং তিনি খলিফার সবচেয়ে কাছের উপদেষ্টা ছিলেন। আলী রা. চেয়েছেন উমার রা. যেন এই মীমাংসায় না থাকে। তাঁরা দুজনই নিজেদের ব্যাপারটা ক্লিয়ার করবেন। সব বিষয় জানতে পেরে উমার রা. ভয় পেলেন। তিনি একা যেতে আবু বকর রা.-কে নিষেধ করলেন। উমার রা. আলী রা.-কে নিয়ে ভয় করছিলেন না। তিনি ভয় পাচ্ছিলেন বনু হাশিম ও বনু উমাইয়াদের থাকা তুলাকা মুসলিমদের। যারা মক্কা বিজয়ের পরে ইসলাম গ্রহণ করেছিল। এরা আবু বকর রা.-কে নেতা মানতে চাইছিল না। উমার রা.-এর উদ্বেগ দেখে আবু বকর রা. বললেন, আমি এ আশঙ্কা করছি না যে, তারা আমার সাথে কোনোরূপ অন্যায় আচরণ করবে। আল্লাহর কসম! আমি তাদের নিকট যাবোই। আবু বকর রা. তাঁদের কাছে গেলেন। 'আলী (রা.) প্রথমে তাওহীদ ও রিসালাতের সাক্ষ্য দিলেন, তারপর বললেন, “আমরা আপনার মর্যাদা এবং আল্লাহ তা'আলা আপনাকে যে নিয়ামত (খিলাফাত) দান করেছেন, সে ব্যাপারে অবগত আছি। আল্লাহ তা'আলা আপনাকে যে সম্মান দান করেছেন, সে জন্য আমরা হিংসা করি না। তবে এটাও ঠিক যে, আপনি খিলাফতের বিষয়টি নিজে একাই সমাধান করে নিয়েছেন। অথচ আমাদের ধারণা ছিল রাসূলের নিকটাত্মীয় হিসেবে সে প্রসঙ্গে আমাদেরও কিছু বলার অধিকার ছিল। এ কথা শুনে আবূ বাকর রা.-এর দু'চোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়লো। তারপর তিনি তার কথা শুরু করেন। তিনি বলেন, “মহান আল্লাহর শপথ! যার হাতে আমার প্রাণ, আমার নিজের আত্মীয়-স্বজনের চাইতেও রাসূলুয়াহ সা.-এর আত্মীয়-স্বজনের সাথে সদ্ব্যবহার করা আমার কাছে অধিক প্রিয়। আমার ও তোমাদের মধ্যে যে সম্পদ নিয়ে মতানৈক্য সৃষ্টি হয়েছে, সে ক্ষেত্রে আমি যথাযথ ভূমিকা গ্রহণ করতে কোনোরূপ ভুল করিনি এবং তাতে রাসূলুল্লাহ সা.-কে যা করতে দেখেছি, আমি কেবল তা-ই করেছি। এটা শুনে ‘আলী রা. আবু বকর রা.-কে বললেন, আপনার হাতে বাইয়াতের জন্য বিকাল বেলা নির্ধারিত হলো। আবু বকর রা. জোহরের নামায আদায় করে মিম্বারের ওপর বসলেন, তারপর শাহাদাতের বাণী পাঠ করলেন। এরপর আলী রা. ও তাঁর সাথে দূরত্বের বিষয়ে কিছু কথা বললেন। এরপর তিনি আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করলেন। অতঃপর আলী রা. উঠে প্রথমে শাহাদাতের বাণী পাঠ করলেন, এরপর আবু বকর রা.-এর মর্যাদা বর্ণনা করলেন। এরপর বললেন, “আমি যা বলেছি এর অর্থ এই নয় যে, আমি আবু বকর রা.-এর সাথে কোনোরূপ বিদ্বেষ পোষণ করছি এবং আল্লাহ তা'আলা তাঁকে যে মর্যাদা দান করেছেন, তা অস্বীকার করছি। বরং প্রকৃত ব্যাপার হলো, আমরা মনে করতাম যে, খিলাফাত প্রসঙ্গে আমাদেরও কিছু বলার অধিকার রয়েছে। কিন্তু আবু বকর রা. এ ব্যাপারটি নিজেই সমাধান করেছেন। তাই আমরা মনে দুঃখ পেয়েছিলাম।” আর নবীর মীরাসের বিষয় তো আছেই। এরপর তিনি আবু বকর রা.-এর কাছে পুনরায় বাইয়াত নিলেন এবং সকল মানসিক দূরত্বকে কবর দিলেন। উপস্থিত মুসলিমগণ আনন্দিত হয়ে বললেন, আপনি ঠিকই করেছেন। এরপর ‘আলী রা. আমর বিল মা‘রূফ-এর পানে ফিরে আসার কারণে মুসলিমগণ আবার তাঁর নিকটবর্তী হতে শুরু করলেন। [১৫][১৬] তথ্যসূত্র : ১. আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া / ইবনে কাসীর / ইসলামিক ফাউন্ডেশন / ৫ম খন্ড / পৃ. ৪৭০-৪৭১ ২. সুনানে আন নাসাঈ / হাদিস নং ৭১১৯ ৩. আবূ বাকর আছছিদ্দীক / ড. আহমদ আলী / বাংলাদেশ ইসলামিক সেন্টার / পৃ. ২৩৪-২৩৫ ৪. আবূ বাকর আছছিদ্দীক / ড. আহমদ আলী / বাংলাদেশ ইসলামিক সেন্টার / পৃ. ২৩৫ ৫. আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া / ইবনে কাসীর / ইসলামিক ফাউন্ডেশন / ৫ম খন্ড / পৃ. ৪৭০ ৬. মুস্তাদরাক আল হাকিম / হাদিস নং ৪৪৩১ ৭. আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া / ইবনে কাসীর / ইসলামিক ফাউন্ডেশন / ৬ষ্ঠ খন্ড / পৃ. ৪৫০-৪৫১ ৮. আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া / ইবনে কাসীর / ইসলামিক ফাউন্ডেশন / ৬ষ্ঠ খন্ড / পৃ. ৪৫১ ৯. আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া / ইবনে কাসীর / ইসলামিক ফাউন্ডেশন / ৬ষ্ঠ খন্ড / পৃ. ৪৭১ ১০. আবূ বাকর আছছিদ্দীক / ড. আহমদ আলী / বাংলাদেশ ইসলামিক সেন্টার / পৃ. ২৩৮ ১১. মুস্তাদরাক আল হাকিম / হাদিস নং ৪৪৩৪ ১২. আবূ বাকর আছছিদ্দীক / ড. আহমদ আলী / বাংলাদেশ ইসলামিক সেন্টার / পৃ. ২৪৪ ১৩. শামায়েলে তিরমিজি / হাদিস নং ৩০৭ ১৪. মুসনাদে আহমদ / হাদিস নং ৬০ ১৫. সহীহ বুখারি / আধুনিক প্রকাশনী ৩৯১৩, ইসলামী ফাউন্ডেশন ৩৯১৭ ১৬. আবূ বাকর আছছিদ্দীক / ড. আহমদ আলী / বাংলাদেশ ইসলামিক সেন্টার / পৃ. ২৪০-২৪২

২৯ নভে, ২০২১

খিলাফত পর্ব-০১ : রাশিদুন খিলাফতের যুগ শুরু হলো যেভাবে


মুহাম্মদ সা.-এর মৃত্যুর পর বনু সাঈদা গোত্রে খাজরাজদের একদল লোক সমবেত হলো। তারা সা'দ বিন উবাদার হাতে বাইয়াত গ্রহণ করে তাকে আমীর ঘোষণা করলো। আলী রা.-এর ঘরে ছিল তালহা ইবনে উবাইদুল্লাহ রা. ও যুবাইর ইবনুল আওয়াম রা.। তারা এখন এসব ঝামেলায় জড়াতে চাননি। একদল লোক তাদের আনুগত্য করলো। তারা সম্ভবত আলী রা.-কে পরিবারের সদস্য হিসেবে নেতা মানতে চেয়েছিল।

আওস গোত্রের শাখা আব্দুল আশহাল গোত্রের নেতা উসাইদ বিন হুদাইর রা.-এর নেতৃত্বে কিছু সাহাবী আলাদা হয়ে তাকে আমীর ঘোষণা করলো। অল্প সময়ের মধ্যে সাহাবারা তিনভাগ হয়ে গেল। সা'দ বিন উবাদা রা.-এর নেতৃত্বে বেশি মানুষ জমায়েত হলো। তিনজন নেতা দেখা দিলেও মদিনার বেশিরভাগ সাহাবী এই তিনদলের কারো সাথেই যুক্ত হননি। মুহাজিররা সিদ্ধান্ত পাওয়ার জন্য আবু বকর রা.-এর কাছে হাজির হলো।

এই প্রসঙ্গে উমার রা. বলেন, //রাসূলুল্লাহ সা. ইন্তিকালের পর আমরা খবর পেলাম আনসারগণ আমাদের বিরোধিতা করছেন। তাঁরা বনু সাঈদা গোত্রের চত্বরে তাঁদের গণ্যমান্য মুরব্বীদের নিয়ে সমবেত হলেন। আলী রা., তালহা ইবনে উবাইদুল্লাহ রা., যুবাইর ইবনুল আওয়াম রা. ও তাঁদের সহচরগণ আমাদের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে রইলেন। আর আবু বকর রা.-এর কাছে জমায়েত হলেন মুহাজিরগণ। আমি আবু বকরকে বললাম, “আপনি আমাদের সঙ্গে নিয়ে আমাদের আনসার ভাইদের কাছে চলুন।” বনু সাঈদা গোত্রের কাছে যাওয়ার পথে আনসারদের দু’জন দায়িত্বশীল ব্যক্তির সাথে আমাদের দেখা হলো। তারা আনসারদের মনোভাব জানালেন। অতঃপর আমরা বনু সাঈদা গোত্রে গেলাম। আমরা সেখানে বসলে তাঁদের এক বক্তা আল্লাহর একত্ব ও রাসূলের রিসালাতের সাক্ষ্য দিয়ে এবং আল্লাহ যথোচিত প্রশংসা করে ভাষণ দিতে শুরু করলেন। বললেন, “আমরা আল্লাহর আনসার এবং ইসলামের বীর সেনানী। আর হে মুহাজিরগণ! আপনার আমাদেরই একটি দল। আপনাদের একটি শান্তশিষ্ট মরুচারী দল আমাদের সাথে এসে ইতোমধ্যেই যোগদান করেছে।” উমার বলেন, আমরা দেখতে পেলাম, তারা আমাদেরকে আমাদের মূল আদর্শ থেকেই বিচ্যুত করতে চাইছে এবং তার ওপর জোরপূর্বক নিজেদের একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে উদ্যত হয়েছে। আমি এর জবাবে চমৎকার একটা বক্তৃতা তৈরি করলাম এবং তা আমার নিজের কাছে অত্যন্ত যুৎসই মনে হয়েছিল। আমি আবু বকরকে শোনাতে চাইলাম। আবু বকরের মধ্যে এক ধরনের তেজস্বিতা ছিল যার জন্য তাঁকে আমি খুবই ভয় পেতাম এবং যথাসম্ভব তাঁর মনরক্ষা করে চলার চেষ্টা করতাম। আবু বকর বললেন, “উমার। তুমি কিছু বলো না।” তিনি তাঁদের কথার এত সুন্দরভাবে জবাব দিলেন যে, আমি মুগ্ধ হয়ে গেলাম। আমি যে বক্তব্য তৈরি করে এটি ছিল তার চাইতেও অনেক সুন্দর। তিনি বললেন, “তোমরা নিজেদের মহৎ চারিত্রিক গুণাবলী ও অবদান সম্পর্কে যা বলেছো তা যথার্থ বলেছো। আবার এ কথাও অনস্বীকার্য যে, এই কুরাইশ গোত্রের অবদান না থাকলে আরবরা ইসলাম সম্পর্কে কিছুই জানতে পারতো না। তারা আরবদের মধ্যে মধ্যম ধরনের বংশীয় মর্যাদার অধিকারী এবং তাদের আবাসিক এলাকাও সমগ্র আরব জাতির মধ্যস্থলে অবস্থিত। আমি তোমাদের সবার জন্য এই দুইজনের যেকোনো একজনকে পছন্দ করি। তোমরা এদের মধ্যে যাকে পছন্দ করো তার নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ হও ও বাইয়াত করো।” এই বলে তিনি আমার ও আবু উবাইদা ইবনুল জাররাহর হাত ধরলেন। তাঁর এই শেষের কথাটি ছাড়া আর কোনো কথা আমার কাছে খারাপ লাগেনি। আল্লাহর কসম, আমার মনে হচ্ছিল, আবু বকর থাকতে অন্য মুসলমান নেতা হতে পারে না। আবু বকরের এই ভাষণের পর আনসারদের একজন বললেন, “আমরা আরবদের মধ্যে বুদ্ধিমত্তায় যেমন নির্ভরযোগ্য, মান মর্যাদায়ও তেমনি শ্রেষ্ঠ। সুতরাং আমাদের পক্ষ থেকে একজন এবং তোমাদের (কুরাইশদের) তরফ থেকে আরো একজন আমীর হোক।” এরপর প্রচুর বাকবিতন্ডা হলো এবং বেশ চড়া গলায় কথা কথাবার্তা হতে লাগলো। আমার আশংকা হলো যে, শেষ পর্যন্ত মুসলমানদের দুই গোষ্ঠী মুহাজির ও আনসারদের মধ্যে একটা বিভেদ বা কলহের সৃষ্টি হয়ে না যায়। আমি (সকল বিতর্কের অবসান ঘটানোর উদ্দেশ্যে) তৎক্ষণাৎ বললাম, “হে আবু বকর! আপনার হাতখানা বাড়িয়ে দিন।” তিনি বাড়িয়ে দিলেন। আমি তার হাত ধরে বাইয়াত করলাম। এরপর মুহাজিররা বাইয়াত করলেন। তারপর আনসাররাও বাইয়াত করলেন। এরপর আমরা সা’দ ইবনে উবাদাকে বকাঝকা করতে আরম্ভ করলাম। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে তাদের একজন বললেন, “তোমরা সা’দ ইবনে উবাদাকে কোণঠাসা করে দিলে।” আমি বললাম, “আল্লাহই সা’দ ইবনে উবাদাকে কোণঠাসা করে দিলেন।”// নেতা নির্বাচন নিয়ে ঘটে যাওয়া এসব কাণ্ডের কারনে সোমবার গত হয়ে যায়। মঙ্গলবারের রাত চলে আসে। আরবি ক্যালেন্ডার অনুসারে দিন শুরু হয় সূর্য অস্ত যাওয়ার পর সন্ধ্যা থেকে। মঙ্গলবার সকালে আবু বকর রা. নামাজ শেষে মিম্বরে বসলেন। রাসূল সা. অসুস্থ থাকতেই মসজিদে নববিতে আবু বকর রা. ইমামতি করতেন। আমীর হিসেবে বাইয়াত নেওয়ার পরও তার ব্যতিক্রম কিছু হয়নি। আবু বকর রা. কিছু বলার আগে উমার রা. তার অনুমতি কিছু বলার জন্য দাঁড়ালেন। আল্লাহর প্রশংসা করে তিনি বলেন, “হে জনতা! গতকাল আমি তোমাদেরকে যে কথা বলেছিলাম [অর্থাৎ মুহাম্মদ সা. মারা যাননি, তিনি মুসা আ. মত সাময়িকভাবে অন্তর্ধান হয়েছেন ইত্যাদি ইত্যাদি] তা আমি কুরআন থেকে পাইনি এবং রাসূলুল্লাহু সা.ও আমাকে তা বলেননি। আমার ধারণা ছিল যে, রাসূলুল্লাহ সা. আমাদের সমষ্টিগত জীবনের সকল দিক পুরোপুরিভাবে গুছিয়ে দিয়ে সবার শেষে ইনতিকাল করবেন। কিন্তু আসলে তা ঠিক নয়। আল্লাহর যে কিতাব দ্বারা তাঁর রাসূল সা.কে নিজের মনোনীত লক্ষ্যে পরিচালিত করেছেন সে কিতাব আল্লাহ তোমাদের মধ্যে বহাল রেখেছেন। এই কিতাবকে যদি তোমরা আঁকড়ে ধর তাহলে আল্লাহ তাঁর রাসূলকে যেদিকে পরিচালিত করেছেন সেদিকে তোমাদের চালিত করবেন। আজ আল্লাহ তোমাদের মধ্যে যিনি শ্রেষ্ঠতম তাঁর কাছেই তোমাদের নেতৃত্ব সমর্পণ করেছেন। তিনি হলেন রাসূলুল্লাহ সা.-এর অন্যতম সঙ্গী, সওর পর্বত গুহায় তাঁর একনিষ্ঠ সহচর। অতএব তোমরা তাঁর কাছে বাইয়াত করে তাঁকে খলিফা বা আমীর হিসাবে গ্রহণ করো।” উমার রা.-এর এই কথার পর সাহাবার একযোগে সবাই বাইয়াত করলো। যারা গতকাল করেছিল তারাও আজ আবার আনুগত্যের শপথ করলো। অতঃপর আবু বকর রা. বক্তব্য রাখলেন। প্রথমে আল্লাহর যথোচিত প্রশংসা করলেন। তারপর বললেন, “হে জনতা! আমাকে তোমাদের দায়িত্বশীল বানানো হয়েছে। আসলে আমি তোমাদের চেয়ে উত্তম নই। আমি যদি ভাল কাজ করি তাহলে আমাকে সাহায্য করবে। আর যদি অন্যায় করি তাহলে আমাকে শুধরে দেবে। সত্যবাদিতাই বিশ্বস্ততা। আর মিথ্যাবাদিতা হলো বিশ্বাসঘাতকতা। তোমাদের কাছে যে দুর্বল বিবেচিত হয়ে থাকে সে আমার শক্তিশালী যতক্ষণ আমি আল্লাহর ইচ্ছায় তার প্রাপ্য হক না দিতে পারবো। আর তোমাদের মধ্যে যে শক্তিশালী বিবেচিত হয়ে থাকে তার কাছ থেকে যতক্ষণ প্রাপ্য হক আদায় না করবো ততক্ষণ সে আমার কাছে দুর্বল। মনে রেখ কোনো জাতি আল্লাহর পথে জিহাদ ত্যাগ করলে আল্লাহ তাকে লাঞ্চনা গঞ্জনা ও বিপর্যয়ের মুখে ঠেলে দেন। আর অশ্লীলতা, বেহায়াপনা ও নোংরামি যে সমাজে ব্যাপক আকার ধারণ করে সে সমাজকে আল্লাহ বিপদ মুসিবত ও দুর্যোগ দিয়ে ভরে দেন। যতক্ষণ আমি আল্লাহ ও আল্লাহর রাসূলের আনুগত্য করবো ততক্ষণ তোমরা আমার কথামতো চলবে। কিন্তু যখন আমি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের নাফরমানী করবো তখন তোমাদের আনুগত্য আমার প্রাপ্য হবে না। তোমরা নামাযের প্রতি যত্নবান থেকো আল্লাহ তোমাদের ওপর রহমত নাজিল করুন।” এই বাইয়াতের সময় গতকালের মতবিরোধের কোনো প্রভাব বিদ্যমান ছিল না। মুসলিমরা আবারো পরস্পর ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ হলো। প্রায় ৩৩ হাজার মুসলিম আবু বকর রা.-এর কাছে আনুগত্যের শপথ করলেন এবং তাকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে নেতা হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। এরপর মুসলিমদের নেতা হিসেবে আবু বকর রা.-এর তত্ত্বাবধানে মুহাম্মদ সা. দাফন সম্পন্ন হয়। শুরু হলো মুসলিমদের নতুন যুগ। যাকে রাশিদুন খিলাফত বলা হয়। এর পারিভাষিক মানে হলো রাসূল সা. নির্দেশিত রাষ্ট্র ব্যবস্থা। এর সময়কাল প্রায় তিরিশ বছর। যে চারজন শাসকের সময়কে রাশিদুন খিলাফত বলা হয় তাদের একত্রে খুলাফায়ে রাশিদা বলা হয়।

১৯ নভে, ২০২১

শহীদ তিতুমীর ও আমাদের করণীয়


এখন থেকে দুই শতাধিক বছর আগে এই বঙ্গে জন্ম নিয়েছেন এক অসাধারণ ব্যক্তি। যিনি মুশরিক ও নাসারাদের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে নিজের সারাজীবন বিলিয়ে দিয়েছেন। এদেশের মুসলিমদের মধ্যে প্রকৃত ইসলামী চেতনা জাগ্রত করেছেন। এদেশের তাওহীদবাদীদের সমস্যা মোকাবেলায় আত্মনিয়োগ করেছেন। 

আজ ১৯ নভেম্বর। শহীদ মাওলানা সৈয়দ মীর নিসার আলী তিতুমীর রহ.-এর শাহদাতবার্ষিকী। ১৯০ বছর পূর্বে ইংরেজ ও হিন্দুদের মিলিত শক্তির সাথে যুদ্ধে কামানের গোলার আঘাতে তিনি শাহদাতবরণ করেন। স্মরণ করছি সেই সময়ের কথা যখন ইংরেজদের সাথে চূড়ান্ত যুদ্ধে লিপ্ত হওয়ার ক্ষণ এসেছিলো তখন তিনি তার অনুসারীদের উদ্দেশ্যে রাখা প্রেরণাদায়ক বক্তব্যে বলেছেন,

ওহে ঈমানদার বীর ভাইয়েরা!
একটু পরেই ইংরেজ বাহিনী আমাদের কেল্লা আক্রমণ করবে। লড়াইতে হার-জিত আছেই। এতে আমাদের ভয় পেলে চলবে না। দেশের জন্য, ইসলামের জন্য শহীদ হওয়ার মর্যাদা অনেক। তবে এই লড়াই আমাদের শেষ লড়াই নয়। আমাদের কাছ থেকে প্রেরণা পেয়েই এ দেশের মানুষ একদিন দেশ উদ্ধার করবে । আমরা যে লড়াই শুরু করলাম, এই পথ ধরেই একদিন দেশ স্বাধীন হবে। ইনশাআল্লাহ"

- শহীদ মীর নিসার আলী তিতুমীর রহ.
(শাহাদাতবরণের আগের দিনে প্রদত্ত বক্তব্য)

মাওলানা তিতুমীর রহ. এর কাহিনী পড়লে সাধারণ চোখে মনে হবে তিতুমীর ব্যর্থ হয়েছেন। তার কেল্লা ধ্বংস হয়েছে। তার সেনাপতিদেরকে ফাঁসী দেয়া হয়েছে। কিন্তু আসলে কি তিনি ব্যর্থ হয়েছেন?

না, কখনোই নয়। তিতুমীর ব্যর্থ হননি। তিতুমীর যখন ইংরেজদের বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণা করেছেন অনেক মুসলিম (উদার) তাকে তিরস্কার করেছেন। তারা ইংরেজদের দালালি করতেন। পোষাকে ও চালচলনে ইংরেজ হওয়ার চেষ্টা করতেন। ইংরেজদের মতো করে সন্তানদের নাম রাখতেন।

এভাবে যখন মুসলিম সমাজ ইংরেজদের গোলামীতে গা ভাসিয়ে দিচ্ছিলো তখন তিতুমীরদের রহ. মতো কিছু মানুষের ঐকান্তিক চেষ্টা ও জীবন বিলিয়ে দেয়ার ঘটনায় মানুষের ইংরেজবিরোধী, সাম্রাজ্যবাদবিরোধী ও ইসলামী খিলাফত প্রতিষ্ঠার চেতনা তৈরি হয়।

এদেশের বেশিরভাগ মানুষই মৌলবাদী থাকতে পারেন না। আপাত জয়ী আদর্শের পেছনে ছুটেন। ইংরেজদের পর এদেশের মুসলিমরা কম্যুনিস্টদের পেছনে ছাতা ধরেছে। বিশ্বব্যাপী কম্যুনিস্টরা পরাজিত হওয়ার পর সেক্যুলারদের উত্থান হয়েছে। এখন মুসলিমরা ছুটছে সেক্যুলারদের পেছনে। এই সেক্যুলাররা বলতে চান রাষ্ট্রব্যবস্থা ও ধর্মকে আলাদা রাখতে।

এগুলো শয়তানের কুমন্ত্রণা। আসুন এসব অলীক চিন্তা থেকে সরে আসি। ইসলামকেই একমাত্র আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করি। মনে রাখবেন এই পথে চলতে গেলে বাধা আসবেই। আর সেই বাধায় মৃত্যু হলে আমাদের মুক্তির দ্বার উন্মোচিত হবে। আমরা হবো সফল ব্যক্তি। যে তালিকায় আছেন শহীদ হামযা রা., শহীদ উমার রা., শহীদ ইমাম আবু হানিফা রহ., শহীদ তিতুমীর রহ., শহীদ গোলাম আযম রহ., শহীদ নিজামী রহ. প্রমুখ ব্যক্তিগণ।

মাওলানা ইউসুফ আল কারযাভী তাঁর 'ইসলামি রাষ্ট্রব্যবস্থা : তত্ত্ব ও প্রয়োগ' বইতে রাসূল সা.-এর একটি হাদীসের কথা উল্লেখ করেছেন। সেটি হলো,

//মুয়াজ রা. হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন। "সাবধান! ইসলামের চাকা ঘূর্ণায়মান, তোমরাও ইসলামের সাথে ঘুরতে থাকবে। সাবধান! অচিরেই কুরআন ও ক্ষমতা আলাদা হয়ে পড়বে। অর্থাৎ ধর্ম থেকে রাষ্ট্র অচিরেই পৃথক হয়ে যাবে। তোমরা আল্লাহর কিতাব থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ো না। সাবধান! অচিরেই তোমাদের ওপর এমন শাসক চেপে বসবে যারা নিজেদের জন্য এমন ফয়সালা করবে যা তোমাদের জন্য করবে না। তোমরা যদি আনুগত্য না করো তবে তারা তোমাদের হত্যা করবে, আর যদি আনুগত্য করো তবে তোমাদের পথভ্রষ্ট করবে।

সাহাবাগণ জিজ্ঞেস করলেন, আমরা তখন কি করব হে আল্লাহর রাসূল? তিনি বললেন, তোমরা তা করবে যা ঈসা ইবনে মারয়াম আ.-এর অনুসারীগণ করেছেন। করাত দিয়ে তাদের ছিন্নভিন্ন করা হয়েছে এবং শূলে চড়ানো হয়েছে (এরপরও তারা আল্লাহর আনুগত্য থেকে সরে আসেনি)। আল্লাহর নাফরমানী করে বেঁচে থাকার চেয়ে আনুগত্যের পথে মারা যাওয়া অনেক শ্রেয়।//

করণীয় সম্পর্কে এর চেয়ে দারুণ গাইডলাইন আর কী হতে পারে! কৃতজ্ঞতা ও দোয়া শহীদ মাওলানা তিতুমীরের জন্য। আল্লাহ সুবহানাল্লাহু তায়ালা এই বীর মানুষটিকে কবুল করুন। তাঁকে সর্বোচ্চ খেতাব দান করুন। তার মর্যাদা বাড়িয়ে দিন।

সেই সাথে মহান আল্লাহ সুবহানাল্লাহু তায়ালা আমাদের সীরাতুল মুস্তাকীমে রাখুন। আমাদের ঈমানের পথে অবিচল থাকার সাহস দান করুন। আমরা যাতে কুরআন থেকে আলাদা না হয়ে যাই। আমরা যাতে সেক্যুলারদের ফিতনায় না পড়ি। রাষ্ট্রব্যবস্থা ও কুরআন একসাথে রাখার আন্দোলন তথা ইকামাতে দ্বীনের আন্দোলন আমরা যেন চালিয়ে নিয়ে যেতে পারি। মহান রব আমাদের তাওফিক দান করুন। 

আমরা যেন দ্বীন কায়েমের পথে শহীদ মাওলানা তিতুমীরের মতো জীবন দিতে পারি! আল্লাহ তায়ালা আমাদের কবুল করুন। আমীন।


১৭ নভে, ২০২১

মাওলানা ভাসানীর সাতকাহন

 

বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও কম্যুনিজমকে একসাথে লালনকারী নেতা ছিলেন মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী। নিজে মাওলানা নামধারী হলেও রাজনীতিতে ইসলামকে প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে ছিল তার ঘোর আপত্তি। আব্দুল হামিদ খান ১৮৮০ সালের ১২ ডিসেম্বর তিনি সিরাজগঞ্জের একটি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা হাজী শারাফত আলী। ছেলে-মেয়ে বেশ ছোট থাকা অবস্থায় হাজী শারাফত আলী মারা যান। কিছুদিন পর এক মহামারীতে বেগম শারাফত ও দুই ছেলে মারা যায়। বেঁচে থাকেন ছোট শিশু আব্দুল হামিদ খান। পিতৃহীন হামিদ প্রথমে কিছুদিন চাচা ইব্রাহিমের আশ্রয়ে থাকেন। ওই সময় ইরাকের এক আলেম ও ধর্ম প্রচারক নাসির উদ্দীন বোগদাদী সিরাজগঞ্জে আসেন। হামিদ তার আশ্রয়ে কিছুদিন কাটান। এরপর ১৮৯৩ সালে তিনি জয়পুরহাট জেলার পাঁচবিবি উপজেলার জমিদার শামসুদ্দিন আহম্মদ চৌধুরীর বাড়িতে লজিং থাকেন। সেখানে তিনি মাদ্রাসার ছাত্র ছিলেন এবং জমিদারের ছেলে-মেয়েকে পড়ানোর দায়িত্ব নেন। ১৮৯৭ সালে পীর নাসির উদ্দীনের সাথে আসাম যান। সেখানে পীরের সাথে দাওয়াতের কাজ করেন। উচ্চতর ইসলামী শিক্ষার উদ্দেশ্যে ১৯০৭ সালে দেওবন্দ মাদ্রসায় যান। দুই বছর সেখানে অধ্যয়ন করে আসামে ফিরে আসেন। সেখানে মাদ্রাসায় পড়ান ও দাওয়াতের কাজ করেন। ১৯১৭ সালে দেশবন্ধু নামে পরিচিত চিত্তরঞ্জন দাস ময়মনসিংহ সফরে গেলে তার ভাষণ শুনে ভাসানী অণুপ্রাণিত হন। ১৯১৯ সালে কংগ্রেসে যোগদান করে অসহযোগ আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে দশ মাস কারাদণ্ড ভোগ করেন। ১৯২৩ সালে গান্ধীর সাথে বিরোধ করে চিত্তরঞ্জন। গান্ধী অসহযোগ আন্দোলন প্রত্যাহার করে নিলে চিত্তরঞ্জন কংগ্রেস ত্যাগ স্বরাজ্য পার্টি গঠন করেন। ভাসানী স্বরাজ্য পার্টিতে যোগ দেন এবং আসামে এই দল সংগঠিত করার ব্যাপারে ভূমিকা পালন করেন। চিত্তরঞ্জনের সাথে থেকেই ভাসানী কম্যুনিস্ট আন্দোলনের সাথে পরিচিত হন এবং কম্যুনিজম দ্বারা প্রভাবিত হন। ১৯২৫ সালে তিনি তার লজিং ছাত্রী ও জমিদার কন্যা আলেমা খাতুনকে বিয়ে করেন। ১৯২৬ সালে তাকে নিয়ে আসাম গমন করেন এবং আসামে প্রথম কৃষক-প্রজা আন্দোলনের সুত্রপাত ঘটান। তিনি কৃষকদেরকে কম্যুনিস্টদের চটকদার কথা শুনিয়ে তাদের নিয়ে সম্মেলন করেন। ১৯২৯ সালে হওয়া ভাসান চরের এই সম্মেলনের পরেই তার নামের সাথে ভাসানী যুক্ত হয়। মাওলানা আব্দুল হামিদ ওঠেন মাওলানা ভাসানী। সহজাত নেতৃত্ব যোগ্যতার কারণে তিনি একাই কম্যুনিজমে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করতে থাকেন। ১৯৩১-এ সন্তোষের কাগমারীতে, ১৯৩২-এ সিরাজগঞ্জের কাওরাখোলায় ও ১৯৩৩-এ গাইবান্ধায় বিশাল কৃষক সম্মেলন করেন। ১৯৩৭ সালে মাওলানা ভাসানী কংগ্রেস ত্যাগ করে মুসলিম লীগে যোগদান করেন। জিন্নাহর দাওয়াতে ১৯৪০ সালে তিনি মুসলিম লীগের লাহোর সম্মেলনে যোগদান করেন। ১৯৪৪ সালে মাওলানা ভাসানী আসাম প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৪৫-৪৬ সালে আসাম জুড়ে বাঙালিদের বিরুদ্ধে "বাঙ্গাল খেদাও" আন্দোলন শুরু হলে ব্যাপক দাঙ্গা দেখা দেয়। এসময় বাঙালিদের রক্ষার জন্য ভাসানী বারপেটা, গৌহাটিসহ আসামের বিভিন্ন জায়গা ঘুরে বেড়ান। ১৯৪৭ সালে সিলেট গণভোটের সময় মারামারির অভিযোগে গ্রেফতার হন। ১৯৪৮-এ মুক্তি পান। ততক্ষণে আসাম ভারতের অন্তর্ভুক্ত হয়ে পড়ে। এরপর তিনি আসাম ছেড়ে টাঙ্গাইলের সন্তোষে চলে আসেন। পাকিস্তান স্বাধীনতা লাভ করার কালে মোটাদাগে বাংলায় রাজনৈতিক দল ছিল দুইটি। এক মুসলিম লীগ, দুই কৃষক প্রজা পার্টি। ১৯৪৫-৪৬ সালের পরিস্থিতিতে শেরে বাংলা একে ফজলুল হকের কৃষক প্রজা পার্টি অস্তিত্ব হারিয়েছে হিন্দুদের সাথে মিলিত হওয়ার দায়ে। একইসাথে বাংলার মানুষের কাছে ফজলুল হক প্রত্যাখ্যাত হয়েছেন। তাই পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠিত হওয়ার পর তিনি রাজনীতি থেকে স্বেচ্ছা অবসর নিয়ে আইন পেশায় সময় দিতে থাকেন। সুতরাং বুঝাই যাচ্ছে নবগঠিত পাকিস্তানে মুসলিম লীগ ছাড়া আর কারো প্রভাব ধর্তব্য ছিল না। ১৯৪৮ সালে পাকিস্তান হওয়ার পরে ঢাকায় মুসলিম লীগের রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করতেন মাওলানা আকরম খাঁ এবং খাজা নাজিমুদ্দিন। তাদের প্রভাবে দলের মধ্যে প্রায় কোণঠাসা ছিলেন সোহরাওয়ার্দী ও আবুল হাশেম নেতৃত্বাধীন বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগের অনুসারীরা। তারা মূলত ইসলামী চেতনা ধারণ করতেন না। তারা মুসলিম জাতীয়তাবাদটাকেই বেশি ধারণ করতেন। তারা মোঘলটুলিতে ১৫০ নম্বর বাড়িতে একটি কর্মী শিবির স্থাপন করেছিলেন। সেখানে তারা একটি নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করার কথা চিন্তা করছিলেন। সোহরাওয়ার্দির নির্দেশে তার অনুগত শেখ মুজিবুর রহমান কলকাতা থেকে এসে তাদের সাথে যুক্ত হন। এদিকে ভাসানী এবং তার অনুসারীরা মুসলিম লীগকে সমাজতান্ত্রিক বামধারায় রূপান্তর করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলেন। কিন্তু ইসলামী চেতনাধারীদের তোপের মুখে সেটা সম্ভব হচ্ছিল না। তাঁর কর্মস্থল আসাম ভারতের অধীনে হওয়ায় তিনিও ঢাকায় অনেকটা প্রভাবহীন অবস্থায় ছিলেন। তখন ভাসানী মুসলিম লীগ ছেড়ে অন্য দল তৈরি করার কথা ভাবছিলেন। ভাসানী টাঙ্গাইলের আরেক মুসলিম লীগ নেতা শামসুল হককে বাঙালি জাতীয়তাবাদ বুঝান এবং তাকে সাথে রাখেন। ভাসানী আদর্শিক বিষয় গোপন রেখে বাঙালিদের নিয়ে আলাদা দল গঠনের উদ্যোগ নিতে থাকেন। তারই প্রস্তুতি হিসেবে সোহরাওয়ার্দির সাথে যোগাযোগ করেন। তারা সবাই মিলে একটি সভা ডাকেন। সেই সভা ডাকার প্রস্তুতি কমিটির সভাপতি ছিলেন মওলানা ভাসানী আর সাধারণ সম্পাদক ছিলেন ইয়ার মোহাম্মদ খান। ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন ঢাকার টিকাটুলীর কেএম দাস লেন রোডের রোজ গার্ডেন প্যালেসে 'পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ' প্রতিষ্ঠিত হয়, যার সভাপতি হন আর সেক্রেটারি শামসুল হক। সহ-সভাপতি হন আতাউর রহমান খান, শাখাওয়াত হোসেন ও আলী আহমদ। শেখ মুজিবুর রহমান, খন্দকার মোশতাক আহমদ ও এ কে রফিকুল হোসেনকে যুগ্ম সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব দেওয়া হয়। কোষাধ্যক্ষ হন ইয়ার মোহাম্মদ খান। এসময় শেখ মুজিব কারাগারে অন্তরীণ ছিলেন। অন্যদিকে, পুরো পাকিস্তানের ক্ষেত্রে সংগঠনটির নাম রাখা হয় নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগ। আর এর সভাপতি হন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। নিখিল পাকিস্তানে এই দলটি আসলে কার্যকর ছিল না। এটা মূলত বাঙালিদের একটি রাজনৈতিক দল হিসেবে গড়ে উঠেছে। এভাবেই ভাসানীর প্রত্যক্ষ প্রভাবে এই অঞ্চলের মানুষের মুসলিম চেতনা বিলুপ্ত করে বাঙালী জাতীয়তার বীজ রোপিত হয় এবং ফ্যাসীবাদী দল আওয়ামী লীগের জন্ম হয়। পূর্ববঙ্গের প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনকে সামনে রেখে ১৯৫৩ সালের ৩ ডিসেম্বর কৃষক-শ্রমিক পার্টির সভাপতি শের-এ-বাংলা এ.কে. ফজলুল হক এবং হোসেন শহীদ সোহ্‌রাওয়ার্দীকে সঙ্গে নিয়ে যুক্তফ্রন্ট নামক নির্বাচনী মোর্চা গঠন করেন। ১৯৫৪ সালের প্রাদেশিক নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট বিপুল বিজয় অর্জন করে এবং পূর্ব বাংলার প্রাদেশিক পরিষদে ২৩৭ টির মধ্য ২২৮ টি আসন অর্জনের মাধ্যমে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। শেরে বাংলা ফজলুল হকের নেতৃত্বে সরকার গঠন হলেও তার সাথে ভাসানীর দন্দ্বে প্রাদেশিক সরকার টিকে নি। শুরু থেকেই ভাসানী আওয়ামী লীগ থেকে ইসলামী ভাবধারা ও চেতনা বিলুপ্তির জন্য চেষ্টা করে যাচ্ছিলেন। সোহরাওয়ার্দির বাধা সত্ত্বেও তার একক প্রচেষ্টায় ১৯৫৫ সালের শুরুর দিকে আওয়ামী মুসলিম লীগ থেকে ভাসানী মুসলিম শব্দ বাদ দিয়ে দলের নাম শুধু আওয়ামী লীগ করে। এই ‘মুসলিম' শব্দ বাদ দেবার কারণে ২০ জন প্রাদেশিক সংসদ সদস্য আওয়ামী লীগ থেকে বের হয়ে আবদুস সালাম খানের নেতৃত্বে আওয়ামী মুসলিম লীগ নামে দলবদ্ধ হয়। বাকীরা আওয়ামী লীগ নামে রাজনীতি করতে থাকে। ১৯৫৫ সাল থেকে আওয়ামী লীগ নিজেদের ধর্মনিরপেক্ষ হিসেবে ঘোষণা করে এবং দলের মধ্যে থেকে ইসলাম রিলেটেড সব শ্লোগান ও চেতনা বাদ দেয়। আর পুরো বিষয়টার নেতৃত্বে ছিল ভাসানী। ১৯৫৬ সালের ১২ সেপ্টেম্বর হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ও রিপাবলিকান পার্টির কোয়ালিশন সরকার গঠিত হয়। এর মাধ্যমে ভাসানীর দল আওয়ামী লীগ পাকিস্তানে ক্ষমতায় আসীন হয়। এটা অনেকেই জানে না যে, পুরো পাকিস্তানের ক্ষমতায় আওয়ামী লীগ আসীন হয়। সোহরাওয়ার্দি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হন। মাওলানা ভাসানী সোহরাওয়ার্দিকে আমেরিকাকে বন্ধু না বানিয়ে চীনকে বন্ধু বানানোর পরামর্শ দেয়। কিন্তু বেশিরভাগ আওয়ামীলীগ ও পাকিস্তানী রাজনীতিবিদেরা কম্যুনিস্টদের অপছন্দ করতো বিধায় সেই পরামর্শ গ্রহণ করা হয়নি। মাওলানা ভাসানী নিজ সরকারের পররাষ্ট্রনীতির বিরোধিতা করে আন্দোলন শুরু করেন। ১৯৫৬ সালে পাকিস্তান গণপরিষদে যে খসড়া শাসনতন্ত্র বিল পেশ করা হয় তাতে পাকিস্তানকে ইসলামিক রিপাবলিক বলে ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল। এর জন্য জামায়াতে ইসলামীর নেতৃত্বে পাকিস্তানের ইসলামপন্থীরা দীর্ঘদিন আন্দোলন করেছিলেন। মাওলানা ভাসানী এর বিরুদ্ধে তীব্র আন্দোলন শুরু করেন। যদিও এই আন্দোলনে তার দলের সাপোর্ট তিনি নিরঙ্কুশভাবে পাননি। মাওলানা ভাসানী পল্টনের জনসভায় ইসলামী রিপাবলিকের বিরোধিতা করে বক্তব্য দিয়েছিলেন। একইসঙ্গে কেন্দ্রে এবং পূর্ব পাকিস্তানে আওয়ামী লীগ ক্ষমতার আসীন হওয়ায় আওয়ামী লীগ অল্প সময়ের সময়ের অত্যন্ত প্রভাবশালী হয়ে ওঠে। কিন্তু আওয়ামী লীগের শাসনামল শান্তিপূর্ণ হতে পারেনি। কেন্দ্রে ও প্রদেশে আওয়ামী লীগ সরকার প্রতিষ্ঠিত হওয়ার এক সপ্তাহের মধ্যেই সরকার গৃহীত বিভিন্ন নীতির প্রশ্নে লীগের অভ্যন্তরে কোন্দল দেখা দেয়। আওয়ামী লীগ গঠিত হওয়ার সময় থেকেই অনেক বামপন্থী নেতা-কর্মী এই পার্টিতে ঢুকে পড়ে। পার্টির এই অংশ ভাসানীর নেতৃত্বে সোহরাওয়ার্দীর পররাষ্ট্রনীতি এবং ইসলামী প্রজাতন্ত্র করার বিরুদ্ধে কঠোর সমালোচনা শুরু করে। মাওলানা ভাসানী প্রকাশ্যে সমালোচনা করে বলেন যে, “আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে যে পররাষ্ট্রনীতি অবলম্বন করেছে তা পার্টির মেনিফেস্টো বিরোধী। এভাবে আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরে দুটি ভিন্নমতালম্বী গ্রুপের সৃষ্টি হয়। এই মতবিরোধ শক্তিশালী হয় ১৯৫৭ সালে আওয়ামী লীগের কাগমারী সম্মেলনে। কাগমারী সম্মেলনে ১৯৫৭ খ্রিস্টাব্দের ৮ ফেব্রুয়ারি থেকে ১০ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত অনুষ্ঠিত হয়। ৮ ফেব্রুয়ারি ডক্টর কাজী মোতাহার হোসেনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানটি আরম্ভ হয়। এই সভায় ভাসানী বক্তৃতা করেন। বক্তৃতায় অন্যান্য বিষয়ের মধ্যে তিনি বলেন, পূর্ববাংলা পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় শাসকদের দ্বারা শোষিত হতে থাকলে পূর্ববঙ্গবাসী তাদের সালামুন আলাইকুম জানাতে বাধ্য হবে। এই সালাম নিয়ে আমাদের দেশে জনপ্রিয় কথা চালু আছে ভাসানী নাকি পাকিস্তানী শাসকদের সালাম দিয়ে বিদায় জানিয়েছেন। আসলে এই কথাটি তিনি বাঙালি ও নিজ দলের নেতা সোহরাওয়ার্দিকে উদ্দেশ্য করে বলেছিলেন। এই কথাটি যখন তিনি বলেন তখন পাকিস্তান কেন্দ্রের সরকারে ছিল আওয়ামী লীগ। আওয়ামী লীগই পাকিস্তানের ক্ষমতাসীন দল। ভাসানী ক্ষমতাসীন দলের সবচেয়ে প্রভাবশালী নেতা। নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সভাপতি সোহরাওয়ার্দি ছিলেন প্রধানমন্ত্রী। পূর্ব পাকিস্তান শোষিত হচ্ছে এটা হচ্ছে ভাসানীর রাজনৈতিক মিথ্যে কথা। সে এর মাধ্যমে সমস্ত বাঙালি বিশেষত আওয়ামীলীগের লোকদেরকে সোহরাওয়ার্দির বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে দিতে চেয়েছিলো। মূলত কাগমারী সম্মেলনে ভাসানী পাক-মার্কিন সামরিক চুক্তি বাতিলের দাবি জানান। এই চুক্তিতে চীন নাখোশ হয়েছে। চীনের খুশি বা অখুশিই ভাসানীর খুশি বা অখুশি। পাকিস্তানের সংবিধান প্রণয়নের ব্যাপারেও সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে ভাসানীর মতবিরোধ দেখা দেয়। প্রস্তাবিত পাকিস্তান সংবিধানে সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর পৃথক নির্বাচন ব্যবস্থার বিরুদ্ধে ভাসানী তীব্র প্রতিবাদ করেন। সোহরাওয়ার্দী পৃথক নির্বাচনের পক্ষপাতি ছিলেন। ইসলামিক রিপাবলিকের ব্যাপারেও ভাসানীর আপত্তি ছিলো। এতে সংখ্যালঘুদের অধিকারহরণ হবে বলে তিনি মনে করতেন। ভাসানী তাঁর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ঘেঁষা বৈদেশিক নীতিরও বিরোধিতা করেন। তিনি চেয়েছিলেন চীনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তুলতে। ভাসানী কাগমারি সম্মেলন করেছে মূলত চীনের চাপে। কাগমারি সম্মেলনের পর পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সভাপতি ভাসানী বিরুদ্ধে প্রকাশ্যেই কথা বলতে থাকেন দলের ডানপন্থী ও উদারপন্থীরা। অনেকটা কোণঠাসা ভাসানী মাসখানেক পরে ১৮ মার্চ আওয়ামী লীগ থেকে পদত্যাগ করেন। কারণ হিসেবে তিনি উল্লেখ করেন সোহরাওয়ার্দীর চুক্তি বাতিলের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান। একই বছর ২৫ জুলাই ভাসানীর নেতৃত্বে ঢাকার রূপমহল সিনেমা হলে 'ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি' (ন্যাপ) গঠিত হয়। ন্যাপ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ভাসানী প্রকাশ্যে বামপন্থী রাজনীতির সাথে জড়িয়ে পড়েন এবং এরপর থেকে সবসময় বাম ধারার রাজনীতির সাথেই সংশ্লিষ্ট ছিলেন। এজন্য তাকে তার বিরোধীরা উপহাস করে লাল মাওলানা বলতো। শেখ মুজিব বলতো চায়না হুজুর। ন্যাপ গঠনের পর প্রাদেশিক পরিষদের ২৮ জন সদস্য আওয়ামী লীগ থেকে সরে এসে ন্যাপে যোগ দেন। এরপর আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে আসেন মাওলানা আব্দুর রশিদ তর্কবাগীশ। ১৯৬৩-র মার্চ মাসে ভাসানী আইয়ুব খানের সাথে সাক্ষাত করেন। একই বছর ২৪ সেপ্টেম্বর চীনের বিপ্লব দিবস-এর উৎসবে যোগদানের জন্য ঢাকা ত্যাগ করেন এবং চীনে সাত সপ্তাহ অবস্থান করেন। তিনি আইয়ুব ও চীনের মধ্যে মধ্যস্থতাকারীতে পরিণত হন। ১৯৬৪-র ২৯ ফেব্রুয়ারি ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি পুনরুজ্জীবিত করে দলের সভাপতির দায়িত্বভার গ্রহণ করেন এবং একই বছর ২১ জুলাই সম্মিলিত বিরোধী দল (কপ) গঠনে ভূমিকা পালন করেন। ভাসানী ১৯৬৫ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বিরোধী দলগুলোর সাথে যুক্ত থেকে বিশ্বাসঘাতকতা করেন ও আইয়ুবকে জিতিয়ে দেন। ১৯৬৫-র ১৭ জুলাই আইয়ুব খানের চীন ঘেঁষা পররাষ্ট্র নীতির প্রতি সমর্থন জ্ঞাপন করেন। ৬০ দশকে সারা পৃথিবীর সমাজতন্ত্রীদের মধ্যে মতবিরোধ তৈরি হয়। পাকিস্তানেও তার ব্যতিক্রম হয় না। ১৯৬৭ সালের কাউন্সিল অধিবেশনের পূর্বে মস্কোপন্থী নেতারা বিশৃঙ্খলা করার চেষ্টা চালায়। তাই মশিউর রহমান যাদু মিয়ার পরামর্শে রংপুরে কাউন্সিল অধিবেশন আহ্বান করা হয়। ১৯৬৭ সালের ৩০ নভেম্বর রংপুরে অনুষ্ঠিত কাউন্সিল অধিবেশনের পর দেশিয় ও আন্তর্জাতিক রাজনীতির প্রশ্নে ন্যাপ চীনপন্থী ও মস্কোপন্থী এ দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে। চীনপন্থী ন্যাপের সভাপতি হন মওলানা ভাসানী এবং মস্কোপন্থী ন্যাপের সভাপতি হন পাকিস্তানের সীমান্ত প্রদেশের (খাইবার পাকতুন) আবদুল ওয়ালী খান। পূর্ব পাকিস্তান ওয়ালী ন্যাপের সভাপতি ছিলেন অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ। এ অংশ বাংলায় মোজাফফর ন্যাপ নামেও পরিচিত হয়। ১৯৬৭ সালে ভুট্টোর নেতৃত্বে ও রাজনৈতিক জোট পিডিএমের নেতৃত্বে আইয়ুব বিরোধী আন্দোলন শুরু হয়। ১৯৬৯ সালে পশ্চিম পাকিস্তানে সেই আন্দোলন জমে উঠে। তখন ভাসানী শেখ মুজিবকে মুক্ত করার ইস্যু নিয়ে পূর্ব পাকিস্তানে আন্দোলন শুরু করেন। আইয়ুব শেখ মুজিবকে মুক্তি দিল ও আগরতলা মামলা থেকে অব্যাহতি দিল। এবার ভাসানী আর শেখ মুজিব মিলে আইয়ুবের পক্ষে ভূমিকা রাখে। মূলত শেখ মুজিবকে এই শর্তে ছাড়া হয়। ১৯৬৯ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি আইয়ুব খান জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দেন। বিরোধী দলগুলোর সাথে আলোচনা করার জন্য তিনি ২৬ ফেব্রুয়ারি গোলটেবিল বৈঠক আহ্বান করেছিলেন। তিনি চেয়েছেন যেন আন্দোলনকারী সব দল তার সাথে আলোচনায় বসে। ২২ ফেব্রুয়ারি আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার করে আইয়ুব খান। শেখ মুজিবসহ ৩৪ জনকে মুক্তি দেওয়া হয়। ২৩ তারিখ গণসংবর্ধনা দেওয়া হয় শেখ মুজিবকে। সেখানে তাকে বঙ্গবন্ধু উপাধি দেওয়া হয়। সারা ঢাকা শহরে আনন্দ মিছিল করে ছাত্রলীগ। রণক্ষেত্র ঢাকা থেকে উৎসবের ঢাকায় পরিণত হয়। মুজিব তার জনপ্রিয়তার শীর্ষে পৌঁছে যান। বক্তৃতায় শেখ মুজিব সব বিরোধী দলকে শান্ত থাকার জন্য আহবান করেন এবং প্রেসিডেন্টের সাথে গোল টেবিল আলোচনায় যোগ দেওয়ার জন্য আহ্বান জানান। তিনি আইয়ুবের প্রতি আস্থা রাখার জন্য আওয়ামী লীগসহ সব বিরোধী দলকে আহ্বান জানান। মুজিবের মুক্তির পর রাওয়ালপিন্ডি থেকে উড়ে আসেন জুলফিকার আলী ভুট্টো। তিনি ভাসানী ও মুজিবের সাথে বৈঠক করেন। ধারণা করা হয় তিনি আইয়ুব বিরোধী আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেন। কিন্তু ঢাকায় আর কেউ আইয়ুব বিরুদ্ধে আন্দোলন করেনি। না মুজিব না ভাসানী। ভুট্টোর নেতৃত্বে পশ্চিম পাকিস্তানে তীব্র আন্দোলন চলতে থাকে। এমতাবস্থায় আইয়ুব খানের ওপর সেনাবাহিনীর চাপ বৃদ্ধি পেতে থাকে। মুজিবের মুক্তির ১ মাস পর অবশেষে ২৫ মার্চ আইয়ুব খান সেনাপ্রধান ইয়াহিয়া খানের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করে পদত্যাগ করেন। এরপর ইয়াহিয়া খান ক্ষমতায় এসে নির্বাচনের ঘোষণা দিলে ভাসানী নির্বাচন থেকে মানুষকে দূরে রাখার চেষ্টা করেন। তিনি বাংলাদেশকে একটি কম্যুনিস্ট রাষ্ট্রে পরিণত করার চেষ্টা করেছিলেন। তিনি বুঝতে পেরেছেন পাকিস্তানের সাথে থেকে এই দেশকে কম্যুনিস্ট বানানো যাবে না। নির্বাচিত শাসক ক্ষমতায় এলে বাংলাদেশকে বিচ্ছিন্ন করার দাবী দৃঢ় হবে না তাই তিনি আওয়াজ তুললেন, ভোটের বাক্সে লাথি মারো বাংলাদেশ স্বাধীন করো। কিন্তু এদেশের মানুষ তার আহ্বানে সাড়া না দিয়ে উল্টো তাকেই লাথি মেরে রাজনীতি থেকে সরিয়ে দিল। তার দল ন্যাপ এই ইস্যুতে দুইভাগ হয়ে যায়। বাংলার জনগণ আওয়ামী লীগকে ভোট দেয়। আওয়ামী লীগ এই নির্বাচনে তাদের হারিয়ে ফেলা ইসলামী চেতনাকে ফিরিয়ে এনে মানুষের সমর্থন আদায়ের চেষ্টা চালিয়ে গিয়েছিলো। এরপরে তো ৭১ এর যুদ্ধ শুরু হলো। ভাসানী এই সময় থেকে মূলত দৃষ্টির আড়ালে চলে যায়। তিনি পাকিস্তানকে ভাঙতে চেয়েছেন কিন্তু তার গুরু অর্থাৎ চীনা কমিউনিস্ট পার্টি তাকে এই কাজে বাধা দিয়েছে। চীন ও পাকিস্তান তখন টেকনিক্যালি মিত্র ছিল কারণ উভয়ের শত্রু ভারত। একাত্তরের সময় থেকে ভাসানী বিভ্রান্ত ছিল সিদ্ধান্ত নিয়ে। তার অনুসারীর অনেকে পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে সাহায্য করে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে। কেউ কেউ আবার মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে ভূমিকা রেখেছে। ভাসানী ভারতে অবস্থান করেছেন। ভারত চীনপন্থী হিসেবে তাকে প্রথমে বন্দি পরে ছেড়ে দিয়ে কড়া নজরদারীর মধ্যে রেখেছিলো। যুদ্ধের পরে দেশে ফিরে নানান সময়ে নানান আন্দোলন করেছিলেন। ১৯৭২-এর ২৫ ফেব্রুয়ারি সাপ্তাহিক হক-কথা প্রকাশ করেন। ১৯৭৪-এর ৮ এপ্রিল হুকুমতে রাব্বানিয়া সমিতি নামে নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করেন। একই বছর জুন মাসে তিনি মুজিবের শোষণের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করলে টাঙ্গাইলের সন্তোষে গৃহবন্দি হন। এরপর মুজিবের মৃত্যু হওয়া পর্যন্ত তিনি ঘর থেকে বের হতে পারেননি। ১৯৭৬-এর ১৬ মে ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণের প্রতিবাদে ঐতিহাসিক লং মার্চে নেতৃত্ব দেন। এর মাধ্যমে তার হারানো জনপ্রিয়তা ফিরে পেতে শুরু করে। তিনি তৎকালীন শাসক জিয়াউর রহমানকে সাপোর্ট করেন। ১৯৭৬ সালে ১৭ নভেম্বর তিনি ইন্তেকাল করেন। এরপর তার দলের নেতৃত্বে আসেন মশিউর রহমান যাদু মিয়া। তিনি ন্যাপের সকল নেতা কর্মী নিয়ে জিয়াউর রহমানের বিএনপিতে যোগ দেন। যদিও ভাসানী আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা তবে তার একনিষ্ঠ অনুসারীরা বিএনপিতে যুক্ত হয়েছে। দেশের শীর্ষ দুটি দল গঠনে তার ভূমিকা রয়েছে।

১২ নভে, ২০২১

হিরো থেকে যেভাবে অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়লেন ইয়াসির আরাফাত


এই আলোচনা শুরু করার জন্য একটু অতীত থেকে শুরু করা দরকার। তাহলে বুঝতে সুবিধা হবে। ১৮৮০ সালের দিকে ফিলিস্তিন ছিল তুর্কি সালতানাতের অধীনে। তখন ইউরোপিয়ানরা বিশেষত ব্রিটেন মুসলিমদের জাতীয়তাবাদের উদ্ভব ঘটায়। আরব-অনারব ইস্যু তুলে মুসলিমদের মধ্যে বিভেদ তৈরি করে। অভিজাত আরবরা নিজেদের সবসময় মুসলিমদের নেতা মনে করতো। এটাকে ব্যবহার করে তারা আরব জাতীয়তাবাদের উত্থান ঘটায়। মুসলিমদের নেতা হিসেবে তারা তুর্কিকে অস্বীকার করতে থাকে।    


অন্যদিকে তখন ইহুদীরা বেশি ছিল রাশিয়া, জার্মানী ও পোল্যান্ডে। আর পুরো ইউরোপের রাষ্ট্রগুলোতে তাদের অবস্থান ছিল। দুর্ভাগ্যজনকভাবে সব রাষ্ট্রেই কমবেশি তারা নির্যাতিত হতো। তখন পৃথিবীতে সুপার পাওয়ার ছিল ব্রিটেন ও উসমানীয় সালতানাত। নির্যাতিত ইহুদীরা এই দুই রাষ্ট্রে পালিয়ে আসতে থাকে। ব্রিটেন শরনার্থীদের আশ্রয় দিতে না চাইলে সবাই একযোগে তুর্কি অঞ্চলে আসতে থাকে। তুর্কি সালতানাত তখন বিশাল। ইহুদী শরনার্থীরা বিচ্ছিন্নভাবে তুর্কি সালতানাতে প্রবেশ করে এবং যার যেখানে সুবিধা সেখানে বসবাস শুরু করে।


ইহুদীদের এই দুরবস্থা নিয়ে তাদের মধ্যে থাকা পণ্ডিতেরা কাজ শুরু করে। অনেকেই কাজ করেন, তবে এর মধ্যে অগ্রগণ্য ছিলেন থিয়োডোর হার্জেল। ১৮৯৬ সালে প্রকাশিত তার পুস্তিকা 'ডের জুডেনস্টাটে' তিনি বিংশ শতাব্দীতে একটি ভবিষ্যৎ স্বতন্ত্র ইহুদি রাষ্ট্র কায়েমের স্বপ্ন দেখেন এবং এর জন্য তিনি স্থান নির্ধারণ করেন জেরুজালেমকে কেন্দ্র করে ফিলিস্তিনকে।


তার এই পুস্তক ইহুদীদের মধ্যে ব্যাপক সাড়া ফেলে। তবে কিছু ইহুদী এর বিরোধীতা করে। তাদের ধর্মীয় বিবেচনায় তাদের রাষ্ট্রগঠন তাদের ধ্বংসের কারণ হবে। এই গ্রুপ ছোট হলেও তারা এখনো বিদ্যমান। আবার কিছু ইহুদী রাষ্ট্রগঠনের বিরোধী ছিল এই মর্মে যে, তুর্কি খলিফা এই রাষ্ট্র গঠনের প্রক্রিয়াতে রাগান্বিত হয়ে তাদের ওপর নির্যাতন চালাবে এবং তুর্কি থেকে উচ্ছেদ করবে এই ভয়ে। সেসময় ফিলিস্তিন অঞ্চল তুর্কি সালতানাতের মধ্যে অবস্থিত ছিল।


সব বাধা উপেক্ষা করে হার্জেল তার পরিকল্পনা বাস্তবায়নে একনিষ্ঠ ছিল। ১৮৯৭ সে সর্বপ্রথম ইহুদী সমাবেশ করে এবং তার ধারণা সবার মাঝে ছড়িয়ে দিতে সক্ষম হয়। তার এই রাষ্ট্রের পরিকল্পনা জায়নবাদ নামে পরিচিত হয়। হিব্রু ভাষায় জায়ন মানে জেরুজালেম। শুরুতে শুধু ইহুদীরাই শুধু জায়নবাদী থাকলেও এখন যারা ইহুদী রাষ্ট্রের পক্ষে অবস্থান করে তারা সবাই জায়নবাদী হিসেবে পরিচিত। আরো নির্দিষ্ট করে বলতে চাইলে যারা মনে করে (সে যে ধর্মেরই হোক না কেন) জেরুজালেম ইহুদীদের অধিকারে থাকবে তারাই জায়নবাদী।


এই জায়নবাদীদের একটি কুমিরের সাথে তুলনা করে সাবেক তুর্কি প্রধানমন্ত্রী ড. নাজিমুদ্দিন এরবাকান বলেন, //জায়নবাদ হল একটি কুমিরের মত।এর উপরের চোয়াল হল আমেরিকা আর নিচের চোয়াল হল ইউরোপীয় ইউনিয়ন। এর জিহ্বা আর দাঁত হল ইসরাঈল। এবং এর শরীর সহ অন্যান্য অঙ্গসমূহ হল মুসলিমদেশ সমূহ সহ অন্যান্য রাষ্ট্রের শাসকগোষ্ঠী, মিডিয়া ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান এবং এর সাথে সম্পৃক্ত বিভিন্ন সংগঠন।//


থিওডোর হার্জেল ফিলিস্তিনে ইহুদীদের জন্য কলোনী বা আবাসভূমি গঠনের প্রস্তাব নিয়ে তুর্কি সুলতান আব্দুল হামিদ সানির সাথে দেখা করে। বিনিময়ে উসমানীয় সালতানাতের একটি বড় ঋণ পরিশোধের প্রতিশ্রুতি দেয়। আব্দুল হামিদ তাতে রাজি হননি এবং তাদের দেশ দখলের পরিকল্পনা বুঝতে পেরে জেরুজালেম ও তার আশে পাশে জমি বিক্রয় নিষিদ্ধ করে দেন।


১৯০৪ সালে হার্জেলের মৃত্যুর পর জায়নবাদকে নেতৃত্ব দেন ইহুদী ধনকুবের ও ব্যাংক ব্যবস্থার প্রবর্তক ব্যারন রথচাইল্ড। এদিকে উসমানীয় সালতানাত ভাঙতে মরিয়া ছিল ব্রিটেন। মুসলিমদের ঐক্য নষ্ট করে তারা। সালতানাতের বিরুদ্ধে আরব জাতীয়তাবাদকে জাগ্রত করে। তাদেরকে বুঝানো হয় অনারব তুর্কি ছোট জাত। তাদের অধিকার নেই আরব মুসলিমদের নেতৃত্ব দেওয়ার। আরবদের কাছেই নবী এসেছে তাই আরবরাই মহান। নেতৃত্বের হকদার তারা। ব্রিটেন আরব নেতা শরীফ হুসেইনকে মুসলিম বিশ্বের নেতা করে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল।


অন্যদিকে উসমানীয় ভূমি দখলের পর ভাগ বাটোয়ারা করে ফ্রান্স ও রাশিয়ার সাথে রিভাল চুক্তির মাধ্যমে। আর ইহুদীদের সাথে চুক্তি করে জেরুজালেমকে কেন্দ্র করে তাদেরকে একটি রাষ্ট্র তৈরিতে সাহায্য করবে। এই বিষয়ে ব্রিটেন পররাষ্ট্র মন্ত্রী বেলফোর জায়নবাদী নেতা রথচাইল্ডকে একটি পত্র দেন, যা বেলফোর ঘোষণা নামে পরিচিত।


মোটকথা ব্রিটেন আরব নিয়ে একইসাথে তিন পক্ষের সাথে তিনটি চুক্তি করে


(ক) বৃটেন আরব নেতাদের আশ্বাস দিল, তারা কুরাইশ বংশের শরীফ হুসেইনের মাধ্যমে আরব রাজ্যের কর্তৃত্ব পাবে।

(খ) ফ্রান্স এবং বৃটেন চুক্তি করলো, ঠিক ঐ এলাকাগুলোই বৃটেন এবং ফ্রান্স ভাগ করে নিবে। সিরিয়া, লেবানন, জর্ডান পাবে ফ্রান্স অন্যদিকে হেজাজ, ফিলিস্তিন, জেরুজালেমসহ বাকী আরব ব্রিটেন পাবে।

(গ) জেরুজালেমকে কেন্দ্র করে ইহুদীদের একটি রাষ্ট্রগঠনের সুযোগ দেওয়া হবে।


১ম বিশ্বযুদ্ধে ফিলিস্তিনের আরব জাতীয়তাবাদী মুসলিমরা ব্রিটেনকে সাপোর্ট করে। তাদের সহায়তায় ব্রিটেন ও ফ্রান্স সহজে মধ্যপ্রাচ্য দখল করে। উসমানীয় সৈন্যরা পরাজিত হয়ে চলে যায়। অন্যদিকে ইহুদীরা চুক্তি অনুযায়ী ব্রিটেনকে প্রযুক্তিগত, আর্থিক ও গোয়েন্দা সুবিধা দেয়। প্রসঙ্গত বলে রাখি উসমানীয় সরকারে একটি উল্লেখযোগ্য অংশ ইহুদী গুরুত্বপূর্ণ পদে কর্মরত ছিল। এর ফলে রাষ্ট্রীয় তথ্য ব্রিটেনের কাছে চলে যেত। ১ম বিশ্বযুদ্ধে মধ্যপ্রাচ্যে উসমানীয় সেনাদের পরাজয়ে জাতীয়তাবাদী মুসলিমরা ও ইহুদীরা ভালো ভূমিকা রেখেছে। তাই এই ফ্রন্টে সহজেই ব্রিটেন ও ফ্রান্সের সেনারা জয়লাভ করে।


১৯১৭ সালে থেকে ১৯৪৮ সাল পর্যন্ত ফিলিস্তিনের ভূমি ব্রিটেনের নিয়ন্ত্রণে ছিল। ইহুদীদের কাছে ব্রিটেন প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল যে ফিলিস্তিনের জমিতে তাদের জন্য একটি রাষ্ট্র গঠনের সুযোগ করে দিবে। সেজন্য ইহুদীরা কাজ করতে থাকে। সারাবিশ্ব থেকে চাঁদা তুলে ইহুদীরা ফিলিস্তিনের গরিব মুসলিমদের থেকে জমি ক্রয় করা শুরু করে। কিছু ক্ষেত্রে জোর করেও দখল নিতে থাকে। সারা পৃথিবীকে উদ্বাস্তু ইহুদীদের ফিলিস্তিনে আনা হয় ও তাদের পুনর্বাসন করা হয়।


সিরিয়া থেকে আসা উসমানীয় সেনা কমান্ডার ইজেদ্দিন আল কাসসাম ব্রিটেন ও ইহুদীদের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলন ও পরে সশস্ত্র আন্দোলন করেন। তিনি মুসলিমদের জমি বিক্রয়ের ব্যাপারেও সতর্ক করেন। 


১৯৩৩ সালের পর থেকে জার্মানির শাসক হিটলার ইহুদিদের প্রতি কঠোর হতে শুরু করেন। ইতোমধ্যে জাহাজে করে সারা বিশ্ব থেকে হাজার হাজার ইহুদি অভিবাসী ফিলিস্তিনী ভূখণ্ডে আসতে থাকে। তখন ফিলিস্তিনী আরবরা বুঝতে পারে যে তাদের অস্তিত্ব হুমকির মুখে পড়ছে।


ইহুদীবাদীদের তিনটি সন্ত্রাসী সংগঠন ছিল হাগানাহ, ইরগুন ও স্ট্যার্ন গ্যাং। যারা হত্যা, সন্ত্রাস, ধর্ষণ আর ধ্বংসযজ্ঞ সৃষ্টির মাধ্যমে নিরীহ ফিলিস্তিনদের বাধ্য করে নিজ মাতৃভূমি ছেড়ে চলে যেতে। আল কাসসাম তাদের বিরুদ্ধে শক্ত প্রতিরোধ গড়ে তোলে। ১৯৩৫ সালে এক খন্ডযুদ্ধে আল কাসসামকে খুন করে ব্রিটিশ সেনাবাহিনী।


আল কাসসামের শাহদাতের মধ্য দিয়ে আরব জাতীয়তাবাদী মুসলিমদের টনক নড়ে। ১৯৩৬-১৯৩৯ সালে ফিলিস্তিনী আরবরা নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য বিদ্রোহ করে। কিন্তু আরবদের সে বিদ্রোহ কঠোর হাতে দমন করেছে ব্রিটিশ সৈন্যরা।


বরাবরের মতো ব্রিটেন আরব এবং ইহুদী- দু'পক্ষকেই হাতে রাখতে চেয়েছে। ১৯৩৯ সালের মাঝামাঝি ব্রিটেনের সরকার একটি শ্বেতপত্র প্রকাশ করে যেখানে বলা হয়েছিল পরবর্তী পাঁচ বছরের জন্য পঁচাত্তর হাজার ইহুদি অভিবাসী আসবে ফিলিস্তিনী ভূখণ্ডে। অর্থাৎ সংখ্যা কমিয়ে আনা হয়েছিল। ব্রিটেনের এ ধরনের পরিকল্পনাকে ভালোভাবে নেয়নি ইহুদীরা। তারা একই সাথে ব্রিটেন এবং আরবদের বিরুদ্ধে লড়াই করার পরিকল্পনা করে।


১৯৪০ সালে ৩২ হাজার ইহুদি ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে যুক্ত ছিল। সেই ইহুদি সৈন্যরা বিদ্রোহ করে ব্রিটেন এবং আরবদের বিরুদ্ধে লড়াই শুরু করে। এদিকে ২য় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে ব্রিটেন ইহুদীদের সব দাবি মেনে নিয়ে আপাতত বিদ্রোহ থামায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় হিটলারের বাহিনীর দ্বারা বহু ইহুদি হত্যাকাণ্ডের পর নতুন আরেক বাস্তবতা তৈরি হয়। ১৯৪৫ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হবার পর যেসব ইহুদি বেঁচে ছিলেন তাদের জন্য জন্য কী করা যায় সেটি নিয়ে আলোচনা শুরু হয়।


তখন ফিলিস্তিনী ভূখণ্ডে ইহুদীদের জন্য একটি আলাদা রাষ্ট্র গঠনের চিন্তা আরো জোরালো হয়। ২য় বিশ্বযুদ্ধের পর ব্রিটেন পৃথিবীতে তার একক কতৃত্ব হারায়। নতুন পরাশক্তি হিসেবে আমেরিকার উত্থান হয়। তৎকালীন প্রেসিডেন্ট হ্যারি ট্রুম্যান ইসরায়েল রাষ্ট্রের পক্ষে জোরালো অবস্থান তুলে ধরেন। ট্রুম্যান চেয়েছিলেন হিটলারের হাত থেকে বেঁচে যাওয়া এক লক্ষ ইহুদিকে অতি দ্রুত ফিলিস্তিনের ভূখণ্ডে জায়গা দেয়া হোক। কিন্তু ব্রিটেন বুঝতে পারছিল যে এতো বিপুল সংখ্যক ইহুদিদের ফিলিস্তিনী ভূখণ্ডে নিয়ে গেলে সেখানে গৃহযুদ্ধ হবে।


ব্রিটেনের গড়িমসি দেখে ইহুদিদের সশস্ত্র দলগুলো ব্রিটিশ সৈন্যদের উপর ফিলিস্তিনের বিভিন্ন জায়গায় হামলা চালানো শুরু করে। তখন ইউরোপ থেকে ফিলিস্তিনের উদ্দেশ্যে জাহাজে বোঝাই হয়ে আসা হাজার-হাজার ইহুদিদের বাধা দেয় ব্রিটিশ বাহিনী। কিন্তু তাতে খুব একটা লাভ হয়নি। ইহুদি সশস্ত্র দলগুলো ব্রিটিশ বাহিনীর উপর তাদের আক্রমণের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়। তাদের উদ্দেশ্য ছিল এমন একটি পরিস্থিতির তৈরি করা যাতে ইহুদি রাষ্ট্র গঠনের জন্য ব্রিটেন এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় দ্রুত সিদ্ধান্ত নেয়। তখন সমাধানের জন্য ব্রিটেনের ওপর চাপ বাড়তে থাকে। এরপর বাধ্য হয়ে ব্রিটেন বিষয়টিকে জাতিসংঘে নিয়ে যায়।


১৯৪৭ সালের নভেম্বর মাসে ফিলিস্তিনের ভূখণ্ডে দু'টি রাষ্ট্র গঠনের সিদ্ধান্ত নেয় জাতিসংঘ। একটি ইহুদিদের জন্য এবং অন্যটি আরবদের জন্য। ইহুদিরা মোট ভূখণ্ডের ১০ শতাংশের মালিক হলেও তাদের দেয়া হয় মোট জমির অর্ধেক। স্বভাবতই আরবরা এ সিদ্ধান্ত মেনে নেয়নি। তারা জাতিসংঘের এ সিদ্ধান্ত খারিজ করে দেয়। কিন্তু ফিলিস্তিনীদের ভূখণ্ডে তখন ইহুদিরা বিজয় উল্লাস শুরু করে। অবশেষে ইহুদিরা একটি স্বাধীন ভূখণ্ড পেল। কিন্তু আরবরা অনুধাবন করেছিল যে কূটনীতি দিয়ে এ সমস্যার সমাধান হবে না। এখানে লক্ষ্যনীয় যে, ১৯৪৭ সালে ফিলিস্তিন অঞ্চলে ইহুদীরা রাষ্ট্র গঠন করতে পারলেও মুসলিমরা তা পারেনি। ইহুদিরা সংগঠিত হয়ে গেল। অন্যদিকে মুসলিমদের কোনো কেন্দ্রীয় নেতা ছিল না। শরীফ হুসেইন জর্ডানের নেতৃত্ব পেয়েই সন্তুষ্ট ছিলেন। 


ইসরাঈল রাষ্ট্র গঠনের পর আরব এবং ইহুদিদের মধ্যে দাঙ্গা শুরু হয়ে যায়। কিন্তু ইহুদিদের সবচেয়ে বড় সুবিধা ছিল তাদের বিচক্ষণ নেতৃত্ব। এর বিপরীতে আরবদের কোন নেতৃত্ব ছিলনা। ইহুদীরা বুঝতে পেরেছিল যে নতুন রাষ্ট্র গঠনের পর আরবরা তাদের ছেড়ে কথা বলবে না। সম্ভাব্য যুদ্ধের জন্য আগে থেকেই তৈরি ছিল ইহুদীরা। জেরুজালেমের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে আরব-ইহুদী সংঘর্ষ বেধে যায়। যেহেতু আরবদের মধ্যে কোন সমন্বয় ছিল না সেজন্য ইহুদিরা একের পর এক কৌশলগত জায়গা দখল করে নেয়। ইহুদিদের ক্রমাগত এবং জোরালো হামলার মুখে ভেঙ্গে পড়তে শুরু করে ফিলিস্তিনীরা। তারা বাড়িঘর ছেড়ে পালাতে থাকে।


তখন ফিলিস্তিনের একজন নেতা আল-হুসেইনি সিরিয়া গিয়েছিলেন অস্ত্র সহায়তার জন্য। কিন্তু তিনি সাহায্য পাননি। এদিকে সিরিয়া, হেজাজ, মিশর, জর্ডান, লেবানন, ইরাক ইত্যাদি আরব অঞ্চলে জাতীয়তাবাদী মুসলিমরা আলাদা আলাদা রাষ্ট্রগঠন করে ব্রিটেনের অনুগত হয়েছে। জেরুজালেমে চলা দাঙ্গার মধ্যে ১৯৪৮ সালের ১৪ই মে ফিলিস্তিন ছেড়ে চলে যায় ব্রিটেন। একই দিন তৎকালীন ইহুদি নেতারা ঘোষণা করেন যে সেদিন রাতেই ইহুদি রাষ্ট্রের জন্ম হবে।


ইসরায়েল রাষ্ট্রের জন্মের এক ঘন্টার মধ্যেই আরবরা আক্রমণ শুরু করে। একসাথে পাঁচটি আরব দেশ ইসরায়েলকে আক্রমণ করে। মিশর, ইরাক, লেবানন, জর্ডান এবং সিরিয়া। তাদের সৈন্য সংখ্যা ছিল প্রায় ত্রিশ হাজারের মতো। অন্যদিকে ইসরায়েলের সৈন্য সংখ্যা ছিল প্রায় ৩৫ হাজার। তীব্র লড়াইয়ের এক পর্যায়ে ইসরায়েলি বাহিনী পিছু হটতে থাকে। তাদের অস্ত্রের মজুত শেষ হয়ে যায়। সম্ভাব্য পরাজয় আঁচ করতে পেরে ইহুদিরা নিজেদের শক্তি সঞ্চয়ের জন্য সময় নেয়। আর কিছুদূর অগ্রসর হলেই মিশরীয় বাহিনী তেল আবিবের দিকে অগ্রসর হতে পারতো। তখন আমেরিকা জাতিসংঘের মাধ্যমে যুদ্ধবিরতি কার্যকর করে।


যুদ্ধবিরতির সময় দু'পক্ষই শক্তি সঞ্চয় করে। কিন্তু ইসরায়েল বেশি সুবিধা পেয়েছিল। তখন চেকোস্লোভাকিয়ার কাছ থেকে আধুনিক অস্ত্রের চালান আসে ইসরায়েলের হাতে। যুদ্ধবিরতি শেষ হলে নতুন করে আরবদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে ইসরাঈলী বাহিনী। একর পর এক গুরুত্বপূর্ণ জায়গা দখল করে নেয় ইহুদীরা। তেল আবিব এবং জেরুজালেমের উপর তাদের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা হয়। রাষ্ট্র গঠনের সময় জাতিসংঘ ইসরাঈলকে ফিলিস্তিনের ৫০% জমি দিলেও ইহুদীরা ক্রমাগত তাদের জমি বাড়াতে থাকে। যুদ্ধ হলে ভূমি বাড়ানোর প্রক্রিয়া কিছুদিন বন্ধ থাকে। আর পরিস্থিতি শান্ত হলে ভূমি অধিগ্রহণ বাড়াতে থাকে।


ইসরাঈল রাষ্ট্রগঠন করতে সক্ষম হলেও ফিলিস্তিনে কোনো রাষ্ট্র গঠিত হয়নি। ফিলিস্তিনে কোনো নেতা ছিল না যার মাধ্যমে তারা ঐক্যবদ্ধ হয়ে রাষ্ট্র গঠন করবে। ১৯৫৯ সালে ৩০ বছর বয়সী ইয়াসির আরাফাত জাতির মুক্তিকামী নেতা হিসেবে আবির্ভাব হন। এই তরুণের নেতৃত্বে ফিলিস্তিনের মুসলিমরা একত্রিত হয়। 


ইয়াসির আরাফাত ছিল তার রাজনৈতিক নাম। তার মূল নাম মুহাম্মদ আবদেল রহমান আব্দেল রউফ আরাফাত আল-কুদওয়া আল-হুসেইনী। ডাক নাম আবু আম্মার। তার জন্ম ও বাড়ি হলো মিশরের কায়রোতে। জেরুজালেম ছিল তার নানার বাড়ি। কায়রোতে পড়াশোনা করার সময় তিনি আরব জাতীয়তাবাদী ধারণা লাভ করেন ও জায়নবাদীদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম শুরু করেন। পড়াশোনা শেষে জেরুজালেমে আসেন ও ফিলিস্তিনীদের একত্র করে প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশন (PLO) নামে একটি সংগঠন কায়েম করেন।  


তার এই সংগঠন কায়েমের আগে তিনি ছাত্রদের নিয়েও কয়েকটি সংগঠন কায়েম করেছিলেন। PLO অল্প সময়ের মধ্যেই আরবদের মধ্যে ব্যাপক জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। তার নেতৃত্বে মুসলিমরা ঘুরে দাঁড়ায়। মূলত PLO থাকার কারণে ফিলিস্তিন থেকে মুসলিমরা হারিয়ে যায় নি। তারা সংগ্রাম করার একটি অবলম্বন পেয়েছিলো। ইয়াসির আরাফাত হয়ে ওঠেন ফিলিস্তিনীদের প্রাণপ্রিয় নেতা।  


১৯৬৭ সালে যুদ্ধে লজ্জাজনকভাবে হারের পর ফিলিস্তিনের জাতীয়তাবাদী দল ফাতাহর নেতা ইয়াসির আরাফাতের নেতৃত্বে PLO গেরিলা সশস্ত্র সংগঠনে পরিণত হয়। তারা ইসরাঈলীদের সীমানা বাড়ানোর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। জায়নবাদীরা নতুন ইহুদি বসতি স্থাপন করতে গেলে PLO তাদের সাথে সশস্ত্র সংগ্রামে লিপ্ত হতো। ১৯৮০ সাল থেকে ইসরাঈলের বিরুদ্ধে পিএলও এর নেতৃত্বে ইন্তিফাদা শুরু করে। প্রতিষ্ঠা সময় থেকে পিএলও জর্ডানের সাহায্য পেয়ে আসছিল। পশ্চিমা বিশ্বের চাপে জর্ডান পিএলওকে বের করে দেয়। এরপর ইয়াসির আরাফাত লেবানন থেকে সংগ্রাম পরিচালনা করেন। সেখান থেকেও তারা বহিষ্কৃত হন। 


১৯৮০ সালের পর থেকে আরবের রাষ্ট্রসমূহ ইসরাঈলকে মেনে নেয় ও জায়নবাদীদের হাতিয়ারে পরিণত হয়। ধীরে ধীরে পিএলও-এর সংগ্রাম ব্যর্থ হতে থাকে। এর কারণ PLO-এর বহু নেতা ইসরাঈলী অর্থ, নারী ও সুযোগ সুবিধার কাছে বিক্রি হয়ে যায়। ইহুদী চক্রান্ত ও প্রলোভনে ইয়াসির আরাফাত ও তার দল বার বার পর্যদস্তু হলে ১৯৮৭ সালে হামাস গঠিত হয়। এরা মিশরের ইসলাম্পন্থী মুসলিম ব্রাদারহুড দ্বারা সংগঠিত হয়। হামাস দ্রুতই জনপ্রিয়তা লাভ করে। ইসলামপন্থী হামাসের উত্থান দেখে ইসরাঈল ফাতাহকে সমর্থন দেয়। তাদেরকে সরকার গঠন করার সুযোগ দেয়। প্রায় ৪১ বছর পর ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠিত হয়। ১৯৯৩ সালে অস্ত্র সমর্পন করে PLO। বিনিময়ে তারা ফিলিস্তিন রাষ্ট্র পুনর্গঠনে ইসরাঈল আমেরিকা সহ সকল জায়নবাদীদের থেকে সুবিধা পায়। এভাবে একটি পঙ্গু রাষ্ট্র ফিলিস্তিনের জন্ম হয়, যার কোনো সার্বভৌমত্ব ছিল না। এটি অসলো চুক্তি নামে পরিচিত। 


এই ভাঁওতা চুক্তির জন্য পশ্চিমা বিশ্ব ইয়াসির আরাফাতকে শান্তিতে নোবেল প্রাইজ দেয়। কিন্তু এর ফলে ইয়াসিরের জনপ্রিয়তা বাড়েনি বরং কমেছে। কারণ রাষ্ট্র গঠনের পর ফিলিস্তিনে বিনা বাধায় ইহুদি বসতি স্থাপন করতে থাকে ইসরাঈল। আগে তো প্রতিরোধ করা যেত। অস্ত্র সমর্পনের মাধ্যমে ইয়াসির আরাফাত ফিলিস্তিনের মুসলিমদের একেবারে নিরাপত্তাহীন করে ফেলেছেন। দ্রুতই মুসলিমরা উচ্ছেদ হতে থাকে তাদের বাড়ি থেকে। ইয়াসির জায়নবাদীদের পাপেটে পরিণত হন। 


অন্যদিকে হামাস তার সশস্ত্র প্রতিরোধ অব্যাহত রাখে। ফলে হামাস জনপ্রিয় হতে থাকে। ২০০০ সালে টিকতে না পেতে ফাতাহ (পিএলও-এর পরিবর্তিত নাম) ২য় ইন্তিফাদা শুরু করে। এটি ব্যাপক আকার ধারণ করে। ফাতাহ আবার অস্ত্র হাতে নেয়। ইয়াসির আরাফাতকে কোণঠাসা করে ফেলে পশিমা বিশ্ব। ইসরাঈল তাকে গৃহবন্দী করে। ২০০৪ সালে বিষ প্রয়োগে খুন করা হয় ইয়াসির আরাফাতকে। ধারণা করা হয় তার খ্রিস্টান স্ত্রী তাকে বিষ প্রয়োগ করেছে জায়নবাদীদের প্ররোচনায়। তিনি ছিলেন ফিলিস্তিনীদের ঐক্যের প্রতীক। তাকে খুন করতে পারলেই ফিলিস্তিনীরা বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে। 


২০০৬ সালের নির্বাচনে ফিলিস্তিনে নিরঙ্কুশ বিজয় পায় হামাস। কিন্তু সরকার গঠন করার পর মাহমুদ আব্বাসের নেতৃত্বে ফাতাহ হামাসের সাথে গৃহযুদ্ধ লাগিয়ে দেয়। ফাতাহকে অস্ত্র ও অর্থের যোগান দেয় ইসরাঈল। অবশেষে ২০০৭ সালে হামাস মুসলিমদের রক্তক্ষয় এড়াতে গাজার একক নিয়ন্ত্রণ নেয় ও পশ্চিম তীর ফাতাহকে ছেড়ে দেয়। পশ্চিম তীরে সরাসরি না হলেও গোপনে হামাস সক্রিয় রয়েছে। আন্দোলন ও বিক্ষোভে পশ্চিম তীরের মানুষ হামাসের আনুগত্য করে। এভাবে কার্যত ফিলিস্তিন দুইভাগ হয়ে পড়ে। একইসাথে ফাতাহ, ইয়াসির আরাফাত ও মাহমুদ আব্বাসরা অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ে। 


আমরা ফিলিস্তিনী যাদেরকে ইট পাথর নিক্ষেপ করতে দেখি তারা মূলত পশ্চিম তীরের জনগণ। তাদের কাছে অস্ত্র নেই। সেই অঞ্চলে প্রায়ই মুসলিমরা উচ্ছেদের শিকার হয়। অন্যদিকে গাজার লোকেরা অবরুদ্ধ হলেও গাজার অভ্যন্তরে ইসরাঈলীদের কোনো প্রবেশাধিকার নেই। তারা সেখানে ভূমি দখল বা বসতি স্থাপন করতে পারে না। হামাস ধীরে ধীরে তাদের শক্তি বৃদ্ধি করছে। ২০১৪ সাল ও ২০২১ সালে তারা সরাসরি যুদ্ধ করে ইসরাঈলকে ভালো জবাব দিতে সক্ষম হয়েছে। এর প্রেক্ষিতে ইসরাঈলের সীমানা বাড়ানোর প্রচেষ্টা রুখে দেওয়া সম্ভব হচ্ছে। তবে হামাস যদি পার্শ্ববর্তী আরব রাষ্ট্রগুলোর সহায়তা পায় তবে ইসরাঈলকে দমন করা সহজ হবে।

১১ নভে, ২০২১

ইয়াসির আরাফাতের মৃত্যু রহস্য


এখন থেকে ১৭ বছর আগে, ২০০৪ সালে অনেকটা হুট করে মারা গিয়েছিলেন ফিলিস্তিনি নেতা ইয়াসির আরাফাত। তিনি সেসময় প্রায় দুই বছর ধরে রামাল্লায় ফাতাহর অফিসে অবরুদ্ধ ছিলেন। ২৫ অক্টোবর মন্ত্রিসভার এক বৈঠকে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েন। তার অফিস সবসময় ইসরাঈলী সেনা দ্বারা অবরুদ্ধ থাকতো। বাইরে থেকে ডাক্তাররা এসে তার সব পরীক্ষা নিরিক্ষা করালেন। কিন্তু তারা কিছু বুঝতে পারেন নি।

তারা তাকে অধিকতর চিকিৎসার জন্য ফিলিস্তিনের বাইরে নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন। ইসরাঈলও এতে বাধ সাধেনি। তবে ইয়াসির আরাফাত নিজেই যেতে চাননি। তার আশংকা ছিল তিনি কোনোভাবে ফিলিস্তিনের বাইরে গেলে তাকে আর দেশে ফিরতে দিবে না ইসরাঈল।

মাহমুদ আব্বাস সেসময় প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। তিনি জানতেন ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট শিরাকের সাথে ইয়াসির আরাফাতের আন্তরিক সম্পর্ক রয়েছে। ফ্রান্সের সাথে এই সম্পর্ক তৈরি হয়েছে আরাফাতের খ্রিস্টান স্ত্রী সুহার মাধ্যমে। যাই হোক মাহমুদ আব্বাস ফ্রান্সের প্রেসিডেন্টের কাছে ইয়াসিরের জন্য চিকিৎসা সাহায্য চাইলে তিনি সানন্দে রাজি হন। এবার মাহমুদ ইয়াসিরকে ফ্রান্সে যেতে অনুরোধ করলে ইয়াসির আরাফাত রাজি হন। কারণ ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট শিরাক তাকে আবার ফিলিস্তিনে ফেরার ব্যাপারে সাহায্য করতে পারবেন বলে আরাফাতের বিশ্বাস ছিল।

ক'দিন পর তাকে বিমানে করে প্যারিসের কাছে একটি সামরিক হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। তার দেহে এমন কোন পরীক্ষা বাকি ছিল না যা ফ্রান্সের ডাক্তাররা করান নি। কিন্তু কোনো সংক্রমণের চিহ্ন পাওয়া যায় নি। ডাক্তাররা বলছিলেন, মনে হচ্ছে যেন তার দেহে বাইরে থেকে কিছু একটা 'অনুপ্রবেশ' করেছে কিন্তু তা যে কি এবং কীভাবে তা ডাক্তাররা বের করতে পারেন নি। তিনি পেটে কিছু রাখতে পারছিলেন না। ভীষণ ডায়রিয়া, দেহে পানিশূন্যতা, কিছু খেতে পারছেনও না।

হাসপাতালে তার প্রথম পাঁচ দিন পর্যন্ত আরাফাত বেশ ভালোই ছিলেন। তিনি বিছানার ওপর উঠে বসেছিলেন, তিউনিসিয়ায় থাকা তার মেয়ের সাথে কথা বলেছিলেন। বিদেশের গণ্যমান্য ব্যক্তিদের ফোন ধরছিলেন। এমনকি রামাল্লায় ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের কর্মচারীদের বেতন দেবার ব্যাপারে অর্থমন্ত্রী সালাম ফায়াদকে নির্দেশনাও দিয়েছিলেন। ধীরে ধীরে তার পরিপাকতন্ত্র পুরোটাই সংক্রমিত হলো। পরীক্ষা করে দেখা গেছে যে, ইয়াসির আরাফাতের গলা থেকে অন্ত্র পর্যন্ত ভেতরটা মনে হচ্ছে যেন পুড়ে গেছে। মনে হচ্ছিল যেন তিনি এমন কিছু খেয়েছেন যাতে তার পরিপাকতন্ত্রটার ভেতর দিকটা পুড়ে গেছে।

নভেম্বরের ৩ তারিখ ইয়াসির আরাফাত সংজ্ঞা হারিয়ে ফেললেন। তবে ডাক্তাররা এমন কিছুই দেখতে পাচ্ছেন না যা রোগীকে অচেতন করে ফেললো। কোন বিষক্রিয়া ঘটেছে কিনা তার পরীক্ষা করার জন্য বাইরে থেকে বিশেষজ্ঞও আনা হয়েছিল। একমাত্র সমস্যা দেখা গিয়েছিল তার রক্তের প্লাটিলেট কমে গিয়েছিল, কিন্তু তার জন্য তার দু বার ডায়ালিসিস করা হয়েছিল, প্লাটিলেট দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু দু'দিন পর নতুন রক্তেরও একই অবস্থা হলো।

তিনি পুরোপুরি 'কোমা'য় চলে গেলেন। তার দেহের প্রতিটি প্রত্যঙ্গ একের পর এক অকেজো হয়ে যাচ্ছিল। এই পরিস্থিতি থেকে তিনি আর ফিরে আসতে পারেন নি। ফ্রান্সে ১৩ দিন চিকিৎসাধীন থাকার পর ১১ নভেম্বর ভোরবেলা মারা যান ইয়াসির আরাফাত।

মৃত্যুর আগে ৮ দিন কোমায় ছিলেন তিনি। মৃত্যুর কারণ হিসেবে ইয়াসির আরাফাতের ডেথ সার্টিফিকেটে লেখা হয়েছিল, "নির্ণয় করা যায় নি এমন এক কারণে তার মৃত্যু ঘটেছে।"

ইয়াসির আরাফাতের দীর্ঘদিনের সহযোদ্ধা ও ফ্রান্সে নিযুক্ত তৎকালীন ফিলিস্তিনী দূত লায়লা শহীদ বলেছেন আমি যখন তাকে (ইয়াসির আরাফাত) দেখি ফ্রান্সের সামরিক বিমানবন্দরে তখন তার ত্বক ছিল পুড়ে যাওয়া রোগীদের মতো তামাটে। যেন সারা শরীরে ফোস্কা হয়ে গেছে। আমি তাকে জিজ্ঞাসা করলাম, আপনি খালি গায়ে রোদে বসে ছিলেন কেন?'

তিনি বললেন, 'কি বলছো লায়লা! আমি দু বছর ধরে আমার অফিসে বন্দী, রোদ কোথায় পাবো?' তখন আমি একটু অপ্রস্তুত হলাম। ভাবলাম হয়তো তিনিই তার চামড়ার সমস্যাটা ঠিক বুঝতে পারেন নি। হাসপাতালে যাবার পর আমি ডাক্তারকে বললাম, তার এই যে ত্বকের সমস্যাটা দেখছি এটা তো তিন মাস আগে ছিল না।"

তার মৃত্যু নিয়ে অনেক গুঞ্জন তৈরি হয়। অনেককে সন্দেহ করা হয়। তবে সবচেয়ে বেশি সন্দেহের শিকার হন তার স্ত্রী সুহা। সংশয় কাটাতে ৯ বছর পর ২০১৩ সালে তার দেহাবশেষ কবর থেকে তুলে সুইজারল্যান্ডে পরীক্ষা করানো হয়। তখন তাতে উচ্চমাত্রার তেজষ্ক্রিয় পদার্থ পোলোনিয়ামের অস্তিত্ব পাওয়া যায়। যা লায়লার কথার সাথে মিলে যায়। তেজষ্ক্রিয়তার প্রভাবে ত্বক এভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়।

তবে তাকে কারা হত্যা করেছে এটা এখনো নিশ্চিতভাবে জানা যায় না। ইয়াসির আরাফাত তার জীবনের শুরুর দিকে ফিলিস্তিনীদের হিরো হিসেবে আবির্ভাব হয়েছেন। তবে পশ্চিমাদের টোপ গিলে তিনি ফিলিস্তিনীদের ভাগ্যকে বরবাদ করেছেন একইসাথে নিজের জনপ্রিয়তা হারিয়েছেন। তিনি নিজেও তা উপলব্ধি করতে পেরেছেন। তিনি ১৯৮৫ সাল সাল থেকে পশ্চিমা বিশ্বের অনুগত হয়ে পড়েন। তার ধারাবাহিকতায় ১৯৯৩ সালে তিনি অসলো শান্তিচুক্তি করেন। ১৯৯৪ সালে এই ভাঁওতা চুক্তির জন্য ইয়াসিরকে নোবেল শান্তি পুরস্কার দেওয়া হয়।

চুক্তির ফলে ফিলিস্তিনের পশ্চিম তীর ও গাজায় আরাফাতের নেতৃত্বে সরকার গঠিত হয়। তবে এই সরকারের কোনো সার্বভৌমত্ব ছিল না। ইসরাঈলী সেনারা সবসময় ফিলিস্তিনে থাকতো এবং নতুন নতুন ইহুদি বসতি স্থাপন করতো। যাকে ইচ্ছে তাকে উচ্ছেদ ও এরেস্ট করতো। সবই হয়েছে চুক্তি অনুসারে। আরাফাত বুঝেছিল সে ভুল পদক্ষেপ নিয়েছে। অসলো চুক্তির কারণে মূলত সমগ্র মুসলিমপ্রধান অঞ্চলে ইসরাইলী সেনাবাহিনীর নেটওয়ার্ক স্থাপিত হয়েছে। মুসলিমরা আরো ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে।

তিনি এসবের প্রতিবাদ করেছেন। চুক্তি থেকে বের হয়ে আসতে চেয়েছিলেন। কিন্তু পারেননি। শেষ জীবনে গৃহবন্দী ছিলেন। আজ তাঁর ১৭ তম মৃত্যুবার্ষিকী। আল্লাহ তায়ালা তাঁকে সম্মানিত করুন। তাঁর ভুল ত্রুটি ক্ষমা করুন এবং ফিলিস্তিনবাসীকে মুক্ত করুন।


১০ নভে, ২০২১

স্বৈরাচার ও নূর হোসেন


আজ ১০ নভেম্বর। নূর হোসেন দিবস। ১৯৮৭ সালের এই দিনে নূর হোসেনসহ তিনজনকে হত্যা করে স্বৈরাচার এরশাদ। তখন দেশের দুটি প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি ও আওয়ামী লীগ একত্র হয়ে স্বৈরশাসক এরশাদের পতনের লক্ষ্যে ঢাকা অবরোধ কর্মসূচির ঘোষণা করে। তাদের একমাত্র দাবি ছিল জামায়াতে ইসলামী প্রস্তাবিত নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের নিয়ন্ত্রণে জাতীয় সংসদ নির্বাচন করা।

অবরোধ কর্মসূচির অংশ হিসেবে ঢাকায় একটি মিছিলে নূর হোসেন অংশ নেন এবং প্রতিবাদ হিসেবে বুকে পিঠে সাদা রঙে লিখিয়ে নেন: "স্বৈরাচার নিপাত যাক, গণতন্ত্র মুক্তি পাক" । মিছিলটি ঢাকা জিপিওর সামনে জিরো পয়েন্টের কাছাকাছি আসলে স্বৈরশাসকের মদদপুষ্ট পুলিশবাহিনীর গুলিতে নূর হোসেনসহ মোট তিনজন আন্দোলনকারী নিহত হন। এসময় বহু আন্দোলনকারী আহত হন। নিহত অপর দুই ব্যক্তি হলেন যুবলীগ নেতা নুরুল হূদা বাবুল এবং আমিনুল হূদা টিটু।

এই হত্যাকাণ্ডের প্রতিক্রিয়া স্বরূপ বিরোধী দলগুলো ১১ ও ১২ই নভেম্বর সারা দেশে সকাল সন্ধ্যা হরতাল ঘোষণা করে। বাংলাদেশের গণতন্ত্রকামী মানুষ বিক্ষোভে ফেটে পড়ে; ফলে স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন আরো ত্বরান্বিত হয়। এই আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় ও নানা ঘটনা ও উপঘটনার মধ্য দিয়ে ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর স্বৈরাচার জেনারেল এরশাদ পদত্যাগ করেন। এর মধ্য দিয়ে স্বৈরাচারী সরকারের পতন ঘটে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়। এরশাদ পদত্যাগ করলে বাংলাদেশে দুটি হ্যাঁ-না ভোটের মধ্য দিয়ে নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার এবং প্রধানমন্ত্রী-শাসিত সরকার ব্যবস্থা চালু হয়।

১৯৯১ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এতে বেগম খালেদা জিয়ার বিএনপি সর্বোচ্চ আসন পান। তবে তিনি সরকার গঠনের জন্য পর্যাপ্ত আসন পাননি। জামায়াতে ইসলামী দেশে একটি শান্তিপূর্ণ সরকার গঠনের লক্ষ্যে কোনো চাহিদা ছাড়াই বিএনপিকে সমর্থন দেয় সরকার গঠনের জন্য। এর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের প্রথম গণতান্ত্রিক নেতা ও মহিলা প্রধানমন্ত্রী হিসেবে খালেদা জিয়া নির্বাচিত হন।

এরপর সরকারের পক্ষ থেকে নূর হোসেন এর মৃত্যুর দিনটি সরকারিভাবে উদযাপনে উদ্যোগ গৃহীত হয়। দিনটিকে প্রথমে ঐতিহাসিক ১০ই নভেম্বর দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হলেও আওয়ামী লীগ এটিকে শহীদ নূর হোসেন দিবস করার জন্য দাবি জানায় এবং এই নামটি এখন পর্যন্ত বহাল রয়েছে। ১৯৯৬ সালে এরশাদ, নূর হোসেনের মৃত্যুর জন্য জাতীয় সংসদে আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমা প্রার্থনা করেন। তাঁর দল জাতীয় পার্টি এখন ১০ই নভেম্বরকে গণতন্ত্র দিবস হিসেবে পালন করে।

নূর হোসেনের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে তাঁর নামে স্মারক ডাকটিকেট প্রকাশ করা হয়েছে। প্রতি বছরের ১০ই নভেম্বর বাংলাদেশে "নূর হোসেন দিবস" হিসেবে পালন করা হয়। এছাড়া তিনি যে স্থানে পুলিশের গুলিতে নিহত হন, তাঁর নামানুসারে সেই জিরো পয়েন্টের নামকরণ করা হয়েছে নূর হোসেন চত্বর। ১০ই নভেম্বর তাঁর মৃত্যুর কিছু সময় পূর্বে তোলা তাঁর গায়ে লেখাযুক্ত আন্দোলনরত অবস্থার ছবিটি বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের এক গুরুত্বপূর্ণ প্রতীক হিসেবে বিবেচিত হয়।

নূর হোসেন বিএনপির কর্মী ছিলেন না। তিনি ছিলেন আওয়ামী লীগের অঙ্গসংগঠন শ্রমিক লীগের কর্মী। দুঃখজনক ব্যাপার হলো গণতন্ত্রের জন্য জীবন দেওয়া আওয়ামী লীগ কর্মী নূর হোসেনের দল ও তার নেতা শেখ হাসিনা গত এক যুগ ধরে বাংলাদেশে স্বৈরাচার হয়ে জগদ্দল পাথর হয়ে চেপে বসেছে।

১৯৮৭ সালের ১০ নভেম্বর মাত্র তিনজনের মৃত্যু দেশে মারাত্মক আলোড়ন তৈরি করেছে ও এরশাদ স্বৈরাচার হিসেবে খ্যাতি পেয়েছে। বর্তমানে হাসিনা এত বড় স্বৈরাচার হয়েছে যে ৩০০ জনের মৃত্যুও এখন মামুলি ব্যাপার মনে হয়। শেখ হাসিনার তুলনায় এরশাদ ছিল চুনোপুটি স্বৈরাচার। 

গত এক যুগে হাসিনা তার গুণ্ডা বাহিনী ও পুলিশ দিয়ে পাঁচ হাজারেরও বেশি মানুষ খুন করেছে। গুম করেছে এক হাজারেরও বেশি মানুষকে। দেশের সব রাজনৈতিক অধিকার হরণ করা হয়েছে। এখন আর কেউ ভোট দিতে পারে না। মিছিল ও সমাবেশ করতে হয় পুলিশের অনুমতি নিয়ে একটু আধটু। তারপরও পুলিশ পিটিয়ে আধমরা বানিয়ে রাখে। আওয়ামীলীগ ছাড়া অন্য দলগুলো নিঃসংকোচে তাদের পার্টি অফিস পর্যন্ত খুলতে পারে না।

৯ নভে, ২০২১

সীমানাভাঙা বিপ্লবের কবি আল্লামা ইকবাল



আল্লামা ইকবাল যখন জন্ম নিলেন তখন মুসলিম নেতৃত্বের সূর্য অস্তমিত হচ্ছে। তিনি যখন যৌবনে তখন মুসলিম সালতানাত ভেঙে খান খান হচ্ছে। ইউরোপিয়ানদের জাতিবাদী রাষ্ট্র ধারণায় মুসলিমরা বিভ্রান্ত হচ্ছে। মুসলিমরা নিজেদের মুসলিম পরিচয়ের চাইতে পাঞ্জাবি, বাঙালি, আরব, তুর্কি ইত্যাদি পরিচয় দিতে বেশি পছন্দ করা শুরু করলো। মুসলিমরা নিজেদের বিশাল শক্তিকে খন্ড খন্ড করে ফেললো এসব জাতিবাদী সংকীর্ণ পরিচয়ে। নিজেদের মধ্যে দাঁড় করিয়ে দিল জাতিয়তাবাদী সীমানা। আল্লামা মুহাম্মদ ইকবাল সেই মেকী সীমানা ভাঙার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন। তাই তো তিনি গেয়ে উঠেন

চীন-ও-আরব হামারা, হিন্দুস্তাঁ হামারা
মুসলিম হে হাম, ওয়াতান হে সারা জাহাঁ হামারা
তাওহীদ কি আমানত সিনোঁ মে হে হামারে
আসাঁ নেহি মিটানা নাম-ও-নিশাঁ হামারা

তিনি সবসময় মুসলিমদের এক জাতিতে পরিণত করার বিপ্লব করেছেন। তাঁর এই সীমানাভাঙা বিপ্লবের ফসল হলো পাকিস্তান। ভারতের সকল মুসলমানদের জন্য তিনি একটি স্বাধীন রাষ্ট্র চেয়েছেন। তাঁর এই চিন্তাই বর্তমান পাকিস্তান রাষ্ট্রের সৃষ্টিতে ভূমিকা রেখেছে। তার নাম মুহাম্মদ ইকবাল হলেও তিনি আল্লামা ইকবাল হিসেবেই অধিক পরিচিত। তার ফার্সি সৃজনশীলতার জন্য ইরানেও তিনি ছিলেন সমধিক প্রসিদ্ধ। ইরানের ইসলামী বিপ্লবেও তাঁর সাহিত্য ব্যপক উদ্দীপনা দিয়েছে। তিনি ইরানে ইকবাল-ই-লাহোরী নামে পরিচিত।

জন্ম ও শৈশব :
কবি ইকবাল পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশের শিয়ালকোট নামক স্থানে ১৮৭৭ সালের ৯ নভেম্বর এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম শেখ নুর মোহাম্মদ এবং মাতার নাম ইমাম বিবি। কবির পিতা মাতা উভয়ই অত্যন্ত দ্বীনদার ও পরহেজগার মানুষ ছিলেন। কবির পূর্বপুরুষগণ কাশ্মীরবাসী সাপ্রু গোত্রীয় ব্রাহ্মণ পন্ডিত ছিলেন। ব্রাহ্মণ থেকে তাঁর পূর্বপুরুষ ইসলামের আদর্শে উজ্জীবিত হয়ে ইসলামকে ধারণ করেন। তাঁর দাদা শিয়ালকোটে এসে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন এবং ষাট বছর বয়সে ইন্তিকাল করেন।

কবির পিতা নূর মোহাম্মদের ইচ্ছা ছিল পুত্রকে মাদরাসায় পড়ানোর। কিন্তু উস্তাদ শামসুল উলামা মীর হাসানের পরামর্শে তাঁকে ইংরেজি স্কুলে ভর্তি করা হয়। প্রাইমারী শিক্ষা শেষ হলে তাঁকে শিয়ালকোট স্কচ মিশন স্কুলে ভর্তি করা হয়। এ স্কুল হতে তিনি ১৮৯৩ সালে ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করেন। স্কচ স্কুলের ছাত্র থাকাকালীন তিনি একদিন দেরিতে ক্লাসে আসেন, ক্লাস টিচার তাঁর দেরিতে ক্লাসে আসার কারণ জানতে চাইলে বালক ইকবাল তৎক্ষণাত উত্তর দেন, “ইকবাল (সৌভাগ্য) দেরিতে আসে স্যার।” উত্তর শুনে পন্ডিত শিক্ষক তো ‘থ’। তিনি যে শুধু উপস্থিত বুদ্ধিতে দক্ষ ছিলেন তা নয়। ছাত্র হিসেবে তিনি ছিলেন প্রচন্ড মেধাবী। ১৮৮৮, ১৮৯১ ও ১৮৯৩ সালে যথাক্রমে প্রাথমিক বৃত্তি, নিম্ন মাধ্যমিক বৃত্তি ও প্রবেশিকা পরীক্ষায় প্রথম স্থান অধিকার করে তিনি স্বর্ণপদক ও মাসিক বৃত্তি লাভ করেন।

উচ্চশিক্ষা :
১৮৯৩ সালে স্কচ মিশন স্কুল কলেজে উন্নীত হলে ইকবাল এখানে এফ. এ. শ্রেণীতে ভর্তি হন। ১৮৯৫ সালে অনুষ্ঠিত এফ.এ. পরীক্ষাতেও তিনি প্রথম বিভাগে পাস করেন এবং যথারীতি বৃত্তিসহ স্বর্ণপদক লাভ করেন।

১৮৯৫ সালে তিনি শিয়ালকোট হতে লাহোরে এসে লাহোর সরকারী কলেজে বি.এ ভর্তি হন। ১৮৯৭ সালে তিনি আরবী ও ইংরেজিতে সমগ্র পাঞ্জাবে প্রথম স্থান নিয়ে বি.এ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। যে কারণে তিনি এবার দুটি স্বর্ণপদক লাভ করেন। এরপর ১৮৯৯ সালে দর্শনশাস্ত্রে এম.এ পাস করেন। সাথে সাথে তিনি লাহোর ওরিয়েন্টাল কলেজে ইতিহাস ও দর্শনশাস্ত্রের অধ্যাপক নিযুক্ত হন।

এর কিছুদিন পরই তিনি লাহোর সরকারী কলেজ ও ইসলামিয়া কলেজের ইংরেজি ও দর্শনশাস্ত্রের খন্ডকালীন সহকারী অধ্যাপক নিযুক্ত হন। এ সময়ে উর্দু ভাষায় অর্থশাস্ত্র সম্বন্ধে তাঁর সর্বপ্রথম বই লিখেন।

১৯০৫ সালে তিনি উচ্চশিক্ষা গ্রহণের জন্য লন্ডন গমন করেন। কিন্তু সেখানে না থেকে তিনি জার্মানী যান। জার্মানীর মিউনিখ বিশ্ববিদ্যালয় হতে পারস্যের দর্শন শাস্ত্র বিষয়ক থিসিস লিখে ১৯০৭ সালে পিএইচডি ডিগ্রী লাভ করেন। এরপরের বছর লিংকন ইন হতে ব্যারিস্টারী পাস করেন। ১৯০৮ সালের ২৭ শে জুলাই তিনি দেশে ফিরে এলে লাহোরের বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ তাঁকে বিপুলভাবে সংবর্ধিত করেন। তিনি লাহোরে ফিরে স্বপদে পুনর্বহাল হন এবং সরকারের অনুমতিক্রমে আইনব্যবসা শুরু করেন। এর বছর দেড়েক পর লাহোর সরকারি কলেজের চাকরি ছেড়ে দিয়ে স্থায়ীভাবে তিনি আইনব্যবসা শুরু করেন।

সাহিত্য প্রতিভা :
ছাত্রাবস্থায় ১৮৯৬ সালে শিয়ালকোটের এক কবিতানুষ্ঠানে অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে তাঁর কবি প্রতিভার বিকাশ লাভ করতে শুরু করে। এরপর তিনি বেশ কিছু কবিতা লিখে হায়দারাবাদের প্রখ্যাত কবি দাগের নিকট পাঠিয়ে দেন সংশোধনের জন্য। কবি দাগ কিশোর কবির এ কবিতাগুলি পেয়ে মনোযোগ সহকারে পড়েন ও চমৎকার একটি মন্তব্য লিখে পাঠান। কবি দাগ লিখেছিলেন, ‘এ কবিতাগুলি সংশোধন করার কোন দরকার নেই। এগুলো কবির স্বচ্ছ মনের সার্থক, সুন্দর ও অনবদ্য ভাব প্রকাশের পরিচয় দিচ্ছে।’ কবি ইকবাল এ চিঠি পেয়ে তো খুব উৎসাহ পেলেন। তাঁরপর হতে চললো তাঁর বিরামহীন কাব্যসাধনা।

এরপর ১৯০০ সালে তিনি লাহোরে অনুষ্ঠিত আঞ্জুমানে হিমায়েতে ইসলাম-এর বার্ষিক সাধারণ সভায় জীবনের প্রথম জনসমক্ষে তাঁর বিখ্যাত কবিতা ‘নালা ইয়াতীম’ বা অনাথের আর্তনাদ পাঠ করেন। কবিতাটি পড়ার পর চারিদিকে ধন্য ধন্য পড়ে যায়। মানে কবিতাটি এত জনপ্রিয়তা অর্জন করে যে, তাৎক্ষণিকভাবে কবিতাটি ছাপা হয় এবং এর প্রতিটি কপি সে সময় চার টাকা দামে বিক্রি হয়। বিক্রয়লব্ধ প্রচুর পরিমাণ টাকা ইয়াতিমদের সাহায্যার্থে চাঁদা হিসেবে গৃহীত হয়। ১৯০১ সালে তিনি ছোটদের জন্য লেখেন-মাকড়সা ও মাছি, পর্বত ও কাঠবিড়ালি, শিশুর প্রার্থনা, সহানুভূতি, পাখীর নালিশ, মায়ের স্বপ্ন প্রভৃতি কবিতা।

এরপর তিনি দু’হাতে অসংখ্য কবিতা লিখেছেন। তাঁর কবিতার বিষয়বস্তু ছিল, ‘স্বদেশপ্রেম, মুসলিম উম্মাহর প্রতি মমত্ববোধ, ইসলামের শ্বাশত আদর্শে তাওহীদভিত্তিক বিশ্বরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন, জাতির উত্থান-পতন, দলীয় কলহ ও অন্তর্দ্বন্ধ নিরসন প্রভৃতি বিষয় কবিতায় স্থান পেতো। ঘুমন্ত মুসলিম জাতিকে তিনি বেলালী সুরে আহবান জানাতেন ক্লান্তিহীনভাবে। স্বকীয় আদর্শের সন্ধানে যুব সমাজকে উদ্বুদ্ধ করে তোলাই তাঁর লক্ষ্য ছিল।’

তাঁর কাব্যে এ ধরনের চিরন্তন আবেদন থাকার কারণে তিনি অল্প সময়ের মধ্যেই সারা বিশ্বে খ্যাতি লাভ করতে সক্ষম হন। নানামুখি প্রতিভার অধিকারী এ মহান ব্যক্তিত্ব তাই জাতি ধর্ম নির্বিশেষে সর্বমহল হতে অকুন্ঠ সম্মান অর্জন করেন। মহীশুর বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের একজন হিন্দু অধ্যাপক বলেছিলেন, “মুসলমানগণ ইকবালকে লক্ষবার তাঁদের সম্পদ বলে দাবি করতে পারেন। কিন্তু তিনি কোন ধর্ম বা শ্রেণীবিশেষের সম্পদ নন-তিনি একান্তভাবে আমাদেরও।’’

১৯০১ সালে ‘হিমালাহ’ নামক কবিতাটি তৎকালীন সময়ের উর্দু ভাষার সর্বশ্রেষ্ঠ পত্রিকা ‘মাখযানে’ ছাপা হয়। এটিই পত্রিকায় প্রকাশিত কবির প্রথম কবিতা। মুসলমানদের জন্য স্বতন্ত্র শিক্ষা ব্যবস্থা প্রবর্তনের দাবিতে তিনি এসময় অনেকগুলো পাঠ্যপুস্তক রচনা করেন। ১৯০৩ সালে লাহোর হতে অর্থনীতির ওপর তাঁর প্রথম পুস্তক ‘আল ইলমুল ইকতেসাদ’ প্রকাশিত হয়।

১৯২৪ সালে ‘বাঙ্গেদারা’ বা ঘন্টাধ্বনি নামক তাঁর বিখ্যাত কবিতার সংকলন প্রকাশিত হয়। এ পর্যন্ত এ গ্রন্থটির বহু সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছে। ১৯১৫ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘আসরার-ই-খুদী’ বা ব্যক্তিত্বের গূঢ় রহস্য। এ কাব্যগ্রন্থটি ১৯২০ সালে ইংরেজি ভাষায় অনুদিত হয়ে প্রকাশিত হয়। সাথে সাথে সমগ্র পশ্চিমা বিশ্বে মহাকবি ও বিশ্বকবি আল্লামা ইকবালের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। ১৯৪৫ সালে ‘আসরার-ই-খুদী’ বাংলা ভাষায় অনুবাদ করা হয়। বিশ্বের বহু ভাষায় এ কাব্যগ্রন্থটি অনূদিত ও প্রকাশিত হয়েছে।

১৯১১ ও ১৯১২ সালে পঠিত তাঁর বিশ্ববিখ্যাত কবিতা ‘শিকওয়াহ’ বা অভিযোগ ও ‘জওয়াব-ই-শিকওয়াহ’ বা অভিযোগের জবাব উর্দু ভাষায় রচিত। এ দীর্ঘ দুটি কবিতার কাব্যগ্রন্থ দু’টির বাংলা ভাষায় একাধিক অনুবাদ প্রকাশিত হয়েছে। ১৯১২ সালে প্রকাশিত হয় ফারসী ভাষায় রচিত ‘পায়গাম-ই-মাশরিক’ প্রাচ্যের বাণী কাব্যগ্রন্থটি। গ্রন্থটি আরবী, ইংরেজী, তুর্কী, জার্মান ও রুশ ভাষায় অনূদিত হয়। ১৯১৮ সালে প্রকাশিত হয় ফারসী ভাষায় ‘রামূয-ই-বেখুদী’ বা আত্মবিলোপের গুঢ়তত্ত্ব কাব্যগ্রন্থটি। মূলত এ গ্রন্থটি ‘আসরারে খুদী’র দ্বিতীয়াংশ। শুনলে আশ্চর্য হতে হয় যে ১৯৬৪ সাল পর্যন্ত এ গ্রন্থটির ৮৪ তম সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছে। তাঁর ‘বালে জিবরীল’ বা জিবরাঈলের ডানা উর্দু ভাষায় প্রকাশিত হয় ১৯৩৫ সালে। ১৯৩৬ সালে প্রকাশিত হয় ‘দরবারে কালীম’ (মুসা আ. কে নিয়ে) কাব্যগ্রন্থটি। উর্দু ভাষায় রচিত এ কাব্যগ্রন্থটি আরবী ও রুশ ভাষায় অনূদিত হয়েও প্রকাশিত হয়।

এর আগে ১৯২৭ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর ‘যাবুরে আজম’ কাব্যগ্রন্থটি। ১৯৩২ সালে প্রকাশিত হয় ফারসী ভাষায় রচিত ‘জাবীদ নামা’ বা অমর লিপি কাব্যগ্রন্থটি। এমনিভাবে একের পর এক তাঁর কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়। তাঁর রচিত কাব্যগ্রন্থগুলি বিশ্বের বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়ে অসংখ্য সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছে। সম্ভবত তিনি প্রাচ্যের সেই ভাগ্যবান কবি ব্যক্তিত্ব যার রচনা এত ব্যাপকভাবে পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত ও প্রকাশিত হয়েছে। সত্যিই যদি বিশ্বকবি বিশেষণে কাউকে বিশেষিত করতেই হয় তবে সে সম্মানের অধিকারী নিঃসন্দেহে কবি আল্লামা ইকবাল। কবি নিজেও ছিলেন বহু ভাষাবিদ পন্ডিত। তিনি উর্দু, ফারসী, ইংরেজি প্রভৃতি ভাষায় লেখনি চালিয়েছেন।

রাজনীতিতে কবি :
আল্লামা ইকবাল নিছক খেয়ালের বশে কবিতা লিখতেন না। তাঁর কবিতাই ছিল মানবতাবাদী ও রাজনীতির অংশ। তাঁর সীমানা ভাঙার বিপ্লবের বাণী ধ্বনিত হতো কবিতায়। ১৯২৬ সালে তিনি পাঞ্জাব আইন পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন।

১৯৩০ সালে নির্বাচিত হন মুসলিম লীগের সভাপতি হিসেবে। সেই থেকে তিনি হিন্দুস্তানের মুসলিমদের প্রতিনিধি হিসেবে ইংরেজদের সাথে বিভিন্ন বৈঠকে অংশ নিতেন। এসব বৈঠকে তিনি ভারতীয় মুসলমানদের জন্য বিভিন্ন দাবি দাওয়া পেশ করেন। মুসলিম লীগের এলাহাবাদ অধিবেশনে ১৯৩০ সালের ২৯ শে ডিসেম্বর সভাপতির ভাষণ দিতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘আমি চাই যে-পাঞ্জাব, উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ, সিন্ধু ও বেলুচিস্তান একটি রাষ্ট্রে পরিণত হউক। পৃথিবীর এই অংশে বৃটিশ সাম্রাজ্যের ভিতরে হোক বা বাইরে হউক-অন্ততপক্ষে উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলে একটি মুসলিম রাষ্ট্র সংগঠনই আমার মতে মুসলমানদের শেষ নিয়তি।’ এই মত অনুযায়ীই পরবর্তীকালে পাকিস্তান রাষ্ট্র জন্মলাভ করে। এ জন্য তাঁকে পাকিস্তানের স্বপ্নদ্রষ্টা ও রূপকার বলা হয়।

যদিও কবি মুসলিম লীগের সাথে যুক্ত ছিলেন কিন্তু তিনি যেভাবে ও যে চরিত্রের ইসলামী আন্দোলন চেয়েছিলেন সেটা মুসলিম লীগ ধারণ করতে পারে নি। তাই তিনি একজন ইসলামী নেতা ও প্রোপার ইসলামী দল খুঁজতে থাকেন। এর মধ্যে হায়দরাবাদ থেকে সাইয়েদ আবু আ'লা মওদূদী নামের এক যুবক ১৯৩২ সাল থেকে তরজুমানুল কুরআন নামের একটি পত্রিকা চালু করেছেন। আল্লামা ইকবাল এই পত্রিকা পড়েন। তিনি তর্জুমানুল কুরআন ও মাওলানা মওদূদীর ভক্ত হয়ে ওঠেন। মাওলানা মওদূদীকে তিনি মুসলিম জাতির ভবিষ্যত নেতা হিসেবে বিবেচনা করতে থাকেন। তিনি মাওলানা মওদূদীকে মদদ দিতে থাকেন।

এদিকে পাঞ্জাবের চৌধুরি নিয়াজ আলী খান তার বিপুল সম্পত্তি দ্বীন প্রতিষ্ঠার কাজে ব্যয় করতে চেয়েছিলেন। এজন্য তিনি তার বন্ধুদের সাথে অনেক আলোচনা করেছেন। তারা সবাই তাকে আল্লামা ইকবালের কাছে যেতে বলেছেন। তিনি আল্লামা ইকবালের সাথে দেখা করে তার ইচ্ছে ও পরিকল্পনার কথা জানান। আল্লামা ইকবালের কাছে নিয়াজ আলী খান আসলে তিনি মাওলানা মওদূদীকে দেখিয়ে দেন। মাওলানা মওদূদী কারো চাকুরি বা অনুগ্রহে কাজ না করার সিদ্ধান্ত নিয়ে রেখেছেন। কারণ এতে স্বাধীন সত্ত্বা থাকে না। ফরমায়েশি কাজ করতে হয়। তাই মওদূদী নিয়াজ আলী খানের সম্পত্তি নিতে অস্বীকার করেন।

অবশেষে নিয়াজ আলী খানের অনুরোধে আল্লামা ইকবাল মাওলানা মওদূদীকে পত্র লিখে পাঞ্জাবে আসতে বলেন। ১৯৩৮ সালে চিঠিটি নিয়াজ আলী খান নিজেই দিল্লী গিয়ে মাওলানার হাতে দেন। আল্লামা ইকবালের মতো প্রভাবশালী ব্যক্তি মাওলানাকে চিঠি দেয়ায় মাওলানা হতবাক হয়ে যান। আল্লামা তাকে হায়দারাবাদ পরিত্যাগ করে পাঞ্জাবে চলে আসার আহ্বান জানান। মাওলানা মওদূদী কিছুদিন পরে আল্লামা ইকবালের সাথে সাক্ষাত করেন এবং বিষয়টি নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা করেন।

নিয়াজ আলী খানের সম্পত্তি ছিল পাঞ্জাবের গ্রামে। সেই সম্পত্তি দিয়ে মাওলানা মওদূদী দারুল ইসলাম ট্রাস্ট গঠন করেন। যদিও শহর ছেড়ে গ্রামে আসা কষ্টকর তারপরও নিরাপদে গবেষণা করার জন্য দারুল ইসলাম ছিল একটি দারুণ স্থান।

এর কিছুদিন পরই আল্লামা মুহাম্মদ ইকবাল ১৯৩৮ সালের ২১ এপ্রিল প্রায় ৬০ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেন। আল্লামা ইকবালের লেখনিতে যে ইসলামী পুনর্জাগরণের আওয়াজ উঠেছিল তা সমসাময়িক অনেক ব্যক্তি ও আন্দোলনকে দারুণভাবে প্রভাবিত করেছে। তার দর্শনে প্রভাবিত হয়েছিলেন মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ যিনি পাকিস্তানের কায়েদে আজম। তার ইসলামী পুনর্জাগরণের চেতনাকে সারা জীবনের তরে জীবনোদ্দেশ্য হিসেবে গ্রহণ করে একটি পুনর্জাগরণী দলের জন্ম দেন তার স্নেহধন্য সাইয়েদ আবুল আ'লা মওদুদী। যার প্রতিষ্ঠিত জামায়াতে ইসলামী পাক-ভারত উপমহাদেশে ইসলামী পুনর্জাগরণের স্বপ্ন দেখেছিল। আল্লামা ইকবাল শিয়া চিন্তানায়কদেরকেও প্রভাবিত করেছিলেন। ইরানের ইসলামী বিপ্লবের চিন্তানায়ক ড. আলি শরিয়তিও আল্লামা ইকবাল দ্বারা সাংঘাতিক প্রভাবিত ছিলেন।

আল্লামা ইকবাল নিজের জীবদ্দশায় না দেখলেও তার দু'টো স্বপ্ন বাস্তবায়িত হয়েছে। মুসলিমদের একটি বহুজাতিক রাষ্ট্র গঠিত হয়েছে ১৯৪৭ সালে মুসলিম চেতনা ধারণ করে। অপরদিকে তিনি যেভাবে চেয়েছিলেন সেভাবে একটি ইসলামী আন্দোলন জামায়াতে ইসলামীর জন্ম হয়েছে ১৯৪১ সালে।