২৬ এপ্রি, ২০২২

আল্লাহ তায়ালা যেভাবে ইহুদীদের দর্প চূর্ণ করলেন!


মদিনার ইহুদীরা বেশ অহংকারী ছিল। এই অহংকার ছিল জ্ঞান, ঐতিহ্য, ব্যবসা ও আল্লাহর প্রিয় গোষ্ঠী হিসেবে। যেহেতু তাদের ওহির জ্ঞান ছিল তাই তারা নিজেরা ছাড়া বাকীদের মূর্খ বলে মনে করতো, শুধু তাই তাদের উম্মী বা অশিক্ষিত হিসেবে সম্বোধন করতো। তাদের কিতাবে শেষ নবীর ভবিষ্যৎবাণী ছিল। এই নিয়েও তারা গর্ব করতো। যেহেতু বনী ইসরাঈল থেকেই নবী বেশি এসেছে তাই তারা ভাবতো তাদের বংশ থেকেই নবী আসবে।

নবী আসা নিয়ে মদিনার ইহুদীরা অন্যান্য মুশরিক গোত্রকে এই বলে হুমকি দিত যে, শেষ নবী আসার সময় হয়েছে। শেষ নবী আসলে আমরা তোমাদের ওপর বিজয়ী হবো এবং সারা আরব শাসন করবো। কিন্তু নবী সা.-এর আবির্ভাব হয়েছে মক্কাতে। ইহুদীদের কথিত 'উম্মী'-দের বংশ থেকে। এটা তারা মেনে নিতে পারে নাই। তাই তারা মুহাম্মদ সা.-এর বিরুদ্ধে সর্বাত্মক শত্রুতা করতে শুরু করলো।

নবী সা. মদিনায় আসলে তাদের শত্রুতা আরো বেড়ে যায়। তারা মুসলিমদের ফকির, উম্মী ইত্যাদি বলে অপমান করতো। অযথা ঝগড়া তৈরি করতো। মদিনায় তখন তিনটি ইহুদি গোত্র ছিল। বনু কাইনুকা, বনু নাদির ও বনু কুরাইজা। বনু কাইনুকার বাজারে এক মুসলিম মহিলাকে বিবস্ত্র করার ইস্যুতে মুসলিমদের সাথে বনু কাইনুকার যুদ্ধ বেধে যায়। মুহাম্মদ সা. তাদের অবরোধ করেন। একপর্যায়ে তারা নতি স্বীকার করে এবং মুহাম্মদ সা. তাদেরকে মদিনা থেকে বহিষ্কার করেন।

এরপর বনু নাদির গোত্র মুহাম্মদ সা.-কে হত্যার পরিকল্পনা করে। জিব্রাঈল আ.-এর মাধ্যমে আল্লাহ তা জানিয়ে দিলে মুসলিমরা তাদের অবরোধ করে। তারা দীর্ঘদিন অবরোধে থেকে অবশেষে পরাজয় স্বীকার করে। মুহাম্মদ সা. তাদেরকেও মদিনা থেকে বহিষ্কার করেন। এই নাদির গোত্রের নেতা আরবের সকল গোত্রকে মুসলিমদের বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তোলে এবং সবাইকে একতাবদ্ধ করে। যার ফলে খন্দকের যুদ্ধ সংঘটিত হয়। যখন প্রায় ১০,০০০ মুশরিক সৈন্য মদিনা অবরোধ করে তখন মদিনার অবশিষ্ট ইহুদী গোত্র বনু কুরাইজা মদিনার ভেতর থেকেই মুসলিমদের ওপর আক্রমণ করার সিদ্ধান্ত নেয়। মুহাম্মদ সা. কূটনৈতিক ও গোয়েন্দা তৎপরতা চালিয়ে তাদের ঐক্য বিনষ্ট করে দেয়। অবশেষে আল্লাহর সাহায্যে বিজয় আসে। তারপর বনু কুরাইজার সৈন্যদের হত্যা করা হয়।

মদিনা থেকে বিতাড়িত ইহুদীদের একটা বড় অংশ খায়বারে ইহুদী পল্লীতে অবস্থান নেয়। সেখানে ইহুদীদের শক্তিশালী আটটি দুর্গ ছিল। মদিনা থেকে খায়বার ছিল প্রায় ১৭০ কি.মি. দূরে। রাসূল সা. সেখানে অভিযান চালিয়ে তাদের পরাস্ত করেন। তারা মুসলিম অধীনে প্রজা হিসেবে থাকতে চাইলে মুহাম্মদ সা. তাদের অনুমতি করেন।

এরপর আল্লাহ তায়ালা সূরা জুম'আর ১ম ৮ আয়াত নাজিল করেন। ইহুদীদের অহংকার চূর্ণ করে ২ নং আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেন,
তিনিই মহান সত্তা যিনি উম্মীদের মধ্যে তাদেরই একজনকে রসূল করে পাঠিয়েছেন যে তাদেরকে তাঁর আয়াত শুনায়, তাদের জীবনকে সজ্জিত ও সুন্দর করে এবং তাদেরকে কিতাব ও হিকমাত শিক্ষা দেয়। অথচ ইতিপূর্বে তারা স্পষ্ট গোমরাহীতে নিমজ্জিত ছিল।

আল্লাহ তায়ালা এখানে বুঝাতে চেয়েছেন, তোমরা এ রাসূলকে মানতে অস্বীকার করছো এই কারণে যে, তিনি এমন এক কওমের মধ্যে প্রেরিত হয়েছেন যাদেরকে অবজ্ঞা ভরে তোমরা ‘উম্মী’ বলে ডাকো। তোমাদের ভ্রান্ত ধারণা এই যে, রসূলকে অবশ্যই তোমাদের নিজেদের কওমের মধ্যে থেকে হতে হবে। তোমরা এ সিদ্ধান্ত নিয়ে বসে ছিলে যে, তোমাদের কওমের বাইরে যে ব্যক্তিই রিসালাতের দাবি করবে সে অবশ্যই মিথ্যাবাদী।

কিন্তু আল্লাহ তা’আলা সেই উম্মীদের মধ্যেই একজন রাসূল সৃষ্টি করেছেন। তোমাদের চোখের সামনেই যিনি তাঁর কিতাব শুনাচ্ছেন, মানুষকে পরিশুদ্ধ করেছেন এবং সেই মানুষকে হিদায়াত দান করেছেন তোমরা নিজেরাও যাদের গোমরাহীর অবস্থা জান। এটা আল্লাহর করুণা ও মেহেরবানী, তিনি যাকে ইচ্ছা তা দান করেন। তাঁর করুণা ও মেহেরবানীর ওপর তোমাদের কোন ইজারাদারী নেই যে, তোমরা যাকে তা দেয়াতে চাও তাকেই তিনি দিবেন আর তোমরা যাকে বঞ্চিত করতে চাও, তাকে তিনি বঞ্চিত করবেন।

এরপর আল্লাহ তায়ালা ৫ নং আয়াতে বলেন,
যাদেরকে তাওরাতের দায়িত্বভার দেওয়া হয়েছিল, কিন্তু তারা তা বহন করেনি। তাদের উপমা সেইসব গাধা যারা বই-পুস্তক বহন করে। এর চেয়েও নিকৃষ্ট উপমা সেই সব লোকের যারা আল্লাহর আয়াতসমূহকে মিথ্যা বলেছে। আল্লাহ এ রকম জালেমদের হিদায়াত দান করেন না।

এখানে আল্লাহ তায়ালা বুঝাতে চেয়েছেন, তোমাদের তাওরাতের বাহক বানানো হয়েছিল। কিন্তু তোমরা এর গুরুদায়িত্ব উপলদ্ধিও করোনি, পালনও করোনি। তোমাদের অবস্থা সেই গাধার মত যার পিঠে বই পুস্তকের বোঝা চাপানো আছে কিন্তু সে কি বহন করে নিয়ে যাচ্ছে তা জানে না। তোমাদের অবস্থা গাধার চেয়েও নিকৃষ্ট। কেননা, তোমরা আল্লাহর কিতাবের বাহক হওয়ার গুরুদায়িত্ব শুধু এড়িয়েই চলছো না, জেনে বুঝে আল্লাহর আয়াতসমূহকে মিথ্যা বলছো। এসব সত্ত্বেও তোমাদের ধারণা এই যে, তোমরা আল্লাহর অতি প্রিয় এবং রিসালাতের নিয়ামত চিরদিনের জন্য তোমাদের নামে লিখে দেয়া হয়েছে।

তারপর ৬-৮ নং আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন,
হে ইহুদী হয়ে যাওয়া লোকগণ! তোমরা যদি ভেবে থাকো যে, অন্য সব মানুষ বাদ দিয়ে কেবল তোমরাই আল্লাহর প্রিয়পাত্র, আর তোমাদের এ ধারণার ক্ষেত্রে তোমরা যদি সত্যবাদী হয়ে থাকো, তাহলে মৃত্যু চেয়ে নাও। কিন্তু যেসব অপকর্ম তারা করেছে, তার কারণে তারা কখনো মৃত্যু কামনা করবে না। আল্লাহ‌ এসব জালেমকে খুব ভালভাবেই জানেন। তাদের বলো, যে মৃত্যু থেকে তোমরা পালাচ্ছো তা তোমাদের কাছে আসবেই তারপর তোমাদেরকে সেই সত্তার সামনে পেশ করা হবে যিনি গোপন ও প্রকাশ্য সবকিছুই জানেন। তখন তিনি তোমাদের জানিয়ে দেবেন যা তোমরা করছিলে।

আল্লাহ তায়ালা তাদের দাবি এখানে পরিষ্কারভাবে নাকচ করে দিয়েছেন। তাদের বলেছেন, সত্যিই যদি তোমরা আল্লাহর প্রিয়পাত্র হতে এবং এ বিশ্বাসও তোমাদের থাকতো যে, তাঁর কাছে তোমাদের জন্য অত্যন্ত সম্মান ও মর্যাদার স্থান সংরক্ষিত আছে তাহলে মৃত্যুর এমন ভীতি তোমাদের মধ্যে থাকতো না যে, অপমান ও লাঞ্ছনার জীবন গ্রহণীয় কিন্তু কোন অবস্থায়ই মৃত্যু গ্রহণীয় নয়। আর মৃত্যুর এই ভয়ের কারণেই তো বিগত কয়েক বছরে তোমরা পরাজয়ের পর পরাজয় স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছো। তোমাদের এই অবস্থা-ই প্রমাণ করে যে, তোমাদের অপকর্মসমূহ সম্পর্কে তোমরা নিজেরাই অবহিত।

এই আয়াতগুলো(১-৮) ৭ম হিজরিতে খাইবারের যুদ্ধের সময় নাজিল হয়েছিল। সূরা জুম'আর আয়াত সংখ্যা ১১। এর অনেক আগে বাকি ১ম হিজরিতে বাকী ৩ আয়াত নাজিল হয়েছিল। মুহাম্মদ সা. মক্কা থেকে মদিনায় হিজরতের পর একদিন মসজিদে নববীতে জুম'আর খুতবা দিচ্ছিলেন। সে সময় মাদীনার একটি ব্যবসায়ী কাফেলা এসে হাজির হয়। ব্যবসায়ীরা কী পণ্য নিয়ে এসেছে তা দেখার কৌতুহল সামলাতে পারেন নি মুসলিমরা। মাত্র বারোজন সাহাবা ছাড়া বাকীরা খুতবা চলাকালীন মসজিদ থেকে থেকে বের হয়ে গেলেন।

এই প্রেক্ষাপটে আল্লাহ তায়ালা সূরা জুম'আর ৯-১১ নং আয়াত বলেন,
হে মুমিনগণ, যখন জুমু‘আর দিনে সালাতের জন্য আহবান করা হয়, তখন তোমরা আল্লাহর স্মরণের দিকে ধাবিত হও। আর বেচা-কেনা বর্জন কর। এটাই তোমাদের জন্য সর্বোত্তম, যদি তোমরা জানতে। অতঃপর যখন সালাত সমাপ্ত হবে তখন তোমরা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড় আর আল্লাহর অনুগ্রহ হতে অনুসন্ধান কর এবং আল্লাহকে বেশি বেশি স্মরণ কর, যাতে তোমরা সফল হতে পারো। আর তারা যখন ব্যবসায় অথবা ক্রীড়া কৌতুক দেখে তখন তারা তার দিকে ছুটে যায়, আর তোমাকে দাঁড়ান অবস্থায় রেখে যায়। বল, আল্লাহর কাছে যা আছে তা ক্রীড়া- কৌতুক ও ব্যবসায় অপেক্ষা উত্তম। আর আল্লাহ সর্বোত্তম রিজিকদাতা।

এই আয়াতগুলো থেকে সহজেই আমরা অনুভব করতে পারি আল্লাহ তায়ালা কী বুঝিয়েছেন। কিন্তু প্রশ্ন হলো আগের অংশের সাথে এই অংশ কেন একই সূরায় সন্নিবেশ করা হলো? এই প্রসঙ্গে মাওলানা মওদূদী রহ. তাফহীমুল কুরআনে বলেন,

আল্লাহ তায়ালা ইহুদীদের ‘সাবত’ বা শনিবারের পরিবর্তে মুসলমানদের ‘জুমআ’ দান করেছেন। তাই আল্লাহ তায়ালা মুসলমানদের সাবধান করে দিতে চান যে, ইহুদীরা, সাবতের সাথে যে আচরণ করেছে তারা যেন জুমআর সাথে সেই আচরণ না করে। রাসূলুল্লাহ সা. বক্তব্য দেওয়া অবস্থায় মসজিদ ছেড়ে চলে যাওয়া ঈমানের সাথে যায় না। তাই নির্দেশ দেওয়া হয় যে, জুমআর আযান হওয়ার পর সব রকম কেনাবেচা এবং অন্য সব রকম ব্যস্ততা নিষেধ। ঈমানদারদের কাজ হলো, এ সময় সব কাজ বন্ধ রেখে আল্লাহর জিকিরের দিকে ধাবিত হবে।

এই সূরা থেকে আমাদের শিক্ষা হলো, আমরা যেন ইহুদীদের মতো আচরণ না করি। ইহুদীদের মতো নিজেদের বিশেষ গোষ্ঠী মনে না করি। আল্লাহর অনুগ্রহের ওপর ভরসা রাখি। আমরা যেন আল্লাহর আয়াতের নির্দেশনা মান্য করি। আল্লাহর আয়াতকে পাল্টে না দেই। ইহুদীদের মতো আমার যেন আল্লাহর আয়াতকে বিক্রি করে পেট ভর্তি না করি যার কথা আল্লাহ তায়ালা সূরা বাকারার ৪১ নং আয়াতে বলেছেন।


২৩ এপ্রি, ২০২২

লাইলাতুল কদরের শানে নুজুল



একবার রাসূল সা. স্বপ্নযোগে দেখতে পেলেন তাঁর জন্য স্থাপিত মিম্বরে উঠে গেছে উমাইয়া বংশের লোকেরা। তিনি খুবই মনঃক্ষুণ্ণ হলেন। এটা সেসময়ের ঘটনা যখন মুহাম্মদ সা. রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হননি। তিনি তখনো মক্কায়।  

মুহাম্মদ সা. বুঝতে পারলেন তাঁর স্থাপিত ইসলামী রাষ্ট্র একটি বংশের কুক্ষিগত হয়ে পড়বে। তিনি দুঃখ পেলেন। একইসাথে এও জানতে পারলেন এই বংশ ১০০০ মাস রাজত্ব করবে। 

স্বপ্ন দেখার পর বিষণ্ণ মুহাম্মদ সা.-কে পুরস্কার দিয়ে সান্ত্বনা দিলেন আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা। তিনি সূরা কদর নাজিল করে জানালেন, আর মহিমান্বিত রাত প্রসঙ্গে আপনি কি জানেন? মহিমান্বিত রাত হাজার মাস হতেও উত্তম”। 

ইমাম তিরমিজি রহ. সূরা কদরের শানে নুজুল হিসেবে এই একটি ঘটনাকেই উল্লেখ করেছেন। 

ইউসুফ ইবনু সা’দ রহ. থেকে বর্ণিত, হাসান রা. মুআবিয়া রা.-এর নিকট বাই’আত গ্রহণের পর তাঁর সামনে এক ব্যক্তি দাঁড়িয়ে বলেন, আপনি (মুআবিয়ার নিকট বায়’আত গ্রহণ করে) মু’মিনদের চেহারা কলঙ্কিত করেছেন। এতে তিনি বললেন, তুমি আমাকে অভিযুক্ত করো না। আল্লাহ তা’আলা তোমার প্রতি রহমত করুন। 

হাসান রা. বলেন, যেহেতু রাসূলুল্লাহ সা.-কে স্বপ্নে উমাইয়্যা বংশীয়দেরকে তাঁর মিম্বারের ওপর দেখানো হয়েছে। বিষয়টি তাঁর নিকট খারাপ লাগে। তখন অবতীর্ণ হয়, “আমি অবশ্যই তোমাকে কাওসার (ঝরণা) দান করেছি” (সূরাঃ আল-কাওসার-১) অর্থাৎ হে মুহাম্মাদ! আমি জান্নাতে তোমাকে কাওসার নামক ঝরণা দান করেছি। আরো অবতীর্ণ হয়, “নিশ্চয় আমি এ কুরআন মহিমান্বিত রাতে অবতীর্ণ করেছি। আর মহিমান্বিত রাত প্রসঙ্গে আপনি কি জানেন? মহিমান্বিত রাত হাজার মাস হতেও উত্তম” (সূরাঃ আল-ক্বাদর-১-৩)। হে মুহাম্মাদ! আপনার পরে বনী উমাইয়্যা হাজার মাস শাসন করবে।    

- জামে আত তিরমিজি/ তাফসীরুল কুরআন / হাদিস নং ৩৩৫০

১৩২ হিজরিতে উমাইয়াদের পতন হয়। হাসান রা. ক্ষমতা ছেড়ে দেওয়া থেকে গণনা শুরু করলে বনু উমাইয়া ৯২ বছর ক্ষমতায় ছিল। বনু উমাইয়াদের ক্ষমতার সময়কাল ৯২ বছর  হলেও মক্কাতে তারা ৮৩ বছর শাসন করে। কারণ মক্কায় আবু বকর রা.-এর নাতি হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে যুবাইর রা. ৯ বছর খলিফা ছিলেন। 

উমাইয়া শাসনের ১ম শাসক মুয়াবিয়া রা.-এর মৃত্যুর আগেই তার ছেলে ইয়াজিদকে শাসন ক্ষমতার উত্তরাধিকার করে যান। এটা হাসান রা.-এর সাথে করা চুক্তির বিপরীত। তাছাড়া এটি শুরার মাধ্যমে হয়নি বলে অনেক বিশেষজ্ঞ মতামত দেন। 

উমাইয়া শাসনের ২য় শাসক ইয়াজিদ ক্ষমতা গ্রহণ করলে রাসূল সা.-এর নাতি ও জান্নাতের সর্দার ইমাম হুসাইন রা. ও আবু বকর রা. এর নাতি আব্দুল্লাহ ইবনে যুবাইর রা. যথাক্রমে মদিনা ও মক্কা থেকে বিদ্রোহ করেন। 

ইমাম হুসাইন রা. কুফায় ইয়াজিদের সেনাবাহিনীর কাছে পরাজিত ও শাহদাতবরণ করলেও আব্দুল্লাহ ইবনে যুবাইর রা. বিদ্রোহ চালিয়ে যান। তিনি ৯ বছর মক্কার খলিফা হিসেবে অধিষ্ঠিত ছিলেন। এরপর উমাইয়া শাসনের এক সেনাপতি হাজ্জাজ বিন ইউসুফের কাছে ইবনে যুবাইর রা.-এর পরাজয় ঘটে ও তিনি শাহদাতবরণ করেন।  

হিসেব করলে দেখা যায় মক্কায় উমাইয়া শাসন ৮৩ বছর ছিল। যা হাজার মাসের সমান। কাসিম ইবনে ফজল রহ. বলেছেন, আমি হিসেব করে দেখেছি পুরো হাজার মাস হয়েছে। কম বেশি হয়নি। 

মুসলিম রাষ্ট্রের ক্ষত হিসেবে আল্লাহ তায়ালা আমাদের জন্য মেহেরবানী করে লাইলাতুল কদর দান করেছেন। আসুন আমরা এই ক্ষত পূরণের চেষ্টা করি। আমাদের রাষ্ট্রকে ইসলামী রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্টা করি। 

আল্লাহর রাসূল সা.-এর মিম্বার কোনো বংশ, কোনো গোত্র, কোনো সেক্যুলার গোষ্ঠির কাছে যেন না যায়। আল্লাহর রাসূল সা.-এর মিম্বার তাঁর একান্ত অনুসারী ও তাঁর আদর্শ ধারণকারীদের হাতে তুলে দেওয়া আমাদের কর্তব্য।

আসুন, আমরা ইকামাতে দ্বীনের জন্য ব্যস্ত হই। আমাদের ব্যস্ততার বড় অংশ যাতে দ্বীন প্রতিষ্ঠাকে কেন্দ্র করেই হয়। আমাদের এই প্রচেষ্টা ও ব্যস্ততা আল্লাহ চাইলে হাজার মাসের প্রচেষ্টার বরকত দিয়ে দিবেন। ইনশাআল্লাহ।

১৮ এপ্রি, ২০২২

খিলাফত পর্ব-২১ : ইরাকে মুসলিমদের পরাজয় ও পুনরুত্থান


মুসলমানদের হাতে শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়ে পার্সিয়ানরা সেনা কমান্ডার জালিনুস পালিয়ে গিয়েছিল। সে নিজের রাজধানীতে ফিরে যাওয়ার পর রুস্তম ওর ওপর প্রচণ্ডভাবে ক্ষুব্ধ হয়। রুস্তম এর প্রতিশোধ নেয়ার জন্য বিশাল বাহিনী তৈরি করে। এর সেনাপতি করে বাহমান হাদাবিয়্যাহকে। মুশরিকদের এই বাহিনী মুসলিমদের মুকাবিলা করার জন্য ফোরাতের তীরে আসে।

ওরা মুসলমানদের নিকট এসে পৌঁছে। উভয় বাহিনীর মাঝে একটি নদী ছিল। সেখানে ছিল একটি সেতু। পার্সিয়ানরা প্রস্তাব দিল যে, হয় তোমরা সেতু পার হয়ে আমাদের নিকট আসো, নতুবা আমরা সেতু পার হয়ে তোমাদের নিকট যাবো। মুসলিম কমান্ডাররা আবু উবাইদকে পরামর্শ দিলেন যাতে মুশরিকরা নদী পার হয়ে এদিকে এসে যুদ্ধ করে। কিন্তু মুসলিম সেনাপতি আবু উবাইদ আস সাকাফি বললেন, আমরা মৃত্যুর ব্যাপারে যত নির্ভীক ওরা ততটা নির্ভীক নয়। এই বলে তিনি সেতু পেরিয়ে নিজ সৈন্যসহ ওদের নিকট পৌঁছে গেলেন। সংকীর্ণ এক জায়গায় সকলে সমবেত হলো। উভয় পক্ষে সেখানে ভীষণ যুদ্ধ হয়। মুসলমান সৈন্যের সংখ্যা ছিল প্রায় দশ হাজার। অন্যদিকে মুশরিক সৈন্যের সংখ্যা ছিল প্রায় ৫০ হাজার। 

পার্সিয়ান মুশরিকরা সাথে করে বড় বড় অনেক হাতি নিয়ে এসেছিল। ওইগুলোর পিঠে ছিল প্রচণ্ড শব্দ সৃষ্টিকারী ঘণ্টা। হাতীগুলো দাঁড়িয়েছিল যাতে মুসলিমদের ঘোড়াগুলো হাতি দেখে আর প্রচণ্ড শব্দ শুনে ভয় পায়। তারা মুসলমানদের উপর হামলা চালায়। বস্তুত বিশাল বিশাল হাতি দেখে এবং প্রচণ্ড ঘন্টাধ্বনি শুনে মুসলিমদের ঘোড়াগুলো ভয়ে পালিয়ে যেতে থাকে। শক্তিপ্রয়োগ করে অল্প সংখ্যক ঘোড়াকে ধরে রাখা সম্ভব হয়। মুসলিমরা তাদের নিয়ে এগুতে পারছে না তদুপরি হাতির ওপর থেকে তীর নিক্ষেপের ফলে ঘোড়াগুলি রক্তাক্ত হয়ে পড়ে। ফলে মুসলিমরা বেকায়দায় পড়ে। 

তারপরও মুসলিম সৈন্যরা বীরবিক্রমে যুদ্ধ করতে থাকে। ওদের প্রায় ৬ হাজার সৈন্যকে হত্যা করে। সেনাপতি আবু উবাইদ নির্দেশ দেন আগে হাতিগুলোকে মেরে ফেলতে। মুসলিম সৈন্যরা একে একে হাতিগুলোকে টার্গেট করে হত্যা করতে থাকে। এভাবে একটি ছাড়া সব হাতি মারা পড়ে। পার্সিয়ানরা একটি সুবিশালদেহী সাদা হাতিকে সামনে ঠেলে দেয়। সেটি হত্যা করার জন্যে সেনাপতি আবু উবাইদ সামনে অগ্রসর হন। তিনি তরবারির আঘাত হানেন হাতীটির উপর। হাতির শুড় কেটে যায়। হাতি মাতাল ও বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে এবং ভয়ংকর একটি চিৎকার দিয়ে সেনাপতি আবু উবাইদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। দু'পায়ে তাঁকে দলিত-মথিত করে ফেলে। তিনি শাহদাতবরণ করেন। হাতিটি তার দেহের উপর দাঁড়িয়ে থাকে।  

আবু উবাইদ তার অবর্তমানে যাকে সেনাপতির দায়িত্ব দিয়েছিলেন তিনি এসে হাতির ওপর আক্রমণ করলেন। হাতিটি তাকেও মেরে ফেলে। এরপর তার পরবর্তী দায়িত্ব প্রাপ্ত সেনাপতি এসে হামলা করলেন। হাতিটি তাকেও মেরে ফেললো। এভাবে আবু উবাইদের মনোনীত সাতজন সেনাপতি নিহত হন। এরা সকলে ছিলেন সাকিফ গোত্রের লোক। এরপর সেনাপতি আবু উবাইদের অসিয়ত অনুযায়ী সেনাপতির দায়িত্ব পান মুসান্না ইবনে হারিস। সেনাপতি আবু উবাইদের স্ত্রী দাওমা স্বপ্ন দেখেছিলেন যা হুবহু বাস্তবায়িত হলো। এসব ঘটনায় মুসলমানগণ সাহস হারা হয়ে গেলেন। বাকি থাকল শুধু পার্সিয়ানদের বিজয়। 

মুসলিমরা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েন। সকলে পালাতে শুরু করে। পার্সিয়ানরা ধাওয়া করতে থাকে। ওরা বহু মুসলমানকে হত্যা করে, মুসলমানগণ বিক্ষিপ্ত ও পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। তারা সেতু পর্যন্ত আসে। কেউ কেউ সেতু পার হয়ে আসে। এরই মধ্যে ভেঙ্গে যায় ওই সেতু। ফলে ওপাড়ে যারা ছিল পার্সিয়ানরা তাদেরকে আটক করে ফেলে। সেখানেও তারা বহু মুসলমানকে হত্যা করে। প্রায় চার হাজার মুসলমান নদীতে ডুবে শহীদ হন। 

সেনাপতি মুসান্না ইবনে হারিসা পলায়নপর মুসলিমদের নিয়ে আরেকটি সেতুর উপর এসে দাঁড়ালেন। সেতুর উপর দাঁড়িয়ে সেনাপতি মুসান্না ডেকে ডেকে বললেন, হে লোক সকল! শান্ত হোন, স্থির হোন, আমি সেতুর মুখে দাঁড়িয়ে আছি। আপনাদের সকলে পার না হওয়া পর্যন্ত আমি সেতু পার হবো না। আপনারা ধীরে ধীরে পার হলে আমরা সবাই পার হতে পারবো। নতুবা এটিও ভেঙে পড়বে। সকল মুসলমান সেতু পার হলো। এরপর মুসান্না রা. সেতু পার হয়ে ওদের নিকট গেলেন। তিনি এবং সাহসী সৈনিকগণ সেনাদলকে পাহারা দিতে লাগলেন। 

উপস্থিত অধিকাংশ সৈন্য ছিলেন আহত, রক্তাক্ত ও ক্ষত-বিক্ষত। কতক মুসলমান বনে-জঙ্গলে চলে যায়। শেষ পর্যন্ত তাদের গন্তব্য জানা যায়নি। ওদের কতক ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে মদীনায় ফিরে আসে। এই দুঃখজনক পরাজয়ের সংবাদ মদিনায় খলীফার নিকট নিয়ে আসেন আবদুল্লাহ ইবনে যায়দ। তিনি এসে দেখেন খলীফা উমার রা. মিম্বরে উপবিষ্ট আছেন। খলীফা বললেন, হে আবদুল্লাহ ইবনে যায়দ, কী সংবাদ? আবদুল্লাহ বললেন, নিশ্চিত সংবাদ এনেছি আপনার নিকট। এরপর মিম্বরে খলীফার নিকট গেলেন এবং কানে কানে প্রকৃত ঘটনা জানালেন। এই যুদ্ধ সেতুর যুদ্ধ নামে পরিচিত।

এ ঘটনা ঘটেছিল ১৩ হিজরি সনের শাবান মাসে। ইয়ারমুক যুদ্ধের ৪০দিন পর। মদিনার মুসলিমদের কাছে ইয়ারমুকের রোমানদের সাথে সফলতা ম্লান হয়ে যায় ইরাকে পার্সিয়ানদের কাছে ব্যর্থতার সংবাদে। ইরাকে মুসলমানগণ ছড়িয়ে-ছিটিয়ে গিয়েছিলেন। তারপর দলবদ্ধ হয়েছিলেন। তাদের কেউ কেউ মদিনায় ফিরে এসেছিলেন। হযরত উমর রা. কাউকে তিরস্কার করেন নি। মন্দ বলেন নি বরং তিনি বলেছেন, আমি আপনাদের অন্তর্ভুক্ত। খলিফা উমার রা.-এর এই সান্ত্বনা সৈন্যদের দুঃখকে কমিয়ে দিয়েছিল। 

এই যুদ্ধের পর্যালোচনায় দুটো বিষয় উঠে এসেছে। এক. সেনাপতি আবু উবাইদ অন্যান্য বিজ্ঞ সাহাবাদের পরামর্শ গ্রহণ না করে সেতু পার হওয়াতে সংকীর্ণ স্থানে কোণঠাসা হয়েছেন। অনেকে পানিতে ডুবে মারা গিয়েছেন। এটাও সেতু পার হওয়াতে হয়েছে। দুই. শ্ত্রুদের ব্যাপারে পর্যাপ্ত খবর নেওয়া হয় নি। যেহেতু এই প্রথম হাতির মুকাবিলা করতে হচ্ছে এই ব্যাপারে পূর্বপ্রস্তুতি নেওয়া হয়নি।  

এদিকে যুদ্ধ জয়ের পর পার্সিয়ানরা অন্তর্দ্বন্দ্বে লিপ্ত হয়। তাদের একটি দল মাদায়েনের দিকে যাত্রা করতে গিয়ে মুসান্না রা.-এর নেতৃত্বে থাকা মুসলিম বাহিনীর মুখোমুখি হয়। মুসলিমরা তাদের পরাজিত করে। তাদের অনেককে হত্যা ও মুক্তিপণ আদায় করেন। এরপর সেনাপতি মুসান্না রা. ইরাকে অবস্থানরত মুসলিম সেনাপতিদের সাহায্য চেয়ে লোক পাঠালেন। সবাই তার নিকট সাহায্য পাঠালো। মদিনা থেকে খলীফা উমর রা. তাঁর নিকট প্রচুর সাহায্য পাঠান। ওই সাহায্য দলে ছিলেন জারীর ইবন আবদুল্লাহ বাজালী ও তার পূর্ণ গোত্র। শীর্ষস্থানীয় অন্যান্য মুসলিম নেতৃবৃন্দও সেই দলে ছিল । ফলে এবারকার সৈন্য সংখ্যা অনেক বৃদ্ধি পায়। 

মুসলিমরা নতুনভাবে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে থাকলেন। মুসলমানদের রণপ্রস্তুতির কথা পার্সিয়ান সেনাপতিগণ অবগত হলো। মুসলিমদেরকে প্রতিরোধ করার জন্যে তারা মিহরানের সেনাপতিত্বে একটি বিশাল সেনাদল প্রেরণ করে। উভয়পক্ষ বুওয়াইব নামক স্থানে মুখোমুখি হয়। বুওয়াইব হলো কুফার নিকটবর্তী একটি স্থান। উভয় পক্ষের মাঝে ছিল ফোরাত নদী। পার্সিয়ানরা আগের মতো বললো, 'হয় তোমরা নদী পার হয়ে আমাদের নিকট আসো নইলে আমরা নদী অতিক্রম করে তোমাদের নিকট যাবো।' 

মুসলমানগণ বললেন, "তোমরাই নদী পার হয়ে আসো।" তারা নদী পার হয়ে এলো। তারপর উভয় পক্ষ যুদ্ধের জন্যে প্রস্তুত হতে থাকল। এটি রমজান মাসের ঘটনা। সেনাপতি মুসান্না মুসলিম সৈনিকদের রোজা না রাখার কথা বললেন। সকলে রোজা ছেড়ে দিলো, যাতে যুদ্ধে শক্তি পায়। সৈন্যগণ প্রস্তুত হলো। সেনাপতি মুসান্না প্রত্যেক গোত্রের সেনাপতিদের পতাকা ঘুরে ঘুরে পরিদর্শন করতে লাগলেন এবং তাদেরকে জিহাদে উৎসাহ দিয়ে ধৈর্য ও নীরবতা অবলম্বনের উপদেশ দিচ্ছিলেন। ওই যুদ্ধে নিজ গোত্রসহ জারীর ইব্‌ন আবদুল্লাহ বাজালী এবং বহু শীর্ষস্থানীয় মুসলিম নেতৃবৃন্দ ছিলেন। 

সবার উদ্দেশ্যে মুসান্না রা. বললেন, আমি তিনবার আল্লাহু আকবর বলবো। তাতে সকলে প্রস্তুত হয়ে যাবে। আমি চতুর্থ বার আল্লাহু আকবর বলার সাথে সাথে শত্রুপক্ষের ওপর আক্রমণ করবে। জবাবে সকলে তার নির্দেশ মান্য ও তার প্রতি আনুগত্যের ঘোষণা দিল। কিন্তু তাঁর ১ম তাকবীরের সাথে সাথে পার্সিয়ানরা হামলা চালায় মুসলমানদের উপর। তারা ঘিরে ফেলে মুসলিম সৈন্যদেরকে। উভয়পক্ষে প্রচণ্ড যুদ্ধ হয়। এই যুদ্ধ বুওয়াইবের যুদ্ধ নামে পরিচিত। 

সেনাপতি মুসান্না একটি সারিতে কিছুটা ত্রুটি লক্ষ্য করেন। তিনি সেখানে একজন লোক পাঠালেন। তিনি মুসলিমদের সুশৃঙ্খল করে যুদ্ধে গতি এনে দেন। মুসলমানদের পক্ষ থেকে আনুগত্য ও হৃদ্যতা দেখে মুসান্না খুশি হলেন এবং বললেন, "হে মুসলিমগণ! যুদ্ধ ও জিহাদ তো আপনাদের নিয়মিত কার্যক্রম। আপনারা আল্লাহকে সাহায্য করুন,  আল্লাহ আপনাদেরকে সাহায্য করবেন।" সেনাপতি মুসান্না ও অন্যান্য মুসলিম সাহায্য ও বিজয়ের জন্যে আল্লাহর নিকট প্রার্থনা করছিলেন। দীর্ঘক্ষণ যুদ্ধ চলার পর মুসান্না রা. তার কতক সাহসী অনুসারীকে একত্রিত করে পেছনের দিক পাহারায় নিয়োজিত করলেন। এরপর তিনি নিজে শত্রু সেনাপতি মিহরানের ওপর আক্রমণ করলেন। মিহরানকে তার স্থান থেকে সরিয়ে দিলেন। মিহরান তার সৈনিকদের নিয়ে ডান পার্শ্ব দলে ঢুকে গেল। 

এরপর মিহরানের উপর আক্রমণ করেছিলেন মুনযির ইবন হাসান। তিনি তাকে মারাত্মকভাবে আহত করে। এরপর জারীর ইবনে আবদুল্লাহ বাজালী তার মাথা কেটে নেন। তার বর্ম ও অস্ত্রশস্ত্র তারা দু'জনে ভাগ করে নেন। জারীর নিলেন অস্ত্রশস্ত্র আর মুনযির নিলেন কোমরবন্দ ও তীরের কুলি। সেনাপতির মৃত্যু দেখে অগ্নিপূজক মুশরিকরা পালাতে শুরু করে। মুসলমানগণ ওদের ঘাড়ে আঘাত করে ওদেরকে ধরাশায়ী করতে থাকেন। মুসান্না ইবনে হারিসা এগিয়ে গিয়ে সেতুর উপর অবস্থান গ্রহণ করেন। যাতে পার্সিয়ানরা সেতু অতিক্রম করে পালাতে না পারে। আর তাতে মুসলমানগণ ওদেরকে হত্যা করার সুযোগ পায়। সেদিনের অবশিষ্ট সময়, ওই রাত এবং পরের দিনেও রাত অবধি মুসলমানগণ ওদেরকে খুঁজে খুঁজে হত্যা করতে থাকেন। কথিত আছে যে, ওই যুদ্ধে প্রায় এক লাখ পার্সিয়ান সৈন্য অস্ত্রের আঘাতে ও পানিতে ডুবে মারা যায়। মুসলমানদের পক্ষেও অনেক নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি ওই যুদ্ধে শহীদ হন। এই ঘটনায় পার্সিয়ানরা গর্ব ও অহংকার ধূলায় মিশে যায়। তারা চরমভাবে লাঞ্ছিত হয়। মুসলিম সৈনিকগণ প্রচুর গনিমত সংগ্রহ করেন।  

বুওয়াইবের যুদ্ধ শেষে মুসান্না রা. পরামর্শ সভা ডাকেন। সেখানে যুদ্ধ বিষয়ে নানান পর্যালোচনা উঠে এসেছে। মুসান্না রা. বলেন, "আরব ও পার্সিয়ানদের মধ্যে বহু যুদ্ধ হয়েছে। জাহিলি যুগে হয়ে। ইসলামী যুগেও হয়েছে। আল্লাহর শপথ! জাহিলি যুগে একশ পার্সিয়ান একহাজার আরবের চাইতে শক্তিশালী ছিল। কিন্তু আজ একশ আরব একহাজার পার্সিয়ানের চাইতেও শক্তিশালী। আল্লাহ তায়ালা তাদের ক্ষমতা কেড়ে নিয়েছেন ও তাদের দুর্বল করে দিয়েছেন। সুতরাং তাদের জাঁকজমক ও বিশাল সংখ্যা দেখে বিভ্রান্ত হয়ো না।" 

তিনি একটি বিষয়ে অনুশোচনা করে বললেন, "আমি ভুল করেছিলাম। তাদেরকে কোণঠাসা করে দেওয়ার জন্য সেতুর দড়ি কেটে দিয়ে আমি যে ক্ষতি করেছি আল্লাহ তার ক্ষতিকর প্রভাব কমিয়ে দেন। তাই আমার উদাহরণ অনুসরণ করে তোমরা কখনো এমনটা করো না। আমার ভুল হয়েছিল। কাউকেই কোণঠাসা করা উচিত নয়। শত্রুদের পালিয়ে যেতে বাধা দিলে তারা আত্মরক্ষার্থে আরো ভয়ংকরভাবে যুদ্ধ করে।" 

এই বিজয় ইরাকে দারুণ প্রভাব তৈরি করে। ইরাকের আশেপাশের গোত্র ও সীমান্তের মানুষেরা দলে দলে ইসলামে দাখিল হয়। মুসান্না রা. এসকল মানুষদের মধ্যে ইসলামের শিক্ষা প্রসারে মুজাহিদদের দায়িত্ব দেন। মুসলিমরা ইরাকের মানুষদের ইসলাম শেখাতে লাগলো। যখন ইরাকে এই অবস্থা তখন পার্সিয়ান মুশরিকরা নিজেদের নেতৃত্ব ব্যাপক দ্বন্দ্বে লিপ্ত হয়ে রইলো। 


১৭ এপ্রি, ২০২২

খিলাফত পর্ব-২০ : উমার রা.-এর ইরাক অভিযান


আবু বকর রা. ইরাক থেকে খালিদ রা.-কে প্রত্যাহার করে সিরিয়ায় রোমানদের বিরুদ্ধে  পাঠান। খালিদ রা. দায়িত্ব দিয়ে যান মুসান্না রা.-কে। মুসান্না রা.-এর সাথে থাকা সৈন্য ছিল নিতান্ত কম। অন্যদিকে পারসিকদের আক্রমণের আশংকা ছিল খুব বেশি। তাদের রাজার পরিবর্তনের ঝামেলা না থাকলে তারা অবশ্যই আক্রমণ করতো। খলীফা আবু বকর সিদ্দীক রা.-এর পক্ষ থেকে দীর্ঘদিন যাবত মুসান্না রা-এর নিকট কোনো সংবাদ যাচ্ছিল না। তাই তিনি মদীনার উদ্দেশ্যে যাত্রা করলেন। তিনি এসে দেখলেন, আবু বকর রা. অসুস্থ। তিনি জীবন সায়াহ্নে। তিনি খলীফাকে ইরাক পরিস্থিতি জানালেন। 

খলিফা আবু বকর রা. উমার রা.-কে নির্দেশ করলেন তিনি যেন জনসাধারণকে পারসিকদের বিরুদ্ধে জিহাদে আহবান করেন । আবু বকর রা. ইন্তেকাল করলেন। উমার রা. নতুন  খলিফা হিসেবে দায়িত্ব গ্রহন করলেন। এরপর উমার রা. আরবের মুসলিমদেরকে ইরাকের জিহাদে অংশগ্রহণের আহ্বান জানালেন। যুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্যে উৎসাহিত করলেন। এর সওয়াব ও পুরস্কার সম্পর্কেও জানালেন।

কিন্তু দুঃখজনকভাবে তার আহ্বানে তেমন কেউ সাড়া দিল না। কারণ পারসিকদের শক্তির দাপট এবং যুদ্ধ-নৈপুণ্যের প্রেক্ষিতে কেউই ওদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে যেতে চাইতো না। তিনি দ্বিতীয় এবং তৃতীয় দিনও যুদ্ধে অংশ নেবার আহ্বান জানান। যথাযথ সাড়া পাওয়া গেল না। সেনাপতি মুসান্না রা. বক্তব্য রাখলেন। তিনি ইরাকের জয় সম্পর্কে জনগণকে অবহিত করলেন। চতুর্থ দিনের আহ্বানের পর সর্বপ্রথম সাড়া জোরালোভাবে সাড়া দেন এবং যুদ্ধে যেতে সম্মতি দেন আবু উবাইদ ইবনে মাসউদ সাকাফী। এরপর একের পর এক লোকজন সাড়া দিতে শুরু করেন।

অবশেষে ইরাকের জন্য বাহিনী গঠিত হলো। সেনাপতির দায়িত্ব দেন আবু উবাইদ আস সাকাফিকে। তিনি কিন্তু সাহাবী ছিলেন না। তাই কেউ কেউ উমার রা.-কে জিজ্ঞেস করলেন, কোনো সাহাবীকে আপনি প্রধান সেনাপতি নিযুক্ত করলেন না কেন? তিনি বললেন, সর্বপ্রথম যে সাড়া দিয়েছে আমি তাকেই প্রধান সেনাপতি নিযুক্ত করেছি। আপনারা তো দ্বীনের সাহায্যে সবার আগে এগিয়ে এসেছেন। আর এই ঘটনায় এই লোক আপনাদের সবার আগে এগিয়ে এসেছে। সবার আগে সাড়া দিয়েছে। এরপর খলীফা উমার রা. আবু উবাইদা সাকাফীকে ডেকে ব্যক্তিগতভাবে তাকওয়া অবলম্বন ও সাথী মুসলিম সৈন্যদের কল্যাণ কামনার উপদেশ দিলেন। সকল কাজে সাহাবীদের সাথে পরামর্শ করার নির্দেশ দিলেন। সালিত ইন বাশিরের সাথেও পরামর্শ করার কথা বললেন। কারণ তাঁর রয়েছে যুদ্ধ সম্বন্ধে বাস্তব অভিজ্ঞতা। তিনি সরাসরি বহু যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন। আবু উবাইদ আস সাকাফি সাত হাজারের একটি বাহিনী নিয়ে ইরাকের উদ্দেশ্যে রওনা হলেন। 

এদিকে ইরাকের যুদ্ধের ভয়াবহতা বিবেচনা করে উমার রা. খালিদ রা.-এর সাথে সিরিয়ায় যাওয়া সৈন্যদের আবার ইরাকে ফেরত পাঠানোর জন্য আবু উবাইদা রা.-কে চিঠি লিখলেন। আবু উবাইদা রা. হাশিম ইবন উতবাকে নেতা মনোনীত করে দশহাজার সৈন্যের একটি বাহিনী ইরাকে প্রেরণ করেন। মুসলিম বাহিনী যখন ইরাক পৌঁছে তখন পারসিকগণ তাদের রাজা-রাণী মনোনয়ন নিয়ে ব্যস্ত ছিল। অবশেষে বুরান বিনতে কিসরাকে ক্ষমতায় বসায়। রাণী বুরান সেনাপতি রুস্তমের নিকট দশ বছরের জন্যে রাজত্ব হস্তান্তর করে এই শর্তে যে, সে যুদ্ধ পরিচালনা করবে। এরপর রাজত্ব ফিরে আসবে কিসরার বংশধরদের নিকট। রুস্তম তা মেনে নেয়। 

এই রুস্তম ছিল একজন জ্যোতিষি। জোত্যিষ ও জ্যোতির্বিদ্যা সম্পর্কে তার ছিল পর্যাপ্ত জ্ঞান । একদিন তাকে বলা হয়েছিল, আপনি জানতেন যে, এই রাজ আর পূর্ণতা পাবে না, স্থায়ী হবে না। তবু এটি গ্রহণে কীসে আপনাকে উৎসাহিত করলো? তিনি বলেলেন, ‘লোভ-লালসা এবং মর্যাদা লাভের উচ্চাকাঙ্ক্ষা আমাকে এটি গ্রহণে উৎসাহিত করেছে। 

সেনাপতি রুস্তম কমান্ডার জাবানকে সেনাপতির দায়িত্ব প্রদান করে মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য প্রেরণ করেছিল। পারসিকরা নামারিক নামক স্থানে সেনাপতি আবু উবাইদ আস সাকাফির মুখোমুখি হয়। নামারিক হলো হীরা ও কাদেসিয়া নগরীর মধ্যবর্তী একটি স্থান। মুসলিম অশ্বারোহী বাহিনীর দায়িত্বে ছিলেন মুসান্না ইবন হারিস। নামারিকে উভয়পক্ষে প্রচণ্ড যুদ্ধ হয়। অবশেষে আল্লাহর সাহায্যে মুসলিমদের বিজয় আসে। 

পরাজিত মুশরিক বাহিনী কাসকায় আশ্রয় গ্রহণ করে। ওখানের শাসক ছিল কিসরার আত্মীয়। তার নাম নারসি। নারসির নেতৃত্বে মুশরিকরা আবারো মুসলিমদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হলো। আবু উবাইদ তাদের ওপর আক্রমণ করে তাদের ছত্রভঙ্গ করে দিলেন। এই যুদ্ধে প্রচুর ধন-সম্পদ মুসলিমদের হস্তগত হয়। এর এক পঞ্চমাংশ মদিনায় পাঠানো হয়। 

নামারিকের দুর্দশার খবর পেয়ে রুস্তম জালিনুসের নেতৃত্বে আরেকটি সেনাদল পাঠায় মুসলিমদের বিরুদ্ধে। জালিনুস আসার আগেই কাসকায় নারসি পরাজিত হয়। এরপর বারুসমা নামক স্থানে জালিনুসের সাথে আবু উবাইদের নেতৃত্বে মুসলিমদের যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে জালিনুস পরাজিত হয়ে মাইনে পালিয়ে যায়। নারসিও মাইনে গিয়ে পৌঁছে। আবু উবাইদ সেনাবাহিনীকে বিভিন্ন ভাগে বিভক্ত করে সীমান্তে প্রেরণ করেন। তাঁরা অবস্থাভেদে আশে পাশের সমস্ত মুশরিক গোষ্ঠীকে নতি স্বীকারে বাধ্য করলো। কেউ কেউ যুদ্ধ না করে সন্ধি করলো। সবাই জিজিয়া দিতে সম্মত হলো। 

এভাবে খুব অল্প সময়ের মধ্যে পারসিক মুশরিকদের তিনটি বাহিনী পরাজিত হয়। এতে তাদের মনোবল ভেঙে পড়ে। অন্যদিকে মুসলিমরা আল্লাহর সাহায্য পেয়ে উজ্জীবিত হয়ে উঠলো। 

১৪ এপ্রি, ২০২২

আমাদের রাহবার জনাব মকবুল আহমাদ


হিন্দুত্ববাদ তথা মুশরিকদের বিরুদ্ধে আজাদির লড়াইয়ে তিনি ছিলেন অবিচল, শান্ত, দৃঢ়, সোম্য একজন সিপাহসালার। তাঁর কথা বলা লাগতো না, চেহারা দেখেই আমরা লড়াইয়ে অবিচল থাকার সাহস পেতাম। তিনি বৃদ্ধ বয়সেও আমাদের নেতৃত্ব দিয়েছেন। যখনই তাঁর মনে হয়েছে অসুস্থতা তাঁকে যোগ্য নেতৃত্ব থেকে দূরে রেখেছে। তিনি সাথে সাথেই পদত্যাগ করে যোগ্য লোকের কাছে নেতৃত্ব বুঝিয়ে দিয়েছেন। নেতৃত্বের প্রতি লোভহীনতা শুধু মুখে বলতেন না, বাস্তবেও দেখিয়ে গেছেন। 


তিনি সাক্ষ্য হয়ে আছেন কীভাবে চরম দুঃসময়ে শান্ত ও অবিচল থেকে কর্মীদের পরিচালনা করতে হয়। একদিকে কারাগারে প্রাণপ্রিয় দায়িত্বশীলরা একের পর এক ফাঁসীতে জীবন দিচ্ছেন, একদিকে স্বৈরাচারী সরকারের ইসলামী আন্দোলন থেকে সরে আসার আপোষ প্রস্তাব অন্যদিকে হতাশ কর্মীবাহিনী। আহ! কী দুঃসময়!  কী যাতনা বহন করতে হয়েছে তাঁকে। কিন্তু তিনি ছিলেন নিরুদ্বিগ্ন। কারণ তাঁর অবিচল আস্থা ছিল মহান রবের প্রতি। 

আমরা হতাশ হতাম! ধৈর্যহারা হতাম! আমাদের আমীরের দিকে তাকালে আমরা আবার উৎসাহ পেতাম! রিচার্জড হতাম। আমাদের আমীর! সহজ সরল অথচ কত মহান ছিলেন আপনি! বলছি বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সাবেক আমীর মকবুল আহমাদের কথা। ২০২১ সালের ১৩ এপ্রিল ৮২ বছর বয়সে তিনি ইন্তেকাল করেছেন।  

২০১০ সালের জুনে জামায়াতের তৎকালীন আমীর মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী গ্রেফতার হওয়ার পর থেকে মকবুল আহমাদ ভারপ্রাপ্ত আমীরের দায়িত্ব পালন করেন। ২০১৬ সালের ১৭ অক্টোবর থেকে ২০১৯ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত তিনি বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর তৃতীয় আমীর হিসেবে নির্বাচিত হয়ে দায়িত্ব পালন করে গেছেন।

বাংলাদেশে ইসলামী আন্দোলন শুরু করার ক্ষেত্রে যে কয়জন তাদের মেধা ও শ্রম সর্বোচ্চ বিনিয়োগ করেছেন মকবুল আহমাদ তাদের অন্যতম। বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর তৃতীয় আমীর হিসেবে তিনি নির্বাচিত হন। জামায়াতে ইসলামীর আন্দোলনকে সারাদেশে ছড়িয়ে দেয়ার ক্ষেত্রে মকবুল আহমাদের ভূমিকা উল্লেখ করার মত। সংগঠনকে তৃণমূল পর্যন্ত পৌঁছানো ও সুস্থ সংগঠন হিসেবে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে তিনি অবিশ্রান্তভাবে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।

জন্ম : 
অত্যন্ত সহজ সরল ব্যক্তিত্ব মকবুল আহমাদ ১৯৩৯ সালের ৮ই আগস্ট ফেনী জেলার দাগনভূঞা উপজেলার ওমরাবাদ গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম মরহুম নাদেরুজ্জামান। তাঁরা ৫ ভাই ও ৩ বোন। তাঁর পরিবারের সকল সদস্যই ইসলামী আন্দোলনের সাথে জড়িত।

শিক্ষা ও ক্যারিয়ার : 
মকবুল আহমাদের প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয় পূর্বচন্দ্রপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। এখানে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপ্ত করে তিনি স্থানীয় দাগনভূঞা কামাল আতার্তুক উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি হন। নবম শেণিতে তিনি জয়লস্কর উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি হন এবং এই স্কুল থেকে ১৯৫৭ সালে এসএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। প্রাথমিক পর্যায় থেকে মাধ্যমিক পর্যায় পর্যন্ত সকল পরীক্ষায় তিনি কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখেছেন। মাধ্যমিক পরীক্ষায় পাশের পরে তিনি ফেনী কলেজে ভর্তি হন। তিনি এ কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা এবং ১৯৬২ সালে বিএ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। বিএ পাশের পরে এক বছর সরকারী চাকুরী করার পরে চাকুরী ছেড়ে দেন এবং শিক্ষকতাকে পেশা হিসাবে গ্রহণ করেন। তিনি নিজ এলাকার শরিষাদী উচ্চ বিদ্যালয়ে ৪ বছর এবং ফেনী সেন্ট্রাল উচ্চ বিদ্যালয়ে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত শিক্ষকতা করেন। ১৯৭০ সাল থেকে ৭১ সাল পর্যন্ত তিনি তৎকালীন ফেনী মহকুমার দৈনিক সংগ্রামের সংবাদদাতা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। বাংলাদেশের চিংড়ি মৎস উৎপাদনের উপরে তার বিশেষ প্রবন্ধ (বাংলাদেশের “কালো সোনা” সৌদী আরবের “তরল সোনা”-কে ছাড়িয়ে যাবে) ৭০ দশকে দৈনিক সংগ্রামে ছাপার পর ব্যবসায়ী মহলে বেশ আলোড়ন সৃষ্টি হয়।

রাজনৈতিক জীবন : 
ছাত্রজীবন থেকেই তিনি সক্রিয়ভাবে ইসলামী আন্দোলনের সাথে জড়িত ছিলেন। ছাত্রজীবন শেষ করে ১৯৬২ সালে জামায়াতে ইসলামীতে যোগদান করেন এবং ১৯৬৬ সালে জামায়াতে ইসলামীর রুকন (সদস্য) হন। ১৯৬৭ সাল থেকে ৬৮ সাল পর্যন্ত ফেনী শহর এবং ১৯৬৮ সাল থেকে ১৯৭০ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত তৎকালীন ফেনী মহকুমার আমীরের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য পদে ফেনী-সোনাগাজী নির্বাচনী এলাকা থেকে জামায়াতের প্রার্থী হিসাবে তিনি নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। ১৯৭০ সালের ফেব্রুয়ারি মাস থেকে ১৯৭১ সালের জুন মাস পর্যন্ত তিনি নোয়াখালী জেলা জামায়াতের আমীরের দায়িত্ব পালন করেন। এরপর চট্টগ্রামে সাংগঠনিক দায়িত্ব পালন করেন।

১৯৭৯ সালে বাংলাদেশে জামায়াতে ইসলামীর কাজ পুনরায় শুরু হলে তিনি কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। দীর্ঘ দশ বছর এই দায়িত্ব পালনের পর ১৯৮৯ সাল থেকে ২০০৩ পর্যন্ত তিনি সহকারী সেক্রেটারী জেনারেলের দায়িত্ব পালন করেছেন। ২০০৪ সাল থেকে তিনি কেন্দ্রীয় নায়েবে আমীরের দায়িত্ব পালন করছেন। ২০১০ সালের জুনে জামায়াতের তৎকালীন আমীর মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী গ্রেফতার হওয়ার পর থেকে মকবুল আহমাদ ভারপ্রাপ্ত আমীরের দায়িত্ব পালন করেছেন। ২০১৬ সালের ১৭ অক্টোবর থেকে ২০১৯ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত তিনি বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর তৃতীয় আমীর হিসেবে নির্বাচিত হয়ে দায়িত্ব পালন করে গেছেন।

পারিবারিক জীবন : 
তিনি ১৯৬৬ সালে লক্ষীপুর নিবাসী প্রখ্যাত আলেমে দ্বীন ঢাকা আরমানিটোলা সরকারী উচ্চ বিদ্যালয়ের হেড মাওলানা মরহুম ওহিদুল হকের কনিষ্ঠা কন্যা জনাবা সুরাইয়া বেগমের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। বর্তমানে তাদের ৩ ছেলে ও ২ মেয়ে রয়েছে। তারা সকলেই ইসলামী আন্দোলনের সাথে সক্রিয়ভাবে জড়িত।

সমাজ কল্যাণমূলক কর্মকান্ড : 
ছাত্র জীবন থেকেই তিনি সমাজ সেবামূলক কাজের সাথেও জড়িত রয়েছেন। নিজ গ্রামের যুবকদের নিয়ে ১৯৬২ সালে “ওমরাবাদ পল্লী মঙ্গল সমিতি” প্রতিষ্ঠা করেন এবং দীর্ঘ দশ বছর পর্যন্ত এ সমিতির সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। এলাকার রাস্তাঘাট, পুল ও সাঁকো সংস্কার নির্মাণে এবং দরিদ্র লোকদের সাহায্য-সহযোগিতাকল্পে এ সমিতির সভাপতি হিসেবে তিনি বিশেষ অবদান রাখেন। তিনি ১৯৭৬ সাল থেকে ১৯৮০ সাল পর্যন্ত “গজারিয়া হাফেজিয়া মাদ্রাসার” ম্যানেজিং কমিটির সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। এ ছাড়া তিনি বিভিন্ন সামাজিক, কল্যাণমূলক প্রতিষ্ঠান পরিচালনার সাথে যুক্ত ছিলেন। 

দেশভ্রমণ ও লেখালেখি : 
রাবেতা আল-আলম আল-ইসলামীর মেহমান হিসাবে তিনি ২বার হজ্জ পালন করেন। তিনি সাংগঠনিক কাজে জাপান ও কুয়েত সফর করেন। সাপ্তাহিক সোনার বাংলায় “জাপান সফর- দেখার অনেক, শিখার অনেক” এ বিষয় তার সফর অভিজ্ঞতা নিয়ে একটি সুন্দর লিখা প্রকাশিত হয়।  ১৯৭৬ ও ৭৯ সালে তিনি “রাবেতা আলম আল ইসলামীর” মেহমান হিসাবে দু’বার পবিত্র হজ্জ্বব্রত পালন করেন এবং জাপান ইসলামী সেন্টারের দাওয়াতে জাপান সফর করেন। ইসলামী আন্দোলন নিয়ে তাঁর একটি বই রয়েছে। 


১২ এপ্রি, ২০২২

যেভাবে খুন করা হলো শহীদ কামারুজ্জামানকে

 


বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী সিনিয়র সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল শহীদ মুহাম্মদ কামারুজ্জামানকে ফ্যাসিবাদী আওয়ামী সরকার আদালতের মাধ্যমে খুন করেছে। বানোয়াট অভিযোগ ও সাজানো বিচারে এই রাষ্ট্রীয় হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়। শহীদ মুহাম্মদ কামারুজ্জামান বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরের ২য় কেন্দ্রীয় সভাপতি ছিলেন।  

শহীদ কামারুজ্জামানের বিরুদ্ধে সাতটি অভিযোগ আনা হয়। এই ব্যাপারে ট্রাইব্যুনালের রায়ের বিরুদ্ধে আপীল করা হয়। শহীদ কামারুজ্জামানের আপীলের ব্যাপারে জৈষ্ঠ্য বিচারপতি মো.আবদুল ওয়াহহাব মিঞা রায়ে বলেন, 

আপিল আংশিকভাবে মঞ্জুর হলো। ২, ৪ এবং ৭ নম্বর অভিযোগে আপিলকারী দোষী না হওয়ায় (মুহাম্মদ কামারুজ্জামান) খালাস দেয়া হলো। ৪ নম্বর অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত হওয়ায় ট্রাইব্যুনালের দেয়া মৃত্যৃদন্ডের স্থলে যাবজ্জীবন সাজা দেয়া হলো। ২ নম্বর অভিযোগের ক্ষেত্রে প্রসিকিউশন সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণে ব্যর্থ। কারণ দোষী প্রমাণিত না হওয়ায় অভিযুক্তকে খালাস দেয়া হলো। ৩ নম্বর অভিযোগে ট্রাইব্যুনালের দেয়া মৃত্যুদন্ডের আদেশ সংশোধন করে যাবজ্জীবন সাজা দেয়াই যুক্তিযুক্ত। কারণ ঘটনাস্থলে অভিযুক্তের উপস্থিতি নিয়ে সন্দেহ রয়েছে, এটা অনিশ্চিত। 

৪ নম্বর অভিযোগের ক্ষেত্রে বলেছেন, প্রসিকিউশন অভিযোগ প্রমাণ করতে পারেনি। ৭ নম্বর অভিযোগে বলা হয়েছে, এই অভিযোগটিও প্রসিকিউশন সন্দেহাতীত প্রমাণ করতে পারেনি। তদন্ত কর্মকর্তা বলেছেন ‘কামারুজ্জামান কোনো কোনো দিন সকালে, কোনো কোনো দিন দুপুরে আবার কোনো কোনো দিন সন্ধ্যার পর ডাক বাংলোর ক্যাম্পে আসতো। যদি তাই হয় তাহলে কিভাবে অভিযুক্ত প্রণিধানযোগ্য আল বদর নেতা হলেন? কিভাবে সাক্ষীরা তাকে দেখেছে এবং ঘটনায় তার সম্পৃক্ততা রয়েছে তা বিশ্বাসযোগ্য নয়। এ বিষয়গুলো আরো বিস্তারিত ট্রাইব্যুনাল বিবেচনা নিতে পারতো। তাই অভিযুক্তকে খালাস দেয়া হলো। 

কিন্তু অন্যান্য বিচারক বিশেষত প্রধান বিচারপতি সিনহা নিজ দায়িত্ব নিয়ে আওয়ামী এজেন্ডা বাস্তবায়ন করে। সে ৩নং অভিযোগে মৃত্যুদণ্ড দেয়। 

সাত অভিযোগের ভিত্তিতে তাঁর বিচার হয়। তার মধ্যে চূড়ান্তভাবে আপীল বিভাগের রায়ে যে সিদ্ধান্ত আসে তা হলো,

১ নং অভিযোগ - খালাস
২ নং অভিযোগ - ১০ বছরের কারাদন্ড
৩ নং অভিযোগ - সংখ্যাগরিষ্টের মতামতের ভিত্তিতে মৃত্যুদন্ড।
৪ নং অভিযোগ - যাবজ্জীবন
৫ নং অভিযোগ - খালাস
৬ নং অভিযোগ - খালাস
৭ নং অভিযোগ - যাবজ্জীবন

অর্থাৎ ৩ নং অভিযোগের ফাঁসীর রায় কার্যকর করা হল যাতে বিচারকেরা একমত হতে পারেননি। এবার আসুন দেখে নিই অভিযোগটি কি ছিল। অভিযোগটি হচ্ছে, কামরুজ্জামানের পরিকল্পনায় এবং নেতৃত্বে সোহাগপুরে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ১২০ জনকে খুন করে এবং অনেক মহিলাকে ধর্ষন করে।

১- কামারুজ্জামানের জন্ম ১৯৫২ সালে, ১৯৭১ সালে তার বয়স ১৯ বছর। ১৯ বছরের একজন কিশোর কিভাবে এতবড় অভিযানের পরিকল্পনা করেন? কিভাবে সেনাবাহিনীর জাঁদরেল অফিসারদের সামনে নেতৃত্ব দেন? আর এমনটাও নয় যে ঐ এলাকার মানুষ কামারুজ্জামানের বিরুদ্ধে অভিযোগ করে আসছিলো। হঠাত করে ৪০ বছর পর কামারুজ্জামানের বিরুদ্ধে এই ধরণের সাজানো অভিযোগে মৃত্যুদন্ড দেয়া হত্যাকান্ডেরই নামান্তর।

২- এই চার্জে তিনজন মহিলা ক্যামেরা ট্রায়ালে সাক্ষ্য প্রদান করেন। ট্রাইব্যুনালে তারা বলেন তাদেরকে ধর্ষন করা হয় এবং সেখানে কামারুজ্জামান উপস্থিত ছিলেন। অথচ তদন্তকারী কর্মকর্তার কাছে জবানবন্দিতে তারা কামারুজ্জামানের উপস্থিতির ব্যাপারে কিছুই বলেন নি। কামারুজ্জামানের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের সময়ও বলা হয়নি তিনি ঘটনার সময় ঐ গ্রামে উপস্থিত ছিলেন।

এই মামলায় দশজন সাক্ষী সাক্ষ্য দেয়ার পর নতুন করে তাদের দিয়ে সাক্ষ্য দেয়ানো হয়। অথচ মূল সাক্ষী তালিকার ৪৬ জনের মধ্যে তাদের নাম ছিলনা।

এর মধ্যে ১১ নং সাক্ষী হাসেন বানু বলেন, দেশ স্বাধীন হলে আমরা মুরুব্বিদের কাছে শুনেছি এই আসামী বড় নেতা ছিলেন এবং স্বাধীনতার পর তিনি শেরপুরে ধরা পড়েছিলেন। তিনি আদৌ কামারুজ্জামানকে চিনেন না।

১২ নং সাক্ষী হাফিজা বেওয়া বলেছেন দেশ স্বাধীন হলে তিনি টিভিতে প্রথম কামারুজ্জামানকে দেখেছেন। হাফিজা বেওয়াও বলেছেন কামারুজ্জামানের নাম মুরুব্বিদের কাছ থেকে শুনেছেন। কোন মুরুব্বি ? এই জিজ্ঞাসায় তিনি কোন মুরুব্বির নাম বলতে পারেননি। এই মুরুব্বী কি সরকারের কর্তাব্যাক্তিরা?

করফুলি বেওয়া আমি যুদ্ধের আগে থেকে কামারুজ্জামানকে চিনিনা। দেশ স্বাধীনের ৩-৪ মাস পরে কামারুজ্জামান সাহেবকে চিনেছি। কিভাবে চিনেছেন এই প্রশ্নের উত্তরও বেশ মজার, তিনি বলেন, আমার বাড়ির আশে পাশে দিয়ে অনেক মানুষ নিয়ে কামারুজ্জামান হেঁটে যায়, তখন চিনেছি। অথচ স্বাধীনতার পর সোহাগপুরে গিয়ে হাঁটাহাঁটির কোন কারনই নেই। কামারুজ্জামানের বাড়ি ভিন্ন থানায়। সোহাগপুর থেকে প্রায় ৪০-৪৫ কিলোমিটার দূরে।

জেরায় তারা কেউই কামারুজ্জামানকে চিনেন না। সবাই মুরুব্বিদের থেকে শুনেছিলেন। তাহলে তাদের ধর্ষন ও স্বামী হত্যার দায় কামারুজ্জামানের উপর পড়বে কেন?

তারা তিনজন যে কত মিথ্যা কথা বলেছে তা তাদের তিনজনের জেরার বর্ণনা পড়লে তা বুঝতে পারবেন। একজন বলেছে আরেকজনের সাথে এসেছে। অন্যজন বলেছে তিনি একাই এসেছেন। আবার তাকে যখন জিজ্ঞাসা করা হয়েছিলো কত টাকা দিয়ে এসেছেন? তিনি আর তা বলতে পারেননি। সমানে মিথ্যা কথা বলা সাক্ষীদের সাক্ষ্য আদালতে কত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ধরা দিয়েছে।

৩- সাক্ষীদের কেউই বলতে পারেননি কামারুজ্জামান কখন কোথায় কাকে এই গণহত্যার নির্দেশ দিয়েছিলেন

৪- সাংবাদিক মামুনুর রশীদ “সোহাগপুরের বিধবা কন্যারা” নামে একটি গবেষনামূলক বই লিখেন। তিনি সেই সময়ের গণহত্যা নিয়ে ১৫ জন মহিলার সাক্ষাৎকার নিয়ে বইটি লিখেন। বইটি প্রকাশিত হয় ২০১০ সালে। সেখানে হাসেন বানু, করফুলি বেওয়া তাদের বিস্তারিত সাক্ষাৎকার দেন। সেখানে তারা কেউই কামারুজ্জামানের নাম উচ্চারণ করেননি। সেই বইতে ভিকটিমদের সাক্ষাৎকার অনুসারে ১৪৮ জন রাজাকারের নাম প্রস্তুত করা হয়। সেখানেও নাম নেই কামারুজ্জামানের। কি আজিব বিষয়! যে মহিলারা ২০১০ সালে কামারুজ্জামানকে চিনতোনা তার বিরুদ্ধে তাদের কোন অভিযোগ ছিলনা অথচ এখন কামারুজ্জামান ছাড়া আর কারো বিরুদ্ধে তাদের অভিযোগ নেই।

৫- কামারুজ্জামানের পক্ষে সাফাই সাক্ষী দেয়ার জন্য ৬০০ জন সাক্ষী থাকলেও আদালত অনুমতি দেয় মাত্র পাঁচজনকে।

আদালত এগুলো কিছুই বুঝার চেষ্টা করেন নি কারণ তাদের তো রায় দিতে হবে। বিচারক নিজামুল হক নাসিমের সুত্র ধরে যদি বলতে হয় তাহলে বলতে “সরকার গেছে পাগল হইয়া তারা একটা রায় চায়”। বিচারপতিগণ অতি নিষ্ঠার সাথে সরকারের চাওয়া সেই রায়েরই বাস্তবায়ন করেছেন। যেখানে বিচার পদদলিত হয়েছে অবিচারের কাছে।

এদেশে এখন সবচেয়ে বেশী অবিচার হয় বিচারালয় হতেই। এখানে বিচার আশা করা পাপ। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যশনালের ভাষায় “বিচারের গর্ভপাত হচ্ছে”। যে দেশে পাপীরা ও সন্ত্রাসীরা বিচারকের আসনে বসে আছে সে দেশে সৎ মানুষেরা শাস্তি পাবে এটাই স্বাভাবিক।

১১ এপ্রি, ২০২২

আমাদের নেতা শহীদ কামারুজ্জামান রহ.



শহীদ মুহাম্মদ কামারুজ্জামান রহ.। বাংলাদেশের রাজনীতিতে একজন প্রতিভাবান যোদ্ধা। বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরের ২য় কেন্দ্রীয় সভাপতি। তাঁর চমৎকার লেখনির মাধ্যমে আমরা সমাজ, সভ্যতা ও পাশ্চাত্যের নানা অসঙ্গতির ইতিহাস জানাতে সক্ষম হয়েছি। দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে গুণগত পরিবর্তন, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার লড়াইয়ে তিনি ছিলেন অন্যতম। দেশে-বিদেশে সভা-সেমিনারে তাঁর ব্যতিক্রমধর্মী উপস্থাপনা সেক্যুলার ও বামপন্থীদের ইসলামী আন্দোলনের ব্যাপারে হিংসা বাড়িয়ে দিয়েছে। এভাবেই তিনি জালিমদের হিটলিস্টে চলে আসেন। তিনি ছিলেন একাধারে একজন রাজনীতিবিদ, বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক, লেখক, ইসলামী ব্যক্তিত্ব, সদালাপী প্রাণপুরুষ। 

শহীদ মুহাম্মদ কামারুজ্জামান যেমন একদিকে সফল রাজনীতিবিদ ও সংগঠক অন্যদিকে একজন সফল সাংবাদিক ও সম্পাদক। রাজনৈতিক ময়দানে প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণের পাশাপাশি মুহাম্মদ কামারুজ্জামান বাংলাদেশের রাজনীতি, ইসলামী সংগঠন ও আন্দোলন, গণতন্ত্র ও তার বিকাশ, নির্বাচন, গণমাধ্যম, সমাজ সংস্কৃতিসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে প্রচুর চিন্তা ও গবেষণা করে চলেছেন। তিনি বাংলাদেশে অবাধ গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠাসহ ইসলামী আদর্শ প্রতিষ্ঠা ও তার কৌশল নিয়ে বেশ কয়েকটি মৌলিক গ্রন্থ রচনা করেছেন। 

জন্ম ও শিক্ষা জীবন: 
মুহাম্মদ কামারুজ্জামান ১৯৫২ সালের ৪ জুলাই শেরপুর জেলার বাজিতখিলা ইউনিয়নের মুদিপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা মরহুম ইনসান আলী সরকার ও মাতা মরহুমা সালেহা খাতুন। তিনি শেরপুর জিকেএম ইন্সটিটিউশন থেকে মাধ্যমিক পাশ করেন। তিনি প্রথম শ্রেণী থেকে দশম শ্রেণী পর্যন্ত বরাবরই প্রথমস্থান অধিকার করেছেন। অষ্টম শ্রেণীতে তিনি আবাসিক বৃত্তি পান। ১৯৬৭ সালে জিকেএম ইন্সটিটিউশন থেকে ৪টি বিষয়ে লেটারসহ এসএসসি পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন এবং আবাসিক বৃত্তি লাভ করেন।  ১৯৬৭-৬৯ সেশনে জামালপুর আশেক মাহমুদ কলেজে উচ্চ মাধ্যমিক শ্রেণীতে অধ্যয়ন করেন। কিন্তু দেশে ’৬৯-এর গণআন্দোলন শুরু হওয়ায় পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করা থেকে বিরত থাকেন। ১৯৭২ সালে মোমেনশাহী নাসিরাবাদ কলেজ থেকে এইচএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ১৯৭৪ সালে ঢাকা আইডিয়াল কলেজ থেকে ডিস্ট্রিংশনসহ বিএ পাস করেন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে মাস্টার্সে ভর্তি হন। সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের আবাসিক ছাত্র হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবৃত্তি লাভ করেন। ১৯৭৬ সালে কৃতিত্বের সাথে সাংবাদিকতায় এমএ পাস করেন।

ছাত্র রাজনীতি: 
শেরপুরের বিশিষ্ট ইসলামী ব্যক্তিত্ব মরহুম কাজী ফজলুর রহমানের আহ্বানে জিকেএম ইন্সটিটিউটে নবম শ্রেণীর ছাত্র থাকাকালীন তিনি ইসলামী ছাত্র আন্দোলনে যোগ দেন। কলেজে পা দিয়েই তিনি ছাত্র রাজনীতিতে সক্রিয়ভাবে জড়িয়ে পড়েন। ১৯৭৭ সালে বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির প্রতিষ্ঠিত হলে তিনি প্রথম ঢাকা মহানগরীর সভাপতি এবং পরে সেক্রেটারি জেনারেল মনোনীত হন। ১৯৭৮ সালের ১৯ এপ্রিল ভারপ্রাপ্ত সভাপতি এবং একমাস পরই নির্বাচনের মাধ্যমে সেশনের বাকি সময়ের জন্য কেন্দ্রীয় সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৭৮-৭৯ সালেও শিবিরের কেন্দ্রীয় সভাপতি হিসেবে পুনঃনির্বাচিত হন।

সাংবাদিকতা: 
ছাত্রজীবন শেষে মুহাম্মদ কামারুজ্জামান সাংবাদিকতাকেই পেশা হিসেবে গ্রহণ করেন। ১৯৮০ সালে তিনি বাংলা মাসিক ‘ঢাকা ডাইজেস্ট’ পত্রিকার নির্বাহী সম্পাদক হিসেবে কাজ শুরু করেন। ১৯৮১ সালে তাকে সাপ্তাহিক ‘সোনার বাংলা’ পত্রিকার সম্পাদকের দায়িত্ব প্রদান করা হয়। মাত্র ১ জন পিয়ন ও ১ জন কর্মচারী নিয়ে যাত্রা শুরু করে সোনার বাংলা। সামরিক স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে সোনার বাংলায় ক্ষুরধার লেখনীর কারণে এরশাদের শাসনামলে পত্রিকাটির প্রকাশনা নিষিদ্ধ হয়। ‘সোনার বাংলা’ রাজনৈতিক কলাম ও বিশ্লেষণ বেশ জনপ্রিয়তা অর্জন করে এবং পত্রিকাটি দেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক সাপ্তাহিকের মর্যাদা লাভ করে। কারাগারে যাওয়ার পূর্ব পর্যন্ত মুহাম্মদ কামারুজ্জামান পত্রিকাটির সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

এছাড়া তিনি নিজস্ব উদ্যোগে একটি ব্যতিক্রমধর্মী সাপ্তাহিক ম্যাগাজিন ‘নতুন পত্র’ প্রকাশ করেন। মুহাম্মদ কামারুজ্জামান ১৯৮৩ সাল থেকে ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত দশ বছর দৈনিক সংগ্রামের নির্বাহী সম্পাদকের দায়িত্বও পালন করেন। মুহাম্মদ কামারুজ্জামান জাতীয় প্রেস ক্লাবের একজন সদস্য এবং ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সদস্য ছিলেন। ১৯৮৫-৮৬ সাল পর্যন্ত তিনি অবিভক্ত বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন-বিএফইউজে’র কার্যনির্বাহী পরিষদের নির্বাচিত সদস্য ছিলেন।

ইসলামী আন্দোলন: 
পেশাগত দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি ১৯৭৯ সালে মুহাম্মদ কামারুজ্জামান জামায়াতে ইসলামীতে যোগদান করেন, একই বছর তিনি জামায়াতের রুকন (সদস্য) হন। ১৯৮১-৮২ সালে তিনি কিছুদিনের জন্য ঢাকা মহানগরী জামায়াতের জয়েন্ট সেক্রেটারি ছিলেন। ১৯৮২ সাল থেকে ১৯৯২ সাল পর্যন্ত জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় প্রচার সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯২ সালে তাকে জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেলের দায়িত্ব অর্পণ করা হয়। জামায়াতের কেন্দ্রীয় রাজনৈতিক কমিটি ও লিয়াজোঁ কমিটির সদস্য হিসেবে বিগত স্বৈরাচার এরশাদ বিরোধী গণতান্ত্রিক আন্দোলনে ১৯৮৩-৯০ পর্যন্ত তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ১৯৯৩-৯৫ সাল পর্যন্ত তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে তার ভূমিকা ছিল উল্লেখযোগ্য।

জামায়াতে ইসলামীর সিনিয়র সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মুহাম্মদ কামারুজ্জামান জামায়াতের নির্বাহী কমিটি, কেন্দ্রীয় মজলিসে শূরা, কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদ ও বিভিন্ন কমিটির সদস্য এবং আন্তর্জাতিক বিষয়ক সেক্রেটারি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসায় পর গঠিত চারদলের কেন্দ্রীয় লিয়াজোঁ কমিটির অন্যতম শীর্ষ নেতা হিসেবে তার অবদান উল্লেখযোগ্য। ইসলামী ও জাতীয়তাবাদী শক্তির ঐক্য প্রচেষ্টায় তিনি অক্লান্ত পরিশ্রম করেন। এজন্য দলীয় রাজনীতি ছাড়াও বিভিন্ন ফোরামে সভা-সমাবেশ, সেমিনার-সিম্পোজিয়ামে তার সক্রিয় উপস্থিতি বিশেষভাবে লক্ষ্য করা যায়।

শেরপুরের জনগনের ম্যান্ডেট:
১৯৮৬ সাল থেকে শেরপুর সদর তথা শেরপুর-১ আসনে জনাব মুহাম্মদ কামারুজ্জামান প্রতিদ্বন্তিতা করে উল্লেখযোগ্য ভোট পেয়ে আসছেন। সর্বশেষ দুটি সাধারন নির্বাচনে(২০০১ ও ২০০৮) তিনি খুব অল্প ভোটের ব্যাবধানে হেরে গেলেও ধারনা করা হয় তিনিই প্রকৃত বিজয়ী। কারণ,ঐ দুই নির্বাচনেই আওয়ামীলীগ প্রার্থী তার নিয়ন্ত্রনাধীন এলাকার ভোট কেন্দ্রগুলো দখল করে ব্যাপক কারচুপির মাধ্যমে বিজয় ছিনিয়ে নেন। এত কিছুর পরও ২০০১ এর নির্বাচনে কামারুজ্জামান ৬৫,৪৯০ ভোট (বিজয়ী আওয়ামী প্রার্থীর প্রাপ্ত ভোট ৮৬,১০১)এবং ২০০৮ এর ডিজিটাল নির্বাচনে ১,১০,০৭০ ভোট পান (বিজয়ী আওয়ামী প্রার্থীর প্রাপ্ত ভোট ১,৩৬,১২৭)। ১৯৭১ সালে শেরপুরের নারকীয় ঘটনাগুলোর প্রত্যক্ষদর্শী মানুষগুলো বেঁচে থাকতে শহীদ কামারুজ্জামানকে এত বিপুল ম্যান্ডেট দেয়া কি কোন অর্থ বহন করে না? যে অভিযোগগুলো আনা হয়েছে তা যদি সত্য হতো তবে তিনি এখানে জনগণের ভালোবাসা পেলেন কী করে?  

লেখক কামারুজ্জামান: 
মুহাম্মদ কামারুজ্জামান দেশী বিদেশী বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে কলাম লিখতেন। পত্র-পত্রিকা ও বিভিন্ন জার্নালে তার লেখা প্রকাশিত হয়েছে। তার লিখিত বইগুলো পাঠক সমাদৃত হয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো আধুনিক যুগে ইসলামী বিপ্লব, পশ্চিমা চ্যালেঞ্জ ও ইসলাম, বিশ্ব পরিস্থিতি ও ইসলামী আন্দোলন, সংগ্রামী জননেতা অধ্যাপক গোলাম আযম, সাঈদ বদিউজ্জামান নুরসী ইত্যাদি।

বিচারিক কার্যক্রম: 
২০১৩ সালের ৯ মে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ এর চেয়ারম্যান বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বে বিচারপতি মজিবুর রহমান মিয়া ও বিচারক মো. শাহিনুর ইসলাম মুহাম্মদ কামারুজ্জামানকে মৃত্যুদন্ডের রায় দেয়। ওই রায়ের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে ৬ জুন আপিল করেন মুহাম্মদ কামারুজ্জামান। গত বছরের ৫ জুন এ বিষয়ে শুনানি শুরু হয়। ১৭ সেপ্টেম্বর মুহাম্মদ কামারুজ্জামানের পক্ষে আপিলের যুক্তি উপস্থাপন শেষ করেন তার আইনজীবীরা। এরপর ৩ নবেম্বর আপিল বিভাগের তৎকালীন জ্যেষ্ঠ বিচারপতি ও বর্তমান প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বে চার বিচারপতির বেঞ্চ মুহাম্মদ কামারুজ্জামানের মৃত্যুদন্ড বহাল রেখে সংক্ষিপ্ত আদেশে রায় ঘোষণা করেন।

যে কারনে মৃত্যুদন্ডাশের বিরোধীতা করলেন এক বিচারপতি:
আপিলের রায়ে জ্যোষ্ঠ বিচারপতি মো.আবদুল ওয়াহহাব মিঞা রায়ে বলেন, আপিল আংশিকভাবে মঞ্জুর হলো। ২, ৪ এবং ৭ নম্বর অভিযোগে আপিলকারী দোষী না হওয়ায় (মুহাম্মদ কামারুজ্জামান) খালাস দেয়া হলো। ৪ নম্বর অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত হওয়ায় ট্রাইব্যুনালের দেয়া মৃত্যৃদন্ডের স্থলে যাবজ্জীবন সাজা দেয়া হলো। ২ নম্বর অভিযোগের ক্ষেত্রে প্রসিকিউশন সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণে ব্যর্থ। কারণ দোষী প্রমাণিত না হওয়ায় অভিযুক্তকে খালাস দেয়া হলো। ৩ নম্বর অভিযোগে ট্রাইব্যুনালের দেয়া মৃত্যুদন্ডের আদেশ সংশোধন করে যাবজ্জীবন সাজা দেয়াই যুক্তিযুক্ত। কারণ ঘটনাস্থলে অভিযুক্তের উপস্থিতি নিয়ে সন্দেহ রয়েছে, এটা অনিশ্চিত। ৪ নম্বর অভিযোগের ক্ষেত্রে বলা হয়েছে ,প্রসিকিউশন অভিযোগ প্রমাণ করতে পারেনি। ৭ নম্বর অভিযোগে বলা হয়েছে, এই অভিযোগটিও প্রসিকিউশন সন্দেহাতীত প্রমাণ করতে পারেনি। তদন্ত কর্মকর্তা বলেছেন ‘কামারুজ্জামান কোনো কোনো দিন সকালে, কোনো কোনো দিন দুপুরে আবার কোনো কোনো দিন সন্ধ্যার পর ডাক বাংলোর ক্যাম্পে আসতো। যদি তাই হয় তাহলে কিভাবে অভিযুক্ত প্রণিধানযোগ্য আল বদর নেতা হলেন? কিভাবে সাক্ষীরা তাকে দেখেছে এবং ঘটনায় তার সম্পৃক্ততা রয়েছে তা বিশ্বাসযোগ্য নয়। এ বিষয়গুলো আরো বিস্তারিত ট্রাইব্যুনাল বিবেচনা নিতে পারতো। তাই অভিযুক্তকে খালাস দেয়া হলো।

প্রাণভিক্ষা নাটক: 
সরকার কামারুজ্জামান, তার পরিবার ও ইসলামী আন্দোলনকে অপদস্ত করার জন্য গুজব ছড়ায় যে, কামারুজ্জামান প্রাণভিক্ষার জন্য আবেদন করেছেন। দুইজন মেজিস্ট্রেটের কাছে তিনি এই কথা বলেছেন। এরপর মুহাম্মদ কামারুজ্জামানের সাথে ১১ এপ্রিল শনিবার বিকেল ৪টা ১০ মিনিটে পরিবারের সদস্যরা ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে সাক্ষাত করেন। সাক্ষাৎ শেষে তার ছেলে হাসান ইকবাল ওয়ামী বলেন, প্রাণভিক্ষা চাওয়া প্রসঙ্গে বাবা বলেছেন, প্রাণের মালিক আল্লাহ। রাষ্ট্রপতি জীবন দেয়ারও মালিক নন নেয়ারও মালিক নন যে তার কাছে প্রাণভিক্ষা চাইবো। তিনি বলেন, বাবা বিচলিত নন, আমরা হাসিমুখে বিদায় দিয়ে গেলাম। তার সাথে কোন ম্যাজিস্ট্রেট দেখা করেননি বলেও জানান মুহাম্মদ কামারুজ্জামান। বড় ছেলে হাসান ইকবাল ওয়ামী বলেন, রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষা চওয়ার প্রশ্নই উঠে না। ক্ষমা চাইবেনতো শুধু আল্লাহর কাছে। তিনি বলেন, আমার বাবার স্বপ্ন ছিল এদেশে ইসলামী শাসন কায়েম হবে। জামায়াতে ইসলামীর নেতৃত্বেই এদেশে ইসলামী শাসন প্রতিষ্ঠিত হবে।তিনি বলেন, তার বাবা বলেছেন, তার সাথে বিচারের নামে প্রহসন করা হয়েছে। ১৯ বছরের একজন কিশোরকে মিথ্যা অভিযোগে ফাঁসিয়ে দেয়া হয়েছে। এর বিচারের ভার তিনি আল্লাহর ওপর ছেড়ে দিয়েছেন। তিনি বলেন, বাবার মনোবল দৃঢ় আছে। তিনি দেশবাসীর কাছে দোয়া চেয়েছেন। বাবা বিচলিত নন, আমরা হাসিমুখে বিদায় দিয়ে গেলাম।

জীবনের শেষ মুনাজাত: 
১১ এপ্রিল পরিবারের সদস্যরা শেষ দেখা করতে গেলে তাদের নিয়ে জামায়াত নেতা মুহাম্মদ কামারুজ্জামান কেন্ত্রীয় কারাগারে মোনাজাত করেন বলে তাকে দেখা করতে যাওয়া ২১ জন সদস্যের একজন প্রকাশ করেন। তিনি ফেসবুকে লিখেছেন, “আলহামদুলিল্লাহ। কাঁদতে কাঁদতে গিয়েছিলাম, হাসি মুখেই বিদায় জানিয়ে আসলাম প্রিয়জন প্রিয় নেতাকে। আমার দু চোখ, আমার হৃদয় সৌভাগ্যবান। আমি তাকে কাঁদতে দেখিনি বরং আমাদেরকেই সান্ত্বনা দিয়েছেন। উনি যখন বিদায় বেলায় আমাদেরকে নিয়ে মোনাজাত করছিলেন বলছিলেন, হে আল্লাহ আমি দেশের জন্য কাজ করেছি ইসলামের জন্য কাজ করেছি যারা এই অন্যায় বিচার করলেন, এই বিচারে সহযোগিতা করেছে এদের বিচার আপনি দুনিয়াতে এবং আখিরাতে উভয় জায়গায় করবেন। আমি আমার দুই হাত দিয়ে কোন অন্য কাজ করিনি আমার মুখ দিয়ে কাওকে গালি দেইনি আমার সম্পর্কে আপনি ভালো জানেন। আপনি আমাকে শাহাদাতের মর্যাদা দান করুন। আমার পরিবার, স্বজনসহ সকলকে ধৈর্য ধারাণ করার তৌফিক দিন। মুনাজাত শেষে উনি শেরপুরসহ দেশবাসী এবং বিশ্ববাসীকে সালাম জানিয়েছেন। সকলের কাছে দোয়া চেয়েছেন।”

অনন্তকালের যাত্রা: 
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নির্বাহী আদেশে মৃত্যুদন্ড কার্যকরের নামে জামায়াতে ইসলামীর সিনিয়র সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল বিশিষ্ট সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবী মুহাম্মদ কামারুজ্জামানকে ২০১৫ সালের ১১ এপ্রিল রাত রাত ১০টা ৩০ মিনিটে হত্যা করা হয়। ইন্নালিল্লাহে ওয়া ইন্না ইলাইহে রাজেউন।


চির নিন্দ্রায় শায়িত শহীদ কামারুজ্জামান: 
শেরপুরে নিজের গড়া এতিমখানার পাশে চিরনিন্দ্রায় শায়িত হলেন শহীদ মুহাম্মদ কামারুজ্জামান। দাফনের পর থেকেই কবর জিয়ারতের জন্য নামে মানুষের ঢল। কঠোর নিরাপত্তার মধ্যে গতকাল রোববার ভোরে শহীদ মুহাম্মদ কামারুজ্জমানকে দাফনের পর বেলা বাড়ার সাথে সাথেই হাজার হাজার মানুষ তার কবর জিয়ারত করতে আসছেন। দূর-দূরান্ত থেকে আসা লোকজন কামারুজ্জামানের রূহের মাগফিরাত কামনা করে মোনাজাত করছেন। এ সময় অনেকেই কান্নায় ভেঙে পড়ছেন।

মুহাম্মদ কামারুজ্জামানের শেষ ইচ্ছা অনুযায়ী তার নিজের গড়া শেরপুর সদর উপজেলার কুমরী বাজিতখিলা এতিমখানার পাশেই তার লাশ দাফন করা হয়। গতকাল রোববার ভোর ৫টা ২০ মিনিটে দাফন সম্পন্ন হয়। এর আগে রোববার ভোর ৪টা ৫০ মিনিটে এতিমখানা মাঠে তার নামাযে জানাযা অনুষ্ঠিত হয়। এতে কামারুজ্জামানের আত্মীয়সহ স্থানীয়রা অংশগ্রহণ করেন। আশেপাশে হাজার হাজার মানুষ উপস্থিত থাকলেও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কড়াকড়ির কারণে তারা অংশগ্রহণ করতে পারেনি। দাফনস্থলে গণমাধ্যম কর্মীসহ স্থানীয় এলাকাবাসীর প্রবেশাধিকার নিষিদ্ধ ছিল।

সারারাত প্রচুর ঝড়-বৃষ্টি উপেক্ষা করে তার গ্রামের বাড়ির পাঁচ বর্গ কিলোমিটারের বাইরে হাজার হাজার মানুষ রাতভর অপেক্ষা করেও জানাযায় অংশগ্রহণের সুযোগ পাননি। এমনকি ঢাকা থেকে লাশের সাথে যাওয়া গণমাধ্যম কর্মীরাও স্থানীয় বাজিতখিলা বাজারে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আটকেছিলেন। রাতে ওই এলাকায় প্রচুর ঝড়-বৃষ্টি হয়। পুরো এলাকা বিদ্যুৎহীন হয়ে পড়ে। ভোর ৪টার দিকে বিদ্যুৎ আসলেও থেমে থেমে বৃষ্টি হচ্ছিল। তারপরও জনসমাগম কমেনি।

নিকটাত্মীয় ও কিছু গ্রামবাসীর উপস্থিতিতে নামাযে জানাযার পর ৫টা ৪০ মিনিটে উপস্থিত হাজার হাজার জনতার গায়েবানা জানাযা অনুষ্ঠিত হয়। সেখানেও বাধা দেয় আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী। মাঠের পূর্ব অংশের অর্ধেক লোক জানাযায় শরীক হতে পারেনি। মাঝখানে ব্যারিকেড দেয়াছিল। এ সময় জনতা নারায়ে তাকবীর শ্লোগানে আকাশ বাতাশ মুখরিত করে তোলে।

জাতীয় মসজিদে গায়েবানা জানাযা: 
১২ এপ্রিল বাদ যোহর জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমে জামায়াতের সিনিয়র সহকারী সেক্রেটারি মুহাম্মদ কামারুজ্জামানের গায়েবানা জানাযা অনুষ্ঠিত হয়েছে। এতে উপস্থিত ছিলেন জামায়াতে ইসলামী কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদ সদস্য ডা. রেদওয়ানউল্লাহ শাহেদী, ঢাকা মহানগরী মজলিসে শূরা সদস্য ও মতিঝিল থানা আমীর কামাল হোসেনসহ হাজার হাজার নেতাকর্মী ও মুসল্লি এতে উপস্থিত ছিলেন। শহীদ কামারুজ্জামানের জন্য দোয়া করার উদ্দেশ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, সৌদি আরবের জেদ্দা, তুরস্ক, দক্ষিণ আফ্রিকা, পর্তুগালসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে গায়েবানা নামাযে জানাযা অনুষ্ঠিত হয়।

১১ এপ্রিল ফ্যাসিবাদী আওয়ামী সরকার শহীদ মুহাম্মদ কামারুজ্জামান রহ.-কে খুন করে যে আন্দোলনকে নিভিয়ে দিয়ে চেয়েছিল সে আন্দোলনকে নেভানোর সাধ্য তাদের নেই। আল্লাহ তাঁর নূরকে প্রজ্জলিত করবেন, এটা আল্লাহর ওয়াদা। মহান রাব্বুল আলামীন শহীদ কামারুজ্জামান ভাইকে কবুল করুন। তাঁকে দুনিয়া ও আখিরাতে সম্মানিত করুন। আমিন।