৩০ সেপ, ২০২৩

উপমহাদেশে ছাত্র রাজনীতির ইতিহাস (১ম পর্ব)

বাংলাদেশ এবং উপমহাদেশে ছাত্র রাজনীতির উন্মেষ ঘটে ইংরেজ শাসনের হাত ধরে। ইংরেজ শাসনের আগে দীর্ঘ মুসলিম শাসনামলে প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনা থাকলেও ছাত্র রাজনীতির প্রয়োজন হয়নি। এর বেসিক কারণ উচ্চশিক্ষা তখন কোনো বৈষয়িক লাভজনক কাজ ছিল না। শিক্ষার উৎকর্ষ সাধন ও মানবসেবাই ছিল মূল লক্ষ্য। তাই উচ্চশিক্ষার জন্য ছাত্র খুব এভেইলেবল ছিল না। অর্থনীতি ছিল কৃষি ও ব্যবসাভিত্তিক। আর এই দুই কাজের জন্যই উচ্চশিক্ষা প্রয়োজনীয় ছিল না। প্রাথমিক শিক্ষা শেষেই সাধারণত ছাত্ররা নিজ নিজ কর্মে আত্মনিয়োগ করতো।[১]

ব্রিটিশ শাসনামলে ইংরেজরা উচ্চশিক্ষাকে লাভজনক ও অর্থ উপার্জনের নিয়ামক হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে। সামাজিক মর্যাদা, সম্মান, সরকারি চাকুরি, ব্যবসায়িক সুবিধা, ইংল্যান্ডে আত্মপ্রতিষ্ঠার হাতছানি, জমিদারি, ভূমির অধিকারসহ প্রতিটি নাগরিক সুবিধার জন্য পাশ্চাত্য শিক্ষা গ্রহণকে শর্ত করে দেওয়া হয়। ফলে উচ্চশিক্ষা তার লক্ষ্যচ্যুত হয়। এটি আর আগের মতো মানবসেবা বা শিক্ষার উৎকর্ষ সাধনের মহান উদ্দেশ্য সামনে রেখে হয়নি। শিক্ষকরা তাদের স্বার্থের জন্য শিক্ষাদান করতো। ছাত্ররাও তাদের বৈষয়িক সুবিধা হাসিল করার জন্য শিক্ষাগ্রহণ করতে থাকে। ফলে ছাত্র ও শিক্ষকের মধ্যে টানাপড়েন তৈরি হয়। এর মাধ্যমে ছাত্রদের অধিকার আদায়ের দরকার হয় এবং ছাত্র রাজনীতির উন্মেষ ঘটে।

বাংলায় ১ম বিশ্ববিদ্যালয় মানের মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেন শেখ শরফুদ্দিন আবু তাওয়ামা। তিনি ছিলেন হাদিস বিশেষজ্ঞ ও ইসলামি আইনবিদ। রসায়ন, ভৌতবিজ্ঞান ও জ্যোতির্বিজ্ঞানেও তিনি ছিলেন পারদর্শী। স্বাধীন সুলতানি আমলে বাংলায় আসেন তিনি। সুলতান গিয়াসউদ্দীন বলবনের শাসনকালে (১২৬৬-৮৭) তিনি দিল্লিতে পৌঁছেন এবং সেখান থেকে বাংলায় আসেন। [২] এরপর সোনারগাঁতে তিনি মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেন। এরকম আরেকটি বড় প্রতিষ্ঠান হলো তৎকালীন গৌড় ও বর্তমান চাঁপাইনবাবগঞ্জের দারাসবাড়ি মাদরাসা।

ভারতে মুসলিম শাসনামলে সাড়ে পাঁচশত বছরে উপমহাদেশে লাখো মাধ্যমিক মাদরাসা ও হাজার খানেক জামেয়া/ বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা হয়। ১৭৫৭ সালে পলাশী যুদ্ধের পরাজয়ের ক্ষত আমাদের এখনো বয়ে বেড়াতে হচ্ছে। ইংরেজরা সমস্ত মাধ্যমিক মাদরাসা ও জামেয়া বন্ধের ঘোষণা দেয়। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য বরাদ্দকৃত নিষ্কর লাখেরাজ সম্পত্তি সরকারের অধিকারে নিয়ে নেয়। এতে মাদরাসাগুলোর আয় বন্ধ হয়ে যায়। মাদরাসায় জমি সরকার দখল করে প্রতিষ্ঠান গুঁড়িয়ে দেয়। এরপরও কিছু প্রসিদ্ধ শিক্ষক ব্যক্তিগতভাবে নিজ বাড়িতে শিক্ষা চালু রাখার চেষ্টা করেন। সেসব শিক্ষকদের নির্মমভাবে খুন করে ইংরেজরা। [৩]

১০ বছরের মধ্যে তারা বাংলাসহ উপমহাদেশের সমস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দিয়ে এক মূর্খ সমাজে পরিণত করার চেষ্টা চালায়। তাদের টার্গেট ছিল উপমহাদেশের মানুষ কেবল কৃষিকাজ করবে। জ্ঞান-বিজ্ঞান ও শিল্পে তাদের কোনো ভূমিকা থাকবে না। ১৮০০ সাল থেকে তারা পাশ্চাত্য শিক্ষানীতির নামে নতুন ষড়যন্ত্র শুরু করে। নতুনভাবে স্কুল কলেজ প্রতিষ্ঠা ও পাঠ্য কার্যক্রমের পরিকল্পনা করে। এতে তাদের টার্গেট ছিল ভারতীয়রা যাতে ইংরেজদের প্রতি অনুগত থাকে সেরকম শিক্ষানীতি প্রণয়ন করা। এজন্য তারা মুসলিম শাসনামলকে অন্ধকারচ্ছন্ন মধ্যযুগ বলে অভিহিত করে। তাদের পুরাতন সভ্যতাগুলো মহান ও মানবিক সভ্যতা হিসেবে উপস্থাপন করে। ইংরেজরা এদেশ থেকে মুসলিম শাসকদের হটিয়ে আমাদের অন্ধকার থেকে আলোর পথে নিয়ে এসেছে এমন কথা দ্বারা পাঠ্যক্রম সাজায়। যাতে ভারতীয়রা ইংরেজদের মহান ভাবে। ইংরেজদের অনুসরণ করে তাদের অনুগত থাকাকে গর্বের বিষয় হিসাবে ভেবে নেয়।

১৮৩৫ সালের ২রা ফেব্রুয়ারি মেকলে তাঁর বিখ্যাত পাশ্চাত্য শিক্ষানীতির প্রস্তাব বড়লাটের কাছে পেশ করেন। এই প্রস্তাবের প্রধান দিকগুলি হল [৪]

(১) তিনি প্রাচ্যের সভ্যতাকে দুর্নীতি, অপবিত্র ও নির্বুদ্ধিতা বলে অভিহিত করে সরাসরি পাশ্চাত্য শিক্ষার পক্ষে মত প্রকাশ করেন।

(২) তাঁর মতে প্রাচ্যের শিক্ষায় কোনও 'বৈজ্ঞানিক চেতনা' নেই এবং তা পাশ্চাত্য শিক্ষাব্যবস্থা অপেক্ষা সম্পূর্ণভাবে নিকৃষ্ট (Oriental learning was completely inferior to European learning)

(৩) তাঁর মতে, ভালো ইউরোপীয় গ্রন্থাগারের একটি তাক আরব ও ভারতের সমগ্র সাহিত্যের সমকক্ষ। বলা বাহুল্য, মেকলের এই মত ছিল সম্পূর্ণভাবে অহমিকা-প্রসূত ও অজ্ঞানতাপূর্ণ।

(৪) তিনি বলেন যে, উচ্চ ও মধ্যবিত্তদের মধ্যে ইংরেজি শিক্ষা বিস্তৃত হলে তা ক্রমনিম্ন পরিস্রুত নীতি (Downward Filtration Theory) অনুযায়ী ধীরে ধীরে জনগণের মধ্যে ছড়িয়ে পড়বে।

(৫) মেকলের লক্ষ্য ছিল সাংস্কৃতিক বিজয়। তিনি বলেন যে, পাশ্চাত্য শিক্ষার ফলে এমন এক ভারতীয় গোষ্ঠী তৈরি হবে যারা রক্তে ও বর্ণে হবে ভারতীয়, কিন্তু রুচি, মত, নৈতিকতা এবং বুদ্ধিমত্তায় হবে ইংরেজ।

মেকলের এই প্রস্তাবনা অনুসারেই পাশ্চাত্য শিক্ষাক্রম চালু করে করে ইংরেজরা। একই সাথে ইংরেজরা পাঠ্যক্রমে 'বৈজ্ঞানিক চেতনা'র নামে সেক্যুলার শিক্ষা চালু করে। যাতে মানুষ জীবন যাত্রায় ধর্মের কোনো সংযুক্ততা না পায়। ধর্মকে শুধুমাত্র আচার ও রীতিনীতি সর্বস্ব সংস্কৃতিতে পরিণত হয়। মুসলিম ও হিন্দুরা যাতে ভেবে নেয় ধর্মই তাদের পিছিয়ে যাওয়া ও পরাজিত হওয়ার মূল কারণ। যত দ্রুত ধর্মকে ছেড়ে দেবে ততই উন্নতি হবে এমন শিক্ষা দেওয়া হয় ভারতীয়দের। ইংরেজদের এই পাশ্চাত্য শিক্ষানীতি ব্যাপক ভূমিকা রেখেছে উপমহাদেশে। নির্যাতন, দুর্নীতি ও শোষণ করে দুর্ভিক্ষে ঠেলে দিলেও ইংরেজদের সভ্য ও মহান ভাবতে থাকে এই অঞ্চলের মানুষরা।

এই ধরণের বস্তুবাদী শিক্ষা চালু করার ফলে এবং ধর্মীয় শিক্ষার অনুপস্থিতিতে শিক্ষা একটি বস্তুবাদী ও স্বার্থ হাসিলের মাধ্যম হয়ে দাঁড়ায়। ছাত্র ও শিক্ষকরা শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য থেকে বিচ্যুত হয়। আগে যেভাবে শিক্ষকরাই ছাত্রদের অভিভাবক ও তাদের সমস্যার সমাধান করতেন। এখন আর সেই ব্যবস্থা থাকে না। শিক্ষকরা তাদের জীবিকার অংশ হিসেবেই শিক্ষা দান করতেন। জাতি গঠনের মানসিকতা থেকে তাঁরা সরে আসেন। ছাত্ররা তাদের নিজেদের অধিকার আদায় করতে গিয়েই উপমহাদেশে ছাত্র রাজনীতির উন্মেষ ঘটে।    

সর্বপ্রথম ১৮১৮ সালে হুগলির শ্রীরামপুরে ডেনমার্কের খ্রিস্টান মিশনারীদের সহায়তায় পাশ্চাত্য শিক্ষা ব্যবস্থার আদলে 'শ্রীরামপুর কলেজ' প্রতিষ্ঠা হয়।[৫] এরপর ১৮৪১ সালে ঢাকা কলেজসহ অনেক উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান তৈরি করে ইংরেজরা। এসব প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা সরকার থেকে সরাসরি ভাতা পেতেন। তাই সুলতানী আমলের মতো ছাত্রদের প্রতি কেয়ারিং ছিলেন না। নতুন শহরে নানাবিধ সুবিধা পাওয়ার জন্য একই প্রতিষ্ঠানের ছাত্ররা বিভিন্ন এলাকাভিত্তিক সমিতি করে রাজনীতি শুরু করেন। যেমন নোয়াখালী-কুমিল্লা, হুগলি, বারাসাত, আসাম, বরিশাল, ঢাকা ইত্যাদি

১৯২৯ সালে ভারতীয় উপমহাদেশের প্রাচীনতম সংগঠন জমিয়তে তালাবায়ে আরাবিয়া মাদ্রাসা ছাত্রদের অধিকার আদায়ে প্রতিষ্ঠিত হয়। এটি প্রথম ছাত্র রাজনৈতিক দল যারা বিভিন্ন মাদরাসায় সক্রিয় ছিল। তবে এই ছাত্র রাজনীতি জাতীয় রাজনীতিতে কোনো প্রভাব রাখতো না। নিজস্ব প্রতিষ্ঠানের সমস্যা সমাধান ও ছাত্র প্রতিনিধি নির্বাচনের মধ্যেই এই ছাত্ররাজনীতি সীমাবদ্ধ ছিল।[৬]

১৮৮৫ সালে ভারতীয় উপমহাদেশে ১ম রাজনৈতিক দল ইন্ডিয়ান ন্যশনাল কংগ্রেস প্রতিষ্ঠা হয়। এটি উপমহাদেশের সবচেয়ে প্রাচীন রাজনৈতিক সংগঠন। ১৮৮৫ সালে থিওজোফিক্যাল সোসাইটির কিছু সদস্য কংগ্রেস প্রতিষ্ঠা করেন। এঁরা হলেন অ্যালান অক্টোভিয়ান হিউম, দাদাভাই নওরোজি, দিনশ এদুলজি ওয়াচা, উমেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, মনমোহন ঘোষ, মহাদেব গোবিন্দ রানাডে ও উইলিয়াম ওয়েডারবার্ন প্রমুখ। ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে জাতীয় কংগ্রেস নেতৃত্ব দান করেছিল। এই রাজনৈতিক দল গঠিত হয় যাতে ভারতীয় এলিট সোসাইটি সরকার থেকে তাদের প্রাপ্য অধিকার পেতে পারে। এর সাথে অল্প কিছু মুসলিমরাও যুক্ত ছিল। [৭]

কিন্তু যতই দিন গড়াতে থাকে ততই দেখা যায় কংগ্রেস মূলত ভারতীয় হিন্দুদের অধিকার আদায়ে সচেষ্ট। মুসলিমদের ব্যাপারে শুধু অনুৎসাহী নয়, মুসলিমদের সাথে বৈরি আচরণ শুরু করে। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গকে কেন্দ্র করে কংগ্রেস মুসলিমদের শত্রু বিবেচনা করে মুসলিমদের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। কংগ্রেসের বৈরি আচরণের প্রেক্ষিতে বাঙালি মুসলিম রাজনীতিবিদ ও ঢাকার নবাব সলিমুল্লাহর আহবানে উপমহাদেশের সকল মুসলিম নেতৃবৃন্দ ঢাকায় একত্রিত হন। ঢাকায় উপমহাদেশের সকল মুসলিম নেতাদের সমাবেশ  থেকে ১৯০৬ সালে মুসলিম লীগ গঠিত হয়। মুসলিমরা কংগ্রেস ত্যাগ করে মুসলিম লীগে যোগ দিতে থাকেন।[৮]

উপমহাদেশের মানুষরা দুইটি রাজনৈতিক দলে বিভক্ত হয়ে পড়েন। মুসলিমরা মুসলিম লীগে ও হিন্দুরা কংগ্রেসের সাথে যুক্ত হয়ে রাজনীতি এগিয়ে নেন। ইতোমধ্যে কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ উভয় দলই নাগরিক অধিকারের পাশাপাশি স্বাধীনতা আন্দোলন শুরু করে। ১৯৩২ সালে ছাত্রদের জাতীয় রাজনীতিতে যুক্ত করে মুসলিম লীগ। কায়েদে আযম মুহাম্মদ আলী জিন্নাহর নির্দেশে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দি মুসলিম ছাত্রদের নিয়ে মুসলিম লীগের অধীনে ছাত্রদের একটি সংগঠন 'অল বেঙ্গল মুসলিম স্টুডেন্টস লীগ' গঠন করেন। বাংলায় নাম ছিল নিখিল বঙ্গ মুসলিম ছাত্রলীগ। সভাপতি হন ঢাকার আব্দুল ওয়াসেক, সাধারন সম্পাদক হন যশোরের শামসুর রহমান।

এটি ছিল জাতীয় রাজনীতিভিত্তিক উপমহাদেশের ১ম রাজনৈতিক ছাত্র সংগঠক। জাতীয় রাজনীতিতে ছাত্রদের অংশগ্রহণ মুসলিমলীগের রাজনীতিকে সহজ করে দেয়। সাধারণত ছাত্ররা কর্মতৎপর ও অনুগত হয়। মুসলিম লীগ সেই সুবিধাটি গ্রহণ করেছে। অল্প সময়ের মধ্যে মুসলিম লীগ সমগ্র মুসলিম ছাত্রদের মধ্যে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। ছাত্রদের অংশগ্রহণের ফলে ও তাদের নেতৃত্বের সুযোগ সৃষ্টি করায় মুসলিম ছাত্ররা দ্রুতই জাতীয় রাজনীতিতে অংশ নিতে থাকে। 'অল বেঙ্গল মুসলিম স্টুডেন্টস লীগের' মাধ্যমে মুসলিম লীগের সফলতা দেখে ১৯৩৬ সালে কংগ্রেসপন্থী হিন্দু ছাত্রদের নিয়ে স্টুডেন্ট ফেডারেশন অব ইন্ডিয়া গঠিত হয়।[১০] এভাবেই ১৯৩২ সাল থেকে মুসলিম লীগের হাত ধরে লেজুড়ভিত্তিক ছাত্র রাজনীতির উত্থান হয় উপমহাদেশে।

তথ্যসূত্র :

১. বাংলার মুসলমানদের ইতিহাস / আব্বাস আলী খান / বাংলাদেশ ইসলামিক সেন্টার / পৃষ্ঠা ১৪০-১৪৪

২. শরফুদ্দিন আবু তাওয়ামা / বাংলাপিডিয়া /  মুয়াযযম হুসাইন খান / এশিয়াটিক সোসাইটি

৩. আমাদের জাতিসত্তার বিকাশধারা / মোহাম্মদ আবদুল মান্নান / কামিয়াব প্রকাশন / পৃষ্ঠা ৫৯-৬৩

৪. বাংলার মুসলমানদের ইতিহাস / আব্বাস আলী খান / বাংলাদেশ ইসলামিক সেন্টার / পৃষ্ঠা ১৬০-১৭২

৫. শ্রীরামপুর কলেজ / বাংলাপিডিয়া /  প্রফুল্ল চক্রবর্তী / এশিয়াটিক সোসাইটি

৬. জমিয়তে তালাবায়ে আরাবিয়ার ৯৩ তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী কাল / দৈনিক ইনকিলাব / ২৩ নভেম্বর ২০২১

৭. The Nature and Dynamics of Factional Conflict/ P. N. Rastogi/ Macmillan Company/ p-69

৮. আমাদের জাতিসত্তার বিকাশধারা / মোহাম্মদ আবদুল মান্নান / কামিয়াব প্রকাশন / পৃষ্ঠা ১৪২

৯. বাংলাদেশের ছাত্র আন্দোলনের ইতিহাস( ১৮৩০-১৯৭১)/ ড. মোহাম্মদ হাননান/ আগামী প্রকাশন/ পৃষ্ঠা ৪১

১০. SFI: A Movement of Study, Struggle and Sacrifice For a Scientific, Secular Education/ Vikram Singh

 


২০ সেপ, ২০২৩

খালিস্তান আন্দোলন ও ভারত - কানাডার বিবাদ


শিখ বিচ্ছিন্নতাবাদীরা তাদের মাতৃভূমি 'খালিস্তান' বলে দাবি করেন। যার অর্থ 'বিশুদ্ধ দেশ'। তারা চান, এই রাষ্ট্র পাঞ্জাবে গড়ে তোলা হোক। ১৯৪৭ সাল থেকে তারা পাঞ্জাবে স্বাধীন শিখ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করে যাচ্ছে। সেই সূত্র ধরে ভারতীয় সরকারের সাথে বিচ্ছিন্নতাবাদী শিখদের দ্বন্দ্ব চলে আসছে।

সম্প্রতি খালিস্তানি তৎপরতাকে কেন্দ্র করে ভারত-কানাডা সম্পর্কের মারাত্মক অবনতি হয়েছে। ২০২৩ সালের জুন মাসে শীর্ষ শিখ নেতা ও কানাডীয় নাগরিক হরদীপ সিং নিজ্জর কানাডায় শিখ মন্দিরের সামনে খুন। অজ্ঞাত আততায়ী মাস্ক পরে তাকে গুলি করে হত্যা করে। এই হত্যাকাণ্ড নিয়ে বেশ নড়েচড়ে বসে কানাডা। কানাডায় বহু আগ বহু খালিস্তানি নেতা রাজনৈতিক আশ্রয়ে রয়েছেন ও অনেকেই কানাডার নাগরিক হয়ে গিয়েছেন।

হত্যাকাণ্ডে ভারত জড়িত, এমন অভিযোগ এনে সে দেশের এক কূটনীতিককে কানাডা সোমবার বহিষ্কার করেছে। কানাডার কাছে প্রমাণ রয়েছে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা র'-এর অপারেশনেই শিখ নেতা হরদীপ সিং খুন হয়েছেন। কানাডার পার্লামেন্টে ট্রুডো অভিযোগ করেন, হরদীপ সিংকে খুনের পেছনে ভারতের হাত থাকার নির্দিষ্ট প্রমাণ তার সরকারের কাছে রয়েছে। তাদের কাছে সেই প্রমাণ যথেষ্ট বিশ্বাসযোগ্যও।

ট্রুডো বলেছেন, দেশের অভ্যন্তরে কানাডার মাটিতে এক নাগরিককে এভাবে হত্যা করা, বিদেশিদের এমন প্রত্যক্ষ যোগসাজশ কানাডার সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘন করেছে। ওই অভিযোগের পরই কানাডায় অবস্থানরত এক ভারতীয় কূটনীতিককে বহিষ্কারের কথা জানান দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী মেলানিয়া জোলি। কানাডা ভারতের দিকে ওই গুরুতর অভিযোগ তোলার পর যুক্তরাজ্য আর অস্ট্রেলিয়া জানিয়েছে তারা কানাডার নাগরিকের হত্যা তদন্তের দিকে নজর রাখছে।

হরদীপ সিং হত্যার ঘটনায় ভারত সরকারের জড়িত থাকার গুরুতর এই অভিযোগকে মোদি সরকার 'মনগড়া' এবং 'উদ্দেশ্য প্রণোদিত' বলে নাকচ করে দিয়েছে। ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র অরিন্দম বাগচী টুইট করে লিখেছেন, এই ধরণের ভিত্তিহীন অভিযোগ খালিস্তানি সন্ত্রাসী ও উগ্রপন্থীদের ওপর থেকে দৃষ্টি ঘুরিয়ে দেওয়ার প্রচেষ্টা। যারা ভারতের সার্বভৌমত্ব ও ভৌগোলিক অখণ্ডতার প্রতি একটা হুমকি, তাদের কানাডায় আশ্রয় দেওয়া চলছে।

এর পরে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় দিল্লিতে কানাডার রাষ্ট্রদূত ক্যামেরুন ম্যাকে-কে ডেকে পাঠায়। কানাডার এক সিনিয়র কূটনীতিককে পাঁচ দিনের মধ্যে ভারত ছাড়তে বলা হয়। ভারত ও কানাডার মধ্যে বৈরিতার সম্পর্ক নেই, তবুও দুই দেশের মধ্যে সম্পর্কের এতটাই অবনতি হয়েছে যে একে অপরের একজন করে শীর্ষ কূটনীতিককে বহিষ্কার করেছে। তবে খালিস্তানীদের ইস্যু নিয়ে গত কয়েক বছর ধরেই ভারত আর কানাডার মধ্যে বাক্য বিনিময় হচ্ছিল। ভারত বলে আসছে যে খালিস্তানপন্থীদের কাজকর্ম কানাডার প্রশ্রয়ে যুক্তরাজ্য এবং অস্ট্রেলিয়াতেও ছড়িয়ে গেছে।

খালিস্তান আন্দোলনের পত্তন হয় যেভাবে:
ভারতবর্ষ ভাগের পর শিখদের স্মৃতিবিজড়িত পাঞ্জাব প্রদেশ দুই ভাগ হয়ে যায়। এক অংশ ছিল ভারতে, আরেক অংশ পাকিস্তানে। পাকিস্তানে যে অংশটি ছিল, সেখান থেকে অসংখ্য শিখ ভারতের পাঞ্জাব অংশে চলে আসে, অপরদিকে পাকিস্তানে অবস্থানরত শিখরা সেদেশের পাঞ্জাব প্রদেশে সংখ্যালঘু হয়ে পড়ে। এছাড়াও ঐতিহাসিক পাঞ্জাব রাজ্যের লাহোর ও শিখ ধর্মের প্রতিষ্ঠাতা গুরু নানকের জন্মস্থানও পাকিস্তানের সীমারেখায় রেখে দেয়া হয়।

এই ভাগকে কেন্দ্র করে রক্তক্ষয়ী সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা শুরু হয়েছিল। শিখরা এই ভাগের ফলে নিজেদের প্রতারিত ভাবতে শুরু করে। ভারতের স্বাধীনতা অর্জনের পর পরই শুরু হয় 'পাঞ্জাবি সুবাহ্ আন্দোলন'। এই আন্দোলনের দাবি ছিল পাঞ্জাবি ভাষার উপর ভিত্তি করে একটি আলাদা প্রদেশ তৈরি করতে হবে। প্রথমদিকে এই দাবিকে গুরুত্ব দেয়া না হলেও অব্যাহত প্রতিবাদের পর ১৯৬৬ সালে ভারতের 'স্টেটস রিকগনাইজেশন কমিশন' এই দাবি গ্রহণ করে। তবে এই দাবি বাস্তবায়ন করতে গিয়ে হিমাচল ও হরিয়ানা নামে দুটো হিন্দিভাষী প্রদেশ তৈরি করা হয়েছিল।

'পাঞ্জাবি সুবাহ্ আন্দোলন' সফল হওয়ার পর প্রদেশটির রাজনৈতিক আকালি দলের জনপ্রিয়তা হু হু করে বাড়তে থাকে। এরপর তারা আরও বেশি জনসমর্থন গড়ে তোলার করার জন্য পরিকল্পনা হাতে নেয়। ১৯৭৩ সালে খালসা মতাদর্শের জন্মস্থান আনন্দপুর সাহিবে দলের নেতারা একত্রিত হন এবং 'আনন্দপুর সাহিব প্রস্তাবনা'র ঘোষণা দেন। এই প্রস্তাবে কিছু দিক ছিল খালিস্তান প্রতিষ্ঠার পদক্ষেপ। যেমন- অন্যান্য প্রদেশের বেশ কিছু অংশ নিয়ে গঠিত একটি প্রদেশ গঠন এবং সেই প্রদেশের পূর্ণ স্বায়ত্তশাসনের দাবি তোলে তারা। এছাড়া তারা নতুন প্রদেশের স্বতন্ত্র শাসনব্যবস্থার জন্য একটি সংবিধান প্রণয়নের দাবি জানায় সেই প্রস্তাবে।

এরপরই প্রেক্ষাপটে আবির্ভাব ঘটে জারনেইল সিং ভিন্দ্রানওয়ালে নামের এক ধর্মীয় ব্যক্তিত্বের। তিনি আকালি দলের স্বায়ত্তশাসনের প্রস্তাবে সন্তুষ্ট ছিলেন না। তিনি চেয়েছিলেন শিখদের জন্য স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা হবে । অল্প সময়ের মধ্যেই তার বিশাল সমর্থন গড়ে ওঠে। পাঞ্জাবের মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত শ্রেণীর মাঝে তার বিপুল জনপ্রিয়তা তৈরি হয়।

১৯৮২ সালের গ্রীষ্মে আকালি দলের নেতৃত্বের সমর্থনে জারনেইল সিং ভিন্দ্রানওয়ালে একটি চরমপন্থী আন্দোলন গড়ে তোলেন পাঞ্জাবে। তিনি নিজে অমৃতসরের স্বর্ণমন্দিরে আশ্রয় নেন এবং সেখান থেকেই পুলিশের সাথে তার অনুসারীদের সংঘাত ও দাবি আদায়ের মিছিলের নেতৃত্ব দিতে থাকেন। আনন্দপুর সাহিব প্রস্তাবনায় যেসব প্রস্তাবের উল্লেখ করা হয়েছিল, সেগুলো মেনে নেয়ার দাবি জানানো হয় তার পক্ষ থেকে। সেই সাথে পাঞ্জাবের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম অবনতি ঘটে। তার অনুসারীরা অন্যান্য ধর্মের মানুষের বিরুদ্ধে সহিংসতা চালায়, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিরুদ্ধে অস্ত্র তুলে নেয়। জারনেইল শিং ভিন্দ্রানওয়ালে হিন্দু ধর্মের বিপক্ষে অনেক স্পর্শকাতর মন্তব্য প্রচার করেন। ভারতের তৎকালীন ইন্দিরা গান্ধী সরকার এই আন্দোলনকে 'দেশদ্রোহী' হিসেবে ঘোষণা দেয়।

১৯৮৪ সালে পাঞ্জাবের পরিস্থিতি আরও বাজে দিকে মোড় নেয়। জারনেইল সিং আন্দোলনরত শিখদের অস্ত্র হাতে নেয়ার আহ্বান জানান। হিন্দু ধর্মাবলম্বী এবং সরকারি কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে আক্রমণ তীব্র রূপ ধারণ করে। ভারতীয় তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী সেনাবাহিনীকে শিখ উগ্রপন্থীদের হাত থেকে স্বর্ণমন্দির মুক্ত করা এবং জারনেইল সিংকে গ্রেফতার করার নির্দেশ দেন।

সেনাবাহিনী 'অপারেশন ব্লু স্টার' হাত নেয়। শিখদের প্রতিরোধ এত বেশি ছিল যে, একপর্যায়ে সেনাবাহিনী ট্যাংক ও বিমান থেকে গোলাবর্ষণের সহায়তা নেয়। এই সামরিক অভিযানে ব্যাপক হতাহতের ঘটনা ঘটে। সরকারি হিসেবে বলা হয়েছিল, ৮৩ জন সেনাসদস্য নিহত এবং ২৪৯ জন সেনাসদস্য আহত হয় এই অভিযানে। শিখ উগ্রপন্থী এবং বেসামরিক মানুষের সংখ্যা দেখানো হয় ৪৯৩। কিন্তু বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের হিসেবে দু'পক্ষ মিলিয়ে হতাহতের সংখ্যা তিন হাজারেরও বেশি বলে উল্লেখ করা হয়েছিল।

সেনাবাহিনীর সামরিক অভিযানে শিখদের নেতা জারনেইল সিং ভিন্দ্রানওয়ালে নিহত হন। সে বছরেরই ৩১ অক্টোবরে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী দুজন শিখ দেহরক্ষীর হাতে নিহত হলে শিখদের বিরুদ্ধে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা সংঘটিত হয়, যাতে প্রায় আট হাজার শিখ নিহত হন। এর পরের বছর কানাডাপ্রবাসী শিখরা এয়ার ইন্ডিয়ার একটি বিমানে বোমা বিস্ফোরণ ঘটায়। এই বোমা বিস্ফোরণে বিমানে অবস্থানরত ৩২৯ জনের সবাই মৃত্যুবরণ করে। এই বিস্ফোরণের পেছনে যারা দায়ী ছিল, তারা তাদের নেতা জারনেইল সিং ভিন্দ্রানওয়ালের মৃত্যুর প্রতিশোধ হিসেবে এই বিমান হামলা চালিয়েছে বলে দাবি করে। ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত পাঞ্জাবে খালিস্তান আন্দোলনকেন্দ্রিক সহিংসতা চলমান ছিল।

খালিস্তান আন্দোলন শিখদের আলাদা রাষ্ট্রের দাবি হলেও ক্রমাগত সহিংসতা ও অন্যান্য ধর্মের প্রতি তাদের ঘৃণাসুলভ মনোভাব এই আন্দোলনের বিরুদ্ধে বিশাল জনমত গড়ে তুলতে সমর্থ হয়। খোদ পাঞ্জাবেই এই আন্দোলনের বিরুদ্ধে আলোচনা শুরু হয়েছিল। ১৯৯৫ সালের পর থেকে খালিস্তান আন্দোলনের মূল নেতারা ভারত থেকে পালিয়ে যান। ইউরোপ, কানাডা ও অস্ট্রেলিয়ায় তারা রাজনৈতিক আশ্রয় ও নাগরিকত্ব নিতে থাকেন। বর্তমানে খালিস্তান আন্দোলনের মূল নেতৃত্ব কানাডা থেকেই আন্দোলন পরিচালনা করে যাচ্ছেন।

১৪ সেপ, ২০২৩

আদালত এখন খুনীদের আশ্রয়স্থল


১২ জুন ১৯৯৬ তারিখে ৭ম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এই নির্বাচনের আগে বাংলাদেশের জনপ্রিয় দল বিএনপি অজনপ্রিয় সিদ্ধান্ত নিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিরুদ্ধে অবস্থান করে। পরবর্তীতে জনগণের আন্দোলনের মুখে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি মানতে বাধ্য হয়।

বিএনপির এই দুর্বল সিদ্ধান্তের সুযোগ নিয়ে ইসলাম বিদ্বেষী ও ভারতীয়দের একান্ত অনুগত আওয়ামী লীগ ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় চলে আসে। তখন থেকেই তারা সারাদেশে ইসলামী রাজনীতিকে উৎখাত করার জন্য উঠে পড়ে লাগে। চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডেও এর বিপরীত কিছু ছিল না।

এর ধারাবাহিকতায় ১৯৯৬ সালের ২২ জুলাই সীতাকুণ্ড কলেজের ছাত্রাবাস থেকে ছাত্রলীগ ৪ জন ছাত্রকে জোরপূর্বক বের করে দেয়। বলাবাহুল্য এরা প্রত্যেকেই ছিলেন সীতাকুণ্ড কলেজ ছাত্রাবাসের বৈধ ছাত্র ও ছাত্রশিবিরের কর্মী। ৪ টি সিট দখল করে তারা ছাত্রলীগের কিছু গুন্ডাকে হলে তুলে দেয়। ছাত্রশিবির এই ঘটনার প্রতিবাদ করে। কলেজ কর্তৃপক্ষকে অবহিত করে। কলেজ কর্তৃপক্ষ ও কর্তব্যরত পুলিশ সাহস করেনি সরকারি দলের মাস্তানদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে।

পরবর্তীতে ছাত্রশিবিরের জেলা নেতাদের হস্তক্ষেপে এই ঘটনার মীমাংসা হয় এবং ছাত্রলীগ গুন্ডারা ছাত্রাবাস ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়। ২৪ জুলাই সন্ত্রাসী ছাত্রলীগ মীমাংসিত ঘটনাকে পুনরায় চাঙ্গা করে সীতাকুণ্ড কলেজ ক্যাম্পাসে তাণ্ডব চালায়। এতে আহত হয় ৪ জন শিবিরকর্মী।

২৪ জুলাই ১৯৯৬, সেদিন ছিল ৭ রবিউল আউয়াল। নবী সা.-এর মাস রবিউল আউয়াল মাসকে স্বাগত জানিয়ে র‍্যালি করে ছাত্রশিবির। সেই সমাবেশেও গুলি করে ছাত্রলীগ। বেশ কয়েকজন আহত হয়। কিন্তু রক্তের নেশা মেটে না ছাত্রলীগের। সেদিন বিকেলে আলিয়া মাদরাসায় হামলা চালায় ও গুলি বর্ষণ করে ছাত্রলীগ। এবার আলিয়া মাদরাসা থেকে সাধারণ ছাত্রদের সাথে নিয়ে ছাত্রশিবির বিক্ষোভ মিছিল বের করে। ছাত্রশিবিরের দৃঢ় অবস্থানে সীতাকুণ্ড পৌর এলাকা থেকে ছাত্রলীগ পালিয়ে যায়।

২৫ জুলাই ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা পুলিশের উপস্থিতিতে কলেজ ক্যাম্পাসে হামলা চালিয়ে আহত করে শিবির কর্মী হেলাল উদ্দিনসহ ৩ জনকে। শিবির নেতৃবৃন্দ ঘটনা জানিয়ে পুলিশকে ব্যবস্থা নিতে অনুরোধ করলেও আওয়ামী সরকারের অশুভ ইশারায় পুলিশ উল্টো হানা দেয় সীতাকুণ্ড আলীয়া মাদরাসায়। শিবির কর্মীসহ ১৫ জন সাধারণ ছাত্রকে গ্রেফতার করে পুলিশ ষড়যন্ত্রমূলক অস্ত্র মামলায় জড়িয়ে দেয়। কিন্তু এরপরও বিষাক্ত ছাত্রলীগ সীতাকুণ্ড কলেজ থেকে ছাত্রশিবিরের ছাত্রদের বের করে দেয়ার ষড়যন্ত্র বাস্তবায়ন করতে পারে নি।

২৯ জুলাই ১৯৯৬। সেদিন ছিল ১২ রবিউল আউয়াল। নবী সা.-এর ওফাতের দিন। বিকেল ৪ টায় সীতাকুণ্ড কলেজের ইসলামী আন্দোলনের কর্মী মো. শাহজাহান তাঁর বন্ধু নুর হোসেনসহ কলেজসংলগ্ন রাস্তা দিয়ে রিকশায় চড়ে তাদের বাসায় যাচ্ছিলেন। ছাত্রলীগ সন্ত্রাসীরা তাঁদের দুইজনকে জোরপূর্বক ধরে নিয়ে যায়। সন্ধ্যার পর কলেজ সংলগ্ন মাঠে ইট, রড, লাঠি দিয়ে পিটিয়ে শাহজাহান ও নুর হোসেনের সমস্ত শরীর থেঁতলে দেয়। মারাত্মক আহত শাহজাহান পানি চাইলে খুনি দুলাল চন্দ্র দে তাঁর মুখে প্রস্রাব করে।

উপস্থিত জনগণ পুলিশকে খবর দিলেও পুলিশ আসেনি। খবর পেয়ে ছাত্রশিবিরের কর্মীরা একত্র হয়ে সন্ত্রাসীদের প্রতিরোধ করে। ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা পালিয়ে যায়। শাহজাহান ভাই ও নূর হোসেন ভাইকে উদ্ধার করে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। নূর হোসেন ভাই জীবন ফিরে পেলেও আল্লাহ তায়ালা শাহজাহান ভাইকে কবুল করে নিয়েছিলেন। অমানুষিক নির্যাতন ও অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে শাহদাতবরণ করেন সীতাকুণ্ড কলেজের এইচএসসি পরিক্ষার্থী মুহাম্মদ শাহজাহান ভাই।

৩০ জুলাই চট্টগ্রাম লালদিঘীতে জানাযা ও পরে শহীদের ক্যাম্পাস সীতাকুণ্ড কলেজ মাঠে জানাজা হয়ে শহীদের মীরসরাইয়ে নিজ গ্রামে তাঁকে দাফন করা হয়।

এই ঘটনায় মামলা হয়। মামলার বাদি ছিলেন শাহজাহান ভাইয়ের চাচাতো ভাই রায়হান উদ্দিন। সরাসরি যারা খুনের সাথে জড়িত ছিল তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করে মামলা করা হয়। তারা হলো, নুরুচ্ছাফা, বিজয় চক্রবর্তী, মো. শাহজাহান, রুহুল আমিন, দুলাল চন্দ্র দে, আমিনুল ইসলাম, আনোয়ার হোসেন, পাপন চন্দ্র দে ও আলাউদ্দিন।

তদন্ত শেষে সীতাকুণ্ড থানার তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ইফতেখার হোসেন ১৯৯৮ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেন। আসামীদের অনেকেই গ্রেপ্তার হয়। আদালতের দীর্ঘসূত্রীতার সুবিধা নিয়ে বেশ কয়েকবছর জেলে থেকে উচ্চ আদালত থেকে জামিন নিয়ে বেরিয়ে আসে খুনীরা। বিচার কাজ এগিয়ে যেতে থাকে ধীরে ধীরে।

২০১৩ সালের ৯ সেপ্টেম্বর আওয়ামী সরকার হস্তক্ষেপ্ত করে এই মামলায়। এই মামলায় থাকা ৯ আসামীর মধ্যে ১ম সাত আসামীকে তারা নির্বাহী আদেশে মামলা থেকে অব্যাহতি প্রদান করতে চায়। এই ৭ জন খুনি এখন সীতাকুণ্ড উপজেলার আওয়ামী রাজনীতির সাথে জড়িত। বাকী দুইজন এখন আওয়ামী লীগ করে না বিধায় তাদের ব্যাপারে সরকারের কোনো বক্তব্য নেই।

২০১৩ সাল থেকে এই প্রসেস শুরু হলেও এটি কার্যকর হয় ২০২৩ সালে। ২০২৩ সালের ১৭ জুলাই বিচার বিভাগের ওপর নজিরবিহীন হস্তক্ষেপের মাধ্যমে মামলা থেকে আসামীদের অব্যাহতি দেওয়া হয়। চট্টগ্রাম জেলা ও দায়রা জজ আদালতের সরকারি কৌঁসুলি (পিপি) শেখ ইফতেখার সাইমুল চৌধুরী বলেন, 'মামলাটি আগে চতুর্থ অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ আদালতে বিচারাধীন ছিল। জেলা পিপি হিসেবে আমি আসামির নাম প্রত্যাহারের আবেদন করলে আদালত তা মঞ্জুর করেন।'

এই কেমন বিচারব্যবস্থা! বাদী অভিযোগ করেছে খুনীদের বিরুদ্ধে। অথচ সরকারের ইশারায় আদালত বিচার না করে, বাদীর সাথে আলোচনা না করে, খুনের মামলার মতো স্পর্শকাতর মামলার আসামীদের কোনো প্রকার তদন্ত ছাড়াই মামলা থেকে অব্যাহতি দিয়ে দেয়।

অব্যাহতি পাওয়া এই খুনীরা হলো, চট্টগ্রাম উত্তর জেলা যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক মো. শাহজাহান, সীতাকুণ্ড উপজেলা যুবলীগের সহসম্পাদক নুরুচ্ছাফা, সদস্য বিজয় চক্রবর্তী, সীতাকুণ্ড আওয়ামী লীগের সদস্য রুহুল আমিন, যুবলীগের কর্মী দুলাল চন্দ্র দে, আমিনুল ইসলাম ও আনোয়ার হোসেন।

৩ সেপ, ২০২৩

মীর কাসেম ছিলেন সৎ ব্যবসায়ীর প্রতিচ্ছবি

 

আজ ৩ সেপ্টেম্বর। শহীদ মীর কাসেম আলীর ৭ম শাহদাতবার্ষিকী। জননেতা মীর কাসেম আলী মিন্টু ক্ষণজন্মা একজন প্রতিভাবান উজ্জল নক্ষত্র হিসেবে পরিচিত। যিনি এদেশের ছাত্র জনতার প্রিয় কাফেলা ইসলামী ছাত্রশিবিরের প্রতিষ্ঠাতা কেন্দ্রীয় সভাপতি, প্রখ্যাত রাজনীতিবিদ, সংগঠক, শিল্প উদ্যোক্তা, সাংস্কৃতিক সংগঠন, প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার প্রতিষ্ঠাতা, জনকল্যাণ ও সমাজকল্যাণ মূলক অসংখ্য প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবেই সকলের নিকট পরিচিত ও সমাদৃত।

আমরা হাদিস থেকে জানি ৭ শ্রেণির লোকদেরকে আল্লাহ তায়ালা কিয়ামতের দিন আরশের ছায়াতলে স্থান দেবেন। এরমধ্যে একশ্রেণির লোক হলো সৎ ব্যবসায়ী। আমাদের দেশে বড় ব্যবসায়ী মানেই লুটেরা। এই লুটেরা সাম্রাজ্যের মধ্যেই সৎ ব্যবসায়ীর নজির স্থাপন করেছেন শহীদ মীর কাসেম আলী রহ.। শহীদ মীর কাসেম আলী যেন আরশের ছায়াতলে স্থান পাওয়া ব্যবসায়ীদের প্রতিচ্ছবি।

জনাব মীর কাসেম আলী প্রিয় জন্মভূমি বাংলাদেশকে মেধা, যোগ্যতা দিয়ে সাধ্যমতো সাজানোর কারিগর হিসেবে ও নিরলসভাবে কাজ করে গিয়েছেন। তিনি শুধু একজন রাজনীতিবিদই নন, দেশে-বিদেশে তিনি একজন উদ্যোক্তা, সফল ব্যবসায়ী হিসেবে সুপরিচিত। বিশেষ করে বাংলাদেশের পর্যটন শিল্পে তাঁর ভূমিকা অনস্বীকার্য। তিনি একটি সপ্নের সোনার বাংলাদেশ গড়তে দিন রাত পরিশ্রম করেছিলেন।

জাহেলিয়্যাতের মোকাবিলায় ইসলামের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমানের চেষ্টায় নিজেকে করেছিলেন আত্মনিয়োগ। যেখানেই হাত দিয়েছেন, সোনা ফলেছে। সাহিত্য-সংস্কৃতি, অর্থনীতি, ব্যবসা, পর্যটন শিল্প, আবাসন খাত, কৃষি, মিডিয়া সব ক্ষেত্রেই তিনি ভূমিকা রেখেছেন স্বমহিমায় ও উজ্জ্বলতার সাথে। তিনি দেখিয়েছেন অমানবিক পুঁজিবাদী সমাজের বিপরীতে ইসলামের অপার সৌন্দর্য।

কেউ বক্তব্য দেয়, কেউ থিউরি দেয়, কেউ আবার সেই থিউরি কপচায়, কেউ বলে এই করা দরকার, সেই করা দরকার, কেউ উপদেশ দেয়, কেউ আবার সেই উপদেশের ক্রিটিসিজম করে, কেউ সমালোচনা করে, কেউ সেই সমালোচনার সমালোচনা করে বিতর্কের হাট বসায়। মীর কাসেম আলী এসবের লোক নন। তিনি নীরবে কাজ করে যেতেন। যারা কাজ করেন তাদের উৎসাহ দিতেন। তিনি বলার চাইতে করতেন বেশী। জনশক্তিদের উপদেশ দিয়ে শেখানোর চাইতে কাজ করে উদাহরণ হওয়া ছিল তার পছন্দের।

জন্ম ও শিক্ষা
অসংখ্য গুণের অধিকারী এই ক্ষণজন্মা ব্যক্তি ১৯৫২ সালের ৩১ ডিসেম্বর মানিকগঞ্জ জেলার, হরিরামপুর থানার, সূতালরী গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা মৃত মীর তৈয়ব আলী ও মাতা মৃত রাবেয়া আখতার (ডলি বেগম)। পারিবারিকভাবে আদর করে তাঁকে পেয়ারু নামে ডাকতেন। ৪ ভাই ১ বোন। জনাব মীর কাসেম আলীর বাবা সরকারী চাকুরী করতেন বিধায় বরিশাল সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় দিয়ে প্রাথমিক শিক্ষার হাতে খড়ি তাঁর।

মীর কাশেম আলী প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত বরিশালে অবস্থিত আদর্শ বিদ্যালয়ে ১৯৫৮-১৯৬২ সাল পর্যন্ত অধ্যয়ন করেন। ১৯৬৩-১৯৬৫ সাল পর্যন্ত ফরিদপুর জেলা স্কুলে লেখাপড়া করে ৬ষ্ঠ থেকে ৮ম শ্রেণী পর্যন্ত উত্তীর্ণ হন। পরবর্তীতে চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুলে লেখাপড়া করে ১৯৬৭ সালে এসএসসি পাস করেন। ১৯৬৭-১৯৬৮ শিক্ষাবর্ষে চট্টগ্রাম কলেজ থেকে লেখাপড়া করে ১৯৬৯ সালে এইচএসসি পাস করেন। অতঃপর তিনি চট্টগ্রাম কলেজে ১৯৬৯-১৯৭০ শিক্ষাবর্ষে বিএসসি অনার্স প্রথম বর্ষে পদার্থ বিজ্ঞান বিষয়ে ভর্তি হয়ে অধ্যয়নরত ছিলেন।

১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হলে তিনি চট্টগ্রাম কলেজের পদার্থ বিজ্ঞানে অনার্স প্রথম বর্ষের লেখাপড়া স্থগিত করেন। অতঃপর ১৯৭১-১৯৭২ শিক্ষাবর্ষের বিএ পাস কোর্সে সাবেক আদর্শ কলেজ বর্তমানে আইডিয়াল কলেজ, ৬৫ সেন্ট্রাল রোড ধানমন্ডি, ঢাকা থেকে অধ্যয়ন করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ১৯৭৩ সালের বিএ (পাশ) পরীক্ষা (১৯৭৪ সালে আগস্ট-সেপ্টেম্বরে অনুষ্ঠিত হয়)। উক্ত পরীক্ষায় তৃতীয় বিভাগে উত্তীর্ণ হন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৭৪ সালের এমএ প্রিলিমিনারি পরীক্ষা মে-জুন ১৯৭৬ সালে অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত পরীক্ষায় তৃতীয় বিভাগে এবং ১৯৭৫ সালে এমএ ফাইনাল পরীক্ষা (সেপ্টেম্বর-অক্টোবর/১৯৭৭ সালে অনুষ্ঠিত হয়)। উক্ত পরীক্ষায় অর্থনীতিতে দ্বিতীয় বিভাগে উত্তীর্ণ হন।

সাংগঠনিক জীবন
মানবতার কল্যাণে জীবন ব্যায়িত মীর কাসেম আলী ছাত্রদের অধিকার আদায়ের লড়াইয়ে ছিলেন প্রথম কাতারে। ১৯৬৬ সালে যোগদান করেন মেধাবীদের প্রিয় সংগঠন ইসলামী ছাত্রসংঘে। ১৯৭১ সালের নভেম্বরে প্রাদেশিক জেনারেল সেক্রেটারির দায়িত্ব পালন করে। স্বাধীনতার পর ১৯৭৭ সালে ইসলামী ছাত্রশিবির প্রতিষ্ঠাতাদের তিনি একজন ছিলেন। দায়িত্ব পালন করেন ইসলামী ছাত্রশিবিরের প্রতিষ্ঠাতা কেন্দ্রীয় সভাপতির। ১৯৭৯ সালে জামায়াতে ইসলামীতে যোগদান করেন। এরপর কেন্দ্রীয় মজলিসে শূরা, কর্মপরিষদ ও নির্বাহী পরিষদ সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।

পারিবারিক জীবন
শহীদ মীর কাসেম আলী ১৯৭৯ সালে খন্দকার আয়েশা খাতুনের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। তাদের ২ ছেলে, ৩ মেয়ে। প্রত্যেকেই উচ্চশিক্ষিত।

রাজনৈতিক আন্দোলন
শহীদ মীর কাসেম আলী ১৯৯০ এর স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন, ১৯৯৪ সালের কেয়ারটেকার আন্দোলন, ১৯৯৮ সালের দেশবিরোধী পার্বত্য কালো চুক্তির বিরুদ্ধে আন্দোলনে সোচ্চার ছিলেন।

সামাজিক আন্দোলন ও কর্মজীবন
শিক্ষাজীবন শেষে ও ছাত্রশিবির থেকে বিদায় নিয়ে শহীদ মীর কাসেম আলী দায়িত্ব নিলেন রাবেতা আলম আল ইসলামী (মুসলিম বিশ্বে ভ্রাতৃত্ব) নামক একটি এনজিওতে যার অন্যতম কাজ স্বাস্থ্যসেবা, বিশেষ করে যেখানে মুসলমানরা নির্যাতিত। তখন সাল ছিল ১৯৭৯। বাংলাদেশে আগত বার্মার নির্যাতিত মুসলমান শরণার্থীদের জন্য আশ্রয়, খাদ্য, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা প্রদান। কক্সবাজারের মরিচ্যাপালংএ গড়ে তুললেন রাবেতা হাসপাতাল। তার বড় ভাইসহ একদল সদ্যপাশ করা তরুন ডাক্তার আর নিবেদিত প্রাণ একঝাঁক যুবকদের নিয়ে গড়ে তুলেন এই প্রকল্প। সেই প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা, কয়েকটি চেয়ার টেবিল দিয়ে শুরু। দেখতে দেখতে সেই হাসপাতালের বড় হলো, অনেক বড়। গড়ে উঠলো ডায়াগনস্টিক সেন্টার, অপারেশন থিয়েটার (O.T), ফার্মেসী, ইনডোর- আউটডোর সার্ভিসসহ সার্বক্ষনিক ব্যবস্থাপনায় এক পূর্ণাঙ্গ হাসপাতাল। স্থানীয় বাংলাদেশীদের চিকিৎসাও চললো পাশাপাশি । গড়ে উঠলো নিজস্ব বিল্ডিং, চালু হলো নার্সিং প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, তৈরি হল আবাসিক হোস্টেল।

গ্রাম-বাংলার জনগন এর চাহিদাকে সামনে রেখে প্রবর্তন করা হলো ‘পল্লী চিকিৎসক প্রকল্প’। এখানে প্রশিক্ষণ নিয়ে যুবকরা ছড়িয়ে পড়লো গোটা বাংলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে। এরপর শুরু হলো ইমামদের স্বাস্থ্য প্রশিক্ষণ, যার প্রধান অংশে রয়েছে স্থানীয়ভাবে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের প্রশিক্ষণ। এভাবেই মীর কাসেম আলীর মাধ্যমে সারা বাংলাদেশের প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা। মীর কাসেম এদেশের জনগণের উন্নতির জন্য যে চিন্তাভাবনা করেছেন তার বাস্তবরূপ প্রকাশ পেয়েছে রাঙ্গামাটির পিছিয়ে পড়া পার্বত্য জনগন এর জন্য নির্মিত রাবেতা হাসপাতাল, মাইনিমুখ এর মাধ্যমে। এছাড়াও রয়েছে রাবেতা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স টেকনাফ এর উখিয়া ও হিলি, রংপুর এর মিঠাপুকুর সহ বিভিন্ন ছোটখাট স্বাস্থ্য প্রকল্পের মাধ্যমে। দিন রাত পড়ে থাকতেন আটকে পড়া রোহিঙ্গা, বিহারী, সাঁওতাল, চাকমা, মারমাসহ পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীদের সেবায়।

ঢাকায় আটকে পড়া বিহারীদের জন্য তৈরী করেছেন মুহাম্মদপুরে রাবেতা হাসপাতাল। দেশের অন্যতম প্রতিষ্ঠান ইবনে সিনাকে একটি ছোট্ট স্বাস্থ্য পরীক্ষা কেন্দ্র থেকে বিরাট হাসপাতাল, ডি ল্যাব, ফার্মাসিউটিক্যাল ইন্ডাষ্ট্রি, ইমেজিং সেন্টার এবং ইবনে সিনা মেডিকেল কলেজ স্থাপন পর্যায়ে নিয়ে আসেন। এছাড়া ইসলামী ব্যাংক ফাউন্ডেশনে থাকাকালীন তিনি প্রতিষ্ঠিত করেন ইসলামী ব্যাংক হাসপাতাল কাকরাইল, শাহজাহানপুর, বরিশাল, খুলনা, রংপুর এবং কমিউনিটি হাসপাতাল নামে মানিকগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় গড়ে তুলেন হাসপাতাল। রাজশাহীতে ইসলামী ব্যাংক মেডিকেল কলেজ, নার্সিং ও মেডিকেল টেকনিক্যাল ইন্সটিটিউট মীর কাসেম আলীর একনিষ্ঠ শ্রমের ফসল। আর ফুয়াদ আল খাতিব হাসপাতাল ঢাকা ও কক্সবাজারে এক অতিপরিচিত নাম।

পেশাগত জীবন
শহীদ মীর কাসেম আলী বিভিন্ন ব্যবসার সাথে যুক্ত ছিলেন। উল্লেখযোগ্য হলো, মীর কাসেম আলী ইসলামী ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা ভাইস চেয়ারম্যান ও পরিচালক ছিলেন। তিনি দিগন্ত মিডিয়া গ্রুপেরও চেয়ারম্যান ছিলেন যেটি দৈনিক নয়া দিগন্ত এবং দিগন্ত টেলিভিশন পরিচালনা করে। এছাড়াও তিনি ইবনে সিনা ট্রাস্ট এর প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন। তিনি সৌদি আরবে প্রতিষ্ঠিত মুসলিম বিশ্বের একটি বুদ্ধিবৃত্তিক ও দাতব্য সংগঠন ‘রাবেতা আল-আলম আল ইসলামী’ এর এদেশীয় পরিচালক ছিলেন। এসবের বাইরে তিনি ইন্ড্রাস্টিয়ালিস্ট অ্যান্ড বিজনেসম্যান ওয়েলফেয়ার ফাউন্ডেশন, কেয়ারি লিমিটেড, ফুয়াদ আল খতিব, আল্লামা ইকবাল সংসদ, আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় চট্টগ্রাম, দারুল ইহসান ইউনিভার্সিটি, সেন্টার ফর স্ট্রেটেজি ও পিস স্টাডিস সহ দেশে-বিদেশে মোট ৪০টি প্রতিষ্ঠানের সাথে যুক্ত ছিলেন।

শাহদাত
২০১২ সালের ১৭ জুন তাঁকে কথিত মানবতা বিরোধী মামলায় এরেস্ট করা হয়। এরপর সাজানো ও হাস্যকার বিচার প্রক্রিয়ার মাধ্যমে তাঁকে ২০১৬ সালের ৩ সেপ্টেম্বর তাঁকে মৃত্যুদণ্ডের মাধ্যমে খুন করা হন। তাঁর শাহদাতের কয়েক সপ্তাহ আগে ৯ আগস্ট তাঁর আইনজীবী ও ছেলে ব্যারিস্টার আরমানকে হাসিনা সরকার তুলে নিয়ে যায়। আইনী প্রক্রিয়ায় পরাজিত হাসিনা সরকার বিচারকদের চাপ দিয়ে জোর করে ফাঁসীর করে ব্যবস্থা করে। মীর কাসেম আলীর ছেলে ব্যরিস্টার আরমানকে আজ পর্যন্ত গুম করে রেখেছে আওয়ামী ফ্যাসিবাদী সরকার।

২০১৬ সালের ৪ সেপ্টেম্বর শহীদের জানাজায় যাওয়ার সময় ব্যাপক হয়রানি করে মীর কাসেম আলীর পরিবারকে। মানিকগঞ্জের নিজ গ্রামে শহীদ মীর কাসেম আলী শায়িত আছে। মহান রাব্বুল আলামীর তাঁকে দুনিয়া ও আখিরাতে সম্মানিত করুন।

১৭ জুল, ২০২৩

যেভাবে বাংলাদেশে কেয়ারটেকার সরকার এলো! (পর্ব - ০৩)

১৯৯৪ সালে জামায়াত পড়েছে মহাবিপদে। একদিকে বিএনপির স্বৈরাচারী আচরণ। অন্যদিকে আওয়ামী লীগের কেয়ারটেকার আন্দোলন। কেয়ারটেকার সরকারের আন্দোলন যতটা না আওয়ামী লীগের তার চাইতে বেশি জামায়াতের।

প্রধান বিরোধী দল হিসেবে স্বাভাবিকভাবেই এ বিষয়ে আন্দোলনের নেতৃত্ব শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগের হাতে থেকেছে। জামায়াতের সংকট হলো, কেয়ারটেকার সরকারপদ্ধতির উদ্ভাবক হলেও আন্দোলনে আওয়ামী লীগের পেছনেই পড়ে থাকতে বাধ্য হবে। রাজনৈতিক ও আদর্শিক দিক থেকে জামায়াতের জন্য এ অবস্থান মোটেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। আন্দোলনে জামায়াত যত বলিষ্ঠ ভূমিকাই পালন করুক, জনগণ জামায়াতকে আওয়ামী লীগের লেজুড় বলেই ধারণা করবে।

এই বিষয়ে অধ্যাপক গোলাম আযম বলেন, //ভারতবিরোধী হিসেবে জামায়াতে ইসলামীর যে ইমেজ রয়েছে তা দারুণভাবে ক্ষুণ্ণ হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। জামায়াতের মতো একটি ইসলামী দলকে আওয়ামী লীগের মতো ইসলামবিরোধী দলের নেতৃত্বে আন্দোলন করতে দেখলে কিছু লোক এ ভুল ধারণাও করতে পারে যে, বর্তমান আওয়ামী লীগ হয়ত ১৯৭৫-পূর্ব আওয়ামী লীগের মতো ইসলামের দুশমন নয়।//

১৯৯০ সালে বিএনপি, আওয়ামী লীগ ও জামায়াতে ইসলামী যুগপৎভাবে কেয়ারটেকার সরকারব্যবস্থা কায়েমের দাবিতে আন্দোলন করলেও সে আন্দোলন আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে পরিচালিত ছিল না। বিএনপি ইসলামী দল না হলেও জনগণের নিকট ইসলামবিরোধী হিসেবে গণ্য নয়। তাই বিএনপি সরকারের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে কোনো আন্দোলনে জামায়াতের শরিক হওয়া অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ।

শহীদ অধ্যাপক গোলাম আযম বলেন, //ঐ সময় মানসিক দিক দিয়ে আমি এত বেশি পেরেশান ছিলাম, সে কথা মনে হলে এখনও বেদনাবোধ করি। রাজনৈতিক আন্দোলনে কোনো সময় আমি এমন কঠিন বিব্রতকর পরিস্থিতির সম্মুখীন হইনি। যেহেতু কেয়ারটেকার সরকার ইস্যু জামায়াতের সৃষ্টি, সেহেতু আওয়ামী লীগ এ দাবিতে আন্দোলন শুরু করলে জামায়াতের পক্ষে নিশ্চুপ থাকা কিছুতেই সম্ভব নয়। আর জামায়াত আন্দোলনে শরিক না হলে রাজনৈতিক ময়দান থেকে চিরবিদায় নিতে বাধ্য হবে।//

এ মহাসংকট থেকে উত্তরণের উদ্দেশ্যে জামায়াতের তৎকালীন সেক্রেটারি জেনারেল ও সংসদে জামায়াতের পার্লামেন্টারি পার্টির লিডার শহীদ মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার সাথে আলাদাভাবে বৈঠকের সিদ্ধান্ত নেয় জামায়াত। তাঁকে সংগঠনের পক্ষ থেকে দায়িত্ব দেওয়া হয়, তিনি যেন কেয়ারটেকার সরকারপদ্ধতি সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করার ব্যাপারে খালেদা জিয়াকে বুঝিয়ে বলেন।

শহীদ মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী জামায়াতের সংসদীয় দলের নেতা হিসেবে জাতীয় সংসদনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার সাথে তাঁর দফতরে একান্তে সাক্ষাৎ করে দীর্ঘ বক্তব্য রেখেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, //১৯৯০ সালে এরশাদের আমলে কেয়ারটেকার সরকারের পরিচালনায় সংসদ নির্বাচনের দাবিতে আপনার সাথে মিলে যুগপৎ আন্দোলন করেছি। আন্দোলন সফল হয়েছিল বলেই কেয়ারটেকার সরকার কায়েম হয়েছে এবং সংসদ নির্বাচন আমাদের দাবি অনুযায়ীই অনুষ্ঠিত হয়েছে।

নির্বাচনে আপনি সর্বোচ্চসংখ্যক আসনে বিজয়ী হয়েছেন। কেয়ারটেকার সরকারের পরিচালনায় নির্বাচন না হলে আপনি কিছুতেই এত আসনে বিজয়ী হতে সক্ষম হতেন না। কেয়ারটেকার সরকারপদ্ধতির বদৌলতেই আপনার উত্থান। আমরা আশা করেছিলাম, নিরপেক্ষ নির্বাচনের নিশ্চয়তা বিধানের উদ্দেশ্যে আপনি নিজেই উদ্যোগী হয়ে সংসদে বিল উত্থাপন করে এ চমৎকার পদ্ধতিটি সংবিধানে সংযোজনের ব্যবস্থা করবেন। আমরা '৯১ সালেই বিল জমা দিয়েছি। অন্যান্য বিরোধী দলও এ উদ্দেশ্যে বিল জমা দিয়েছে।

কিন্তু সংসদে এ বিষয়টি আলোচনার কোনো ব্যবস্থা এ পর্যন্ত হলো না। বাধ্য হয়ে সংসদের বাইরে সকল বিরোধী দল এর পক্ষে দাবি জানিয়ে আসছে। জনগণ এ বিষয়ে অবহিত যে, বিরোধী দল কেয়ারটেকার সরকারব্যবস্থা দাবি করছে আর সরকারি দল এ দাবিকে অযৌক্তিক ও অপ্রয়োজনীয় বলে ঘোষণা করে চলেছে।

মাগুরা জেলার মুহাম্মদপুর আসনের উপনির্বাচনে আওয়ামী লীগ পরাজিত হওয়ার প্রতিক্রিয়ায় তারা ঘোষণা করেছে যে, এ সরকারের পরিচালনায় আর কোনো নির্বাচনে তারা অংশগ্রহণ করবেন না। তারা এখন কেয়ারটেকার সরকার সংবিধানে সংযোজনের দাবিতে আন্দোলন চালিয়ে যাবেন, এমনকি সংসদ বয়কট করারও সিদ্ধান্ত নিতে পারেন।//

নিজামী সাহেব বলেন, //কেয়ারটেকার সরকার ইস্যু ছাড়া আওয়ামী লীগের নিকট অন্য কোনো রাজনৈতিক ইস্যু নেই। জনগণকে আকৃষ্ট করার মতো কোনো কর্মসূচিও তাদের হাতে আছে বলে মনে হয় না। কেয়ারটেকার সরকার কায়েমের দাবি মেনে নিয়ে এরশাদ পদত্যাগ করতে বাধ্য হওয়ায়, বিএনপিসহ সকল রাজনৈতিক দল এ দাবিতে একমত হওয়ায় এবং এর ভিত্তিতে নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ায় এ দাবি বিশাল জনপ্রিয়তা পেয়েছে। এ দাবিতে আবার আন্দোলন হলে জনগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে বিপুলসংখ্যায় সাড়া দেবে বলে ধারণা করা যায়।

আমরা নিশ্চিত যে, কেয়ারটেকার সরকারের পরিচালনায় নির্বাচন হলে আগামী নির্বাচনে আপনি আরো বেশি আসনে বিজয়ী হবেন। নিরপেক্ষ নির্বাচন হলে আওয়ামী লীগ কিছুতেই অধিকাংশ আসন পাবে না। তাই আপনি এ জনপ্রিয় ইস্যু আওয়ামী লীগের হাতে তুলে দেবেন না। আপনি স্বয়ং উদ্যোগ নিয়ে এটাকে সংবিধানে সংযোজনের ব্যবস্থা করুন। এত বড় একটা হাতিয়ার হাতছাড়া করবেন না।

আপনি জানেন, এ ইস্যুটি জামায়াতে ইসলামীর সৃষ্টি। এ ইস্যুতে আওয়ামী লীগ আন্দোলন শুরু করলে জামায়াত তাতে শরিক হতে বাধ্য হবে। জামায়াত কিছুতেই আপনার বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের সাথে আন্দোলনে যেতে চায় না। আপনি আমাদেরকে আওয়ামী লীগের দিকে ঠেলে দেবেন না। আমাদেরকে আপনার রাজনৈতিক দুশমনে পরিণত করবেন না।

আওয়ামী লীগ সংসদ বয়কটের ঘোষণা দেবে বলে মনে হচ্ছে। এর আগেই যদি কেয়ারটেকার সরকার ইস্যু নিয়ে সংসদে আলোচনা হবে বলে আপনি ঘোষণা দেন, তাহলে সংসদের আগামী অধিবেশনে আমরা যোগদান করব। তখন আওয়ামী লীগও সংসদে যেতে বাধ্য হবে। আপনি এ সিদ্ধান্ত নিলে আওয়ামী লীগ আপনার সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনের আর কোনো জনপ্রিয় ইস্যুই পাবে না। আমি বড় আশা নিয়ে আপনার নিকট হাজির হয়েছি।//

নিজামী সাহেবের দীর্ঘ যুক্তিপূর্ণ বক্তব্য মনোযোগ দিয়ে শুনলেও প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া তাঁর পূর্বসিদ্ধান্তে অটল থেকেছিলেন। তিনি বেশি কিছু বলেননি। নিজামী সাহেবের কোনো যুক্তি খণ্ডনের চেষ্টাও করেননি। অত্যন্ত দাম্ভিকতার সুরে আঙুল উচিয়ে নিজ মুখের দিকে ইশারা করে উচ্চারণ করেছিলেন, “এ মুখ দিয়ে ‘কেয়ারটেকার সরকার' উচ্চারণ হবে না।”

শহীদ অধ্যাপক গোলাম আযম বলেন, //হতাশা ও দুঃখভারাক্রান্ত মন নিয়ে নিজামী সাহেব আমাকে যখন রিপোর্ট দিয়েছিলেন তখন আমার পেরেশানি আরো বেড়ে গিয়েছিল। আমি অত্যন্ত বিস্মিত হয়ে ভেবেছিলাম, বেগম জিয়া এত বড় ভুল সিদ্ধান্ত কেমন করে নিলেন? কার কুপরামর্শে তিনি কেয়ারটেকার সরকার ফর্মুলাকে শিশুসুলভ বলে ধারণায় পৌঁছালেন? এমন আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত তিনি নিলেন কীভাবে?//

১৯৯৪-এর জুনের প্রথম সপ্তাহে সংসদের বাজেট অধিবেশন শুরু হয়েছিল। অধিবেশন শুরুর আগের দিন বেগম জিয়া এক সমাবেশে ভাষণ দিতে গিয়ে বিরোধী দলসমূহকে সম্বোধন করে বলেছিলেন, 'জনগণ আপনাদেরকে ভোট দিয়ে সংসদে পাঠিয়েছে আপনারা রাজপথে কেন আন্দোলন করবেন? যা বলার সংসদেই বলুন, তবে কেয়ারটেকার সরকার সম্পর্কে সংসদে কোনো আলোচনা হবে না।'

খালেদা জিয়ার এই কথা বিরোধী দলকে রাজপথে আন্দোলন করতে বাধ্য করেছিলো। সকল বিরোধী দলও সংসদ বয়কট করার সিদ্ধান্ত নিয়ে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়লো। ১৯৯১ সালের নির্বাচনের পর সংসদীয় গণতন্ত্র যেভাবে এগিয়ে যাচ্ছিল তাতে আশা করা হয়েছিল যে, স্বাভাবিক নিয়মেই বিএনপি সরকার পাঁচ বছরের মেয়াদ পূর্ণ করবে এবং বিরোধী দল সংসদে স্বাভাবিকভাবেই দায়িত্ব পালন করবে।

সরকার যদি নিজেই কেয়ারটেকার সরকারপদ্ধতিকে সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করার উদ্যোগ নিত, তাহলে গণতন্ত্র স্বাভাবিক গতিতেই অগ্রসর হতো। সরকারের অপ্রত্যাশিত ও স্বৈরাচারী ভূমিকার ফলে বিএনপির বিরুদ্ধে চরম রাজনৈতিক বৈরীভাব সৃষ্টি হলো। যে কেয়ারটেকার সরকারপদ্ধতি কায়েমের দাবি বিএনপিসহ সকল দল মেনে নিয়েছিল, সে দাবিতে আবার আন্দোলন করতে সরকার বাধ্য করলো।

এতে জামায়াতে ইসলামী সবচেয়ে বেশি বিব্রতকর অবস্থার সম্মুখীন হয়েছিল। জামায়াতে ইসলামী সরকার গঠনে আওয়ামী লীগকে সমর্থন করতে অস্বীকার করে বিএনপিকে সমর্থন করলো, অথচ বিএনপিই আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে বিএনপির বিরুদ্ধে জামায়াতকে আন্দোলনে নামতে বাধ্য করলো। এ আন্দোলন না হলে বিএনপি সরকারের মেয়াদ পূর্ণ হওয়ার আগেই সরকারের পদত্যাগ করার দাবি উঠত না।

এ দাবির কারণে গণতন্ত্র বিপন্ন হয়ে গেল। নির্বাচিত সরকারকে মেয়াদ পূর্ণ করার সুযোগ দান করাই গণতন্ত্রের দাবি। ১৯৮৮ সালে উল্লেখযোগ্য সকল রাজনৈতিক দল নির্বাচন বয়কট করা সত্ত্বেও স্বৈরশাসক এরশাদ নির্বাচন করেছে। আর নির্বাচিত হওয়া সত্ত্বেও বিএনপি সরকার ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি বিরোধী দল বিহীন ষষ্ঠ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠান করে গণতান্ত্রিক পরিবেশকে কলুষিত করেছে।

এ অস্বাভাবিক নির্বাচনের পর বিএনপি সরকার গঠন করার দুসপ্তাহের মধ্যেই সংবিধানে কেয়ারটেকার সরকারপদ্ধতি সংযোজন করে পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছে। ১৯৯৬ সালের মার্চ মাসে ৬ষ্ঠ জাতীয় সংসদে গৃহীত সংবিধানের ১৩ নং সংশোধনীর মাধ্যমে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পরিচালনায় জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের আইন প্রণীত হয়। এ আইন অনুযায়ীই যথাক্রমে ১৯৯৬ সালের ১৫ই জুন এবং ২০০১ সালের ১লা অক্টোবর ৭ম ও ৮ম জাতীয় সংসদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।

দ্বিতীয় কেয়ারটেকার সরকারের পরিচালনায় অনুষ্ঠিত সপ্তম সংসদ নির্বাচনে অনেক কারণেই আওয়ামী লীগ সংসদে বেশি আসন পেয়েছে এবং এরশাদের জাতীয় পার্টির সমর্থনে ক্ষমতাসীন হয়েছে। ১৯৯১ সালে কেয়ারটেকার সরকার ছিল রাজনৈতিক দলগুলোর ঐক্যমতের ভিত্তিতে গঠিত।

১৯৯৬ সালের কেয়ারটেকার সরকার ছিল সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত সাংবিধানিক কেয়ারটেকার সরকার। আন্দোলনের মুখে বিএনপি সরকার পদত্যাগ করতে বাধ্য হওয়ায় ১৯৯৬ সালের জুন মাসে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে বিএনপি ব্যাকফুটে চলে যায়। নির্বাচনী পরিবেশ আওয়ামী লীগের অনুকূলে চলে গেছে। বিএনপির জনপ্রিয়তা মারাত্মকভাবে ক্ষুণ্ণ হওয়ার পরও ১১৬ আসনে বিজয়ী হয়েছে।

শেখ হাসিনা নির্বাচনের পূর্বে ওমরাহ করে হিজাব অবস্থায় তাসবীহ হাতে নিয়ে দেশে ফিরে এসে গোটা নির্বাচনী অভিযানে দুই হাত জোড় করে জনগণের নিকট দলের অতীত সকল ভুলের জন্য ও ইসলাম বিরোধী ভূমিকার জন্য ক্ষমা চেয়েছে। জনগণ তাদেরকে সুযোগ দিয়েছে। ১৪৬ টি আসনে আওয়ামী লীগ বিজয়ী হয়। এরশাদের সমর্থনে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে।

এভাবে কেয়ারটেকার বাংলাদেশের জন্য প্রাসঙ্গিক হয়, জনপ্রিয়তা পায় ও প্রতিষ্ঠা লাভ করে। সবশেষ সংবিধানে অন্তুর্ভুক্ত হয়।


১৫ জুল, ২০২৩

যেভাবে বাংলাদেশে কেয়ারটেকার সরকার এলো! (পর্ব - ০২)

 

১৯৮৪ সালে এরশাদের সাথে সংলাপ ব্যর্থ হয়ে গেলে বিনা বাধায় '৮৪ সালের মে মাসে উপজিলা চেয়ারম্যান নির্বাচন করা সরকারের পক্ষে সহজ হয়ে গেল। এ সাফল্যের ভিত্তিতেই '৮৫ সালের ২১শে মার্চ স্বৈরশাসকদের ঐতিহ্য মোতাবেক তথাকথিত গণ-ভোটের মাধ্যমে প্রধান সামরিক শাসনকর্তা ‘নির্বাচিত' প্রেসিডেন্ট হয়ে গদীতে মজবুত হয়ে বসলেন।

'৮৫ সালের শেষ দিকে যুগপৎ আন্দোলনের আবার সূচনা হলো। আন্দোলন দানা বাঁধার মুখে '৮৬ সালের সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ নিয়ে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি'র মধ্যে চরম মতবিরোধ হয়। যুগপৎ আন্দোলন আবার থেমে যায়।

রাজনৈতিক ঐ পরিস্থিতিতে জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদের তিন দিনব্যাপী এক বৈঠক হয়। ব্যাপক আলোচনার পর জামায়াত সিদ্ধান্ত নেয় যে, যুগপৎ আন্দোলনের কোনো সুনির্দিষ্ট রাজনৈতিক লক্ষ্য না থাকায় স্বৈরশাসককে অপসারণের কোনো সম্ভাবনাই নেই, তাই জনগণকে নির্বাচনমুখী করা ছাড়া অন্য কোনো কর্মসূচির প্রতি তেমন সাড়া পাওয়া সম্ভব নয়। দুই জোটকেও নির্বাচনমুখী করার চেষ্টা করতে হবে। নির্বাচনে যাতে এরশাদের দল কিছুতেই সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে বিজয়ী হতে না পারে, সে প্রচেষ্টা চালাতে হবে। অন্য কোনো বিকল্প কর্মসূচির সম্ভাবনা নেই।

বিশেষ করে জামায়াতের জন্য জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ সবচেয়ে জরুরি। কারণ, নতুন দেশ বাংলাদেশে জামায়াতের নামে তখন পর্যন্ত নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা সম্ভব হয়নি। যেকোনো গণতান্ত্রিক দেশে আইনগতভাবে রাজনৈতিক দল হিসেবে স্বীকৃতি পেতে হলে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা অত্যাবশ্যক। কোনো দল পার্লামেন্ট নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করলে এবং নির্বাচন কমিশন সে দলের জন্য প্রতীক বরাদ্দ করলে দলটি আইনগতভাবে রাজনৈতিক স্বীকৃতি পেয়ে গেল। 

যদি নির্বাচনে অন্তত ১০টি আসনে জয়ী হয় তবে পার্লামেন্টারি পার্টির মর্যাদা পেয়ে যায়। নির্বাচনে কোনো আসন না পেলেও আইনগত সার্টিফিকেট পেয়ে গেল। এ মর্যাদা পেলে রাজনৈতিক ময়দানে সে দলটিকে স্বীকৃতি দিতে সবাই বাধ্য। শেষ পর্যন্ত কর্মপরিষদের সকল সদস্য একমত হলেন যে, জামায়াতের অস্তিত্বের স্বার্থেই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা প্রয়োজন।

এত বড় ইস্যুতে কর্মপরিষদের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণের গঠনতান্ত্রিক ইখতিয়ার না থাকায় জামায়াতের মজলিসে শূরা আহ্বান করা হলো। মজলিসে শূরা সদস্যগণ বিষয়টির গভীর তাৎপর্য ও গুরুত্ব উপলব্ধি করে প্রাণ খুলে আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন। মজলিসে শূরায় দুই দিন বিস্তারিত আলোচনার পর নির্বাচনে অংশগ্রহণের পক্ষে সর্বসম্মতভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয় ।

রাজনৈতিক জোটভুক্ত দলসমূহ ভেতরে ভেতরে নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছিল, অপরদিকে প্রকাশ্যে নির্বাচনবিরোধী বক্তব্যও দিয়ে যাচ্ছিল। বড় দুই জোটের মধ্যে রাজনৈতিক প্রতিযোগিতা থাকাই স্বাভাবিক। কোনো দলই নির্বাচনে অংশগ্রহণের কথা না বলায় পারস্পরিক সন্দেহ বিরাজ করছিল। এ পরিবেশে শেখ হাসিনা চট্টগ্রাম লালদিঘি ময়দানে দলীয় জনসভায় বলেন, এরশাদ সরকারের পরিচালনায় নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা অর্থহীন। যারা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে এরশাদের গদি মযবুত করবে তারা 'জাতীয় বেঈমান' হিসেবে গণ্য হবে।

অথচ ১৫ দলীয় জোটের শরীক দলগুলো নির্বাচনে আসন দাবি করে লীগের সাথে রীতিমতো দর কষাকষি চালাচ্ছে। তখন জামায়াত ও বিএনপির মধ্যে নির্বাচনী সমঝোতার আলোচনা চলছে। বেগম জিয়ার পক্ষ থেকে কর্নেল মুস্তাফিজ ও জামায়াতের লিয়াজোঁ কমিটির মধ্যে আনুষ্ঠানিক বৈঠকাদি চলল। প্রথমে বিএনপির পক্ষ থেকে জামায়াতকে মাত্র ২০টি আসন ছেড়ে দেওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হয়। কয়েক দিনের দর কষাকষির পর কর্নেল মুস্তাফিজ ৫০টি আসন জামায়াতকে ছেড়ে দিতে সম্মত হলে শেষ পর্যন্ত জামায়াত তা মেনে নেয়।

জামায়াতকে এত বেশি আসন ছেড়ে দিতে সম্মত হওয়ায় নিজ দলীয় বৈঠকে কর্নেল মুস্তাফিজ রীতিমতো নাজেহাল হন। ফলে বিএনপির সাথে নির্বাচনী সমঝোতার প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়ে যায়।

নির্বাচনে অংশগ্রহণের ব্যাপারে রাজনৈতিক জোট ও দলসমূহের কোনো সুস্পষ্ট সিদ্ধান্ত ঘোষণা না হওয়ায় জেনারেল এরশাদ ধমকের সুরে ঘোষণা করলেন, ১৯ মার্চ পর্যন্ত রাজনৈতিক দলগুলোকে সিদ্ধান্তে পৌঁছতে হবে। ২০ মার্চ তিনি জাতির উদ্দেশে নির্বাচন সম্পর্কে ভাষণ দেবেন। যারা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে না তাদেরকে নির্বাচন বিরোধী কোনো তৎপরতা চালাতে দেওয়া হবে না। রাজনৈতিক দলগুলোর অভ্যন্তরীণ দুর্বলতার খবর তিনি হয়তো জানতেন। তাই এই টাইপের হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করতে পেরেছেন। 

আওয়ামী লীগ ও বিএনপি ১৯ মার্চ এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য নিজ নিজ দলীয় কার্যালয়ে মিটিং ডাকলো। জামায়াতও ঐ একই তারিখে বৈঠকে বসার সিদ্ধান্ত নিল।

জামায়াত আগে থেকেই সিদ্ধান্ত নিয়ে রেখেছে দুই জোটের এক জোটও যদি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে তাহলে জামায়াত অবশ্যই নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবে। জামায়াত অল্প সময়ের মধ্যেই ঘোষণাপত্র প্রস্তুত করে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় রইলো। জামায়াতের লিয়াজোঁ কমিটির আহ্বায়ক শহীদ আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ বিএনপি ও আওয়ামী লীগের সাথে ফোনে যোগাযোগ রাখছিলেন।

রাত ১১টা পর্যন্ত তাদের সিদ্ধান্ত জানা গেল না। দৈনিক সংগ্রামের সাংবাদিক ৩২ নং ধানমন্ডির বাড়িতে আওয়ামী লীগের সংবাদ সংগ্রহের জন্য অপেক্ষায় ছিলেন। বিএনপির খবর মুজাহিদ সাহেব ফোনে নিচ্ছিলেন। রাত ২টার সময় দৈনিক সংগ্রামের সাংবাদিক মোটর সাইকেলে খবর নিয়ে এলেন। খবর এল যে, আওয়ামী লীগ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে। কিন্তু বিএনপি তখন পর্যন্ত কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছেনি। 

বিএনপির তদানীন্তন মহাসচিব ওবায়দুর রহমানের সাথে মুজাহিদ সাহেব অব্যাহতভাবে ফোনে যোগাযোগ রাখছিলেন। রাত তিনটায় ওবায়েদ সাহেব শহীদ মুজাহিদ সাহেবকে জানালেন, //একটা টেকনিক্যাল কারণে আমরা এখনো সিদ্ধান্ত নিতে পারলাম না। আগামীকাল সিদ্ধান্ত নেব। আপনাদের সিদ্ধান্ত পত্রিকায় দিয়ে দিন।//

সকল পত্রিকা অফিস তখন পর্যন্ত খবরের প্রতীক্ষা করছিল। ২০ মার্চ (১৯৮৬) বড় বড় হেডিং-এ পত্রিকায় খবর বের হলো, আওয়ামী লীগ ও জামায়াত নির্বাচনে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে এবং বিএনপি এখনো সিদ্ধান্ত নেয়নি। 

বিএনপির টেকনিক্যাল কারণটি কী?
শহীদ মুজাহিদ ঘনিষ্ঠভাবে যোগাযোগ করে ঐ কারণটি জেনে নিলেন। বিএনপির প্রথম সারির নয়-দশজন নেতা প্রেসিডেন্ট আবদুস সাত্তারের মন্ত্রী ছিলেন। জেনারেল এরশাদ সামরিক শাসন কায়েম করার পর তাদের বেশ কয়েকজনকে কারারুদ্ধ করেন এবং তাদেরকে পরবর্তী নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার অযোগ্য বলে অন্যায়ভাবে অর্ডিন্যান্স জারি করেন। তাদের মধ্যে ওবায়দুর রহমানও ছিলেন একজন।

বিএনপিকে নির্বাচনমুখী করার উদ্দেশ্যে ঐ অর্ডিন্যান্স বাতিল করে তাদের নির্বাচনে অংশগ্রহণের সুযোগ দেওয়ার ওয়াদাও নাকি এরশাদ বিএনপি-কে দিয়েছিলেন। ১৯ মার্চ সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় পর্যন্ত ঐ ওয়াদা পূরণ না করায় বিএনপি সমস্যায় পড়ে গেল। পরের দিন ওয়াদা পূরণের অপেক্ষায় থাকার পর বিএনপি বুঝতে পারল, স্বৈরাচার এরশাদ তাদের ধোঁকা দিয়েছেন। 

তখন বিএনপি নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দিল এবং নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার কারণে হাসিনার দেওয়া 'জাতীয় বেঈমান' উপাধিটি আওয়ামী লীগের প্রতি সার্থকভাবে প্রয়োগ করল। আসল যে কারণে বিএনপি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করলো না, তা তো জনগণের নিকট প্রকাশ করা যায় না।

উভয় জোট এতদিন পর্যন্ত এরশাদ সরকারের পরিচালনায় নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্ভব নয় বলে প্রচার করেছে। এখন বিএনপি অত্যন্ত যোগ্যতার সাথে নির্বাচন বর্জনকে গৌরবের সাথে প্রচার করতে থাকল। স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে আপসহীন দল হিসেবে আবির্ভূত হলো। ‘জাতীয় বেঈমান' গালি খেয়ে আওয়ামী লীগ দাবি করলো, বিএনপি তাদের সাথে প্রতারণা করেছে। তারা আরো দাবি করলো, বিএনপির সাথে তাদের নির্বাচনী প্রার্থীদের তালিকার বিনিময়ও হয়েছে। 

জামায়াত বিএনপি'র সাথে পরামর্শ করেই নির্বাচনে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আর জামায়াত আওয়ামীলীগের মতো নির্বাচনে না যাওয়ার ঘোষণাও দেয়নি। এই প্রসঙ্গে শহীদ অধ্যাপক গোলাম আযম বলেন, //জামায়াত বিএনপির সাথে এবং তাদের মহাসচিবের সম্মতি নিয়ে নির্বাচনে অংশগ্রহণের খবর পত্রিকায় পরিবেশন করেছে। তাই জামায়াতের নির্বাচনে অংশগ্রহণের বিরুদ্ধে বিএনপি কোনো বিরূপ মন্তব্য করেনি। জামায়াত তো নিশ্চিতই ছিল যে, বিএনপিও নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে।//

১৯৮৬ সালের ৭ মে তৃতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ও জামায়াতে ইসলামী ছাড়াও অনেক দল অংশগ্রহণ করে। নির্বাচনে আসন বণ্টন নিয়ে ১৫ দল থেকে পাঁচটি বামদল বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। জাতীয় পার্টি ১৫৩ আসনে, আওয়ামী লীগ ৭৬ আসনে ও জামায়াত ১০ আসনে বিজয়ী হয়। এই নির্বাচনে এরশাদ ঢালাওভাবে ডাকাতি না করে জেনারেল জিয়াকে অনুসরণ করেছিলেন। কোন কোন আসন জাতীয় পার্টিকে জয়ী করা হবে তা আগেই নির্ধারণ করা হয়েছে। জামায়াতের রংপুরের এক প্রার্থী শাহ রুহুল ইসলামকে জোরপূর্বক হারিয়ে দেওয়া হয়েছে। ওই আসনের সকল ব্যালট বাক্স সেনাবাহিনী সেনানিবাসে নিয়ে এসে ফলাফল ঘোষণা দেয়। 

জামায়াত নির্বাচনে সন্তুষ্ট না হলেও রাজনৈতিক টার্গেট পূরণ হয়। পার্লামেন্টারিয়ান দলে পরিণত হয়। মার্কা হিসেবে দাড়িপাল্লাও বৈধতা পায়। নির্বাচনের শুরুতে এই নিয়ে ঝামেলা হয়। এটা সুপ্রিম কোর্টের প্রতীক হিসেবে জামায়াতকে পাল্লা মার্কার বরাদ্দ দিতে চায়নি নির্বাচন কমিশন। পরে ১৯৭০ এর নির্বাচনের নথিপত্র দেখিয়ে এই বৈধতা অর্জন করে।  

১৯৮৭ সালে স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে আবার যুগপৎ আন্দোলন গড়ে উঠে। '৮৬ এর সংসদ নির্বাচনে বিএনপি অংশগ্রহণ না করায় তারাই এ আন্দোলনে অধিকতর সংগ্রামী ভূমিকা পালন করে। বিরোধী দলগুলো সরকারের ওপর চাপ তৈরি করতে সংসদ থেকে গণ পদত্যাগের সিদ্ধান্ত নেয়। ৬ই ডিসেম্বর জামায়াতে ইসলামীর ১০ সদস্য- বিশিষ্ট সংসদীয় দল তাদের নেতা অধ্যাপক মুজীবুর রহমানের নেতৃত্বে স্পীকার জনাব শামসুল হুদা চৌধুরীর নিকট যেয়ে পদত্যাগ পত্র পেশ করেন। 

আওয়ামী লীগ বিবিসি'কে পদত্যাগ করবেন বলে জানানো সত্ত্বেও বিদেশে অবস্থানকারী নেত্রীর সম্মতির অভাবে দোদুল্যমান থাকা অবস্থায় তিন দিন পর সরকার সংসদ ভেঙ্গে দেয়। আওয়ামী লীগ অপ্রস্তুত অবস্থায় পড়ে যায়। এরশাদ সরকার সংসদ ভেঙ্গে দেয়। 

প্রধান দুই দলের সমন্বয়ের অভাবে যুগপৎ আন্দোলন জোরদার না হওয়ায় ঐ অনুকূল পরিবেশটিকেও কাজে লাগনো গেল না। ফলে এরশাদ '৮৮ সালের মার্চ মাসে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ব্যবস্থা করেন। এ নির্বাচনে আ স ম আবদুর রবের নেতৃত্বে কয়েকটি বাম দল ছাড়া যুগপৎ আন্দোলনের সকল দলই ঐ নির্বাচন বয়কট করে । প্রহসনমূলক এবং ভোটার বিহীন নির্বাচনের পর জনপ্রতিনিধিত্বহীন সংসদের বিরুদ্ধে বিরোধী দলগুলো সোচ্চার হতে থাকে। এরশাদের পদত্যাগ ও সংসদ ভেঙ্গে দেবার দাবীতে আন্দোলন ঢিমে তালে চলতে থাকে ।

১৯৮৯ সালের অক্টোবরে বিএনপি ও আওয়ামী লীগ জামায়াত প্রস্তাবিত কেয়ারটেকার সরকারে সম্মত হয়। এবার সব বিরোধী দল কেয়ারটেকার সরকারের অধীনে সংসদ নির্বাচনের দাবীতে আন্দোলন করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। অভিন্ন দাবীর কারণে এরশাদ বিরোধী আন্দোলন চাংগা হয়ে উঠে। কেয়ারটেকার সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করার সুনির্দিষ্ট দাবী সর্বমহলে সহজে বোধগম্য হওয়ায় স্বৈরশাসনের অবসানের পথ সুগম হয়।

কীভাবে সরকার পরিবর্তন করা হবে এ বিষয়ে সুস্পষ্ট দাবী উত্থাপিত হওয়ায় আন্দোলনে প্রাণ সঞ্চার হয়। কেয়ারটেকার সরকার সম্পর্কে জামায়াতে ইসলামীর দেওয়া ফর্মূলা অনুযায়ীই ১৫, ৭ ও ৫ দলীয় জোটের নামে একটা রূপরেখা পেশ করা হয়। এতে বলা হয় যে সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতির হাতে জেনারেল এরশাদ ক্ষমতা হস্তান্তর করবেন। প্রধান বিচারপতি অস্থায়ী প্রেসিডেন্ট হিসাবে অরাজনৈতিক ও নির্দলীয় ব্যক্তিদের দ্বারা গঠিত (মন্ত্রীর মর্যাদায়) উপদেষ্টা পরিষদ গঠন করবেন। এ নবগঠিত সরকার নির্বাচন কমিশন গঠন করে জাতীয় সংসদের নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করবেন।

এবার সরকার পরিবর্তনের আন্দোলন জোরদার হলো এবং জনগণ সক্রিয়ভাবে এগিয়ে এলো। ঠিক ঐ পরিবেশে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদল ও ছাত্রলীগ ঐক্যবদ্ধ হয়ে কেয়ারটেকার সরকার কায়েমের আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ায় আন্দোলন তুঙ্গে উঠলো। সরকারের ১৪৪ ধারা অগ্রাহ্য করে জনগণ ময়দানে নেমে এলো। সেনাবাহিনী জনগণের বিরুদ্ধে এরশাদ সরকারের পক্ষে ভূমিকা রাখতে অস্বীকার করলো। বাধ্য হয়ে এরশাদ ৬ই ডিসেম্বর (১৯৯০) পদত্যাগ করলো।

কেয়ারটেকার সরকার কায়েমের আন্দোলন সফল হলো। প্রধান বিচারপতি প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব হাতে নিয়ে একটি নিরপেক্ষ ও অবাধ নির্বাচন অনুষ্ঠান করতে সক্ষম হলেন। ১৯৯১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ১৯৮৪ সালের এপ্রিলে ১৫ ও ৭ দলীয় জোট এবং জামায়াতে ইসলামীর সাথে জেনারেল এরশাদের সংলাপের সময় যদি কেয়ারটেকার সরকার দাবীটি সবাই একসাথে পেশ করতে সক্ষম হতো তাহলে স্বৈরশাসন থেকে মুক্তি '৯০ সাল পর্যন্ত বিলম্বিত হতো না ।

প্রধান বিচারপতি শাহাবুদ্দীন আহমদের নেতৃত্বে পরিচালিত সফল নিরপেক্ষ নির্বাচনে কোন দল নিরংকুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পাওয়ায় সরকার গঠনে সমস্যা দেখা দিল। ঘটনাক্রমে ৩০০ আসনের মধ্যে মাত্র ১৮টি আসনের অধিকারী জামায়াতে ইসলামীর হাতে ‘ব্যালেন্স অব পাওয়ার' এসে পড়লো। জামায়াত ক্ষমতায় অংশীদার না হয়ে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে অব্যাহত রাখার উদ্দেশ্যে নিঃস্বার্থভাবে বিএনপি'কে সরকার গঠনে সাহায্য করলো। বিএনপি নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া ২০ মার্চ প্রধানমন্ত্রী হিসাবে শপথ নেন।

জুন মাসে বাজেট সেশনেই জামায়াতে ইসলামী পার্লামেন্টারী পার্টির নেতা শহীদ মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী কেয়ারটেকার সরকার পদ্ধতিকে শাসনতন্ত্রে অন্তর্ভূক্ত করার উদ্দেশ্যে সংসদে পেশ করার জন্য একটি বিল জমা দেন। পরে ঐ বছরই আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টি পৃথকভাবে এ উদ্দেশ্যে বিল জমা দেয়। কিন্তু ক্ষমতাসীন দল বিএনপি এ বিষয়ে মোটেই গ্রাহ্য করলো না।

১৯৯১ সালের সংসদ নির্বাচন যদি জেনারেল এরশাদের তত্ত্বাবধানে অনুষ্ঠিত হতো তাহলে নিশ্চয়ই বিএনপি ক্ষমতাসীন হতে পারতো না। বিএনপি সরকার কেয়ারটেকার সরকারেরই ফসল। ভবিষ্যতে যাতে এ পদ্ধতিতেই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় সেজন্য দেশের শাসনতন্ত্রে এ বিষয়ে একটি আইনের সংযোজন করাই সবচাইতে যুক্তিসংগত। এ পদ্ধতিতেই জনগণের নিকট গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠান করা নিশ্চিত হয়।

দুঃখের বিষয় বিএনপি সংসদে ‘কেয়ারটেকার সরকার পদ্ধতি' সম্পর্কিত বিল আলোচনার সুযোগই দিতে রাজি হলো না। জামায়াতে ইসলামী কেয়ারটেকার সরকার দাবী নিয়ে ১০ বছর (১৯৮০ থেকে ১৯৯০) আন্দোলন করেছে। '৯০ সালে বিএনপিও এ আন্দোলনে শরীক ছিল। কেয়ারটেকার সরকার পদ্ধতির সুবাদেই তাঁরা ক্ষমতায় গেলেন। অথচ এ পদ্ধতিটি সংসদে আলোচনা পর্যন্ত করতে দিলেন না। তাঁরা ক্ষমতাসীন থাকা অবস্থায় নির্বাচন করে ক্ষমতায় স্থায়ী হবার অবৈধ উদ্দেশ্য না থাকলে এমন স্বৈরাচারী আচরণ করতে পারতো না।

১৯৯৪ সালের এপ্রিলে মাগুরা জেলার একটি আসনে উপনির্বাচন হয়। এটি আওয়ামী লীগের আসন ছিল। বিএনপি'র খালেদা সরকার একচেটিয়াভাবে সন্ত্রাসী দিয়ে সকল কেন্দ্র করে নেয়। এভাবে নির্বাচনে কেন্দ্র দখল করে নেবার পর আওয়ামী লীগ ঘোষণা করল যে কেয়ারটেকার সরকার কায়েম না হওয়া পর্যন্ত বিএনপি সরকারের পরিচালনায় কোন নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবো না। নতুন করে আবার শুরু হলো কেয়ারটেকার সরকারের আন্দোলন। 

- চলবে 


১৪ জুল, ২০২৩

যেভাবে বাংলাদেশে কেয়ারটেকার সরকার এলো! (১ম পর্ব)



বাংলাদেশের নির্বাচন ব্যবস্থা ধ্বসে পড়েছে মুলত ১৯৭০ সালের নির্বাচনে। ঐ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ এক নজিরবিহীন কাণ্ড করে বসে। আওয়ামী লীগ ভিন্ন অন্যান্য দল ভোটারদের কাছে গেলেও আওয়ামী লী ভিন্ন প্রস্তুতি নিয়েছে। তারা জোরপূর্বক ব্যালট বাক্স দখল, বিরোধী প্রার্থী ও নেতা-কর্মীদের পিটিয়ে কেন্দ্র ছাড়া করে। এর জন্য প্রস্তুত ছিল না মুসলিম লীগ, জামায়াত, নেজামে ইসলাম ও ন্যাপ (একাংশ)।

এর ফলাফল হিসেবে অভাবনীয় সাফল্য পায় আওয়ামী লীগ। এটা শুধু তৎকালীন পাকিস্তানে তো বেনজির নয় গোটা পৃথিবীতেই ছিল নজিরবিহীন। মুসলিম লীগ, নেজামে ইসলাম ও জামায়াত ভেবেছিল নির্বাচন কমিশন অভিযোগ আমলে নিয়ে অভিযুক্ত কেন্দ্রগুলোতে পুনঃনির্বাচন করবে। কিন্তু প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া এই নির্বাচনেই আস্থা রেখে ক্ষমতা হস্তান্তরের ব্যাপারে কার্যক্রম এগিয়ে নিলেন। এভাবে ঘটনা পরিক্রমায় ইয়াহিয়া-ভুট্টো-মুজিব সমঝোতা শেষ হতে না পারায় যুদ্ধ লাগিয়ে দেয় এদেশের বিপথগামী কিছু বিচ্ছিন্নতাবাদী।

আলাদা দেশ হিসাবে বাংলাদেশের অভ্যুত্থানের পর শেখ মুজিব ১৯৭০ এর সাফল্যের কথা ভুলে যায়নি। একইভাবে তারা নির্বাচনে জয়ের পরিকল্পনা করে। মুজিব সরকারের পরিচালনায় ১৯৭৩ সালের সংসদ নির্বাচনে ৩০০ আসনের প্রায় সব কয়টি আওয়ামী লীগ দখল করে নেয়। ১ টি জাসদ জোর করে দখলে রাখতে পারে। ১ টি জাতীয় লীগ পায়। ৫টি আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী জিতে যায়। বাকী ২৯৩ আসনে জয়লাভ করে মুজিব। এরমধ্যে খন্দকার মোশতাকের আসন থেকে ব্যালট বাক্স হেলিকপ্টার দিয়ে উড়িয়ে আনে মুজিব। মুজিবের বাসভবন থেকে ঘোষণা হয় মোশতাকের বিজয়।

এভাবে বাংলাদেশের নির্বাচনের সংস্কৃতি পুরোপুরি ভেস্তে দেয় শেখ মুজিব। এখানে নির্বাচনে জিততে হলে পেশিশক্তি লাগবে। অস্ত্রের শক্তি লাগবে। মানুষ ভোট দিক বা দিক সেটা কোনো মূখ্য ব্যাপার ছিল না। এরপর বাম ভাবাপন্ন সেনাবাহিনীর ক্যুতে মুজিব নিহত হয়। নানান ঘটনা চক্রে ক্ষমতায় আসে জেনারেল জিয়া।

প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের আমলে ১৯৭৯ সালে অনুষ্ঠিত সংসদ নির্বাচনে জিয়াউর রহমানের দল দুই তৃতীয়াংশ আসনেরও বেশি দখল করে। আওয়ামী লীগ ৩৯টি আসনে বিজয়ী হয়ে প্রধান বিরোধী দলের মর্যাদা লাভ করে। মুসলিম লীগ, জামায়াতে ইসলামী ও নেজামে ইসলাম পার্টি মিলে আই.ডি.এল (ইসলামী ডেমোক্রেটিক লীগ) নামে নির্বাচনে ১৮ টি আসন পায়।

এ নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ না হলেও ৭৩ এর নির্বাচনের মতো একচেটিয়া সীট দখলের অপচেষ্টা করা হয়নি। শেখ মুজিবের নগ্ন ডাকাতি এখানে হয়নি। তবে জিয়াউর রহমান কূটকৌশলী ও বুদ্ধিমান ছিলেন। নির্বাচনে যত দল যোগদান করেছে সে সব দলের প্রধানগণ যাতে সংসদে আসেন সেদিকে খেয়াল রেখেছেন। নির্বাচন কমিশন ও প্রশাসনকে নিয়ন্ত্রণ করে ইচ্ছেমত ফলাফল নিয়ে এসেছেন।

এই প্রসঙ্গে শহীদ গোলাম আযম বলেন, //জিয়ার শাসনামলের প্রধানমন্ত্রী শাহ আজীজুর রহমান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার সিনিয়ার ছিলেন। সমসাময়িক হিসাবে কিছুটা সম্পর্ক ছিল। পরবর্তীতে রাজনৈতিক অঙ্গনে বন্ধুত্ব গড়ে উঠে। প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে যোগাযোগ ও সাক্ষাত হতো। তাঁর কাছ থেকে জিয়াউর রহমানের রাজনৈতিক ও নির্বাচনী পলিসি সম্পর্কে কিছু জানার সুযোগ পেয়েছি।

তিনি জিয়ার নির্বাচনী পলিসির প্রশংসা করতে গিয়ে জানালেন যে, দলীয় প্রধানগণ যাতে সংসদের বাইরে আন্দোলন করা প্রয়োজন মনে না করেন সে উদ্দেশ্যে তাদেরকে নির্বাচিত হবার সুযোগ দিয়েছেন। সর্বহারা দলের তোয়াহা প্রথম ভোট গণনায় পরাজিত হওয়া সত্ত্বেও শেষ পর্যন্ত নির্বাচিত বলে ঘোষণা করা হয় । এ দ্বারা বুঝা গেল যে জিয়াউর রহমানের ইচ্ছার বিরুদ্ধে কারো বিজয়ী হওয়া সম্ভব হয়নি।//

গোলাম আযম আশা করেছিলেন জিয়া যেহেতু বহুদলীয় গণতন্ত্র চালু করেছেন, সেক্ষেত্রে তিনি সুষ্ঠু নির্বাচনের প্রতি আগ্রহী হবেন। কিন্তু ১৯৭৯ সালের নির্বাচনে তিনি হতাশ হলেন। এই প্রসঙ্গে অধ্যাপক গোলাম আযম বলেন, //শেখ মুজিবের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ, রাজনীতি ও নির্বাচনকে বাকশালী স্বেচ্ছাচারে পরিণত করলো। জিয়াউর রহমান বহুদলীয় গণতন্ত্র চালু করার ব্যবস্থা করলেন। কিন্তু অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের উদ্দেশ্য সম্পূর্ণ সফল হয়নি। গণতন্ত্রের অগ্রগতি ও বিকাশের জন্য নিরপেক্ষ নির্বাচন অপরিহার্য। তা না হলে নির্বাচন নিতান্তই প্রহসন মাত্র।//

শহীদ অধ্যাপক গোলাম আযম তখন থেকেই বিকল্প পদ্ধতিতে নির্বাচনের কথা ভাবতে থাকলেন। গবেষণা করতে থাকলেন। প্রতিটি সম্ভাবনার সাইড ইফেক্ট চিন্তা করলেন। এরপর তিনি কেয়ারটেকার সরকার ব্যবস্থার কথা ভাবলেন। এরপর এটি তিনি জামায়াতের নির্বাহী পরিষদে উত্থাপন করেন। দীর্ঘ আলোচনা পর্যালোচনার পর জামায়াত সর্বসম্মতভাবে এ প্রস্তাব অনুমোদন করে।

অধ্যাপক গোলাম আযম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ছাত্র ছিলেন ও কারমাইকেল কলেজে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক ছিলেন। তাই এই বিষয়ে তাঁর একাডেমিক পদচারণা ছিল। একইসাথে তিনি রাজনৈতিক নেতা হওয়ায় বিষয়টি তাঁর জন্য সুবিধা হয়েছে।

কেয়ারটেকার শব্দটি কীভাবে এসেছে এই নিয়ে তিনি বলেন, //গণতান্ত্রিক দেশের নির্বাচনের সময় এক ধরনের কেয়ারটেকার সরকারই থাকে। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী রাজনৈতিক ব্যক্তি ও দলীয় নেতা হওয়ায় সরকার পরিচালনার সুযোগে নির্বাচনকে প্রভাবান্বিত করার সম্ভাবনা থাকে। বৃটেনে দীর্ঘ ঐতিহ্যের কারণে এমন সুযোগ গ্রহণ না করলেও আমাদের দেশে অবশ্যই আছে। এ ভাবনা থেকে অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য অরাজনৈতিক ও নির্দলীয় কেয়ারটেকার সরকার পদ্ধতির প্রস্তাব করা হয়েছে। আমি “কেয়ারটেকার সরকার” পরিভাষার আবিষ্কারক নই। এ পরিভাষা রাষ্ট্র বিজ্ঞানেই আমি পেয়েছি। আমার প্রস্তাবে শুধু 'নির্দলীয় ও অরাজনৈতিক সরকারের' পরিচালনার কথাটুকুই নতুন সংযোজন বলা যায়।//

অধ্যাপক গোলাম আযম প্রস্তাবিত কেয়ারটেকার মডেলের মূলকথা ছিল,
“নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের উদ্দেশ্যে সুপ্রিম কোর্টের কর্মরত (অবসরপ্রাপ্ত নয়) প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে একটি অরাজনৈতিক ও নির্দলীয় কেয়ারটেকার সরকার গঠন করতে হবে। এ সরকারে মন্ত্রীর পদমর্যাদায় এমন লোকদেরকে নিয়োগ করতে হবে যারা রাজনৈতিক ব্যক্তি হিসাবে পরিচিত নন এবং কোন রাজনৈতিক দলের সাথে সম্পৃক্ত নন। এ সরকার দলনিরপেক্ষ লোকদের দ্বারা নির্বাচন কমিশন গঠন করবেন। নির্বাচন অনুষ্ঠানের পর নতুন সরকার গঠিত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত এ সরকার কায়েম থাকবে এবং প্রধান বিচারপতি নিজ পদে প্রত্যাবর্তন করবেন।”

গোলাম আযম সাহেব বলেন, //মূল প্রস্তাবে কর্মরত প্রধান বিচারপতিকে সরকার প্রধান করার কথা এ কারণেই বলা হয়েছে যে, তিনি নির্বাচনের পরই পূর্বপদে ফিরে যাবেন বিধায় তাঁর মধ্যে রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষের সুযোগ কম থাকবে। এ অবস্থায় তাঁর কোন দলের প্রতি পক্ষপাতিত্ব করার কোন আশংকা থাকবে না।//

১৯৮০ সালের ৭ই ডিসেম্বরে রমনায় এক সাংবাদিক সম্মেলনে জামায়াতের ভারপ্রাপ্ত আমীর জনাব আব্বাস আলী খান সর্বপ্রথম জামায়াতের পক্ষ থেকে এ দাবীটি উত্থাপন করেন। ১৯৮১ সালের মে মাসে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানকে নিহত করার ফলে ঐ বছর নভেম্বরে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বিচারপতি আবদুস সাত্তার নির্বাচিত হন এবং নতুন সরকার গঠন করেন ১৯৮২ সালের মার্চে সেনাপ্রধান জেনারেল এরশাদ সামরিক শাসন কায়েম করে গণতন্ত্রের ধারা স্তব্ধ করে দেন।

১৯৮৩ সালের এপ্রিলে রাজনৈতিক দলসমূহকে সক্রিয় হবার সুযোগ দিলে ঐ বছরই ২০শে নভেম্বর বাইতুল মুকাররামের দক্ষিণ চত্বরে জামায়াতের জনসভায় একটি রাজনৈতিক প্রস্তাব হিসাবে কেয়ারটেকার সরকারের পরিচালনায় নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবী জানানো হয়। এই দাবির সাথে সকল বিরোধী দলকে একাত্ম হওয়ার আহ্বান জানানো হয়।

১৯৮৩ সালে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ১৫ দলীয় জোট ও বি.এন.পি-এর নেতৃত্বে ৭ দলীয় জোট এবং জামায়াতে ইসলামী পৃথক পৃথক ভাবে সামরিক শাসন প্রত্যাহার করে স্থগিত হওয়া শাসনতন্ত্র বহাল করার আন্দোলন শুরু করে। এক পর্যায়ে এ আন্দোলন যুগপতের রূপ নিলে ১৯৮৪ সালের শুরুতে স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন জোরদার হয়ে উঠে। সামরিক শাসক এরশাদ এপ্রিল মাসে ১৫ দল, ৭ দল ও জামায়াতকে সংলাপের আহবান জানান।

যুগপৎ আন্দোলনের ফলে উভয় জোট নেত্রীর সাথে যে রাজনৈতিক সম্পর্ক গড়ে উঠে জামায়াত সে সুবাদে ১৫+৭+জামায়াত মিলে ২৩ দলের একসাথে সংলাপে অংশগ্রহণের প্রস্তাব দেয়। একসাথে সংলাপে যাবার পক্ষে জামায়াত যুক্তি পেশ করে যে পৃথক পৃথকভাবে গেলে জেনারেল এরশাদ থেকে কোন কমিটমেন্ট আদায় করা যাবে না। একজোটের সাথে কথা বলার পর তিনি বলবেন, আপনাদের কথা শুনলাম, দেখি অন্যান্যরা কী বলেন। একসাথে গেলে এ রকম কোন অজুহাত তুলতে পারবেন না। তাহলে সংলাপ ফলপ্রসূ হবে এবং তাঁকে সিদ্ধান্ত জানাতে বাধ্য করা যাবে।

দুই নেত্রী একসাথে যেতে সম্মত হলেন না। জামায়াত দুই নেত্রীর নিকট প্রস্তাব দিল যে সবাই একসাথে সংলাপে না গেলেও সবাই যদি একই ভাষায় একই রকম দাবী জানায় তাহলেও সংলাপ সফল হতে পারে। উভয় নেত্রী বললেন, ঐ দাবীটি লিখিতভাবে দিলে আমরা জোটের বৈঠকে বিবেচনা করব।

জামায়াত সংলাপে পেশ করার জন্য দাবীটি লিখিত আকারে দুইনেত্রীকে দেবার পর তারা কেউ তা পছন্দ করলেন কিনা জানা গেল না। ১০ এপ্রিল জামায়াতের ভারপ্রাপ্ত আমীরের নেত্বত্বে ৭ সদস্যের ডেলিগেশন জেনারেল এরশাদের সাথে সাক্ষাৎ করে ঐ লিখিত দাবীটিই পেশ করে যা দুই জোট নেত্রীকে দেওয়া হয়েছিল।

জামায়াতের তৈরি করা দাবিগুলো ছিল নিন্মরূপ,

“সেনাপ্রধান হিসাবে শপথ নেবার সময় আপনি যে শাসনতন্ত্রের হেফাযতের দায়িত্ব নিয়েছিলেন তা মুলতবী করে এবং নির্বাচিত সরকারকে উৎখাত করে ক্ষমতা দখল করার কোন বৈধ অধিকার আপনার ছিল না। শাসনতন্ত্র বহাল করে নির্বাচনের মাধ্যমে নতুন সরকারের হাতে ক্ষমতা তুলে দিন। এ ব্যাপারে দুটো বিকল্প পদ্ধতি অবলম্বন করতে পারেন :

(১) আপনি যদি নিজে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে চান তাহলে সুপ্রিম কোর্টের কর্মরত প্রধান বিচারপতির নিকট ক্ষমতা হস্তান্তর করুন। তাঁর নেতৃত্বে একটি অরাজনৈতিক ও নির্দলীয় কেয়ারটেকার সরকার নিরপেক্ষ নির্বাচনের ব্যবস্থা করুক। এ নির্বাচনে জনগণ আপনাকে নির্বাচিত করলে আপনি দেশ শাসনের বৈধ অধিকার পাবেন।

(২) যদি আপনি ঘোষণা করেন যে আপনি নিজে নির্বাচনে প্রার্থী হবেন না এবং কোন রাজনৈতিক দলের নেতৃত্বে থাকবেন না, তাহলে আপনাকেও কেয়ারটেকার সরকার হিসাবে গ্রহণ করতে আমরা সম্মত। নির্বাচনের পর আপনি পদত্যাগ করবেন এবং নির্বাচিত সরকার দেশ পরিচালনার দায়িত্ব পালন করবে।

এ দাবীর জওয়াবে এরশাদ বললেন, //আপনাদের কথা শুনলাম। অন্যদের কথা শুনবার পর সবার প্রস্তাব একসাথে বিবেচনা করবো।//

জনাব আব্বাস আলী খান সংলাপের পর বঙ্গভবন থেকে সরাসরি জাতীয় প্রেসক্লাবে এসে সাংবাদিকদের নিকট ঐ লিখিত দাবীর কপি বিলি করেন।

১৫ দল ও ৭ দলীয় জোটের সাথে আলোচনা শেষে ১৭ এপ্রিল জামায়াতের ডেলিগেশনের সাথে দ্বিতীয় দফা সংলাপে জেনারেল এরশাদ একটু উষ্মার সাথে বললেন, “আপনারা কোথায় পেলেন কেয়ারটেকার সরকারের অদ্ভূত পদ্ধতি? দুই জোটের কেউ আপনাদের দাবী সমর্থন করে না। ২৮ এপ্রিল পর্যন্ত সংলাপ শেষ হওয়ার পর ২৯ তারিখে এরশাদ সাহেব দাপটের সাথে জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণে বললেন,

//রাজনৈতিক দলগুলো এত বিভিন্ন রকম দাবী জানিয়েছে যে আমি কার দাবী গ্রহণ করব? তাই অবিলম্বে উপজিলা চেয়ারম্যান নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।//

১৫ দলীয় ও ৭ দলীয় জোট এবং জামায়াতের যুগপৎ আন্দোলনের মূল দাবী ছিল, উপজিলা নির্বাচন নয়, সবার আগে সংসদ নির্বাচন চাই। এ দাবীতে আন্দোলন জোরদার হওয়ায় এরশাদ সংলাপের ডাক দিতে বাধ্য হন।

সব দল যদি একসাথে সংলাপে যেয়ে একই দাবী একবাক্যে পেশ করতে সক্ষম হতো তাহলে ঐ বছরই দেশ স্বৈরশাসন থেকে হয়তো মুক্তি পেতো। সংলাপ ব্যর্থ হয়ে যাওয়ায় আন্দোলন স্তিমিত হয়ে গেল এবং সামরিক শাসক এরশাদ উপজিলা নির্বাচন করিয়ে ক্ষমতায় আরো মজবুত হয়ে বসার সুযোগ পেলো।

- চলবে

২৫ জুন, ২০২৩

গণতান্ত্রিক আওয়ামী লীগ যেভাবে ফ্যাসিবাদে পরিণত হয়!

ছবি: বাম থেকে শেখ মুজিব, শামসুল হক, আব্দুর রশিদ তর্কবাগীশ।

১৯৪৯ সালের ২৩ জুন ঢাকার টিকাটুলীর কেএম দাস লেন রোডের রোজ গার্ডেন প্যালেসে 'পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ' প্রতিষ্ঠিত হয়, যার সভাপতি ছিলেন টাঙ্গাইলের আবদুল হামিদ খান ভাসানী। সাধারণ সম্পাদক শামসুল হক। ঘটনাক্রমে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক দু'জনেই টাঙ্গাইলের। সহ-সভাপতি হন আতাউর রহমান খান, শাখাওয়াত হোসেন ও আলী আহমদ। শেখ মুজিবুর রহমান, খন্দকার মোশতাক আহমদ ও এ কে রফিকুল হোসেনকে যুগ্ম সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব দেওয়া হয়। কোষাধ্যক্ষ হন ইয়ার মোহাম্মদ খান। এসময় শেখ মুজিব কারাগারে অন্তরীণ ছিলেন ঢাবিতে ভাংচুর চালানোর অপরাধে।

১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণের অভিযোগে শামসুল হককে গ্রেপ্তার করা হয়। অধিকাংশ ইতিহাস লেখক বলেছেন, ১৯৫৩ সালে কারামুক্তির পর ঘরোয়া ষড়যন্ত্রের পরিণতিতে আওয়ামী লীগ তাঁকে বহিষ্কার করে; যার ফলশ্রুতিতে তিনি চিরকালের জন্য মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন। ষড়যন্ত্রটি কী ছিলো তা বেশিরভাগ লেখক এড়িয়ে যান। আওয়ামী মুসলিম লীগের নেতাদের মধ্যে কেউ ছিলো ইসলামপন্থী, কেউ ছিলো বামপন্থী আবার কেউ ছিলো সেক্যুলার। আওয়ামী মুসলিম লীগকে একটি মুসলিম দল থেকে সেক্যুলার দলে পরিণত করার ক্ষেত্রে একজন বাধা ছিলেন শামসুল হক।

শামসুল হক কারাগারে থাকা অবস্থায় শেখ মুজিব প্রচার করতে থাকেন শামসুল হক পাগল হয়ে গেছেন। তিনি মানসিক বিকারগ্রস্থ। এক্ষেত্রে শেখ মুজিবের মূল উদ্দেশ্য ছিলো সাধারণ সম্পাদকের পদ দখল করা। এটা ছিলো একটা মোক্ষম ফাঁদ। সকলে গিয়ে শামসুল হকের সাথে দেখা করেন এবং তার মানসিক স্বাস্থ্যের কথা জিজ্ঞাসা করেন। এক পর্যায়ে এই বিষয়ে তাকে প্রশ্ন করলেই তিনি কারাগারে ক্ষিপ্ত হয়ে যেতেন।

ভাসানীও এই ঘটনার ফায়দা নিতে থাকেন। তিনি মৌখিকভাবে শামসুক হককে বহিষ্কার করেন। তাহলে দলকে সেক্যুলার/বামপন্থী করার পথে বাধা আর থাকবে না। কারণ শামসুল হক অনেকটা ইসলামপন্থী ছিলেন। কারামুক্তির পর তার স্ত্রী আফিয়া সবার অব্যাহত প্ররোচনায় তাকে মানসিক হাসপাতালে ভর্তি করাতে চাইলে শামসুল হক অত্যন্ত মনঃক্ষুন্ন হন। তাদের দাম্পত্য সম্পর্কে চিড় ধরে। ঘরে-বাইরে কাউকে বিশ্বাস না করে সব ছেড়েছুড়ে শামসুল হক নিরুদ্দেশ হন। এক পর্যায়ে সত্যিই তার মানসিক বিকার লক্ষ্য করা যায়। এই ব্যাপারে অনেক লেখক সাক্ষ্য দিয়েছেন।

এই বিষয়ে সাংবাদিক গোলাম মহিউদ্দিন তার মুক্তিযুদ্ধের অজানা ইতিহাস বইতে বলেছেন,
কারামুক্ত শেখ মুজিব তখন কারাবাসী মওলানা ভাসানীর নিকট হতে নাকি অনুমোদন অর্জন করে আওয়ামী লীগের কর্ণধার হয়ে (সেক্রেটারীর পদে) বসেছেন। তখনকার আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক (টাঙ্গাইলবাসী) শামসুল হক নাকি তার মস্তিষ্ক বিকৃতির তথাকথিত রোগটির কারণে দায়িত্ব পালনে সক্ষম ছিলেন না। তাই তখন শেখ মুজিবকেই নাকি সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব প্রদান করা হয়েছিলো।

শেখ মুজিবের সেই কর্মতৎপর দিনগুলোতেই আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শামসুল হক নাকি অপ্রকৃতিস্থ অবস্থায় নিখোঁজ হন। জনাব শামসুল হকের স্ত্রী অধ্যাপিকা আফিয়া খাতুন এরপর হতে দেশে বিদেশে তার স্বামীর (শামসুল হকের) অন্তর্ধানের পিছনে শেখ মুজিবেরও কালো হাত রয়েছে বলে সারা জীবনকাল ধরে অভিযোগ করেছেন।

একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের কাজে আমরা যখন দেশে-বিদেশে সক্রিয় ছিলাম তখন ভারতের নয়া দিল্লীস্থ গান্ধী পিস ফাউন্ডেশন হোস্টেলে আমাদের অস্থায়ী আবাসস্থলে মার্কিন মুল্লুকের বিখ্যাত হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের জনৈক ভারতীয় বাঙালী হিন্দু অধ্যাপক বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে প্রচারের কাজে সস্ত্রীক এসে আমাদের সঙ্গে ক'দিন ছিলেন। ভয়েস অব আমেরিকা খ্যাত বাঙালী সাংবাদিক-ব্রডকাস্টার প্রসুন মিত্রও আমাদের সঙ্গে সেখানে ছিলেন। সর্বপ্রথমের 'জয়বাংলা' (নওগাঁ) পত্রিকার প্রকাশক (আসলে ব্যাংকার) রহমতুল্লাহও তার কয়েক সপ্তাহের দিল্লীবাসকালে সেখানে আমাদের সঙ্গে ছিলেন।

উপরোক্ত হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বাঙালী অধ্যাপক বাবু প্রায়ই নিখোঁজ শামসুল হকের স্ত্রী অধ্যাপিকা আফিয়া খাতুনের কথা আমাদের সামনে তুলতেন। উক্ত মিসেস আফিয়া খাতুনও তখনকার দিনে মার্কিন মুল্লুকে বিশ্ববিদ্যালয়ে দীর্ঘদিন ধরে অধ্যাপনার কাজে ছিলেন। সেখানেও তিনি তার স্বামী শামসুল হকের অন্তর্ধানের পেছনে শেখ মুজিবের কালো হাত থাকবার কথা উপরোক্তদের সবার নিকটেই বিশেষ জোরের সঙ্গেই বলে বেড়াতেন, হার্ভার্ড অধ্যাপকদের মুখে আমরা সবাই তা শুনতাম। এতে সেসব দেশে তাদের মুজিবকে হিরো বানাবার প্রয়াস নাকি বার বার বাধাপ্রাপ্ত হয়েছে, অধ্যাপক বাবু দু:খ করে বলতেন।

১৯৬৫ সালে তাকে সর্বশেষ দেখা গিয়েছে বলে অনেকেই উল্লেখ করেছেন। তার মৃত্যু কীভাবে ও কোথায় হয়েছে এই ব্যাপারে কেউ জানে না। সম্প্রতি কেউ কেউ বলছেন তার মৃত্যু ও কবর নাকি টাঙ্গাইলের কালিহাতিতে রয়েছে।

ভাসানী আওয়ামী লীগকে ধীরে ধীরে বামপন্থার দিকে নিয়ে যেতে চাইছিলো। তারই পরিপ্রেক্ষিতে ডানপন্থীদের সাথে প্রায়ই তার মতবিরোধ দেখা দিতো। এই মতবিরোধ শক্তিশালী হয় ১৯৫৭ সালে আওয়ামী লীগের কাগমারী সম্মেলনে। কাগমারি সম্মেলনের পর পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সভাপতি ভাসানী বিরুদ্ধে প্রকাশ্যেই কথা বলতে থাকেন দলের ডানপন্থী ও উদারপন্থীরা। অনেকটা কোণঠাসা ভাসানী ১৮ মার্চ আওয়ামী লীগ থেকে পদত্যাগ করেন। কারণ হিসেবে তিনি উল্লেখ করেন সোহরাওয়ার্দীর চুক্তি বাতিলের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান।

একই বছর ২৫ জুলাই ভাসানীর নেতৃত্বে ঢাকার রূপমহল সিনেমা হলে 'ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি' (ন্যাপ) গঠিত হয়। ন্যাপ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ভাসানী প্রকাশ্যে বামপন্থী রাজনীতির সাথে জড়িয়ে পড়েন এবং এরপর থেকে সবসময় বাম ধারার রাজনীতির সাথেই সংশ্লিষ্ট ছিলেন। এজন্য তাকে তার বিরোধীরা উপহাস করে লাল মাওলানা বলতো। ভাসানী আওয়ামী লীগ ত্যাগ করার পর ১৩-১৪ জুন লীগের বিশেষ সম্মেলনে সভাপতি নির্বাচিত হন মাওলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগীশ। সাধারণ সম্পাদক হন শেখ মুজিব।

এরপর ১৯৬৬ সালে শেখ মুজিব আইয়ুবের ষড়যন্ত্রে পড়ে ৬ দফা উত্থাপন করেন। তার এই ৬ দফার বিষয়টি কেউ জানতো না। সে আওয়ামী লীগের কারো সাথেই আলোচনা না করে ৬ দফা উত্থাপন করে। মূলত সে লাহোরে যায় আইয়ুবের তাসখন্দ চুক্তির বিরুদ্ধে বিরোধী দলগুলোর একটি মিটিং-এ যোগ দিতে। কিন্তু সেখানে তাসখন্দ চুক্তি নিয়ে কথা না বলে মুজিব ৬ দফা উত্থাপন করে মূলত ঐ মিটিংটা ভেস্তে দিতে চেয়েছিলো।

আওয়ামী লীগের অধিকাংশই ৬ দফা মানে নি। দফাগুলোর সাথে তাদের বিরোধ অতটা না হলেও তাদের মূল বিরোধ মুজিবকে নিয়ে। মুজিবের কারো সাথে পরামর্শ না করে এধরণের ঘোষণা কেউ মেনে নিতে পারে নি। ১৯৬৬ সালের ১৮-১৯ মার্চ ঢাকায় পূর্ব-পাকিস্তান আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠক শুরু হয়। এতে অন্যান্য মেম্বার সহ লীগ সভাপতি আব্দুর রশীদ তর্কবাগীশের প্রবল আপত্তির মুখে মুজিব ছয় দফা পাশ করাতে ব্যর্থ হয়। এর মাধ্যমে ছয় দফার সাথে আওয়ামী লীগের লীগের আর কোন সম্পর্ক থাকে না। হতাশ মুজিব তার শেষ অস্ত্র হিসেবে ছাত্রলীগকে ব্যবহার করেন।

এই প্রসঙ্গে সাবেক মন্ত্রী ও তৎকালীন ছাত্রলীগ নেতা আব্দুর রাজ্জাক বলেন, সেসময় দুঃখভরা মন নিয়ে শেখ মুজিব আমাদের (ছাত্রলীগ) ডাকলেন। বললেন, আমি তো বিপদে পড়ে গেছি। আমারে তোরা কি সাহায্য করবি না? ছয় দফা বলার পর থেকেই বিভিন্ন দিক থেকে আমার অপর এটাক আসছে। আমার তো এখন ঘরে বাইরে শত্রু। আমরা তখন বললাম নিশ্চয়ই আপনার পাশে থাকবো।

অবশেষে ফ্যাসিবাদী মুজিব ছাত্রলীগের গুন্ডাদের সহযোগিতায় সভাপতি তর্কবাগীশকে পদত্যাগে বাধ্য করেন। ছাত্রলীগের গুন্ডারা চ্যালাকাঠ নিয়ে আওয়ামী লীগের অফিস থেকে সভাপতি তর্কবাগীশ ও তার অনুসারীদের ভয় দেখিয়ে তাড়িয়ে দেয়। এরপর শেখ মুজিব নিজে নিজেকে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সভাপতি ঘোষণা করেন।

এরপর শেখ মুজিব নিজের দক্ষতায় ছয় দফাকে আওয়ামীলীগের মধ্যে জনপ্রিয় করতে সক্ষম হন। একইসাথে নিজের ব্র্যান্ডিংটাও ভালোভাবে করতে পারেন। এভাবে তিনি আওয়ামীলীগের সর্বেসর্বা হয়ে উঠেন। জোর করে আওয়ামী লীগের সভাপতির পদ দখল করার পর শেখ মুজিবের জীবদ্দশায় আর কখনোই কাউন্সিল হয়নি।

আওয়ামী লীগ হয়ে ওঠে ফ্যাসিবাদ ও স্বৈরাচারের সমার্থক। এখানে মুজিব যা বলবে তা-ই আইন। শেখ হাসিনা দলের দায়িত্ব নেয়ার পরেও একই ঘটনা ঘটতে থাকে। আওয়ামী লীগ পরিণত হয় শেখ মুজিবের জমিদারি। এখানে তার বংশের লোকই শেষ কথা। দলীয় প্রধান হাসিনার কথাই আইন।