বাংলাদেশ মুসলিমদের দেশ। এদেশ পরিচালনার জন্য গঠিত সংবিধান অবশ্যই মুসলিমদের চেতনার আলোকেই হতে হবে। সংবিধানের মূলনীতি যা হওয়া উচিত।
১. আল্লাহর স্বার্বভৌমত্ব
২. আদল ও ইনসাফ
৩. শুরাভিত্তিক শাসন (গণতন্ত্র)
৪. ইনসানিয়াত / মানবতা
৫. স্বচ্ছতা ও জবাবদিহীতা
আমরা গত তিন পর্বে ১ থেকে ৪ নং মূলনীতি নিয়ে আলোচনা করেছি। আজ আমরা ৫ নং মূলনীতি 'স্বচ্ছতা ও জবাবদিহীতা' নিয়ে আলোচনা করবো।
রাষ্ট্র পরিচালনা স্বচ্ছতা ও জবাবদিহীতা বেশ গুরুত্বপূর্ণ। জবাবদিহীতা না থাকা মানে শাসক স্বৈরাচারের ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়া। তাই শাসককে স্বৈরাচার হওয়া থেকে রক্ষা করার জন্য জবাবদিহীতা থাকাটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের অধঃপতনের অন্যতম প্রধান কারণ হ’ল জবাবদিহিতার অনুভূতির দুর্বলতা।
১. আল্লাহ তায়ালা বলেন ‘কেউ অণু পরিমাণ সৎকর্ম করলে তা সে (ক্বিয়ামতের দিন) দেখতে পাবে’। ‘আর কেউ অণু পরিমাণ মন্দকর্ম করলে তাও সে দেখতে পাবে’ (যিলযাল ৯৯/৭-৮)। আখেরাতে কঠিন শাস্তির ভয়ে সে সদা কম্পবান থাকে। কেননা সে জানে যে, সেদিন ‘যার ওযনের পাল্লা হালকা হবে’, ‘তার ঠিকানা হবে ‘হাভিয়াহ’। ‘তুমি কি জানো তা কি?’ ‘প্রজ্বলিত অগ্নি’ (ক্বারে‘আহ ১০১/৮-১১)। বস্ত্ততঃ ক্বিয়ামতের দিন ওযনের পাল্লা হালকা হওয়ার ভয়েই হযরত ওমর (রাঃ) স্বীয় খেলাফতকালে বলতে গেলে ঘুমাতেন না। তিনি বলতেন, যদি আমি রাতে ঘুমাই, তাহ’লে আমি নিজেকে ধ্বংস করলাম। আর যদি দিনে ঘুমাই, তাহ’লে প্রজাদের ধ্বংস করলাম। কেননা আমি তাদের উপর দায়িত্বশীল। (মাক্বরীযী, আল-খুত্বাত্ব ১/৩০৮)।
২. জবাবদিহিতার অনুভূতি ও দায়িত্বানুভূতির তীব্রতা মুসলিম নেতাদের মধ্যে কেমন পর্যায়ে পৌঁছেছিল, তা ওমর ইবনুল খাত্ত্বাব (রাঃ)-এর একটি ঘটনা থেকেই বুঝা যায়। একদিন তিনি প্রচন্ড সূর্যতাপে ছাদাক্বার উটের পরিচর্যা করছিলেন। এমন সময় বনু তামীমের নেতা আহনাফ বিন ক্বায়েস ইরাক থেকে একটি প্রতিনিধি দল নিয়ে আসেন। যখন তারা নিকটবর্তী হ’লেন, তখন খলীফা ওমর আহনাফকে ডেকে বললেন, হে আহনাফ! কাপড়-চোপড় ছেড়ে দ্রুত এস এবং এই উট পরিচর্যার ব্যাপারে আমীরুল মুমিনীনকে সাহায্য কর। কেননা এগুলি ছাদাক্বার উট। এর মধ্যে ইয়াতীম-মিসকীন ও বিধবাদের হক রয়েছে। তখন একজন বলল, হে আমীরুল মুমিনীন! আল্লাহ আপনাকে ক্ষমা করুন। আপনি ছাদাক্বা খাতের কোন একজন গোলামকে এ কাজের নির্দেশ দিলেই তো যথেষ্ট ছিল। জবাবে ওমর (রাঃ) বললেন, আমার চাইতে ও আহনাফের চাইতে বড় গোলাম আর কে আছে? কেননা যে ব্যক্তি মুসলমানদের কোন দায়িত্বে থাকে তার উপরে ঐরূপভাবে দায়িত্ব পালন করা ওয়াজিব, যেভাবে একজন মনিবের প্রতি গোলামের দায়িত্ব পালন করা ওয়াজিব’ (ইবনুল জাওযী, তারীখু ওমর ৮৯ পৃ.)।
৩. ক্বিয়ামতের দিন প্রত্যেক মানুষকে যে পাঁচটি বিষয়ে জিজ্ঞেস করা হবে। তা হ’ল এই যে, তার জীবন সে কোন কাজে ব্যয় করেছে? তার যৌবন সে কোন কাজে জীর্ণ করেছে? সে কোন পথে আয় ও ব্যয় করেছে? সে যা ইলম শিখেছে, সে অনুযায়ী আমল করেছে কি-না?’ (তিরমিযী হা/২৪১৬)। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘আল্লাহ কোন বান্দাকে যদি প্রজাদের উপরে দায়িত্বশীল নিযুক্ত করেন, অতঃপর সে তাদের উপর খেয়ানতকারী হিসাবে মৃত্যুবরণ করে, তাহ’লে তার উপর আল্লাহ জান্নাতকে হারাম করে দেন’ (বুঃ মুঃ)। কেবল শাসকই নন, বরং যেকোন দায়িত্বশীলের জন্য একই হুকুম।
৪. রাসূল (সা.) বলেন, ‘মনে রেখ তোমরা সবাই দায়িত্বশীল। আর তোমরা প্রত্যেকেই স্ব স্ব দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে। শাসক তার প্রজাদের উপর দায়িত্বশীল। সে তাদের ব্যাপারে জিজ্ঞাসিত হবে। ব্যক্তি তার পরিবারের উপরে দায়িত্বশীল। সে তার পরিবার সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে। নারী তার স্বামীর পরিবার ও সন্তানদের উপর দায়িত্বশীল। সে তাদের সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে। গোলাম তার মনিবের সম্পদের উপর দায়িত্বশীল। সে সে বিষয়ে জিজ্ঞাসিত হবে। সাবধান! তোমরা প্রত্যেকে দায়িত্বশীল এবং প্রত্যেকে স্ব স্ব দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে’ (বুঃ মুঃ)।
৫. আল্লাহ বলেন, ‘যেদিন তাদের কৃতকর্ম বিষয়ে তাদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিবে তাদের যবান এবং তাদের হাত ও পা’ (নূর ২৪/২৪)। এমনকি প্রত্যেকের দেহচর্ম ও ত্বক তার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিবে (হামীম সাজদাহ ৪১/২০-২৩)। অতএব হে মানুষ! অবিচ্ছেদ্য সাক্ষীদের থেকে সাবধান হও। হে দায়িত্বশীলগণ! ক্বিয়ামতের দিন নিজের আমলনামা নিজে পাঠ করার জন্য প্রস্ত্তত হও (বনু ইস্রাঈল ১৭/১৪)।
উপরোক্ত আলোচনা থেকে আমরা বুঝতে পারলাম ইসলামে জবাবদিহীতার গুরুত্ব কতটা বেশি!। বাংলাদেশের সংবিধানের মূলনীতিতে আমরা তাই স্বচ্ছতা ও জবাবদিহীতা যুক্ত করতে চাই। সংবিধানের মূলনীতিতে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহীতা থাকা মানে হলো,
১. সরকারপ্রধান তার সকল কাজ, সিদ্ধান্ত ও চুক্তির বিষয়ে জনগণের সামনে স্বচ্চ থাকবে।
২. যে কোনো সিদ্ধান্ত ও কর্মকান্ডের ব্যাপারে জনগণের কাছে জবাব দিতে বাধ্য থাকবে।
৩. সরকার ও সরকারি প্রতিষ্ঠানের আয় ব্যয় জনগণের সামনে উন্মূক্ত থাকবে।
৪. সরকার ও সরকারের কোনো প্রতিষ্ঠানকে সংবিধান এমন কোনো স্বাধীনতা দিবে না যে, তারা যা ইচ্ছা সিদ্ধান্ত নিতে পারবে।
৫. রাষ্ট্রের সকল পর্যায়ের কর্মকর্তা ও ক্ষমতাসীন ব্যাক্তিগণ নিজেকে জনগণের সেবক ভাবতে বাধ্য থাকবেন।
৬. দুর্নীতির সয়লাব বন্ধ হবে।
৭. স্বৈরাচার সৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা কমে যাবে।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন