এদেশে নির্বাচন ব্যবস্থাকে চূড়ান্তরূপে ধ্বংস করে দেয় আওয়ামী লীগ। আরেকটু প্রিসাইজলি বলতে গেলে আওয়ামীলীগের মধ্যে লুকিয়ে থাকা সিরাজুল আলম খানের গোপন সংগঠন 'নিউক্লিয়াস' এই ঘটনাটা ঘটিয়েছে। ১৯৭০ সালে পাকিস্তানের সাধারণ নাগরিকরা জানতোই না যে, কেন্দ্র দখল করে জাল ভোট দিয়ে জেতা যায়। এই ধরণের প্র্যাকটিস সেসময় ছিল না, যা এখন আছে।
১৯৭০ সালে সভ্যতাকে বিসর্জন দিয়ে অসভ্যের মতো ছাত্রলীগের কর্মীরা কেন্দ্র দখল করে প্রায় সব আসনে মুসলিম লীগের প্রার্থীকে হারিয়ে দেয়। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান এই আনফেয়ার ইলেকশনটিকে পরোয়া না করে অসভ্য শেখ মুজিবকে বিজয়ী ঘোষণা করে। শেখ মুজিব ও তার দলের টার্গেট ছিল জাল ভোট দিয়ে পূর্ব পাকিস্তানে সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়া। কিন্তু মুসলিম লীগের প্রার্থীদের অপ্রস্তুতি ও ইয়াহিয়া সরকারের অদক্ষতায় শেখ মুজিব শুধু পূর্ব পাকিস্তান নয়, পুরো পাকিস্তানেরই সংখ্যাগরিষ্ঠ দলে পরিণত হয়। অথচ আওয়ামী লীগ বাংলা ছাড়া অন্য চার প্রদেশে কাউকে নমিনেশন পর্যন্ত দেয়নি।
যাই হোক এরপর ১৯৭৩ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মূল প্রতিদ্বন্দ্বি জাসদ। জাসদ ছিল তারা, যারা আগে আওয়ামী লীগে আড়ালে নিউক্লিয়াস করতো। জাসদ ও আওয়ামী লীগ দুই পক্ষই জানে কীভাবে কেন্দ্র দখল করে জিততে হয়। উভয়ই মারামারি খুনোখুনি করে। যেহেতু রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় ফ্যাসিস্ট মুজিব ছিল তাই জাসদকে খুবই হতাশাজনক পরাজয় বরণ করতে হয়। ৩০০ আসনের মধ্যে ১ আসন পায় জাসদ। পায় বলা ঠিক হবে না, ১ টি আসন দেওয়া হয় জাসদকে। সেই ইলেকশনে মুজিব হেলিকপ্টার দিয়ে ব্যালট বাক্স তুলে নিয়ে এসে খন্দকার মুশতাককে বিজয়ী ঘোষণা করেন।
এরপর ১৯৭৭ সালে একটি প্রেসিডেন্ট জিয়া একটি গণভোট করেন। ভোটারদের কাছে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, আপনি কি রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের প্রতি এবং তার দ্বারা গৃহীত নীতি ও কার্যক্রমের প্রতি আস্থাশীল?
এই ইলেকশনে ৯৮.৯% মানুষ হ্যাঁ ভোট দেয়। এই ইলেকশন ছিল একেবারেই নিরুত্তাপ। কোনো সন্ত্রাসী কর্মকান্ড নেই। জোরপূর্বক ভোট দেওয়া হয়নি। তবে কথিত আছে এখানে কারচুপি করা নির্বাচনে দায়িত্ব পালনরত প্রিসাইডিং অফিসার দ্বারা।
একই ধারাবাহিকতায় প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের আমলে ১৯৭৯ সালে অনুষ্ঠিত ২য় জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জিয়াউর রহমানের দল দুই তৃতীয়াংশ আসনেরও বেশি দখল করে। আওয়ামী লীগ ৩৯টি আসনে বিজয়ী হয়ে প্রধান বিরোধী দলের মর্যাদা লাভ করে। মুসলিম লীগ, জামায়াতে ইসলামী ও নেজামে ইসলাম পার্টি মিলে আই.ডি.এল (ইসলামী ডেমোক্রেটিক লীগ) নামে নির্বাচনে ১৮ টি আসন পায়।
এ নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ না হলেও ৭৩ এর নির্বাচনের মতো একচেটিয়া সীট দখলের অপচেষ্টা করা হয়নি। শেখ মুজিবের নগ্ন ডাকাতি এখানে হয়নি। তবে জিয়াউর রহমান কূটকৌশলী ও বুদ্ধিমান ছিলেন। নির্বাচনে যত দল যোগদান করেছে সে সব দলের প্রধানগণ যাতে সংসদে আসেন সেদিকে খেয়াল রেখেছেন। ৭৭ সালের মতো নির্বাচন কমিশন ও প্রশাসনকে নিয়ন্ত্রণ করে ইচ্ছেমত ফলাফল নিয়ে এসেছেন।
এই প্রসঙ্গে শহীদ গোলাম আযম বলেন, //জিয়ার শাসনামলের প্রধানমন্ত্রী শাহ আজীজুর রহমান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার সিনিয়ার ছিলেন। সমসাময়িক হিসাবে কিছুটা সম্পর্ক ছিল। পরবর্তীতে রাজনৈতিক অঙ্গনে বন্ধুত্ব গড়ে উঠে। প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে যোগাযোগ ও সাক্ষাত হতো। তাঁর কাছ থেকে জিয়াউর রহমানের রাজনৈতিক ও নির্বাচনী পলিসি সম্পর্কে কিছু জানার সুযোগ পেয়েছি।
তিনি জিয়ার নির্বাচনী পলিসির প্রশংসা করতে গিয়ে জানালেন যে, দলীয় প্রধানগণ যাতে সংসদের বাইরে আন্দোলন করা প্রয়োজন মনে না করেন সে উদ্দেশ্যে তাদেরকে নির্বাচিত হবার সুযোগ দিয়েছেন। সর্বহারা দলের তোয়াহা প্রথম ভোট গণনায় পরাজিত হওয়া সত্ত্বেও শেষ পর্যন্ত নির্বাচিত বলে ঘোষণা করা হয় । এ দ্বারা বুঝা গেল যে জিয়াউর রহমানের ইচ্ছার বিরুদ্ধে কারো বিজয়ী হওয়া সম্ভব হয়নি।//
গোলাম আযম আশা করেছিলেন জিয়া যেহেতু বহুদলীয় গণতন্ত্র চালু করেছেন, সেক্ষেত্রে তিনি সুষ্ঠু নির্বাচনের প্রতি আগ্রহী হবেন। কিন্তু ১৯৭৯ সালের নির্বাচনে তিনি হতাশ হলেন। এই প্রসঙ্গে অধ্যাপক গোলাম আযম বলেন, //শেখ মুজিবের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ, রাজনীতি ও নির্বাচনকে বাকশালী স্বেচ্ছাচারে পরিণত করলো। জিয়াউর রহমান বহুদলীয় গণতন্ত্র চালু করার ব্যবস্থা করলেন। কিন্তু অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের উদ্দেশ্য সম্পূর্ণ সফল হয়নি। গণতন্ত্রের অগ্রগতি ও বিকাশের জন্য নিরপেক্ষ নির্বাচন অপরিহার্য। তা না হলে নির্বাচন নিতান্তই প্রহসন মাত্র।//
শহীদ অধ্যাপক গোলাম আযম তখন থেকেই বিকল্প পদ্ধতিতে নির্বাচনের কথা ভাবতে থাকলেন। গবেষণা করতে থাকলেন। প্রতিটি সম্ভাবনার সাইড ইফেক্ট চিন্তা করলেন। এরপর তিনি কেয়ারটেকার সরকার ব্যবস্থার কথা ভাবলেন। এরপর এটি তিনি জামায়াতের নির্বাহী পরিষদে উত্থাপন করেন। দীর্ঘ আলোচনা পর্যালোচনার পর জামায়াত সর্বসম্মতভাবে এ প্রস্তাব অনুমোদন করে।
অধ্যাপক গোলাম আযম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ছাত্র ছিলেন ও কারমাইকেল কলেজে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক ছিলেন। তাই এই বিষয়ে তাঁর একাডেমিক পদচারণা ছিল। একইসাথে তিনি রাজনৈতিক নেতা হওয়ায় বিষয়টি তাঁর জন্য সুবিধা হয়েছে।
কেয়ারটেকার শব্দটি কীভাবে এসেছে এই নিয়ে তিনি বলেন, //গণতান্ত্রিক দেশের নির্বাচনের সময় এক ধরনের কেয়ারটেকার সরকারই থাকে। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী রাজনৈতিক ব্যক্তি ও দলীয় নেতা হওয়ায় সরকার পরিচালনার সুযোগে নির্বাচনকে প্রভাবান্বিত করার সম্ভাবনা থাকে। বৃটেনে দীর্ঘ ঐতিহ্যের কারণে এমন সুযোগ গ্রহণ না করলেও আমাদের দেশে অবশ্যই আছে। এ ভাবনা থেকে অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য অরাজনৈতিক ও নির্দলীয় কেয়ারটেকার সরকার পদ্ধতির প্রস্তাব করা হয়েছে। আমি “কেয়ারটেকার সরকার” পরিভাষার আবিষ্কারক নই। এ পরিভাষা রাষ্ট্র বিজ্ঞানেই আমি পেয়েছি। আমার প্রস্তাবে শুধু 'নির্দলীয় ও অরাজনৈতিক সরকারের' পরিচালনার কথাটুকুই নতুন সংযোজন বলা যায়।//
অধ্যাপক গোলাম আযম প্রস্তাবিত কেয়ারটেকার মডেলের মূলকথা ছিল,
“নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের উদ্দেশ্যে সুপ্রিম কোর্টের কর্মরত (অবসরপ্রাপ্ত নয়) প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে একটি অরাজনৈতিক ও নির্দলীয় কেয়ারটেকার সরকার গঠন করতে হবে। এ সরকারে মন্ত্রীর পদমর্যাদায় এমন লোকদেরকে নিয়োগ করতে হবে যারা রাজনৈতিক ব্যক্তি হিসাবে পরিচিত নন এবং কোন রাজনৈতিক দলের সাথে সম্পৃক্ত নন। এ সরকার দলনিরপেক্ষ লোকদের দ্বারা নির্বাচন কমিশন গঠন করবেন। নির্বাচন অনুষ্ঠানের পর নতুন সরকার গঠিত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত এ সরকার কায়েম থাকবে এবং প্রধান বিচারপতি নিজ পদে প্রত্যাবর্তন করবেন।”
গোলাম আযম সাহেব বলেন, //মূল প্রস্তাবে কর্মরত প্রধান বিচারপতিকে সরকার প্রধান করার কথা এ কারণেই বলা হয়েছে যে, তিনি নির্বাচনের পরই পূর্বপদে ফিরে যাবেন বিধায় তাঁর মধ্যে রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষের সুযোগ কম থাকবে। এ অবস্থায় তাঁর কোন দলের প্রতি পক্ষপাতিত্ব করার কোন আশংকা থাকবে না।//
১৯৮০ সালের ৭ই ডিসেম্বরে রমনায় এক সাংবাদিক সম্মেলনে জামায়াতের ভারপ্রাপ্ত আমীর জনাব আব্বাস আলী খান সর্বপ্রথম জামায়াতের পক্ষ থেকে এ দাবীটি উত্থাপন করেন। ১৯৮১ সালের মে মাসে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানকে নিহত করার ফলে ঐ বছর নভেম্বরে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বিচারপতি আবদুস সাত্তার নির্বাচিত হন এবং নতুন সরকার গঠন করেন ১৯৮২ সালের মার্চে সেনাপ্রধান জেনারেল এরশাদ সামরিক শাসন কায়েম করে গণতন্ত্রের ধারা স্তব্ধ করে দেন।
চলবে...
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন