২ জুল, ২০২৫

নির্বাচন, পিআর, খালেদা জিয়া ইত্যাদি (পর্ব ২)

 ১৯৮২ সালে জিয়ার মৃত্যু ও এরশাদের সেনাশাসন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে গণতান্ত্রিক পরিস্থিতির চরম অবনতি হয়। সেক্ষেত্রে রাষ্ট্র সংস্কারের আলোচনা পর্দার আড়ালে চলে যায়। জামায়াত দুইটা প্রস্তাবনা নিয়ে ১৯৮৪ সালে আবারো রাজনীতিতে গণতান্ত্রিক পরিবেশ তৈরির চেষ্টা চালায়।

১. নির্বাচনকালীন কেয়ারটেকার সরকার
২. আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বমূলক পদ্ধতি (পিআর পদ্ধতি)

দুইটা পদ্ধতিই বাংলাদেশের জন্য নতুন। বাংলাদেশে ১৯৩৭ সালের ইংরেজদের দেখানো পদ্ধতিতে অর্থাৎ First-past-the-post voting পদ্ধতিতে ইলেকশন হয়ে আসছে। নতুন পদ্ধতিতে যাওয়ার ব্যাপারে সরকারি দল অর্থাৎ এরশাদের জাতীয় পার্টির তো একমত হওয়ার প্রয়োজন নেই। দুর্ভাগ্যজনকভাবে বিরোধী দলগুলোও এই বিষয়ে একমত হয়নি।

এদিকে এরশাদ ১৯৮৬ সালে বিরোধীদের দাবির প্রেক্ষিতে একটি নির্বাচন করার পরিকল্পনা করে। দেশে বিরোধীদের মধ্যে স্পষ্টত দুইটা জোট বিদ্যমান ছিল। একটি আওয়ামীলীগ নেতৃত্বাধীন অন্যটি বিএনপির নেতৃত্বাধীন।

রাজনৈতিক জোটভুক্ত দলসমূহ ভেতরে ভেতরে নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছিল, অপরদিকে প্রকাশ্যে নির্বাচনবিরোধী বক্তব্যও দিয়ে যাচ্ছিল। বড় দুই দলের মধ্যে রাজনৈতিক প্রতিযোগিতা থাকাই স্বাভাবিক। কোনো দলই নির্বাচনে অংশগ্রহণের কথা না বলায় পারস্পরিক সন্দেহ বিরাজ করছিল। এ পরিবেশে শেখ হাসিনা চট্টগ্রাম লালদিঘি ময়দানে দলীয় জনসভায় বলেন, এরশাদ সরকারের পরিচালনায় নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা অর্থহীন। যারা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে এরশাদের গদি মযবুত করবে তারা 'জাতীয় বেঈমান' হিসেবে গণ্য হবে।

অথচ ময়দানে গুজব রটেছে যে, ১৫ দলীয় জোটের শরীক দলগুলো নির্বাচনে আসন দাবি করে রীতিমতো দর কষাকষি চালাচ্ছে। তখন জামায়াত ও বিএনপির মধ্যে নির্বাচনী সমঝোতার আলোচনা চলছে। খালেদা জিয়ার পক্ষ থেকে কর্নেল মুস্তাফিজ ও জামায়াতের লিয়াজোঁ কমিটির মধ্যে আনুষ্ঠানিক বৈঠকাদি চললো। প্রথমে বিএনপির পক্ষ থেকে জামায়াতকে মাত্র ২০টি আসন ছেড়ে দেওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হয়। কয়েক দিনের দর কষাকষির পর কর্নেল মুস্তাফিজ ৫০টি আসন জামায়াতকে ছেড়ে দিতে সম্মত হলে শেষ পর্যন্ত জামায়াত তা মেনে নেয়।

পরে জানা গেল, জামায়াতকে এত বেশি আসন ছেড়ে দিতে সম্মত হওয়ায় নিজ দলীয় বৈঠকে কর্নেল মুস্তাফিজ নাজেহাল হন। খালেদা জিয়া তাকে রীতিমত অপমান করেন এবং জামায়াতের সাথে আলোচনা বন্ধ করে দেন। ফলে বিএনপির সাথে নির্বাচনী সমঝোতার চুক্তি হলেও খালেদা জিয়া সেই প্রচেষ্টাকে নষ্ট করে দেন কোনো ঘোষণা না দিয়েই।

নির্বাচনে অংশগ্রহণের ব্যাপারে রাজনৈতিক জোট ও দলসমূহের কোনো সুস্পষ্ট সিদ্ধান্ত ঘোষণা না হওয়ায় এরশাদ ঘোষণা করলো, ১৯ মার্চ পর্যন্ত রাজনৈতিক দলগুলোকে সিদ্ধান্তে পৌঁছতে হবে। ২০ মার্চ জাতির উদ্দেশে সে নির্বাচন সম্পর্কে ভাষণ দেবে। যারা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে না তাদেরকে নির্বাচনবিরোধী কোনো তৎপরতা চালাতে দেওয়া হবে না। রাজনৈতিক দলগুলোর অভ্যন্তরীণ দুর্বলতার খবর সে হয়তো জানতো। নির্বাচনে অংশগ্রহণের বিরোধী কোনো রাজনৈতিক কর্মসূচি ময়দানে না থাকায় এরশাদ পূর্ণ আস্থার সাথেই ঐ সতর্কবাণী উচারণ করলো।

আওয়ামী লীগ ও বিএনপি ১৯ মার্চ এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার উদ্দেশ্যে বৈঠকে বসবে বলে গণমাধ্যমকে জানালো। জামায়াতও ঐ একই তারিখে বৈঠকে বসার সিদ্ধান্ত নিল। জামায়াতের আগেই সিদ্ধান্ত নেওয়া ছিল দুই জোটের কোনো একজন নির্বাচনে অংশ নিলে জামায়াতও নির্বাচনে অংশ নেবে। জামায়াতের উদ্দেশ্য ছিল নির্বাচনের মাধ্যমে নামকাওয়াস্তে হলেও সেনা শাসককে জনগণের মুখোমুখি করা। যাতে এরশাদের স্বৈরাচারী মনোভাবে কমে আসে।

জামায়াত ঘোষণাপত্র প্রস্তুত করে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় রইলো। জামায়াতের লিয়াজোঁ কমিটির আহ্বায়ক শহীদ আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ বিএনপি ও আওয়ামী লীগের সাথে ফোনে যোগাযোগ রাখছিলেন। জামায়াতের সিদ্ধান্ত পত্রিকায় পাঠানোর পূর্ণ প্রস্তুতি সত্ত্বেও ঐ দুই দলের সিদ্ধান্ত না জানা পর্যন্ত অপেক্ষা করছিলো। রাত ১১টা পর্যন্ত তাদের সিদ্ধান্ত জানা গেল না।

আসলে বিএনপি ও আওয়ামীলীগ উভয় দলই বুঝতে পেরেছে নির্বাচনের মাধ্যমে প্রহসন হবে। তাই তারা কেউ আগ বাড়িয়ে নির্বাচনে যাওয়ার ঘোষণা দিতে পারছিল না। আবার নির্বাচনে যুক্ত হলে কিছু সংসদ সদস্য পাওয়া যাবে। যার মাধ্যমে রাষ্ট্রের অংশ হওয়া যাবে, এই ব্যাপারটাও বড় দুই দল হাতছাড়া করতে চাইছিল না।

দৈনিক সংগ্রামের দুজন সাংবাদিক ৩২ নং ধানমন্ডির বাড়িতে আওয়ামী লীগের সংবাদ সংগ্রহের জন্য অপেক্ষায় ছিলেন। বিএনপির খবর মুজাহিদ সাহেব ফোনে নিচ্ছিলেন। রাত ২টার সময় দৈনিক সংগ্রামের সাংবাদিকদ্বয় মোটর সাইকেলে খবর নিয়ে এলেন। খবর এল যে, আওয়ামী লীগ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে; কিন্তু বিএনপি তখন পর্যন্ত কোনো সিদ্ধান্তে পৌছেনি।

বিএনপির তদানীন্তন সেক্রেটারি জেনারেল ওবায়দুর রহমানের সাথে মুজাহিদ সাহেব অব্যাহতভাবে ফোনে যোগাযোগ রাখছিলেন। রাত তিনটায় ওবায়েদ সাহেব মুজাহিদ সাহেবকে জানালেন, একটা টেকনিক্যাল কারণে আমরা এখনো সিদ্ধান্ত নিতে পারলাম না। আগামীকাল সিদ্ধান্ত নেব। আপনাদের সিদ্ধান্ত পত্রিকায় দিয়ে দিন।

অর্থাৎ বিএনপি'র গ্রিন সিগন্যাল নিয়েই জামায়াত নির্বাচনে যাওয়ার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে। ২০ মার্চ (১৯৮৬) বড় বড় হেডিং-এ পত্রিকায় খবর বের হলো, আওয়ামী লীগ ও জামায়াতের নির্বাচনে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে এবং বিএনপি এখনো সিদ্ধান্ত নেয়নি।

বিএনপির টেকনিক্যাল কারণটি কী?

বিএনপির প্রথম সারির আট/দশজন নেতা প্রেসিডেন্ট আবদুস সাত্তারের মন্ত্রী ছিলেন। এরশাদ সামরিক শাসন জারি করার পর তাদের বেশ কয়েকজনকে কারাবদ্ধ করেন এবং তাদেরকে পরবর্তী নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার অযোগ্য বলে অন্যায়ভাবে অর্ডিন্যান্স জারি করেন। তাদের মধ্যে ওবায়দুর রহমানও একজন।

বিএনপিকে নির্বাচনমুখী করার উদ্দেশ্যে ঐ অর্ডিন্যান্স বাতিল করে তাদের নির্বাচনে অংশগ্রহণের সুযোগ দেওয়ার ওয়াদাও এরশাদ করেছিলেন। তবে তা গোপনে। ১৯ মার্চ সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় পর্যন্ত ঐ ওয়াদা পূরণ না করায় বিএনপি সমস্যায় পড়ে গেল।

বিএনপি আশা করেছিলো পরের দিন এরশাদ তার কথা রাখবে। ওয়াদা পূরণের অপেক্ষায় থাকার পর বিএনপি বুঝতে পারল, এরশাদ তাদের ধোঁকা দিয়েছে। বিরোধীদের মধ্যে বিএনপিই সবচেয়ে পপুলার দল ছিল। তাই শেষ সময়ে এরশাদ এই দলকে পঙ্গু করে দেওয়ার চেষ্টা করে।

এরশাদের সাথে করা গোপন চুক্তি এরশাদ রাখে নি। তাই নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দিল খালেদা জিয়া। নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার কারণে হাসিনার দেওয়া 'জাতীয় বেঈমান' উপাধিটি আওয়ামী লীগের প্রতি সার্থকভাবে প্রয়োগ করল বিএনপি। আসল যে কারণে বিএনপি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারল না, তা তো জনগণের নিকট প্রকাশ করা চলে না। তাই তারা এরশাদের বিরুদ্ধে কোনো বক্তব্য না দিয়ে নির্বাচনে অংশ নেওয়া আওয়ামী লীগকে স্বৈরাচারের দোসর হিসেবে আখ্যা দিলো। বিএনপি এই ঘটনায় নিজেদের নেতা খালেদা জিয়াকে "আপোষহীন নেত্রী" ঘোষণা করলো।

এরশাদ সফলভাবে বিরোধীদলগুলোর মধ্যে অনৈক্য তৈরি করতে সক্ষম হলো। অতিকথক হাসিনা নিজের গালি নিজেই খেলো। 'জাতীয় বেঈমান' গালি খেয়ে আওয়ামী লীগ দাবি করল, বিএনপি তাদের সাথে প্রতারণা করেছে। তারা আরো দাবি করল, বিএনপির সাথে তাদের নির্বাচনী প্রার্থীদের তালিকার বিনিময়ও হয়েছে।

জামায়াত তার বিবৃতিতে বিএনপির সাথে এবং তাদের সেক্রেটারি জেনারেলের সম্মতি নিয়ে নির্বাচনে অংশগ্রহণের খবর পত্রিকায় পরিবেশন করেছে। তাই জামায়াতের নির্বাচনে অংশগ্রহণের বিরুদ্ধে বিএনপি কোনো বিরূপ মন্তব্য করেনি। জামায়াত তো নিশ্চিতই ছিল যে, বিএনপিও নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে।

যাই হোক টেকনিক্যাল কারণে বিএনপি নির্বাচনে অংশ না নিলেও বাংলাদেশের বাকী সব রাজনৈতিক দল (২৮টি) ১৯৮৬ সালের ৩য় সংসদ নির্বাচনে অংশ নেয়। এই নির্বাচনও কোনো সুষ্ঠু নির্বাচন ছিল না। তবে এটি মুজিবের কেন্দ্র দখল মডেল নয়, জিয়ার প্রশাসনিক কর্মকর্তা দিয়ে নিজের ইচ্ছেমতো রেজাল্ট ঘোষণার মডেল ছিল। এরশাদ শুধু যতটুকু হলে তার সরকার গঠনের জন্য যথেষ্ট হবে ততটুকুই নিয়েছে। অর্থাৎ ১৫৩ আসন নিয়েছে। জিয়া'র মডেলে ১০ টি রাজনৈতিক দলকে আসন পাইয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করে।

এই নির্বাচনের পরে আবারো জামায়াত বুঝাতে চেষ্টা করে সমস্ত বিরোধী দলগুলোকে, এভাবে নির্বাচন হয় না। বাংলাদেশে নির্বাচন হতে হলে নির্বাচনকালীন নির্দলীয় কেয়ারটেকার সরকার লাগবে। কেয়ারটেকার সরকার বুঝাতে হাসিনা ও খালেদাকে প্রায় ৩ বছর লেগে যায় জামায়াতের। ১৯৮৯ সালে সকল বিরোধী দল কেয়ারটেকার সরকারের ব্যাপারে একমত হয় এবং এই দাবীতে আন্দোলন শুরু করে। বরাবরের মতোই যারা সরকারে থাকে তাদের কেয়ারটেকার সরকারের দরকার হয় না।

এরশাদ এই ব্যবস্থাকে পাগলের প্রলাপ ও আজগুবি পদ্ধতি বলে উল্লেখ করে। কেয়ারটেকারকে গুরুত্ব দিতে গিয়ে গুরুত্ব হারিয়ে ফেলে পিআর পদ্ধতি।

-- চলবে

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন