২৬ জুল, ২০১৮

চেনা মসজিদের অজানা গল্প


বায়তুল মুকাররম মসজিদ। কে না চিনে? বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় মসজিদ। আমি নোয়াখালীর মফস্বলে বেড়ে উঠা মানুষ। বায়তুল মুকাররমে নামাজ পড়া ছিল স্বপ্নের মতো। একবার একটি রাজনৈতিক প্রোগ্রামে অনেকের সাথে এলাম পল্টনে। স্কুলছাত্র ছিলাম বলে নিয়ে আসতে চাইছিলো না কেউ। কিন্তু জোর করে চলে এলাম। 

পল্টন ময়দানে এসে জানতে পারলাম পাশেই বায়তুল মুকাররম। অনেক ভাইকে বললাম ভাই আমাকে একটু নিয়ে চলেন। মসজিদটা একটু দেখবো। কিন্তু কেউ রাজি হলো না দলছুট হয়ে যাওয়ার ভয়ে। প্রচণ্ড গরম। আইসক্রিম আর তরমুজ বিক্রি হচ্ছে স্থানে স্থানে। 

আইসক্রিম খেতে এসে দেখি আমার স্কুলের এক স্যার। সালাম দিলাম। তিনি বললেন ছোট মানুষ তুমি। কেন এলে? আমি কিছু না বলে চুপ করে ছিলাম। তিনি আমাকে আইসক্রিম কিনে দিলেন। বললেন আর কিছু লাগবে কিনা? 

আমি বললাম, স্যার বায়তুল মুকাররমে যোহর নামাজ পড়তে চাই। তিনি বললেন বেশ! আমিও তো চিন্তা করে রাখছি যোহর বায়তুল মুকাররমে পড়বো। এরপর স্যারের পিছে লেগে থাকলাম। যাতে এত মানুষের মধ্যে স্যারকে হারিয়ে না ফেলি। 

সেই আমার প্রথম বায়তুল মুকাররম দেখা ও নামাজ পড়া। অন্যরকম অনুভূতি কাজ করেছিল। আহা আমি বাংলাদেশের সেরা মসজিদে নামাজ পড়ছি। যে মসজিদকে এতদিন পত্রিকায় ও টিভিতে দেখেছি সেটাতে এখন আমি নিজেই। আহা...। চোখ বন্ধ করে এখনো টের পাই ছেলেবেলার সেই অনুভূতি। 

এরকম দুইটা অনুভূতির জন্য অপেক্ষা করছি। এক. সৌদিতে গিয়ে কা'বায় ও নববীতে দাঁড়িয়ে আবেগে আপ্লুত হবো আর চোখের পানি ফেলবো। দুই. জেরুজালেমে গিয়ে অনেক নবীর স্মৃতি বিজড়িত বায়তুল আকসায় সিজদা দিয়ে পড়ে রইবো। জানিনা কবে আল্লাহ তায়ালা আমার ইচ্ছেগুলো কবুল করবেন! 

যাই হোক ফিরে আসি বায়তুল মুকাররমে। এটি পল্টনে অবস্থিত। মসজিদটির আয়তন ৬০ হাজার বর্গফুট। এর ধারণ ক্ষমতা ৪০,০০০। মানে একসাথে ৪০ হাজার মানুষ এখানে নামাজ পড়তে পারে। এই সুবিশাল মসজিদ বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় এবং ধারণক্ষমতা বিবেচনায় এটি পৃথিবীতে দশম বৃহত্তম মসজিদ। 

পাকিস্তান স্বাধীন হওয়ার পর যে ক'জন ব্যক্তি/পরিবার নিজ উদ্যোগে পাকিস্তান গঠনে এগিয়ে এসেছিলেন তাদের মধ্যে বাওয়ানী, আদমজী, ইস্পাহানী অন্যতম। বাওয়ানী পরিবারের লতিফ বাওয়ানী বাংলাদেশে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে ১৫ টি শিল্পকারখানা স্থাপন করে। বাংলাদেশের পাটকে সোনালী আঁশে পরিণত করে মূলত বাওয়ানী, আদমজী ও ইস্পাহানী পরিবার। 

লতিফ বাওয়ানী পূর্ব-পাকিস্তানে একটি দৃষ্টিনন্দন মসজিদ স্থাপনের ব্যাপারে উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন। সে জন্য ঢাকার আলেম সমাজ ও গণ্যমান্যদের নিয়ে একটি কমিটি গঠন করেছিলেন ১৯৫৯ সালে। সেখানে ঠিক হয় এই মসজিদের নাম হবে বায়তুল মুকাররম। কমিটির নাম হয় বায়তুল মুকাররম মসজিদ সোসাইটি। কিন্তু তখনো ঠিক হয়নি মসজিদটি কোথায় স্থাপিত হবে? 

বেশিরভাগ লোক বলেছিলো পুরান ঢাকায় করার জন্য। কিছু লোক বললো নতুন ঢাকায় করা ভালো হবে কারণ সেটা হবে পরিকল্পিত ঢাকা। যেহেতু এটা গ্র্যান্ড মসজিদ হবে তাই পুরান ঢাকায় সম্ভব নয় কারণ সেখানে এত জায়গা নেই। তাহলে? পরে সর্বসম্মতিক্রমে সিদ্ধান্ত হয় এটি পুরান ঢাকা ও নতুন ঢাকার সংযোগস্থলেই স্থাপিত হবে। আর সেটা হবে পল্টনে। 

ঢাকায় যখন এমন আলোচনা চলছিলো তখন পাকিস্তানের শাসক ছিলেন সেনাশাসক স্বৈরাচারী আইয়ুব খান। স্বৈরাচারীদের একটা ব্যাপার থাকে এমনসব আকর্ষণীয় কিছু করা যাতে তারা মানুষদের কাছে ভালো ও ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব হিসেবে স্থান পায়। যেমন বাংলাদেশে এরশাদ নিজেকে ইসলামিক প্রমাণ করার জন্য অনেক কিছু করেছে। আবার এখন হাসিনা নিজেকে তাহাজ্জুদ্গুজার হিসেবে প্রমাণ করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। 

আসলে এরা সবাই আইযুবের শিষ্য। যাই হোক আইয়ুব খানও এমন একটি মসজিদের কথা ভাবছেন যা পাকিস্তানের ঐতিহ্যকে শাণিত করবে। এটা হবে পাকিস্তানের সবচেয়ে বড় মসজিদ। এমন সময় লতিফ বাওয়ানীর প্রস্তাব আইয়ুব খানের কাছে পৌঁছলে তা আইয়ুবের জন্য সহজ হয়ে গেলো। একইসাথে আইয়ুব খান ঢাকাকে সেকেন্ড রাজধানী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে চাইলো। তাই পাকিস্তানের পার্লামেন্টের জন্য শেরে বাংলা নগরে কাজ শুরু করলো। 

জাতীয় সংসদ ভবন ও বায়তুল মুকাররম মসজিদ দুটি মেগা প্রজেক্ট আইয়ুব একইসাথে শুরু করে। লতিফ বাওয়ানী মসজিদের খরচের বড় অংশ বহন করে। সরকার প্রায় সাড়ে আট একর জমি বরাদ্দ দেয় মসজিদের জন্য। মসজিদটি এখন যে স্থানে সেখানে একটি বিশাল পুকুর ছিল, নাম পল্টন পুকুর। সেই পল্টন পুকুর ভরাট করেই মসজিদ স্থাপিত হয়। 

বিশিষ্ট স্থপতি আবদুল হুসেন মুহাম্মদ থারিয়ানিকে মসজিদ কমপ্লেক্সটির নকশার জন্য নিযুক্ত করেন লতিফ বাওয়ানী। থারিয়ানীর বাড়ি ছিল মুম্বাইতে। পরে অবশ্য পাকিস্তানে স্থানান্তরিত হয়েছিলেন। পুরো কমপ্লেক্স নকশার মধ্যে দোকান, অফিস, লাইব্রেরি ও গাড়ি পার্কিংয়ের ব্যবস্থা অন্তর্ভুক্ত হয়। পরবর্তীতে ১৯৬০ সালের ২৭ জানুয়ারি এই মসজিদের নির্মাণ কাজ শুরু হয়। এই মসজিদে একসঙ্গে ৪০ হাজার মুসল্লি নামাজ আদায় করতে পারেন। মসজিদের প্রধান কক্ষটি তিন দিকে বারান্দা দিয়ে ঘেরা। মিহরাবটি অর্ধ-বৃত্তাকারের পরিবর্তে আয়তাকার।

বাইরে থেকে দেখলে বায়তুল মোকাররম মসজিদকে ‘কাবার’ মডেলের মতো মনে হবে। বায়তুল মোকাররম মসজিদটি প্রধানত ৮তলা। নীচতলায় বিপণী বিতান ও গুদামঘর। বাকীগুলো নামাজের জন্য। আল্লাহর ৯৯টি নামের কথা স্মরণ করে মসজিদটির উচ্চতা ৯৯ ফুট করা হয়েছে। 

১৯৬৩ সালে বায়তুল মোকাররম মসজিদের প্রথম পর্বের নির্মাণ কাজ শেষ হয়। ১৯৬৩ সালের ২৫ জানুয়ারি শুক্রবার বায়তুল মোকাররম মসজিদে প্রথম জুমআর নামাজ আদায় করা হয়। আর এর পরদিন ২৬ জানুয়ারি শনিবার তারাবীহ নামাজ শুরু হয়।

১৯৭২ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর তৎকালীন মুজিব সরকার সমাজতন্ত্রীদের পরামর্শে লতিফ বাওয়ানীর সমস্ত শিল্পকারখানা ও প্রতিষ্ঠান দখল করে নেয়। বাওয়ানী পরিবার প্রায় নিঃস্ব অবস্থায় পাকিস্তানে ফিরে যায়। অবশ্য পশ্চিম পাকিস্তানেও তাদের ব্যবসা ছিলো। পাকিস্তান গঠনের পর এই বাওয়ানী, আদমজী ও ইস্ফাহানীরা পূর্ব পাকিস্তানকে সমৃদ্ধ করার কাজ করেছিলো। এখনকার ব্যবসায়ী মতো শুধু ব্যবসা করেনি তারা। এই বাওয়ানীরা শত শত স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা, মসজিদ, পাঠাগার স্থাপন করেছে। বাংলা শিল্প সাহিত্যের বিকাশে বহু সম্মাননা ও পুরষ্কারের আয়োজন করেছে।

এদেশের কাঁচামাল থেকে যাতে এদেশের মানুষ উপকৃত হয় সেই ব্যবস্থা করেছে। হাজার হাজার মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করেছে এই লতিফ বাওয়ানী। যিনি আমাদের বায়তুল মুকাররমের মতো মসজিদ উপহার দিয়েছেন আমরা তাকে গলাধাক্কা দিয়েছি শুধুমাত্র অবাঙালি হওয়ার অপরাধে। এমন নয় যে তিনি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন। এমনও নয় তিনি পশ্চিম পাকিস্তানী। তিনি ভারতের গুজরাট থেকে আসা মুহাজির মুসলিম।   

যাই হোক, এবার আসি খতিবদের প্রসঙ্গে। বায়তুল মোকাররম মসজিদের প্রথম খতিব ছিলেন মাওলানা আবদুর রহামন বেখুদ (রহ:)। তিনি ১৯৬৩ সালে এই মসজিদের খতিব হন। এরপরে খতিব হন মাওলানা ক্বারী উসমান মাদানী (রহ:)। তিনি এ মসজিদের খতিব ছিলেন (১৯৬৩-১৯৬৪) মাত্র এক বছর। পরবর্তী খতিব ছিলেন মুফতী সাইয়েদ মুহাম্মদ আমীমুল ইহসান। তিনি ১৯৬৪-১৯৭৪ সাল পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন। এরপর এ মসজিদের খতিব হন মুফতী মাওলানা মুইজ (রহ:)। 

তিনি দায়িত্ব পালন করেন ১৯৭৪-১৯৮৪ সাল পর্যন্ত। এরপরে বায়তুল মোকাররম মসজিদের দায়িত্ব পালন করেন খতিব মাওলানা উবায়দুল হক (রহ:)। তিনি ছিলেন দেশ বরেণ্য আলেম। তিনি খতিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন ১৯৮৪-২০০৯ সাল পর্যন্ত। 

তারপর ২৪ বছর যিনি এখানে ইমামের দায়িত্ব পালন করেছিলেন সেই মুফতি মাও: নুরুদ্দীন সাহেব এক বছর ভারপ্রাপ্ত খতিবের দায়িত্ব পালন করেছিলেন। বর্তমানে বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদের খতিবের দায়িত্বে রয়েছেন প্রফেসর মাওলানা মো: সালাহ্উদ্দিন। তিনি ৫ জানুয়ারি ২০০৯ সালে এ মসজিদের খতিব নিযুক্ত হন।

২৪ জুল, ২০১৮

তালিবানঃ একই সাথে মাদক ও ইসলামের লালন করে যারা!


শিরোনামটা অত্যন্ত উদ্বেগজনক সেই সাথে ভয়ংকরও। তালিবান, যারা মনে করে তারাই পারে একমাত্র পৃথিবীতে ইসলামকে নিয়ে আসতে। তবে তারা কতটুকু ইসলামকে প্রতিষ্ঠা করেছে সেটা প্রশ্নবিদ্ধ হলেও তারা সারা পৃথিবীতে এখন হেরোইন সাপ্লাইয়ের কাজ করছে। এই কাজটা তারা বেশ ভালোভাবেই পারছে। এই নিয়ে কারো কোন কনফিউশন নেই। 

আফগানিস্তানের জন্য একটি দুঃখজনক ঘটনা হলো আফিম বা পপি চাষ। আফিম চাষে আফগানিস্তান সেরা। প্রতি বছর বিশ থেকে পঁচিশ হাজার টন আফিম উৎপাদন করে তারা। আর এই আফিমের মূল ক্রেতা হলো যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপ। 

আফগানিস্তানের মানুষ আফিম চাষ শিখেছে মূলত কমিউনিস্ট শাসনামলে। আফিম চাষ লাভজনক হওয়ায় বহু কৃষক সহজেই এই চাষের সাথে যুক্ত হয়ে পড়ে। আফগানিস্তান জামায়াতের নেতৃত্বে দীর্ঘ যুদ্ধের পর ১৯৯২ সালে কমিউনিস্ট শাসনের পতন হলে জামায়াতের আমীর শহীদ বুরহান উদ্দিন রব্বানী প্রেসিডেন্ট হন। এবং আফগানিস্তান ইসলামী রাষ্ট্রে রূপ নেয়। 

জামায়াতে ইসলামী আফগানিস্তানে পপি চাষ নিষিদ্ধ করে। কিন্তু অল্প কিছুদিন পরেই আবারো আফগানিস্তানে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়। ইসলামী রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে কোন কারণ ছাড়াই বিদ্রোহ করে হিজবে ইসলামের প্রধান গুলুবুদ্দিন হেকমতিয়ার। দেশের বিশৃঙ্খল অবস্থায় CIA স্পন্সরড আল কায়েদার তত্ত্বাবধানে শুরু হয় তালিবানের উত্থান। 

১৯৯৬ সালে বিদেশী শক্তির (আমেরিকা ও পাকিস্তান) সহায়তায় তালিবান জামায়াতকে হটিয়ে সরকার গঠন করে। তখন অনেক মার্কিন NGO তালিবান সরকারের অনুকূলে যুদ্ধবিদ্ধস্ত আফগানিস্তানকে পুনর্গঠনে কাজ শুরু করে। তারাই আবার কৃষকদের টাকা দিয়ে পপি চাষে উদ্বুদ্ধ করে। 

তালিবান আমলে আবারো পপি চাষ শুরু হয়। বেশি লাভ পায় বলে অল্প দিনের মধ্যেই প্রচুর কৃষক পপি চাষ শুরু করে। আফগানিস্তানকে কেন্দ্র করে পাকিস্তান ও ইরান সীমান্তের কৃষকেরাও এই চাষ শুরু করে। মাদক চাষের জন্য পৃথিবীতে এই অঞ্চলের নাম নতুন নাম হয় গোল্ডেন ক্রিসেন্ট। 

বিষয়টা তালিবান সরকারের ইমেজের সাথে সাংঘর্ষিক হওয়ায় তারা এটা পপি চাষ বন্ধ করার ব্যবস্থা করে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সফলতা বেশি আসে নি। তারপরও তারা চেষ্টা চালিয়ে এসেছিলো। 

২০০১ সালে আফগানিস্তানে মার্কিন আগ্রাসন হওয়ার পর আফগানিস্তানে আবারো পপি চাষ বেড়ে যায়। এবার মার্কিনীরা পরোক্ষ ভূমিকা রাখলেও প্রত্যক্ষ ভূমিকা রাখে তালিবানরা। এখন তালিবানরাই সবচেয়ে বড় মাদক ব্যবসায়ী। এর মাধ্যমে তাদের আয় হয় সবচেয়ে বেশি। 

কালক্রমে এখন আফগানিস্তান সবচেয়ে বেশি আফিম উৎপাদনকারী দেশ। আফগান সরকার এটি নিয়ন্ত্রনের জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যাচ্ছে। আফগানিস্তানে যা আফিম তৈরি হয় তার ৯৫% তৈরী হয় তালিবান নিয়ন্ত্রনাধীন এলাকায়। 

হেলমান্দে আফগানিস্তানের ৮০% আফিম পপি উৎপন্ন হয়। তালিবানদের মূল এলাকা হেলমান্দ, এটা এক বিরাট মাদক কারখানা। হেলমান্দ বলতে বোঝায় মাদক, পপি ও তালিবান। 

আফগান প্রেসিডেন্ট আশরাফ গণি বলেছেন, মাদক না থাকলে অনেক আগেই আফগান যুদ্ধ শেষ হয়ে যেত। এখন আমেরিকা ও তালিবান উভয়েই মাদকের সাথে যুক্ত। 

আমেরিকার সৈন্যরা অল্প সময়ের মধ্যে পুরো আফগানিস্তান দখলে নিলেও অল্প কিছু অঞ্চলে তালিবানরা বহুদিন শাসন করছে। আফগান সরকার মনে করে তালিবানদের বাঁচিয়ে রাখছে মার্কিনীরাই। তালিবানরা নিশ্চিহ্ন হলেই মার্কিনীদের আফগানিস্তান ছাড়তে হবে। কিন্তু সেটা মার্কিনীরা চায় না। 

একদিকে কপট যুদ্ধ লাগিয়ে রাখছে অন্যদিকে পপি চাষ করে যাচ্ছে। কানাডায় পাওয়া হেরোইনের ৯০ শতাংশ ও যুক্তরাজ্যের ৮৫ শতাংশ পরিমাণ হেরোইনের উৎস আফগানিস্তান। ২০১৭ সালের ইউরোপীয় মাদক রিপোর্ট মতে ইউরোপে পাওয়া হেরোইনের অধিকাংশই গোল্ডেন ক্রিসেন্টে উৎপাদিত। 

বর্তমান আফগানিস্তানে তালিবানদের সাথে মার্কিনীদের যুদ্ধ তালিবানদের জন্য আশির্বাদ। এখন হেলমান্দের একজন তালিবান কমান্ডার গড়ে মাসে দশ লাখ ডলার আয় করে মাদক ব্যবসায়ের মাধ্যমে।  

তবে আশার দিক হলো আফগান সরকার এই আফিম চাষ রোধে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে পারছে কয়েক বছর ধরে। আফিম চাষ লাভজনক হওয়ায় চাষীরা এই চাষে খুব আগ্রহী। আফগান সরকার এখন গোলাপ চাষে উদ্বুদ্ধ করছে কৃষকদের। 

দেশটির অনেক কৃষকই আফিম চাষ বাদ দিয়ে গোলাপ চাষে মজেছেন। সে গোলাপ থেকে তৈরি হচ্ছে গোলাপজল আর তেল। সেগুলো ছড়িয়ে পড়ছে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে। 

নানগারহার আফগানিস্তানের একটি প্রদেশ। এটি পাকিস্তানের সীমান্তে এবং তালিবানদের উৎপাতও রয়েছে এখানে। সেখানে বহুদিন ধরে সরকার আফিমমুক্ত করার চেষ্টা চালিয়ে আসছে। 

‘নানগারহারের জন্য গোলাপ’ প্রকল্পের আওতায় চাষীরা আফিমের জগৎ ছেড়ে গোলাপের জগতে পা রেখেছেন। এটি আফগানিস্তান ও জার্মানির যৌথ উদ্যোগ। নানগারহারের আটশর বেশি চাষী গোলাপ চাষ করে লাভবান হচ্ছেন। চাষীরা জানিয়েছেন সরকারি সুবিধা ও কষ্ট কম হওয়ায় এই চাষ পপি চাষের চাইতেই লাভজনক হচ্ছে দিনকে দিন। 

আফগানিস্তানে মাদক নির্মূল হবে, যুক্তরাষ্ট্র বের হয়ে যেতে বাধ্য হবে। শুধু আফগানিস্তান নয়, সারা পৃথিবী মাদকমুক্ত হবে। এই কামনাই করছি।

তথ্যসূত্র

১৭ জুল, ২০১৮

ঢাকার সবচেয়ে পুরনো মসজিদের ছোঁয়া


এই যে মসজিদের শহর ঢাকা, বলতে পারবেন কোন মসজিদটি ঢাকা শহরের প্রথম মসজিদ?

একটু ভড়কে যাওয়ার মতই প্রশ্ন। আসলে এই ইতিহাস কোথাও লিখিত নেই। প্রথমে ঢাকার কোথায় মসজিদ স্থাপিত হয়েছে এটা আসলেই জানা যায় না। তবে বর্তমানে ঢাকার মসজিদ্গুলোর মধ্যে কোনটি সবচেয়ে পুরনো তা বলা যায়। এক অর্থে এটাই এখন ঢাকার ১ম মসজিদ।

রাতেই ঠিক করে ফেললাম বিনত বিবির মসজিদে যাবো। গুগল ম্যাপ দেখে বুঝে নিলাম কত সময় লাগতে পারে।

জুমার নামাজের বেশ আগেই আমরা তিনজন রওনা হলাম পুরান ঢাকার নারিন্দায়। যেখানে আছে ঢাকার সবচেয়ে প্রাচীন মসজিদ বিনতে বিবির মসজিদ।

সায়েদাবাদ পর্যন্ত বাসে করে গেলাম। এরপর রিকশা নিয়ে রওনা হলাম। রিকশাওয়ালা মামাকে বললাম, চিনেন কিনা? তিনি বেশ আত্মবিশ্বাসের সাথে জানান দিলেন, অবশ্যই চিনেন।

বেশ, তাহলে তো আর চিন্তা নেই! তবে নিত্যদিনের সঙ্গী গুগল ম্যাপ তো সাথে আছেই। মাথার উপর ভীষণ রোদ। চোখটা ভালো করে খুলে তাকাতে পর্যন্ত পারছি না। এমন সময় একজন বলতে লাগলো সেলফি তুলবে। রিকশায় নাকি তিনজনের সেলফি ভালো উঠে।

ভীষণ রোদে সেলফি তুলতে গিয়ে পড়লাম বেকায়দায়। ভালো করে হাসি মুখে ছবি তোলা যাচ্ছে না। রোদের তীব্রতায় কপাল কুঁচকে আছে। এমতাবস্তায় হাসতে গিয়ে আমার চেহারার যে দশা তা নিতান্তই দুর্দশা।

যাই হোক রিকশাওয়ালা একটা মসজিদের সামনে আমাদের নামিয়ে দিলো। গুগোল ম্যাপে তখনো দুই মিনিটের রাস্তা বাকী। জিজ্ঞাসা করলাম এটাইতো সেই মসজিদ? সে বললো, হু এটা তো সেটাই।

বেশ ভালো মসজিদে ঢুকে পড়লাম। কিছুটা পুরাতন ছাপ আছেই। ভিতরে তিনটা কবরও আছে। অবাক হতে শুরু করলাম। অনলাইনে যা পড়ে এসেছি এবং যেসব ছবি দেখেছি তার সাথে তো মিল পাচ্ছি না।

ইতিমধ্যে আমাদের এক সঙ্গী কাতচিৎ হয়ে ছবি তোলা শুরু করেছে। গুগোল ম্যাপ অনুসারেও এটা সেই স্থান নয়। বেকায়দায় পড়ে গেলাম। একজনকে জিজ্ঞাসা করলাম এটা কি বিনত বিবির মসজিদ? তিনি বললেন না, এটা পীরসাব বাড়ির মসজিদ, একটু সামনে হেঁটে গেলেই সেই মসজিদ।

রিকশাওয়ালার উপর প্রচন্ড বিরক্তি প্রকাশ করে হাঁটা শুরু করলাম। যে সঙ্গীটা এতক্ষণ বহু কসরত করে বহু ছবি তুলেছিলো সে রাগে গজরাতে গজরাতে শালীন কিছু গালি দিচ্ছে আর ছবি ডিলেট করছে।

আমরা অল্প কিছুক্ষণ হেঁটেই পেয়ে গেলাম বিনত বিবির মসজিদ। ভাবা যায়, প্রায় সাড়ে পাঁচশত বছর আগের মানুষের স্মৃতি। তাদের স্পর্শ পেতে যাচ্ছি। ভাবছি আর শিউরে উঠছি। কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি ব্যবসায়ী আরাকান আলীর। আল্লাহ তাকে উত্তম প্রতিদান দান করুন।

ঢাকায় প্রাপ্ত শিলালিপিসমূহের মধ্যে বিনত বিবির মসজিদের শিলালিপিটিই ছিল প্রথম মুসলিম শিলালিপি। শিলালিপিটি মূল মসজিদের প্রধান প্রবেশ পথে লাগানো ছিল, কিন্তু বর্তমানে এটা উত্তর দিক থেকে দ্বিতীয় প্রবেশ পথের মাথায় রয়েছে। ঢাকায় এটিই একমাত্র মসজিদ, যার নাম রাখা হয়েছে একজন নারীর নামে।

মসজিদের দেয়ালে স্থাপিত একটি কালো পাথরে ফারসি ভাষায় লিখিত বর্ণনায় রয়েছে, সে-সময় পারস্য উপসাগরের আশেপাশের এলাকা থেকে লোকজন জলপথে এ অঞ্চলে বাণিজ্যে আসতেন। পুরান ঢাকার এই নারিন্দা-ধোলাইখাল এলাকা দিয়ে তখন বয়ে যেত বুড়িগঙ্গার একটি শাখা, যা বুড়িগঙ্গা হয়ে শীতলক্ষ্যায় গিয়ে মিশেছিল। আরাকান আলী নামক এক সওদাগর সে সময় এ এলাকায় বাণিজ্যের জন্য আসেন এবং এখানে বসবাস শুরু করেন। তিনিই নামাজ পড়ার সুবিধার্থে এখানে মসজিদটি নির্মাণ করেছিলেন। এখানে বসবাসকালীন আরাকান আলীর মেয়ে বিনত বিবির আকস্মিক মৃত্যু হয়।

মসজিদের পাশেই সমাধিস্থ করা হয় এবং মেয়ের মৃত্যুর শোকে ছয় মাস পর আরাকান আলীর মৃত্যু ঘটলে তাকেও এখানেই কবর দেয়া হয়। পরবর্তীতে বিনত বিবির নামে মসজিদটির নামকরণ করা হয়। বর্তমানে চারপাশে ঘিঞ্জি দোকান-পাট আর অনেক দোকানের মাঝেই একটি দোকানের মতো জায়গা নিয়ে পড়ে আছে আরকান আলি ও তার মেয়ের খুব সাধারণভাবে পাশাপাশি দুটি কবর। কবরের উপরটা চাদরে মোড়ানো।

সুলতানি আমলে সাধারণভাবে আরবি শিলালিপি পাওয়া গেলেও এখানে আরবির সঙ্গে ফার্সি লিপিরও ব্যবহার লক্ষণীয়। মসজিদটির প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো, এর আককোণবিশিষ্ট পার্শ্ব স্তম্ভ, বর্গাকার কক্ষের ওপর অর্ধ বৃত্তাকার গম্বুজ, উত্তর, দক্ষিণ ও পূর্বদিকে খিলানের ব্যবহার, সাদামাটা অলঙ্করণ, প্লাস্টারে ঢাকা, বাঁকানো কার্নিশ প্রভৃতি।

ছয়-সাত কাঠা জায়গায় গড়ে ওঠা মূল মসজিদটি বর্গাকৃতির এবং এক গম্বুজবিশিষ্ট। এর ভেতরভাগের পরিমাপ প্রতিদিকে ৩.৬৬ মিটার। মসজিদটির ছাদ গোলাকার গম্বুজ দ্বারা আচ্ছাদিত এবং গম্বুজটি সরাসরি ছাদে স্থাপিত। মসজিদের দেওয়ালগুলি ১.৮৩ মিটার পুরু। এর পূর্ব, উত্তর ও দক্ষিণ দিকে একটি করে মোট তিনটি প্রবেশপথ আছে। পশ্চিম দেওয়ালের পেছনের দিকে একমাত্র মিহরাবটি এখন অব্যবহৃত।

মসজিদের দুটো গম্বুজের একটির গায়ে আদি ভবন প্রতিষ্ঠার সাল ৮৬১ হিজরি (১৪৫৭ খ্রি:) লেখা আছে। আরেকটি গম্বুজের লেখা অনুযায়ী ভবনটি প্রথম সংস্কারের মুখ দেখে ১৩৩৭ বঙ্গাব্দে (১৯৩০ খ্রি:)।

২০০৬ সালে মসজিদের পুরান ভবনটি ভেঙে নতুন করে আবার নির্মাণের জন্য কাজে হাত দেয় পরিচালনা কমিটি। সে সময় মসজিদের প্রায় সব অংশই ভেঙে ফেলা হয়। তবে এলাকাবাসীর প্রতিরোধে মসজিদের বারান্দাটুকু বেঁচে যায়। ফলে রয়ে যায়, ঢাকার প্রথম মসজিদের এক টুকরো স্মৃতি।

ঢাকায় মুসলিমদের অবস্থার উন্নতি মূলত মুঘল সেনাপতি ইসলাম খানের ঢাকা আগমনের পর থেকে। তখন থেকেই মূলত ঢাকা ইসলামের শহরে পরিণত হয়। বিনত বিবির মসজিদ ইসলাম খানের ঢাকা আগমনেরও প্রায় ১৫০ বছর আগে তৈরি হয়েছে। তখন বাংলার স্বাধীন সুলতান নাসির উদ্দিন মাহমুদ শাহের আমল চলছিলো।

তখন ঢাকায় মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ না হলেও সারা পৃথিবীজুড়ে মুসলিমদের রাজত্ব ছিল। দিল্লিতে রাজত্ব করছিলেন লোদী রাজবংশের বাহলুল খান লোদী। আর পৃথিবী চালাচ্ছিলেন মুসলিমদের ইতিহাসে খ্যতিমান বীর সুলতান ফাতিহ মুহাম্মদ যিনি মাত্র ২১ বছর বয়সে কনস্টান্টিনোপল জয় করেন।

ইতিহাসের ছোঁয়া নিয়ে বের হয়েছি মসজিদ থেকে। কিন্তু তখনো রোদের তেজ কমেনি। একটু হেঁটে মোড়ে আসতেই দেখি লাচ্ছি বিক্রি হচ্ছে। পুরান ঢাকার নামকরা লাচ্ছি। গলায় ঢেলে দিলাম সেই ঠাণ্ডা লাচ্ছি। আহ শান্তি। ইতিহাস ও লাচ্ছি একসাথেই খেলাম।

১৩ জুল, ২০১৮

গত একশো বছরে ইসলামপন্থীদের ভূমিকা কী?



বিশ্বে ইসলামের পতনের প্রায় ১০০ বছর হতে যাচ্ছে। ১ম বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে মোটামুটি ইসলাম আর মাথা তুলে কোথাও বেশিদিন থাকতে পারেনি। গত একশ বছর আমাদের ইতিহাস পরাজিত হওয়ার ইতিহাস।

যখন কোন আদর্শ জয়ী অবস্থায় থাকে, ট্রেন্ডে থাকে তখন সবাই সে চালু আদর্শকে গ্রহণ করতে চায়। গত ১০০ বছরে তাই মুসলিম হওয়ার ইতিহাস একেবারেই হাতে গোণা। তাই আমরা দুই একজন ইউরোপিয়ান ইসলাম গ্রহণ করলে সেটা আর্টিকেল আকারে প্রকাশ করতে থাকি। অথচ তার আগের সময়গুলোতে গোষ্ঠীশুদ্ধ মানুষ ইসলামে প্রবেশ করতো।

এই যে ধরুণ তুর্কি অঘুজ গোষ্ঠী যখন একটু একটু করে নেতৃত্বে আসতে শুরু করলো তখন তাদের আদর্শ ইসলাম ছিল না। তখন বিশ্বে চালু আদর্শ ছিল ইসলাম। যেহেতু তারা বিশ্বে নিজেদের অবস্থান তৈরি করতে চাইলো তারা ইসলাম গ্রহণ করেছে।

এরপর তুর্কিরা যখন বহু বছর ধরে বিশ্ব শাসন করছে আরবদের শাসনকে উপেক্ষা করে, তখন বন্য মোঙ্গলদের আক্রমণে তুর্কি শাসন লণ্ডভণ্ড হয়েও আবার ঠিক হয়ে গেছে। কারণ মোঙ্গলরা ট্রেন্ডি আদর্শ গ্রহণ করেছে।

লাস্ট ১০০ বছর মানুষ ইসলাম থেকে দূরে সরেছে কেবল। কারণ ইসলাম ট্রেন্ডে ছিল না। ক্যাপিটালিজম, ন্যাশনালিজম, সেক্যুলারজম ও কম্যুউনিজমের হামলায় দিশেহারা হয়েছি আমরা।

ক্যাপিটালিজম ও ন্যাশালিজম খুব সহজে মানুষকে গ্রাস করে। এর জন্য আলাদা পড়ালিখা বা খুব বেশি আদর্শবান মানুষ হওয়ার প্রয়োজন নেই। একটি ব্যাক্তিগত উন্নয়নে ও আরেকটি জাতিগত উন্নয়নে ব্যাপক ভূমিকা রাখে। এদের সাথে ধর্মের খুব একটা বিরোধ খালি চোখে দেখা যায় না। তাই মুসলিমরা সহজেই এর কবলে পড়ে গিয়েছে। এবং এই দুই জাহেলিয়াতকে ইসলাম বিরুদ্ধ বলতে নারাজ সবাই। এই দুই জাহেলিয়াত কখনোই নিজেদের ধর্মের বিরুদ্ধে বা ইসলামের বিরুদ্ধে দাঁড় করেনি বরং সুযোগমত ইসলামকে ব্যবহার করেছে।

আর বাকী দুটো পুরোটাই ঈমান বিধ্বংসী এবং তারা নিজেদেরকে ইসলামের বিরুদ্ধে দাঁড় করেছে। এরপরও তারা অনেক মুসলিমদের কাছে প্রিয় হয়েছে।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর সোভিয়েত ইউনিয়ন খুব শক্তিশালী ছিল। ট্রেন্ডি আদর্শ হিসেবে সবাই কম্যুউনিজম গ্রহণ করেছে বিশেষ করে এই উপমহাদেশের মানুষরা। আফগানিস্তানের মুসলিমরা দলে দলে সবাই কমিউনিস্ট হয়ে সেখানে কমিউনিজমের বিপ্লব করেছে।

৪৭ এ পাকিস্তান গঠনের পর এই আদর্শ সেখানে নিষিদ্ধ হলেও গোপনে এই আদর্শের প্রচার চলতে থাকে। এই আদর্শ যুবক ও ছাত্র সমাজের কাছে বেশ প্রিয় হয়। আওয়ামীলীগ ও মুসলিম লীগে এই আদর্শের ব্যাপক মানুষ ঘাপটি মেরে ছিলো।

সবচেয়ে মজার বিষয় হলো কিছু বিখ্যাত ইসলামপন্থী সেই কমিউনিজমকে ইসলামীকরণের হাস্যকর চেষ্টা করেছিলো। বস্তুত তারা বিদ্বান হিসেবে সমাজে পরিচিত ছিল। এরা বিভিন্ন পত্রিকায় আর্টিকেল ও বই লিখে ইসলামপন্থীদের বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করে গিয়েছে।

অতঃপর নিজেরাই একটি দল গঠন করেছিলো খেলাফতে রব্বানী নামে। তাদের এই দল উচ্চশিক্ষিত সমাজে বেশ সাড়া ফেলেছিলো। এই দলের প্রধান পৃষ্ঠপোষক ছিলেন ড মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ। এই প্রসঙ্গে শহীদ মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী বলেন, খেলাফতে রব্বানীর এক নেতা তাঁকে বলেছিলেন, আমরা বুঝি না আমরা এত ছাত্রকর্মী তৈরী করি কিন্তু তারা সবাই একটু বুঝজ্ঞান হলেই কমিউনিস্ট হয়ে যাচ্ছে।

তখন শহীদ নিজামী বলেন, আপনারা ইসলামের ভিতরে কমিউনিজমের কথা বলছেন কিন্তু তারা যখন ইসলামে কমিউনিজম খুঁজে পায় না তখন তারা সত্যিকারের কমিউনিস্ট হয়ে যায়। এই দলেরই কালচারাল উইং ছিল তমুদ্দুনে মজলিশ। যাদের বাড়াবাড়িতে এক ভয়ংকর জাতীয়তাবাদের জন্ম হয়েছে। সেই থেকে বাড়তে বাড়তে এক সেক্যুলার রাষ্ট্রের সৃষ্টি।

একসময় সোভিয়েত ভেঙ্গে পড়ে। কিন্তু একই আদর্শের আরেকটি মডেল চীনসহ অনেক দেশে প্রতিষ্ঠিত হয়। তাদের প্রভাব এই ভূখন্ডসহ সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ে।

কিন্তু বাংলাদেশে শেখ মুজিব ও জিয়ার আমলে তারা ব্যাপক হত্যাযজ্ঞের শিকার হয়। আর সারা পৃথিবীতেও তারা একটু মিইয়ে পড়ে। মুসলিমদের মধ্যে তাদের প্রভাব অনেক কমতে থাকে।

সেক্যুলারিজম এরই মধ্যে মুসলিমদের মধ্যে বেশ জনপ্রিয় হয়। আগের মতো ইসলামপন্থীদের মধ্যে একটি গ্রুপ আবারো সেই হটকারি সিদ্ধান্ত নিয়ে আগাতে থাকে। তাদের দাবী ইসলামপন্থী হয়েও সেক্যুলার হওয়া যায়। সারা বিশ্বে এখন মুসলিমরা ও ইসলামপন্থীরা ট্রেন্ডি আদর্শ হিসেবে সেক্যুলারিজমকে গ্রহণ করছে।

লাস্ট একশ বছরে আমাদের শত পরাজয়ের মধ্যেও আশার দিক হলো তিনজন মুজাদ্দিদ। জামাল উদ্দিন আফগানী, হাসান আল বান্না আর আবুল আ'লা মওদুদী। তাদের সংগ্রাম ও আন্দোলন সবার কাছেই পরিষ্কার।

গত একশ বছরে এই তিনজন মুজাদ্দিদের সবচেয়ে বড় কাজ ছিলো মুসলিমদের মুসলিম রাখা। মুসলিমদের মধ্য থেকে যাতে ইসলাম হারিয়ে না যায় সে চেষ্টা করা।

আলহামদুলিল্লাহ। গত শতাব্দি আমাদের না হলেও এই তিন মুজাদ্দিদের উসিলায় মুসলিমরা সঠিক পথে থেকেছে। আরব রাষ্ট্রগুলোতে ইখওয়ান এবং এশিয়াতে জামায়াত যুগান্তকারী ভূমিকা রেখেছে।

জামায়াত আফগানিস্তানের মুসলিমদের আবারো ইসলামপন্থী করে তুলেছে। পাকিস্তান, বাংলাদেশ, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়াতে ইসলামী আদর্শের মানুষ তৈরী করেছে অবিরত। বাংলাদেশেসহ এশিয়ার সব মুসলিম দেশে কমিউনিস্টদের আদর্শিক পরাজয় হয়েছে জামায়াতের কাছে।

১০০ বছর ধরে একটি আদর্শ ক্রমাগত পরাজিত হতে থাকলে সেই আদর্শের মানুষ খুঁজে পাওয়া মুশকিল। কিন্তু ইসলামকে তো আল্লাহ মুছে ফেলবেন না দুনিয়া থেকে এটা আল্লাহর ওয়াদা। আর এই কাজ আল্লাহ তায়ালা বাস্তবায়ন করেছেন ইখওয়ান ও জামায়াত দ্বারা।

আমি খুব আশাবাদী। এই শতাব্দি ইসলামের শতাব্দি। যারা পরাজিত অবস্থায় একশ বছর ধৈর্য ধরে থাকতে পারে, আল্লাহ তাদের বিজয় দিবেন ইনশাআল্লাহ। ইসলামেই থাকুন। কোন জাহেলিয়াতকে টেনে নিবেন না।

ক্যাপিটালিজম, ন্যাশনালিজম, সেক্যুলারজম ও কম্যুউনিজমের থাবা থেকে নিজেকে দূরে রাখুন। কোন ইজমের সাফল্য দেখে নিজেকে হারিয়ে ফেলবেন না। মনে রাখবেন আপনার আদর্শই সর্বোত্তম আদর্শ।

৭ জুল, ২০১৮

গান্ধী কেন নোয়াখালী এসেছিলেন? কেনইবা ছাগল হারিয়েছেন?


নোয়াখালীর মানুষ কত খারাপ সেটা বুঝানোর জন্য উদাহরণ হিসেবে অনেকেই বলে থাকেন ‘নোয়াখালীর মানুষ গান্ধীর ছাগল চুরি করেছিলো’। সেরকমই এক অর্বাচীনের সাথে হঠাৎ দেখা হলো। খুব ভাব নিয়ে গান্ধীর ছাগল চুরির বর্ণনা দিয়ে আসছেন। আমি তাকে বিনীতভাবে জিজ্ঞাসা করলাম, গান্ধী কেন নোয়াখালী গিয়েছিলেন?

তিনি একটু অপ্রস্তুত হয়ে পড়লেন। আমি তাকে বললাম নোয়াখালী মনে হয় সেসময় এখনকার কক্সবাজারের মতো ছিল। আপনার মহাত্মা গান্ধী নোয়াখালীতে হাওয়া খেতে এসেছিলেন। সেসময় নোয়াখাইল্যারা তার ছাগল চুরি করেছিলো। এমন কিছু? তিনি আর কিছু বললেন না।

যাই হোক মহাত্মা গান্ধী যাকে বলা হয় তার নাম মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী। তাকে অনেকে মহান আত্মার অধিকারী মনে করেন বিধায় তাকে মহাত্মা বলে থাকেন। আমার কাছে তাকে নিচু আত্মার বলেই মনে হয় বলে আমি কখনোই তাকে মহাত্মা বলি না। সে যাই হোক তার কথা পরে হবে। কেন সে নোয়াখালী গিয়েছিল? কেনইবা তাকে ছাগল হারাতে হয়েছিল? এসব বিষয় প্রাসঙ্গিকভাবে আসবে। তার আগে আমরা অন্য একটা বিষয়ে দৃষ্টিপাত করি।

নোয়াখালীতে ১৯৪৬ সালে একটি দাঙ্গা অনুষ্ঠিত হয়। ভয়াবহ দাঙ্গা। এটি ইতিহাসে নোয়াখালী রায়ট/দাঙ্গা নামে পরিচিত। ইংলিশে এই লিখে সার্চ করলে অনেক আর্টিকেল পাবেন। বাংলায়ও পেতে পারেন। উইকিতেও বেশ ভালো আর্টিকেল আছে এই নিয়ে। আপনি যদি সেগুলো পড়েন তবে আপনি এক তরফা একটি ইতিহাস পাবেন যেখানে বলা হয়েছে হিন্দুদের প্রতি ভয়াবহ নির্যাতনের কথা।

অথচ বর্তমানে নোয়াখালীর অনেকেই সেই দাঙ্গার কথা জানেন না। না জানার কারণ এই ইতিহাস নিয়ে কারো লিখার দরকার হয়নি। যেহেতু এখানে হিন্দুদের ক্ষয়ক্ষতি বেশি হয়েছে তাই তারাই এটা নিয়ে গবেষণা করেছে। দাঙ্গার কিছুদিন পরেই নোয়াখালী পাকিস্তানের অন্তর্গত হওয়ায় মুসলিমরা এই অঞ্চলে জয়ী হয়ে যান।

নোয়াখালীতে দাঙ্গার সূত্রপাত নোয়াখালীতে নয়। মুসলিম লীগের নেতৃত্বে মুসলিমরা পাকিস্তান দাবী করেছে আর অন্যদিকে কংগ্রেসের নেতৃত্বে হিন্দুরা একক ভারতের জন্য দাবী জানাচ্ছে। এই নিয়ে হিন্দু মুসলিম দাঙ্গা লেগেছে কলকাতায়। তারই সূত্র ধরে বিহারে শুরু হয়। কলকাতায় হিন্দু-মুসলিম সমান সমান ছিলো বলে পরিস্থিতি অতটা নাজুক হয়ে পড়ে নি। তবে বিহারে মুসলিমদের অবস্থা হচ্ছিলো অত্যন্ত করুণ।

এখন যেভাবে আরাকান থেকে রোহিঙ্গাদের ঢল নেমেছে। সেসময় বিহার হতে নোয়াখালীতে ঢল নেমেছিলো। নোয়াখালী যদিও একেবারে মুসলিম অধ্যুষিত ছিল না, তবে নানান কারণে নোয়াখালীতে বিহারীরা এসেছিলো। এর অন্যতম কারণ নোয়াখালীর মুসলিমরা অন্য মুসলিমদের মতো অসচেতন ছিল না। তারা ছিলেন রাজনৈতিকভাবে অত্যন্ত সচেতন। এর কারণ এখানে ওহাবী আন্দোলন এবং হাজী শরীয়ত উল্লাহর ফরায়েজী আন্দোলন অত্যন্ত শক্তিশালী ছিল।

বিহারীরা নোয়াখালীতে আসার আরেকটি কারণ ছিল গোলাম সরোয়ার হুসেইনী। তাঁর বাড়ি বর্তমান লক্ষ্মীপুর জেলার রামগঞ্জ থানার শামপুরে। তিনি ছিলেন পীর পরিবারের। তারা বংশানুক্রমিকভাবে মুসলিমদের নেতৃত্ব দিয়ে আসছেন। তিনি নির্যাতিত বিহারীদের নোয়াখালীতে আহ্বান জানিয়েছেন। এই লক্ষ্যে তাদের নিরাপত্তা ও আবাসনের ব্যবস্থা করার জন্য একটি বাহিনী তৈরি করেন। এটি মিয়ার ফৌজ নামে পরিচিত ছিল।

গোলাম সরোয়ার হুসেইনী রাজনৈতিক লোক ছিলেন। তিনি ১৯৩৭ সালের নির্বাচনে কৃষক প্রজা পার্টির নমিনেশন নিয়ে বঙ্গীয় আইন পরিষদের নির্বাচিত সদস্য হন। ১৯৪৬ সালের নির্বাচনে তিনি মুসলিম লীগের প্রার্থীর কাছে পরাজিত হন।

যাই হোক গোলাম সরোয়ার সাহেব বিহারীদের আশ্রয় দিচ্ছিলেন পাশাপাশি বিহারে ও কলকাতায় দাঙ্গা বন্ধ করার জন্য রাজনৈতিক প্রচেষ্টা চালাতে থাকেন। কিন্তু তার সেই প্রচেষ্টায় সাড়া দেয়নি কংগ্রেস এবং মুসলিম লীগ। তিনি সবার কাছে চিঠি লিখেন এবং নির্বিচারে মানুষ হত্যার সমাধান চান। কেউ সমাধানে জোরালো ভূমিকা রাখেন নি। তিনি খুবই হতাশ হয়েছিলেন।

এদিকে রায়পুরের হিন্দু জমিদার চিত্তরঞ্জন রায় চৌধুরী নোয়াখালীতে বিহারীদের এই অনুপ্রবেশ পছন্দ করছিলেন না। তিনি বিহারীসহ মুসলিমদের আগমন ঠেকানোর প্রস্তুতি নিয়েছিলেন। চিত্তরঞ্জন রায় চৌধুরীর এই আচরণ সরোয়ার সাহেবকে ব্যাথিত করেছিলো। তিনি তাকে বুঝানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু জমিদার তা মানতে নারাজ। জমিদার কংগ্রেসের সাথে যুক্ত ছিলেন। সরোয়ার সাহেব তাই গান্ধীকে খবর জানালেন যাতে তিনি জমিদারকে তার নিষ্ঠুর আচরণ থেকে বিরত রাখেন। গান্ধী তার আহ্বানকে পাত্তা দিলেন না। এদিকে জমিদার নোয়াখালী থেকে সকল বহিরাগত মুসলিমকে উচ্ছেদের অভিযানে নেমেছেন।

সরোয়ার হুসেইনী কারো থেকে কোন সাহায্য না পেয়ে অবশেষে তিনি তার আস্তানা সামপুরের দিয়ারা শরীফে তার ভক্তদের ও মুসলিমদের এক সমাবেশ ডাকলেন। সেখানে তিনি মুসলিমদের বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে জানিয়েছেন এবং চিত্তরঞ্জনের রায় চৌধুরীর বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য আহ্বান জানান।

সকল মুসলিম তার আহবানে সাড়া দেয়। চিত্তরঞ্জনকে অবরোধ করে মুসলিমরা। সে বৃটিশ পুলিশ, আগ্নেয়াস্ত্র, তার পেয়াদা বাহিনী, হিন্দু জঙ্গী, কংগ্রেস কর্মী ও জলকামান দিয়েও সেদিন মুসলিমদের আটকাতে পারেনি। অবশেষে সে তার পরিবারের সদস্যদের হত্যা করে এবং নিজে আত্মহত্যা করে। সরোয়ার সাহেবের এই অভিযানে তাঁকে সহায়তা করেন জনৈক মুসলিম লীগ নেতা কাশেম। সরোয়ার সাহেবের বাহিনীর নাম মিয়ার ফৌজ আর কাশেমের বাহিনীর নাম ছিল কাশেম ফৌজ।

জমিদারের পতনের পর তারা পুরো নোয়াখালীতে কয়েকটিভাগে ভাগ হয়ে হিন্দু উচ্ছেদে নেমে পড়েন। এক সপ্তাহের মধ্যে ঘটনা প্রবাহ পাল্টে যায়। এবার হিন্দু শরনার্থীদের ঢল শুরু হয় নোয়াখালী থেকে। এতক্ষণে টনক নড়ে মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধীর। তিনি মুসলিম নেতাদের সাথে যোগাযোগ শুরু করেন সরোয়ার হুসেইনীকে থামানোর জন্য। কিন্তু কোন মুসলিম নেতার কথা এমনকি তার দলের প্রধান বরিশালের এ কে ফজলুল হকের কথাও শুনেন নি সরোয়ার সাহেব। কারণ এতদিন কেউ তাকে কোন সহায়তা করেনি।

অবশেষে তাকে থামানোর জন্য গান্ধী নিজেই এসেছিলেন নোয়াখালীতে। নোয়াখালীর চৌমুহনীতে কংগ্রেসের উদ্যোগে সমাবেশে বক্তব্য রাখেন। ইতিমধ্যে সরোয়ার হুসেইনী ঘোষণা দিয়েছেন তিনি পুরো বাঙলা থেকে হিন্দুদের উচ্ছেদ করবেন। গান্ধী এসে সরোয়ার সাহেবের সাথে সেখা করতে চাইলে প্রথমে তিনি অস্বীকৃতি জানান। পরে রাজি হন।

গান্ধী যেখানেই যান সেখানেই তিনি একটি ছাগল নিয়ে যান। তিনি সেই ছাগলের দুধ পান করেন। সরোয়ার সাহেবের আস্তানায় প্রবেশ করা মাত্রই তার ছাগল হস্তগত করেন মিয়া ফৌজের লোকেরা। যখন সারোয়ার সাহেবের সাথে তার কথা হচ্ছিলো তখনই রান্না করা ছাগল উপস্থাপন করা হয় গান্ধীর সামনে। এটা ছিল সরোয়ার সাহেবের একটি থ্রেট। গান্ধী সরোয়ার সাহেবের এই আচরণেই আন্দাজ করতে সক্ষম হয় নোয়াখাইল্লারা কী জিনিস!

সরোয়ার সাহেব গান্ধীকে বলেন, আপনি ভুল স্থানে এসেছেন। দাঙ্গার সূত্রপাত এখানে নয়। আপনাকে ব্যবস্থা নিতে অনুরোধ করেছি বিহারে ও কলকাতায়। আপনি এসেছেন নোয়াখালীতে। যেদিন কলকাতায় ও বিহারে সংঘর্ষ বন্ধ হবে সেদিন নোয়াখালী ঠান্ডা হয়ে যাবে। গান্ধী অনুরোধ করেছেন তিনি চেষ্টা চালাবেন এই সময়ের মধ্যে নোয়াখালীতে যাতে হিন্দু উচ্ছেদ বন্ধ থাকে। সরোয়ার সাহেব বলেছেন আপনি কি আমাকে এই নিশ্চয়তা দিবেন আমি বন্ধ করার সাথে সাথে বিহারে ও কলাকাতায় বন্ধ হবে?

গান্ধী নিশ্চয়তা দিতে ব্যর্থ হয়েছিল। সরোয়ার হুসেইনী বললেন তাহলে আমাকে আপনি কোন অনুরোধ করার যোগ্যতা রাখেন না। আমি আপনার নিরাপত্তা দিতেও প্রস্তুত নই। আমি আপনাকে নোয়াখালীতে আহ্বান করিনি। সরোয়ার সাহেবের হুমকিতে গান্ধী কাজ শুরু করলেন। তিনদিনের মধ্যে পুরো ভারতে দাঙ্গা বন্ধ হলো। একথা সরোয়ার সাহেবের কাছে স্পষ্ট ছিলো গান্ধীর হাতেই সকল চাবিকাঠি। সেই সকল দাঙ্গা লাগাচ্ছে এবং মুসলিমদের হত্যা করছে।

দাঙ্গা বন্ধ হলে গান্ধী নোয়াখালীতে তার নিরাপত্তা চাইলেন এবং হিন্দুদের কল্যাণে আশ্রম করার অনুমতি চাইলেন। সরোয়ার সাহেব তার নিরাপত্তার ব্যবস্থা করলেন এবং নোয়াখালীর সোনাইমুড়িতে হিন্দু আশ্রম করার অনুমতি দেন। সেখানের হিন্দু নেতা হেমন্তের জায়গায় আশ্রম স্থাপিত হয়।

২৯ জুন, ২০১৮

চেচনিয়া এখন কেমন আছে?

রমজান কাদিরভ, চেচনিয়ার প্রেসিডেন্ট


আমি যখন ছোট ছিলাম, প্রাইমারিতে পড়তাম তখন খবর পেতাম চেচনিয়ায় মুসলিম নির্যাতনের। যে কয়টি এলাকায় মুসলিম নির্যাতনের জন্য আমাদের কাছে পরিচিত ছিল এর মধ্যে চেচনিয়া অন্যতম।

বহুদিন হলো সেখানের খবর আর পাওয়া যায় না। কিছুদিন আগে খবরে দেখলাম মিশরের সালাহকে নাগরিকত্ব দিয়েছে চেচেন নেতা রমজান কাদিরভ। আজকের লিখা চেচনিয়াকে নিয়ে।

চেচনিয়া বর্তমানে রুশ ফেডারেশনের অন্তর্গত একটি মুসলিম স্বায়ত্বশাসিত অঞ্চল। এটি রাশিয়ার উত্তর ককেশাস অঞ্চলে অবস্থিত। চেচনিয়ার আয়তন ১ লাখ ৩০ হাজার বর্গকিলোমিটার এবং লোকসংখ্যা প্রায় ১৪ লাখ। চেচনিয়ার অধিকাংশ জনগণ মুসলিম। চেচনিয়া বহু বছর ধরে স্বাধীনতা আন্দোলন চালিয়ে আসছেন এবং তাদের বিরুদ্ধে রুশ আগ্রাসনের ইতিহাস প্রায় চারশ' বছরের।

ককেশাস অঞ্চলের স্বাধীনতার জন্য প্রথম লড়াই মনসুর উসুরমা। তিনি একজন মুসলিম নেতা। তার নেতৃত্বে ১৭৮৫ থেকে ১৭৯১ সাল পর্যন্ত যুদ্ধ করেছিলেন। বিফল হয়ে ১৮৩৪ সাল থেকে ১৮৫৯ সাল পর্যন্ত ইমাম শামাইলের নেতৃত্বে যুদ্ধ করেছিলো স্বাধীনতার জন্য। অল্প কিছু সাফল্য থাকলেও চূড়ান্ত সফলতা আসে নি।

শেখ নাজমুদ্দীনের নেতৃত্বে মুসলিমরা আবারো সংঘবদ্ধ হয় এবং ১৯১৭ সালে উত্তর ককেশাস ইসলামী রাষ্ট্রের ঘোষণা দেয়। এটা টিকিয়ে রাখতে অনেক সংগ্রাম করতে হয়েছে মুসলিমদেরকে। ১৯৪২ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন আবার সমগ্র ককেশাস দখলে নিতে সক্ষম হয়।

২য় বিশ্বযুদ্ধে চেচেনদেরকে বাধ্য করা হয় যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই যুদ্ধে সৈনিকদের জন্য রশদ পরিবহন, যুদ্ধাস্ত্র পরিবহন, বাংকার তৈরি, ব্রিজ কালভার্ট মেরামত ইত্যাদি কাজে চেচেনদের শ্রমিক হিসেবে কাজ করানো হয়। বেশিরভাগ চেচেন সুযোগ পেলেই যুদ্ধ থেকে পালাতো।

বিদ্রোহ, অবাধ্যতা, নাজিদের সহায়তা করা ইত্যাদি অভিযোগে বহু চেচেনকে হত্যা করে রুশ কমিউনিস্টরা। ১৯৪৪ সালে স্টালিন প্রায় ৫ লাখ মানুষকে সাইবেরিয়া, কাজাখাস্তান ও কিরগিজস্তানে নির্বাসন দেয়। এতে বহু মানুষ নিহত হয়। কারণ যেসব স্থানে নির্বাসন দেয়া হয়েছিলো এগুলো আদতে বসবাসের উপযোগী ছিল না।

চেচনিয়ার মূল শহর গ্রোজনী সবসময় মুসলিমদের নিয়ন্ত্রণে ছিল। সেখানে জ্ঞান বিজ্ঞান চর্চার একটি ভালো স্থান ছিল। মুসলিমদের নির্বাসনে পাঠানোর পর রুশরা মুসলিমদের সব স্থাপনা ধ্বংস করে, লাইব্রেরীগুলো জ্বালিয়ে দেয়। পরিত্যাক্ত এই নগরীতে স্থান দেয় ইহুদী ও মেসখেতিয়ান তুর্কিদের।

৫৩ সালে স্টালিনের মৃত্যু হয়, ৫৭ সালে এই অধ্যাদেশের ফলে মুসলিমরা আবার তাদের নিজ ভূমিতে ফিরে আসার সুযোগ পায়। ১৯৯০ সাল পর্যন্ত চেচেনিয়া ভাষার কোন স্কুল করতে দেওয়া হয় নি যাতে মুসলমানেরা জ্ঞানের দিক দিয়ে পিছিয়ে পড়েন।

১৯৯০ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে গেলে দীর্ঘকালের রুশ দুঃশাসনের কবল থেকে পরিত্রাণ লাভের প্রত্যাশায় চেচেনরা ১৯৯১ সালের সেপ্টেম্বরে গণভোটের আয়োজন করে। গণভোটে চেচনিয়ার অধিকাংশ জনগণ স্বাধীনতার পক্ষে রায় দেয়। কিন্তু তৎকালীন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট বরিস ইয়েলেৎসিন চেচনিয়ার স্বাধীনতা মেনে নিতে অস্বীকৃতি জানান এবং চেচনিয়ায় প্রেসিডেন্টের শাসন জারি করে সেনাবাহিনী প্রেরণ করেন।

১ম চেচেন যুদ্ধঃ
কিন্তু চেচেন স্বাধীনতাকামীদের প্রবল প্রতিরোধের মুখে আগ্রাসী রুশ বাহিনী পিছু হটতে বাধ্য হয়। ১৯৯১ সালের ২৯ অক্টোবর চেচনিয়ায় প্রেসিডেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত নির্বাচনে সোভিয়েত বাহিনীর সাবেক জেনারেল জওহর দুদায়েভ প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন এবং তিনি ২৪ নবেম্বর ১৯৯১ আনুষ্ঠানিকভাবে চেচনিয়ার স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। দুদায়েভের এ পদক্ষেপ রাশিয়ার শাসকগোষ্ঠী মেনে নিতে পারেনি।

১৯৯৪ সালের ২৬ নবেম্বরের পর রাশিয়া চেচনিয়ায় ব্যাপক সামরিক অভিযান শুরু করে। আসলান মাশখাদভ নামক ব্যক্তির নেতৃত্বে বিদ্রোহীরা গেরিলা অপারেশন চালাতে থাকে। তবে অল্প কিছুদিন পরই গ্রোজনী দখল করে রুশরা। গ্রোজনী দখলের দু'বছর পর ১৯৯৬ সালে দুদায়েভকে রুশ বাহিনী হত্যা করলে ১ম চেচেন যুদ্ধের পরিসমাপ্তি ঘটে।

২য় চেচেন যুদ্ধঃ
১৯৯৯ সালের আগস্টে চেচেন ও আরবীয়ান বিদ্রোহীগণ শামিল বাসায়েভ ও আমির খত্তাবের নেতৃত্বে যুদ্ধ-বাহিনী গঠন করেন। চেচেন বিদ্রোহীদের তৎপরতা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেলে তৎকালীন রাশিয়ার নতুন প্রধানমন্ত্রী ভ্লাদিমির পুতিন তাদের বিরুদ্ধে ১৯৯৯ সালের ১লা অক্টোবর কঠোর সামরিক অভিযান চালায়। রাশিয়ান বাহিনী চেচনিয়াতে ঢুকে পড়ে।

২০০০ সালে সরাসরি বিদ্রোহীদের মধ্যে এক নেতা আখমাদ কাদিরভকে পুতিন তার নিজের দলে টেনে নিতে সক্ষম হয়। এরপর তাকে নেতা বানিয়ে সেখানে ডিরেক্ট রুল শুরু করে রাশিয়া। আখমাদ কাদিরভেরও অনেক সমর্থক ছিল। ফলে বিদ্রোহীরা বিভক্ত হয়ে পড়ে এবং রুশরা সেখানে সহজে জয়লাভ করে।

আখমাদ কাদিরভ ২০০৪ সালে বিদ্রোহীদের একটি আত্মঘাতী হামলায় নিহত হলে তার ছেলে রমজান কাদিরভ এখন চেচনিয়ার নেতা হন। তার নেতৃত্বে অনেকটাই শান্তি ফিরে এসেছে রাশিয়ায়।

তিনি চেচনিয়ার বিদ্রোহ দমন করতে সমর্থ হন। এর একটি জোরালো কারণ হচ্ছে চেচনিয়ায় ইসলামী আইন বাস্তবায়নের সুযোগ দিয়েছে পুতিন। বিনিময়ে শুধু অনুগত থাকতে হবে। ২০০৭ সাল থেকে রমজান কাদিরভ একই সাথে মুসলিম ও রুশ স্বার্থ দেখার পর চেচনিয়ায় শান্তি ফিরে আসে।

রমজান কাদিরভ তার এক সাক্ষাতকারে বলেছেন, স্বাধীনতা আমাদের জন্য সমস্যা ছাড়া আর কিছুই সৃষ্টি করেনি। রাশিয়ার কাছ থেকে চেচনিয়া স্বাধীন হোক তা আমি চাই না। আমরা শান্তি চাই।

২৭ জুন, ২০১৮

যেভাবে একটি স্কুল মসজিদে পরিণত হলো



নোয়াখালী ছেড়ে বাসটি যাবে ঢাকা। আমি পথিমধ্যে চড়ে বসলাম। নিজের আসন বুঝে নিয়ে মাত্র আরাম করে চোখ বন্ধ করলাম। তখনি বাসটি কিছু যাত্রী তোলার জন্য দাঁড়াল। কিন্তু যাত্রী তোলা বাদ দিয়ে চলছে গ্যাঞ্জাম। কৌতুহলী হয়ে দরোজার দিকে তাকালাম। দুজন নারী উঠলেন, আবার নামলেন। গ্যাঞ্জাম তখনো চলছে।

তারপর আরেকজন উঠলেন। আরে, এ যে আমারই সহকর্মী বন্ধু। বুঝলাম গ্যাঞ্জাম তার সাথেই হয়েছে। সে বাসে উঠে তখনো সমানে মুখ চালিয়ে যাচ্ছে। ভুল ছিল সুপারভাইজারের। এতক্ষণে সে ভুল বুঝতে পেরে ক্ষমা চাইতে লাগলো।

আমার আসন ছিল বাসের একেবারে সামনের দিকেই। আমি মুখ ফিরিয়ে জানালার দিকে তাকিয়ে থাকলাম। যাতে করে সে আমাকে দেখতে না পায়। একটু মজা করার চিন্তা করলাম। আড় চোখে দেখলাম সে তার সিটে গিয়ে বসেছে। হাতে মোবাইল ফোন।

আমি তাকে মেসেজ করলাম, 'বাসে উঠে এভাবে রাগ করতে হয় না'। সে সচকিত হয়ে মাথা ঘুরাতে লাগলো। কয়েক সেকেন্ড পরই বুঝতে পারলো এই বাসে আমিও আছি। আমি কিন্তু মাথা ঘুরিয়ে জানালার দিকেই তাকিয়ে আছি।

সে তার সিটে বসে আমাকে আবিষ্কার করতে সক্ষম হয়নি। অবশেষে হেঁটে আমার সিটের সামনে আসলো। দুজনেই হেসে উঠলাম। মুহুর্তেই একটি বিরক্ত মুখ হাসিমুখে পরিণত হলো।

প্রতিটা ঈদের পর পরই বেজে উঠে বিচ্ছেদের সুর। ঈদ আমাদের জন্য বিরাট রহমত। বিশেষ করে আমরা যারা পরিবারের সাথে থাকি না। ঈদ উপলক্ষে আমাদের সুযোগ হয় প্রিয় মানুষগুলোর সাথে সময় কাটাবার।

আর এবার আমার জন্য বিচ্ছেদ যে অন্যান্য বারের চাইতে অনেক বেশি সে কথা সহজেই অনুমেয়।

বাড়ি ছেড়ে ঢাকায় আসার পথে সহকর্মীকে পেয়ে বিচ্ছেদ অনেকটাই বন্ধনে পরিণত হয়েছে। সহকর্মীর অনুরোধে নিজের বাসায় না গিয়ে রাতে তার বাসায় দাওয়াত নিলাম।

পরদিন সে আমাকে বললো মসজিদ দেখবে আমার সাথে। আমি যেভাবে পুরাতন মসজিদ দেখি। বললাম ঠিক আছে, তাই হবে।

কোন মসজিদে যাবো? কিছুক্ষণ ঘাঁটাঘাঁটি করে পেয়ে গেলাম একটি নাম 'খান মুহাম্মদ মৃধা' মসজিদ। অনলাইনে ছবি দেখে দারুণ লোভ হয়েছে দেখার। সেজেগুজে বের হয়ে পড়লাম।

ফাঁকা রাস্তা। ঢাকা তখনো অবগুণ্ঠন খুলে নি। ঝিরি ঝিরি বাতাস। এমন সময়ে রিকশা ভ্রমণ খুবই আনন্দদায়ক ও স্বাস্থ্যকর। গল্প করতে করতে পৌঁছে গেলাম গন্তব্যে।

দেখেই মনে হয়েছে এটা একটা দুর্গ। তিন গম্বুজঅলা এই মসজিদটির অন্যতম বিশেষত্ব হলো এটি প্রায় সতের ফুট উঁচু প্লাটফর্মের উপর নির্মিত। মসজিদটি যে যুগে নির্মিত সে যুগে দোতলা মসজিদ নির্মিত হওয়ার নজির নেই। কিন্তু মসজিদটি দোতলায় নির্মিত।

নিচের তলায় অনেকগুলো কক্ষ। সেই কক্ষগুলোকে ভিত্তি করে উপরে অনেকটা মঞ্চের মত করে স্থাপনাটি তৈরী করা হয়েছে। মঞ্চের উপর মুঘল রীতিতে নির্মিত ৪৮ ফুট বাই ২৪ ফুট ক্ষেত্রবিশিষ্ট মসজিদ। দোতলায় মানে মঞ্চে যেমন প্রশস্ত আঙিনা রয়েছে তেমনি নিচে আরো বড় আঙিনা রয়েছে।

আমরা প্রথমে ভেবে নিয়েছি পুরো স্থাপনা একটি দূর্গ। নিচের কক্ষগুলোতে সৈন্যরা থাকতো। কিন্তু আবার খটকা লাগলো লালবাগ কেল্লা এত কাছে থাকতে এখানে আবার কেন ছোট দূর্গ স্থাপনের প্রয়োজন হলো!

বাসায় ফিরে এই মসিজদ নিয়ে পড়তে লাগলাম। পরে জানতে পেরেছি এটা ছিল একটি স্কুল/ মাদ্রাসা। আগের দিনে যেখানে জ্ঞান চর্চা হতো।

মসজিদটির উত্তর-পূর্বদিকে নির্মিত কক্ষগুলো শ্রেণিকক্ষ হিসেবে ব্যবহৃত হতো। মঞ্চের উপর তিন গম্বুজ মসজিদ ও স্কুল ভবন ছাড়া অবশিষ্ট উন্মুক্ত অংশও শিক্ষার্থীদের পাঠদান কাজে ব্যবহৃত হতো।

মঞ্চের নিম্নস্থ কক্ষগুলো মাদ্রাসার ছাত্র ও শিক্ষকদের বাসস্থান হিসেবে নির্মিত হয়েছে। এটি খুব নামকরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছিল। ধারণা করা হয় খান মুহাম্মদ মৃধা এই স্কুলের প্রধান পন্ডিত ছিলেন।

বর্তমানে এটি মসজিদ হিসেবে পরিচিত হলেও মসজিদ ছিল এখানে গৌণ। মূল ব্যাপার ছিল স্কুল। এই স্কুলটি যখন প্রতিষ্ঠিত হয় তখন বাংলার সুবেদার ছিলেন সম্রাট ফররুখ শীয়ার। অবশ্য তিনি তখনো মুঘল সম্রাট হননি। তখন সম্রাট ছিলেন আওরঙ্গজেব বা আলমগীর। ফররুখ শীয়ার ছিলেন আওরঙ্গজেবের প্রপৌত্র।

ফররুখ শীয়ার যখন বাংলার সুবেদার তখন ঢাকার প্রধান কাজী ছিলেন কাজী ইবাদুল্লাহ। কাজী ইবাদুল্লাহ ঢাকার সন্তানদের সুশিক্ষিত করার জন্য স্কুলের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেন। তিনি সুবেদারের কাছে আবেদন করলে ফররুখ শীয়ার তা মঞ্জুর করে ও অর্থ বরাদ্দ করেন।

কাজী ইবাদুল্লাহ সেই অর্থ পন্ডিত খান মুহাম্মদ মৃধাকে দিয়ে একটি স্কুল নির্মানের নির্দেশ দেন। পন্ডিত সাহেব তার দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করেন। মসজিদটি ছিল স্কুলের মসজিদ।

ইংরেজরা ঢাকা দখল করার পর মুসলিমদের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ন্যায় স্কুলটি বন্ধ করে দেয়। সেই থেকে আজ পর্যন্ত স্কুলটি বন্ধই রয়েছে। এখন পুরো স্কুল মসজিদে পরিণত হয়েছে। দোতলার শেণিকক্ষগুলো এখন মসজিদের খাদেমদের থাকার জায়গা। আর নিচতলার কক্ষগুলো ব্যবহৃত হয় লালবাগ কেল্লার কর্মচারীদের হোস্টেল হিসেবে।

খান মুহাম্মদ মৃধা মসজিদ আপনার ভালো লাগবে। বিশেষ করে দোতলায় উঠার জন্য সিঁড়ির ২৩ টি ধাপ আপনাকে নিয়ে যাবে সেই মুঘল আমলে। স্মরণ করিয়ে দেবে ইসলামী ঐতিহ্যের সেই দিনগুলোর কথা।

কৃতজ্ঞতা ও মাগফেরাত কামনা করছি তাদের জন্য যারা আমাদের প্রিয় শহরকে ইসলামের শহর হিসেবে তৈরী করেছেন। আল্লাহ তায়ালা তাদেরকে জান্নাত নসীব করুন। আমীন।

১৩ জুন, ২০১৮

আফগানিস্তানে কমিউনিস্টদের শাসন ও পতন

Add caption
আফগানিস্তান মানেই আমাদের মনে হয় আগাগোড়া ইসলামী রাষ্ট্র। কিন্তু আসলে তা ছিল না। আফগানিস্তানে যেমন ইসলামপন্থীদের উত্থান হয়েছে তেমনি কমিউনিস্টদেরও উত্থান হয়েছে।

২য় বিশ্বযুদ্ধের পর সেখানে ছাত্রদের মধ্যে কমিউনিস্টদের প্রভাব বাড়তে থাকে। এর একটি বড় কারণ ছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন ছিল আফগানিস্তানের প্রতিবেশী রাষ্ট্র। আর অন্য কারণ ছিল সেসময় পৃথিবীব্যাপী পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে এটি ছিল একটি জনপ্রিয় আদর্শ।

আফগানিস্তানে স্বৈরশাসককে উৎখাত করে কমিউনিস্টরা ক্ষমতায় আসে ১৯৭৮ সালে। মুহাম্মদ দাউদ খান ১৯৭৩ থেকে ১৯৭৮ সাল পর্যন্ত আফগানিস্তানের রাষ্ট্রপতি ছিলেন। ১৯৭৮ থেকে ১৯৯২ সাল পর্যন্ত বিদ্যমান ছিল আফগানিস্তানে কমিউনিস্টদের শাসন। এই সময় আফগানিস্তান পিপলস ডেমোক্রেটিক পার্টি (পিডিপিএ) শাসন করেছে। সাওর বিপ্লবের মাধ্যমে এই দল ক্ষমতায় আসে। এই বিপ্লবে মুহাম্মদ দাউদ খানের সরকার উৎখাত হয়।

দাউদ খানের পতনের পর পিডিপিএ প্রধান নূর মুহাম্মদ তারাকি রাষ্ট্র ও সরকার প্রধান হন। তারাকি ও হাফিজউল্লাহ আমিন তাদের শাসনামলে বেশ কিছু সংস্কার করেছেন। এর মধ্যে রয়েছে নারী অধিকার, শিক্ষা ও ভূমি সংস্কার।

ভূমি সংস্কার করতে গিয়ে তারা জনগণের বিপক্ষে চলে যায়। জনগণ তাদের এই সংস্কার কার্যক্রম ভালোভাবে নিতে পারেনি। প্রকৃতপক্ষে তখন জনগণ কমিউনিস্টদের অসাধুতা ও প্রতারণার সাথে পরিচিত হয়। একই সাথে তারাকী ইসলামপন্থীদের নির্মুলে গনহত্যা শুরু করে। প্রায় ২৭০০০ রাজনৈতিক বন্দিকে মৃত্যুদণ্ড দেয় তারাকি।

কমিউনিস্টদের একটি বড় জনসমর্থন ছিল আফগানিস্তানে। সেসময় আফগানিস্তান জামায়াতের আমীর শহীদ বুরহান উদ্দিন রব্বানী কমিউনিস্টদের বিরুদ্ধে লিখালিখি ও বক্তব্য দিয়ে আফগানিস্তানে কমিউনিস্ট বিরোধী নেতা হিসেবে পরিচিত হয়েছিলেন। যখন জনগণ তারাকী গংদের সম্পদ লিপ্সা ও রক্তলিপ্সা দেখতে পায় তখন জনসমর্থন জামায়াতের দিকে আসতে থাকে।

এদিকে আবার কমিউনিস্টরা মধ্যে দুটো দলে বিভক্ত ছিল। তারা ক্ষমতা গ্রহণের পর শীঘ্রই তারাকি ও আমিনের নেতৃত্বাধীন খালকপন্থি এবং বাবরাক কারমালের নেতৃত্বাধীন পারচামপন্থিদের মধ্যে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব্ব শুরু হয়। খালকপন্থিরা এতে জয়ী হয় পারচামপন্থিরা দল থেকে বহিষ্কৃত হয়। অধিকাংশ উল্লেখযোগ্য পারচাম নেতারা সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং পূর্বাঞ্চলীয় ব্লকে পালিয়ে যান।

খালক-পারচাম দ্বন্দ্ব্বের পর এবার খালকপন্থিদের অভ্যন্তরে তারাকি ও আমিনের মধ্যে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব্ব শুরু হয়। আমিন এই দ্বন্দ্ব্বে জয়ী হন এবং তার নির্দেশে তারাকিকে হত্যা করা হয়। তারাকি গণহত্যা ও ভূমি সংস্কারের ফলে দেশে অজনপ্রিয় ছিল। সোভিয়েত ইউনিয়নেও সে জনপ্রিয় হতে পারেনি।

ইতিমধ্যে তারাকি ও আমিনের ইসলাম বিরোধী অবস্থান ও জনগণের সম্পদ রাষ্ট্রের কুক্ষিগত করার কারণে সেনাবাহিনী থেকে ইসলামপন্থীরা ও দেশপ্রেমিকরা পদত্যাগ করে। আফগানিস্তান জামায়াতের নেতৃত্বে মুজাহিদিন বাহিনী গঠিত হয়। যারা আফগানিস্তানকে কমিউনিস্টদের হাত হতে রক্ষা করার জন্য লড়াই শুরু করে।

১৯৭৯ সালের ডিসেম্বরে জামায়াত নেতৃত্বাধীন মুজাহিদিন গ্রুপকে দমন করার জন্য আফগান সরকারের সমর্থনে সোভিয়েত ইউনিয়ন হস্তক্ষেপ করে। ২৭ ডিসেম্বর সোভিয়েত সামরিক বাহিনীর হাতে আমিন নিহত হন। এরপর পালিয়ে যাওয়া পারচাম নেতা কারমালকে সোভিয়েত ইউনিয়ন আফগানিস্তানের নতুন নেতা বানায়। কারমাল ১৯৭৯ থেকে ১৯৮৬ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় ছিলেন। তার শাসনামল সোভিয়েত-আফগান যুদ্ধের জন্য পরিচিত।

১৯৮০ সালের জানুয়ারিতে ৩৪টি মুসলিম রাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রীগণ আফগানিস্তান থেকে "সোভিয়েত সৈন্যদের তাৎক্ষণিক, জরুরি এবং নি:শর্ত প্রত্যাহারের" দাবি জানিয়ে প্রস্তাব পেশ করে, অন্যদিকে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে ১০৪–১৮ ভোটে আফগানিস্তানে সোভিয়েত হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ প্রস্তাব গৃহীত হয়।

যুদ্ধের ফলে সোভিয়েত সেনাদের হাতে ব্যাপক সংখ্যক বেসামরিক নাগরিক হতাহত হয়। কয়েক লক্ষ উদ্বাস্তু এসময় পাকিস্তান ও ইরানে পালিয়ে যায়। ১৯৮০ সালের এপ্রিল একটি সংবিধান প্রণীত হয় এবং সমর্থন মজবুত করার জন্য দলের বাইরে থেকে সরকারে অংশগ্রহণের সুযোগ দেয়া হয়। কারমালের কার্যক্রমের মাধ্যমে দেশে শান্তি আনয়ন করা যায়নি। ১৯৮৬ সালে মুহাম্মদ নজিবউল্লাহ দলের মহাসচিব হিসেবে কারমালের উত্তরসুরি হন।

নজিবউল্লাহ বিরোধীদের সাথে সমঝোতা চেষ্টা করেন। ১৯৮৭ সালে একটি নতুন সংবিধান প্রণয়ন করা হয়। ১৯৮৮ সালে আইনসভার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। মুজাহিদিনরা এই নির্বাচন বয়কট করে এবং যুদ্ধ অব্যাহত রাখে।

নজিবুল্লাহ তার ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার জন্য নানান পলিসি এপ্লাই করে। নজিবুল্লাহ পিপলস ডেমোক্রেটিক পার্টিকে ওয়াতান পার্টিতে রূপান্তর করে। দেশকে ইসলামী প্রজাতন্ত্র করার ঘোষণা পর্যন্ত দেয়। কিন্তু কোন কিছুই তার পক্ষে যায় নি। এর মধ্যে আন্তর্জাতিক চাপে জেনেভা চুক্তিতে সাক্ষর করতে বাধ্য হয়।

চুক্তি অনুসারে সোভিয়েত সেনাদের ফিরিয়ে দিতে বাধ্য হয় নাজিবুল্লাহ। ১৯৮৯ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি নাগাদ আফগানিস্তান ত্যাগ করে সোভিয়েত সেনারা। আফগানিস্তান থেকে সোভিয়েতরা চলে যাওয়ার পর সরকার ক্রমবর্ধমান প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়।

সোভিয়েত সেনারা চলে যাওয়ার পর খালকপন্থী কমিউনিস্টরা অভ্যুত্থানের চেষ্টা করে। নানামুখী সমস্যা ও মুজাহিদিনদের প্রবল আক্রমণে অবশেষে নজিবুল্লাহ পদত্যাগে আগ্রহী হয়। ১৯৯২ সালের মার্চে নজিবউল্লাহ তার সরকারকে পদত্যাগের প্রস্তাব দেন। জাতিসংঘের সাথে এক সমঝোতার পর তার সরকারের পরিবর্তে একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার প্রতিষ্ঠা করা হয়।

নজিবউল্লাহর পদত্যাগের পর আবদুর রহিম হাতিফ ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপ্রধান হন। মুজাহিদিনদের হাতে কাবুলের পতনের পূর্বে নজিবউল্লাহ জাতিসংঘের কাছে ক্ষমা চাইলে তা মঞ্জুর করা হয়। নজিবউলাহ কাবুলের স্থানীয় জাতিসংঘ দপ্তরে আশ্রয় নেন।

মুজাহিদিনদের সাথে যুদ্ধে আফগান কমিউনিস্ট সরকার ব্যাপক হত্যাকাণ্ড সংঘটিত করেছে। আফগানিস্তানের সরকারি হিসেবে সোভিয়েত বাহিনীর হাতে ২,৫০,০০০ এবং আফগান সরকারের হাতে ১,৭৮,০০০ ব্যক্তি নিহত হয়।

কমিউনিস্টদের পতনের পর ১৯৯২ সালে কমিউনিস্ট বিরোধী যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী দলগুলোর মধ্যে একটি চুক্তি সাক্ষরিত হয়। চুক্তি অনুসারে জামায়াতে ইসলামীর আমীর শহীদ বুরহানউদ্দিন রব্বানী ইসলামী প্রজাতন্ত্র আফগানিস্তানের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনকভাবে সেই সরকার স্থায়ী হয়নি পশতুন জাতীয়তাবাদী নেতা গুলুবুদ্দিন হেকমতিয়ারের হটকারিতা ও সিআইএ সৃষ্ট আল কায়েদা কর্তৃক ষড়যন্ত্রের কারণে