৩১ ডিসে, ২০২০

কে ছিলেন দুই শিংওয়ালা শাসক?



রাসূল সা.-এর সময় আরবের মধ্যে ইহুদীরা পড়াশোনা ভালো করতো। তাদের অনেক জানাশোনা ছিল। রাসূল সা.-এর আগমন ও তাঁর দাওয়াতের সংবাদ যখন সবদিকে ছড়িয়ে পড়লো তখন ইহুদীরা মহানবীর সত্যতা বুঝতে চাইলো। তারা ভেবেছিল শেষ নবী তাদের মধ্য থেকেই আসবে কারণ তাদের তাওরাতে মহানবী সা.-এর ভবিষ্যতবাণী নিয়ে আলোচনা আছে। 

মক্কার কাফিরদের থেকে তারা যখন জানলো মহানবী সা. শিক্ষাগ্রহণ করেননি, তিনি নিরক্ষর। তাই তারা মহানবী সা.-কে আটকানোর জন্য বিভিন্ন ঐতিহাসিক প্রশ্ন উত্থাপন করলো। যেগুলো মহানবী সা.-এর জানার কথা না। এর মধ্যে ছিল আসহাবে কাহফ ও যুলকারনাইন। ইহুদীদের থেকে জেনে মক্কার কাফিররা মহানবী সা.-কে প্রশ্ন করতে থাকলো যুলকারনাইন কে ছিলেন? 

এখানে প্রসঙ্গত বলে রাখি, মহানবী সা. জ্ঞানী ছিলেন, বিচক্ষণ ছিলেন, আমানতদার ছিলেন, সৎ মানুষ ছিলেন এই প্রত্যেকটি বিষয় তার নবুয়্যত পাওয়ার আগেই প্রকাশ পেয়েছিল। কিন্তু তিনি এই পৃথিবীর কারো কাছে শিক্ষা গ্রহণ করেননি বিধায় তিনি অক্ষরজ্ঞানহীন ছিলেন। এই বিষয়ে সূরা জুময়াতে উল্লেখ রয়েছে। মহানবী সা. যে উম্মী অর্থাৎ অক্ষরজ্ঞানহীন ছিলেন অনেকবার হাদিসে উল্লেখ হয়েছে। সবচেয়ে বড় কথা ছিল এটা একটা মুজিযা। তিনি পড়তে পারতেন না বিধায় কোনো প্রাচীন গ্রন্থ থেকে তার জ্ঞান আহরণের কোনো সুযোগ ছিল না। 

যারা মহানবী সা. নিরক্ষর ছিলেন এই কথা স্বীকার করেন না তারা মূলত সীরাত ও তাফসীর সম্পর্কে জ্ঞান রাখেন না। সূরা আম্বিয়ার ৫ নং আয়াতের ব্যাখ্যায় আল্লামা ইবনে কাসীর তার তাফসীরে একটি ঘটনা উল্লেখ করেন যা বিভিন্ন হাদীস গ্রন্থেও এসেছে। আব্দুল্লাহ ইবনে উবাই তখনো ইসলাম গ্রহণ করেননি। তিনি রাসূল সা.-এর কাছে এমন মুজিযা দেখতে চাইলেন যেরকম আগের নবীদের ছিল। তখন মহানবী সা. জবাবে বললেন, আমার মতো নিরক্ষর ব্যক্তির কাছে কুরআনের মতো জ্ঞানময় কুরআন আছে। এটাই তো সবচেয়ে বড় মুজিযা। 

হুদায়বিয়ার সন্ধির সময় সন্ধিপত্রে যখন লেখা হলো ‘এই সন্ধি আল্লাহর রসুল মুহাম্মদ (সা.)-এর তরফ থেকে তখন কোরাইশ প্রতিনিধি সুহাইল প্রতিবাদ জানিয়ে বলল : ‘আল্লাহর রসুল’ কথাটি লেখা যাবে না; এ ব্যাপারে আমাদের আপত্তি আছে।’ এ কথায় সাহাবিদের মধ্যে প্রচণ্ড ক্ষোভের সৃষ্টি হলো। সন্ধিপত্র লেখক হজরত আলী (রা.) কিছুতেই এটা মানতে রাজি হলেন না। কিন্তু হজরত (সা.) নানাদিক বিবেচনা করে সুহাইলের দাবি মেনে নিলেন। এরপর আলী রা.-কে বললেন কোথায় আল্লাহর রাসূল লেখা আছে আমাকে দেখিয়ে দাও। আলী রা. দেখিয়ে দিলে তিনি হাতে ‘আল্লাহর রসুল’ কথাটি কেটে দিয়ে বললেন : ‘তোমরা না মানো, তাতে কি? কিন্তু খোদার কসম, আমি তাঁর রসুল।’

যাই হোক কাফিরদের অব্যাহত প্রশ্নের প্রেক্ষিতে আল্লাহ তায়ালা সূরা কাহফের ৮৩ - ৯৮ নং আয়াতে যুলকারনাইন সম্পর্কে উল্লেখ করেছেন। আল্লাহ তায়ালা বলেন, 

//আর তারা তোমাকে যুলকারনাইন সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করছে। বল, ‘আমি এখন তার সম্পর্কে তোমাদের নিকট বর্ণনা দিচ্ছি’। আমি তাকে যমীনে কর্তৃত্ব দান করেছিলাম এবং সব বিষয়ের উপায়- উপকরণ দান করেছিলাম। অতঃপর সে (পশ্চিমে) একটি পথ অবলম্বন করলো। অবশেষে যখন সে সূর্যাস্তের স্থানে পৌঁছল, তখন সে সূর্যকে একটি কর্দমাক্ত পানির ঝর্ণায় ডুবতে দেখতে পেল এবং সে এর কাছে একটি জাতির দেখা পেল। আমি বললাম, ‘হে যুলকারনাইন, তুমি তাদেরকে আযাবও দিতে পার অথবা তাদের ব্যাপারে সদাচরণও করতে পার’।

সে বলল, ‘যে ব্যক্তি যুলম করবে, আমি অচিরেই তাকে শাস্তি দেব। অতঃপর তাকে তার রবের নিকট ফিরিয়ে নেয়া হবে। তখন তিনি তাকে কঠিন আযাব দেবেন’। ‘আর যে ব্যক্তি ঈমান আনবে এবং সৎকাজ করবে, তার জন্য রয়েছে উত্তম পুরস্কার। আর আমি আমার ব্যবহারে তার সাথে নরম কথা বলবো’।

তারপর সে আরেক পথ (পূর্বে) অবলম্বন করলো। অবশেষে সে যখন সূর্যোদয়ের স্থানে এসে পৌঁছল তখন সে দেখতে পেল, তা এমন এক জাতির উপর উদিত হচ্ছে যাদের জন্য আমি সূর্যের বিপরীতে কোন আড়ালের ব্যবস্থা করিনি। প্রকৃত ঘটনা এটাই। আর তার নিকট যা ছিল, আমি সে সম্পর্কে সম্পূর্ণ অবহিত।

তারপর সে আরেক পথ অবলম্বন করলো। অবশেষে যখন সে দুই পর্বতের মধ্যবর্তী স্থানে পৌঁছল, তখন সেখানে সে এমন এক জাতিকে পেল, যারা তার কথা তেমন একটা বুঝতে পারছিল না। তারা বলল, ‘হে যুলকারনাইন! নিশ্চয় ইয়া’জূজ ও মা’জূজ যমীনে অশান্তি সৃষ্টি করছে, তাই আমরা কি আপনাকে এ জন্য কিছু খরচ দেব যে, আপনি আমাদের ও তাদের মধ্যে একটা প্রাচীর নির্মাণ করে দেবেন’?

সে বলল, ‘আমার রব আমাকে যে সামর্থ্য দিয়েছেন, সেটাই উত্তম। সুতরাং তোমরা আমাকে শ্রম দিয়ে সাহায্য কর। আমি তোমাদের ও তাদের মাঝখানে একটি সুদৃঢ় প্রাচীর নির্মাণ করে দেব’। ‘তোমরা আমাকে লোহার পাত এনে দাও’। অবশেষে যখন সে দু’পাহাড়ের মধ্যবর্তী জায়গা সমান করে দিল, তখন সে বলল, ‘তোমরা ফুঁক দিতে থাক’। অতঃপর যখন সে তা আগুনে পরিণত করল, তখন বলল, ‘তোমরা আমাকে কিছু তামা দাও, আমি তা এর উপর ঢেলে দেই’।

এরপর তারা (ইয়া’জূজ ও মা’জূজ) প্রাচীরের উপর দিয়ে অতিক্রম করতে পারল না এবং নিচ দিয়েও তা ভেদ করতে পারল না। সে বলল, ‘এটা আমার রবের অনুগ্রহ। অতঃপর যখন আমার রবের ওয়াদাকৃত সময় আসবে তখন তিনি তা মাটির সাথে মিশিয়ে দেবেন। আর আমার রবের ওয়াদা সত্য’।//

আল্লাহর দেওয়া এই বর্ণনা থেকে যা জানা যায় তা হলো, যুলকারনাইনকে আল্লাহ তায়ালা ক্ষমতা দিয়েছেন। তিনি পশ্চিমে শেষ প্রান্ত পর্যন্ত বিজয় করেছেন। সেখানে তিনি সূর্যকে কর্দমাক্ত পানিতে ডুবে যেতে দেখেছেন। তার মানে সমুদ্রের দ্বারে উপস্থিত হয়েছেন। পশ্চিমে জয়ী হওয়ার পর তিনি সেখানে যারা ঈমান এনেছে তাদের প্রতি সদয় হয়েছেন। আর যারা জালিম তাদের শাস্তি দিয়েছেন। এরপর তিনি পূর্বদিকে অভিযান পরিচালনা করেছেন। এমন জাতির নিকট গিয়ে পৌঁছেছেন যারা সূর্যকে আড়াল করার মতো যোগ্যতা হাসিল করেনি।   

এরপর তিনি আরেকদিকে অভিযান পরিচালনা করেন। সেখানে তিনি দুই পর্বতের মাঝামাঝি একটি স্থানে এসে পৌঁছলেন। সেখানে যারা থাকতো তাদের ভাষার সাথে যুলকারনাইনের ভাষার মিল ছিল না। তারা ইয়াজুজ মাজুজ নামে এক জাতির অত্যাচারে অতিষ্ঠ ছিল। তাই যুলকারনাইনের সহায়তায় ওই জাতি একটি প্রাচীর নির্মাণ করলো যাতে ইয়াজুজ মাজুজ আর আসতে না পারে। তবে একসময় এই প্রাচীর আল্লাহর ইচ্ছায় ভেঙ্গে পড়বে। আর যুলকারনাইন শব্দের অর্থ দুই শিংওয়ালা। এই নামেই আরবের ইতিহাস ও প্রাচীন কবিতাতে যুলকারনাইনের বর্ণনা পাওয়া যেত। 

এখন প্রশ্ন হলো কে ছিলেন এই শিংওয়ালা?   

উপরোক্ত আলোচনা থেকে আমরা চারটি ক্লু পাই যা দ্বারা আমরা বিবেচনা করতে পারবো কে ছিলেন যুলকারনাইন। 

প্রথমত- যেহেতু কুরআনের এই অংশ কাফিরদের প্রশ্নের প্রেক্ষিতে নাজিল হয়েছে। তাই নিশ্চিত করে বলা যায় যুলকারনাইনের নাম ইহুদীরা আগেই জানতো। এখন প্রশ্ন হলো ইহুদীরা পূর্বের কোন দিগ্বিজয়ী শাসককে দুই শিংওয়ালা হিসেবে অভিহিত করতো?   

দ্বিতীয়ত- এমন শাসক যিনি ছিলেন তাওহীদবাদী, ন্যায়বিচারক, ঈমানদার ও মুসলিম। 

তৃতীয়ত-  এমন শাসক যিনি পূর্বে ও পশ্চিমে অভিযান পরিচালনা করেছেন ও জয়ী হয়েছেন। কুরআন নাজিলের আগে এমন শাসক পাওয়া যায় তিনজন মোটে। আলেকজান্ডার, সাইরাস ও হিমায়ার। তিনজনের মধ্যে হিমায়ার ও আলেকজান্ডার মুশরিক ছিলেন বিধায় তারা আলোচনা থেকে বাদ পড়ে যান। কুরআনের বর্ণনা অনুসারে কোনো মুশরিক যুলকারনাইন হতে পারেন না। বাকী থাকেন একজন যিনি আরবি উচ্চারণে কুরুশ আর ইউরোপিয় উচ্চারণে সাইরাস। 

চতুর্থত- এমন শাসক যিনি পার্বত্য পথে প্রাচীর নির্মাণ করেছিলেন ও ইয়াজুজ মাজুজকে ঠেকিয়ে দিয়েছিলেন।

প্রথম ক্লু সহজেই সাইরাসের বেলায় প্রযোজ্য। কারণ বাইবেলের দানিয়েল পুস্তকে দানিয়েল নবীর যে স্বপ্নের কথা বর্ণনা করা হয়েছে তাতে তিনি ইরানীদের উত্থানের পূর্বে মিডিয়া ও পারস্যের যুক্ত সাম্রাজ্যকে একটি দু’শিংওয়ালা মেষের আকারে দেখেন। এই দুই সাম্রাজ্যের মানচিত্র দেখতে দুই শিংওয়ালা মেষের অনুরূপ। ইহুদীদের মধ্যে এ “দু’শিংধারী”র বেশ চর্চা ছিল। কারণ তার সাথে সংঘাতের ফলেই শেষ পর্যন্ত বেবিলনের সাম্রাজ্য খণ্ড-বিখণ্ড হয়ে যায় এবং বনী ইসরাঈল দাসত্ব শৃংখল থেকে মুক্তি লাভ করে। তাই তারা যুলকারনাইনকে সম্মান ও শ্রদ্ধা করতো। 

দ্বিতীয় ক্লু সাইরাসের সাথেই ভালোভাবে মিলে যায়। তিনি তাওহীদবাদী ছিলেন। তার শত্রুরাও তার ন্যায়বিচারের প্রশংসা করেছে। তিনি ন্যায়বিচারক ও আল্লাহভীরু ছিলেন। সাইরাস সিলিন্ডার নামে কিউনিফর্ম হরফে লেখা একটি সনদ পাওয়া যায় যেখানে সাইরাস মানবাধিকারের ঘোষণা দিয়েছেন। এটা এখন পর্যন্ত সর্বপ্রথম মানবাধিকার ঘোষণা বলে পৃথিবীব্যাপী বিবেচিত। 

তৃতীয় ক্লু'ও মোটামুটি আংশিক মিলে যায়। তার বিজয় অভিযান নিঃসন্দেহে পশ্চিমে এশিয়া মাইনর ও সিরিয়ার সমুদ্রসীমা এবং পূর্বে বলখ পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। কিন্তু উত্তরে বা দক্ষিণে তার কোন বড় আকারের অভিযানের সন্ধান এখনো পর্যন্ত ইতিহাসের পাতায় পাওয়া যায়নি। অথচ কুরআন সুস্পষ্টভাবে তার তৃতীয় একটি অভিযানের কথা বর্ণনা করছে। তবুও এ ধরনের একটি অভিযান পরিচালিত হওয়া অসম্ভব নয়। কারণ ইতিহাস থেকে দেখা যায়, সাইরাসের রাজ্য উত্তরে ককেশিয়া অঞ্চল পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল।

চতুর্থ ক্লু'র ব্যাপারে কোনো কিছু নিশ্চিত করে বলা যায় না। সাইরাসের নির্মিত কোনো প্রাচীরের সন্ধান প্রচলিত ইতিহাসে নেই।

একনজরে সাইরাস : 

সাইরাস ছিলেন ইরানী হাখমানেশি সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা। এই সাম্রাজ্যটি এশিয়া, ইউরোপ ও আফ্রিকা—এই তিন মহাদেশে বিস্তৃত ছিল। ইরান ছাড়াও বর্তমান কালের আফগানিস্তান, পাকিস্তান, মধ্য এশিয়ার অংশবিশেষ, আনাতোলিয়া (তুরস্ক), গ্রিস, কৃষ্ণ সাগরের উপকূল, ইরাক, সৌদি আরবের উত্তরাংশ, জর্দান, প্যালেস্টাইন, লেবানন, সিরিয়া, প্রাচীন মিশরের সব গুরুত্বপূর্ণ এলাকা এবং লিবিয়া এই সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল। এটি প্রাচীন বিশ্বের বৃহত্তম সাম্রাজ্যগুলির একটি। তার রাজকীয় উপধিগুলো ছিল মহান রাজা, পারস্যের রাজা, অ্যানসানের রাজা, মিডিয়ার রাজা, ব্যাবিলনের রাজা ও সুমেরের রাজা। তার আরেকটি উপাধি ছিল পৃথিবীর চতুর্কোণের রাজা। 

এছাড়াও ৫৩৯ এবং ৫৩০ খ্রিস্টপূর্বের মাঝামাঝি কোনো এক সময় সাইরাস সিলিন্ডারের ঘোষণাপত্রের মাধ্যমে বৈশ্বিক মানবাধিকার ঘোষণা করেছিলেন যা বিশ্বের ইতিহাসে ঐতিহাসিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ প্রথম মানবাধিকারের সনদ। সাইরাসের শাসনকাল আনুমানিক ৩১ বছর পর্যন্ত স্থায়ী ছিল। সাইরাস তার সাম্রাজ্য বিস্তার করেছিলেন প্রথম মিডিস সাম্রাজ্য দখলের মাধ্যমে, তারপর লিডিয় সাম্রাজ্য এবং পরবর্তীতে ব্যাবিলন সাম্রাজ্য দখল করেছিলেন। 

অনেক তাফসীরকারক যুলকারনাইন বলতে সাইরাসকে বুঝিয়ে থাকেন। উস্তাদ সাইয়্যেদ আবুল আলা মওদূদীও তার ব্যতিক্রম নন। 

২৭ ডিসে, ২০২০

কয়েকজন ঈমানদার যুবকের গল্প



এফিসুস শহর। এখানের মানুষ মুর্তিপূজা করে। ডায়না নামে এক দেবী ছিল এদের মূল উপাস্য। ডায়ানার পূজারীদের বিশাল এক কেন্দ্র এফিসুস। এখানে সুবিশাল ডায়ানা দেবীর মন্দিরটি সে যুগে পৃথিবীর অত্যাশ্চর্য বিষয় বলে গণ্য হতো। আনাতোলিয়া অর্থাৎ তুরস্কের লোকেরা ডায়ানার পূজা করতো। পুরো রোমান সাম্রাজ্যেও ডায়ানার পূজারীরা ছিল ক্ষমতাবান। মুশরিকদের এই শহরে ঈশা আ.-এর অনুসারী মুসলিমরা দাওয়াত নিয়ে হাজির হন। সেই দাওয়াতে সাড়া দেয় এফিসুসের কিছু মানুষ। 

হযরত ঈসা আ.-এর উদ্ধারোহন হওয়ার পর যখন তাঁর দাওয়াত রোম সাম্রাজ্যে পৌঁছতে শুরু করে তখন এফিসুস শহরের কয়েকজন যুবকও শিরক থেকে তাওবা করে এক আল্লাহর প্রতি ঈমান আনে। তাদের ধর্মান্তরের কথা শুনে এপিসুসের শাসক কাইজার ডিসিয়াস তাদের নিজের কাছে ডেকে পাঠান। তাদের জিজ্ঞেস করেন, তোমাদের ধর্ম কি? তারা জানতেন, কাইজার মুসলিম বিদ্বেষী। কিন্তু তারা কোন প্রকার ভয় না করে পরিষ্কার বলে দেন, আমাদের রব তিনিই যিনি পৃথিবী ও আকাশের রব। তিনি ছাড়া অন্য কোন মাবুদকে আমরা ডাকি না। যদি আমরা এমনটি করি তাহলে অনেক বড় গুনাহ করবো। কাইজার প্রথমে ভীষণ ক্রুদ্ধ হয়ে বলেন, তোমাদের মুখ বন্ধ করো, নয়তো আমি এখানেই তোমাদের হত্যা করার ব্যবস্থা করবো। তারপর কিছুক্ষণ থেমে বললেন, তোমরা এখনো ছোট। তাই তোমাদের তিনদিন সময় দিলাম। ইতোমধ্যে যদি তোমরা নিজেদের মত বদলে ফেলো এবং জাতির ধর্মের দিকে ফিরে আসো তাহলে তো ভালো, নয়তো তোমাদের শিরশ্ছেদ করা হবে।

এ তিন দিনের অবকাশের সুযোগে কেউ কেউ ঈমান গোপন করলেন। কিন্তু হাতেগোণা কয়েকজন যুবক শহর ত্যাগ করেন। তারা কোন গুহায় লুকাবার জন্য পাহাড়ের পথ ধরেন। পথে একটি কুকুর তাদের সাথে চলতে থাকে। তারা কুকুরটাকে তাদের পিছু নেয়া থেকে বিরত রাখার জন্য বহু চেষ্টা করেন। কিন্তু সে কিছুতেই তাদের সঙ্গ ত্যাগ করতে রাজি হয়নি। শেষে একটি বড় গভীর বিস্তৃত গুহাকে ভাল আশ্রয়স্থল হিসেবে বেছে নিয়ে তারা তার মধ্যে লুকিয়ে পড়েন। কুকুরটি গুহার মুখে বসে পড়ে। দারুন ক্লান্ত পরিশ্রান্ত থাকার কারণে তারা সবাই সঙ্গে সঙ্গেই ঘুমিয়ে পড়েন। খ্রিস্টানদের বর্ণনা অনুসারে এটি ২৫০ খৃস্টাব্দের ঘটনা। ১৯৭ বছর পর ৪৪৭ খৃস্টাব্দে তারা হঠাৎ জেগে ওঠেন। তখন ছিল কাইজার দ্বিতীয় থিয়োডোসিসের শাসনামল। রোম সাম্রাজ্য তখন খৃস্টধর্ম গ্রহণ করেছিল এবং এফিসুসের শহরের লোকেরাও মূর্তিপূজা ত্যাগ করেছিল।

এটা ছিল এমন এক সময় যখন রোমান সাম্রাজ্যের অধিবাসীদের মধ্যে কিছু ব্যক্তি নাস্তিক হয়ে উঠেছিল। তারা বিজ্ঞানের দোহাই দিয়ে ও নানান যুক্তি হাজির করে মৃত্যুর পরের জীবন এবং কিয়ামতের দিন হাশরের মাঠে জমায়েত ও হিসেব-নিকেশ হওয়া সম্পর্কে ফিতনা তৈরি করে চলছিল। আখেরাত অস্বীকারীরের ধারণা লোকদের মন থেকে কীভাবে নির্মূল করা যায় এ ব্যাপারটা নিয়ে কাইজার নিজে বেশ চিন্তিত ছিলেন। একদিন তিনি আল্লাহর কাছে দোয়া করেন যেন তিনি এমন কোন নিদর্শন দেখিয়ে দেন যার মাধ্যমে লোকেরা আখেরাতের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করতে পারে। ঘটনাক্রমে ঠিক এ সময়েই এ যুবকরা ঘুম থেকে জেগে ওঠেন।

জেগে ওঠেই তারা পরস্পরকে জিজ্ঞাস করেন, আমরা কতক্ষণ ঘুমিয়েছি? কেউ বলেন একদিন, কেউ বলেন দিনের কিছু অংশ। তারপর আবার একথা বলে সবাই নীরব হয়ে যান যে এ ব্যাপারে আল্লাহই ভাল জানেন। এরপর তারা তাদের মধ্যে থাকা একজনকে রূপার কয়েকটি মুদ্রা দিয়ে খাবার আনার জন্য শহরে পাঠান। লোকেরা যাতে চিনতে না পারে এজন্য তাকে সতর্কতা অবলম্বন করতে বলেন। তারা ভয় করছিলেন, লোকেরা আমাদের ঠিকানা জানতে পারলে আমাদের ধরে নিয়ে যাবে এবং ডায়নার পূজা করার জন্য আমাদের বাধ্য করবে। কিন্তু তাদের একজন শহরে পৌঁছে দেখে সবকিছু বদলে গেছে। তিনি খুবই অবাক হয়ে যান। তিনি দেখেন সবাই মুসলিম হয়ে গেছে এবং ডায়না দেবীর পূজা কেউ করছে না। 

তিনি একটি দোকানে গিয়ে কিছু রুটি কিনেন এবং দোকানদারকে একটি রূপার মুদ্রা দেন। এ মুদ্রার গায় কাইজার ডিসিয়াসের ছবি খোদাই করা ছিল। দোকানদার এ মুদ্রা দেখে অবাক হয়ে যায়। সে জিজ্ঞেস করে, এ মুদ্রা কোথায় পেলে? তিনি বলেন, এ আমার নিজের টাকা, অন্য কোথাও থেকে নিয়ে আসিনি। এ নিয়ে দু’জনের মধ্যে বেশ কথা কাটাকাটি হয়। লোকদের ভীড় জমে ওঠে। এমনকি শেষ পর্যন্ত বিষয়টি নগর কোতোয়ালের কাছে পৌঁছে যায়। কোতোয়াল বলেন, এ গুপ্তধন যেখান থেকে এনেছো সেই জায়গাটা কোথায় আমাকে বলো। তিনি বলেন, কিসের গুপ্তধন? এ আমার নিজের টাকা। কোন গুপ্তধনের কথা আমার জানা নেই। কোতোয়াল বলেন, তোমার একথা মেনে নেওয়া যায় না। কারণ তুমি যে মুদ্রা এনেছো, এ তো কয়েকশো বছরের পুরানো। তুমি তো সবেমাত্র যুবক, আমাদের বুড়োরাও এ মুদ্রা দেখেনি। নিশ্চয়ই এর মধ্যে কোন রহস্য আছে।

যুবকদের একজন যখন শোনেন কাইজার ডিসিয়াস মারা গেছে বহুযুগ আগে তখন তিনি বিস্ময়াভিভূত হয়ে পড়েন। কিছুক্ষণ পর্যন্ত তিনি কোন কথাই বলতে পারেন না। তারপর আস্তে আস্তে বলেন, এ তো মাত্র কালই আমি এবং আমার ছয়জন সাথী এ শহর থেকে পালিয়ে গিয়েছিলাম এবং ডিসিয়াসের জুলুম থেকে আত্মরক্ষা করার জন্য একটি গুহায় আশ্রয় নিয়েছিলাম। তার একথা শুনে কোতোয়ালও অবাক হয়ে যান। তিনি তাকে নিয়ে যেখানে তার কথা মতো তারা লুকিয়ে আছেন সেই গুহার দিকে চলেন। বিপুল সংখ্যক জনতাও তাদের সাথী হয়ে যায়। তারা যে যথার্থই কাইজার ডিসিয়াসের আমলের লোক সেখানে পৌঁছে এ ব্যাপারটি পুরোপুরি প্রমাণিত হয়ে যায়। এ ঘটনার খবর কাইজার থিয়োডোসিসের কাছেও পাঠানো হয়। তিনি নিজে এসে তাদের সাথে দেখা করেন এবং তাদের থেকে বরকত গ্রহণ করেন। তারপর হঠাৎ তারা সাতজন গুহার মধ্যে গিয়ে সটান শুয়ে পড়েন এবং তাদের মৃত্যু ঘটে। এ সুস্পষ্ট নিদর্শন দেখে লোকেরা যথার্থই মৃত্যুর পরে জীবন আছে বলে বিশ্বাস করে। এ ঘটনার পর কাইজারের নির্দেশে গুহায় একটি ইবাদাতখানা নির্মাণ করা হয়। 

এই ঘটনার কথা এফিসুস থেকে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। বিভিন্ন কবিতা ও সাহিত্যে তাদের এই ঘটনা বর্ণনা হতে থাকে। এই যুবকদেরকে একত্রে গুহাবাসী বা আসহাবে কাহফ বলা হয়।  আল্লাহর রাসূল সা. যখন মক্কায় ইসলামের দাওয়াত দিতে থাকেন তখন কাফেররা আল্লাহর রাসূলের কাছে বিভিন্ন ঐতিহাসিক ঘটনা সম্পর্কে জানতে প্রশ্ন করে। একবার তারা মুহাম্মদ সা. কাছে আসহাবে কাহফ সম্পর্কে বলার জন্য বললো। মুহাম্মদ সা. বললেন, ঠিক আছে আমি তোমাদের আগামী কাল বলবো। মহানবী সা.-এর এই জবাবে আল্লাহ তায়ালা মনঃক্ষুণ্ণ হলেন, কারণ মহানবী সা. 'ইনশাআল্লাহ' বলেননি। এর প্রেক্ষিতে ১৫ দিন রাসূল সা.-এর কাছে ওহী আসা বন্ধ হয়ে যায়। মহানবী সা. অস্থির হয়ে ওঠেন। অন্যদিকে কাফেররা তাঁকে বার বার চাপ দিতে থাকে। মহানবী সা. সিজদায় দোয়া করতে থাকেন। অবশেষে ওহী নাজিল হয় এবং গুহাবাসীদের ব্যাপারে বিস্তারিত আল্লাহ তায়ালা জানিয়ে দেন। সেই সাথে মহানবী সা.-কেও সতর্ক করে দেন। 

সূরা কাহফের ২৩-২৪ আয়াতে আল্লাহ বলেন,  
//আর কোন কিছুর ব্যাপারে তুমি মোটেই বলবে না যে, ‘নিশ্চয় আমি তা আগামীকাল করবো’, বলবে ইনশাআল্লাহ্‌। যদি বলতে ভুলে যাও, তখন তুমি তোমার রবের যিকির কর এবং বলো, আশা করা যায়, আমার রব এ ব্যাপারে সত্যের নিকটতর কথার দিকে আমাকে পথ দেখিয়ে দেবেন।// 

আসহাবে কাহফের এই ঘটনার বর্ণনা আল্লাহ তায়ালা কুরআনে দিয়েছেন। তিনি সূরা কাহফে ৯-১১ আয়াতে বলেন, 
//তুমি কি মনে করেছ যে, গুহা ও রাকীমের অধিবাসীরা ছিল আমার আয়াতসমূহের এক বিস্ময়? যখন যুবকরা গুহায় আশ্রয় নিল অতঃপর বলল, ‘হে আমাদের রব, আমাদেরকে আপনার পক্ষ থেকে রহমত দিন এবং আমাদের জন্য আমাদের কর্মকান্ড সঠিক করে দিন’। ফলে আমি গুহায় তাদের কান বন্ধ করে দিলাম অনেক বছরের জন্য।// 
তারা গুহায় আশ্রয় নিয়ে মহান রবের কাছে দোয়া করেছেন যেন আল্লাহ রহমত দান করেন এবং সঠিক পথে পরিচালিত করেন। আল্লাহ তাদের দোয়া কবুল করলেন ও তাদের ঘুম পাড়িয়ে দিলেন। 

এরপর ১২ নং আয়াতে আল্লাহ তায়ালা ঘুমের সময়কালের ব্যাপারে তৈরি হওয়া কনফিউশন নিয়ে কথা বলেছেন, তিনি বলেন, 
//তারপর আমি তাদেরকে উঠিয়েছি একথা জানার জন্য যে, তাদের দু’দলের মধ্য থেকে কোনটি তার অবস্থান কালের সঠিক হিসেব রাখতে পারে।//
তাদের যখন ঘুম ভাংলো তখন গুহায় অবস্থানকাল নিয়ে দু’টি দল তৈরি হয়েছিল। একদল বলেছিল, আমরা অবস্থান করেছি এক দিন অথবা এক দিনের কিছু কম সময়। অন্যদল বলেছিল, দীর্ঘ সময়। অতঃপর তারা খাদ্য কিনতে শহরে গিয়ে জানতে পারলো তারা বহু ঘুমিয়েছে। 

আল্লাহ তায়ালা ১৩-১৬ নং আয়াতে গুহাবাসী ও তাদের কথোপকথন বর্ণনা করে বলেন, 
//আমিই তোমাকে তাদের সংবাদ সঠিকভাবে বর্ণনা করছি। নিশ্চয় তারা কয়েকজন যুবক, যারা তাদের রবের প্রতি ঈমান এনেছিল এবং আমি তাদের হিদায়াত বাড়িয়ে দিয়েছিলাম। যখন তারা উঠেছিল, আমি তাদের অন্তরকে দৃঢ় করেছিলাম। তখন তারা বলল, ‘আমাদের রব আসমানসমূহ ও জমিনের রব। তিনি ছাড়া কোন ইলাহকে আমরা কখনো ডাকব না। (যদি ডাকি) তাহলে নিশ্চয় আমরা গর্হিত কথা বলবো’। এরা আমাদের কওম, তারা তাঁকে ছাড়া অন্যান্য উপাস্য গ্রহণ করেছে। কেন তারা তাদের ব্যাপারে স্পষ্ট প্রমাণ উপস্থিত করে না? অতএব যে আল্লাহর ব্যাপারে মিথ্যা রটায়, তার চেয়ে বড় যালিম আর কে? আর যখন তোমরা তাদের থেকে আলাদা হয়েছ এবং আল্লাহ ছাড়া যাদের তারা উপাসনা করে তাদের থেকেও, তখন গুহায় আশ্রয় নাও। তাহলে তোমাদের রব তোমাদের জন্য তার রহমত উন্মুক্ত করে দেবেন এবং তোমাদের জন্য তোমাদের জীবনোপকরণের বিষয়টি সহজ করে দেবেন।// 

গুহাবাসীরা ঈমানদার যুবকেরা এমনভাবে গুহায় ঘুমাতো তখন যদি কেউ তাদের দেখতো তবে তাদের ঘুমন্ত মনে হতো না। সূর্যের উদিত হওয়া অস্ত যাওয়ার সময় তারা পাশ পরিবর্তন করতেন যাতে গুহায় প্রবেশ করা আলো এড়ানো যায়। সেই প্রসঙ্গে আল্লাহ ১৭-১৮ আয়াতে বলেন, 

//তুমি যদি তাদেরকে গুহায় দেখতে, তাহলে দেখতে পেতে সূর্য উদয়ের সময় তাদের গুহা ছেড়ে ডান দিক থেকে ওঠে এবং অস্ত যাওয়ার সময় তাদেরকে এড়িয়ে বাম দিকে নেমে যায় আর তারা গুহার মধ্যে একটি বিস্তৃত জায়গায় পড়ে আছে। এ হচ্ছে আল্লাহর অন্যতম নিদর্শন। যাকে আল্লাহ সঠিক পথ দেখান সে-ই সঠিক পথ পায় এবং যাকে আল্লাহ বিভ্রান্ত করেন তার জন্য তুমি কোন পৃষ্ঠপোষক ও পথপ্রদর্শক পেতে পারো না। তোমরা তাদেরকে দেখে মনে করতে তারা জেগে আছে, অথচ তারা ঘুমুচ্ছিল। আমি তাদের ডানে বায়ে পার্শ্ব পরিবর্তন করাচ্ছিলাম। তাদের কুকুর গুহা মুখে সামনের দু’পা ছড়িয়ে বসেছিল। যদি তুমি কখনো উঁকি দিয়ে তাদেরকে দেখতে তাহলে পিছন ফিরে পালাতে থাকতে এবং তাদের দৃশ্য তোমাকে আতংকিত করতো//

এরপর মহান মালিক সূরা কাহফের ১৯-২১ নং আয়াতে গুহাবাসীদের জেগে ওঠা, বাজারে যাওয়া, তৎকালীন মানুষের আছে প্রকাশিত হওয়া ও ইন্তেকাল করা ইত্যাদি নিয়ে বর্ণনা করেছেন। আল্লাহ বলেন, 

//আর এমনি বিস্ময়করভাবে আমি তাদেরকে উঠিয়ে বসালাম১৬ যাতে তারা পরস্পর জিজ্ঞাসাবাদ করতে পারে। তাদের একজন জিজ্ঞেস করলোঃ “বলোতো, কতক্ষণ এ অবস্থায় থেকেছো?” অন্যেরা বললো, “হয়তো একদিন বা এর থেকে কিছু কম সময় হবে।” তারপর তারা বললো, “আল্লাহই ভাল জানেন আমাদের কতটা সময় এ অবস্থায় অতিবাহিত হয়েছে। চলো এবার আমাদের মধ্য থেকে কাউকে রূপার এ মুদ্রা দিয়ে শহরে পাঠাই এবং সে দেখুক সবচেয়ে ভাল খাবার কোথায় পাওয়া যায়। সেখান থেকে সে কিছু খাবার নিয়ে আসুক; আর তাকে একটু সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে, আমাদের এখানে থাকার ব্যাপারটা সে যেন কাউকে জানিয়ে না দেয়।

আর এমনিভাবে আমি তাদের ব্যাপারে (লোকদেরকে) জানিয়ে দিলাম, যাতে তারা জানতে পারে যে, নিশ্চয় আল্লাহর ওয়াদা সত্য এবং কিয়ামতের ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই। যখন তারা নিজদের মধ্যে তাদের বিষয়টি নিয়ে বিতর্ক করছিল, তখন তারা বলল, ‘তাদের উপর তোমরা একটি ভবন নির্মাণ কর’। তাদের রবই তাদের ব্যাপারে অধিক জ্ঞাত। যারা গুহাবাসীদের উপর প্রাধান্য লাভ করেছিল, তারা বলল, ‘আমরা অবশ্যই তাদের উপর একটি মসজিদ নির্মাণ করবো’।//

উপরোক্ত আল্লাহ তায়ালা ইঙ্গিত দিলেন কীভাবে সেসময়ের কাফিরদের দেখিয়ে দিলেন, আল্লাহর ওয়াদা সত্য এবং কিয়ামতের ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। তারপর যখন আসহাবে কাহফের যুবকরা ইন্তেকাল করলেন তখন সেখানে গুহার মুখে একটি মসজিদ নির্মাণ করা হলো। 

মক্কার কাফেররা আল্লাহর রাসূল সা.-এর কাছে আসহাবে কাহাফের সংখ্যা ও তাদের অবস্থানকালের বছর সংখ্যা নিয়ে বিতর্ক করতে চাইলে মহান রাব্বুল আলামীন এই আলোচনা থেকে রাসূল সা.-কে দূরে থাকতে বলেন। এই ইস্যুতে আল্লাহ তায়ালা ২২ ও ২৫-২৬ আয়াতে বলেন,    

//কিছু লোক বলবে, তারা ছিল তিনজন আর চতুর্থজন ছিল তাদের কুকুরটি। আবার অন্য কিছু লোক বলবে, তারা পাঁচজন ছিল এবং তাদের কুকুরটি ছিল ষষ্ঠ, এরা সব আন্দাজে কথা বলে। অন্যকিছু লোক বলে, তারা ছিল সাতজন এবং অষ্টমটি তাদের কুকুর। (হে নবী) বলো, আমার রবই ভাল জানেন তারা ক’জন ছিল, অল্প লোকই তাদের সঠিক সংখ্যা জানে। কাজেই তুমি সাধারণ কথা ছাড়া তাদের সংখ্যা নিয়ে লোকদের সাথে বিতর্ক করো না এবং তাদের সম্পর্কে কাউকে কিছু জিজ্ঞাসাবাদও করো না।

আর তারা তাদের গুহায় অবস্থান করেছে তিনশ’ বছর এবং এর সাথে অতিরিক্ত হয়েছিল ‘নয়’। (হে নবী) বলো, ‘তারা যে সময়টুকু অবস্থান করেছিল, সে ব্যাপারে আল্লাহই অধিক জানেন’। আসমানসমূহ ও জমিনের গায়েবী বিষয় তাঁরই। এ ব্যাপারে তিনিই উত্তম দ্রষ্টা ও উত্তম শ্রোতা। তিনি ছাড়া তাদের কোন অভিভাবক নেই। তাঁর সিদ্ধান্তে তিনি কাউকে শরীক করেন না।//

সেসময় বহুল প্রচলিত ছিল আসহাবে কাহফের সংখ্যা সাত জন সাথে অষ্টম জন কুকুর। আর তারা গুহায় সৌরবর্ষ অনুসারে ৩০০ বছর ঘুমিয়ে ছিল। আর চন্দ্রবর্ষ অনুসারে অতিরিক্ত নয় বছর যুক্ত হয়ে ৩০৯ বছর ঘুমিয়েছিল। আল্লাহ তায়ালা আসহাবে কাহফের সংখ্যা ও তাদের ঘুমিয়ে থাকার বছর সংখ্যা নির্দিষ্ট করে জানিয়ে দেননি। এবং এই নিয়ে বিতর্ক করতেও নিষেধ করেছেন। আমি শুরুতে যে বর্ণনা দিয়েছি তা বর্তমানের ইউরোপিয়ানদের মধ্যে চালু থাকা ইতিহাস। এর সাথে কুরআনের বর্ণনা অনেকখানিই মিলে যায়। 

তবে আমাদের উচিত হবে না কোনো সংখ্যা অস্বীকার করা বা এই নিয়ে বিতর্ক করা। বরং আমাদের উচিত হবে ঐ যুবকদের মতো নিজের জীবন গড়ে তোলা। যে কোনো ত্যাগের বিনিময়ে আমরা আল্লাহর আনুগত্য করবো। হাসিনা সরকারের চাপে আমরা অবশ্যই ভাস্কর্যের নামে শেখ মুজিবের মুর্তি পূজা শুরু করে দেব না। ইনশাআল্লাহ্‌।

এফিসুস শহর বর্তমানে তুরস্কের ইজমির প্রদেশে সেলকক জেলায় অবস্থিত।     

২৫ ডিসে, ২০২০

বঙ্গকথা পর্ব-৭৫ : কেমন ছিল স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশ?



স্বাধীনতা পরপরই এদেশের ইসলামপন্থীদের ওপর ভয়াবহ দুর্যোগ নেমে আসে। এটা অনুমিত ছিল। কারণ মুসলিম জাতীয়তাবাদের ইস্যুতে সৃষ্টি হওয়া পাকিস্তানকে ভাঙতে দিতে চায়নি সকল ধর্মপ্রাণ মুসলিম। যারা মুজিবকে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দেখতে চেয়েছিলেন তাদের বেশিরভাগই পাকিস্তান বিভক্তির বিপক্ষে ছিলেন। ১৮ ডিসেম্বর যুদ্ধাপরাধ শুরু করে মুক্তিযোদ্ধা ও ভারতীয় সেনাবাহিনী। বিশেষত কাদের সিদ্দিকীর অধীনে কাদেরিয়া বাহিনী ও জেনারেল ওবানের অধীনে মুজিব বাহিনী। ঢাকা ও তার আশপাশের মুসলিম লীগের নেতা কর্মী, নেজামে ইসলামের নেতা কর্মী, জামায়াতে ইসলামের নেতা-কর্মী, কমিউনিস্ট পার্টির নেতা-কর্মী, ন্যাপের নেতা-কর্মী, মসজিদ্গুলোর ইমাম মুয়াজ্জিন, কওমী মাদ্রাসার শিক্ষক ও সিনিয়র ছাত্রদের পল্টন ময়দানে জমায়েত করা হতো। তারপর তাদের বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করা হতো। এটা কোনো গোপন ঘটনা ছিল না। এটি ছিল খুবই প্রকাশ্য এবং দেশি-বিদেশী সাংবাদিকদের সামনে চলে বেসামরিক নাগরিক হত্যা। এদের অপরাধ ছিল তারা পাকিস্তান ভেঙে যাক এটা চায়নি। 

একইসাথে ভারতীয় সেনাবাহিনী বাংলাদেশের সব ক্যান্টনমেন্ট দখলে নিয়ে সেখানের অস্ত্র, গোলাবারুদ ও অন্যান্য সম্পদ লুটপাট করে। এটাও ছিল যুদ্ধাপরাধ। বিরোধী মতের রাজনৈতিক নেতাদের বাড়ি ঘর দখল ও লুটপাটের আয়োজন করে মুক্তিবাহিনী। এ সবই ছিল যুদ্ধাপরাধ। যে মুহাজিররা ১৯৪৭ সালে ভারতের বিহার থেকে নির্যাতনের শিকার হয়ে বাংলায় এসেছিল তাদের মধ্যে অনেকে মুক্তিবাহিনীর অত্যাচারে আবার ভারতে পাড়ি জমান। এ এক জিল্লতির জীবন ছিল। বিহারীরা ফিরে যেতে পারলেও এদেশের ইসলামপন্থীদের পালানোর জায়গা ছিল না বললেই চলে। সেসময়ের বেশ কয়েকজন ভিকটিমের সাথে কথা বলে জানতে পেরেছি তারা নির্যাতনের মুখে তাদের নিজ জেলা থেকে পালিয়ে দূরের জেলায় পালিয়ে থেকেছে। 

ইসলামের প্রতি আক্রোশ :
শুধু যে ইসলামপন্থীরা আক্রান্ত হয়েছে তা নয়। মুক্তিযোদ্ধাদের দ্বারা ইসলাম বেশ ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। তারা ইসলামের প্রতি আক্রোশ দেখিয়েছে। যে সকল প্রতিষ্ঠান, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও সংস্থার নামে ইসলাম ও মুসলিম ছিল সেগুলো থেকে তারা ইসলাম ও মুসলিম শব্দ বাদ দিয়েছে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় জাহাঙ্গীরনগর মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মুসলিম বাদ দেওয়া হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লোগো থেকে 'রাব্বি জিদনি ইলমা' ও কুরআনের চিহ্ন বাদ দেওয়া হয়েছে। নজরুল ইসলাম কলেজ থেকে ইসলাম বাদ দিয়েছে। পাবনার সেরা কলেজ ইসলামিয়া কলেজকে বুলবুল কলেজে পরিণত করা হয়েছে। এভাবে সারা বাংলাদেশে সব স্থান ইসলাম ও মুসলিমকে উৎখাত করা হয়েছে। কওমী মাদ্রাসাগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্রী ও শিক্ষিকাদের বোরকা নিষিদ্ধ করে শাড়ি পড়তে বাধ্য করা হয়েছে। এই কারনে বহু ছাত্রী একাত্তর পরবর্তীতে বিদ্যালয়ে শিক্ষা নিতে যায় নি।    

সংবিধান প্রণয়ন করে বাংলাদেশে ইসলামী রাজনীতি নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এখানে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার এই যে, নেজামী ইসলামী ও জামায়াতে ইসলামী এই দুইদলই ছিল সেসময় ইসলামী রাজনীতির ধারক ও বাহক। এদের নিষিদ্ধ করা হয় নাই যে, তারা মুক্তিযুদ্ধের বিরোধীতা করেছিলেন। বরং তাদের এইজন্য নিষিদ্ধ করা হয়েছে যে, তারা ইসলামী রাজনীতি করেন। সেসময় মুক্তিযুদ্ধের বিরোধীতাকারী ন্যাপ (মুজাফফর), মনি সিং এর কমিউনিস্ট পার্টি, জাতীয় দল, কৃষক শ্রমিক পার্টি, পূর্ব-পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টি, পূর্ব বাংলা সর্বহারা পার্টি এবং কৃষক শ্রমিক সমাজবাদী দল এই দলগুলোকে নিষিদ্ধ করা হয়নি। সুতরাং এটা নিশ্চিত করে বলা যায়, মুক্তিযুদ্ধের যারা কুশীলব তাদের মূল আক্রোশ ছিল ইসলামের সাথে। এই সাধারণ ব্যাপার সেসময়ের সকল ইসলামী রাজনীতিবিদ বুঝেছিলেন এবং তারা এজন্যই মুক্তিযুদ্ধের বিরোধীতা করেছিলেন। সেসময়ের অনেক মুসলিম না বুঝে মুক্তিযুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছিলো এটা তাদের ব্যর্থতা ও অদূরদর্শিতা ছিল। আল্লাহ তায়ালা তাদের ক্ষমা করুন। 

সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রেও বিরাট পরিবর্তন এনেছে মুক্তিযোদ্ধারা। তারা রেডিও টেলিভিশনে বিসমিল্লাহ, সালাম দিয়ে শুরু করা বাদ দিয়ে সুপ্রভাত, শুভকামনা ইত্যাদি প্রতিস্থাপন করেছে। রেডিওতে কুরআন তিলওয়াত বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। ইসলামী একাডেমি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এই ইসলামী একাডেমীকেই তিনবছর পরে ইসলামী ফাউন্ডেশন নামে চালু করা হয়েছে। ১৯৭৫ সালের পটপরিবর্তনের মধ্য দিয়ে আবার পুনরায় রেডিও টেলিভিশনে সালাম, বিসমিল্লাহ, আযান ও কুরআন তেলওয়াত শুরু হয়েছিল। 

এইসব কাজ শেখ মুজিব তার নিজস্ব পরিকল্পনাতে করেছেন এটা আমি বলতে চাই না। মুজিব পরিবেষ্টিত ছিলেন তাজউদ্দিনদের মতো এক ঝাঁক কমিউনিস্ট দ্বারা। তার ফলে মুজিবের শাসনামলের শুরুর দিকে সমস্ত ইসলামবিরোধী কাজের জোয়ার শুরু হয়েছিল। সংবিধান থেকে ইসলামী প্রজাতন্ত্র বাদ পড়েছে। মূলনীতি থেকে আল্লাহর ওপর বিশ্বাস বাদ দেওয়া হয়েছে। রাষ্ট্রীয় মূলনীতি হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছে কমিউনিজম, সেক্যুলারিজমের মতো ইসলাম ও ধর্ম বিদ্বেষী মতবাদকে। ক্ষমতায় থেকে ইসলামপন্থা দমনে সব কাজ করেছেন শেখ মুজিব। যখন জাসদ গঠিত হয় এবং বামপন্থীদের সাথে সরকারের চরম বিরোধ শুরু হয় তখন মুজিব কোনঠাসা হয়ে থাকা ইসলামপন্থীদের কাছে টানতে থাকেন তার শক্তি বৃদ্ধি করার জন্য। তবে অবশ্যই তিনি ইসলামী রাজনীতিকে প্রশ্রয় দেননি। তিনি শুধুমাত্র অরাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের অনুমতি দিয়েছেন। তাবলীগের প্রসার করার চেষ্টা করেছেন। কওমীদের শুধুমাত্র মাদ্রাসার গণ্ডির মধ্যে থেকে কাজ করার সুযোগ দিয়েছেন।  

জাতীয়করণ :
কমিউনিজমের আদর্শ অনুসরণ করতে গিয়ে একের পর এক শিল্প কারখানা জাতীয়করণ করেন মুজিব। তবে কোনো বাঙালির কারখানা জাতীয়করণের আওতায় আসে নি। ১৯৪৭ এর পর বাঙালি রাজনীতিবিদেরা সবসময় মুসলিম বিশ্বের ব্যবসায়ীদের আমন্ত্রণ জানাতেন এদেশে ব্যবসা করার জন্য, শিল্প কারখানা প্রতিষ্ঠিত করার জন্য। তাতে সাড়া দেয় অনেক অবাঙালি কোম্পানি। এরা বেশির ভাগ ভারত ও মিয়ানমারের। এর মধ্যে বড় ব্যাবসায়ি গোষ্ঠী ছিল আদমজি, বাওয়ানী ও ইস্পাহানী পরিবার। এর বাইরেও বহু ছোট ও মাঝারি শিল্প উদ্যোক্তা এদেশে এসেছিলেন। বাংলা ও বাঙালির উন্নয়নে এসব উদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর অনেক অবদান ছিল। কিন্তু শেখ মুজিব জাতীয়করণের নামে এসব অবাঙালি ব্যবসায়ীদের সমস্ত সম্পদ ও কারখানা দখল করে নেয়। যারা এতদিন এদেশের নেতাদের আহ্বানে সাড়া দিয়ে এদেশের উন্নয়নে ও কর্মসংস্থানে ভূমিকা রেখেছিল শেখ মুজিব তাদের রিক্ত হস্তে গলাধাক্কা দিয়ে বের করে দিয়েছেন। তবে দুঃখজনক হলো, এসব শিল্প কারখানা থেকে বাংলাদেশ কখনোই লাভবান হতে পারে নি। সরকার বছর বছর কেবল এগুলোতে ভর্তুকি দিয়েই আসছে। 

লুটপাট :
যুদ্ধপরবর্তী মানুষের পুনর্বাসন একটা বড় চ্যালেঞ্জ ছিল মুজিব সরকারের জন্য। সেজন্য মুজিব জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে বিশাল ত্রাণ সাহায্য পেয়েছে। কিন্তু আওয়ামী লীগের লুটেরা গোষ্ঠীর লুটপাটে এই ত্রাণ থেকে সাধারণ মানুষ বঞ্চিত হয়েছে। একটি বিশাল জনগোষ্ঠী দুর্ভিক্ষে পতিত হয়েছে। দ্রব্যমূল্যের এতো উর্ধ্বগতি হয়েছিল যে, লবণের কেজি ৯০ টাকা পর্যন্ত উঠেছিল। অথচ যুদ্ধের সময়ও ১ মণ চাউলের দাম ছিল ১৫-২০ টাকা। মুজিবের আমলে চাউলের কেজি ১০০-১৬০ টাকা, মশুর ডাল ১২০-১৫০ ও সয়াবিন ৫৯০ টাকা পর্যন্ত দাম উঠেছে। এর বড় কারণ ছিল মুক্তিযোদ্ধারা আমদানিকৃত দ্রব্য আটকে দাম বাড়াতো, একইসাথে এদেশীয় কৃষকের ক্ষেতের ফসলও তারা লুটপাট করে নিজেদের দখলে নিয়ে নিয়েছে। ১৯৭০ সালে 'সোনার বাংলা শ্মশান কেন?' বলে মিথ্যা প্রচারণাকারীরা টের পেল সোনার বাংলা কীভাবে মুজিবের হাতে শ্মশান হয়! 

রক্ষিবাহিনী :
মুজিব তার একান্ত অনুগত একটি বাহিনীর প্রয়োজনীয়তা অনুভব করলেন। এটা অনেকটা জার্মানীর গেস্টাপো বাহিনীর মতো ছিল। সবচেয়ে বেশি যুদ্ধাপরাধ করা কাদেরিয়া ও মুজিব বাহিনীর সদস্যদের দিয়ে এই বাহিনী গঠন করা হয়। এর মাধ্যমে মুজিব তার সমস্ত পরিকল্পনা মুহুর্তেই বাস্তবায়ন করতে চেয়েছিলেন। একইসাথে বিরোধী মত দমনে অসামান্য ভূমিকা রেখেছে রক্ষিবাহিনী। মূলত পুলিশ ও সেনাবাহিনীতে বিভিন্ন আদর্শের লোক থাকায় সেসব বাহিনীর ওপর মুজিব ভরসা করতে পারেননি। শুরুর দিকে রক্ষীবাহিনী বেশ কিছু কার্যকর পদক্ষেপ নিয়ে অনেক অস্ত্রশস্ত্র, চোরাচালানের মালামাল উদ্ধার করে এবং মজুতদার ও কালোবাজারীদের কার্যকলাপ কিছুটা প্রতিহত করতে সক্ষম হয়। কিন্তু খুব দ্রুতই বাহিনীর ভাবমূর্তি নষ্ট হতে থাকে। এই বাহিনীকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সাধনের জন্য ব্যবহার করা হয় এবং এর পাশাপাশি রাজনৈতিক হত্যাকান্ড, গুম, গোলাগুলি, লুটপাট এবং ধর্ষণের সাথে জড়িত হয়ে পড়ে। ঝটিকা বাহিনীর মতো রক্ষীবাহিনী প্রায়ই একেকটি গ্রামের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ত এবং অস্ত্র ও দুষ্কৃতিকারীদের খুঁজতো। 

তাদের নিয়ন্ত্রণ করার এবং তাদের কার্যকলাপের জবাবদিহিতার আইনগত কোন ব্যবস্থা ছিল না। অপরাধ স্বীকার করানোর জন্য গ্রেফতারকৃত লোকদের প্রতি নৃশংস অত্যাচারের অভিযোগও তাদের বিরুদ্ধে ওঠে। তাদের বিরুদ্ধে লুটপাট এবং ভয়ভীতি দেখিয়ে টাকা আদায়ের অভিযোগও ছিল। তাদের কার্যকলাপের সমালোচনা যখন তুঙ্গে ওঠে এবং পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হতে থাকে, তখন ১৯৭৩ সালের ১৮ অক্টোবর সরকার জাতীয় রক্ষীবাহিনী (সংশোধনী) অধ্যাদেশ-১৯৭৩ জারি করে রক্ষীবাহিনীর সকল কার্যকলাপ আইনসঙ্গত বলে ঘোষণা করে। রক্ষীবাহিনীর কোন সদস্য সরল বিশ্বাসে কোন কাজ করলে অথবা সৎ উদ্দেশ্যে উক্ত কাজ করে থাকলে অনুরূপ কাজের জন্য তার বিরুদ্ধে বিচারের জন্য কোন আইনি ব্যবস্থা নেয়া যাবে না বলেও ঘোষণা দেওয়া হয়। এর মাধ্যমে এই বাহিনীকে বিরুদ্ধ মত ও জনগণের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দেন শেখ মুজিব। রক্ষিবাহিনীর সাথে সরাসরি বিরোধ তৈরি হয় সেনাবাহিনীর সাথে। এই দুই বাহিনীর মধ্যে প্রায়ই গোলাগুলি হতো।  

লালবাহিনী :
রক্ষীবাহিনী যেভাবে সরকারের ঘোষিত বাহিনী ছিল লালবাহিনী সেভাবে সরকারি বাহিনী ছিল না। আওয়ামী লীগের মধ্যে বামপন্থীরা বেশ সক্রিয়ভাবে ছিল। বামদের বড় অংশ ছিল শ্রমিকদের মধ্যে। যখন আওয়ামী লীগের মধ্যে থাকা বামপন্থীরা জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) নামে আলাদা হয়ে যায় তখন বাকীরা আওয়ামী শ্রমিক লীগ নামধারণ করে। যেহেতু জাসদের বড় অংশ ছিল শ্রমিক তাই শেখ মুজিব জাসদকে কন্ট্রোল করার জন্য শ্রমিক লীগকেই বেছে নিয়েছেন।   

আবদুল মান্নান, যিনি বাংলাদেশ জাতীয় শ্রমিক লীগের প্রধান ছিলেন, তার নেতৃত্বেই লালবাহিনী গঠন করা হয়। এটি ছিল একটি সশস্ত্রবাহিনী। এটিও সরকারের আজ্ঞাবহ তবে সরকার এর দায়দায়িত্ব নিত না। তাদের মূল কাজ ছিল বিভিন্ন স্থানে শ্রমিক বিক্ষোভ দমন করা। শ্রমিকদের মধ্যে জাসদের কার্যক্রম বন্ধ করাও ছিল লালবাহিনীর কাজ। ১৯৭২ সালের মার্চ থেকে অবাঙালিদের কারখানাগুলিকে জাতীয়করণের নীতি ঘোষণার পরে লাল বাহিনী তাদের 'বিরোধী দল' হিসেবে চিহ্নিত রাজনৈতিক দলগুলোকে নির্মূল করার জন্য শুদ্ধি অভিযান শুরু করে। ১৯৭২ সালের ডিসেম্বরে লাল বাহিনীর শুদ্ধি অভিযানের পক্ষে সমর্থন জানিয়ে এক জনসভায় শেখ মুজিবুর রহমান তথাকথিত শোষণকারীদের শেষ করতে তাঁর 'লাল ঘোড়া' মোতায়েনের হুমকি দিয়েছিলেন। তিনি বহু ভাষণে লাল ঘোড়া দাবড়িয়ে দেওয়া হবে হুমকি দিতেন। লালবাহিনীর প্রধান আবদুল মান্নানকে এমনও বলতে শোনা গেছে যে, "নতুন ফ্রন্ট (জাসদের শ্রমিক ফ্রন্ট) যদি মুজিববাদের বিরুদ্ধে একটি শব্দও উচ্চারণ করে তবে আমি তাদের জিহ্বা কেটে দেব"।

লাল বাহিনীর গণহত্যা : 
লাল বাহিনীর প্রথম নৃশংসতা করেছিল মংলা বন্দরে। সেখানে হাজার হাজার শ্রমিক কুলি হিসাবে কাজ করত। ধারণা করা হয়েছিল যে বামপন্থী শ্রমিক মোর্চা ও বাংলাদেশ জাতীয় শ্রমিক লীগের মধ্যে কুলিদের উপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার দ্বন্দ্ব থেকেই এই গণহত্যার ঘটনা ঘটেছে। সরকারের আনুষ্ঠানিক বিবৃতি অনুসারে দাঙ্গার ফলে প্রায় ৩৬ জন শ্রমিক নিহত হয়েছেন। তবে প্রকৃত মৃত্যুর হার সরকার কর্তৃক বর্ণিত সংখ্যার চেয়ে অনেক বেশি ছিল। দাঙ্গা চলাকালীন বাংলাদেশে থাকা বিশিষ্ট সাংবাদিক মাসকারেনহাসের মতে, সেদিন প্রায় ২০০০ মানুষ নিহত হয়েছিল এবং তারা সবাই বামপন্থী শ্রমিক ছিল। এই ঘটনা স্বাধীনতার কিছু দিন পর ১৯৭২ সালের মার্চে সংঘটিত হয়। 

আরেকটি ভয়াবহ ঘটনা ছিল ৫ এপ্রিল। টঙ্গী শিল্পাঞ্চলে বাংলাদেশ শ্রমিক ফেডারেশনের কর্মীদের উপর লাল বাহিনীর লোকেরা হামলা করে। এই হামলার লক্ষ্য ছিল টঙ্গীর ন্যাপ (ভাসানী) সমর্থিত ফেডারেশন কর্মীদের প্রভাব শেষ করা। ঐ সময় বাংলাদেশের শ্রমিক সংগঠনের মধ্যে এটি বৃহত্তম ছিল। লাল বাহিনীর সশস্ত্র ক্যাডারদের হামলায় হাজার হাজার শ্রমিক নির্যাতিত ও সহিংসতার শিকার হয়। ন্যাপের দাবি অনুসারে সেখানে শতাধিক শ্রমিক খুন হন।

কালুরঘাট শিল্পাঞ্চলে এবং চট্টগ্রামের আরআর জুট অ্যান্ড টেক্সটাইল মিলের দাঙ্গার জন্য প্রত্যক্ষ দায়ী ছিল এই লালবাহিনী। এই দাঙ্গার পেছনের প্রধান কারণ ছিল 'স্থানীয় ও অ-স্থানীয় সমস্যা' এবং 'জেলাবাদ' যা লালবাহিনী সদস্যরা প্রবর্তন করেছিল এবং এটি শ্রমিকদের পার্থক্য করতে ব্যবহৃত হত। চট্টগ্রাম যেহেতু একটি বন্দর নগরী ছিল তাই অন্যান্য জেলা থেকে কাজের সন্ধানে অনেক শ্রমিককে চট্টগ্রাম আসতে হয়েছিল। ১৯৭৩ সালের মে মাসে লাল বাহিনী সদস্যরা স্থানীয়-অ-স্থানীয় সমস্যাটি ব্যবহার করে শুদ্ধি অভিযান শুরু করেছিল। যেভাবে আগে তারা বামপন্থী ইস্যুতে শুদ্ধি অভিযান করেছিল। এই হামলায় চট্টগ্রামে কাজ করতে আসা শত শত শ্রমিককে খুন করে লালবাহিনী।আরো বেশ কয়েকটি দাঙ্গার ঘটনা ঘটেছিল এবং খুনোখুনি ছিল নিয়মিত ঘটনা। এতে মিলগুলির উৎপাদন ক্রমাগতভাবে হ্রাস পেয়েছিল। লালবাহিনীর দৌরাত্মে কারখানাগুলো দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতির মুখে পড়েছিল। কারখানাগুলোর শৃঙ্খলা সম্পূর্ণ ভেঙে পড়েছিলো। লালবাহিনীর অশিক্ষিত শ্রমিকরাই তাদের ইচ্ছেমতো কারাখানা পরিচালনা করতে লাগলো। এরপর সরকার একে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করেও সক্ষম হয়নি।  

ভারতের আজ্ঞাবহ : 
শেখ মুজিব সরকার ভারতের আজ্ঞাবহ সরকারে পরিণত হয়ে পড়েছে। বাংলাদেশ স্বাধীন সিদ্ধান্ত নিতে সক্ষম হতো না। পররাষ্ট্র বিষয়ক প্রতিটা সিদ্ধান্তের জন্য ভারতের অনুমোদনের অপেক্ষায় থাকতে হয়েছে মুজিবকে। শেখ মুজিব তার ক্ষমতার শেষদিকে এই অবস্থা থেকে উত্তরণের চেষ্টা চালিয়েছেন। তদুপরি সে যখন দেখলো সে চরম আর্থিক সংকটে পড়েছে, দুর্ভিক্ষ ছাড়ছেই না। জনগণ বেকার হয়ে পড়েছে। রাষ্ট্রের ইনকাম সোর্স বন্ধ হয়ে গেছে তখন শেখ মুজিব তার নীতি পরিবর্তনের চেষ্টা করলেন। তিনি তার বন্ধু রাষ্ট্র রাশিয়া, কিউবা, ভারত, ইংল্যান্ড থেকে সরে এসে মধ্যপ্রাচ্যের দিকে বন্ধুত্বের অনুরোধ নিয়ে ছোটাছুটি করলেন। মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর শুভদৃষ্টি পেতে চাইলেন। ৭৪-এ আলজেরিয়াকে মিডিয়া বানিয়ে কমিউনিস্টদের সাথে সম্পর্ক ত্যাগ করার শর্তে বাংলাদেশ ওআইসির স্বীকৃতি লাভ করে। এর পরপরই তিনি পাকিস্তানে ওআইসি'র সম্মেলনে যোগ দেন। এই ঘটনায় ভারতের সাথে শেখ মুজিবের দূরত্ব তৈরি হয়।     

বাকশাল : 
শেখ মুজিব তার ক্ষমতার একেবারে শেষদিকে এসে মাও সে তুং-এর মতো করে একদলীয় শাসন চালু করার সিদ্ধান্ত নেয়। দেশে শুধু একটি দল থাকবে তার নাম দেওয়া হয়েছে বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ (বাকশাল)। ১৯৭৫ সালের ২৪ জানুয়ারি বাংলাদেশের সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনী অনুসারে বহুদলীয় সংসদীয় সরকার পদ্ধতি পরিবর্তন করে রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয় এবং দেশের সমগ্র রাজনৈতিক দল বিলুপ্ত করে বাকশাল নামক এই একক রাজনৈতিক দল গঠন করা হয়। বাকশাল ব্যবস্থায় দলের চেয়ারম্যানই সর্বক্ষমতার অধিকারী। চেয়ারম্যান ইচ্ছা করলে গঠনতন্ত্রের যে কোন ধারা পরিবর্তন, সংশোধন ও পরিবর্ধন করতে পারবেন এবং একমাত্র চেয়ারম্যানই গঠনতন্ত্রের ব্যাখ্যা দান করতে পারবেন। 

বাকশাল ব্যবস্থার অধীনে কোন নির্দলীয় শ্রেণী ও পেশাভিত্তিক সংগঠন এবং গণসংগঠন করার কোন অধিকার নেই। ট্রেড ইউনিয়ন মাত্রই তাকে বাকশালের অঙ্গদল শ্রমিক লীগের অন্তর্ভুক্ত হতে হবে। এই ব্যবস্থায় জাতীয় শ্রমিক লীগ, জাতীয় কৃষক লীগ, জাতীয় মহিলা লীগ, জাতীয় যুবলীগ এবং জাতীয় ছাত্রলীগ বাদে কোন শ্রমিক, কৃষক, মহিলা, যুব ও ছাত্র সংগঠন থাকতে পারবে না। আর উপরিউক্ত সংগঠনগুলি হচ্ছে বাকশালেরই অঙ্গ সংগঠন। বাকশাল আইনের অধীনে ১৯৭৫ সালের ৬ জুন দেশে চারটি দৈনিক ছাড়া আর সকল সংবাদপত্রের ডিক্লারেশন বাতিল করা হয়। ঐ চারটি ছিল দৈনিক ইত্তেফাক, দ্য বাংলাদেশ টাইমস, দৈনিক বাংলা, বাংলাদেশ অবজারভার। 

২৩ ডিসে, ২০২০

বঙ্গকথা পর্ব-৭৪ : ১৯৭১ সালের হত্যাযজ্ঞ, ধর্ষণ ও সত্যাসত্য প্রসঙ্গ



বাংলাদেশে ৫০ বছরে এই পর্যন্ত ৭১ এর হত্যাযজ্ঞ নিয়ে ভালো কোনো তালিকা বা রেকর্ড তৈরি করেনি এদেশের কোনো সরকার। বরং পারলে বাধা দিয়েছে। মুজিব সরকার কমিটি গঠন করে পরে কাজ বন্ধ করে দিয়েছিল। পরবর্তীতে যারাই ব্যক্তিগতভাবে এই কাজের সাথে জড়িত হয়েছেন তারা খুন হয়েছেন। এই ধারাবাহিক খুনের সর্বশেষ শিকার জাতীয় ভার্সিটির ভিসি আফতাব আহমাদ। তাই আজ পর্যন্ত সুষ্ঠু কোনো শুমারি হয়নি যে, কতজন মানুষ ১৯৭১-এ খুন হয়েছেন।

২০১০ সালে সংসদে মুক্তিযোদ্ধা বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব প্রাপ্ত প্রতিমন্ত্রী তাজুল ইসলাম বলেন, 'স্বাধীনতা যুদ্ধে কতজন মারা গিয়েছে তা গণনার কোন পরিকল্পনা এ সরকারের নেই'। বিদেশের অনেক ব্যক্তি ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান এ ব্যাপারে বিভিন্ন তথ্য দিলেও দেশের সব সরকার ছিল বরাবরের মতই নির্বিকার। শেখ মুজিব পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তনের পথে ১৯৭২ সনের ১০ জানুয়ারী ভারতের পালাম বিমানবন্দরে সাংবাদিকদের বলেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ ৩ (তিন) মিলিয়ন মানুষ মারা গিয়েছে; আজোবধি ৩ (তিন) মিলিয়ন তথা ৩০ (ত্রিশ) লক্ষ মানুষ মারা গিয়েছে এ সংখ্যাই প্রচলিত আছে। শেখ মুজিব পাকিস্তানের কারাগার থেকে বের হয়ে দেশে না আসতেই কোনো তদন্ত ছাড়াই কেন এমন বললেন এই বিষয়ে বিবিসি সাংবাদিক সিরাজুর রহমান এক সাক্ষাৎকারে বলেন, বাংলাদেশে ফেরত আসার সময় মুজিব জিজ্ঞাসা করলেন কেমন মানুষ মারা গেল যুদ্ধে? তখন সিরাজুর রহমান তাকে জানিয়েছেন আমরা আশংকা করছি প্রায় তিন লক্ষ মারা গেছে। এরপর সাংবাদিকদের তিনি থ্রি মিলিয়ন বলেছেন। সিরাজুর রহমান বলেছেন সেই সময়ের উত্তেজনা ও উদ্ভ্রান্ত মুহূর্তে শেখ মুজিব তিন লক্ষকে ভুলে থ্রি মিলিয়ন বলে ফেলেছেন।

বাংলাদেশে সেই সময় মুজিবকে তার অনুসারীরা প্রফেটিক মর্যাদা দিয়েছে। মুজিব বলেছে অতএব তাই ঠিক! এমন অবস্থা আজো চলমান। এ ব্যাপারে ১৫.০৬. ১৯৯৩ তারিখে সংসদে আলোচনায় কর্ণেল আকবর হোসেন বলেন যে, আওয়ামী লীগ স্বাধীনতা যুদ্ধে ৩ (তিন) মিলিয়ন মানুষ মারা গিয়েছে উল্লেখ করে যা মূলতঃ প্রকৃত সংখ্যার ১০ (দশ) গুণ। তখন আওয়ামী লীগের আবদুস সামাদ আজাদ বলেন যে, জিয়াউর রহমানসহ কেউ এ সংখ্যা নিয়ে প্রশ্ন করেননি; আমাদের নেতা শেখ মুজিব যেহেতু সংখ্যাটি বলেছেন ধরে নিতে হবে এটিই সঠিক।

শর্মিলা বসু বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে কতজন মারা গিয়েছে সে হিসেব দিতে গিয়ে শাখারীবাজারের বর্ণনা দিয়েছেন এভাবে“ In Shakharipara an estimated 8,000 men, women and children were killed when the army, having blocked both ends of winding street, hunting them down house by house. The description is entirely false. Survivors of the attack on Shakharipara on March 26 testify that about 14 men and one child (carried by his father) were killed inside a single house that day."

বিচারপতি হামুদুর রহমান কমিশন রিপোর্টে এই সংখ্যা প্রায় ২৬ হাজার, শর্মিলা বসু বলেন এ যুদ্ধে প্রায় ৩৬ হাজার নিহত হয়েছেন, কল্যাণ চৌধুরীর মতে ১২,৪৭,০০০ জন এবং British Medical Journal এ প্রকাশিত “Fifty Years of Violent War Deaths from Vietnam to Bosnia: Analysis of Data from World Health Survey Programme” বলা হয়েছে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ ২,৬৯,০০০ (দু' লক্ষ ঊনসত্তর হাজার) জন মানুষ মারা গিয়েছে। এভাবে নানান বর্ণনা পাওয়া যায়। বাঙালি লেখকরা প্রায় সবাই মুজিবের কথাকে চূড়ান্ত ধরে নিয়ে নিহতের সংখ্যা তিরিশ লাখ উল্লেখ করেছেন। ঢাকায় প্রত্যাবর্তনের পরে মুজিবনগর সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ টিভি ভাষণে বলেন, “দশ লক্ষাধিক মানুষের আত্মাহুতির মাঝ দিয়ে আমরা হানাদার পশুশক্তির হাত থেকে পদ্মা-মেঘনা-যমুনা বিধৌত বাংলাদেশকে স্বাধীন করে ঢাকার বুকে সোনালী রক্তিমবলয় খচিত পতাকা উত্তোলন করেছি।

শেখ মুজিব ২৯ জানুয়ারী ১৯৭২ ডেপুটি ইন্সপেক্টর অব পুলিশ আব্দুর রহিমকে প্রধান করে মুক্তিযুদ্ধে হতাহতের সংখ্যা নির্ধারণের জন্য ১২ সদস্য বিশিষ্ট একটি কমিটি গঠন করেন। ৩০ এপ্রিল ১৯৭২ তারিখের মধ্যে হতাহতের সংখ্যা, ক্ষয়-ক্ষতিসহ এর সাথে জড়িতদের অপরাধীদেরকে চিহ্নিত করার জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়। কিন্তু অজ্ঞাত কারণে কমিটিকে পরে কাজ করতে দেওয়া হয়নি। প্রসঙ্গত এই আব্দুর রহীমকে প্রধান করেই রাজাকারে বাহিনী গঠন করা হয়েছিল। পরবর্তীতে শেখ মুজিব সরকার প্রধান রাজাকার কমান্ডার আব্দুর রহীমকে সচিব পদে উন্নীত করেন।

বস্তুত ১৯৭১ সালের ১ থেকে ২৫ মার্চ আওয়ামী ও নিউক্লিয়াসের সন্ত্রাসীদের চালানো বর্বরতার একটি গোপন ঘাঁটি ছিল সেই বাড়িটি। যেখানে সন্ত্রাসীরা একত্রিত হতো এবং এখানে অস্ত্র ও বোমা বানানো হতো। সেনাবাহিনীর অভিযানের সময় তারা সেনাবাহিনীর সাথে যুদ্ধ করে মারা যায়। এই সংখ্যা ১৫। কিন্তু ইতিহাস বিকৃতকারীরা সংখ্যা দেখিয়েছে ৮০০০। শাঁখারিবাজারে সব বাড়িতে গণহারে অভিযান চালানো হয় নি, শুধুমাত্র সুনির্দিষ্ট তথ্যের ভিত্তিতে একটি বাড়িতে অভিযান চালানো হন। যেভাবে ঢাবির সব হলে অভিযান চালানো হয়নি। শুধুমাত্র দুটি হলে অভিযান চালানো হয়েছে।

শর্মিলা বসু অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির একজন গবেষক। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ইস্যুতে তিনি একজন নিরপেক্ষ গবেষক বলে বিবেচিত। তিনি পাকিস্তানী বাহিনীর বর্বরতা ও গণহত্যা প্রমাণ করতে এসে প্রচলিত ইতিহাসের সাথে সত্যের ব্যাপক বিরোধ দেখতে পান। যা তিনি তার গবেষণায় উল্লেখ করেন।

কোন যুদ্ধেই শুধু একপক্ষের মানুষ মারা যায় না, যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সকল পক্ষের মানুষই মারা যায়। যুদ্ধোত্তরকালে কোন পক্ষের কত জন নিহত বা আহত হয়েছে তার হিসেব বের করার দায়িত্ব রাষ্ট্রের। কিন্তু রাষ্ট্র সে দায়িত্ব পালন করেনি বা করতে পারে নি। বাংলাদেশে কত মানুষ মারা গেছে তা নিয়েই কেবল আলোচনা হয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে কতজন মুক্তিযোদ্ধা নিহত হয়েছেন তার সংখ্যা নিয়ে তেমন আলোচনা নেই। কারণ এ সংখ্যা নিয়ে আলোচনা হলে যুদ্ধকালে ত্রিশ লাখ মানুষ মারা যাবার তথ্যটি সকলের কাছে অগ্রহণযোগ্য হয়ে পড়বে। স্বাধীনতা যুদ্ধে মোট ৬৬২৯ জন মুক্তিযোদ্ধা নিহত হয়েছেন এবং যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা হচ্ছে ১৫১১ জন। ৬৬২৯ জনের মধ্যে সেনাবাহিনীর সংখ্যা ১৫৪৪, নৌবাহিনীর সংখ্যা ২১, বিমানবাহিনীর সংখ্যা ৪৭, ইপিআরের সংখ্যা ৮১৭, পুলিশ ১২৬২ আর বেসামরিক মুক্তিযোদ্ধা ২৯৩৮ জন নিহত হয়েছে।

আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার যা আমাদেরকে সত্যের কাছাকাছি পৌঁছতে সহায়তা করবে তা হলো, ১৯৭২ সালে শেখ মুজিব সরকার শহীদ পরিবারকে প্রতিজন শহীদের বিপরীতে ২০০০ (দু’হাজার) টাকা করে অনুদান দেয়ার ঘোষণা করে। সারাদেশ থেকে প্রায় ৭২০০০ আবেদন জমা পড়ে। যাচাই বাছাই করে দেখা যায় এর মধ্যে প্রায় ২২ হাজার হলো স্বাধীনতাবিরোধী যারা মুক্তিবাহিনীর হাতে নিহত হন। পরবর্তীতে রাজাকারদের নাম বাদ দিয়ে করে মোটামুটি ৫০০০০ নিহত ব্যক্তির জন্য তাদের পরিবারকে ২০০০ (দু'হাজার) টাকা করে অনুদান দেওয়া হয়। এই তথ্যকে বিবেচনায় নিয়ে বাংলাদেশ ইনষ্টিটিউট অব স্ট্রাট্রেজিক স্ট্যাডিজের ১৯৯৩ সালের অক্টোবর মাসের জার্নালে বলা হয়েছে বাংলাদেশ-পাকিস্তানের মধ্যে সংঘটিত যুদ্ধের মেয়াদ ছিল ৮ মাস ৩ দিন । এ যুদ্ধে নিহত হয় ৫০ হাজার মানুষ।

উপরে হত্যাকান্ড বা নিহতের যে হিসেব দেওয়া হয়েছে তা শুধু পাকিস্তান সামরিকবাহিনী, এর সহযোগী বাহিনী বা দালাল কর্তৃক বাঙালি হত্যার সংখ্যা। এভাবে বিষয়টি একপেশে প্রচারণার শিকার। মুক্তিযোদ্ধা ও ভারতীয় বাহিনী কর্তৃক অখন্ড পাকিস্তানে বিশ্বাসী বাঙালি, বিহারি ও তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানী নিহত হওয়ার বিষয়টি একেবারে চাপা পড়ে গিয়েছে। পাশাপাশি যুদ্ধে পাকিস্তান ও ভারতের সামরিকবাহিনীর সদস্য নিহত হওয়ার বিষয়টিও আলোচনার বাইরে থেকে যাচ্ছে। যুদ্ধে পাকিস্তান সামরিকবাহিনীর প্রায় ৪৫০০ সদস্য নিহত ও প্রায় ৮০০০ জন আহত হয়েছেন। ভারতীয় সামরিক বাহিনীর ১৪২১ সদস্য নিহত ও ৪০৫৮ জন আহত হয়েছে।

বাংলাদেশে একাত্তরে যত নারী-ধর্ষণ হয়েছে তার চেয়ে বহুগুণ বেশী হয়েছে সত্যকে ধর্ষণ। গবেষক শর্মিলা বসু তেমনটাই মনে করেন। নারী ধর্ষণ নিয়ে দীর্ঘদিন গবেষণার পর তার মনে এ ধারণা দৃঢ়মূল হয় যে, বাংলাদেশে একাত্তরে নারী ধর্ষণ হয়তো হয়েছে ঠিকই, তবে বিপুল সংখ্যক অবাঙালি মহিলাও বাঙালিদের হাতে ধর্ষিতা হয়েছে। অথচ বাংলাদেশের ইতিহাসের বইয়ে তার কোনো উল্লেখই নেই। ১৯৭১ সালের ধর্ষণ নিয়ে শর্মিলা বসু তার নিজের গবেষণায় যে উপসংহারটি টেনেছেন তা হলো, “একাত্তরে পূর্ব পাকিস্তানে ঘটে যাওয়া কয়েকটি ঘটনার মাঠ পর্যায়ের গবেষণায় আমি দেখলাম, বাংলাদেশী অংশগ্রহণকারীগণ এবং যারা ঘটনা প্রত্যক্ষদর্শী ছিল তারা যুদ্ধের বর্ণনা দিল। গুলি করে হত্যার বর্ণনাও দিল। কিন্তু তারা আমাকে এ কথাও বললো, “আর্মি মহিলাদের কোনো ক্ষতি করেনি। তবে যদি কেউ দুর্ভাগ্যক্রমে ক্রস ফায়ারে পড়ে যায় তবে অন্যকথা। একাত্তরে ধর্ষণের যে বিশাল সংখ্যা তুলে ধরা হয়েছিল সে প্রেক্ষিতে এটি আমার কাছে বিস্ময়কর লেগেছে। আমার কেস স্টাডিজে আমি একটি মাত্র ঘটনারও প্রমাণ পেলাম না।

হত্যার সংখ্যা নিয়ে যেমন অসততার আশ্রয় নেয়া হয়েছে, ধর্ষণের সংখ্যা নিয়েও তেমনই অসত্য বর্ণনা দেওয়া হয়েছে। আমি যখন স্কুলে পড়তাম তখন এই সংখ্যা জরিপ ছাড়াই ছিল দুই লক্ষ। ইতোমধ্যে এক যুগ পরে সেই সংখ্যা আর এক লক্ষ বেড়ে গিয়েছে। এখন বলা হয়, তিন লক্ষ মা-বোনকে ধর্ষণ করা হয়েছে। এই যে প্রচারণা চলছে তারও কোন জরিপ করা হয়নি।

শর্মিলা বসু বলেন “60000 Pakistan Army to kill three million and rape three hundred thousand women, each and everyone of them had to kill 50 persons and rape 5 women.”

শর্মিলা বসু আরো লিখেছেন, //একাত্তরের যুদ্ধের ওপর গবেষণা করতে গিয়ে দেখলাম ২ লাখ থেকে ৪ লাখ ধর্ষিতার যে সংখ্যা বাংলাদেশে বলা হয় তার হিসাব নিকাশের কোন ভিত্তি নেই। এটি অবশ্যই অপ্রত্যাশিত নয় যে ভূক্তভোগীদের সংখ্যার একটি অনুমান (estimate) করা হবে। তবে প্রতিটি অনুমানের মূলেও মাঠ পর্যায়ের কিছু সাক্ষী প্রমাণ থাকতে হয় যার ভিত্তিতে একটি পরিসংখ্যান বের করা যায় । কিন্তু বাংলাদেশে একাত্তরে তেমন কিছুই ছিল না। এ ব্যাপারে কোন সরকারি পরিসংখ্যানও নাই। পরিসংখ্যানের একটা বিশ্বাসযোগ্য ভিত্তি হতে পারতো মাঠপর্যায়ের তদন্ত, ক্ষতিপূরণ এবং পুনর্বাসনের ক্ষতিপূরণ থেকে। কিন্তু তেমন কিছু পাওয়া যায় নি।//
(পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর সদস্য ছিল ৬০,০০০; তারা যদি ত্রিশ লক্ষ মানুষ মেরে থাকে ও তিন লক্ষ মহিলাকে ধর্ষণ করে থাকে , তা হলে প্রতিজন পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর সদস্য গড়ে ৫০ জন মানুষ মেরেছে ও ৫ জন করে মহিলাকে ধর্ষণ করেছে ।)।

ফেরদৌসীর যুক্তি হলো, সে ছিল পরিবারের একমাত্র উপার্জনকারি তাই তাকে খালিশপুরে থাকতে হয়েছিল। তার মতে যেদিন সে প্রথম ধর্ষণের শিকার হয় সেদিন সে তার ম্যানেজারের সাথে দুপুরের খানা খেতে গিয়েছিল, কাজ শেষে সে তার সাথে তার এপার্টমেন্টেও গিয়েছিল। এবং সেখানেই সে ধর্ষণের শিকার হয়। পরের দিন সে আবার কাজে গিয়েছিল। এখানে প্রশ্ন হলো, যে ধর্ষণ নিয়ে একাত্তরের পর সে এতবড় জবানবন্দী পেশ করলো এবং ইতিহাসের বইয়ে প্রকাণ্ড ও একমাত্র সাক্ষীতে পরিণত হলো, অথচ যেদিন সে ধর্ষিতা হলো, সেদিন তার নিজের আচরণটি কেমন ছিল? সে যখন ধর্ষিতা হওয়ার মুখে তখনও সে বাধা দেয়নি। প্রতিবাদও করেনি। ধাক্কাধাক্কি করে সে ধর্ষণ থেকে বাঁচবার বা পলায়নেরও চেষ্টা করেনি। যেখানে ধর্ষণকারি হলো স্বয়ং ম্যানেজার, সে স্থান কোন অবস্থাতেই তার জন্য নিরাপদ ছিল না। অথচ সে বিপদজনক স্থান থেকে সেদিন বা পরের দিন পলায়নও করেনি। পরবর্তী নয় মাসেও সে পলায়নের চেষ্টা করেনি। বরং পরের দিন আবার সে অফিসেই কাজে গেছে। অথচ কোন অবস্থাতেই এ বিশ্বাস করা যাবে না যে ফেরদৌসী বন্দী ছিল। নিরাপদ স্থানে সে চলে যেতে পারতো। কিন্তু সে যায়নি।//

বাংলাদেশের ইতিহাসে ধর্ষণের প্রমাণরূপে খাড়া করা হয়েছে ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিনীকে। শাহরিয়ার কবির তার সম্পাদিত “একাত্তরের দুঃসহ স্মৃতি” বইতে তার জবানবন্দীকে দলিলরূপে পেশ করেছেন। শর্মিলা বসু তার ঘটনা কেস স্টাডি হিসেবে নিয়ে কাজ করছেন। এই বিষয়ে শর্মিলার মন্তব্য হলো, //ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিনী একজন মধ্যবিত্ত শ্রেণীর শিক্ষিত মহিলা এবং পেশায় ভাস্কর। তার কাজের স্থান ছিল খুলনার এক জুটমিলের অফিসে। ফেরদৌসীর অভিযোগ তাকে প্রথমে তার আগাখানী জেনারেল ম্যানেজার ধর্ষণ করে। তারপর সে ১৫ জন পাকিস্তানী সামরিক অফিসারের নাম নেয় যাদের অবস্থান ছিল যশোর ও খুলনায় । তাদের মধ্য থেকে একমাত্র দুইজন বাদে সবার বিরুদ্ধে হয় ধর্ষণ অথবা ধর্ষণের চেষ্টা বা অন্য প্রকার যৌন নিপীড়নের অভিযোগ আনা হয়েছে যা করা হয়েছে তাকে জিজ্ঞাসাবাদের নামে।

তার নিজের ভাষ্য মতে সে একজন তালাকপ্রাপ্তা তিন সন্তানের মা। তার সন্তানেরা খুলনায় ফেরদৌসীর নানীর কাছে থাকতো আর নিজের মা এবং ৭ জন ভাই-বোন নিয়ে সে খালিশপুরে থাকতো। যেখানে সে জুটমিলে কাজ করতো। আহসান উল্লাহ আহমেদ নামে ফেরদৌসীর একজন পুরুষ বন্ধু ছিল এবং সে ছিল পাশ্ববর্তী আরেকটি জুটমিলের লেবার অফিসার। মিলিটারি এ্যাকশনের পর আহসান উল্লাহ তার নিজের পরিবারের সদস্যদের নিরাপদ স্থানে চলে যেতে বলে। ফেরদৌসীর মা এবং তার ভাই-বোনেরাও শহর চলে যায়। তখন ফেরদৌসী একা থেকে যায় তবে মাঝে মধ্যে তার কোন ভাই বা বোন বেড়াতে আসতো। তখন তার পুরুষ প্রেমিকটি পাশেই কাজ করতো।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে আওয়ামী লীগের কোনো নেতা মারা গেছেন অথবা তাদের আত্নীয়-স্বজনরা মারা গিয়েছেন এমনটা শুনা যায়নি। শহীদুল্লাহ কায়সারের স্ত্রী পান্না কায়সার বলেন “আওয়ামী লীগের প্রথম সারির কোন নেতা যুদ্ধে আপনজন হারাননি।” অথচ এর বিপরীতে পাকিস্তানের অখন্ডতায় বিশ্বাসী তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের গভর্ণর মোনায়েম খানকে মুক্তিযোদ্ধারা তার বাড়িতেই হত্যা করে। পূর্ব পাকিস্তানে শান্তি ও কল্যাণ কাউন্সিলের আহবায়ক মৌলভী ফরিদ আহম্মেদকে গুম করা হয়। মুসলিম লীগ নেতা আজিজুল হক চৌধুরী, আব্দুল জব্বার আমীন ও সোলায়মান পাইকারকে হত্যা করে মুক্তিযোদ্ধারা। সাবেক মন্ত্রী জহুরুল হক (লাল মিয়া), সিলেট পিডিপি সভাপতি জসিমউদ্দিন, প্রাক্তন এমএনএ আবদুল হামিদ, মুসলিম লীগ নেতা সিরাজুল হক, বগুড়ার খোরশেদ আলমসহ শত শত স্বাধীনতা বিরোধী নেতা কর্মীকে যুদ্ধ কালেই হত্যা করা হয়। অথচ তারা বেসামরিক নাগরিক ছিলেন। তারা কারো বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ন হন নি।

ধর্ষণের ইতিহাস কীভাবে বিকৃতি করা হয়েছে তার একটি নমুনা বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী আর জেয়াদ আল মালুমের কথোপকথন থেকেই অনুমান করা যায়। “জেয়াদ আল মালুম বলেন, আমাদের আইনের প্রধান বৈশিষ্ট্যের জায়গাটা হলো, সাধারণ ফৌজদারী সাক্ষ্য-প্রমাণের জন্য যে সমস্ত সাক্ষ্য-প্রমাণের বিষয় থাকে, আমাদের ক্ষেত্রে আপনারা হয়তো লক্ষ্য করে থাকবেন, আমাদের আইনে শুধুমাত্র ব্যক্তি সাক্ষী তাই নয়, এমনও হতে পারে, রায়েরবাজার বধ্যভূমি, এটাতো নিজেই একটা সাক্ষী। টাঙ্গাইলের ভুয়াপুরের একটা অঞ্চলে রেপের ঘটনা রয়েছে। ছাব্বিশাতে বহু রেপ ভিকটিম আছে।

এ সময় কাদের সিদ্দিকী প্রবল আপত্তি তুলে ধরে বলেন, এখানে আমার আপত্তি আছে। ইতিহাস বিকৃত করা অত্যন্ত অন্যায়। ছাব্বিশাতে একটি রেপও হয়নি। ছাব্বিশা মুক্তিযুদ্ধে আমার নিয়ন্ত্রিত এলাকা ছিল। ছাব্বিশা গ্রামটি সমস্ত পুড়ে ছারখার করে দিয়েছিল। তাই আমি বলবো, বিভ্রান্ত করা ভালো কাজ না। এটা বিরক্তিকর। জিয়াদ আল মালুম বলেন, আমি বিভ্রান্ত করছি না। আমাদের কাছে সে ধরনের তথ্য-উপাত্ত আছে। কাদের সিদ্দিকী এ পর্যায়ে বলেন, তথ্য যদি ওই রকম বিভ্রান্তিকর হয় তাহলে তো হবেই। যুদ্ধ করলাম আমি। ছাব্বিশা গ্রামে এক দিনে ৩৬ জন রেপ, যে গ্রাম জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করা হলো, তখন কেউ রেপ করে?”

এখানে যদি জেয়াদ আল মালুম সত্য হয়ে থাকেন তবে ছাব্বিশাতে রেপের ঘটনা কাদেরিয়া বাহিনীর দ্বারাই সংঘটিত হয়েছে। যা এখন জেয়াদ আল মালুম সেনাবাহিনীর ওপর চাপিয়ে দিচ্ছেন। আর যদি কাদের সিদ্দিকী সত্য হয়ে থাকেন তবে সেখানে কোনো রেপের ঘটনা ঘটে নি। জেয়াদ আল মালুম মিথ্যা অভিযোগ করছেন। এখানে জেয়াদ আল মালুম দুই ক্ষেত্রেই মিথ্যেবাদী। কারণ ছাব্বিশাতে একদিন মাত্র অভিযান চালিয়ে ফিরে যেতে বাধ্য হয় সেনাবাহিনী। তাই সেনাবাহিনী দ্বারা রেপের ঘটনা অবাস্তব।

এদেশে প্রকাশ্যে গণহত্যা শুরু হয় ১৬ ডিসেম্বরের পর থেকে। যেসব বাঙালি নেতা স্বাধীনতার পক্ষে অবস্থান নেন নি তাদের বিরুদ্ধে নির্বিচার হত্যা চলতে থাকে। এই হত্যাকাণ্ডে নেতৃত্ব দেন কাদের সিদ্দিকীর কাদেরিয়া বাহিনী ও নিউক্লিয়াসের সদস্যদের দিয়ে গঠিত ভারতীয় জেনারেল ওবানের বিশেষ বাহিনী 'মুজিব বাহিনী'। বহু মসজিদ ও মাদ্রাসা বিশেষত কওমী মাদ্রাসা বন্ধ হয়ে যায় সেদিন থেকে। এই হত্যাযজ্ঞ ও গণহত্যা এতই মর্মান্তিক ছিল যে, ঢাকার অনেক কওমী মাদ্রাসা চালু হতে প্রায় তিন বছর সময় লেগে গিয়েছে।
আর বধ্যভূমির কথা যা বলা হয়েছে তার দিকে যদি আমরা নজর করি তাহলে দেখতে সবগুলো বধ্যভূমি ছিল ভারত থেকে আসা বিহারের মজলুম মুহাজিরদের আবাসস্থলে বা তার কাছাকাছি। বলা যায় এপ্রিল ও মার্চে বিহারীদের ওপর ঘটে যাওয়া নির্মম ও নির্বিচার হত্যাযজ্ঞই বধ্যভূমির কারণ। যেগুলো এখন বাঙালি হত্যা বলে চালিয়ে দেওয়া হচ্ছে। আইসিটি ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর জেয়াদ আল মালুমরা এভাবেই তথ্য বিকৃতি করে গেছেন পুরোটা সময় জুড়ে।

এই ১৯৫ জনের মধ্যে প্রায় অর্ধেকই হত্যার নির্দেশের জন্য অভিযুক্ত অর্থাৎ তারা যুদ্ধ করেননি বা সরাসরি অভিযানে যাননি। তাহলে কারা তিরিশ লক্ষ মানুষকে হত্যা করলো? অথবা কারা লক্ষ লক্ষ মানুষকে হত্যা করলো? ১০০ জনের কম মানুষ কীভাবে লাখ লাখ মানুষকে খুন করলো? এবার আসুন ধর্ষণের অভিযোগ নিয়ে কথা হোক। ১৯৫ জনের মধ্যে মাত্র ১৩ জনের বিরুদ্ধে মহিলাদের উঠিয়ে নিয়ে যাওয়ার অভিযোগ আসলো! তাহলে কী এই ১৩ জনই ৩ লক্ষ নারীকে ধর্ষণ করলো! আবার খেয়াল করুন এই ১৯৫ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছে মাত্র। প্রমাণিত নয়। যদি অভিযোগ সত্যও প্রমাণিত হয় তবে পাকিস্তান সেনাবাহিনী কর্তৃক ধর্ষণের ঘটনা অনধিক ২০। এখানে এমন কোনো ঘটনা ঘটেনি যে, কোনো স্থানে ধর্ষণ হয়েছে কিন্তু শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি। কারণ পাকিস্তান বাহিনীর সব সদস্যকেই বাঙালি সৈনিকরা যারা মুক্তিযুদ্ধ করেছিল তারা চিনতো। একই ক্যান্টনমেন্টেই তারা থাকতো।

১৯৭০ সনের নির্বাচনের পরপরই বিহারিরা নির্যাতিত হতে শুরু করে। ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থানে বিক্ষিপ্তভাবে বসবাসরত বিহারিরা দলবদ্ধভাবে থাকা শুরু করে। তারপরও তারা নিজেদেরকে বা পরিবারের সদস্যদেরকে রক্ষা করতে পারেননি। স্কুল-কলেজ ও কর্মস্থলে যাতায়াতকালে তাদের উপর আক্রমণ হতে শুরু হয়। ঢাকা, চট্টগ্রাম, সৈয়দপুর, লালমনিরহাট, কুষ্টিয়া, যশোর, খুলনা, ময়মনসিংহসহ অন্যান্য স্থানে ১ মার্চ ১৯৭১ তারিখ হতেই বিহারি ও তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানীদের ওপর আক্রমণ ও হত্যাকাণ্ড ঘটায় আওয়ামী সন্ত্রাসীরা ও নিউক্লিয়াস। ১৯৭১ সনের ঘটনার ওপর পাকিস্তান সরকার কর্তৃক প্রকাশিত শ্বেতপত্রে এসব ঘটনায় নিহতের সংখ্যা প্রায় ১ লক্ষ উল্লেখ করা হয়।

এতক্ষণ যে বিষয়গুলো আলোচিত হয়েছে তা থেকে বুঝতেই পারছেন আমি বিভিন্ন সোর্স থেকে যুদ্ধের হতাহত উল্লেখ করার চেষ্টা করেছি। আর আমি যে অবস্থায় আছি তাতে আমার পক্ষে মাঠ পর্যায়ের গবেষণা অত্যন্ত বিপদজনক। আমি বিভিন্ন সোর্স থেকে সত্যের কাছাকাছি যাওয়ার চেষ্টা করেছি। আরেকটি বিষয় আমি আপনাদের সামনে উল্লেখ করতে চাই যা দ্বারা আপনারা অনুমান করতে পারবেন কী পরিমাণ হত্যাকাণ্ড হয়েছে!

সেসময়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সব বাহিনী মিলে আত্মসমর্পন করেছে ৬০০০০ সেনা ও কর্মকর্তা। ৯৩০০০ হলে বলে যে সংখ্যা আমরা শুনতে পাই তা হলো সেনাবাহিনীর পরিবার পরিজন ও পশ্চিম পাকিস্তানী সাধারণ জনগণসহ। যাই হোক বাংলাদেশ সরকার যখন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ আনে তখন স্পেসেফিক নাম দেওয়ার প্রয়োজন হয়। প্রথমে পাক সেনাবাহিনীর ৫০০০ এরও বেশি সদস্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ আনা হয়। যুদ্ধাপরাধ মানে বেসামরিক মানুষ হত্যা, লুটপাট, অগ্নিসংযোগ ও ধর্ষণ। এরপর যাচাই বাছাই করে বাংলাদেশ সরকার এই তালিকা আরো ছোট করে প্রায় ১২০০ জনের তালিকা প্রস্তুত করে। এরপর যখন সুনির্দিষ্ট অভিযোগ করার প্রয়োজন হয় তখন বাংলাদেশ সরকার মাত্র ১৯৫ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ উত্থাপন করতে সক্ষম হন। এই ১৯৫ জনকে বিচারের আওতায় আনার কথা ছিল। কিন্তু ভারত-পাকিস্তান-বাংলাদেশ ত্রিদেশীয় 'শিমলা চুক্তি'র মাধ্যমে তাদেরকে ছেড়ে দেওয়া হয়।

স্বাধীনতার পর স্বাধীনতার বিপক্ষের মানুষদের বিচার করার জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করে শেখ মুজিব সরকার। যেহেতু পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বন্দী সদস্য ও তাদের পরিবার ভারতের জিম্মায় তাই তাদের বিচার ইচ্ছেমত করার সুযোগ ছিল না। তাদের বিচার হবে আন্তর্জাতিক আইনে যুদ্ধাপরাধ মামলায়। আর যারা ছিলেন বাঙালি কিন্তু স্বাধীনতাবিরোধী তাদের বিচার করার জন্যে মুজিব সরকার দালাল আইনের ব্যবস্থা করেছিল।

তাহলে এবার বলা যেতে পারে পাকিস্তানীরা নয়, বাঙালিদের মেরেছে ও ধর্ষণ করেছে রাজাকার ও স্বাধীনতাবিরোধী বাঙালিরা। সেই চিত্রটাও আমরা একটু দেখে নিতে পারি। এদেশীয় জনগণ যারা স্বাধীনতার বিরোধীতা করেছিল তাদের বিচারের জন্য ১৯৭২ সালের ২৪ জানুয়ারী দালাল আইন প্রণয়নের পর ৬ ফেব্রুয়ারী, ১ জুন ও ২৯ আগস্ট তারিখে তিন দফা সংশোধনীর পর আইনটি চূড়ান্ত হয়।

এ আইনের অধীনে প্রায় একলাখ লোককে আটক করা হয়। এদের মধ্যে থেকে অভিযোগ আনা সম্ভব হয় ৩৭৪৭১ জনের বিরুদ্ধে। বাকীদের বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ না থাকায় ছেড়ে দেয়া হয়। অভিযুক্ত ৩৭৪৭১ জনের মধ্যে থেকে দালালী বা অপরাধের কোন প্রকার প্রমাণ না পাওয়ায় ৩৪৬২৩ জনের বিরুদ্ধে কোন মামলা দায়ের করাই সম্ভব হয়নি। সারাদেশে ৭৩টি বিশেষ ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে ২২ মাসে বাকি ২৮৪৮ জনকে বিচারের আওতায় আনা হয়।

১৯৭৩ সালের ৩০ নভেম্বর দালাল আইনে আটক যেসব ব্যক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধীদের সুনির্দিষ্ট কোনো অভিযোগ নেই তাদের জন্য ক্ষমা ঘোষণা করা হয়। এ ঘোষণার পর দালাল আইনে আটক ৩৭ হাজারের অধিক ব্যক্তির ভেতর থেকে প্রায় ২৬ হাজার ছাড়া পায়। সাধারণ ক্ষমা ঘোষণায় হয়, ‘যারা বর্ণিত আদেশের নিচের বর্ণিত ধারাসমূহে শাস্তিযোগ্য অপরাধে সাজাপ্রাপ্ত অথবা যাদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ রয়েছে তারা কোনোভাবেই ক্ষমার যোগ্য নন।’

যাদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ আনা হয়েছে, তাদের বিচার হয়। তাদের মধ্যে বিচারে মাত্র ৭৫২ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হয়। বাকী ২০৯৬ জন বেকসুর খালাস পায়। যে ৭৫২ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমানিত হয় তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগও গুরুদন্ড দেয়ার মতো ছিল না। একজনের বিরুদ্ধেও ধর্ষণের অভিযোগ প্রমাণিত হয় নি। শুধুমাত্র চিকন আলী নামের একজনকে হত্যার অভিযোগে ফাঁসির আদেশ দেওয়া হয়। তাহলে সে আবার আগের প্রশ্ন এত হত্যা কে করলো? এত ধর্ষণ কে করলো?

প্রাসঙ্গিকভাবে বলে রাখি ২০১০ সাল থেকে যাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের মামলা হয়েছে, যারা অভিযুক্ত হয়েছে ও যাদের দণ্ড কার্যকর করা হয়েছে এবং হচ্ছে তাদের কারো বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধ তো দূরের কথা দালাল আইনেও মামলা করা হয়নি। অথচ তারা প্রকাশ্যে তাদের বাড়িতে, কর্মস্থলে ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অবস্থান করেছেন। এটা বানোয়াট এবং প্রতিহিংসামূলক বিচার তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। বাংলাদেশের দৃষ্টিতে ১৯৭১ সালের অপরাধীদের মধ্যে অবাঙালি হলেন ১৯৫ জন। যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করা হয়েছে কিন্তু বিচার হয়নি। আর বাঙালি অপরাধী হলেন ৭৫২ জন। এই ৭৫২ জনের ১ জন বাদে কেউই হত্যা, গণহত্যা ও ধর্ষণের অপরাধ করেননি বলে বাংলাদেশের আদালত ঘোষণা দিয়েছেন।

যদি সত্যিই অনেক ধর্ষণ হয়ে থাকে অথবা ১০০ টি ধর্ষণের ঘটনাও ঘটে থাকে তবে এর দায় যুদ্ধের জয়ী পক্ষ মুক্তিযোদ্ধা ও ভারতীয় বাহিনীর। আর যদি তা না হয়ে থাকে তবে পুরো বিষয়টাই বানোয়াট ও মিথ্যা।

২০ ডিসে, ২০২০

বঙ্গকথা পর্ব-৭৩ : ১৯৭১ এ যেভাবে ধরাশয়ী হয় পাকিস্তান সেনাবাহিনী


ইন্দিরা গান্ধীর প্ল্যান ছিল আওয়ামী কর্মী, ভারতীয় গোয়েন্দা ও অন্যান্য বিদেশী গোয়েন্দাদের ব্যাপক তৎপরতা ও গেরিলা যুদ্ধে পাকিস্তান বাহিনী নাজেহাল হয়ে পড়বে। ম্যসাকার চালাবে পাকিস্তান। অবশেষে মানবতার দোহাই দিয়ে পাকিস্তানে ঢুকে পড়বে। রাশিয়া এক্ষেত্রে ভারতকে সাপোর্ট দিলেও সরাসরি যুক্ত হয়নি, কারণ তা চীন ও আমেরিকাকে আরো বেশি পাকিস্তানের পক্ষে সক্রিয় করবে। কিন্তু মে মাসে যখন পাকিস্তান সেনাবাহিনী সকল স্থানে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হলো তখন ইন্দিরা আর কোনোভাবেই পাকিস্তানে অস্থিরতা তৈরি করতে সক্ষম হচ্ছিল না। 


আন্তর্জাতিক সাহায্য পাওয়ার জন্য তিনি তৎপরতা চালাতে লাগলেন। কিন্তু সেরকম পজেটিভ কিছু পাননি। আমেরিকা তাকে হতাশ করলো। এরপরো দমে যেতে চান নি তিনি। এদিকে পাকিস্তান পরিস্থিতি ধীরে ধীরে শান্ত হচ্ছে দেখে রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে পূর্ব-পাকিস্তানের ক্ষমতা হস্তান্তর করেছে। টিক্কা খানকে প্রত্যাহার করে ডা. আব্দুল মোতালেব মালেককে গভর্ণর করা হয়েছে। নির্বাচন কমিশন শূন্য আসনগুলোতে নির্বাচনের প্রস্তুতি নিয়েছে। বাঙালিরা আবার নির্বাচনের উৎসবমুখর পরিবেশে চলে গেছে। এসব ঘটনাপ্রবাহ ইন্দিরাকে ব্যাপকভাবে বিচলিত করে। 

তাই তিনি পাকিস্তান ভেঙে দেওয়ার সুযোগ যাতে হাতছাড়া না হয় সেজন্য কাজ করতে থাকেন। 


ভারতীয় সামরিক বাহিনী পাকিস্তানে কর্মরত RAW এর এজেন্ট, মুক্তিযোদ্ধা ও সে দেশে আশ্রয়গ্রহণকারী শরণার্থীদের মাধ্যমে এ অঞ্চলের সার্বিক অবস্থার তথ্য সংগ্রহ করে। সামগ্রিক পরিস্থিত্রি খুঁটিনাটি বিশ্লেষণ ও মূল্যায়ন করার পর তারা এ যুদ্ধে সরাসরি অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত নেন। প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা ভারতীয় সেনাপ্রধান মানেক'শ-কে সর্বাত্মক যুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়ার জন্য বলেন। মানেক'শ রাজি হননি। কারণ যুদ্ধে জড়ানোর মতো উপযুক্ত কারণ তখনো তৈরি হয়নি। এছাড়া আমেরিকা যদি ব্যবস্থা গ্রহণ করে তবে পাল্টা ব্যবস্থা নেওয়ার মতো সক্ষমতা ভারতের নেই। 


এদিকে নতুন রাষ্ট্র বাংলাদেশের প্রতি স্বীকৃতি আদায়ে তাজউদ্দিন আহমেদ মুসলিম ছাড়া আর যত জাতি আছে সবার কাছে ধরনা দিয়েছে। ভারত, রাশিয়া আর ইংল্যান্ড তো আছেই সাথে পাকিস্তানের মিত্র হিসেবে পরিচিত আমেরিকা ও চীনের সাথেও যোগাযোগ চালিয়ে গেছে। চীন তাদের পুরোপুরি হতাশ করেছে আর আমেরিকা বরাবরের মতো আশা-নিরাশার দোলাচলে রেখেছে। শুধু তাই নয় তাজউদ্দিন মুসলিমদের সর্বোচ্চ দুশমন বলে পরিচিত ইহুদীদের কাছে সমর্থন আদায়ের জন্য গিয়েছেন। কারণ তিনি জানতেন ইহুদি-খ্রিস্টানরা ধর্ম বিবেচনায় হলেও পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যাবেন।  


তাজউদ্দিন ইসরাঈলের সাথে যোগাযোগের দায়িত্ব দেন আওয়ামী লীগের আব্দুস সামাদ আজাদকে। ইসরাঈল প্রবাসী সরকারের ভূয়সী প্রশংসা করে ও পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যেকোনো সহায়তার অঙ্গিকার প্রকাশ করে। প্রবাসী সরকারের অনেক কর্মকর্তাই এটিকে ভালো চোখে দেখে নি। হয়তো ইহুদী হওয়ায় মুসলিম সত্ত্বাটি জেগে উঠেছে। সমাজতন্ত্রী ছাড়া যারা শুধু আওয়ামী লীগ তারা কেউই ইসরাইলের সাথে সম্পর্ক রাখতে ইচ্ছুক ছিল না। তাই প্রবাসী সরকারের সাথে ইসরাঈলের সরাসরি সম্পর্ক তৈরি হয়ে ওঠেনি। 


তারপরও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রতি ইসরাইলের ভূমিকা ছিল বিস্ময়কর। ইসরাইল বিশ্বের প্রথম রাষ্ট্র যারা ১৯৭১ সালের এপ্রিল মাসে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদান করেছিল। ১৯৭১ সালের ২ জুলাই ইসরাইলি পার্লামেন্ট বাঙালিদের উপর পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর আক্রমণের অভিযোগ এনে নিন্দা প্রস্তাব গৃহীত হয়। এমনকি ইসরাইল রেডক্রস বাঙালি মুক্তিযোদ্ধা, শরণার্থীদের জন্য উল্লেখযোগ্য পরিমাণ ঔষধ কাপড় ও খাবার ভারত সরকারের নিকট পাঠায়।


সরাসরি যোগাযোগ না রাখলেও তাজউদ্দিন ও ইসরাঈলের সাথে সম্পর্কের মধ্যস্থতা করেছেন ভারতের পূর্বাঞ্চলের ইহুদী কমান্ডার জ্যাকব। মূলত ভারত ১৯৭১ সালের যুদ্ধ করেছিলো জ্যাকবের নেতৃত্বে। ইন্দিরা গান্ধী শুরু থেকেই পূর্ব পাকিস্তানে আক্রমণ চালিয়ে বাংলাদেশকে আলাদা করার ব্যাপারে দৃঢ় ছিলো। কিন্তু সেনাপ্রধান মানেক'শ এর প্রতিক্রিয়া হিসেবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের ভূমিকা কী হবে তা নিয়ে যুদ্ধ জড়াতে চাইছিলো না। 


পাকিস্তানের সাথে মার্কিনীদের সমাজতন্ত্রী বিরোধী সিয়াটো চুক্তি রয়েছে। তাতে তারা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ছিলো যে, কোনো সমাজতন্ত্রী রাষ্ট্র দ্বারা তারা পরষ্পরের কেউ আক্রান্ত হলে উভয়েই যুদ্ধে জড়িয়ে পড়বে। সেই হিসেবে পাকিস্তান তাদের সমস্যাকে সমাজতন্ত্র সমস্যা হিসেবে বেশি আখ্যায়িত করেছে। এদিকে ভারতও রাশিয়াকে এই যুদ্ধে আমন্ত্রণ জানাতে চায় না। কারণ রাশিয়ার অংশগ্রহণ যুদ্ধকে জটিল করবে এবং আমেরিকা রাশিয়াকে ঠেকাতে সব ধরণের চেষ্টা করবে। 


মানেকশ তাই সরাসরি যুদ্ধে না জড়িয়ে বাঙালিদের প্রশিক্ষণ ও অস্ত্র দিয়ে যুদ্ধ করানোর নীতি গ্রহণ করেছে। এদিকে ইহুদী জে এফ আর জ্যাকব ইন্দিরাকে আশ্বস্ত করেন আমেরিকাকে নিষ্ক্রিয় করার ও স্বল্পমেয়াদি যুদ্ধে পাকিস্তানকে হারাবার সকল পরিকল্পনা তার আছে। জ্যাকব পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ জয়ে ইসরাঈলকে ব্যবহার করেন। ইসরাঈলও সর্বাত্মক সাহায্য করতে প্রস্তুত ছিল। সেসময় ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী ছিলো গোল্ডা মেয়ার। গোল্ডা মেয়ার দফায় দফায় পাকিস্তান ইস্যুতে মিটিং আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নিক্সনের সাথে। তিনি আমেরিকাকে নিরপেক্ষ থাকতে রাজি করান। 


পাকিস্তান যাতে ভেঙে যায় এই ব্যাপারে ইসরাঈল আন্তরিক ছিল। গোল্ডা মেয়ার ভারতকে অস্ত্র সাহায্য পাঠায়। ইন্দিরা যাতে এই যুদ্ধে স্ট্রং থাকে সেজন্য অস্ত্র সাহায্য ও শরনার্থী সমস্যা মোকাবেলায় ভারতকে সাহায্য করে ইসরাঈল। ইন্টারেস্টিং বিষয় হলো ভারতের সাথে তখন ইসরাঈলের কোনো কূটনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিলো না। তাছাড়া ৭১ সালে ইসরাঈল অর্থনৈতিকভাবেও দুর্বল ছিলো। তবুও গোল্ডা মেয়ার এসব সাহায্য পাঠিয়ে ভারতকে মুসলিমবিরোধী যুদ্ধে চাঙা রাখে এবং এর মাধ্যমে ভারতের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের চেষ্টা চালায়। কিন্তু ইন্দিরা সাহায্য গ্রহণ করলেও রাশিয়ার বিরাগভাজন হওয়ার আশংকায় সেসময় কূটনৈতিক সম্পর্কের ইসরাঈলি প্রস্তাব ফিরিয়ে দেয়। 


১৯৭১ সালের অক্টোবরে শেষদিকে মুক্তিযুদ্ধে নিয়োজিত সকল বাহিনী তথা মুক্তিবাহিনী, মুজিববাহিনী, কাদেরিয়া বাহিনী ইত্যাদির কমান্ড ভারতীয় বাহিনী গ্রহণ করে এবং জেনারেল ওসমানীর বিরোধিতা সত্ত্বেও যৌথবাহিনী গঠন করে জ্যাকব। ভারতীয় বাহিনী সকল ক্ষেত্রে যুদ্ধ করার প্রস্তুতি গ্রহণ করার মাধ্যমে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানকে পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন করার সকল ব্যবস্থা সম্পন্ন করে। তাজউদ্দিন-ইন্দিরা চুক্তির দ্বিতীয় ২য় দফায় উল্লেখ ছিল যে, বাংলাদেশ ও ভারতের সশস্ত্র বাহিনী মিলে একটি যৌথ কমান্ডের মাধ্যমে সশস্ত্র বাহিনী পরিচালিত হবে। 


ভারতের সেনাপ্রধান উক্ত যৌথ কমান্ডের প্রধান হবেন এবং তার কমান্ড অনুসারে যুদ্ধে শামিল হওয়া বা যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। সে অনুসারে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সকল বাহিনী (সামরিক বাহিনী, আধাসামরিক বাহিনী, মুক্তি ফৌজ, মুজিব বাহিনীসহ অন্যান্য আঞ্চলিক মুক্তিবাহিনী) কার্যতঃ ভারতীয় বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। জেনারেল আতাউল গনি ওসমানী যাকে মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক হিসাবে ঘোষণা দেওয়া হয়, তাকে ভারতীয় সেনা কর্মকর্তা লে. জেনারেল আরোরা অধীনে কমান্ড গ্রহণ করতে হয়।


এদিকে জে এফ আর জ্যাকব তার পরিকল্পনা অনুসারে ও ইসরাঈল থেকে পজেটিভ ইঙ্গিত পেয়ে সর্বাত্মক যুদ্ধে নেমে পড়ে। যুদ্ধে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার সে নিজেই সিদ্ধান্ত নেয়। দিল্লি কিংবা মানেক'শর জন্য অপেক্ষা করে না। আত্মসমর্পনের খসড়া প্রস্তাব তার নিজেরই লেখা। সে কীভাবে অল্প সময়ে কৌশলে ব্লাফ দিয়ে আমীর আব্দুল্লাহ খান নিয়াজীকে পরাজিত করেন তা কিংবদন্তি হয়ে আছে। এজন্য সে ব্লাফ মাস্টার খ্যাতি পায়। 


ভারতীয় স্থলবাহিনীর সম্মুখ অভিযান শুরু হয় চারটি অঞ্চল থেকে

১. পূর্বে ত্রিপুরা রাজ্য থেকে তিন ডিভিশনের সমন্বয়ে গঠিত ৪র্থ কোর সিলেট, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, কুমিল্লা, নোয়াখালী অভিমুখে। 

২. উত্তরাঞ্চল থেকে দু' ডিভিশনের সমন্বয়ে গঠিত ৩৩তম কোর রংপুর, দিনাজপুর, বগুড়া অভিমুখে

৩. পশ্চিমাঞ্চলে থেকে দু' ডিভিশনের সমন্বয়ে গঠিত ২য় কোর যশোর কুষ্টিয়া, খুলনা, ফরিদপুর অভিমুখে এবং 

৪. মেঘালয় রাজ্যের তুরা থেকে ডিভিশনের চাইতে ছোট একটি বাহিনী জামালপুর ও ময়মনসিংহ অভিমুখে। 

এর সঙ্গে যুক্ত হয় ভারতের বিমান ও নৌশক্তি, মুক্তিযোদ্ধাদের প্রচ্ছন্ন কিন্তু সদাতৎপর সহযোগিতা। 

এসব মিলে বাংলাদেশকে ডিসেম্বরের এক তারিখ থেকে ঘিরে ফেলে ভারত।


২ ডিসেম্বর ভারত সাঁড়াশি আক্রমণ চালিয়ে খুলনার কিছু অংশ দখল করে। এর প্রতিবাদে পাকিস্তান ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। ৩ ডিসেম্বর দুই দেশ পাল্টাপাল্টি বোমা হামলা করে ও সর্বাত্মক যুদ্ধ শুরু হয়। যুদ্ধের কয়েকদিনের মধ্যেই পাকিস্তান কর্তৃপক্ষ রণেভঙ্গ দেয়। পূর্ব-পাকিস্তান কমান্ডার নিয়াজী কেন্দ্রের সাথে যোগাযোগ হারিয়ে ফেলে। ইস্টার্ন রিফাইনারিতে হামলা করে ভারত জ্বালানী তেলের মজুদ ধ্বংস করে দেয়। ভারতীয় বিমান বাহিনী আকাশ থেকে লিফলেট ফেলে ঢাকাকে আত্মসমর্পনের জন্য নির্দেশ দিতে থাকে। এদিকে কেন্দ্র থেকে বিচ্ছিন্ন নিয়াজীকে জ্যাকব ব্লাফ দেয় যে, সেনাবাহিনী একটা অংশ ও অবাঙ্গালিরা তার কাছে জিম্মি হয়ে আছে।  


১১ তারিখ গভর্নর হাউসে (বঙ্গভবনে) বোমা হামলা করে ভারত। সাহস হারিয়ে ডা. মালেক পদত্যাগ করেন। এরপর তিনি ও তার সরকারের কিছু মন্ত্রী Hotel Intercontinental (বর্তমান রূপসী বাংলা)-এ আশ্রয় গ্রহণ করেন। এটি আন্তর্জাতিকভাবে ঘোষিত নিরপেক্ষ স্থান ছিল। মূলত ১১ তারিখ থেকেই নিয়াজির বাঁধ ভেঙে যায়। সে হতাশ হয়ে পড়ে। তাছাড়া ৪ দিক থেকে ধীরে ধীরে ঢাকার দিকে এগোতে থাকে ভারতীয় বাহিনী। ১৩ ডিসেম্বর নিয়াজী জ্যাকবের কাছে আত্মসমর্পন করার সিদ্ধান্ত জানান। এরপর পাকিস্তান বাহিনী যারা সারাদেশে যুদ্ধ করছিলো তারা পুরোপুরি হাল ছেড়ে দেয় ও পিছু হটে ঢাকার দিকে আসতে থাকে।


১৬ তারিখ আত্মসমর্পন অনুষ্ঠানের ডেট নির্ধারিত আয়োজন হয়। ভারতীয় জেনারেলরা আত্মসমর্পনের ব্যাপারে ওসমানীকে অন্ধকারে রাখে। নিয়াজীও চেয়েছিলো মুক্তিবাহিনীর কাছে নয় বরং ভারতীয় বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পন করতে। কারণ মুক্তিবাহিনীর কোনো আন্তর্জাতিক চুক্তিতে চুক্তিবদ্ধ নয়। তারা বন্দীদের সাথে নৃশংস আচরণ করতে পারে যা ভারতীয় সেনাবাহিনী করবে না।     

১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ তারিখে পাকিস্তান বাহিনী আত্মসমর্পণ করলে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়। মাত্র ১৩ দিনের যুদ্ধে পরাস্ত হয় পাকিস্তান। 


২২ ডিসেম্বর একটি ভারতীয় বিমানে করে মুজিবনগর সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতিসহ মন্ত্রীসভার অন্যান্য সদস্যগণ ঢাকা আসেন। কি কারণে প্রবাসী মন্ত্রীসভা ছ'দিন পর প্রত্যাবর্তন করে তা পরিস্কার নয়। এ সময়ে ভারতীয় বাহিনী সকল সেনানিবাস ও গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনার (KPI) নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করে এবং পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর ফেলে যাওয়া বিপুল পরিমাণ অস্ত্র ভান্ডারের অধিকাংশ ভারতে স্থানান্তরের সুযোগ পায়। এ সময়ই ভারতীয় বাহিনীর লুটতরাজের বিরোধিতা করায় সেক্টর কমান্ডার মেজর এম এ জলিলকে গ্রেফতার করে ভারত।

১৯ ডিসে, ২০২০

ঘুরে এলাম কাঁচের মসজিদ



শিরোনাম দেখে অবাক হতে পারেন। কাঁচ দিয়ে কী মসজিদ তৈরি হয়! আমিও অবাক হয়েছি। এই প্রথম কোনো মসজিদ দেখলাম যার চারপাশের দেয়ালই তৈরি হয়েছে কাঁচ দিয়ে। প্রায় ২২ ফুট লম্বা কাঁচের খণ্ড দিয়ে তৈরি করা হয়েছে কেরানীগঞ্জের দোলেশ্বর জামে মসজিদ। এরকম নান্দনিক মসজিদ খুব কমই দেখেছি। 

মসজিদটি এমন ছিল না। ১৫২ বছরের পুরনো মসজিদ এটি। ১৮৬৮ সালে মসজিদটি স্থাপন করেন ঢাকার কেরানীগঞ্জের দোলেশ্বর গ্রামের গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ। সেসময় পাঁচজন দানশীল ব্যক্তি মসজিদের জন্য জমি দান করেন। দারোগা আমিনউদ্দীন আহম্মদের নেতৃত্বে এই মসজিদের কার্যক্রম শুরু হয়। তাই এটি পরিচিত ছিলো “দারোগা মসজিদ” নামে। তার ছেলে মইজ উদ্দিন আহম্মদ ছিলেন মসজিদের প্রথম মোতোয়ালি। 

পাঁচজন দানশীল ব্যক্তির একজন হলেন খিদির বক্স। মইজউদ্দিনের পর খিদির বক্সের পরিবার এই মসজিদটির দেখাশোনা করেন। কয়েকজন মানুষের হাত বদল হয়ে পাকিস্তান আমলে এই মসজিদটির দায়িত্ব আসে অধ্যাপক হামিদুর রহমানের কাছে। অধ্যাপক হামিদুর রহমান মসজিদটির সংস্কার করেন। মিনার ও গম্বুজ তৈরি করেন। এটি দুই গম্বুজ বিশিষ্ট সুন্দর মসজিদ। 


হামিদুর রহমান সাহেব আওয়ামী লীগ করতেন। ১৯৭০ এর নির্বাচনে তিনি প্রাদেশিক পরিষদে কেরানীগঞ্জের আসন থেকে নির্বাচিত হন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি পাকিস্তানের প্রতি অনুগত থাকেন। মোস্তফা মহসিন মন্টুর নেতৃত্বে এখানে সন্ত্রাসী কার্যক্রম শুরু হয়। মন্টু ও ঢাকা থেকে পালিয়ে আসা বেশিরভাগ বাম মুক্তিযোদ্ধা কেরানীগঞ্জে আশ্রয় নেয়। সেখানে তারা এদিক-সেদিক বোমা ফাটানো জনজীবন বিপর্যস্ত করে তোলে। এপ্রিলে সেনাবাহিনী কেরানীগঞ্জে অভিযান পরিচালনা করে। তারাও সন্দেহভাজন সন্ত্রাসীদের হত্যা করে। এই ব্যাপক গন্ডগোলের সময় অধ্যাপক হামিদুর রহমান কেরানীগঞ্জের মানুষের পাশে দাঁড়ান ও দুই বাহিনী থেকেই গণমানুষকে রক্ষার চেষ্টা করেন। 


অধ্যাপক হামিদুর রহমানের মৃত্যুর পর এই মসজিদ পরিচালনার দায়িত্ব আসে তার ছেলে নসরুল হামিদ বিপুর কাছে। নসরুল হামিদ বর্তমানে আওয়ামী এমপি ও জ্বলানী প্রতিমন্ত্রী। তিনি দায়িত্বে আসার পর মসজিদটি সংস্কারের প্রসঙ্গ আসে। মসজিদটির ছাদ বেয়ে পানি পড়ে ও মসজিদে মুসল্লিদের স্থান সংকুলান হয় না। নসরুল হামিদ আগের স্থাপনা রেখেই নতুন মসজিদ করার পরিকল্পনা করেন। কারণ তিনি ঐতিহ্য হারাতে চান নি। নতুন মসজিদ তৈরির জন্য তিনি দায়িত্ব দেন বাংলাদেশের নামকরা স্থপতি কাশেফ মাহবুব চৌধুরীকে। 


কাশেফ মাহবুব চৌধুরী বাংলাদেশের সেরা আর্কিটেক্টদের একজন। ২০১৬ সালে তিনি ফ্রেন্ডশিপ সেন্টারের জন্য আর্কিটেক্টদের সর্বোচ্চ পুরস্কার 'Aga Khan Award for Architecture' লাভ করেন। চট্টগ্রামে থাকাকালে তার আরেকটি স্থাপনা চাঁদগাঁও আবাসিক মসজিদের নিয়মিত মুসল্লি ছিলাম। 


যাই হোক কাশেফ মাহবুব দোলেশ্বর মসজিদকে পুরো একটি কমপ্লেক্সে পরিণত করে। আগের মসজিদের পূর্ব দিকে থাকা পুকুর ভরাট করে চার বিঘা জমির ওপর নতুন মসজিদ তৈরি করা হয়। নতুন মসজিদের চারদিক থেকে খোলা যায়। তাই বাতাস চলাচলের কারণে গরমকালে এটি বেশ আরামদায়ক হয়। মসজিদের তিনদিকে বিশাল চত্ত্বর ও বসার স্থান আছে। যাতে বাচ্চার দৌড়াদৌড়ি করে ও মুরুব্বিরা বসে নানান বিষয় নিয়ে আলোচনা করেন। ফলে মসজিদটি এখন একটি সামাজিক মেলবন্ধনের জায়গা হয়ে দাঁড়িয়েছে। 


মসজিদটি ৩০ টি বৃক্ষাকৃতির কংক্রিটের পিলারের ওপর কংক্রিটের ছাদ। ছাদে একটি ডিম্বাকৃতির গম্বুজ রয়েছে। এটি আমার কাছে সুন্দর লাগেনি। আমার মনে হয় গোলাকার ও বড় গম্বুজ হলেই বেশ মানাতো। তিনি হয়তো ভিন্নতা তৈরি করতে এই পলিসি নিয়েছেন। ছাদটি এমনভাবে তৈরি তাতে মনে হচ্ছে ছাদকে ছয়ভাগে ভাগ করা হয়েছে। দুইটি কংক্রিটের বড় খন্ডের মাঝে গ্লাস দেওয়া হয়েছে যাতে ওপর থেকে আলো মসজিদে প্রবেশ করতে পারে। মসজিদে প্রচুর আলো ও বাতাস প্রবেশ করতে পারে। 


মসজিদটির পুরো কমপ্লেক্স জুড়ে সর্বত্র লালের ছড়াছড়ি। লাল টাইলসে মুসল্লিদের সিজদাহ বেশ পবিত্র আবহ তৈরি করে। প্রায় ১৬০০ মানুষ একসাথে সেখানে নামাজ পড়তে পারে। লাল রং যারা অপছন্দ করেন তাদের জন্য এটি বাড়াবাড়ি মনে হতে পারে। তবে আমার কাছে বেশ মনোহর মনে হয়েছে। এর কারণ হিসেবে কাশেফ মাহবুব বলেছেন আগের মসজিদটি লাল রং-এর থাকায় তিনি ঐতিহ্য হিসেবে লালকে বেইস করেছেন। পুরাতন মসজিদ এখন ব্যবহার হচ্ছে না। তবে পরিকল্পনা রয়েছে এটিকে লাইব্রেরিতে পরিণত করা হবে। 


মসজিদ তিনদিকে অর্থাৎ পূর্ব দিক বাদে বাকী সব দিকে কৃত্রিম লেক ও ফোয়ারা তৈরি করা আছে। তাই উত্তর ও দক্ষিণ দিকে দরজা খোলা গেলেও মুসল্লি প্রবেশ করতে পারে কেবল পূর্ব দিক থেকে। এই মসজিদে একটি দারুণ বিষয় ছিল এর সাউন্ড সিস্টেম। সাধারণত মসজিদের সাউন্ড সিস্টেম ভালো হয় না। ইমামের সুন্দর তিলওয়াত সাউন্ড সিস্টেমের বদৌলতে মন ছুঁয়ে গেছে। মসজিদের পশ্চিম-দক্ষিণ কোণে পারিবারিক কবরস্থান। সেটাও সুন্দর করে গোছানো হয়েছে। পশ্চিম-উত্তর দিকে রয়েছে সুন্দর ওয়াশরুম। মন ভালো করে দেওয়ার মতো একটি স্থাপনা দোলেশ্বর জামে মসজিদ। সময় থাকলে একটি বিকাল ঘুরে আসুন। শান্তি পাবেন। 


রাত নামলে মসজিদ নতুন রূপ ধারণ করে। সেটা আরো মায়াবী। মসজিদের ভেতরে ও বাইরের চত্ত্বরের লাইটিং একটি স্বপ্নময় জগত তৈরি করে। এমন সুন্দরে আপনার ঘন্টা পর ঘন্টা কাটিয়ে দিতে একটুও বিরক্তি আসবে না। 


মসজিদ থেকে বের হয়ে ঘাটের কাছে পাবেন প্রচুর স্ট্রিট ফুডের দোকান। আমার মতো ভোজন রসিক হলে খাবারের মতো হালাল বিনোদন থেকে বঞ্চিত হবেন না আশা করি। 


যেভাবে যাবেন... 
সাধারণত কোনো স্থানে যাওয়ার জন্য এখন লোকেশন বলার দরকার হয় না। এখন গুগল ম্যাপ সবার হাতে হাতে। তবে এই মসজিদের জন্য সাজেশন লাগবে। নইলে গুগল ম্যাপ আপনাকে পুরো কেরানীগঞ্জ ঘুরিয়ে মারবে। ঢাকার যে কোন স্থান থেকে পোস্তগোলা ব্রিজের গোড়ায় অর্থাৎ জুরাইন রেল গেইটে চলে আসবেন। যারা এই স্থানটি চিনছেন না তাদের জন্য বলছি, যাত্রাবাড়ি থেকে জুরাইন রেল গেইট মাত্র দুই কিলোমিটার দূরে। অর্থাৎ যাত্রাবাড়ি এসে রিকশায় ২০/৩০ টাকা দিয়ে জুরাইন রেল গেইটে আসতে পারেন। 


জুরাইন রেল গেইট থেকে রিকশা করে দোলেশ্বর ঘাটে চলে আসবেন। ৩০/৪০ টাকা নিবে। দোলেশ্বর ঘাটে ২ টাকা ঘাট চার্জ দিবেন। তারপর ট্রলারে করে বুড়িগঙ্গার ওপারে অর্থাৎ কেরানীগঞ্জের দোলেশ্বরে যাবেন। ট্রলার ভাড়াও জনপ্রতি দুই টাকা। ট্রলার ছাড়া ডিঙ্গি নৌকা আছে যেখানে ৭/৮ জন বসা যায়। ডিঙ্গি নৌকা দিয়ে পার হতে চাইলে বিশ টাকা দিতে হবে। দোলেশ্বরে নেমে মাত্র ১৫০ মিটার হাঁটলেই মসজিদ।


আর কেউ যদি ব্যক্তিগত পরিবহনে আসেন তবে দোলেশ্বর ঘাটে আপনার যানবাহন রেখে তারপর নদী পার হতে পারেন।

১৫ ডিসে, ২০২০

বঙ্গকথা পর্ব-৭২ : স্বাধীনতা তথা দেশভাগের পক্ষে যারা ছিলেন




ভারত ও তাদের গোয়েন্দা সংস্থার সহায়তা ও পরিকল্পনা অনুযায়ী ভারত সংলগ্ন মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলায় ১৭ এপ্রিল ১৯৭১ স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রসহ বাংলাদেশের প্রবাসী সরকার গঠন হয়। এ সরকারই মুজিবনগর সরকার হিসাবে সকলের কাছে গ্রহণযোগ্যতা পায়। এ দিনই তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান থেকে নির্বাচিত জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের সদস্যদের সমন্বয়ে গণপরিষদ গঠিত বলে গণ্য হয়। মেজর জিয়ার স্বাধীনতার ঘোষণার পর এটি যুদ্ধের দ্বিতীয় মাইলফলক যা বাংলাদেশের অনেক তারুণ্যকে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার উৎসাহ যোগায়। ভারত সরকার দেশভাগের পক্ষে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পক্ষ। 

ভারতের শরনার্থী গ্রহণ

২৫ মার্চ অপারেশন সার্চলাইট ও পরে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সারাদেশে আগ্রাসী সামরিক অভিযান অনেককে ভীত সন্ত্রস্ত করে। প্রথমে হিন্দু জনগোষ্ঠী ভারতে শরনার্থী হিসেবে গমন করে। ভারতীয় সীমান্তবর্তী এলাকার মানুষ দলবেঁধে ভারতে প্রবেশ করতে থাকে। পরে অন্যান্য অংশের মানুষও শরনার্থী হয়। এভাবে ভারতের শরণার্থী শিবিরে ৭০ থেকে ৮০ লক্ষ মানুষ আশ্রয় গ্রহণ করে । 

মুক্তিবাহিনী ও মুজিব বাহিনী গঠন এবং প্রশিক্ষণ

সেনাবাহিনীর সাঁড়াশী অভিযানে কিংকর্তব্যবিমুঢ় বিদ্রোহীরা মেজর জিয়ার স্বাধীনতা ঘোষণায় দিকনির্দেশনা পায়। পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে বিদ্রোহী বাঙালি সামরিক বাহিনী, ই.পি.আর, ও পুলিশ বাহিনীর সদস্যগণ সংঘবদ্ধ হতে থাকেন। ৪ এপ্রিল ৭১ তারিখে সামরিক কর্মকর্তাগণ মিলিত হন হবিগঞ্জ জেলার মাধবপুর উপজেলার তেলিয়াপাড়া চা বাগানে। পাকিস্তান পক্ষ ত্যাগকারী সামরিক বাহিনী, ইপিআর, পুলিশ ও আনসার সদসদের নিয়ে গঠিত হয় মুক্তিফৌজ। এর প্রধান করা হয় কর্ণেল (পরবর্তীতে জেনারেল) আতাউল গনি ওসমানীকে।

অন্যদিকে তাজউদ্দিন ভারতে আশ্রয় গ্রহণ করেন এবং প্রবাসী সরকার গঠন নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। ভারতীয় নিরাপত্তা এজেন্সীগুলোর মাধ্যমে পূর্ব রণাঙ্গনের প্রতিরোধ সংগ্রামের এ সব ঘটনা ও সিদ্ধান্তের সংবাদ তাজউদ্দিনের কাছে পৌঁছতে শুরু করে প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান থেকে হাজার হাজার আওয়ামী কর্মী ভারতে আশ্রয় নিলে এ অঞ্চলের রাজনৈতিক ও সামরিক পরিস্থিতি বদলাতে থাকে। দেশত্যাগীরা নিজের অস্তিত্বের তাগিদে ও ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর অনুপ্রেরণায় সশস্ত্র প্রশিক্ষণের দাবী জানাতে থাকে। এ সময় রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ও নিউক্লিয়াসের মধ্যে দ্বন্দ্ব দেখা দেয়। RAW এর সরাসরি তত্ত্বাবধানে গঠিত হয় মুজিববাহিনী আর ভারতীয় সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে গঠিত হয় মুক্তিযোদ্ধা। জুলাই মাসে মুক্তিফৌজ আর মুক্তিযোদ্ধা একীভূত করে গঠন করা হয় মুক্তিবাহিনী। মুক্তিবাহিনীর নেতৃত্বে জেনারেল ওসমানী থাকলেও মুজিববাহিনীর নেতৃত্ব দেন ভারতীয় জেনারেল ওবান।

পাকিস্তান সামরিক বাহিনী দেশ রক্ষার মন্ত্র নিয়ে দেশদ্রোহীদের শায়েস্তা করার শুরুর দিন থেকে মাত্র পাঁচ দিন পরেই পূর্ব বাংলার বিদ্রোহীদের সাহায্য করার জন্য ভারতীয় পার্লামেন্ট যে প্রস্তাব গ্রহণ করে তা অল্পদিনের মধ্যেই কার্যকর রূপ লাভ করেছিল। ফলে এপ্রিল মাসে ভারতের সীমান্ত নিরাপত্তা বাহিনী (বিএসএফ) বিক্ষিপ্তভাবে প্রশিক্ষণ, অস্ত্র সরবরাহ ও সংশ্লিষ্ট অন্যান্য বিষয়ে যে অল্প স্বল্প সাহায্য করে চলেছিল তার উন্নতি ঘটে। ভারতীয় সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হয় চার সপ্তাহ মেয়াদী ট্রেনিং কার্যক্রম। এখানে শেখানো হতো সাধারণ হাল্কা-অস্ত্র ও বিস্ফোরকের ব্যবহার। মে মাসের তৃতীয় সপ্তাহে শুরু হয় দু'হাজার ছাত্র ও যুবকের প্রথম দলের ট্রেনিং।

তরুণদের ট্রেনিং দেওয়ার ব্যাপারে অবশ্য ভারতীয় প্রশাসন সতর্ক ছিল। এর অন্যতম প্রধান কারণ ছিল, নক্সালবাদী, নাগা, মিজো প্রভৃতি সশস্ত্র বিদ্রোহীদের তৎপরতা-হেতু পশ্চিমবঙ্গ ও ভারতীয় পূর্বাঞ্চলের নিরাপত্তা সম্পর্কে ভারতীয় উদ্বিগ্ন ছিল। বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য বরাদ্দকৃত অস্ত্র এই সব সন্ত্রাসবাদী বা বিদ্রোহীদের হাতে যে পৌঁছবে না, এ নিশ্চয়তাবোধ গড়ে তুলতে বেশ কিছু সময় লাগে। তাই শুধু আওয়ামী লীগ ছাড়া অন্য সাধারণ যুবকদের প্রশিক্ষণ ও অস্ত্র দেওয়া হয়নি। 

আগস্ট-সেপ্টেম্বর মাসে, সামগ্রিক সমস্যার চাপে ভারত সরকারের নীতি প্রণয়নের ক্ষেত্রে যখন দক্ষিণপন্থীদের প্রভাব হ্রাস পায় এবং বাংলাদেশ মন্ত্রিসভার মধ্যে তাজউদ্দিনের অবস্থান অপেক্ষাকৃত সবল হয়, তখন বাংলাদেশের বামপন্থী তরুণদের বিরুদ্ধে এই বিধি-নিষেধ বহুলাংশে অপসারণ করা হয়। মনি সিং এর তৎপরতার ফলে ছাত্র ইউনিয়নের কর্মীদের নিয়ে আলাদাভাবে একটি প্রশিক্ষণ শিবির চালু করা হয় অক্টোবর মাসে। তারা যুদ্ধে অংশ গ্রহণের পূর্বেই বাংলাদেশ স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। 

প্রাথমিক পর্যায়ে (মার্চ-এপ্রিল) পাকিস্তানী সামরিক বাহিনীর অভিযানের মুখে জীবনের নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে সকল দল, মত, ধর্মের মানুষ ভারতে পাড়ি জমায়। সেখানে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে ট্রেনিং গ্রহণ করতে তারা আগ্রহ প্রকাশ করেন। এটি ছিল স্বাধীনতার স্বপক্ষে একপ্রকার ঐক্য। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধা মনোনয়ন ও ট্রেনিং-এর ক্ষেত্রে প্রদর্শিত বৈষম্য তরুণদের সেই একতাবোধকে বহুলাংশে বিনষ্ট করে। বিশেষ করে দাড়ি টুপিধারী শরণার্থীকে মারধর অথবা বন্দী করে রাখার ঘটনা ইসলামপন্থী মুসলিম জাতীয়তাবাদী চেতনার মানুষদের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া ঘটায়। 

ইসলামী ছাত্রসংঘের (পরবর্তীতে ইসলামী ছাত্রশিবির) কর্মী সন্দেহে ট্রেনিং থেকে বের করা সম্পর্কে মহিউদ্দিন আহমদ বলেন, “এর মধ্যে একটি ঘটনা ঘটে। প্রথমে আমরা বুঝতেই পারিনি কী হয়েছে! আমাদের ব্যাচের একজনকে ডেকে পাঠানো হয়। বলা হয়, ঐ ছেলেটিকে উইথড্র করা হয়েছে। একটা চাপা গুঞ্জন শুনি, সে নাকি ইসলামী ছাত্রসংঘের সাথে জড়িত ছিল।” মুক্তিযোদ্ধাদের প্রকৃত সংখ্যা নিয়েও বিভ্রান্তি রয়েছে। জেনারেল ওসমানী এক সাক্ষাতে বলেন, এ সংখ্যা ছিল প্রায় ষাট হাজার। 

স্বাধীনতার পক্ষে রাজনৈতিক শক্তি 

এ যুদ্ধের নেতৃত্বকারী রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগের নাম প্রথমে আসে, এরপর মস্কোপন্থী কমুনিস্ট পার্টি, ন্যাপসহ কিছু ছোট ছোট রাজনৈতিক দল এবং মস্কোপন্থী অনেক বুদ্ধিজীবী মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি ভূমিকা রাখেন। আন্তর্জাতিকভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে ছিল ভারত ও তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন ও তার মিত্রশক্তি। ব্রিটিশ পলিসি ছিল বরাবরই চতুর। ব্রিটেনের নীতিনির্ধারকদের একাংশ পাকিস্তানের পক্ষে আর অন্য অংশ বাংলাদেশের পক্ষে বক্তব্য দেন।

চীনপন্থী রাজনৈতিক দল ও বুদ্ধিজীবীদের দুই একজন ব্যতিক্রম ছাড়া কেউ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কোন ভূমিকা রাখেননি। মাওলানা ভাসানী মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহণের জন্য ভারতে গিয়ে বন্দী জীবন কাটান। রাশেদ খান মেনন বলেন “তারপর মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস মাওলানাকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। জানতাম তিনি আমাদের কাছেই আছেন। পত্রিকায় তাঁর বিবৃতি পড়েছি। আকাশবাণীতে সাক্ষাৎকার শুনেছি। প্রবাসী সরকারের উপদেষ্টা কমিটির সভার ছবিও দেখেছি পত্রিকায়। কিন্তু মওলানা যা আশংকা করেছিলেন, তিনি সুভাস বসুর মতো বন্দী ছিলেন ভারত সরকারের হাতে"। 

মুক্তিযুদ্ধের সময় শেখ মুজিবের উর্দ্ধে কোন নেতার আবির্ভাব ভারতের কাছে বিব্রতকর ছিল। ভারত সরকার আশংকা করত ভারতের বাইরে গেলে ভাসানী হয়তো বামপন্থীদের নিয়ে স্বাধীনতা শক্তির পক্ষে অপর একটি সরকার গড়ে তুলতে পারেন। স্বাধীনতার পর আওয়ামী লীগ ছাড়া আর কেউ ক্ষমতার নিয়ন্ত্রণ লাভ করুক এটাও ভারত সরকারের কাম্য ছিল না। তাই ভাসানীকে ভারত সরকারের নিয়ন্ত্রণে গৃহ-অন্তরীণ থাকতে হয়। 

আওয়ামী লীগ বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী রাজনৈতিক দল। পাকিস্তান জাতীয় পরিষদে ১৬৭ জন ও পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদে ২৮৮ জন সদস্যের অধিকাংশই ভারতে গমন করেন তবে এর সঠিক সংখ্যা পাওয়া যায় না। কতিপয় সদস্য মিয়ানমারে (বার্মায়) আশ্রয় গ্রহণ করেন। পাকিস্তান সরকার ৭৭ জন জাতীয় পরিষদের ও ১৪৫ জন প্রাদেশিক পরিষদের সদস্যদেরকে সামরিক আদালতে হাজির হওয়ার জন্য ইশতেহার জারী করে। এই থেকে অনুমান করা যায় ১৬৭ জনের মধ্যে ৭৭ জন স্বাধীনতার পক্ষে ও ২৮৮ জনের মধ্যে ১৪৫ জন স্বাধীনতার পক্ষে থেকে ভারতে গমন করেছে বা পলাতক হয়েছে। বাকীরা পাকিস্তানের প্রতি অনুগত তথা দেশভাগের বিরুদ্ধে ছিল। 

মস্কোপন্থী ন্যাপ ও কম্যুনিস্ট পার্টি

দুটি ভিন্ন ভিন্ন নামের দল হলেও আদর্শিকভাবে তারা ছিল মার্ক্সবাদ-লেনিনবাদের ধারক। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ন্যাপের অধ্যাপক মুজাফফর আহমদ আর কম্যুনিস্ট পার্টির কমরেড মনি সিং যুগপৎ সোভিয়েত ইউনিয়ন ও তার মিত্রদের সঙ্গে কূটনৈতিক যোগাযোগ রক্ষার মাধ্যমে বাংলাদেশের পক্ষে রাজনৈতিক সমর্থন আদায় করেন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে এ দু’জন নেতা উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। মুক্তিযুদ্ধের পূর্বে বঙ্গবন্ধুকে ছদ্মবেশে আগরতলা প্রেরণ ও বিভিন্ন সময় গোপন বৈঠকে গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ দিতেন ন্যাপ ও কমিউনিস্ট নেতারা। 

তৎকালীন ন্যাপ নেতা ক্যাপ্টেন হালিমের নেতৃত্বে ঢাকা জেলার মানিকগঞ্জ ও বিক্রমপুর অঞ্চলে ৬ হাজার গেরিলা মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। পূর্ব-পাক ন্যাপ সভাপতি অধ্যাপক মুজাফফর আহমদ, পাকিস্তান ন্যাপের যুগ্ম-সম্পাদক দেওয়ান মাহবুব আলী জাতিসংঘসহ পূর্ব ইউরোপ এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন সফর করেন। ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির একটি সর্বোচ্চ প্রতিনিধি দলের সঙ্গে এক হয়ে মুজাফফর ও কমরেড মণি সিংহ, সোভিয়েত পার্টিকে বাংলাদেশ ও ভারতের পক্ষে কনভিন্স করেন। মুজাফফর আহমদ কংগ্রেসের সোশ্যালিস্ট ফোরাম ও ইন্দিরা গান্ধীর ঘনিষ্ঠ সর্বোচ্চ উপদেষ্টা পরিষদ, সচিব পরে মন্ত্রী ডিপি ধর, পিএন হাকসার প্রমুখ ক্ষমতাধর ব্যক্তির সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। 

ভাসানী ন্যাপ (পিকিংপন্থী)

মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী ছিলেন আওয়ামী মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। পরবর্তী সময়ে তিনি ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি গঠন করেন এবং লেনিন ও মাও এর চিন্তাধারার ভিন্নতায় ন্যাপ দ্বিখন্ডিত হয়ে ভাসানী ন্যাপ ও মস্কোপন্থী ন্যাপ নামে দুটি রাজনৈতিক দলে পরিণত হয়। ভাসানী পিকিংপন্থী হওয়া সত্ত্বেও আওয়ামী লীগের প্রতি ছিলেন দুর্বল এবং পূর্ব পাকিস্তানকে স্বাধীন রাষ্ট্র করার স্বপ্ন তিনি ১৯৬৯ সন থেকেই দেখতেন বিধায় মুক্তিযুদ্ধকালে তিনি ভারতে পাড়ি জমান। ভারত প্রথম দিকে তাকে বন্দী ও পরে গৃহবন্দী করে রাখলেও মুক্তিযুদ্ধের উপদেষ্টা পরিষদে তাকে সভাপতি করে রাখা হয়। এ দলের মশিউর রহমান যাদু মিয়া, কাজী জাফরসহ শীর্ষস্থানীয় অনেক নেতাই ভারতে গিয়ে ফিরে আসেন। 

বিদ্রোহী পাকিস্তানী সামরিক বাহিনী

বাংলাদেশের স্বাধীনতা বা দেশভাগের পক্ষে কাজ করেছে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিদ্রোহী বাঙালি সেনারা। বাংলাকে ১১ সেক্টরে ভাগ করে তারা যুদ্ধ পরিচালনা করে। সামরিক বাহিনীর সকল শাখা, ইপিআর ও পুলিশের বিদ্রোহীরা মুক্তিফৌজ নামে সরাসরি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। 

ছাত্র এবং ছাত্র সংগঠন

মুক্তিযুদ্ধের মূল চালিকাশক্তি ছিল ছাত্রদের দ্বারা গঠিত নিউক্লিয়াস। পরে তারা ভারতের সহায়তায় গঠন করে মুজিব বাহিনী। সিরাজুল আলম খান, শেখ মনি, আব্দুর রাজ্জাক, তোফায়েল আহমদ, আসম আব্দুর রব প্রমুখ ছাত্রনেতাদের নেতৃত্বে এদেশের অনেক ছাত্র মুক্তিযুদ্ধে এটেইন করে। সেসময় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্রলীগ ও বামপন্থীদের প্রভাব। সেই প্রভাবেই রাজনীতি সচেতন ছাত্রদের একটি অংশ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। 

কাদেরিয়া বাহিনী 

আবদুল কাদের সিদ্দিকী আওয়ামী লীগের রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলেন। ১-২৫ মার্চ তিনি টাংগাইলে আওয়ামী কর্মীদের সাথে নিয়ে গণহত্যা চালান। সেনাবাহিনীর অভিযানে তার বাহিনী ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে। পরে তিনি ভারত না গিয়ে এলাকার যুবক, কৃষক ও ডাকাতদের সংগঠিত করতে থাকে টাংগাইলের সখীপুরে। এই বাহিনীই কাদেরিয়া বাহিনী হিসেবে পরিচিতি পায়। অতর্কিত ও চোরাগোপ্তা হামলা করে তারা সেনাবাহিনীকে নাজেহাল করতে থাকে। সাফল্য আসায় তাদের বাহিনী বড় হতে থাকে। এই বাহিনীতে মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা ছিল প্রায় ১৭০০০। সমগ্র টাঙ্গাইল জেলা এবং ঢাকা, ময়মনসিংহ ও পাবনার কিছু অংশ ছিল এর কর্মক্ষেত্র। এ বাহিনীর কোন যোদ্ধাই বাংলাদেশের বাইরে গিয়ে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেনি। তবে এদের মধ্যে অনেকেই পূর্বে ডাকাতির সাথে যুক্ত ছিল বিধায় যৎসামান্য আগ্নায়াস্ত্র ও দেশীয় অস্ত্রের ব্যবহার তারা জানতো। ফলে নিজেরাই নিজেদের মধ্যে ট্রেনিং-এর ব্যবস্থা করেছে। বাংলাদেশের অভ্যন্তরেই তারা প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে পাক সেনাবাহিনীকে বেকায়দায় ফেলে দেয়। টাঙ্গাইলে তারা মুক্ত অঞ্চল গড়ে তুলতে সক্ষম হয়। 

হেমায়েত বাহিনী 

হেমায়েত উদ্দিন ছিলেন ২য় ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের একজন হাবিলদার। তিনি জয়দেবপুর ক্যাম্পে ছিলেন। তিনি এবং তার অনুসারী সৈনিকরা পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ১৫ জনকে হত্যা করে শতাধিক অস্ত্র, প্রচুর গোলাবারুদ, ৩টি গাড়ী এবং কয়েকজন জোয়ান নিয়ে পূর্ব দিকে চলে যান। হেমায়েত প্রথমে বাঘিয়ার বিলে তার ঘাঁটি স্থাপন করেন। ২৯ মে গৌরনদী থানার বাটরা বাজারে আনুষ্ঠানিকভাবে হেমায়েত বাহিনীর উদ্বোধন করেন। ১ জুন বরিশাল অঞ্চলে স্বাধীনতার পতাকা উত্তোলন করেন। হেমায়েত বাহিনীর কর্মক্ষেত্র ছিল বরিশালের উজিরপুর ও গৌরনদী থানা, ফরিদপুরের কালকিনি, মাদারীপুর, রাজৈর, গোপালগঞ্জ ও কোটালীপাড়া। সম্পূর্ণ অভ্যন্তরীণভাবে গড়ে উঠেছিল এই হেমায়েত বাহিনী। তার দলে মুক্তিযোদ্ধা ছিল ৫,০৫৪ জন। তাদের মধ্যে নিয়মিত সশস্ত্র বাহিনীর লোক ছিল ৪০ জন। এদের সাহায্যে তিনি কোটালীপাড়া থানার জহরের কান্দি হাই স্কুলে সংক্ষিপ্ত প্রশিক্ষণ কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করেন এবং তিন মাসে প্রায় চার হাজার যুবককে প্রশিক্ষণ দান করা হয়। এদের মধ্যে দেড় হাজার গরীব শ্রেণীর মুক্তিযোদ্ধাকে মাসিক ৯৫ টাকা হিসেবে বেতনও দেওয়া হতো। বিভিন্ন বাজার থেকে তারা চাঁদা কালেকশন করতেন।

সরকারী ও প্রশাসনিক কর্মকর্তা

১৯৭১ সনে প্রায় ২০০ জন সিএসপি ছিলেন যারা তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান হতে নিয়োগপ্রাপ্ত হয়েছিলেন, তাদের মধ্যে মাত্র ১৩ জন স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। এছাড়া ইপিসিএস ৬২ জন অন্যান্য বিভাগের ৫১ জন উচ্চপদস্থ বেসামরিক কর্মকর্তা স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন।