২৭ মার্চ, ২০২০

বঙ্গকথা পর্ব-৩৪ : মুসলিম লীগ গঠন ও মুসলিমদের রাজনৈতিক যাত্রা



বঙ্গভঙ্গের ব্যাপক ঘটনা প্রবাহে কলকাতাকেন্দ্রিক বর্ণহ্দিু সাম্প্রদায়িক শক্তির সাথে ঢাকাকেন্দ্রিক বাঙালি মুসলমানদের যে দ্বন্দ্ব, তার পটভূমিতে গঠিত হয় মুসলিম লীগ, বঙ্গভঙ্গকে কেন্দ্র করে বর্ণহিন্দুদের সাথে যে মানসিক বিচ্ছেদ তা কোন আকস্মিক ঘটনা ছিল না। ডক্টর রমেশচন্দ্র মজুমদারের ভাষায়, “যদিও তারা একই দেশের মানুষ ছিল, তবুও এক ভাষা ছাড়া অন্য সব ব্যাপারে তারা বিভিন্ন ছিল। ধর্মে, শিক্ষায়, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবনে আটশ’ বছর ধরে তারা বাস করেছে যেন দু’টি ভিন্ন পৃথিবীতে”। 

মুসলিম শাসনের শুরু থেকে কয়েক শতাব্দী বাংলাদেশের মুসলমান ও হিন্দুগণ, অভিন্ন ভৌগোলিক ও প্রাকৃতিক আবহাওয়ায় নিজেদের স্বতন্ত্র ধর্মীয় বিশ্বাস ও জীবনাচরণ পদ্ধতি নিয়ে ধর্মীয় জীবনের স্বাতন্ত্র্য-চেতনা সামাজিক ও রাজনৈতিক জীবনের লক্ষ্য অর্জনে আপাতদৃষ্টিতে বড় রকমের কোন দ্বন্দ্ব-সংঘাত সৃষ্টি করেনি। কিন্তু ব্রিটিশ শাসনকালে হিন্দু ও মুসলমানদের ধর্মীয় পার্থক্য তাদের সামাজিক ও রাজনৈতিক জীবনে বিস্তার লাভ করে। ব্রিটিশ শাসনকে হিন্দুরা নিছক শাসক-বদলের ঘটনারূপে গ্রহণ করে। ইংরেজদের আস্থা ও অনুগ্রহ লাভের জন্য তারা নিজেদের মধ্যে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়। রাতারাতি তাদের একটি শ্রেণী বিপুল বিত্ত-বৈভবের মালিক হয়। অন্যদিকে ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে মুসলমানদের প্রতিক্রিয়া ছিল অত্যন্ত তীব্র। তারা এই শাসনের বিরুদ্ধে অবিরাম সংগ্রাম চালিয়ে ‘রানীর বিদ্রোহী প্রজা’ রূপে অভিহিত হয়। সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়ে মুসলমানরা দরিদ্র হয়ে পড়ে। হিন্দুরা ইংরেজদের সমর্থনে পুষ্ট হয়ে তাদের বিরুদ্ধে সাংস্কৃতিক আগ্রাসন পরিচালনা করে। মুসলমানদের সংগ্রামে হিন্দুদের কোন সহানুভূতি ছিল না।

বঙ্গভঙ্গের প্রেক্ষপটে হিন্দু ধর্মীয় জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের মধ্য দিয়ে হিন্দুদের মাঝে সাম্প্রয়াদিক স্বাতন্ত্র্যবোধ তীব্র হয়। মুসলমানদের শক্ররূপে চিহ্নিত করে তাদের ওপর তারা নানামুখী হামলা পরিচালনা করে। কুড়ি শতকের শুরুতে প্রশাসনিক কারণে বঙ্গভঙ্গ হওয়ার ফলে বাংলাদেশের মুসলমানদের অবস্থার উন্নয়নের সুযোগ সৃষ্টি হয়। তার বিরুদ্ধে হিন্দুদের মারমুখী সংগ্রাম হিন্দু-মুসলিত জাতি-স্বাতন্ত্র্যের দিকটিকে আরো প্রকটভাবে উপস্থিত করে।

সৈয়দ আমীর আলী সর্বপ্রথম তাঁর বক্তৃতা ও লেখায় মুসলমানদেরকে একটি ‘স্বতন্ত্র জাতি’ (Nationality, Nation) নামে অভিহিত করে তাদের জন্য স্বতন্ত্র নির্বাচন ও প্রতিনিধিত্বের দাবি করেন। এর আগে সৈয়দ আহমদ খান মুসলমানদেরকে ‘কওম’ নামে অভিহিত করলেও আমীর আলীর দাবি ছিল অধিকতর রাজনৈতিক তাৎপর্যমণ্ডিত। ১৮৮৩ সালে আমীর আলী ‘মিউনিসিপ্যালিটি বিলে’ সংখ্যালঘুদের জন্য স্বতন্ত্র নির্বাচন ও প্রতিনিধিত্ব দাবি করেন। এ সময় থেকেই মুসলমানদের নিজস্ব রাজনৈতিক সংগঠন কায়েমের প্রয়োজনও অনুভূত হচ্ছিল। ১৯০১ সালের অক্টোবরে নওয়াব ওয়াকার উল মূলক লাখনৌতে মুসলমানদের এক ঘরোয়া বৈঠকে এ বিষয় নিয়ে আলোচনা করেন। ১৯০৩ সালে সাহারানপুরে একটি মুসলিম রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান গঠন করা হয়। ১৯০৬ সালের ফ্রেরুয়ারি মাসে পাঞ্জাবে ফযল-ই-হুসাইন ‘মুসলীম লীগ’ নামে একটি সংগঠন কায়েম করেন।

এ সময় ভারত সচিব লর্ড মর্লি পার্লামেন্টে আভাস দেন যে, ব্রিটিশ সরকার ভারতের শাসনতান্ত্রিক সংস্কারের বিষয় বিবেচনা করছেন। এই নতুন শাসনতান্ত্রিক ব্যবস্থায় মুসলমানদের স্বার্থ রক্ষার দাবি নিয়ে মুসলিম নেতৃবৃন্দের এক প্রতিনিধি দল আগা খানের নেতৃত্বে ১৯০৬ সালের ১ অক্টোবর সিমলায় বড় লাট মিন্টোর সাথে সাক্ষাত করেন। নওয়াব সলীমুল্লাহর অসুস্থতার কারণে তাঁর প্রতিনিধি হিসেবে সিমলা ডেপুটেশনে যোগ দেন সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরী ও আবুল কাসেম ফজুলল হক। তাঁরা নওয়াব সলীমুল্লাহর সর্বভারতীয় মুসলিম কনফেডারেসী গঠনের খসড়া পরিকল্পনা সাথে নিয়ে যান। একই বছর আগস্ট ও সেপ্টেম্বর মাসে সৈয়দ আমীর আলী তাঁর কয়েকটি প্রবন্ধে ভারতীয় মুসলমানদেরকে রাজনৈতিক নিষ্ক্রিয়তা থেকে বেরিয়ে এসে একটি শক্তিশালী রাজনৈতিক দল গঠনের উদাত্ত আহবান জানান।

মুসলিম রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান গঠনের সলীমুল্লাহর পরিকল্পনা নিয়ে প্রতিনিধিদলের সদস্যগণ সিমলায় নিজেদের মধ্যে আলোচনা করেন। তাঁরা ডিসেম্বরে ঢাকায় অনুষ্ঠিতব্য শিক্ষা সম্মেলনে কনফেডারেসী বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ইচ্ছা প্রকাশ করেন। এরপর বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে হিন্দু জমিদার, সাংবাদিক ও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের প্রবল আন্দোলনের পটভূমিতে ঢাকায় ১৯০৬ সালের ডিসেম্বর মাসে মুসলিম শিক্ষা সম্মেলন শেষে সর্বভারতীয় মুসলিম প্রতিনিধিদের এক বিশেষ সভায় নওয়াব সলীমুল্লাহর প্রস্তাবক্রমে ‘অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগ’ গঠিত হয়। ১৯০৬ সালের ৩০ ডিসেম্বর রবিবার ঢাকার শাহবাগে ভারতের বিভিন্ন প্রদেশের আটশ’ প্রতিনিধির এই ঐতিহাসিক অধিবেশনে বঙ্গভঙ্গ সমর্থন করা হয় এবং বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলনের নিন্দা করে প্রস্তাব গৃহীত হয়। এভাবেই ভারতীয় মুসলমানগণ একটি নতুন রাজনৈতিক যুগে প্রবেশ করেন। এ রাজনৈতির ভিত্তি হলো জাতিস্বাতন্ত্রভিত্তিক মুসলিম জাতীয়তাবাদ।

সর্ব ভারতীয় মুসলিম লীগের উদ্দেশ্যাবলি ছিল মুসলমানদের স্বার্থ সংরক্ষণ করা, ব্রিটিশ সরকারের প্রতি মুসলমানদের আনুগত্য রেখে নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতি করা, ভারতীয় অন্যান্য সম্প্রদায়, বিশেষ করে হিন্দুদের সঙ্গে মুসলমানদের সম্পর্ক স্বাভাবিক করে তোলা। একটি মুসলিম রাজনৈতিক সংগঠনের জন্য নওয়াব সলিমুল্লাহর পদক্ষেপের তাৎক্ষণিক উদ্দেশ্য ছিল বঙ্গভঙ্গ রদের জন্য হিন্দুদের শক্তিশালী বিক্ষোভের বিরুদ্ধে উপমহাদেশের মুসলমানদের ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ গড়ে তোলা। এটাই ছিল মূল এবং প্রধান কারণ। 

ভারতীয় জাতীয়তাবাদী সংবাদপত্রসমূহ একটি দুর্বল সংগঠন হিসেবে মুসলিম লীগকে বাতিল করে দেয়। এসব সংবাদপত্র দ্রুত মুসলিম লীগের বিলুপ্তি ঘটবে বলে প্রচার চালায়। এটা সত্য যে প্রথম দিকে একটি রাজনৈতিক সংগঠন হিসেবে লীগের গতিশীলতার অভাব ছিল। কিন্তু কয়েক বছরের মধ্যে মধ্যবিত্ত সম্প্রদায় থেকে আসা এবং বৈপ্লবিক চিন্তাধারার তরুণ প্রজন্মের মুসলমানগণ মুসলিম লীগের রাজনীতিতে এগিয়ে আসেন। তারা ব্রিটিশ উপনিবেশিক শাসকদের বিরোধিতা তো করেনই, অধিকন্তু ভারতে নিজেদের নিয়ন্ত্রিত সরকার প্রতিষ্ঠারও দাবি করতে থাকেন।

১৯১০-এর দশকে মুসলিম লীগ ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের আদলে একটি নিজস্ব রাজনৈতিক মতাদর্শ গ্রহণ করে। লক্ষ্ণৌ চুক্তি (১৯১৬) এবং খেলাফত ও অসহযোগ আন্দোলনের সময়ে হিন্দু-মুসলিম সম্পর্কের উন্নতি ঘটলে মুসলিম লীগ জড় ও স্থবির অবস্থায় পড়ে। ১৯২০-এর পর থেকে কয়েক বছর খেলাফত সংগঠনই মুসলমান সম্প্রদায়ের স্বার্থরক্ষার সকল কাজ পরিচালনা করে।

১৯৩৫ সালে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ নেতৃত্ব গ্রহণ না করা পর্যন্ত সংগঠনটি রাজনৈতিকভাবে খুব বেশি সফলতা পায়নি। অনেক মুসলমান নেতার অনুরোধের প্রেক্ষিতে মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ লন্ডন হতে ভারতে ফিরে আসেন এবং মুসলিম লীগের সভাপতির পদ গ্রহণ করেন। ১৯৩৫ সালে ভারত শাসন আইনের অধীনে অনুষ্ঠিতব্য আসন্ন নির্বাচনের পরিপ্রেক্ষিতে জিন্নাহ মুসলিম লীগের কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক শাখাসমূহ পুনর্গঠিত করে নতুন কাঠামো প্রদান করেন। নতুন কমিটিসমূহকে জনসংযোগ এবং আসন্ন নির্বাচনী রাজনীতির জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করতে নির্দেশ দেওয়া হয়।

১৯৩৭ সালের নির্বাচনে বাংলায় মুসলিম লীগ বিস্ময়কর সাফল্য অর্জন করে। মোট নয়টি প্রদেশে মুসলমানদের জন্য সংরক্ষিত ৪৮২টি আসনের মধ্যে লীগ ১০৪টি আসন লাভ করে। মোট প্রাপ্ত আসনের এক তৃতীয়াংশেরও অধিক (৩৬টি) শুধু বাংলাতেই অর্জিত হয়েছিল। মুসলিম লীগ আইন সভায় কংগ্রেসের পর দ্বিতীয় বৃহত্তম দল হিসেবে আবির্ভূত হয়। ধারণা করা হয় যে, বাংলায় মুসলিম লীগের বিজয় ছিল পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত মুসলমান পেশাদার ও মুসলমান ভূমি মালিক সম্প্রদায়ের যৌথ সমর্থনের ফল। এখানে একটি বিষয় উল্লেখ করার মতো তা হলো আলেম শ্রেণি বিশেষত দেওবন্দি ধারার আলেমরা মুসলিম লীগের কার্যকলাপ থেকে দূরে থাকাতেই আগ্রহী ছিল।

১৯৩৭ সালে বাংলার মুখ্যমন্ত্রী এ.কে. ফজলুল হক মুসলিম লীগে যোগদান করেন এবং এর ফলে তার মন্ত্রিসভা কার্যত মুসলিম লীগের মন্ত্রিসভায় পরিণত হয়। শেরে বাংলা ফজলুল হকের ব্যাপক জনপ্রিয়তা ব্যবহার করে বাংলাকে মুসলিম লীগের দুর্গে পরিণত করা হয়। বাংলার মুসলমানদের নেতা হিসেবে ফজলুল হক মুসলিম লীগের মঞ্চ থেকে উপমহাদেশের মুসলমানদের জন্য স্বাধীন আবাসভুমি দাবি করে লাহোর প্রস্তাব উত্থাপন করেন। 

গর্ভনর জন হার্বাট-এর পরামর্শে ফজলুল হক পদত্যাগ করলে খাজা নাজিমউদ্দীন মন্ত্রিসভা গঠন করেন। ১৯৪৩ থেকে ১৯৪৬-এর মধ্যে মুসলিম লীগ একটি যথার্থ জাতীয় সংগঠনে পরিণত হয়। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও আবুল হাশিম এর নেতৃত্বে মুসলিম লীগ এতই জনপ্রিয় হয়ে ওঠে যে, ১৯৪৬ সালের নির্বাচনে বাংলার মুসলমানদের জন্য সংরক্ষিত ১১৭টি আসনের মধ্যে দল ১১০টি আসন অর্জন করে। ফলে একথা নিশ্চিত করে বলা যায়, মুসলিম লীগই বাংলার মুসলমান সম্প্রদায়ের একক সংগঠন। তখন পর্যন্ত কংগ্রেস প্রভাবাধীন একমাত্র উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ ছাড়া ভারতের অন্যান্য মুসলমানপ্রধান প্রদেশসমূহে লীগের সাফল্য সমভাবে উৎসাহব্যঞ্জক ছিল। ১৯৪৬ সালের নির্বাচনে মুসলিম লীগের সাফল্যের নায়ক মোহাম্মদ আলী জিন্নাহকে ভারতীয় মুসলমানদের অবিসংবাদিত নেতায় পরিণত করে। ব্রিটিশ কর্তৃক ক্ষমতা হস্তান্তর বিষয়ক সকল আলোচনা ও চুক্তিতে মুসলমান সম্প্রদায় সম্পর্কিত সকল বিষয়ে জিন্নাহর মতামত গ্রহণ করা অপরিহার্য হয়ে পড়ে। লাহোর প্রস্তাবের ছয় বছর পরে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী আইন সভায় মুসলমান সদস্যদের দিল্লি কনভেনশনে ‘একটি মুসলমান’ রাষ্ট্রের প্রস্তাব উত্থাপন করেন। ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট স্বাধীনতা অর্জিত হলে মুসলিম লীগ ভারতীয় মুসলমানদের প্রায় সকলের সংগঠনে পরিণত হয়।  

২৩ মার্চ, ২০২০

শতাব্দিশ্রেষ্ঠ নায়ক শহীদ শায়খ আহমেদ ইয়াসিন


শায়খ আহমেদ ইয়াসিনের অনেক পরিচয়। কিন্তু সবচেয়ে বড় পরিচয় তিনি হামাস প্রতিষ্ঠাতা। এছাড়া তিনি গাজায় ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা। তিনি একাধারে ইসলামী ব্যক্তিত্ব, রাজনীতিবিদ, ফিলিস্তিনের শিক্ষা আন্দোলনের অগ্রপথিক এবং ধর্মীয় নেতা। একজন সাধারণ মানুষ থেকে তিনি হয়েছেন অসাধারণ। তাঁর জীবন সিনেমার নায়কের মতো। একজন পঙ্গু ব্যক্তি হয়েও তিনি ছিলেন পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী সন্ত্রাসী বাহিনীর জম। ইসরাঈল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর থেকেই ফিলিস্তিনী মুসলিমদের উপর ভয়াবহ দুর্যোগ নেমে আসে। আর এই দুর্যোগের বিরুদ্ধে একজন প্যরালাইসিস আক্রান্ত মানুষ হয়েও দাঁড়িয়েছেন কঠোরভাবে। তিনি সারাবিশ্বের মুসলিমদের দেখিয়ে দিয়েছেন সন্ত্রাসীদের মোকাবেলা করা জন্য সাহস লাগে, লাগে দৃঢ় মনোবল ও রবের প্রতি অবিচল আস্থা ও বিশ্বাস। তিনি মুসলিমদের শতাব্দিশ্রেষ্ঠ নায়ক। 

১৯৪৮ সালের যুদ্ধের পর পরিবারের সাথে গাজার শরণার্থী শিবিরে আসেন। মাত্র বারো বছর বয়সে বন্ধুর সাথে খেলতে গিয়ে দুর্ঘটনার শিকার হন এবং পক্ষাঘাতগ্রস্থ হয়ে পড়েন। তিনি পড়াশোনার জন্য আল আযহার বিশ্ববিদ্যালয়েও ভর্তি হলেও পরবর্তীকালে শারিরীক অক্ষমতার কারণে সেখানে পুরো পড়াশোনা শেষ করতে পারেননি। কর্মজীবনে তিনি ছিলেন একজন শিক্ষক। এছাড়া তিনি মসজিদে ইমামতি করেতেন এবং খুতবাও দিতেন। তার বলিষ্ঠ যুক্তি এবং উপস্থাপন ভঙ্গী তাকে ফিলিস্তিনের একজন জনপ্রিয় ব্যক্তিত্বে পরিণত করেছিল। 

১৯৬৭ সালের আরব ইসরাইল যুদ্ধের পর শায়খ তার বক্তব্যে ফিলিস্তিনের প্রতিরোধের দিকে উদ্বুদ্ধ করতে শুরু করেন। তিনি এসময় ইসলামী সমাজ সংস্থার প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন এবং বিভিন্ন জায়গা থেকে অবরুদ্ধ জনগন, আহত এবং বন্দীদের জন্য ত্রাণ ও সাহায্যের ব্যবস্থা করেন। বিভিন্ন সামাজিক কাজের মাধ্যমে তিনি ফিলিস্তিনী জনগণের ভালোবাসার মানুষে পরিণত হন। 

১৯৮৩ সালে তিনি প্রথমবারের মত গ্রেফতার হন এবং ইহুদী রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণে জনগণকে উস্কানী দেয়ার অভিযোগে তার ১৩ বছরের জেল হয়। ১৯৮৫ সালে তিনি ছাড়া পান। ১৯৮৭ সালে তিনি হামাস প্রতিষ্ঠা করেন। প্রথম দিকে হাসপাতাল, এনজিও, স্কুল, লাইব্রেরি গঠনের মাধ্যমে জনগনের মন আকর্ষণ করলেও ধীরে ধীরে হামাস ইহুদীবাদীদের বিরুদ্ধে একটি স্বশস্ত্র প্রতিরোধ আন্দোলনে রূপ নেয়। ১৯৯১ সালে তিনি দ্বিতীয়বারের মত গ্রেফতার হন। ১৯৯৭ সালে ছাড়া পেয়ে দ্বিগুন উদ্যমে প্রতিরোধ আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন। আহমেদ ইয়াসিন বিশ্বাস করতেন যে, ইসরাইলের জন্মই হয়েছে অবৈধভাবে এবং পুরো ফিলিস্তিনের প্রতিটি ইঞ্চি জমিই মুসলমানদের। আরব নেতাদের ফিলিস্তিন-ইসরাইল চুক্তিতে তার আস্থা ছিলনা। এর চেয়ে অস্ত্র নিয়ে প্রতিরোধেই তিনি আগ্রহী ছিলেন। 

জন্ম ও শিক্ষা
শায়খ আহমাদ ইয়াসিন ১৯৩৬ সালের জানুয়ারি মাসে আসকালান শহরের উপকণ্ঠে জুরাহ নামক স্থানে জন্মগ্রহণ করেন। তার পুরো নাম শায়খ আহমেদ ইসমাইল হাসান ইয়াসিন। তার পিতার নাম ছিল আব্দুল্লাহ ইয়াসিন এবং মাতার নাম সা'দা আল হাবেল। শিশু অবস্থায়ই তিনি তার পিতাকে হারান। লোকে তাকে চিনত তার মাতার নামের সাথে মিলিয়ে আহমাদ সা'দা হিসেবে। ইয়াসিনরা ছিলেন তার চার ভাই এবং দুই বোন। ১৯৪৮ সালে তাদের গ্রাম ইসরাঈলের দখলে চলে গেলে দশ বছরের বালক আহমেদের জায়গা হয় গাজার আল শাতিঈ শরণার্থী শিবিরে। শরণার্থী শিবিরের প্রচন্ড কষ্টের মধ্যে এই বালকের মধ্যে ইসরাইলীদের প্রতি তীব্র বিদ্বেষ এবং ফিলিস্তিনীদের প্রতি ভালোবাসা জন্ম নেয় যা পরবর্তীতে তার প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে তুলতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। 

শিবির জীবনের দু’বছরের মাথায় যখন তার বয়স মাত্র বারো, বন্ধু আব্দুল্লাহর সঙ্গে কুস্তি খেলতে গিয়ে মেরুদণ্ডে প্রচণ্ড আঘাত পান। টানা পঁয়তাল্লিশ দিন প্ল্যাস্টার করে রেখেও শেষ রক্ষা হয়নি। আহমেদ ইয়াসিন সারা জীবনের জীবনের জন্য পঙ্গু হয়ে যান। পঙ্গু হয়ে যাবার পরেও তিনি উচ্চ শিক্ষা লাভের জন্য একাগ্র মানসিকতা নিয়ে ইসলামী জ্ঞানের তীর্থস্থান কায়রোর আল আযহার বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। ক্রমান্বয়ে শরীরের অবনতি ঘটায় তিনি গাজায় ফিরে আসেন। তবে এতে তার জ্ঞানের প্রতি স্পৃহা বিন্দুমাত্র কমেনি। বাড়ি বসেই তিনি পড়ে ফেলেন দর্শন, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, সমাজবিজ্ঞান, অর্থনীতি আর ধর্মের নানা বিষয়। আধুনিক নানা বিষয়ে তিনি বড় মাপের পণ্ডিত হয়ে ওঠেন।

পেশাগত কাজ
এসময় তিনি এলাকার মসজিদে জুমার নামাজ পড়ানো শুরু করেন। প্রখর যুক্তি এবং মানুষকে আকৃষ্ট করার যোগ্যতার কারনে তার খুৎবা এলাকাবাসীর কাছে অত্যন্ত মনোমুগ্ধকর। বিশেষ করে তরুণরা তার কথা বার্তায় খুঁজে পায় ফিলিস্তিনী জাতির মুক্তির মন্ত্র। এভাবে নানা এলাকার মসজিদে মসজিদে লোকে তাকে ডাকতে থাকে। এর পাশাপাশি রোজগারের জন্য একটি স্কুলে আরবী ভাষা বিষয়ে শিক্ষকতা শুরু করেন। শিক্ষক হিসেবেও ছাত্রদের মধ্যে তার সুনাম ছড়িয়ে পড়ে। তার ছাত্রদের মনেও তিনি বপন করে দেন ইসরাইল বিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনের বীজ।

ব্যক্তিগত জীবন
১৯৬০ সালে আহমাদ ইয়াসিন হালিমা নামে তার একজন আত্নীয়াকে বিয়ে করেন। তখন তার বয়স ছিল ২২ বছর। শায়খ আহমাদ ইয়াসিনের ছেলে মেয়ের সংখ্যা হল এগারোজন। খুব সাধাসিধে জীবনযাপনকারী এই নেতা গাজায় তিন রুমের একটি এপার্টমেন্টে বাস করতেন।

প্রতিরোধ আন্দোলন ও হামাস প্রতিষ্ঠা 
১৯৪৮ সালে আরব-ইসরাইল যুদ্ধের ফলে প্রায় ৭ লক্ষ ফিলিস্তিনীর ওপর নেমে আসে দুর্যোগ। একে তারা নাম দেয় নাক্ববা। এই দুর্যোগের শিকার ছিলেন আহমেদ ইয়াসিন নিজে। তার পুরোকে গ্রামকেই ইসরাঈলী বাহিনী গুড়িয়ে দেয়। এজন্য এই গ্রামটির বর্তমানে অস্তিত্ব পাওয়া যায়না। খুব কাছ থেকে ফিলিস্তিনীদের দুর্দশা দেখবার সুযোগ পাওয়ায় তিনি এর থেকে পরিত্রাণ খুঁজে ফেরেন। ১৯৫৯ সালে দ্বিতীয়বার মিশরে গিয়ে ইখওয়ানের আন্দোলনের সাথে তার পরিচয় ঘটে। ইখওয়ানের কর্মকাণ্ড তাকে দারুণ আকৃষ্ট করে। ফিলিস্তিন ফিরে এসে তার দাওয়াতী কাজ অব্যহত রাখেন। এসময় তিনি বলেন,
'ফিলিস্তিনের সমস্যা আমাদের, আমাদেরকেই এর সমাধান করতে হবে। অস্ত্র ধরে প্রতিরোধে নামতে হবে। আমাদেরকে আরবের কোন দেশ বা আন্তর্জাতিক কেউ সাহায্য করতে আসবেনা।'

১৯৬৭ তে আরব-ইসরাঈল যুদ্ধের সময় গাজাসহ পুরো ফিলিস্তিন দখল করে ফেলে ইসরাঈল। শায়খ আহমেদ ইয়াসিন এই জুলুমের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ এবং আল আকসার পুনরুদ্ধারের জন্য আহ্বান জানাতে থাকেন। মসজিদে মসজিদে তিনি খুতবা দিতে থাকেন। যুবকদের তিনি আহ্বান জানান নিজের অধিকার বুঝে নিতে। তার ভাষণে জাগরণের শুরু হয়। দলে দলে যুবকেরা যোগ দিতে থাকল তার এসব সমাবেশে।

১৯৭৮ সালে ৪৯ বছর বয়সে শায়খ আহমেদ ইয়াসিন ফিলিস্তিনিদের সাহায্যের জন্য 'আল মুজাম্মা আল ইসলামী' নামে একটি ইসলামী সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন। যার নামের বাংলা অর্থ দাঁড়ায় ইসলামী সমাজ সংস্কার সংস্থা। এই সংগঠন ব্যাপকভাবে জনসেবা এবং সামাজিক কাজ করতে লাগল যেমন ফ্রি ট্রিটমেন্টের ব্যবস্থা, ফ্রি স্কুলিং, মসজিদ এবং লাইব্রেরি নির্মাণ। ইসরাঈলের তখনকার নেতারা আহমেদ ইয়াসিনকে সেভাবে বাধা দেয়নি। ধীরে ধীরে ইসরাঈলের বিরুদ্ধে হুমকি হয়ে দাড়ায় আহমাদ ইয়াসিনের কর্মকান্ড। ১৯৮০ সালে এই সংগঠন পরিবর্তিত হয়ে আল মুজাহিদ আল ফিলিস্তিনিয়্যুন সংগঠন গঠিত হয়। 'মাজদ' এই সাংকেতিক নামে ইসরাইলীদের উপর হামলা চালাতে থাকে তার শিষ্যরা। চিন্তাগত দিক থেকে আহমেদ ইয়াসিনের সংগঠন মিশরের ইখওয়ানের অনুরূপ।  

শেখ ইয়াসিন ১৯৮৭ সালে সহযোগী মুজাহিদ ও সমমনাদের নিয়ে গড়ে তোলেন ‘‘হামাস’’ নামের ইসলামী প্রতিরোধ আন্দোলন। হামাস শব্দের অর্থ 'উদ্দীপনা' । ইন্তিফাদা বা গণ-আন্দোলন গড়ে তোলার ক্ষেত্রে হামাসের মসজিদ-কেন্দ্রিক তৎপরতা ছিল ব্যাপক বিস্তৃত। ১৯৮৮ সালে গৃহীত হয় “হামাস চার্টার” যার লক্ষ্য হলো অধিকৃত ফিলিস্তিন থেকে দখলদারিত্বের অবসান ঘটানো। হামাসের সামরিক শাখাও গড়ে তোলা হয়। এই শাখা দখলদার বিরোধী সশস্ত্র সংগ্রাম শুরু করে। এই সংগ্রামের সময় ইয়াসিন ব্যাপক হুমকির সম্মুখীন হন এবং তার সহযোগী অনেক নেতা ইসরাঈলী ঘাতকদের হামলায় শহীদ হন। 

প্রথম ইন্তিফাদা
আহমেদ ইয়াসিন ফিলিস্তিনীদের বোঝালেন আমাদের ভাগ্যের রাস্তা আমাদেরকেই খুলতে হবে। হামাসের নেতৃত্বে তিনি ডাক দিলেন প্রথম ইন্তিফাদাহ এর। ইন্তিফাদাহ মানে গণ-অভ্যুত্থান। হাতের কাছে যা পাওয়া যাবে তাই নিয়েই ইসরাঈলীদের প্রতিরোধে তিনি জনগণকে উৎসাহিত করতে থাকেন। শিশুরাও পর্যন্ত তার ডাকে রাস্তায় নেমে আসে। ইন্তিফাদাহ শুরুর এক বছরের মধ্যে ইসরায়েলি সৈন্যদের হাতে ৩১৮ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়, আহত হয় ৭ হাজারের অধিক লোক, ১৫ হাজার ফিলিস্তিনিকে কারাগারে পাঠানো হয়। তারপরেও অচিন্তনীয় প্রতিরোধের সম্মুখীন হয় ইসরাইলী বাহিনী যার পুরোভাগের নেতৃত্বই দিয়েছেন আহমদ ইয়াসিন। তিনি এই প্রতিরোধ সম্পর্কে বলেছেন, আমরা এই পথ বেছে নিয়েছি, হয় বিজয় না হয় মৃত্যুর মাধ্যমে এর শেষ হবে। পরবর্তীতে তার এই কথা ফিলিস্তিনী জনগন গণজাগরণের মূলমন্ত্র হিসেবে মনে করতে থাকে।

কারাজীবন
মিসরে থাকা অবস্থায় ইখওয়ানুল মুসলিমীনের সাথে তার সম্পর্ক থাকায় মিসর সরকার তাকে জেলে পাঠায়। ১৯৮৩-তে ইজরাইলীদের হাতে প্রথম বারের মত গ্রেপ্তার হন শাইখ আহমেদ ইয়াসিন। ইজরাইলের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরার এবং জনগনকে উস্কানীর অভিযোগে তাকে ১৩ বছরের জেল দেয়া হয় তাকে। ১৯৮৫ সালে গ্রেপ্তারের এক বছরের মাথায় বন্দি বিনিময় চুক্তির অংশ হিসেবে তিনি মুক্তি পান। এই বিনিময় চুক্তি সম্পন্ন হয়েছিল Popular Front for the Liberation of Palestine General Command নামক একটি প্রতিরোধ সংগঠন এবং ইজরাইল সরকারের মধ্যে, ফিলিস্তিনের পক্ষে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন আহমেদ জিবরিল।

১৯৮৯ সাল, প্রথম ইন্তিফাদার দুবছর পর আবার গ্রেপ্তার হন হামাসের এই প্রতিষ্ঠাতা। এইসময় তাকে বিভিন্নরকম নির্যাতন করা হয় বলেও অভিযোগ আছে। এবার ৪০ বছরের কারাদন্ড দেয়া হয় তাকে। প্রধান অভিযোগ ছিল তার বিরুদ্ধে ইজরাইলী সৈন্যদেরকে হত্যা, কিডন্যাপ এবং স্বশস্ত্র প্রতিরোধ আন্দোলন হামাসের প্রতিষ্ঠায় নেতৃত্ব দেওয়া। জেলখানায় তার শরীরের ক্রমাবনতি ঘটতে থাকে। আস্তে আস্তে ডান চোখের দৃষ্টি শক্তি হ্রাস পায়। আক্রান্ত হন শ্বাসকষ্টজনিত রোগে। পক্ষাঘাতগ্রস্থ পিতাকে চলাফেরায় সাহায্য করার জন্য জেলখানায় তাকে সহযোগীতা করতেন তার দুই ছেলে। আট বছর জেল খাটার পরে ১৯৯৭ সালে জর্দানের বাদশাহ হুসাইনের সহযোগীতায় মুক্তি পান আহমদ ইয়াসিন। এরপরে দফায় দফায় তাকে গৃহবন্দীও করে রাখা হয়।

শাহদাত 
বেশ কয়েকবার হত্যা চেষ্টা চালানোর পরে ২০০৪ সালের ২২ মার্চ ভোরে বাসা থেকে ১০০ মিটার দূরের মসজিদে হুইল চেয়ারে করে ফজরের নামাজ পড়ার জন্য মসজিদের দিকে যা্ওয়ার সময় হেলিকপ্টার গানশিপ থেকে ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করে শেখ আহমেদ ইয়াসিনকে হত্যা করে ইসরাঈল। আমরা হারিয়ে ফেললাম আমাদের সেরা নায়ককে, আমাদের সাহসের বাতিঘরকে। সেদিন তার সাথে তিনজন বডিগার্ডসহ মসজিদ থেকে নামাজ শেষে বেরুনো মুসল্লিদের মধ্যে থেকে আরো ৫ জন মারা যান। গুরুতর আহত হয় প্রায় ১৭ জন। যাদের মধ্যে শহীদ ইয়াসিনের দুই পুত্রও ছিল। খ্রিষ্টান-মুসলমান নির্বিশেষে দু’লাখ লোকের ঢল নেমেছিল তার শেষকৃত্যে। আব্দুল আজিজ আল রানতিসি তার মৃত্যুর পর হামাসের প্রধানের দায়িত্ব পালন করেন। 

১৮ মার্চ, ২০২০

বঙ্গকথা পর্ব-৩৩ : বঙ্গভঙ্গ এবং মুসলিম ও মুশরিকদের দ্বন্দ্বের পুনরাবৃত্তি


বাংলার ইতিহাসে বঙ্গভঙ্গ একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। এর মাধ্যমে বাংলায় চলে আসা হাজার বছরের তাওহীদবাদী ও মুশরিকদের মধ্যে দ্বন্দ্ব পুনরায় চরমে পৌঁছে যায়। বঙ্গভঙ্গের প্রস্তাবনার একেবারে শুরুতে মুসলিমরা এর বিরোধীতা করে ইংরেজরা তাদের শোষণ আরো জোরদার করবে মনে করে। তখন হিন্দু সমাজ চুপ ছিলো। কিন্তু যখন লর্ড কার্জন বঙ্গভঙ্গের পক্ষে কিছু সুযোগ সুবিধা ঘোষণা করেন আর এতে সন্তুষ্ট হয়ে মুসলিম সমাজ বঙ্গভঙ্গ মেনে নেয়। 

এতেই বাধে বিপত্তি। মুসলিমদের উপকার হবে আর হিন্দুরা তা মেনে নিবে এটা তো হতে পারে না। সর্বাত্মক আন্দোলন করে বঙ্গভঙ্গকে রুখে দেয় হিন্দুরা। এই ঘটনাকে ইস্যু করে মুসলিমরা বুঝতে পারে কংগ্রেস ভারতীয়দের জন্য নয় সেটা কেবল হিন্দুদের স্বার্থ বিবেচনা করে। এর প্রেক্ষিতে ১৯০৬ সালে মুসলিম লীগ গঠন প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত হয়। 

লর্ড কার্জন ভাইসরয় থাকাকালীন সময়ে ১৯০৫ সালের ১৬ অক্টোবর বঙ্গভঙ্গ কার্যকর হয়। ১৭৬৫ সাল থেকে বিহার ও উড়িষ্যা সমন্বয়ে গঠিত বাংলা ব্রিটিশ ভারতের একটি একক প্রদেশ হিসেবে বেশ বড় আকার ধারণ করেছিল। এর ফলে প্রদেশটির প্রশাসনকার্য পরিচালনা দুঃসাধ্য হয়ে ওঠে এবং এজন্য এটিকে বিভক্ত করার প্রয়োজন হয়ে পড়ে। বলা চলে এই বিশাল প্রদেশ শাসন করা ইংরেজদের জন্য কষ্টসাধ্য হয়ে উঠেছিলো বলেই এখানে বারংবার বিদ্রোহের আগুন জ্বলে উঠেছিলো। 

১৯০৩ সালে বাংলা প্রদেশটির জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে ৭ কোটি ৮৫ লক্ষে দাঁড়ায়। এর ফলস্বরূপ পূর্ব বাংলার অনেকগুলি জেলা কার্যত বিচ্ছিন্ন এবং অনুন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে অবহেলিত ছিল। ফলে এতদঞ্চলের সুষ্ঠু শাসন ব্যবস্থা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে। কলকাতা ও এর নিকটস্থ জেলাসমূহ সরকারের আওতাধীন ছিলো। অন্যান্য অঞ্চলে জমিদারদের শোষণের ভারে চাষীদের অবস্থা ছিল দুর্দশাগ্রস্ত; এবং ব্যবসায়, বাণিজ্য ও শিক্ষা ছিল অবহেলিত। প্রদেশের প্রশাসনিক যন্ত্রকে প্রয়োজন অপেক্ষা কমসংখ্যক কর্মচারী নিয়ে কাজ চালিয়ে যেতে হতো। বিশেষত নদ-নদী ও খাঁড়িসমূহ দ্বারা অত্যধিক বিচ্ছিন্ন পূর্ববাংলার গ্রামাঞ্চলে পুলিশী কাজ চালানো অসুবিধাজনক হলেও উনিশ শতকের শেষ দশক পর্যন্ত সেখানে আলাদা মনোযোগ প্রদান করা হয় নি। জলপথে সংঘবদ্ধ জলদস্যুতা অন্তত এক শতাব্দীকাল বিদ্যমান ছিল।

প্রশাসনিক প্রতিবন্ধকতাসমূহের পাশাপাশি দুর্ভিক্ষ, প্রতিরক্ষা অথবা ভাষাগত সমস্যাবলির কারণে ইংরেজরা বাংলাকে ভাগ করে নতুন প্রদেশ সৃষ্টি করার চিন্তা করে। বঙ্গভঙ্গের প্রস্তাবসমূহ ১৯০৩ সালে প্রথম বিবেচনা করা হয়। লর্ড কার্জন মূলত প্রসাশনিক ও প্রতিরক্ষামূলক কাজের সুবিধার জন্যই নতুন প্রদেশ সৃষ্টি করতে চেয়েছেন। ১৯০৪ সালের জানুয়ারি মাসে আনুষ্ঠানিকভাবে বঙ্গভঙ্গের পরিকল্পনার কথা প্রকাশিত হয়। ১৯০৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাস থেকে লর্ড কার্জন পূর্ব বাংলার জেলাগুলি সফর করেন। তিনি বিভিন্ন জেলার নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গের সাথে আলোচনা করেন এবং বিভক্তির ব্যাপারে সরকারের অবস্থান ব্যাখ্যা করে ঢাকা, চট্টগ্রাম ও ময়মনসিংহে বক্তৃতা দেন। প্রথমে মুসলিমরা বিরোধীতা করলেও তার এই সফরে মুসলিমরা বঙ্গভঙ্গের পক্ষে অবস্থান নেন। 

বঙ্গভঙ্গ অনুসারে নতুন প্রদেশটি গঠিত হবে পার্বত্য ত্রিপুরা রাজ্য, চট্টগ্রাম, ঢাকা ও রাজশাহী বিভাগসমূহ এবং মালদা জেলাকে আসামের সাথে একত্র করে। বাংলাকে যে শুধু পূর্বদিকে এ বৃহৎ ভূখণ্ডসমূহ ছেড়ে দিতে হবে তাই নয়, তাকে হিন্দি-ভাষাভাষী পাঁচটি রাজ্যও মধ্যপ্রদেশকে ছেড়ে দিতে হবে। পশ্চিম দিকে সম্বলপুর এবং মধ্যপ্রদেশ থেকে উড়িয়া-ভাষাভাষী পাঁচটি রাজ্যের সামান্য ভূখণ্ড বাংলা লাভ করবে। বাংলার নিজের দখলে যে ভূখণ্ড থেকে যায় তার আয়তন ১৪১,৫৮০ বর্গ মাইল এবং জনসংখ্যা পাঁচ কোটি চল্লিশ লক্ষ, যাদের মধ্যে চার কোটি বিশ লক্ষ হিন্দু ও নব্বই লক্ষ মুসলমান।

নতুন প্রদেশটি অভিহিত হবে ‘পূর্ব বাংলা ও আসাম’ নামে, যার রাজধানী হবে ঢাকা এবং অতিরিক্ত সদর দপ্তর হবে চট্টগ্রামে। এর আয়তন হবে ১০৬,৫৪০ বর্গ মাইল এবং জনসংখ্যা তিন কোটি দশ লক্ষ। এর মধ্যে এক কোটি আশি লক্ষ মুসলমান ও এক কোটি বিশ লক্ষ হিন্দু। এর প্রশাসন গঠিত হবে একটি আইন পরিষদ ও দুই সদস্যবিশিষ্ট একটি রাজস্ব বোর্ড নিয়ে। নতুন প্রদেশটির সবচেয়ে লক্ষণীয় বিষয় হলো যে, এটা এর নিজস্ব চৌহদ্দির মধ্যে এ যাবৎ বাংলার তুচ্ছ ও অবহেলিত প্রতিনিধিত্বমূলক সমপ্রকৃতির মুসলমান জনগণের প্রতি পূর্ণ মনোযোগ দিবে। অধিকন্তু, চা শিল্প এবং পাট উৎপাদনকারী এলাকার বৃহদংশ একক প্রশাসনের অধীনে নিয়ে আসা হবে। 

মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ পূর্ব বাংলাকে নিজের পক্ষে টানতে লর্ড কার্জন ঢাকাকে রাজধানী করে মুসলিমদের সুযোগ সুবিধা বৃদ্ধির ঘোষণা দেন। সেই সাথে একজন লেফটেন্যান্ট গভর্নর, পৃথক আইন পরিষদ ও রাজস্ব বোর্ডের ঘোষণাও দেন কার্জন। প্রথমদিকে পূর্ব বাংলার মুসলিমরা ভেবেছিলো তাদের উপর ইংরেজ শাসন আরো জেঁকে বসবে তাই তারা বিরোধীতা করেছিলো। কিন্তু পরে বিভিন্ন সুবিধার কথা চিন্তা করে বেশিরভাগই বঙ্গভঙ্গের পক্ষে চলে যায়। নবাব সলিমুল্লাহও বঙ্গভঙ্গের পক্ষে অবস্থান নিয়ে জনমত গঠনে ভূমিকা রাখেন। জমিদার, আইনজীবী ও কিছু ব্যবসায়ী ছাড়া মুসলমানদের অধিকাংশই বঙ্গভঙ্গের পক্ষে অবস্থান নেন। তবে আসামের চিফ কমিশনার হেনরি কটন নিজেও এ প্রস্তাবের বিরোধিতা করেন। এসব পক্ষ-বিপক্ষ মতের মধ্যেই ১৯০৫ সালের ৯ জুন ভারত সচিব ব্রডরিক এ পরিকল্পনা অনুমোদন করেন ও ১০ জুলাই সরকারি গেজেট হিসেবে তা প্রকাশিত হয়। একই বছর ১৬ অক্টোবর থেকে বঙ্গভঙ্গ কার্যকর হয়। 

প্রশাসনিক ও অর্থনৈতিক সুবিধার জন্য পূর্ব বাংলাকে গুরুত্ব দেয়ার দরকার অপরিহার্য হলে বঙ্গভঙ্গের পেছনে কাজ করেছিল কিছু রাজনৈতিক ব্যাপারও। ব্রিটিশ শিক্ষা ব্যবস্থায় শিক্ষিত হওয়া শিক্ষিত সমাজ একসময় নিজেদের পরাধীনতার কষ্টটা অনুভব করতে থাকে। ফলে বাঙালি জাতীয়তাবাদের সৃষ্টি হয় আর এর কেন্দ্র ছিল কলকাতা। বাংলাকে বিভক্ত করে এই জাতীয়তাবাদকে দুর্বল করার কথা যে ব্রিটিশরা একেবারেই ভাবেনি সেটা মোটেই বিশ্বাসযোগ্য না। এছাড়া সরকারি চাকরিতে ব্রিটিশদের তুলনায় দেশীয়দের বৈষম্য বাঙালিদের ক্ষুব্ধ করে রেখেছিল অনেক দিন ধরেই। হিন্দু-মুসলিম বিভেদ তৈরি করে ভারতীয়দের ঐক্য নষ্ট করে ব্রিটিশদের শাসকরা সুবিধা নিবে এটাই স্বাভাবিক। আর এই সুবিধা নেয়ার মূল কারণ হিন্দুদের হিংসা। 

বঙ্গভঙ্গের শুরুতে হিন্দু সমাজের তেমন প্রতিক্রিয়া দেখা যায় না। কিন্তু যখন ঢাকাকে রাজধানী করা, মুসলিমদের সুযোগ সুবিধা বৃদ্ধি, সেই সাথে একজন লেফটেন্যান্ট গভর্নর, পৃথক আইন পরিষদ ও রাজস্ব বোর্ডের ঘোষণা দেন তখনই মূলত হিন্দু সমাজ ও কংগ্রেসের বিরোধীতা পরিলক্ষিত হয়। এদিকে লর্ড কার্জন পূর্ব বাংলা সফরে মুসলমানদের ঐক্যের উপরেই জোর দেন বেশি। এটি ধর্মকে সরাসরি ব্যবহার করা দুই বাংলাতেই প্রভাব ফেলে। কোলকাতার হিন্দুদের আচরণে পূর্ব বাংলায় মুসলমানদের মধ্যে হিন্দু বিদ্বেষী মনোভাব বাড়তে থাকে। এছাড়া পূর্ব বাংলায় প্রচুর হিন্দু থাকলেও তাদের অধিকাংশই ছিলেন নিচু বর্ণের হিন্দু। অন্যদিকে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়দের মতো উঁচু বর্ণের হিন্দুরা থাকতেন কোলকাতায়। ফলে মুসলমানদের সাথে সাথে পূর্ব বাংলার হিন্দুরাও নিজেদের সুবিধার কথা ভেবে বঙ্গভঙ্গের পক্ষেই অবস্থান নেন।

মুসলমানগণ নতুন লেফটেন্যান্ট গভর্নর ব্যামফিল্ড ফুলার-কে উষ্ণ সংবর্ধনা জ্ঞাপন করে। মুসলেম ক্রনিকল সংবাদপত্র বঙ্গভঙ্গের পক্ষে অবস্থান নেয়। কলকাতার মুসলমানরাও নতুন প্রদেশটির সৃষ্টিকে স্বাগত জানায়। মোহামেডান লিটারেরি সোসাইটি ১৯০৫ সালে সাতজন নেতৃস্থানীয় মুসলমান ব্যক্তিত্ব কর্তৃক স্বাক্ষরিত একটি প্রকাশ্য লিখিত ঘোষণা বের করে। ঘোষণাটি পশ্চিম ও পূর্ব উভয় বাংলার বিভিন্ন মুসলমান সোসাইটিগুলির নিকট বিলি করা হয় এবং এর মাধ্যমে বিভক্তি ব্যবস্থার প্রতি তাদের শর্তহীন সমর্থন দানের জন্য মুসলমানদের নিকট অনুরোধ জানানো হয়। নতুন প্রদেশটির সৃষ্টি মুসলমানদেরকে একটি সঙ্ঘবদ্ধ দলে পরিণত এবং সামাজিক ও রাজনৈতিক সম্পর্কিত বিষয়ে তাদের আশা-আকাঙ্ক্ষা তুলে ধরার অভিপ্রায়ে একটি সংঘ গঠন করতে উৎসাহিত করে। ১৯০৫ সালের ১৬ অক্টোবর ‘মোহামেডান প্রভিন্সিয়াল ইউনিয়ন’ প্রতিষ্ঠা করা হয়। বিরাজমান সকল প্রতিষ্ঠান ও সমিতিকে এ নতুন ইউনিয়নটির সাথে নিজেদেরকে অধিভুক্ত করতে আহ্বান জানানো হয় এবং খাজা সলিমুল্লাহকে সর্বসম্মতিক্রমে এর পৃষ্ঠপোষক হিসেবে মনোনীত করা হয়।

আবার একদল শিক্ষিত মুসলিম পন্ডিত ছিল যারা বঙ্গভঙ্গ বিরোধী বিক্ষোভ ও স্বদেশী আন্দোলন-এর প্রতি সমর্থন জ্ঞাপন করেন। যদিও তাদের সংখ্যা ছিল নগণ্য, তবুও তাদের ভূমিকা মুসলমানদের চিন্তাধারায় নতুন মাত্রা যোগ করে। এই দলটি ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসকে সমর্থন ও বঙ্গভঙ্গের বিরোধিতা করে। মুসলমানদের মধ্যকার এ ধারার লোকদের মধ্যে সবচেয়ে বিশিষ্ট ব্যক্তি ছিলেন নওয়াব সলিমুল্লাহর সৎ ভাই খাজা আতিকুল্লাহ। কংগ্রেসের কলকাতা অধিবেশনে (১৯০৬) তিনি বঙ্গভঙ্গকে আনুষ্ঠানিকভাবে বর্জন করে একটি প্রস্তাব উত্থাপন করেন।

বঙ্গকথা পর্ব-৩২ : মুসলিমদের প্রথম রাজনৈতিক সংগঠনের ইতিকথা



সৈয়দ আহমদ খান ছিলেন ইংরেজদের সাথে উদারনৈতিক আচরণে বিশ্বাসী। আর আব্দুল লতিফ ছিলেন ইংরেজদের সাথে সহযোগিতামূলক আচরণে বিশ্বাসী। আর আমীর আলী ছিলেন ইসলামের আদর্শে উজ্জীবিত হয়ে নিয়মতান্ত্রিক রাজনৈতিক চিন্তাধারার মানুষ।

বাংলার মুসলমানদের পুনঃজাগরণে ও সাংস্কৃতিক পুনর্জন্মে সৈয়দ আমীর আলী অবিস্মরণীয় অবদান রেখেছেন। তার চিন্তাধারার উদারনৈতিক প্রভাব তৎকালীন সমাজব্যবস্থাকে বিশেষভাবে প্রভাবিত করেছিল। সৈয়দ আমীর আলী সম্পর্কে বিপুল রঞ্জন নাথ বলেন, "তিনি মুসলমানদের গৌরময় অতীতকেই রেনেসাঁ আন্দোলনের ভিত্তি হিসাবে গ্রহণ করেন এবং রাজনীতি কৃষ্টি ও বুদ্ধিবৃত্তির ক্ষেত্রে তাঁহাদের অতীত অবদান নূতনভাবে তুলিয়া ধরিতে প্রয়াসী হন।"

১৮৪৯ খ্রিস্টাব্দে সৈয়দ আমীর আলী হুগলী জেলার চুঁচড়া শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তার পরিবার অত্যন্ত উদারপন্থী হওয়ায় তিনি ইংরেজী শিক্ষা ও পাশ্চাত্য শিক্ষা লাভের সুযোগ পান। তিনিই ছিলেন কলিকাতা হাইকোর্টের প্রথম মুসলিম ব্যারিস্টার। এছাড়া ভারতীয়দের মধ্যে তিনিই প্রথম প্রিভি কাউন্সিলের সদস্য হন।

ভারতীয় মুসলমানদের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে সৈয়দ আমীর আলীর অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা পাওয়া যায়। তিনিই প্রথম মুসলিম নেতা যিনি রাজনৈতিক সংগঠনের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন। তিনি রাজনৈতিক অধিকার আদায়ের জন্য গঠনতান্ত্রিক সংগ্রাম করাকে নিজের দায়িত্ব মনে করতেন। ভারতীয় মুসলমানদের স্বার্থরক্ষা এবং রাজনৈতিক সচেতনতা সৃষ্টির উদ্দেশ্যে মুসলিমদের ১ম রাজনৈতিক সংগঠন সেন্ট্রাল ন্যাশনাল মোহামেডান এ্যাসোসিয়েশন গঠন করেন। 

আমীর আলী বিশ্বাস করতেন যে, একজন নেতার ব্যক্তিগত প্রচেষ্টার চেয়ে সংগঠনের মাধ্যমে দলগত প্রচেষ্টা অধিক ফলপ্রসূ। প্রতিটি ক্ষেত্রেই মুসলমানরা তাদের হিন্দু প্রতিবেশীদের চেয়ে পিছিয়ে পড়েছিল। তাদের মধ্যে পাশ্চাত্য শিক্ষার অভাব ছিল এবং তারা হিন্দু জমিদার ও মহাজনদের দ্বারা শাসিত এবং কিছু ক্ষেত্রে শোষিত হতো। তৎকালীন ইন্ডিয়া অ্যাসোসিয়েশন, ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস প্রভৃতি রাজনৈতিক সংগঠনে ছিল হিন্দুদের প্রাধান্য। কাজেই এসব সংগঠন তাঁর ধর্মের লোকদের স্বার্থ সংরক্ষণ করতে পারবে না। তাই মুসলমানদের স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য তিনি গড়ে তোলেন একটি সংগঠন। তিনি চেয়েছিলেন মুসলমানদের মাঝে ব্রিটিশ সরকারের প্রতি আনুগত্যপ্রবণতা সৃষ্টি করতে, যাতে তাদের প্রতি ব্রিটিশ সরকারের সন্দেহ দূর হয়। দেশের অন্যান্য সম্প্রদায়ের সঙ্গে তিনি সম্প্রীতি রক্ষা করতে চেয়েছিলেন। নিয়মতান্ত্রিক পন্থায় মুসলমানদের কল্যাণ সাধনই ছিল সংগঠনটির উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য। এর উদ্দেশ্য ছিল নৈতিক মূল্যবোধ ও বুদ্ধিবৃত্তিক ঐতিহ্যের চেতনা ফিরিয়ে এনে মুসলমানদের পুনরুজ্জীবিত করা।

সৈয়দ আমীর আলীর উদ্যোগে লন্ডনে সর্বভারতীয় মুসলিম লীগের লন্ডন শাখা প্রতিষ্ঠিত হয়। তিনি ভারতীয় মুসলমানদের জন্য পৃথক নির্বাচন ব্যবস্থা প্রবর্তনেও ভূমিকা পালন করেন। তিনি লর্ড মর্লির নিকট জোড়ালোভাবে নিজের মতামত তুলে ধরেন। তিনি নিয়মতান্ত্রিক বা সাংবিধানিক পন্থার উপর গুরুত্ব দিতেন। 

মাত্র ২০০ সদস্য নিয়ে সেন্ট্রাল ন্যাশনাল মোহামেডান অ্যাসোসিয়েশন যাত্রা শুরু করলেও পাঁচ বছরের মধ্যে এর সদস্য সংখ্যা প্রায় ছয়শ-তে পৌঁছে। আমীর আলী তাঁর অক্লান্ত প্রচেষ্টায় বাংলা, বিহার, বোম্বাই, যুক্ত প্রদেশ, পাঞ্জাব, এমনকি লন্ডনে এর প্রায় ৫০টি শাখা খোলেন। সচরাচর শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণির লোকেরাই এই সংগঠনের সদস্য হতেন। সরকারি চাকরিতে নিয়োজিত ব্যক্তিরাও এর সদস্য হতে পারতেন। এটি মুসলমানদের স্বার্থ সংরক্ষণে যেকোন রাজনৈতিক সংগঠনের সঙ্গে সহযোগিতা করতে প্রস্তুত ছিল। তার এই সংগঠনের সদস্যরাই পরবর্তীতে মুসলিম লীগের কলেবর বৃদ্ধিতে সহায়তা করে। 

মুসলমানদের আধুনিক চিন্তাধারায় উদ্বুদ্ধকরণ ও রাজনৈতিক সচেতনতা বৃদ্ধিতে সংগঠনটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এ সংগঠনের কার্যক্রমের মধ্যে অন্যতম ছিল; অ্যাসোসিয়েশরেন উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে সভা, বুদ্ধিবৃত্তিক আলোচনা ও বার্ষিক সম্মেলনের আয়োজন করা, সংবাদপত্র ও জনসভার মাধ্যমে মুসলমানদের সমস্যা ও অধিকার সম্বন্ধে সরকারের মনোযোগ আকর্ষণ করা প্রভৃতি। সৈয়দ আমীর আলী নিজে সংগঠনের ব্যানারে স্মারকলিপি পেশ করতেন এবং কর্তৃপক্ষের নিকট নিয়মিত প্রতিনিধিদল প্রেরণ করতেন। তাছাড়াও গভর্নর জেনারেল ও লেফটেন্যান্ট গভর্নরদের সংবর্ধনা প্রদান করতেন। অ্যাসোসিয়েশন মূলত মুসলমানদের শিক্ষা ও রাজনৈতিক উন্নয়নের জন্য কাজ করত। 

১৮৮১ সালে মুসলমানদের শিক্ষার সমস্যাবলি নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ ছিল অ্যাসোসিয়েশনের একটি উলে­খযোগ্য কাজ। আমীর আলীর নেতৃত্বে অ্যাসোসিয়েশন ১৮৮২ সালে হান্টার কমিশনের নিকট একটি লিখিত বক্তব্য পেশ করে। এ বক্তব্যে বলা হয়, মুসলমানরা ইংরেজি শিক্ষার প্রতি তাদের পূর্ব অনুসৃত ঘৃণা পরিত্যাগ করেছে এবং এখন তারা ইংরেজি শিক্ষা গ্রহণে ইচ্ছুক। কিন্ত চরম দারিদ্র্য এ পথে তাদের সবচেয়ে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। 

সৈয়দ আমীর আলী ১৮৮২ সালে অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষে ‘'A cry from the Indian Muhamedans’ শীর্ষক একটি স্মারকলিপি পেশ করেন। স্মারকলিপিতে আবেদন করা হয় যে, মুসলমানরা ব্রিটিশ সরকারের প্রতি অনুগত, কিন্তু তাদের দুরবস্থার কারণে তারা অসন্তুষ্ট। তারা চাকরির সুযোগ এবং সমাজে সম্মানজনক অবস্থান হতে বঞ্চিত। এভাবে ক্রমাগত চাপ প্রয়োগে অ্যাসোসিয়েশন একটি বড় রকমের সাফল্য অর্জনে সক্ষম হয়। ১৮৮৫ সালে সরকার মুসলিম শিক্ষার ওপর একটি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। সৈয়দ আমীর আলী এই সিদ্ধান্তকে মুসলমানদের জন্য ম্যাগনাকার্টা রূপে গণ্য করেন।

ভারতে ও ইংল্যান্ডে যুগপৎ আই.সি.এস পরীক্ষা অনুষ্ঠান এবং মনোনয়ন পদ্ধতি বলবৎ রাখার জন্য সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জীর দাবির বিরোধিতা করে সেন্ট্রাল ন্যাশনাল মোহামেডান অ্যাসোসিয়েশন। অ্যাসোসিয়েশনের দাবি ছিল ব্যাপক হারে মুসলমানদের নিয়োগ, নির্বাহি পরিষদের সম্প্রসারণ ও ভোটাধিকার নিশ্চিতকরণ। স্থানীয় পরিষদসমূহে মুসলমানদের জন্য পৃথক নির্বাচনের দাবি করা হয়েছিল। সৈয়দ আমীর আলীর নেতৃত্বে অ্যাসোসিয়েশনের আন্দোলন ফলপ্রসু হয় যখন ১৮৯২ সালে ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অ্যাক্ট পাস হয়। এই আইন বিভিন্ন স্বার্থ সংশ্লিষ্ট দলের স্বার্থ রক্ষার নিশ্চয়তা প্রদান করে।

তিনি বিভিন্ন ঐতিহাসিক গ্রন্থ রচনার মাধ্যমে মুসলমানদের ইতিহাস ও কৃষ্টিগত ঐতিহ্য তুলে ধরার চেষ্টা করেন তিনি । তার রচিত গ্রন্থগুলোর মাঝে উল্লেখযোগ্য হলো The Spirit of Islam এবং A Short History of Saracens। এছাড়া তিনি মুসলিম আইনবিষয়ক প্রচুর গ্রন্থও রচনা করেন। 

সৈয়দ আমীর আলী দেশের অর্থনৈতিক সংকটাপন্ন অবস্থা নিয়ে সোচ্চার হন। তিনি রাজস্ব আদায়ে কঠোরতার নিন্দা করেন। তিনি সুতি বস্ত্রের আমদানির উপর শুল্ক হ্রাস, আফগান যুদ্ধে ব্যয় হ্রাস এবং কর্মক্ষেত্রে দেশী কর্মচারীদের নিয়োগের ব্যাপারে শাসকগোষ্ঠীর দৃষ্টি আকর্ষণের প্রচেষ্টা চালান। তিনি জাতি ও ধর্মের ভিত্তিতে পৃথক শিক্ষা ব্যবস্থার সুপারিশ করেন। ১৯০৬ সালে মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পেছনে আমীর আলীর রাজনৈতিক সংগঠন ভূমিকা রাখে। মুসলিম লীগ গঠন হওয়ার পর সেন্ট্রাল ন্যাশনাল মোহামেডান অ্যাসোসিয়েশনের কার্যক্রমের প্রয়োজনীয়তা আর থাকে না। সংগঠনটি বিলুপ্ত হয়। সৈয়দ আমীর আলী ১৯০৮ সালে মুসলিম লীগ লন্ডন শাখার সভাপতি নির্বাচিত হন।

১২ মার্চ, ২০২০

বঙ্গকথা পর্ব-৩১ : সৈয়দ আহমদ এবং তাঁর আলিগড় আন্দোলন



আলিগড় আন্দোলনের প্রবর্তক ছিলেন স্যার সৈয়দ আহমেদ খান। পিছিয়ে পড়া মুসলমান সম্প্রদায়কে যুক্তিবাদী আধুনিক পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত করে তোলার জন্য স্যার সৈয়দ আহমেদ খান উত্তরপ্রদেশের আলিগড়ে যে আন্দোলনের সূচনা করেন তা আলিগড় আন্দোলন নামে খ্যাত। ইতোপূর্বে ওয়াহাবি ও ফরায়েজি আন্দোলন হলেও তা সাধারণ মুসলিম সমাজকে স্পর্শ করেনি। ১৮৫৭ সালের বিদ্রোহের পর অনগ্রসর মুসলিম সমাজে কিছু কিছু সংস্কারের প্রয়োজন অনুভূত হয় । হিন্দুদের তুলনায় অনগ্রসর পাশ্চাত্য শিক্ষায় উদাসীন মুসলিম সমাজের দুরবস্থার কথা সৈয়দ আহমেদ খান অবগত ছিলেন। তিনি ইংরেজি ভাষার মাধমে পাশ্চাত্য শিক্ষাকে প্রগতির যথার্থ সোপান বলে মনে করতেন, তাই তিনি মুসলমানদের মধ্যে পাশ্চাত্য শিক্ষা ও পাশ্চাত্য সংস্কৃতির প্রসারে উদ্যোগী হন ।

সৈয়দ আহমদ খান ব্রিটিশ সরকারের অধীনে উচ্চপদের চাকুরীতে নিয়োজিত ছিলেন। তিনি মনে করতেন, মুঘল সাম্রাজ্যের ধ্বংসস্তূপের উপরে ভারতে এক সুশৃংখল ব্রিটিশ শাসন সুপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে। আধুনিক জ্ঞান বিজ্ঞান ও আধুনিক যুদ্ধবিদ্যায়ও ইউরোপিয়ানরা মুসলমানদের চেয়ে বহুগুণে উন্নত। তাই এদেশ থেকে সহসা তাদেরকে উৎখাত করা সহজসাধ্য ব্যাপার নয়। বিদ্রোহ না করে রাজনৈতিকভাবে তাদের মোকাবেলা করাকেই তিনি উত্তম মনে করতেন। ইংরেজদের সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হওয়া মুসলমানদের আত্মহত্যারই শামিল হবে বলে তিনি মনে করতেন। ১৮৫৭ সালের বিদ্রোহের সকল দোষ শুধুমাত্র মুসলমানদের ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে তাদের উপর পাইকারী হারে যে অমানুষিক নিষ্পেষণ চালানো হচ্ছিল, তাতে তিনি অত্যন্ত মর্মাহত হন। তিনি তাঁর প্রসিদ্ধ পুস্তিকা ‘আসবাব-ই-বাগাওয়াতে হিন্দু’ ও ‘ভারতীয় মুসলমান’ নামক পুস্তিকার মাধ্যমে মুসলমানদের বিরুদ্ধে ব্রিটিশের কঠোর মনোভাব দূর করার চেষ্টা করেন। জ্ঞান বিজ্ঞানে মুসলমানদের পশ্চাদপদতাকেই তিনি তাদের পরাজয়ের মূল কারণ বলে উল্লেখ করেন। তাঁর বাণী ছিল –‘আগে মূলকে রোগমুক্ত কর। তাহলেই বৃক্ষ বর্ধনশীল হবে’। ১৮৬৫ সালে তিনি আলীপুরের গাজীপুরে একটি অনুবাদ সমিতি প্রতিষ্ঠিত করেন। এ সমিতির মাধ্যমে বহু বিদেশী গ্রন্থ অনূদিত হয়ে প্রকাশিত হয়।

তিনি মুসলমানদের মন থেকে পাশ্চাত্যের ভয় ভীতি দূর করার জন্য ও মুসলমানদের মধ্যে উদারনৈতিক ভাবধারা প্রচারের জন্য ‘তাহজিব-উল-আখলার্ক’ নামে একটি পত্রিকা প্রকাশ করেন । সেই সঙ্গে কমিটি ফর অ্যাডভান্সমেন্ট অফ লার্নিং নামে একটি সংস্থারও তিনি প্রতিষ্ঠা করেন। অক্সফোর্ড ও কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুকরণে ১৮৭৫ খ্রিস্টাব্দে মে মাসে আলিগড়ে তিনি মহামেডান অ্যাংলো ওরিয়েন্টাল কলেজ [Muhammedan Anglo-Oriental College] -এর প্রতিষ্ঠা করেন । এই কলেজটিই পরে আলিগড় বিশ্ববিদ্যালয় [Aligarh Muslim University] নামে পরিচিত হয়। ইংরেজ শিক্ষাবিদগণের তত্ত্বাবধানে এই কলেজে কলা ও বিজ্ঞান শিক্ষার ব্যবস্থা করা হয়। মুসলমান ছাত্রদের মধ্যে পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসার ও প্রগতিমূলক মনোভাবের উন্মেষ ঘটানোর ক্ষেত্রে এই কলেজের অবদান অস্বীকার করা যায় না। তৎকালে সরকারী ইংরেজী বিদ্যালয়গুলিতে ধর্মীয় শিক্ষার ব্যবস্থা না থাকায় মুসলমানরা সেখানে তাদের সন্তানকে পাঠাতে সংকোচ বোধ করতো। আধুনিক শিক্ষালাভের পথ থেকে সে প্রতিবন্ধকতা দূর করা হয় আলীগড় কলেজের মাধ্যমে।

এ কলেজ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে স্যার সৈয়দ আহমদ মুসলিম সমাজ সংস্কার ও শিক্ষা বিস্তারের যে আন্দোলন গড়ে তোলেন তা আলীগড় আন্দোলন’ নামে খ্যাতি লাভ করে। এ মুসলিম রেনেসাঁ আন্দোলনে কবি হালী, মুহসিনুল মুলক, নাজির আহমদ, চেরাগ আলী প্রমুখ মনীষীবৃন্দ যোগদান করে আন্দোলনের অগ্রগতি সাধিত করেন।

রাজনৈতিক ক্ষেত্রে আলিগড় আন্দোলনের ফলাফল ছিল সুদূরপ্রসারী। আলিগড় আন্দোলন মুসলমানদের মধ্যে রাজনৈতিক চেতনার উন্মেষ ঘটাতে সাহায্য করে। মুসলিমরা তাদের অধিকার আদায়ে সচেতন ও সচেষ্ট হয়। এই আন্দোলনের ধারাবাহিকতাই মুসলিমদের আলাদা রাষ্ট্রের কথা ভাবতে শেখায়। 

মুসলিম স্বার্থের রক্ষাকবচ হিসাবে স্বায়ত্তশাসনমূলক প্রতিষ্ঠানগুলিতে স্যার সৈয়দ আহমদ মুসলমানদের জন্যে পৃথক সরকারী মনোনয়নপ্রথার দাবী জানান। তিনি বলেন এসব প্রতিষ্ঠানে সাধারণ যুক্ত নির্বাচন প্রথা প্রবর্তিত হলে মুসলমানদের স্বার্থে পদদলিত হবে। ১৮৮৩ সালের ১২ই জানুয়ারী গভর্নর জেনারেলের কাউন্সিলের নিকটে মুসলমানদেরন জন্যে পৃথক নমিনেশন প্রথার সমর্থনে তিনি বলেনঃ “সাধারণ যুক্ত নির্বাচন প্রথার দ্বারা শুধুমাত্র সংখ্যাগরিষ্ঠের মত ও স্বার্থের প্রতিনিধিত্ব করা হয়। যে দেশে শুধুমাত্র একজাতি ও এক ধর্মের লোক বাস করে সেখানে এ প্রথা গ্রহণযোগ্য। কিন্তু ভারতে বিভিন্ন জাতির বাস, কেউ সংখ্যাগরিষ্ঠ, কেউ সংখ্যালঘু এবং তাদের মধ্যে জাতিভেদ ও ধর্মভেদ বিদ্যমান। এমতাবস্থায় যুক্ত নির্বাচন প্রবর্তন করলে কুফল দেখা দিতে বাধ্য। এ প্রথা প্রবর্তন করলে সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুদের দ্বারা সংখ্যালঘুদের স্বার্থ পদদলিত হবে। তাতে জাতি বিদ্বেষ ও ধর্ম বিদ্বেষ প্রবল আকার ধারণ করবে। এর জন্যে সরকারকেই দায়ী হতে হবে”।

তার এ যুক্তিপূর্ণ প্রস্তাব মুসলিম সমাজের জন্যে এক চিন্তার দ্বার উন্মুক্ত করে এবং তার এ প্রস্তাব কার্যকর হয় ছাব্বিশ বছর পর। ১৯০৬ সালের ১লা অক্টোবর আগা খানের নেতৃত্বে ভারতের বিশিষ্ট ৩৬ জন মুসলমানের একটি প্রতিনিধিদল ভারতের গভর্নর জেনারেল লর্ড মিন্টের কাছে পৃথক নির্বাচন প্রথার দাবীতে একটি স্মারকলিপি পেশ করে। ১৯০৯ সালের মর্লি-মিন্টো সংস্কারে এ দাবী স্বীকৃতি লাভ করে। এতে করে ভারতের সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু সমাজ ক্ষিপ্ত হ’য়ে উঠে। কারণ ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের বিঘোষিত নীতি ছিল একজাতীয়তাবাদ। এই নিয়ে বহু বৎসর ধরে হিন্দু মুসলমানের মধ্যে বাকবিতন্ডা ও তিক্ততা চলে। 

অবশেষে ১৯১৬ সালে লক্ষ্ণৌ শহরে কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের বার্ষিক অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়। আলোচনা শেষে উভয় প্রতিষ্ঠানের যথারীতি ক্ষমতাপ্রাপ্ত প্রতিনিধিগণ তাঁদের সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে একটি চুক্তিপত্রে স্বাক্ষর করেন। এটাই ঐতিহাসিক লক্ষ্ণৌ চুক্তি নামে অভিহিত। চুক্তিটি কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ কর্তৃক আনুষ্ঠানিকভাবে অনুমোদিত হয়। লক্ষ্ণৌ চুক্তিতে আইন পরিষদের সদস্য নির্বাচনে মুসলমানদের স্বতন্ত্র নির্বাচনাধিকার স্বীকৃতি লাভ করে। এভাবে হিন্দু কংগ্রেস ভারতে একজাতীয়তার পরিবর্তে দ্বিজাতিত্ব স্বীকার করে নেয়, যা ছিল ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার মূল ভিত্তি।

সৈয়দ আহমদের প্রতিটি নীতি ও কথায় একমত হওয়া কঠিন। তবে তিনি তাঁর তীক্ষ্ণ রাজনৈতিক দূরদৃষ্টির দ্বারা ভারতীয় মুসলমানদেরকে কংগ্রেসে যোগাদান করতে নিষেধ করেছেন এবং  এই বলে সাবধান করে দিয়েছিলেন যে, কংগ্রেস শুধুমাত্র ভারতের হিন্দু স্বার্থেরই প্রতিনিধিত্ব করবে এবং মুসলমানদের স্বার্থ হবে উপেক্ষিত। এ সত্যটি প্রথমে মাওলানা মুহাম্মদ আলী ও মুহাম্মদ আলী জিন্নাহরা মতো ঝানু রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বরা উপলব্ধি করতে না পারলেও সৈয়দের সাবধানবাণীর সত্যতা তাঁদের কাছে পরবর্তীকালে দিবালোকের ন্যায় সুস্পষ্ট হয়িছিল। যার ফলে মুসলমানদের মধ্যে স্বতন্ত্র জাতীয়তার প্রেরণা জাগ্রত হয় এবং মুসলিম নেতারা এ পথেই অগ্রসর হয়। তাই বলতে হয়, ভারতীয় মুসলমাদের স্বতন্ত্র জাতি হিসাবে বেঁচে থাকার মূলমন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে আলীগড় আন্দোলন এবং স্যার সৈয়দ আহমদের হাত ধরেই।

বঙ্গকথা পর্ব-৩০ : আব্দুল লতিফ ও মুসলিমদের রাজনৈতিক উত্থান


বাঙালি মুসলিমরা ইংরেজ শাসনের শুরু থেকে তাদের মেনে নেয়নি। একের পর এক বিদ্রোহ করেছে। সর্বশেষ ১৮৫৭ সালের স্বাধীনতাযুদ্ধের পর এদেশের মুসলিমদের অনেকেই উপলব্ধি করেন সশস্ত্র আন্দোলন/ বিদ্রোহ করে ইংরেজ দুঃশাসন ঠেকানো কঠিন হয়ে যাচ্ছে। তাই মুসলিমদের বাঁচতে হলে এখন রাজনৈতিক আন্দোলন করা জরুরী। এমন ধারণা থেকে সিপাহী বিদ্রোহের ছয় বছর পর ১৮৬৩ সালের ২ এপ্রিল নওয়াব আব্দুল লতিফ কোলকাতায় প্রতিষ্ঠা করলেন ‘মোহামেডান লিটারারি সোসাইটি’। সশস্ত্র সংগ্রামোত্তর মুসলিম জাতীয় জীবনে এ ধরনের সংস্থা, সমিতি গঠন এই প্রথম। সমিতির প্রথম বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় কোলকাতার নওয়াব আব্দুল লতিফের ১৬নং তালতলা লেনস্থ বাড়িতে ২রা এপ্রিল তারিখে।

নওয়াব আব্দুল লতিফ উনিশ শতকের বাংলার মুসলিম জাগরণের অগ্রদূত ও সমাজসেবক। জন্ম ১৮২৮ সালে ফরিদপুর জেলার রাজাপুর গ্রামে। তাঁর পিতা ফকির মাহমুদ ছিলেন কলকাতার সদর দেওয়ানী আদালতের আইনজীবী। আবদুল লতিফ কলকাতা মাদ্রাসা থেকে আরবি, ফারসি ও ইংরেজি ভাষায় সর্বোচ্চ ডিগ্রি লাভ করেন।

আবদুল লতিফ ১৮৪৬ সালে ঢাকা কলেজিয়েট স্কুল এর শিক্ষক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। ১৮৪৮ সালে তিনি কলকাতা আলিয়া মাদ্রাসায় আরবি ও ইংরেজির শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। তিনি ১৮৪৯ সালে ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে সরকারি চাকরিতে যোগ দেন। ১৮৭৭ সালে তিনি প্রেসিডেন্সি ম্যাজিস্ট্রেট পদে উন্নীত হন।

আবদুল লতিফ সাতক্ষীরায় ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে কর্মরত অবস্থায় সেখানকার কৃষকদের ওপর ইংরেজ নীলকরদের নির্যাতন ও শোষণ প্রত্যক্ষ করেন। তিনি সেখানকার ঐক্যবদ্ধ হতে এবং তাদের অভিযোগের কথা সরকারকে অবহিত করতে উৎসাহ দেন। তিনি নিজেও এ ব্যাপারে উদ্যোগ নেন। অবশেষে তাঁর উদ্যোগেই নীলকরদের অত্যাচার বন্ধ করার লক্ষ্যে ১৮৬০ সালে ইংরেজ সরকার নীল কমিশন গঠন করে।

১৮৬২ সালে লর্ড ক্যানিং-এর শাসনামলে বঙ্গীয় ব্যবস্থাপক সভা গঠিত হলে আবদুল লতিফ এ সভার সদস্য মনোনীত হন। ১৮৬৩ সালে আবদুল লতিফ সিভিল ও মিলিটারি সার্ভিস সমূহের পরীক্ষক বোর্ডের সদস্য এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফেলো নিযুক্ত হন। ১৮৬৫ সালে কলকাতা মিউনিসিপ্যাল কর্পোরেশন গঠিত হলে তিনি এর ‘জাস্টিস অব দি পিস’ নিযুক্ত হন এবং ১৮৭৫ সাল পর্যন্ত উক্ত পদে বহাল থাকেন। ১৮৬৫ সালে ভারতীয় ব্যবস্থাপক পরিষদে আনীত একটি প্রস্তাবে মুসলিম সমাজে তীব্র ক্ষোভ দেখা দিলে আবদুল লতিফ একটি স্মারকলিপির মাধ্যমে ইংরেজ সরকারকে এ বিল সংশোধনের পক্ষে যুক্তি প্রদান করেন।

বাংলার মুসলিমদের মধ্যে আধুনিক শিক্ষা বিস্তারে আবদুল লতিফের অবদান বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তিনি প্রথম উপলব্ধি করেন যে, যুগের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে ব্যর্থ হচ্ছে মুসলিমরা। ইংরেজি শিক্ষা বর্জন এবং সরকারের সঙ্গে অসহযোগ নীতির কারণে মুসলমান জাতি সবক্ষেত্রে পিছিয়ে আছে। তিনি মুসলিমদের শিক্ষা ও বৈষয়িক উন্নতিকল্পে নানা উদ্যোগ গ্রহণ করেন। 

প্রথমত, ব্রিটিশদের নতুন শাসন পদ্ধতির সুফল ভোগ করার জন্য মুসলিমদেরকে প্রস্তুত করা। 

দ্বিতীয়ত, উপনিবেশিক সরকারের প্রতি তাদের মধ্যে আনুগত্যের ভাব সৃষ্টি করা এবং এভাবে মুসলিমদের প্রতি ইংরেজদের সন্দেহ ও অবিশ্বাস দূর করা। 

তিনি বিশ্বাস করতেন যে, শিক্ষিত মুসলিমগণ সরকারের উদ্দেশ্য, শক্তি ও কৌশল বুঝতে পারলে তাদের মধ্যে উপনিবেশিক সরকারের প্রতি আনুগত্যের মনোভাব সৃষ্টি হবে। এ লক্ষ্য অর্জনের জন্য তিনি, শাসক শ্রেণির সঙ্গে যে কোনো ধরনের সংঘর্ষ পরিহার করার পক্ষপাতি ছিলেন।

১৮৫৩ সালে ‘কলকাতা আলিয়া মাদ্রাসার’ সমস্যাদি তদন্তের জন্য সরকার এফ. হেলিডের সভাপতিত্বে উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে। আবদুল লতিফ এ তদন্ত কমিটি ও যথাযথ কর্তৃপক্ষের নিকট মাদ্রাসার উন্নতির জন্য দাবি জানান। তার সক্রিয় প্রচেষ্টায় ১৮৫৪ সালে কলকাতা আলিয়া মাদ্রাসায় ইংরেজি ও ফারসি বিভাগ খোলা হয় এবং উর্দু ও বাংলা শিক্ষার ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। আবদুল লতিফ বরাবরই সরকারের নিকট মুসলিমদের জন্য ইংরেজি উচ্চ শিক্ষা ব্যবস্থার দাবি জানিয়ে আসছিলেন। ফলে ১৮৫৪ সালে হিন্দু কলেজ প্রেসিডেন্সি কলেজে রূপান্তরিত করে সকল সম্প্রদায়ের ছাত্রদেরকে এ কলেজে পড়ার সুযোগ দেয়া হয়।

ব্রিটিশ সরকার সন্দেহ করে যে, ১৮৫৭ সালের সিপাহি বিদ্রোহ কলকাতা আলিয়া মাদ্রাসার ছাত্ররা জড়িত ছিল। এ কারণে বাংলার লেফটেন্যান্ট গভর্নর স্যার এফ. হেলিডে মাদ্রাসাটিকে একেবারে বন্ধ করে দেয়ার জন্য সুপারিশ করেন। ১৮৬৭ সালে ব্রিটিশ সরকার আরও একবার কলকাতা মাদ্রাসা বন্ধ করে দেয়ার প্রস্তাব করে। কিন্তু আবদুল লতিফের তৎপরতায় দুবারই মাদ্রাসাটি রক্ষা পায়। ১৮৭১ সালে মাদ্রাসার কার্যনির্বাহী কমিটি গঠিত হলে আবদুল লতিফ এর অবৈতনিক সচিব নির্বাচিত হন।

আবদুল লতিফ হুগলি কলেজ ও স্কুলে মুসলিম ছাত্রদের সুযোগ সুবিধা প্রদানের ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। মোহসিন ফান্ডের টাকায় এ প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠিত হলেও প্রতিষ্ঠানটি কার্যত হিন্দু ছাত্রদের প্রতিষ্ঠানেই পরিণত হয়েছিল। এ সময়ে এ প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি মুসলিমদের জন্য একটি মাদ্রাসা চালু থাকলেও এর ব্যবস্থাপনায় অনেক অনিয়ম চলছিল। ছোটলাট জে.পি. গ্রান্ট-এর নির্দেশে আবদুল লতিফ মাদ্রাসা সম্পর্কে বিচার বিশ্লেষণ করে ১৮৬১ সালে একটি প্রতিবেদন তৈরি করেন। মূলত এটি ছিল হুগলি মাদ্রাসা সম্পর্কে একটি প্রতিবেদন। এর ওপর ভিত্তি করেই হুগলি মাদ্রাসায় ঈঙ্গ-ফারসি বিভাগ খোলা হয় এবং ছাত্রদের জন্য বৃত্তি প্রদানের ঘোষণা দেয়া হয়। ইতোমধ্যে আবদুল লতিফ কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করে দাবি জানান যে, দাতার ইচ্ছানুযায়ী মোহসিন ফান্ডের টাকা কেবল মুসলিমদের জন্য ব্যয় করা হোক। তিনি এ ব্যাপারে দীর্ঘদিন প্রচেষ্টা চালিয়ে যান। অবশেষে ১৮৭৩ সালে হুগলি কলেজ একটি সরকারি কলেজে রূপান্তরিত হয় এবং মোহসিন ফান্ডের টাকা শুধু মুসলিমদের শিক্ষার জন্য ব্যয় করার ব্যবস্থা করা হয়।

আবদুল লতিফের প্রচেষ্টায় ১৮৭৪ সালে মুসলিম ছাত্রদের শিক্ষার জন্য ঢাকা, চট্টগ্রাম ও রাজশাহীতে মাদ্রাসা স্থাপিত হয়। তিনি দরিদ্র ও মেধাবী মুসলিম ছাত্রদের পড়াশুনার জন্য নানাভাবে প্রচেষ্টা চালান এবং বিত্তশালী মুসলিমদের কাছ থেকে অর্থ সংগ্রহ করে একটি তহবিল সৃষ্টি করেন। বাংলার মুসলিমদের মধ্যে পাশ্চাত্য শিক্ষা বিস্তারের মাধ্যমে মুসলিমদের প্রভাব বিস্তার এবং পুনর্জাগরণের লক্ষ্যে ১৮৬৩ সালের এপ্রিল মাসে কলকাতায় ‘মুসলিম সাহিত্য সমিতি’ (Mohammedan Literary Society of Calcutta) গঠন ছিল আবদুল লতিফের জীবনের একটি উল্লেখযোগ্য প্রচেষ্টা। তিনি মুসলিমদের মধ্যে আধুনিক পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসার ও সমকালীন চিন্তা ধারার অনুকূলে জনমত এবং শিক্ষিত মুসলিম, হিন্দু ও ইংরেজদের মধ্যে পারস্পরিক সম্প্রীতির মনোভাব গড়ে তোলার লক্ষ্যে এ সমিতি গঠন করেন। এটি ছিল ভারতে মুসলিমদের সর্বপ্রথম সমিতি। এই সমিতির কর্মতৎপরতার মাধ্যমেই ভারতে মুসলিমগণ প্রথম স্বনামে একটি সংঘবদ্ধ প্রচেষ্টা চালাতে শুরু করে। তাছাড়াও এর মাধ্যমে বিভিন্ন সময়ে সভা, বক্তৃতা ও আলোচনা সভার আয়োজন করে মুসলিমদেরকে পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রতি আকৃষ্ট করে তোলা হতে থাকে।

মোহামেডান লিটারেরি সোসাইটির ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি ছিলেন মহীশূরের প্রিন্স মুহম্মদ রহিমুদ্দীন এবং সহ-সভাপতি ছিলেন অযোধ্যার প্রিন্স মির্জা জাহান কাদের বাহাদুর ও মহীশূরের প্রিন্স মুহম্মদ নাসিরুদ্দীন হায়দার। কমিটির মোট ১২ জন সদস্যের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন অযোধ্যার প্রিন্স মির্জা আসমান জাহ বাহাদুর ও প্রিন্স মুহম্মদ জাহ আলী বাহাদুর এবং মহীশূরের প্রিন্স মুহম্মদ হরমুজ শাহ ও প্রিন্স মুহম্মদ বখতিয়ার শাহ। বাংলার ছোটলাটকে সোসাইটির পৃষ্ঠপোষক করা হয়েছিল। সমগ্র ভারতবর্ষের পাঁচ শতেরও বেশি মুসলমান সোসাইটির সাধারণ সদস্যভুক্ত ছিল। সোসাইটির মাসিক সভার কার্যক্রম উর্দু, ফারসি, আরবি ও ইংরেজি ভাষায় পরিচালিত হতো।

আবদুল লতিফ এর ভাষায় ‘মুসলমানদের ইংরেজি ভাষার মাধ্যমে আধুনিক পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত করা এবং সামাজিক আচরণ ও আদান-প্রদানে শিক্ষিত হিন্দু ও ইংরেজদের সমকক্ষ করে তোলাই ছিল সোসাইটি প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য। এ উদ্দেশ্যে তিনি বিজ্ঞান, কলা ও চলমান সমস্যা সংক্রান্ত এবং মুসলমানদের মধ্যে শিক্ষার প্রসারের উপায় উদ্ভাবনের জন্য আলোচনা সভার আয়োজন করেন। সোসাইটি মুসলমানদের ক্ষয়িষ্ণু আত্মবিশ্বাস ফিরিয়ে আনা, আধুনিক শিক্ষা প্রবর্তন ও বুদ্ধিবৃত্তিক আলোচনার দ্বারা সমাজ উন্নয়নের নতুন ধারার প্রবর্তনা এবং এভাবে শাসক ও শাসিতের মধ্যে এক নির্ভরশীল সেতু স্থাপনের উদ্যোগ গ্রহণ করে। মুসলমানদের এই ধরনের সর্বপ্রথম সংগঠন হিসেবে মোহামেডান লিটারেরি সোসাইটি কালক্রমে মুসলমানদের প্রভূত কল্যাণ সাধন করে।

মোহামেডান লিটারেরি সোসাইটির প্রথম সভা কলকাতার ১৬নং তালতলায় অনুষ্ঠিত হয়। মৌলভী মুহম্মদ ওয়াজির এ সভায় সভাপতিত্ব করেন। বিভিন্ন বিষয় ও সমস্যা সম্পর্কে মতবিনিময়ই ছিল এ ধরনের নিয়মিত সভার প্রধান বৈশিষ্ট্য। বছরে একবার কলকাতা টাউন হলে সোসাইটির সদস্যদের পান্ডিত্যপূর্ণ সান্ধ্য আলোচনাসভা অনুষ্ঠিত হতো। কলকাতা শহরের দেশী-বিদেশী প্রখ্যাত বৈজ্ঞানিক ও জ্ঞানী-গুণীরা এই অনুষ্ঠানে আকর্ষণীয় বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা প্রদর্শন করতেন। ১৮৬৫ সালে কলকাতা টাউন হলে সোসাইটির এক জনাকীর্ণ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। বাংলার ছোটলাট এই সভায় প্রধান অতিথি ছিলেন। মুসলমান, হিন্দু, খ্রিস্টান ও ইহুদীদের মধ্য থেকে প্রায় দুই হাজার প্রতিনিধি এই সমাবেশে অংশ গ্রহণ করেন। মোহামেডান লিটারেরি সোসাইটি এভাবে প্রখ্যাত পন্ডিত ও জ্ঞানী-গুণীদের মিলন কেন্দ্রে পরিণত হয়। মোহামেডান লিটারেরি সোসাইটির বিভিন্ন সভায় ইন্দোরের মহারাজা, ভূপালের বেগম এবং জয়পুর, পাতিয়ালা ও কুচবিহারের রাজারা সম্মানিত অতিথি হিসেবে অংশগ্রহণ করেন।

মোহামেডান লিটারারি সোসাইটি বিরাট এক দুঃসময়ে মুসলিম জাতি-স্বার্থকে আলাদাভাবে চিহ্নিত করার ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করে। ভারতীয় স্বার্থের সাইনবোর্ডে হিন্দুরা যখন সব অধিকার একাই কুক্ষিগত করছিল, তখন মোহামেডান লিটারারি সোসাইটি প্রথমবারের মতো মুসলিম স্বার্থের প্রয়োজন আলাদাভাবে তুলে ধরে। মোহসীন ফান্ডের টাকা লুটেপুটে খাওয়া হচ্ছিল। যাদের জন্যে এই টাকা এবং যাদের জন্যে এটা বেশি প্রয়োজন, সেই মুসলমানরা মোহসীন ফান্ডের টাকা পাচ্ছিল না। নওয়াব আব্দুল লতিফ তাঁর অক্লান্ত চেষ্টা দ্বারা বাংলার গভর্নর স্যার ক্যাম্পবলকে বুঝাতে সক্ষম হলেন যে, মোহসীন ফান্ডের টাকা দাতার ইচ্ছানুযায়ী ব্যবহৃত হচ্ছে না। ফলস্বরূপ বাংলার বৃটিশ প্রশাসন ১৮৭৩ সালের ২৯ জুলাই গৃহীত এক প্রস্তাব অনুসারে মোহসীন ফান্ডের টাকা শুধু মুসলমানদের জন্যে ব্যয় করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। তখন থেকে হুগলী কলেজ সরকারি হয়ে গেল এবং মোহসীন ফান্ডের টাকা মুসলমানদের শিক্ষার কাজে নিয়োজিত হয়। এই টাকায় হুগলী ও কোলকাতা মাদরাসার উন্নতি, ঢাকা, চট্টগ্রাম ও রাজশাহীতে মাদরাসা স্থাপন এবং মুসলিম ছাত্রদের জন্যে বৃত্তির ব্যবস্থা করা হলো। সরকার ৯টি জিলা স্কুলে আরবী ও ফার্সির শিক্ষক রাখার নির্দেশ দিলেন। এত বড় কাজ সম্ভব হয়েছিল বৃটিশ প্রশাসনের সাথে নওয়াব আব্দুল লতিফের সুসম্পর্কের ফলেই। উল্লেখ্য, মোহামেডান লিটারারি সোসাইটির দ্বিতীয় আলোচনা সভাতেই নওয়াব আব্দুল লতিফ গভর্নর জেনারেল স্যার লরেন্সকে প্রধান অতিথি করে আনতে সমর্থ হন। এ আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়েছিল ১৮৬৬ সালের ৬ মার্চ।

মোহামেডান লিটারারি সোসাইটির মাধ্যমে নওয়াব আব্দুল লতিফের চেষ্টায় জাতি হিসেবে মুসলমানরা ঊনিশ শতকের সত্তরের দশকেই আরও কিছু সুবিধা অর্জনে সমর্থ হলো। ১৮৭১ সালের ৭ আগস্ট ভারতের বৃটিশ সরকার প্রাদেশিক সরকারগুলোকে নির্দেশ দিল যে, 

(ক) সকল সরকারি বিদ্যালয় ও কলেজে মুসলমানদের ধর্মীয় ও মাতৃভাষা শিখবার উৎসাহ দিতে হবে, 

(খ) মুসলিম অধ্যুষিত জিলাসমূহে স্থাপিত ইংরেজি বিদ্যালয়গুলোতে অধিকতর যোগ্য মুসলমান ইংরেজি শিক্ষক নিয়োগ করতে হবে, 

(গ) নিজেদের মাতৃভাষা শিক্ষায় বিদ্যালয় ও ইংরেজি বিদ্যালয় স্থাপনের জন্য মুসলমানদের অধিকতর অর্থ সাহায্য দিতে হবে, 

(ঘ) নিজেদের মাতৃভাষায় সাহিত্য রচনার জন্যে মুসলমানদের অধিকতর উৎসাহ দিতে হবে।’

আজকের বিচারে এই পাওয়াগুলো হয়তো খুব বড় নয় কিংবা এর অন্য রাজনৈতিক ব্যাখ্যাও হতে পারে। যখন বৃষ্টিশ শাসন বিদ্রোহী জাতি মুসলমানদের পিষে ফেলতে ব্যস্ত এবং হিন্দুরা যখন জাতি হিসেবে মুসলমানদের স্বতন্ত্র অস্তিত্ব মুছে ফেলতে মরিয়া, তখনকার সেই ঘোর অমানিশার দিনগুলোতে জাতি হিসেবে মুসলমানদের এই আলাদা প্রাপ্তি মোটেই ছোট ঘটনা ছিল না। এই সিদ্ধান্তগুলোর মাধ্যমে অন্তত শিক্ষা ক্ষেত্রে মুসলমানদের আলাদা জাতীয় স্বীকৃতি ও স্বার্থ চিহ্নিত হয়েছিল। মুসলিম জাতির রাজনৈতিক ও সামাজিক অগ্রগতির জন্য লিটারেরি সোসাইটি ছিলো প্রথম কার্যকর ধাপ।

৫ মার্চ, ২০২০

আমেরিকা - তালেবানের চুক্তি ও কিছু কথা



আমেরিকা ও তালেবানের সাথে চুক্তি হয়েছে দীর্ঘদিন আলোচনার ইতি টেনে। তালেবান নিয়ে আমার আলাদা দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে যারা আমার আগের লেখাগুলো পড়েছেন তারা তা জানেন। সে দৃষ্টিভঙ্গি থেকে আমার আরো আগেই এই চুক্তি বিষয়ে লিখা উচিত ছিল, কিন্তু পারিবারিক ব্যস্ততা আমাকে সে সুযোগ দেয়নি।  

যাই হোক, আমেরিকান ও তালেবানরা যে চুক্তি স্বাক্ষর করলো, সেটার মাধ্যমে গেরিলা গ্রুপ ও কাবুল সরকারসহ অন্যান্য আফগান গ্রুপের মধ্যে আলোচনার দরজা খুলে গেলো বলে অনেকে মনে করছেন। যদিও আমি এখানে আশার কিছু দেখছি না।  

চুক্তিতে যা পাওয়া গেছে...  
১. ধারাবাহিক মার্কিন সেনা প্রত্যাহার শুরু হবে। এই মুহূর্তে আফগানিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় ১২ হাজার সেনা রয়েছে। তাদের সাথে রয়েছে ন্যাটো মিত্র বাহিনীর আরও কয়েক হাজার সেনা। আগামী পাঁচ মাসে ৫০০০ সেনা প্রত্যাহার হবে।  
২. এই ১৫ মাস আমেরিকান সেনারা আফগানিস্তানের বর্তমান সরকারকে নিরাপত্তা দিবে। 

৩. তালেবানরা আল কায়েদা ও অন্যান্য সন্ত্রাসী গ্রুপগুলোকে আফগান ভূমি ব্যবহার করে যুক্তরাষ্ট্র বা তার মিত্রদের বিরুদ্ধে কোন হামলা পরিচালনা করতে দেবে না। 

৪. যুক্তরাষ্ট্র এবং তালেবানরা কাতারে একটি যৌথ পর্যালোচনা কমিটি গঠন করবে, এবং এই কমিটি চুক্তির বিভিন্ন অগ্রগতি পর্যালোচনা করবে।  

৫. আগামী ১৪ মাসের মধ্যে আফগানিস্তানের সরকার, বিভিন্ন আফগান পক্ষ, এবং  তালেবানদের সাথে ক্ষমতা  কিভাবে শেয়ার করবে সেই ব্যাপারে একটা চূড়ান্ত চুক্তিতে আসবে সকল পক্ষ মিলে। এই ব্যাপারে আগামী ১০ দিনের মধ্যেই সকল পক্ষ আলোচনা শুরু করবে।

৬. আফগান সরকারের কাছে থাকা ৫ হাজার তালেবান বন্দি আছে তাদের মুক্তি দিতে যুক্তরাষ্ট্র চেষ্টা করবে, সেই সাথে তালেবানেরা মুক্তি দিবে তাদের হাতে আটক ১ হাজার আফগান বন্দিকে।  

তালেবানের সাবেক প্রধান মোল্লা ওমরের সহপ্রতিষ্ঠাতা ছিলেন আবদুল গনি। ২০১০-এর ফেব্রুয়ারিতে আটক হয়েছিলেন পাকিস্তানের করাচিতে। আট বছর পর ছেড়ে দেওয়া হয় সিআইএর অনুরোধে। এখন তার সাথেই চুক্তি করেছে যুক্তরাষ্ট্র। চুক্তির কথাগুলো সবই পরস্পর সম্পর্কিত ও শর্তসাপেক্ষ। 

পর্যালোচনা 
চুক্তির ভাষা থেকে যা বুঝা যায় তা হলো বর্তমান সমঝোতা কেবল একটা সম্ভাব্য শান্তিচুক্তির প্রাথমিক শর্ত মাত্র। এটা কোনো শান্তিচুক্তি নয়। বরং চুক্তির একটি ধাপ মাত্র। এই চুক্তির মধ্য দিয়ে দেশটি থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সৈনিকেরা তাৎক্ষণিকভাবে চলে যাবে না। তালেবানও এখনই তাদের হারানো ‘ইসলামিক আমিরাত অব আফগানিস্তান’ আবার গড়তে পারছে না। দুটিই অনেক সময়সাপেক্ষ বিষয় হবে। এমনকি চুক্তিতে বারবার বলা হয়েছে, তালেবানের ‘ইসলামিক আমিরাতকে’ যুক্তরাষ্ট্র কোনো বৈধ সরকার বলে স্বীকারও করছে না।

তালেবান আর আমেরিকার এই ধরনের শান্তি চুক্তি অথবা চুক্তির নামে নাটক নতুন কিছু নয়, সময় সময়ে তারা তাদের দ্বিপাক্ষিক প্রয়োজনে তারা এমন চুক্তির মহড়া দিয়ে থাকে। প্রেসিডেন্ট হামিদ কারজাই ২০০৭-এ তালেবানের দিকে আলোচনার হাত বাড়িয়েছিলেন সর্বপ্রথম। আফগান থেকে মার্কিন সৈন্যদের যাওয়ার প্রধান ব্যাপার হলো আফগানে শান্তি আসা। আর সেই শান্তি প্রতিষ্ঠা করার জন্য কাজ করতে হবে আফগানদের। এই শান্তির পক্ষে সবচেয়ে বড় বাধা হলো তালেবান আর মার্কিনীরা। শান্তি প্রতিষ্ঠা হলো মার্কিনীদের জন্য সবচেয়ে খারাপ খবর। তাই অশান্তি জিইয়ে রাখতে তাদের নিরঙ্কুশ সহযোগিতা করে যাচ্ছে তালেবানরা। কিন্তু মার্কিনীরা এমন ভাব নেয় যেন তাদের কোনো দোষ নেই। তারা শান্তির জন্য আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছে কিন্তু আফগানেরা শান্তি প্রতিষ্ঠায় ব্যর্থ হচ্ছে। 

এই শান্তি প্রক্রিয়ার সবচেয়ে কার্যকর কাজ করেছিলেন সাবেক প্রেসিডেন্ট শহীদ বুরহান উদ্দিন রব্বানী। ওবামা চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য ফেইক সদিচ্ছা প্রমাণ করতে দুই হাজার সেনা তৎক্ষণাৎ প্রত্যাহার করেছে। কিন্তু তালেবানকে দিয়ে আবার প্রেসিডেন্ট রব্বানীকে খুন করিয়ে আরো বাড়তি সেনা প্রেরণ করে। 

এ চুক্তিতে সবচেয়ে খুশি দেখা যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এবং সাধারণ আফগানরা। উভয়ের খুশির কারণ অবশ্যই এক নয়। ট্রাম্পের সামনে নির্বাচন। সেখানে সে জাতিকে দেখাবে আমি যুদ্ধ বন্ধ করতে সক্ষম হয়েছি। যে কারণে যুদ্ধ হয়েছে আমি সেই কারণ জয় করেছি। যুদ্ধ শুরু হয়েছে আল কায়েদাকে হোস্ট করার জন্য আজ আর সেই কারণ নেই। আজ তালেবান স্বীকার করে নিয়ে আল কায়েদা সন্ত্রাসী এবং তারা আল কায়েদাকে হোস্ট করবে না। কিছু সেনা প্রত্যাহার হবে। আর সেই প্রত্যাহার ট্রাম্পের নির্বাচনের একটি ভালো প্রচারণা হবে। আফগানিস্তানের শান্তির চেয়েও ট্রাম্পের জন্য জরুরি ছিল এই চুক্তিটি। যুক্তরাষ্ট্রের জনগণ যুদ্ধ চায় না। তারা যুদ্ধের ব্যয়ভার বহন করতে করতে ক্লান্ত।  

এই চুক্তিতে বড় লাভ যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটোর। চুক্তির পরই ন্যাটো সৈন্যদের আফগানিস্তান ছাড়তে হচ্ছে না। তালেবানকে এখন তারা বর্তমান আফগান সরকারের দিকে ঠেলে দিলো। ফলে ভবিষ্যতের যেকোনো সহিংসতার দায় ওয়াশিংটন ওই দুই পক্ষের ওপর বর্তাতে পারবে। এবং তাই হবে। 

এই চুক্তিতে শান্তি আসার খুব একটা সম্ভাবনা নেই কারণ তালেবানরা আফগানের একমাত্র পক্ষ তো নয়ই বরং ছোট পক্ষ। এরা পশতুনদের একটা গ্রুপ। পশতুনদের আরো একটি গ্রুপ হলো হিজবে ইসলাম। এর বাইরে আছে তাজিক, হাজারা ও উজবেক জনগোষ্ঠী। এসব গোষ্ঠীর মধ্যে তালেবানের সাপোর্ট নেই। পশতুনদের মধ্যে যারা দেওবন্দের অনুসারী তারাই কেবল তালেবানের সমর্থক।  

আফগানিস্তানের ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে দেশটিতে শান্তি আনতে চাইলে আফগানিস্তানের পাঁচ প্রতিবেশীকেও শান্তি প্রক্রিয়ার সাথে যুক্ত হতে হবে। তবে সবচেয়ে ভালো হয় যদি আফগান নেতারা একমত হতে পারে। কিন্তু তালেবানের মত গোঁড়া দিয়ে সেই আশা করা একটু কঠিন। তালেবানের সঙ্গে আলোচনায় বর্তমান সরকারকে ক্ষমতার ভারসাম্য আনতে হবে এবং একইসাথে যুদ্ধবিরতি নিশ্চিত করতে হবে। 

কিন্তু আমরা কী দেখলাম! 
ট্রাম্প জানিয়েছে, তার সাথে তালেবান নেতার খুবই ফলপ্রসূ আলোচনা হয়েছে। কথাবার্তার ডিউরেশন ছিলো ৩৫ মিনিট। ফোনকলের পরপরই আমরা জানতে পারলাম তালেবান আফগানিস্তানের ৩৪টি প্রদেশের মধ্যে অন্তত ১৫টিতে ৩০টি হামলা চালিয়েছে। এর মধ্যে কুন্দুজ প্রদেশে ১০ আফগান সেনা, ৪ আফগান পুলিশ ও ৬ আফগান বেসামরিক নাগরিককে হত্যা করতে সক্ষম হয়েছে। এবং এর প্রতিবাদে আমেরিকা হেলমান্দে বিমান হামলা চালিয়েছে। 

অতএব পুরো ব্যপারটাই আমার কাছে মনে হচ্ছে একটা নাটক। যা আরো কয়েকবার মঞ্চস্থ করেছে আমেরিকা ও তালেবান। তবে চুক্তি অনুযায়ী যদি আমেরিকা আফগান ছাড়ে তবে এটা আফগানিস্তানের জন্য বড় রহমত হতে পারে এবং সেটাই কামনা করি। তবে এই বিষয়টা যদি তালেবান ১৯ বছর আগে বুঝতো তাহলে হয়তো এতো কঠিন যুদ্ধ এড়ানো যেত। 

টুইন টাওয়ারে বেসামরিক মানুষ হত্যা করা ইসলামসম্মত নয়। আল কায়েদা এই হত্যার দায় স্বীকার করে ইসলামের ক্ষতি করেছে। তালেবান তাদের সাপোর্ট করে ও হোস্ট করে আফগান মুসলিম ও বিশ্বব্যাপী মুসলিমদের অনেক ক্ষতির সম্মুখিন করেছে। পুরো মুসলিম জাতিকে আমেরিকার সন্ত্রাসীদের মুখোমুখি করে দিয়েছে।

৩ মার্চ, ২০২০

বঙ্গকথা পর্ব-২৯ : সাতান্ন সালের বিদ্রোহ ও তার আফটারম্যাথ


১৮৫৭ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধ আসলে কেমন যুদ্ধ ছিল তা একটু আলোচনা করা যেতে পারে। আগের বিদ্রোহগুলোর সাথে এই বিদ্রোহের একটি বেসিক পার্থক্য আছে। ১৮৫৭ সালের আগে যে বিদ্রোহগুলো হয়েছিলো সেগুলো সবগুলোই হয়েছে তাদের দ্বারা যারা ইংরেজদের বিরোধী ছিল। আর এই বিদ্রোহ হয়েছে ইংরেজদের দালাল দ্বারা। যারা ইংরেজদের সৈনিক ছিল, ইংরেজদের অধীনে চাকরি করতো এবং ইংরেজদের নিরাপত্তায় ছিল। পলাশীর ট্রাজেডির বরাবর ১০০ বছর পর এমন একটি বিদ্রোহ জনগণের মধ্যে সাড়া ফেলে দিয়েছে। প্রচুর সাধারণ মানুষও সিপাহিদের সাথে বিদ্রোহে এটেইন করেছে। বিদ্রোহের অনেকগুলো কারণ রয়েছে। শুরুতে এদেশের অনেকে ইংরেজদেরকে অন্যান্য বিদেশি শাসকদের মতোই মনে করেছিলো। কিন্তু তারা ছিল অত্যাচারী ও জুলুমবাজ। তাই তাদের সৈনিকরাই তাদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরেছিল।  ১৮৫৭ সালের বিদ্রোহের অনেকগুলো কারণ রয়েছে। 

প্রথমত
ইংরেজদের অর্থনৈতিক আগ্রাসন। উপমহাদেশ দখলের শুরু থেকেই তারা দেশীয় অর্থনীতিকে ধ্বংস করে তার উপর ঔপনিবেশিক অর্থনীতি চাপিয়ে দেয়। তারা এদেশের প্রচলিত ব্যবসা বাণিজ্য নষ্ট করে, কুটির শিল্পগুলি ধ্বংস এবং দেশের যাবতীয় মূলধন ও সম্পদ হস্তগত করে এদেশের অর্থনীতির উপর একচেটিয়া অধিকার প্রতিষ্ঠা করে। দেশীয় ব্যবসা বাণিজ্যের উপর থেকে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে এবং কুটির শিল্পগুলি ধ্বংস হওয়ার ফলে অসংখ্য মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়ে। দেশে বেকার ও দারিদ্র বৃদ্ধি পায় । প্রজাসাধারণ কৃষির উপর অত্যধিক নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। কোম্পানির ভ্রান্ত নীতির ফলে একদিকে যেমন জমিদার ও মহাজন শ্রেণির উদ্ভব হয়, তেমনি অন্যদিকে ভূমিহীন কৃষকের সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। কোম্পানির কর্মচারী এবং জমিদার ও মহাজনদের শোষণ ও অত্যাচারে জনজীবন অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে।

দ্বিতীয়ত
ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথম দিক থেকে ইংরেজদের দালালশ্রেণির আগ্রহের বাড়াবাড়িতে ব্রিটিশ শাসকবর্গ সামাজিক কুপ্রথা এবং কুসংস্কারের অবসান কল্পে একের পর এক বিধি প্রণয়ন করতে থাকেন। সতীদাহ প্রথার অবলুপ্তি, বিধবাবিবাহ প্রচার, স্ত্রী-শিক্ষার প্রবর্তন, বাল্যবিবাহ নিবারণ প্রভৃতি ব্যবস্থা রক্ষণশীল হিন্দুদের মনে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। পাশ্চাত্য শিক্ষা-দীক্ষা, সংস্কৃতির প্রভাবে ভারতীয় সমাজ ব্যবস্থারও আমূল পরিবর্তন হয়। এতে রক্ষনশীল ভারতীয়দের মনে ইংরেজদের উদ্দেশ্যে সন্দেহ জাগে। তাদের ধারণা হয়, সমগ্র ভারতবর্ষকে ধর্মান্তরিত করার জন্য ইংরেজগণ পরিকল্পিতভাবে তোড়জোড় শুরু করছিল। তদুপরি সামাজিক ক্ষেত্রে ভারতীয়দের প্রতি বৃটিশের অবজ্ঞা এবং উপেক্ষা, রাজনৈতিক ক্ষেত্রে বঞ্চনা তাঁদের মধ্যে ব্রিটিশ বিরোধী মনোভাবের জন্ম দেয়। ভারতীয়দের সেই বিরূপ মনোভাব সিপাহী বিদ্রোহে পরোক্ষ ইন্ধন জোগায়। সামাজিক এই সংস্কারের ফলে হিন্দু সমাজ যারা শুরু থেকেই মুসলিম শাসকদের বিরুদ্ধে ইংরেজদের সহায়তা করেছিল তারা বেঁকে বসে।   

তৃতীয়ত
ইংরেজরা একের পর এক দেশীয় রাজ্যগুলো গ্রাস করতে থাকে এবং রাজবংশের উচ্ছেদ করতে থাকে, তাতে দেশীয় রাজন্যবর্গ এবং তাদের কর্মচারিরা ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন। দুচার জন বাদে ওয়ারেন হেস্টিংস থেকে লর্ড ডালহৌসি পর্যন্ত সকলেই সমস্ত প্রকার রীতিনীতি ও মূল্যবোধ বিসর্জন দিয়ে ভারতীয় রাজ্যগুলি অধিকার করেন। লর্ড ডালহৌসির স্বত্ববিলোপ নীতির প্রয়োগের ফলে বহু রাজবংশের উচ্ছেদ হয়। মোগল বাদশাহের অপসারণ মুসলিমদের মনে দারুন আঘাত হানে। পেশোয়ায় নানা সাহেবের বৃত্তি বন্ধ করে ইংরেজগণ মারাঠাদের উত্তেজিত করে তোলেন। ফলে ব্রিটিশ বিরোধী অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত রাজন্য বর্গের সঙ্গে এইসব অসন্তুষ্ট মানুষ হাত মেলালে বিদ্রোহ তীব্র আকার ধারণ করে।

চতুর্থত
ভারতের খ্রিস্টান মিশনারিদের কার্যকলাপ সামগ্রিকভাবে রক্ষনশীল ভারতীয়দের মনে ব্রিটিশ বিরোধী মনোভাবের জন্ম দেয়। তাদের মিশনারি কার্যকলাপ মানুষের ধর্ম বিশ্বাসে প্রচন্ড আঘাত হানে। মুসলিমগণ যারা দীর্ঘকাল রাজ্যশাসনের দায়িত্বে ছিলেন তারা অপসারিত হওয়ায় ধর্মপ্রাণ মুসলিম সম্প্রদায়ও ব্রিটিশের প্রতি চাপা অসন্তোষ পোষণ করতে থাকেন । তাদের ক্ষমতাচ্যুতি এবং দুরাবস্থার জন্য তারা ইংরেজদের দায়ী করেন। আর মুসলিমরা তো গোড়া থেকেই ইংরেজদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে এবং একের পর এক বিদ্রোহ করেছে ইংরেজদের বিরুদ্ধে। তারাও দেখেছিলো যে ইংরেজদের দমননীতির ফলে বন্ধ হয়ে যায় মাদরাসাগুলো। ফলে মুসলিমদের মধ্যে শির্ক ও বিদআতের প্রচলন শুরু হয়। এজন্য এদেশে ওয়াহাবী আন্দোলন জমে উঠেছিলো। তারই প্রেক্ষিতে জিহাদী মানসিকতা তৈরি হয় মুসলিমদের মধ্যে। 

পঞ্চমত 
সেনাবিভাগে ব্রিটিশ ও ভারতীয় সৈন্যদের মধ্যে বেতন, পদোন্নতি, বদলি ইত্যাদির ক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষের বৈষম্যমূলক আচরণ ভারতের সৈন্যদের মনে ক্ষোভের সঞ্চার হয়। সিন্ধু ও আফগানিস্তানে নিযুক্ত সেনাদলকে বিশেষ ভাতা দেওয়ার ব্যবস্থা থাকলেও ভারতীয় সেনাগণ তা থেকে বঞ্চিত হতেন। তাদের ধর্ম বিশ্বাসকে মর্যাদা না দিয়ে তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে সামরিক কর্তৃপক্ষ তাদের যত্রতত্র বদলি ও নিয়োগের ব্যবস্থা করেন। জাত ও ধর্ম হারাবার ভয়ে সিপাহিগণ কালাপানি পার হয়ে ব্রহ্মদেশ বা অন্যত্র যেতে অস্বীকৃত হন। অর্থনৈতিক ও ধর্মীয় কারণে যখন তাঁরা অত্যন্ত ক্ষুদ্ধ ও উত্তেজিত তখনই লর্ড ক্যানিং -এর প্রবর্তিত সামরিক নিয়োগ বিধি আগুনে ঘি ঢালার ব্যবস্থা করে। এই নিয়মানুসারে ভারতীয় সিপাহিদের যেকোনো কাজ করতেও বাধ্য করা হয়েছিল। এই পরিস্থিতিতে ইউরোপে ক্রিমিয়ার যুদ্ধে (১৮৫৪-৫৬ খ্রিস্টাব্দ) ইংল্যান্ডের জয়লাভ সত্ত্বেও ব্রিটিশ সামরিক বিভাগের দুর্বলতা ভারতীয় সেনাদের উৎসাহিত করে তোলে। তাদের ধারণা হয়, ভারতে অনুরূপ ব্যাপক অভ্যুত্থান ঘটাতে পারলে সেই অভ্যুত্থান দমন করা ইংরেজ বাহিনীর পক্ষে সম্ভব হবে না। ফলে তারা গোপনে প্রস্তুত হতে থাকেন। অন্য একটি বদ্ধমূল ধারণা এক্ষেত্রে কাজ করেছিল, যে ভারতে ব্রিটিশ শাসন একশো বছর স্থায়ী হবে। ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে সেই শাসনেরই শতবর্ষ পূর্তির বছর। অতএব সেই সুযোগ কাজে লাগানোর জন্যেও ভারতীয় সিপাহিগণ তৎপর হন।                        
ষষ্ঠত
১৮৫৭ সালের বিদ্রোহের মূল কারণ ছিল এনফিল্ড রাইফেল। বিভিন্ন কারণে সিপাহিদের মধ্যে যখন ক্ষোভ ক্রমশ পূঞ্জীভূত হচ্ছিল ঠিক সেই সময়ে এনফিল্ড রাইফেল নামে এক নতুন ধরনের রাইফেলের প্রবর্তন তাদের ক্ষোভ কে বিদ্রোহে পরিণত করে। এনফিল্ড রাইফেলে যে কার্তুজ (Cartridge) ব্যবহার করা হতো, তার খোলসটি দাঁতে কেটে রাইফেলে ভরতে হত । গুজব রটে যায় যে, এই কার্তুজে গরু ও শুয়োরের চর্বি মেশানো আছে । ধর্মচ্যুত হওয়ার আশঙ্কায় কোম্পানির সেনাবাহিনীর হিন্দু ও মুসলমান সিপাহিরা ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে এবং এই টোটা ব্যবহার করতে অস্বীকার করে।

তবে মূল কথা হলো এনফিল্ড রাইফেলের প্রবর্তন সিপাহী বিদ্রোহের প্রত্যক্ষ কারণ হলেও একে প্রধান কারণ বলা যায় না। কারণ, চর্বি মাখানো টোটাই যদি এই বিদ্রোহের প্রধান কারণ হতো, তাহলে টোটা ব্যবহার নিষিদ্ধ করে সরকারি নির্দেশ জারি করার পরেই এই বিদ্রোহের অবসান ঘটতো। কিন্তু তা না হয়ে বিদ্রোহ চলতে থাকে এবং ইংরেজদের হটানোই মূল লক্ষ্যে পরিণত হয়। পরবর্তীকালে ইংরেজদের বিরুদ্ধে সিপাহিরা চর্বি মাখানো এই টোটাই ব্যবহার করেছিল।

সিপাহী বিদ্রোহ প্রথমে শুরু হয় মঙ্গল পান্ডের নেতৃত্বে কলকাতার উত্তরে ব্যারাকপুরে। এই বিদ্রোহের সংবাদ লক্ষ্ণৌ-এর সিপাহিদেরও সংক্রামিত করেছিল। লক্ষ্ণৌ-এর পরে বিদ্রোহ মীরাটে প্রসারিত হয়। ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের ২৪ শে এপ্রিল মীরাট সেনা ছাউনিতে ৮০ জন সৈনিক প্রকাশ্যে ওই কার্তুজ ব্যবহার করতে অস্বীকার করে বিদ্রোহ ঘোষণা করে। মীরাট থেকে এই বিদ্রোহ দ্রুত গতিতে দিল্লীতে ছড়িয়ে পড়ে । দিল্লীতে সিপাহিরা স্ত্রী-পুরুষ-শিশু নির্বিচারে ইংরেজদের হত্যা করে । দিল্লি পৌঁছে বিদ্রোহীরা লাল কেল্লা দখল করে । পরে বৃদ্ধ বাহাদুর শাহকে সিংহাসনে বসিয়ে তাঁকে দিল্লির বাদশারূপে ঘোষণা করেন। এর পর বিদ্রোহ গাঙ্গেয় প্রদেশগুলিতে ও মধ্যভারতে ছড়িয়ে পড়ে। ফিরোজপুর, মজফ্‌ফর নগর ও আলিগড়ে সিপাহিরা বিদ্রোহী করে। এরপর পাঞ্জাবের বিদ্রোহ বিস্তার লাভ করে। অযোধ্যা ও উত্তরপ্রদেশের নানা অঞ্চলে বিদ্রোহ তীব্র আকার ধারণ করে। অযোধ্যার সম্পত্তিচ্যুত তালুকদাররা বিদ্রোহে যোগ দেন। রোহিলাখন্ডের সর্দাররা এই বিদ্রোহে যোগ দেন। এদের মধ্যে বেরিলির খান বাহাদুর, নাজিরাবাদের মহম্মদ খাঁ, গোরখপুরের মহম্মদ হাসান প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য। ১৮৫৭ সালের নভেম্বর মাসে বাংলার চট্টগ্রামের সিপাহিরা বিদ্রোহী হন। কিন্তু সেখানে জনসাধারণের সমর্থন না পাওয়ায় সিপাহিরা পার্বত্য অঞ্চলে আশ্রয় নিতে বাধ্য হন।

নর্মদা নদীর দক্ষিণাঞ্চলে শান্তি একরকম অক্ষুন্নই ছিল, যদিও সিপাহিদের মধ্যে উত্তেজনার অভাব ছিল না।রাজস্থানেও বিদ্রোহ সংক্রামিত হয়। কিন্তু রাজপুত শাসকরা ব্রিটিশদের প্রতি অনুগত থাকায় সেখানে বিদ্রোহ ব্যাপক আকার ধারণ করতে পারেনি। ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী ভারতীয় সিপাহিদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে জনগণের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সংগ্রামে নামা ছিল ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের গণবিদ্রোহের একটি অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য। গ্রামাঞ্চলে কোম্পানি প্রবর্তিত নতুন ভূমিরাজস্ব আইন দ্বারা সুরক্ষিত সুদখোর মহাজন ও নতুন জমিদারদের  বাড়িঘর ও কাছারি লুঠ করা হয় । যদিও কোনো কোনো ক্ষেত্রে স্থানীয় ডাকাতরাও এই সব লুঠতরাজে অংশ নিয়েছিল। ব্যবসায়ী ও মহাজনদের ওপর কর বসিয়ে বিদ্রোহী সিপাহিদের খাদ্যশস্য ও যুদ্ধের রসদপত্র কেনা হয়।

তারপরও ব্যর্থ এই বিদ্রোহ
ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী শাসনের বিরুদ্ধে পুঞ্জিভূত নানান ক্ষোভ ও অসন্তোষকে কেন্দ্র করেই ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহের সূচনা হয় । বিদ্রোহে সেনাবাহিনীর সমর্থন, জনগণের সক্রিয় সমর্থন ও সহানুভূতি থাকা সত্বেও মহাবিদ্রোহ শেষ পর্যন্ত ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয় । ১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহের ব্যর্থতার মূলে একাধিক কারণ ছিল।

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টা হলো এই বিদ্রোহের কোনো কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব ও পরিকল্পনা ছিলো না। সিপাহিরা যার যার ইচ্ছেমতো বিদ্রোহ করেছে। কোনো দিক-নির্দেশনা ও গাইডলাইন ছিলো না। বিদ্রোহের কোনো সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা না থাকায় প্রথম থেকেই এর সাফল্য লাভের সম্ভাবনা ছিল না বললেই চলে। সিপাহি বা জনগণের নেতৃবর্গ কোনো সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য তুলে ধরতে পারেন নি। বিচ্ছিন্নভাবে বিভিন্ন সময়ে, বিভিন্ন স্থানে বিদ্রোহ সংগঠিত হওয়ায় বিদ্রোহ দমন করতে ইংরেজ প্রশাসনের বিশেষ কোনো অসুবিধার সন্মুখীন হতে হয়নি। সিপাহিরা বাহাদুর শাহকে নেতা হিসেবে উপস্থাপন করেছে কিন্তু সিপাহী ও বাহাদুর শাহের মধ্যে যোগাযোগ ছিলো না। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো সিপাহিরা বেশিরভাগ ছিলেন হিন্দু অপরদিকে মুসলিম বাহাদুর শাহকে করা হয়েছে নেতা। 

সমগ্র ভারতে বিদ্রোহ প্রসারিত হলেও মূলত উত্তর ও মধ্য ভারতের বিহার, দিল্লী, উত্তরপ্রদেশ ও মধ্যপ্রদেশেই সীমাবদ্ধ ছিল, ভারতের অন্যান্য অঞ্চলে বিদ্রোহের বিশেষ কোনো প্রতিক্রিয়া ছিল না। ভারতের সমস্ত অঞ্চলে বিদ্রোহ না হওয়ায় কোম্পানি শান্তিপূর্ণ অঞ্চল থেকে সেনাবাহিনী সরিয়ে নিয়ে এসে তাদের অন্যত্র বিদ্রোহ দমনে নিয়োজিত করে। ভারতের বিভিন্ন জাতি ও দেশীয় রাজারা বিদ্রোহের বিরোধিতা করে ব্রিটিশদের সমর্থন করেন। এরমধ্যে রয়েছে হায়দ্রাবাদের নিজাম, কাশ্মীরের মহারাজা, সিন্ধিয়া, পাতালিয়া ও গুর্খা বীর স্যার জঙ্গবাহাদুর প্রভৃতি দেশীয় রাজা ও অসংখ্য ছোটো-বড়ো জমিদার বিদ্রোহ দমনে ব্রিটিশকে সক্রিয়ভাবে সাহায্য করেছিল।

১৮৫৭ সালের ফলাফল
ইংরেজরা ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহ দমাতে সক্ষম হলেও তাদের টনক নড়ে। তারা বুঝতে সক্ষম হয়েছে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি যেভাবে লুটতরাজ চালাচ্ছে তাতে ভারত শাসন কঠিন হয়ে যাবে। তাই বিদ্রোহ দমনের পর ইংল্যান্ডের রানী ভিক্টোরিয়া ১ নভেম্বর থেকে নিজের হাতে ভারতের শাসনভার গ্রহণ করেন এবং কোম্পানী শাসন বিলুপ্ত ঘোষণা করেন। এর মধ্যমে ভারতে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা হতে শুরু করে। এছাড়া তিনি আরো ঘোষণা নিয়ে এক ঘোষণাপত্র প্রেরণ করেন। যার মাধ্যমে তিনি ভারতীয়দের নানানভাবে আশ্বস্ত করেন।

এই ঘোষণাপত্রে বলা হয় — 
১. ভারতবাসীর ধর্মীয় ও সামাজিক ব্যাপারে ব্রিটিশ সরকার হস্তক্ষেপ করবে না। 
২. জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে যোগ্যতাসম্পন্ন ভারতীয়দের চাকরিতে নিযুক্ত করা হবে। 
৩. স্বত্ববিলোপ নীতি ও অধীনতামূলক মিত্রতা নীতি পরিত্যক্ত হবে। 
৪. স্বাক্ষরিত সন্ধি ও চুক্তিগুলিকে মান্য করা হবে। 
৫. বন্দি সিপাহী ও ভারতীয়দের মুক্তি দেওয়া হবে।

প্রশাসনিক পরিবর্তন 
বিদ্রোহের ফলশ্রুতিতে ভিক্টোরিয়া ভারত শাসন আইন পাশ করেন। ব্রিটিশ সরকারের মন্ত্রিসভার ও পার্লামেন্ট মহাসভার অধীনে ভারতের শাসনকে আনা হয়। ব্রিটিশ মন্ত্রীসভায় একজন ভারত বিষয়ক মন্ত্রী নিয়োগ করা হয়। তার খেতাব হয় "ভারত সচিব"। তিনি ব্রিটিশ মন্ত্রীসভার পক্ষে ভারতবাসীর প্রধান হন। ভারত সচিবকে পরামর্শ দানের জন্য ১৮৫৮ সালে আইনে একটি কাউন্সিল গঠন করা হয়। আগের মতো বড়লাট তার ক্ষমতায় থাকেন। তবে তার উপাধি হয় গভর্ণর জেনারেল ও ভাইসরয়। প্রথম ভাইসরয় হয় লর্ড ক্যানিং।

আগের ডিরেক্টর সভা ও বোর্ড অব কন্ট্রোল-এর যাবতীয় ক্ষমতা দেওয়া হয় ভারত সচিব নামে ব্রিটিশ মন্ত্রীসভার এক ক্যাবিনেট মন্ত্রীকে। ভারত সচিবকে সাহায্যের জন্য ১৫ জন সদস্য নিয়ে গঠন হয় ইন্ডিয়ান কাউন্সিল। ১৮৬১ সালের কাউন্সিল আইন পাশ করে ভাইসরয়ের আইন পরিষদে ৬-১২ জন সদস্যের মধ্যে বেসরকারি ইংরেজ ও ভারতীয়নের সংখ্যা অর্ধেক হয়। ১৮৭০ খ্রিস্টাব্দে লর্ভ মেয়ো, ১৮৭৭ খ্রিস্টাব্দে লর্ড লিটন ও ১৮৮২ খ্রিস্টাব্দে লর্ড ক্যানিং বিকেন্দ্রীকরণ নীতি গ্রহণ করে প্রাদেশিক শাসন পরিষদ ও আইনসভাগুলিকে কিছু কিছু ক্ষমতা দান করেন।

প্রদেশগুলিকে অর্থনৈতিক ক্ষমতা দান করায় স্থানীয় স্বায়ত্তশাসন ব্যবস্থায় উন্নতি হয়। স্থানীয় পৌরসভা ও জেলা বোর্ডগুলি শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পানীয় জলের বন্দোবস্ত প্রভৃতি উন্নতির দায়িত্ব দেওয়া হয়। স্বায়ত্তশাসন ব্যবস্থার উন্নতিতে লর্ড রিপনের নাম স্মরণীয়। ১৮৭৭ সালে রানী ভিক্টোরিয়াকে আনুষ্ঠানিকভাবে ভারতসম্রাজ্ঞী বলে ঘোষণা করা হয়। এরপর থেকে ভারতীয় রাজন্যবর্গ হন তার অধীনস্থ সামন্ত বা প্রজা।

সামরিক বিভাগের পরিবর্তন 
ভারতের সামরিক বিভাগকে নতুন করে গঠন করা হয়। দেশীয় সৈন্যসামন্তের সংখ্যা হ্রাস করে ইংরেজ সৈন্যের সংখ্যা বৃদ্ধি করা হয়। প্রেসিডেন্সি সেনাবাহিনীকে পৃথক করা হয়। গোলন্দাজ বাহিনীতে ভারতীয়দের নিয়োগ নিষিদ্ধ করা হয়। সীমান্তরক্ষা ও অভ্যন্তরীণ শান্তি রক্ষার দায়িত্ব ইউরোপীয় সামরিক কর্মচারীদের উপর অর্পণ করা হয়। বিদ্রোহের পরবর্তী সময়ে মুঘল সাম্রাজ্যের সম্পূর্ণ বিলুপ্তি ঘটে। শেষ মুঘল সম্রাট বাহাদুর শাহ বন্দি অবস্থায় রেঙ্গুনে প্রেরিত হন এবং তার পুত্র ও পৌত্রগণকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। এভাবে মুঘল বংশের অবসান ঘটে। একইসাথে অনেক মুসলিম স্বাধীনতাকামী নেতাদের নির্বাসন ও মৃত্যুদন্ড কার্যকর করে ইংরেজ সরকার। 

ভারতে রাজনৈতিক চেতনার উন্মেষ 
বিদ্রোহ ও তার পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহে সাধারণ ভারতবাসী তার রাজনৈতিক অবস্থা সম্বন্ধে সজাগ হয়ে উঠলো এবং রাজনৈতিক আন্দোলনের ফলে ক্রমশ ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ও ভারতের জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠিত হয়। এভাবে সিপাহী বিদ্রোহ ভারতবর্ষের রাজনৈতিক ইতিহাসে এক নব যুগের সূচনা করে। ভারতবাসীদের শিক্ষা, সংস্কৃতি ও ধর্মচর্চার সুযোগ বৃদ্ধি পায়। শিক্ষিত মধ্যবিত্তের সংখ্যা বাড়ে। ডাক-তার-রেল ও যোগাযোগ ব্যবস্থার ফলে ভারতের বিভিন্ন প্রান্তের মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ ও আদানপ্রদান বৃদ্ধি পেল। জেগে উঠল সংঘ চেতনা। শিক্ষিত মধ্যবিত্তদের নেতৃত্বে ইংরেজ বিরোধী রাজনীতি সম্প্রসারিত হওয়া শুরু করেছিলো। একইসাথে ইংরেজদের পক্ষের সুবিধাভোগী শিক্ষিত শ্রেণিও তৈরি হয়েছিলো।  

বঙ্গকথা পর্ব-২৮ : সাতান্ন সালের খালক-ই-খুদা, মুলক-ই-বাদশাহ, হুকুম-ই-সিপাহী



মুঘল সম্রাট বাবরের বিশতম বংশধর ও শেষ সম্রাট বাহাদুর শাহ ১৮৩৭ সালে ক্ষমতায় আরোহন করেন। এই ক্ষমতা নিরঙ্কুশ ছিল না। তিনি ছিলেন মূলত ইংরেজদের অনুদানপ্রাপ্ত। তিনি প্রকৃত শাসক ছিলেন না। তিনি কোম্পানি থেকে বার্ষিক এক লক্ষ টাকা ভাতা গ্রহণ করতেন। ইংরেজদের সাথে ভাতা ও উত্তরাধিকার নিয়ে তার মনোমালিন্য ছিল। এর মধ্যেই শুরু হয় সর্বাত্মক স্বাধীনতা আন্দোলন। এই আন্দোলনের মূল নেতা হিসেবে ধারণা করা হয় সম্রাট বাহাদুর শাহকে। যদিও তিনি আসলে কতটুকু নেতৃত্ব দিয়েছেন তা প্রশ্নবিদ্ধ। 

বাহাদুর শাহ সম্রাট হিসেবে আরোহণের ২০ বছর পর সূত্রপাত হয় ঐতিহাসিক স্বাধীনতা বিদ্রোহের। এটি পলাশীর যুদ্ধের ১০০ বছর পরের ঘটনা। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি সমগ্র ভারতবর্ষ দখল করে নিয়েছে। দেশবাসীর সাথে সাথে ইংরেজদের অধীনে থাকা এদেশীয় সৈন্যদের ওপরও চলছে জুলুম, বঞ্চনা ও নির্যাতন। একের পর এক দেশীয় রাজ্য ইংরেজ অধিকারে নিয়ে যাওয়া, লাখেরাজ ও দেবোত্তর সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা, কারাগারে হিন্দু-মুসলমান সিপাহিদের জন্য একই খাবারের ব্যবস্থা, ঘিয়ের মধ্যে চর্বি ও আটার মধ্যে হাড়গুঁড়োর সংমিশ্রণ, গরু ও শূকরের চর্বি মিশ্রিত কার্তুজ বিতরণ ইত্যাদি ভারতবর্ষের জনমনে এবং সৈনিকদের মনে ব্যাপক প্রভাব ফেলে। 

ভারতীয় সিপাহীদের মধ্যে ধূমায়িত বিক্ষোভ ও অস্থিরতার প্রথম বহিঃপ্রকাশ ঘটে ১৮৫৭ খ্রিষ্টাব্দের ২২ জানুয়ারি পশ্চিমবঙ্গের দমদম সেনাছাউনিতে। সিপাহীরা ইংরেজ অফিসারকে জানায়, এনফিল্ড রাইফেলের জন্য যে কার্তুজ তৈরি হয়, তাতে গরু ও শূকরের চর্বি মেশানো থাকে এবং এতে তাদের ধর্ম নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। কর্তৃপক্ষ সিপাহীদের বুঝিয়ে শান্ত করে। কিন্তু খবরটি একে একে বিভিন্ন সেনাছাউনিতে পৌঁছে যায় এবং তা সিপাহীদের মধ্যে বিদ্রোহের রূপ ধারণ করে। প্রথম বিস্ফোরণ ঘটে পশ্চিমবঙ্গের বহরমপুর সেনাছাউনিতে ২৫-২৬ ফেব্রুয়ারি। ১৯ নম্বর পদাতিক বাহিনীর সিপাহীরা কার্তুজ নিতে অস্বীকার করে, রাতে অস্ত্রাগারের দরজা ভেঙে পুরনো মাসকেট বন্দুক ও কার্তুজ সংগ্রহ করে। তারা এনফিল্ড রাইফেলের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করছিল। পরিস্থিতি সামাল দিতে সিপাহীদের নিরস্ত্র ও বরখাস্ত করা হয়। এই সংবাদও দ্রুত পৌঁছে যায় বিভিন্ন সেনানিবাসে। ২৯ মার্চ রোববার ব্যারাকপুরের দেশীয় সিপাহিরা বিদ্রোহ করে। মঙ্গল পান্ডে নামের সিপাহি গুলি চালিয়ে ইংরেজ সার্জেন্টকে হত্যা করে। 

প্রহসনমূলক বিচারে মঙ্গল পান্ডে তাকে সহায়তার অভিযোগে জমাদার ঈশ্বরী পান্ডেকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়। ৮ এপ্রিল সকাল ১০টায় তাদের ফাঁসি দেয়া হয়। এর পরিণতিতে বিদ্রোহের আগুন ছড়িয়ে পড়ে ভারতের উত্তর থেকে মধ্যপ্রদেশ এবং জলপাইগুড়ি থেকে পূর্ববাংলার দক্ষিণ-পূর্ব কোণের চট্টগ্রাম পর্যন্ত। ৯ মে উত্তর প্রদেশের মিরাটের সিপাহীরা বিদ্রোহ ঘোষণা করেন দিল্লির পথে অগ্রসর হন। ১১ মে সিপাহীরা দিল্লি অধিকার করে বহু ইংরেজকে হত্যা ও বিতাড়ন করেন। দেশপ্রেমিক সিপাহিরা এ দিন লালকেল্লায় প্রবেশ করে নামেমাত্র মুঘল সম্রাট দ্বিতীয় বাহাদুর শাহ জাফরকে ভারতের স্বাধীন সম্রাট বলে ঘোষণা করেন। সিপাহীরা সম্রাটের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করে শপথ নেন। এদিন গভীর রাতে লালকেল্লায় একুশবার তোপধ্বনির মাধ্যমে ৮২ বছরের বৃদ্ধ সম্রাটকে দেওয়ান-ই খানোস এ সম্মান জানানো হয়।

বাহাদুর শাহ জাফর সিপাহীদের বিপ্লব তথা ভারতবর্ষের প্রথম সশস্ত্র স্বাধীনতা সংগ্রামের নেতৃত্ব দিচ্ছেন ­ এ সংবাদ  কানপুর, লক্ষ্মৌ, বিহার, ঝাঁশি, বেরিলি থেকে শুরু করে পশ্চিম ও পূর্ববাংলার সর্বত্র সিপাহিরা গর্জে ওঠে ‘খালক-ই খুদা, মুলক ই বাদশাহ, হুকুম ই সিপাহী।’ অর্থাৎ আল্লাহর দুনিয়া, বাদশার রাজ্য, সিপাহির হুকুম। একের পর সেনাছাউনিতে বিদ্রোহ হতে থাকে। ইংরেজরা অতি নির্মমভাবে বিদ্রোহ দমন করে। হাজার হাজার স্বাধীনতাকামীর রক্তে রঞ্জিত হয় ভারতবর্ষের মাটি। ইংরেজদের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষও বিক্ষুব্ধ ছিল। তারাও এই বিদ্রোহে অংশগ্রহণ করে। 

কিন্তু ভারতীয়দের এই সংগ্রাম সফল হতে পারেনি। ইংরেজরা দিল্লি দখল করে নেয় এবং সম্রাট ২১ সেপ্টেম্বর আত্মসমর্পণ করেন। ইংরেজ সৈন্যরা মীর্জা মোগল, মীর্জা খিজির সুলতান, মীর্জা আবু বকরসহ ২৯ জন মুঘল শাহজাদাসহ বহু আমির ওমরাহ, সেনাপতি ও সৈন্যকে নৃশংসভাবে হত্যা করে। সম্রাটকে বিচারের নামে প্রহসনের আদালতে দাঁড় করানো হয়। হাজির করা হয় বানোয়াট সাক্ষী। বিচারকরা রায় দেন, দিল্লির সাবেক সম্রাট ১০ মে থেকে ১ অক্টোবর পর্যন্ত ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ সংগঠনের দায়ে অপরাধী। তার শাস্তি চরম অর্থাৎ মৃত্যুদণ্ড হওয়া উচিত। কিন্তু তার বার্ধক্যের কথা বিবেচনা করে প্রাণ দণ্ডাদেশ না নিয়ে নির্বাসনে পাঠানোর সুপারিশ করা হয়। অবশেষে বাহাদুর শাহকে ইয়াঙ্গুনে নির্বাসনে পাঠানো হয় এবং সেখানেই তিনি মৃত্যুবরণ করেন। 

বাহাদুর শাহকে বাংলাদেশে প্রাক্তন ভিক্টোরিয়া পার্ককে বাহাদুর শাহ পার্ক নামকরণ করা হয়। বাংলাদেশের প্রধান নৌবন্দর সদরঘাটে এই পার্ককে ঘিরে রয়েছে সাতটি রাস্তা। সিপাহী বিদ্রোহের সাথে সংশ্লিষ্ট সৈনিক ও দেশপ্রেমিক জনতার একটি অংশকে এই পার্কের গাছগুলিতে ঝুলিয়ে কার্যকর করা হয়। ১৯৫৭ সালে পাকিস্তান আমলে ১৮৫৭ সালের স্বাধীনতা আন্দোলনের ১০০ বছর পূর্তি উপলক্ষে শহীদদের স্মরণে স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা হয় এবং এই পার্কের নাম পরিবর্তন করে বাহাদুর শাহ পার্ক নামকরণ করা হয়। এই কাজটি করে ডিআইটি তথা ঢাকা ইমপ্রুভমেন্ট ট্রাস্ট। ডিআইটির বর্তমান নাম রাজউক তথা রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ।