৩০ এপ্রি, ২০২০

উশর : একটি উপেক্ষিত ফরজ বিধান



‘উশর’ শব্দটি আরবী আশরাতুন (দশ) শব্দ হতে এসেছে। এর শাব্দিক অর্থ হলো এক দশমাংশ। শরীয়তের পরিভাষায় কৃষিজাত পণ্য- ফল ও ফসলের যাকাতকে উশর বলে। এটা ফসলের যাকাত। আমাদের দেশে অধিকাংশ মানুষ কোনো না কোনোভাবে কৃষির সাথে জড়িত। কিন্তু আমার জানামতে বহু মুসলিম ভাই উশর আদায়ে সক্রিয় নন। আজকের আলোচনা তাই উশর নিয়ে।

উশর সম্পর্কে মহান আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা বলেন, তোমরা তোমাদের উপার্জিত হালাল সম্পদ হতে এবং যা আমি তোমাদের জন্য যমীন হতে উৎপন্ন করিয়েছে তা থেকে দান করো। (বাকারা ২৬৭)

তিনি আরো বলেন, ফসল কাটার সময় তার হক (উশর) আদায় করো। (আনআম ১৪১)

প্রিয় নবী মুহাম্মদ সা. উশরের নিয়ম বলে দেন, যে যমীনকে আসমান অথবা প্রবাহমান কূপ পানি দান করে অথবা যা নালা দ্বারা সিক্ত হয়, তাতে পবিত্র উশর অর্থাৎ দশ ভাগের এক ভাগ আর যা সেচ দ্বারা সিক্ত হয়, তাতে অর্ধ উশর অর্থাৎ বিশ ভাগের এক ভাগ। (বুখারী শরীফ)

ইমামে আবু হানীফা বলেন, যমীনে উৎপন্ন যাবতীয় ফসলেরই উশর অথবা অর্ধ উশর দিতে হবে। চাই দীর্ঘস্থায়ী শস্য হোক, চাই ক্ষণস্থায়ী শস্য অর্থাৎ শাক-সবজি হোক। তিনি আরো বলেন, কম-বেশি যাই হোক উশর আদায় করতে হবে।

উশর আদায়ের সময় :
উশর আদায়ের নির্দিষ্ট কোনো সময় নেই। যতবারই ফসল উৎপন্ন হবে ততবারই ফসলের যাকাত তথা উশর দিতে হবে।

উশরের নিসাব :
বিনা পরিশ্রমে ও খরচে উৎপাদিত ফসল ও ফল ফলাদির দশ ভাগের এক ভাগ বা তার মূল্য দান করে দিতে হবে। আর পরিশ্রম করে ফসল বা ফল ফলাদি ফলানো হলে তখন বিশ ভাগের এক ভাগ বা তার মূল্য দান করে দিতে হবে। ধান, চাল, গম ব্যতীত ফল-ফলাদির ১০টির ১টি বা ২০টির একটি দিতে হবে। আর যদি ৫টি হয় তবে একটার অর্ধেক দিতে হবে।

আবু সাঈদ খুদরী (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী করীম (সা.) বলেন, ‘পাঁচ ওসাকের কম পরিমাণ শস্যের মধ্যে কোন যাকাত নেই এবং পাঁচ উটের কম সংখ্যায় যাকাত নেই। মুসলিম শরীফ, হাদীস নং-২১৩৫, অনুবাদ: বাংলাদেশ ইসলামিক সেন্টার এবং বোখারী শরীফ, হাদীস নং-১৩২৩, অনুবাদ: আধুনিক প্রকাশনী

কিন্তু ইমাম আবু হানিফা এবং পরবর্তীযুগের হানাফী আলেমগণের মতে ‘ভূমি থেকে যাই উৎপন্ন হোক, কম হোক বা বেশী হোক তার উপর যাকাত দিতে হবে’। উশরে কোনো নিসাব প্রযোজ্য হবে না।

যদি পাঁচ ওয়াসাক হিসেবে উশর দিতে চান তবে হিসাব হলো,
৫ ‘ওয়াসাক’ এক ওয়াসাক সমান ৬০ সা’আ। তাহলে ৫ * ৬০= ৩০০ সা’আ।
এক সা’আ উত্তম গমের মাপ হয় প্রায় ২.৪০ কেজি। তাহলে ৩০০ * ২.৪০= ৭২০ কেজি। নিসাব হলো ৭২০ কেজি।

কোন কোন ফসল/শস্য/ফলের উপর উশর ফরজ : 
জমি থেকে উৎপাদিত প্রত্যেক ফসলের উপর উশর ফরজ। যেমন খাদ্যশস্য, সরিষা, তিল, বাদাম, আখ, খেজুর, শুকনো ফল, শাকসবজি, শশা, খিরাই, গাজর, মূলা, সালগম, তরমুজ, লেবু, পেয়ারা, আম, মালটা প্রভৃতি। 
.
ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে বিনিয়োগ করা হলে বনজ বৃক্ষ, ঘাস, নলখাগড়া, ঔষধি বৃক্ষ, চা বাগান, রাবার চাষ, তুলা, আগর, ফুল, অর্কিড, বীজ, চারা, কলম ইত্যাদি যাকাতের আওতাভুক্ত হবে।

বারোমাসি ফলের ক্ষেত্রে বিধান কী?
কিছু কিছু ফল সারাবছর হয়। আপনি একসাথে পান না। যেমন নারিকেল। ধরুন আমার ৫টি নারিকেল গাছ আছে। সারাবছরই ফল হয়। নোয়াখালী অঞ্চলে নারিকেল গাছের সাধারণত পরিচর্যা লাগে না। সেক্ষেত্রে আমি যখনই নারিকেল কালেকশন করবো তখনই প্রতি দশটা নারিকেলের জন্য একটা নারিকেল দান করে দিব। 

উশর আদায়ের হুকুম :
ফসলের যাকাত হচ্ছে উশর, যে উশর আদায় করলো সে তার ফসলের যাকাত আদায় করলো। যে উশর আদায় করলো না, সে তার ফসলের যাকাত আদায় করলো না। কাজেই, টাকা-পয়সা, স্বর্ণ-চান্দির যাকাত আদায় করা যেরূপ ফরয জমির উৎপাদিত ফসল ও ফল-ফলাদির যাকাত (উশর) আদায় করাও তদ্রুপ ফরয। অতএব, কেউ যদি ফসলের যাকাত (উশর) আদায় না করে তাহলে সে ফরয অনাদায়ের গুনাহে গুনাহগার হবে।

উশর পাবে কারা? 
যারা যাকাত পাওয়ার যোগ্য তারাই উশর পাবে।

পশুর জাকাত :
ছাগল, ভেড়া ইত্যাদি ছোট পশুর ক্ষেত্রে ১ থেকে ৩৯টি পর্যন্ত জাকাত নেই। ৪০ থেকে ১২০টি পশুর জন্য ১টি পশু যাকাত দিতে হবে। ১২১ থেকে ২০০ টি পশুর জন্য ২টি পশু যাকাত দিতে হবে। এরপর থেকে প্রতি ১০০ জন্য একটি হারে জাকাত দিতে হবে। 

গরুর মতো বড় পশুর ক্ষেত্রে ২৯ টি পশুর জন্য জাকাত নেই। ৩০ থেকে ৩৯টি পশুর জন্য এক বছর বয়সী ১টি বাছুর জাকাত দিতে হবে। ৪০-৫৯ টি পশুর জন্য দুই বছর বয়সী একটি গরু জাকাত দিতে হবে।  ৬০ টির জন্য একবছর বয়সী দুইটি বাছুর জাকাত দিতে হবে। এর উপরের পশু থাকলে প্রতি তিরিশটির জন্য একটি এক বছরের বাছুর জাকাত দিতে হবে। 

পাখি ও মাছের যাকাত :
হাঁস মুরগি ও মাছের ক্ষেত্রে যদি ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে প্রতিপালন না হয় তবে যাকাত নেই। যদি ডিম বিক্রি করেন তাহলেও যাকাত দেওয়া লাগবে না। যেমন কেউ বড় খামার করেছে ডিম উৎপাদন করার জন্য। সেক্ষেত্রে শুধু ডিম বিক্রির টাকা থেকে যদি নিসাব পরিমাণ টাকা হয় তবেই জাকাত দিতে হবে। আর কেউ যদি মুরগী বিক্রির উদ্দেশ্যে খামার করে তবে মুরগীর দাম সহ হিসেব করতে হবে। তা যদি নিসাব পরিমাণ হয় তবে জাকাত দিতে হবে। 

মাছের হিসেবও একই। খাওয়ার জন্য মাছ চাষ করলে জাকাত নেই। আর যদি ব্যাবসায়িক ব্যাপার থাকে তবে মাছের দাম যদি নিসাব পরিমাণ হয় তবে জাকাত ফরজ হবে।

বাংলাদেশে সবসময়ই কোনো না কোনো ফসল উত্তোলন করা হয়। এখনও কয়েকটি ফসল উত্তোলনের মওসুম চলছে। যেমন, ধান, আম, লিচু, কাঁঠাল ইত্যাদি। হানাফি মাযহাব অনুসারে আপনার ফসল যত পরিমাণই হোক উশর আদায় করতে হবে। আর অবশ্যই যদি আপনার সম্পদ ৭২০ কেজির বেশি হয় তবে কোনভাবেই আপনি উশর আদায় এড়াতে পারবেন না।

২৬ এপ্রি, ২০২০

বঙ্গকথা পর্ব-৩৬ : নিজের নাক কেটে মুসলিমদের যাত্রা ভঙ্গ করলো মুশরিকরা



১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ হওয়ার পর থেকে এদেশে অর্থাৎ বাংলাদেশে অবকাঠামো উন্নয়ন হতে শুরু করে। ঢাকাকে রাজধানী করার জন্য যা যা করা দরকার তার প্রস্তুতি শুরু হয়। যদিও ঢাকা পূর্বেই শহর ছিল তবে প্রায় ১৫০ বছর এর কোনো উন্নয়ন হয়নি। ফলে এর অবস্থা ছিল শোচনীয়। এখানে আরেকটি তথ্য বলে রাখা দরকার গোড়া থেকেই ইংরেজদের রাজধানী ছিল বাংলায় তথা কলকাতায়। কলকাতা থেকেই সারা ভারতবর্ষ শাসন করতো তারা। ফলে স্বভাবতই কলকাতা বড় শহরে পরিণত হলো এবং কলকাতা কেন্দ্রীক ইংরেজদের পোষ্য সিভিল সোসাইটি ও বুদ্ধিজীবী শ্রেণী তৈরি হলো। ঢাকাকে রাজধানী করার জন্য অনেকক্ষেত্রেই সেই সিভিল সোসাইটির সাহায্য ইংরেজ সরকার পায়নি। এর মধ্যে কলকাতায় শুরু হয়েছে সন্ত্রাসবাদী আন্দোলন। সব সমস্যা উত্তরণ করে ঢাকাকে প্রতিষ্ঠিত করতে চাইলো ইংরেজরা।

তাই বাংলায় সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে ইংরেজ সরকার কর্তৃক কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছিল। সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসী ক্ষুদিরামকে ফাঁসী দেওয়া হলো। আরেক বড় সন্ত্রাসী প্রফুল্ল চাকী নিজেই আত্মহত্যা করলো। ফলে এ আন্দোলন ক্রমশঃ স্তিমিত হয়ে পড়েছিল। ১৯১০ সালের শেষে পরিস্থিতি স্বাভাবিকের দিকে ফিরে আসছিল। আন্দোলনের যোদ্ধারা একরকম রণক্লান্ত হয়ে পড়েছিল। এ বৎসরেই জনৈক বাঙালি হিন্দু ব্যবস্থাপক সভায় বিষয়টি নতুন করে উত্থাপন করতে গিয়ে ব্যর্থ হন। পরে তিনি তাঁর প্রস্তাব প্রত্যাহার করতে সম্মত হন। স্যার সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জি ছিলেন আন্দোলনের উদ্যোক্তা। তিনিও সবশেষে তাঁর ‘বাঙালী’ পত্রিকার মাধ্যমে বলেন, “আমরা অবশ্য স্বীকার করি যে এ বিভাগ টিকে থাকার জন্যে হয়েছে এবং আমরা একে বানচাল করতে চাইনা”। সুরেন্দ্রনাথ বাবুর এই কথার পর আর বঙ্গভঙ্গ রদ হওয়ার কোনো কারণ থাকতে পারে না। কিন্তু তারপরও হয়েছিল। এর কারণ ছিলো কলকাতা কেন্দ্রীক বুদ্ধিজীবী। যেটা সন্ত্রাসবাদীরা পারেনি সেটাই পেরেছে বুদ্ধিজীবীরা।

রাজা পঞ্চম জর্জ ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের সিংহাসনে আরোহণের প্রাক্কালে তিনি সর্বাপেক্ষা বড় উপনিবেশকে নিজের মতো সাজাতে ও নিয়ন্ত্রণ করতে চাইলেন। সেক্ষেত্রে তিনি এই অঞ্চলের মানুষের প্রিয়ভাজন হওয়ার চেষ্টা করলেন। তারই সূত্রে বুদ্ধিজীবীরা তাকে নানান পরামর্শ দিয়েছিলো। রাজাও তার কিছু সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করেছেন। তিনি তার অভিষেক নিজের মুখে ঘোষণা করার জন্য ১৯১১ সালে ভারতে আগমন করেন। ওনার আসার সময় ভারতবর্ষ স্থিতিশীল ছিল না। বস্তুত ইংরেজদের অপশাসনের কারণে এখানে কখনোই স্থিতিশীল অবস্থা ছিল না। 

বাংলার সন্ত্রাসবাদীরা স্থিমিত হলেও তারা পুরোপুরি হারিয়ে যায়নি। সুযোগের অপেক্ষা করছিলো। ভারতে তখন দুর্ভিক্ষ বিরাজমান। ইতালী-তুর্কী যুদ্ধের কারণে মুসলমানরা বিক্ষুব্ধ। এসব কারণে পঞ্চম জর্জের মন্ত্রীরা ভারত সফর উচিত হবে না বলে পরামর্শ দেন। কিন্তু রাজা সকল পরামর্শ উপেক্ষা করে ভ্রমণের প্রস্তুতি করতে থাকেন। নভেম্বর মাসে ভারতের উদ্দেশ্যে যাত্রা করে ডিসেম্বরের শুরুতে তিনি বোম্বাই বর্তমানে মুম্বাই পৌঁছান। ভারতবাসীর তিনি কিছু পুরস্কার ঘোষণা করতে চাইলেন। জাঁকজমকপূর্ণ সমাবেশে ভাবগম্ভীর পরিবেশে রাজা পঞ্চম জর্জ রাজ্যাভিষেক ঘোষণা করলেন। সাথে সাথে তিনি ভারতবর্ষের আস্থা অর্জন করার জন্য কিছু ঘোষণা দেন।
  
১- সকল রাজনৈতিক বন্দীদের প্রতি সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেন 
২- শিক্ষার উন্নয়নে মোটা রকমের অংক বরাদ্দ করেন; 
৩- ভারতীয় সৈনিকদের জন্যে ‘ভিক্টোরিয়া ক্রস’ সম্মান লাভের অযোগ্যতা দূর করা হলো, 
৪- অল্প বেতনভূক্ত সরকারী কর্মচারীদেরকে অতিরিক্ত অর্ধ মাসের বেতন দেয়া হলো; 
৫- ভারতের রাজধানী কলকাতা থেকে দিল্লী স্থানান্তরিত করা হলো। 
৬- সর্বশেষে বলা হলো ‘বঙ্গভঙ্গ’ রদ করা হলো। 

বাংলার হিন্দুগণ আনন্দ উল্লাসে ফেটে পড়লো। বঙ্গভঙ্গ বাতিলের ঘোষণা দ্বারা তাৎক্ষণিক সুবিধা এই হলো যে, ভারত সাম্রাজ্যের হিন্দু সাম্প্রদায়িক অধ্যুষিত অঞ্চলগুলির মধ্য দিয়ে রাজদম্পতির নিরাপদ ভ্রমণের নিশ্চয়তা পাওয়া গেল। কিছুদিন পর যখন রাজা কলকাতায় এলেন, তখন হিন্দুরা আনন্দে আত্মহারা হয়ে রাজা ও ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের প্রতি তাদের অসীম আনুগত্য প্রদর্শন করে বিরাট বিরাট শোভাযাত্রা করে। হিন্দু সংবাদপত্র এতদূর পর্যন্ত অগ্রসর হয় যে, হিন্দু মন্দিরে রাজা ও রাণীর মুর্তি স্থাপনের প্রস্তাব করে। ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস রাজার প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করে প্রস্তাব গ্রহণ করে এবং লর্ড হার্ডিঞ্জের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়। 

বঙ্গভঙ্গের ফলে তাদের যতটুকু ক্ষতি তার চাইতে বড় ক্ষতি হয়ে গেল এখন। কিন্তু তারপরও তারা খুশি কারণ মুসলিমদের কোন উপকার হয়নি। নিজের নাক কেটে অপরের যাত্রা ভঙ্গ করার মতো হিংসুক জাতি বাংলার এই মুশরিকরা। কলকাতা ছিল পুরো ভারতবর্ষের রাজধানী। সেখান থেকে হয়ে শুধু বাংলার রাজধানী। লাভ হলো শুধু বাংলা আয়তন একটু বেড়েছে। আবার আগের মতো বড় হয়নি। তাদের এত বড় ক্ষতি হওয়ার পরও তারা রাজার সাথে এরকম সিদ্ধান্তে সম্মত হয় শুধুমাত্র মুসলমানদের উন্নতি ঠেকানোর জন্য। কার্যত এটা মুসলিমদের জন্য অকল্যাণ মনে হলেও এর প্রভাব হয়েছে সুদূরপ্রাসারী। এটা মুসলিমদের স্বাধীনতার জন্য আলাদা করে ভাবতে শিখিয়েছে। পাশ্চাত্য পড়াশোনা করা মুসলিম নেতারা হিন্দুদের সম্পর্কে সচেতন হয়েছেন। হিন্দুদের সাথে একরাষ্ট্রে থাকা সম্ভবপর নয় এই চরমসত্য তাদের উপলব্দি হয়েছে। স্বাধীনতা আন্দোলন আলাদাভাবে করতে হবে এটা তারা বুঝে নিয়েছেন। যদিও পাশ্চাত্য ভাবধারার মুসলিমরা বুঝেছেন কিন্তু দেওবন্দ আন্দোলনের মুসলিমরা এক অজানা প্রলোভনে সারাসময় মুশরিকদের সাথেই জোট করে ছিলেন। দেওবন্দ আন্দোলনের মুসলিমরা মুসলিম লীগে যোগ দিতে ব্যর্থ হয়েছেন। ফলে তারা মুসলিমদের নেতৃত্ব দেওয়ার যোগ্যতা হারিয়েছেন।   

যাই হোক রাজা পঞ্চম জর্জের ঘোষণার পরিপ্রেক্ষিতে পূর্ব ও পশ্চিমবাংলাকে সংযুক্ত করে যুক্তবঙ্গীয় প্রদেশ সৃষ্টি করা হলো। এ প্রদেশ থেকে আসামকে সরিয়ে নেওয়া হলো। বাংলা থেকে বিচ্ছিন্ন করা হলো বিহার ও উড়িষ্যাকে। এই দুই এলাকা নিয়ে গঠন করা হলো একটি স্বতন্ত্র প্রদেশ। ফলে দেখা গেল বাংলা প্রদেশ আদতে ছোট হয়ে গেল। আর ব্রিটিশ-ভারতের দেড়শ’ বছরের পুরনো রাজধানী স্থানান্তর করা হলো কলকাতা থেকে দিল্লীতে। কলকাতার বর্ণহিন্দুরা নিজেদের নাক কেটে পরের যাত্রা ভঙ্গ করলেন এবং ‘জনগণ-মন-অধিনায়ক হে ভারত-ভাগ্য বিধাতা’ বলে পুরনো সুরে ব্রিটিশ-প্রভুর জয়গান গাইলেন। ইংরেজ শাসকরাও অল্পকালের মধ্যেই প্রমাণ পেলেন যে, কলকাতার বাইরে ভারতের আর কোথাও তাদের জন্য ‘অভয়াশ্রম’ ছিল না। ১৯১২ সালের ৩০ ডিসেম্বর দিল্লীতে ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন উপলক্ষে চকবাজার থেকে মিছিল বের হলো বড়লাটের নেতৃত্বে। এই মিছিলে বড়লাট হার্ডিঞ্জের র‍্যালির ওপর বোমা নিক্ষিপ্ত হলো। প্রাচীন রাজধানী দিল্লী এভাবেই ইংরেজদেরকে পুষ্পরেণুর বদলে বারুদ ছিটিয়ে স্বাগত জানালো।

বঙ্গভঙ্গ রদের ফলে শুধু বাংলাদেশ নয়, গোটা ভারতের মুসলমানগণ স্তম্ভিত হলেন। দারুণভাবে আহত হলেন ঢাকার নবাব সলীমুল্লাহ। বাংলার বাইরের মুসলিম নেতাদের সবচেয়ে বেশি প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করলেন নবাব ওয়াকার উল মুলক। তিনি উত্তর প্রদেশের মীরুটের নবাব ছিলেন। দিল্লীর দরবার থেকে ফিরে এসে বঙ্গভঙ্গ রদের মাত্র এক সপ্তাহ পর ১৯১১ সালের ২০ ডিসেম্বর তিনি আলীগড় ইন্সটিটিউট গেজেটে ‘ভারতীয় মুসলমানদের কর্মপন্হা’ নামে এক আবেগময় প্রবন্ধ লিখলেন। তাতে তিনি বলেন,

“বঙ্গভঙ্গ রদ করে সরকার মুসলমানদের প্রতি অন্যায় উদাসীনতা দেখিয়েছেন। তাই আমাদেরকে অবশ্যই বিকল্প কর্মপন্হার কথা ভাবতে হবে। মধ্যদিনের আলোকিত সূর্যের মতোই এটা এখন পরিস্কর হয়ে গেছে যে, মুসলমানদেরকে সরকারের ওপর নির্ভরশীল থাকার পরামর্শ দেওয়া অর্থহীন। কারোর ওপর ভরসা করার সময় এখন উত্তীর্ণ। নিজেদের শক্তির ওপরই আমাদেরকে নির্ভর করতে হবে। আমাদের গৌরবান্বিত পূর্ব-পুরুষগণ আমাদের জাতির জন্য সে নজির রেখে গেছেন”। দিল্লীর দরবারে উপস্থিত উপমহাদেশের মুসলিম নেতৃবৃন্দের সাথে পরামর্শ করে নবাব সলীমুল্লাহ ওয়াকার উল মূলক-এর প্রবন্ধ প্রকাশের একই তারিখে অর্থাৎ ১৯১১ সালের ২০ ডিসেম্বর লর্ড হার্ডিঞ্জের কাছে বাংলার মুসলমানদের পক্ষ থেকে আট দফা দাবি সম্বলিত একটি পত্র পেশ করেন। সেই আট দফা দাবি হলো,

১. বঙ্গ প্রেসিডেন্সির গভর্নর কলকাতা ও ঢাকা এই উভয় রাজধানীতে সমভাবে অবস্থান করবেন;
২. বঙ্গ প্রেসিডেন্সির মুসলমানদেরকে স্বতন্ত্র নির্বাচনের মাধ্যমে সংখ্যানুপাতিক হারে ব্যবস্থাপক পরিষদ ও স্থানীয় স্বায়ত্তশাসিত সংস্থাসমূহে সুযোগ দিতে হবে;
৩. পূর্ববঙ্গের জন্য স্বতন্ত্রভাবে বার্ষিক বাজেট প্রণয়ন করতে হবে অথবা পূর্ববঙ্গের রাজম্ব এখানকার জেলাসমূহের শাসন-ব্যবস্থা ও উন্নয়ন খাতে ব্যয় করতে হবে;
৪. সরকারি চাকরিতে আরো অধিকহারে মুসলমানদের নিয়োগ করতে হবে। এবং পালাক্রমে একজন হিন্দুর পর একজন মুসলমান সদস্য বঙ্গ প্রেসিডেন্সির এক্সিকিউটিভ কাউন্সিলে নিয়োগ করতে হবে;
৫. এক্সিকিউটিভ কাউন্সিলে এমন একজন অফিসার থাকতে হবে, যিনি পূর্ববাংলার প্রশাসনিক কার্যাবলী পরিচালনার ব্যাপারে অভিজ্ঞতা সম্পন্ন;
৬. ঢাকা ও চট্টগ্রাম বিভাগে এমন দু’জন কমিশনার নিয়োগ করতে হবে, যাদের অনুরূপ অভিজ্ঞতা রয়েছে। পূর্ববাংলা ও আসামের মুলমানদের শিক্ষা সংক্রান্ত বিষয় তত্ত্বাবধানের জন্য একজন যুগ্ম পরিচালক বা সহ-পরিচালক নিয়োগ করতে হবে;
৭. মুসলমানদের উচ্চশিক্ষা খাতে বিশেষ অনুদানের ব্যবস্থা করতে হবে;
৮. মাদরাসা শিক্ষা সংস্কারের উদ্দেশ্যে পূর্ববঙ্গ ও আসাম প্রাদেশিক সরকার কর্তৃক গঠিত কমিটির সুপারিশসমূহ বাস্তবায়ন করতে হবে।

১৯১২ সালে মার্চ মাসে কোলকাতায় অনুষ্ঠিত মুসলিম লীগ অধিবেশনের সভাপতির ভাষণে নবাব খাজা সলিমুল্লাহ বলেন, বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে আন্দোলন থেমে যাওয়ার পর প্রসঙ্গটি পুনরায় উত্থাপনের কোন ন্যায়সংগত কারণ কোন দায়িত্বশীল বিবেক সম্পন্ন ব্যক্তি আবিষ্কার করতে পারেনি। এ বিভাগ ১৯০৫ সালে অনুষ্ঠিত হয়ে ১৯১১ পর্যন্ত বলবৎ ছিল। মুসলমানদের আশা আকাঙ্ক্ষার সম্ভাবনা দেখে আমাদের শত্রুগণ ব্যথিত হয়ে পড়লেন। প্রকৃতপক্ষে বিভাগের ফলে আমরা তেমন বিশেষ কিছুই লাভ করিনি। যতটুকুই লাভ করেছিলাম আমাদের প্রতিবেশী অন্যসম্প্রদায় স্বর্গমর্ত্য আলোড়ন সৃষ্টি করে তাও আমাদের নিকট থেকে কেড়ে নিল। হত্যা ও দস্যুবৃত্তি করে তারা প্রতিশোধ গ্রহণ করলো, তারা বিলাতী দ্রব্যাদি বর্জন করলো। সরকার এতে কিছুই মনে করলেন না। এসব হত্যাকান্ডে মুসলমানগণ অংশগ্রহণ না করে সরকারের প্রতি অনুগতই রইলো। বিভাগের ফলে মুসলমান কৃষককুল লাভবান হলো। হ্নিদু জমিদারগণ তাদেরকে আন্দোলনে টেনে নামাবার চেষ্টা করলো। কিন্তু তারা কর্ণপাত করলো না। এত করে হিন্দু মুসলিম সংঘর্ষ শুরু হলো। সরকার দমননীতি অবলম্বন করলেন। তাতে ফল হলো না। একদিকে ছিল সম্পদশালী বিক্ষুব্ধ সম্প্রদায় এবং অপরদিকে দরিদ্র মুসলমান এবং এরা ছিল সরকারের সাথে। এভাবে কয়েক বৎসর অতিবাহিত হলো। আকস্মিকভাবে সরকার বিভাগ রদ করে দিলেন। এ বিষয়ে আমাদের সাথে কোন আলাপ আলোচনাও করা হলো না। (Ahmed, Ruh-i-Raushan Mustaqbil, pp 58-59; A. Hamid:Muslim Separatism in India, p.92)

এ সম্পর্কে বাংলার মুসলিম নেতা এ কে ফজলুল হক বঙ্গীয় ব্যবস্থাপক সভায় ১৯১৩-১৪ সালের বাজেট অধিবেশনে যে বক্তৃতা করেন তা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তিনি তাঁর বক্তৃতায় বলেন, //ভারত সরকারের ২৫শে আগষ্টের প্রতিবেদনে প্রতিশ্রুতি দেয়া হয় যে, বঙ্গভঙ্গ রদের দরুন যে পরিবর্তন সাধিত হয়, তার দ্বারা মুসলিম স্বার্থ ক্ষুণ্ণ হবে না, তারপর আঠার মাস অতিবাহিত হয়ে গেল এবং এখন দেখার সময় এসেছে তাঁরা তাঁদের প্রতিশ্রুতি কতখানি পালন করেন। দিল্লী দরবারের ঘোষণার অল্পদিন পর বড়লাট যখন ঢাকায় পদার্পন করেন, তখন প্রত্যেকেই আশা করেছিল যে, মুসলমানদের সন্তুষ্টি বিধানের জন্য তিনি কোন একটা ঘোষনা করবেন। অবশ্য আমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ঘোষণা শুনতে পেয়েছি। কিন্তু আমি অবশ্যই বলব যে আমরা যা আশা করেছিলাম, সেদিক দিয়ে এ অতি তুচ্ছ। আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গুরুত্বকে ছোট করতে চাই না। কারণ, পূর্ব বাংলার শিক্ষার উন্নয়নে যে অন্তরায় সৃষ্টি হয়েছিল, তা এর দ্বারা বিদূরিত হবে। একটি মুসলিম কেন্দ্রে একটি আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অশেষ সুযোগ সুবিধার কথাও অস্বীকার করিনা। 

কিন্তু এই যে বলা হচ্ছে এ বিশ্ববিদ্যালয়টি শুধু মুসলমানদের উপকারার্থে করা হচ্ছে অথবা এটা হচ্ছে মুসলমানদের খুশী করার একটা বিশিষ্ট পদক্ষেপ, আমি এসবের প্রতিবাদ করছি। বড়লাট সুস্পষ্টভাবে বলেছেন, ‘এ বিশ্ববিদ্যালয় হিন্দু মুসলমান উভয়েরই জন্যে এবং তাই হওয়া উচিত’। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে পরিকল্পিত একটি মুসলিম কলেজ এবং ফ্যাকাল্টি অব ইসলামিক স্টাডিজ – এটাকে মুসলমানদের প্রতি অনুগ্রহ করার অভিপ্রায় বলেও ধরা যেতে পারে না। কারণ অর্ধশতাব্দীর অধিককাল ধরে ষোল আনা শিক্ষক-কর্মচারী ও প্রয়োজনীয় সকল সরঞ্জামাদিসহ সরকার কোলকাতায় একটি একচেটিয়া হিন্দু-কলেজ চালিয়ে আসছেন এবং ঢাকায় একটি মুসলিম কলেজ হলে তা হবে মুসলমানদের দীর্ঘদিনের অবহেলিত দাবীর দীর্ঘসূত্রী স্বীকৃতি। 

ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ সম্পর্কে কথা এই যে, যে অঞ্চলে মুসলমানগণ দীর্ঘকাল যাবত আরবী ও ফার্সী শিক্ষার বাসনা পোষণ করে আসছে, সেখানকার বিশ্ববিদ্যালয়ের কারিকুলামের শুধু স্বাভাবিক ফলমাত্র এই ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ। এটা সকলের জানান না থাকতে পারে যে, পূর্ব বাংলার জেলাগুলি থেকে অধিক সংখ্যক ছাত্র বাংলাদেশের মাদ্রাসাগুলিতে পড়াশুনা করে এবং এই শ্রেণীর অধিবাসীদের প্রয়োজন পূরণ ও শিক্ষাগত যোগ্যতা অর্জনের কোন ব্যবস্থা ব্যতীত একটি বিশ্ববিদ্যালয় কিছুতেই ন্যায়সংগত হতোনা। আমি আশা করি সরকারি কর্মকর্থাগণ এ কথা উপলব্ধি করবেন যে, যদিও মুসলমানগণ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষেই রায় দিয়েছে, কিন্তু এটাকে এমনকি একটি মুসলিম কলেজ এবং ফ্যাকাল্টি অব ইসলামিক স্টাডিজকেও তাদের প্রতি কোন অনুগ্রহ বলে তারা মনে করে না।// 

ফজলুল হকের উপরের বক্তব্যে এ কথা সুস্পষ্ট হয়েছে যে, বঙ্গভঙ্গ, ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা তথা মুসলমানদের কোন সুযোগ সুবিধার ব্যাপারে হিন্দু ভারত ও ইংরেজদের মানসিকতা ও আচরণ কী ছিল। শুধু তাই নয় অসন্তুষ্ট মুসলিমদের শান্ত করার জন্য ইংরেজরা যে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার কথা বলেছে তা ঘোষণার সাথে সাথেই শুরু হয় এর বিরুদ্ধে আন্দোলন। যদিও এই আন্দোলন ধোপে টিকে নাই তবুও মুশরিকদের নীচু মানসিকতা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এখানেও ইংরেজরা তাদের আজ্ঞাবহ হিন্দুদের খুশি করেই বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে। এই যেহেতু শিক্ষা রিলেটেড বিষয় তাই এর জন্য সবচেয়ে বেশি লড়েছেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি আশুতোষ মুখোপাধ্যায়। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়কে আরো চারটি নতুন সাবজেক্ট যোগ করা,  কলকাতা থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক পাঠানো হবে, সিন্ডিকেটে আশুতোশ থাকবে এমন কিছু শর্তে তারা আন্দোলন থেকে নিজেদের সরিয়ে আনে।

আমরা যেভাবে সালাতুত তারাবীহ পেলাম



রাসূল সা.-এর জীবনের শেষ রামাদানের ঘটনা। একদিন রাতে রাসূল সা. মসজিদে নববীতে নামাজ পড়তে শুরু করলেন। এরকম আগে করেননি। আসহাবে সুফফার বাসিন্দারা তাঁর সাথে যুক্ত হয়ে নামাজ পড়লেন। রাসূল সা. মধ্যরাত পর্যন্ত নামাজ পড়েছেন। পরদিন এই ঘটনা আরো কয়েকজন সাহাবী জানলেন। তারাও রাতে মহানবীর সাথে যুক্ত হয়ে নামাজ আদায় করলেন। এই দিন আল্লাহর রাসূল আরো লম্বা করলেন নামাজ। প্রায় শেষ রাতের কাছাকাছি সময় চলে গিয়েছেন।

এর পরের দিন রাতে সবাই জেনে গেল মহানবী রাতে মসজিদে এসে নামাজ পড়েন। বরকত হাসিল করার জন্য অনেক সাহাবী জমা হয়ে গেলেন। তারাও রাসূলের সাথে নামাজ আদায় করবেন। কিন্তু তৃতীয় দিন রাসূল সা. তাঁর ঘর থেকে বের হলেন না। সাহাবারা অনেক্ক্ষণ অপেক্ষা করে ফিরে গেলেন। এর পরের বছর রাসূল সা. আরা রামাদান পাননি।

এই ঘটনা থেকে সাহাবারা যে মেসেজ নিয়েছেন তা হলো রামাদানের রাতে নামাজ পড়লে আল্লাহ খুশি হন। এমনিতেই রামাদানে নফলকে ফরজের মান দেওয়া হবে। তাই রামাদানে সৎ কাজ ও ইবাদত করার জন্য সাহাবারা প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হতেন। এর পরের দুই বছর খলিফা ছিলেন আবু বকর রা.। তার সময়ে সাহাবারা সবাই যার যার মতো নামাজ পড়তেন রাতে মসজিদে নববীতে। এভাবে চলতে থাকে।

এরপর খলিফা হন হযরত উমার রা.। তিনি দেখলেন মসজিদে নববীতে কেউ একা আবার কেউ খণ্ড খণ্ড জামায়াত করে রামাদানের রাতে নামাজ পড়ছেন। উমার রা. সুশৃঙ্খল মানুষ। তিনি এলোপাথাড়ি কাজ পছন্দ করতেন না। তাই তিনি অন্যান্য সাহাবাদের নিয়ে পরামর্শ করলেন। সিদ্ধান্ত হলো আমরা যেহেতু মসজিদে সবাই আসি তবে আমরা একসাথে নামাজ পড়ি। তিনি উবাই ইবনে কা'ব রা.-কে ইমাম বানিয়ে সবাইকে একসাথে জামায়াতে নামাজ আদায় করার নির্দেশ দিলেন। ওনার জামানায় বিভিন্ন বর্ণনায় রাকায়াত সংখ্যা বিভিন্ন পাওয়া যায়। ১১, ১৩, ২৩ এবং ৩৯ পর্যন্ত। উবাই ইবনে কা'বকে ইমামতিতে সহায়তা করার জন্য তামিম আদ দ্বারি রা.-কে সহকারি ইমাম নিয়োগ করেছেন এমন বর্ণনাও পাওয়া যায়। উমার রা.-এর শেষ বছরে বিশ রাকায়াত ও বিতর নামাজ যোগে তেইশ রাকায়াত হয়েছিলো বলে জানা যায়।

উসমান রা.-এর সময়ে বিশ রাকায়াত নামাজ পড়া হয়। এ সময় মসজিদে নববীতে ইমামতি করতেন আলী রা.। এই আমলে নতুন যেটা যোগ হয় তা হলো রাতের নামাজে কুরআন শেষ করার প্রচলন শুরু হয়। এরপর আসে হযরত আলী রা.-এর শাসনামল। এই আমলে যেটা পরিবর্তন পাওয়া যায় তা হলো তিনি পুরুষ ও মহিলাদের জন্য আলাদা ইমাম দিয়েছেন। মহিলাদের জন্য মহিলা ইমাম। আর এশা ও বিতর তিনি নিজে পড়াতেন। এ ছাড়া কোনো পরিবর্তন হয়নি। মসজিদে নববী ও কা'বায় বিশ রাকায়াতের মাধ্যমে কুরআন শেষ করার নিয়ম চালু থাকে।

এরপর মুয়াবিয়া রা.-এর আমলে সরকারিভাবে কোনো পরিবর্তন হয়নি বলেই জানা যায়। তবে মক্কা-মদিনাতে একটু পরিবর্তন আসে। এখানে আরো জানা দরকার। মদিনা তখন আর রাজধানী ছিলো না। হযরত আলী রাজধানী পরিবর্তন করে ইরাকের কুফায় নিয়ে গেছেন। তাঁর শাহদাতের পর কুফায় খলিফাতুল মুসলিমিন নির্বাচিত হন ইমাম হাসান রা.। হজরত মুয়াবিয়া রা. কুফা দখল করতে আসলে ইমাম হাসান কিছু শর্ত সাপেক্ষে হযরত মুয়াবিয়া রা.-এর কাছে ক্ষমতা ছেড়ে দেন। এরপর সিরিয়া হয় মুসলিম জাহানের রাজধানী। সেখানে নামাজের কোন পরিবর্তন হয়নি।

তবে মক্কা মদিনায় থাকা সাহাবারা রামাদানে সওয়াব হাসিল করার জন্য প্রতিযোগিতা করতেন। সেই সূত্রে এই পরিবর্তন। তারাবীহ সবসময় দুই রাকায়াত করে পড়া হতো। তবে চার রাকায়াতের পর সাহাবারা কিছুক্ষণ বিশ্রাম করতেন। এসময় তারা দোয়া করতেন ও তাসবিহ পাঠ করতেন। মুয়াবিয়া রা.-এর সময়ে মক্কার সাহাবারা চিন্তা করলেন বসে থেকে কী লাভ! আমরা এই সময়ে কা'বা তাওয়াফ করি। তখন কা'বায় প্রতি চার রাকায়াতের পর তাওয়াফ শুরু হয়। এভাবে তাঁরা নামাজের সময়ে চারবার তাওয়াফ করতেন।

এই খবর মদিনায় চলে যায়। তাঁরা চিন্তা করেন আমরা প্রতিযোগিতায় পেছনে পড়ে যাচ্ছি। তাই তাঁরা রাকায়াত সংখ্যা দিলেন বাড়িয়ে। প্রতি তাওয়াফের জন্য চার রাকায়াত বাড়িয়ে মোট ৩৬ রাকায়াত পড়া শুরু করলেন। এভাবে চলে কিছু বছর। এরপর যখন উমাইয়া খলিফা উমার ইবনে আব্দুল আজিজ ক্ষমতায় আসেন তখন আবার পরিবর্তন হয়। উমার ইবনে আব্দুল আজিজকে ইসলামের পঞ্চম খলিফা হিসেবেও অবিহিত করা হয়। উমাইয়া শাসকদের ভোগ বিলাস তিনি বন্ধ করে আবার খুলাফায়ে রাশেদার নীতিতে রাষ্ট্র পরিচালনা করা শুরু করেন। তিনি মক্কা মদিনাতে এভাবে চলা তারাবীহকে আবার হযরত আলী রা.-এর আমলের মতো করে ফেলেন। মক্কায় আনুষ্ঠানিক তাওয়াফ বন্ধ করেন এবং মদিনায় অতিরিক্ত ১৬ রাকায়াত বাদ দেন।

এরপর থেকে আমার জানামতে আর কোনো পরিবর্তন হয়নি। এভাবেই চলছে। হযরত আলী রা.-এর নিয়ম অনুসারে যিনি মসজিদের নিয়মিত ইমাম তিনি এশা ও বিতর পড়ান। নতুন নিয়োগকৃত হাফেযরা তারাবীহ পড়েন।

তারাবীহ নামাজের নাম তারাবীহ আনুষ্ঠানিকভাবে হয়নি। সাহাবারা বলতে বলতে এর নাম ধীরে ধীরে তারাবীহ হয়ে পড়ে। তারাবীহ মানে হলো বিশ্রাম। যেহেতু তারাবীহ পড়তে গিয়ে বিশ্রাম নিতে হতো তাই তাঁরা বিশ্রামের নামাজ বলতে বলতে এই এর নাম সালাতুত তারাবীহ হয়ে পড়ে।

আমাদের জন্য করণীয় কী?
আমাদের জন্য উত্তম হলো মসজিদে জামায়াতের সাথে তারাবীহ আদায় করা। যে মসজিদে যত সংখ্যক রাকায়াত হয় তত সংখ্যক পড়া। আর মসজিদের কর্তৃপক্ষের জন্য উচিত হলো বিশ রাকায়াত নামাজ কুরআন খতমের সাথে আদায়ের ব্যবস্থা করা। এটা উত্তম। জরুরি নয়। এটা নফল বা অতিরিক্ত নামাজ। কেউ যদি এই নামাজ না পড়েন, কম পড়েন বা বেশি পড়েন তবে তাঁর কোনো সমস্যা নেই এবং রোজার কোনো ক্ষতি হবে না। তবে মসজিদে যত রাকায়াত পড়া হয় আপনি যদি তার সাথে ভিন্নতা করেন তবে উচিত হবে বাসায় পড়া। অবশ্যই মসজিদে ও সমাজে বিতর্ক সৃষ্টি করা, ফিতনা তৈরি করা বড় গুনাহ।

আল্লাহ তায়ালা আমাদের সহীহ বুঝ দান করেন। আমীন।

বি. দ্র.: এ বছর মহামারির জন্য উত্তম হলো বাসায় তারাবীহ আদায় করা।

২০ এপ্রি, ২০২০

আল্লাহ কী মুসলিমদের বিরুদ্ধে মুশরিকদের বিজয় দান করেছেন?



একটি ঐতিহাসিক ঘটনাকে পুঁজি করে কিছু মুশরিক ইতিহাসবিদ এমন দাবি করেন। আগে সেই ঘটনা ও তার পূর্বাপর কিছু ইতিহাস জেনে নিই। 

৫২৫ সালের। তখন ঈসা আ.-এর অনুসারীদের মুসলিম বলা হতো। তবে বেশিরভাগ মুসলিমই বিকৃতির শিকার হয়ে পড়েছিলেন। তারা ঈসা আ.-কে আল্লাহর সাথে জড়িয়ে শিরকে লিপ্ত ছিল। তখন মক্কার প্রতিবেশী অঞ্চল ইয়েমেনে শাসক ছিলেন জুনুয়াস বা জু নাওয়াস। সে ছিল ইয়াহুদি। সে মুসলিমদের ওপর ব্যাপক নির্যাতন শুরু করে। বহু মুসলিমকে হত্যা করে। ইয়েমেনের একজন মুসলিম যার নাম দাউস জু সালাবান তিনি রোমে (ইতালি) হাজির হন এবং রোমের বাদশাহের কাছে ইয়াহুদিদের নির্যাতনের কথা বর্ণনা করেন। 

ইতালির শাসকদের বলা হতো কায়সার। তারা ছিলেন খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বী অর্থাৎ মুসলিম। তিনি আবিসিনিয়ার বাদশাহ নাজ্জাশীকে লিখলেন, তিনি যেন দাউস জু সালাবানের সঙ্গে একটি বাহিনী পাঠিয়ে দেন এবং ইয়াহুদিদের শায়েস্তা করেন। আবিসিনিয়া মানে বর্তমানের ইথিওপিয়া। ইথিওপিয়া থেকে অল্প সমুদ্র পাড়ি দিলেই ইয়েমেন। ইথিওপিয়াতেও মুসলিমদের শাসন। বাদশাহ নাজ্জাশী আমীর ইবনে ইরবাতকে সৈন্য পরিচালনার দায়িত্ব দিয়ে এক বিরাট সেনাবাহিনী জুনুয়াসের বিরুদ্ধে প্রেরণ করেন। এই সৈন্যদল ইয়েমেনে পৌঁছলো এবং সহজেই ইয়াহুদিদের পরাজিত করলো। জুনুয়াস পালিয়ে গেল এবং সমুদ্রে ডুবে মৃত্যুবরণ করলো। এরপর সমগ্র ইয়েমেন আবিসিনিয়ার কর্তৃত্বে চলে গেল। সৈন্যাধ্যক্ষ হিসেবে আগমনকারী সর্দার ইয়েমেনে বসবাস করতে লাগলো। 

কিন্তু অল্প কিছুদিন পরই তার সাথে তার অধীনস্ত কমান্ডার আবরাহা ইবনে সাহাবের মধ্যে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব দেখা দিলো। আমীর ইবনে ইরবাত আবরাহার ওপর আক্রমণ করলো এবং তরবারীর এক আঘাতে তার চেহারা রক্তাক্ত করে ফেললো। নাক, ঠোট এবং চেহারার বেশ কিছু অংশ কেটে গেল। এই অবস্থা দেখে আবরাহার ক্রীতদাস আদাহ্ এক অতর্কিত আক্রমণ চালিয়ে ইরবাতকে হত্যা করে ফেললো। আবরাহা ইয়েমেনের শাসনকর্তা হয়ে বসলো। আবিসিনিয়ার বাদশাহ নাজ্জাশী এ খবর পেয়ে খুবই ক্রুদ্ধ হলেন এবং পত্রে জানালেন, “আল্লাহর কসম! আমি তোমার শহরসমূহ ধ্বংস করবো এবং তোমার টিকি কেটে আনবো।” 

আবরাহা অত্যন্ত বিনয়ের সাথে এ পত্রের জবাব লিখলো এবং দূতকে নানা প্রকারের উপহার, একটা থলের মধ্যে ইয়েমেনের মাটি এবং নিজের মাথার কিছু চুল কেটে নাজ্জাশীর কাছে পাঠালো। তাছাড়া চিঠিতে সে নিজের অপরাধের ক্ষমা চেয়ে লিখলো, “ইয়ামনে মাটি এবং আমার মাথার চুল হাজির রয়েছে, আপনি নিজের কসম পূর্ণ করুন এবং আমার অপরাধ ক্ষমা করে দিন!" এতে নাজ্জাশী খুশি হলেন এবং ইয়েমেনের শাসনভার আবরাহাকে লিখে দিলেন। তারপর আবরাহা নাজ্জাশীকে লিখলো, “আমি ইয়ামনে আপনার জন্যে এমন একটি গীর্জা তৈরি করছি যে, এরকম গীর্জা ইতোপূর্বে পৃথিবীতে কখনো তৈরি হয়নি। অতি যত্ন সহকারে খুবই মযবুত ও অতি উঁচু করে ঐ গীর্জাটি নির্মিত হলো। ঐ গীর্জার চূড়া এতো উঁচু ছিল যে, চূড়ার প্রতি টুপি মাথায় দিয়ে তাকালে মাথার টুপি পড়ে যেতো। আরববাসীরা ঐ গীর্জার নাম দিয়েছিল কালিস' অর্থাৎ টুপি ফেলে দেওয়া গীর্জা। 
সেসময় মুসলিমরা কাবায় হজ্ব করলেও কাবা ছিলো মুশরিক কুরাইশদের নিয়ন্ত্রণে। এই নিয়ে তৎকালীন মুসলিমদের মধ্যে একটা আক্ষেপ ছিলো। আবার কুরাইশদের একটি ভালো গুণ ছিলো তারা কারো জন্য কাবা বন্ধ করেনি। যে যার বিশ্বাসমতে কাবায় হজ্ব করতো। আবরাহা পরিকল্পনা করলো যে, জনসাধারণ কাবায় হজ্ব না করে বরং এ গীর্জায় এসে হজ্ব করবে। এটলিস্ট যারা ঈসা আ.-কে অনুসরণ করে তারা কাবায় না গিয়ে কালিস গীর্জায় আসবে। কিন্তু আবরাহার এই ঘোষণা ছিলো ইসলামবিরোধী। কারণ হজ্বের জন্য কাবা ফিক্সড। কাবা ছাড়া অন্য কোথাও হজ্ব হবে না। 

আবরাহা ইয়েমেনে ঘোষণা করে দিল এখন থেকে হজ্ব হবে কালীসে। আবিসিনিয়াতেও জানিয়ে দিলো এবং নাজ্জাশীকে সম্মানের সাথে আহবান করা হলো। পুরো অনুষ্ঠান নাজ্জাশীকে সম্মান করে হবে বিধায় নাজ্জাশী ইসলামের বিরুদ্ধে গেলেও এই সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ করেনি। কিন্তু ইয়েমেনের ধর্মপ্রাণ মুসলিম গোত্র আদনানিয়্যাহ ও কাহতা নিয়্যাহ গোত্র এ ঘোষণায় খুবই অসন্তুষ্ট হন এবং কুরায়েশরা ভীষণ রাগান্বিত হয়। অল্প কয়েকদিন পরে দেখা গেল যে, এক ব্যক্তি রাতের অন্ধকারে ঐ গীর্জায় প্রবেশ করে পায়খানা করে এসেছে। প্রহরীরা পরের দিন এ অবস্থা দেখে বাদশাহ আবরাহার কাছে খবর পাঠালো এবং অভিমত ব্যক্ত করলো যে, কুরাইশরাই এ কাজ করেছে। তাদের মর্যাদা ক্ষুন্ন করা হয়েছে বলেই এ কাণ্ড তারা করেছে। আবরাহা তৎক্ষণাৎ কসম করে বললো, “আমি মক্কার বিরুদ্ধে অভিযান চালাবো এবং কাবার প্রতিটি ইট পর্যন্ত খুলে ফেলবো।” ইবনে কাসীর বলেছেন, এমন বর্ণনাও পাওয়া যায় কয়েকজন উদ্যোগী কুরাইশ যুবক ঐ গীর্জায় আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছিল। 

যাই হোক, এর পর ক্রুদ্ধ আবরাহা এক বিরাট বাহিনী নিয়ে মক্কা অভিমুখে রওনা হলো। তাদের সাথে এক বিরাট উঁচু ও মোটা হাতি ছিল। ঐরূপ হাতি ইতোপূর্বে কখনো দেখা যায়নি। হাতিটির নাম ছিল মাহমুদ। বাদশাহ নাজ্জাশী মক্কা অভিযান সফল করার লক্ষ্যে ঐ হাতিটি আবরাহাকে দিয়েছিল। ঐ হাতির সাথে আবরাহা আরো আটটি অথবা বারোটি হাতি নিলো। তার উদ্দেশ্য ছিল যে, সে বায়তুল্লাহর দেয়ালে শিকল বেঁধে দিবে, তারপর সমস্ত হাতির গলায় ঐ শিকল লাগিয়ে দিবে। এতে শিকল টেনে হাতিগুলো সমস্ত দেয়াল একত্রে ধ্বসিয়ে দিবে।

মক্কার অধিবাসীরা এ সংবাদ পেয়ে দিশেহারা হয়ে পড়লো। যে কোনো অবস্থায় এর মুকাবিলা করার তারা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলো। জুনফর নামক ইয়ামনের একজন রাজ বংশীয় লোক নিজের গোত্র ও আশে পাশের বহু সংখ্যক আরবকে একত্রিত করে আবরাহার মুকাবিলা করলেন। জুনফর পরাজিত হলেন এবং আবরাহার হাতে বন্দী হলেন। যুনফরকেও সঙ্গে নিয়ে আবরাহা মক্কার পথে অগ্রসর হলো। খাশআম গোত্রের এলাকায় পৌঁছার পর নুফায়েল ইবনে হাবীব আশআমী একদল সৈন্য নিয়ে আবরাহার মুকাবিলা করলেন। কিন্তু তারাও আবরাহার হাতে পরাজয়বরণ করলেন। নুফায়েলকেও জুনফরের মত বন্দী করা হলো। আবরাহা প্রথম নুফায়েলকে হত্যা করার ইচ্ছা করলো, কিন্তু পরে মক্কার পথ দেখিয়ে নেয়ার উদ্দেশ্যে জীবিতাবস্থায় সঙ্গে নিয়ে চললো। 

তায়েফের উপকণ্ঠে পৌঁছলে সাকীফ গোত্র আবরাহার সাথে সন্ধি করলো যে, লাত মূর্তিটি যে কক্ষে রয়েছে, আবরাহার সৈন্যরা ঐ কক্ষের কোনো ক্ষতিসাধন করবে না। সাকীফ গোত্র আবু রিগাল নামক একজন লোককে পথ দেখিয়ে দেওয়ার জন্যে আবরাহার সঙ্গে দিলো। মক্কার কাছে মুগমাস নামক স্থানে তারা অবস্থান করলো। আবরাহার সৈন্যেরা আশেপাশের জনপদ এবং চারণভূমি থেকে বহু সংখ্যক উট এবং অন্যান্য পশু দখল করে নিলো। এগুলোর মধ্যে রাসূল সা.-এর দাদা আবদুল মুত্তালিবের দুইশত উটও ছিল। 

অতঃপর আবরাহা নিজের বিশেষ দূত হানাতাহ হুমাইরীকে বললো, তুমি মক্কার সর্বাপেক্ষা বড় সর্দারকে আমার কাছে ডেকে নিয়ে এসো এবং ঘোষণা করে দাও আমরা মক্কাবাসীদের সাথে যুদ্ধ করতে আসিনি, কাবা ভেঙ্গে ফেলাই শুধু আমাদের উদ্দেশ্য। তবে হ্যাঁ, মক্কাবাসীরা যদি কাবাগৃহ রক্ষার জন্যে এগিয়ে আসে এবং আমাদেরকে বাধা দেয় তাহলে বাধ্য হয়ে আমাদেরকে তাদের সাথে যুদ্ধ করতে হবে। হানাতাহ মক্কার জনগণের সাথে আলোচনা করে বুঝতে পারলো যে, আবদুল মুত্তালিব ইবনে হাশেমই মক্কার বড় নেতা। হানাতাহ আবদুল মুত্তালিবের সামনে আবরাহার বক্তব্য পেশ করলে আবদুল মুত্তালিব বললেন, “আল্লাহর কসম! আমাদের যুদ্ধ করার ইচ্ছাও নেই এবং যুদ্ধ করার মত শক্তিও নেই।” আল্লাহর সম্মানিত ঘর। তাঁর প্রিয় বন্ধু হযরত ইবরাহীমের জীবন্ত স্মৃতি। সুতরাং আল্লাহ ইচ্ছা করলে নিজের ঘরের হিফাজত নিজেই করবেন। অন্যথায় তাঁর ঘরকে রক্ষা করার সাহসও আমাদের নেই এবং যুদ্ধ করার মত শক্তিও আমাদের নেই। হানাতাহ তখন তাকে বললো, “ঠিক আছে, আপনি আমাদের বাদশাহর কাছে চলুন।” 

আবদুল মুত্তালিব তখন তার সাথে আবরাহার কাছে গেলেন। আবদুল মুত্তালিব ছিলেন অত্যন্ত সুদর্শণ বলিষ্ঠ দেহ সৌষ্ঠবের অধিকারী। আবরাহা তাকে দেখেই সিংহাসন থেকে নেমে এলো এবং তার সাথে মেঝেতে উপবেশন করলো। সে তার দোভাষীকে বললো, 
- তাকে জিজ্ঞেস করো তিনি কি চান? 
- আবদুল মুত্তালিব জানালেন, “বাদশাহ আমার দু’শ উট লুট করেছেন। আমি সেই উট ফেরত নিতে এসেছি।” 
- প্রথম দৃষ্টিতে আপনি যে শ্রদ্ধা আকর্ষণ করেছিলেন, আপনার কথা শুনে সে শ্রদ্ধা লোপ পেয়ে গেছে। নিজের দু’শ উটের জন্যে আপনার এতো চিন্তা অথচ স্বজাতির ধর্মের জন্যে কোন চিন্তা নেই! আমি আপনাদের ইবাদতখানা কা’বা ধ্বংস করে ধূলিসাৎ করতে এসেছি।" 
- শোন, উটের মালিক আমি, তাই উট ফিরে পাওয়ার চেষ্টা করতে এসেছি। আর কাবাগৃহের মালিক হলেন স্বয়ং আল্লাহ। সুতরাং তিনি নিজেই নিজের ঘর রক্ষা করবেন।” 
- আজ স্বয়ং আল্লাহও কাবাকে আমার হাত থেকে রক্ষা করতে পারবেন না।” 
- তা আল্লাহ জানেন এবং আপনি জানেন।” 

আবদুল মুত্তালিব তাঁর উটগুলো নিয়ে ফিরে আসলেন এবং মক্কাবাসীদেরকে বললেন, “তোমরা মক্কাকে সম্পূর্ণ খালি করে দাও। সবাই তোমরা পাহাড়ে গিয়ে আশ্রয় নাও।” তারপর আবদুল মুত্তালিব কুরায়েশের কয়েকজন বিশিষ্ট ব্যক্তিকে সঙ্গে নিয়ে কা'বা গৃহে গিয়ে কাবার খুঁটি ধরে দেয়াল ছুঁয়ে আল্লাহর দরবারে কান্নাকাটি করলেন এবং কায়মনোবাক্যে ঐ পবিত্র ও মর্যাদাপূর্ণ গৃহ রক্ষার জন্যে প্রার্থনা করলেন। আবরাহা এবং তার রক্ত পিপাসু সৈন্যদের অপবিত্র ইচ্ছার কবল থেকে কাবাকে পবিত্র রাখার জন্যে আবদুল মুত্তালিব কবিতার ভাষায় নিম্নলিখিত দুআ করেছিলেন,
"আমরা নিশ্চিন্ত, কারণ আমরা জানি যে, প্রত্যেক গৃহমালিক নিজেই নিজের গৃহের হিফাযত করেন। হে আল্লাহ! আপনিও আপনার গৃহ আপনার শত্রুদের কবল হতে রক্ষা করুন। আপনার অস্ত্রের ওপর তাদের অস্ত্র জয়যুক্ত হবে এমন যেন কিছুতেই না হয়। 

পরদিন প্রভাতে আবরাহার সেনাবাহিনী মক্কায় প্রবেশের উদ্যোগ আয়োজন করলো। বিশেষ করে হাতি মাহমুদকে সজ্জিত করা হলো। পথে বন্দী হয়ে আবরাহার সাথে আগমনকারী নুফায়েল ইবনে হাবীব তখন মাহমুদ নামক হাতিটির কান ধরে বললেন, “মাহমুদ! তুমি বসে পড়ো, আর যেখান থেকে এসেছ সেখানে ভালোভাবে ফিরে যাও। তুমি আল্লাহর পবিত্র শহরে রয়েছ।” একথা বলে নুফায়েল হাতির কান ছেড়ে দিলেন এবং ছুটে গিয়ে নিকট এক পাহাড়ের আড়ালে গিয়ে আত্মগোপন করলেন। মাহমুদ নামক হাতিটি নুফায়েলের কথা শোনার সাথে সাথে বসে পড়লো। বহুচেষ্টা করেও তাকে নড়ানো সম্ভব হলো না। পরীক্ষামূলক ভাবে ইয়ামনের দিকে তার মুখ ফিরিয়ে টেনে তোলার চেষ্টা করতেই হাতি তাড়াতাড়ি উঠে দ্রুত অগ্রসর হতে লাগলো। পূর্বদিকে চালাবার চেষ্টা করা হলে সেদিকেও যাচ্ছিল, কিন্তু মক্কা শরীফের দিকে মুখ ঘুরিয়ে চালাবার চেষ্টা করতেই বসে পড়লো। 

সৈন্যরা তখন হাতিটিকে প্রহার করতে শুরু করলো। হাতিটি যখন আর উঠানো সম্ভব হলো না তখন সৈন্যরা অন্য একটি হাতিকে সামনের দিকে নেয়ার চেষ্টা করলো। এমন সময় দেখা গেল এক ঝাঁক পাখি কালো মেঘের মত হয়ে সমুদ্রের দিক থেকে উড়ে আসছে। চোখের পলকে ওগুলো আবরাহার সেনাবাহিনীর মাথার ওপর এসে পড়লো এবং চতুর্দিক থেকে তাদেরকে ঘিরে ফেললো। প্রত্যেক পাখির ঠোঁটে একটি এবং দুপায়ে দুটি কংকর ছিল। কংকরের ঐ টুকরোগুলো ছিল মসুরের ডাল বা মাসকলাই এর সমান। পাখিগুলো কংকরের ঐ টুকরোগুলো আবরাহার সৈন্যদের প্রতি নিক্ষেপ করছিল। যার গায়ে ঐ কংকর পড়ছিল সেই সঙ্গে সঙ্গে মৃত্যু যন্ত্রণায় ছটফট করতে করতে মারা পড়ছিলো।

অন্য হাতিটি কাবার দিকে পা বাড়াতেই তার মাথায় কংকরের টুকরো পড়লো এবং আর্তনাদ করে পিছনে সরে এলো। অন্যান্য হাতিও তখন এলোপাতাড়ি ছুটতে শুরু করলো। কয়েকটির ওপর কংকর পড়ায় তৎক্ষণাৎ ওগুলো মারা গেল। যারা ছুটে পালাচ্ছিল তাদেরও এক একটি অঙ্গ খসে খসে পড়ছিল। এবং অবশেষে সবগুলোই মারা গেল। আবরাহাও ছুটে পালালো, কিন্তু তারও এক একটি অঙ্গ খসে খসে পড়ছিল। অবশেষে সে ধুঁকতে ধুঁকতে মৃত্যুবরণ করলো। 

এ ঘটনার প্রেক্ষিতে নুফায়েল আরো বলেন, "হাতিওয়ালাদের দুরাবস্থার সময়ে তুমি যদি উপস্থিত থাকতে! যখন প্রান্তরে তাদের ওপর আযাবের কংকর বর্ষিত হয়েছে। তুমি সে অবস্থা দেখলে আল্লাহর দরবারে সিজদায় পতিত হতে। আমরা পাহাড়ের ওপর দাঁড়িয়ে আল্লাহর প্রশংসা করছিলাম। আমাদের হৃৎপিণ্ড কাঁপছিল এই ভয়ে যে, না জানি হয়তো আমাদের ওপরও এই কংকর পড়ে যায় এবং আমাদেরও দফারফা করে দেয়"। 

এখানে একটি মজার বিষয় লক্ষণীয় আল্লাহ তায়ালা তৎকালীন নামধারী মুসলিমদের বিরুদ্ধে সাহায্য করলেন মুশরিকদেরকে। অনেক হিন্দু মুশরিকরা এমনটা দাবী করেন। তারা দাবী করেন কাবা তাদের এবং তাদের সাহায্যে আল্লাহ তায়ালা পাখিদের পাঠিয়েছিলো। আসলে বিষয়টা সেটা নয়। ঐ নামধারী মুসলিমরা স্বয়ং আল্লাহর বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছিলো। আর আল্লাহ তায়ালা তাঁর ঘরকে রক্ষা করেছিলেন। কাবা যে তাদের নয় সেটা প্রকাশ পায় মুশরিকদের নেতা রাসূলের দাদার বক্তব্য থেকে। তিনি দাবী করেছেন এই ঘর ইব্রাহীমের। আর ইব্রাহীম আ. কখনোই মুশরিক ছিলেন না। তিনি তাঁর পিতার শিরকি কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন। অর্থাৎ কাবা ঘর মুসলিমদের। কিন্তু ইব্রাহীমের মুসলিম সন্তানরা বংশ পরম্পরা ইসলাম থেকে বিচ্যুত হয়ে মুশরিক হয়ে গিয়েছে। ঐ সন্তানেরা কাবাঘর তৈরি করেননি। কাবা ঘর মুসলিমদের এবং মুসলিমরা তাই এর দখল নিয়েছে এবং তাদের ঘরে থাকা মুর্তি ধ্বংস করেছে। 

আল্লাহ তায়ালা আবরাহাকে ধ্বংস করে দিয়ে কাবা রক্ষা করেছেন, এর মানে এই না যে সবসময় কাবাঘর রক্ষা পাবে। এর আগেও কাবা নূহ আ.-এর বণ্যার সময় ও ভূমিকম্পে ধ্বংস হয়েছিলো। তারপর ইয়াজিদের বাহিনীও কাবার দেয়াল ধ্বসিয়ে দিয়েছিলো। তাই আল্লাহ তায়াল কখন কী করবেন এটা একমাত্র তাঁরই ইচ্ছে। মহান আল্লাহ তায়ালা এই ঘটনাকে স্মরণীয় করে রাখতে নাজিল করেছেন সূরা ফিল।

//তুমি কি দেখনি তোমার রব হাতিওয়ালাদের সাথে কী করেছিলেন?
তিনি কি তাদের ষড়যন্ত্র ব্যর্থতায় পর্যবসিত করেননি?
আর তিনি তাদের বিরুদ্ধে ঝাঁকে ঝাঁকে পাখি প্রেরণ করেছিলেন।
তারা তাদের ওপর নিক্ষেপ করে পোড়ামাটির কঙ্কর 
অতঃপর তিনি তাদেরকে করলেন ভক্ষিত শস্যপাতার ন্যায়।// 

যে বছর এই অসাধারণ ঘটনা ঘটে সে বছরকে কুরাইশরা বলতো আমুল ফিল বা হস্তিবর্ষ। এই হস্তিবর্ষেই জন্ম নেন আল্লাহর রাসূল মুহাম্মাদ সা.। এটা শেষ নবী হযরত মুহাম্মদ সা. আগমনের ইশারাও ছিলো। সে বছর আল্লাহ তায়ালা মক্কার মুশরিকদেরও শাস্তি দেন কারণ তারা যথাযথভাবে কাবা রক্ষার ব্যবস্থা নেয় নি। ঐ বছরই মক্কায় প্রথম মাহামারি প্লেগ ও কলেরা দেখা দেয়।

বি. দ্র. 
নাজ্জাশী নাম দেখে বিভ্রান্ত হবেন না। আমরা নাজ্জাশী নামে যাকে চিনি তিনি ভালো লোক ছিলেন। সংকটাপন্ন মুসলিমদের শেল্টার দিয়েছেন। বিবেচনাবোধসম্পন্ন ও আল্লাহভীরু লোক ছিলেন। মুহাম্মাদ সা.-এর একটি বিয়েতে তিনি ঘটক ছিলেন এবং ঐ বিয়েতে রাসূলের পক্ষে তিনি চার হাজার দিরহাম মোহর প্রদান করেন। আল্লাহর রাসূল সা. তাঁর জানাজা পড়েছেন। মূলকথা হলো আবিসিনিয়ার বাদশাহদের নাজ্জাশী বলা হয়। যেভাবে আগে মিশরের বাদশাহদের ফিরাউন বলা হতো। আমরা যাকে চিনি তার নাম 'আরমাহ'। কিছু বর্ণনায় এসেছে 'শাহামা'। 

আর এখানে যে নাজ্জাশীর কথা বলা হয়েছে অর্থাৎ আবরাহার সময়কার নাজ্জাশী ছিলেন 'গারসেম'। গারসেম মৃত্যুবরণ করেছে ৬০০ সালে। অর্থাৎ মুহাম্মদ সা. তখনো নবীত্ব লাভ করেন নাই। এর পরেই আরমাহ নাজ্জাশী হন। গারসেমের সাথে আরমাহের সম্পর্ক কী তা নির্ণয় করতে পারিনি।

১৬ এপ্রি, ২০২০

মৃত ব্যক্তির গোসল ও কাফনের পদ্ধতি


একটা জরুরি বিষয়ে আপনাদের অবহিত করতে চাই। আর সেটি হলো মৃত ব্যক্তির গোসল ও কাফন। বর্তমানে মহামারী চলার কারণে এই বিষয়টা জানা প্রত্যেকের জন্য জরুরি হয়ে পড়েছে। নিজের কোন আত্মীয় ইন্তেকাল করলে প্রয়োজনীয় সাপোর্ট পাওয়া না গেলে নিজেকেই সব কাজ করতে হবে। সেক্ষেত্রে এসব সহজ বিষয় জানা জরুরি। মৃতের গোসল, কাফন, জানাযার সালাত এবং দাফন করা ফরজ। মনে করুন আপনার পরিবারের এক সদস্য ইন্তেকাল করেছে। কী করবেন? 

১- পানি গরম করবেন। সাথে বরই পাতা দিতে পারলে ভালো। 

২- মৃত ব্যক্তি যদি পুরুষ হন তাহলে পুরুষ যদি মহিলা হন তবে মহিলারা গোসল দিবেন। তবে উত্তম হলো স্বামী স্ত্রীকে, স্ত্রী স্বামীকে গোসল দিবে। এটা সম্ভব না হলে নিকটাত্মীয়রা দিবে। যেমন পুরুষ হলে বাবা, ছেলে, নাতি ইত্যাদি। মহিলাদের ক্ষেত্রে মা, মেয়ে, নাতনী ইত্যাদি। মৃত ব্যক্তি যদি কার ব্যাপারে ওসিয়ত করেন তবে সেটা পূর্ণ করা উত্তম। 

৩- মৃত ব্যক্তিকে এমন স্থানে নিয়ে যাবেন যেখানে পানি ঢাললে সমস্যা হয় না। সেক্ষেত্রে আমাদের শহুরে পরিবেশে বারান্দায় নিয়ে যেতে পারেন। অবশ্যই পর্দা টানিয়ে দিবেন। যাতে গোসল করানো ব্যক্তিরা ছাড়া অন্য কেউ লাশ না দেখতে পান। 

৪- সতর অংশ ছাড়া বাকীটা অনাবৃত করে নিবেন। মহিলা হলে একটি কাপড় সবসময় দেহের উপর রাখবেন। 

৫- লাশকে শোয়া থেকে বসানোর মতো করে একটু উঠাবেন ও পেটে হালকা চাপ দিবেন। যাতে কোন মলমূত্র আটকে থাকলে তা বের হয়ে যায়। পানি দিয়ে উভয় মলমূত্র বের হওয়ার স্থানদুটি ভালোভাবে ধৌত করে নিবেন। সতর না দেখে যতটা সম্ভব ভালো করে ধুবেন। এক্ষেত্রে আপনি হ্যান্ড গ্লাভস পরে নিতে পারেন অথবা হাতকে ন্যাকড়া দিয়ে মুড়িয়ে নিতে পারেন। 

৬- বিসমিল্লাহ বলে অযু করিয়ে নিবেন। তবে মুখে ও নাকে পানি দেওয়ার দরকার নেই। সেক্ষেত্রে ভেজা কাপড় দিয়ে মুখের ভেতর ও নাকের ভিতর পরিষ্কার করে দিবেন। যতটুকু পারা যায়। 

৭- তারপর মাথার সামনে পেছনে পানি ঢালবেন। সামনের ডান দিকে পানি ঢেলে ধুবেন। লাশটাকে একটু তুলে ধরে ডানদিকের পিঠের অংশে পানি ঢেলে ধুবেন। একইভাবে বাম পাশে সামনের ও পিঠের অংশ ধুবেন। গোসল হয়ে গেল। মোটকথা হলো পুরো শরীরে ভালোভাবে পানি পৌঁছে দিবেন। এভাবে তিনবার করবেন। চাইলে সাবান ইউজ করতে পারেন। শেষবারে যদি থাকে তবে কাপুর মিশ্রিত পানি দিতে পারেন।

৮- এরপর পরিষ্কার শুকনো কাপড় দিয়ে শরীর মুছে দিবেন। লজ্জাস্থানের উপর এক খণ্ড শুকনো কাপড় রাখবেন। 

৯- মৃতের চুল আঁচড়ানোর দরকার নেই। মহিলাদের ক্ষেত্রে বেণী করে দেওয়া যেতে পারে। 

১০- এরপর কাফন পরিয়ে দিতে হবে। কাফনের কাপড় সাদা হওয়া উত্তম। অন্য কিছুও হতে পারে। ফিতা সাতটা নিবেন। কিছু কম-বেশি হলেও সমস্যা নেই।

১১- পুরুষদের ক্ষেত্রে প্রথমে সাতটি ফিতা একের পর এক রাখতে হবে। তিনটি বড় কাপড় ফিতার উপর রাখবেন। তার তপর লাশ রেখে কাপড় দিয়ে মুড়িয়ে নিবেন। এরপর ফিতা দিয়ে বেঁধে ফেলবেন। 

১১- কাফনের কাপড় সাদা হওয়া উত্তম। অন্য কিছুও হতে পারে। ফিতা সাতটা না হলেও সমস্যা নেই। তবে বেঁধে ফেলা জরুরি। 

১২- মহিলাদের ক্ষেত্রেও একইভাবে হতে পারে। তবে পাঁচটি কাপড় কাফন পরানো উত্তম। সেক্ষেত্রে নিচের দিকে লুঙ্গির মতো করে এখখণ্ড কাপড় জড়ানো হবে। একখণ্ড কাপড় জামার মতো করে মুড়িয়ে দিবেন। ৩য় খণ্ড দিয়ে মাথা মুড়িয়ে দিবেন। বড় দুই খণ্ড দিয়ে পুরো শরীর মুড়িয়ে বেঁধে ফেলবেন। 

কিছু সম্পূরক প্রশ্ন

১- যদি গোসলের জন্য কাউকে না পাওয়া যায় তবে কী হবে? 

যদি কোন পুরুষকে গোসলের জন্য কোন পুরুষকে ও কোন মহিলাকে গোসলের জন্য কোন মহিলাকে না পাওয়া যায় তবে গোসল দেওয়ার দরকার নেই। সে ক্ষেত্রে তায়াম্মুম করিয়ে নেবেন। তায়াম্মুম করানোর নিয়ম হলো পরিষ্কার মাটিতে হাত মেরে মৃত ব্যক্তির দুই হাত ও মুখমণ্ডল মাসেহ করে নিবেন। 

২- লাশ যদি ছিন্নভিন্ন থাকে? 

লাশ যদি ছিন্ন ভিন্ন ও আগুনে পুড়ে যাওয়া হয় সেক্ষেত্রে গোসল দেওয়ার দরকার নেই। গোসল ছাড়াই অঙ্গগুলো (যা পাওয়া যায়) কাপড় দিয়ে মুড়িয়ে নিতে হবে। একটা জরুরি বিষয় জানা দরকার। তা হলো শহীদের গোসল। আমাদের সমাজে প্রচলিত আছে যারা শহীদ অর্থাৎ যাদের অন্যায়ভাবে খুন করা হয়েছে তাদের গোসল দেওয়া হবে না। ব্যাপার শুদ্ধ নয়। যারা এরূপ বলেন তাদের দলিল হলো উহুদের যুদ্ধ। ব্যাপারটা ছিল উহুদে মুসলিমদের বিপর্যয় হয়েছিলো। তখন গোসল, কাফন ও দাফনের সঠিক নিয়ম পালন করার সাধ্য ছিলো না। 

তাই জরুরি অবস্থায় আল্লাহর রাসূল সা. শহীদদের গোসল, কাফন, জানাজার সালাত ছাড়াই দাফন করেছেন। শুধু তাই নয় এক গর্তে কয়েকজনকে সমাহিত করেছেন। অতএব জরুরি অবস্থা আর স্বাভাবিক অবস্থার দলিল এক হতে পারে না। যারা মনে করেন শহীদদের গোসল দেওয়ার দরকার নেই তাদের কিন্তু কাফন ও জানাজার সালাত বাদ দেওয়ার কথা বলেন না। যাই হোক মূল বিষয় হলো কোন শহীদকে যদি গোসল দেওয়ার পরিবেশ থাকে তবে গোসল দিতে হবে। যদি পরিস্থিতি এমন হয় লাশ ছিন্ন-ভিন্ন হয়ে গেছে তাহলে দরকার নেই। এটা শহীদ এবং শহীদ ভিন্ন সবার জন্য একই বিধান। তিন খুলাফায়ে রাশেদা শাহদাতবরণ করার পর প্রত্যেকেরই গোসল দেওয়া হয়েছে। 

৩- চুল দাঁড়ি কাটা ও পশম উপড়াতে হবে কি?

না, এমন কাজ করবেন না। চুল দাঁড়ি কাটার দরকার নেই। আর লজ্জাস্থানের পশম উপড়ানো জায়েজ নয়। 

৪- লাশের পেট থেকে ময়লা বের হতে থাকলে? 

লাশ থেকে যদি ক্ষণে ক্ষণেই ময়লা বের হতে থাকে তবে কাপড় গুঁজে দিয়ে গোসল শেষ করতে হবে। 

৫- শিশু বাচ্চার ক্ষেত্রে কে গোসল দিবে? 

বাবা-মা দিতে পারলে ভালো। নতুবা নারী-পুরুষ উভয়েই শিশুদের গোসল দিতে পারবে। 

বি.দ্র.- উপরোক্ত বিষয়গুলো হাদিস দ্বারা সাব্যস্থ। কেউ যদি আরো বিস্তারিত জানতে চান তবে হাদিস গ্রন্থগুলোর জানাজা অধ্যায় দেখে নিবেন।

১৫ এপ্রি, ২০২০

মহানবীর যাদুগ্রস্থ হওয়ার ইতিহাস



একবার রাসূল সা.-এর কিছু সমস্যা সৃষ্টি হলো। তিনি ভুলোমনা হয়ে পড়লেন। তিনি এমন কাজ করেননি অথচ তাঁর মনে হতে লাগলো তিনি তা করেছেন। আবার কোনো কাজ করার পর তা ভুলে যেতে লাগলেন। এভাবে কিছুদিন চললো। এমন অবস্থা হয় যে, তাঁর মনে হতো তিনি স্ত্রীদের কাছে এসেছেন, অথচ তিনি আদৌ তাঁদের কাছে আসেননি।

এইমন ভুলোমনা অবস্থা দূরীকরণের জন্যে রাসূলুল্লাহ সা. দিন রাত চেষ্টা করতেন। সবকিছু মনে রাখার জন্য আলাদা করে চেষ্টা করতেন। আল্লাহর কাছে সাহায্য চাইতেন। কিন্তু তারপরও তিনি ঘোরে আচ্ছন্ন হয়ে পড়তেন। এরকম অবস্থায় তিনি কেন পতিত হলেন, এর থেকে উত্তরণের উপায় কী তা তিনি জানতেন না। ছয় মাস পর্যন্ত ঐ একই অবস্থা চলতে থাকে।

এর কারণ ছিলো যাদু। ইয়াহুদীরা আল্লাহর রাসূল সা.-কে যাদুগ্রস্থ করে ফেলে। ইয়াহুদী এক বালক মসজিদে নববীতে আল্লাহর রাসূল সা.-এর পাশে থাকতেন। তাঁর সেবা করতেন। ঐ ছেলেটিকে ফুসলিয়ে ইয়াহুদীরা রাসূল সা. কয়েকটি চুল এবং তাঁর চুল আঁচড়াবার চিরুনির কয়েকটি দাঁত হস্তগত করে। তারপর তারা ওগুলো দিয়ে যাদু করে। এ কাজে সবচেয়ে বেশি অগ্রগামী ছিলো লাবীদ ইবনে আ'সাম। কিছু কিছু বর্ণনায় নামটি এসেছে লুবাইদ ইবনে আ'সাম। এ ইয়াহুদীদের মিত্র সুরাইক গোত্রের। সে ছিল মুনাফিক। এরপর যাদুর পোটলা যারওয়ান নামক কূপে তারা স্থাপন করে। এরপর থেকেই রাসূল ঘোরে চলে যেতেন ও ভুলোমনো হয়ে যেতেন।

এদিকে অসুস্থ থাকা অবস্থায় একদিন রাসূল সা. রাতে ঘুমালেন। স্বপ্নে তাঁকে আল্লাহ তায়ালা তাঁর রোগ সম্পর্কে জানালেন। বুখারিতে উল্লেখ রয়েছে, ঘুম থেকে উঠে প্রিয় নবী তাঁর স্ত্রী-কে বললেন, হে আয়েশা! আমি আমার প্রতিপালককে জিজ্ঞেস করেছি এবং তিনি আমাকে জানিয়েছেন এই রোগ সম্পর্কে। স্বপ্নে আমার নিকট দু’জন লোক এলেন। তাদের একজন আমার মাথার নিকট এবং অন্যজন আমার পায়ের নিকট বসলেন।

আমার মাথার কাছের লোকটি অন্যজনকে জিজ্ঞেস করলেন,
- এ লোকটির এই অবস্থা কেন?
- একে যাদু করা হয়েছে।
- কে যাদু করেছে?
- লাবীদ ইবনু আ‘সাম।
- কীসের মধ্যে যাদু করা হয়েছে?
- চিরুনি ও চিরুনি করার সময় উঠে যাওয়া চুলের মধ্যে।
- সেগুলো কোথায়?
- খেজুর গাছের মাথার মধ্যে রেখে ‘যারওয়ান’ নামক কূপের ভিতর পাথরের নিচে রাখা আছে।

আল্লাহর রাসূল সা.-এর কাছে আল্লাহ তায়ালা নানানভাবে ম্যাসেজ পাঠাতেন। স্বপ্ন এর মধ্যে অন্যতম। মুহাম্মদ সা. ঘুম থেকে উঠেই হযরত আয়িশাকে অবহিত করলেন ভুলে যাওয়ার আগেই। এরপর রাসূল সা. হযরত আলী রা., হযরত যুবায়ের রা. এবং হযরত আম্মার রা.-কে নিয়ে সে কূপের কাছে গেলেন। এরপর সেই কূপ থেকে যাদুর পোটলাগুলো বের করিয়ে আনেন।

ঐ যাদুকৃত জিনিসগুলোর মধ্যে একটি ধনুকের সুতো ছিল, তাতে ছিলো এগারোটি গেরো। প্রত্যেক গেরোতে একটি করে সূচ বিদ্ধ করে দেয়া হয়েছিল। তারপর আল্লাহ তা'আলা এ সময় সূরা ফালাক ও সূরা নাস নাজিল করেন। রাসূলুল্লাহ সা. এ সূরা দু’টির একেকটি আয়াত পাঠ করছিলেন আর ঐ গেরোগুলো একটি একটি করে আপনা আপনি খুলে যাচ্ছিল। সূরা দু'টি পূর্ণ হওয়ার সাথে সাথে সমস্ত গেরোই খুলে যায় এবং রাসূলুল্লাহ সা. সম্পূর্ণরূপে সুস্থ হয়ে যান।

এই সময় জিবরাঈল আ. রাসূল সা.-এর জন্য দোয়া নিচের দোয়াটি পড়ে ফুঁক দেন।
“বিসমিল্লাহি আরক্বিক মিন কুল্লি শাইয়িন উযিক। ওয়া মিন শাররি কুল্লি নাফসিন আও আইনিন হাসিদিন; আল্লাহু ইয়াশফিক। বিসমিল্লাহি আরক্বিক।”

এদিকে সাহাবীগণ রাসূলুল্লাহ সা.-কে বলেন,
- হে আল্লাহর রাসূল সা.! আমরা কি ঐ নরাধমকে ধরে হত্যা করে ফেলবো?
- না, আল্লাহ তায়ালা আমাকে আরোগ্য দান করেছেন। আমি মানুষের মধ্যে অনিষ্ট ও ফাসাদ সৃষ্টি করতে চাই না।

যাদু থেকে বাঁচতে করণীয়;
কেউ যদি যাদুগ্রস্থ হয়ে পড়েন তবে এর থেকে বাঁচার বা রক্ষা পাওয়ার মোক্ষম উপায় হলো যাদু নষ্ট করা। সেক্ষেত্রে যা করণীয়

১- যদি যাদুর পুটলির সন্ধান পাওয়া যায় তবে তা পুড়িয়ে ফেলতে হবে। যদি যাদুকরকে শনাক্ত করা যায় তাহলে তাকে বাধ্য করতে হবে যেন সে যে যাদু করেছে সেটা নষ্ট করে ফেলে। প্রসঙ্গত, যাদুকরের শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। নবী সা. বলেন: “যাদুকরের শাস্তি হচ্ছে তরবারির আঘাতে তার গর্দান ফেলে দেয়া।” একবার হাফসা রা. জানতে পারলেন তাঁর এক দাসী যাদু করেছে। এতে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। তখন শাসক ছিলেন উমার রা.। তিনি ঐ বাঁদির মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করেন। তবে অবশ্যই এই শাস্তির বিধান কায়েম করবেন ইসলামী শাসক।

২- যাদুর পুটলি বা যাদুকর কাউকেই যদি না পাওয়া যায় তবে ঝাড়ফুঁক করতে হবে। এর বড় ধরনের প্রভাব রয়েছে। এর পদ্ধতি হচ্ছে- যাদুতে আক্রান্ত রোগীর উপর অথবা কোন একটি পাত্রে পানি নিয়ে আয়াতুল কুরসি, সূরা আরাফ, সূরা ইউনুস, সূরা ত্বহা এর যাদু বিষয়ক আয়াতগুলো, সূরা কাফিরুন এবং এই দোয়া পড়তে হবে। “আল্লাহুম্মা, রাব্বান নাস! আযহিবিল বা’স। ওয়াশফি, আনতাশ শাফি। লা শিফাআ ইল্লা শিফাউক। শিফাআন লা উগাদিরু সাকামা।”

(অর্থ- হে আল্লাহ! হে মানুষের প্রতিপালক! আপনি কষ্ট দূর করে দিন ও আরোগ্য দান করুন। (যেহেতু) আপনিই রোগ আরোগ্যকারী। আপনার আরোগ্য দান হচ্ছে প্রকৃত আরোগ্য দান। আপনি এমনভাবে রোগ নিরাময় করে দিন যেন তা রোগকে নির্মূল করে দেয়।)

জিবরাঈল আ. নবী সা. যে দোয়া পড়ে ঝাড়ফুঁক করেছেন সেটাও পড়া যেতে পারে। এর অর্থ আল্লাহর নামে আমি আপনাকে ঝাড়ফুঁক করছি। সকল কষ্টদায়ক বিষয় থেকে। প্রত্যেক আত্মা ও ঈর্ষাপরায়ণ চক্ষুর অনিষ্ট থেকে। আল্লাহ আপনাকে আরোগ্য করুন। আল্লাহর নামে আমি আপনাকে ঝাড়ফুঁক করছি। এই দোয়াটি তিনবার পড়ে ফুঁ দিবেন।

সূরা ইখলাস, সূরা ফালাক ও সূরা নাস তিনবার পড়ে ফুঁ দিবেন। এরপর যাদুতে আক্রান্ত ব্যক্তি সে পানি পান করবে। আর অবশিষ্ট পানি দিয়ে প্রয়োজনমত একবার বা একাধিক বার গোসল করবে। তাহলে আল্লাহর ইচ্ছায় রোগী আরোগ্য লাভ করবে। আলেমগণ এ আমলের কথা উল্লেখ করেছেন।

যাদুতে আক্রান্ত হওয়ার আগেই যে প্রতিরোধ্মূলক ব্যবস্থা নিতে পারেন তা হলো,
১- সূরা ফাতিহা পড়া। সকাল-সন্ধ্যায় ও ঘুমানোর সময়
২- আয়াতুল কুরসি তথা সূরা বাকারার ২৫৫ নং আয়াত পড়া।
৩- দৈনিক সূরা আরাফের যাদু বিষয়ক আয়াতগুলো (১০৬-১২২) পড়া।
৪- দৈনিক সূরা ইউনুসের যাদু বিষয়ক আয়াতগুলো (৭৯-৮২) পড়া।
৫- সূরা কাফিরুন, সূরা ইখলাস, সূরা ফালাক ও সূরা নাস ৩ বার করে প্রতি ফরজ নামাজের পর পড়া।
৬- জিবরাঈল আ. যা পড়ে ফুঁক দিয়েছেন সে দোয়া পড়া।
৭- প্রতিবার ঘরে ঢুকার সময় সালাম দেওয়া এবং পরিবারের সকল সদস্যকে এই আমলে অভ্যস্ত করা।

এই আমলগুলো হাদিস দ্বারা সাব্যস্ত। আল্লাহ তায়ালা আমাদের এসব বিপদ থেকে এই আমলগুলোর উসিলায় প্রটেক্ট করবেন ইনশাআল্লাহ।

বি. দ্র.
১- রাসূল সা.-এর যাদুগ্রস্থ হয়ে যাওয়া মোটেই স্বাভাবিক ঘটনা নয়। মক্কার মুশরিকরা তাঁকে এই অপবাদই দিয়েছেন যে, তিনি যাদুগ্রস্থ। যাদুগ্রস্থ অবস্থায় তাঁর কাছে শয়তান আসে এবং শয়তানের শিখিয়ে দেওয়া বাক্যই সে আমাদের শোনায়। এই সমস্যা ও জটিলতার সমাধান দেওয়ার চেষ্টা করেছেন মাওলানা মওদূদী। এক্ষেত্রে সূরা ফালাকের তাফসীর তাফহীমুল কুরআন থেকে পড়ার অনুরোধ করছি।

২- আল্লামা সুয়ুতিসহ অনেক প্রসিদ্ধ ইতিহাসবিদ জানিয়েছেন প্রখ্যাত সাহাবী আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ সূরা ফালাক ও নাসকে কুরআনের অন্তর্ভুক্ত মনে করতেন না। এবং তিনি তাঁর নিজস্ব পান্ডুলিপিতে তা সংযোজন করেন নি। এই জটিলতারও সমাধান দেওয়ার চেষ্টা করেছেন মাওলানা মওদূদী। পড়ে নেয়ার অনুরোধ।

১৪ এপ্রি, ২০২০

বঙ্গকথা পর্ব-৩৫ : হিন্দু সমাজে বঙ্গভঙ্গের প্রতিক্রিয়া ও স্বদেশী (সন্ত্রাসবাদী) আন্দোলন



শিরোনামে স্বদেশী আন্দোলনের পাশে সন্ত্রাসবাদী শব্দটা লিখার কারণ ইচ্ছেকৃত। আমাদের পাঠ্যপুস্তকে স্বদেশী আন্দোলনকে ইংরেজবিরোধী আন্দোলন, স্বাধীনতা আন্দোলন ও মহান বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলন হিসেবে দেখানো হয়। সেভাবেই ইতিহাস লিখিত হয়েছে। অথচ এই আন্দোলন ছিলো মুসলিমবিরোধী। ইংরেজরা কেন মুসলিদের উপকার করলো এই ক্ষোভ থেকে এই আন্দোলন চলে।  

যাই হোক বাংলার হিন্দুরা বঙ্গভঙ্গের ফলে উগ্রমূর্তি ধারণ করে। এটাকে হিন্দুরা প্রথমত ‘জাতীয় ঐক্যের’ প্রতি আঘাত বলে অভিহিত করে। অতঃপর নানাভাবে এর ব্যাখ্যা দিতে থাকে, যথা তাদের ‘রাজনৈতিক আন্দোলনে নেতৃত্ব দেয়ার শাস্তি’, ‘মুসলমানদের প্রতি সরকারের পক্ষপাতিত্ব’, এবং অবশেষে এটাকে ‘মুসলমানদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা’ নামে অভিহিত করে। তারা এর বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করে দিলেন। ‘জাতিকে দ্বিধাবিভক্ত করা হলো’, ‘পবিত্র বাংলাকে দ্বিখন্ডিত করা হলো’, ‘ব্রিটিশ সরকার এবং দেশদ্রোহী মুসলমানদের মধ্যে এক অশুভ আঁতাত’ প্রভৃতি উত্তেজনাকর উক্তির দ্বারা বাংলার পরিস্থিতি ভয়ংকর করে ফেললো বাংলার হিন্দু সমাজ।

হিন্দু আইনজীবীগণ এর আইনগত বৈধতার প্রশ্ন উত্থাপন করলেন, বাংলা ভাষার সাহিত্যিকগণ প্রচার শুরু করলেন যে, বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের প্রতি চরম আঘাত হানা হলো। ব্যবসায়িরা জানালের তাদের কীরূপ ক্ষতি হলো। এ ধরনের অসংগত ও অবাস্তব প্রচারণার কারণ কি ছিলো? মুসলমানদের উপরে হঠাৎ এ আক্রমণ ও অশোভন উক্তি শুরু হলো কেন? আব্বাস আলী খান বলেন, প্রকৃত ব্যাপার হচ্ছে এই যে বংগভংগে কায়েমী স্বার্থ বিপন্ন ও বেসামাল হয়ে পড়েছিল। যে সংখ্যাধিক্যের কারণে বাংগালী হিন্দুগণ উভয় বাংলার চাকুরী বাকুরী ও জীবন জীবিকার উপর একচেটিয়া অধিকার প্রতিষ্ঠিত করে রেখেছিল, তা বংগভংগের ফলে বিনষ্ট হয়ে গেল। নতুন বাংলায় মুসলমানরা হলেন সংখ্যাগরিষ্ঠ। বাংলার পূর্বাঞ্চলের মুসলমানগণ সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুর বশ্যতা ও পরাভব থেকে মুক্তি লাভ করলেন এবং তাঁদের মনে এ আশার সঞ্চার হলো যে, এখন স্থানীয় সমস্যাদির উপর তাঁদের কথা বলার অধিকার থাকবে। সমসাময়িক লেখম সরদার আলী খান বলেন, “যত সব হৈ হল্লা এবং হঠাৎ রাতারাতি যে দেশপ্রেমের আন্দোলন শুরু হলো মাতৃভূমি অথবা ভারতের কল্যাণের সাথে তার কোন সম্পর্ক নেই। যে প্রদেশে হিন্দুগণ সুস্পষ্ট সংখ্যালঘু সেখানে তাদের শ্রেণীপ্রাধান্য অক্ষুণ্ণ রাখা ব্যতীত অন্য কোন মহৎ উদ্দেশ্য এ আন্দোলনের নেই। 

বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন অন্যতন নেতা সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জি বলেন, বঙ্গভঙ্গের ঘোষণা আকস্মিক বজ্রপাতের ন্যায়। যে ১৬ই অক্টোবর নতুন বাংলার (পূর্ব বাংলা ও আসাম) সূচনা হয়, সেদিন কোলকাতায় হিন্দুগণ জাতীয় শোকদিবস পালন করেন। ঐ দিন তারা কালো ব্যাজ পরিধান করেন, মাথার ভস্ম মাখেন, পানাহার পরিত্যাগ করে নানারূপ বিক্ষোভ ধ্বনি সহকারে মিছিল করে গঙ্গাস্নান করেন। অপরাহ্নে এক জনসভায় মিলিত হয়ে তাঁরা বঙ্গভঙ্গ রদের শপথ গ্রহণ করেন।

মোহাম্মদ ওয়ালিউল্লাহ তাঁর ‘আমাদের মুক্তি সংগ্রাম’ গ্রন্থে বলেন,  “যে সময়ের কথা বলা হইতেছে তখন বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যা একই লেফটন্যান্ট গভর্নরের শাসনধীন ছিল। শাসন কার্যের সুবিধার জন্য পূর্ব বাংলাকে আসামের সহিত সংযুক্ত করিয়া দিয়া একটি নূতন প্রদেশ গঠনের বিষয় ব্রিটিশ সরকার অনেকদিন হইতে চিন্তা করিতেছিলেন। বড়লাট লর্ড কার্জন অবশেষে ভারত সচিবের সহিত পরামর্শ করিয়া বঙ্গ বিভাগের অনুকূলে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। এই সিদ্ধান্তের কথা প্রকাশ হওয়া মাত্রই বাংলার শিক্ষিত হিন্দু সমাজ ইহার বিরুদ্ধে প্রতিবাদমুখর হইয়া উঠে। দূর মফঃস্বলেও বংগভংগের বিরোধিতা করিয়া সভাসমিতিতে প্রস্তাব গৃহীত হইতে থাকে”। 

কিছু  মুসলমান হিন্দুদের প্রচার ও তথাকথিত দেশপ্রেম আন্দোলনে বিভ্রান্ত হয়ে বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনে যোগদান করেন। কিন্তু যখন দেখলেন যে, বালগংগাধর তিলক প্রমুখ হিন্দু নেতৃবৃন্দ শিবাজীকে আন্দোলনের প্রতীক হিসাবে উপস্থিত করে মুসলমানদের বিরুদ্ধে হিন্দুজাতির সুপ্ত ঘৃণা ও বিদ্বেষ জাগ্রত করতে লাগলেন, তখন তাঁরা বঙ্গভঙ্গের সুদূরপ্রসারী মঙ্গল ও তার বিরোধিতার মূল রহস্য উপলব্ধি করে আন্দোলন পরিত্যাগ করেন। এ প্রসংগে আবদুল মওদূদ তাঁর “মধ্যবিত্ত সমাজের বিকাশঃ সংস্কৃতির রূপান্তর” গ্রন্থে বলেন –“কিন্তু এই বংগভংগ বিভাগকে কেন্দ্র করে শিক্ষিত বর্ণহিন্দু সম্প্রদায় যে তুমুল আন্দোলন করে, তার প্রতিধ্বনিতে মুখরিত হয়ে উঠেছিল ব্রিটেনের সংবাদপত্রগুলি ও বেতনভুক্ত সাংবাদিকরা। নিজস্ব সংবাদদাতার পত্র ও ডিসপ্যাচসমূহে যেসব পরস্পর বিরোধী সংবাদ পরিবেশিত হতে লাগলো ‘দি টাইমস’ ও ‘মানচেষ্টার গার্জেনে’ তাতে ব্রিটিশ জনমত বিভ্রান্ত হয়ে পড়লো সঠিক পরিস্থিতি অনুধাবন করতে অসমর্থ হয়ে। টাইমস পত্রিকায় বংগভংগকে সমর্থন করে ও কার্জনের কার্যাবলীকে পূর্ণ অনুমোদন জানিয়ে সুন্দর সুন্দর সম্পাদকীয় প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। মানচেষ্টার গার্জেনে বঙ্গভঙ্গকে নিন্দা করে গরম গরম প্রবন্ধ বের হ’তে থাকে, নিজস্ব সংবাদদাতার বিবরণ প্রকাশিত হতে থাকে আন্দোলন সম্পর্কে ও বিক্ষোভকে সমর্থন জানিয়ে। কটন, নেভিন্সন ও হার্ডি বিক্ষোভকে সমর্থন করে বিবৃতি প্রচার করতে থাকে।

কংগ্রেস ও হিন্দু নেতাদের বিক্ষোভকে নতুন মাত্রা দিতে ‘স্বদেশী’ নামে রাজনৈতিক আন্দোলনের সূচনা করা হয়। সে আন্দোলনকে আরো তীব্র করতে বিলাতী পণ্য বর্জনের ডাক দেওয়া হয়। ১৯০৫ সালের ১৭ জুলাই বাগেরহাটে এক জনসভায় বিলাতি পণ্য বর্জন সংক্রান্ত প্রথম প্রস্তাব গৃহীত হয়। প্রস্তাবে বলা হয়, যতদিন বঙ্গভঙ্গ বাতিল না হবে, ততদিন ব্রিটিশ পণ্য বর্জন করা হোক। পরবর্তী ছয় মাস সব ধরনের আনন্দ অনুষ্ঠান ও উৎসবে অংশগ্রহণ বন্ধ রাখার কথাও প্রস্তাবে বলা হয়। কলকাতার রিপন কলেজে দু’দিনব্যাপী প্রতিবাদ সভা অনুষ্ঠিত হয়। বিলাতি পণ্য পোড়ানের আহ্বান জানানো হয় এবং সেখানে একটি কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়।

স্বদেশী আন্দোলন শুরু হওয়ার সাথে সাথে বরিশালের অশ্বিনীকুমার দত্ত এই আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন। তাঁর প্রতিষ্ঠিত ‘স্বদেশ বান্ধব সমিতি’ ১৫৯টি শাখার মাধ্যমে বরিশাল জেলায় স্বদেশী ও বয়কট আন্দোলন সংঘটিত করে। মহারাজা গিরিজা নাথের সভাপতিত্বে দিনাজপুরে এক সভায় বছরব্যাপী জাতীয় শোক পালন এবং জেলা বোর্ড, ইউনিয়ন বোর্ড ও পৌরসভা থেকে সকল সদস্যের পদত্যাগের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। বরিশালে লর্ড কার্জনের কুশপুত্তলিকা পোড়ানো হয়, শ্রাদ্ধানুষ্ঠান করে তাতে যুদ্ধ-মন্ত্রের মতো ‘বন্দে মাতরম’ গাওয়া হয় এবং বিভক্ত ‘বাংলা-মা’- এর পুনঃসংযোজন না হওয়া পর্যন্ত যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার সংকল্প প্রকাশ করা হয়।

১৯০৫ সালের ৭ আগস্ট কলকাতার টাউন হলে সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জীর উদ্যোগে মনীন্দ্রনাথ নন্দীর সভাপতিত্বে বাংলার বর্ণহিন্দু নেতৃবৃন্দের এক প্রতিবাদ সভা অনুষ্ঠিত হয়। পূর্ববঙ্গ থেকে ৪৬ জন প্রতিনিধি এই সভায় যোগ দেন। সভার প্রস্তাবে বলা হয়, “বঙ্গ বিচ্ছেদ প্রত্যাহার না হওয়া পর্যন্ত ব্রিটিশ পণ্য ব্যবহার হবে না”। বিলাতি পণ্য বয়কটের পাশাপাশি স্বদেশী মাল ব্যবহার, জাতীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপন, কর্মচারীদের অফিস বর্জন, সরকারের কাছে প্রতিনিধি দল প্রেরণ প্রভৃতি কর্মসূটি নেওয়া হয়। ১৯০৫ সালের আগস্ট মাসের শেষ দিকে ঢাকার জগন্নাথ কলেজে বাবু অন্নদা চন্দ্র রায়ের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জী অংশগ্রহণ করেন। এর কয়েক দিন পর বড়লাটের কাছে বঙ্গভঙ্গ রদের দাবিতে প্রতিনিধি দল পাঠানো হয়।

স্বদেশী ও বয়কট আন্দোলনের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের মধ্যে ছিলেন কলকাতাকেন্দ্রিক হিন্দু নেতাদের সর্বাধিনায়ক সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জী (১৮৪৮-১৯২৫), তাঁর সহযোগী ফরিদপুরের অম্বিকাচরণ মজুমদার (১৮৫১-১৯২২), আনন্দচন্দ্র রায় (১৮৪৪-১৯০৫), মোমেনশাহীর অনাথবন্দু গুহ, বর্ধমানের রাসবিহারী ঘোষ, নরেন্দ্রনাথ সেন, বরিশালের অশ্বিনা কুমার দত্ত (১৮৫৬-১৯২৩), সিলেটের বিপিন চন্দ্র পাল, কলকাতার অরবিন্দু বোস (১৮৭২-১৯৫৯), আনন্দমোহন বসু, রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী, কৃষ্ণকুমার মিত্র, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রমুখ।

১৯০৫ সালের ১৬ অক্টোবল বঙ্গভঙ্গ কার্যকরী হওয়ার প্রথম দিনে ঢাকার নওয়াব সলীমুল্লাহর নেতৃত্বে মুসলিম নেতৃবৃন্দ নর্থব্রুক হলের সভাস্থলে মিলিত হয়ে যখন নতুন প্রদেশের উন্নয়নে তাঁদের দায়-দায়িত্ব সম্পর্কে আলোচনা করছেন, কলকাতার চেহারা সেদিন সম্পূর্ণ অন্য রকম। এ সম্পর্কে এম আর আখতার মুকুল লিখেছেনঃ

“১৬ আক্টোবর এদের কর্মসূটির মধ্যে ছিল ধর্মঘট, গঙ্গাস্নান এবং রাখী বন্ধন। বাস্তব তথ্যের ভিত্তিতে উল্লেখ করতে হয় যে, এদিন কলকাতায় যে শোভাযাত্রা হয়েছিল অন্যদের মধ্যে রবীন্দ্রনাথও তার পুরোভাগে ছিলেন এবং তিনি অসংখ্য পথচারীর হাতে রাখী বেঁধে দিয়েছিলেন। অপরাহ্নে রোগ-জর্জর আনন্দমোহন বসু ‘মিলন মন্দিরের’ ভিত্তি প্রস্তর স্থাপনের অনুষ্ঠানের জন্য ইংরেজিতে যে ভাষণ লিখে এনেছিলেন তা পড়ে শুনালেন আাশুতোষ চৌধুরী এবং বাংলায় অনুবাদ করে পাঠ করেছিলেন বঙ্গদর্শন পত্রিকার সেই আমলের সম্পাদক কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। বিকেলের জনসভায় ঘোষিত শপথ বাক্যের বাংলায় তর্জমা করেও পাঠ করেছিলেন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ”। 

হিন্দুদের এইরূপ আন্দোলন ব্রিটিশদের কাছে ছিল অভাবনীয়। তারা চিন্তাও করতে পারেননি সদা অনুগত হিন্দুরা একটি সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে এতটা ক্ষেপে যাবে। হিন্দুরা ক্ষিপ্ত হওয়ার কারণ শুধু একটাই। চিরশত্রু মুসলিমদের উপকার। এই উপকার সহ্য করতে সক্ষম ছিলো না হিন্দুরা। তাদের এই হিংসাত্মক মনোভাব বাংলার শুরু থেকে চলে আসা মুশরিক ও মুসলিমদের মধ্যকার বিভেদকে জাগিয়ে তুলে। রাজনীতিতে উদাসীন পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত মুসলিমগণও হিন্দুদের মানসিকতার সাথে পরিচিত হয়।    

ক্রমেই বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন বর্ণহিন্দু চরমপন্হি নেতৃবৃন্দের নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। ১৯০৬ সালে এসে এই আন্দোলনকে কেন্দ্র করে গোপন সন্ত্রাসবাদী আন্দোলনের বিস্তার ঘটে। চিত্তরঞ্জন দাসের ইঙ্গিতে অনুশীলত সমিতি এ সময় পুরাপুরি সন্ত্রাসবাদী সংগঠনে পরিণত হয়। চিত্তরঞ্জন দাসকে এসময় হিন্দুরা দেশবন্ধু উপাধি দেয়। ঋষি বঙ্কিমচন্দ্র, রামকৃষ্ণ পরমহংস আর স্বামী বিবেকান্দের ‘নব্য হিন্দুবাদের’ দীক্ষাপ্রাপ্ত বর্ণহিন্দুরা দেশের বিভিন্ন স্থানে স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী গঠন, শরীর চর্চার আখড়া স্থাপন এবং কালী মন্দিরকে ঘিরে শক্তি সাধনায় মত্ত হয়ে ওঠে। হিন্দুদের সম্পাদিত পত্র-পত্রিকাগুলো মুসলমানদের বিরুদ্ধে উগ্রমূর্তি নিয়ে হামলা চালাতে থাকে। চরমপন্হিরা ১৯০৬ সালে অনুষ্ঠিত জাতীয় কংগ্রেসের অধিবেশনে বঙ্গভঙ্গ প্রশ্নে নরমপন্হিদের সাথে উত্তপ্ত পরিবেশ সৃষ্টি করে। হিন্দু ধর্ম-রাজ্যে বিশ্বাসী মারাঠা ব্রাহ্মণ বালগঙ্গাধর তিলককে কংগ্রেসের সভাপতি পদে মনোনয়ন দেওয়া হয় এবং এ নিয়ে ১৯০৭ সলে সুরাটে কংগ্রেসের অধিবেশনে মারামারি হয়।

১৯০৭ সাল ছিল বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনের চরম পর্যায়। ১৯০৯ সাল পর্যন্ত তা অব্যাহত থাকে। ১৯১০ সালে এসে এই আন্দোলনের উম্মত্ততা ক্রমশ নিস্তেজ হয়ে পড়ে। বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের চূড়ান্ত পর্যায়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বিপিনচন্দ্র পাল, বারীন ঘোষ, অরবিন্দ ঘোষ প্রমুখের প্রচেষ্টায় বর্ণহিন্দু লেখক, কবি ও সাংস্কৃতিক কর্মীদের হিন্দু জাতীয়তাবাদমূলক রচনা ও প্রচারণায় বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন সরকার বিরোধীতার সাথে সাথে মুসলিমবিরোধী আন্দোলনের রূপ লাভ করে। রাখী বন্ধন, কালী মন্দীরে শপথগ্রহণ, বন্দে মাতরম স্লোগান, এমনি অসংখ্য হিন্দু আচার এই আন্দোলনের সাতে জুড়ে দেওয়া হয়। সাম্প্রদায়িক বিষবাষ্প ছড়িয়ে দেওয়া হয় সর্বত্র। ফলে হিন্দু-মুসলিম সম্পর্কের দারুণ অবনতি ঘটে। রাস্তাঘা্টে সর্বত্র বিদ্বেষেরে আগুন ছড়িয়ে পড়ে। স্কুলে হিন্দু ছাত্ররা তাদের সহপাঠি মুসলমান ছাত্রদের মুখ থেকে ‘পিয়াজের গন্ধ আসে’ বলে অভিযোগ তুলে তাদের সাথে একত্রে বসতে অস্বীকার করে। ক্লাসে মুসলমান ছাত্রদের জন্য পৃথক শাখার ব্যবস্থা করতে হয়। 

বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে ১৯০৬ সালে নিখিল ভারত মুসলিম লীগ নামে মুসলমাদের একটি রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের জন্ম দিল। ঐ বছরই অক্টোবরে আগা খানের নেতৃত্বে নেতৃস্থানীয় ৩৬ জন মুসলমানের একটি প্রতিনিধিদল বড়োলাটের সাথে সাক্ষাত করে মুসলমানের জন্যে পৃথক নির্বাচনের দাবী জানান। বড়োলাট সম্মত হন এবং তারপরও বহু চাপ সৃষ্টির ফলে এবং সৈয়দ আমীর আলীর ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় ১৯০৯ সালে পৃথক নির্বাচন পদ্ধতি বৃটিশ পার্লামেন্ট কর্তৃক অনুমোদিত হয়। মুসলমানদের পৃথক রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান ‘মুসলিম লীগ’ এবং মুসলমানদেরজ জন্যে স্বতন্ত্র নির্বাচন প্রথা –এ দুটি অর্জন সমস্ত ভারতীয় হিন্দুদের গায়ে আগুন ধরিয়ে দেয়। ফলে সন্ত্রাসবাদী ও ‘স্বদেশী’ আন্দোলন একসাথেই সারা ভারতে আলোড়ন সৃষ্টি করে।

সন্ত্রাসীদের প্রথম লক্ষ্য ছিলো বঙ্গভঙ্গ বানচাল করা। দ্বিখন্ডিত ‘বাংলা মা’কে পুনর্জীবিত ও সন্তুষ্ট করার জন্যে মানুষের মারণাস্ত্র ব্যবহারের প্রশিক্ষণ দেয়া হলো। বোমা বিস্ফোরণে সরকারি অফিস আদালত ধ্বংস করা, সভা সমিতি বানচাল করা, খুন জখম, লুটতরাজ প্রভৃতি চলতে থাকলো পূর্ণ উদ্যমে। মেনিদীপুরের ক্ষুদিরাম ও বগুড়ার প্রফুল্ল চাকী এসব ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ ও হত্যাকান্ডে আত্মনিয়োগ করলো। বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন কেউ সমর্থন না করলে তার আর রক্ষা ছিল না। গুন্ডামী ও হত্যাকান্ডের সমালোচনা করলেও তার মুণ্ডুপাত করা হতো। এ কারণে জনৈক হিন্দু সরকারী উকিলকে ১৯০৯ সালে গুলী করে হত্যা করা হয়। ১৯১০ সালে ডিএসপি শামসুল আলমকেও হত্যা করা হয়। বাংলার লেফটন্যান্ট গভর্নরকে চারবার আক্রমণ করা হয়। ঢাকার জেলা ম্যাজিস্ট্রেট এলেনের উপর হাতবোমা নিক্ষেপ করা হয়।

বঙ্গভঙ্গ সমর্থনকারী মুসলমানদের বিরুদ্ধে এসব সন্ত্রাসবাদীরা ছিল খড়গহস্ত। আবার নিরীহ ও সরলপ্রকৃতির কিছু মুসলমানদেরকে তাদের আন্দোলনে ভিড়াবার জন্যে হিন্দুরা অন্যপথ অবলম্বন করলো। ‘বংগভংগের ইতিকথায়’ ইবনে রায়হান বলেন, হিন্দু মেয়েরা মুসলমানদের বাড়ী বাড়ী গিয়ে হিন্দু মুসলিম দুটি প্রাণ তথা দুই বাংলার মিলনের প্রতীক রাখী বন্ধনী পরিয়ে দিত মুসলমানদের হাতে, তাদের হৃদয় মন জয় করার জন্যে চারদিকে হতে ভেসে আসতো সুললিত কন্ঠের সুমধুর সুর-
বাংলার মাটি, বাংলার জল,
বাংলার বায়ু, বাংলার ফল।
সত্য হউক, সত্য হউক, সত্য হউক
হে ভগবান।
বাঙালীর প্রাণ বাঙালীর মন
বাঙালীর ঘরে যত ভাইবোন
এক হউক, এক হউক, এক হউক
হে ভগবান।

এভাবেও কিছু মুসলিম বিভ্রান্ত হয়েছিল। তবে যখন কালী মন্দিরে শপথ নেয়া শুরু হয়েছে এবং মুসলিম ও ইংরেজদের বিরুদ্ধে বোমা হামলা শুরু হয়েছে তখন ফিরে এসেছে। বোমা হামলা করার জন্য সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসী ক্ষুদিরামকে ফাঁসী দেওয়া হয়। অথচ এই ক্ষুদিরামকে বাংলাদেশের পাঠ্যবইসহ মূলধারার ইতিহাসে স্বাধীনতাকামী বিপ্লবী হিসেবে চিত্রিত করা হয়ে থাকে। 

সন্ত্রাসবাদ, নাগরিকদের বিশেষ করে ইংরেজদের জীবনের নিরাপত্তাহীনতা যতোটা ব্রিটিশ সরকারকে বিব্রত করে তুলেছিল, সম্ভবত তার চেয়ে অধিক বিব্রত করেছিল –বিলাতী বস্ত্রাদি বর্জন নীতি। ম্যানচেষ্টারের কলকারখানাগুলি বিরাট ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছিল। ম্যানচেষ্টার চ্যাম্বার অব কমার্সের কাছে হিন্দু বণিক সমিতির পক্ষ থেকে অনবরত চাপ সৃষ্টি করা হচ্ছিল। দ্ব্যর্থহীন ভাষায় তাদেরকে বলা হচ্ছিল, ‘যদি এ দেশে তোমাদের বস্ত্রাদি চালাতে চাও, তবে বঙ্গভঙ্গ রদ করো’।

বঙ্গভঙ্গ রদ ঠেকাবার বহু চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়ে খাজা সলিমুল্লাহ অত্যন্ত মর্মাহত হন এবং ১৯১২ সালের মার্চ মাসে কোলকাতায় অনুষ্ঠিত মুসলিম লীগের অধিবেশনে সভাপতির ভাষণে তিনি যে উক্তি করেন তাতে বাংলার মুসলমানদের অসন্তোষ ও বিক্ষোভই প্রতিধ্বনিত হয়েছে। তিনি বলেন যে, বঙ্গভঙ্গ রদের ফলে অনুন্নত পূর্ব বাংলার মুসলমানদের মনে চরম আঘাত লেগেছে এবং তাদের ঘরে ঘরে বিষাদের সঞ্চার হয়েছে। বংগভংগের ফলে অনুন্নত পূর্ব বাংলা ও আসামের অবহেলিত অধিবাসীগণ যে সুযোগ পেয়েছিল এবং বিশেষ করে মুসলমানদের উন্নতির যে সুযোগ পেয়েছিল তা সহ্য করতে না পেরে বিভাগ বিরোধীরা বঙ্গভঙ্গ বানচাল করার জন্যে রাজদ্রোহিতামূলক ষড়যন্ত্রের আশ্রায় গ্রহণ করে। এতে করে ব্রিটিশ সরকার এ আন্দোলনের কাছে নতি স্বীকার করে তাঁদের মর্যাদা ক্ষুণ্ণ করেছেন। নবাব সলিমুল্লাহ ব্রিটিশ সরকারের সমালোচনা করে বলেন “এতদিন সমগ্র প্রাচ্যে মনে করা হতো যে যাই ঘটুক না কেন ব্রিটিশ সরকার কখনো প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করেন না। যদি কোনো কারণে এ বিশ্বাস খর্ব হয়, তাহলে ভারতে ও প্রাচ্যে ব্রিটিশের মর্যাদা ক্ষুণ্ণ হবে”।

ফাতেমী মোহরানা ও মোহরানা নিয়ে কিছু কথা



একদিন হযরত আলী রা.-এর দাসী তাঁকে বললেন, আপনি কি জানেন ফাতিমার জন্য বিয়ের প্রস্তাব আসছে একের পর এক। আলী বললেন, কই জানিনা তো! 

দাসী- কিন্তু রাসূল সা. সব প্রস্তাব ফিরিয়ে দিচ্ছেন। 

আলী- ও... 

দাসী- তবে আপনি কেন যাচ্ছেন না? 

আলী- আমি কেন যাব? আমার কী যোগ্যতা আছে যা দিয়ে ফাতিমাকে গ্রহণ করতে পারবো? 

দাসী- আপনি যান, আপনাকেই রাসূল সা. জামাই হিসেবে গ্রহণ করবেন। 

আলী রা. বলেন, এভাবে দাসীর বারংবার চাপে আমি রাসূল সা.-এর নিকট উপস্থিত হলাম। কিন্তু তাঁকে কিছুই বলতে পারলাম না। লজ্জায় জড়সড় হয়ে বসে ছিলাম। এই অবস্থা দেখে রাসূল সা. বললেন,

- আলী তুমি কি আমাকে কিছু বলবে? তোমার কি কোনো প্রয়োজন আছে? 

- (জবাবে আলী রা. মাথা নিচু করে রাখলেন, কিছু বললেন না)

- আলী তুমি কি ফাতিমাকে বিয়ে করতে চাও? সেজন্যই কি এসেছ? 

- জ্বি

- আলী! তোমার পূর্বেও অনেকে ফাতিমার প্রস্তাব নিয়ে এসেছে। কিন্তু যখনই আমি তাদের প্রস্তাব ফাতিমার নিকট উপস্থাপন করেছি, সে না-সূচক জবাব দিয়েছে। এখন তোমার বিষয়টিও তাঁর কাছে তুলে ধরব।

এরপর আল্লাহর রাসূল সা. ফাতিমা রা.-এর নিকট গেলেন এবং বললেন,

আমি চাই তোমাকে আলীর সাথে বিবাহ দিতে। এ সম্পর্কে তোমার মতামত কি? 

হযরত ফাতেমা রা. লজ্জিত হয়ে মাথা নত করেন এবং নীরব থাকেন। এরপর রাসূল সা. উঠে আসলেন এবং প্রসিদ্ধ ব্যাক্যটি যা বিবাহ সংক্রান্ত ব্যাপারে ফকিহ্গণের নিকট অত্যন্ত সুপরিচিত তা উল্লেখ করেন, "আল্লাহু আকবার! তার নীরবতা হচ্ছে সম্মতির প্রমাণ।” 

অতঃপর রাসূল সা. পুনরায় আলী রা.-এর নিকট আসলেন এবং বললেন,

- আলী, তোমার কাছে এমন কিছু কী আছে যা দ্বারা তোমার স্ত্রীর দেনমোহর প্রদান করবে? 

- আমার পিতা-মাতা আপনার প্রতি উৎসর্গিত হোক। আপনি আমার জীবন-যাপন সম্পর্কে ভালভাবেই অবগত আছেন। আমার নিকট একটি তরবারী, একটি বর্ম ও একটি উট ছাড়া আর কিছুই নেই।

- ঠিক আছে, তরবারি তো তুমি দিতে পারবে না। তুমি যোদ্ধা, এই তরবারি দিয়েই তুমি শত্রুদের মোকাবিলা করবে। উটটিও দিতে পারবে না, কারণ উট দিয়ে খেজুর বাগানে পানি দিয়ে জীবিকা নির্বাহ করবে এবং সফরের সময়ও তোমার উটের প্রয়োজন হবে। অতএব, অবশিষ্ট থাকে শুধুমাত্র বর্ম। বর্ম যুদ্ধে প্রয়োজন হলেও তুমি বর্ম ছাড়াই যুদ্ধ করবে। এই বর্মই হোক তোমার মোহরানা। যা তোমার স্ত্রীকে তোমার জন্য হালাল করবে। এই হলো আলী রা. ও ফাতিমা রা.-এর বিয়ের ইতিহাস। এই ইতিহাসকে সামনে রেখে বর্তমান সমাজে চালু হয়েছে ফাতেমী মোহর। 

ফাতেমী মোহর 
যদি এই ঘটনাকে আদর্শ হিসেবে নিই তাহলে স্ত্রী-কে মোহর দিতে হবে জীবিকা/ব্যবসায়ের মূলধন (উট) ও পেশাগত সম্পত্তি (তলোয়ার) বাদে যত অস্থাবর সম্পত্তি আছে সব দিতে হবে। আল্লাহর রাসূল আলীর কোনো সম্পদ নাই দেখে বর্মকে মোহরানা হিসেবে নির্ধারণ করেছেন। এর মানে যদি কেউ বুঝে নেয় বর্ম হলো আদর্শ মোহরানা আমি বলবো তার বুঝের সমস্যা আছে। সে বুঝে হোক বা না বুঝে হোক স্ত্রী-কে ঠকানোর পাঁয়তারা করছে। আমার হিসেবে ফাতেমী মোহর অর্থাৎ সকল অস্থাবর দিয়ে দেওয়া খুবই কঠিন যা একজন মানুষের পক্ষে দেয়া কষ্টকর। 

প্রচলিত ফাতেমী মোহর কীভাবে নির্ধারণ হয়?
বাংলাদেশের বাজারে ফাতেমী মোহরের মূল্যমান ধরা হয় টাকার হিসেবে দেড় লাখ টাকার কাছাকাছি। কীভাবে বর্মটির দাম দেড়লক্ষ হলো? বলা হয় সেই বর্মটি বিক্রয় করা হয়েছে ৫০০ দিরহামে। আর ৫০০ দিরহামই হলো ফাতিমা রা.-এর মোহরানা। 

১ দিরহাম = ৩.১২৫ গ্রাম রূপা (ইমাম আবু হানিফার মতে। অন্যরা কেউ ২.৯৫, কেউ ৩ গ্রাম বলেছেন)

৫০০ দিরহাম = ১৫৬২.৫ গ্রাম রূপা 

১১.৬৩ গ্রাম রূপা = ১ তোলা 

১৫৬২.৫ গ্রাম রূপা = ১৩৪.৩৫ তোলা 

১ তোলা রূপা = ১০০০ টাকা (পরিবর্তনশীল)

১৩৪.৩৫ তোলা রূপা = ১৩৪৩৫০ টাকা। 

এটা হলো প্রচলিত হিসেব। যারা বুঝের সমস্যার কারণে বর্মকেই আদর্শ মোহর হিসেবে উল্লেখ করতে চান তারা নিজেদের বিয়েতে ফাতেমী মোহর নির্ধারণ করার চেষ্টা করেন। এটা যে ভ্রান্ত চিন্তা তা উল্লিখিত ঘটনা থেকে বুঝা যায়। 

এবার আসুন আরেকটি দিকে দৃষ্টিপাত করি। আসলেই কি বর্মটির দাম ৫০০ দিরহাম ছিলো? ইবনে কাসির তার ইতিহাস গ্রন্থ 'আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া'-তে আলী রা.-এর উদ্ধৃতি দিয়েছেন যেখানে আলী রা. বলেছেন, আল্লাহর কসম! ঐ বর্মটির দাম চার দিরহামের বেশি হবে না। কোথায় চার দিরহাম আর কোথায় ৫০০ দিরহাম! 

তাহলে ৫০০ দিরহাম কোথা থেকে আসলো?
এটা সম্ভবত আল্লাহর রাসূল সা. তার স্ত্রীদের যে মোহরানা দিয়েছেন তা থেকে নির্ধারিত হয়েছে। আবু দাউদে এসেছে আয়িশা রা.-কে রাসূলুল্লাহ সা.-এর স্ত্রীদের মোহরানা সম্বন্ধে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, বারো উকিয়া ও এক নাস্ব। 

নাস্ব মানে আধা উকিয়া। অর্থাৎ রাসূল সা.-এর স্ত্রীদের মোহরানা ছিলো সাড়ে বারো উকিয়া। 

১ উকিয়া = ৪০ দিরহাম 

১২.৫ উকিয়া = ৫০০ দিরহাম। 

সম্ভবত এভাবেই আল্লাহর রাসূলের স্ত্রীদের মোহরানাকে ফাতেমী মোহরানা হিসেবে চালিয়ে দেওয়া হচ্ছে। 

মোহর কীভাবে নির্ধারিত হবে? 
রাসূল সা.-এর সময়কার বিবাহগুলো থেকে দেখা যায়, রাসূল সা. সমসময় মোহরানা নির্ধারণ করতেন আলোচনা ও পরামর্শ করে। অর্থাৎ বরের সামর্থ অনুযায়ি ও কন্যার সম্মানের কথা বিবেচনা করে মোহর আলোচনা সাপেক্ষে নির্ধারিত হবে। এমনভাবে নির্ধারিত হওয়া উচিত যাতে বরের সেটা দেওয়ার সামর্থ থাকে। রাসূল সা. বলেছেন, উত্তম মোহর হচ্ছে যা দেয়া সহজ হয়। মোটকথা বিয়েতে মোহর অবশ্যই নির্ধারণ করতে হবে। মোহর ছাড়া বিয়ে হবে না। মোহরের কোন সর্বনিম্ন বা সর্বোচ্চ পর্যায় নেই। মোহর নির্ধারিত হবে সামর্থ অনুযায়ি এবং আলোচনা সাপেক্ষে। আল্লাহর রাসূল সা. এক লোকের দেওয়ার মতো কিছুই নাই বিধায় কুরআনের একটি সূরা মুখস্ত করানোর মোহরে বিয়ে দিয়েছেন। আবার আল্লাহর রাসূল সা. নিজে উম্মে হাবিবাহ-কে বিয়ে করেছেন চার হাজার দিরহাম দিয়ে। এই টাকা বিয়ের ঘটক বাদশাহ নাজ্জাশী আল্লাহর রাসূলের পক্ষে পরিশোধ করেন। অতএব কোন সম্পদের পরিমাণকে উত্তম মোহরানা বলা উত্তম হবে না। 

হজরত উমার রা. এর খিলাফতকালে যখন মুসলমানদের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি আসে তখন সাহাবারা তাদের সন্তানদের বিয়েতে বেশি মোহর ধার্য করতে শুরু করেন তখন হজরত উমার রা. দেনমোহরের ক্রমবৃদ্ধির গতিকে নিয়ন্ত্রণ করতে চেয়েছিলেন। তিনি এত বেশি পরিমাণ দেনমোহরের পক্ষে ছিলেন না। তিনি দেনমোহর কমানোর জন্য জুমুয়ার খুতবায় নসিহত করেন। অতঃপর তিনি একটি পরিমাণ নির্ধারণ করেন এবং বলেন এর বেশি মোহর ধার্য করা যাবে না। 

কিন্তু সেখানে এক মহিলা হযরত উমারের সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ করেন এবং সূরা আন নিসার ৪ নম্বর আয়াত পাঠ করেন। এ আয়াতে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন জানিয়েছেন, ‘তোমরা স্ত্রীদের তাদের মোহর দিয়ে দাও খুশি মনে’। তিনি আরো বলেন, এটা আমাদের হক আপনি এটা নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন না। আল্লাহর রাসূল আমাদের এই অধিকার প্রতিষ্ঠিত করেছেন। হযরত উমার রা. তার এই কথার জবাবে ভুল স্বীকার করে নেন এবং সিদ্ধান্ত বাতিল করেন। অতএব মোহরানা সেটাই উত্তম যেটা উভয়ের জন্য ইনসাফপূর্ণ।