২৮ জুল, ২০২০

বাঙালিরা কেন বেশি গরু কুরবানী করে?



মুহাম্মদ সা.-এর যুগে মদিনাতে তিনটি ইহুদী গোত্রের বসবাস ছিল। তারা তাদের ধর্মীয় গ্রন্থ থেকে আল্লাহর রাসূল সা.-এর আগমনের ভবিষ্যতবাণী জানতেন। এজন্য তাদের সাথে কারো ঝামেলা হলেই তারা বলতেন সময় হয়েছে আখেরি নবী আসার। তিনি আসলে তোদের শায়েস্তা করবো। এখন যেমন কেউ কেউ ইমাম মাহদীর জন্য অপেক্ষা করে বসে আছে, অথচ নিজের দায়িত্ব পালনে সচেষ্ট নয়, সেরকম। ইহুদীরা ভেবেছে যেহেতু নবীরা বেশি এসেছেন বনী ইসরাঈলে। তাই তাদের মধ্য থেকেই কেউ হবে শেষ নবী। কিন্তু যখন শেষ নবী আসলেন মক্কার কুরাইশ থেকে তখন তারা নবীকে মেনে নেয়নি। অথচ নবী সা. এর সাথে তাদের জানা সকল বৈশিষ্ট্য মিলে গিয়েছে। 

এই তিন ইহুদী গোত্র থেকে খুব কম অংশই ইসলাম গ্রহণ করেছে। অথচ তারা এই নবীর জন্যই বহু বছর ধরে অপেক্ষা করেছে। তারা শুধু মুহাম্মদ সা.-কে গ্রহণ না করেই ক্ষান্ত হয়নি। বরং বন্ধুত্বের মোড়কে থেকে পিঠে ছুরি মারার অপেক্ষায় ছিল। মদিনার তিন ইহুদী গোত্রই আল্লাহর রাসূল সা.-এর মদিনা সনদে চুক্তিবদ্ধ হয় এবং পরে বিশ্বাসঘাতকতা করে। এর মধ্যে বনু নাজিরের প্রধান কা'ব বিন আশরাফকে মদিনা রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে কুরাইশদের তথ্য সরবরাহ, চিঠি পাঠানো, আবু সুফিয়ানের সাথে মুহাম্মদ সা.-কে হত্যার চুক্তি স্বাক্ষর ও মুসলিমদের ওপর গণহত্যা চালানোর পরিকল্পনার অপরাধে হত্যা করা হয়। খন্দকের যুদ্ধের সময় কুরাইশরা আক্রমণ করলে মদিনায় থাকা বনু কুরাইজা পেছন দিক থেকে মুহাম্মদ সা.কে আক্রমণ করার পরিকল্পনা ও কুরাইশদের সাথে এই মর্মে চুক্তি করে। আল্লাহর রাসূল তাদের সাথে যুদ্ধ করেন ও তাদের সুপারিশকৃত বিচারকের রায়ে তাদের হত্যা করেন। বনু কায়নুকাও এমন এক মুসলিম মহিলাকে নির্যাতন বিবস্ত্র করার সূত্র ধরে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে এবং পরে তারা মদিনা থেকে বহিষ্কৃত হয়। 

যাই হোক ইহুদীদের মধ্যে অল্প সংখ্যক ইসলাম গ্রহণ করে। তাদের ইহুদী ধর্মে তারা উট খেত না এবং শনিবারকে পবিত্র জ্ঞান করতো। যারা ইসলাম গ্রহণ করেছে তাদের মধ্যে কেউ কেউ উট খাওয়া থেকে বিরত থাকতো এবং শনিবারে রোজা রাখতো ও নফল ইবাদত বেশি করতো। এটা তাদের পূর্বের ধর্মের অনুরাগ থেকেই করতো। তাদের এই আচরণ আল্লাহ পছন্দ করেন নি। তাদের উদ্দেশ্যে সূরা বাকার ২০৮ ও ২০৯ নং আয়াতে আল্লাহ বলেন,

//হে মুমিনগণ, তোমরা ইসলামে পরিপূর্ণভাবে ইসলামে প্রবেশ করো এবং শয়তানের অনুসরণ করো না। নিশ্চয়ই সে তোমাদের স্পষ্ট শত্রু। অতএব তোমরা যদি সুস্পষ্ট নিদর্শন আসার পরও পদস্থলিত হও তবে জেনে রাখো, আল্লাহ পরাক্রমশালী ও প্রজ্ঞাবান।// 

চট্টগ্রামের প্রখ্যাত আলিম অধ্যাপক মফিজুর রহমান বলেন, আল্লাহ তায়ালা ইহুদীদের উট খেয়ে মুসলিম হতে বলেছেন। যারা ইহুদী তারা যদি মুসলিম হয় তবে তারা উট খেয়ে নিশ্চিত হতে হবে সত্য উপলব্ধি করার পর আগের ধর্মের প্রতি তাদের ভালোবাসা আর নেই। তেমনি এদেশে যারা মুশরিক থেকে মুসলিম হবে তারাও গরু খেয়ে নিশ্চিত হতে হবে তারা এখন আর গরুকে তাদের মা মনে করেন না। 

আর একারণে বাংলায় দাওয়াতী কাজে আসে আলিমরা এদেশের মানুষকে গরু জবাইতে অভ্যস্ত করে তুলেছেন। যাতে তারা পরিপূর্ণভাবে মুসলিম হয়।       
  
ঈদুল আযহায় গরু কুরবানী সম্ভবত সবচেয়ে বেশি দেওয়া হয় বাংলাদেশে। অথচ বাঙালিদের আশে পাশের মুসলিম জাতিরা এই ঈদকে বকরির ঈদ বলে। তারা সাধারণত বকরি/ভেড়া কুরবানী করে। মধ্যপ্রাচ্যেও উট, দুম্বা, ভেড়া ইত্যাদি দেয়া হয়। অবশ্য সেসব স্থানে গরু বেশি উৎপাদন হয় না, এটাও একটা ব্যাপার হতে পারে। ইন্দোনেশিয়াতেও গরু কুরবানী হয় তবে সেটা বাঙালিদের মতো এতো বেশি সংখ্যায় অবশ্যই নয়।

এর ঐতিহাসিক কারণ রয়েছে। খ্রিস্টপূর্ব যুগে যখন আর্যরা এদেশে আগ্রাসন চালাতে শুরু করেছে তখন থেকে তারা তাদের আয়ত্বাধীন এলাকাগুলোতে গরু কুরবানী বা জবাই করা বন্ধ করে দেয়। তখন থেকে বাঙালিরা বা দ্রাবিড়রা গরু জবাইকে মুশরিকদের বিরুদ্ধে এক ধরনের প্রতিবাদ হিসেবে দেখে আসছে। এদেশে ইসলাম রাজনৈতিকভাবে আগমনের আগে ও পরে বহু মুসলিম প্রাণ দিয়েছেন গরু কুরবানীর কারণে। এই নিয়ে পাল আমল ও সেন আমলে ব্রাহ্মন্যবাদী তথা আর্যদের সাথে মুসলিমদের যুদ্ধ হয়েছে। এরকম একটি যুদ্ধ হয়েছে বাবা আদম শহীদের সাথে বল্লাল সেনের। 

বাবা আদম শহীদ (রহ.) ১১৪২ খিস্টাব্দে ইসলাম প্রচারের উদ্দেশে ১২ জন আরবীয় নাগরিক নিয়ে বাণিজ্য জাহাজযোগে চট্টগ্রাম পৌঁছান। তিনি জন্মগ্রহণ করেন পবিত্র আরব দেশের তায়েফ নগরীতে। ১০৯৯ সালে জেরুজালেম ক্রুসেডে তার বাবা শহীদ হন। খোরসান প্রদেশে প্রাথমিক শিক্ষা লাভের পর বাবা আদম (রহ.) উচ্চশিক্ষার জন্য বাগদাদের নিজামিয়া মাদ্রাসায় ভর্তি হন। নিজামিয়া মাদ্রাসা থেকে উচ্চ শিক্ষালাভের পর বাবা আদম (রহ.) আধ্যাত্মিক জ্ঞান অর্জনের জন্য বাগদাদে হজরত আবদুল কাদির জিলানী (রহ.)-এর সাহচর্যে আসেন এবং তার থেকে শিক্ষা গ্রহণ করেন।

বাবা আদম (রহ.) প্রথমে মহাস্থানগড়ে মাদ্রাসা স্থাপন করে ইসলাম প্রচার শুরু করেন। তার সফরসঙ্গী ১২ জন আউলিয়ার অধীনে ১২টি মিশন গঠন করে এলাকায় পানির অভাব দূর করতে পুকুর খনন, শিক্ষা, চিকিৎসাসেবা ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ১২ জন ওলি বাবা আদমের নেতৃত্বে ইসলাম প্রচারে বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে পড়েন। ইসলাম প্রচারের সময় রাজা বল্লাল সেনের রাজকর্মচারীদের সঙ্গে বিরোধ তৈরি হয়। বিরোধ যুদ্ধের দিকে গড়িয়ে যায় গরু কুরবানীকে কেন্দ্র করে। একজন নওমুসলিম গরু জবাই করলে বল্লালসেনের কর্মাচারীরা সেই পরিবারের সবাইকে হত্যা করে। বাবা আদম এর প্রতিবাদে সেই কর্মচারীদের গ্রেপ্তার করে।

বল্লাল সেন বাংলায় দ্বীন প্রচারকারী সব দায়ির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। ১১৭৪ সালে বিক্রমপুরের কানাইচং ময়দানে বল্লালসেনের বাহিনীর মোকাবেলা করেন বাবা আদম শহীদ। সে যুদ্ধে বল্লাল সেন পরাস্ত হয়ে ফিরে যান। এর চার বছর পর বল্লাল সেন আবারো আক্রমণ করেন বিক্রমপুর তথা মুন্সিগঞ্জে। ১০ থেকে ২০ সেপ্টেম্বর ১১৭৮ সালে মুন্সীগঞ্জে কানাইচং ময়দানে ১০ দিনব্যাপী প্রচণ্ড যুদ্ধে বহু সংখ্যক সৈন্য ও মুজাহিদ নিহত হন। এ যুদ্ধে বল্লাল সেনের সৈন্য ছিল ২০ হাজার, অপরদিকে মুজাহিদ ও সেচ্ছাসেবক বাহিনীর সংখ্যা ছিল ৭ হাজার। যুদ্ধে পরাজয়ের আশংকায় বল্লাল সেন ২০ সেপ্টেম্বর ১১৭৮ সালে যুদ্ধ বিরতির প্রস্তাব করলে বাবা আদম সরল বিশ্বাসে মেনে নেন। সেদিন রাতে ঘটে বিশ্বাসঘাতকতা। বিক্রমপুরের দরগাহ বাড়িতে রাতে অতর্কিত আক্রমণ করে এবং বাবা আদম শহীদ রহ.-কে হত্যা করে। তাঁর কবর মুন্সিগঞ্জে এখনো আছে। তাঁর নামে বহু বছর পর সুলতানি আমলে একটি মসজিদও স্থাপিত হয়।

গরু কুরবানী নিয়ে এভাবে অসংখ্য বাঙালি জীবন দিয়েছেন। এরপর আরেকটি মশহুর ঘটনা হলো শ্রীহট্ট তথা সিলেটের ঘটনা। সেটাও গরু জবাইকে কেন্দ্র করে। বখতিয়ার খিলজির মাধ্যমে বাংলা মুসলিমদের অধিকারে আসার পর সিলেটে মুসলমান জনবসতি গড়ে ওঠেছে। সেখানের অধিবাসী বুরহান উদ্দীন নামক জনৈক মুসলমান নিজ ছেলের আকিকা উপলক্ষে গরু জবাই করে হিন্দু রাজা গৌর গোবিন্দের কাছে অপরাধী সাব্যস্ত হন। এ কারণে, গোবিন্দ বুরহান উদ্দীনের শিশুপুত্রকে হত্যা করে। বুরহান উদ্দীন বাংলার তত্কালীন রাজা শামস উদ্দীন ফিরোজ শাহের নিকট গিয়ে এই নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ডের অভিযোগ করলে রাজা তাঁর ভাগ্নে সিকান্দর গাজীকে তার বাহিনীসহ সিলেটে প্রেরণ করেন। সৈন্যরা যখন ব্রহ্মপুত্র নদী পার হতে চেষ্টা করে তখনই রাজা গোবিন্দ যাদুশক্তির সাহায্যে মুসলিম সৈন্যের উপর অগ্নিবাণ নিক্ষেপ করে সমস্ত চেষ্টাকে বিফল করে ফেলে। সিকান্দার শাহকে ঠেকিয়ে দেয়। গোবিন্দের যাদুশক্তির প্রভাবে সিকান্দর গাজীর ব্যর্থ হওয়ার সংবাদ দিল্লীর সম্রাট আলাউদ্দীন খিলজীর নিকট পৌঁছলে সম্রাট এ সংবাদে মর্মাহত হন।

দিল্লির সম্রাট তার সেনাবাহিনীর মধ্যে একজন বুজুর্গ ও আল্লাহ ওয়ালা সেনানায়ককে দায়িত্ব দিলেন সিলেট অভিযানে। তিনি ছিলেন সৈয়দ নাসির উদ্দীন। এদিকে বুরহান উদ্দীন তখন দিল্লীতে অবস্থান করছিলেন। এসময় শাহ জালালও তাঁর সঙ্গীদের নিয়ে দিল্লীতে আসেন। দিল্লীতেই বুরহান উদ্দীনের সাথে শাহ জালাল উদ্দিনের সাক্ষাৎ হয় এবং এখানেই বুরহান উদ্দীন তার কাছেও নিজের পুত্র হত্যার কাহিনী বর্ণনা করেন।

শাহ জালাল উদ্দিন দিল্লী হতে বুরহান উদ্দীনসহ ২৪০ জন সঙ্গীসহচর সিলেটের উদ্দেশ্য রওয়ানা হলেন। শাহ জালাল সাতগাঁও এসে ত্রিবেণীর নিকট দিল্লীর সম্রাট প্রেরিত সিপাহসালার সৈয়দ নাসির উদ্দীনের সাথে মিলিত হন। সৈয়দ নাসির উদ্দীন শাহ জালাল সম্পর্কে অবগত হয়ে তদীয় শিষ্যত্ব গ্রহণের অভিপ্রায় ব্যক্ত করেন। পথে পথে শাহ জালালের শিষ্য বর্ধিত হতে লাগল। ত্রিবেণী থেকে বিহার প্রদেশে আসার পর আরো কয়েকজন জিহাদী সাথী হলেন। যাদের মধ্যে হিসাম উদ্দীন, আবু মোজাফর উল্লেখযোগ্য। এখান থেকে সিপাহসালার সৈয়দ নাসির উদ্দীনের আনিত এক হাজার অশ্বারোহী ও তিন হাজার পদাতিক সৈন্যসহ শাহ জালাল নিজ সঙ্গীদের নিয়ে সোনারগাঁ অভিমুখে সিকান্দর গাজীর সাথে মিলিত হওয়ার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন। সিকান্দর গাজী সোনারগাঁয়ে অপেক্ষা করছিলেন।

সিকান্দর গাজী শাহ জালাল উদ্দিনের শিষ্যত্ব গ্রহণপূর্বক সিলেট অভিমুখে যাত্রা করলেন। এভাবে শাহ জালালের শিষ্য সংখ্যা বেড়ে ৩৬০ জনে পৌঁছায়। এদিকে গৌর গৌবিন্দ শাহ জালালের সমাগম সংবাদ পেয়েছেন। নতুন এ দল যাতে ব্রহ্মপুত্র নদী পার না হতে পারেন, সে জন্য নদীর সমস্ত নৌ-চলাচল বন্ধ করে দেয়। জনশ্রুতি আছে, তিনি তাঁর শিষ্যদের নিয়ে বিনা বাধায় জায়নামাজের সাহায্যে ব্রহ্মপুত্র নদী অতিক্রম করেন। শাহ জালাল উদ্দিনের এই অভিনব আগমনে ভীত হয়ে যুদ্ধ ছাড়াই পলায়ন করে গৌর গোবিন্দ। সিলেট শহরে প্রবেশ করে সর্বপ্রথম হযরত শাহ জালাল উদ্দিন (রঃ) এর আদেশে সিপাহসালার সৈয়দ নাসিরুদ্দিন আজান দেন। বুজুর্গ নাসির উদ্দিনের আজানের ধ্বনিতে গৌর গোবিন্দের যাদুগুলো অকার্যকর হয়ে পড়ে। যাদুবিদ্যার স্থান ও মন্দির ধ্বসে পড়ে।

পরবর্তিতে সুলতানি আমলজুড়ে দ্রাবিড় তথা বাঙালিরা গরু কুরবানী করে মুশরিকদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদস্বরূপ। এটি ধীরে ধীরে বাঙালিদের কালচারে পরিণত হয়েছে। ইংরেজ আমলে যখন হিন্দু জমিদাররা আবারো মুসলিমদের উপর চেপে বসে তখনো গরু কুরবানী নিয়ে বাঙালিদের বহু নির্যাতনের মুখোমুখি হতে হয়েছে। পাকিস্তান আমল থেকে বাঙালিরা আবারো মহা সমারোহে গরু কুরবানী করতে শুরু করে মুশরিকদের বহুদিনের নির্যাতনের প্রতিবাদে। 

আমাদের গরু কুরবানী শুধু কুরবানী নয়, এটি মুশরিকদের রসমের প্রতিবাদ ও কুরআনের নিদর্শনের বাস্তবায়ন।

২৩ জুল, ২০২০

ইসলামী রাষ্ট্র ও রাজতন্ত্রের মধ্যে কিছু মৌলিক ব্যবধান



এখন শুধু বাংলাদেশ নয় সারা পৃথিবীতেই মুসলিমদের মধ্যে তুর্কি খিলাফত ট্রেন্ডে আছে। সবাই লকডাউনে দিরিলিস ও কুরুলুসের ভক্ত হয়ে পড়েছে। সারা পৃথিবীর চাহিদার কথা মাথায় রেখে তুর্কি মুভি পরিচালকেরা একের পর এক সিরিজ নামাচ্ছে। সেদিন ফেসবুকের এক আলাপচারিতায় দেখলাম এক দ্বীনি ভাই উসমানীয় পরিবারের খুব প্রশংসা করে বাংলাদেশে এমন একটি সাহসী পরিবারের জন্য আক্ষেপ করছে। আমি তখন বুঝলাম একটি ভুল মেসেজ সমাজে ছড়িয়ে পড়ছে।

তারও আগে সম্ভবত ১১ সালের কথা। তখন হিজবুত তাহরির মাত্র নিজেদের জানান দিচ্ছে। বিভিন্ন স্থানে ঘরোয়া সমাবেশ ও সম্মেলন করে বেড়াচ্ছে। সেসময় একদিন হিজবুত তাহরিরের এক সমাবেশে উপস্থিত হয়ে জানতে পারলাম খিলাফত ১৯১৯ সালে ধ্বংস হয়েছে। সেই খিলাফত আমাদের পুনরুদ্ধার করতে হবে। আমি অবাক হয়ে রইলাম। অথচ আমি ছোটবেলা থেকেই জানি খিলাফত ধ্বংস হয়েছে আলী রা.-এর শাহদাতের মাধ্যমে। 

খিলাফত ও রাজতন্ত্রের মধ্যে পার্থক্য জানা খুব জরুরি। যে সংগঠন এই পার্থক্য জানে না তারা ইসলামের মূল চেতনায় নেই একথা বলাই যায়। কেউ নিজেকে খলিফা দাবি করলে সেই ব্যক্তি খলিফা বা তার রাষ্ট্র খিলাফত রাষ্ট্রে পরিণত হয়না। খিলাফত ও রাজতন্ত্রের মধ্যে কিছু মৌলিক পার্থক্য রয়েছে। তেমনি কোনো রাষ্ট্রে সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম হলে, মুসলিম রাষ্ট্রপ্রধান হলে এবং কতিপয় অপরাধের ইসলাম নির্ধারিত শাস্তি বাস্তবায়িত হলেও তা খিলাফত রাষ্ট্র হয় না। রাসূল সা. এর খিলাফত রাষ্ট্রের কিছু মৌলিক বৈশিষ্ট্য রয়েছে যা আমাদের জানা আবশ্যক।  

 প্রথমত রাষ্ট্রের নেতা/ খলিফা/ আমীর/ রাষ্ট্রপ্রধান নির্বাচন হবে শুরার মাধ্যমে।
নেতা নির্বাচনের বৈধ পন্থা দুইটি। এক আল্লাহর মনোনীত, দুই জনগণের মনোনীত। যেহেতু আল্লাহ আর নবী পাঠাচ্ছেন না তাই প্রথম বৈধ পন্থা রহিত। বাকী রইলো জনগণের মনোনীত। খিলাফতের নেতা নির্বাচনের পন্থা ছিল জনগণের মতামত ও পরামর্শের ভিত্তিতে। কেউ নিজে ক্ষমতা লাভের চেষ্টা করেননি, নিজের চেষ্টা-তদবীর দ্বারা ক্ষমতা গ্রহণ করেননি, বরং জনগণ উম্মাতের নেতৃত্বের জন্য যাকে যোগ্য মনে করতো, পরামর্শক্রমে তাঁর ওপর দায়িত্ব ন্যস্ত করতো। বায়আত (আনুগত্যের শপথ) ক্ষমতার ফল ছিল না, বরং তা ছিল ক্ষমতার কারণ। বায়আত লাভে মানুষের চেষ্টা বা ষড়যন্ত্রের আদৌ কোন ভূমিকা ছিল না বায়আত করা না-করার ব্যাপারে জনগণ সম্পূর্ণ স্বাধীন মতামতের ভিত্তিতে বায়আত করত। বায়আত লাভের আগে কেউ ক্ষমতা গ্রহণ করতেন না। যে ব্যক্তি দায়িত্ব চেয়ে নেয় সে ব্যক্তি দায়িত্বের জন্য সবচেয়ে অযোগ্য ব্যক্তি।

 এ নিয়মের ব্যতিক্রম থেকেই রাজতন্ত্রের সূচনা। হযরত মুআবিয়া রা.-এর খেলাফত এ ধরনের ছিল না যে, জনগণ খলিফা করেছে বলে তিনি খলিফা হয়েছিলেন- জনগণ খলিফা না করলে তিনি খলিফা হতেন না। যেভাবেই হোক তিনি খলিফা হতে চেষ্টা করেছেন। যুদ্ধ করে তিনি খেলাফত হাসিল করেছেন। মুসলমানদের সন্তুষ্টি-অসন্তুষ্টির তোয়াক্কা করেননি তিনি। জনগণ তাঁকে খলীফা করেনি, তিনি শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে খলীফা হয়েছেন। খেলাফতের সূচনাকালে একবার মদীনায় ভাষণদান প্রসঙ্গে তিনি নিজে বলেছিলেন, আল্লার কসম করে বলছি, তোমাদের সরকারের দায়িত্ব গ্রহণকালে আমি এ বিষয়ে অনবহিত ছিলাম না যে, আমার ক্ষমতায় আসীন হওয়ায় তোমরা সন্তুষ্ট নও, তোমরা তো পছন্দ করো না। এ বিষয় তোমাদের মনে যা কিছু আছে, আমি তা ভালো করেই জানি। কিন্তু আমার এ তরবারী দ্বারা তোমাদেরকে পরাভূত করেই আমি তা অধিকার করেছি। [আল-বেদায়া ওয়ান নেহায়া, ইবনে কাসীর, ৮ম খন্ড, পৃষ্ঠা- ১৩২।]

দ্বিতীয়ত শাসকদের লাইফস্টাইল সাধারণ মানুষ থেকে আলাদা কিছু হবে না। 
রাজতন্ত্রের সূচনালগ্ন থেকেই বাদশাবেশধারী খলিফারা কায়সার ও কিসরার অনুরূপ জীবনধারা অবলম্বন করে। মহানবী সা. এবং চারজন খোলাফায়ে রাশেদীন যে জীবনধারা অবলম্বন করেছিলেন, তারা তা পরিহার করে। তারা শাহী মহলে বিলাসবহুলভাবে বসবাস শুরু করে। রাজকীয় দেহরক্ষী বাহিনী তাদের রাপ্রাসাদের হেফাযতে নিয়োজিত হয় এবং সর্বদা তাদের পাহারায় নিযুক্ত থাকে। তাদের এবং জনগণের মধ্যে দেহরক্ষী ও প্রহরী অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়।

খলিফারা যে ধারায় শাসন কার্য পরিচালনা করতেন, এটা ছিল তার সম্পূর্ণ বিপরীত- একেবারেই তার পরিপন্থী। তাঁরা জনগণের মধ্যে বাস করতেন। সেখানে যে কোন ব্যক্তি স্বাধীনভাবে তাঁদের সাথে সাক্ষাৎ করতে পারতো। তাঁরা হাট-বাজারে গমন করতেন এবং যে কোন ব্যক্তি তাঁদের সাথে কথা বলতে পারতো। তাঁরা জনগণের সাথে সারিবদ্ধ হয়ে পাঁচ ওয়াক্ত সালাত আদায় করতেন এবং জুমার খুতবায় আল্লার জিকর এবং দ্বীনের শিক্ষার পাশাপাশি সরকারের নীতি সম্পর্কেও জনগণকে অবহিত করতেন। তাঁদের নিজেদের এবং সরকারের বিরুদ্ধে জনগণের যে কোন অভিযোগের জবাব দিতেন তাঁরা। হযরত আলী (রাঃ) প্রাণের আশংকা সত্ত্বেও জীবনের মুহূর্ত পর্যন্ত কুফায় এ নিয়ম বজায় রেখেছিলেন।

তৃতীয়ত রাষ্ট্রের মালিক কিংবা রাষ্ট্রীয় সম্পদের মালিকানা রাষ্ট্রপ্রধানের নয়।
বায়তুল মাল সম্পর্কিত ইসলামী নীতি এই যে, তা খলিফা এবং তাঁর সরকারের নিকট আল্লাহ এবং জনগণের আমানত। বায়তুল মাল কখনোই শাসকের সম্পত্তি নয়। শাসক/ খলিফা রাষ্ট্রের একজন বেতনভোগী কর্মচারি মাত্র। রাষ্ট্রীয় সম্পদ কারো মর্জিমতো ব্যবহারের অধিকার নেই। খলীফা বে-আইনীভাবে তাতে কিছু জমা করতে পারেন না, পারেন না তা থেকে বে-আইনীভাবে কিছু ব্যয়ও করতে। এক একটি পাই পয়সার আয়-ব্যয়ের জন্য তাঁকে জবাবদিহি করতে হয়। সাধারণ জীবন যাপনের জন্য যতটুকু প্রয়োজন, কেবল ততটুকু গ্রহণ করার অধিকার আছে তার।

রাজতন্ত্রে বায়তুল মালের এ নীতি পরিবর্তিত হয়ে যায় এবং বায়তুল মাল বাদশা ও শাহী বংশের মালিকাধীন হয়ে পড়ে। প্রজারা পরিণত হয় বাদশার নিছক করদাতায়। সরকারের নিকট হিসেব চাওয়ার কারো অধিকারই থাকে না। এ সময় বাদশাহ এবং শাহজাদাদের এমনকি তাদের গভর্ণর এবং সিপাহসালাদের (সেনাপতিদের) জীবন যে শান-শওকতের সাথে নির্বাহ হয়ে থাকে, তা বায়তুল মালকে অন্যায়ভাবে নিজের স্বার্থে ব্যবহার করা ছাড়া কিছুতেই সম্ভব নয়।

চতুর্থত খলিফার সিদ্ধান্তের পর্যালোচনায় জনগণ স্বাধীন থাকবে।
ইসলামে 'সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজে বাধা' এটাকে কেবল মুসলমানদের অধিকারই নয়, বরং ফরয বা কর্তব্য হিসেবে নির্ধারণ করা হয়েছে। জাতির সচেতন বিবেক জনগণের বাক-স্বাধীনতা, যে কোন অন্যায় কাজে সর্বোচ্চ আসনে সমাসীন ব্যক্তির সমালোচনা এবং প্রকাশ্যে সত্য কথা বলার স্বাধীনতার ওপরই ইসলামী সমাজ ও রাষ্ট্রের সঠিক পথে পরিচালিত হওয়া নির্ভরশীল ছিল। খিলাফতের সময়ে জনগণের এ স্বাধীনতা সম্পূর্ণ সংরক্ষিত ছিল। খলিফারা এ জন্য শুধু অনুমতিই দিতেন না বরং এজন্য জনগণকে উৎসাহিতও করতেন। তাঁদের শাসনামলে সত্যভাষীর কণ্ঠরোধ করা হতো না বরং এ জন্য তাঁরা প্রশংসা এবং অভিনন্দন লাভ করতেন। সমালোচকদেরকে দাবিয়ে রাখা হতো না, তাদেরকে যুক্তিসঙ্গত জবাব দিয়ে সন্তুষ্ট করার চেষ্টা করা হতো।

কিন্তু রাজতন্ত্রের যুগে বিবেকের ওপর তালা লাগানো হয়, মুখ বন্ধ করে দেয়া হয়। প্রশংসার জন্য মুখ খোলো অন্যথায় চুপ থাকো – এটাই তখন রীতিতে পরিণত হয়। যদি তোমার বিবেক এতই শক্তিশালী হয় যে, সত্য ভাষণ থেকে তুমি নিবৃত্ত থাকতে না পারো তাহলে কারাবরণ, প্রাণদন্ড ও চাবুকের আঘাতের জন্য প্রস্তুত হও। তাই সে সময়ে যারা সত্য ভাষণ এবং অন্যায় কাজে বাধা দান থেকে নিবৃত্ত হননি, তাদেরকে কঠোরতম শাস্তি দেয়া হয়েছে। সমগ্র জাতিকে একটা ভীতিকর অবস্থায় রাখাই রাজতন্ত্রের লক্ষ্য। হযরত মুআ’বিয়া রা.-এর শাসনামলে আল্লাহর রাসূল সা.-এর সাহাবী একজন সাধক ও ইবাদতগুযার এবং উম্মাতের সৎ ব্যক্তিদের মধ্যে বিশিষ্ট মর্যাদার অধিকারী হযরত হুজর ইবনে আদীর হত্যার (৫১ হিজরী) মাধ্যমে এ নতুন পলিসির সূচনা হয়। এই ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ রয়েছে ইবনে কাসীরের বিদায়া ওয়ান নেহায়াতে।

পঞ্চমত বিচার বিভাগের ভূমিকা শাসক ও জনগণ নির্বিশেষে একই থাকবে।
ইসলামী রাষ্ট্রের অন্যতম মূলনীতি ছিল বিচার বিভাগের স্বাধীনতা। খেলাফতে রাশেদায় খলিফারাই বিচারক নিয়োগ করলেও আল্লার ভয় এবং নিজের জ্ঞান ও বিবেক ব্যতীত অন্য কিছুরই চাপ এবং প্রভাব খাটাতো না তাঁর ওপর। কোন শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিই আদালতের কাজে হস্তক্ষেপের সাহস করতে পারতো না। এমনকি, কাযী স্বয়ং খলীফার বিরুদ্ধে রায় দিতে পারতেন এবং দিতেনও। কিন্তু রাজতন্ত্রের আগমনে অবশেষে এ নীতিরও অবসান ঘটতে থাকে। 

যেসব ব্যাপারে এ খলিফা নামধারী বাদশাহদের রাজনৈতিক এবং ব্যক্তিগত স্বার্থ জড়িত ছিল, সেসব ব্যাপারে সুবিচার করার ক্ষেত্রে আদালতের স্বাধীনতা হরণ করা হয়। এমনকি শাহযাদা, গভর্নর, নেতা-কর্তা ব্যক্তি এবং রাজমহলের সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে মামলায় সুবিচার করাও অসম্ভব হয়ে পড়ে। সে সময়ের সত্যাশ্রয়ী আলেমদের সাধারণত বিচারকের আসন গ্রহণে রাজি না হওয়ার এটাই ছিল অন্যতম প্রধান কারণ আর যেসব আলেম এ শাসকদের পক্ষ থেকে বিচারকের আসন গ্রহণ করতে রাজি হতেন, তারা সুবিচার করতে সক্ষম হতেন না।

রাজতন্ত্রের যুগে রাজা বাদশাহরা ব্যক্তি স্বার্থ, রাজনৈতিক উদ্দেশ্য এবং বিশেষ করে নিজেদের শাসন পাকা-পোক্ত করার ব্যাপারে শরীয়াত নির্ধারিত বিধি-বিধান লংঘন এবং তার সীমারেখা অতিক্রমে কুণ্ঠাবোধ করেনি। যদিও তাদের সময়েও দেশের আইন ইসলামীই ছিল, তাদের কেউই আল্লাহর কিতাব এবং রাসূলের সুন্নার আইনগত মর্যাদা অস্বীকার করেনি। এ আইন অনুযায়ী আদালত ফয়সালা করতো, সাধারণ পরিস্থিতিতে শরীয়তের বিধান অনুযায়ী সকল বিষয়ের মিমাংসা হতো। কিন্তু শাসক ও ক্ষমতাসীনদের ব্যাপারে আইন একইভাবে প্রয়োগ হতো না। তাদের জন্য অনেক অবৈধ জিনিস বৈধ হয়ে যায়।

ষষ্ঠত সরকার পরিচালিত হবে পরামর্শভিত্তিক।
ইসলামী রাষ্ট্রের অন্যতম মূলনীতি ছিল, রাষ্ট্র শাসিত হবে পরামর্শের ভিত্তিতে আর পরামর্শ নেয়া হবে এমন সব লোকের, যাদের তত্ত্বজ্ঞান, তাকওয়া, বিশ্বস্ততা এবং নির্ভুল ও ন্যায়নিষ্ঠ মতামতের ওপর জনগণের আস্থা রয়েছে। খুলাফায়ে রাশেদীনের শাসনামলে জাতির শ্রেষ্ঠতম ব্যক্তিরা তাঁদের পরামর্শদাতা ছিলেন। তাঁরা ছিলেন পরিপূর্ণ দ্বীনী জ্ঞানের অধিকারী। নিজেদের জ্ঞান এবং বিবেক অনুযায়ী পূর্ণ স্বাধীনতার সাথে তাঁরা নিরপেক্ষ মতামত ব্যক্ত করতেন। তাঁরা কখনো সরকারকে ভুল পথে পরিচালিত হতে দেবেন না- গোটা জাতির এ ব্যাপারে পূর্ণ আস্থা ছিল। এদেরকেই স্বীকার করা হতো সমগ্র মুসলিম উম্মাতের দায়িত্বশীল ব্যক্তি হিসেবে। কিন্তু রাজতন্ত্রের আগমনে এ নীতিরও পরিবর্তন সাধিত হয়। ব্যক্তি একনায়কত্ব শূরার স্থান দখল করে। 

সপ্তমত রাষ্ট্রে বংশীয় এবং জাতীয় ভাবধারা থাকবে না।
ইসলাম জাহেলী যুগের যেসব জাতি, বংশ-গোত্র ইত্যাদির ভাবধারা নিশ্চিহ্ন করে আল্লার দ্বীন গ্রহণকারী সকল মানুষকে সমান অধিকার দিয়ে এক উম্মতে পরিণত করেছিল, রাজতন্ত্রের যুগে তা আবার মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। বনী উমাইয়া সরকার শুরু থেকেই আরব সরকারের রূপ ধারণ করেছিল, আরব মুসলমানদের সাথে অনারব মুসলমানদের সমান অধিকারের ধারণা এ সময় প্রায় অনুপস্থিত ছিল। ইসলামী বিধানের স্পষ্ট বিরুদ্ধাচারণ করে নওমুসলিমদের ওপর জিযিয়া আরোপ করেছিলো। এর ফলে কেবল ইসলাম বিস্তারের ক্ষেত্রেই মারাত্নক অন্তরায় দেখা দেয়নি; বরং অনারবদের মনে এ ধারণাও দেখা দিয়েছে যে, ইসলামের বিজয় মূলত তাদেরকে আরবদের গোলামে পরিণত করেছে। 

ইসলাম গ্রহণ করেও তারা এখন আর আরবদের সমান হতে পারে না। কেবল এখানেই সীমাবদ্ধ ছিল না এ আচরণ। শাসনকর্তা, বিচারপতি এমনকি সালাতের ইমাম নিযুক্ত করার বেলায়ও দেখা হতো, সে আরব, না অনারব। কুফায় হাজ্জাজ ইবনে ইউসুফের নির্দেশ ছিল, কোন অনারবকে যেন সালাতে ইমামতি না করা হয়। পরবর্তি সময়ে উসমানীয়, আব্বাসীয়, ফাতেমীয়, মুঘল ইত্যাদি নানান বংশের শাসন শুরু হয়। অথচ ইসলাম এসব জাতিসত্ত্বার বাহাদুরি রহিত করার জন্যই এসেছে। মুহাম্মদ সা. এই জাতিসত্ত্বাকে জাহেলিয়াত হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন।

১৮ জুল, ২০২০

বাংলাদেশের জন্মে ইসরাঈলের ভূমিকা



১৯৭১ সাল। বাংলাদেশের একদল রুশপন্থী বাম পাকিস্তানের আভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক অস্থিরতার সুযোগ নিয়ে এদেশে ভারত থেকে আসা অবাঙালি মুহাজিরদের ওপর গণহত্যা চালায় ও স্বাধীনতার দাবি তুলে। তাদেরকে বুঝে ও না বুঝে সমর্থন করে প্রভাবশালী রাজনৈতিক সংগঠন আওয়ামীলীগের অধিকাংশ নেতা-কর্মী। 

বামদের এই পরিকল্পনা ও আন্দোলন কিন্তু নির্বাচন উপলক্ষে তৈরি হয়নি। এরা আরো আগে থেকেই গোপনে পাকিস্তান ভেঙে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠনের চেষ্টা চালায়। এদেশের নাম, পতাকা, সংগীত সবটাই নির্বাচনের আগেই তৈরি করা হয়। 

৬৮-তে তারা একবার চেষ্টা চালিয়েছিলো। কিন্তু পাকিস্তান সরকার তাদের হাতে নাতে ধরে ফেলে। মামলা হয় আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা। এই মামলায় শেখ মুজিবসহ অনেককেই আসামী হিসেবে গ্রেপ্তার করা হয়। যদিও সেসময় আওয়ামীলীগ সেই মামলাকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করেছে তবে এখন তারা স্বীকার করে তারা ভারতের সাথে ষড়যন্ত্র করে দেশ ভাগ করতে চেয়েছিলো। 
যাই হোক পশ্চিম পাকিস্তানে ভুট্টোর নেতৃত্বে আইয়ুব খান বিরোধী আন্দোলন চরম জনপ্রিয়তা পায়। পাঞ্জাব ইউনিভার্সিটির ছাত্ররা এই আন্দোলনে বড় নির্যাতনের শিকার হয়। নানান দিক থেকে চিপায় পড়ে আইয়ুব খান। অবশেষে চিপা থেকে উদ্ধার হওয়ার জন্য আগরতলা মামলা প্রত্যাহার করে। 

একাত্তরে যুদ্ধ যখন শুরু হয়ে যায় তখন তাজউদ্দিনরা আন্তর্জাতিকভাবে তিনটি রাষ্ট্রের সহায়তা পায়। ভারত, রাশিয়া এবং ইসরাঈল। ভারত কেন পাকিস্তান ভাঙতে চায় এটা তো একদম স্পষ্ট। রাশিয়া তাজউদ্দিনদের মোরাল সাপোর্ট দেয় কারণ তাজউদ্দিনেরা তাদের আদর্শের অনুসারী। আর বাকী রইলো ইসরাঈল। তাদের সাপোর্টের একটাই কারণ। একটি মুসলিম রাষ্ট্র ভাঙা মানে মুসলিমদের ক্ষতি। আর মুসলিমদের ক্ষতি মানেই ইসরাইলের খুশি। 

তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে নিয়োগকৃত ভারতীয় গোয়েন্দা ডা. কালিদাস বৈদ্যের বইতে জানতে পারি তাজউদ্দিন ইসরাঈলের সাথে যোগাযোগের দায়িত্ব দেন হোসেন তৌফিক ইমাম বা এইচটি ইমামকে। প্রবাসী সরকারের অনেক কর্মকর্তাই এটিকে ভালো চোখে দেখে নি। সমাজতন্ত্রী ছাড়া যারা শুধু আওয়ামী লীগ তারা কেউই ইসরাইলের সাথে সম্পর্ক রাখতে ইচ্ছুক ছিল না। তাই প্রবাসী সরকারের সাথে তাদের সরাসরি সম্পর্ক ভালোভাবে তৈরি হয়নি। 

সরাসরি না থাকলেও তাজউদ্দিন ও ইসরাঈলের সাথে সম্পর্কের মধ্যস্থতা করেছেন ভারতের পূর্বাঞ্চলের কমান্ডার জ্যাকব। মূলত ভারত ১৯৭১ সালের যুদ্ধ করেছিলো জ্যাকবের নেতৃত্বে। ইন্দিরা গান্ধী শুরু থেকেই পূর্ব পাকিস্তানে আক্রমণ চালিয়ে বাংলাদেশকে আলাদা করার ব্যাপারে দৃঢ় ছিলো। কিন্তু সেনাপ্রধান মানেক'শ এর প্রতিক্রিয়া হিসেবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের ভূমিকা কী হবে তা নিয়ে যুদ্ধ জড়াতে চাইছিলো না। 

পাকিস্তানের সাথে মার্কিনীদের সমাজতন্ত্রী বিরোধী সিয়াটো চুক্তি রয়েছে। তাতে তারা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ছিলো যে, কোনো সমাজতন্ত্রী রাষ্ট্র দ্বারা তারা পরষ্পরের কেউ আক্রান্ত হলে উভয়েই যুদ্ধে জড়িয়ে পড়বে। সেই হিসেবে পাকিস্তান তাদের সমস্যাকে সমাজতন্ত্র সমস্যা হিসেবে বেশি আখ্যায়িত করেছে। এদিকে ভারতও রাশিয়াকে এই যুদ্ধে আমন্ত্রণ জানাতে চায় না। কারণ রাশিয়ার অংশগ্রহণ যুদ্ধকে জটিল করবে এবং আমেরিকা রাশিয়াকে ঠেকাতে সব ধরণের চেষ্টা করবে। 

মানেকশ তাই সরাসরি যুদ্ধে না জড়িয়ে বাঙালিদের প্রশিক্ষণ ও অস্ত্র দিয়ে যুদ্ধ করানোর নীতি গ্রহণ করেছে। এদিকে ইহুদী জ্যাকব ইন্দিরাকে আশ্বস্ত করেন আমেরিকাকে নিষ্ক্রিয় করার ও স্বল্পমেয়াদি যুদ্ধে পাকিস্তানকে হারাবার সকল পরিকল্পনা তার আছে। জে এফ আর জ্যাকব সম্পর্কে জানতে একটু গুগল করলেই হবে। ২০১২ সালে শেখ হাসিনা তাকে পুরষ্কিত করে। 
জ্যাকব তার চেতনার রাষ্ট্র ইসরাঈলকে ব্যবহার করেন। সেসময় ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী ছিলো গোল্ডা মেয়ার। গোল্ডা মেয়ার আমেরিকাকে নিরপেক্ষ থাকতে রাজি করায়। একইসাথে ইন্দিরা যাতে এই যুদ্ধে স্ট্রং থাকে সেজন্য অস্ত্র সাহায্য পাঠায় গোপনে। সেই গোপন আর গোপন নেই এখন। এগুলো নিয়ে অনেক আর্টিকেল হয়েছে। বইও হয়েছে। গোল্ডা মেয়ার একইসাথে ভারতে অবস্থানরত শরনার্থীদের জন্য বিপুল অর্থ সাহায্য পাঠায়। 

ইন্টারেস্টিং বিষয় হলো ভারতের সাথে তখন ইসরাঈলের কোনো কূটনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিলো না। তাছাড়া ৭১ সালে ইসরাঈল অর্থনৈতিকভাবেও দুর্বল ছিলো। তবুও গোল্ডা মেয়ার এসব সাহায্য পাঠিয়ে ভারতকে মুসলিমবিরোধী যুদ্ধে চাঙা রাখে এবং এর মাধ্যমে ভারতের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের চেষ্টা চালায়। কিন্তু ইন্দিরা সাহায্য গ্রহণ করলেও রাশিয়ার বিরাগভাজন হওয়ার আশংকায় সেসময় কূটনৈতিক সম্পর্কের ইসরাঈলি প্রস্তাব ফিরিয়ে দেয়। গোল্ডা মেয়ার তাতে রাগ করেনি বরং ভারতকে সাহায্য প্রদান অব্যাহত রাখে।   

এদিকে জে এফ আর জ্যাকব তার পরিকল্পনা অনুসারে ও চেতনারাষ্ট্র থেকে পজেটিভ ইঙ্গিত পেয়ে সর্বাত্মক যুদ্ধে নেমে পড়ে। যুদ্ধে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার সে নিজেই সিদ্ধান্ত নেয়। দিল্লি কিংবা মানেক'শর জন্য অপেক্ষা করে না। আত্মসমর্পনের খসড়া প্রস্তাব তার নিজেরই লেখা। সে কীভাবে অল্প সময়ে কৌশলে ব্লাফ দিয়ে আমীর আব্দুল্লাহ খান নিয়াজীকে পরাজিত করেন তা নিয়ে বহু আর্টিকেল আছে। আপনারা গুগল করে পড়ে নিয়েন। এজন্য সে ব্লাফ মাস্টার খ্যাতি পায়। 

এদিকে বাংলাদেশ স্বাধীন হলে শেখ মুজিবের সামনে ইসরাঈল সম্পর্কের বিষয়টা সামনে আসে। আবার ইসরাঈলের দেওয়া স্বীকৃতি গ্রহণ করার সিদ্ধান্ত সামনে আসে। তখন শেখ মুজিব ইসরাঈলের সাথে কোনো সম্পর্ক রাখতে রাজি হননি। কৌশলী রাজনীতিবিদ শেখ মুজিব মুসলিম বিশ্বের কাছে ঘৃণিত হতে চায়নি। হয়তো তিনি নিজেও মুসলিমদের রক্তের ওপর প্রতিষ্ঠিত ইসরাঈলকে মনে প্রাণে অপছন্দ করতেন। তাই শেখ মুজিব আরো একধাপ এগিয়ে ১৯৭৩ সাল থেকে বাংলাদেশি পাসপোর্টে লিখে দেন "THIS PASSPORT IS VALID FOR ALL COUNTRIES OF THE WHOLE WORLD EXCEPT ISRAEL"

তাজউদ্দিনের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগে শেখ মুজিব রুষ্ট ছিলেন। এর মধ্যে এটাও ছিল যে তার ইসরাঈলপ্রীতি। যাই হোক এভাবে একটি মুশরিক রাষ্ট্র ও একটি ইহুদী রাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে বাংলাদেশের জন্ম হয়। 

আল্লাহ তায়ালা সূরা মায়েদার ৮২ নং আয়াতে বলেন, অবশ্যই তুমি মানুষের মধ্যে মুমিনদের বড় শত্রু হিসেবে ইহুদী ও মুশরিকদের দেখতে পাবে। মহান রাব্বুল আলামীন আমাদের শত্রু চিনার তাওফিক দান করুন।

১৬ জুল, ২০২০

কাফিরদের সাথে বৈবাহিক সম্পর্ক হারাম হওয়ার ইতিহাস



সমস্যার সূত্রপাত হুদায়বিয়া সন্ধির সময় থেকে। সন্ধির একটি শর্ত ছিলো মুসলিমদের বিপক্ষে। কুরাইশরা নিজেদের লোকদের মুসলিম হওয়া ঠেকানোর জন্য একটি শর্ত দিয়েছিল। মক্কা থেকে কেউ যদি মদিনায় যায় তবে তাকে ফিরিয়ে দিতে বাধ্য থাকবে মদিনা। এর মাধ্যমে তারা চেয়েছিলো তাদের লোকদের মুসলিম হওয়া ঠেকাতে। কারণ এর ফলে কেউ মুসলিম হয়ে মদিনায় আশ্রয় পাওয়ার জন্য যেতে পারবে না। এই শর্তের প্রথম শিকার আবু জান্দাল রা.। তিনি তার পিতার অত্যাচার থেকে বাঁচার জন্য রাসূল সা.-এর কাছে এসেছেন। রাসূল সা. বেদনা নিয়ে শর্তানুসারে তাকে ফিরিয়ে দিতে বাধ্য হন। তখন আবু জান্দাল মক্কায় ফিরে না গিয়ে জেদ্দার পার্শ্ববর্তী একটি স্থানে ঘাঁটি করে অবস্থান নিয়েছিল। তাঁর সাথে আরো কিছু নতুন মুসলিম মক্কা থেকে পালিয়ে যোগ দেন। তারা একের পর এক কুরাইশদের বাণিজ্য কাফেলা আক্রমণ করে তছনছ করে দেন। পরে বাধ্য হয়ে কুরাইশরা তাদেরকে মদিনায় ফিরিয়ে নিতে রাসূল সা.-কে অনুরোধ করেন।

যাই হোক পুরুষরা তো নিজেদের একটা গতি করতে সক্ষম হয়েছিলো। কিন্তু মক্কা থেকে চলে আসা মহিলাদের ব্যাপারে কী হবে? সর্বপ্রথম উম্মে কুলসুম বিনতে উকবা হিজরত করে মদীনায় এসে পৌছলেন ৷ কাফেররা চুক্তির কথা বলে তাকেও ফিরিয়ে দেয়ার দাবি জানাল। উম্মে কুলসূমের দুই ভাই ওয়ালিদ ইবনে উকবা এবং উমারা ইবনে উকবা তাকে ফিরিয়ে নেয়ার জন্য মদিনায় হাজির হলো। তখন এ মর্মে প্রশ্ন দেখা দিল যে, হুদাইবিয়ার সন্ধি নারীদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য হবে কি না?

চুক্তিতে উল্লেখ ছিলো "আমাদের মধ্য থেকে তোমাদের কাছে কোন পুরুষ যদি আসে আর সে যদি তোমাদের ধর্মের অনুসারীও হয় তাহলেও তোমারা তাকে আমাদের কাছে ফিরিয়ে দেবে"। কুরাইশদের পক্ষে চুক্তির লেখক সুহাইল ইবনে আমর রা. (পরে মুসলিম হয়েছেন) হয়তো 'রাজুল' শব্দটি ব্যক্তি অর্থে ব্যবহার করেছিল। কিন্তু যেহেতু চুক্তিপত্রে রাজুল শব্দটিই লেখা হয়েছিল, আরবী ভাষায় যা পুরুষদের বুঝানোর জন্য ব্যবহৃত হয়ে থাকে। তাই উম্মে কুলসুম বিনতে উকবার প্রত্যার্পণের দাবি নিয়ে তার ভাই মদিনায় আসলে আল্লাহর নির্দেশে তাকে ফিরিয়ে দিতে অস্বীকার করেন মুহাম্মদ সা.। এই ঘটনার আগ পর্যন্ত কুরাইশরাও এই ভুল ধারণার মধ্যে ছিল যে, নারী -পুরুষ নির্বিশেষে সব ধরনের মুহাজিরদের বেলায় এ চুক্তি প্রযোজ্য। কিন্তু নবী সা. যখন চুক্তির এই শব্দের প্রতি তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করলেন তখন তারা হতবাক ও লা-জওয়াব হয়ে গেল এবং বাধ্য হয়েই তারা রাসূল সা. এই সিন্ধান্ত মেনে নিলো।

এই বিষয়ে আল্লাহ তায়ালা সূরা মুমতাহিনার ১০ নং আয়াতে বলেন,
// হে ঈমানদাররা, ঈমানদার নারীরা যখন হিজরত করে তোমাদের কাছে আসবে তখন তাদের ঈমানদার হওয়ার বিষয়টি পরীক্ষা নিরীক্ষা করে নাও। তাদের ঈমানের প্রকৃত অবস্থা অবশ্য আল্লাহই ভাল জানেন। অতঃপর যদি তোমরা বুঝতে পারো যে, তারা সত্যিই ঈমানদার তাহলে তাদেরকে কাফেরদের কাছে ফেরত পাঠিয়ে দিও না। না তারা কাফেরদের জন্য হালাল, না কাফেররা তাদের জন্য হালাল। তাদের কাফের স্বামীরা তাদেরকে যে মোহরানা দিয়েছে তা তাদের ফিরিয়ে দাও। তাদেরকে মোহরানা দিয়ে বিয়ে করায় তোমাদের কোনো গুনাহ হবে না। আর তোমরা নিজেরাও কাফের নারীদেরকে নিজেদের বিয়ের বন্ধনে আটকে রেখো না। নিজেদের কাফের স্ত্রীদের তোমরা যে মোহরানা দিয়েছ তা ফেরত চেয়ে নাও। আর কাফেররা তাদের মুসলমান স্ত্রীদের যে মোহরানা দিয়েছে তাও যেন তারা ফেরত চেয়ে নেয়। এটি আল্লাহর নির্দেশ। তিনি তোমাদের সবকিছুর ফায়সালা করেন। আল্লাহ জ্ঞানী ও বিজ্ঞ।//

এই আয়াতে আল্লাহ তা'আলা প্রথম নির্দেশ দিয়েছেন, যেসব স্ত্রীলোক হিজরত করে আসবে এবং তাদের ঈমানদার হওয়ার কথা প্রকাশ করবে তাদেরকে জিজ্ঞেসাবাদ করে এ বিষয়ে নিশ্চিত হও যে, প্রকৃতই তারা ঈমান গ্রহণ করে এখানে চলে এসেছে। এ বিষয়ে নিশ্চিত হওয়ার পর আর তাদেরকে ফেরত পাঠিয়ে দিও না। আল্লাহ তা'আলার এ নির্দেশ কার্যকরী করার জন্য যে নিয়ম চালু করা হয়েছিল তা হলো, যেসব স্ত্রীলোক হিজরত করলে মদীনায় চলে আসত তাদেরকে এ মর্মে জিজ্ঞাসাবাদ করা হতো যে, তারা সত্যিই আল্লাহর একত্ব এবং মুহাম্মাদ সা.এর রিসালাতের প্রতি ঈমান পোষণ করে কিনা এবং কেবল আল্লাহ ও তাঁর রসূলের জন্যই হিজরত করেছে কিনা?

ব্যাপারটা এমন নয়তো যে স্বামীর প্রতি বিরূপ ও বিরক্ত হয়ে রাগে বা অভিমানে ঘর ছেড়ে চলে এসেছে? কিংবা আমাদের এখানকার কোন পুরুষের প্রতি তার ভালবাসা ও অনুরাগ তাকে নিয়ে এসেছে? কিংবা অন্য কোন পার্থিব স্বার্থ তার এ কাজের চালিকা শক্তি হিসেবে কাজ করেছে? যেসব স্ত্রীলোকেরা এসব প্রশ্নের সন্তোষজনক জবাব দিতে পারত শুধু তাদেরকেই থাকতে দেয়া হতো এবং অবশিষ্ট সবাইকে ফিরিয়ে দেয়া হতো।

দ্বিতীয় যে নির্দেশনাটি এই আয়াত থেকে পাওয়া যায় তা হলো, কাফিরদের সাথে মুমিনের বিবাহ জায়েজ নেই। যে বিবাহিতা নারী মুসলমান হয়ে দারুল কুফর থেকে হিজরত করে দারুল ইসলামের আসে তার বিবাহ বন্ধন আপনা থেকেই ছিন্ন হয়ে যায়। কোনো পুরুষ লোক মুসলমান হয়ে যাওয়ার পর তার স্ত্রী যদি কাফেরই থেকে যায় তাহলে ঐ স্ত্রীকে বিবাহ বন্ধনে আটকে রাখা তার জন্য জায়েয নয়। আল্লাহ তায়ালা মুমিন ও কাফেরের মধ্যে বৈবাহিক সম্পর্ক হারাম ঘোষণা করেছেন।

একই আয়াত থেকে আমরা তৃতীয় যে নির্দেশনাটি পাই তা হলো, দারুল কুফর ও দারুল ইসলামের মধ্যে যদি সন্ধি চুক্তি বর্তমান থাকে তাহলে কাফেরদের যেসব বিবাহিত স্ত্রী হিজরত করে দারুল ইসলামে চলে এসেছে মুসলমানদের পক্ষ থেকে তাদের প্রাক্তন স্বামীকে মোহরানা ফিরিয়ে দেয়া এবং মুসলমানদের সাথে বিবাহিত যেসব কাফের স্ত্রী দারুল কুফরে রয়ে গিয়েছে তাদেরকে প্রদত্ত মোহরানা কাফেরদের পক্ষ থেকে ফিরে পাওয়ার জন্য ইসলামী সরকারকে দারুল কুফরের সরকারের সাথে বিষয়টির ফায়সালা করার চেষ্টা করতে হবে।

বিবাহ ছিন্ন হওয়া ও মোহরানা ফিরিয়ে দেওয়া ছিলো আল্লাহর নির্দেশ। আল্লাহর এই নির্দেশ মানতে মুসলিমরা যেমন বাধ্য তেমনিভাবে মোটেই বাধ্য নয় মক্কার মুশরিকরা। তাই কাফির স্ত্রীদের থেকে মোহরানা ফেরত পাওয়ার সম্ভাবনা ছিল না মোটেই। এর সমাধানে আল্লাহ তায়ালা পরবর্তী আয়াত অর্থাৎ মুমতাহিনার ১১ নং আয়াতে বলেন,
//তোমাদের কাফের স্ত্রীদেরকে দেয়া মোহরানার অংশ যদি তোমরা ফেরত না পাও এবং পরে যদি তোমরা সুযোগ পেয়ে যাও তাহলে যাদের স্ত্রীরা ওদিকে রয়ে গিয়েছে তাদেরকে দেয়া মোহরানার সমপরিমাণ অর্থ দিয়ে দাও। যে আল্লাহর প্রতি ঈমান এনেছো তাকে ভয় করে চলো।//

আল্লাহর নির্দেশে মুসলিমরা মক্কার কুরাইশদের সাথে বিষয়টির ফায়সালা এভাবে করতে চাইছিল যে, যেসব স্ত্রীলোক হিজরত করে মদিনায় চলে এসেছে আমরা তাদের মোহরানা ফিরিয়ে দেব। আর আমাদের লোকদের যেসব কাফের স্ত্রী ওদিকে রয়ে গিয়েছে তোমরা তাদের মোহরানা তোমরা ফিরিয়ে দাও।

কিন্তু তারা এ প্রস্তাব গ্রহণ করলো না। অতএব মুসলিমরা এই আয়াতে আল্লাহর নির্দেশনা অনুসারে এই সমস্যার সমাধান করলো। মক্কা থেকে আগত নারীদের মোহরানা মক্কায় ফেরত না পাঠিয়ে রাষ্ট্রের ফান্ডে জমা করা হলো। আর সেখান থেকে যাদের স্ত্রী মক্কায় থেকে গিয়েছে তাদেরকে পাওনা মোহরানা ফেরত দেয়া হলো। এরপরেও যদি মুসলিম পুরুষেরা সবাই মোহরানা ফেরত না পায় তবে যুদ্ধলব্ধ গনিমত থেকে তাদের মোহরানা আদায়ের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

ইসলামের প্রাথমিক যুগে এমন অনেক পুরুষ ছিল যারা ইসলাম গ্রহণ করেছিল কিন্তু তাদের স্ত্রীরা ইসলাম গ্রহণ করেনি। আবার এমন অনেক স্ত্রীলোকও ছিল যারা ইসলাম গ্রহণ করেছিল কিন্তু তাদের স্বামীরা ইসলাম গ্রহণ করেনি। স্বয়ং রসূলুল্লাহ সা.-এর এক মেয়ে হযরত যয়নবের রা.-এর স্বামী আবুল আস ছিলেন অমুসলিম এবং কয়েক বছর পর্যন্ত অমুসলিমই রয়ে গিয়েছিলেন।
মুসলমান নারীদের জন্য তাদের কাফের স্বামী এবং মুসলমান স্বামীদের জন্য তাদের মুশরিক স্ত্রী হালাল নয় এমন কোন নির্দেশও ইসলামের প্রাথমিক যুগে হয়নি। তাই তাদের মধ্যকার দাম্পত্য সম্পর্ক অব্যহত ছিল। হিজরাতের পরেও কয়েক বছর পর্যন্ত এ অবস্থা বিদ্যমান ছিল। এ সময় কিছু সংখ্যক নারী মুসলমান হওয়ার পর হিজরাত করে চলে এসেছিল। কিন্তু তাদের কাফের স্বামীরা মক্কায় থেকে গিয়েছিল।

আবার বহু সংখ্যক মুসলমান পুরুষ হিজরত করে চলে এসেছিল। কিন্তু তাদের কাফের স্ত্রীরা দারুল কুফরেই রয়ে গিয়েছিল। তা সত্ত্বেও তাদের বিবাহ বন্ধন অবশিষ্ট ছিল। এতে বিশেষভাবে মহিলাদের জন্য বড় ধরনের জটিলতা সৃষ্টি হচ্ছিল। কারণ, পুরুষ তো দ্বিতীয় বিয়েও করতে পারে। কিন্তু মহিলাদের জন্য তা সম্ভব ছিল না। পূর্ব স্বামীর সাথে তার বিয়ে বাতিল না হওয়া পর্যন্ত সে অন্য কারো সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে পারত না। হুদায়বিয়ার সন্ধির পর এসব আয়াত নাযিল হলে মুসলমান এবং কাফের ও মুশরিকদের মধ্যকার পূর্বের দাম্পত্য সম্পর্ক বাতিল করে দেয়া হয় এবং মুসলিমদের জন্য একটা অকাট্য ও সুষ্পষ্ট আইন তৈরী করে দেয়া হয়।

১৪ জুল, ২০২০

বঙ্গকথা পর্ব-৪৬ : ১৯৪৬ সালের নির্বাচন এবং পাকিস্তানের পক্ষে মুসলিমদের গণরায়



জাপানের হিরোশিমা ও নাগাশাকিতে পারমানবিক বোমার বিস্ফোরণ ঘটায় আমেরিকা। এক মহা বিপর্যয়ের মুখোমুখি হয় জাপান। সারা পৃথিবীতে জাপানের বেপরোয়া অভিযান থমকে যায়। আত্মসমর্পন করে জাপান। জাপানের আত্মসমর্পণের পর ১৫ই আগষ্ট, ১৯৪৫ সালে বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়ে যায়। তার কিছুদিন আগে অর্থাৎ জুলাইয়ের শেষ দিকে ইংল্যান্ডের সাধারণ নির্বাচনে লেবার-পার্টি বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। বহু পূর্ব থেকেই লেবার পার্টির সাথে কংগ্রেসের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল এবং এবারের নির্বাচনের ফলাফল কংগ্রেসকে খুবই উল্লসিত করে। এর থেকে রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের জন্য কংগ্রেস তৎপরতা শুরু করে। 

ব্রিটিশ পলিসিই ছিলভারতে অখন্ডতার পক্ষে এবং এ ইস্যুটিতে লেবার পার্টির বেশি সমর্থন কংগ্রেস লাভ করবে বলে আশা করে। আর এ ইস্যুটিই কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের মধ্যে বিরাট দূরত্ব সৃষ্টি করে রেখেছিল। কংগ্রেসের দাবি মুসলিম অমুসলিম নির্বিশেষে এক জাতি এবং অখন্ড ভারতে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের শাসন। পক্ষান্তরে মুসলিম লীগের দাবি মুসলমানগণ একটি সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র জাতি এবং সে কারণেই তাদের জন্যে হতে হবে একটি স্বতন্ত্র স্বাধীন রাষ্ট্র। এ দুই বিপরীতমুখী দাবির চূড়ান্ত ফয়সালার জন্যে বছরের শেষে শীতের মওসুমে কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক আইনসভার জন্যে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে বলে ব্রিটিশ সরকারের পক্ষ থেকে ঘোষণা করা হয়।

নির্বাচনে মুসলিম লীগের দাবি পুরোপুরি স্বীকৃতি লাভ করে। কেন্দ্রীয় আইনসভার সকল মুসলিম আসন মুসলিম লীগ লাভ করে। প্রাদেশিক আইন সভাগুলোর ৪৯৫ মুসলিম আসনের মধ্যে মুসলিম লীগ লাভ করে ৪৪৬টি আসন। হিন্দু প্রধান প্রদেশগুলোতে কংগ্রেস সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে এবং তা ছিল অতি স্বাভাবিক। বাংলায় ১১৯টি মুসলিম আসনের মধ্যে মুসলিম লীগ লাভ করে ১১৩টি। শেরে বাংলা একে ফজলুল হকের মুসলিম লীগের ছয়টি আসন হাতছাড়া হয়। বাংলায় মুসলিম লীগের হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী মন্ত্রীসভা গঠন করেন। পাঞ্জাবে ৮৬টি মুসলিম আসনের মধ্যে ৭৯টি মুসলিম লীগ হস্তগত হয়। সিন্ধুতেও মুসলিম লীগ মন্ত্রীসভা গঠিত হয়। সীমান্ত প্রদেশে সীমান্ত গান্ধী নামে অভিহিত কংগ্রেসপন্থী আবদুল গাফফার খানের প্রচন্ড প্রভাবের দরুন মুসলিম লীগ ৩৬টি আসনের মধ্যে ১৭টি লাভ করে এবং ডা. খান মন্ত্রীসভা গঠন করেন।

তবে এ নির্বাচনে মুসলিম লীগের প্রতি প্রায় সকল মুসলিমের রায় ঘোষিত হয়েছে। কংগ্রেসের এক জাতি নীতি মেনে নেয় নি মুসলিমরা। অথচ ১৯৩৭ সালের নির্বাচনে এতটা ভালো সাফল্য পায়নি মুসলিম লীগ। তখন অনেক মুসলিমই ভেবেছে হিন্দু প্রধান কংগ্রেসের সাথে থাকা সম্ভব। এ সাধারণ নির্বাচনে এ কথা অকাট্যভাবে প্রমাণিত হয়েছে যে, একমাত্র মুসলিম লীগই মুসলিমদের জন্য ভারতের প্রতিনিধিত্বশীল রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান। এতে কংগ্রেসের মুসলিম লীগ বিরোধিতা তীব্রতর আকার ধারণ করে। মুসলিম লীগের প্রতিনিধিত্বমূলক বৈশিষ্ট্য মেনে নিয়ে তার সাথে একটা রাজনৈতিক সমঝোতায় উপনীত হওয়ার পরিবর্তে কংগ্রেস মুসলমানদের মধ্যে ভাঙন সৃষ্টির পলিসি অবলম্বন করে এবং মুসলমানদের আস্থাশীল প্রতিনিধিদের হাতে, এমনটি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রদেশেও রাজনৈতিক ক্ষমতা হস্তান্তরে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করে। এর ফলে সাম্প্রদায়িক মতভেদ তীব্রতর হয় এবং উভয়ের মধ্যে আপস নিষ্পত্তি অসম্ভব হয়ে পড়ে।

অখন্ড বাংলার মূল নেতা ছিলেন শেরে বাংলা একে ফজলুল হক। মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর সাথে শেরে বাংলা একে ফজলুল হকের রাজনৈতিক ইস্যুতে মতপার্থক্য দেখা দিলে মুসলিম লীগ নেতা সোহরাওয়ার্দী ১৯৪১ সালের ৭ ডিসেম্বর ফজলুল হক মন্ত্রিসভা থেকে ইস্তফা দেন। ১৯৪৩ সালের ২৯ মার্চ ফজলুল হক মন্ত্রিসভার পতন ঘটলে পূর্ব বাংলার মুসলিম লীগ নেতা ২৪ এপ্রিল খাজা নাজিমুদ্দিনের নেতৃত্বে নতুন মন্ত্রিসভা গঠিত হয়। এ মন্ত্রিসভায় হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী খাদ্যমন্ত্রী ছিলেন। এ সময় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলছিল। বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন বাংলায় দুর্ভিক্ষ ও মহামারি দেখা দেয়। এ দুর্ভিক্ষে বাংলায় প্রায় ৫০ লাখ লোক মারা যায়। ১৯৪৫ সালের ৮ মার্চ খাজা নাজিমুদ্দিন সোহরাওয়ার্দীর মুসলিম লীগ মন্ত্রিসভার পতন ঘটে। 

হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী আবুল হাশিমকে সাথে নিয়ে মুসলিম লীগ সুসংগঠিত করার কাজে নিজেকে নিয়োজিত করেন। এসময় তারা শেরে বাংলার বিরুদ্ধে ব্যাপক প্রচার করে। এবং প্রচারে কৃষক প্রজা পার্টির বিরুদ্ধে জনমত তৈরি হয়। ধারাবাহিকভাবে কংগ্রেসীদের মুসলিম বিদ্বেষ মুসলিম লীগের প্রতি জনমত তৈরি করে। শেরে বাংলার অপরাধ ছিলো তিনি হিন্দু নেতা শ্যামাপ্রসাদের সঙ্গে মন্ত্রীসভা গঠন করেছিলেন। এই কারণে মুসলিম লীগ তাকে মুসলিম বিদ্বেষী হিসেবে প্রচার করে। ফলে শেরে বাংলার রাজনৈতিক ক্যারিয়ার ধ্বংস হয়ে পড়ে। শেরে বাংলা আর কখনো রাজনীতিতে ভালো করতে পারেন নি। অথচ তিনিই অবিভক্ত বাংলার সবচেয়ে জনপ্রিয় রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ছিলেন। 

১৯৪৫ সালের ১০-১২ ডিসেম্বর কেন্দ্রীয় পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এ নির্বাচনে সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে মুসলিম লীগ ৩০টি মুসলিম আসনে জয়লাভ করে। ১৯৪৬ সালের মার্চ মাসে পাকিস্তান ইস্যুর ভিত্তিতে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এ নির্বাচনে সোহরাওয়ার্দীর মুসলিম লীগ ১২০টি আসনের মধ্যে ১১৪টিতে বিজয়ী হয়। এ নির্বাচনে শেরে বাংলার প্রজা পার্টির ভরাডুবি ঘটে। সোহরাওয়ার্দীর অসাধারণ সাংগঠনিক দক্ষতার কারণে ভারতের সকল প্রদেশের মধ্যে কেবল বাংলায় মুসলিম লীগ একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে এবং মন্ত্রিসভা গঠন করে। ১৯৪৬ সালের ৮ এপ্রিল দিল্লীতে মুসলিম লীগ আইনসভার সদস্যদের কনভেনশন অনুষ্ঠিত হয়। জিন্নাহর নির্দেশে সোহরাওয়ার্দী ওই কনভেনশনে পাকিস্তান প্রস্তাব উত্থাপন করেন। ১৯৪৬ সালের ২৪ এপ্রিল হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী মন্ত্রিসভা গঠন করেন। তিনি বাংলার প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বভার গ্রহণ করে জনকল্যাণমুখী কর্মসূচি বাস্তবায়নে আত্মনিয়োগ করেন।

মুহম্মদ আলী জিন্নাহ ১৯৪৬ সালের ১৬ আগস্ট ডাইরেক্ট অ্যাকশন বা প্রত্যক্ষ দিবস পালনের কর্মসূচি ঘোষণা করেন। এ সময় কলকাতায় হিন্দু-মুসলমানদের মধ্যে ব্যাপক দাঙ্গা সংঘটিত হয়। এ দাঙ্গায় কয়েক হাজার মানুষ নিহত হয় এবং অসংখ্য বাড়িঘর ভস্মীভূত হয়। সোহরাওয়ার্দী সাহসের সাথে এ দাঙ্গা পরিস্থিতি মোকাবিলা করেন। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী সবসময় বিভক্ত ভারতের অবিভক্ত স্বাধীন বাংলার স্বপ্ন দেখতেন। বৃটিশ সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে ভারত বিভাগের ঘোষণা দিলে তিনি ১৯৪৭ সালের ২৭ এপ্রিল দিল্লীতে অনুষ্ঠিত এক সাংবাদিক সম্মেলনে স্বাধীন অবিভক্ত বাংলার দাবি পেশ করেন। কিন্তু কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের বিরোধিতার কারণে সোহরাওয়ার্দী শরৎ বসুর অবিভক্ত স্বাধীন বাংলার দাবি প্রত্যাখ্যাত হয়।

১৩ জুল, ২০২০

দ্বীন ইসলামের গোপনীয়তা রক্ষা করার গুরুত্ব



তখন মদিনায় দ্বীন ইসলাম কায়েম হয়ে গিয়েছিল। আল্লাহর রাসূল সা. সেই রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপ্রধান। মক্কা বিজয়ের কিছুদিন পূর্বের ঘটনা। মক্কার কুরাইশরা হুদাইবিয়ার সন্ধি লঙ্ঘন করলো, চুক্তি ভঙ্গ করলো। এর প্রেক্ষিতে রাসূল সা. মক্কা জয় করার পরিকল্পনা গ্রহণ করছিলেন। তিনি মক্কা আক্রমণের প্রস্তুতি নিতে থাকলেন। তবে অভিযানের প্রস্তুতি সবাই দেখছিলো, কিন্তু অভিযানটি কি মক্কায় হবে নাকি অন্য কোথাও তা সাধারণ কেউ জানতো না। রাসূল সা. মক্কা অভিযানের ব্যাপারটা সাধারণ মুসলিমদের কাছে প্রকাশ করেননি। শুধুমাত্র বিশেষ পরামর্শ সভার গুরুত্বপূর্ণ সাহাবীরা জানতেন। 


একজন মুহাজির সাহাবী নাম হাতিব ইবনে আবি বালতায়া রা.। তিনি রাসূল সা.-এর মক্কা আক্রমণের বিষয়টি আঁচ করতে পারেন। এরপর থেকেই তার মনে অস্থিরতা শুরু হয়। কারণ মক্কায় তার পরিবার পরিজন রয়েছে।তাঁর সন্তান-সন্ততি, ধন-সম্পদ মক্কাতেই ছিল। তবে তিনি নিজে কুরাইশদের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন না। শুধু তিনি হযরত উসমান রা.-এর মিত্র ছিলেন, এ জন্যেই মক্কায় তিনি নিরাপত্তা লাভ করেছিলেন। অতঃপর তিনি হিজরত করে রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর সাথে মদীনায় অবস্থান করছিলেন। শেষ পর্যন্ত যখন মক্কাবাসী চুক্তি ভঙ্গ করে এবং এর ফলে রাসূলুল্লাহ্ সা. মক্কা-আক্রমণের ইচ্ছা করেন তখন তাঁর মনে বাসনা এই ছিল যে, আকস্মিকভাবে তিনি মক্কা আক্রমণ করবেন, যাতে রক্তপাত বন্ধ থাকে এবং তিনি মক্কার উপর আধিপত্যও লাভ করতে পারেন। এ জন্যেই তিনি মহামহিমান্বিত আল্লাহর নিকট দু'আ করেনঃ “হে আল্লাহ্ ! মক্কাবাসীদের নিকট যেন আমাদের যুদ্ধ প্রস্তুতির খবর না পৌছে।” এদিকে তিনি মুসলমানদেরকে প্রস্তুতির নির্দেশ দিয়েছেন। 


এই যখন পরিস্থিতি তখন মক্কা থেকে একজন মহিলা আসলো। সে আগে মহানবী সা.-এর দাদা আবদুল মুত্তালিবের দাসী ছিল। কিন্তু পরে দাসত্ব শৃঙ্খল মুক্ত হয়ে গানবাদ্য করে বেড়াত। নবীর সা. কাছে এসে সে তার দারিদ্রের কথা বলল এবং কিছু অর্থ সাহায্য চাইলো। নবী সা. বনী মুত্তালিবের লোকদের কাছে থেকে কিছু অর্থ চেয়ে দিয়ে তার অভাব পূরণ করলেন। সে মক্কায় ফিরে যাচ্ছিলো। এ ব্যাপারটির সুযোগ নিয়েছিলেন হাতিব ইবনে আবি বালতায়া রা.। তিনি ঐ মহিলার সাথে দেখা করলেন এবং মক্কার কয়েকজন নেতার নামে লেখা একটি চিঠি তাকে দিলেন। আর সে যাতে এই গোপনীয় বিষয়টি প্রকাশ না করে এবং গোপনে তাদের কাছে পৌঁছে দেয় সে জন্য তিনি তাকে দশটি দিনারও দিলেন। মহিলাটি সবেমাত্র মদিনা থেকে রওনা হয়েছিল। ইতোমধ্যে আল্লাহ তা'আলা এই বিষয়টি নবী সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়া সাল্লামকে অবহিত করলেন। 


রাসূল সা. তৎক্ষণাৎ হযরত আলী, হযরত যুবায়ের এবং হযরত মিকদাদ ইবনে আসওয়াদকে তার সন্ধানে পাঠিয়ে দিলেন। তিনি নির্দেশ দিলেন, তোমরা দ্রুত অগ্রসর হও। মহিলাটিকে ধরো। তার কাছে মুশরিকদের নামে হাতেবের একটি চিঠি আছে। যেভাবেই হোক তার নিকট থেকে সেই চিঠিটি নিয়ে এসো। সে যদি পত্রখানা দিয়ে দেয় তাহলে তাকে ছেড়ে দেবে। আর যদি না দেয় তাহলে তাকে হত্যা করবে। 


আলী রা.-এর দল মদীনা থেকে ১২ মাইল দূরে মহিলাটির দেখা পেলেন। তাঁরা তার কাছে পত্রখানা চাইলেন। কিন্তু সে অস্বীকার করে বললো, আমার কাছে কোনো পত্র নেই। তাঁরা তার থলে তাল্লাশী করলেন। কিন্তু কোন পত্র পাওয়া গেল না। অবশেষে তারা বললেন, পত্রখানা আমাদের দিয়ে দাও তা না হলে আমরা তোমাকে বিবস্ত্র করে তল্লাশী নেব। সে যখন বুঝতে পরলো রক্ষা পাওয়ার কোনো উপায় নেই তখন সে তার চুলের খোঁপার ভেতর থেকে পত্রখান বের করে দিলো। আর আলী রা.-এর দল তা নিয়ে নবী সা.-এর দরবারে উপস্থিত হলেন। চিঠিটি খুলে পড়া হলো। দেখা গেলো তাতে কুরাইশদের জানানো হয়েছে যে, রসূলুল্লাহ সা. তোমাদের বিরুদ্ধে আক্রমণের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। 


মহানবী সা. হযরত হাতেবকে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি একি করেছো? তিনি বললেন, ইয়া রাসূলুল্লাহ আপনি আমার ব্যাপারে দ্রুত সিদ্ধান্ত নেবেন না। আমি যা করেছি তা এ জন্য করি নাই যে, আমি কাফের বা মুরতাদ হয়ে গিয়েছি এবং ইসলামকে পরিত্যাগ করে এখন কুফরকে ভালবাসতে শুরু করেছি। প্রকৃত ব্যাপার হলো, আমার আপনজনেরা সব মক্কায় অবস্থান করছে। আমি কুরাইশ গোত্রের লোক নই। বরং কুরাইশদের কারো কারো পৃষ্ঠপোষকতা ও ছত্রছায়ায় আমি সেখানে বসতি স্থাপন করেছিলাম। অন্য যেসব মুহাজিরের পরিবার-পরিজন মক্কায় অবস্থান করছে তাদের গোত্র তাদের রক্ষা করবে। কিন্তু আমার পরিবার -পরিজনকে রক্ষা করার মত কেউই সেখানে নেই। তাই আমি এই পত্র লিখেছিলাম। আমি মনে করেছিলাম, এটা হবে কুরাইশদের প্রতি আমার একটা অনুগ্রহ। এই অনুগ্রহের কথা মনে করে তারা আমার সন্তানদের ওপর নির্যাতন চালাবে না। 


হযরত হাতেব রা.-এর পুত্র আবদুর রহমান বর্ণনা করেছেন যে, ঐ সময় হযরত হাতেবের সন্তান-সন্তুতি ও ভাই মক্কায় অবস্থান করেছিল। তাছাড়া হযরত হাতেবের নিজের একটি বর্ণনা থেকে জানা যায় যেসময় তার মাও সেখানে ছিলো। হাতেবের এই বক্তব্যে শুনে রসূলুল্লাহ সা. উপস্থিত সবাইকে বললেন, হাতেব তোমাদের কাছে সত্য কথাই বলেছে। অর্থাৎ এটিই তার এই কাজের মূল কারণ। ইসলামকে পরিত্যাগ বা কুফরকে সহযোগিতা করার মানসিকতা থেকে কাজটি হয়নি। 


হযরত উমর উঠে বললেন, হে আল্লাহর রসূল সা.! আমাকে অনুমতি দিন। আমি এই মুনাফিকের শিরচ্ছেদ করি। সে আল্লাহ, তাঁর রসূল এবং মুসলমানদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। 
নবী করিম সা. বললেন, এ ব্যক্তি তো বদর যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিল। তোমরা তো জানো না, হয়তো আল্লাহ তা'আলা বদর যুদ্ধে অংশ গ্রহণকারীদের বিষয় বিবেচনা করে বলে দিয়েছেন, তোমরা যাই করো না কেন আল্লাহ তোমাদের মাফ করে দিয়েছেন। একথা শুনে হযরত উমর রা. বললেন, আল্লাহ এবং তাঁর রসূলই সর্বাধিক জানেন। তাদের কথাই চূড়ান্ত। 


যতদূর জানা যায় হযরত হাতেব রা.-এর এই ওজর শোনার পর তাকে ক্ষমা করে দেওয়া হয়েছিল। তবে মহান রাব্বুল আলামীন এই বিষয়টিকে আমাদের জন্য শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে রেখে দিয়েছেন। তিনি এই ঘটনার প্রেক্ষিতে সূরা মুমতাহিনা নাজিল করেছেন। সেখানে আল্লাহ আমাদের এইসব অপরাধ করা থেকে সতর্ক করে দিয়েছে। হযরত হাতেব রা. শুধু তার পরিবার পরিজনকে রক্ষা করার উদ্দেশ্যে রসূলুল্লাহ সা. এর অতি গুরুত্বপূর্ণ একটি গোপন সামরিক তথ্য শত্রুদের জানিয়ে দেয়ার চেষ্ট করেছিলেন। এটি যথাসময়ের ব্যর্থ করে দেওয়া না গেলে মক্কা বিজয়ের সময় ব্যাপক রক্তপাত হতো। মুসলমানদেরও বহু মূল্যবান প্রাণ নষ্ট হতে পারতো এবং কুরাইশদেরও এমন বহু লোক মারা যেতো, যাদের দ্বারা পরবর্তী সময়ে ইসলামের ব্যাপক খেদমত পাওয়ার গিয়েছিল। 


শান্তিপূর্ণ উপায়ে মক্কা বিজিত হওয়ায় যেসব সুফল অর্জিত হয়েছে তা সবই পণ্ড হয়ে যেতে পারতো। এসব বিরাট ও ব্যাপক ক্ষতি সাধিত হতো শুধু এ কারণে যে, মুসলমানদেরই এক ব্যক্তি যুদ্ধের বিপদ থেকে নিজের পরিবারকে নিরাপদ রাখতে চেয়েছিল। সূরা মুমতাহিনাতে হযরত হাতেব রা.-এর এ কাজের কঠোর সমালোচনা করা হয়েছে। মারাত্মক এই ভুল সম্পর্কে সতর্ক করে দিয়ে আল্লাহ তা’আলা সমস্ত ঈমানদারদের এ শিক্ষা দিয়েছেন যে, কোনো ঈমানদারের কোন অবস্থায় কোন উদ্দেশ্যেই ইসলামের শত্রু কাফেরদের সাথে ভালবাসা ও বন্ধুত্বের সম্পর্ক না রাখা উচিত। এবং এমন কোন কাজও না করা উচিত যা কুফর ও ইসলামের সংঘাতে কাফেরদের জন্য সুফল বয়ে আনে। 


মহান রাব্বুল আলামীন বলেন সূরা মুমতাহিনার ১ ও ২ নং আয়াতে বলেন, 
// হে ঈমানদারগণ, তোমরা আমার ও তোমাদের শত্রুদেরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করে তাদের প্রতি ভালোবাসা প্রদর্শন করো না, অথচ তোমাদের কাছে যে সত্য এসেছে তা তারা অস্বীকার করেছে এবং রাসূলকে ও তোমাদেরকে বের করে দিয়েছে এজন্য যে, তোমরা তোমাদের রব আল্লাহর প্রতি ঈমান এনেছ। তোমরা যদি আমার পথে সংগ্রামে ও আমার সন্তুষ্টির সন্ধানে বের হও (তবে কাফিরদেরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করো না)। তোমরা গোপনে তাদের সাথে বন্ধুত্ব প্রকাশ করো, অথচ তোমরা যা গোপন করো এবং যা প্রকাশ করো তা আমি জানি। তোমাদের মধ্যে যে এমন করবে সে সরল পথ হতে বিচ্যুত হবে। তাদের আচরণ হলো, তারা যদি তোমাদের কাবু করতে পারে তাহলে তোমাদের সাথে শত্রুতা করবে। হাত ও জিহবা দ্বারা তোমাদের কষ্ট দেবে। তারা চায় যে, কোনক্রমে তোমরা কাফের হয়ে যাও।// 


যাদের জন্য এই অপরাধ সংঘটিত হয়েছে তারা কিয়ামতের দিন কোনো কাজে আসবে না এই মর্মে আল্লাহ ৩ নং আয়াতে বলেন, 
//কিয়ামতের দিন তোমাদের আত্মীয়তার বন্ধন কোনো কাজে আসবে না, সন্তান-সন্তুতি কোনো কাজে আসবে না। সেদিন আল্লাহ তোমাদের পরস্পর বিচ্ছিন্ন করে দেবেন। আর তিনিই তোমাদের আমল বা কর্মফল দেখবেন।// 


নিশ্চয়ই আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্ন করা সহজ নয়। এটা খুবই কঠিন। মহান রাব্বুল আলামীন মুমিনদের তাই সান্তনা দেওয়ার উদ্দেশ্যে ৭ ও ৮ নং আয়াতে বলেন,
//অসম্ভব নয় যে, আজ তোমরা যাদের শত্রু বানিয়ে নিয়েছো আল্লাহ তা’আলা তাদের ও তোমাদের মধ্যে কোন এক সময় বন্ধুত্ব সৃষ্টি করে দেবেন। আল্লাহ অত্যন্ত ক্ষমতাবান। আর তিনি ক্ষমাশীল ও দয়াময়। যারা দ্বীনের ব্যাপারে তোমাদের সাথে লড়াই করেনি এবং বাড়ীঘর থেকে তোমাদের তাড়িয়ে দেয়নি তাদের সাথে সদ্ব্যবহার ও ন্যায় বিচার করতে আল্লাহ তোমাদের নিষেধ করেন না। আল্লাহ ন্যায় বিচারকারীদের পছন্দ করেন।//


সবশেষে কোনো অবস্থায়ই জালিমদের বন্ধু বানানো যাবে না এই মর্মে মহান আল্লাহ তায়ালা আবারো ৯ নং আয়াতে সতর্ক করে দিয়েছেন শুধু তাই নয় তিনি বলেছেন যারা জালিমদের সাথে বন্ধুত্ব করবে তারাও জালিম। তিনি বলেন, 
//আল্লাহ তোমাদেরকে শুধু তাদের সাথে বন্ধুত্ব করতে নিষেধ করছেন যারা দ্বীনের ব্যাপারে তোমাদের সাথে লড়াই করেছে, বাড়ীঘর থেকে তোমাদের তাড়িয়ে দিয়েছে এবং তোমাদেরকে তাড়িয়ে দেয়ার ব্যাপারে পরস্পরকে সাহায্য করেছে। যারা তাদের সাথে বন্ধুত্ব করবে তারাই জালিম।// 


মহান রাব্বুল আলামীন আমাদের শিক্ষা গ্রহণ করার তাওফিক দান করুন। আত্মীয়দের দ্বীনের ওপরে স্থান দেওয়া থেকে রক্ষা করুন। জালিমদের বন্ধু বানানো থেকে রক্ষা করুন। আরো বেশি আমানতদার হওয়ার তাওফিক দান করুন। আমাদের খিয়ানত থেকে দ্বীন ইসলামকে রক্ষা করুন। আমীন।

১১ জুল, ২০২০

বঙ্গকথা পর্ব-৪৫ : কোণঠাসা কংগ্রেসের সাথে মুসলিম লীগের কতক ঐক্য প্রচেষ্টা



হিন্দুস্থানে মুসলমানদের প্রতি কংগ্রেসের হিংসাত্মক মনোভাব এবং তাদের নির্মূল করে অথবা অন্তত অধীনস্ত করে রেখে রামরাজ্য প্রতিষ্ঠার রাজনৈতিক পরিবেশকে বিষাক্ত করে তুলেছিলো। ফলে উপমহাদেশের রাজনৈতিক ভারসাম্য, পারষ্পরিক শ্রদ্ধাবোধ নষ্ট হয়ে পরেছিলো। কংগ্রেসের পলিসি অনেকটা এরকম ছিল যে, যে কোন ব্যাপারে যদি দেখা যায় যে মুসলমানগণ সামান্য কিছু সুযোগ সুবিধা লাভ করছে, তখন নিজের নাক কেটে পরের যাত্রা ভংগ করার ন্যায় কংগ্রেস তা কিছুতেই হতে দেবে না। ক্রিপসের প্রস্তাবে কিছুটা পাকিস্তান বা ভারত বিভাগের গন্ধ আবিস্কার করে কংগ্রেস তা প্রত্যাখ্যান করেছে। অতঃপর যুদ্ধে ব্রিটিশের পরাজয় অবধারিত মনে করে ‘ভারত ছাড়’ আন্দোলন তথা ভারতের সর্বত্র বিশেষ করে হিন্দু অধ্যুষিত প্রদেশগুলোতে চরম ধ্বংসাত্মক কর্মকান্ড শুরু করে। 

তারা আশা করেছিল, জাপানীরা ভারতের একাংশ দখল করে নিতে পারলে ব্রিটিশ সরকার কংগ্রেসের দাবী মানতে বাধ্য হবে এবং সারা ভারতে সে তাদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হবে। এই বিষয়ে তারা অত্যন্ত আশাবাদী ছিলো। তাই অন্যান্য রাজনৈতিক দলের সাথে আলোচনা দূরে থাক উল্টো সমঝোতা যা হয়েছে পূর্বে তা বাতিল করে দিলো গান্ধি-নেহেরুরা। কিন্তু এর ফল হয়েছে উল্টো। পুরো বিষয়টা কংগ্রেসের বিরুদ্ধে গেছে। ‘ভারত ছাড়’ আন্দোলন কোন মহলই সমর্থন করেনি। এমনকি হিন্দু মহাসভা ও কমিউনিষ্ট পার্টি পর্যন্ত এর তীব্র সমালোচনা করেছে। আজীবন ইংরেজদের অনুকূলে থাকা কংগ্রেস নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়েছে ব্রিটিশ সরকার কর্তৃক। গান্ধীসহ সকল কেন্দ্রীয় নেতাকে গ্রেফতার করে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। আর যাদের ওপর ভরসা করে এতো আয়োজন সেই জাপানীরা ভারত দখল করতে ব্যর্থ হয়েছে। 

কংগ্রেসের এই পরিস্থিতিতে মুসলিম লীগ মুসলিম প্রধান প্রদেশগুলোতে তার জনপ্রিয়তা বৃদ্ধির চেষ্টা চালিয়ে গেছে। ১৯৪৩ এবং ১৯৪৪ সালে বাংলা, আসাম, সিন্ধু ও উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশে মুসলিম লীগ মন্ত্রীসভা বলবৎ ছিল। পাঞ্জাবে মুসলিম ইউনিয়নিষ্ট পার্টির মন্ত্রীসভাও মুসলিম লীগ ও ভারত বিভাগ সমর্থন করতেন। ফলে জনগণের সাথে গভীর যোগাযোগ থাকার কারণে মুসলিম লীগের জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকে এবং পাকিস্তান আন্দোলনও শক্তিশালী হতে থাকে। এতে করে কংগ্রেস নেতৃবৃন্দ চরম হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়েন।

১৯৪৩ সালের জুলাই মাসে গান্ধী ভাইসরয় লর্ড ওয়াভেলের কাছে লিখিত এক পত্রে বলেন, তিনি অসহযোগ আন্দোলন প্রত্যাহার করে যুদ্ধ প্রচেষ্টায় ব্রিটিশদের পূর্ণ সহযোগিতা করার জন্যে কংগ্রেসকে পরামর্শ দিতে চান। এর অর্থ হলো কংগ্রেস আগের মতো ব্রিটিশদের সহায়তা করতে প্রস্তুত। তবে গান্ধী শর্ত জুড়ে দেন, সহযোগিতা করা হবে যদি দ্রুতই ভারতের স্বাধীনতা ঘোষণা করা হয় এবং যুদ্ধ চলাকালে ভারতের উপর কোনো আর্থিক বোঝা চাপানো না হয়।

ভাইসরয় এ পত্রের জবাব দেন ১৫ই আগষ্টে। বলা হয়, যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর সর্বসম্মত শাসনতন্ত্র প্রণীত হলে ব্রিটিশ সরকার ভারতের স্বাধীনতা ঘোষণা করতে প্রস্তুত আছেন। তারা পূর্বে বৃটেনের সাথে একটি চুক্তিও সম্পাদিত হতে হবে। গান্ধীর দাবী অনুযায়ী কেন্দ্রীয় পার্লামেন্টের নিকট দায়ী একটি জাতীয় সরকার গঠন করতে হলে বর্তমান শাসনতন্ত্র পরিবর্তন করতে হবে। তা এখন কিছুতেই সম্ভব নয়। তবে ভাইসরয় বলেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে প্রচলিত শাসনতন্ত্রের অধীন একটি পরিবর্তনকালীন সরকার গঠনে সহযোগিতা করার জন্যে সকলের প্রতি আহবাদ জানাচ্ছি। সকল দল ভবিষ্যৎ শাসনতন্ত্র প্রণয়নের পন্থা পদ্ধতি নিয়ে নীতিগতভাবে একমত হলে প্রস্তাবিত সরকার ভাল কাজ করতে পারবে। গান্ধী তার স্বভাবসুলভ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে বলেন, ব্রিটিশ সরকার ৪০ কোটি মানুষের উপর যে শাসন ক্ষমতা লাভ করে আছেন, তা ততোক্ষণ পর্যন্ত হস্তান্তর করতে রাজী নন, যতোক্ষণ না ভারতবাসী তা ছিনিয়ে নেয়ার ক্ষমতা লাভ করেছে।

গান্ধীর এ কথায় আরো একটি সহিংহ আন্দোলনের হুমকি প্রচ্ছন্ন ছিল। যাহোক ভাইসরয়ের নিকট থেকে নৈরাশ্যজনক জবাবে কতিপয় কংগ্রেস নেতা মুহাম্মদ আলী জিন্নাহর সাথে যোগাযোগ করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন। তাঁদের ধারণা, কংগ্রেস তার প্রচেষ্টায় সরকারের সাথে একটা সমঝোতায় আসতে পারলে তো খুবই ভালো হতো। কিন্তু তা যখন সম্ভব নয়, তখন মুসলিম লীগের সাথেই একটি সমঝোতা অত্যাবশ্যক হয়ে পড়েছে।

সি আর ফর্মুলা
কংগ্রেসের এ ধরনের মনোভাব পরিবর্তনের পূর্বে প্রবীণ কংগ্রেসী নেতা চক্রবর্তী রাজা গোপালাচারিয়া এ সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে, শাসনতান্ত্রিক অবলাবস্থায় অবসানের জন্যে ভারত বিভাগ অপরিহার্য। তিনি এ বিষয়ে কংগ্রেস নেতৃবৃন্দকে সম্মত করার জন্যে জনসভায় তার মনোভাব ব্যক্ত করতে থাকেন। তেতাল্লিশের এপ্রিলে মাদ্রাজের এক জনসভায় তিনি বলেন, আমি পাকিস্তানের পক্ষে। কারণ আমি এমন রাষ্ট্র চাই না, যেখানে আমাদের হিন্দু ও মুসলিম উভয়ের কোন মান সম্মান নেই। মুসলমান পাকিস্তান লাভ করুক। ব্রিটিশ সরকার অসুবিধা সৃষ্টি করলে তার মুকাবিলা আমরা করবো। ...আমি পাকিস্তানের পক্ষে, তবে আমি মনে করি কংগ্রেস এতে রাজী হবে না। 

রাজা গোপালাচারিয়া আরও বলেন, আমরা ব্রিটিশ শাসনের অবসান চাই। হিন্দু-মুসলমানের রাজনৈতিক মতানৈক্যও আমরা মিটাতে চাই। মুসলমানদের প্রতিনিধিত্বশীল হিসাবে মুসলিম লীগকে আমাদের মেনে নিতে হবে। তারা চায় যে আমরা তাদের দাবি মেনে নিই। তাদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দাবী পাকিস্তান। রাজা গোপালচারিয়া ১৯৪৩ সালে একটি ফর্মূলা তৈরি করেন যা সি আর ফর্মূলা নামে অভিহিত। ফর্মূলাটি কংগ্রেস লীগের মধ্যে সমঝোতার ভিত্তি হিসাবে কাজ করবে বলে তিনি মনে করেন। কারাগারে গান্ধীর অনশনরত অবস্থায় তার সাথে সাক্ষাৎ করে ফর্মূলাটি তাঁকে দেখানো হয় এবং গান্ধী তা অনুমোদন করেন। অতঃপর ১০ই জুলাই ১৯৪৩, ফর্মূলাটি সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়।



কংগ্রেস এবং মুসলিম লীগের মধ্যে সমঝোতার ভিত্তিস্বরূপ ফর্মূলাটি মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী এবং মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ মেনে নিয়ে তাঁরা যথাক্রমে কংগ্রেস এবং মুসলিম লীগকে মেনে নেয়ার জন্যে চেষ্টা চালাবেন। ফর্মুলার বিষয়বস্তু নিম্নরূপ : 
১। স্বাধীন ভারতের শাসনতন্ত্র সম্পর্কে নিম্নোক্ত শর্তাবলী সাপেক্ষে মুসলিম লীগ ভারত স্বাধীনতার দাবী সমর্থন করছে এবং পরিবর্তনশীল সময়ে একটি সাময়িক মধ্যবর্তী সরকার গঠনে কংগ্রেসের সাথে সহযোগিতা করবে।
২। ভারতের উত্তর পশ্চিম ও পূর্বাঞ্চলে, যেখানে মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ, সেখানে সীমানা নির্ধারণের জন্যে একটি কমিশন নিয়োগ করা হবে। তারপর সে সব অঞ্চলে বয়স্কদের ভোটাধিকারের ভিত্তিতে গণভোট অনুষ্ঠিত হবে এবং গণভোট দ্বারা ভারত থেকে পৃথক হওয়ার বিষয়টি মীমাংসি হবে। ভারত থেকে পৃথক একটি সার্বভৌম রাষ্ট্রের সপক্ষে যদি সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোট পাওয়া যায় তাহলে সিদ্ধান্ত কার্যকর হবে। তবে সীমান্তের জেলাগুলোর যে কোন রাষ্ট্র যোগদানের অধিকার থাকবে।
৩। গণভোট অনুষ্ঠানের পূর্বে সকল দলের বক্তব্য পেশ করার অধিকার থাকবে।
৪। ভারত থেকে আলাদা হওয়ার সিদ্ধান্তের পর প্রতিরক্ষা, ব্যবসাবাণিজ্য এবং যোগাযোগ ব্যবস্থার জন্যে পারস্পরিক চুক্তি সম্পন্ন করতে হবে।
৫। অধিবাসী স্থানান্তর হবে সম্পূর্ণ স্বতঃপ্রবৃত্ত ও ঐচ্ছিক।
৬। ভারত শাসনের জন্যে বৃটেন কর্তৃক সকল ক্ষমতা ও দায়িত্ব হস্তান্তরের বেলায় ফর্মুলার শর্তাবলী অবশ্য পালনীয় হবে।

মুসলিম লীগ ওয়ার্কিং কমিটি ফর্মুলাটি পরীক্ষা নিরীক্ষার পর এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের দায়িত্ব জিন্নাহর উপর অর্পিত হয়। বিষয়টি নিয়ে গান্ধী-জিন্নাহর মধ্যে বহু পত্রবিনিময় হয়। জিন্নাহ কতকগুলো প্রশ্ন উত্থাপন করেন। গান্ধী সকল প্রশ্নের সন্তোষজনক জবাব দিতে ব্যর্থ হন। অবশেষে চক্রবর্তী রাজা গোপালচারিয়ার  উদ্যোগ ব্যর্থ হয়। 

সি আর ফর্মুলার ব্যর্থতার কারণ
এই সমঝোতা চেষ্টার ব্যর্থতার মূল কারণ গান্ধী ও তাদের পাকিস্তান বিরোধী মনোভাব। গান্ধী মুসলমানদের পাকিস্তান দাবী কিছুতেই মেনে নিতে পারেন নি। টু-নেশন থিওরি তিনি প্রত্যাখ্যান করেন এবং একমাত্র কংগ্রেসকেই তিনি সকল ভারতবাসীর প্রতিনিধিত্বশীল সংগঠন বলে বিশ্বাস করেন। আলোচনার উদ্দেশ্য ছিল বিশ্ববাসীকে দেখানো যে তিনি একটা সমঝোতায় উপনীত হওয়ার চেষ্টা করেছেন। আর সি আর ফর্মুলায় অনুমোদন করার কারণ আগের মতোই মুসলিম লীগের ঠুনকো চুক্তি করা। যাতে প্রয়োজনের সময় মুসলিম লীগকে কাছে পাওয়া যায় আর প্রয়োজন শেষে সমঝোতা বাতিল করা যায়। কিন্তু জিন্নাহ যখন প্রতিটি পদক্ষেপ যাচাই করছিলেন তখন গান্ধীর পাকিস্তান মেনে না নেয়ার বিষয়টি সামনে চলে আসে ও আলোচনা ভেস্তে যায়।   

সাপ্রু প্রস্তাব
সি আর ফর্মূলা ব্যর্থ হওয়ার পর তেজবাহাদুর সাপ্রু কতিপয় প্রস্তাব পেশ করেন কংগ্রেস-মুসলিম লীগের মধ্যে সমঝোতা সৃষ্টির চেষ্টা করেন। সাপ্রু নির্দলীয় সম্মেলনের স্ট্যান্ডিং কমিটি ১৯৪৪ সালের ৩রা ডিসেম্বর এলাহাবাদে মিলিত হয় এবং একটি কমিটি গঠন করেন। তার সদস্য হলেন, স্যার তেজবাহাদুর সাপ্রু (চেয়ারম্যান), এম, আর জয়াকর (তিনি হাজির হননি), বিশপ ফস ওয়েস্টকট, এস রাধাকৃষ্ণ, স্যার হোসি মোদী, স্যার মহারাজ সিংহ, মুহাম্মদ ইউনুস, এন আর সরকার, ফ্ল্যাংক এন্টনী এবং সন্ত সিংহ। অতঃপর সাপ্রু ১০ ডিসেম্বর জিন্নাহর নিকটে লিখিত পত্রে গঠিত কমিটির লক্ষ্য-উদ্দেশ্য বর্ণনা করে সাক্ষাতপ্রার্থী হন।

জিন্নাহ ১৪ই ডিসেম্বর পত্রের জবাবে বলেন, তিনি কোন নির্দলীয় সম্মেলন অথবা তার স্ট্যান্ডিং কমিটিকে কোনরূপ স্বীকৃতি দানে নারাজ। সাপ্রু পরের বছর, ১৯৪৫ সালের ৮ এপ্রিল তার কমিটির প্রস্তাবগুলির ঘোষণা দেন। কমিটির প্রস্তাবগুলোতে তার মনোভাবই পরিস্ফুট হয়েছে। প্রস্তাবের প্রথম দফায় দৃঢ়তার সাথে ভারত বিভাগের বিরোধিতা করা হয়েছে। পৃথক নির্বাচন রহিত করারও প্রস্তাব করা হয়েছে। এ প্রস্তাবগুলো মুসলমানদের নিকটে যে কিছুইতেই গ্রহণযোগ্য হতে পারেনা তা বলার প্রয়োজন করে না। জিন্নাহ এ কমিটিকে কংগ্রেসের গৃহ চাকরানীর সাথে তুলনা করে বলেন, এ কমিটি গান্ধীর সুরে সুর মিলিয়েই কথা বলছে।

দেশাই-লিয়াকত চুক্তি
১৯৪৫ সাল। ভারত ছাড় আন্দোলনের দায়ে তখনও কংগ্রেস নেতৃবৃন্দ কারাগারে। ভারতের পত্রপত্রিকায় কংগ্রেস-লীগের মধ্যে চুক্তির খবর বা গুজব প্রকাশিত হতে থাকে। কেন্দ্রীয় আইনসভার কংগ্রেস সদস্যগণ কয়েক মাস ধরে নিয়মিত আইনসভায় যোগদান করতে থাকেন এবং আইনসভার মুসলিম লীগ সদস্যদের সাথে মিলেমিশে কাজ করতে থাকেন। কংগ্রেস পার্লামেন্টারী পার্টির নেতা ভুলাভাই দেশাই লীগ দলের নেতা লিয়াকত আলী খানের সাথে পুরোপুরি একমত হয়ে কাজ করছেন বলে শোনা যায়। একটি সাময়িক জাতীয় সরকারের সংবিধান নিয়ে উভয় নেতা একটি সমঝোতায় উপনীত হয়েছেন বলেও শোনা যায়। দেশাই ১৩ই জানুয়ারী ভাইসরয়ের প্রাইভেট সেক্রেটারী স্যার ইভান জেনকিন্সের সাথে এবং ২০শে জানুয়ারী ভাইসরয়ের সাথে সাক্ষাৎ করেন। এ সাক্ষাতে দেশাই-লিয়াকতের মধ্যে একটা চুক্তি হয়েছে বলে ভাইসরয়কে অবহিত করা হয়। দেশাই বলেন, এ চুক্তির প্রতি গান্ধীর সমর্থন আছে। তিনি আরও বলেন যে, লিয়াকত আলীর সাথে আলোচনার বিষয় সম্পর্কে জিন্নাহ অবহিত আছেন এবং তিনি এ কথিত চুক্তি অনুমোদন করেন।

কথিত চুক্তি অনুসারে কংগ্রেস এবং লীগ একমত যে তারা কেন্দ্রে একটি মধ্যবর্তী সরকারে যোগদান করবেন। সরকার গঠিত হওয়ার পর তা ভারত সরকার আইনের (১৯৩৫) অধীন কাজ করতে থাকবে। মন্ত্রীসভা যদি কোন বিশেষ কর্মপন্থা বা ব্যবস্থা আইনসভার দ্বারা পাশ করতে সক্ষম না হয়, তাহলে গভর্ণর জেনারেল বা ভাইসরয়ের বিশেষ ক্ষমতার শরণাপন্ন হয়ে তা বলবৎ করতে যাবেনা। এতে করে ভাইসরয়ের প্রভাবমুক্ত হয়ে স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ হবে।

এ বিষয়েও কংগ্রেস ও লীগের মধ্যে ঐকমত্য হয় যে, এ ধরনের সাময়িক সরকার গঠিত হলে তার প্রথম কাজ হবে কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির সদস্যগণকে কারামুক্ত করা। এ চুক্তির ভিত্তিতে গভর্ণর জেনারেলকে অনুরোধ করা হবে তিনি যেন সরকারের নিকটে এ ধরনের প্রস্তাব পেশ করেন যে, কংগ্রেস ও লীগের চুক্তির ভিত্তিতে একটি সাময়িক সরকার গঠনে তিনি আগ্রহী।

গভর্ণর জেনারেল দেশাই-লিয়াকত চুক্তির প্রস্তাবগুলো ভারত সচিবকে জানিয়ে দেন। তিনি এ সম্পর্কে কয়েকটি প্রশ্ন উত্থাপন করে তার ব্যাখ্যা দাবি করেন। গভর্ণর জেনারেল দেশাই ও লিয়াকত আলীর সাথে সাক্ষাৎ করবেন এমন সময় জিন্নাহ এক বিবৃতির মাধ্যমে বলেন, তিনি চুক্তি সম্পর্কে কিছুই জানেন না। দেশাই হতাশ না হয়ে চুক্তির বৈধতা সম্পর্কে দৃঢ়তা প্রকাশ করতে থাকেন। গভর্ণর জেনারেল বিষয়টি পরীক্ষা করার জন্যে বোম্বাই-এর গভর্ণর স্যার জন কোলভিনকে জিন্নাহর সাথে দেখা করে অনুরোধ করতে বলেন যে জিন্নাহ তার সাথে দিল্লীতে দেখা করলে খুশি হবেন। জিন্নাহ বলেন, তিনি দেশাই-লিয়াকত চুক্তি সম্পর্কে কিছুই জানেন না এবং এ চুক্তি মুসলিম লীগের অনুমতি ব্যতিরেকেই করা হয়েছে। এদিকে গান্ধীর অনুমোদন থাকলেও কংগ্রেস নেতৃবৃন্দ দেশাই-এর সমালোচনা করেন। কংগ্রেস এবং মুসলিম লীগ উভয়েই চুক্তিটি প্রত্যাখ্যান করে।

ওয়াবেল পরিকল্পনা 
দেশাই-লিয়াকত চুক্তি ব্যর্থ হওয়ার পর ব্রিটিশ সরকারের সাথে আলাপ আলোচনার জন্যে ভাইসরয় মে মাসে লন্ডন গমন করেন। অতঃপর তিনি সরকারের পক্ষ থেকে অচলাবস্থা দূরীকরণের জন্যে একটি প্রস্তাব নিয়ে ভারতে ফিরে আসেন। ভারত সচিব ১৪ জুন হাউস অব কমন্সে এক বিবৃতির মাধ্যমে ভারতের ভবিষ্যৎ শাসনতান্ত্রিক সমস্যার সমাধানকল্পে একটি প্রস্তাব পেশ করেন। 

প্রস্তাবে বলা হয়, ভাইসরয় তাঁর কার্যকরী কাউন্সিল এমনভাবে পুনর্গঠিত করবেন যাতে তিনি ভারতীয় রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্য থেকে কিছু লোককে তাঁর কাউন্সিলর মনোনীত করতে পারেন। এতে প্রধান সম্প্রদায়গুলোর ভারসাম্যপূর্ণ প্রতিনিধিত্ব থাকবে মুসলমান ও বর্ণহিন্দুর সমানুপাতে। এ কাউন্সিলে ভাইসরয় ও সেনাপ্রধান ব্যতীত সকলে হবেন ভারতীয়। এ কাউন্সিল পুর্গঠনে সকলের সহযোগিতা লাভের পর সকল প্রদেশ থেকে ৯৩ ধারা প্রত্যাহার করা হবে যাতে জনপ্রিয় মন্ত্রীসভা গঠিত হতে পারে। একই দিনে এ প্রস্তাব ব্যাখ্যা করে ভাইসরয় লর্ড ওয়াবেল দিল্লী থেকে এক বেতার ভাষণ দান করেন। গান্ধী এবং কংগ্রেস কাউন্সিলে মুসলমান ও বর্ণহিন্দুর সমসংখ্যক প্রতিনিধিত্ব মেনে নিতে অস্বীকার করেন।

শিমলা সম্মেলন
ভাইসরয় তাঁর চেষ্টা অব্যাহত রাখার জন্যে ২৫শে জুন শিমলার সকল দলের সম্মেলন আহ্বান করেন। সম্মেলনে কংগ্রেস, মুসলিম লীগ, এবং অন্যান্য দলের একুশ জন যোগদান করেন। যাদের মধ্যে মুসলিম লীগের জিন্নাহ ও লিয়াকত আলীসহ ছয় জন ছিলেন। সম্মেলনে কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের মধ্যে চরম মতানৈক্য পরিলক্ষিত হয়। মাওলানা আবুল কালাম আজাদ বলেন, এমন কোন ব্যবস্থা, সাময়িক বা স্থায়ী হোক, কংগ্রেস মেনে নিতে পারেনা, যা তার জাতীয় মর্যাদা ক্ষুণ্ণ করে, এক জাতীয়তাবাদের অগ্রগতি বাধাগ্রস্ত করে এবং কংগ্রেসকে একটি সাম্প্রদায়িক প্রতিষ্ঠানে পর্যবসিত করে। 

জিন্নাহ বলেন, পাকিস্তান ব্যতীত অন্য কোন কিছুর ভিত্তিতে গঠিত শাসনতন্ত্র মুসলিম লীগ মেনে নিতে পারে না। ২৬ এবং ২৭ তারিখেও আলোচনা অব্যাহত থাকে। ইউপি-এর প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী জিবি পন্তের সাথে জিন্নাহর আলাপ আলোচনা চলছিল বিধায় ২৭ তারিখের বৈঠক অল্প সময় পর মুলতবী করা হয়। অতঃপর ২৮ ও ২৯ তারিখে সম্মেলনের অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়। জিন্নাহ-পন্ত আলেচনা ব্যর্থ হয় বলে জানা যায়। ভাইসরয় আলোচনার একটা ভিন্ন পথ অবলম্বন করে সম্মেলনে যোগদানকারী প্রত্যেক দলকে একটি করে নামের তালিকা দাখিল করতে অনুরোধ করেন যারা হবেন ভাইসরয়ের কাউন্সিলের সদস্য। তিনি আশা প্রকাশ করেন যে কংগ্রেস এবং মুসলিম লীগ উভয়েরই ৮ জন থেকে ১২ জনের নামের একটি করে তালিকা পেশ করবেন।

তেসরা জুলাই কংগ্রেস তার নামের তালিকা ভাইসরয়ের নিকটে প্রেরণ করে। ৬ই জুলাই মুসলিম লীগ ওয়ার্কিং কমিটির সাথে পরামর্শের ভিত্তিতে পরদিন জিন্নাহ ভাইসরয়-এর কাছে নিম্নোক্ত প্রস্তাব পেশ করেন :

১। মুসলিম লীগের পক্ষ থেকে নামের তালিকা গ্রহণ করার পরিবর্তে ভাইসরয়-এর সাথে জিন্নাহর ব্যক্তিগত আলোচনার পর কাউন্সিলের জন্যে প্রতিনিধি নির্বাচন করা হবে।
২। কাউন্সিলের সকল মুসলিম সদস্য মুসলিম লীগ বেছে নেবে।
৩। কাউন্সিলের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যদের সিদ্ধান্ত থেকে মুসলিম স্বার্থ সংরক্ষণের জন্যে ফলপ্রসূ রক্ষাকবচের ব্যবস্থা থাকতে হবে।

শেষবারের মতো ১১ই জুলাই ভাইসরয় ও জিন্নাহর মধ্যে আলাপ আলোচনার পর জিন্নাহ যখন বুঝতে পারেন ভাইসরয় কংগ্রেসের চাপে পাকিস্তান দাবির পক্ষে না, তখন তিনি বলেন মুসলিম লীগ ব্রিটিশ সরকারের সাথে কাউন্সিল গঠনে সহযোগিতা করতে পারেনা। অতএব ভাইসরয়-এর শিমলা সম্মেলনও ব্যর্থ হয়।

শিমলা সম্মেলনের ব্যর্থতার কারণ বলতে গিয়ে আব্বাস আলী খান বলেন, শিমলা সম্মেলনের ব্যর্থতার একই কারণ যা কংগ্রেস-লীগ সমঝোতার সকল প্রচেষ্টা বানচাল করে দিয়েছে। তাওহীদ, রেসালাত ও আখেরাতে বিশ্বাসী মানুষ, তাওহীদ, রেসালাত ও আখেরাত অস্বীকারকারীর সাথে মিলে এক জাতি হতে পারে না কিছুতেই। তাই মুসলমানগণ একটি স্বতন্ত্র জাতি –মুসলীমলীগের এ দাবী অকাট্য সত্য যা এ উপমহাদেশের বুকে অসংখ্য ঘটনার দ্বারা প্রমাণিত। 

অতএব জিন্নাহ যদি দাবী করেন যে, যেহেতু মুসলমানগণ একটা স্বতন্ত্র জাতি, সেহেতু ভাইসরয়-এর কাউন্সিলে মুসলিম প্রতিনিধি মনোনয়নের অধিকার মুসলিম জাতির প্রতিনিধিত্বশীল সংগঠন মুসলিম লীগের, তাহলে তা নীতিগতভাবে সকলের মেনে নেয়া উচিত। আর মুসলমাগণ একটি স্বতন্ত্র জাতি হওয়ার কারণেই তাদের জন্যে পৃথক স্বাধীন রাষ্ট্র পাকিস্তানের দাবী করা হয়েছে এবং তার জন্যে সংগ্রাম অব্যাহত আছে। কিন্তু কংগ্রেসের অন্যায় ও অবাস্তব দাবী হচ্ছে উপমহাদেশের সকল হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে এক জাতি এবং তার প্রতিনিধিত্বকারী কংগ্রেস। দেশের ভবিষ্যৎ শাসন ক্ষমতা কংগ্রেস দাবী করে এবং তা হতে পেলে সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু শাসনের অধীনে মুসলমানদের নির্মূল করা যাবে। মুসলমানদের এ আশংকা কল্পনাপ্রসূত নয়, প্রমাণিত সত্য। এ সত্য কংগ্রেস মেনে নিতে রাজী নয়। ভাইসরয় ও কংগ্রেসের দাবীর সমর্থনে জিন্নাহর প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান হলে সম্মেলন ব্যর্থ হয়।

৮ জুল, ২০২০

মুনাফিকদের ইতিহাস এবং তাদের ব্যাপারে রাসূল সা.-এর সিদ্ধান্ত


মুনাফিকরা একদিনে হুট করে তৈরি হয়নি। এর রয়েছে ধারাবাহিক পরিক্রমা। যখনই ইসলামের অবস্থা একটু ব্যাকফুটে থাকে তখন তাদের দৌরাত্ম দেখা যায়। ইসলামের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র, কটূক্তি, আনুগত্যহীনতা এবং ফিতনা তৈরি করে। বার বার আল্লাহর রাসূল সা.-কে তারা বিপদগ্রস্থ করে তুলেছিলো। তারপরও আল্লাহর রাসূল সা.-এর বিচক্ষণ সিদ্ধান্ত তাদেরকে কন্ট্রোলে রেখে সহবস্থানে বাধ্য করেছিল। এরপর ধীরে ধীরে যতই ইসলামের অবস্থান শক্তিশালী হচ্ছিল ততই মুনাফিকরা নিষ্ক্রিয় হয়ে গিয়েছিলো। রাসূল সা. শেষদিকে একেবারে নিঃশেষ হয়ে গিয়েছিলো।      

মদিনায় রাসূল সা.-এর আগমনের পূর্বেই বিবদমান আওস ও খাযরাজ গোত্র দুটি পারস্পরিক গৃহযুদ্ধে ক্লান্ত শ্রান্ত হয়ে এক ব্যক্তির নেতৃত্ব ও কর্তৃত্ব মেনে নিতে প্রায় ঐকমত্যে পৌঁছেছিল। তারা যথারীতি তাকে বাদশাহ বানিয়ে তার অভিষেক অনুষ্ঠানের প্রস্তুতিও শুরু করেছিল। এমন কি তার জন্য রাজ মুকুটও তৈরী করা হয়েছিল। এ ব্যক্তি আর কেউ নয় তিনি ছিলেন খাযরাজ গোত্রের নেতা আবদুল্লাহ ইবনে উবাই ইবনে সালূল। মুহাম্মাদ ইবনে ইসহাক বর্ণনা করেন, খাযরাজ গোত্রে তার মর্যাদা ও শ্রেষ্ঠত্ব ছিল সর্বসম্মত এবং আওস ও খাযরাজ ইতিপূর্বে আর কখনো একযাগে এক ব্যক্তির নেতৃত্ব মেনে নেয়নি। 

এই পরিস্থিতিতে ইসলামের সুমহান দাওয়াত মদিনায় পৌঁছে এবং এই দুটি গোত্রের প্রভাবশালী ব্যক্তিবর্গ ইসলাম গ্রহণ করতে শুরু করে। হিজরতের আগে আকাবার দ্বিতীয় শপথের সময় রাসূল সা.-কে যখন মদীনায় আগমনের জন্য আহবান জানানো হচ্ছিল তখন হযরত আব্বাস ইবনে উবাদা রা. এ আহবান জানাতে শুধু এ কারণে দেরী করতে চাচ্ছিলেন যাতে আবদুল্লাহ ইবনে উবাইও বাইয়াত ও দাওয়াতে শামিল হয়। সে যেন রাসূল সা.-এর প্রতিদ্বন্দ্বি না হয়। এভাবে মদীনা যেন সর্বসম্মতিক্রমে ইসলামের কেন্দ্র হয়ে ওঠে। কিন্তু যে প্রতিনিধি দল বাইয়াতের জন্য হাজির হয়েছিল তারা এই যুক্তি ও কৌশলকে কোন গুরুত্বই দিলেন না এবং এতে অংশগ্রহণকারী দুই গোত্রের পঁচাত্তর ব্যক্তি সব রকম বিপদ মাথা পেতে নিয়ে নবী সা.-কে দাওয়াত দিতে প্রস্তুত হয়ে গেল। 

এরপর নবী সা. যখন মদীনায় পৌঁছলেন তখন আনসারদের ঘরে ঘরে ইসলাম এতটা প্রসার লাভ করেছিল যে, আবদুল্লাহ ইবনে উবাই নিরূপায় হয়ে পড়েছিল। নেতৃত্ব ও কর্তৃত্ব রক্ষার জন্য ইসলাম গ্রহণ করা ছাড়া আর কোন উপায় ছিল না। তাই সে তার বহু সংখ্যক সহযোগী ও অনুসারিদের নিয়ে ইসলাম গ্রহণ করে। এদের মধ্যে উভয় গোত্রের প্রবীণ ও নেতা পর্যায়ের লোকেরা ছিল। 

মদিনায় ইসলামের প্রসারে আবদুল্লাহ ইবনে উবাইয়ের অন্তরজ্বালা ও দুঃখ ছিল অত্যন্ত তীব্র। কারণ সে মনে করতো, রসূলুল্লাহ সা. তার রাজত্ব ও বাদশাহী ছিনিয়ে নিয়েছেন। তার এই মুনাফেকীপূর্ণ ঈমান এবং নেতৃত্ব হারানোর দুঃখ কয়েক বছর ধরে বিচিত্র ভঙ্গিতে প্রকাশ পেতে থাকলো। একদিকে তার অবস্থা ছিল এই যে, প্রতি জুমআর দিন রসূলুল্লাহ সা. যখন খুতবা দেওয়ার জন্য মিম্বরে উঠে বসতেন তখন আবদুল্লাহ ইবনে উবাই উঠে বলতো, “ভাইসব, আল্লাহর রসূল আপনাদের মধ্যে বিদ্যমান। তাঁর কারণে আল্লাহ তা’আলা আপনাদেরকে সম্মান ও মর্যাদা দান করেছেন। তাই আপনারা সবাই তাঁকে সাহায্য ও সহযোগিতা করুন। এবং তিনি যা বলেন গভীর মনযোগ সহকারে শুনুন এবং তার আনুগত্য করুন।“ 

সে এমন ঘোষণা দিয়ে নিজেকে খাঁটি ঈমানদার বুঝানোর সর্বোচ্চ চেষ্টা করতো। অপরদিকে অবস্থা ছিল এই যে, প্রতিদিনই তার মুনাফেকীর মুখোশ খুলে পড়ছিল এবং সৎ ও নিষ্ঠাবান মুসলমানদের কাছে পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছিল যে, সে ও তার সাঙ্গপাঙ্গরা ইসলাম, রসূলুল্লাহ সা. এবং ঈমানদারদের বিরুদ্ধে চরম শত্রুতা পোষণ করে। একবার নবী সা. কোনো এক পথ দিয়ে যাচ্ছিলেন । এই সময় পথে আবদুল্লাহ ইবনে উবাই তাঁর সাথে অভদ্র আচরণ করে। তিনি খাজরাজ গোত্রের আরেক নেতা সা’দ ইবনে উবাদাকে বিষয়টি জানালে সা’দ বললেন, “হে আল্লাহর রসূল, আপনি এ ব্যক্তির প্রতি একটু নম্রতা দেখান। আপনার আগমনের পূর্বে আমরা তার জন্য রাজমুকুট তৈরী করেছিলাম। এখন সে মনে করে, আপনি তার নিকট থেকে রাজত্ব ছিনিয়ে নিয়েছেন।“

বদর যুদ্ধের পর বনী কাইনুকা গোত্রের ইহুদীরা প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ ও অকারণে বিদ্রোহ করলে রসূলুল্লাহ সা. তাদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করেন। তখন আব্দুল্লাহ ইবনে উবাই তাদের সমর্থনে কোমর বেঁধে কাজ শুরু করে। সে নবীর সা. বর্ম ধরে বলতে লাগলো, এই গোত্রটির সাতশত বীরপুরুষ যোদ্ধা শত্রুর মোকাবেলায় সবসময় আমাকে সাহায্য করেছে, আজ একদিনেই আপনি তাদের হত্যা করতে যাচ্ছেন? আল্লাহর শপথ, আপনি যতক্ষণ আমার এই মিত্রদের ক্ষমা না করবেন আমি ততক্ষণ আপনাকে ছাড়বো না। পরে আল্লাহর রাসূল সা. আব্দুল্লাহ ইবনে উবাইয়ের কথা আংশিকভাবে মেনে নেন। বনু কাইনুকার ইহুদীদের বিদ্রোহের সর্বোচ্চ শাস্তি না দিয়ে মদিনা থেকে বহিষ্কার করেন। 

উহুদ যুদ্ধের সময় আব্দুল্লাহ বিন উবাই ও তার সঙ্গীরা তাদের সর্বোচ্চ মুনাফেকী প্রদর্শন করেন। তারা সরাসরি ইসলামের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। যুদ্ধ কোথা থেকে করা হবে এই নিয়ে পরামর্শ সভায় মতরিরোধ তৈরি হয়। আলোচনা করে একটি সিদ্ধান্তে সবাই একমত হয়। কিন্তু পরে যুদ্ধের ঠিক পূর্ব মুহুর্তে আব্দুল্লাহ বিন উবাই তার তিনশত সঙ্গী-সাথীকে নিয়ে যুদ্ধের ময়দানে থেকে ফিরে এসেছে। কী মারাত্মক বিপদে পড়েছেন রাসূল সা. এটা সহজেই অনুমেয়। মুসলিমদের মনোবল ভেঙে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। কুরাইশরা তিন হাজার লোকের একটি বাহিনী নিয়ে মদীনার ওপরে চড়াও হয়েছিল আর রসূলুল্লাহ সা. মাত্র একহাজার লোক নিয়ে তাদের মোকাবিলা ও প্রতিরোধের জন্য বেরিয়েছিলেন। এক হাজার লোকের মধ্যে থেকেও মুনাফিকরা আলাদা হয়ে যুদ্ধের ময়দান থেকে নিজেদের সরিয়ে নিয়ে গেল এবং নবী সা.-কে শুধু সাতশত লোকের একটি বাহিনী নিয়ে তিন হাজার শত্রুর মোকাবিলা করতে হলো।

উহুদের ঘটনার পর এটা সমস্ত মুসলিমদের কাছে নিশ্চিত ছিল যে আব্দুল্লাহ বিন উবাই এবং তার দল সত্যিকারের মুসলিম নন। নইলে আল্লাহর রাসূল সা.-এর সাথে বিদ্রোহ করে যুদ্ধের ময়দান থেকে ফিরে যেতে পারে না। এতে মুসলিমদের সুবিধে হলো তারা মুনাফিক সর্দার ও তার অনুসারীদের চিহ্নিত করার সুযোগ পেল। এ কারণে উহুদ যুদ্ধের পর প্রথম জুম’আর দিনে নবী সা. খুতবা দেয়ার পূর্বে আব্দুল্লাহ বিন উবাই যখন বক্তৃতা করতে দাঁড়ালো তখন লোকজন তার জামা টেনে ধরে বলল, “তুমি বসো, তুমি একথা বলার উপযুক্ত নও। মদীনাতে এই প্রথমবারের মত প্রকাশ্যে তাকে অপমানিত করা হলো। এতে সে ভীষণভাবে ক্ষুব্ধ ও রাগান্বিত হলো এবং মসজিদ থেকে বেরিয়ে গেল। মসজিদের দরজার কাছে কিছু সংখ্যক আনসার সাহাবী তাকে বললেন, “তুমি একি আচরণ করছো? ফিরে চলো এবং আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাওয়ার জন্য রসূলুল্লাহ সা. কাছে আবেদন করো।“ এতে সে ক্রোধে ফেটে পড়লো এবং বললো! “তাকে দিয়ে আমি কোন প্রকার ক্ষমা প্রার্থনা করাতে চাই না”। 

হিজরী ৪ সনে বনু নাযীর যুদ্ধ সংঘটিত হয়। সেই সময় বিন উবাই ও তার সাঙ্গপাঙ্গরা প্রকাশ্যে ইসলামের বিরুদ্ধে ইসলামের শত্রুদের সাহায্য সহযোগিতা দান করে। একদিন রসূলুল্লাহ সা. এবং তাঁর সাহাবীগণ এসব ইহুদী শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। অপরদিকে এই মুনাফিকরা গোপনে গোপনে ইহুদীদের কাছে খবর পাঠাচ্ছিল যে, তোমরা রুখে দাঁড়াও । আমরা তোমাদের সাথে আছি। তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা হলে আমরা তোমাদের সাহায্য করবো এবং তোমাদেরকে বহিষ্কার করা হলে আমরাও তোমাদের সাথে বেরিয়ে যাব। আল্লাহ তা’আলা তাদের এই গোপন ষড়যন্ত্রের বিষয়টি প্রকাশ করে দিলেন। সূরা হাশরে আল্লাহ আমাদের জানিয়ে দিয়েছেন। 

মুনাফিকদের মুখোশ খুলে পড়ার পরও রসূলুল্লাহ সা. তার কার্যকলাপ ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখে এড়িয়ে গিয়েছেন। কারণ মুনাফিকদের একটা বড় দল তার সহযোগী ছিল। আওস ও খাযরাজ গোত্রদ্বয়ের বহু সংখ্যক নেতা তার সাহায্যকারী ছিল। কম করে হলেও মদীনার গোটা জনবসতির এক চতুর্থাংশ ছিল তার অনুসারী। উহুদ যুদ্ধের সময় এ বিষয়টিই প্রকাশ পেয়েছিল। এই পরিস্থিতিতে বাইরের শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াই করার সাথে সাথে আভ্যন্তরীণ শত্রুর সাথেও যুদ্ধের ঝুঁকি নেয়া কোন অবস্থায়ই সমীচীন ছিল না। এ কারণে তাদের মুনাফিকী সম্পর্কে অবহিত থাকা সত্ত্বেও নবী সা. দীর্ঘদিন পর্যন্ত বাহ্যিকভাবে ঈমানের দাবী অনুসারেই তাদের সাথে আচরণ করেছেন। 

অপরদিকে এসব লোকেরও এতটা শক্তি ও সাহস ছিল না যে, তারা প্রকাশ্যে কাফের হয়ে ঈমানদারদের বিরুদ্ধে অস্ত্রহাতে লড়াই করতো অথবা খোলাখুলি কোন হামলাকারী শত্রুর সাথে মিলিত হয়ে ময়দানে অবতীর্ণ হতো। বাহ্যত তারা নিজেদের একটা মজবুত গোষ্ঠী তৈরী করে নিয়েছিল। কিন্তু তাদের মধ্যে বহু দুর্বলতা ছিল। সূরা হাশরের ১২ থেকে ১৪ আয়াতে আল্লাহ তা’আলা স্পষ্টভাবে সেইসব দুর্বলতার কথাই তুলে ধরেছেন। তাই তারা মনে করতো মুসলমান সেজে থাকার মধ্যেই তাদের কল্যাণ নিহিত। তারা মসজিদে আসতো, নামায পড়তো এবং যাকাতও দিতো। তাছাড়া মুখে ঈমানের লম্বা চওড়া দাবী করতো, সত্যিকার মুসলমানদের যা করার আদৌ কোন প্রয়োজন পড়তো না। 

নিজেদের প্রতিটি মুনাফিকী আচরণের পক্ষে হাজারটা মিথ্যা যুক্তি তাদের কাছে ছিল। এসব যুক্তি দিয়ে তারা নিজেদের স্বগোত্রীয় আনসারদেরকে এই মর্মে মিথ্যা আশ্বাস দিত যে, আমরা তোমাদের সাথেই আছি। আনসারদের ভ্রাতৃত্ব বন্ধন থেকে বিচ্ছিন্ন হলে তাদের অনেক ক্ষতি হতো । এসব কৌশল অবলম্বন করে তারা যেসব ক্ষতি থেকে নিজেদের রক্ষা করেছিল। তাছাড়া তাদের ভ্রাতৃত্ব বন্ধনে আবদ্ধ থেকে মুসলমানদের ভেতরে কলহ কোন্দাল ও ফাসাদ সৃষ্টির এমন সব সুযোগও তারা কাজে লাগাচ্ছিল যা অন্য কোন জায়গায় থেকে লাভ করতে পারত না।

এসব কারণে আবদুল্লাহ ইবনে উবাই এবং তার অনুসারী মুনাফিকরা রসূলুল্লাহ সা.-এর সাথে বনু মুসতালিক যুদ্ধাভিযানে শরীক হওয়ার সুযোগ লাভ করেছিল এবং এই সুযোগে একই সাথে এমন দুটি মহাফিতনা সৃষ্টি করেছিল যা মুসলমানদের সংহতি ও ঐক্যকে ছিন্নভিন্ন করে দিতে পারতো। কিন্তু পবিত্র কুরআনের শিক্ষা এবং রসূলুল্লাহ সা.এর পবিত্র সাহচর্য থেকে ঈমানদাগণ যে সর্বোত্তম প্রশিক্ষণ লাভ করেছিলেন তার কল্যাণে যথাসময়ে এ ফিতনার মুলোৎপাটন হয়ে যায় এবং এসব মুনাফিক নিজেরাই অপমানিত ও লাঞ্ছিত হয়। এ দুটি ফিতনার মধ্যে একটির উল্লেখ করা হয়েছে সূরা নূরে। আর অপর ফিতনাটির উল্লেখ করা হয়েছে সূরা মুনাফিকুনে। 

বনু মুসতালিককে পরাস্ত করার পর ইসলামী সেনাবাহিনী তখনও মুরাইসী নামক কূপের আশেপাশের জনবসতিতে অবস্থান করেছিল। ইতোমধ্যে হঠাৎ পানি নিয়ে দুই ব্যক্তির মধ্যে বচসা হয়। তাদের মধ্যে একজনের নাম ছিল জাহ্জাহ্ ইবনে মাসউদ। তিনি ছিলেন হযরত উমরের রা.-এর কর্মচারী। তিনি তাঁর ঘোড়ার দেখাশোনা করতেন। অন্যজন ছিলেন সিনান ইবনে ওয়াবার ইল জুহানী। তাঁর গোত্র খাযরাজ গোতের মিত্র ছিল। মৌখিক বাদানুবাদ শেষ পর্যন্ত হাতাহাতিতে পরিণত হয় এবং জাহজাহ সিনানকে একটি লাথি মারে। এতে সিনান সাহায্যের জন্য আনসারদেরকে আহবান জানায় এবং জাহজাহও মুহাজিরদের আহবান জানায়। 

এই ঝগড়ার খবর শোনামাত্র আবদুল্লাহ ইবনে উবাই আওস ও খাযরাজ গোত্রের লোকদের উত্তেজিত করতে শুরু করে। সে চিৎকার করে বলতে থাকে দ্রুত এসো, নিজের মিত্রদের সাহায্য করো। অপরদিকে থেকে কিছু সংখ্যক মুহাজিরও এগিয়ে আসেন। বিষয়টি আরো অনেক দূর পর্যন্ত গড়াতে পারতো। তাই আনসার ও মুহাজিরগণ সম্মিলিতভাবে সবেমাত্র যে স্থানটিতে এক দুশমন গোত্রের বিরুদ্ধে লড়াই করে তাদের পরাজিত করেছিলেন এবং তখনও তাদের এলাকাতেই অবস্থান করেছিলেন সে স্থানটিতেই পরস্পরের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের লিপ্ত হয়ে পড়তেন। 

কিন্তু শোরগোল শুনে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এগিয়ে গেলেন এবং বললেন, “কী ব্যাপার? জাহেলিয়াতের আহবান শুনতে পাচ্ছি কেন? জাহেলিয়াতের আহবানের সাথে তোমাদের কি সম্পর্ক? এসব ছেড়ে দাও, এগুলো দুর্গন্ধময় নোংরা জিনিস। এতে উভয়পক্ষের সৎ ও নেককার লোকজন অগ্রসর হয়ে ব্যাপারটি মিটমাট করে দিলেন এবং সিনান জাহজাহকে মাফ করে আপোষ করে নিলেন। 

এখানে এলাকাভিত্তিক জাতীয়তাবাদকে আল্লাহর রাসূল সা. জাহেলিয়্যাত বলেছেন। মদিনাবাসী ও মক্কাবাসী একে অপরের বিরুদ্ধে নিজের জাতিকে আহ্বান জানিয়েছিলো। অথচ মুসলিমরা নিজেদের ভাইদের মধ্যে ইনসাফ কায়েম করবে। কেউ কোন অপরাধ করলে নিজের জাতির লোক বলে তাকে সাপোর্ট করবে না। আবার অন্য জাতির কেউ অপরাধ করলে পুরো জাতিকে দোষারোপ করা যাবে না। এভাবে এলাকাভিত্তিক, ভাষাভিত্তিক ও বর্ণভিত্তিক জাতীয়তাবাদের স্থান ইসলামে নেই। এটা হারাম।  

যাই হোক, এই মীমাংসার পর যাদের অন্তরে মুনাফিকী ছিল তারা সবাই এরপর আবদুল্লাহ ইবনে উবাইয়ের কাছে সমবেত হয়ে তাকে বললো, “এতদিন আমরা তোমার দিকে তাকিয়ে ছিলাম। তুমি প্রতিরোধও করে আসছিলে। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে, তুমি আমাদের বিরুদ্ধে এসব কাঙাল ও নিঃস্বদের (মুহাজির) সাহায্যকারী হয়ে গিয়েছো!“ আবদুল্লাহ ইবনে উবাই আগে থেকেই অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হয়েছিল। একথা শুনে সে আরো জ্বলে উঠল। সে বলতে শুরু করল, এসব তোমাদের নিজেদেরই কাজের ফল। তোমরা এসব লোককে নিজের দেশে আশ্রয় দিয়েছো, নিজেদের অর্থ-সম্পদ তাদের বন্টন করে দিয়েছো। এখন তারা ফুলে ফেঁপে উঠেছে এবং আমাদেরই প্রতিপক্ষ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমাদের এবং কুরাইশদের এই কাঙালদের অবস্থা বুঝাতে একটি উপমা হুবহু প্রযোজ্য। উপমাটি হলো, তুমি নিজের কুকুরকে খাইয়ে দাইয়ে মোটা তাজা করো, যাতে তা একদিন তোমাকেই ছিঁড়ে ফেঁড়ে খেতে পারে। তোমরা যদি তাদের থেকে সাহায্যের হাত গুটিয়ে নাও তাহলে তারা কোথায় নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। আল্লাহর শপথ, মদীনায় ফিরে গিয়ে আমাদের মধ্যে যারা মর্যাদাবান লোক তারা হীন ও লাঞ্ছিত লোকদের বের করে দেবে।“

এ বৈঠকে ঘটনাক্রমে হযরত যায়েদ ইবনে আরকামও উপস্থিত ছিলেন। তখন তিনি একজন কম বয়স্ক বালক ছিলেন। এসব কথা শোনার পর তিনি তাঁর চাচার কাছে তা বলে দেন। তাঁর চাচা ছিলেন আনসারদের একজন নেতা। তিনি রসূলুল্লাহ সা.-এর কাছে গিয়ে সব বলে দেন। নবী সা. যায়েদকে ডেকে জিজ্ঞেস করলে তিনি যা শুনেছিলেন আদ্যপান্ত খুলে বললেন। নবী সা. বললেন, তুমি বোধহয় ইবনে উবাইয়ের প্রতি অসন্তুষ্ট। সম্ভবত তোমার শুনতে ভুল হয়েছে। ইবনে উবাই একথা বলছে বলে হয়তো তোমার সন্দেহ হয়েছে। 

কিন্তু যায়েদ বললেন, হে আল্লাহর রসূল সা.! তা নয়। আল্লাহর শপথ আমি নিজে তাকে এসব কথা বলতে শুনেছি। অতঃপর নবী সা. ইবনে উবাইকে ডেকে জিজ্ঞেস করলে সে সরাসরি অস্বীকার করলো। সে বারবার শপথ করে বলতে লাগলো আমি একথা কখনো বলি নাই। আনসারদের লোকজনও বললেন, হে আল্লাহর নবী! এতো একজন ছেলে মানুষের কথা, হয়তো তার ভুল হয়েছে।

তিনি আমাদের নেতা ও সম্মানিত ব্যক্তি। তার কথার চেয়ে একজন বালকের কথার প্রতি বেশী আস্থাশীল হবেন না। বিভিন্ন গোত্রের প্রবীণ ও বৃদ্ধ ব্যক্তিরাও যায়েদকে তিরস্কার করলো। বেচারা যায়েদ এতে দুঃখিত ও মনঃক্ষুণ্ন হয়ে নিজের জায়গায় চুপচাপ বসে থাকলেন। কিন্তু নবী সা. প্রকৃত ব্যাপার কী তা তিনি ঠিকই উপলব্ধি করতে পারলেন।

হযরত ‘উমর এ বিষয়টি জানতে পেরে নবী সা.-এর কাছে এসে বললেন, “আমাকে অনুমতি দিন, আমি এই মুনাফিকের গর্দান উড়িয়ে দেই। কিন্তু নবী সা. বললেন, “এ কাজ করো না। ধৈর্য ধরো। লোকে বলবে, মুহাম্মাদ সা. নিজের সংগী-সাথীদেরকেই হত্যা করেছে”। উমার রা. আরো প্রস্তাব করলেন, যেহেতু আমি মুহাজির আমি হত্যা করলে নানান কথা উঠবে, তাহলে আপনি কোনো আনসার দিয়ে এই কাজটি করিয়ে নিন। নবী করিম সা. এবারো তাঁকে নিভৃত করলেন। ধৈর্যধারণ করতে বললেন।

এরপর  এরপর নবী সা. তৎক্ষনাৎ যাত্রা শুরু করার নির্দেশ দিয়ে দিলেন। ক্রমাগত ৩০ ঘন্টা পর্যন্ত যাত্রা অব্যাহত থাকলো। এমন কি লোকজন ক্লান্তিতে নিস্তেজ ও দুর্বল হয়ে পড়লো। ক্লান্ত শ্রান্ত লোকজন মাটিতে পিঠ ঠেকানো মাত্র সবাই গভীর নিদ্রায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়লো। এ কাজ রাসূল সা. এ জন্য করলেন যাতে, মুরইসী কূপের পাশে যে ঘটনা ঘটেছিল মানুষের মন-মগজ থেকে তা মুছে যায়। কিন্তু রাসূল সা.-এর ব্যাপারে আব্দুল্লাহ বিন উবাই যে মন্তব্য করেছিলো তা ধীরে ধীরে সবার মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। আনসার সাহাবীদের অনেকেই তাকে রাসূল সা.-এর কাছে ক্ষমা চাওয়ার পরামর্শ দেয়। কিন্তু সে তা করেনি। তার বেপরোয়া আচরণে সাহাবীদের মধ্যে তার সম্পর্কে আরো বিরূপ ধারণা তৈরি হয়।    

এই ঘটনাকে ইঙ্গিত করে মহান রাব্বুল আলামীন সূরা মুনাফিকুনে মুনাফিকদের আচরণের সাথে মুসলিমদের পরিচয় করে দিয়েছিলেন। তিনি বলেন, 

// যখন তোমার কাছে মুনাফিকরা আসে, তখন বলে, আমরা সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, নিশ্চয় আপনি আল্লাহর রাসূল এবং আল্লাহ জানেন যে, অবশ্যই তুমি তাঁর রাসূল। আর আল্লাহ সাক্ষ্য দিচ্ছেন যে, অবশ্যই মুনাফিকরা মিথ্যাবাদী। তারা নিজদের শপথকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে। অতঃপর তারা আল্লাহর পথ থেকে বিরত রাখে। তারা যা করছে, নিশ্চিয় তা কতইনা মন্দ! তা এ জন্য যে, তারা ঈমান এনেছিল তারপর কুফরী করেছিল। ফলে তাদের অন্তরসমূহে মোহর লাগিয়ে দেয়া হয়েছে। তাই তারা বুঝতে পারছে না।

আর যখন তুমি তাদের প্রতি তাকিয়ে দেখবে তখন তাদের শরীর তোমাকে মুগ্ধ করবে। আর যদি তারা কথা বলে তুমি তাদের কথা (আগ্রহ নিয়ে) শুনবে। তারা দেয়ালে ঠেস দেয়া কাঠের মতই। তারা মনে করে প্রতিটি আওয়াজই তাদের বিরুদ্ধে। এরাই শত্রু, অতএব এদের সম্পর্কে সতর্ক হও। আল্লাহ এদেরকে ধ্বংস করুন। তারা কিভাবে সত্য থেকে ফিরে যাচ্ছে! 

আর তাদেরকে যখন বলা হয় এসো, আল্লাহর রাসূল তোমাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করবেন, তখন তারা তাদের মাথা নেড়ে অস্বীকার করে। আর তুমি তাদেরকে দেখতে পাবে, অহঙ্কারবশত বিমুখ হয়ে চলে যেতে। তুমি তাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা কর অথবা না কর, উভয়টি তাদের ক্ষেত্রে সমান। আল্লাহ তাদেরকে কখনো ক্ষমা করবেন না। অবশ্যই আল্লাহ পাপাচারী সম্প্রদায়কে হেদায়াত দেন না।

তারা বলে, যদি আমরা মদীনায় ফিরে যাই তাহলে অবশ্যই সেখান থেকে প্রবল দুর্বলকে বহিষ্কার করবে। কিন্তু সকল মর্যাদা তো আল্লাহর, তাঁর রাসূলের ও মুমিনদের। কিন্তু মুনাফিকরা তা জানে না।//

উস্তাদ আবুল আ'লা মওদূদী র. বলেন, এ ঘটনা থেকে শরীয়াতের দুটি গুরুত্বপূর্ণ মাসায়ালা সম্পর্কে স্পষ্টভাবে জানা যায়। 

১. ইবনে উবাই যে কর্মনীতি গ্রহণ করেছিল এবং যে ধরনের তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছিল মুসলিম মিল্লাতের অন্তরভুক্ত থেকে কেউ যদি এ ধরনের আচরণ করে তাহলে সে হত্যা যোগ্য অপরাধী। 

২. শুধু আইনের দৃষ্টিতে কোন ব্যক্তি হত্যার উপযুক্ত হলেই যে তাকে অবশ্যই হত্যা করতে হবে তা জরুরি নয়। এরূপ কোন সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে দেখতে হবে, তাকে হত্যা করার ফলে কোন বড় ধরনের ফিতনা মাথা চাড়া দিয়ে উঠবে কিনা। পরিবেশ-পরিস্থিতিকে উপেক্ষা করে অন্ধভাবে আইনের প্রয়োগ কোন কোন সময় আইন প্রয়োগের উদ্দেশ্যের পরিপন্থী ফলাফল নিয়ে আসে। যদি একজন মুনাফিক ও ফিতনাবাজের পেছনে কোন উল্লেখযোগ্য রাজনৈতিক শক্তি থাকে তাহলে তাকে শাস্তি দিয়ে আরো বেশি ফিতনাকে মাথাচড়া দিয়ে ওঠার সুযোগ দেয়ার চেয়ে উত্তম হচ্ছে, যে রাজনৈতিক শক্তির জোরে সে দুষ্কর্ম করছে কৌশল ও বুদ্ধিমত্তার সাথে তার মূলোৎপটন করা। 

এই সুদূর প্রসারী লক্ষ্যেই নবী করিম সা. তখনো আবদুল্লাহ ইবনে উবাইকে শাস্তি দেননি যখন তিনি তাকে শাস্তি দিতে সক্ষম ছিলেন। বরং তার সাথে সবসময় নম্র আচরণ করেছেন ও তার ব্যাপারে সতর্ক থেকেছেন। শেষ পর্যন্ত দুই তিন বছরের মধ্যেই মদীনায় মুনাফিকদের শক্তি চিরদিনের জন্য নির্মূল হয়ে গেল।

-তাফহীমুল কুরআন ও সীরাতে ইবনে হিশাম থেকে সংকলিত

৬ জুল, ২০২০

বঙ্গকথা পর্ব-৪৪ : জাপানের জোরে গান্ধীর 'ভারত ছাড়' আন্দোলন



১৯৪২ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে জাপান একের পর এক বৃটিশ দুর্গ দখল করে ভারতকে প্রায় ঘিরে ফেলে। এমন পরিস্থিতিতে ভারতের রাজনৈতিক নেতাদের সমর্থন আদায়ে ক্রিপসকে ভারতে পাঠায় ব্রিটেন। কিন্তু ক্রিপসের মিশন ব্যর্থ হয়। এদিকে কংগ্রেস নিশ্চিত ছিল জাপান যেভাবে এগিয়ে আসছে তাতে ভারত দখল করা সময়ের ব্যাপার মাত্র। আর ভারতে জাপানিদের হাতে বৃটিশদের পতন হলে তারাই শাসনক্ষমতা দখলে নিবে। তাই জাপানিদের কাছে নিজেদের বৃটিশবিরোধী অবস্থান নিশ্চিত করতে ভারত ছাড় আন্দোলনের সিদ্ধান্ত নেয়।

কংগ্রেস নেতৃবৃন্দ মনে করেছিলেন যে যুদ্ধে মিত্র শক্তির পরাজয় অবধারিত। এই সুযোগে দেশে চরম বিশৃংখলা সৃষ্টি করে সমগ্র দেশের শাসন ক্ষমতা হস্তগত করা ছিল কংগ্রেসের পরিকল্পনার অধীন। এভাবেই মুসলমানদের সকল দাবী দাওয়া প্রত্যাখ্যান করে উপমহাদেশে হিন্দুরাজ প্রতিষ্ঠা করা যাবে। কংগ্রেসের এ পরিকল্পনার স্বীকৃতি পাওয়া যায় মাওলানা আবুল কালাম আযাদ-এর ‘ইন্ডিয়া উইনস ফ্রীডম’ বইয়ে। তিনি বলেন, তাঁর মনে এ পরিকল্পনা ছিল যে, যেইমাত্র জাপানীরা বাংলায় পৌঁছে যাবে এবং ব্রিটিশ সৈন্য বিহারে পিছু হটে আসবে, কংগ্রেস গোটা দেশের নিয়ন্ত্রণভার গ্রহণ করবে। কিন্তু কংগ্রেসের এ পরিকল্পনা অমূলক ও অবাস্তব প্রমাণিত হয়।

ক্রিপস মিশনের ব্যর্থতার অব্যবহিত পরপরই  ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে ভারতের বোঝাপড়া শেষ করে দিয়ে গান্ধী তীব্র ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের পরিকল্পনা করতে শুরু করে। গান্ধী ১৯৪২ সালে ২৬ এপ্রিল 'হরিজন' পত্রিকাতে 'ভারত ছাড়' নামে একটি প্রবন্ধ লিখেন। এই প্রবন্ধে তিনি বলেন "ভারতে ব্রিটিশ শাসনের অবিলম্বে অবসান চাই। ভারতের স্বাধীনতা চাই কেবল ভারতের স্বার্থে নয় — চাই বিশ্বের নিরাপত্তার জন্য নাত্সীবাদ, ফ্যাসিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদ এবং একজাতির উপর অন্যজাতির আক্রমণের অবসানের জন্য।" এরপর ১৯৪২ সালের ১৪ জুলাই মহারাষ্ট্রের ওয়ার্ধা অধিবেশনে 'কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটি' গান্ধী 'ভারত ছাড়' আন্দোলনের প্রস্তাব অনুমোদন করে। ১৯৪২ সালের ৮ আগস্ট কংগ্রেসের কার্য-নির্বাহক সমিতি গান্ধীর ঐতিহাসিক 'ভারত ছাড়' প্রস্তাবের আইনগত স্বীকৃতি জানায় এবং সিদ্ধান্ত হয় যে ৯ আগস্ট ১৯৪২ সালে সকালে আন্দোলন শুরু হবে। 

এই প্রস্তাবে বলা হয় ভারতের মঙ্গলের জন্য, বিশ্বের নিরাপত্তার জন্য, নাত্সীবাদ, ফ্যাসিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের অবসান ঘটিয়ে বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য ভারতে ব্রিটিশ শাসনের অবসান অপরিহার্য। প্রস্তাবে আরও বলা হয়, ব্রিটিশ ভারত ছেড়ে চলে গেলে ভারতীয় জনপ্রতিনিধিরা একটি সামরিক সরকার গঠন করবেন এবং সকলের গ্রহণযোগ্য একটি সংবিধান রচনা করবেন। প্রস্তাব অনুমোদনের পর গান্ধী দৃঢ় কন্ঠে ঘোষণা করেন, 'করেঙ্গে ইয়ে মরেঙ্গে' । অর্থাৎ দেশ স্বাধীন করব, না হয় মৃত্যুবরণ করব । গান্ধীর এই উদাত্ত আহ্বানের সঙ্গে সঙ্গেই ভারত ছাড় আন্দোলনের সূচনা হয়। ১৯৪২ সালের ভারত ছাড় আন্দোলনের রণধ্বনি ছিল 'করেঙ্গা ইয়ে মরেঙ্গে'। সারাজীবন কুসুম কোমল আন্দোলন করা ও বৃটিশদের প্রতি পূর্ণ আনুগত্য রেখে অধিকার আদায়ের কথা বলা গান্ধী হুট করেই জাপানের জোরে খুবই সহিংস হয়ে উঠলেন। সারা ভারতে কংগ্রেস কর্মীদের দিয়ে জ্বালাও পোড়াও আন্দোলন শুরু করলেন। 

ব্রিটিশ সরকার ১৯৪২ সালের ৯ই আগস্ট গান্ধীকে গ্রেফতার করে। এরপর একে একে সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল, জওহরলাল নেহরু, আবুল কালাম আজাদ, জে. বি. কৃপালনী সমেত বহু প্রথম সারির নেতা গ্রেপ্তার হন। ব্রিটিশ সরকার কংগ্রেসকে বেআইনি সংগঠন রূপে ঘোষণা করে। সারা হিন্দুস্তানে কংগ্রেস কর্মীদের গ্রেপ্তার করে কারারুদ্ধ করা হয়। সরকারি দমন নীতির প্রতিবাদে দেশের আপামর জনসাধারণ ভারত ছাড় আন্দোলনে অংশ গ্রহণ করে। 

দেশব্যাপী ধর্মঘট, শোভাযাত্রা, মিছিল, মিটিং ইত্যাদি অনুষ্ঠিত হয়। কংগ্রেসের কর্মীরা আন্দোলন সশস্ত্র বিদ্রোহে রূপ দেওয়ার চেষ্টা করে। রেললাইন ধ্বংস, স্কুল-কলেজ বর্জন, বিভিন্ন অফিস-আদালতে অগ্নি-সংযোগ, ট্রেন ও টেলিফোন সংযোগ বিছিন্নকরণ থানা, ডাকঘর, রেজিস্ট্রি অফিস, রেলস্টেশন দখল ইত্যাদি কর্মসূচি চলতে থাকে।

ভারত ছাড় আন্দোলনের প্রধান কেন্দ্রগুলি ছিল মহারাষ্ট্রের সাতারা, মেদিনীপুরের তমলুক, কাঁথি, দিনাজপুরের বালুরঘাট, উত্তরপ্রদেশের বালিয়া, আজমগড়, আসামের নওগাঁ, ওড়িশার তালচের, বালাশোর ইত্যাদি । বিশিষ্ট নেতাদের মধ্যে সাতারার শ্রীনাথ লালা, নানা পাতিল, বালিয়ার চৈতু পান্ডে, সরযূ পান্ডে, তমলুকের মাতঙ্গিনী হাজরা, সুশীল ধাড়া, পাঞ্জাবের গৃহবধু ভোগেশ্বরী ফকোননি, আসামের স্কুলছাত্রী কনকলতা বড়ুয়া অন্যতম । এছাড়া অরুণা আসিফ আলি, সুচেতা কৃপালিনী, জয়প্রকাশ নারায়ণ, আচার্য নরেন্দ্রদেব, রামমনোহর লোহিয়া, যোগেশ চ্যাটার্জি, উষা মেহেতা, অচ্যুত পট্টবর্ধন, অজয় মুখার্জি প্রমুখ উল্লেখযোগ্য । 

জাপানের জোরে গান্ধী এতোটাই অন্ধ হয়ে গিয়েছিলেন যে, তিনি ভারত ছাড় আন্দোলনকে আন্দোলন শুরু করার আগেই বৃটিশদের বিরুদ্ধে প্রকাশ্য বিদ্রোহ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। তার এই ঘোষণা ইংরেজদের আগেই সচেতন করে তোলে এবং কংগ্রেস নিষিদ্ধ সংগঠন হিসেবে ঘোষণা করে। সারা দেশে আন্দোলনের শুরুতেই দমননীতি চালাতে উদ্বুদ্ধ করে। অবশেষে মাত্র চার মাসে আন্দোলন পুরো নিয়ন্ত্রণে চলে আসে বৃটিশ সরকারের। 

মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ ভারত ছাড় আন্দোলনকে গৃহযুদ্ধের ঘোষণা আখ্যা দিয়ে এধরণের হটকারি সিদ্ধান্ত থেকে দূরে থাকার আহ্বান জানান। জনগণের নিরাপত্তা ও ব্রিটিশদের দমননীতি থামাতে তিনি কংগ্রেসকে এই আন্দোলন থামানোর আহ্বান জানান। তিনি আরো বলেন, বৃটিশ সরকারের বিরুদ্ধে কংগ্রেসের এই বিদ্রোহ প্রকৃতপক্ষে মুসলিম লীগ ও অন্যান্য অকংগ্রেসী সংগঠনগুলোর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা। ১৯৪২ এর ডিসেম্বরে ভারত ছাড় আন্দোলন বন্ধ হয়ে যায়। 

যেসব কারণে ভারত ছাড় আন্দোলন ব্যর্থ হয়
১. আন্দোলনের শুরুতেই কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব গ্রেফতার হয়ে যাওয়া এবং সারাদেশে কংগ্রেসের বিরুদ্ধে বৃটিশদের কঠিন দমননীতি। 

২. আন্দোলনের সঠিক পরিকল্পনা ও রূপরেখা না থাকা এবং স্থানীয় নেতৃত্ব আত্মগোপনে চলে যাওয়া। 

৩. কংগ্রেস এই আন্দোলনে অন্য কোন রাজনৈতিক সংগঠনকে সাথে তো রাখেনি অধিকন্তু অন্যান্য দলের করা বিভিন্ন সময়ের সমঝোতা ও চুক্তি বাতিল করেছে। তাদের চিন্তা ছিলো জাপানের আক্রমণে ব্রিটিশরা পিছু হটলে তারাই হবে ভারতের একমাত্র ক্ষমতার দাবীদার। তাই আন্দোলন চলাকালে অন্যান্য রাজনৈতিক দলকে পাশে তো পায়নি উল্টো বিরোধীতার সম্মুখীন হয়েছে। 

৪. গান্ধীর উস্কানীতে আন্দোলন শুরু থেকে সহিংস আকার ধারণ করেছে। শিক্ষালয়, রেললাইন, ডাক ব্যবস্থা ইত্যাদির ব্যাপক ক্ষতিসাধন করে আন্দোলনকারীরা। ফলে জনসাধারণ এই আন্দোলনের বিপক্ষে চলা যায়। 

৫. যাদের ওপর আস্থা করে এই আন্দোলনের সূতপাত সেই জাপানীরা বাংলা দখল করতে ব্যর্থ হওয়া। জাপানিদের টার্গেট ছিলো কোলকাতা বন্দর দিয়ে ভারত আক্রমণ করে তারা ভারতে প্রবেশ করবে। কিন্তু তারা তা করতে ব্যর্থ হয়।