২৫ আগ, ২০২০

বঙ্গকথা পর্ব-৪৯ : অবশেষে পাকিস্তান ঘোষিত হলো



১৯৪৬ সালে ভারতীয় সংবিধান সভার প্রতিনিধি নির্বাচন হয়। এই সভার প্রতিনিধি ছিলেন ২৯৬ জন। ৯টি আসন ব্যতীত সকল সাধারণ আসনে কংগ্রেস জয়ী হয় এবং ৫টি আসন ছাড়া বাকী সকল মুসলিম আসনে মুসলিম লীগ জয়ী হয়। সংবিধান সভার প্রথম অধিবেশন ৯ই ডিসেম্বর ১৯৪৬ হওয়ার কথা। কিন্তু মুসলিম লীগ এতে অংশগ্রহণে অস্বীকৃতি জানায়। এমনকি একে বৈধ বলে স্বীকার করতে রাজি হচ্ছিল না যতক্ষণ না মুসলিমদের জন্য আলাদা ভূমি আলাদা রাষ্ট্র কংগ্রেস মেনে না নিচ্ছে। কারণ গত দশ বছরের কংগ্রেসের আচরণে মুসলিমরা একথা পরিষ্কার বুঝতে পেরেছিলো ইংরেজদের অধীনে থাকার চেয়েও খারাপ পরিণতি হবে মুশরিকদের অধীনে থাকা। মুসলিমদের আলাদা ভূমি মেনে নেয়ার জন্য ভাইসরয় কংগ্রেসকে অনুরোধ করেন। 

এ অনুরোধের পুরস্কার এভাবে দেওয়া হলো যে গান্ধী ও নেহরু ভাইসরয়কে অপসারণের জন্যে বৃটিশ সরকারের নিকটে তারবার্তা ও পত্র প্রেরণ করেন। উপায়ান্তর না দেখে ভাইসরয় কেবিনেট মিশন পরিকল্পনার অধীন সংবিধান সভায় যোগদানের জন্য ২০ শে নভেম্বর মুসলিম লীগকে আমন্ত্রণ জানান। সংগে সংগেই জিন্নাহ এটাকে মারাত্মক ধরনের ভুল পদক্ষেপ বলে আখ্যায়িত করেন। তিনি বলেন, ভাইসরয় ভয়ংকর পরিস্থিতি ও তার বাস্তবতা উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হন এবং কংগ্রেসকে খুশী করার চেষ্টা করছেন। ৯ই ডিসেম্বর সংবিধান সভার অধিবেশনে কোন লীগ প্রতিনিধি যোগদান করেন নি।

এরূপ পরিস্থিতিতে শেষ চেষ্টা করার উদ্দেশ্যে বৃটিশ সরকার দুজন কংগ্রেস এবং দুজন লীগ নেতাকে লন্ডন আমন্ত্রণ জানান। ভাইসরয়ের পরামর্শক্রমে একজন শিখ প্রতিনিধিকেও আমন্ত্রণ জানান হয়। লর্ড ওয়াভেল নেহরু, জিন্নাহ, লিয়াকত আলী, এবং বলদেব সিংসহ লন্ডন যাত্রা করেন। চারদিন যাবত আলাপ আলোচনা চলে। তবে সমাধানে পৌঁছা সম্ভব হয়নি। চরম রাজনৈতিক অচলাবস্থা সৃষ্টি হয়।

কোনো আপোস মীমাংসা না হওয়ায় বৃটিশ সরকার এক বিবৃতি প্রকাশ করেন। বিবৃতির শেষ অনুচ্ছেদে বলা হয়, সর্বসম্মত কার্যধারার ভিত্তিতে কোন সিদ্ধান্ত ব্যতীত সংবিধান সভার সাফল্য আশা করা যায় না। সংবিধান সভা যদি এমন কোন সংবিধান রচনা করে যার রচনাকালে ভারতবাসীর বিরাট সংখ্যক লোকের কোন প্রতিনিধিত্ব নেই, তাহলে বৃটিশ সরকার এ ধরনের কোন সংবিধান অনিচ্ছুক জনগোষ্ঠীর উপর বলপূর্বক চাপিয়ে দিতে পারেনা।

নেহরু ও বলদেব সিং সংবিধান সভার অধিবেশনে অংশগ্রহণ করার উদ্দেশ্যে ভারতে প্রত্যাবর্তন করেন। জিন্নাহ ও লিয়াকত আলী আরও কিছুদিন যুক্তরাজ্যে অবস্থান করেন। লন্ডনে এক সাংবাদিক সম্মেলনে জিন্নাহ বলেন, //পাকিস্তানের জনসংখ্যা পৃথিবীর যে কোন রাষ্ট্রের জনসংখ্যা অপেক্ষা অধিক। আমরা ভারতের তিন চুতর্থাংশের উপর কংগ্রেসের নিয়ন্ত্রণ মেনে নিচ্ছি। পাকিস্তান মেনে নিতে কংগ্রেসের আপত্তি এ জন্যে যে তারা সমগ্র ভারত চায়। তাহলে আমরা আর থাকি কোথায়? এখন সমস্যা এই যে, বৃটিশ সরকার কি তাদের বেয়নেটের বলে হিন্দুসংখ্যাগরিষ্ঠের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে চান? তা যদি হয় তাহলে বলবো, তোমরা তোমাদের মানসম্ভ্রম, ন্যায়পরায়নতা ও সুবিচার ও সভ্য আচরনের সর্বশেষ কণাটুকুও হারিয়ে ফেলেছ।// 

এদিকে ভারতে কংগ্রেস তীব্র কণ্ঠে ঘোষণা করে, মুসলিম লীগ সংবিধান সভায় যোগদান না করলে তাদেরকে অন্তবর্তী সরকার থেকে বহিষ্কার করা হোক, অপরদিকে বৃটিশ সরকারের ৬ ডিসেম্বরের ঘোষণা অদূর ভবিষ্যতে এক নতুন রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের ইংগিত বহন করে। এসময় সারা ভারতে কংগ্রেসী মুশরিকদের দাঙ্গায় জর্জরিত হচ্ছে ভারত। পরের বছর ১৩ ফেব্রুয়ারি নেহরু ভাইসরয়কে লিখিত পত্র দ্বারা মুসলিম লীগকে বহিস্কারের দাবি জানান। ১৫ই ফেব্রুয়ারী প্যাটেল ব্রিটিশ সরকারকে হুমকি দিয়ে বলেন, মুসলিম লীগকে সরকার থেকে বহিষ্কার না করলে কংগ্রেস অন্তর্বর্তী সরকার থেকে পদত্যাগ করবে। 

রাজনৈতিক জটিল পরিস্থিতিতে ২০ ফেব্রুয়ারি ১৯৪৭ প্রধানমন্ত্রী এটলী একটি বিবৃতি প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, এ ধরনের অনিশ্চিত পরিস্থিতি আর দীর্ঘায়িত হতে দেওয়া যায় না। বৃটিশ সরকার পরিষ্কার বলে দিতে চান যে, জুন মাসের ভেতরেই দায়িত্বশীল ভারতীয়দের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ সরকার গ্রহণ করবে। পূর্ণ প্রতিনিধিত্বশীল সংবিধান সভা কর্তৃক সর্বসম্মত শাসনতন্ত্র এ সময়ের মধ্যে প্রণীত না হলে, সরকার বিবেচনা করবে বৃটিশ ভারতে ক্ষমতা কার কাছে যথাসময়ে হস্তান্তর করা হবে। বিবৃতির শেষে এ কথাও ঘোষণা করা হয় যে ওয়াভেলের স্থলে মাউন্টব্যাটেনকে ভাইসরয় করা হচ্ছে।

চারদিন পর ভারত সচিব হাউস অব লর্ডস –এ ঘোষণা করেন যে, এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল ভারতের দায়িত্বশীল মহলের পরামর্শে। আর উদ্দেশ্য ছিল একটি চাপ সৃষ্টি করা যাতে ভারতীয় দলগুলো একটা সমঝোতায় পৌঁছে। এখানে ভারতের দায়িত্বশীল মহল বলতে যে গান্ধী আর নেহরুকে বুঝানো হয়েছে এবং সমঝোতা বলতে কংগ্রেসের দাবী মুসলিম লীগকে মেনে নেয়া বুঝানো হয়েছে তা বুঝতে কারো কষ্ট হওয়ার কথা নয়।

মাউন্টব্যাটেন ইংল্যান্ড থেকে সযত্নে ও সাবধানতা সহকারে তার সহযোগী বেছে নিয়ে এসেছিলেন। তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন লর্ড ইসমে যিনি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে চার্চিলের ব্যক্তিগত সাধারণ উপদেষ্টা ছিলেন। আরও ছিলেন এরিক সিভিল, লর্ড উইনিংডনের প্রাক্তন প্রাইভেট সেক্রেটারী এবং ৬ষ্ঠ জর্জের এসিস্ট্যান্ট প্রাইভেট সেক্রেটারি, এ দুজন ছিলেন ভাইসরয়ের সাধারণ ও বেসামরিক দিকের প্রধান উপদেষ্টা এবং লর্ড ইসমে ছিলেন চীফ অব স্টাফ। 

ভপ্পালা পাঙ্গুনি মেনন ছিলেন সাংবিধানিক পরামর্শদাতা। প্রায়ই স্টাফের বৈঠক অনুষ্ঠিত হতো। প্রথমত মাঝে মাঝে মেননকে বৈঠকে ডাকা হতো। পরে প্রত্যেক বৈঠকে তাকে ডাকা হতো। ভাইসরয় এবং অন্যান্য সকলের জানা ছিল যে মেনন ছিলেন কংগ্রেস নেতা বল্লভভাই প্যাটেলের অত্যন্ত বিশ্বস্ত লোক। এর ফলে ভাইসরয়ের কাউন্সিলের আভ্যন্তরীণ সকল গোপন তথ্যই শুধু প্যাটেল জানতেন না, বরঞ্চ তার এ মুখপাত্রকে দিয়ে তিনি ভাইসরয়ের পলিসি প্রভাবিত করতেন। মেননের স্থলে যদি কোন মুসলমান হতেন এবং তিনি জিন্নাহর সাথে যোগাযোগ রক্ষা করে চলতেন, তাহলে কি কংগ্রেস তাকে বরদাশত করতে পারতো? 

কেবিটেন মিশন পরিকল্পনার ভিত্তিতে অখন্ড ভারতের জন্য সর্বসম্মত সমাধান প্রচেষ্টার উদ্দেশ্যে মাউন্টব্যাটেনকে ভারতে ভাইসরয় নিযুক্ত করা হয়েছিল। কিন্তু ভারতে পৌঁছার পর ঘটনা প্রবাহ এবং রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের বিপরীতমুখী দৃষ্টিভংগী লক্ষ্য করার পর সর্বসম্মত সমাধান এবং অখন্ড ভারতের কোনো সম্ভাবনা দেখা যায় না। অতএব প্রধানমন্ত্রীর ২০ ফেব্রুয়ারীর ঘোষণাকে কেন্দ্র করেই পরিকল্পনা তৈরীর প্রতি ভাইসরয় মনোনিবেশ করেন।

তিনি তার পরামর্শদাতাগণের সাথে পরামর্শের পর ক্ষমতা হস্তান্তরের একটি পরিকল্পনা তৈরি করেন। ১ এপ্রিল ইসমে পরিকল্পনার খসড়া মেননকে দেন তার সংশোধনীসহ সময়সূচী তৈরীর জন্য। মেনন আদেশ পালন করেন এবং সেই সাথে তার অভিমত ব্যক্ত করে বলেন, এ একটি মন্দ পরিকল্পনা এবং এ কার্যকর হবে না। গভর্নরদের সম্মেলনে চূড়ান্ত পরিকল্পনা পেশ করা হয় এবং তা অনুমোদিত হয়। ২ মে লর্ড ইসমে এবং জর্জ এবেল হোয়াইট হলের অনুমোদনের জন্য পরিকল্পনাটি নিয়ে লন্ডনে যান। ভাইসরয় আশা করছিলেন ১০ মে'র ভেতরে অনুমোদন পেয়ে যাবেন এবং ১৭ মে দলীয় নেতাদের প্রতিক্রিয়া জানার জন্য একত্রে মিলিত হওয়ার আবেদন জানাবেন।

অতঃপর মাউন্টব্যাটেন এরিক সিভিল ও মেননসহ শিমলা গমন করেন। এখানে মেনন ভাইসরয়ের সাথে নিরিবিল কথা বলার সুযোগ পান এবং লন্ডনে প্রেরিত পরিকল্পনার বিরুদ্ধে যুক্তি প্রদর্শন করে বলেন, এ পরিকল্পনা কার্যকর হবেনা। মেননের সকল যুক্তি শুনার পূর্বে হঠাৎ নেহরু এবং ভি.কে. কৃষ্ণ মেনন ভাইসরয়ের সাথে আলোচনা করার জন্য ৮ই মে শিমলা পৌঁছেন। ঐদিনই লন্ডন থেকে কিছু সংশোধনীসহ অনুমোদিত পরিকল্পনা ভাইসরের হাতে আসে। ডিনারের পর ভাইসরয় নেহরুকে ডেকে পরিকল্পনাটি দেখান যা অনুমোদিত হয়ে এসেছে। পরিকল্পনাটি পড়ার পর নেহেরু ভয়ানক রেগে গিয়ে বলেন, আমি, কংগ্রেস এবং ভারত কারো কছেই এ পরিকল্পনা গ্রহণযোগ্য নয়। 

লর্ড মাউন্টব্যাটেন উভয়পক্ষকে খুশি রাখতে চেয়েছিলেন এবং উভয়পক্ষকে বুঝিয়েছিলেন যে পাকিস্তানের সৃষ্টি না হয়ে উপায় নেই। মাউন্টব্যাটেন কংগ্রেসের সিনিয়র নেতাদের মনে পাকিস্তান সৃষ্টির বীজ বপন করার চেষ্টা করেছিলেন। আর ভারতীয় নেতাদের মধ্যে সরদার প্যাটেল মাউন্টব্যাটেনের এ ধারণা সবার আগে গ্রহণ করেছিলেন। ভারতবর্ষ ভাগ করার জন্য প্যাটেল আগে থেকেই মানসিকভাবে অর্ধেক তৈরি ছিলেন। প্যাটেল ধরে নিয়েছিলেন, মুসলিম লীগের সাথে একত্রে কাজ করা যাবে না।

কংগ্রেস নেতা মাওলানা আবুল কালাম আজাদ বলেন, সরদার প্যাটেল এক পর্যায়ে জনসম্মুখে বলেই ফেললেন, মুসলিম লীগের হাত থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য তিনি ভারতবর্ষ ভাগ করতেও রাজী আছেন। এ কথা বলা অত্যুক্তি হবে না যে সরদার প্যাটেলই ছিলেন ভারতবর্ষ ভাগের স্থপতি।

ভারতবর্ষ বিভক্ত করার ফর্মুলা বিষয়ে সরদার প্যাটেল মনস্থির করার পর লর্ড মাউন্টব্যাটেন মনোযোগ দিয়েছিলেন জওহরলাল নেহেরুর দিকে। এ ধরনের ফর্মুলার কথা শুনে প্রথমে নেহেরু খুবই রাগান্বিত হন।কিন্তু লর্ড মাউন্টব্যাটেন জওহরলাল নেহেরুকে ভারতবর্ষ ভাগ করার বিষয়ে ক্রমাগত বোঝাতে থাকেন। এ বিষয়ে মি: নেহেরুর রাগ প্রশমিত না হওয়া পর্যন্ত মাউন্টব্যাটেন তাঁর তৎপরতা চালিয়ে গেছেন।

কিন্তু ভারত ভাগ করার বিষয়ে জওহরলাল নেহেরু শেষ পর্যন্ত কীভাবে রাজী হলেন?

মাওলানা আবুল কালাম আজাদ মনে করেন, এর দুটি কারণ আছে।
প্রথমত; জওহরলাল নেহেরুকে রাজী করানোর বিষয়ে লর্ড মাউন্টব্যাটেনের স্ত্রীর একটি বড় প্রভাব ছিল। লেডি মাউন্টব্যাটেন ছিলেন খুবই বুদ্ধিমতী। এছাড়া তার মধ্যে আকর্ষণীয় এবং বন্ধুত্বপূর্ণ কিছু বিষয় ছিল যার মাধ্যমে সে অন্যদের আকৃষ্ট করতে পারতো। লেডি মাউন্টব্যাটেন তার স্বামীকে খুব শ্রদ্ধা করতেন এবং অনেক সময় যারা প্রথমে তার স্বামীর কাজের সাথে একমত হতে পারতেন না, তাদের কাছে স্বামীর চিন্তা-ভাবনা পৌঁছে দিয়ে তাদের সম্মতি আদায় করতেন।

দ্বিতীয়ত ভারত ভাগ করার পেছনে নেহেরুর রাজী হবার আরেকটি কারণ ছিলেন কৃষ্ণ মেনন। এ ভারতীয় ব্যক্তি ১৯২০'র দশক থেকে লন্ডনে বসবাস করতেন। কৃষ্ণ মেনন ছিলেন জওহরলাল নেহেরুর একজন বড় ভক্ত এবং নেহেরুও কৃষ্ণ মেননকে খুবই পছন্দ করতেন। লর্ড মাউন্টব্যাটেন বুঝতে পেরেছিলেন যে ভারত ভাগ করার বিষয়ে কৃষ্ণ মেননের মাধ্যমে নেহেরুকে রাজী করানো যাবে এবং সেটাই হয়েছে।

সরদার প্যাটেলের দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে মৌলানা আজাদ তাঁর বইতে লিখেছেন, " আমরা পছন্দ করি কিংবা না করি, ভারতবর্ষে দুটো জাতি আছে। হিন্দু এবং মুসলমানরা একজাতি হিসেবে ঐক্যবদ্ধ হতে পারে না। যখন দুই ভাই একসাথে থাকতে পারে না, তখন তারা আলাদা হয়ে যায়। তাদের পাওনা নিয়ে আলাদা হয়ে যাবার পরে তারা আবার বন্ধু হয়ে যায়। কিন্তু তাদের যদি একসাথে থাকতে বাধ্য করা হয় তাহলে তারা প্রতিদিন ঝগড়া করবে।প্রতিদিন মারামারি করার চেয়ে একবার বড় ঝগড়া করে আলাদা হয়ে যাওয়াটাই ভালো।"

ভারত ভাগ করার বিষয়ে সরদার প্যাটেল যেভাবে প্রকাশ্যে কথা বলতেন, জওহরলাল নেহেরু সেভাবে বলতেন না। কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকারের নির্বাহী পরিষদে মুসলিম লীগের সাথে একত্রে কাজ করতে গিয়ে নেহেরুর তিক্ত অভিজ্ঞতা হয়েছিল। তাদের মধ্যে প্রতিদিনই ঝগড়া হতো। সেজন্য জওহরলাল নেহেরু মৌলানা আজাদকে বলেছিলেন ভারতবর্ষ ভাগ না করে কোন উপায় নেই। একপর্যায়ে নেহেরু মাওলানা আজাদকে অনুরোধ করলেন, তিনি যাতে ভারত ভাগের বিরোধিতা না করেন এবং বাস্তবতা মেনে নেন।

এক পর্যায়ে ব্রিটিশ সরকারের সাথে আলোচনার জন্য লর্ড মাউন্টব্যাটেন লন্ডন চলে যান। ১৯৪৭ সালের ৩০ মে লর্ড মাউন্টব্যাটেন ভারতবর্ষে ফিরে আসেন। ২ জুন তিনি কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের নেতাদের সাথে বৈঠক করেন। বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন নেহেরু, প্যাটেল, কৃপালনী, জিন্নাহ, লিয়াকত আলী খান, আবদুর রব নিশতার এবং বলদেব সিং। সেখানে তার পরের দিন ৩ জুন মাউন্টব্যাটেন ব্রিটিশ সরকারের পরিকল্পনা সম্বলিত 'হোয়াইট পেপার' বা 'শ্বেতপত্র' প্রকাশ করেন। সেখানে ভারতবর্ষ বিভক্তির রূপরেখা তুলে ধরা হয়।

পাকিস্তান ঘোষণা :
৩ জুনের পরিকল্পনাটি মাউন্টব্যাটেন পরিকল্পনা নামেও পরিচিত ছিল। ব্রিটিশ সরকার ৩রা জুন, ১৯৪৭ সালে ঘোষণা করা একটি পরিকল্পনা প্রস্তাব করেছিল, যার মধ্যে এই নীতিগুলি অন্তর্ভুক্ত ছিল:

৩ জুনের গুরুত্বপূর্ণ ঘোষণা :
১- ব্রিটিশ ভারতের দুটি নতুন অধিরাজ্য ভারত এবং পাকিস্তানের বিভাগ ১৯৪৭ সালের ১৫ ই আগস্ট থেকে কার্যকর হবে।
২- দুটি নতুন দেশের মধ্যে বেঙ্গল এবং পাঞ্জাব প্রদেশ দুটির বিভক্তকরণ হবে।
৩- দুটি নতুন দেশের প্রত্যেকটিতে গভর্নর-জেনারেলের অফিস স্থাপন করা হবে রাণীর প্রতিনিধি হিসাবে।
৪- নতুন দুটি দেশের সম্পর্কিত সংবিধান সভার উপর সম্পূর্ণ আইনসভার কর্তৃত্ব প্রদান।
৫- ১৯৪৭ সালের ১৫ই আগস্ট থেকে কার্যকরভাবে দেশীয় রাজ্য গুলোর ওপর থেকে ব্রিটিশ আধিরাজ্যের অবসান, এবং স্বতন্ত্র থাকার বা উভয় অধিরাজ্যকে স্বীকার করার রাষ্ট্রের অধিকারকে স্বীকৃতি প্রদান।
৬- দুটি নতুন দেশের মধ্যে বিশেষত সশস্ত্র বাহিনীর বিভাজন সহ যৌথ সম্পত্তি ইত্যাদির বিভাজন হবে।

পাকিস্তানে যে অঞ্চলগুলো থাকবে : 
পূর্ববঙ্গ, পশ্চিম পাঞ্জাব, সিন্ধু এবং বালুচিস্তান প্রদেশ। উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ (এখন পাখতুনখোয়া)র ভাগ্য গণভোটের ফলাফল সাপেক্ষে।

বাংলা ও আসাম :
ভারত সরকার আইন ১৯৩৫ এর অধীন গঠিত বাংলা প্রদেশটির অস্তিত্ব আর থাকবেনা। এর পরিবর্তে দুটি নতুন প্রদেশ গঠন করা হবে, যথাক্রমে পূর্ববঙ্গ এবং পশ্চিমবঙ্গ। আসাম প্রদেশের সিলেট জেলার ভাগ্য নির্ধারণ করা হবে গণভোটে।

২৩ আগ, ২০২০

আল্লাহ মুহাম্মদ সা. কে যেভাবে মহাবিজয় দান করেছেন

 

একবার আমাদের প্রিয় নবী সা. স্বপ্ন দেখছিলেন! তিনি দেখলেন তার সঙ্গী-সাথীদের নিয়ে মদীনা থেকে মক্কায় চলে গেলেন এবং সেখানে উমরা পালন করলেন। নবীর স্বপ্ন নিছক একটি স্বপ্ন নয় বরং সেটিও একধরনের ওহী। আল্লাহই তাকে এ স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন। এটা ৬ষ্ঠ হিজরির ঘটনা। তখন এমন অবস্থা ছিল না যে মহানবী চাইলেই মক্কায় যেতে পারেন। মক্কা থেকে মদিনায় হিজরত করে আসার পর থেকেই মক্কার সাথে শুরু হলো একের পর এক যুদ্ধ। সেখানে উমরার চিন্তাই দুঃসাধ্য। 

কুরাইশরা ছয় বছর যাবত মুসলমানদের জন্য বায়তুল্লাহর পথ বন্ধ করে রেখেছিল এবং এ পুরো সময়টাতে তারা হজ্জ ও উমরাহ আদায়ের জন্য পর্যন্ত কোন মুসলমানকে হারাম এলাকার ধারে কাছে ঘেঁষতে দেয়নি। এখন উমরার জন্য ইহরাম বেঁধে যুদ্ধের সাজ সরঞ্জাম সাথে নিয়ে বের হওয়ার অর্থ যুদ্ধ ডেকে আনা এবং নিরস্ত্র হয়ে যাওয়ার অর্থ নিজেদের জীবনকে বিপন্ন করা। এ পরিস্থিতিতে স্বপ্নের আদেশ কীভাবে বাস্তবায়ন করবেন তা নিয়ে বিচলিত হয়ে পড়লেন মহানবী সা.। 

রাসূল সা. তার স্বপ্নের কথা দ্বিধাহীন চিত্তে সাহাবীদের বললেন এবং সফরের প্রস্তুতি শুরু করে দিলেন। আশপাশের গোত্রসমূহের মধ্যেও ব্যাপকভাবে ঘোষণা করলেন, আমরা উমরা আদায়ের জন্য যাচ্ছি। যারা আমাদের সাথে যেতে ইচ্ছুক তারা যেন এসে দলে যোগ দেয়। বাহ্যিক কার্যকরণসমূহের ওপর যাদের দৃষ্টি নিবদ্ধ ছিল তারা মনে করলো এরা মৃত্যুর মুখে ঝাঁপ দিতে যাচ্ছে। তাদের কেউই তার সাথে যেতে প্রস্তুত হলো না। কিন্তু যারা সত্যি সত্যিই আল্লাহ ও তার রসূলের প্রতি ঈমান পোষণ করতো পরিণাম সম্পর্কে তারা কোন পরোয়াই করেছিলো না। তাদের জন্য এটাই যথেষ্ট ছিল যে, এটা আল্লাহ তা’আলার ইংগিত এবং তাঁর রাসূল সা. এ নির্দেশ পালনের জন্য প্রস্তুত হয়েছেন। নবীর সা.-এর সাথে এ বিপজ্জনক সফরে যেতে ১৪শ সাহাবী প্রস্তুত হলেন।

৬ষ্ঠ হিজরীর জিলকদ মাসের শুরুতে মহানবী সা. তাঁর দল নিয়ে মদিনা থেকে যাত্রা করলেন। সাথে কুরবানির জন্য ৭০ টি উট ছাড়া যুদ্ধের আর কোন উপকরণ সঙ্গে নিলেন না। এভাবে তাঁদের কাফেলা লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক, ধ্বনি তুলে বায়তুল্লাহ অভিমুখে যাত্রা করলো। বি’রে আলীতে এসে ইহরাম বাঁধলেন। মদীনার হাজীগণ এখান থেকেই হজ্জ ও উমরার ইহরাম বেঁধে থাকেন।

গত বছরই ৫ম হিজরির শাওয়াল মাসে কুরাইশরা বিভিন্ন আরব গোত্রের সম্মিলিত শক্তি নিয়ে মদীনার ওপর চড়াও হয়েছিল যার কারণে খন্দকের যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল। কুরাইশদের সাথে শত্রুতা তখনো চরমে। তাই রসূলুল্লাহ সা. যখন এত বড় একটা কাফেলা নিয়ে শত্রুর এলাকার দিকে যাত্রা করলেন তখন স্বাভাবিকভাবেই গোটা আরবের দৃষ্টি এ বিস্ময়কর সফরের প্রতি নিবদ্ধ হলো। তারা এও খেয়াল করলো যে, এ কাফেলা লড়াই করার জন্য যাত্রা করেনি বরং পবিত্র মাসে ইহরাম বেঁধে কুরবানীর উট সাথে নিয়ে প্রায় নিরস্ত্র অবস্থায় বাইতুল্লাহ তাওয়াফের জন্য যাচ্ছে।

নবী সা. এ পদক্ষেপ কুরাইশদেরকে মারাত্মক দ্বিধায় ফেলে দিল। যে পবিত্র মাসগুলোকে শত শত বছর ধরে আরবে হজ্জ ও বায়তুল্লাহর যিয়ারতের জন্য পবিত্র মনে করা হতো জিলকদ মাসটি ছিল তার অন্যতম। যে কাফেলা এ পবিত্র মাসে ইহরাম বেঁধে হজ্জ অথবা উমরার জন্য যাত্রা করেছে তাকে বাধা দেয়ার অধিকার কারো ছিল না। এমনকি কোন গোত্রের সাথে যদি তার শত্রুতা থেকে থাকে তবুও আরবের সর্বজন স্বীকৃত আইন অনুসারে সে তাকে তার এলাকা দিয়ে অতিক্রম করতেও বাধা দিতে পারে না। কুরাইশরা দ্বিধান্বিত হয়ে পড়লো যে, যদি তারা মদিনার এ কাফেলার ওপর হামলা করে মক্কা প্রবেশ করতে বাধা দেয় তাহলে গোটা দেশে হৈ চৈ শুরু হয়ে যাবে। আরবের প্রতিটি মানুষ বলতে শুরু করবে এটা বাড়াবাড়ি ছাড়া আর কিছুই নয়। 

প্রতিটি গোত্রই এ ভেবে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়বে যে ভবিষ্যতে কাউকে হজ্জ ও উমরা করতে দেয়া না দেয়া কুরাইশদের মর্জির ওপর নির্ভরশীল। আজ যেমন মদীনার জিয়ারতকারীদের বাধা দেওয়া হচ্ছে তেমনি যাদের প্রতিই তারা অসন্তুষ্ট হবে ভবিষ্যতে তাদেরকেই বাইতুল্লার জিয়ারত করতে বাধা দেবে। এটা হবে কুরাইশদের এমন একটা ভুল যার কারণে সমগ্র আরব তাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী হয়ে উঠার সম্ভাবনা রয়েছে। অপরদিকে তারা যদি মুহাম্মাদ সা.কে এত বড় কাফেলা নিয়ে নির্বিঘ্নে তাদের শহরে প্রবেশ করতে দেয় তাহলে গোটা দেশের সামনেই তাদের প্রভাব প্রতিপত্তি বিনষ্ট হবে। লোকজন বলবে, কুরাইশরা মুহাম্মাদ সা.-এর ভয়ে ভীত হয়ে পড়েছে। শেষ পর্যন্ত অনেক চিন্তা-ভাবনা ও বিচার-বিবেচনার পর তাদের জাহেলী আবেগ ও মানসিকতাই তাদের ওপর প্রভাব বিস্তার করলো এবং তারা নিজেদের মুখ রক্ষার জন্য যে কোন মূল্যে এ কাফেলাকে শহরে প্রবেশ করতে না দেয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলো।

এদিকে মুহাম্মদ সা. এক ব্যক্তিকে গুপ্তচর হিসেবে পাঠিয়েছেন যাতে সে যথাসময়ে তাঁকে কুরাইশদের পরিকল্পনা সম্পর্কে অবহিত করতে পারে। গুপ্তচর জানায় কুরাইশরা মুসলিমদের গতি রোধ করার জন্য খালিদ ইবনে ওয়ালিদকে দুই শত অশ্বারোহীসহ অগ্রগামী বাহিনী হিসেবে পাঠিয়ে দিয়েছে। কুরাইশদের পরিকল্পনা ছিল কোনো না কোনো উপায়ে নবী সা.-এর কাফেলাকে উত্যক্ত করে উত্তেজিত করা এবং তার পরে যুদ্ধ সংঘটিত হলে গোটা আরবে একথা প্রচার করে দেওয়া যে, উমরা আদায়ের বাহানা করে এরা প্রকৃতপক্ষে যুদ্ধ করার জন্যই এসেছিলো এবং শুধু ধোঁকা দেয়ার জন্যই ইহরাম বেঁধেছিল।

এ খবর পাওয়ামাত্র মহানবী সা. রাস্তা পরিবর্তন করলেন এবং ভীষণ কষ্ট স্বীকার করে অত্যন্ত দুর্গম একটি পথ ধরে হারাম শরীফের একেবারে প্রান্ত সীমায় অবস্থিত হুদাইবিয়ায়  গিয়ে পৌঁছলেন। এখানে খুযআ গোত্রের নেতা বুদায়েল ইবনে ওয়ারকা তার গোত্রের কতিপয় লোককে সাথে নিয়ে নবী সা.-এর কাছে আসলো এবং তাঁকে জিজ্ঞেস করলো, আপনি কি উদ্দেশ্যে এখানে এসেছেন? 

নবী সা. বললেন, “আমরা কারো বিরুদ্ধে লড়াই করতে আসিনি। আমাদের উদ্দেশ্য শুধু বাইতুল্লাহর জিয়ারত ও তাওয়াফ। তারা গিয়ে কুরাইশ নেতাদের একথাটিই জানিয়ে দিল । তারা তাদেরকে এ পরামর্শও দিল যে, তারা যেন হারামের জিয়ারতকারীদের পথরোধ না করে। কিন্তু তারা তাদের জিদ বজায় রাখলো এবং নবীকে ( সা) ফিরে যেতে রাজি করানোর জন্য আহাবিশদের নেতা হুলাইস ইবনে আলকামাকে তাঁর কাছে পাঠালো। কুরাইশ নেতাদের উদ্দেশ্য ছিলো, মহানবী সা. তার কথা না মানলে সে অসন্তুষ্ট হয়ে ফিরে আসবে এবং এভাবে আহাবিশদের শক্তি তাদের পক্ষে থাকবে। 

কিন্তু হুলাইস এসে যখন দেখলো, গোটা কাফেলা ইহরাম বেঁধে কুরবানির উটগুলোর সামনে দাঁড়িয়ে আছে এবং এ মানুষগুলো লড়াই করার জন্য নয় বরং বায়তুল্লাহর তাওয়াফ করার জন্য এসেছে তখন সে মুহাম্মদ সা.-এর সাথে কোন কথাবার্তা না বলেই মক্কায় ফিরে গিয়ে কুরাইশ নেতাদের স্পষ্ট বলে দিল যে, তারা বায়তুল্লাহর মর্যাদার স্বীকৃতি দিয়ে তা যিয়ারত করতে এসেছে। তোমরা যদি তাদের বাধা দাও তাহলে আহাবিশরা কখনো তোমাদের সহযোগিতা করবে না। 

অতঃপর কুরাইশদের পক্ষ থেকে মাসউদ সাকাফী আসলো এবং সেও নিজের পক্ষ থেকে মুহাম্মদ সা.-কে ভালো-মন্দ সব দিক বুঝিয়ে তাঁকে মক্কায় প্রবেশ করার সংকল্প থেকে বিরত রাখতে চাইলো। মুহাম্মদ সা. বনী খুযআ গোত্রের নেতাকে যে জওয়াব দিয়েছিলেন তাকেও একই জওয়াব দিলেন। অর্থাৎ আমরা লড়াই করার উদ্দেশ্যে আসিনি, বাইতুল্লাহর মর্যাদা প্রদর্শনকারী হিসেবে একটি ধর্মীয় কর্তব্য পালন করার জন্য এসেছি। 

দূতদের আসা যাওয়া ও আলাপ-আলোচনা চলাকালে কুরাইশরা গোপনে নবী সা.-এর সেনা শিবিরে আকস্মিক হামলা চালিয়েছে। তাদের উদ্দেশ্য ছিল মুসলিমদের উত্তেজিত করা এবং যুদ্ধের অজুহাত কাজে লাগিয়ে মহানবীকে ঠেকানো যায়। কিন্তু মুসলিমদের ধৈর্য এবং মুহাম্মদ সা.-এর বিচক্ষণতা ও দূরদৃষ্টি তাদের সমস্ত অপেচেষ্টা ব্যর্থ করে দেয়। তাদের চল্লিশ পঞ্চাশজন লোকের একটি দল একদিন রাতে মুসলমানদের তাঁবুর ওপরে পাথর নিক্ষেপ ও তীর বর্ষণ করতে থাকে। মুসলিমরা তাদের সবাইকে বন্দী করে নবী সা.-এর সামনে হাজির করেন। কিন্তু মুহাম্মদ সা. তাদের সবাইকে ছেড়ে দেন। অপর এক ঘটনায় ঠিক ফজর নামাযের সময় তানঈমের দিক থেকে ৮০ ব্যক্তির একটি দল এসে আকস্মিকভাবে হামলা করে বসে। তাদেরকেও বন্দী করা হয়। মুহাম্মদ সা. তাদেরকেও মুক্ত করে দেন। 

অবশেষে মুহাম্মদ সা. নিজের পক্ষ থেকে হযরত উসমান রা.-কে দূত হিসেবে মক্কায় পাঠান এবং তাঁর মাধ্যমে কুরাইশ নেতাদের জানিয়ে দেন যে, আমরা যুদ্ধের উদ্দেশ্যে নয় বরং বাইতুল্লাহ যিয়ারতের উদ্দেশ্যে কুরবানীর পশু সঙ্গে নিয়ে এসেছি। বায়তুল্লাহ তাওয়াফ ও কুরবানী করে ফিরে যাব। কিন্তু এরপরও তারা উমরা করতে দিতে সম্মত হলো না উপরন্তু হযরত উসমানকে রা.-কে মক্কাতে আটক করলো। 

এ সময় তারা এই খবর ছড়ালো যে, হযরত উসমানকে রা.-কে হত্যা করা হয়েছে। তাঁর ফিরে না আসায় মুসলমানরাও নিশ্চিত হয়ে গেলেন যে, খবরটা সত্য। এখন আর সংযম প্রদর্শনের কোনো অবকাশ নেই। মক্কা প্রবেশের ব্যাপারটি ছিল ভিন্ন জিনিস। সে জন্য শক্তি প্রয়োগের কোন চিন্তা আদৌ ছিল না। কিন্তু যখন দূতকে হত্যা করার ঘটনা পর্যন্ত ঘটলো তখন যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হওয়া ছাড়া মুসলমানদের আর কোন উপায় থাকলো না।

মুহাম্মদ সা. তাঁর সমস্ত সাহাবীকে একত্রিত করলে এবং তাদের নিকট থেকে এ মর্মে বাইয়াত গ্রহণ করলেন যে, আমরা এখন এখান থেকে আমৃত্যু পিছু হটবো না। অবস্থার নাজুকতা বিচার করলে যে কেউ উপলব্ধি করবেন যে, এটা কোন মামুলি বাইয়াত ছিল না। মুসলমানদের সংখ্যা ছিল মাত্র ১৪শত। কোন যুদ্ধ সরঞ্জামও তাদের সাথে ছিল না। নিজেদের কেন্দ্র থেকে আড়াই শত মাইল দূরে একেবারে মক্কার সীমান্তে অবস্থান করেছিলেন তারা। সেখানে শত্রু তার পুরো শক্তি নিয়ে আক্রমণ করতে পারতো এবং আশপাশের সহযোগী গোত্রগুলোকে ডেকে এনে তাদের ঘিরে ফেলতে পারতো। এসব সত্ত্বেও সাহাবারা মুহাম্মদ সা.-এর হাতে হাত রেখে জীবনের ঝুঁকি নিতে দ্বিধাহীন চিত্তে প্রস্তুত হয়ে গেল। এটিই ইসলামের ইতিহাসে “বাইয়াতে রিদওয়ান” নামে খ্যাত।

পরে জানা গেল যে, হযরত উসমান রা.-কে হত্যা করার খবর মিথ্যা ছিল। হযরত উসমানকে নিজেও ফিরে আসলেন এবং কুরাইশদের পক্ষ থেকে সন্ধির আলোচনা করার জন্য সুহাইল ইবনে আমরের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দলও নবী সা. শিবিরে এসে পৌঁছলো। দীর্ঘ আলাপ আলোচনার পর যেসব শর্তের ভিত্তিতে সন্ধিপত্র লেখা হলো তা হলো,

(১) মুসালমানগণ এ বছর উমরাহ না করেই মদিনায় ফিরে যাবে।

(২) আগামী বছর উমরার জন্য এসে তারা তিন দিন মক্কায় অবস্থান করতে পারবে এবং তাদের অবস্থানকালে কুরাইশরা মক্কা ত্যাগ করে অন্যত্র চলে যাবে।

(৩) কুরাইশদের এবং মুসলমানদের মধ্যে আগামী দশ বছর যুদ্ধ বন্ধ থাকবে।

(৪) কুরাইশদের কেউ মদীনায় আশ্রয় নিলে তাকে ফেরত দিতে হবে। কিন্তু মদীনার কোন মুসলমান মক্কায় আশ্রয় নিলে, তাকে ফেরত দেওয়া হবে না।

(৫) আরবের যেকোন গোত্রের লোক মুসলমানদের বা কুরাইশদের সাথে সন্ধিসূত্রে আবদ্ধ হতে পারবে।

(৬) মক্কায় ব্যবসায়ীরা নিরাপদে মদীনার পথ ধরে সিরিয়া, মিশর প্রভৃতি দেশে ব্যবসা করতে পারবে।

( ৭) মক্কায় বসবাসকারী মুসলিমদের জান মালের নিরাপত্তা দেওয়া হবে।

(৮) চুক্তিতে স্বাক্ষরকারী পক্ষদ্বয় একে অপরেরে সম্পদকে সম্মান করবে।

(৯) মক্কায় প্রবেশকালে মুসলিমরা বর্শা বা ফলা আনতে পারবে না। আত্মরক্ষার জন্য শুধু কোষবদ্ধ তলোয়ার আনতে পারবে।

যে সময় এ সন্ধির শর্তসমূহ নির্ধারিত হচ্ছিলো তখন মুসলমানদের পুরা বাহিনী অত্যন্ত বিচলিত বোধ করেছিলেন। যে মহৎ উদ্দেশ্য সামনে রেখে মুহাম্মদ সা. এসব শর্ত মেনে নিচ্ছিলেন তা কেউই বুঝে উঠতে পারছিলো না। কুরাইশরা এই চুক্তিকে তাদের সফলতা মনে করেছিলো আর মুসলমানরা বিচলিত হচ্ছিলো এই ভেবে যে, তারা কেন অবমাননাকর শর্তাবলী গ্রহণ করবে? 

এমন কি হযরত উমর রা.-এর মত গভীরদৃষ্টি সম্পন্ন জ্ঞানীজনের অবস্থা ছিল এই যে, তিনি বলেন, ইসলাম গ্রহণের পরে কখনো আমার মনে কোন সন্দেহ-সংশয় সৃষ্টি হয়নি। কিন্তু এ যাত্রায় আমিও তা থেকে রক্ষা পাইনি। তিনি বিচলিত হয়ে হযরত আবু বকর রা.-এর কাছে গিয়ে বললেন, “তিনি কি আল্লাহর রসূল নন? আমরা কি মুসলমান নই? এসব লোক কি মুশরিক নয়? এসব সত্ত্বেও আমরা আমাদের দ্বীনের ব্যাপারে এ অবমাননা মেনে নেব কেন?” 

তিনি জবাব দিলেন, “হে উমর! তিনি আল্লাহর রসূল। আল্লাহ কখনো তাঁকে ধ্বংস করবেন না”। এরপরও তিনি ধৈর্যধারণ করতে পারলেন না। মুহাম্মদ সা.-এর কাছে গিয়ে তাঁকেও এ প্রশ্নগুলো করলেন। পরে হযরত উমর রা. মুহাম্মদ সা.-এর সাথে যে কথাবার্তা বলেছিলেন তার জন্য দীর্ঘদিন পর্যন্ত লজ্জিত ও অনুতপ্ত ছিলেন। তাই তিনি অধিক পরিমাণে দান-খয়রাত এবং নফল নামায আদায় করতেন। যাতে আল্লাহ তা’আলা তাঁকে মাফ করে দেন ।

এ চুক্তির দু’টি শর্ত মুসলিমদের কাছে সবচেয়ে বেশী অসহনীয় ও দুর্বিসহ মনে হচ্ছিলো। প্রথমত যে জিনিসটি মুসলিমদের মনে দ্বিধা-সংশয় সৃষ্টি হচ্ছিলো সেটি ছিল সন্ধির প্রথম শর্ত। মুসলমানগণ মনে করেছিলেন, এটি মেনে নেয়ার অর্থ হচ্ছে গোটা আরবের দৃষ্টিতে আমরা যেন ব্যর্থ হয়ে ফিরে যাচ্ছি। তাছাড়া এ প্রশ্নও মনে সন্দেহ সৃষ্টি করেছিল যে, মুহাম্মদ সা. তো স্বপ্নে দেখেছিলেন, আমরা মক্কায় বায়তুল্লাহ তাওয়াফ করেছি। অথচ এখানে আমরা তাওয়াফ না করেই ফিরে যাওয়ার শর্ত মেনে নিচ্ছি। এর ব্যাখ্যায় মুহাম্মদ সা. বললেন, চুক্তির শর্ত অনুসারে এ বছর যদি না-ও হয় তাহলে আগামী বছর ইনশায়াল্লাহ তাওয়াফ হবে।

দ্বিতীয়ত চার নং শর্ত সম্পর্কে মুসলিমগণ হতাশ হয়ে পড়েছিলেন। এটি সম্পর্কে তাদের বক্তব্য হলো এটি অসম শর্ত। মক্কা থেকে পালিয়ে আসা লোকদের যদি আমরা ফিরিয়ে দেই তাহলে মদিনা থেকে পালিয়ে যাওয়া লোকদের তারা ফিরিয়ে দেবে না কেন? এর জবাবে মুহাম্মদ সা. বললেন, যে আমাদের এখান থেকে পালিয়ে তাদের কাছে চলে যাবে সে আমাদের কোন কাজে লাগবে? আল্লাহ যেন তাকে আমাদের থেকে দূরেই রাখেন। তবে যে তাদের ওখান থেকে পালিয়ে আমাদের কাছে চলে আসবে তাকে যদি আমরা ফিরিয়েও দেই তাহলে তার মুক্তিলাভের অন্য কোন উপায় হয়তো আল্লাহ সৃষ্টি করে দেবেন। 

তাছাড়া একটি ঘটনা মুসলিমদের অন্তরকে কষ্টে জ্বালিয়ে দিচ্ছিল। যখন সন্ধি চুক্তিটি লিপিবদ্ধ করা হচ্ছিলো ঠিক তখন সুহাইল ইবনে আমরের পুত্র আবু জান্দাল কোন প্রকারে পালিয়ে নবীর সা.-এর কাছে গিয়ে হাজির হলেন। তিনি আগেই ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন এবং এই অপরাধে তার পিতা ও মক্কার কাফেররা তাকে বন্দি করে রেখেছিলো। এ সময় তাঁর পায়ে শিকল পরানো ছিল এবং দেহে নির্যাতনের চিহ্ন ছিল। তিনি মুহাম্মদ সা.-এর কাছে আবেদন জানালেন, আমাকে এ অন্যায় বন্দীদশা থেকে মুক্ত করুন। এ করুণ অবস্থা দেখে সাহাবায়ে কিরামের পক্ষে ধৈর্যধারণ করা কঠিন হয়ে পড়লো। কিন্তু তার পিতা সুহাইল ইবনে আমর বললো, চুক্তিপত্র লেখা শেষ না হলেও চুক্তির শর্তাবলী সম্পর্কে আপনার ও আমাদের মধ্যে সিদ্ধান্ত হয়ে গিয়েছে। অতএব এ ছেলেকে আমার হাতে অর্পণ করুন। মুহাম্মদ সা. তার যুক্তি মেনে নিতে বাধ্য হলেন এবং আবু জান্দালকে জালেমদের হাতে তুলে দিলেন।

সন্ধি চুক্তি শেষ করে মুহাম্মদ সা. সাহাবীদের বললেন, এখানেই কুরবানী করে মাথা মুড়ে ফেলো এবং ইহরাম শেষ করো। কিন্তু কেউ-ই তাঁর জায়গা থেকে একটুও নড়লেন না। নবী সা. তিনবার আদেশ দিলেন কিন্তু উমরাহ করতে না পারার কারণে এবং অসম চুক্তিতে স্বাক্ষরের কষ্ট সাহাবীদের ওপর এমন প্রবল প্রভাব বিস্তার করেছিলো যে, তারা যার যার জায়গা হতে একটু নড়াচড়া পর্যন্ত করলেন না। মুহাম্মদ সা. সাহাবাদের আদেশ দিচ্ছেন কিন্তু তারা তা পালনের জন্য তৎপর হচ্ছেন না এমন বিষয় এই একটি ঘটনা ছাড়া নবী সা.-এর গোটা নবুয়্যত জীবনে আর কখনো ঘটেনি। এতে তিনি অত্যন্ত দুঃখ পেলেন। 

মহানবী সা. তাঁর তাঁবুতে গিয়ে উম্মুল মু’মিনীন হযরত উম্মে সালমার কাছে নিজের মনের কষ্টের কথা প্রকাশ করলেন। হযরত উম্মে সালামা বললেন, আপনি চুপচাপ গিয়ে নিজের উট কুরবানি করুন এবং মাথা মুড়ে ফেলুন। তাহলে সবাই স্বতস্ফূর্তভাবে আপনাকে অনুসরণ করবে। উম্মে সালামার কথাই সত্য হলো। সাহাবারা মহানবী সা.-কে এরূপ করতে দেখে সবাই কুরবানি করলো, মাথা মুড়ে কিংবা চুল ছেঁটে নিল এবং ইহরাম থেকে বেরিয়ে আসলো। কিন্তু দুঃখ ও মর্ম যাতনায় তাদের হৃদয় চৌচির হয়ে যাচ্ছিলো।

এরপর মুসলিমরা সবাই মদিনার দিকে যাত্রা শুরু করলো। মক্কা থেকে ২৫ মাইল দূরে যাওয়ার পর আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা ওহী নাজিল করে মুসলিমদের সান্তনা দিয়েছেন। আল্লাহ মুসলমানদের জানিয়ে দেন যে, এ সন্ধিচুক্তি যাকে তারা পরাজয় মনে করেছে তা প্রকৃতপক্ষে বিরাট বিজয়। তিনি সূরা ফাতাহর ১-৩ নং আয়াতে বলেন, 

//হে নবী, আমি তোমাকে সুস্পষ্ট বিজয় দান করেছি। যাতে আল্লাহ তোমার আগের ও পরের সব ক্রটি-বিচ্যুতি মাফ করে দেন, তোমার জন্য তাঁর নিয়ামতকে পূর্ণতা দান করেন। তোমাকে সরল সহজ পথ দেখিয়ে দেন এবং অত্যন্ত বলিষ্ঠভাবে সাহায্য করেন।// 

এ সূরা নাযিল হওয়ার পর মুহাম্মদ সা. মুসলমানদের একত্রিত করে বললেন, আজ আমার ওপর এমন জিনিস নাযিল হয়েছে যা আমার জন্য দুনিয়া ও দুনিয়ার সবকিছুর চেয়েও বেশী মূল্যবান। তারপর তিনি এ সূরা তেলাওয়াত করলে এবং বিশেষভাবে হযরত উমরকে ডেকে তা শুনালেন। কেননা, তিনিই সবচেয়ে বেশি মনোকষ্ট পেয়েছিলেন। 

ঈমানদারগণ যদিও আল্লাহ তা’আলার এ বাণী শুনেই সন্তুষ্ট ও পরিতৃপ্ত হয়েছিলেন। তবুও খুব বেশি সময় যেতে না যেতেই এ চুক্তির সুফলসমূহ এক এক করে প্রকাশ পেতে থাকলো এবং এ চুক্তি যে সত্যিই একটা বিরাট বিজয় সে ব্যাপারে আর কারো মনে কোন সন্দেহ থাকলো না।

১. এ চুক্তির মাধ্যমে আরবে প্রথমবারের মতে ইসলামী রাষ্ট্রের অস্তিত্ব মেনে নেয়া হলো। এর পূর্ব পর্যন্ত আরবদের দৃষ্টিতে মুহাম্মাদ সা. এবং তাঁর সাহাবাদের মর্যাদা ছিল শুধু কুরাইশ ও আরব গোত্রসমূহের বিরুদ্ধে বিদ্রোহকারী একটি গোষ্ঠী হিসেবে তারা তাদের সমাজচ্যুত বলেই মনে করতো। 

২. কুরাইশরা এ যাবত ইসলামকে ধর্মহীনতা বলে আখ্যায়িত করে আসছিলো। কিন্তু মুসলমানদের জন্য বায়তুল্লাহ জিয়ারতের অধিকার মেনে নিয়ে তারা আপনা থেকেই একথাও মেনে নিল যে, ইসলাম কোন ধর্মহীনতা নয় বরং আরবে স্বীকৃতি ধর্মসমূহের একটি এবং অন্যান্য আরবদের মত এ ধর্মের অনুসারীরাও হজ্জ ও উমরার অনুষ্ঠানসমূহ পালনের অধিকার রাখে। কুরাইশদের অপপ্রচারের ফলে আরবের মানুষের মনে ইসলামের বিরুদ্ধে যে ঘৃণার সৃষ্টি হয়েছিলো এতে সে ঘৃণাও অনেকটা হ্রাস পেল।

৩. দশ বছরের জন্য যুদ্ধ বিরতি চুক্তি হওয়ার ফলে মুসলমানগণ নিরাপত্তা ও শান্তি লাভ করলেন। মুসলিমরা গোটা আরবের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে এত দ্রুত ইসলামের প্রচার চালালেন যে, হুদাইবিয়ার সন্ধি পরবর্তী দু’বছর যতো লোক মুসলমান হলো সন্ধি পূর্ববর্তী পুরো ১৯ বছরেও তা হয়নি। সন্ধির সময় যেখানে নবীর সা. সাথে মাত্র ১৪ শত লোক ছিলেন। সেখানে মাত্র দুই বছর পরেই কুরাইশদের চুক্তিভংগের ফলে নবী সা. যখন মক্কায় অভিযান চালান তখন দশ হাজার সৈনিকের এক বিশাল বাহিনী তাঁর সাথে ছিল। এটা ছিল হুদাইবিয়ার সন্ধির সুফল।

৪. কুরাইশদের পক্ষ থেকে যুদ্ধ বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর নবী সা. তাঁর অধিকারভুক্ত এলাকায় ইসলামী সরকারকে সুদৃঢ় করার এবং ইসলামী আইন-কানুন চালু করে মুসলিম সমাজকে একটি পূর্ণাঙ্গ সভ্যতা ও সংস্কৃতি হিসেবে দাঁড় করানোর সুযোগ লাভ করেন। এটিই সেই মহান নিয়ামত যা সম্পর্কে আল্লাহ তা’আলা সূর মায়েদার ৩ নং আয়াতে বলছেন, “আজ আমি তোমাদের দ্বীনকে তোমাদের জন্য পূর্ণাঙ্গ করে দিলাম, তোমাদের জন্য আমার নিয়ামতকে পরিপূর্ণ করলাম এবং তোমাদের দীন হিসেবে ইসলামকে গ্রহণ করলাম।“ 

৫. কুরাইশদের সাথে সন্ধি হয়ে যাওয়ার পর দক্ষিণ দিক থেকেও সুফল পাওয়া গেল। মুসলমানগণ উত্তর ও মধ্য আরবের সমস্ত বিরোধী শক্তিকে অতি সহজেই বশীভূত করে নেয়। হুদাইবিয়ার সন্ধির মাত্র তিন মাস পরেই ইহুদীদের সবচেয়ে বড় দুর্গ খায়বার বিজিত হয় এবং তারপর ফাদাক, ওয়াদিউল কুরা, তায়ামা ও তাবুকের মত ইহুদী জনপদেও একের পর এক মুসলমানদের কর্তৃত্বধীনে চলে আসে। তারপর মধ্য আরবের যেসন গোত্র ইহুদী ও কুরাইশদের সাথে গাঁটছড়া বেঁধেছিলো তার সবগুলোই এক এক করে মুসলমানদের শাসনাধীন হয়ে পড়ে। 

৬. সন্ধিচুক্তির যে বিষয়টি মুসলমানদের কাছে সবচেয়ে বেশী অপছন্দনীয় ছিল এবং কুরাইশরা তাদের বড় বিজয় বলে মনে করেছিলো তা হচ্ছে, মক্কা থেকে পালিয়ে মদিনায় আশ্রয় গ্রহণকারীদের ফিরিয়ে দেয়া হবে কিন্তু মদিনা থেকে পালিয়ে মক্কায় গমনকারীদের ফিরিয়ে দেয়া হবে না। কিন্তু অল্প কিছুদিন যেতে না যেতেই এ ব্যাপারটিও কুরাইশদের স্বার্থের পরিপন্থী হয়ে দাঁড়ালো। 

সন্ধির কিছুদিন পরেই মক্কার একজন মুসলমান আবু বাসীর কুরাইশদের বন্দীত্ব থেকে পালিয়ে মদীনায় চলে আসেন। কুরাইশরা তাকে ফেরত দেয়ার দাবী জানালো এবং নবী সা. চুক্তি অনুযায়ী মক্কা থেকে যারা তাকে বন্দী করে নিয়ে যেতে এসেছিলো তাদের কাছে হস্তান্তর করলেন। কিন্তু মক্কা যাওয়ার পথে সে আবার তাদের বন্দীত্ব থেকে নিজেকে মুক্ত করে এবং লোহিত সাগরের যে পথ ধরে কুরাইশদের বাণিজ্য বহর যাতায়াত করতো সে পথের একটি স্থানে গিয়ে আশ্রয় নেয়। এরপর থেকে যে মুসলমানই কুরাইশদের বন্দিত্ব থেকে নিজেকে মুক্ত করার সুযোগ করতে পারতো সে-ই মদীনায় যাওয়ার পরিবর্তে আবু বাসীরের আশ্রয়ে চলে যেত। এভাবে সেখানে ৭০ জনের সমাবেশ ঘটে এবং তারা কুরাইশদের কাফেলার ওপর বারবার অতর্কিতে আক্রমণ চালিয়ে তাদের অবস্থা শোচনীয় করে তোলে। অবশেষে তাদেরকে মদীনায় নিয়ে যাওয়ার জন্য কুরাইশরা নিজেরাই নবী সা.-এর কাছে আহবান জানায়। এভাবে হুদায়বিয়ার চুক্তির ঐ শর্তটি আপনা থেকেই রহিত হয়ে যায়। 

যে সন্ধি চুক্তিকে মুসলমানগণ তাদের ব্যর্থতা আর কুরাইশরা তাদের সফলতা মনে করেছিলো সে সন্ধিচুক্তি থেকেই তারা এসব সুফল ও কল্যাণ লাভ করে। হুদাইবিয়ার এই সন্ধিচুক্তিই ছিল মূলত মক্কা বিজয়ের সবচেয়ে কার্যকরী পদক্ষেপ।

১৬ আগ, ২০২০

মুজিব খুনের পর তার মন্ত্রীদের প্রতিক্রিয়া কেমন ছিল?


মুজিব খুনের পর তার রাজনৈতিক বিরোধীরা উল্লাস করেছিল। তারা সারা দেশে আনন্দ মিছিল বের করেছিল। এমন একটি একটি ঘটনা ঘটবে তারা কল্পনাও করতে পারেনি। তবে এমন একটি ঘটনা ঘটুক এটা তারা কামনা করতো। তার প্রতিফল দেশ দেখেছে। 

সেনাবাহিনীর প্রতিক্রিয়া ছিল এমন, আচ্ছা হইসে! একটা প্রেসিডেন্ট মরছে। আরেকটা আসবে। এইতো। এটা নিয়ে এতো মাতামাতি করার দরকার কী? 

মুজিবের পোষা মিডিয়ার ভূমিকা তো কালকেই উল্লেখ করলাম। আজকে দেখি তার মন্ত্রীসভার সদস্যদের কেমন ভূমিকা ছিল? 

বলা চলে মুজিবের মন্ত্রীরাই মুজিব থেকে সবচেয়ে বেশি সুবিধাপ্রাপ্ত। কিন্তু এই গোষ্ঠীই অত্যন্ত হাস্যোজ্জল মুখে আবার মুশতাকের মন্ত্রীসভায় অংশগ্রহণ করে। আর মুশতাক তো সেই ব্যক্তি ১৯৭৩ সালে যার নির্বাচনী এলাকার ব্যালট বাক্স সব হেলিকপ্টারে তুলে নিয়ে এসে মুজিব নিজেই মুশতাককে জয়ী ঘোষণা করেন। 

একজন মানুষ যখন স্বৈরাচার হয়ে যায় তখন তার মধ্যে ন্যায় অন্যায় বোধ থাকে না। যারা তার তোষামোদ করে তাদেরই কেবল ভালো হিসেবে দেখে। মুজিবের হয়েছে এই দশা। মুজিবের লাশের দাফন তখনো হয় নি। অথচ মুজিবের একেবারে কাছের লোকেরাই আরেকটি মন্ত্রীসভা গঠন করেছে। সমস্ত করাপ্ট লোক ছিল তার পাশে কারণ তার করাপ্ট কাজগুলো এই লোকগুলোই বাস্তবায়ন করতো।

এই লোকগুলোর মধ্যে মোশতাকের মন্ত্রীসভাতে মুজিবসহ যোগ দিতে পারে নাই ৭ জন। মুজিব বাদ দিলে ৬ জন, এর মধ্যে একজন সেরনিয়াবাত মুজিবের সাথে খুন হন। বাকী রইলো ৫ জন। এর মধ্যে একজন কামাল হোসেন, পররাষ্ট্রমন্ত্রী। তিনি বিদেশে ছিলেন। তিনি দেশে থাকলে যে মন্ত্রীসভায় এটেইন করতো তা একপ্রকার বুঝাই যায়। 

লন্ডনে থাকা আওয়ামীপন্থী কিছু মানুষ কামাল হোসেনকে হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে সংবাদ সম্মেলন করতে বললে তিনি তা সরাসরি অস্বীকার করেন। বাকী রইলো ৪ জন, তারা হলো 

 সৈয়দ নজরুল ইসলাম- উপরাষ্ট্রপতি

মো. মনসুর আলী- প্রধানমন্ত্রী

এএইচ এম কামরুজ্জামান- শিল্প মন্ত্রী

আব্দুস সামাদ আজাদ- কৃষি মন্ত্রী


এরা মন্ত্রীসভায় যোগ দেয়নি এটা সরাসরি ঠিক হবে না। তবে তাদের কাছে মন্ত্রী হবার প্রস্তাব যায় নি। মুজিবের হত্যাকারীরা এই চারজনসহ তাজউদ্দিনকে পছন্দ করতেন না। তারা হয়তো এই কজনকে মুজিবের আপন চ্যালা মনে করতেন। তাজউদ্দিনসহ এই চারজন এরেস্ট হন এবং আজাদ বাদে বাকীরা খুন হন। তাজউদ্দিনকে আগেই মুজিব মন্ত্রীসভা থেকে বের করে দিয়েছে কারণ সে যতটা মুজিবের মন্ত্রী তার চাইতে বেশি ইন্দিরার প্রতিনিধি।

এবার আসুন তাদের নাম জেনে নিই যারা একইসাথে মুজিবের ও মোশতাকের মন্ত্রীসভাতে ছিলেন। এমন সংখ্যা ২৩ জন। 

১. খন্দকার মোশতাক আহমেদ- রাষ্ট্রপতি

২. মোহাম্মদ উল্লাহ- উপরাষ্ট্রপতি

৩. অধ্যাপক ইউসুফ আলী- মন্ত্রী, পরিকল্পনা 

৪. শ্রী ফণী ভূষণ মজুমদার- মন্ত্রী, এলজিআরডি

৫. মো. সোহরাব হোসেন- মন্ত্রী, পূর্ত, গৃহনির্মাণ

৬. আব্দুল মান্নান- স্বাস্থ্য, পরিবার পরিকল্পনা মন্ত্রী

৭. শ্রী মনোরঞ্জন ধর- আইন, বিচার, সংসদ মন্ত্রী

৮. আব্দুল মোমিন তালুকদার- মন্ত্রী, কৃষি দফতর, খাদ্য

৯. আসাদুজ্জামান খান- মন্ত্রী, বন্দর ও জাহাজ চলাচল

১০. ড. আজিজুর রহমান মল্লিক- অর্থমন্ত্রী

১১. ড. মুজাফফর আহমদ চৌধুরী- শিক্ষামন্ত্রী

১২. বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী- মন্ত্রী, পররাষ্ট্র দফতর

১৩. শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন- প্রতিমন্ত্রী, বিমান ও পর্যটন

১৪. তাহের উদ্দিন ঠাকুর- প্রতিমন্ত্রী, তথ্য, বেতার, শ্রম

১৫. কে এম ওবায়দুর রহমান— প্রতিমন্ত্রী, ডাক ও তার

১৬. নুরুল ইসলাম মঞ্জুর- প্রতিমন্ত্রী, রেল ও যোগাযোগ মন্ত্রণালয়

১৭. দেওয়ান ফরিদ গাজী- প্রতিমন্ত্রী, বাণিজ্য, খনিজ সম্পদ

১৮. অধ্যাপক নুরুল ইসলাম চৌধুরী- প্রতিমন্ত্রী, শিল্প মন্ত্রণালয়

১৯. রিয়াজ উদ্দিন আহমদ- প্রতিমন্ত্রী, বন, মৎস্য ও পশুপালন

২০. মোসলেম উদ্দিন খান- প্রতিমন্ত্রী, পাট মন্ত্রণালয়

২১. মোমেন উদ্দিন আহমেদ- প্রতিমন্ত্রী, বন্যা, পানি বিদ্যুত

২২. ডা. ক্ষিতিশ চন্দ্র মন্ডল- প্রতিমন্ত্রী, সাহায্য ও পুনর্বাসন

২৩. সৈয়দ আলতাফ হোসেন- প্রতিমন্ত্রী, সড়ক যোগাযোগ। 


এর বাইরে মুজিব সরকারের ডেপুটি স্পিকার আব্দুল মালেককে স্পিকার মনোনীত করেন খন্দকার মোশতাক আর কথিত মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক আতাউল গনি ওসমানীকে মন্ত্রীর মর্যাদায় নিরাপত্তা উপদেষ্টা পদে নিয়োগ দেন মোশতাক।

শেখ মুজিবের হত্যাকারী সে নিজেই। সেই এই ঘটনার যুগপৎ পরিকল্পনাকারী ও শিকার। যে ত্রাস ও সন্ত্রাসের রাজত্ব সে কায়েম করেছিলো তার জন্য এই পরিণতি যথার্থ ছিলো। 


হিসাব করে দেখুন যারা হত্যাকারী তারা কেউ আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়নি। তারা আবারো আওয়ামীলীগকেই ক্ষমতায় বসিয়েছে। শুধু ১০-১২ জন নেতাকে টার্গেট করে সরিয়ে দিয়েছে। আর সন্ত্রাসী মুজিবের প্রতি এতোটাই ক্ষুব্দ ছিল যে তার পুরো পরিবারকে উড়িয়ে দিয়েছে। একটা লোক কতটুকু অযোগ্য হলে এতোগুলা গাদ্দার নিয়ে মন্ত্রীসভা গঠন করে! 

আরো ইন্টারেস্টিং বিষয় হলো এই খুনী চক্রকে সাথে রেখেই রাজনীতি করেছেন মুজিব খুনের সবচেয়ে বেশি বেনিফিশিয়ারি শেখ হাসিনা।

মোহাম্মদ উল্লাহকে ১৯৭৩ সালে রাষ্ট্রপতি করেছিলেন শেখ মুজিব। তার স্বাক্ষরের মধ্য দিয়ে প্রবর্তন হয়েছিল বাকশাল ব্যবস্থা। বাকশাল ব্যবস্থার অধীনে বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্রপতি হলে মোহাম্মদ উল্লাহকে বাকশাল সরকারের ভূমিমন্ত্রী হিসেবে নিজের মন্ত্রিসভায় স্থান দেন মুজিব। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পরপরই খন্দকার মোশতাকের সরকারে যোগ দেন তিনি। মোশতাক তাকে উপরাষ্ট্রপতি করেন। তিনি জিয়ার সরকারেও মন্ত্রী ছিলেন। তিনি ১৯৯১ সালের নির্বাচনে বিএনপির মনোনয়নে সংসদ সদস্যও নির্বাচিত হন।


১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ডের মাত্র সপ্তাহখানেক আগে ৮ আগস্ট বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীকে বাকশালের মন্ত্রিসভায় স্থান দেওয়া হয়। তাকে এর আগে রাষ্ট্রপতিও বানিয়েছিলেন মুজিব। মুজিব হত্যার পর মোশতাকের মন্ত্রিসভায়ও যোগ দেন তিনি। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পান। মোশতাকের পতনের পর তিনি রাজনীতিতে আর সক্রিয় ছিলেন না। ১৯৮৫ সালে তিনি জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন।


একাত্তরে মুজিবনগর সরকারের ঘোষণাপত্র পাঠ করা অধ্যাপক ইউসুফ আলী বাকশাল সরকারের শ্রম, সমাজ কল্যাণ এবং সংস্কৃতি ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পান। ১৫ আগস্টের পর তিনি আবারও খুশি মনে যোগ দিয়েছেন মোশতাকের সরকারে। দায়িত্ব পান পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের। মোশতাকের পতনের পরে তিনি জিয়ার আমলেও মন্ত্রী হন। এরশাদের আমলেও মন্ত্রী ছিলেন তিনি। পরে তিনি আবারও বিএনপির রাজনীতিতে সক্রিয় হন।


মুজিব সরকারের আইনমন্ত্রী মনোরঞ্জন ধরও (ময়মনসিংহ) আইনমন্ত্রী হিসেবে মোশতাকের মন্ত্রিসভায় যোগ দেন। তবে মোশতাকের পতনের পর ১৯৭৮ সালে তিনি আওয়ামী লীগে ফিরে আসেন।


মুজিবের মন্ত্রিসভা থেকে তাজউদ্দীন পদচ্যুত হলে অর্থমন্ত্রী হন শিক্ষাবিদ অধ্যাপক ড. আজিজুর রহমান মল্লিক। তিনি বাকশাল সরকারেও অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব পান। অন্যদের মতো অধ্যাপক মল্লিকও মোশতাকের মন্ত্রিসভায় যোগ দিয়ে একই মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পান। অবশ্য মোশতাকের পতনের পর তিনি ফের শিক্ষকতা পেশায় ফিরে যান, যোগ দেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে।


স্বাধীন বাংলাদেশে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ভিসি ড. মোজাফ্ফর আহমদ চৌধুরীকে বাকশাল সরকারে শিক্ষামন্ত্রীর দায়িত্ব দেন মুজিব। শিক্ষাবিদ মোজফ্ফর আহমদ চৌধুরীও মোশতাকের মন্ত্রিসভার সদস্য হিসেবে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পান। মোশতাকের পতনের পর শিক্ষকতা পেশায় ফিরে আসেন। তিনি ১৯৭৮ সালে মারা যান।


মুজিবের মন্ত্রিসভার প্রবীণ সদস্য এলজিআরডি মন্ত্রী ফণী ভূষণ মজুমদার (মাদারীপুর) মোশতাকের মন্ত্রিসভায়ও একই মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পান। মোশতাকের পতনের পর তিনি ১৯৭৮ সালে ফের আওয়ামী লীগে ফিরে আসেন। এর আগে তিনি ১৯৭৭ সালে গ্রেফতারও হন। তিনি ১৯৭৯ সালে আওয়ামী লীগের হয়ে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। তিনি দলের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য নির্বাচিত হন।


মুজিব সরকারের স্বাস্থ্যমন্ত্রী আবদুল মান্নান (টাঙ্গাইল) মোশতাকের মন্ত্রিসভায় যোগ দেন। দায়িত্ব পান স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের। মোশতাকের পরে তিনি ১৯৭৮ সালে আওয়ামী লীগে ফেরত আসেন। ১৯৯৬ সালে তিনি আওয়ামী লীগের টিকিটে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ২০০২ সাল পর্যন্ত আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ছিলেন। তিনি ২০০৫ সালে মারা যান।


সোহরাব হোসেন (মাগুরা) ছিলেন মুজিব সরকারের পূর্ত মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী। মোশতাকের মন্ত্রিসভায়ও তিনি একই মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পান। মোশতাক সরকারের পতনের পরে তিনি আওয়ামী লীগে যোগ দেন। ১৯৭৯ সালে সংসদ নির্বাচনে অংশ নিয়ে পরাজিত হন। ১৯৯৮ সালে তিনি মারা যান।


মুজিব সরকারের খাদ্য ও পুনর্বাসন মন্ত্রী আবদুল মোমিন (নেত্রকোনা) মোশতাকের খাদ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব পান। তিনি ১৯৭৮ সালে আওয়ামী লীগে ফেরত আসেন। ২০০২ সাল পর্যন্ত আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ছিলেন। ১৯৯৬ ও ২০০১ সালের নির্বাচনে তিনি আওয়ামী লীগের মনোনয়নে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।


আসাদুজ্জামান খান (কিশোরগঞ্জ) ছিলেন মুজিব মন্ত্রিসভার পাট মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী। তিনিও যোগ দেন বাকশালের মন্ত্রিসভায়। পান নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব। মোশতাকের পতনের পর তিনি ফিরে আসেন আওয়ামী লীগে। ১৯৭৯ সালে তিনি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। জাতীয় সংসদে বিরোধীদলীয় নেতাও নির্বাচিত হন। ১৯৯২ সালে তিনি মারা যান।


বাকশাল সরকারের ডাক, তার ও টেলিযোযোগ প্রতিমন্ত্রী সাবেক ছাত্রলীগ নেতা কে এম ওবায়দুর রহমান (ফরিদপুর) মোশতাকের মন্ত্রিসভায় যোগ দিয়ে একই মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পান। মোশতাকের পতনের পর তিনি জিয়ার মন্ত্রিসভায় যোগ দেন এবং বিএনপির রাজনীতি শুরু করেন। তিনি খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিএনপির মন্ত্রিসভারও সদস্য হয়েছিলেন। জেল হত্যা মামলায় তিনি গ্রেফতার হয়েছিলেন। পরে মামলায় খালাস পান।


দেওয়ান ফরিদ গাজী (সিলেট)  বাকশালের অভ্যন্তরীণ বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী ছিলেন। মোশতাকের মন্ত্রিসভায়ও তিনি একই পদ মর্যাদা পান। পরে তিনি আওয়ামী লীগে ফেরত আসেন। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি দলের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য ছিলেন। এ সময় তিনি একাধিকবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।


মুজিবের শাসনকালে জাতীয় সংসদের চিফ হুইফ ছিলেন সাবেক ছাত্রলীগ নেতা শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন (মুন্সীগঞ্জ)। মোশতাকের মন্ত্রিসভায় প্রতিমন্ত্রী হিসেবে ভূমি ও বিমান মন্ত্রকের দায়িত্ব পান। পরবর্তী সময় এরশাদ সরকারের মন্ত্রী হন। সর্বশেষ তিনি বিএনপিতে যোগ দেন। জেল হত্যা মামলার আসামি শাহ মোয়াজ্জেম খালাস পান।


অধ্যাপক নুরুল ইসলাম চৌধুরী (চট্টগ্রাম) ছিলেন বাকশালের শিল্প ও প্রতিরক্ষা প্রতিমন্ত্রী। মোশতাকের প্রতিমন্ত্রী হিসেবে একই মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পান তিনি। জেল হত্যা মামলায় আসামি ছিলেন। তিনিও বেকসুর খালাস পান।


তাহের উদ্দিন ঠাকুর (ব্রাহ্মণবাড়িয়া) বাকশালের তথ্য ও বেতার প্রতিমন্ত্রী ছিলেন। মোশতাকের মন্ত্রিসভায়ও একই মর্যাদা ও মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পান। পরে তিনি জিয়া ও এরশাদ সরকারের সুবিধাভোগী ছিলেন। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার সঙ্গে তাহের ঠাকুরের  সম্পৃক্ততা ছিল। জেল হত্যা মামলায় তিনি গ্রেফতার হয়েছিলেন। তাহের ঠাকুর এ মামলা থেকে খালাস পান।


মোসলেমউদ্দিন খান হাবু মিয়া (মানিকগঞ্জ) বাকশালের পাট প্রতিমন্ত্রী নিযুক্ত হন। মোশতাকের মন্ত্রিসভায়ও পাট প্রতিমন্ত্রী হন। মোশতাকের পতনের পর ১৯৭৮ সালে আওয়ামী লীগে ফিরে আসেন। পরবর্তী সময় মানিকগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন।


বাকশালের রেল ও যোগোযোগ প্রতিমন্ত্রী ছিলেন নুরুল ইসলাম মঞ্জুর (পিরোজপুর)। অবশ্য বাকশাল সরকার গঠনের ছয় মাসের মাথায় ১৯৭৫ সালের ২১ জুলাই তাকে মন্ত্রিসভা থেকে অপসারণ করা হয়। খন্দকার মোশতাক তার মন্ত্রিসভায় মঞ্জুরকে জায়গা দেন। দায়িত্ব পান একই মন্ত্রণালয়ের। পরবর্তী সময়ে তিনি বিএনপির রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হন। জিয়া সরকারে মন্ত্রীর দায়িত্ব পান। তিনি ১৯৯৬ সালেও বিএনপির প্রার্থী হিসেবে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।


মঞ্জুরের অপসারণের পর সৈয়দ আলতাফ হোসেনকে (কুষ্টিয়া) রেল প্রতিমন্ত্রী করেন মুজিব। ন্যাপ নেতা আলতাফ বাকশাল গঠনের সময় দলের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বাকশালে যোগ দিয়ে কেন্দ্রীয় কমিটির নেতা হন। অন্যদের মতো আলতাফ হোসেনও যোগ দেন মোশতাকের মন্ত্রিসভায়। দায়িত্ব পান একই মন্ত্রণালয়ের। মোশতাকের পতনের পর তিনি ন্যাপে ফিরে আসেন। মোজাফফর ন্যাপের একাংশের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন।


বাকশালের সাহায্য ও পুনর্বাসন প্রতিমন্ত্রী ছিলেন ডা. ক্ষীতিশ চন্দ্র মণ্ডল (পিরোজপুর)। তিনি মোশতাকের মন্ত্রিসভায়ও একই মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী হন। ১৯৭৮ সালে আওয়ামী লীগে ফেরত এবং পরবর্তী সময় জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত। পরে ডা. ক্ষিতিশ জাতীয় পার্টিতে যোগ দিয়ে মন্ত্রী হন।


বাকশালের বন, মৎস্য ও পশুপালন প্রতিমন্ত্রী রিয়াজউদ্দিন আহমদ ভোলা মিয়া (রংপুর) মোশতাক সরকারের একই মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী হন। মোশতাকের পতনের পর ভোলা মিয়া বিএনপি হয়ে জাতীয় পার্টিতে যোগ দিয়ে মন্ত্রী হন।


মোশতাকের মন্ত্রসভায় একমাত্র নতুন সদস্য হিসেবে যুক্ত হন মোমিন উদ্দিন আহমদ (খুলনা)। প্রতিমন্ত্রী হিসেবে তিনি পান যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের। পরে তিনি বিএনপি হয়ে জাতীয় পার্টিতে যোগ দেন। এরশাদ সরকারের শিক্ষামন্ত্রীর দায়িত্বও পালন করেন।


মুজিব বাকশাল গঠনের সিদ্ধান্ত নিলে এর প্রতিবাদ জানান মুক্তিবাহিনীর সর্বাধিনায়কের দায়িত্ব পালন করা জেনারেল এম এ জি ওসমানী। প্রতিবাদে জাতীয় সংসদ সদস্যের পদ থেকে পদত্যাগ করেন তিনি। তিনি মোশতাকের নিরাপত্তা উপদেষ্টার পদ গ্রহণ করেন।


খন্দকার মোশতাক সরকারের পক্ষে আন্তর্জাতিক সমর্থন আদায়ে মহিউদ্দীন আহমদ বিশেষ দূত হন। মোশতাকের পতনের পরে মহিউদ্দীন আহমদ আওয়ামী লীগে ফিরে আসেন। ১৯৮৩ সালের ৮ আগস্ট তিনি দল থেকে  বহিষ্কার হলে বাকশাল গঠন করে তার চেয়ারম্যান হন। ১৯৯৩ সালে বাকশাল আওয়ামী লীগে অন্তর্ভুক্ত হলে তাকে প্রেসিডিয়াম সদস্য করা হয়।


মোশতাক ক্ষমতায় এসে আগের জাতীয় সংসদই বহাল রেখেছিলেন। স্পিকার ছিলেন আবদুল মালেক উকিল। স্পিকার হিসেবে বিদেশে স্পিকারদের একটি সম্মেলনেও যোগ দেন তিনি। পরে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে সক্রিয় হন। মালেক উকিল আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিলেন শেখ হাসিনা নেতৃত্বে আসার আগ পর্যন্ত।


বকশাল সরকারের সময় সংসদে হুইপ ছিলেন আবদুর রউফ (নীলফামারী)। ওই সরকারের চিফ হুইপ শাহ মোয়াজ্জেম হোসেনকে মোশতাক প্রতিমন্ত্রী করার পর শূন্য হওয়া চিফ হুইপের পদে আবদুর রউফকে নিয়োগ দেওয়া হয়। পরে অন্যদের মত আবদুর রউফও আওয়ামী লীগে ফিরে আসেন। তিনি ১৯৮৬ ও ১৯৯১ সালে আওয়ামী লীগের মনোনয়নে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। তবে পরে তিনি ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বাধীন গণফোরামে যুক্ত হন। তিনি গণফোরামের সভাপতিমণ্ডলির সদস্য থাকা অবস্থায় ২০১১ সালে মৃত্যু বরণ করেন।


মুজিবের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. কামাল হোসেন ১৫ আগস্টের আগে সরকারি কাজে বিদেশ সফরে ছিলেন। হত্যার খবর পাওয়ার পর তিনি দেশে আসতে অস্বীকৃতি জানান। মুজিবের জীবিত দুই কন্যার একজন তখন ড. কামাল হোসেনকে লন্ডনে মোশতাক সরকারের বিরুদ্ধে সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করতে বললেও তখন তা করেননি ড. কামাল। অবশ্য দেশে ফিরে তিনি আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হন। দলের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য হন। ১৯৯১ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের পরাজয়ের পরে বিতর্কে জড়িয়ে পড়েন তিনি। পরে দল ত্যাগ করে নিজেই নতুন দল গঠন করেন। বর্তমানে তিনি গণফোরামের সভাপতি।


বাকশাল সরকারের কৃষি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে ছিলেন আবদুস সামাদ আজাদ (সিলেট)। তিনি মোশতাকের সরকারে যোগ দিতে অস্বীকৃতি জানান। যার কারণে আওয়ামী লীগের অন্য নেতাদের মতো তাকেও কারাগারে যেতে হয়। ১৯৭৮ সালে মুক্তি পাওয়ার পরই তিনি আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে সক্রিয় হন। পরে তিনি আওয়ামী লীগের মনোনয়নে একাধিকবার এমপি নির্বাচিত হন। ১৯৯৬ সালে তিনি পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। ২০০৫ সালের ২৭ এপ্রিল ঢাকায় তার মৃত্যু হয়। 

১৩ আগ, ২০২০

বঙ্গকথা পর্ব-৪৮ : ১৯৪৬ সালে কংগ্রেসের দাঙ্গা রাজনীতি

গোলাম সরওয়ার হুসেইনীর বাড়ি ও দরগাহ



সুলতানি ও নবাবি শাসনের পর ইংরেজ শাসনের শুরু থেকেই ভারত বরাবরই ধর্মীয় সহিংসতার দেশ হিসেবে পরিচিতি পায়। মুসলিম সম্ভ্রান্ত আলেম ও জমিদারদের হটিয়ে ইংরেজ ও হিন্দুরা মিলে এদেশের মুসলিমদের নিশ্চিহ্ন করার মিশনে নেমে পড়ে। কোম্পানী শাসনের অবসান হয়ে যখন ইংরেজদের সরাসরি শাসন শুরু হয় তখন সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা কিছটা হ্রাস পায়। 

আবার ১৯০৫ সালে যখন প্রশাসনিক প্রয়োজনে ইংরেজরা বাংলা ভেঙে দুইটি প্রদেশে ভাগ করার পর থেকে আবারো দাঙ্গা হিন্দুস্থানে নিয়মিত ঘটনা হয়ে পড়ে। হিন্দুরা বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয় এর একটাই কারণ, আর তা হলো বঙ্গভঙ্গের কারণে ঢাকা বাংলার আরেকটি রাজধানী হবে এবং এতে মুসলিমরা উপকৃত হবে। এরপর হিন্দু প্রভাবাধীন কংগ্রেস এমন সাম্প্রদায়িক আচরন শুরু করে যে, মুসলিমদের আলাদা রাজনৈতিক দল প্রতিষ্ঠা করতে হয়েছে। একের পর এক হিন্দুদের অমানবিকতা, চুক্তি ভঙ্গ ও হটকারিতার ফলশ্রুতিতে মুসলিমরা হিন্দুস্থানে একইসাথে থাকার ব্যাপারে আস্থা হারিয়ে ফেলে।    

মুসলিমদের প্রাণের দাবী হয়ে ওঠে পাকিস্তান রাষ্ট্র। এর দাবীতে মুসলিম লীগ নানান ঘাত প্রতিঘাতের মধ্যে এগিয়ে যায়। ১৯৪৬ সালে ক্যাবিনেট মিশন যখন মুসলিম লীগের সাথে প্রতারণা করে তখন মুসলিম লীগ পাকিস্তানের দাবীতে ১৬ আগস্ট ডাইরেক্ট অ্যাকশন ডে পালন করে। এই দিবসের কর্মসূচী ছিল তারা রাষ্ট্রকে সহায়তা করবে না; অফিস আদালত, দোকান-পাট বন্ধ রাখবে। 

তৎকালীন কংগ্রেস সভাপতি মাওলানা আবুল কালাম আযাদকে সামনে রেখে কংগ্রেস নেতৃবৃন্দ সেদিন যেসব অঞ্চলে মুসলিমরা ডাইরেক্ট অ্যাকশন ডে পালন করেছিল সেসব অঞ্চলে উগ্রবাদী হিন্দুদের উস্কে দিয়েছিল। এর ফলে হিন্দুরা মুসলিমদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। সবচেয়ে ভয়ংকর অবস্থা হয় কলকাতায়। অথচ কলকাতায় প্রাদেশিক শাসনভার ছিল মুসলিম লীগের হাতে। মুসলিম লীগ সরকার সেদিন বাংলায় সাধারণ ছুটি ঘোষণা করে। 

আগস্টের ১৬ তারিখ শুরু হয়েছিল এ দাঙ্গা। দিনটি ছিল বসন্তকালের অত্যন্ত উত্তপ্ত ও কষ্টকর দিন। সেদিন কলকাতায় মুসলমানরা তাদের বিরাট সমাবেশে যখন নেতাদের বক্তব্য শুনছিল, তখনই শুরু হয় এ গণহত্যা। হিন্দুরা আক্রমণ করে সেই সমাবেশে। হিন্দু ও মুসলমানরা ধারালো ছুরি নিয়ে একে অপরের মুখোমুখি দাঁড়ায়। কলকাতায় মুসলমানদের হত্যার খবর পূর্ববাংলা সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। এতে বিভিন্ন স্থানে দাঙ্গা তৈরি হয়। এর কিছুদিন পর সেপ্টেম্বরে বিহার, উত্তর প্রদেশ ও পাঞ্জাবে দাঙ্গা শুরু হয়। এরপর অক্টোবরে নোয়াখালীতে দাঙ্গা শুরু হয়।

কলকাতার এ ভয়ঙ্কর নরহত্যা ও ধ্বংসকাণ্ডের বিবরণ দিয়ে স্টিফেনস লিখেছেন, শ্যামপুর ও এর পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে মানুষের মৃতদেহের স্তূপ নিকটবর্তী বাড়িগুলোর দোতলার মেঝে বরাবর উঁচু হয়ে উঠেছিল। স্থানীয় সংবাদপত্রগুলোর হিসাবমতে প্রায় ৫০ হাজার লোক সে সময় হতাহত হয়েছিল। মেননের মতে, ৫০ হাজার নিহত ও ১৫ হাজার আহত হয়েছিল। স্টেটসম্যানের হিসাব অনুযায়ী হতাহতের সংখ্যা ২০ হাজার কিংবা কিছু বেশি ছিল। প্রথম বাহাত্তর ঘন্টায় একচেটিয়া মুসলিমরা আক্রান্ত হয়। 

এরপর বাংলার মুখ্যমন্ত্রী সোহরাওয়ার্দির নির্দেশে বিশেষভাবে শেখ মুজিব ও তাদের দল পাড়ায় পাড়ায় মুসলিম যুবকদের সংগঠিত করে পাল্টা প্রতিরোধ ব্যবস্থা গ্রহণ করায় সাম্যবস্থা তৈরি হয়। যদিও কলকাতায় মুসলিমদের অপ্রস্তুত অবস্থায় রেখে প্রচুর নিরীহ মুসলিমকে হত্যা করা হয় তারপরও মুসলিমদের পাল্টা প্রতিরোধে কলকাতায় লড়াইটা অনেকটাই সমানে সমান হয়। কিন্তু বিহার, উত্তর প্রদেশ, আসাম ও পাঞ্জাবে মুসলিমরা প্রচুর হত্যাযজ্ঞের শিকার হয়। সেপ্টেম্বরে বিহারে আর্য সমাজের সদস্যদের নেতৃত্বে ৩০,০০০ হিন্দুর একটি দল প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবসের পরের মাস থেকে মুসলিম হত্যাযজ্ঞ চালানো শুরু করে। লক্ষ লক্ষ বিহারি বাড়িহারা হয়ে পড়ে। কলকাতা থেকে দাঙ্গা সারা ভারতে ছড়িয়ে পড়ে। লক্ষ লক্ষ মুসলিম উদ্বাস্তু হয়ে পড়ে এবং উদ্বাস্তুদের ঢল পূর্ব বাংলায় নামতে থাকে।

যেহেতু বাংলায় মুসলিম লীগ ক্ষমতায় তাই বেশিরভাগ উদ্বাস্তু মুহাজির মুসলিম এসেছিল পূর্ববাংলায়। দাঙ্গা বন্ধ ও শরনার্থীদের মৌলিক চাহিদার ব্যবস্থাপনায় ব্যর্থ হয় বাংলার সোহরাওয়ার্দি সরকার। এর পাশাপাশি কংগ্রেসের উগ্র বর্ণহিন্দুরা সন্ত্রাসী কার্যক্রম চালিয়েই যাচ্ছিল। এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য কাজ শুরু করেন তৎকালীন নোয়াখালীর সাবেক এমএলএ (এমপি) গোলাম সরওয়ার হুসেইনী। তিনি ১৯৩৭ সালে শেরে বাংলার রাজনৈতিক দল কৃষক প্রজা পার্টির নমিনেশনে নির্বাচিত হন। পরে ১৯৪৬ সালে শেরে বাংলার রাজনৈতিক ইমেজ ধ্বংস হওয়া এবং পাকিস্তান দাবির প্রতি মুসলিমদের ঐক্যবদ্ধ হওয়ার সুবাদে সরওয়ার হুসেইনী পরাজিত হন মুসলিম লীগের কাছে। 

সরওয়ার হুসেইনী শাহ মখদুমের অধস্তন পুরুষ ছিলেন। তাই তার পরিবার পীর বংশ হিসেবে আলাদাভাবে প্রসিদ্ধ ও জনপ্রিয় ছিল। এছাড়া সরওয়ার সাহেব কলকাতা বারের এডভোকেট ছিলেন। আইনজীবী হিসেবে কৃষকের খাজনা মওকুফ, ঋণ সালিশি বোর্ড থেকে সুদখোর ব্যবসায়ীদের উৎখাত করা এবং জমিদারি বাজার বয়কট করার আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়ে তিনি তৎকালীন নোয়াখালীর ক্ষমতাধর হিন্দু জমিদার এবং মহাজনদের চক্ষুশূল হয়েছিলেন। একইসাথে দরিদ্র হিন্দু ও মুসলিমদের কাছে জনপ্রিয় নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলেন। 

যাই হোক সরওয়ার হুসেইনী দাঙ্গা বন্ধ ও শরনার্থীদের অবর্ণনীয় মানবেতর জীবন যাপনের চিত্র তুলে ধরে ও এর আশু সমাধানের জন্য মুসলিম লীগের প্রাদেশিক নেতা সোহরাওয়ার্দি, কেন্দ্রীয় নেতা মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ, কংগ্রেসের কেন্দ্রীয় নেতা নেহেরু এবং মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধীর কাছে পত্র পাঠান। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে তার চিঠির গুরুত্ব কেউ উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়নি। এদিকে তৎকালীন রায়পুরের জমিদার রায় চৌধুরী কংগ্রেসের সাথে যুক্ত ছিলেন। রায় চৌধুরীও দাঙ্গার সময় নতুন করে ঝামেলা শুরু করেছেন। তিনি নোয়াখালীতে শরনার্থীদের ঢুকতে বাধা দিচ্ছিলেন ও মুসলিমদের নানানভাবে উত্যক্ত করছিলেন। 

এই প্রসঙ্গে গোলাম সরওয়ার হুসেইনী কংগ্রেসের বিভিন্ন নেতা এবং মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধীর কাছেও চিঠি পাঠিয়ে জমিদারের অত্যাচারের কথা জানান এবং তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার অনুরোধ করেন। এর বাইরে পত্রিকায় বক্তব্য বিবৃতি ও পার্টি প্রধান শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হককে সাথে নিয়ে কংগ্রেসের সন্ত্রাসী ও সোহরাওয়ার্দি তথা মুসলিম লীগের ব্যর্থতার বিরুদ্ধে জনসমাবেশে সোচ্চার হন। শরনার্থীদের মানবিক সহায়তা প্রদানের জন্য তিনি সেচ্চাসেবক বাহিনী মিয়ার ফৌজ তৈরি করেন।   

এদিকে অক্টোবর মাসে খোদ নোয়াখালীতেই সাম্প্রদায়িক হিন্দুরা মুসলিমদের ওপর নির্যাতনের পরিকল্পনা করে। সরওয়ার হুসেইনী নিজের এলাকা রামগঞ্জে ঘটে এক নজিরবিহীন ঘোষণা। লক্ষ্মীপূজা উপলক্ষে রামগঞ্জের জমিদার রাজেন্দ্রলাল চৌধুরীর বাড়িতে ভারত সেবাশ্রম সংঘের এক সন্ন্যাসী এসে উঠেছেন। তার নাম সাধু ত্রিয়াম্বাকানন্দ। তিনি ঘোষণা করেছেন, পূজার জন্য ছাগবলির বদলে এবার তিনি মুসলমানের রক্ত দিয়ে দেবীকে প্রসন্ন করবেন। সাধু রামগঞ্জের মুসলিমদের আক্রমণ করতে ও পূজার আগেই রক্ত সংগ্রহের আদেশ দেন।  

এই খবর শুনে সরওয়ার হুসেইনী দ্রুতই রামগঞ্জের মুসলিমদের পাশে থাকতে নিজের বাড়িতে চলে আসেন। ১০ই অক্টোবর ভোরবেলা চৌকিদারের মারফৎ রাজেন্দ্রলাল চৌধুরীর কাছে একটি চিঠি পাঠান এবং বিষয়টি নিয়ে আলোচনার প্রস্তাব দেন। কিন্তু রাজেন্দ্রলাল চৌধুরী সরওয়ার হুসেইনীকে পাত্তা দেননি। উল্টো তার অনুসারীদের মুসলিম উচ্ছেদের আহ্বান জানান। 

কারো থেকে সাহায্য ও সাড়া না পেয়ে গোলাম সারোয়ার হুসেইনী পরদিন শাহ্‌পুর বাজারে তার অনুগত ভক্ত, রাজনৈতিক কর্মী এবং সাধারণ মুসলমানদের এক সমাবেশ ডাকেন। বস্তুত নোয়াখালীর মুসলিমরা এমন একটি সমাবেশের জন্য আগ্রহী ছিল। কারণ তারা নিরাপত্তা সংকটে ভুগতে ছিলেন। জনসভায় বক্তৃতাকালে সরওয়ার সাহেব মুসলমানদের সেই সময়কার অবস্থান তুলে ধরেন এবং হিন্দু জমিদারকে উৎখাত করার ডাক দেন।

সমাবেশ চলাকালে আক্রমণ করে জমিদার ও তার অনুগত পাইক পেয়েদারা। তারা জনসভায় গুলি করে এবং কয়েকজন মুসলিমকে হত্যা করে। কিন্তু অল্প সময় পরেই ঘুরে দাঁড়ায় মুসলিমরা। ইট, পাথর, লাঠি ইত্যাদি ছিল মুসলিমদের অস্ত্র। উত্তেজিত মুসলিম জনতা জমিদারের লোকদের পরাস্ত করে। জমিদারের লোকদের গুলি ফুরিয়ে গেলে পালাতে থাকে তারা। অল্প সময়ে রামগঞ্জের জমিদার বাড়ির নিয়ন্ত্রণ উত্তেজিত মুসলিমদের হাতে চলে আসে। জমিদার রাজেন্দ্রলাল চৌধুরী উত্তেজিত জনতার হাতে নিহত হন। সাধু ত্রিয়াম্বাকানন্দ পালিয়ে যেতে সক্ষম হন। 

রায়পুরের জমিদার চিত্তরঞ্জন রায় চৌধুরীর সাথে তো আগে থেকে বিরোধ চলে আসছিল সরওয়ার হুসেইনীর সাথে। তিনি নোয়াখালীতে মুসলমানদের ক্রমবর্ধমান রাজনৈতিক শক্তিকে গোড়া থেকেই মেনে নিতে পারছিলেন না। রাজেন্দ্রলাল হত্যার প্রতিশোধ নিতে এগিয়ে আসেন রায়পুরের জমিদার রায় চৌধুরী। এদিকে সরওয়ার হুসেইনীকে সহায়তা করেন রায়পুরের স্থানীয় মুসলিম লীগ নেতা আবুল কাশেম।  

সরওয়ার হুসেইনীর অনুসারীরা 'মিয়ার ফৌজ' নামে এবং আবুল কাশের অধীন 'কাশেম ফৌজ'র সদস্যদের সাথে খন্ডযুদ্ধ হয় রায় চৌধুরীর সাথে। এখানেও জমিদার পরাজিত হন। দুই বাহিনী জমিদার বাড়ি অবরোধ করেন। রায় চৌধুরী পরাজয় নিশ্চিত জেনে আত্মহত্যা করেন। তার আগে তিনি নিজে তার পরিবারের সদস্যদের খুন করেন।

সরওয়ার হুসেইনীর কার্যক্রম এই দুইটি ঘটনার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে। কিন্তু এসব ঘটনার কথা ছড়িয়ে পড়লে নোয়াখালী জেলার রায়পুর, রামগঞ্জ, বেগমগঞ্জ, লক্ষ্মীপুর, ছাগলনাইয়া এবং পার্শ্ববর্তী ত্রিপুরা (বৃহত্তর কুমিল্লা) জেলার চাঁদপুর, চৌদ্দগ্রাম, হাজীগঞ্জ, ফরিদগঞ্জ এবং লাকসাম থানার বিশাল এলাকাজুড়ে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। হিন্দুরা তাদের দুইপ্রভাবশালী জমিদারের করুণ কাহিনী শুনে এসব এলাকা থেকে পালাতে থাকে। 

বিহার, কলকাতা, উত্তর প্রদেশ ও পাঞ্জাবের উল্টো ঘটনা ঘটে নোয়াখালীতে। এই প্রথম হিন্দুরা শরনার্থী হতে শুরু করে। এতদিন লক্ষ লক্ষ মানুষ গৃহহারা হলেও টনক নড়েনি গান্ধীর। কেবল নোয়াখালীর ঘটনায় তিনি উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন। তিনি নোয়াখালীর উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করেন ৬ই নভেম্বর। পরদিন নোয়াখালীর চৌমুহনীতে যোগেন্দ্র মজুমদারের বাড়িতে দুই রাত কাটিয়ে ৯ই নভেম্বর থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে তিনি তার শান্তির লক্ষ্যে পদযাত্রা শুরু করেন।

নোয়াখালীতে এসে গান্ধী গোলাম সারোয়ার হুসেইনীর সাথে দেখা করতে চান। কিন্তু গোলাম সরওয়ার হুসেইনী ততদিনে গান্ধীর ওপর সম্পূর্ণভাবে আস্থা হারিয়ে ফেলেছিলেন। তাই তিনি প্রথম দিকে সাক্ষাতে রাজী ছিলেন না। পরে গান্ধীর অনুরোধে নোয়াখালীর চাটখিলে দুজনের মধ্যে বৈঠক হয়। বৈঠকে সরওয়ার হুসেইনী গান্ধীকে বলেন যে, দাঙ্গার সূত্রপাত নোয়াখালীতে নয়। এবং বার বার চিঠি দিয়েও তিনি এর প্রতিকার পাননি। কলকাতা ও বিহারে যখন দাঙ্গা থেমে যাবে তখন নোয়াখালীতেও হানাহানি বন্ধ হবে উল্লেখ করেন সরওয়ার সাহেব। গোলাম সরওয়ার নোয়াখালীতে শান্তি ফিরিয়ে আনার জন্য উদ্যোগ নিতে রাজি হন তবে তার আগে শর্ত হিসেবে কলকাতা, বিহার ও উত্তর প্রদেশে দাঙ্গা বন্ধ হওয়া ও মুসলিমদের নিরাপত্তার দাবি জানান। 

গান্ধী রাজি হন ও দাঙ্গা বন্ধ করতে কংগ্রেস নেতাদের সাথে আলোচনা শুরু করেন। অল্প দিনের মধ্যে দাঙ্গা নিয়ন্ত্রণে এসেছে। এই হলো করমচাঁদ গান্ধীর অহিংস আন্দোলনের নমুনা। যতদিন মুসলিমরা আক্রান্ত হচ্ছিলো ততদিন তার কোন বিকার ছিল না। তিনি এরপরও নোয়াখালী থেকে চলে যাননি। প্রায় তিনমাস তিনি নোয়াখালী অবস্থান করেছেন। এখানেও ছিল তার রাজনীতি। তিনি নোয়াখালী থেকে বিশ্ববাসীদের জানান দিচ্ছিলেন দাঙ্গায় হিন্দুরা নির্যাতিত হচ্ছে। দাঙ্গা বন্ধ হওয়ার পর তার এই অবস্থান ও নানান বক্তব্য বিবৃতি আবারো বর্ণহিন্দুদের উত্তেজিত করে। আবারো উগ্রবাদী হিন্দুরা বিহারে দাঙ্গা তৈরি করে।   

এবার মুসলিম লীগের নেতৃবৃন্দ গান্ধীকে নোয়াখালী ত্যাগ করতে বলেন। শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক গান্ধীকে নোয়াখালী থেকে চলে যাওয়ার জন্য চাপ দিতে থাকেন। এরপর গান্ধী বিহারের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করেন। যদিও হিন্দুরা এক ভারত প্রতিষ্ঠার জন্য এমন দাঙ্গা বাধায়। তারা ভেবেছিল তাদের আক্রমণে মুসলিম লীগ ভয়ে পাকিস্তান আন্দোলন থেকে দূরে সরে যাবে। তবে বাস্তবে এটা তাদের জন্য হিতে বিপরীত হয়েছে। মুসলিম ও হিন্দুরা একসাথে থাকা যে অসাধ্য এবং কংগ্রেসের এই দাবী যে অবান্তর তা দাঙ্গার ঘটনায় আরো স্পষ্ট হয়। এই দাঙ্গার ফলে পাকিস্তান দাবী আরো যৌক্তিক হয়ে ওঠে এবং পাকিস্তান সৃষ্টি ত্বরান্বিত হয়। 

১১ আগ, ২০২০

যে নারীর ফরিয়াদ আল্লাহ তৎক্ষণাৎ শুনেছেন!

একদিন মদিনার এক আনসার বয়স্ক মহিলা আল্লাহর রাসূল সা.-এর নিকট এসেছেন। তিনি তার স্বামীর বিরুদ্ধে একটি অভিযোগ নিয়ে এসেছেন। মহানবীর কাছ এসে খুবই নিচুকণ্ঠে তার অভিযোগের কথা বলছিলেন। এই প্রসঙ্গে আয়িশা রা. বলেন, মহিলাটি এসে নবী সা.-এর সাথে এতো চুপে চুপে কথা বলতে শুরু করে যে, আমি ঐ ঘরে থাকা সত্ত্বেও মোটেই শুনতে পাইনি।  

তিনি তার স্বামীর বিরুদ্ধে অভিযোগ করে বলেন, “হে আল্লাহর রাসূল সা.! আমার যৌবনতো তার সাথেই কেটেছে। এখন আমি বুড়ি হয়ে গেছি এবং আমার সন্তান জন্মদানের যোগ্যতা লোপ পেয়েছে, এমতাবস্থায় আমার স্বামী আমার সাথে যিহার করেছে। এখন আমি কী করবো? আমার কী অবস্থা হবে? হে আল্লাহ! আমি আপনার সামনে দুঃখের কান্না কাঁদছি।

যিহার সম্পর্কে ইসলামের বিধান আসার আগ পর্যন্ত আরবে বিধান ছিল যে স্ত্রীর সাথে যিহার করা হয় সে মা হয়ে যায়। আর তার সাথে বিবাহ বিচ্ছিন্ন তালাক হয়ে যায়। মহিলাটির স্বামী মহিলাটির সাথে যিহার করেছিল। এতে তিনি কষ্ট পেয়ে এর ব্যাপারে ইসলামের বিধান জানতে চেয়েছিলেন। তার স্বামীর নাম ছিল হযরত আউস ইবনে সামিত রা.। 

আরবে অনেক সময় এমন ঘটনা ঘটতো যে, স্বামী ও স্ত্রীর মধ্যে ঝগড়া বিবাদ হলে স্বামী ক্রোধান্বিত হয়ে বলতো "তুমি আমার জন্য ঠিক আমার মায়ের পিঠের মত"। এর প্রকৃত অর্থ হলো, আমার তোমার সাথে সহবাস ঠিক আমার মায়ের সাথে সহবাস করার মত। এটি স্পষ্ট বার্তা ছিল যে, স্বামী এখন আর তাকে স্ত্রী মনে করে না, বরং যেসব স্ত্রীলোক তার জন্য হারাম তাদের মতো মনে করে। এরূপ করাকেই "যিহার" বলা হয়। 

আরবদের কাছে যিহার তালাক বা তার চেয়ে অত্যন্ত কঠোর প্রকৃতির সম্পর্কচ্ছেদের ঘোষণা বলে মনে করা হতো। কারণ, তাদের দৃষ্টিতে এর অর্থ ছিল এই যে, স্বামী তার স্ত্রীর সাথে দাম্পত্য সম্পর্কই ছিন্ন করছে না, বরং তাকে নিজের মায়ের মত হারাম করে নিচ্ছে। এ কারণে আরবদের মতে তালাক দেয়ার পর তা প্রত্যাহার করা যেতো। কিন্তু "যিহার" প্রত্যাহার করার কোন সুযোগই থাকতো না।  

আল্লাহর রাসূল সা.-এর কাছে যিহারের ব্যাপারে কোনো আলাদা বিধান ছিল না। তাই তিনি ঐ মহিলাকে কোনো সমাধান দিতে পারেন নি। কান্না করতে করতে মহিলাটি ফিরে যেতে উদ্যত হয়েছিলেন, ততক্ষণে মহান রাব্বুল আলামীন তাঁর ফরিয়াদ শুনেছেন। তখনো মহিলাটি ঘর হতে বের হয়নি ইতোমধ্যেই হযরত জিবরাঈল আ. যিহারের ব্যাপারে সিদ্ধান্তসহ ওহি নিয়ে হাজির হন।

আল্লাহ তায়ালা সূরা মুজাদালাহর ১-৬ নং আয়াত এই ঘটনা প্রসঙ্গে নাজিল করেছেন। আল্লাহ তায়ালা ১ ও ২ নং আয়াতে বলেন, 

//আল্লাহ অবশ্যই সে মহিলার কথা শুনছেন, যে তার স্বামীর ব্যাপারে তোমার কাছে কাকুতি মিনতি করেছে, এবং আল্লাহর কাছে অভিযোগ করছে। আল্লাহ তোমাদের দু’জনের কথা শুনছেন। তিনি সবকিছু শুনে ও দেখে থাকেন। তোমাদের মধ্যে যারা নিজেদের স্ত্রীদের সাথে “যিহার” করে তাদের স্ত্রীরা তাদের মা নয়। তাদের মা কেবল তারাই যারা তাদেরকে প্রসব করেছে। এসব লোক একটা অতি অপছন্দনীয় ও মিথ্যা কথাই বলে থাকে। প্রকৃত ব্যাপার হলো, আল্লাহ মাফ করেন, তিনি অতীব ক্ষমাশীল।// 

এখানে আল্লাহ তায়ালা স্পষ্ট করে বলেছেন, যদি কোনো স্ত্রীর সাথে যিহার করা হয় তবে ঐ স্ত্রী তার মা হয়ে যায় না। মা কেবল একজনই। আর তিনি হলেন জন্মদাত্রী মা। অতএব যিহার একটি অপছন্দনীয় মিথ্যে কথা। কখনোই স্ত্রী মা হতে পারে না। আর তাই কারো সাথে যিহার করলে বিয়ে ভঙ্গ বা তালাক হয়ে যায় না। তবে এই ন্যাক্কারজনক কাজের প্রায়শ্চিত্ত তাকে করতে হবে। এই বিষয়ে পরের দুই আয়াতে আল্লাহ বলেন, 

//যারা নিজের স্ত্রীর সাথে “যিহার” করে বসে এবং তারপর নিজের বলা সে কথা প্রত্যাহার করে এমতাবস্থায় তারা পরস্পরকে স্পর্শ করার পূর্বে একটি ক্রীতদাসকে মুক্ত করতে হবে। এর দ্বারা তোমাদের উপদেশ দেয়া হচ্ছে। তোমরা যা করো আল্লাহ সে সম্পর্কে অবহিত। যে মুক্ত করার জন্য কোন ক্রীতদাস পাবে না সে বিরতিহীনভাবে দুই মাস রোযা রাখবে। উভয়ে পরস্পরকে স্পর্শ করার পূর্বেই। যে তাও পারবে না সে ষাট জন মিসকিনকে খাবার দেবে। তোমাদেরকে এ নির্দেশ দেয়া হচ্ছে এ জন্য যাতে তোমরা আল্লাহ ও তাঁর রসূলের ওপর ঈমান আনো। এগুলো আল্লাহর নির্ধারিত ‘হদ’। কাফিরদের জন্য রয়েছে কষ্টদায়ক শাস্তি।//

এই আয়াত দ্বারা মূলত যিহারকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। তারপরও যারা যিহার করে ফেলবে তারা কাফফারা আদায় করবে। এরপর আল্লাহ বলেছেন কাফফারার এই নির্দেশ দেওয়া হয়েছে যাতে ঈমান আনা হয়। এখানে ঈমান আনা বলতে আল্লাহর ওপর ঈমান আনা বুঝানো হয়নি। কারণ এই নির্দেশ তো কেবল মুসলিমদের জন্যই। এখানে ঈমান আনা বলতে বুঝানো হয়েছে মুসলিমরা যাতে জাহেলি এসব কালচার আর চর্চা না করে। কারণ এসব জাহেলী চর্চা ঈমানের সাথে বেমানান। ৪ নং আয়াতের সর্বশেষে আল্লাহ বলেছেন, কাফিরদের জন্য রয়েছে কষ্টদায়ক শাস্তি। এখানে কাফির বলতে যারা এই নির্দেশকে ভায়োলেট করবে তাদেরকে এড্রেস করা হয়েছে। 

৫ ও ৬ নং আয়াতে যিহারের মতো অমানবিক ও জাহেলি কালচারে যারা লিপ্ত থাকবে এবং এই সম্পর্কিত বিধি বিধানের যারা অমান্য করবে তাদের ব্যাপারে কঠোর হুঁশিয়ারি প্রদান করা হয়েছে। আল্লাহ তায়ালা বলেন, 

//যারা আল্লাহ এবং তাঁর রসূলের বিরোধীতা করে তাদেরকে ঠিক সেইভাবে লাঞ্ছিত ও অপমানিত করা হবে যেভাবে তাদের পূর্ববর্তীদের লাঞ্ছিত ও অপমানিত করা হয়েছে। আমি পরিস্কার ও স্পষ্টভাবে সব নির্দেশ নাযিল করেছি। কাফেরদের জন্য রয়েছে অপমানকর শাস্তি। (এই অপমানকর শাস্তি হবে) সেই দিন যেদিন আল্লাহ তাদের সবাইকে জীবিত করে উঠাবেন এবং তারা কী কাজ করে এসেছে তা জানিয়ে দেবেন। তারা ভুলে গিয়েছে কিন্তু আল্লাহ তাদের সব কৃতকর্ম সযত্নে সংরক্ষণ করেছেন। আল্লাহ সব বিষয়ে সর্বাধিক অবহিত।// 

যে মহিলা সম্পর্কে এ আয়াতগুলো নাযিল হয়েছিল তিনি ছিলেন খাযরাজ গোত্রের খাওলা বিনতে সা'লাবা রা.। তিনি তার ব্যাপারে আল্লাহর সিদ্ধান্ত পেয়ে অত্যন্ত খুশি হলেন। একইসাথে খুশি হলেন আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা তার ফরিয়াদ তৎক্ষণাৎ শুনেছেন। এজন্য তিনি মদিনায় বিশেষ মর্যাদা পেয়েছিলেন। সাহাবীরা তাকে এই কারণে আলাদাভাবে সম্মানের চোখে দেখতেন। 

একবার হযরত উমর রা. কিছুসংখ্যক সঙ্গী-সাথীর সাথে কোথাও যাচ্ছিলেন। পথে এক বৃদ্ধা মহিলার সাথে দেখা হলে সে তাঁকে থামতে বললে তিনি সঙ্গে সঙ্গে থেমে গেলেন। মাথা নিচু করে দীর্ঘ সময় তার কথা শুনলেন এবং সে নিজে কথা শেষ না করা পর্যন্ত তিনি দাঁড়িয়ে থাকলেন। সংগীদের মধ্যে একজন জিজ্ঞেস করলো, হে আমীরুল মু'মিনীন, এ বুড়ির জন্য আপনি আমাদের দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষায় রেখেছেন কেন? 

তিনি বললেন, তোমরা কি জানো, তিনি কে? এ যে, খাওলা বিনতে সা'লাবা! এ তো সে মহিলা, সাত আসমানের ওপরে যার ফরিয়াদ গৃহীত হয়েছে। আল্লাহর কসম, তিনি যদি আমাকে সারা রাত দাঁড় করিয়ে রাখতেন তাহলে আমি সারা রাতই দাঁড়িয়ে থাকতাম। শুধু নামাযের সময় ওজর পেশ করতাম। 

খাওলা রা. উমর রা.কে নসিহতের উদ্দেশ্যে বলেন, একসময় তুমি লাঠি হাতে নিয়ে বকরি চরিয়ে বেড়াতে। তখন তোমাকে উমর নামে ডাকা হতো। অতঃপর এমন এক সময় আসলো যখন তোমাকে 'আমীরুল মু'মিনীন' বলে সম্বোধন করা শুরু হলো। জনগণের ব্যপারে অন্তত কিছুটা আল্লাহকে ভয় করো। মনে রেখো, যে আল্লাহর আযাব সম্পর্কিত সাবধানবাণীকে ভয় পায় দূরের মানুষও তাঁর নিকটাত্মীয়ের মত হয়ে যায়। আর যে মৃত্যুকে ভয় পায় তার ব্যাপারে আশংকা হয় যে, সে এমন জিনিসও হারিয়ে ফেলবে যা সে রক্ষা করতে চায়। 

হযরত উমরের রা. সাথে ছিলেন জারুদ আবদী। একথা শুনে তিনি খাওলা রা.-কে থামাতে চাইলে হযরত উমর বললেন, তাকে বলতে দাও। তার কথা তো সাত আসমানের ওপরে গৃহীত হয়েছিল। উমরকে তো অবশ্যই তার কথা শুনতে হবে।

৯ আগ, ২০২০

বঙ্গকথা পর্ব-৪৭ : ক্যাবিনেট মিশন, ডাইরেক্ট অ্যাকশন ও লীগ-কংগ্রেসের কোয়ালিশন সরকার


১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দে ইংল্যান্ডের নবনিযুক্ত লেবার পার্টি থেকে নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী ক্লিমেন্ট এটলি বরাবরই ভারত থেকে ইংল্যান্ডকে গুটিয়ে নেয়ার পক্ষপাতী ছিলেন। তিনি ১৯৪৬ সালের মার্চে তিন সদস্য বিশিষ্ট ব্রিটিশ মন্ত্রিসভার একটি প্রতিনিধি দলকে হিন্দুস্থানে পাঠান। এটি ক্যাবিনেট মিশন বা মন্ত্রী মিশন নামে পরিচিত। এই দলে ছিলেন পেথিক লরেন্স, স্ট্যাফোর্ড ক্রিপস এবং এ.ডি. আলেকজান্ডার। ক্যাবিনেট মিশনের রিপোর্টে যে সব সুপারিশের কথা বলা হয় —

(১) ব্রিটিশ শাসিত ভারত ও আঞ্চলিক রাজ্যগুলিকে নিয়ে একটি যুক্তরাষ্ট্র গঠিত হবে এবং ক্ষমতা বন্টন নীতি গৃহিত হবে।
(২) ভারতের হিন্দু অধ্যুষিত প্রদেশগুলি 'ক', মুসলিম অধ্যুষিত প্রদেশগুলি 'খ' এবং বাংলা ও আসাম প্রদেশকে 'গ' শ্রেণিভুক্ত করা হবে।
(৩) এই প্রদেশগুলির নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নিয়ে ভারতের সংবিধান রচনার জন্য একটি গণপরিষদ গঠিত হবে।
(৪) সাম্প্রদায়িক নীতির ভিত্তিতে গণপরিষদ গঠন ও প্রাদেশিক আইনসভার নির্বাচন হবে।
(৫) কোনো প্রদেশ ইচ্ছা করলে নতুন সংবিধান রচনা করতে পারবে।
(৬) এ ছাড়া নতুন সংবিধান রচনা না হওয়া পর্যন্ত ভারতের প্রধান রাজনৈতিক দল সমূহের প্রতিনিধিদের নিয়ে একটি অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হবে।

ক্যাবিনেট মিশন তাঁদের পরিকল্পনায় কংগ্রেস ও মুসলিম লিগের মধ্যে সমন্বয় সাধনের চেষ্টা করে এক ঐক্যবদ্ধ ভারত গঠনের প্রস্তাব করেছিলেন। এই মিশনের প্রস্তাব অনুসারে একটি স্বতন্ত্র ও স্বাধীন পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠনের সম্ভাবনা লক্ষ্য করে মুসলিমগণ সন্তুষ্ট হয়েছিলেন। কিন্তু অন্য সব বিষয়ে সম্মতি থাকলেও সাম্প্রদায়িক ভিত্তিতে প্রদেশগুলির শ্রেণিবিভাগ ও চিহ্নিত করণ কংগ্রেসের মনঃপুত হয় নি। কিন্তু ব্রিটিশ সরকার কংগ্রেসকে অন্তর্বর্তী সরকার ও সংবিধান সভাকে যথাসম্ভব স্বাধীনভাবে কাজ করার প্রতিশ্রুতি দিলে কংগ্রেস শেষ পর্যন্ত ক্যাবিনেট মিশনের প্রস্তাব গ্রহণ করে ।

এরপরই ভাইসরয় লর্ড ওয়াভেল কংগ্রেস সভাপতি জওহরলাল নেহরুকে অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করতে আহ্বান জানান। এর মানে হলো ভারতের ভাগ্য কংগ্রেসের হাতে ন্যস্ত করা। এতে মুসলিম লীগ ক্ষুব্ধ ও উত্তেজিত হয়ে পাকিস্তান দাবি আদায়ের জন্য ১৯৪৬ সালের ১৬ আগস্ট ডাইরেক্ট একশন ডে-এর ডাক দেন। দেশের অন্যান্য অঞ্চলে ওই দিনটি শান্তিপূর্ণ ভাবে অতিবাহিত হলেও কলকাতা এবং ত্রিপুরায় ব্যাপক সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হাঙ্গামা বেধে যায়। অসংখ্য জীবনহানি, সম্পত্তি নাশ, লুঠতরাজের মধ্যে দিয়ে দিনটি অতিবাহিত হয়। বাংলার দাঙ্গার প্রতিক্রিয়ায় বিহার, উত্তরপ্রদেশ, পাঞ্জাব প্রভৃতি স্থানেও সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষের আগুন জ্বলে ওঠে। আইন শৃঙ্খলার চরম অবনতি হয়। সবচেয়ে লক্ষনীয় বিষয় ছিল, কেন্দ্রে ওয়াভেল সরকার কিংবা বাংলায় মুসলিম লীগ সরকার কেউই এই সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা নিবারণে কোনো কার্যকর ভূমিকা নিতে পারেনি বা নেওয়ার চেষ্টা করেনি।

কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের মধ্যে বিরোধের মূল কারণ হলো পাকিস্তান নামে একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দাবী। এ ছিল উপমহাদেশের মুসলমানদের দাবি যা কংগ্রেস এবং বৃটিশ সরকার মেনে নিতে মোটেই রাজি ছিলনা। কেবিনেট মিশনের পরিকল্পনার ভেতর দিয়ে কংগ্রেস মুসলিম লীগকে ফাঁদে ফেলে তাদের একচ্ছত্র আধিপত্য প্রতিষ্ঠার সকল চেষ্টা করেছে। তাদের ফাঁদে ফেলার এ চক্রান্তটি বুঝতে পেরে মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ কেবিনেট মিশনের প্রস্তাব শর্তসাপেক্ষে গ্রহন করতে সম্মতি জ্ঞাপন করেছেন। কিন্তু কংগ্রেসের কাছে ক্ষমতা তুলে দেওয়ার কারণে সকল চেষ্টাই ভেস্তে যায়।

মুসলিম লীগের অধিবেশনে এ মর্মে প্রস্তাব গৃহীত হয় যে, পাকিস্তান হাসিল করার উদ্দেশ্যে এবং বৃটিশের গোলামী এবং বর্ণহিন্দুর ভবিষ্যৎ প্রাধান্য থেকে মুক্তি লাভের জন্যে মুসলিম জাতির পক্ষে ডাইরেক্ট অ্যাকশন অবলম্বন করার সময় এসেছে। মুসলমানদের সংগঠিত করে প্রয়োজনীয় সময়ে সংগ্রাম করার লক্ষে কর্মসূচী প্রণয়নের অনুরোধ জানানো হয়। উপরন্তু বৃটিশের মনোভাব ও আচরণের প্রতিবাদে বিদেশী সরকার প্রদত্ত সকল খেতাব পরিত্যাগ করার জন্যে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গের প্রতি আবেদন জানানো হয়।

জিন্নাহ সাংবাদিক সম্মেলনে দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে বলেন, ডাইরেক্ট অ্যাকশন কারো বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষনা নয়। তিনি বলেন, একমাত্র মুসলিম লীগই সংবিধানের আওতায় থেকে সাংবিধানিক পন্থায় কাজ করেছে। কেবিনেট মিশন পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনাকালে মুসলিম লীগ বৃটিশ সরকারকে কংগ্রেসের ভয়ে ভীত সন্ত্রস্ত দেখতে পায়। তাদের ভয় ছিল এই যে, কংগ্রেসকে সন্তুষ্ট করতে না পারলে তারা এমন এক সংগ্রামে অবতীর্ণ হবে যা ১৯৪২ সনের সংগ্রাম অপেক্ষা সহস্র গুণে মারাত্মক হবে। বৃটিশের মেশিন গান আছে এবং ইচ্ছামতো ব্যবহার করতে পারে। কংগ্রেস আর এক ধরনের অন্ত্রে সজ্জিত এবং তাকে তুচ্ছ মনে করা যায় না। অতএব আমরা এখন আত্মরক্ষা ও সংরক্ষণের জন্যে সাংবিধানিক পন্থা পরিহার করতে বাধ্য হচ্ছি। সময়মত সংগ্রামে অবতীর্ণ হওয়ার জন্যে প্রস্তুতি গ্রহণের সিদ্ধান্ত নিয়েছি। 

ডাইরেক্ট অ্যাকশনের জন্যে ১৬ই আগষ্ট নির্ধারিত হয়। তার দুদিন পূর্বে জিন্নাহ তাঁর প্রদত্ত বিবৃতিতে বলেন, দিনটি ছিল ভারতের মুসলিম জনসাধারণের কাছে ২৯শে জুলাই মুসলিম লীগ কাউন্সিল কর্তৃক গৃহীত প্রস্তাবের ব্যাখ্যা করা, কোন প্রকার প্রত্যক্ষ সংঘর্ষে যাওয়ার জন্যে নয়। অতএব আমি মুসলমানদের প্রতি এ আবেদন জানাই তাঁরা যেন আমদের নির্দেশ পুরোপুরি মেনে চলেন, নিজেদের অত্যন্ত শান্তিপূর্ণ ও সুশৃংখলভাবে পরিচালিত করেন এবং শত্রুর হাতের খেলনায় পরিণত না হন।

ডাইরেক্ট অ্যাকশন নিয়ে কংগ্রেসের মুসলিম নেতা আবুল কালাম আজাদ বলেন, আমি জনসাধারণের মধ্যে এ অনুভূতি লক্ষ্য করলাম যে ১৬ আগষ্ট মুসলিম লীগ কংগ্রেসীদের উপর আক্রমণ চালাবে এবং তাদের ধনসম্পদ লুণ্ঠন করবে। ১৬ই আগষ্ট ভারতের ইতিহাসে একটি কালো দিবস। এ দিনে শত শত মানুষের জীবন হানি হয় এবং কোটি কোটি টাকার ধনসম্পদ লুণ্ঠিত হয়। মুসলিম লীগের মিছিলগুলি লুণ্ঠন ও অগ্নি সংযোগ শুরু করে।

তিনি আরো বলেন, বাংলার সরকার কর্তৃক ১৬ আগষ্ট সরকারি ছুটি ঘোষণার ফলে অধিক মাত্রায় আতংক ছড়িয়ে পড়ে। বাংলার আইন পরিষদের কংগ্রেস দল এ সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ জানায়। প্রতিবাদে কোন ফল না হওয়ায় তাঁরা সংসদ ভবন থেকে ওয়াক আউট করেন। কোলকাতার জনমনে ভয়ানক উদ্বেগ বিরাজ করছিল এবং সে উদ্বেগ এ কারণে বেড়ে চলেছিল যে মুসলিম লীগ সরকার প্রতিষ্ঠিত ছিল এবং হুসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ছিলেন প্রধানমন্ত্রী। 

আসলে আবুল কালাম আযাদ তার এই বক্তব্যের মাধ্যমে কংগ্রেসীদের মনোভাবকেই তুলে ধরেছেন। এবং মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে প্রস্তুতি স্বরুপ একটি যুদ্ধাবস্থার জন্য কংগ্রেস কর্মীদের উস্কে দেন। 

মাওলানা আবুল কালাম আজাদের উপরোক্ত বক্তব্যে কোলকাতার লোমহর্ষক সাম্প্রদায়িক হানাহানির প্রকৃত কারণ চিহ্নিত হয়েছে। কারণগুলো হচ্ছে-
১। বাংলায় মুসলিম লীগ মন্ত্রীসভা প্রতিষ্ঠিত যা হ্নিদুদের জন্য ছিল অসহনীয়।
২। প্রধানমন্ত্রী ছিলেন হুসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী যাঁকে হিন্দুগণ মনে করতো হিন্দুবিদ্বেষী।
৩। ১৬ই আগষ্টের ক’দিন পূর্ব থেকেই এ মিথ্যা গুজন ছড়ালো যে মুসলিম লীগ তথা কোলকাতার মুসলমানগণ হিন্দুদের উপর আক্রমণ চালাবে এবং তাদের ধনসম্পদ লুণ্ঠন করবে। এ গুজব ছড়ানোর এ উদ্দেশ্য ছিল না যেন হিন্দুগণ কোলকাতার শতকরা প্রায় পঁচিশ মুসলমান নির্মূল করার জন্য তৈরী হয়।

আব্বাস আলী খান বলেন, আমি সে সময়ে গুরুত্বপূর্ণ সরকারী চাকুরীতে নিয়োজিত থাকলেও পাকিস্তান আন্দোলন মনে প্রানে সমর্থন করতাম। মুসলিম লীগ মহলের হিন্দুদের উপর আক্রমণ চালানো হবে এরূপ কোন পরিকল্পনার হিন্দু বিসর্গও কানে আসেনি। আমি তখন ফ্যামিলিসহ কোলকাতায় থাকতাম, বাসায় আমার সাথে আমার স্ত্রী ও চার বছরের কন্যা মাত্র। গোলযোগের কোন আশংকা থাকলে তাদেরকে একাকী ফেলে ১৬ই আগষ্টে মুসলিম লীগের জনসভায় নিশ্চিন্ত মনে কিছুতেই যেতে পারতাম না।

গড়ের মাঠে অনুষ্ঠিত জনসভায় আমার মতো আরো অনেকেই যোগদান করেন। আমরা জনসভায় উপস্থিত হয়ে দেখলাম রাজা গজনফর আলী খান ইংরেজিতে বক্তৃতা করছেন। মুসলিম লীগ কর্মীদের হাতে কোন অস্ত্র তো দূরের কথা, কোন লাঠি-সোটাও দেখতে পাইনি। তবে পাকিস্তান লাভের আশায় সকলকে হর্ষোৎফুল্ল ও উজ্জীবিত দেখতে পেয়েছিলাম।

রাজা সাহেবের পর সোহরাওয়ার্দী সাহেব মঞ্চে ওঠার পর মুসলিম লীগ মিছিলের এবং জনসভায় আগমনকারীদের উপর হিন্দুদের সশস্ত্র আক্রমণের সংবাদ আসতে থাকলো। অতঃপর আক্রান্ত মুসলমানদের অনেকেই রক্তমাখা জামাকাপড় নিয়ে সভায় হাজির হয়ে হিন্দুদের সশস্ত্র হামলার বিবরণ দিতে লাগলো। শ্রোতাদের হর্ষ বিষাদে পরিণত হলো। ভয়ানক উত্তেজনা, ভীতি ও আশংকা বাড়তে থাকলো। কোলকাতায় শতকরা বিশ থেকে পঁচিশ ভাগ মুসলমান। প্রায় সকলেই দরিদ্র। তাদের শতকরা প্রায় পাঁচ ভাগ বহিরাগত, বিভিন্ন স্থানে চাকরি করে।

জনসভায় যোগদানকারীগণ বিভাবে নিরাপদে বাড়ি ফিরে যাবে, তাদের অরক্ষিত পরিবারের অবস্থাই বা কি –এমন এক আশংকা সকলের চোখে মুখে দৃশ্যমান হয়ে উঠলো। প্রধানমন্ত্রী বুঝতে পারলেন। তাঁর বক্তৃতার কোন কথাই আমার মনে নেই। তবে জনতাকে সান্ত্বনা দেবার জন্যে ‘হাম সব দেখ লেংগে’ বলে সকলকে শৃংখলার সাথে ঘরে ফিরে যেতে বললেন। আমরা কোন রকমে ‘আল্লাহ আল্লাহ’ করে বাসায় ফিরলাম। কোলকাতার মুসলিম পল্লী পার্কসার্কাসে থাকতাম বলে বেঁচে গিয়েছি, নতুবা হিন্দুদের আক্রমণের শিকার অবশ্যই হতে হতো।

এ লোমহর্ষক ঘটনা সম্পর্কে তৎকালীন কোলকাতার দৈনিক স্টেটসম্যান পত্রিকার সম্পাদক –Lan Stepens বলেন –‘সম্ভবত প্রথম দিনের মারামারিতে এবং নিশ্চিতরূপে দ্বিতীয় ও তৃতীয় দিনে মুসলমানদের জানমালের সবচেয়ে বেশী ক্ষতি হয়।

এসব ঘটনার দ্বারা এ কথা নিঃসন্দেহে প্রমাণিত হয় যে, ১৬ই আগস্ট হ্নিদুদের উপর আক্রমণ করার কোন পরিকল্পনা মুসলিম লীগের ছিলনা। বরঞ্চ লীগের ডাইরেক্ট অ্যাকশনকে নিজেদের হীন স্বার্থে ব্যবহার করার জন্য কংগ্রেস মুসলিম নিধনের নিখুঁত পরিকল্পনা তৈরী করে। তবে এর সুফল হয়েছে মুসলমানদের জন্যে। পাকিস্তান সৃষ্টি ত্বরান্বিত হয়েছে –যার সম্ভাবনা কিছুটা ক্ষীণ হয়েছিল কেবিনেট মিশনের প্রস্তাবের পর। জিন্নাহ খোলাখুলি ও অপকটে কোলকাতার নৃশংস ঘটনার তীব্র নিন্দা করেন এবং নিহত ও ক্ষতিগ্রস্তদের প্রতি গভীর সমবেদনা জ্ঞাপন করেন।

ভারতে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা নতুন কিছু নয়। প্রায়ই এখানে সেখানে দাঙ্গা হয়। কিন্তু ১৬ আগস্টের কলকাতায় ঘটে যাওয়া দাঙ্গা ছিল নজিরবিহীন। মুসলিমদের নিশ্চিহ্ন করতে কংগ্রেসীদের এক আগ্রাসী চেষ্টা ছিল সেই দাঙ্গায়। 

এদিকে ভাইসরয় ২৪শে আগস্ট মধ্যবর্তী সরকারের সদস্যদের নাম ঘোষণা করেন। তাদেরকে ২ সেপ্টেম্বর দায়িত্ব গ্রহণ করতে হবে। উল্লেখ্য যে, ভাইসরয় ৬ই আগষ্ট নেহরুকে মধ্যবর্তী সরকার গঠনের আহবান জানান। ৭ই আগষ্ট কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটি সরকার গঠনে সম্মতি দান করে। ১৭ই আগষ্ট নেহরু ভাসরইকে বলেন যে তিনি মুসলিম আসনগুলো লীগ বহির্ভূত লোকদের দ্বারা পূরণ করে একটি শক্তিশালী সরকার গঠন করতে চান। ভাইসরয় এতে ভিন্নমত পোষণ করে বলেন যে আপাতত কিছু সময়ের জন্যে মুসলিম আসনগুলো উন্মুক্ত রাখা হোক। নেহরু এ প্রস্তাবে রাজী না হয়ে তার নিজের প্রস্তাবে অবিচল থাকেন।

কংগ্রেসী মধ্যবর্তী সরকারের শপথ গ্রহণের প্রাক্কালে ভাইসরয় ব্রিটিশ সরকারকে বলেন যে, মুসলিম লীগ সরকারে যোগদান করতে রাজি না হওয়া পর্যন্ত শপথ অনুষ্ঠান মুলতবি রাখা হোক। প্রধানমন্ত্রী এটলী ভাইসয়ের যুক্তি প্রত্যাখ্যান করে বলেন যে, এখন যে কোন বিলম্বকরণ প্রক্রিয়া কংগ্রেস নেতাদের বিক্ষুব্ধ করবে এবং কংগ্রেস ও ব্রিটিশ সরকারের মধ্যে ভাঙন সৃষ্টি করবে। অতঃপর দিল্লী থেকে জারিকৃত এক সরকারী ইশতাহারে বলা হয় যে, নতুন কাউন্সিল ২ সেপ্টেম্বর কার্যভার গ্রহন করবে।

নতুন কাউন্সিলে যোগদানকারী সদস্যগণ ছিলেন, নেহরু, প্যাটেল, রাজা গোপালচারিয়া, রাজেন্দ্র প্রসাদ, আসফ আলী, শরৎচন্দ্র বোস, জন ম্যাথাই, বলদেব সিং, স্যার শাফায়াত আহমদ খান, জগজীবন রাম, আলী জহির এবং সি এইচ ভবা। দুজন মুসলমান পরে নেয়া হবে 

মধ্যবর্তী সরকার গঠনের পর ভাইসরয় সাম্প্রদায়িক দাংগায় বিধ্বস্ত কোলকাতা পরিদর্শন করেন। কোলকাতা ভ্রমণের পর তিনি নিশ্চিত হন যে, কংগ্রেস এবং লীগের মধ্যে কোন সমঝোতা না হলে সমগ্র ভারত ভয়ংকর গৃহযুদ্ধের শিকার হয়ে পড়বে। কোলকাতা থেকে প্রত্যাবর্তনের পর তিনি কংগ্রেস নেতাদেরকে বুঝাবার চেষ্টা করেন এবং এ উদ্দেশ্যে ২৭ আগষ্ট গান্ধীর সাথে সাক্ষাৎ করেন। তিনি বাংলার এবং কেন্দ্রে কোয়ালিশন সরকার গঠনের প্রস্তাব দেন এবং একটা ফর্মূলা পেশ করেন। ২৮ আগষ্ট নেহরু ভাইসরয়কে জানিয়ে দেন যে ওয়ার্কিং কমিটি ফর্মূলাটি প্রত্যাখ্যান করেছে।

ভাইসরয় লর্ড ওয়াভেল একটি মীমাংসায় পৌঁছার আপ্রাণ চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। তার এ প্রচেষ্টা কংগ্রেস ভিন্নভাবে গ্রহন করে। উপমহাদেশের উপর কংগ্রেসের একচেটিয়া প্রভূত্ব কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার পথে ওয়াভেলকে তার প্রতিবন্ধক মনে করেন এবং তার শাস্তি বিধানের জন্য উঠে পড়ে লাগেন। ওয়াভেলের সাথে আলাপ আলোচনার পর ফিরে এসে গান্ধী এবং নেহরু উভয়ে পত্র লিখতে বসে যান। গান্ধী প্রথমে এটলীর নিকট এ মর্মে তারবার্তা প্রেরণ করেন যে, ভাইসরয়ের মনের অবস্থা এমন যে শিগগির প্রতিকার হওয়া দরকার। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ এই যে কোলকাতার ঘটনায় তিনি মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছেন। 

গান্ধী তাঁর স্থলে একজন যোগ্যতর ব্যক্তির দাবী জানান। গান্ধী ওয়াভেলকেও পত্রের দ্বারা শাসিয়ে দেন যে তিনি ভীতি প্রদর্শন করে কংগ্রেসকে তার তার মতে আনতে চান। তিনি আরও বলেন যে ভাইসরয় যদি সাম্প্রদায়িক সম্পর্কের অবনতিতে ভীত হয়ে পড়েন এবং তা দমন করার জন্যে শক্তি প্রয়োজ করতে চান, তাহলে বৃটিশের শিগগির ভারত ত্যাগ করা উচিত এবং ভারতে শান্তি প্রতিষ্ঠার দায়িত্ব কংগ্রেসের উপর অর্পণ করা উচিত।

অপরদিকে নেহরু বৃটেনে তার কতিপয় প্রভাবশালী বন্ধুকে পত্র দ্বারা জানিয়ে দেন যে, ভাইসরয় অত্যন্ত দুর্বল লোক এবং মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছেন। জিন্নাহকে খুশী করার জন্যে তিনি ভারতকে বিপদের মুখে ঠেলে দিচ্ছেন। তিনি বলেন যে, ভাইসরয় স্যার ফ্রান্সিস মুডি এবং জর্জ এবেল এর পরামর্শ অনুযায়ী চলছেন এবং নেহরুর মতে এ দুজন হচ্ছেন প্রকট মুসলিম মনা (Rabidly pro-Muslim)। নেহরু তাদেরকে ইংলিশ মোল্লা বলেও অভিহিত করেন। 

২ সেপ্টেম্বর ১৯৪৬, কংগ্রেস সরকার কার্যভার গ্রহণ করেন। কংগ্রেস খুবই উল্লসিত। তারা ঘোষণা করেন, ক’বছরের মধ্যেই ভারতে একটি জাতীয় সরকার প্রতিষ্ঠিত হবে। মুসলিম লীগ আসুক না আসুক –তাতে কিছু যায় আসে না। কাফেলা চলতেই থাকবে। এখন আমাদেরকে এ ভূখন্ডের শাসক মনে করতে হবে। 

ভারতে একদলীয় শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য মুসলিম ভারত এবং বৃটেনের বিভিন্ন রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক অত্যন্ত দুঃখ প্রকাশ করেন। জিন্নাহ ২৫ আগষ্ট অত্যন্ত কঠোর ভাষায় এক বিবৃতি দান করেন। তিনি ভাইসরয়ের সিদ্ধান্তে দুঃখ প্রকাশ করে বলেন যে, মুসলিম লীগকে যে নিশ্চয়তা দান করা হয়েছিল এবং যে সব প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছিল, তার সিদ্ধান্ত সে সবের সাথে অসামঞ্জস্যশীল। নতুন সরকার যে দিন কার্যভার গ্রহণ করেন সেদিন মুসলমানগণ সমগ্র ভারতে তাদের গৃহে ও দোকানে কালো পতাকা উড়ায়। কারন মুসলিমরা বুঝেছিল শত্রুতায় ও হিংসায় ইংরেজদের থেকে অনেকগুণ বেশি হবে মুশরিকরা। 

উইনস্টোন চার্চিল সরকারি সিদ্ধান্তের তীব্র প্রতিবাদ জানান এবং বলেন, হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসন প্রতিষ্ঠার চেষ্টা গৃহযুদ্ধ ব্যতীত সফল হবেনা। অন্তবর্তী সরকার গঠনের পর এক মাস অতিক্রান্ত হতে না হতে মুসলিম লীগ উপলব্ধি করে যে, সরকারের বাইরে অবস্থান মুসলিম স্বার্থের চরম পরিপন্থী। নীতিগতভাবে মুসলিম লীগ সরকারে যোগদান করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে। এ নীতি বলবৎ থাকবে। তবে রাজনৈতিক প্রয়োজন এবং সেইসাথে দেশে শত্রুভাবাপন্ন একটি হিন্দু সরকার প্রতিষ্ঠা মুসলিম লীগকে তার নীতি পরিবর্তনে বাধ্য করে।

যতদিন মুসলিম লীগ সরকারের বাইরে থাকবে, ততদিন মুসলমানগণ দুর্গতি আরো বাড়বে বলে তাদের আশংকা হয়। আইন শৃংখলার অবনতি ঘটছে এবং বহু অঞ্চল থেকে মুসলমানদের নির্মূল হওয়ার আশংকা রয়েছে। কংগ্রেসের কোন মাথা ব্যথা নেই। হিন্দু সরকার ক্ষমতায় থাকার কারণে দুষ্কৃতিকারিগণ উৎসাহিত বলে মনে হচ্ছে। অতএব এমতাবস্থায় মুসলিম ভারত রক্ষার উদ্দেশ্যে মুসলিম লীগকে অবশ্যই সরকারে যোগদান করতে হবে। জিন্নাহর মতে কোয়ালিশন সরকারের বাইরে থাকার চেয়ে ভেতরে থেকে ভালোভাবে তিনি পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার সংগ্রাস চালাতে পারবেন।

কোয়ালিশন সরকারে মুসলিম লীগকে পাওয়ার জন্যে ভাইসরয় আগ্রহী ছিলেন। কারণ তিনি ভবিষ্যৎ সংকট সম্পর্কে সচেতন ছিলেন। এ কারণে দীর্ঘ জটিল আলাপ আলোচনা চলতে থাকে একদিকে জিন্নাহ ও নেহরুর মধ্যে এবং অপরদিকে জিন্নাহ ও ভাইসরয়ের মধ্যে। অবশেষে ২৫ অক্টোবরে মুসলিম লীগ কোয়ালিশন সরকারে যোগদান করে। 

নেহরু কোয়ালিশন সরকারে মুসলিম লীগের যোগদান ভালো চোখে দেখেননি। তদুপরি দপ্তর বন্টনেও তিনি চরম একগুঁয়েমির পরিচয় দেন। ভাইসরয় চাচ্ছিলেন তিনটি অতি গুরুত্বপূর্ণ দপ্তর যথা External Affairs, Home and Defense –এর যে কোন একটি মুসলিম লীগকে দেয়া হোক। নেহরু এর চরম বিরোধিতা করেন। অবশেষে যে পাঁচটি দপ্তর মুসলিম লীগকে দেয়া হয় তার মধ্যে অর্থ (Finance) একটি। কংগ্রেস অর্থ বিভাগের দপ্তরটি মুসলিম লীগকে দিতে এ জন্যে রাজী হয়েছিল যে, তাদের বিশ্বাস ছিল এ দপ্তর চালাতে মুসলিম লীগ অপারগ হবে –বরঞ্চ চালাতে গিয়ে বোকা সাজবে। মাওলানা আবুল কালাম আজাদ কংগ্রেসের এ সিদ্ধান্তে দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, তার সহকর্মীদের এ এক ভুল সিদ্ধান্ত হয়েছে। 

আবুল কালাম আজাদ তাঁর ‘India Wins Freedom’ গ্রন্থে এ বিষয়ে বলেন, 
যেহেতু লীগ সরকারে যোগদান করতে সম্মত হয়েছে, কংগ্রেসকে সরকার পুনর্গঠিত করতে হবে এবং এতে মুসলিম লীগ প্রতিনিধিদের স্থান করে দিতে হবে। এখন প্রশ্ন কে কে সরকার থেকে সরে দাঁড়াবেন। মনে করা হলো যে, শরৎ চন্দ্র বসু, স্যার শাফায়াত আহমদ খান এবং সৈয়দ আলী জহির লীগ নমিনীদের স্থান করে দেয়ার জন্যে ইস্তাফা দেবেন। ভাইসরয়ের প্রস্তাব ছির যে স্বরাষ্ট্র বিভাগ মুসলিম লীগকে দেয়া হোক। সর্দার প্যাটেল এ প্রস্তাবের তীব্র বিরোধিতা করেন। আমার ধারণা মতে আইন শৃংখলা অবশ্যম্ভাবী রূপে একটি প্রাদেশিক বিষয় কেবিনেট মিশন পরিকল্পনার যে চিত্রটি সামনে রয়েছে তাতে এ ব্যাপারে কেন্দ্রের সামান্য কিছুই করার আছে। অতএব নতুন সরকার কাঠামোতে কেন্দ্রে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তেমন কোন গুরুত্ব নেই। এ কারণে আমি লর্ড ওয়াভেলের প্রস্তাবের পক্ষেই ছিলাম। কিন্তু প্যাটেল একেবারে নাছোড়বান্দা। তিনি বললেন, আমি বরঞ্চ সরকার থেকে বেরিয়ে যাব কিন্তু স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ছাড়বনা।

আমরা তখন বিকল্প চিন্তা করলাম। রফি আহমদ কিদওয়াই প্রস্তাব করেন যে অর্থ মন্ত্রণালয় মুসলিম লীগকে দেয়া হোক। তিনি আরও বলেন, এ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিভাগ। কিন্তু এ একটি উচ্চমানের টেকনিক্যাল বিষয় এবং মুসলিম লীগের মধ্যে এমন কেউ নেই যে এ বিভাগ ভালোভাবে পরিচালনা করতে পারবে। কিদওয়াইয়ের ধারণা মুসলিম লীগ এ দপ্তর গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানাবে। এতে কংগ্রেসের কোন ক্ষতি নেই। আর এ দপ্তর গ্রহণ করলে পরে তারা বোকা প্রমাণিত হবে।

প্যাটেল লাফ মেরে প্রস্তাবটির প্রতি তার অতি জোরালো সমর্থন জানান। আমি এ কথা তুলে ধরার চেষ্টা করলাম যে অর্থ মন্ত্রণালয় হলো একটি সরকারের চাবিকাঠি এবং এ মুসলিম লীগের নিয়ন্ত্রণে থাকলে আমাদেরকে বিরাট অসুবিধার সম্মুখীন হতে হবে। প্যাটেল আমার বিরুদ্ধাচারণ করে বললেন যে, লীগ এ বিভাগ চালাতে পারবেনা এবং এ প্রস্তাব প্রত্যাখান করতে বাধ্য হবে। আমি এ সিদ্ধান্তে খুশী হতে পারিনি। তবে সকলে যখন একমত, আমাকে তা মেনে নিতে হলো।

লর্ড ওয়াভেল জিন্নাহকে প্রস্তাবটি সম্পর্কে অবহিত করলে তিনি পরের দিন জবাব দেবেন বলেন। জিন্নাহরও সংশয় ছিল যে কেবিনেটে লীগের প্রধান প্রতিনিধি লিয়াকত আলী এ বিভাগটি চালাতে পারবেন কিনা। অর্থ বিভাগের কতিপয় মুসলমান অফিসার এ বিষয়টি জানার পর জিন্নাহর সাথে দেখা করেন। তারা বলেন যে, কংগ্রেসের এ প্রস্তাব অচিন্তনীয় পাকা ফলের মতো এবং এতে লীগের বিরাট বিজয় সূচিত হয়েছে। ...অর্থ বিভাগ নিয়ন্ত্রণের ফলে সরকারের প্রতিটি বিভাগে লীগের কর্তৃত্ব চলবে। তারা জিন্নাহকে এ নিশ্চয়তা দান করেন যে তার ভয়ের কোন কারণ নেই। লিয়াকত আলীকে সর্বপ্রকারে সাহায্য সহযোগিতার প্রতিশ্রুতি তারা দেন যাতে যথাযথভাবে তিনি তার দায়িত্ব পালন করতে পারেন। কংগ্রেস শীঘ্রয় উপলব্ধি করেছিলেন যে অর্থ বিভাগ লীগকে দিয়ে বিরাট ভুল করা হয়েছে। 

এ প্রসঙ্গে মুসলিম লীগ নেতা চৌধুরী মুহাম্মদ আলী বলেন,
জুন মাসে যখন সর্বপ্রথম একটি অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের সম্ভাবনা দেখা দিয়েছিল, তখন কায়েদে আজম লীগের সম্ভাব্য দপ্তরগুলো সম্পর্কে আমার সাথে আলোচনা করেন। তিনি স্বরাষ্ট্র ও প্রতিরক্ষা বিভাগ গ্রহণের ইচ্ছা প্রকাশ করেন। আমি বললাম, আইন শৃংখলা ও পুলিশ প্রাদেশিক বিষয় যার উপর কেন্দ্রের কোন নিয়ন্ত্রণ নেই। কংগ্রেস প্রদেশগুলো লীগ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কোন পরোয়াই করবেনা। অনুরূপ মুসলিম লীগ প্রাদেশিক সরকারগুলো তার উপদেশ গ্রহণের প্রয়োজন বোধ করবেনা। 

আমি বললাম যে প্রতিরক্ষা দপ্তর অবশ্যই লাভজনক। কিন্তু যদি লীগ প্রতিটি বিভাগে সরকারের নীতি-পলিসি প্রভাবিত করতে চায়, তাহলে তার অর্থ বিভাগ নেয়া দরকার। আমি তখন তাকে অর্থ বিভাগের কৌশলগত গুরুত্ব বুঝাতে পারিনি। কিন্তু এখন ঘটনাচক্রে অর্থদপ্তর লীগের ঘাড়ে এসে পড়েছে। আমাকে যখন পুনরায় ডেকে পাঠানো হয় তখন অত্যন্ত জোরালোভাবে আমার পূর্ব পরামর্শের পুনরাবৃত্তি করি। লীগের প্রধান প্রতিনিধি হিসাবে লিয়াকত আলীর উপর অর্থ বিভাগ অর্পিত হওয়ায় তিনি দ্বিধাগ্রস্ত ছিলেন। আমি সর্বাত্মক সাহায্য সহযোগিতার প্রস্তাব দিলাম এবং কায়েদে আজম ও লিয়াকত আলী খান উভয়কেই সাফল্যজনক পরিণামের নিশ্চয়তা দান করলাম। আমার প্রস্তাব গৃহীত হলো এবং লিয়াকত আলী অর্থমন্ত্রী হলেন।

৭ আগ, ২০২০

ইহুদী গোত্র বনু নাযিরকে মদিনা থেকে বহিষ্কার করার ইতিহাস


উহুদ যুদ্ধের পরের ঘটনা। একদিন নজদের নেতা আবু বারা আমির বিন মালিক মদিনায় মুহাম্মদ সা.-এর কাছে উপস্থিত হলেন। মুহাম্মদ সা. তাকে ইসলামের দাওয়াত দিলেন কিন্তু তিনি ইসলাম গ্রহণ করলেন না আবার প্রত্যাক্ষানও করলেন না। তিনি বললেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল! যদি আপনি দ্বীনের দাওয়াত দেওয়ার জন্য একদল সাহাবীগণকে নাজদবাসীদের নিকট প্রেরণ করেন তাহলে তারা আপনার দাওয়াত গ্রহণ করবে বলে আশা করি।

মুহাম্মদ সা. বললেন, নাজদবাসীদের সম্পর্কে আমি ভয় করছি। তারা যদি সাহাবীদের খুন করে!

আবু বারা তখন বললেন, ‘তারা আমার আশ্রয়ে থাকবেন।’

এরপর রাসূল সা. মুনযির বিন আমিরকে নেতা নিযুক্ত করে ৭০ জনের একটি দল নজদে প্রেরণ করেন। এ সাহাবারা ছিলেন বিজ্ঞ, তিলওয়াতকারী এবং শীর্ষ স্থানীয় আবেদ। তারা দিনের বেলা জঙ্গল থেকে জ্বালানী সংগ্রহ করে তার বিনিময়ে আহলে সুফফাদের জন্য খাদ্য ক্রয় করতেন ও কুরআন শিক্ষা করতেন এবং শিক্ষা দিতেন। আর রাতের বেলা আল্লাহর সমীপে মুনাজাত ও সালাতের জন্য দণ্ডায়মান থাকতেন। ৭০ জনের সেই কাফেলাটি নজদের উদ্দেশ্যে যাত্রা করে বীর-এ মাউনা নামক কুয়ার নিকট পৌঁছেন। এই কুয়াটি বনু আমির এবং বনু সুলাইমের মধ্যস্থলে অবস্থিত ছিল।

সাহাবীগণ উম্মু সুলাইমের ভাই হারাম বিন মিলহানকে রাসূলুল্লাহ সা.-এর পত্রসহ নজদের মুশরিক নেতা আমির বিন তোফাইলের নিকট প্রেরণ করেন। কিন্তু পত্রটি পাঠ করা তো দূরের কথা তার ইঙ্গিতে এক ব্যক্তি হারামকে পিছন দিক থেকে এত জোরে বর্শা দ্বারা আঘাত করল যে, দেহের অপর দিক দিয়ে ফুটো হয়ে বের হয়ে গেল। বর্শা-বিদ্ধ রক্তাক্তদেহী হারাম বলে উঠলেন, ‘আল্লাহর মহান! কাবার প্রভূর কসম! আমি কৃতকার্য হয়েছি।’

এর পরপরই আমির অবশিষ্ট সাহাবাদের আক্রমণ করার জন্য তার গোত্র বনু আমিরকে আহবান জানাল। কিন্তু যেহেতু তারা আবু বারা’র আশ্রয়ে ছিলেন সেহেতু তারা সেই আহবানে সাড়া দিল না। এদিক থেকে সাড়া না পেয়ে সে বনু সুলাইমকে আহবান জানাল। বুন সুলাইমের তিনটি গোত্র এ আহবানে সাড়া দিয়ে তৎক্ষণাৎ সাহাবীদের চতুর্দিক থেকে ঘিরে ফেলল। প্রত্যুত্তরে সাহাবারা যুদ্ধে লিপ্ত হলেন এবং একজন বাদে সকলেই শাহাদত বরণ করলেন। কেবলমাত্র কা‘ব বিন যায়দ রা. জীবিত ছিলেন। 

এছাড়াও আরও দু’জন সাহাবী একটু দূরে আমর বিন উমাইয়া যামরী রা. এবং মুনযির বিন উক্ববা রা. কাফেলার উট চরাচ্ছিলেন। ঘটনাস্থলে তাঁরা পাখি উড়তে দেখে সেখানে গিয়ে পৌঁছেন। অতঃপর তারা মুশরিকদের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হন। মুনযির যুদ্ধ করতে করতে শাহাদতবরণ করেন। আর ‘আমর বিন উমাইয়া রা.-কে বন্দী করা হয়। কিন্তু যখন আমির বিন তোফায়েল অবগত হয় যে, আমর বিন উমাইয়া মুদার গোত্রের তখন তাকে হত্যা না করে ছেড়ে দেয়। কারণ তার মা মুদার গোত্রের একটি দাসকে মুক্ত করার মানত করেছিলেন। 

আমর বিন উমাইয়া মদিনায় ফিরে যাচ্ছিলেন। পথিমধ্যে এক স্থানে তিনি বিশ্রাম নিচ্ছিলেন। এমন সময় তার পাশে আরো দুজন লোক বিশ্রামের জন্য বসলো। তিনি তাদের পরিচয় জেনে নিলেন তারা বনু আমিরের লোক। তিনি প্রতিশোধ নেয়ার নিমিত্তে ঐ দুজনকে হত্যা করেন। যদিও বনু আমিরের নেতা আমির বিন তুফায়েলের নেতৃত্বে সাহাবাদের হত্যা করা হয় কিন্তু বনু আমিরের লোকেরা সেই হত্যাযজ্ঞে অংশগ্রহণ করেনি এবং নিরাপত্তাও দেয়নি। 

যাই হোক আমর বিন উমাইয়া রাসূলের সা.-এর কাছে সব ঘটনা বর্ণনা করলেন। রাসূল সা. যখন শুনলেন বনু আমিরের দুজন লোককে হত্যা করেছে আমর তখন তিনি বললেন তাদের সাথে তো আমাদের নিরাপত্তা চুক্তি আছে। আমর জানালেন তিনি তা জানেন না। তখন রাসূল সা. বনু আমিরের সাথে সম্পর্ক নষ্ট না করার জন্য ঐ দুজনের ব্যাপারে বললেন, তাদের রক্তপণ আমাকে দিতে হবে। 

আল্লাহর রাসূল সা. বনু আমিরের সাথে মধ্যস্থতা করার জন্য বনু নাযিরের সহায়তা চাইলেন। কারণ বনু নাযির আর বনু আমিরের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ছিল। বনু নাযির হলো মদিনার সবচেয়ে শক্তিশালী ইহুদী গোত্র। বনু নাযির মদিনা সনদে সাক্ষর করার মাধ্যমে আল্লাহর রাসূলের রাজনৈতিক মিত্র ছিল। যদিও তারা মিত্র চুক্তিতে আবদ্ধ ছিল কিন্তু তারা মদিনা রাষ্ট্র গঠনের পর থেকেই আল্লাহর রাসূলের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিল। একই ষড়যন্ত্রে জড়িত ছিল মক্কার কুরাইশরা ও মদিনার মুনাফিকরা। এটা ছিল ত্রিপক্ষীয় ষড়যন্ত্র। এর দায়ে ২য় হিজরিতে বনু নাযিরের নেতা কা'ব বিন আশরাফকে শাস্তি দেওয়া হয়েছিল। 

যাই হোক বনু নাযিরের নেতা হুয়াই বিন আখতাব বনু আমিরের সাথে আল্লাহর রাসূল সা.-এর মধ্যস্থতা করতে রাজি হয় এবং আল্লাহর রাসূল সা.-কে অপেক্ষা করতে বলেন। রাসূল সা. আবু বকর রা. ও ঊমার রা.সহ আরো কিছু সাহাবী নিয়ে অপেক্ষা করছিলেন। এদিকে ইহুদী বনু নাযির গোত্র আল্লাহর রাসূল সা.-কে হত্যা করার ষড়যন্ত্র শুরু করলো। তারা রাসূল সা.-এর নিকট হতে সরে গিয়ে পরস্পর পরামর্শ করলো, “এর চেয়ে বড় সুযোগে কি আর পাওয়া যাবে? এখন মুহাম্মদ আমাদের হাতের মুঠোর মধ্যে রয়েছেন। এসো তাকে আমরা শেষ করে (হত্যা করে) ফেলি।” তারা পরামর্শক্রমে এ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলো যে, যে দেয়াল ঘেঁষে তিনি বসে আছেন ঐ ঘরের উপর কেউ উঠবে এবং সেখান হতে সে তার উপর একটি বড় পাথর নিক্ষেপ করবে। এতেই তাঁর জীবনলীলা শেষ হয়ে যাবে।

আমর ইবনে জাহাশ ইবনে কা'ব এই কাজে নিযুক্ত হলো। অতঃপর কার্য সাধনের উদ্দেশ্যে সে ছাদের উপর আরোহণ করলো। ইতিমধ্যে আল্লাহ তা'আলা হযরত জিবরাঈল আ.-কে স্বীয় নবী সা.-এর নিকট পাঠিয়ে নির্দেশ দিলেন যে, তিনি যেন সেখান হতে চলে যান। সুতরাং তিনি তৎক্ষণাৎ সেখান হতে উঠে চলে গেলেন, ফলে ঐ ইহুদীরা তাদের উদ্দেশ্য সাধনে ব্যর্থ হলো। ঐ সময় রাসূলুল্লাহ্ সা.-এর সাথে তাঁর কয়েকজন বিশিষ্ট সাহাবী ছিলেন। যেমন হযরত আবু বকর রা., হযরত উমার রা., হযরত আলী রা. প্রমুখ। তিনি সেখান হতে সরাসরি মদীনা অভিমুখে রওয়ানা হন।

রাসূল সা.-এর চলে যাওয়া দেখে সাহাবারা ভেবেছিলেন তিনি হয়তো প্রাকৃতিক কর্ম সারতে যাচ্ছেন। এদিকে ইহুদিরাও পাথর ফেলে হত্যা করতে এসে দেখে মুহাম্মদ সা. নেই। তারাও মুহাম্মদ সা.-এর ফিরে আসার অপেক্ষা করতে থাকে। অনেকক্ষণ অপেক্ষা করে সাহাবার মদিনায় ফিরে দেখেন রাসূল সা. মসজিদে নববীতে। তখন মুহাম্মদ সা. ওহীর কথা সাহাবাদের জানান এবং বনু নাযিরের বিশ্বাসভঙ্গ ও মুনাফিকির কারণে তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের ঘোষণা দেন। 

তিনি মুহাম্মদ বিন মাসলামাকে ইহুদীদের কাছে পাঠিয়ে বার্তা পাঠান তিনদিনের মধ্যে মদিনা ছেড়ে চলে যেতে নতুবা তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা হবে। যুদ্ধের ঘোষণা শুনে ইহুদীরা একটুও বিচলিত হয়নি। কারণ তাদের বিশ্বাস ছিল তাদের শক্তিশালী দুর্গগুলো তাদের রক্ষা করবে। আল্লাহর রাসূল সা. তাদের বিরুদ্ধে হত্যার ষড়যন্ত্রের যে অভিযোগ এনেছেন তা তারা অস্বীকার করেনি উপরন্তু তারা আল্লাহর রাসূলের সাথে করা চুক্তি ভঙ্গের ঘোষণা করলো। 

এদিকে আরেক ইহুদী গোত্র বনু কুরাইজা তাদের সাহায্যে এগিয়ে আসার গোপন আশ্বাস দিলে আল্লাহর রাসূল সা. বনু নাযিরের ওপর অবরোধ বহাল রেখেই বনু কুরাইজার দুর্গগুলোর উদ্দেশ্যে মহড়া দিয়ে আসলেন। মুহাম্মদ সা.-এর এই রূপ দেখে বনু কুরাইজা তাদের সাহায্যে এগিয়ে আসে নি। আবার মুনাফিকদের মধ্য থেকে আব্দুল্লাহ বিন উবাই তাদের সাহায্যে এগিয়ে আসার কথা জানালেও সেও এগিয়ে আসেনি। অবশেষে বনু নাযির আত্মসমর্পন করে। 

এই ঘটনাকে উদ্দেশ্য করে মহান রাব্বুল আলামীন সূরা হাশর নাজিল করেছেন।  আল্লাহ তায়ালা সূরা হাশরের ২ - ৪ নং আয়াতে বলেন,

//তিনিই আহলে কিতাবদের মধ্যে যারা কাফের, তাদেরকে প্রথমবার একত্রিত করে তাদের বাড়ী-ঘর থেকে বহিস্কার করেছেন। তোমরা ধারণাও করতে পারনি যে, তারা বের হবে এবং তারা মনে করেছিল যে, তাদের দূর্গগুলো তাদেরকে আল্লাহর কবল থেকে রক্ষা করবে। অতঃপর আল্লাহর শাস্তি তাদের উপর এমনদিক থেকে আসল, যার কল্পনাও তারা করেনি। আল্লাহ তাদের অন্তরে ত্রাস সঞ্চার করে দিলেন। তারা তাদের বাড়ী-ঘর নিজেদের হাতে এবং মুসলমানদের হাতে ধ্বংস করছিল। অতএব, হে চক্ষুষ্মান ব্যক্তিগণ, তোমরা শিক্ষা গ্রহণ কর।

আল্লাহ যদি তাদের জন্যে নির্বাসন অবধারিত না করতেন, তবে তাদেরকে দুনিয়াতে শাস্তি দিতেন। আর পরকালে তাদের জন্যে রয়েছে জাহান্নামের আযাব। এটা এ কারণে যে, তারা আল্লাহ ও তাঁর রসূলের বিরুদ্ধাচরণ করেছে। যে আল্লাহর বিরুদ্ধাচরণ করে, তার জানা উচিত যে, আল্লাহ কঠোর শাস্তিদাতা।//

এখানে এটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল যে, তারা ভয় পেয়ে গিয়েছিল। এমন পরিস্থিতি হবে তা ইহুদীরাতো কল্পনা করেনি, মুসলিমরাও ভাবতে পারে নি এত সহজে বনু নাযির আত্মসমর্পন করবে। এখানে আল্লাহ তায়ালা আরো বলেছেন তারা যদি আত্মসমর্পন না করে, দেশান্তরী না হয়ে যুদ্ধ করতো তবে তাদের জন্য আরো ভয়ংকর শাস্তি অপেক্ষা করতো। যেমন শাস্তি পেয়েছে খন্দক যুদ্ধের পরে বনু কুরাইজা। 

সূরা হাশরের ৪ নং আয়াতে আল্লাহ তায়ালা আরেকটি প্রসঙ্গ টেনে এনেছেন যাতে করে মুসলিমরা হীনমন্যতায় না ভুগে। বনু নাযির যাতে দ্রুতই আত্মসমর্পন করে সেজন্য রাসূল সা.-এর নির্দেশে মুসলিম সেনাবাহিনী বনু নাযিরের কিছু খেজুর গাছ কেটে ফেলে। আল্লাহ বলেন,

//তোমরা যে কিছু কিছু খেজুর গাছ কেটে দিয়েছ এবং কিছু না কেটে ছেড়ে দিয়েছ, তা তো আল্লাহরই আদেশ এবং যাতে তিনি অবাধ্যদেরকে লাঞ্ছিত করেন।//

বনু নাযিরের ইহুদীরা সম্পদশালী ছিল। তাদের গর্বের একটি বড় কারণ ছিল তারা অনেক খেজুর বাগানের মালিক। অর্থাৎ তাদের খাদ্যের অভাব হবে না। কিন্তু তারা যখন দেখলো মুহাম্মদ সা. তাদের গাছগুলোর কিছু কিছু কেটে ফেলতে শুরু করেছে তখন তারা বিচলিত হয়ে পড়লো। কারণ তারা জানতো মুসলিমদের যুদ্ধনীতিতে ফসলের গাছ কাটা নিষেধ।    

যখন মুসলিম বাহিনী কিছু কিছু খেজুর গাছ নষ্ট করে দিচ্ছিলেন তখন মদিনার মুনাফিকরা ও বনু কুরাইজা এমনকি বনু নাযির গোত্রের লোকও হৈ চৈ করতে শুরু করলো যে, মুহাম্মাদ সা. "ফাসাদ ফিল আরদ" বা পৃথিবীতে বিপর্যয় সৃষ্টি করতে নিষেধ করেন; কিন্তু দেখো, তরুতাজা শ্যামল ফলবান গাছ কাটা হচ্ছে ৷ এটি কি "ফাসাদ ফিল আরদ" নয়? এই সময় আল্লাহ তা'আলা এই নির্দেশ নাযিল করেলেন, "তোমরা যেসব গাছ কেটেছো এবং যা না কেটে অক্ষত রেখেছো এর কোন একটি কাজও নাজায়েয নয় ৷ বরং এ উভয় কাজেই আল্লাহর সম্মতি রয়েছে।" 

এ থেকে শরীয়াতের এ বিধানটি পাওয়া যায় যে, সামরিক প্রয়োজনে যেসব ধ্বংসাত্মক ও ক্ষতিকর তৎপরতা অপরিহার্য হয়ে পড়ে তা "ফাসাদ ফিল আরদ" বা পৃথিবীতে বিপর্যয় ও অশান্তি সৃষ্টির সংজ্ঞায় পড়ে না ৷ "ফাসাদ ফিল আরদ" হলো কোন সেনাবাহিনীর মাথায় যদি যুদ্ধের ভূত চেপে বসে এবং তারা শত্রুর দেশে প্রবেশ করে শস্যক্ষেত, গবাদি পশু, বাগান, দালানকোঠা, প্রতিটি জিনিসই নির্বিচারে ধ্বংস ও বরবাদ করতে থাকে। হযরত আবু বকর সিদ্দিক সিরিয়ায় সেনাবাহিনী পাঠানোর সময় যে নির্দেশ দিয়েছিলেন যুদ্ধের ব্যাপারে সেটিই সাধারণ বিধান। তিনি নির্দেশ দিয়েছিলেন, ফলবান বৃক্ষ কাটবে না, ফসল ধ্বংস করবে না এবং তিনি জনবসতি বিরাণ করবে না। 

কুরআনে বিপর্যয় সৃষ্টিকারী মানুষদের নিন্দা ও সমালোচনা করতে গিয়ে এ কাজের জন্য তাদের তিরষ্কার ও ভীতি প্রদর্শন করে বলা হয়েছেঃ "যখন তারা ক্ষমতাসীন হয় তখন শস্যক্ষেত ও মানব বংশ ধ্বংস করে চলে।" (বাকারাহ, ২০৫) হযরত আবু বকরের রা. এর নীতি ছিল কুরআনের এ শিক্ষারই হুবহু অনুসরণ। তবে সামরিক প্রয়োজন দেখা দিলে বিশেষ নির্দেশ হলো, শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধে জয়লাভের জন্য কোনো ধ্বংসাত্মক কাজ অপরিহার্য হয়ে পড়লে তা করা যেতে পারে। 

এরপর আল্লাহ তায়ালা সূরা হাশরের ৬ থেকে ১০ নং আয়াতে বনু নাযির থেকে প্রাপ্ত সম্পদ কীভাবে বন্টিত হবে তা নিয়ে আলোচনা করেছেন। অবরোধের একটা পর্যায়ে যখন বনু নাযির বুঝতে পারলো কেউ তাদের সাহায্যে এগিয়ে আসবে না তখন তারা ভীত হয়ে পড়লো। তারা মুহাম্মদ সা.-এর কাছে প্রাণভিক্ষা চাইলো। মুহাম্মদ সা. তাদের প্রাণের নিরাপত্তা দিতে রাজি হলেন এবং মদিনা থেকে তাদের চলে যাওয়ার নির্দেশ দিলেন। সেই সাথে তাদের জানালেন তারা শুধু ততটুকু সম্পদ নিতে পারবে যতটুকু উটের পিঠে বোঝাই করা সম্ভব। তবে কোনো অস্ত্র নেওয়া যাবে না। সব অস্ত্র রেখে যেতে হবে। 

বনু নাযির যখন চলে যায় তখন মুসলিমরা অনেক সম্পদ পায়। এই সম্পদ পাওয়ার জন্য মুসলিমদের যুদ্ধ করতে হয় নি। তাই এই সম্পদকে গণিমত না বলে ফাই বলা হয়। গণিমতের বিধান আর ফাইয়ের বিধান একই রকম নয়। আল্লাহ তায়ালা বলেন, 

//  আল্লাহ তাদের কাছ থেকে তাঁর রসূলকে যে ধন-সম্পদ দিয়েছেন, তজ্জন্যে তোমরা ঘোড়ায় কিংবা উটে চড়ে যুদ্ধ করনি, কিন্তু আল্লাহ যার উপর ইচ্ছা, তাঁর রসূলগণকে প্রাধান্য দান করেন। আল্লাহ সবকিছুর উপর সর্বশক্তিমান। আল্লাহ জনপদবাসীদের কাছ থেকে তাঁর রসূলকে যা দিয়েছেন, তা আল্লাহর, রসূলের, তাঁর আত্নীয়-স্বজনের, ইয়াতীমদের, অভাবগ্রস্তদের এবং মুসাফিরদের জন্যে, যাতে ধনৈশ্বর্য্য কেবল তোমাদের বিত্তশালীদের মধ্যেই পুঞ্জীভূত না হয়। রসূল তোমাদেরকে যা দেন, তা গ্রহণ কর এবং যা নিষেধ করেন, তা থেকে বিরত থাক এবং আল্লাহকে ভয় কর। নিশ্চয় আল্লাহ কঠোর শাস্তিদাতা।এই ধন-সম্পদ দেশত্যাগী নিঃস্বদের জন্যে, যারা আল্লাহর অনুগ্রহ ও সন্তুষ্টিলাভের অন্বেষণে এবং আল্লাহ তাঁর রসূলের সাহায্যার্থে নিজেদের বাস্তুভিটা ও ধন-সম্পদ থেকে বহিস্কৃত হয়েছে। তারাই সত্যবাদী //

মহান রাব্বুল আলামীন এখানে বিস্তারিত বলে দিয়েছেন ফাইয়ের সম্পদ কীভাবে বন্টিত হবে। রাসূল সা. এই সম্পদ থেকে যৎসামান্য নিজের ও তার পরিবারের জন্য গ্রহণ করেন। এই সম্পদ দেওয়া হয়েছে মূলত মুহাজিরদেরকে যারা তাদের সর্বস্ব ত্যাগ করে মদিনায় এসেছেন। একইসাথে মুহাজিররা এতোদিন আনসারদের যেসব সম্পদ ব্যবহার করতো সেগুলোও আনসার ফেরত দিয়ে নিজেরাই স্বাবলম্বী হতে থাকেন। 

এরপর মহান রাব্বুল আলামীন মুনাফিকদের চরিত্র সম্পর্কে আমাদের জানান। রসূলুল্লাহ সা. যে সময় বনু নযিরকে মদীনা ছেড়ে চলে যাওয়ার জন্য সময় দিয়ে নোটিশ দিয়েছিলেন এবং তাদের বিরুদ্ধে অবরোধ শুরু হতে এখনো কয়েকদিন দেরী ছিল সেই সময় এই আয়াতগুলো নাযিল হয়েছিলো। রসূলুল্লাহ সা. বনু নাযিরকে এই নোটিশ দিলে আবদুল্লাহ ইবনে উবাই এবং মদীনার অন্যান্য মুনাফিক নেতারা তাদের বলে পাঠালো যে, আমরা দুই হাজার লোক নিয়ে তোমাদের সাহায্য করার জন্য আসবো। আর বনু কুরাইযা এবং বনু গাতফানও তোমাদের সাহায্যে এগিয়ে আসবে। অতএব তোমরা মুসলমানদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াও এবং কোন অবস্থায়ই তাদের কাছে আত্মসমর্পণ করো না। তারা তোমাদের বিরুদ্ধে লড়াই করলে আমরাও তাদের বিরুদ্ধে লড়াই করবো। আর তোমরা এখান থেকে বহিষ্কৃত হলে আমরাও চলে যাব। এই প্রেক্ষাপটে আল্লাহ তা'আলা এ আয়াতগুলো নাযিল করেছেন। 

 তিনি হাশরের ১১ থেকে ১৭ নং আয়াতে আব্দুল্লাহ বিন উবাইদের বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করেন, 

//আপনি কি মুনাফিকদেরকে দেখেন নি? তারা তাদের কিতাবধারী কাফের ভাইদেরকে বলে, তোমরা যদি বহিস্কৃত হও, তবে আমরা অবশ্যই তোমাদের সাথে দেশ থেকে বের হয়ে যাব এবং তোমাদের ব্যাপারে আমরা কখনও কারও কথা মানব না। আর যদি তোমরা আক্রান্ত হও, তবে আমরা অবশ্যই তোমাদেরকে সাহায্য করব। আল্লাহ তা’আলা সাক্ষ্য দেন যে, ওরা নিশ্চয়ই মিথ্যাবাদী।

যদি তারা (বনু নযির) বহিস্কৃত হয়, তবে মুনাফিকরা তাদের সাথে দেশত্যাগ করবে না আর যদি তারা আক্রান্ত হয়, তবে তারা তাদেরকে সাহায্য করবে না। যদি তাদেরকে সাহায্য করে, তবে অবশ্যই পৃষ্ঠপ্রদর্শন করে পলায়ন করবে। এরপর কাফেররা কোন সাহায্য পাবে না। নিশ্চয়ই তারা আল্লাহর চাইতে তোমাদের বেশি ভয় করে। এটা এ কারণে যে, তারা এক নির্বোধ সম্প্রদায়। 

তারা সংঘবদ্ধভাবেও তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে পারবে না। তারা যুদ্ধ করবে কেবল সুরক্ষিত জনপদে অথবা দুর্গ প্রাচীরের আড়াল থেকে। তাদের পারস্পরিক কোন্দল প্রচন্ড হয়ে থাকে। আপনি তাদেরকে ঐক্যবদ্ধ মনে করবেন; কিন্তু তাদের অন্তর শতধাবিচ্ছিন্ন। এটা এ কারণে যে, তারা এক কান্ডজ্ঞানহীণ সম্প্রদায়।

তারা সেই লোকদের মত, যারা তাদের নিকট অতীতে নিজেদের কর্মের শাস্তিভোগ করেছে। তাদের জন্যে রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি। তারা শয়তানের মত, যে মানুষকে কাফের হতে বলে। অতঃপর যখন সে কাফের হয়, তখন শয়তান বলেঃ তোমার সাথে আমার কোন সম্পর্ক নেই। আমি বিশ্বপালনকর্তা আল্লাহ তা’আলাকে ভয় করি। অতঃপর উভয়ের পরিণতি হবে এই যে, তারা জাহান্নামে যাবে এবং চিরকাল তথায় বসবাস করবে। এটাই জালেমদের শাস্তি।// 

মহান রাব্বুল আলামীন আমাদের শিক্ষাগ্রহণ করার তাওফিক দান করুন।