২২ ডিসে, ২০২২

খিলাফত পর্ব-৪১ : যেভাবে খুন হলেন উসমান রা.

 

মারওয়ান ইবনে হাকাম মদিনাবাসীর সঙ্গে খারাপ আচরণ করলো। ক্ষমতার গরম ও দাম্ভিকতা দেখালো। উসমান রা.-এর ইচ্ছার বিরুদ্ধে হলেও তিনি এটাকে প্রতিরোধ করতে সক্ষম হননি। এই ঘটনা তাঁকে খাদের কিনারে ফেলে দিয়েছে। মারওয়ানের ক্ষুব্ধ আচরণের ফলে আলী রা. রাজনৈতিক বিষয়ে আর হস্তক্ষেপ না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তিনি উসমান রা.-এর সাথে অভিমানমূলক কথা বললেও তিনি উসমান রা.-কে রক্ষায় সব চেষ্টা করেছিলেন।

বিভিন্ন শহরের বাসিন্দাগণের কাছে মারওয়ানের দাম্ভিক আচরণের খবর পৌঁছে গেছে। তার সাথে আরো রঙচঙও যুক্ত হয়েছে। যা স্বাভাবিকভাবেই হয়। এই কারণে হযরত উসমান রা.-এর প্রতি হযরত আলী রা-এর রাগের খবরও পৌঁছে গেছে। কথা ছিল উসমান রা. পূর্ববর্তী দুই খলিফার নীতি অনুসরণ করবেন। অতএব জনগণ ধারণা করেছিল তিনি নিকটাত্মীয়দের দায়িত্ব থেকে প্রত্যাহার করবেন। কিন্তু তা তো হয়ই নাই বরং উসমান রা.-এর আত্মীয়রা তাঁকে আরো বেশি পরিবেষ্টিত করে ফেললো।

ইত্যাদি বিষয়ে সারারাষ্ট্রে উসমান রা.-এর বিরুদ্ধে কেউ কেউ জনগণকে ক্ষেপিয়ে তুললো। মিসর, কুফা ও বসরার বাসিন্দারা খলীফার বিরুদ্ধে পরস্পর যোগাযোগ করতে লাগলো। এখানেও ষড়যন্ত্র ছিল, যা রাষ্ট্রের গোয়েন্দারা ধরতে ব্যর্থ হয়েছে। মদিনায় অবস্থানরত তিনজন সাহাবী যেমন আলী রা., তালহা রা., যুবাইর রা.-এর লিখিত জাল পত্রাদির মাধ্যমে জনগণকে উত্তেজিত করা হয়েছে। জাল চিঠির মাধ্যমে উসমান রা.-এর হত্যার আহ্বান ও দ্বীনের সাহায্যের জন্য আহ্বান জানানো হয়। এটাকে হাল যমানার শ্রেষ্ঠ জিহাদ বলে ঘোষণা করা হয়। অথচ সিনিয়র সাহাবারা এসব বিষয়ে কিছুই জানতেন না।

৩৫ হিজরীর ঈদুল ফিতরের পর শাওয়াল মাসে মিসরের বাসিন্দারা ৪জন নেতার নেতৃত্বে ৪ ভাগে মদিনায় রওয়ানা হয়। তারা ছিলেন প্রায় এক হাজার জন। একইভাবে কুফাবাসী ও বসরাবাসীরাও চার নেতার অধীনে আসতে লাগলো। মিসরের বাসিন্দারা হযরত আলী ইব্ন আবূ তালিব রা.-কে আমীর বানানোর প্রতি আগ্রহী। কুফার বাসিন্দারা হযরত যুবাইর রা.-কে আমীর নির্বাচন করতে চায় এবং বসরার বাসিন্দারা হযরত তালহা রা.-এর আমীর হওয়ার ব্যাপারে দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করে। তবে তারা এই বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়নি। তারা মূলত উসমান রা.-এর অপসারণটাই মূখ্য দাবি হিসেবে বিবেচনা করেছে।

তাই প্রতিটি দল তাদের শহর থেকে রওয়ানা হয় এবং মদিনার আশপাশ পর্যন্ত পৌঁছে। তিনটি দলই চিঠির মাধ্যমে একে অন্যের সাথে ওয়াদাবদ্ধ হয়েছিল। সেই মুতাবিক শাওয়াল মাসে একদল যুখাশাব -এ অবতরণ করেন। অন্য একদল আল আওয়াসে এবং অধিকাংশ লোক যুল মারওয়াতে তাঁবু করেন। তারা মদিনাবাসী হতে ভীত ছিল বিধায় পৌঁছার পূর্বেই তারা গুপ্তচর প্রেরণ করে লোকজনের খবরাখবর নেয়। কিন্তু মদিনায় তাদের বাধা দেওয়ার জন্য কেউ ছিল না। উসমান রা.-এর কঠোর নিষেধে তাঁর আত্মীয়দের কেউ অর্থাৎ উমাইয়া বংশের লোকেরাও কোনো প্রতিরোধের ব্যবস্থা নেয়নি।

মিসরিয়রা আলী রা.-এর সঙ্গে দেখা করার ব্যাপারে আগ্রহী ছিল। আলী রা. সেই সুযোগ গ্রহণ করে তাদের একটি প্রতিনিধি দলের সঙ্গে কথা বললেন। তিনি তাদের প্রশ্নের জবাব দিলেন এবং তাদের কাছে পাঠানো জাল চিঠির বিষয় অস্বীকার করলেন। তাদেরকে কিয়ামতের ভয় দেখালেন। মিসরিয়দের ফিরে যেতে বললেন। তিনি তাদের বললেন, মহান আল্লাহ্ যেন তোমাদেরকে ভোরের আলো না দেখায়।” তাঁরা বলেন, 'জি হ্যাঁ' এ বলে তারা তাঁর কাছ থেকে চলে গেল।

বসরাবাসীরা তালহা রা.-এর কাছে আগমন করলো। বসরাবাসীরা হযরত তালহা রা.-কে সালাম দিলেন। তখন তিনি তাদের সাথে উচ্চ স্বরে কথা বললেন এবং তাদেরকে তাড়িয়ে দিলেন। কুফাবাসীদের ক্ষেত্রেও হযরত যুবাইর রা. অনুরূপ আচরণ করলেন। তারপর প্রত্যেকটি দলই তাদের সম্প্রদায়ের কাছে ফেরত রওয়ানা হলো এবং তারা প্রকাশ করতে লাগল যে, তারা তাদের শহরে ফিরে যাচ্ছে। ফেরত পথে কয়েক দিন ভ্রমণ করার পর তারা পুনরায় পবিত্র মদীনার দিকে প্রত্যাবর্তন করে এবং কিছুক্ষণের মধ্যেই মদীনাবাসীরা তাদের তাকবীরের আওয়াজ শুনতে পেল। তিনদল বিদ্রোহী মদিনা ঘিরে ফেললো।

বিদ্রোহীরা ঘোষণা দিল, যে অস্ত্র থেকে বিরত থাকবে সে নিরাপত্তা লাভ করবে। মদিনার প্রায় সব লোকজন বিরত রইল। তারা তাদের ঘরে অবস্থান করতে লাগলো। এভাবে কয়েকদিন চলে গেল। এসব ঘটনা ঘটছে কিন্তু সাধারণ লোকজন জানে না বিদ্রোহীরা কি করছে এবং কাকে তারা লক্ষ্যবস্তু নির্ধারণ করছে। এর মধ্যে আমীরুল মু'মিনীন হযরত উসমান রা. ঘর থেকে বের হন এবং মসজিদে নামায পড়ান। মদিনাবাসীগণ তাঁর পেছনে নামায পড়েন। অন্যান্য সাহাবী বিদ্রোহীদের কাছে যান এবং তাদেরকে ফেরত চলে যাবার জন্যে বার বার অনুরোধ করেন। এমনকি আলী রা. মিসরীয়দেরকে বললেন, “তোমাদের চলে যাওয়ার পর, অভিমত পাল্টানোর পর তোমরা আবার কেন ফিরে এসেছো?”

উত্তরে তারা বলল, 'আমরা একটি দূতের কাছে একটি পত্র পেলাম সে পত্রে আমাদেরকে হত্যা করার জন্যে বলা হয়েছে। মিসরিয়রা তাদের পাশে দ্রুতগতিতে একটি উটকে যেতে দেখে তাদের সন্দেহ হয়। তখন তারা তাকে ধরে ফেলল এবং তারা তার দেহ ও মালপত্র তল্লাশি করল। একটি পাত্রের মধ্যে একটি পত্র পাওয়া গেল। পত্রে দেখা গেল হযরত উসমান রা. তাদের মুহাম্মদ ইবনে আবু বকরসহ কয়েকজন মিসরিয় নেতাকে হত্যার নির্দেশ দিয়েছেন, কয়েকজনকে শূলে চড়াবার হুকুম দিয়েছেন ও অন্য কয়েকজনের উল্টো দিক থেকে হাত-পা কেটে ফেলার আদেশ দিয়েছেন। পত্রের মধ্যে উসমান রা.-এর সীলমোহর ছিল। আর দূতটি ছিল হযরত উসমান রা.-এর একজন গোলাম। আবার উটটিও ছিল হযরত উসমান রা.-এরই । যখন বিদ্রোহীরা ফেরত আসল তারা তখন পত্রটি সঙ্গে নিয়ে আসল এবং ঘুরে ঘুরে লোকজনকে তা প্রদর্শন করতে লাগল।

এ সম্পর্কে মদিনার জনগণ আমীরুল মু'মিনীনকে জিজ্ঞেস করলেন। তিনি বলেন, আল্লাহর শপথ! আমি এটা লিখিও নাই কিংবা হুকুমও করি নাই। আর এ ব্যাপারে আমি কোন প্রকার অবহিতও নই। সীলমোহর কোন কোন সময় জালও হয়ে থাকতে পারে। মদিনাবাসীদের সবাই উসমান রা.-কে বিশ্বাস করেননি। সত্য বলে ধারণাকারীরা এটাকে সত্য ও সঠিক বলে গণ্য করল। আর জাল বলে ধারণাকারীরা চিঠিকে জাল বলে আখ্যায়িত করল।

ইবনে জারীর র. বলেন, মিসরের গভর্নর আব্দুল্লাহ বিন সা'দের প্রতি হযরত উসমান রা.-এর পক্ষ থেকে লিখিত পত্রটি যার কাছে পাওয়া গিয়েছিল তার নাম ছিল আবুল আওয়ার আস-সালামী আর উটটি ছিল হযরত উসমান রা.-এর। উসমান রা. অবশ্য আগেই জানিয়েছেন তাঁর উট হারানো গিয়েছে। বিদ্রোহীদের কাছ থেকে শক্ত অভিযোগ পাওয়ার পর মদিনাবাসীরা যার যার গৃহে ফেরত গেল। তারা উসমান রা.-কে তাঁর নিজের ওপর ছেড়ে দিল।

এ দিনগুলোতে হযরত উসমান রা. লোকজনদেরকে নিয়ে জামায়াতে নামায আদায় করছিলেন। এরপর এক জুমার দিন খলীফা হযরত উসমান রা. মিম্বরে দণ্ডায়মান ছিলেন। বিদ্রোহীরা তাঁকে লাঞ্চিত করলো। মিম্বার থেকে নামিয়ে দিল। আমর ইবনুল আস রা., যার প্রত্যাহার নিয়ে এতো কাহিনীর জন্ম হলো তাঁর হস্তক্ষেপে বিদ্রোহীরা সরে গেল। উসমান রা. নামাজ পড়ালেন। কিছু বর্ণনায় এমনও পাওয়া গেছে নামাজ শেষে বিদ্রোহীরা পাথর নিক্ষেপ করেছে। এতে উসমান রা. আহত হয়েছেন। আলী রা. ঢাল হয়ে তাঁকে রক্ষা করে সরিয়ে নিলেন। সাথে তালহা রা. ও যুবায়ের রা.ও ছিলেন।

সাহাবায়ে কিরামের মধ্য হতে একটি দল যেমন আবূ হুরায়রা রা., ইবন উমর রা. এবং যায়িদ ইবন সাবিত রা. হযরত উসমান রা.-এর পক্ষ হতে যুদ্ধ করার জন্যে বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে এগিয়ে আসেন। হযরত উসমান রা. তাদের কাছে লোক প্রেরণ করলেন এবং তাদের থেকে ওয়াদা নিলেন যাতে আল্লাহ্ তা'আলার ফয়সালায় হস্তক্ষেপ থেকে তাঁরা বিরত থাকেন ও চুপ থাকেন। জুমআর দিনের এই ঘটনার পর থেকে উসমান রা. ঘরে নামাজ পড়তে বাধ্য হলেন। বিদ্রোহীরা তাঁকে ঘর থেকে বের হতে বাধা দিয়েছিল।

বিদ্রোহীরা তাঁকে গৃহে অবরুদ্ধ থাকতে বাধ্য করে, তাঁর জীবন সংকীর্ণ করে তোলে এবং গৃহের অভ্যন্তরে তাঁকে অবরুদ্ধ করে রাখে। অনেক সাহাবী নিজ নিজ গৃহের অভ্যন্তরে অবস্থান করতে লাগলেন। সাহাবীদের সন্তানদের একটা দল তাদের নিজ নিজ পিতার নির্দেশে উসমান রা.-এর দিকে ছুটে যায়। তাঁদের মধ্যে হাসান-হুসাইন রা., আবদুল্লাহ্ ইবন যুবাইর রা.ও ছিলেন। আরো ছিলেন আব্দুল্লাহ্ ইব্ন আমর রা.। এরা উসমান রা. পক্ষ নিয়ে বিতণ্ডায় লিপ্ত হন এবং প্রতিরোধ গড়ে তোলেন, যাতে অপরাধী চক্রের কেউ খলিফার কাছে পৌঁছতে সক্ষম না হয়। তবে বেশিরভাগ মদিনাবাসী মনে করেছিলেন খলিফা অবরোধকারীদের কিছু দাবি মেনে নিবেন এবং এই সমস্যার অবসান হবে।

বিদ্রোহীরা কেউই উসমান রা.-এর কথাকে বিশ্বাস করেন নি। এছাড়াও মদিনার অনেক প্রবীণ সাহাবীও ধারণা করেন যে, এ চিঠির ঘটনা হযরত উসমান রা.-এর নির্দেশক্রমেই ঘটেছে। মিসরীয় বিদ্রোহীদের সঙ্গে সমঝোতা হওয়ার পর এমন ঘটনা মোটেই সমীচীন ছিল না। এ সব কিছুই তো সমঝোতার পরিপন্থী। উসমান রা. বিদ্রোহীদের অভিযোগ অস্বীকার করলে, বিদ্রোহীরা বললো, 'পত্রে তো আপনার সীলমোহর আছে!' তিনি বললেন, 'কোন ব্যক্তি এ সীলমোহর জাল করতে পারে।' তখন তারা বললো, পত্রতো ছিল আপনার উটের উপর সওয়ার আপনার সেবকের নিকট। তখন তিনি বললেন : 'আল্লাহর কসম! এ সম্পর্কে আমি কিছুই জানি না।'

এ সমস্ত কথার পর বিদ্রোহীরা তাঁকে বলে, আপনি এ পত্র লিখে খিয়ানত তথা বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন; আর যদি আপনি না লিখে থাকেন বরং আপনার অগোচরে অন্য কেউ লিখে থাকে তাহলে তো আপনি অক্ষম প্রমাণিত হলেন। আর আপনার মতো অক্ষম ব্যক্তি তো খিলাফতের যোগ্য নয়। এই ঝামেলার জন্য আপনার খিয়ানত তথা বিশ্বাসহীনতা অথবা অক্ষমতাই প্রধান কারণ। অন্যদিকে আমীরুল মুমিনিন উসমান রা. ও তাঁর সঙ্গীরা ভেবেছে বিদ্রোহীরাই ষড়যন্ত্র করে জাল পত্র লিখেছে তাদের উদ্দেশ্য হাসিল করার জন্য।

আমীরুল মু'মিনীন-এর নিকট তাদের দাবি ছিল হয় তিনি পদত্যাগ করবেন অথবা মারওয়ান ইবনুল হাকামকে তাদের নিকট সমর্পণ করবেন। কারণ ইতোমধ্যে পত্রসহ আটক ব্যক্তি থেকে জানা গেছে মারওয়ান তাকে আব্দুল্লাহ বিন সা'দের নিকট পত্রসহ পাঠিয়েছে। বিদ্রোহীরা স্বয়ং খলিফাকে হত্যা করবে এমন চিন্তা আসলে কেউ করতে পারেনি। খলিফার অবর্তমানে সা'দ ইব্ন হারব লোকদের নিয়ে নামায আদায় করেন। কোনো কোনো সময় তালহা রা., আবু আইয়ুব রা., সাহল বিন হুনাইনও নামাজের ইমামতি করেছেন। তবে জুমআর নামাজ পড়িয়েছেন আলী রা.। খলিফা উসমান রা. পরিণতির জন্য অপেক্ষা করছিলেন। তিনি কোনো সিদ্ধান্ত দিচ্ছিলেন না। তাঁর পক্ষে কাউকে দাঁড়াতেও দিচ্ছিলেন না। অবরোধ এক মাসের বেশি অব্যাহত থাকে। কারো কারো মতে তা ছিল চল্লিশ দিনব্যাপী।

যিলকদ মাসের শেষের দিক থেকে ১৮ই যিলহজ্জ পর্যন্ত অবরোধ অব্যাহত ছিল। সেদিন ছিল জুমআর দিন। উসমান রা.-কে বিপদ থেকে রক্ষার জন্য প্রায় সাতশত জন তার গৃহের পাশে ছিলেন। তাঁদের মধ্যে নেতৃস্থানীয় সাহাবী ছিলেন আব্দুল্লাহ ইবনে উমর, আব্দুল্লাহ ইবন যুবাইর, হাসান ইবনে আলী, হুসাইন ইবনে আলী, মারওয়ান এবং আবূ হুরায়রা। উসমান রা.-এর মুক্ত করা অনেক দাসও উপস্থিত ছিল।

তিনি তাদের বলেছিলেন, "যার উপর আমার অধিকার আছে, যে আমার আনুগত্যের মধ্যে আছে, আমি কসম দিয়ে বলছি সে যেন হাত গুটিয়ে নিজ গৃহে ফিরে যায়। তিনি তাঁর দাসদেরকে বললেন, যে তরবারি কোষবদ্ধ রাখবে, সে আজ থেকে মুক্ত। ফলে ভেতর থেকে লড়াইয়ে ভাটা পড়ে গেল। কিন্তু বাইরে থেকে বিদ্রোহীরা উত্তপ্ত হয়ে পড়ে। পরিস্থিতি হয়ে উঠে তীব্রতর। উসমান রা. স্বপ্নে দেখেন, যা থেকে তাঁর সময় ফুরিয়ে এসেছে বলে বোঝা যায়। গৃহ ত্যাগ করার জন্য তিনি কড়া নির্দেশ দানের পর উসমান রা.-এর গৃহ ত্যাগকারী সর্বশেষ ব্যক্তিটি ছিলেন হাসান ইব্ন আলী রা.। তিনিও বেরিয়ে আসেন।

১৩ জন লোক সঙ্গে নিয়ে হযরত আবূ বকর রা.-এর ছেলে মুহাম্মদ আগমন করে তাদের দাবি পুনরায় পেশ করে। কিন্তু উসমান রা. কোনো দাবি মেনে নিতে অস্বীকার করেন। মুহাম্মদ বিন আবু বকর আমিরুল মু'মিনিন উসমান রা.-এর সাথে বিতর্ক জুড়ে দিলেন। অনেকগুলো সূত্র মতে তিনি আব্দুল্লাহ বিন সা'দের কাছে লেখা চিঠি নিয়ে প্রশ্ন করেছেন। কুরাআনের পরিবর্তনকারী হিসেবে অভিযোগ করেছেন। স্বজনপ্রীতির অভিযোগ করেছেন। উসমান রা. সব অভিযোগ অস্বীকার করেন। ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টা করেন। এই সময় হট্টগোল শুরু হয়। হট্টগোলের মধ্যে কয়েকজন লোক উসমান রা.-কে তীরের ফলা/ খঞ্জর / ছুরি দ্বারা আঘাত করে পালিয়ে যায়। এই আঘাতে উসমান রা. রক্তাক্ত হন এবং শাহদাতবরণ করেন।

মারওয়ান ইবনুল হাকাম উসমান রা.-এর নামে আব্দুল্লাহ বিন সা'দের নিকট এ পত্র লিখে এবং এ সম্পর্কে যুক্তি হিসাবে কুরআন মজীদের নিম্নোক্ত আয়াত উপস্থাপন করে, যারা আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে, এবং পৃথিবীতে বিপর্যয় সৃষ্টি করে বেড়ায়, এটাই তাদের শাস্তি যে তাদেরকে হত্যা করা হবে, শূলীবিদ্ধ করা হবে অথবা বিপরীত দিক থেকে তাদের হস্তপদ কর্তন করা হবে অথবা তাদেরকে দেশ থেকে নির্বাসিত করা হবে। দুনিয়াতে এটাই তাদের লাঞ্ছনা, অবমাননা, আর আখিরাতে তাদের জন্য রয়েছে মহা শাস্তি। (সূরা মায়িদা ৫; আয়াত ৩৩)।

মারওয়ান ইবনুল হাকামের মতে যারা উসমান রা.-এর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করছে, তারা সকলেই পৃথিবীতে বিপর্যয় সৃষ্টিকারী। অথচ সেই ছিল বিপর্যয়কারী! বিদ্রোহীদের বুঝিয়ে ফিরিয়ে দেয়ার পরও খলিফার সীলমোহর ব্যবহার, তাঁর উট ব্যবহার ও তাঁর গোলামকে পত্র প্রেরণের জন্য ব্যবহার করে মারওয়ান বিপর্যয় ডেকে এনেছে।

২১ ডিসে, ২০২২

খিলাফত পর্ব-৪০ : উসমান রা.-এর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ


উসমান রা.-এর বিরুদ্ধে বিদ্রোহের সূত্রপাত কুফায়। কুফার একটি মহল উমার রা.-এর সময় থেকেই বিশৃঙ্খলা করতো। নানানভাবে তারা গভর্নরকে বিতর্কিত করতো। এর ফলে সেখানে রাষ্ট্র পরিচালনা করা কঠিন হয়ে পড়েছিল। বার বার তারা জনগণকে গভর্নরের বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তুলতো। জনগণ ঐ মহলের উস্কানিতে গভর্নর পরিবর্তনের দাবি জানাতো। উমার রা.-এর সময়ে তারা শুধু গভর্নরের দোষ খুঁজে পরিবর্তনের কথা বলা হতো। কিন্তু উসমান রা.-এর নরম স্বভাবকে কাজে লাগিয়ে তারা এবার তাদের পছন্দমতো ব্যক্তিকে গভর্নর বানানোর দাবি জানাতে থাকলো।

উমার রা.-এর শাহদাতের সময় কুফার গভর্নর ছিলেন মুগিরা বিন শুবা রা.। মুগিরা বিন শুবা রা.-কে তিনি নিয়োগ দিতে বাধ্য হন। কারণ মুগিরা রা. ছিলেন কঠোর প্রকৃতির মানুষ। কুফার ঐ প্রভাবশালী মহলকে কন্ট্রোল করার জন্য তিনি মজলিসে শুরায় দীর্ঘ আলোচনা করে মুগিরা রা.-কে গভর্নর নিয়োগ করেন। উমার রা. শাহদাতকালে অসিয়ত করেন কুফায় যেন পুনরায় সা'দ বিন আবি ওয়াক্কাস রা.-কে গভর্নর করা হয়। সা'দ ছিলেন কুফা নগরীর প্রতিষ্ঠাতা। অসিয়ত অনুসারে উসমান রা. তাঁকে গভর্নর নিয়োগ করলেন। তবে তিনি সেখানে দ্বৈত-শাসন চালু করলেন। সা'দ রা.-কে সেনাবাহিনী প্রধান ও ইমামতির দায়িত্ব দিলেন। আর আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা.-কে দিলেন বাইতুল মাল বা রাজস্ব আদায়ের দায়িত্ব।

কুফায় গভর্ণর সা'দ রা.-এর কার্যকাল দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। কুফার প্রভাবশালী লোকদের অভিযোগ আসতে লাগলে সা'দ রা.-এর বিরুদ্ধে। এর মধ্যে আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা.-এর সাথে বাইতুল মাল থেকে ঋণ নেওয়া নিয়ে মতবিরোধ তৈরি হয়। প্রভাবশালী মহল এটাকে পুঁজি করে আন্দোলন শুরু করে। ফলে সা'দ রা. অপসারিত হন। সা'দ রা.-কে অপসারণের পর আল-ওয়ালীদ ইবনু উকবাকে কুফার গভর্ণর পদে নিয়োগ দেওয়া হয়। তিনি আবু বাকর রা.-এর আমলে বাহিনী প্রধান হিসেবে জর্দানে অভিযান পরিচালনা করেছিলেন। উমার রা. তাঁকে আরব আল-জাযীরায় যাকাত ও রাজস্ব আদায়ের কাজে নিযুক্ত করেছিলেন।

আল ওয়ালিদের বিরুদ্ধে মদ্যপানের অভিযোগ আসলে (এটাও একটা অসত্য অভিযোগ ছিল) তাকে অপসারণ করে সাঈদ ইবনুল আস রা.-কে কুফার গভর্নর হিসেবে নিযুক্ত করা হয়। কুফাবাসী বার বার শাসকদের বিরুদ্ধে অনাস্থা আনতে লাগলো। তারা এবার সাঈদ অবনুল আসের বিরুদ্ধে অনাস্থা এনে আবু মুসা আল-আশ'আরী রা.-কে নিয়োগ দেয়ার জন্য দাবী করলো খলিফার কাছে। খলিফা উসমান রা. তাদের এই দাবিও পূরণ করেন। কুফায় আবু মুসা আল-আশ'আরী রা.-কে গভর্নর হিসেবে নিয়োগ দেন। তবে এবার উসমান রা. বিশৃঙ্খলাকারীদের চিহ্নিত করে কুফা থেকে সিরিয়ায় বহিষ্কার করেন এবং মুয়াবিয়া রা.-কে তাদের নসিহত করার নির্দেশ দেন।

মুয়াবিয়া রা.-এর নসিহত তারা শুনেননি। মুয়াবিয়া রা. তাদের আচরণে অতিষ্ঠ ছিলেন। মুয়াবিয়া রা. তাদের আবার কুফায় ফেরত পাঠানোর আবেদন জানালেন। এবার ঐ প্রভাবশালী মহল আর কুফার গভর্নরের বিরুদ্ধে সীমাবদ্ধ থাকে নি। এবার তারা উসমান রা.-এর বিরুদ্ধে নানান অভিযোগ এনে জনগণকে ক্ষিপ্ত করার চেষ্টায় ছিল। তাদেরকে এই কাজে সহায়তা করেছে ইয়েমেনের ইহুদি আব্দুল্লাহ বিন সা'বা। কুফায় অনেকে উসমান রা.-এর বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে নানাবিধ মিথ্যা অপবাদ দিলে লাগলো। এই পরিস্থিতিতে আবু মুসা আল-আশ'আরী রা. তাদের সমস্ত মিথ্যা অভিযোগের জবাব দেন এবং আগামীতে এই ধরণের কাজ করলে তাদেরকে বিশৃঙ্খলা ও মিথ্যা অপবাদের শাস্তি দেয়ার হুমকি দেন।

উসমান রা. এবার তাদের হোমসে নির্বাসনে পাঠান। সেখানের শাসক ছিলেন আব্দুর রহমান ইবনে খালিদ। আব্দুর রহমান তাদের সাথে খুবই কঠোর আচরণ করলেন। তাদেরকে তিনি বললেন, আমাকে সাঈদ ও মুয়াবিয়ার মতো মনে করলে ভুল করবে। আমি শয়তানের ঘুঁটিদের মাথা উড়িয়ে দিতে জানি। আমি খালিদ বিন ওয়ালিদের ছেলে। ফিতনাবাজেরা হোমসে দশ মাসের মতো ছিল। আব্দুর রহমানের কঠোর শাসনে তারা সবাই সংশোধন হলো। নিজেদের অপকর্মের জন্য ক্ষমা চাইলো। উসমান রা. তাদের আবার যেখানে ইচ্ছা সেখানে বসবাস করার অনুমতি দিলেন। অবাক করা ব্যাপার হলো তাদের অধিকাংশই আব্দুর রহমানের সাথে থাকতে পছন্দ করলো।

কুফার সমস্যা মিটলেও শুরু হয়েছিল মিসরে সমস্যা। তার কারণ ছিল, হযরত উসমান ইব্‌ন আফফান রা. কর্তৃক আমর ইবনুল আস রা.-কে মিসর থেকে প্রত্যাহার করা এবং আবদুল্লাহ ইব্‌ন সা'দ কে আমীর নিযুক্ত করা। মিসরের একদল মুসলিম ইসলামী শাসনের বিরুদ্ধে সবসময় কথা বলতো। এটা উমার রা.-এর সময় থেকেই ছিল। আমর ইবনুল আস রা.-এর শাসনে তারা পরাভূত ছিল। তাই তারা খলীফার ও আমীরের বিরুদ্ধে কোন রকম বিরূপ মন্তব্য করতে সাহস পেত না। তারা এরূপ অবস্থায় দিন কাটাতে লাগল। একদিন তারা হযরত উসমান রা.-এর কাছে আমীরের বিরুদ্ধে অভিযোগ পেশ করল এবং তাকে তাদের থেকে প্রত্যাহার করে অন্য একজন তার চেয়ে নম্র শাসক নিযুক্ত করার দাবি জানাল। তাদের এ দাবি আদায়ের জন্য তারা খলীফার উপরে চাপ সৃষ্টি করতে লাগল। তারপর খলীফা আমর রা.-কে সেনাপতির পদ থেকে প্রত্যাহার করলেন কিন্তু তাকে সালাতের ইমামতিতে বহাল রাখলেন। সেনাপতি ও কর আদায়ের দায়িত্ব দিলেন আবদুল্লাহ ইব্‌ন সা'দকে।

এরপর কুচক্রীরা আমর রা. ও আব্দুল্লাহ ইবনে সা'দের সাথে ঝামেলা তৈরি করলো। আব্দুল্লাহ ইবনে সা'দ সুদানের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে অভিযান পরিচালনা করতে গিয়ে আমর রা.-এর সাথে মতবিরোধ তৈরি হলো। আমর রা. এর আগে কয়েকবার এই অভিযানে ব্যর্থ হন। যদিও তিনি রোমানদের বিরুদ্ধে বড় জয় লাভ করেছিলেন। কিন্তু তিনি আফ্রিকায় ব্যর্থ হন। উসমান রা. আমর ইবনুল আস রা.-কে মদিনায় নিয়ে আসেন ও উপদেষ্টা নিয়োগ করেন। আর মিসরের গভর্নর হিসেবে আব্দুল্লাহ ইবনে সা'দকে নিযুক্ত করেন। স্বাভাবিকভাবেই আমর রা. এই বিষয়টা পছন্দ করেননি।

আমর রা. মদিনায় ফিরে গেলে আমর রা.-এর অনুসারীরা বিষয়টাকে খুবই খারাপ চোখে দেখলো। তারা উসমান রা.-এর বিরুদ্ধে স্বজনপ্রীতির (আব্দুল্লাহ বিন সা'দ উসমান রা.-এর আত্মীয়) অভিযোগ আনলেন। যদিও আব্দুল্লাহ বিন সা'দ শুরু থেকেই অর্থাৎ উমার রা.-এর আমল থেকেই আমর রা.-এর ডেপুটি হিসেবে কাজ করছিলেন। ফিলস্তিন, মিসর ও রোমানদের বিরুদ্ধে বড় জয়ে আব্দুল্লাহ বিন সা'দ আমর রা.-এর যোগ্য সহযোগী ছিলেন। আমর রা.-কে পছন্দ করা লোকেরা আব্দুল্লাহ বিন সা'দের সাথে বিভিন্ন বিষয়ে দ্বিমত করতে শুরু করলেন। একইসাথে তারা উসমান রা.-এর ওপরও ক্ষিপ্ত ছিল। তাদের মূল অভিযোগ উসমান রা. প্রবীণ সাহাবীদের বরখাস্ত করে তরুণদেরকে দায়িত্ব প্রদান এবং অযোগ্য আত্মীয়-স্বজনদের নিয়োগ প্রদান করা। এছাড়াও এর সাথে যুক্ত হয়েছে কুফার লোকদের করা অপপ্রচার। এখানেও ইহুদি আব্দুল্লাহ বিন সা'বা ইসলামী রাষ্ট্রে গোলযোগ লাগানোর জন্য প্ররোচনা দিতে লাগলো।

এই বিষয়ে উসমান রা.-এর সাথে কথা বলার জন্য কয়েকজন সাহাবীর সন্তানেরা মিসরে একত্রিত হন। এরা সবাই মিসর জয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন। তাদের মধ্যে প্রধান ছিলেন মুহাম্মদ ইব্‌ন আবূ বকর রা.। তারা তাদের সাথে যাওয়ার জন্য প্রায় ছয়শত মানুষকে রাজি করাল। তারা চারটি দলে বিভক্ত ছিল এবং তাদের চারজন নেতাও ছিল। তারা হলো, আমর ইব্‌ন বুদাইল, আবদুর রহমান ইব্‌ন উদাইস, কিনানাহ ইবন বশর, সূদান ইব্‌ন হুমরান। তাদের সাথে সংগী ছিলেন মুহাম্মদ ইব্‌ন আবূ বকর রা.। এই বিষয়ে বিস্তারিত লিখে গভর্নর আব্দুল্লাহ বিন সা'দ দূত পাঠালেন উসমান রা.-এর কাছে। উসমান রা. এই বিষয়ে কথা বলার জন্য আলী রা.-এর নেতৃত্বে একদল প্রবীণ সাহাবীকে দায়িত্ব দিলেন।

আলী রা. তাদের সাথে কথা বললেন, তাদের অভিযোগ শুনলেন ও জবাব দিলেন। প্রকৃত তথ্য তাদের কাছে তুলে ধরলেন ও তাদেরকে সন্তুষ্ট চিত্তে ফেরত পাঠালেন। এরপর অভিযোগকারীরা লজ্জিত হলো এবং একে অন্যকে বলতে লাগল এ জন্যে কি তোমরা আমীরের বিরুদ্ধে লড়াই করতে চাও? মিসরের অভিযোগকারীরা ৫ টি অভিযোগ করেন।
১. সরকারী চারণ ভূমি নিজস্ব স্বার্থে ব্যবহার।
২. কুরআন শরীফ জ্বালিয়ে দেওয়া।
৩. মুসাফিরী অবস্থায় পূর্ণ নামায আদায় করা।
৪. প্রবীণ সাহাবীদেরকে বরখাস্ত করে তরুণদেরকে আমীর নিযুক্ত করা।
৫. বনু উমাইয়ার সদস্যদেরকে অধিক হারে চাকুরীতে নিয়োগ করা।

হযরত আলী রা. এসব অভিযোগের উত্তর প্রদান করেন।
১. সরকারের কিছু সম্পত্তি সীমানা নির্ধারণ করে পৃথক করা হয় খলিফার নিজের ভেড়া-বকরী চরাবার জন্যে নয় বরং তা করা হয়েছে বাইতুলমালের উট চরাবার জন্যে, যাতে এগুলো পূর্ণভাবে মোটাতাজা হতে পারে।
২. কুরআন শরীফের বিরোধপূর্ণ কিছু অংশ (কিরাতের বিভিন্নতা) সাহাবায়ে কিরামের সম্মতিতে পুড়িয়ে ফেলা হয় এবং সর্বসম্মতিক্রমে গ্রহণযোগ্য অংশগুলো বাকি রাখা হয়। কুরআন সংকলনের দ্বিতীয় পর্যায়ে এরূপ ব্যবস্থা গ্রহণ সর্বসম্মতিক্রমে গৃহিত হয়েছে।
৩. পবিত্র মক্কায় মুসাফিরী অবস্থায় পূর্ণ সালাত আদায় করার বিষয়টির ব্যাখ্যা হলো, তিনি পবিত্র মক্কায় স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন এবং এখানে ১৫ দিনের অধিককাল থাকর নিয়ত করেন। তাই তিনি পূর্ণ নামায আদায় করতেন।
৪. তরুণদেরকে নিয়োগ দেওয়ার ব্যাপারে এই কথাই সত্য যে, তিনি ন্যায়পরায়ণ ও যোগ্যতাসম্পন্ন ব্যক্তিবর্গকে নিয়োগ দিয়েছেন। রাসূলুল্লাহ সা. ইতাব ইবন উসাইদ রা.-কে পবিত্র মক্কার আমীর নিযুক্ত করেছিলেন। অথচ তার বয়স ছিল তখন ২০ বছর মাত্র। অনুরূপভাবে উসামা ইবন যায়িদ ইবন হারিসা রা.কে রাসূলুল্লাহ সেনাপতি নিয়োগ করেন অথচ জনসাধারণ তাঁকে আমির নিযুক্ত করার ব্যাপারে আপত্তি উত্থাপন করে। তখন রাসূলুল্লাহ বলেন, “তিনি আমীর হওয়ার উপযুক্ত।
৫. তাঁর নিজ সম্প্রদায় বনু উমাইয়ার সদস্যদেরকে অগ্রাধিকার দেওয়ার ক্ষেত্রে বলা যায় যে, রাসূলুল্লাহও অনেক বিষয়ে কুরাইশকে অগ্রাধিকার দিতেন। উসমান রা. তার আত্মীয়দের হক ও অধিকারের ব্যাপারে অধিক সচেতন। তিনি অন্যায়ভাবে কিছু করেননি।

আলী রা. উসমান রা.-এর কাছে ফেরত আসেন এবং বিদ্রোহীদের ফিরে যাবার সংবাদ হযরত উসমান রা.-এর নিকট দিলেন। আর তারা যে হযরত আলী রা.-এর কথা শুনেছেন তাও ব্যক্ত করেন। তবে আলী রা. উসমান রা.-এর কাছে কিছু পর্যবেক্ষন দিলেন। তিনি সারা রাষ্ট্রে বিভিন্ন স্থানে প্রচারিত খবর ও মানুষের প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে জানালেন। তিনি আশংকা করলেন, এভাবে চলতে থাকলে কয়েকদিনের মধ্যে কুফা ও বসরা থেকেও এমন অভিযোগে লোকজন আসতে পারে।

তিনি হযরত উসমান রা.-কে জনগণের কাছে একটি খুতবা দেওয়ার জন্যে অনুরোধ করলেন। এ খুতবার মাধ্যমে তিনি তার কিছু সংখ্যক আত্মীয়-স্বজনকে অগ্রাধিকার দেওয়ার প্রেক্ষিতে যে অন্যায় হয়েছে তার সম্বন্ধে যেন জনগণের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেন এবং তাদেরকে এ কথার উপরে সাক্ষ্য দিতে বলেন যে, তিনি তা থেকে তাওবা করেছেন এবং তার পূর্বে দুইজন প্রবীণ খলীফা যেভাবে কাজ করেছেন তার ধারাবাহিকতা বজায় রাখবেন। তিনি তা থেকে লক্ষ্যভ্রষ্ট হবেন না। আলী রা. উসমান রা.-কে এই পরামর্শ দিয়েছেন যাতে বিদ্রোহের আগুন প্রশমিত হয়।

এদিকে মদিনার মানুষের অভিযোগ ছিল মারওয়ান ইবনে হাকামকে নিয়ে। মারওয়ান ও তার পিতাকে আল্লাহর রাসূল সা. মদিনা থেকে তায়িফে নির্বাসন দিয়েছেন। উসমান রা. মারওয়ানকে মদিনায় এনে তাঁর উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব দেন। এতটুকু পর্যন্ত সমস্যা ছিল না। কিন্তু মারওয়ান ক্ষমতার দম্ভ দেখাত, প্রায়ই মদিনার বাসিন্দাদের শাসাত। এই নিয়ে মদিনাবাসী ক্ষুব্ধ ছিল। উসমান রা. তাদের সম্পর্কে বলেন, তিনি তাদেরকে তাদের মঙ্গলের জন্যই সমুচিত শাসন করেছিলেন। রাসূলুল্লাহ সা. তাদেরকে তায়িফে প্রথম নির্বাসন দিয়েছিলেন। তারপর তাকে ফেরত আসার অনুমতি দেন। তিনি এই বিষয়ে কয়েকজন সাহাবাকে সাক্ষী হিসেবে উল্লেখ করেন। তারাও সাক্ষ্য দেয়। তারপরও মদিনাবাসী মারওয়ানকে নিয়ে উসমান রা.-এর ওপর ক্ষুব্ধ ছিল। আলী রা. সেদিকে ইঙ্গিত করে মদিনাবাসীর সামনে ভাষণ দেওয়া ও তওবা করার কথা বলেছেন যাতে রাজধানী অর্থাৎ মদিনা উসমান রা.-এর কন্ট্রোলে থাকে।

এটা স্পষ্ট ছিল যে, যখন মিসর থেকে একদল মুসলিম রণপ্রস্তুতি নিয়ে অভিযোগসহ আসলো তখন মদিনাবাসী উসমান রা.-এর পক্ষে সেভাবে রুখে দাঁড়ায়নি। অর্থাৎ মদিনাবাসীর মনেও অভিযোগ ছিল। উসমান রা.-এর কাছে কেউ আসলে আগে মারওয়ানের সাথে দেখা করতে হতো। সরাসরি খলিফার সাথে সাধারণত দেখা হতো না। এর আগে মদিনাবাসী উসমান রা.-এর বিরুদ্ধে অভিযোগ করে তাঁকে সিদ্ধান্ত থেকে সরিয়ে এনেছিল। বহুদিন আফ্রিকা বিজয় করতে না পারায় উসমান রা. ঘোষণা দিলেন আব্দুল্লাহ বিন সা'দ যদি আফ্রিকা বিজয় করতে পারে তবে তাকে গনিমতের পাঁচ ভাগের এক ভাগ যা রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা হওয়ার কথা তা তাকে দেওয়া হবে। আফ্রিকা বিজয়ের পর উসমান রা. তাই করলেন। কিন্তু মদিনাবাসী এই সিদ্ধান্তের বিরোধীতা করলেন। ফলে উসমান রা. তাঁর সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করতে বাধ্য হলেন।

খলিফা উসমান রা. আলী রা.-এর এ পরামর্শটি শুনলেন এবং তা গ্রহণ করেন। জুমার দিন যখন আসল তিনি জনগণের মাঝে খুতবা দেন এবং খুতবার মধ্যে দুই হাত উত্তোলন করে বলেন, হে আল্লাহ! আমি তোমার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করছি এবং আমি তোমার কাছে তাওবা করছি। হে আল্লাহ! আমার থেকে যা কিছু হয়ে গেছে আমি তার সর্বপ্রথম তাওবাকারী। তারপর দুইচোখের অশ্রু ছেড়ে দিলেন। সমস্ত মুসলমানও তাঁর সাথে কাঁদলো। মদিনার জনগণ তাদের ইমামের জন্য অত্যন্ত দরদ দেখালেন। হযরত উসমান রা. জনগণের এরূপ ব্যবহার স্বয়ং প্রত্যক্ষ করলেন। আর তিনি প্রতিজ্ঞা করলেন আবূ বকর সিদ্দীক রা. ও হযরত উমার রা. যেভাবে চলেছিলেন তিনিও সেভাবে চলবেন। তিনি তার ঘরের দরজা সাক্ষাতপ্রার্থীদের জন্যে খোলা রাখবেন। কাউকে তিনি কোনো সময় বাধা দিবে না। তিনি মিম্বার থেকে নামলেন এবং জনগণকে নিয়ে সালাত আদায় করলেন। তারপর ঘরে প্রবেশ করলেন এবং আমীরুল মু'মিনীনের ঘরে কোন প্রয়োজন কিংবা মাসয়ালা কিংবা প্রশ্নের উত্তর জানার জন্যে যদি কেউ প্রবেশ করতে ইচ্ছে করেন তাহলে তাকে কোনরূপ বাধা দেওয়া হবে না।

এরপর উসমান রা. তার আত্মীয় স্বজন ও বংশধরদের দ্বারা পরিবেষ্টিত হলেন। তারা মিসর থেকে আগমনকারী দলকে বিদ্রোহী হিসেবে উল্লেখ করে তাদের শাস্তি দেওয়ার কথা বললেন। একমাত্র খলিফার স্ত্রী নাইলা রা. বলেছেন আপনি সঠিক কাজ করেছেন। মদিনাবাসী আপনাকে এখন গভীরভাবে শ্রদ্ধা করবে।

মারওয়ান বললো, আমার পিতা-মাতা আপনার ওপর কুরবান হোক। আমি চেয়েছিলাম, আপনার কথাবর্তা হবে অত্যন্ত কঠোর, আর আপনি থাকবেন অটল ও অনড়। তাহলে আমি হতাম প্রথম ব্যক্তি যে এটাকে মেনে নিত এবং এটাকে সাহায্য-সহায়তা করত কিন্তু আপনি যা বললেন, তাতে অবস্থা অত্যন্ত জটিল আকার ধারণ করেছে। অনেক কিছু হাতছাড়া হয়ে গেছে। অসম্মানিত ব্যক্তিকে সম্মান দেওয়া হয়েছে। আপনি যদি চাইতেন তা হলে তাওবার দৃঢ় প্রত্যয় নিতে পারতেন এবং আমাদের কাছে কথিত অন্যায় অস্বীকার করতে পারতেন। আত্মীয়দের বিভিন্ন বাক্যবাণে উসমান রা. অস্থির হয়ে পড়লেন।

এর মধ্যে বহু মানুষ উসমান রা.-এর সাথে দেখা করার জন্য তার ঘরের সামনে জড়ো হলো। উসমান রা. বলেন, তুমি যাও এবং তাদের সাথে কথা বলো। তাদের কথা শোন। তাদের সাথে কথা বলতে আমার লজ্জা হচ্ছে।

সুযোগ পেয়ে মারওয়ান দরজার দিকে এগিয়ে আসলো। সে বললো,
“কি হয়েছে? তোমাদেরকে দেখে মনে হয় যেন তোমরা এখানে লুট করতে এসেছ! তোমাদের উপর অভিশাপ, প্রত্যেক মানুষ তার সাথীর উপকার করে থাকে তবে যার উদ্দেশ্য অসৎ তার কথা ভিন্ন। তোমরা এখানে এসেছ আমাদের ক্ষমতা হরণ করার জন্যে। অতএব তোমরা এখান থেকে বেরিয়ে পড়ো। আল্লাহর শপথ! আবার যদি তোমরা আমাদেরকে প্রভাবিত করতে চাও, তাহলে তোমাদের জন্যে এমন হুকুম জারি করা হবে, যা তোমাদের সকলকে কষ্ট দিবে। আর তোমরা তার পরিণাম প্রশংসার চোখে দেখবে না। তোমাদের ঘরে তোমরা ফিরে যাও। আল্লাহর শপথ! আমাদের হাতে যে ক্ষমতা আছে তা নিয়ে আমরা পরাভূত হবো না।

মদিনার জনগণ অপমানিত হয়ে কষ্ট পেয়ে ফিরে গেলেন। তাদের কয়েকজন হযরত আলী রা.-এর কাছে আগমন করলেন এবং পুরো ঘটনা জানালেন। আলী রা. অত্যন্ত রাগান্বিত হলেন এবং দ্রুত উসমান রা-এর ঘরে প্রবেশ করলেন। তিনি উসমান রা.-কে বললেন, আপনি কি মারওয়ানের প্রতি সন্তুষ্ট? কিন্তু আপনার দ্বীন ও বিবেক বুদ্ধি ধ্বংস না করা পর্যন্ত সে আপনার প্রতি সন্তুষ্ট হবে না। আপনার উদাহরণ এখন ভারবাহী উটের ন্যায়। আল্লাহর শপথ! মারওয়ান ধর্মের দিক দিয়েও সচেতন নয় এবং বিবেকের দিক দিয়েও বুদ্ধিমান নয়। আল্লাহর শপথ! আমি তাকে দেখেছি যে, সে আপনাকে রাস্তায় নামিয়ে দেবে আর উঠাতে পারবে না। এরপর আর আমি আপনার ব্যাপারে মাথা ঘামানোর জন্যে আপনার কাছে আসব না। একথা বলে তিনি বেরিয়ে গেলেন।

আলী রা. বের হয়ে যাওয়ার পর হযরত উসমান রা. হতভম্ব হয়ে গেলেন। তাঁর স্ত্রী নাইলা রা. ঘরে প্রবেশ করলেন এবং বললেন, হযরত আলীর কথা আমি সব শুনেছি। তিনি আর আপনার কাছে আসবেন না। আপনি মারওয়ানের কথামত চলছেন। খলীফা বললেন, এখন আমি কি করব? নাইলা রা. বললেন, "আপনি শুধুমাত্র একচ্ছত্রভাবে আল্লাহকে ভয় করুন এবং আপনার পূর্ববর্তী দুই খলীফার নীতি অনুসরণ করুন। কেননা, আপনি যদি মারওয়ানের কথা শুনেন, তাহলে সে আপনাকে ধ্বংস করে দিবে। আপনি আলী রা.-এর কাছে লোক প্রেরণ করুন এবং তাঁর থেকে উপস্থিত সংকট কাটানোর জন্য পরামর্শ গ্রহণ করুন। কেননা, তিনি আপনার নিকটাত্মীয়। তিনি আপনার কথা আমান্য করবেন না।”


১৮ ডিসে, ২০২২

শহীদ ইমরান ভাইকে আমরা ভুলবো না

 


আজ ১৮ ডিসেম্বর। শহীদ মুস্তফা শওকত ইমরান ভাইয়ের শাহদাতবার্ষিকী।

১৯৭১ সালের এই দিনে তিনি শাহদাতবরণ করেন। মহান রাব্বুল আলামীন জানিয়েছেন তিনি শহীদদের জীবিত রাখেন ও রিজিক দেন। আজ এত বছর পর আমরা তাঁকে স্মরণ করছি যখন তাঁর অনুসারী অনুজরাই তাঁকে ভুলিয়ে দিতে চেয়েছিল। অবশ্য তা বাধ্য হয়ে করেছিল। কিন্তু সেই ধারাবাহিকতায় কালক্রমে তা হারিয়ে যেতে বসেছে।

কিন্তু ঐ যে শহীদের রক্ত! এটা তো মুছা যাবে না। রক্ত কথা বলবেই!

মুস্তফা শওকত ইমরান ভাই ঢাকা মেডিকেলের ছাত্র ছিলেন। বাড়ি ছিল তৎকালীন নোয়াখালীতে, বর্তমান ফেনীতে। ১৯৭১ সালে তিনি ইসলামী ছাত্রসংঘ, ঢাকা শহর শাখার সেক্রেটারি মনোনীত হন। সভাপতি নির্বাচিত হন শামসুল হক ভাই। ১৯৭১ সালের শেষ দিকে শামসুল হক হক ভাই নিখোঁজ হওয়াতে ভারপ্রাপ্ত সভাপতি হন ইমরান ভাই।

৭১ সালের ডিসেম্বরে মুশরিকদের সহায়তায় তাদের এদেশীয় দালাল ও সমাজতন্ত্রীরা গণহত্যা শুরু করে। প্রথমেই আঘাত আসে চীনপন্থী সমাজতন্ত্রীদের ওপর যারা ভৌগলিক রাজনীতির কারণে পাকিস্তানের অখণ্ডতার পক্ষে ছিল। ১৪ ডিসেম্বর তাদের একটি বড় অংশকে খুন করা হয়।

এরপর আঘাত আসে ইসলামপন্থীদের ওপর। আর এর প্রধান শিকার হয় জামায়াতে ইসলামী, নেজামে ইসলামী ও ইসলামী ছাত্রসংঘ। ঢাকা শহরের বিভিন্ন স্থান থেকে ইসলামী ছাত্রসংঘের নেতাকর্মীদের গ্রেফতার করে পল্টন ময়দানে নিয়ে আসা হয়। এর মধ্যে ছিলেন ঢাকা শহরের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি মুস্তফা শওকত ইমরান ভাই।

১৮ ডিসেম্বর ১৯৭১ সালের পল্টন গণহত্যার খুনীরা ইমরান ভাইকে দিয়ে তাদের রক্তখেকো চরিত্রের উন্মোচন করে। ইমরান ভাইকে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করে। একইভাবে প্রায় তিনশত ইসলামপন্থী মানুষকে হত্যা করে। এর মধ্যে পঁচাত্তর জনের মতো ছিল জামায়াত ও ইসলামী ছাত্রসংঘের নেতা-কর্মী।

এই গণহত্যার মাস্টার মাইন্ড ছিল ক্র্যাক প্লাটুন। ক্র্যাক প্লাটুন তৈরি হয় খালেদ মোশাররফ ও এটিএম হায়দারের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে। এই বাহিনীর সদস্যরা ভারতের মেলাঘর প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে গেরিলা যুদ্ধের প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে। আওয়ামী লীগ নেতা মায়া, বিচ্চু জালাল, নাসির উদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু, গোলাম দস্তগীর গাজীসহ ৩৪ জন ছিল এই ক্র্যাক প্লাটুনের সদস্য। খালেদ মোশাররফ ভারত থেকে প্রশিক্ষণ নেওয়া তার সন্ত্রাসী বাহিনীকে দিয়ে ১৮ ডিসেম্বরের পল্টন গণহত্যা ঘটায়।

এই গণহত্যায় আরেকজনের নাম উল্লেখযোগ্য। সে হলো যুদ্ধাপরাধী কাদের সিদ্দিকী। সে ও তার অনুসারীরা ছিল বর্বর ও হিংস্র। তারা যুদ্ধের আগে ডাকাতি করতো। ক্র্যাক প্লাটুনের লোকদের গ্রেফতার করা শত শত নিরস্ত্র ও বেসামরিক মানুষকে হিংস্র ও বর্বরভাবে খুঁচিয়ে হত্যা করে কাদের সিদ্দিকী ও তার দল।

১৮ ডিসেম্বর সারাদেশে কয়েকশত জামায়াত ও ইসলামী ছাত্রসংঘের নেতাকর্মীকে শহীদ করা হয়। একইসাথে নেজামে ইসলামী, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম, ঢাকার অনেক মসজিদের ইমাম এবং অনেক কওমী মাদ্রাসায় হাজারো শহীদের রক্তের স্রোত বইয়ে দেওয়া হয়।

১৮ ডিসেম্বরে শহীদ ইমরান ভাইদের হত্যাকাণ্ড নিয়ে ইতালির বিখ্যাত সাংবাদিক ওরিয়ানা ফ্যালাসি শেখ মুজিবের সাথে দীর্ঘ বাকযুদ্ধে লিপ্ত হন।

ফ্যালাসি ১৮ ডিসেম্বরের হত্যাকাণ্ডকে ম্যাসাকার হিসেবে উল্লেখ করে মুজিবের প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে মুজিব বলে,
//- ম্যাসাকার? হোয়াট ম্যাসাকার?
- ঢাকা স্টেডিয়ামে মুক্তিদের দ্বারা সংঘটিত হত্যাকান্ডটি।
- ঢাকা স্টেডিয়ামে কোন ম্যাসাকার হয়নি, তুমি মিথ্যে বলছো।
- মিঃ প্রাইম মিনিস্টার। আমি মিথ্যাবাদী নই। সেখানে আরো সাংবাদিক ও হাজার হাজার লোকের সাথে আমি হত্যাযজ্ঞ প্রত্যক্ষ করেছি। আপনি চাইলে ছবি দেখাতে পারি। আমার পত্রিকায় সে ছবি প্রকাশিত হয়েছে।
- মিথ্যেবাদী, ওরা মুক্তিবাহিনী নয়।
- মিঃ প্রাইম মিনিস্টার দয়া করে মিথ্যেবাদী শব্দটা আর উচ্চারণ করবেন না, তারা মুক্তিবাহিনী তাদের নেতৃত্ব দিচ্ছিল আবদুল কাদের সিদ্দিকী।
- তাহলে হয়তো তারা রাজাকার ছিল, যারা প্রতিরোধের বিরোধীতা করেছিল এবং কাদের সিদ্দিকী তাদের নির্মূল করতে বাধ্য হয়েছিলো।
- মিঃ প্রাইম মিনিস্টার, কেউ প্রমাণ করেনি যে, লোকগুলো রাজাকার ছিল এবং বিরোধীতা করেছিল। তারা ভীতসন্ত্রস্ত্র ছিল, হাত-পা বাঁধা ছিল তারা নড়া ছড়াও করতে পারছিলোনা।
-মিথ্যেবাদী
- শেষবারের মত বলছি, আমাকে “মিথ্যাবাদী” বলার অনুমতি আপনাকে দেবো না।
- আচ্ছা সে অবস্থায় তুমি কি করতে?
- আমি নিশ্চিত হতাম, ওরা রাজাকার এবং অপরাধী, তারপর ফায়ারিং স্কোয়াডে দিতাম এবং খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে এভাবে ঘৃন্য হত্যাকাণ্ড এড়াতাম।
- ওরা এভাবে করেনি, হয়তো আমার লোকেদের কাছে বুলেট ছিলনা।
- হ্যা তাদের কাছে বুলেট ছিল। প্রচুর বুলেট ছিল, এখনো তাদের কাছে প্রচুর বুলেট রয়েছে। তা দিয়ে সকাল থেকে রাত পর্যন্ত গুলি ছোঁড়ে। ওরা গাছে, মেঘে, আকাশে, মানুষের প্রতি গুলি ছোঁড়ে শুধু আনন্দ করার জন্য।//

যতদূর জানতে পেরেছি অর্থাৎ পুরাতন লোকদের কাছ থেকে শুনেছি বেয়নেট দিয়ে ইমরান ভাইয়ের বুক চিরে হৃৎপিণ্ড বের করে সেই রক্তাক্ত হৃৎপিণ্ড নিয়ে উল্লাস করেছে গণহত্যাকারী, যুদ্ধাপরাধী বর্বর খালেদ মোশাররফের ক্র্যাক প্লাটুন ও কাদের সিদ্দিকীর ডাকাত দল।

সেই ক্র্যাক প্লাটুনের গাজী দস্তগীর এখনো খুন করে যাচ্ছে। যতদূর জানা যায় গাজী দস্তগীরের সর্বশেষ শিকার ফারদিন নামের এক সাধারণ বুয়েট শিক্ষার্থী।

আল্লাহ তায়ালা শহীদ মুস্তফা ইমরান ভাইকে দুনিয়া ও আখিরাতে সম্মানিত করুন। সেই সাথে তাঁর সাথে শহীদ হওয়া হাজারো মুসলিমের রক্তের অভিশাপ থেকে আমাদের মুক্ত করুন। আমরা যাতে মুশরিকদের ফাঁদ থেকে উদ্ধার হতে পারি সেই তাওফিক দান করুন।

আল্লাহ তায়ালা শহীদের রক্তের সাথে গাদ্দারির মতো ভয়ংকর অপরাধ থেকে মুক্ত করুন। আমাদের ক্ষমা করুন। আস্তাগফিরুল্লাহ! আস্তাগফিরুল্লাহ!

৮ ডিসে, ২০২২

খিলাফত পর্ব-৩৯ : উসমান রা.-এর বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ ও পর্যালোচনা


৩য় খলিফা উসমান রা. ছিলেন মজলুম শাসক। তাকে জালিমরা অন্যায়ভাবে খুন করেছে আর ইতিহাসবিদদের একাংশ তার কর্মকাণ্ডের অন্যায্য সমালোচনা করে তাঁর মর্যাদাকে খুন করার অপচেষ্টা চালায়। আলী রা.-এর শাহদাতের পর সৃষ্ট শিয়াদের উগ্র অংশ মূলত এসব অবান্তর সমালোচনার আবিষ্কারক। রাষ্ট্র পরিচালনা করতে গিয়ে সাহাবাদের মধ্যে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে মতপ্রার্থক্য হলেও সাহাবারা পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। স্বৈরাচারী ইয়াজিদের অপরাধের দায় তার পিতা ও তার বংশের ওপর চাপানো হয়। এভাবে উমাইয়া বংশের হওয়াতে উসমান রা. শিয়াদের উগ্র অংশের হিংসার মুখোমুখি হন।

উসমান রা.-এর বিরুদ্ধে চর্চিত অভিযোগ মোটাদাগে তিনটি।
১. সরকারি পদে নিয়োগের ক্ষেত্রে স্বজনপ্রীতি
২. আত্মীয়দের মধ্যে রাষ্ট্রীয় সম্পদ বিলিবন্টনের অভিযোগ
৩. বিশিষ্ট সাহাবী আবু যর রা.-কে বহিষ্কার

সরকারি পদে নিয়োগের ক্ষেত্রে স্বজনপ্রীতি :
সরকারি পদে নিয়োগের ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদ ছিল গভর্নর ও যুদ্ধের সেনাপতি। উসমান রা.-এর শাসনামলে ২৬ জন এসব বড় দায়িত্ব পালন করেন। এর মধ্যে উমাইয়া বংশের ছিল মোটে ৫ জন। তারা হলেন, মুয়াবিয়া রা., আব্দুল্লাহ ইবনে সা'দ, ওয়ালিদ ইবনে উকবা, আব্দুল্লাহ ইবনে আমির ও সাঈদ ইবনুল আস। এর মধ্যে আব্দুল্লাহ ইবনে আমির ও সাঈদ ইবনুল আস নিয়োগ পেয়েছে উসমান রা.-এর শাসনামলে। আর বাকি ৩ জন আগে থেকেই সরকারি দায়িত্ব পালন করতেন। ২৬ জনের মধ্যে মাত্র দুইজন। এটা মোটেই বেশি নয়। আর উমাইয়া বংশের লোকেরা জাহেলি যুগ থেকেই যুদ্ধ ও রাজনীতিতে অগ্রগামী ছিল। সেই হিসেবে অনেক কমই নিয়োগ পেয়েছে উমাইয়া বংশ থেকে।

এখানে যেটা উল্লেখযোগ্য সেটা হলো উমার রা. যোগ্যতা থাকলেও তার বংশের কাউকে নিয়োগ দিতেন না, যাতে কেউ প্রশ্ন তুলতে না পারে। কিন্তু এর মানে এই নয় যে, নিজ বংশের যোগ্যতর কাউকে দায়িত্ব দেওয়া অবৈধ। এই প্রসঙ্গে উসমান রা. বলেন, "উমার রা. আল্লাহর জন্য নিকটাত্মীয়দের বঞ্চিত করতেন। আর আমি আল্লাহর জন্যই আত্মীয়দের দান করি"। অর্থাৎ তাঁর মতে, আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের নির্দেশ আত্মীয়দের প্রতি সদাচরণ ও তাদের হক আদায় করা। যোগ্যতা থাকলেও তাকে নিয়োগ না দেওয়া তাঁর মতে ছিল অবিচার। তাই তিনি এই ব্যাপারে উমার রা.-এর নীতি অনুসরণ করেন নি। যোগ্যতা অনুযায়ী শাসনকার্যে আত্মীয়রা নিয়োগ পেতেন।

উসমান রা. যোগ্যতা ছাড়া কাউকে কোনো এক্সট্রা সুবিধা দেন নি। আর তাছাড়া উসমান রা. তাঁর প্রতিটি সিদ্ধান্তই পরামর্শভিত্তিক গ্রহণ করতেন। বিশেষভাবে আলী রা.-এর মতামতকে তিনি সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতেন। এক মজলিসে শুরায় উসমান রা. আত্মপক্ষ সমর্থন করে বলেন, আমি নিজ সম্পর্কে ও যাদেরকে নিয়োগ দিয়েছি তাদের সম্পর্কে তোমাদের অবহিত করবো। আমার পূর্বসূরি দুইজন নিজেদের ওপর জুলম করেছেন। তারা নিকটাত্মীয়ের দূরে রেখেছেন। তোমরা জানো রাসূল সা. স্বীয় আত্মীয়দের নিয়োগ দিতেন ও দান করতেন। আর আমার খান্দানের জনসংখ্যা বেশি, তারা দরিদ্রও বটে। তাই আমি তাদের জন্য হস্ত প্রসারিত করি। তোমরা যদি এটাকে ভুল মনে করো তবে তা ফিরিয়ে নিতে পারো।

মুয়াবিয়া রা. :
মুয়াবিয়া রা. সরকারি কাজে যুক্ত হয়েছে রাসূল সা.-এর আমল থেকেই। তিনি রাসূল সা.-এর দাপ্তরিক কাজের ও অহি লিপিবদ্ধ করার দায়িত্ব পালন করেন। সিরিয়া অভিযানে আবু বকর রা. তাকে তার ভাই ইয়াজিদের সাথে যুদ্ধে প্রেরণ করেন। উমর রা.-এর আমলে সিরিয়াতে পর পর কয়েকজন গভর্নর মহামারীতে মৃত্যুবরণ করেন। সর্বশেষ ইয়াজিদ ইবনে আবু সুফিয়ান রা.। তাঁর মৃত্যুর পর মুয়াবিয়া রা.-কে সিরিয়ার গভর্নরের দায়িত্ব দেন। উসমান রা.-এর আমলে মুয়াবিয়া রা. একই দায়িত্বে বহাল থাকেন। এই সময়ে মুয়াবিয়া রা. নৌবাহিনী গঠন ও নৌযুদ্ধে মুসলিমদের অভিষেকের মতো গুরুদায়িত্ব পালন করেন। তিনি সাইপ্রাস দ্বীপ ইসলামী রাষ্ট্রের অধিকারে আনেন ও ভূমধ্যসাগরে মুসলিমদের কর্তৃত্ব বৃদ্ধিতে দারুণ ভূমিকা রাখেন। তিনি সিরিয়া সীমান্তে রোমানদের কর্তৃত্ব খর্ব করেন। শাসক হিসেবে তিনি তাঁর যোগ্যতার প্রমাণ দেন।

আব্দুল্লাহ ইবনে সা'দ :
আমর ইবনুল আস রা.-এর যোগ্য সহযোগী ছিলেন আব্দুল্লাহ ইবনে সা'দ। মিশর অভিযানে আমর রা.-এর ডেপুটি সেনাপতি হিসেবে ভূমিকা রাখেন। মিশরের বিশাল অংশ নিয়ন্ত্রণে আব্দুল্লাহ ইবনে সা'দ আমর রা.-কে সহায়তা করতেন। উমার রা. আবদুল্লাহ ইবনু সা'দকে মিশরের কিছু অংশের শাসক নিযুক্ত করেছিলেন। এই ব্যবস্থা উসমান রা.-এর আমলের শুরুর দিকেও বহাল ছিলো। কিছুদিন পর মিসরের কতিপয় অধিবাসী শাসক হিসেবে আমর রা.-এর কঠোরতার ব্যাপারে উসমান রা.-এর কাছে অভিযোগ করেন।

তাছাড়া আমর রা.-এর আমলে রাজস্ব আয়ে ঘাটতি দেখা দেয়। তাই উসমান রা. গভর্ণর আমরের কর্তৃত্ব খর্ব করে তাকে শুধু সালাতে ইমামতির দায়িত্ব দেন এবং আবদুল্লাহ ইবনু সা'দকে প্রতিরক্ষা ও রাজস্ব বিভাগের প্রধান হিসেবে নিয়োগ দেন। শীঘ্রই এই নিয়োগের সুফল পাওয়া যায়। আবদুল্লাহ ইবনু সা'দ দায়িত্ব গ্রহণের পর মিসরের রাজস্ব আয় বেড়ে যায়। তবে আমর রা. ও আবদুল্লাহর মধ্যে মতবিরোধ দেখা দিলে খলিফা উসমান রা. আমর রা.-কে মদিনায় প্রত্যাহার করেন ও রাষ্ট্র পরিচালনায় উপদেষ্টা নিয়োগ করেন। আর মিশরের শাসক হিসেবে আব্দুল্লাহ ইবনে সা'দকে নিযুক্ত করেন। আমর রা. রোমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে পারদর্শীতা দেখালেও আফ্রিকার বিস্তীর্ণ অঞ্চল বিজয় করতে ব্যর্থ হয়েছেন। আব্দুল্লাহ ইবনে সা'দ দায়িত্ব পেয়ে সেই ব্যর্থতাকে সফলতায় পরিণত করেন। সুদান বিজয় করেন।

ওয়ালিদ ইবনে উকবা :
ওয়ালিদ ইবনে উকবা রা.-এর ব্যাপারে একটি নেগেটিভ ঘটনা ছিল। তারপরেও তিনি নবিজীর আমলেই ক্ষমা লাভ করেন ও রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালন শুরু করেন। অনেক মুফাসসির দাবি করেছেন, সূরা হুজুরাতের ৬ নং আয়াত তাঁর ব্যাপারে নাজিল হয়। বনী মুসতালিক গোত্র মুসলমান হলে রসূলুল্লাহ সা. তাদের থেকে যাকাত আদায় করে আনার জন্য ওয়ালীদ ইবনে উকবাকে পাঠালেন। তিনি তাদের এলাকায় পৌঁছে কোন কারণে ভয় পেয়ে গেল এবং গোত্রের লোকদের কাছে না গিয়েই মদীনায় ফিরে গিয়ে রাসূল সা.-এর কাছে এ বলে অভিযোগ করলো যে, তারা যাকাত দিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে এবং আমাকে হত্যা করতে উদ্যত হয়েছে। এ খবর শুনে নবী সা. অত্যন্ত অসন্তুষ্ট হলেন এবং তাদের শায়েস্তা করার জন্য এক দল সেনা পাঠাতে মনস্থ করলেন।

কোন কোন হাদীসে বর্ণিত হয়েছে যে, তিনি সেনাদল পাঠিয়েছিলেন এবং কোন কোনটিতে বর্ণিত হয়েছে যে, পাঠানোর উদ্যোগ নিয়েছিলেন। মোটকথা, এ বিষয়েই সবাই একমত যে, এ সময় বনী মুসতালিক গোত্রের নেতা হারেস ইবনে দ্বিরার (উম্মুল মু’মিনীন হযরত জুয়াইরিয়ার পিতা) এক প্রতিনিধি দল নিয়ে নবী সা.-এর খেদমতে হাজির হন। তিনি বললেন, আল্লাহর কসম যাকাত দিতে অস্বীকৃতি এবং ওয়ালীদকে হত্যা করার চেষ্টা তো দূরের কথা তার সাথে আমাদের সাক্ষাত পর্যন্ত হয়নি। আমরা ঈমানের ওপর অবিচল আছি এবং যাকাত প্রদানে আদৌ অনিচ্ছুক নই। এ ঘটনার প্রেক্ষিতে এ আয়াত নাযিল হয়। তবে আবার কেউ কেউ দাবি করেছেন ওয়ালিদ ইবনে উকবা সেই ব্যক্তি ছিলেন এমন অকাট্য প্রমাণ নেই।

তবে যাই হোক আল ওয়ালিদ কিন্তু উসমান রা.-এর আমলেই প্রথম সরকারি দায়িত্বে নিযুক্ত হন নি। তিনি তার বিশ্বস্ততার দরুণ আবু বকর রা. ও উমার রা.-এর আমলেও যাকাত কালেক্টর হিসেবে দায়িত্বরত ছিলেন। আবু বকর রা. তাঁকে জর্ডান অভিযানে প্রধান সেনাপতি হিসেবে নিযুক্ত করেছেন।

কুফায় সা'দ বিন আবি ওয়াক্কাস রা. ও আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা.-এর মধ্যেকার মতবিরোধের দরুণ সা'দ রা.-কে প্রত্যাহার করতে হয়। তদস্থলে উসমান রা. ওয়ালিদ ইবনে উকবা রা.-কে নিয়োগ দেন। আল ওয়ালিদ ইবনে উকবা দায়িত্ব পেয়ে কুফায় শক্তিশালী শাসন চালু করতে সক্ষম হন। উমার রা.-এর আমল থেকেই কুফার বাসিন্দারা শাসকদের নানানভাবে হেনস্থা করতো। মুগিরা বিন শুবা ও আল ওয়ালিদ সেটা দারুণভাবে কন্ট্রোল করতে সক্ষম হন।

এছাড়াও তিনি আজারবাইজান, আর্মেনিয়া ও ইরানে অভিযান পরিচালনা করে প্রাচ্যের বিস্তীর্ণ অঞ্চল ইসলামী রাষ্ট্রের অধিকারে নিয়ে আসেন। তবে তিনি কুফার ষড়যন্ত্রকারীদের কবলে পতিত হন। সমালোচনাকারীরা বলতে চান উসমান রা. এমন একজনকে গভর্নর নিয়োগ দিয়েছেন যিনি মদ্যপানের শাস্তি পেয়েছেন।

কুফার কিছু লোক ইবনে হাইসামান নামে এক যুবককে হত্যা করে। আল ওয়ালিদ এই ব্যাপারে শক্ত অবস্থান নেন। খুনীদের শাস্তি দেন। সেই থেকে খুনীদের আত্মীয়রা আল ওয়ালিদকে ফাঁসানোর চেষ্টা করেন। আল ওয়ালিদ কতিপয় খ্রিস্টানকে ইসলামের দাওয়াত দেওয়ার জন্য তাদের সাথে সখ্যতা গড়ে তুলেন। এর মধ্যে একজন একদিন মদসহ ওয়ালিদ রা.-এর দরবারে উপস্থিত হন।

তাবারি উল্লেখ করেছেন, আল ওয়ালিদ রা. মদপান করেননি। কিন্তু মদসহ খ্রিস্টান অতিথি দরবারে উপস্থিত ছিল। এই নিয়ে ঐ খুনীদের আত্মীয়দের চারজন উসমান রা.-এর কাছে সাক্ষ্য দেয় যে, তারা ওয়ালিদ রা.-কে মদপান করতে দেখেছে।

সাক্ষ্যের ভিত্তিতে উসমান রা. হদ প্রয়োগ করতে বাধ্য হন। তিনি আত্মীয় বলে তাঁকে ছেড়ে দেননি। উসমান রা. নিজেও বুঝেছেন যে, আল ওয়ালিদ মদপান করেন নি। তিনি আল ওয়ালিদকে উদ্দেশ্য করে বলেন, আমরা সাক্ষ্যের ভিত্তিতে হদ প্রয়োগ করবো। মিথ্যা সাক্ষীর বাসস্থান হবে জাহান্নামে। অতএব ধৈর্যধারণ করো হে ভাই!

এটা উসমান রা.-এর ত্রুটি নয়, বরং প্রশংসার ব্যাপার। তিনি স্বজন বলে ছাড় দেননি। যদিও আল ওয়ালিদ রা. দোষী ছিলেন না। শুধু তাই নয়, বিতর্ক তৈরি হবে বলে তিনি গভর্নরের দায়িত্ব থেকেও অব্যাহতি দিয়েছেন। উসমান রা.-এর সিলেকশনেও ভুল ছিল না। এর আগে বা পরে কখনোই আল ওয়ালিদের বিরুদ্ধে মদপানের অভিযোগ আসে নি।

সাঈদ ইবনুল আস:
আল ওয়ালিদের প্রত্যাহারের পর সাঈদ ইবনুল আসকে কুফার গভর্নরের দায়িত্ব দেওয়া হয়। সাঈদ বাগ্মী ও বিশুদ্ধভাষী ছিলেন। তিনি কুরআন সংকলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিক রাখেন। ইসলামী রাষ্ট্রের দাপ্তরিক দায়িত্বও পালন করেন। কুফার দায়িত্ব পাওয়ার পর তিনি দারুণভাবে কুফাকে সামলেছেন। তিনি প্রাচ্যের বিভিন্ন অঞ্চল ইসলামী রাষ্ট্রের অধিকারে নিয়ে আসেন। তিনি তার দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন।

আব্দুল্লাহ ইবনে আমির :
বসরার শাসক ছিলেন আবু মুসা আশআরি রা.। তিনি ভালো শাসক ছিলেন। কিন্তু তিনি নিজ সেনাবাহিনীর বিরাগভাজন হওয়ায় তাকে প্রত্যাহার করতে হয়েছে। এরপর উসমান রা. আব্দুল্লাহ ইবনে আমিরকে শাসক নিযুক্ত করেন। আব্দুল্লাহ ইবনে আমির সেরা গভর্নরদের মধ্যে একজন ছিলেন। প্রাচ্যে কাবুল পর্যন্ত তিনি বিজয়ী হয়। উসমান রা.-এর আমলে সবচেয়ে বেশি এলাকা বিজয় করেন আব্দুল্লাহ ইবনে আমির।

৭ম হিজরিতে কাজা উমরাহ পালন করছিলেন রাসূল সা.। সেসময় আব্দুল্লাহ ইবনে আমির ছিল একেবারে শিশু। মুহাম্মদ সা. তাকে আদর করলেন ও অনিষ্ট থেকে রক্ষার জন্য তার মুখে হালকা থুথু ছিটিয়ে দিলেন। আব্দুল্লাহ ইবনে আমির তা খেয়ে নিল। রাসূল সা. বললেন, এ তো তৃষ্ণা নিবারণকারী হবে। আব্দুল্লাহ ইবনে আমির মরুভূমিতে যে পথ দিয়ে যেতেন সেখানে পানি পাওয়া যেত। এছাড়াও তিনি বসরার শাসক থাকা অবস্থায় প্রায় ১০ টি খাল কেটে মানুষের পানির সমস্যার সমাধান করে দেন।

উসমান রা. নিয়োগকৃত গভর্নর দুইজনই ছিলেন সফল ও কর্মে দক্ষ।  

৭ ডিসে, ২০২২

খিলাফত পর্ব-৩৮ : উসমান রা.-এর আফ্রিকা অভিযান


উসমান রা.-এর শাসনামলে তিনটি ফ্রন্টে রাষ্ট্রের সীমানা বাড়ে। পূর্বে আফগানিস্তানের কাবুল পর্যন্ত ইসলামী রাষ্ট্রের সীমানা বিস্তৃত হয়। ইউরোপের দিকে ইস্তাম্বুলের প্রণালি পর্যন্ত আর আফ্রিকার দিকে মিশর ছাড়িয়ে লিবিয়া, আলজেরিয়া ও ভূমধ্যসাগরের নিয়ন্ত্রণ নেয় ইসলামী রাষ্ট্র।  


দ্বিতীয় খলিফা উমার রা.-এর আমলে মিসরের রোমান রাজধানী আলেকজান্দ্রিয়া মুসলিমদের অধিকারে আসে। তবে মুসলিমরা ঐ শহরে বসবাসরত রোমানদেরকে বহিষ্কার করেননি। তাছাড়া বিপুল সংখ্যক মুসলিমও আলেকজান্দ্রিয়ায় হিজরাত করেননি। কেবল সীমান্ত পাহারার দায়িত্বে ছিল কিছু মুসলিম সৈনিক। ফলে শহরটিতে অনারব-অমুসলিম নাগরিকের আধিক্য ছিল। অপরদিকে উসমান রা. মিসরের শাসনকর্তার পদে পরিবর্তন আনেন। তিনি আবদুল্লাহ ইবনু সা'দ-কে মিসরের শাসক নিয়োগ করেন। 

আলেকজান্দ্রিয়ায় বসবাসরত রোমানরা এটিকে মুসলিমদের দুর্বলতা হিসেবে চিহ্নিত করে। তারা রোমান সম্রাট কন্সট্যান্টাইনকে হারানো সাম্রাজ্য পুনরুদ্ধারে উস্কানি দিতে থাকে। এদের আবেদনে সাড়া দিয়ে রোমান সম্রাট সেনাপতি মানাভীলের নেতৃত্বে ৩০০ রণতরী সজ্জিত একটি বিরাট বাহিনী আলেকজান্দ্রিয়া পুনরুদ্ধারের মিশনে প্রেরণ করেন। রোমানদের প্রস্তুতির খবর পেয়ে মিসরের মুসলিমরা খালীফা উসমান রা.-কে পরিস্থিতি অবহিত করে পত্র দিল। তারা ও আবদুল্লাহ ইবনু সা'দ মনে করলো আমর ইবনুল আস রা.-কে পুনরায় শাসক নিয়োগ করা দরকার। কারণ রোমানদের যুদ্ধকৌশল সম্পর্কে তিনি সবচেয়ে বেশি ধারণা রাখতেন। 

খলিফা তাদের অনুরোধে সম্মত হয়ে আমর রা.-কে পুনরায় মিসরে প্রেরণ করলেন। রোমান সেনাপতি মানাভীল আলেকজান্দ্রিয়ায় লুটপাটের মাধ্যমে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে কায়রোর দিকে রওয়ানা করল। মানাভীলকে পশ্চাদ্ধাবনের পরামর্শ দিলেন সহযোদ্ধারা; কিন্তু আমর রা.-এর চিন্তা ছিল ভিন্ন। তিনি মানাভীলের লাগাম ছেড়ে দিলেন, তাকে ধ্বংসযজ্ঞ চালানোর সুযোগ দিলেন। প্রকারান্তরে তিনি মিসরবাসীকে তুলনার সুযোগ দিলেন। মিসরবাসী যেন রোমান খৃস্টান ও মুসলিম শাসনের মাঝে তফাৎ উপলব্ধির প্রত্যক্ষ সুযোগ পায়, সে লক্ষ্যে 'আমর ইবনুল আস রা. মানাভীলকে একটু সুযোগ দিলেন। মানাভীল বিনা বাধায় এগিয়ে গেল।  

ইতোমধ্যে আমর রা.-এর সেনাপতিত্বে মুসলিম বাহিনী এগিয়ে গেল নীল নদের তীরে দু'বাহিনীর মাঝে প্রচণ্ড যুদ্ধ হলো। প্রচণ্ড যুদ্ধে আমর রা.-এর ঘোড়া তীরবিদ্ধ হলে তিনি বাহন ছেড়ে দিয়ে পদাতিক বাহিনীতে ঢুকে পড়েন। তীব্র লড়াইয়ের পর রোমান বাহিনী পরাজিত হলো। বিপুল সংখ্যক রোমান সৈনিক নিহত হল। অবশিষ্ট সৈনিক নিয়ে মানাভীল পিছু হটে আলেকজান্দ্রিয়ায় অবস্থান নিল। 

যদিও স্থানীয় খ্রিস্টানদের আহ্বানে রোমান বাহিনী এসেছিল কিন্তু স্থানীয়রা মুসলিমদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেনি। যুদ্ধ শেষে মুসলিমরা জরুরি কিছু সংস্কার কাজ সম্পন্ন করল। রোমানরা পলায়ন-পথে রাস্তাঘাট ও পুল-ব্রিজ ধ্বংস করে দিয়েছিল। মুসলিম বাহিনী বিধ্বস্ত অবকাঠামো জরুরিভিত্তিতে সংস্কার করল। এই কাজে তারা মিসরীয়দের সমর্থন ও সহযোগিতা লাভ করল। এরপর স্থানীয়রা মুসলিম বাহিনীকে প্রয়োজনীয় অস্ত্রশস্ত্র ও রসদ সরবরাহ করল।

আলেকজান্দ্রিয়ায় পৌঁছে মুসলিম বাহিনী শহর অবরোধ করে মিনজানিক দিয়ে হামলা শুরু করল। কয়েকদিন প্রতিরোধের পর স্থানীয়রা গেইট খুলে দিতে বাধ্য হলো। শহরের অভ্যন্তরে দু'বাহিনীর মাঝে তীব্র লড়াই চলল কয়েকদিন। মানাভীলসহ বহু সংখ্যক খৃস্টান সৈন্য নিহত হল, অনেকে পালিয়ে গেল। যুদ্ধ বন্ধ হওয়ার পর আমর ইবনুল আস রা. 'মাসজিদুর রাহমাহ' নামে একটি মাসজিদ নির্মাণ করল। এরপর তিনি অবকাঠামো পুনঃনির্মাণে মনোযোগ দিলেন। আলেকজান্দ্রিয়ায় শান্তি ফিরে এলো। খ্রিস্টান বিশপ বেঞ্জামিন পলায়ন করেছিলেন। শহরের খৃস্টানরা চুক্তিভঙ্গ করেনি; অতএব তাদেরকে নিরাপত্তা দেওয়া হয় এবং নিরাপদে ধর্মকর্ম পালনের সুযোগ দেওয়া হয়। 

দলে দলে মিসরীয়রা এসে আমর রা.-এর কাছে অভিযোগ করল, রোমানরা তাদের গবাদিপশু থেকে শুরু করে সবকিছু লুট করেছে, তাদের লুণ্ঠিত সম্পদ যেন ফেরত দেওয়া হয়। আমর রা. এদের অনুরোধ রাখলেন, রোমানদের ফেলে যাওয়া সম্পদ প্রমাণসাপেক্ষে মিসরীয় মালিকদের কাছে ফেরত দিলেন। এটি মুসলিমদের পরম ঔদার্যের দৃষ্টান্ত হিসেবে উপস্থাপিত হয়। মজলুম মিসরীয়দের অনুরোধের প্রেক্ষিতে আমর রা. দখলদার রোমান বাহিনীর পরিত্যক্ত সম্পদ মালে-গানীমাত হিসেবে বণ্টন না করে মিসরীয়দের মধ্যে বিতরণ করে দিলেন। 

দ্বিতীয় খালীফা উমার রা.-এর সময়ে আমর রা. নুবায় (বর্তমানে সুদান) অভিযান পরিচালনা করেছিলেন। তবে এই অভিযানে মুসলিমরা সুবিধা করতে পারেনি। নুবা-এর কৃষ্ণাঙ্গ যোদ্ধাদের কাছ থেকে তারা তীব্র প্রতিরোধের সম্মুখীন হন। মুসলিমরা অভিনব এক যুদ্ধকৌশলের কাছে পরাস্ত হন। নুবার কালো যোদ্ধা তীর নিক্ষেপে খুবই দক্ষ ছিল। তারা মুসলিম মুজাহিদদের চোখ লক্ষ্য করে তীর নিক্ষেপ করতে থাকে। প্রথম যুদ্ধেই কমপক্ষে ১৫০ জন মুসলিম যোদ্ধা চোখ হারান। বাধ্য হয়ে আমর রা. নুবা-এর অধিবাসীদের সাথে সন্ধি করে ফিরে আসেন।

মিসরের শাসক হিসেবে নিয়োগ লাভের পর আবদুল্লাহ ইবনু সা'দ ৩১ হিজরীতে আবার নুবা'য় অভিযান পরিচালনা করেন। এই যুদ্ধেও বিপুল সংখ্যক মুসলিম যোদ্ধা চোখ হারান। তীব্র লড়াইয়ের পর নুবা'র অধিবাসীরা সন্ধির প্রস্তাব দেয়। প্রস্তাব মেনে নিয়ে ইবনু সা'দ তাদের সাথে সন্ধি করেন যা ছয় শতাব্দী স্থায়ী ছিল। খিলাফাতের ইতিহাসে বিরল এই চুক্তিটি কর বা জিইয়ার বিনিময়ে সম্পাদিত হয়নি। 

নুবা বা সুদান ছিল মরুময় এলাকা; সেখানে শস্য উৎপাদন হত না বললেই চলে। ফলে কর হিসেবে নগদ অর্থ বা শস্য প্রদান তাদের পক্ষে একেবারেই অসম্ভব ছিল। পক্ষান্তরে দারিদ্রের কারণে সেখানে দাস কেনাবেচা হত। অভিভাবকরা স্বেচ্ছায় নিজেদের সন্তান-সন্ততিকে বিক্রি করে দিত। বিক্রি হওয়াকে তারা চাকুরি পাওয়ার মতো সেলিব্রেট করতো। ধরে নেওয়া হতো যে বিক্রি হয়েছে তার আর খাবারের অভাব হবে না। 

মুসলিমদের সাথে সম্পাদিত চুক্তিতে এই দাস হওয়ার প্রতিফলন ছিল। চুক্তির শর্ত ছিল এই: প্রতি বছর নুবাবাসী ৩০০ দাস প্রদান করবে, বিনিময়ে মুসলিমরা (সমমূল্যের) গম ও যবসহ প্রয়োজনীয় খাদ্যশস্য সরবরাহ করবে। পাশাপাশি নুবা'র অধিবাসীদের স্বাধীনতা মেনে নেওয়া হয় এবং মুসলিমদের অবাধ যাতায়াত ও ব্যবসা-বাণিজ্যের সুযোগ স্বীকার করা হয়। এই চুক্তি নুবা'য় ইসলাম প্রচারের বিরাট সুযোগ এনে দেয়; মুসলিমদের সাহচর্যে বিপুল সংখ্যক নুবাবাসী(সুদানবাসী) ইসলাম গ্রহণ করেন।

মিসর-গভর্ণর 'আমর ইবনুল আস রা. আফ্রিকা বিজয়ের সূচনা করেছিলেন। আলেকজান্দ্রিয়ার রোমান বিদ্রোহ দমনের পরই তিনি বারকাহ, যুওয়াইলাহ ও লিবিয়ার ত্রিপলিসহ উত্তর আফ্রিকার কিছু অংশ বিজয় করেছিলেন। আবদুল্লাহ ইবনু সা'দ মিসরের শাসনকর্তা নিযুক্ত হওয়ার পর আফ্রিকা সীমান্তে ক্ষুদ্র অশ্বারোহী বাহিনী প্রেরণ করতেন। ক্ষুদ্র অভিযানসমূহ সাফল্যের সাথে প্রত্যাবর্তন করত। প্রতিবারই গানীমাত অর্জিত হত এবং ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র এলাকা বিজিত হত।

আফ্রিকার মানবসম্পদ, প্রাকৃতিক সম্পদ, প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাসহ বিভিন্ন বিষয়ে সবিস্তারে সংবাদ সংগ্রহের পর 'আবদুল্লাহ ইবনু সা'দ গোটা আফ্রিকায় বড় অভিযান পরিচালনার অনুমতি চেয়ে উসমান রা.-এর কাছে লিখলেন। খালীফা উসমান রা. নেতৃস্থানীয় সাহাবায়ে কিরামের সাথে পরামর্শ করলেন; দুয়েকজন ছাড়া বেশির ভাগ সাহাবী অভিযানের পক্ষে মত দিলেন। আফ্রিকা অভিযানের পক্ষে ইতিবাচক সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর উসমান রা. জিহাদের অংশগ্রহণের জন্য উদাত্ত আহ্বান জানালেন। বিপুল সংখ্যক মুজাহিদ খালীফার ডাকে সাড়া দিলেন। অল্প সময়ের মাঝেই খিলাফাতের রাজধানী মাদীনাতেই বিশাল স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী প্রস্তুত হল। 

বিশিষ্ট ব্যক্তিদের মাঝে রাসূলুল্লাহ সা.-এর নাতি হাসান রা. ও আল-হুসাইন রা., মা'বাদ ইবনু 'আব্বাস, আবদুর রহমান ইবনু যায়িদ ইবনিল খাত্তাব, আবদুল্লাহ ইবনু উমার রা., আসিম ইবনু উমার, উবাইদুল্লাহ ইবনু 'উমার, আবদুর রহমান ইবনু আবি বাকর, আবদুল্লাহ ইবনু আমর ইবনিল আস প্রমুখ সেনাবাহিনীতে যোগ দিলেন। 

উসমান রা. নিজেও যুদ্ধ প্রস্তুতিতে অংশগ্রহণ করলেন। তিনি এক হাজার উট দিলেন। রওয়ানা করার প্রাক্কালে খালীফা সৈনিকদের উদ্দেশ্যে উদ্দীপক ভাষণ দিলেন। আল-হারিছ ইবনুল হাকামকে সেনাপতি নিয়োগ করা হল। মাদীনার বাহিনী মিসরীয় বাহিনীর সাথে যোগ দিল। যৌথ বাহিনী আবদুল্লাহ ইবনু সা'দ-এর নেতৃত্বে ফুসতাত হতে বের হয়ে মিসর ও লিবিয়া সীমানা ধরে এগিয়ে গেল। 

২০ হাজার সৈন্য নিয়ে মুসলিম বাহিনী বারকাহ-এ পৌঁছলে উকবা ইবনু নাফি আল-ফিহরী তাদের সাথে যোগ দিলেন। তিনি আগে থেকেই এই অঞ্চলে অবস্থান করছিলেন। বারকাহ অঞ্চল মুসলিম বাহিনী নির্বিঘ্নে অতিক্রম করল। আবদুল্লাহ ইবনু সা'দ সেনাবাহিনীকে নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার পথে সতর্কতামূলক পদক্ষেপ হিসেবে অগ্রবর্তী গোয়েন্দা বাহিনী প্রেরণ করলেন। এদের কাজ ছিল যাত্রাপথের কোথাও শত্রুবাহিনী লুকিয়ে থাকলে তার সংবাদ দেওয়া। এই পদক্ষেপের সুফল অতি দ্রুতই পাওয়া গেল। অগ্রবর্তী গোয়েন্দা দল ত্রিপলীর উপকূলে ভূমধ্যসাগরের তীরে কয়েকটি রোমান রণতরী দেখতে পেল। আবদুল্লাহ অতি দ্রুত একদল সৈনিক উপকূল পানে প্রেরণ করলেন, তারা শতাধিক রোমান সৈন্যকে আটক করল এবং অস্ত্রশস্ত্র ও রসদ সামগ্রীসহ বিপুল পরিমাণ গনীমাতের সম্পদ লাভ করলেন। 

অগ্রবর্তী গোয়েন্দা বাহিনী কর্তৃক সরবরাহকৃত তথ্যের আলোকে পদক্ষেপ গ্রহণ করে 'আবদুল্লাহ ইবনু সা'দ এগিয়ে গেলেন। আফ্রিকার তৎকালীন রাজধানী সুবাইতালাহ শহরে পৌঁছে শত্রু বাহিনীর দেখা মিলল। এক পক্ষে আবদুল্লাহ ইবনু সা'দ-এর নেতৃত্বাধীন মুসলিম বাহিনী, অপরপক্ষে আফ্রিকার রোমীয় শাসক জারজির নেতৃত্বাধীন এক লক্ষ বিশ হাজার সৈন্যের রোমান বাহিনী। চূড়ান্ত যুদ্ধ শুরুর পূর্বে দু'সেনাপতির মাঝে কয়েক দফা পত্র ও দূত বিনিময় হয়। আবদুল্লাহ ইবনু সা'দ এই সুযোগে ইসলামের সুমহান দাওয়াত উপস্থাপন করলেন। 

তিনি জারজিরকে ইসলামের দিকে আহ্বান জানালেন। বিকল্প হিসেবে জিজিয়া আদায় করে ইসলামী খিলাফাত-এর কর্তৃত্বের অধীনে স্বধর্মে বহাল থাকার এবং স্বশাসন বজায় রাখার সুযোগ গ্রহণের আহ্বান জানালেন। জারজির ও তার বাহিনী দম্ভভরে এই দাওয়াত প্রত্যাখ্যান করল, ফলে যুদ্ধ অনিবার্য হয়ে পড়ল। কয়েকদিন ঘোরতর যুদ্ধ চলল। অমীমাংসিত এই যুদ্ধে নির্ণায়কের ভূমিকা পালন করলেন আবদুল্লাহ ইবনে যুবাইর রা.। স্বীয় বাহিনী নিয়ে তিনি মুসলিম বাহিনীর সাথে যোগদান করলে মুসলিমদের শক্তিবৃদ্ধি হয়। তাঁর হাতেই রোমান শাসক জারজির প্রাণ হারান।
 
রোমান শাসক জারজিরের পরিণতি দেখে উপকূলের অধিবাসীরা রণে ভঙ্গ দিল। তারা কর দেওয়ার বিনিময়ে মুসলিমদের সাথে সন্ধি করার প্রস্তাব দিল। আবদুল্লাহ ইবনু সা'দ তাদের প্রস্তাব মেনে নিলেন। বার্ষিক জিযইয়া হিসেবে তারা ৩০০ কিনতার স্বর্ণ নির্ধারণ হলো। তবে শর্ত ছিল মুসলিমরা তাদের এলাকা ছেড়ে চলে যাবে এবং চুক্তি ভঙ্গ না করলে পুনরায় হামলা করবে না। চুক্তির পূর্বে যা মুসলিমদের হস্তগত হয়েছে তা ফেরত দিতে হবে না, তবে চুক্তির পর যা মুসলিমরা নিয়েছে তা ফেরত দেবে। আবদুল্লাহ তাদের প্রস্তাব মেনে নিলেন এবং মিসরে ফিরে গেলেন। 

ইসলামের ইতিহাসে যাতুস সাওয়ারী যুদ্ধ অবিস্মরণীয় হয়ে আছে। এটি প্রথম নৌযুদ্ধ- যাতে মুসলিমরা রোমানদেরকে পর্যুদস্ত করেছিল। আফ্রিকায় সাম্রাজ্য হারানোর পর রোমানরা ভূমধ্যসাগরের কিছু অংশের কর্তৃত্বও মুসলিমদের কাছে হারায়। রাদূস থেকে বারকাহ পর্যন্ত দীর্ঘ উপকূলজুড়ে মুসলিমদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়। রোমান সম্রাট কস্ট্যান্টাইন-এর নিকট ব্যাপারটি ছিল অত্যন্ত লজ্জাজনক। তিনি আফ্রিকার হারানো সাম্রাজ্য পুনরুদ্ধারে সংকল্পবদ্ধ হলেন। আলেকজান্দ্রিয়া ছিল রোমান মিসরের রাজধানী; এটি পুনরুদ্ধার করাও ছিল তাঁর নিকট অনেক গুরুত্বপূর্ণ। 

রোমান সম্রাট ১০০০ যুদ্ধজাহাজ সমৃদ্ধ একটি নৌবহর প্রস্তুত করলেন। রোমানদের প্রস্তুতির সংবাদ মুসলিমদের কাছে পৌঁছলে উসমান রা. আক্রমণকারী শত্রুর প্রতিরোধে পর্যাপ্ত প্রস্তুতি নিতে সংশ্লিষ্ট শাসকদেরকে নির্দেশ দিলেন। খালীফার আদেশ পেয়ে মু'আবিয়া রা. সিরিয়ার নৌযানগুলো বুসর ইবনু উরতা-এর নেতৃত্বে আলেকজান্দ্রিয়ায় পাঠিয়ে দিলেন। অন্যদিকে মিসরের নৌযানগুলো 'আবদুল্লাহ ইবনু সা'দ রণসাজে সজ্জিত করলেন। সিরিয়া ও মিসরের নৌবহরের সম্মিলিত নৌযান সংখ্যা ছিল দুইশ। মিসর শাসনকর্তা আবদুল্লাহ ইবনু সা'দের নেতৃত্বে মুসলিম নৌবহর রওয়ানা করল। 

রোমানরা তীরে নামতে অস্বীকার করল আর ভূমধ্যসাগরের বিশাল জলরাশিতে নৌযুদ্ধে অবতীর্ণ হতে মুসলিমদের বাধ্য করলো। যেহেতু সমুদ্রের যুদ্ধে রোমানরা পারদর্শী ছিল তাই তারা ছিল খোশমেজাজে। রোমানরা সারারাত বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে আনন্দ করল। পক্ষান্তরে মুসলিমগণ সালাত, দু'আ ও যিকরে রাত কাটিয়ে দিলেন। কনস্ট্যান্টাইন খুব সকালে যুদ্ধ শুরু করতে চাইলেন। অন্যদিকে 'আবদুল্লাহ ইবনু সা'দ জামাআতের সাথে ফাজর সালাত আদায়ের পর শীর্ষ কমাণ্ডারদের সাথে পরামর্শ করলেন; আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে অত্যন্ত চমৎকার একটি কৌশল বেরিয়ে এল। মুসলিমগণ সিদ্ধান্ত নিলেন তারা সাগরকে স্থলভাগ বানিয়ে যুদ্ধ করবেন। 

প্রথমে তারা নিজেদের নৌযানগুলো শত্রুর নৌযানের কাছাকাছি নিয়ে গেলেন। তারপর কমাণ্ডো বাহিনী সাগরে নেমে পড়লেন। অতঃপর শক্ত দড়ি দিয়ে মুসলিম বাহিনীর নৌযানের সাথে রোমান বাহিনীর নৌযানগুলো বেঁধে ফেলা হল। সাগরে ১২০০ নৌযান, প্রতি ১০ টি বা ২০ টি নৌযান একত্রে বাঁধা; সাগরে সৃষ্টি হল কয়েক টুকরা ভূখণ্ড। এভাবে অথৈ জলরাশিতে অবস্থান করেও স্থলযুদ্ধ পরিচালনার পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হল। যুদ্ধজাহাজের চার কিনারায় সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে মুসলিমগণ প্রস্তুত হলেন। 'আবদুল্লাহ ইবনু সা'দ দিকনির্দেশনামূলক উজ্জীবনী বক্তৃতা দিলেন। তিনি যোদ্ধাদেরকে সূরাতুল আনফাল তিলাওয়াত করতে বললেন।

নৌযুদ্ধে সাফল্য লাভের ব্যাপারে রোমানরা অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসী ছিল। ভূমধ্যসাগরে তারা দোর্দণ্ড প্রতাপে দীর্ঘদিন আধিপত্য বিস্তার করে আসছে, অন্যদিকে মুসলিমদের জন্য ছিল এটিই প্রথম নৌযুদ্ধ। আত্মবিশ্বাসী রোমানরা প্রথমে আক্রমণ চালাল। তারা মুসলিমদের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ধ্বংস করে দিতে চাইল, অপর পক্ষে মুসলিমরাও তীব্র প্রতিরোধ চালিয়ে গেল। দু'পক্ষ কয়েকদিন ধরে লড়াই চালিয়ে গেল। বিপুল সংখ্যক যোদ্ধা হতাহত হল। বহু লাশ সাগরে ভেসে গেল। ভয়ংকর যুদ্ধ বেধে গেল। নানান প্রতিকূলতা সত্ত্বেও মুসলিমরা যুদ্ধে তাদের অবস্থান ধরে রাখলো। 

অবশেষে আল্লাহর সাহায্যে মুসলিমরা যুদ্ধে জয়ী হয়। সম্রাট কনস্ট্যান্টাইন নিজেও আহত হলেন। স্বীয় বাহিনীর দুরবস্থা দেখে তিনি কিছু অনুচর সহযোগে পালিয়ে সিসিলি দ্বীপে আশ্রয় নিলেন। রোমান সম্রাট আশ্রয় নেওয়ার পর দ্বীপটিতে প্রচণ্ড ঝড় শুরু হল। দ্বীপবাসী আশ্রিতদের কাছে জানতে চাইল কেন তারা পালিয়ে এসেছে। তারা প্রকৃত ঘটনা জানিয়ে দিলে সিসিলিবাসী বলল, ‘আপনি খৃস্টবাদকে ধ্বংস করেছেন এবং এর অনুসারীদেরকে নিঃশেষ করেছেন, মুসলিমরা যদি এখানে আসে তবে কেউ তাদেরকে ঠেকাতে পারবে না।' মুসলিমদের হাতে পরাজিত খৃস্টান শাসককে আশ্রয় দেয়নি সিসিলিবাসী; তারা কনস্ট্যান্টাইনকে হত্যা করল। 

ইতিহাসে বিখ্যাত এই যুদ্ধের পূর্ব পর্যন্ত দোর্দণ্ড প্রতাপে ভূমধ্যসাগর নিয়ন্ত্রণ করত রোমানরা। যাতুস সাওয়ারী যুদ্ধের পূর্বেই মিসর ও আফ্রিকা তাদের হাতছাড়া হয়। এই যুদ্ধের পর ভূভাগের পাশাপাশি সমুদ্রও তাদের নিয়ন্ত্রণমুক্ত হয়। সমগ্র ভূমধ্যসাগরে মুসলিম কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়। ইতোপূর্বে যে অঞ্চলগুলোতে ইসলামের বিজয় হয়েছিল সেগুলো ছিল স্থলভাগের এলাকা। ভূমধ্যসাগরে মুসলিম কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর বিভিন্ন দ্বীপে ইসলামের দাওয়াত সম্প্রসারণের সুযোগ সৃষ্টি হয়। মুসলিম দা'ঈগণ এই সুযোগ গ্রহণ করলেন এবং দূর-দূরান্তের দ্বীপগুলোতে ইসলামের আদর্শ পৌঁছে দিলে লাগলেন। 

ক্রীট, কোর্সিকা, সার্দিনিয়া, সিসিলিসহ ভূমধ্যসাগরীয় অন্যান্য দ্বীপ মুসলিম অধিকারে আসল এবং তথায় ইসলামের সুমহান দাওয়াত পৌঁছে গেল। ভূমধ্যসাগর, লোহিত সাগর, আরব সাগর, ভারত মহাসাগরে মুসলিমদের আধিপত্য ধরে রাখার জন্য ব্যাপকহারে নৌবিদ্যা ও তৎসংশ্লিষ্ট বিষয়গুলোর চর্চা শুরু হয়। বাণিজ্যতরী ও যুদ্ধজাহাজ নির্মাণশিল্পের বিস্তার ঘটে। নৌযান সংক্রান্ত জ্ঞানবিজ্ঞানের সকল শাখায় মুসলিম নাবিকরা শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করেন। আরব নৌবহরের এই আধিপত্য ষোড়শ শতকে ইউরোপীয়দের সমুদ্রাভিযানের পূর্ব পর্যন্ত অব্যাহত ছিল। মুসলিমদের নৌবিদ্যায় শ্রেষ্ঠত্বের সূচনা হয়েছিল যাতুস সাওয়ারী যুদ্ধে বিজয়ের মাধ্যমে।

৪ ডিসে, ২০২২

খিলাফত পর্ব-৩৭ : উসমান রা.-এর ইউরোপ অভিযান


রাসূলুল্লাহ সা. ও প্রথম দুই খলিফার আমলে ইসলামী খিলাফাতের কোন নৌবাহিনী ছিল না। উসমান রা.-এর আমলে খিলাফতের উত্তর পশ্চিমমুখী অর্থাৎ ইউরোপের দিকে সম্প্রসারণের স্বার্থে নৌবাহিনী গঠনের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে অভিজ্ঞদের সাথে পরামর্শক্রমে খালীফা নৌবাহিনী গঠনের অনুমতি দেন। নবগঠিত বাহিনী যুদ্ধে অভূতপূর্ব সাফল্য অর্জন করে। খিলাফাতের ইতিহাসে সর্বপ্রথম নৌবাহিনী গঠনের কৃতিত্ব মু'আবিয়া রা.-এর এবং সাইপ্রাস অভিযানে প্রথমবারের মত মুসলিমরা নৌবাহিনী ব্যবহার
করে।

এর আগে দ্বিতীয় খালীফা ‘উমার রা.-এর আমলে মু'আবিয়া রা. সিরিয়ার শাসনকর্তা ছিলেন। সিরিয়ার বিভিন্ন অঞ্চল রোমান সাম্রাজ্যের সীমান্তবর্তী ছিল। তিনি প্রায়ই রোমানদের আক্রমণের শঙ্কায় থাকতেন। তিনি উমার রা.-কে লিখেন, 'আলেপ্পোর কোন কোন গ্রাম হতে রোমানদের কুকুরের চিৎকার ও মোরগের বাক শোনা যায়। অতএব নৌযুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়ার অনুমতি দিন।

এই বিষয়ে উমার রা. তথ্যানুসন্ধান করলেন। মিসরের শাসক আমর ইবনুল আস রা.-কে তিনি লিখলেন, সমুদ্র ও সমুদ্রারোহী সম্পর্কে আমাকে জানান। আমার মন ওদিকে ঝুঁকছে। জবাবে আমর রা. লিখলেন, 'সাগর একটি মহাসৃষ্টি, খুব কম মানুষই এতে আরোহণ করে, সাগরের নিচে পানি আর ওপরে আকাশ, এছাড়া আর কিছুই নেই। সাগর যখন স্থির থাকে তখন হৃদয় বিদীর্ণ করে, আর যখন প্রকম্পিত হয় তখন বুদ্ধি বেঁকে যায়, সাগরে ইয়াকীন কমে যায় আর সন্দেহ বেড়ে যায়, সাগরারোহীরা নৌকার ওপর কীটের ন্যায়; হেলে পড়লে ডুবে যায় আর মুক্তি পেলে পেরেশান ও হয়রান হয়ে পড়ে।'

আমর রা. হতে সমুদ্র সম্পর্কে অবহিত হয়ে উমার রা. মু'আবিয়া রা.-কে লিখলেন, 'না, তোমাকে সমুদ্রাভিযানের অনুমতি দেওয়া হলো না। আমি এখনই কোন মুসলিমকে সাগরে অভিযানে পাঠাব না। আল্লাহর শপথ, রোমের সমস্ত সম্পদের চাইতে একজন মুসলিম আমার কাছে অনেক গুরুত্বপূর্ণ।

রোমান সাম্রাজ্যের সৌন্দর্য ও ঐশ্বর্য সম্পর্কে মু'আবিয়া রা. জানতেন। তাই তিনি তাঁর পরিকল্পনা হতে রোমান সাম্রাজ্যে অভিযানের বিষয়টি বাদ দিতে পারলেন না। উসমান রা. খলীফা নির্বাচিত হলে মু'আবিয়া রা. আবারো সমুদ্রাভিযানের অনুমতি চাইলেন। এ বিষয়ে উমার রা.-এর সিদ্ধান্ত উসমান রা.-এর জানা ছিল। তাই তিনি প্রথমবার অনুমতি দেননি।

কিন্তু মু'আবিয়া রা.-এর বারংবার অনুরোধে উসমান রা. শর্তসাপেক্ষে রাজি হন। একটি শক্তিশালী নৌ-বাহিনী গঠনের উদ্যোগ নেন। মুসলিমদের জন্য সম্পূর্ণ নতুন এ অভিযানের জন্য মু'আবিয়া রা. সর্বাত্মক প্রস্তুতি গ্রহণ করেন। কিছু নৌযান প্রয়োজনীয় অস্ত্রশস্ত্র ও রসদসহ প্রস্তুত করা হয়। অভিযান শুরু করার জন্য আকা বন্দর বাছাই করা হয়। সামুদ্রিক জিহাদে অংশগ্রহণের জন্য নৌবাহিনীর সদস্যরা প্রস্তুতি সম্পন্ন করেন। মু'আবিয়া রা.-এর সাথে তাঁর স্ত্রী ফাখিতা বিনতু কারাযা অভিযানে অংশগ্রহণ করেন আর বিশিষ্ট সাহাবী উবাদাহ ইবনু সামিত রা.-এর সাথে তাঁর স্ত্রী উম্মু হারাম বিনতু মিলহান রা. এ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। মুআবিয়া রা.-এর জন্য স্ত্রী সাথে নিয়ে যাওয়া খলিফার দেওয়া শর্ত ছিল। যাতে মুআবিয়া রা. যুদ্ধে মুসলিমদের নিরাপত্তার ব্যাপারে কনসার্ন থাকেন।

রাসূলুল্লাহ সা.-এর দু'আ কবুল হওয়ার একটি নজির হল উবাদাহ রা.-এর স্ত্রী উম্মু হারাম বিনতু মিলহানের সাইপ্রাস যুদ্ধে অংশগ্রহণ ও শাহাদাতবরণ। আনাস রা.-এর খালা ও 'উবাদা ইবনু সামিত রা.-এর পত্নি উম্মু হারামের বাসায় রাসূলুল্লাহ সা. মাঝেমধ্যে যেতেন এবং পানাহার করতেন। একদিন রাসূলুল্লাহ সা. তাঁর বাসায় গিয়ে পানাহার করেন ও ঘুমিয়ে পড়লেন।

ঘুম থেকে জেগে তিনি হেসে ওঠলেন। উপস্থিতরা জিজ্ঞাসা করলো আপনি কেন হাসলেন? তিনি বললেন, 'স্বপ্নে আমি আমার উম্মাতের একদল যোদ্ধাকে দেখলাম, সিংহাসনে উপবিষ্ট রাজার ন্যায় তারা সাগর পাড়ি দিচ্ছে। উম্মু হারাম রা. বললেন, 'আপনি দু'আ করুন, আমিও যেন সেই দলের অন্তর্ভুক্ত হই। রাসূলুল্লাহ সা. তাঁর জন্য দু'আ করে আবার ঘুমিয়ে পড়লেন। কিছুক্ষণ পর ঘুম থেকে জেগে আবার হেসে ওঠলেন। উম্মু হারাম রা. জিজ্ঞেস করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনি কেন হাসলেন?' রাসূলুল্লাহ সা. বললেন, 'স্বপ্নে আমি আমার উম্মাতের একদল যোদ্ধাকে দেখলাম, সিংহাসনে উপবিষ্ট রাজার ন্যায় তারা সাগর পাড়ি দিচ্ছে আর সেই বাহিনীতে তুমিও আছো।

২৮ হিজরীতে কিছু নৌযান নিয়ে মুসলিম বাহিনী 'আকা বন্দর হতে সাইপ্রাসের উদ্দেশে রওয়ানা করলেন। রোমান দ্বীপটিতে পৌঁছার পর বাহিনীর সদস্যদের সাথে উম্মু হারাম রা.-ও তীরে অবতরণ করলেন। তিনি যখন বাহনে আরোহণ করতে গেলেন তখন তিনি পড়ে গেলেন এবং তাঁর ঘাড় ভেঙ্গে গেল। ঘটনাস্থলেই তিনি প্রাণ হারালেন। ঐ দ্বীপে উম্মু হারাম রা.-এর কবরটি দ্বীন প্রচারে মুসলিমদের ত্যাগের স্মারক হিসেবে আজো বিদ্যমান। পরবর্তীতে ঐ স্থানটি নেককার রমণীর কবর হিসেবে পরিচিত হয়।

এ অভিযানে বেশ কয়েকজন সাহাবী অংশগ্রহণ করেন। সেনাপতি ও বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের সাথে পরামর্শক্রমে মু'আবিয়া রা. সরাসরি আক্রমণ না করার সিদ্ধান্ত নিলেন। তিনি দূত মারফত সাইপ্রাসবাসীদের জানালেন:
(১) আমরা এখানে যুদ্ধ করতে আসিনি।
(২) আমরা এসেছি আল্লাহর মনোনীত দ্বীন ইসলামের সুমহান আদর্শের দিকে আহ্বান জানানোর জন্য।
(৩) ইসলামী সাম্রাজ্যের অবিচ্ছেদ্য অংশ সিরিয়ার সীমান্তের নিরাপত্তার জন্যও এ অভিযান পরিচালনার প্রয়োজন হয়েছে। কারণ রোমানরা সাইপ্রাসকে ঘাঁটি বানিয়ে সিরিয়া সীমান্তে অব্যাহতভাবে হামলা চালাচ্ছে। এসব অভিযানের জন্য তারা সাইপ্রাস থেকে সৈন্যও সংগ্রহ করে। তোমরা আত্মসমর্পণ করলে আমরা কোন অভিযান পরিচালনা করব না।'

মুসলিমদের এই আহ্বানে সাইপ্রাসবাসী সাড়া দিল না। তারা রোমান সহায়তার প্রতীক্ষায় ছিল, তাদের ধারণা ছিল রোমানরা তাদের সাহায্যে এগিয়ে আসবে এবং মুসলিমদেরকে দ্বীপ থেকে বিতাড়িত করবে। সাইপ্রাসবাসীর কাছ থেকে ইতিবাচক সাড়া না আসায় মুসলিম বাহিনী দ্বীপটির রাজধানী অবরোধ করল। কয়েক ঘন্টার মধ্যেই দ্বীপবাসী আত্মসমর্পণ করে সন্ধির প্রস্তাব দিল। মুসলিম বাহিনী সন্ধি প্রস্তাব মেনে নিল। সাইপ্রাসবাসীর শর্ত ছিল তাদেরকে যেন রোমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে সম্পৃক্ত না করা হয়; কারণ রোমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার সামর্থ তাদের ছিল না। মুসলিম বাহিনী এই শর্ত মেনে নেয়। মুসলিমদের শর্তগুলোও দ্বীপবাসী মেনে নেয়।

তাদেরকে যে শর্তগুলো দেওয়া হয়
১. দ্বীপবাসী অস্ত্রধারণ করলে মুসলিমরা তাদেরকে নিরাপত্তা দেবে না;
২. রোমানদের তৎপরতা সম্পর্কে মুসলিমদেরকে অবহিত করতে হবে;
৩. ফি বছর দ্বীপবাসী ৭০০০ দিনার মুসলিমদেরকে প্রদান করবে;
৪. শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধের সময় মুসলিম বাহিনীকে সাইপ্রাসের ভূমি বিনা দ্বিধায় ব্যবহার করতে দিতে হবে;
৫. রোমানরা মুসলিমদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করলে দ্বীপবাসী তাদেরকে সাহায্য করতে পারবে না এবং
৬. মুসলিম বাহিনী সম্পর্কিত কোন তথ্যও সরবরাহ করতে পারবে না।

সন্ধিচুক্তির পর মুসলিম বাহিনী সিরিয়ায় ফিরে গেল। খিলাফাহ-এর ইতিহাসে প্রথম সমুদ্রাভিযান ও নৌযুদ্ধে মুসলিম বাহিনী সফলতা লাভ করল। এ অভিযান মুসলিমদের সাফল্য ও সক্ষমতার স্মারক হয়ে রইল। পরবর্তী প্রতিটি সমুদ্রাভিযান ও নৌযুদ্ধে মুসলিম বাহিনীর সাফল্যের অনুপ্রেরণা হিসেবে এই অভিযান ভূমিকা পালন করেছে।

চুক্তি পালনের শর্তে সাইপ্রাসবাসীদেরকে স্বশাসনের সুযোগ দেওয়া হয়েছিল। মু'আবিয়া (রা.) সেখানে কোন শাসনকর্তা নিয়োগ করেননি। ওদিকে মুসলিমরা চলে আসার পর রোমানরা সাইপ্রাস দ্বীপবাসীকে ইসলামী খিলাফাতের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণের জন্য উস্কানি দিতে লাগল। ৩২ হিজরীতে সাইপ্রাসবাসী চুক্তি শর্ত ভঙ্গ করে রোমান বাহিনীকে নৌযান সরবরাহ করে সহায়তা করল। তাদের এহেন আচরণে মু'আবিয়া রা. খুবই ক্ষুব্ধ হলেন। এবার তিনি সাঁড়াশি আক্রমণ চালালেন; একদিকে মু'আবিয়া (রা.) ও অন্যদিকে আবদুল্লাহ ইবনু সা'দ-এর নেতৃত্বে অভিযান পরিচালিত হয়। বিপুল সংখ্যক দ্বীপবাসী নিহত হল, অনেকে বন্দী হল। সাইপ্রাসের শাসনকর্তা আত্মসমর্পণ করে সন্ধি প্রার্থনা করলেন। পূর্ববর্তী চুক্তির শর্তের ভিত্তিতে মু'আবিয়া রা. প্রস্তাব মেনে নিলেন। তবে এবার তিনি সতকর্তামূলক কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করলেন:
(১) সাইপ্রাসে ১২০০০ সদস্যের একটি বাহিনী মোতায়েন করলেন, এ বাহিনীতে বা আলবাক্ক হতে অনেক সৈনিক যোগদান করেছিল।
(২) একটি নতুন শহর ও মসজিদ স্থাপন করলেন।

মুসলিম বাহিনী অনুভব করল, সাইপ্রাসের বাসিন্দারা শান্তিপ্রিয় জনগোষ্ঠী, তাদের সামরিক সামর্থ্যও সীমিত। তবে রোমানরা জোর করে তাদেরকে মুসলিমদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করে। মুসলিম বাহিনী তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করল এবং রোমানদের আক্রমণ ও অত্যাচার হতে তাদেরকে রক্ষা করলো।

হাবীব ইবনু মাসলামা আল-ফিহরী ছিলেন সিরিয়ার মুসলিম বাহিনীর সেনাপতি। উসমান রা.-এর খিলাফাতকালে তাঁর সেনাপতিত্বে সিরিয়া সীমান্তে অনেকগুলো সফল অভিযান পরিচালিত হয়।

কুফা ও সিরিয়া বাহিনীর যৌথ প্রতিরোধে রোমান আগ্রাসন প্রতিহত:
২৪ হিজরীতে রোমানরা সিরিয়া সীমান্তে মুসলিম এলাকায় অভিযান পরিচালনার জন্য এগিয়ে আসে। মু'আবিয়া রা. সেনাপতি হাবীব ইবনু মাসলামা আল-ফিহরীর নেতৃত্বে সিরিয়ার বাহিনীকে রোমানদের প্রতিরোধে প্রেরণ করেন। কিন্তু তাঁর কাছে মুসলিম সৈন্য সংখ্যা অপ্রতুল মনে হওয়ায় তিনি খালীফার কাছে অতিরিক্ত ফৌজ চেয়ে পত্র লিখেন। খালীফা কূফার গভর্নর আল-ওয়ালীদকে সিরিয়া বাহিনীর সহায়তায় দ্রুত সৈন্য প্রেরণের নির্দেশ দেন। আল-ওয়ালীদ আট হাজার সৈনিকসহ কুফার একটি দল সেনাপতি সালমানের নেতৃত্বে সিরিয়দের সহায়তার জন্য প্রেরণ করেন। হাবীব ও সালমানের নেতৃত্বাধীন সিরিয়া ও কুফার মুসলিম বাহিনী শত্রুদের পর্যুদস্ত করে রোমান ভূমিতে আক্রমণ হানে। যৌথ বাহিনী বিপুল বিজয় অর্জন করে; অভিযানে বহু দুর্গ বিজিত হয়, মুসলিম বাহিনী প্রচুর যুদ্ধলব্ধ সম্পদসহ প্রত্যাবর্তন করে।

২৫ হিজরীতে খালীফা উসমান রা. সিরিয়ার গভর্ণর মু'আবিয়া রা.-কে নির্দেশ দেন তিনি যেন সেনাপতি হাবীব ইবনু মাসলামাকে আর্মেনিয়া অভিযানে প্রেরণ করেন। নির্দেশ মুতাবিক হাবীবকে আর্মেনিয়া অভিযানে প্রেরণ করা হয়। সেনাপতি হাবীব সর্বপ্রথমে ইউরোপের কালীকালা অবরোধ করেন, কিছুদিন পর স্থানীয়রা দেশত্যাগ ও জিজিয়ার বিনিময়ে নিরাপত্তা কামনা করে। তাদের আবেদন মেনে নেওয়া হয় এবং চুক্তি মুতাবিক অনেককে রোমান এলাকায় বহিষ্কার করা হয়। কালীকালায় কয়েক মাস অবস্থান করে হাবীব প্রত্যাবর্তন করেন।

সিরিয়া সীমান্তের একটি রোমান প্রদেশের নাম ছিল আর্মিনাকুস (বর্তমানে তুরস্ক)। এই প্রদেশের আওতায় অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ এলাকা ছিল, যেমন মালাতইয়া, সীওয়াস, কূনিয়া ইত্যাদি। এই প্রদেশের খৃস্টান প্রধানের নাম ছিল মাওরিয়ান। কালীকালা বিজয়ের পর মুসলিম সেনাপতি হাবীব ইবনু মাসলামা আল-ফিহরী শুনতে পেলেন যে, মাওরিয়ান ৮০,০০০ সৈন্যের এক রোমান বাহিনী সিরিয়া সীমান্তে প্রেরণ করছেন। সংবাদ পেয়ে হাবীব অতিরিক্ত ফৌজ চেয়ে মু'আবিয়ার কাছে পত্র লেখেন। মু'আবিয়া রা. খালীফার কাছে সাহায্যের আবেদন করলে তিনি কুফা হতে ছয় হাজার সৈন্যসহ সালমান ইবনু রাবী'আহ আল-বাহিলীকে প্রেরণ করেন। এবারও যৌথবাহিনী রোমানদের পর্যদুস্থ করেন। উসমান রা.-এর শাসনামলে তুরস্ক, আর্মেনিয়া, জর্জিয়া ও আজারবাইজানের বিস্তীর্ণ এলাকা মুসলিমদের দখলে আসে।

রোমানদের বিরুদ্ধে অভিযানে সাফল্য মুআবিয়া রা.-কে ভালো কনফিডেন্স এনে দেয়। তিনি ৩২ হিজরীর কনস্ট্যান্টিনোপল (বর্তমানে ইস্তাম্বুল) প্রণালীতে অভিযান চালান। এটি রোমানদের অন্তরে ভয় তৈরি করে। তবে তিনি রোমানদের রাজধানী কনস্ট্যান্টিনোপল দখল করতে পারেন নি। সেরকম ইচ্ছাও সেসময় তাঁর ছিল না। তবে রোমানদের আগ্রাসী ভূমিকা অনেকটাই তিনি থামিয়ে দিতে পেরেছেন। এছাড়াও মুয়াবিয়া রা. তাঁর সেনা ও নৌ-বাহিনী দিয়ে প্রতিবছর গ্রীষ্মকালে রোমান সীমান্তে মহড়ার আয়োজন করতেন।

১ ডিসে, ২০২২

খিলাফত পর্ব-৩৬ : উসমান রা.-এর প্রাচ্য অভিযান


আরব অঞ্চল পৃথিবীর প্রায় মাঝামাঝ স্থানে থাকায় ইসলামী রাষ্ট্র মূলত দুইদিকে বিস্তার লাভ করে। প্রথমত ইরাক ইরান হয়ে ভারতের দিকে। দ্বিতীয়ত সিরিয়া হয়ে ইউরোপের দিকে। পূর্ব দিকে অর্থাৎ ইরাক-ইরানে অগ্নিপুজারী পারসিকদের সাম্রাজ্য ছিল। আর সিরিয়া ও ইউরোপে খ্রিস্টান রোমানদের সাম্রাজ্য ছিল। উমার রা.-এর বিজয় অভিযানের ক্ষেত্রে সিরিয়া থেকে বাহিনী দুইভাগ একভাগ ইউরোপের দিকে অন্যভাগ জেরুজালেম ও মিশরের দিকে এগিয়ে যায়। ৩য় খলিফা উসমান রা.-এর খিলাফতকালে ইসলামী রাষ্ট্র প্রাচ্যের আজারবাইজান থেকে বিজয় অভিযান শুরু করে কাবুল অর্থাৎ আফগানিস্তান পর্যন্ত বিস্তৃতি লাভ করে।

এই বিস্তৃতির লাভের অনেক আগ থেকেই অর্থাৎ উমার রা.-এর শাসনামল থেকেই মুসলিম দাঈ ও ব্যবসায়ীরা এসব অঞ্চলে মুসলিমদের দাওয়াত দিতে শুরু করেছেন। উসমান রা.-এর সময়ে দাঈরা সিন্দু নদীর তীরের হিন্দুস্থানে ব্যাপক দাওয়াতী কাজ করেছেন। প্রাচ্য ও ইউরোপ অভিযানে যুদ্ধকৌশল নির্ণয় ও সেনাপতি নির্বাচনে উসমান (রা.)-এর দূরদর্শিতার প্রমাণ মেলে। অত্যন্ত বিচক্ষণতার সাথে তিনি ইসলামী রাষ্ট্রের সীমানা সংরক্ষণ করেন, অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহ দমন করে রাষ্ট্রের সীমানা সম্প্রসারণ করেন। স্বভাবে উমার রা. থেকে কোমল হওয়ায় কোন কোন ইতিহাসবিদ উসমান রা.-কে দুর্বল শাসক হিসেবে চিহ্নিত করার ব্যর্থ প্রয়াস চালিয়েছেন। একজন দুর্বল শাসকের পক্ষে এত বিশাল রাষ্ট্রের সাম্রাজ্যের সীমানা সংরক্ষণ ও রাজ্য সম্প্রসারণ সম্ভব হত না।

প্রাচ্যের বিজয়সমূহ
কুফা বাহিনীর আজারবাইজান বিজয় :
উসমান রা. খালীফা হওয়ার পর আল-ওয়ালীদ ইবনু উকবাকে কূফার শাসনকর্তা নিয়োগ করা হলে তিনি কিছু অভিযোগের ভিত্তিতে তার অধীনস্ত আজারবাইজানের শাসনকর্তা উতবা ইবনু ফারকাদকে পদচ্যুত করেন। এই সুযোগে আজারীরা বিদ্রোহ করে এবং উমার রা.-এর আমলে তারা যে সন্ধিচুক্তি করেছিল তা ভঙ্গ করে। উসমান রা. কুফার শাসনকর্তাকে বিদ্রোহ দমনের নির্দেশ দেন। ২৫ হিজরিতে আল-ওয়ালীদ সেনাপতি সালমান ইবনু রাবী'আহকে একদল সৈনিকসহ অগ্রবাহিনী হিসেবে প্রেরণ করেন। কিছু সময় পরে তিনিও একটি বড় সেনাদলসহ রওয়ানা হন। মুসলিমদের যুদ্ধযাত্রা দেখে আজারবাইজানের বিদ্রোহীরা আগের সন্ধির শর্তে আনুগত্য স্বীকার করল। আল-ওয়ালীদ তাদের আনুগত্য গ্রহণ করলেন এবং চারদিকে ক্ষুদ্র বাহিনী প্রেরণ করলেন। আবদুল্লাহ ইবনু শুবাইল আল-আহমাসী চার হাজার সৈন্যের এক বাহিনী নিয়ে মুকান, বাবর ও তাইলাসান জয় করেন। তারপর সালমান আল-বাহিলী বারো হাজার সৈনিক নিয়ে আর্মেনিয়া জয় করেন। এই যুদ্ধে প্রচুর গানীমতের সম্পদ অর্জিত হয়। বিজয় শেষে আল-ওয়ালীদ আশ'আস ইবনু কায়সকে আজারবাইজানের দায়িত্ব দিয়ে কুফায় ফিরে আসেন।

রোমানদের হামলা প্রতিরোধে কুফাবাসীদের অংশগ্রহণ :
এদিকে সিরিয়ার শাসক মুয়াবিয়া রা. রোমানদের পক্ষ বড় আক্রমণের আশংকায় ছিলেন। তাই খলিফা উসমান রা. কুফার শাসক আল ওয়ালিদকে লিখলেন, //মু'আবিয়া ইবনু আবি সুফিয়ান আমার কাছে এই মর্মে পত্র দিয়েছে যে, রোমানরা মুসলিমদের বিরুদ্ধে বিশাল সৈন্যবাহিনী প্রস্তুত করেছে। আমার মনে হয় কুফাবাসীদের উচিত সিরিয় সেনাবাহিনীকে সাহায্য করা। তোমার কাছে আমার পত্র পৌছলে তুমি এমন একজন সেনাপতি বাছাই করবে যার সাহসিকতা ও ধার্মিকতার ব্যাপারে তুমি সন্তুষ্ট এবং তাঁর সাথে আট, নয় বা দশ হাজার সৈন্যের একটি বাহিনী সিরিয়দের সাহায্যে প্রেরণ করবে। যেখানে আমার দূত তোমার সাথে সাক্ষাৎ করবে সেখান থেকেই তুমি সৈন্য প্রেরণ করবে।//

মাত্রই আজারবাইজান অভিযান শেষ করে এই চিঠি পেয়েছেন আল-ওয়ালীদ। তিনি সৈন্যদের উদ্দেশ্যে বললেন,
//হে সমাবেশ! পুর্ব দিকে আল্লাহ তোমাদের পরীক্ষা নিয়েছেন আর তোমরা সেই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছ। তিনি তোমাদের হৃত সাম্রাজ্য ফিরিয়ে দিয়েছেন, নতুন নতুন অঞ্চল তোমাদের করায়ত্ত করে দিয়েছেন, তোমরা সুস্থ অবস্থায় যুদ্ধলব্ধ সম্পদ ও সাওয়াবের অধিকারী হয়ে প্রত্যাবর্তন করেছ। সুতরাং সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর জন্য। আমার কাছে আমীরুল মু'মিনীন এই পত্র দিয়েছেন যে আমি যেন তোমাদের মধ্য থেকে বাছাই করে আট থেকে দশ হাজার সৈন্যের একটি দল গঠন করি; যাতে তোমরা তোমাদের সিরিয় ভাইদেরকে সাহায্য করতে পার। কারণ তারা রোমানদের আক্রমণের মুখে পড়েছে। আর এতে রয়েছে মহান প্রতিদান ও সুস্পষ্ট মর্যাদা। কাজেই তোমরা সালমান ইবনু রাবী'আহ আল-বাহিলী-এর নেতৃত্বে এই আহবানে সাড়া দেয়ার জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ কর।//

সৈনিকরা তাদের সেনাপতির আহবানে সাড়া দিল। তিনদিন অতিক্রান্ত হওয়ার আগে আট হাজার কুফাবাসী সালমান ইবনু রাবী'আহ আল-বাহিলীর নেতৃত্বে সিরিয়ার উদ্দেশ্যে রওয়ানা করল। ওদিকে সিরিয় বাহিনীর নেতৃত্বে ছিলেন হাবীব ইবনু মাসলামা ইবনু খালিদ আল-ফিহরী। যৌথবাহিনী শত্রু এলাকায় তীব্র হামলা করে রোমানদেরকে পর্যুদস্ত করে ফেলল। যুদ্ধ শেষে কুফা ও সিরিয়ার বাহিনী বিপুল গানীমতসহ ফিরে এলো।

সা'ঈদ ইবনুল 'আস-এর তিবরিস্তান অভিযান :
হিজরী ত্রিশ সনে কুফার গভর্ণর সা'ঈদ ইবনুল আস কুফা হতে খুরাসান (আফগানিস্তান) বিজয়ের উদ্দেশে রওয়ানা করলেন। তাঁর সাথে অনেক সাহাবী ছিলেন: হুযাইফা ইবনুল ইয়ামান রা., আল-হাসান রা., আল-হুসাইন রা., আবদুল্লাহ ইবনু আব্বাস রা., আবদুল্লাহ ইবনু উমার রা., আবদুল্লাহ ইবনু আমর ইবনিল আস রা., আবদুল্লাহ ইবনুয্ যুবাইর রা.-সহ অনেকে। তিনি ইরানের তিবরিস্তান বিজয় করেন। সেখানের মুশরিকবাহিনী বাধা তৈরী করলেও সেটা ভয়াবহ যুদ্ধে রূপ নেয়নি। তিনি একের পর এক শহর ইসলামী রাষ্ট্রের অধীনে নিয়ে আসেন। এরপর জুরজান শহরে পৌঁছলে শহরবাসী তাদের চুক্তি ভঙ্গ করে মুসলিম বাহিনীর সাথে ব্যাপক যুদ্ধে লিপ্ত হয়। এত মারাত্মকভাবে যুদ্ধ করতে হয় যে, মুসলিমরা সালাতুল খাওফ (যুদ্ধকালীন নামাজ) পড়তে হয়। অবশেষে মুসলিমরা জুরজানবাসীর দূর্গ দখল করতে সক্ষম হয়। তিবরিস্তান জয় করে সৈন্যদল কুফায় ফেরত আসে।

পারস্য সম্রাট ইয়াযদগির্দ-এর পলায়ন ও হত্যাকাণ্ড:
আবদুল্লাহ ইবনু আমির ছিলেন বসরার শাসক। তিনি ফার্স অভিমুখে রওয়ানা করে সেটি অধিকার করেন। মুসলিম বাহিনীর অগ্রগামিতার খবর পেয়ে ছন্নছাড়া পারস্যের সম্রাট ইয়াজদিগার্দ পালিয়ে গেলেন। এটি ৩০ হিজরী সনের ঘটনা। কিসরাকে ধাওয়া দেওয়ার জন্য মাজাশি ইবনু মাস'উদ আস-সুলামীকে প্রেরণ করলেন ইবনু আমির। তিনি কিসরাকে তাড়িয়ে কারমানে নিয়ে গেলেন। ইয়াযদিগার্দ খুরাসানে পালিয়ে গেলেন আর মাজাশি সেনাবাহিনী নিয়ে সায়ারজানে অবস্থান নিলেন। গ্রামবাসী নিজেদের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হওয়ার ভয়ে সম্রাটকে আশ্রয় দিল না, শুধু তাই নয়, তারা সম্রাটের বিরুদ্ধে তুর্কীদের সাহায্য চাইল। তুর্কী সৈন্যরা ইয়াযদগির্দের ক্ষুদ্র বাহিনীকে হত্যা করলে সম্রাট পালিয়ে গিয়ে মারগাব নদীর তীরে এক ব্যক্তির ঘরে আশ্রয় নিলেন। সেখানে তাকে হত্যা করা হয়। এভাবে পরিসমাপ্তি হয় দীর্ঘ পার্সিয়ান শাসক কিসরার ইতিহাস। কিসরা আর ফিরে আসেনি পৃথিবীতে।

আবদুল্লাহ ইবনু আমিরের খুরাসান বিজয় :
উসমান রা.-এর নির্দেশে ৩১ হিজরিতে আব্দুল্লাহ ইবনু আমির খোরাসান অভিযানে বের হন। কিন্তু নিশাপুরের পথে কুহিস্তান অতিক্রম করার সময় তিনি কঠিন প্রতিরোধের সম্মুখীন হন। সেনাপতি আল- আহনাফ ইবনু কায়স তাদের দর্প চূর্ণ করে নিশাপুরের রাস্তার নিরাপত্তা বিধান করেন। তারপর ক্ষুদ্র সেনাদল প্রেরণ করে তিনি রাসতাক যাম, বাখার ও জুওয়াইন দখল করেন। এখান থেকে ইবনু 'আমির, আল-আসওয়াদ ইবনু কুলসূম আল-আদাবীকে বাইহাকেরও উদ্দেশে প্রেরণ করেন। নগরপ্রাচীরের এক ছিদ্রপথ দিয়ে তিনি দলবলসহ শহরে প্রবেশ করেই স্থানীয়দের প্রবল প্রতিরোধের সম্মুখীন হন। যুদ্ধে আল-আসওয়াদ নিহত হলে তার ছোট ভাই আদহাম ইবনু কুলসূম মুসলিম বাহিনীর নেতৃত্ব গ্রহণ করেন এবং বিজয় সম্পন্ন করেন। নিশাপুর বিজয়ের পূর্বে ইবনু আমিরের সেনাপতিত্বে বুত, আশবান্দ, রুখ, যাওয়াহ, খুওয়াফ, আসফারাইন ও আরগিয়ান বিজিত হয়।

আবদুল্লাহ ইবনু আমির নিশাপুরের উপকণ্ঠে এসে শহর অবরোধ করলেন। শহরটি চারভাগে বিভক্ত ছিল; প্রতি ভাগে একজন করে শাসক ছিল। এক চতুর্থাংশের শাসক, ইবনু 'আমিরের কাছ থেকে নিরাপত্তার নিশ্চয়তা পেয়ে মুসলিমদেরকে শহরে প্রবেশ করতে দিলেন। আচানক শত্রু বাহিনী দেখে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে নিশাপুরের প্রধান শাসক সন্ধির প্রস্তাব দিলেন। নিশাপুর হতে বার্ষিক দশ লক্ষ দিরহাম কর প্রদান করা হবে-এই শর্তে চুক্তি সম্পাদিত হল। কায়স ইবনুল হায়সাম নিশাপুরের শাসক নিযুক্ত হলেন। মুসলিম সেনাবাহিনী নিশাপুরের আশে পাশে আরো বেশ কয়েকটি শহর সন্ধির মাধ্যমে ইসলামী রাষ্ট্রের অধিকারে নিয়ে আসেন।

মার্ভারুজ বিজয় :
আবদুল্লাহ ইবনু আমির তাঁর সেনাপতি আল-আহনাফ ইবনু কায়সকে মার্ভারুয অভিমুখে প্রেরণ করেন। আল-আহনাফ শহর অবরোধ করে রাখেন। শহরবাসী দুর্গ থেকে বের হয়ে মুসলিমদের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হয়। কিন্তু পরাজিত হয়ে পুনরায় দুর্গে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়। মার্ভবাসীর অনুরোধে সেই দিনের জন্য যুদ্ধ স্থগিত রেখে আল-আহনাফ শিবিরে ফিরে যান। পরদিন প্রত্যুষে মার্ভের গভর্ণর তাঁর ভ্রাতুষ্পুত্র মাহাক মারফত আরব বাহিনীর অধিনায়ক আল-আহনাফের নিকট সন্ধির প্রস্তাব সম্বলিত একটি চিঠি প্রেরণ করেন। পত্রে নিম্নোক্ত শর্তাবলীর উল্লেখ ছিল:
ক) মার্ভ থেকে বার্ষিক ষাট হাজার দিরহাম কর প্রদান করা হবে;
খ) পারস্য সম্রাট কিসরা কর্তৃক দখলকৃত ভূমিতে গভর্ণরের অধিকার মেনে নিতে হবে;
গ) গভর্ণর ও তাঁর পরিবারের কাছ থেকে কর আদায় করা যাবে না এবং
ঘ) মার্ভের নেতৃত্ব তাঁর পরিবারের হাতেই বহাল রাখতে হবে।
আল-আহনাফ চিঠির বিষয়বস্তুর ব্যাপারে নেতৃস্থানীয় সৈনিকদের সাথে পরামর্শ করে ইতিবাচক জবাব দিলেন। তবে একটি অতিরিক্ত শর্ত যুক্ত করলেন যে মার্ভবাসীকে মুসলিমদের শত্রুদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে হবে। তদুপরি তিনি তাদেরকে ইসলামের দিকে আহ্বান জানালেন; তারা যদি ইসলাম গ্রহণ করে তাহলে তারা মর্যাদায় আসীন হবে এবং মুসলিমদের ভাই বলে পরিগণিত হবে। মুহাররাম মাসের প্রথম দিবসে সম্পাদিত এই চুক্তিনামা লেখেন বানু সা'লাবা - এর আযাদকৃত দাস কায়সান।

তুখারিস্তান, জুযজান, তালকান ও ফারিয়ার বিজয়:
এরপর আল- আহনাফ চার হাজার সৈনিক নিয়ে তুখারিস্তান অভিমুখে রওয়ানা করেন। মুসলিম বাহিনীর অগ্রগামিতার খবর পেয়ে তুখারিস্তান, জুযজান, তালকান ও ফারিয়াব-এর প্রায় ত্রিশ হাজার সৈন্য তিনটি দলে বিভক্ত হয়ে যুদ্ধের প্রস্তুতি নেয়। বিপুল সংখ্যক শত্রু সৈন্য দেখে মুসলিমদের মাঝে যুদ্ধের ব্যাপারে মতভেদ দেখা দেয়। কিন্তু সেনাপতি আল- আহনাফ ছিলেন অবিচল। তিনি অত্যন্ত কার্যকর একটি কৌশলের আশ্রয় নেন; মারগাব নদী ও পাহাড়ের মাঝখানের সরু পথ ধরে তিনি এগিয়ে যান। ফলে একসঙ্গে বিপুল সেনাবাহিনীর সাথে যুদ্ধ করা থেকে তিনি নিস্তার লাভ করেন। এই সময় মার্ভবাসী সাহায্যে এগিয়ে এলেও আল-আহনাফ এই বলে তাদের সাহায্য গ্রহণে বিরত থাকেন যে তিনি মুশরিকদের সাহায্য নেবেন না। প্রচণ্ড যুদ্ধের পর মুসলিম বাহিনী জয়লাভ করে। পলায়নপর শত্রুবাহিনীকে পশ্চাদ্ধাবন করার জন্য আল-আকরা ইবনু হারিসকে পাঠানো হয়; তিনি বীরবিক্রমে হামলা চালিয়ে শত্রু বাহিনীকে তছনছ করে দেন।

বালখ বিজয়:
আল-আহনাফ মার্ভ থেকে বাল্‌খ অভিমুখে রওয়ানা করলেন। বালখবাসী যুদ্ধ করতে অনিচ্ছুক ছিল। তারা বার্ষিক চার লক্ষ দিরহামের বিনিময়ে সন্ধির প্রস্তাব দিলে আল-আহনাফ তা মেনে নিলেন চাচাতো ভাই উসাইদ ইবনুল মুতাশাম্মিসকে বালখের শাসক হিসেবে নিয়োগ করে আল-আহনাফ খাওয়ারিজের-এর পথ ধরলেন। কিন্তু শীতের মৌসুম এসে পড়ায় তিনি কোন অভিযান পরিচালনা না করে বাল্‌খে ফিরে এলেন। তখন বাল্‌খে নববর্ষের উৎসব চলছিল। বাখবাসীরা শাসনকর্তা উসাইদকে স্বর্ণ-রৌপ্যের পাত্র ও অজস্র মুদ্রা উপহার দিল। আল-আহনাফ বাল্‌খে এলে উসাইদ স্থানীয়দের উপহারের বিষয়টি তাকে জানালেন। তিনি সকল উপহার সামগ্রী ইবনু 'আমিরের কাছে নিয়ে যান। ইবনু 'আমির বললেন, 'আবু বাহর! ওগুলো তুমি নিয়ে নাও।' আল-আহনাফ জবাব দিলেন, 'ওগুলোতে আমার কোন প্রয়োজন নেই। আবদুল্লাহ্ ইবনু 'আমির যুদ্ধজয়ের পর বাসরায় ফিরে গেলেন। যাওয়ার পূর্বে তিনি কায়স ইবনুল হায়সামকে খুরাসানের শাসনকর্তা নিয়োগ করলেন।

তুর্কি সেনানায়ক কারেনের আক্রমণ :
মুসলিমদের অগ্রযাত্রার খবর পেয়ে ৭০ হাজার যোদ্ধা নিয়ে তুর্কী যুদ্ধবাজ কারেন এগিয়ে এল। তুর্কীদের মুকাবিলায় 'আবদুল্লাহ ইবনু খাযিম আস-সুলামী চার হাজার যোদ্ধা নিয়ে এগিয়ে গেলেন। এঁদের মধ্য হতে ছয়শ' সৈনিককে অগ্রবর্তী দল হিসেবে পাঠালেন। শত্রুসৈন্যের কাছে পৌঁছলে ইবনু খাযিম সৈন্যদেরকে বললেন, 'সবাই যেন বর্শাগ্রে কাপড়ের টুকরা বেঁধে তাতে তেল বা চর্বি মেখে আগুন জ্বালিয়ে নেয়। তারপর আগুনের বর্ষা দিয়ে কারেন বাহিনীর ওপর হামলা চালানো হয়। ৭০ হাজার যোদ্ধার কারেন বাহিনী চারদিকে আগুন দেখে দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে পালাতে থাকে। তুর্কী দলপতি কারেনসহ বহু সৈন্য নিহত হয়।

কাবুল জয় :
আবদুল্লাহ ইবনু আমির কাবুল অভিযানের সেনানায়ক হিসেবে আবদুর রহমান ইবনু সামুরাকে নিয়োগ দেন। তিনি ইসলামী রাষ্ট্রের সীমানা বর্ধনে চেষ্টা অব্যাহত রাখেন। প্রথমে তিনি যারানজ-এর বিদ্রোহ দমন করেন। তারপর ভারত সীমান্তে যারানজ ও কাশ-এর মধ্যবর্তী এলাকা জয় করেন। অতঃপর রুখরাজ জয় করে দাউন-এর বাসিন্দাদেরকে অবরোধ করেন। সামান্য প্রতিরোধের পর স্থানীয়রা সন্ধি করে। ঐ পাহাড়ে স্বর্ণমূর্তি ছিল, যার দু'চোখ ছিল ইয়াকুত পাথরের। আবদুর রহমান মূর্তিটির হাত কেটে চোখ বের করে নিলেন। কিন্তু স্বর্ণ ও জহরত না নিয়ে শহরের শাসকের কাছে সেগুলো ফেরত দিয়ে বললেন, এগুলোতে আমার কাজ নেই, আমি শুধু তোমাকে দেখাতে চেয়েছিলাম যে, মূর্তিটি ক্ষতি বা উপকার করতে পারে না। তারপর তিনি বুত, কাবুল ও যাবুলিস্তান (গজনী) জয় করেন। তারপর বিজয়াভিযান দীর্ঘ না করে তিনি যারানজ-এ ফিরে আসেন। উসমান রা.-এর খিলাফাতের শেষদিকে বিশৃঙ্খলা দেখা দিলে তিনি উমাইর ইবনু আহমার আল-ইয়াশকুরীকে প্রতিনিধি হিসেবে দায়িত্ব প্রদান করে যারানজ ত্যাগ করেন।

আফগানিস্তানের বিস্তীর্ণ এলাকা জয় করার পর বসরার শাসক আব্দুল্লাহ ইবনু আমল উমরাহ আশ-শুকুর পালন করেন। ৩১ ও ৩২ হিজরিতে বসরার গভর্নর আব্দুল্লাহ ইবনু আমীর ও তাঁর অধীনস্থ সেনাপতিগণ মধ্য এশিয়ার বিশাল ভূখন্ড জয় করেন। এরকম বিজয়ের কৃতিত্ব খুব কম গভর্ণরের ভাগ্যে জুটেছে। বিজয়াভিযানের সমাপ্তিতে লোকজন ইবনু 'আমিরকে বলল: 'আল্লাহ আপনাকে বিপুল বিজয় দান করেছেন: আপনি ফার্স, কারমান, সিজিস্তান ও সমগ্র খুরাসান জয় করেছেন! ইবনু আমির বললেন, ‘আল্লাহর শুকরিয়াস্বরূপ আমি এখান থেকে ইহরাম বেঁধে উমরাহ পালন করব। তারপর ইবনু আমির নিশাপুর থেকে ইহরাম বেঁধে মাক্কায় গিয়ে উমরাহ পালন করেন।

৩২ হিজরীতে বালানজার-এর যুদ্ধে বিপর্যয় :
কুফার গভর্ণর সা'ঈদ ইবনুল আসের অধীনে সেনাপতি আবদুর রহমান ইবনু রাবী'আহ আল-বাবে নিযুক্ত ছিলেন। তিনি বালাজারে অভিযান পরিচালনার সংকল্প করলেন। বিষয়টি জানতে পেরে উসমান রা. সা'ঈদ ইবনুল আসকে লিখেন, 'তুমি সালমান ইবনু রাবী'আহকে তাঁর ভাই আবদুর রহমান ইবনু রাবী'আহ-এর সহায়তার জন্য আল-বাবে প্রেরণ কর। আবদুর রহমান ইবনু রাবী'আহ আল-বাবে ছিলেন, তাঁকে সাবধান করে খালীফা লিখলেন, 'বদহজমে প্রজাদের অনেকে দুর্বল হয়ে পড়েছে; অতএব তুমি অভিযান সংক্ষেপ কর, মুসলিমদেরকে দুর্যোগে ঠেলে দিও না। কারণ আমার ভয় হয় তারা বিপদে পড়বে। খালীফার এই সতর্কবাণী আবদুর রহমানকে লক্ষ্যচ্যুত করতে পারল না। তিনি বালানজার থেকে ফিরে আসলেন না। উসমান রা.-এর খিলাফাতের নবম বছরে আবদুর রহমান ইবনু রাবী'আহ বালানজারে পৌঁছে শহর অবরুদ্ধ করে মিনজানিক দাগিয়ে পাথর ছুঁড়তে লাগলেন। অবরুদ্ধ শহরবাসীর কেউ মিনজানিকের তোড়ে কাছে ঘেঁষতে পারছিল না। তারপর একদিন বালাজারবাসীর সহায়তায় তুর্কীরা এগিয়ে এল, যৌথ বাহিনী প্রচণ্ড আক্রমণের ফলে মুসলিম বাহিনী পরাজিত হলো। আবদুর রহমান ইবনু রাবী'আহ নিহত হলেন। তাঁকে বালানজারের উপকন্ঠে দাফন করা হয়। পরাজিত মুসলিম বাহিনী ছিন্নবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ল। সালমান ইবনু রাবী'আহ একদলকে আশ্রয় দিয়ে আল-বাবের পথে নিরাপদ স্থানে পৌঁছে দিলেন। আরেকদল খাযার-এর পথ ধরে জীলান ও জুরজানের পথে বেরিয়ে গেলেন। এঁদের সাথে সালমান ফারসী রা. ও আবূ হুরাইরা রা. ছিলেন।

হিন্দুস্থান অভিযানের পরিকল্পনা :
খলিফা উসমান রা. বাসরার গভর্ণর 'আবদুল্লাহ ইবনু আমিরকে হিন্দুস্থান তথা ভারত সম্পর্কে তথ্যানুসন্ধানের নির্দেশ দেন। তিনি হুকাইম ইবনু জাবালা আল-‘আবদীকে সিন্ধুতে প্রেরণ করেন। হুকাইম ভারত সম্পর্কে সরেজমিনে তথ্য সংগ্রহ করে খালীফাকে অবহিত করে বলেন, 'ভারতে পানি কম, ফলমূল নিম্নমানের, ওই অঞ্চলের চোরগুলো অনেক সাহসী, আমাদের সৈনিক সংখ্যা কম হলে তারা ধ্বংস হয়ে যাবে আর বেশি হলে ক্ষুধায় মারা যাবে। খালীফা বললেন, 'তুমি কি অভিজ্ঞতা থেকে বলছো না বুদ্ধি থেকে বলছো? তিনি জবাব দিলেন, 'না, বরং অভিজ্ঞতা থেকে বলছি।' এরপর খালীফা আর ভারতে কোন বাহিনী প্রেরণ করেননি।