১৮ অক্টো, ২০১৫

তাজউদ্দিন নামা


বাংলাদেশের মানুষ সাধারণত ধর্মপ্রিয়। এখানে তাই বামদের ভালো অবস্থান কখনোই হয়নি। তারা তাই ছলে বলে কৌশলে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছে। বাংলাদেশের সাথে পাকিস্তানী সামরিক জান্তাদের স্বৈরাচারীর কারনে সৃষ্টি হওয়া দূরত্বকে কাজে লাগিয়ে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করার স্বপ্নে বিভোর ছিল। তাদের এই স্বপ্নকে কাজে লাগিয়েছে ভারত। ভারত ৭১ এর আগে পরাজিত হওয়া যুদ্ধের শোধ নিতে মরিয়া ছিল। আর তাছাড়া আজন্মশত্রু দেশকে বিপদে ফেলা তাদের গুরুত্বপূর্ণ প্রজেক্ট ছিল। ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা “র” এর প্রথম প্রজেক্ট ছিল পাকিস্তান ভাগ। 

ভারত এদেশীয় রুশপন্থী বামদের কাজে লাগিয়ে তাদের সেই প্রজেক্ট বাস্তবায়ন করে। আওয়ামীলীগে লুকিয়ে থাকা সিরাজুল আলম খান ছিলেন এই প্রজেক্ট বাস্তবায়নের মূল হোতা। তিনি একেক পর এক ছাত্রলীগের নানান কর্মকান্ড দিয়ে পাকিস্তান ভাগের জন্য মুজিবকে প্ররোচিত করতে থাকেন। কিন্তু মুজিব পাকিস্তান ভাগের ব্যাপারে একেবারেই অমত করেছিলেন। 

অমত না করার কোন কারণও নেই। কারণ সত্তরের নির্বাচনে “ভোটের বাক্সে লাথি মার/ বাংলাদেশ স্বাধীন করো” বলে শ্লোগান তুলে চীনপন্থী বাম নেতা ভাসানী তার রাজনৈতিক ক্যরিয়ার, জনগণের আস্থা সবই নষ্ট করেছেন। এর বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে মুজিবের ব্যাপক জনসমর্থন বাড়ে। মুজিব জনগণের পালস বুজতে পেরেছেন। তাই বামদের ফাঁদে পা দেননি। আর তাছাড়া গনতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হলে মুজিবের জন্যই লাভ, তার পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে। পাকিস্তানে যে অল্পকয়দিন গনতন্ত্র ছিল তার বেশিরভাগ সময়ে ক্ষমতায় ছিল বাঙ্গালীরাই।

এবার আসি তাজউদ্দিন প্রসঙ্গে। বেসিক্যলি তাজউদ্দিন সাহেব রুশপন্থী বাম ছিলেন। এই ব্যাপারে কমরেড তোয়াহা বলেন, এছাড়া তাজউদ্দীন পূর্বাপর কমিউনিস্ট পার্টির সাথে সংশ্লিষ্ট ছিলেন। যদিও তাজউদ্দীন বাহ্যত: আওয়ামী লীগ করতেন কিন্তু প্রকৃতপক্ষে আমাদের সাথেই জড়িত ছিলেন। পার্টির সিদ্ধান্তেই তাকে আওয়ামী লীগে রাখা হয়। একবার সম্ভবত: '৬২ সালের দিকে তিনি জেল থেকে বের হয়ে আমাদের বললেন 'আর ছদ্মনামে (অর্থাৎ আওয়ামী লীগে) কাজ করতে আমার ভালো লাগছে না। আমি নিজ পার্টিতেই কাজ করবো।' তখন কেউ কেউ মনে করলো, 'থাক না আমাদের একজন আওয়ামী লীগে আছে, সেখানেই কাজ করুক না।' পরে অবশ্য পার্টিতে এ নিয়ে আলোচনাও হয়েছিল কিন্তু তাজউদ্দীনকে প্রত্যক্ষভাবে পার্টিতে নেয়া হয়নি। আমার মতে সেটা ছিল ভুল সিদ্ধান্ত। তবে তাজউদ্দিন আওয়ামী লীগে থেকেও আমাদের জন্য কাজ করেছেন। আওয়ামী লীগের সব তথ্য আমাদের সরবরাহ করেছেন। ইন্ডিয়াতে গিয়ে অসম-চুক্তি করার পরই তার মাঝে একটা বিক্ষিপ্তভাব এসে যায়। এরপর তিনি কিছুটা যেন কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েন। তবে, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর যখন আমরা তাকে তাঁবেদার সরকারের প্রধানমন্ত্রী মনে করতাম, তখনও তিনি আমাদের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করেছেন। (বারান্দার দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে) প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে একবার এ বারান্দায় বসে আমার সাথে আলাপ করে গেছেন। ভুল-শুদ্ধ যখন যা করেছেন সবই এসে আমাদের কাছে অকপটে বলেছেন।
তথ্যসূত্রঃ ভাষা আন্দোলন : সাতচল্লিশ থেকে বায়ান্ন / মোস্তফা কামাল

১৯৭১ সালে তার কাজ ছিল কেবল ইন্ডিয়ান এজেন্ডা বাস্তবায়ন করা। উপপ্রেসিডেন্ট নজরুল ইসলামকে দিয়ে অসম ৭ দফা চুক্তি করে বাংলাদেশ বিক্রীর ব্যবস্থা করে ভারতে নিশ্চিন্ত জীবন যাপন করেছেন। এই বিষয়ে ৯ নং সেক্টর কমান্ডার মেজর আবদুল জলিল বলেছেন দেশের শান্তিপ্রিয় জনগনকে হিংস্র দানবের মুখে ঠেলে দিয়ে কোলকাতার বালিগঞ্জে একটি আবাসিক এলাকার দোতলা বাসায় প্রধানমন্ত্রী তার মন্ত্রীসভা সহকারে নিরাপদে তাস খেলছিলেন দেখে আমি শুধুই বিস্মিত হইনি, মনে মনে বলেছিলাম ধরনী দ্বিধা হও। 
তথ্যসূত্রঃ অরক্ষিত স্বাধীনতাই পরাধীনতা/ মেজর জলিল, পৃঃ ৪৪

১৭ই এপ্রিল নতুন প্রবাসী সরকার গঠনের ঘোষনা দিয়ে দেশের মানুষকে বিপদের মুখে ঠেলে দিয়ে তিনি কিভাবে নিশ্চিন্ত ছিলেন তা আমরা বুঝতে পারবো যদি ভারত সরকারের সাথে তার চুক্তিগুলো একটু পড়ি। 

১- মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে যারা যুদ্ধ করেছে তারাই দেশ স্বাধীন হলে প্রশাসনে নিয়োগ পাবে। বাকীরা চাকরীচ্যুত হবে। যে শূন্যপদ সৃষ্টি হবে তা ভারতীয় প্রশাসনিক কর্মকর্তা দ্বারা পূরণ করা হবে।

২- বাংলাদেশ ও ভারতের সশস্ত্র বাহিনী মিলে যৌথ কমান্ড গঠন করে যুদ্ধ পরিচালনা করা হবে। ভারতের সেনাপ্রধান উক্ত যৌথ কমান্ডের প্রধান হবেন। তার কমান্ড অনুসারেই যুদ্ধে শামিল হওয়া বা যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।

৩- স্বাধীন বাংলাদেশের কোন নিজস্ব সশস্ত্র বাহিনী থাকবেনা।

৪- আভ্যন্তরীন আইন-শৃংখলা রক্ষার জন্য মুক্তিবাহিনীকে কেন্দ্র করে প্যারামিলিটারি বাহিনী প্রতিষ্ঠা করা হবে।

৫- দুই দেশের মধ্যে মুক্ত বাজার ব্যবস্থা গড়ে তোলা হবে। কিন্তু সময়ে সময়ে আলাপ আলোচনার মাধ্যমে বানিজ্য নীতি নির্ধারণ করা হবে।

৬- বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ভারতীয় সেনাবাহিনী অনির্ধারিত সময়ের জন্য বাংলাদেশে অবস্থান করা হবে।

৭- বাংলাদেশ ও ভারত উভয় দেশ আলোচনা করে একই ধরণের পররাষ্ট্র নীতি ঠিক করবে।
তথ্যসূত্রঃ বাংলাদেশে স্বাধীনতা যুদ্ধে "র" এবং "সি আই এ"/ মাসুদুল হক, পৃঃ ৮১

তাজউদ্দিন আহমদ এ চুক্তি স্বাক্ষর করার জন্য চাপ দিতে থাকেন সৈয়দ নজরুল ইসলামকে। নজরুল ইসলাম সাহেব নিরুপায় হয়ে এই চুক্তি স্বাক্ষর করে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন।
তথ্যসূত্রঃ বাংলাদেশে 'র'/ আবু রুশদ
দুঃসময়ের কথাচিত্র সরাসরি/ ড. মাহবুবুল্লাহ ও আফতাব আহমেদ।

ভারতপ্রীতি তাজউদ্দিনকে প্রায় অন্ধ করে ফেলেছিল। সে কি আসলে আলাদা রাষ্ট্র চেয়েছিল নাকি ভারতের তত্ত্বাবধানে কোন অঙ্গরাজ্য চেয়েছিল এটা সহজেই অনুমান করা যায় তার কার্যক্রম দেখে। ১৯৭২ সালের ১লা জানুয়ারি এক আদেশবলে বাংলাদেশের মুদ্রামান ৬৬ ভাগ হ্রাস করা হয়। অথচ সে সময় বাংলাদেশের মুদ্রামান ছিল ভারত থেকে বেশি। তাজউদ্দীন দু'দেশের মুদ্রামানের বিনিময় হারের সমতা চেয়েছিলেন। লাগামহীন মুদ্রাস্ফীতির ফলে দ্রব্যমূল্য বেড়ে গিয়েছিল হু হু করে। অর্থনীতির ওপরও প্রভাব পড়েছিল। ৭৩- ৭৪এ দূর্ভিক্ষ দেখা দিয়েছিল। যদিও দূর্ভিক্ষের পারিপার্শ্বিক অনেক কারণ ছিল, তবে এটাও বড় একটি কারণ। 
তথ্যসূত্রঃ
ভয় পেয়ে রিপোর্ট করা থেকে বিরত থাকলাম/২২ মার্চ ২০১৬ মতিউর রহমান চৌধুরী/ দৈনিক মানবজমিন

৭১ এর পুরো বিষয়টা অনুধাবন করতে শেখ মুজিবের সময় লাগেনি। দেশে এসে ক্ষমতা গ্রহন করেই উপরোক্ত চুক্তি ভেঙ্গে দেয়ার চেষ্টা করেন। তিনি বিশ্বাস হারিয়ে ফেলেন তাজউদ্দিনের প্রতি। যে কয়টা দিন মুজিব ক্ষমতায় ছিলেন সে কয়টা বছর তাজউদ্দিন শেখ মুজিবের কাছে ঘেঁষতে পারেনি। তাজউদ্দিনের উপর আস্থা হারিয়ে ফেলে রুশপন্থী সমাজতন্ত্রীরাও। আওয়ামীলীগে ঘাপটি মেরে থাকা বামরা মুজিবের অপশাসনে ও অত্যাচারে বিরক্ত হয়ে আরেকটি সংগঠন জাসদ গঠন করার সময় তাজউদ্দিনের বাড়িতে সিরাজুল আলম খানের নেতৃত্বে গোপন আলোচনায় বসেন। সেখানে তাজউদ্দিন মুজিবের বিরুদ্ধে যেতে সাহস করেনি। বলেছিল আমি মুজিবের বিরুদ্ধে যেতে পারবোনা, আমার সেই সাহস নেই। তবে তোমাদের আমি সর্বাত্মক সাহায্য করবো। 

এরপর জাসদ গঠন হলো। জাসদের উপর মুজিবের নির্যাতন ক্রমেই সকল সীমা অতিক্রম করছিলো। এছাড়া রক্ষীবাহিনীর অত্যাচার, জুলুম, সন্ত্রাসী জনগণকে মুজিবের বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তুলে। তাই একমাত্র বিরোধী হিসেবে জাসদের জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকে। জাসদের উত্থানে আরো ভয়ানকভাবে ক্ষেপে গিয়ে মুজিব জাসদের উপর অত্যাচারের স্টীমরোলার চালাতে থাকেন। জাসদ এসব কিছুর পেছনে তাজউদ্দিনকে সন্দেহ করে। সেনাবাহিনী, জনতা, জাসদ এই ত্রিপক্ষীয় জনরোষে মুজিব হত্যার ষড়যন্ত্র দানা বাঁধতে থাকে। এরই ফলশ্রুতিতে ৭৫ সালে খুন হন মুজিব। সেই সাথে নির্মমভাবে খুন হন তাজউদ্দিনসহ চার নেতা। বামপন্থী সেনা অফিসাররাই খুন করে বাম চিরজীবন আদর্শ লালন করা তাজউদ্দিনকে। 
তথ্যসূত্রঃ জাসদের উত্থানপতনঃ অস্থির সময়ের রাজনীতি / মহিউদ্দিন আহমদ।

১১ অক্টো, ২০১৫

রুপকথা নয় সত্যকথাঃ ০১


দানশীলতার জন্য তাঁর ছিল বেশ সুনাম। একদিন তিনি স্বপ্নে দেখলেন একস্থানে উটের দুধ আর অন্যস্থানে বিষ্ঠা। এর মাঝামাঝি স্থানে কে যেন কোদাল দিয়ে খনন করছে। তাতে একটা কূপ দেখা গেল। সেখানে কেবল পানি আর পানি। তিনি ঘুম থেকে উঠলেন কিন্তু স্বপ্নের আগাগোড়া কিছুই বুঝলেন না। একই ভাবে তিনদিন স্বপ্নে দেখলেন।
তারপর তিনি এক গণকের কাছে গেলেন। গণক বললেন তোমার জন্য সম্মান অপেক্ষা করছে। তুমি সম্মানিত হবে। এর কিছুদিন পর তিনি উটের পাল নিয়ে বরাবরের মত মাঠে গেলেন। হঠাৎ একটা তীর কোথা থেকে এসে একটা উটের ওলানে গিয়ে পড়লো। দুধে ভেসে গেলো ঐ স্থান। কে তীর মারলো তিনি আর সেই চিন্তা করতে গেলেন না। তার মনে পড়ে গেলো স্বপ্নের কথা।
তিনি খেয়াল করলেন কিছুদূরে বিষ্ঠা রয়েছে। যা ঐ উট একটু আগে ত্যাগ করেছে। তিনি বুঝলেন স্বপ্নই সত্য। এখানেই পানি পাওয়া যাবে। তাঁর হাতের লাঠি দিয়ে স্থানটি চিহ্নিত করে তিনি ছুটলেন বাড়ির দিকে। কোদাল নিয়ে এসে খনন করতে লাগলেন। অল্প কিছু খনন করার পরই পাওয়া গেলো কূপটি। তিনি চিৎকার করে জানিয়ে দিলেন সবাইকে। তোমাদের আর চিন্তার কিছু নেই। আমাদের পানি সমস্যা দূর হয়ে গেলো।
এই সম্মানিত ব্যাক্তির নাম আব্দুল মুত্তালিব। আর কূপটি ইসমাইল আঃ এর জমজম কূপ। যা এতদিন পাথর দ্বারা ঢাকা পড়ে ছিল। আব্দুল মুত্তালিব কূপটিকে সুন্দর করে বাঁধিয়ে দিলেন। কূপটা সবার জন্য উন্মুক্ত করে দিলেন যাতে সবাই পানি নিতে পারে।
এদিকে কিছু স্বার্থবাদী কুরাইশ নেতা কূপের মালিকানা দাবী করে বসলো। এই নিয়ে অনেক ঝগড়া-বাকবিতন্ডা শুরু হলো। পরে সবাই সিদ্ধান্ত নিলো ইরাকের বনু সা’দ গোত্রের এক মহিলা জ্যোতিষীর কাছে যাবে। তিনি যা সিদ্ধান্ত দিবেন তাই সবাই মেনে নিবেন।
আব্দুল মুত্তালিব সহ মালিকানা দাবীদাররা রওনা হলো। কিছুদূর যাওয়ার পর তারা মুরুভূমিতে পথ হারিয়ে ফেললো। তাদের কাছে ছয় দিনের খাবার ছিল। দশ দিনে সব খাবার শেষ হলো। এরপর একজন প্রস্তাব করলো আমাদের তো মৃত্যু ছাড়া অন্যকোন গতি নেই। আসো সবাই কবর খুঁড়ে শুয়ে পড়ি। সবাই কবর খুঁড়ে মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করতে থাকলো।
আব্দুল মুত্তালিব তাদের বোঝালো, এভাবে শেষ হওয়া যাবেনা। আমাদের যতক্ষন পর্যন্ত শক্তি থাকবে ততক্ষন পর্যন্ত বাঁচার চেষ্টা করবো। তাছাড়া আমাদের কাছে তো উট রয়েছেই। আমরা তো সেগুলো খেয়েও বাঁচতে পারবো। তারপর তারা নির্দিষ্ট দূরত্বে অবস্থান করে প্রত্যেকে আলাদাভাবে পানি খুঁজতে লাগলো। এভাবে দুদিন যাওয়ার পর আব্দুল মুত্তালিব একটি পরিত্যাক্ত কূপের সন্ধান পায়।
তাদের প্রত্যেকটি উটই ছিল মৃতপ্রায়। উটগুলো ও তারা পানি পেয়ে আবার কর্মক্ষমতা ফিরে পায়। নতুন করে বাঁচার আশা দেখতে পায়। এই সময় সব কুরাইশ নেতা জমজম কূপের ব্যাপারে নিজেদের দাবী ছেড়ে দেয়। তারা বলে হে আবদুল মুত্তালিব, খোদাই আমাদের বিরুদ্ধে এবং তোমার স্বপক্ষে ফয়সালা দিয়েছেন। খোদার কসম এখন আর জমজম নিয়ে তোমার সাথে ঝগড়া করবোনা। যে খোদা এই মুরুভূমিতে তোমাকে পানি দিয়েছেন, সেই খোদাই তোমাকে জমজম দিয়ছেন।
এরপর তারা এক বানিজ্য কাফেলার সন্ধান পায় ও মক্কায় ফিরে আসে। এই ঘটনার পর আব্দুল মুত্তালিব আল্লাহকে খুশি করার জন্য নিজের এক ছেলেকে কোরবানী করার মানত করেন। তিনি তার দশ ছেলের সবাইকে কথাটা জানালেন। সবাই মেনে নিলো। এরপর তিনি দশ জনের নাম লিখে হোবাল মুর্তির তত্ত্বাবধায়কের কাছে দিলেন। তিনি লটারী করলেন দেখলেন ৪র্থ ছেলে আবদুল্লাহর নাম উঠেছে। 
আবদুল্লাহ ছিলেন আব্দুল মুত্তালিবের ছেলেদের মধ্যে সবচেয়ে দানশীল, সজ্জন, পরোপকারী। মক্কাবাসীরা সবাই তাকে ভালোবাসতো। তারা ওর কোরবানী মেনে নিতে পারে নি। সবাই আবারো লটারী করতে বললো, ২য় এবং ৩য় বারেও আবদুল্লাহর নাম উঠলো। সবাই আবারো বাধা দিল। সবচেয়ে বেশী বাধা দিল সহোদর আবু তালিব।

এরপর আব্দুল মুত্তালিব এক খ্রীস্টান মহিলা সাধকের কাছে গেলেন এবং সব খুলে বললেন। তিনি তাকে বললেন তুমি আবদুল্লাহর নাম ও দশটি উট লিখে লটারী কর। যদি আবদুল্লাহর নাম না উঠে তাহলে দশটি উট উঠে তবে দশটি উট আবদুল্লাহর বদলে কোরবানী করবে। আর যদি আবদুল্লার নাম উঠে তবে দশটি করে উট বাড়াতে থাকবে। যতক্ষন পর্যন্ত না আল্লাহ তায়ালা খুশি হন।
দশটি উটে কাজ হলোনা। বিশটি কিংবা পঞ্চাশটিতেও না। যখন আবদুল্লাহর নামের সাথে একশো উট লিখে লটারী করা হলো তখনই কেবল লটারীতে একশ উট উঠলো। মক্কাবাসীরা খুশীতে উল্লাস করতে লাগলো। আবদুল্লাহ নিশ্চিত যবাইয়ের হাত হতে আল্লাহর ইচ্ছায় বেঁচে গেলেন।
আব্দুল মুত্তালিব একশো উট জবাই করে সবার উদ্দেশ্যে রেখে দেন। সবাই যার যার ইচ্ছেমত নিয়ে যায়। তারপরও শেষ হয়নি। অন্যান্য মাংশাসী পশুরও ভুরিভোজের ব্যবস্থা হয়েছিল।
সেদিন হতে রক্তঋনের পরিমাণ হিসেবে একশো উট নির্ধারিত হলো। এর আগে ১০ টি উট ছিল। ইসলামেও এটি অব্যাহত আছে। আমাদের প্রিয় নবী মুহাম্মদ (সঃ) বলতেন আমি দুই যবীহর (যবাইকৃত) সন্তান।
তথ্যসূত্রঃ 
১. ইবনে হিশাম
২. মুখতাছার সীরাতে রাসূল 
৩. আর রাহীকূল মাখতুম 
৪. সীরাতে সরওয়ারে আলম

সমাজে কিভাবে ইসলাম প্রতিষ্ঠিত হবে?


আমাদের সমাজে ইসলামপন্থীদের মাঝে এক ধরণের অবাস্তব কল্পনা বিলাস আছে। আর তা হল শুধুমাত্র সব ইসলামপন্থিরা এক প্লাটফর্মে এলেই অথবা তাদের মধ্যে ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হলে সমাজে ইসলাম প্রতিষ্ঠিত হবে।

কথাটা পুরোপুরি ঠিক নয়। এরকম একটা ধারণা থেকে পাকিস্তানের উদ্ভব হয়েছে। অথচ দেখুন সেখানে ইসলামের বিজয় হয় নি, বিজয় হয়েছে জাতীয়তাবাদের।

১ম বিষয় হচ্ছে যোগ্যতা। একটি ইসলামী রাষ্ট্রের জন্য প্রথমত যেটা জরুরী তা হল ঐ রাষ্ট্র বা জনপদকে ইসলাম মোতাবেক চালানোর জন্য একদল সেক্টরভিত্তিক যোগ্য লোক তৈরী করা। যারা আল্লাহর সার্বভৌমত্ব ও জনগণের প্রতিনিধিত্ব ভিত্তিক রাষ্ট্র চালাতে পারবে। আল্লাহর রাসূল মক্কায় অগ্নিপরীক্ষার মাধ্যমে এই ধরণের যোগ্যতা সম্পন্ন লোক তৈরী করেছেন। 

২য় বিষয় হল বৃহৎ জনগোষ্ঠীর মানসিকতা পরিবর্তন করা। যাতে তারা ইসলামের শাসন ও অনুশাসন মেনে নেয়ার জন্য প্রস্তুত থাকে। বাংলাদেশের বেশীরভাগ মানুষ আল্লাহ ও তার রাসূলকে (সঃ) মনে প্রাণে বিশ্বাস করে ও মানে। তবে আল্লাহ্‌র সার্বভৌমত্ব মানতে তারা এখনো অভ্যস্ত হয় নি। এই ধরণের জনগোষ্ঠী মদিনায় তৈরী হয়েছিল। 

৩য় বিষয় হল নেতা হবেন আদর্শের মডেল। অর্থাৎ যাদের নেতৃত্বে ইসলাম প্রতিষ্ঠিত হবে তারা হতে হবে ইসলামের মডেল। তাদের দেখে জনগণ ইসলাম শিখবে। তাদের জীবনাচরণের সাথে যদি ইসলামের সামান্যতম প্রার্থ্যক্যও থাকে তাহলে তা জনগণের উপর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে অনেকখানি। আল্লাহর রাসূল সঃ স্বয়ং নিজেই মডেল হিসেবে উপস্থাপিতহয়েছেন। সেই সাথে ছিল সাহাবাদের উন্নত চরিত্র। 

এই তিনটি বিষয় নিশ্চিত হলে তবেই আল্লাহ তায়ালা আমাদের ইসলামী রাষ্ট্র দিবেন। মক্কায় ২য় বিষয়টি অর্জিত হয়নি বিধায় প্রথমেই মক্কায় ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হতে পারেনি। আল্লাহর রাসূল সঃ মক্কা থেকে যোগ্য নেতৃত্ব সহ মদিনায় গিয়ে তিনটি বিষয়ের সমন্বয় করাতেই সেখানে ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা সম্ভব হয়েছে। 

এখানে শর্টকাট কোন ওয়ে নেই যে আপনি হুট করে ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত করবেন। জিন্নাহ যখন দ্বিজাতিতত্ত্ব ঘোষনা করেছিলেন তখন এক সেমিনারে তাকে প্রশ্ন করা হয়েছিলো পাকিস্তানের সংবিধান কি হবে। সে দ্রুত পকেট হতে একটি ছোট কুরআন শরীফ বের করে অত্যন্ত আবেগ মেখে বলেছিলো এটিই হবে পাকিস্তানের সংবিধান। অথচ দেখুন আজও কি হয়েছে সেখানে কুরআনের সংবিধান? হয় নি। কারণ কুরআনকে সংবিধানে রূপ দেয়ার মত যোগ্যতা তার বা তার মন্ত্রীসভার কারো ছিল না।

ইসলামপন্থীদের জন্যতো বটেই, সবার জন্যই ঐক্য একটা বড় শক্তি। ঐক্য থাকলে আমাদের অনেক কাজ সহজ হয়ে যায়। তবে ঐক্য হওয়া উচিত আল্লাহর জন্য। দ্বীনের জন্য। জাতীয়তাবাদের ঐক্য নয়। সঠিক পন্থায় ঐক্যের জন্য যোগ্যতা দরকার। আমাদের মধ্যে অনেক মতপার্থক্য থাকে। আমরা যদি একটু ধৈর্য্য ধরে অপরের কথা শুনি, অপরের মতামত শুনি, খুব শালীন ভাষায় দ্বিমত করি বা নিজের মতামত উপস্থাপন করি তাহলেই নিজেদের সমস্যাগুলো কেটে যায়। কোন সম্প্রদায়কে ম্যনশন দোষারোপ করা ঐক্যের জন্য ভয়ানক হুমকি।

আসুন যোগ্যতা অর্জনের চেষ্টা করি। নিজ নিজ সেক্টরে অথবা আমাদের ইন্টারেস্টের জায়গাগুলোতে আমরাই যাতে নেতৃত্ব দিতে পারি সেই ব্যবস্থা আমাদেরই করতে হবে। এভাবেই একদিন ইসলাম নেতৃত্বের আসনে আসীন হবে ইনশাআল্লাহ। 

আর সেই সাথে আমাদের সবার কমন দায়িত্ব, আমরা আমাদের যার যার অবস্থান হতে আমাদের দাওয়াতকে আরো গতিশীল করবো। মানুষকে আল্লাহ্‌র সার্বভৌমত্বের দিকে আহ্বান করবো। আল্লাহ তায়ালা আমাদের সমগ্র প্রচেষ্টা কে কবুল করে নিন। আমিন।


৮ অক্টো, ২০১৫

সাক্ষী হয়ে থাকা কিছু ঘটনাঃ আমাদের প্রেরণা


দাদাজান মৃত্যুবরণ করলেন। তখন আমার মিডটার্ম পরিক্ষা চলছিলো। দ্রুত বিভাগীয় প্রধানকে জানালাম। তিনি আমকে সান্ত্বনা দিয়ে বললেন যাও, বাড়ি যাও। তোমার পরীক্ষা আমি দেখবো। দাদাজানের পাশে আসলাম। অনেক চেষ্টা করেও কাঁদতে পারলাম না। কেমন যেন সব স্বাভাবিক মনে হয়।
নিজেকে আগে থেকেই কাঠখোট্টা বলে জানতাম। কিন্তু তাই বলে এতটা!! এই ঘটনার পর নিজেকে পাষান মনে হতে থাকে। অনেকের নাটক সিনেমা দেখেও চোখ ভিজে। আমার তো সেরকম হওয়ার প্রশ্নই আসে না। কিন্তু আমি সাক্ষী হয়ে গিয়েছি এমন সব ঘটনার যেগুলো মনে হলে এখনো কাঁদি। চোখ থেকে অবিরল পানি পড়ে।
পাঁচলাইশ থানায় এক মধ্যবয়সী মা পা জড়িয়ে আছে ওসির। স্যার, স্যার, স্যারগো, আমার পোলাটারে আর মারিয়েন না। আপনার পায়ে পড়ি। স্যার আপনি যেমনে বলেন সেভাবে হবে আমি পোলারে আর শহরে রাখুম না। স্যার, স্যারগো আর মারবেন না। আমারে মারেন, আমারে মারেন। পোলাটারে ছাড়ি দেন।
বিরক্ত পুলিশ পা ঝাড়া দেয়, মা ছুটে পড়ে তিন হাত দূরে। মায়ের দেরী হয় না। আবার উঠে দৌড়ে যায়। লক্ষ্য পুলিশের পা। স্যারগো আপনে আমার পোলারে বাঁচান। ওরা মেরে ফেলতেছে। মা কান্না করছে নিচতলায়। তিনতলায় ছেলের উপর অমানুষিক নির্যাতন চলছে। মা – ছেলের কান্নায় জাহান্নাম হয়ে গেলো সব।
..................
আব্বু, তুমি আমাকে বলতা, মিথ্যা বলা খুব খারাপ, আল্লাহ শাস্তি দেন। আর তুমি সমানে মিথ্যা বলছো। তুমি বলেছো আমার পরীক্ষার সময় বাসায় আসবে, আমাকে স্কুলে নিয়ে যাবে। তুমি আসোনি। এরপর বলেছো, রোযায় আসবে, আসোনি। তারপর বলেছো ঈদে আসবে, তুমি এতটাই খারাপ হয়েছো, তুমি ঈদেও আসোনি। আমরা সবাই খুব কান্না করেছি...।
তুমি এখানে কি কর? আমাদের কথা মনে পড়ে না?
ছোট্ট মেয়ে বাবাকে উদ্দেশ্য করে কথাগুলো বলছে, দুজনের মাঝখানে হাসিনার জিন্দানখানার লোহার মোটা মোটা শিক।
বাবা বলছে, আম্মু তুমি আমাকে মাফ করে দাও, আমি আর মিথ্যা বলবো না। ছোট্ট মেয়েটির মা কোন কথা বলেন না। শুধু দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কাঁদছেন। এক সময় বাবা মেয়ের কথাগুলো কান্নায় রূপান্তরিত হয়। তিনজনেই কাঁদছেন। কে কাকে সান্ত্বনা দিবে? সান্ত্বনা দেয়ার কেউ নেই।
..................
ছেলেকে কোর্টে তুলেছে তাই মা বাসা থেকে খাবার নিয়ে এলেন ছেলেকে একটু নিজ হাতে খাইয়ে দিবেন বলে। কিন্তু পুলিশ কিছুতেই তা হতে দিচ্ছে না। মা পুলিশের পিছ পিছ দৌড়াচ্ছেন। ছেলেকে হাতকড়া পরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে পুলিশ। ছেলে মায়ের দূর্দশা দেখে বললো, মা আমার পেট জ্যাম। খেতে পারবো না। জেলখানা থেকে আসার সময় অনেক খেয়ে এসেছি।
মা হাল ছাড়েন না। দৌড়াতেই থাকেন। একবার এর কাছে একবার ওর কাছে। ছেলে দূর থেকে মাকে বারণ করে। মা বলেন, বাবা তোর পছন্দের কাচ্চি নিয়ে আসছি। ছেলে মাকে থামানোর জন্য বলে কাচ্চি খাবো না, গ্যাষ্ট্রিক হবে। মা আর্তনাদ করে উঠেন, বাবা তোরে ওরা খেতে দেয় না? তোর তো গ্যাষ্ট্রিকের সমস্যা ছিল না। ছেলে কি বলবে, বুঝে উঠতে পারে না।
মায়ের ক্রমাগত বিরক্তিতে অতিষ্ঠ হয়ে উঠে কয়েকজন পুলিশ। গালি দিয়ে তারা মায়ের হাত থেকে কেড়ে নেয় খাবার। দূরে নিক্ষেপ করে। সব বিরিয়ানি ছড়িয়ে পড়ে রাস্তায়। কয়েকটা কুকুর দৌড়ে এসে খাবার খাওয়া শুরু করে। মা কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে যান। একবার কুকুরগুলোর দিকে আরেকবার ছেলের দিকে তাকিয়ে থাকেন আর কাঁদতে থাকেন।
ছেলে লজ্জায় অপমানে ঠোঁট কামড়ে কাঁদতে থাকে। চিৎকার করে বলতে থাকে, মা তুমি আর কোনদিন কোর্টে আসবা না। কোনদিন না। কখনো না।
...........................
কোর্ট থেকে ছেলেকে নিয়ে যাচ্ছে জেলখানায়। মা ছেলের বিদায় হল। ছেলে মাকে সান্ত্বনা দিচ্ছে। কিন্তু মায়ের মন কিছুই মানছে না। কাঁদতে থাকেন, আর বলতে থাকেন, আমার ছেলে কোন অপরাধ করে নি। সে চোর ও না ডাকাতও না, তবে কেন তাকে বন্দি করা হল?
হাতকড়া পরিয়ে, কোমরে দড়ি দিয়ে বেঁধে প্রিজন ভ্যানে তোলা হল। মা-ছেলের কথা তবু শেষ হয় না। এক পর্যায়ে গাড়ি চলতে শুরু করে। মাও দৌড়াতে থাকেন। ছেলে মা কে বারণ করে কিন্তু কে শোনে কার কথা!!
মা দৌড়াতে থাকেন। হোঁচট খেয়ে আছড়ে পড়েন রাস্তায়। উঠে আবার দৌড়াতে থাকেন কিছুদূর গিয়ে আবার আছড়ে পড়েন। আর উঠতে পারেন না। ততক্ষনে গাড়ি অনেকদূর। মা তাকিয়ে থাকেন। রাস্তায় বসে কাঁদতে থাকেন মা। আর প্রিজন ভ্যানে কাঁদতে থাকেন ছেলে।
.........................
এইরকম দুই চারটা নয়, শত শত ঘটনা আছে। তবে আমরা হতাশ নই। জানি একদিন জুলুমের অবসান হবে। ইনশাল্লাহ। আসুন আমরা আমাদের সর্বোচ্চ সামর্থ দিয়ে চেষ্টা করি। বাংলাদেশের মানুষকে মহান আল্লাহ তায়ালার সার্বভৌমত্ব মেনে নেয়ার আহবান করি। বিজয় আমাদেরই। মুমিনদের কোন পরাজয় নেই।

এরশাদ কাহিনী


লে. জে. হু. মু. এরশাদ ১৯৫২ সালে যোগ দেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে। দীর্ঘ তেরো বছর চাকুরীর পর ১৯৬৫ তে পান মেজর পদ। একাত্তরের পুরো সময় জুড়ে ছিলেন পশ্চিম পাকিস্তানে। মাঝখানে ছুটি নিয়ে পূর্বপাকিস্তান এসেছিলেন। যুদ্ধে যোগ না দিয়ে আবার ফিরে যান পশ্চিম পাকিস্তানে। তিনি সেসময় দায়িত্ব পালন করেন কোর্ট মার্শালে।

স্বাধীনতার পরপরই তিনি ফিরে আসেন নি। তিনি এসেছেন ৭৩ সালে। সেই বছরই যোগ দেন বাংলাদেশ আর্মিতে। এখানে একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন পাকিস্তানের প্রতি একান্ত অনুগত এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা বিরোধী কিভাবে এতদিন পরে এসে সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে পারে? এর উত্তর অনেক হতে পারে, তবে আমার কাছে যেটা সবচেয়ে গ্রহনযোগ্য মনে হয় তাহলো মুজিব ফ্রিডম ফাইটার সেনাবাহিনীর সদস্যদের বিশ্বাস করতোনা। তাই সে সেনাবাহিনীতে কিছু লোককে চাচ্ছিল যারা একান্তই তার হয়ে কাজ করবেন। এইরকম অনেক লোককে রিক্রুটমেন্ট করেছেন মুজিব। তার মধ্যে অন্যতম এরশাদ।

৭১ এর মুক্তিযুদ্ধ সেনাবাহিনীর সদস্যদের মধ্যে অন্যরকম সাহস নিয়ে আসছিল। তারা এখন ক্যু করতে ভয় পায়না। তাই ৭৫ এ কয়েকটি ক্যু করে ফ্রিডম ফাইটাররা। এই বিষয়টা মুজিবের মত জিয়াও তার বিবেচনায় এনেছেন। ক্ষমতা অধিগ্রহন করার পর জিয়া কর্ণেল তাহের সহ চারশত ছয়জন ফ্রিডম ফাইটারকে হত্যা করেছেন যৌক্তিক কারনেই। যার ফলে ক্যু এর ভয় জিয়াকে তাড়া করে ফিরতো।

মুজিব হত্যাকান্ডের সময় এরশাদ এক প্রশিক্ষনে ভারতে ছিলেন। জিয়া ক্ষমতা গ্রহনের পর তাকে ভারত থেকে নিয়ে আসেন। তাকে রাতারাতি মেজর জেনারেল পদে উন্নীত করে উপ-সেনাপ্রধানের পদে অধিষ্ঠিত করেন। অথচ সব দিক দিয়ে এই বিবেচনায় এগিয়ে ছিলেন মেজর মঞ্জুর। জিয়ার সাথে কোন দন্ধই ছিলনা মঞ্জুরের। হয়তো ফ্রিডম ফাইটার বলেই জিয়া রিস্ক নিতে চাননি।

ইহাই বাংলাদেশের ফ্রিডম ফাইটার। কেউ কাউরে বিশ্বাস করেনা। কিভাবে করবে? তারা সবাইতো বিশ্বাস ভঙ্গকারী। সিদ্ধান্তটি নিঃসন্দেহে খারাপ। যোগ্য লোককে বঞ্চিত করে এরশাদের মত অযোগ্য, চরিত্রহীন ও করাপ্ট লোককে দায়িত্ব প্রদান কোনভাবেই ভালো সিদ্ধান্ত হতে পারেনা। এর চরম মূল্য দিতে হয়েছে জিয়াকে। বিপুল জনপ্রিয়তাও তাকে সেইভ করতে পারেনি। আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র ও ক্ষমতার লোভ এরশাদকে প্রায় পাগল করে দিয়েছিল। সেই সাথে আছে মাথা গরম ফ্রিডম ফাইটাররা।

জিয়ার এক ভুলে দেশ ধূর্ত স্বৈরাচারের কবলে পড়েছে ৯ বছর। তার ছেলে তারেকের প্রায় সেরকম ভুলে দেশ ভয়ংকর ড্রাকুলার কবলে পড়ে আছে। কবে উদ্ধার হবে আল্লাহ জানে।

বাংলাদেশ নিয়ে আমেরিকান ষড়যন্ত্র


অস্ট্রেলিয়া বাংলাদেশে খেলতে আসেনি, এটা অস্ট্রেলিয়ার জন্য যতটা ভালো হয়েছে তার চাইতে বেশী ভালো হয়েছে বাংলাদেশের জন্য। আমার এখন স্পষ্ট মনে হচ্ছে অস্ট্রেলিয়া ক্রিকেট দলের উপর হামলা করার জন্য আন্তর্জাতিকভাবে একটা ষড়যন্ত্র হচ্ছিল। যেভাবেই হোক অস্ট্রেলিয়া সেটা টের পেয়ে তাদের ক্রিকেট দলকে পাঠায়নি।
আমেরিকা যেহেতু উল্লফনটা বেশী করছে সেহেতু আমেরিকা যুক্ত আছে এই ষড়যন্ত্রের সাথে এটা বলার অপেক্ষা রাখেনা। এই বিষয়টা আমার মনে হয়েছে যেদিন ইতালির নাগরিক নিহত হয়েছে। প্রথম আলোসহ অনেক পত্রিকায় নিউজ হয়েছে আমেরিকান নাগরিক নিহত। তারমানে একটা পক্ষ জানে একজন আমেরিকান খুন হবে। পরে দেখা গেল এটা ইতালির নাগরিক। সম্ভবত খুনিদের ভুলে বা ছক ঠিক করতে পারেনি বলে আমেরিকানের স্থলে ঐ ইতালিয় নিহত হয়েছেন।
এখানে আই এস জড়িত এটা আমেরিকার এক থার্ড ক্লাস নিউজ পোর্টাল বলেছে। ব্যাস সারাবিশ্বে এটা রটে গেলো। দেখা গেলো একজন ইতালীয় হত্যা দিয়ে পরিস্থিতি তাদের পক্ষে আনা যাবেনা। তাই আরেকজন বিদেশী খুন করা হয়েছে। ওরা বেচে বেচে এমন লোককে খুন করলো যিনি ইতিমধ্যে মুসলিম হয়েছেন।
একজন মুসলিম খুন করা হলো, আবার ঐ খুনের দায়ে মুসলিমদেরও ফাঁসানোর চেষ্টা চলছে। ঐ খুনের স্বীকার করা টুইটার বার্তাও রয়টার্স আবিষ্কার করে। গতকাল আবার জাপান বললো, আই এস'র অনলাইন রেডিও নাকি স্বীকার করেছে তারা হোসিও কুনিকে হত্যা করেছে। কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছে, জাপান আই এস বিরোধী জোটে অংশগ্রহন করেছে তাই তারা এই মুসলিম লোকটিকে হত্যা করেছে। কোথায় সিরিয়া, ইরাক আর কোথায় বাংলাদেশে অবস্থান করা হোসি কুনি !!
বাংলাদেশে আমেরিকা-ইসরাঈল পরিচালিত আই এস নামক সন্ত্রাসীদের কোন স্থান হবেনা যেমনিভাবে হয়নি ভারত পরিচালিত জেএমবি'র স্থান, ইনশাআল্লাহ্‌। এদেশের বেশীরভাগ মানুষ প্র্যাক্টিসিং মুসলিম না হলেও ইসলামের প্রাথমিক জ্ঞান তাদের মধ্যে আছে। তাই এদেশে কিছু দুষ্কৃতিকারী ইসলামের নামে সন্ত্রাসী করে ইসলামের অপমান করে পার পাবেনা।
আমরা ২০০৫ সালে দেশের সবক'টি মসজিদ থেকে যেভাবে এসব সন্ত্রাসীর বিরুদ্ধে দুর্বার আন্দোলন গড়ে তুলেছি আবারো সেভাবে আমরা এসব সন্ত্রাসীদের প্রতিহত করবো, ইনশাআল্লাহ্‌।

৬ অক্টো, ২০১৫

পার্বত্য চট্টগ্রামে নতুন ষড়যন্ত্রের নাম “আদিবাসী”


পার্বত্য চট্টগ্রাম, বাংলাদেশের অসাধারণ সুন্দর একটি অংশ। সমগ্র দেশের একমাত্র পাহাড় বিধৌত অঞ্চলটির আয়তন দেশের মোট আয়তনের প্রায় দশ ভাগের এক ভাগ। রাঙ্গামাটি,খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান এই তিনটি জেলা নিয়ে গঠিত এই পার্বত্য চট্টগ্রাম। এর মধ্যে রাঙ্গামাটি আয়তনের দিক দিয়ে গোটা দেশের মধ্যে বৃহত্তম জেলা। শুধুই প্রাকৃতিক সৌন্দর্য নয়, অফুরন্ত বনজ সম্পদ সমৃদ্ধ এই অঞ্চল খনিজ সম্পদেরও আধার। ভৌগোলিক অবস্থানগত কারনেও এই অঞ্চল যথেষ্ঠ গুরুত্বের দাবী রাখে। এই এলাকার অশান্ত পরিস্থতির কথা কারও অজানা নয়, আজও চলছে সেসব।

পার্বত্য চট্টগ্রামে উপজাতিদের সংক্ষিপ্ত ইতিহাসঃ 
একটি সাম্প্রতিক জরিপ হতে দেখা যায়, এখানে মোট জনসংখ্যার প্রায় ৪৭%-৪৯% বাঙালি, বাকি ৫৩%-৫১% উপজাতি। উপজাতিদের মধ্যে ‘চাকমা’ গোষ্ঠিই সংখ্যাগরিষ্ঠ। মোট জনসংখ্যার ৩৩% (প্রায়) হচ্ছে চাকমা জনগোষ্ঠি। এছাড়া অন্যান্য উপজাতি সম্প্রদায়ের মধ্যে মারমা, ত্রিপুরা, তংচংগ্যা, পাংখো, মুরং, বোম, কুকি, গারো, খিয়াং, চাক, লুসাই, খুমি ইত্যাদি উল্ল্যেখযোগ্য। ব্রহ্মযুদ্ধের সময় চাকমাদের আরাকান থেকে বিতাড়িত করে মগরা। আসামের নৃতাত্ত্বিক তথ্যের পরিচালক মি.জে পি মিলস-এর মতে চাকমারা সেখান থেকে আশ্রয় নেয় কক্সবাজার এলাকায়, পার্বত্য চট্টগ্রামে আসে ১৮ শতাব্দীতে।

উপজাতীয় রাজাদের বংশক্রম থেকে দেখা যায়, চাকমাদের মধ্যে অনেক রাজাই মুসলিম ধর্মে ধর্মান্তরিত হন। তাঁরা মুসলিম নাম ও পদবি গ্রহন করতেন। এছাড়া তাঁদের সাথে মুসলিম বিবাহ-রীতির হুবহু মিল খুঁজে পাওয়া গেছে অপর একটি গবেষনায়। চাকমাদের ধর্ম বৌদ্ধ হলেও, ধর্মগত আচারে বৌদ্ধত্বের বিশেষ প্রমান পাওয়া যায় না। ১৮ শতকে বহু চাকমার মুসলিম হবার প্রমান রয়েছে। পরে আবার হিন্দুত্বের অনুপ্রবেশের চেষ্টা চলে। 

সর্বপ্রথম ব্রিটিশ আমলেই কালিন্দি রানী নামের তাঁদের এক রানী সকলকে বৌদ্ধ হবার নির্দেশ দেন। ১৮ শতাব্দীতে তাঁদের মধ্যে এতটাই বাঙালিয়ানা ভর করে যে, জে পি মিলস বলেন, 'এরা আচারে-ব্যাবহারে ও সংস্কৃতিগত বিষয়ে খুবই বাঙালি হয়ে গেছে (Most Bangalaised tribes)'। আরেকটি গবেষনায় দেখা গেছে, চাকমা ভাষা বাংলা ভাষার একটি উপভাষা। এমনকি হুমায়ুন আজাদের মতে চাকমা রাজা মোআন তসনি ব্রহ্মদেশ হতে তাড়া খেয়ে ১৪১৮ সালে কক্সবাজারের টেকনাফ ও রামুতে এসে বসতি স্থাপন শুরু করে।......। তারপর, পালাক্রমে মারমারা আসতে শুরু করে এবং একটা সময় পার্বত্য চট্টগ্রাম ব্যাপী বসতি ছড়িয়ে পড়ে। জে পি মিলসের মতে, এই ‘একটা সময়’ হচ্ছে ১৮ শতাব্দী (সুবোধ ঘোষ)। সুতরাং, পার্বত্য চট্টগ্রামে চাকমা সহ অধিকাংশ উপজাতিদের বসবাসের ইতিহাস বড়জোর ২০০-৩০০ বছর। বাঙালি ও মুসলিম সংস্কৃতির প্রভাব ও বসবাসের ইতিহাসের দিক থেকে বলা যায় উপজাতিরা আদিবাসী নয়। কিন্তু কেন ইদানিং আদিবাসী বনে যাবার জন্য তাঁদের এত দৌড়ঝাঁপ? কেন এখন ‘উপজাতি’ শব্দটায় তাঁদের এত এলার্জি, কেন তাঁরা এই শব্দটির দরুন 'অপমানিত' বোধ করেন, যেখানে তাঁরা এমনকি ‘৯৭ সালে করা শান্তিচুক্তিতেও নিজেদের উপজাতি হিসেবেই নিজেদের উপস্থাপন করেছেন?

পার্বত্য চট্টগ্রামে জুমিয়াদের সংগ্রামের সূচনাঃ
পার্বত্য চট্টগ্রামে মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার নেতৃত্বে ১৯৭৩ সালের ৭ জানুয়ারি শান্তিবাহিনী প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেয়া হয়। একটি সশস্ত্র প্রতিরোধ সংগঠন হিসেবে শান্তিবাহিনীর উদ্ভবের পটভূমি রচিত হয়েছিল পাকিস্তান আমলে। ১৯৬০ সালে কাপ্তাই হাইড্রো-ইলেকট্রিক প্রজেক্ট বাস্তবায়নের ফলে ক্ষতিগ্রস্থ পাহাড়ি জনগণের মধ্যে অসন্তোষ দেখা দেয়। মূলত ১৯৫৭ সালে কর্ণফুলী নদীতে কাপ্তাই বাঁধের কার্যক্রম শুরু হয়। এর কারণে বিশাল এলাকা জলমগ্ন হয়ে পড়ে। হাজার হাজার লোক ঘরবাড়ি, আবাদি জমি হারিয়ে সর্বস্বান্ত হয়। ক্ষতিগ্রস্থ জনগণ অবশ্য এসকল জমির প্রকৃত মালিক ছিল না, কারণ তৎকালীন পার্বত্য চট্টগ্রাম ম্যানুয়েল অনুসারে এলাকার সব জমিই রাষ্ট্রীয় সম্পত্তি হিসেবে ঘোষিত হয়েছিল। তথাপি মানবিক কারণে সরকারকে ক্ষতিগ্রস্থদের ন্যায্য ক্ষতিপূরণ ও পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করতে হয়েছিল। লেকের কারণে সমুদ্রপৃষ্ঠের সর্বোচ্চ ৩৩.২২ মিটার উঁচু পর্যন্ত এলাকাসমুহ নিমজ্জিত হয়ে গিয়েছিল। মূল লেকটির আয়তন প্রায় ১৭২২ বর্গ কিমি, তবে আশপাশের আরও প্রায় ৭৭৭ বর্গ কিমি এলাকাও প্লাবিত হয়। কাপ্তাই বাঁধের কারণে আনুমানিক ১৮,০০০ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়, ৫৪ হাজার একর কৃষিজমি পানিতে তলিয়ে যায় এবং প্রায় ৬৯০ বর্গ কিমি বনভূমি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সরকার ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলিকে ক্ষতিপূরণ হিসেবে সেসময় ৪ কোটি ১৫ লক্ষ টাকা বরাদ্দ করেছিল। তারপরও অসন্তোষ থেকে যায়। 

ওই অসন্তোষেরই ধারাবাহিকতায় ১৯৭২ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি আত্মপ্রকাশ ঘটে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির। এর আশু কারণ ছিল বাঙালি জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে বাংলাদেশের উদ্ভব। পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়িরা নিজেদের জুমিয়া জাতি হিসেবে ঘোষণা দেয় এবং বাংলাদেশ সরকারের নিকট থেকে এর স্বীকৃতি দাবি করে। স্বীকৃতিলাভে ব্যর্থ হয়ে জুমিয়া জাতি আত্মনিয়ন্ত্রনের অধিকার অর্জনের লক্ষ্যে নিম্নোক্ত ৪ দফা দাবিনামা তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের নিকট পেশ করে: 
(ক) নিজস্ব আইন পরিষদসহ পার্বত্য চট্টগ্রামকে একটি স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল ঘোষণা করা।
(খ) ১৯০০ সালের পার্বত্য চট্টগ্রাম অধ্যাদেশের ‘হিল ম্যানুয়েল অ্যাক্ট’ বাংলাদেশের সংবিধানে বিধিবদ্ধ করা। 
(গ) উপজাতীয় রাজাদের দপ্তর সংরক্ষণ করা এবং 
(ঘ) সংবিধানে পার্বত্য চট্টগ্রামের স্বায়ত্তশাসন সংরক্ষিত রাখার বিধান অন্তর্ভুক্ত করা।

এই দাবিসমূহের আলোকে ১৯৭২ সালের ২৪ এপ্রিল সাংসদ মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা লিখিতভাবে সরকারের নিকট পার্বত্য চট্টগ্রামের জন্য বিশেষ প্রশাসনিক মর্যাদার দাবি জানান। কিন্তু নতুন সংবিধান পার্বত্য চট্টগ্রামের জন্য বিশেষ রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক মর্যাদা দেয় নি। এরূপে নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে দাবি আদায়ে ব্যর্থ হয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার নেতৃত্বে সশস্ত্র সংগ্রামের পথ বেছে নেয়।

কার্যক্রম পরিচালনার সুবিধার্থে শান্তিবাহিনী তৎকালীন পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলাকে উত্তর ও দক্ষিণ দুটি সামরিক অঞ্চলে বিভক্ত করে। প্রতিটি অঞ্চলকে আবার ৩টি সেক্টরে এবং সেক্টরগুলোকে বিভিন্ন এলাকায় ভাগ করা হয়। জনসংহতি সমিতি ও শান্তিবাহিনীর সদর দপ্তর ছিল বর্তমান খাগড়াছড়ি জেলার দীঘিনালা উপজেলার দুর্গম অরণ্যে। ১৯৭৪ সাল নাগাদ বিপুল সংখ্যক পাহাড়িদের সামরিক প্রশিক্ষণ দিয়ে শান্তিবাহিনীভুক্ত করা হয়। নিয়মিত বাহিনী ছাড়াও সংক্ষিপ্ত প্রশিক্ষণ প্রাপ্তদের নিয়ে মিলিশিয়া বাহিনী গঠিত হয়। শান্তিবাহিনী ও মিলিশিয়া বাহিনীকে সহায়তার লক্ষ্যে গ্রাম পঞ্চায়েত এবং বহুসংখ্যক যুব সমিতি ও মহিলা সমিতি গড়ে তোলা হয়। সামগ্রিক প্রস্ত্ততি গ্রহণ শেষে শান্তিবাহিনী ১৯৭৬ সালের প্রথমদিকে সশস্ত্র তৎপরতা শুরু করে। শান্তিবাহিনী পার্বত্য এলাকায় বসবাসকারী বাঙালিদের আক্রমণ ও হত্যা, নিরাপত্তা বাহিনীকে আক্রমণ, তাদের মতাদর্শ বিরোধী উপজাতীয়দের হত্যা, সরকারি সম্পদের ক্ষতিসাধন, অপহরণ ও বলপূর্বক চাঁদা আদায়সহ বিভিন্ন ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ জোরদার করে। ১৯৮৩ সালের ১০ নভেম্বর অন্তর্দলীয় কোন্দলে নিহত হবার পূর্ব পর্যন্ত মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা জনসংহতি সমিতি ও শান্তিবাহিনীর নেতৃত্ব দেন। 

মানবেন্দ্র লারমার হত্যাকান্ডের পর শান্তিবাহিনী দ্বিধাবিভক্ত হয়ে (লারমা ও প্রীতি গ্রুপ) আত্মঘাতি সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। বাংলাদেশ সরকার সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা দিয়ে এবং স্বাভাবিক জীবনযাপনের জন্য শান্তিবাহিনীর সদস্যদের পূর্ণ সহযোগিতার আশ্বাস দিয়ে শান্তি পুনঃপ্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেয় এবং তাদের প্রতি অস্ত্র সমর্পণ ও বিদ্রোহ সংঘাত বন্ধ করার আহবান জানায়। প্রীতি গ্রুপের অধিকাংশ নেতা-কর্মী ১৯৮৫ সালের ২৯ এপ্রিল আত্মসমর্পণ করে। কিন্তু লারমা গ্রুপ নাশকতামূলক কর্মকান্ড অব্যাহত রাখে। ইতোমধ্যে শান্তিবাহিনীর ফিল্ড কমান্ডার বোধিপ্রিয় লারমা জনসংহতি সমিতির সভাপতি নিযুক্ত হন (১৯৮৫)। এরপর বিভিন্ন সময়ে সরকার ও শান্তিবাহিনীর মধ্যে সমঝোতার উদ্যোগ গৃহীত হয়। ১৯৯১-৯৬ মেয়াদের জন্য নির্বাচিত সরকার পূর্ববর্তী সকল সরকারের নেয়া শান্তি প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখেন। অবশেষে পরবর্তী মেয়াদের (১৯৯৬-৯৭) জন্য নির্ধারিত সরকার ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর শান্তিচুক্তি স্বাক্ষর করে। ১৯৯৯ সালে জনসংহতি সমিতির ষষ্ঠ মহাসম্মেলনে শান্তিবাহিনীর আনুষ্ঠানিক বিলুপ্তি ঘোষণা করা হয়।

শান্তিবাহিনীর নৃশংসতাঃ
হুমায়ুন আজাদ শান্তিবাহিনীর নৃশংসতা ও বর্বরতার একটি চিত্র তুলে ধরেছেন। তাদের ভয়াল আক্রমনের শিকার হন নীরিহ বাঙালিরা। এ ছাড়াও তাঁরা হত্যা করে সেনাবাহিনীর সহযোগী পাহাড়িদের, অপহরন করে বাঙালি, সরকারী কর্মকর্তা-কর্মচারী ও ব্যাবসায়ীদের। ১৯৮৪ সালের ১৮ জানুয়ারী তাঁর অপহরন করে শেল তেল কোম্পানির কাজে নিয়োজিত ৫ জন বিদেশী বিশেষজ্ঞকে। বিপুল মুক্তিপণ দিয়ে তাদেরকে পরে ছাড়িয়ে আনা হয়। '৯৭ সালে থানচির থানা নির্বাহীকে অপহরণ করে মুক্তিপন দাবী করে তাঁরা। সেনাবাহিনী মুক্তিপন ছাড়াই উদ্ধার করে তাকে। সেতু ধ্বংস করে, বিদ্যুতের তার বিচ্ছিন্ন করে এবং সাম্প্রদায়ীক দাঙ্গা বাঁধিয়ে উপজাতিদের শরণার্থীরূপে ভারত যেতে বাধ্য করে শান্তিবাহিনী। এ সময় উল্লেখযোগ্য সহিংসতার মধ্যে ছিল '৯৬ সালে ২৯ কাঠুরিয়াকে হত্যা, ভূবনছড়া গনহত্যা, ইত্যাদি। ১৯৮০ থেকে ১৯৯১ পর্যন্ত শান্তিবাহিনী ৯৫২ জন বাঙালি ও ১৮৮ জন পাহাড়িকে হত্যা, ৬২৬ জন বাঙালি ও ১৫২ জন পাহাড়িকে জখম এবং ৪১১ জন বাঙালি ও ২০৫ জন পাহাড়িকে অপহরণ করে। এই তথ্য জানিয়েছেন, M R Shelly ১৯৯১ সালে প্রকাশিত তাঁর ‘The Chittagong Hill Tracts of Bangladesh : An Untold Story’ বইতে। হুমায়ুন আজাদ কতৃক প্রদত্ত এক পরিসংখ্যান অনুযায়ী '৯৭ সাল পর্যন্ত এই হতাহতের সংখ্যা দাঁড়ায় নিম্নরূপ- ১৭ জন সৈনিক, ৯৬ জন বিডিআর, ৪১ জন পুলিশ, অর্থাৎ বছরে গড়ে ১৫ জন। আহত হয়েছে মোট ৩৭৩ জন, ম্যালেরিয়ায় মারা গেছে ১৫৬ জন। অসামরিক ব্যাক্তিরাই মরেছে বেশি- বাঙালি ১০৫৪ জন, উপজাতীয় ২৭৩ জন। আহত হয়েছে- ৫৮৭ জন বাঙালি, ১৮১ জন পাহাড়ি। অপহৃত হয়েছে- ৪৬১ জন বাঙালি আর ২৮০ জন উপজাতীয়।

শান্তিচুক্তির ব্যবচ্ছেদ
অশান্ত পাহাড়ে শান্তি প্রতিষ্ঠার অংশ হিসেবে তৎকালীন আওয়ামী সরকার শান্তিচুক্তির আয়োজন করে। মূলত দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনী বিচ্ছিন্নতাবাদীদের প্রায় কোণঠাসা করে ফেলার পর বিদেশীদের চাপে এদের নির্মূল না করে শান্তিচুক্তির ব্যবস্থা করা হয়। চুক্তির বেসিক বিষয় ছিল সন্তু লারমা নেতৃত্বে শান্তি বাহিনী অস্ত্রসমর্পন করবে। বিনিময়ে সরকার তাদের ক্ষমা করে দিবে এবং তারা যাতে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে পারে সেজন্য তাদের টাকা ও সম্পদ দিয়ে পূনর্বাসন করা হবে। চুক্তিটি উপজাতি বা জুমিয়াদের পক্ষেই গিয়েছে। অউপজাতি তথা বাঙ্গালীদের অধিকার ক্ষণ্ণ করা হয়েছে। তাছাড়া এমন কিছু ধারা সেখানে সংযুক্ত হয়েছে যা বাংলাদেশ সংবিধান পরিপন্থী ও রাষ্ট্রের জন্য চরম হুমকিস্বরূপ।
শান্তি চুক্তিতে আপাত স্থিতিশীলতা আসলেও, এর অসারতা এখন বোঝা যাচ্ছে। এখনও পাহাড়ে অবৈধ অস্ত্রের ঝনঝনানি শোনা যায়। প্রায় প্রতি সপ্তাহে জনসংহতি ও চুক্তি বিরোধী ইউপিডিএফ এর মধ্যে চাঁদাবাজি সংক্রান্ত ঘটনা নিয়ে বিভিন্ন স্থানে বন্দুক যুদ্ধ ঘটে। সেখানকার পাহাড়ি-বাঙালি উভয় সম্প্রদায়ই রয়েছে আতংকে। প্রায়ই বাঙালি-পাহাড়ি দাঙ্গায় হতাহতের খবর পাওয়া যায়। চাঁদাবাজি, খুন, অপহরণ, সন্ত্রাস আগের চেয়ে তো কমেইনি, বরং তিনগুণ বেড়েছে। কারণ জেএসএস(জনসংহতি), ইউপিডিএফ ছাড়াও জেএসএস থেকে ‘সংস্কারপন্থী’ বলে পরিচিত নতুন আরেক সংগঠনের আবির্ভাব ঘটেছে। এবার সমপরিমাণ চাঁদা তিন দলকেই দিতে হয় পাহাড়ি-বাঙালি সবাইকে। এ ছাড়া চুক্তি বাস্তবায়নের পরপরই বাঙালিরা বিভিন্ন বিষয় নিয়ে নিজেদের আপত্তির কথা তীব্রভাবে তুলে ধরে। সে গুলো সংক্ষিপ্তভাবে উপস্থাপিত হল-


১- চুক্তির খ-খণ্ডের ৩০-এর ঘ- ধারা মোতাবেক বাঙালিদের নাগরিকত্ব সনদ দিবেন উপজাতীয় রাজা এমনকি নির্বাচনে প্রার্থী হতে হলেও, যা সংবিধানসম্মত নয়।
২- চুক্তির খ- খণ্ডের ২৬ ধারা অনুযায়ী আঞ্চলিক পরিষদ ও পার্বত্য জেলা পরিষদের অনুমতি ব্যাতীত জমি-ভূমি ক্রয়বিক্রয়য়, হস্তান্তর এমনকি ইজারা পর্যন্ত দিতে পারবে না কেউ, স্বয়ং সরকারও রাষ্ট্রের প্রয়োজনে ভূমি অধিগ্রহণ করতে পারবে না। এ ক্ষেত্রে নাগরিক হিসেবে বঞ্চিত করা হয়েছে বাঙালিদের।
৩- পার্বত্য জেলা পরিষদ ও আঞলিক পরিষদের চেয়ারম্যানের পদ, সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যপদ সহ গুরুত্বপূর্ণ জনপ্রতিনিধিত্ব উপজাতিদের জন্য সংরক্ষণ করা হয়েছে, অথচ সেখানে বাঙালিদের সংখ্যা প্রায় অর্ধেকেরও বেশী।
৪- চুক্তির খ-খন্ডের ১৬ ধারায়, যে শান্তি বাহিনী দীর্ঘ এত ২৪ বছর ধরে দেশপ্রেমিক বাঙালি ও নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের হত্যা করে আসছে, তাদেরকে ৫০,০০০ টাকা পুরস্কার সহ পুনর্বাসনের ব্যাবস্থা করা হয়েছে। অথচ দেশমাতৃকার জন্য শান্তি বাহিনীর হাতে যারা নির্মমভাবে আহত/নিহত হয়েছে, তাঁদেরকে কোন প্রকার ক্ষতিপূরণ বা পুনর্বাসনের ব্যাবস্থা করা হয়নি।
৫- চুক্তির গ-খন্ডের ৭ নং ধারা মোতাবেক পরিষদ সমূহের তিনটি উপসচিব ও একটি যুগ্ন-সচিব সহ চারটি পদে বাঙালি হওয়ার অপরাধে বাঙালি কর্মকর্তাদের বদলে পাহাড়িদের নিয়োগ দেয়া হবে, এর ফলে বাঙালিদের ন্যায্য প্রাপ্তির জন্য আর কোনও প্রশাসনিক স্তর রইলো না। 
৬- চুক্তির খ-খণ্ডের ৩২ ধারায় পরিষদসমূহের ধারায় মহান জাতীয় সংসদে পাশকৃত আইনের বিরুদ্ধে ভেটো দেওয়ার ক্ষমতা আঞ্চলিক পরিষদকে দেওয়া হয়েছে, যা সংবিধানসম্মত হতে পারে না। এ যেন গণতান্ত্রিক শাসন ব্যাবস্থার ভেতর আইয়ুব খানের মৌলিক গণতন্ত্র।
৭- চুক্তির খ- খণ্ডের ২৪ ধারায় সিপাই থেকে সাব-ইন্সপেক্টর পর্যন্ত পদে শান্তি বাহিনী প্রত্যাগতদের নিয়োগের ক্ষমতা পরিষদকে দেওয়া হয়েছে। যারা কিছুদিন আগেও আনসার, বিডিআর, পুলিশ, সেনাবাহিনী সহ সাধারণ বাঙালিদের দেখা মাত্র গুলি করতো, তাঁরা এবার বৈধ অস্ত্র দিয়ে তা করতে যে দ্বিধা করবে না, তাঁর নিশ্চয়তা কি? 
৮- চুক্তির খ-খন্ডের ১৪ ধারা অনুযায়ী পরিষদকে সরকারী কর্মচারী উপজাতীয় থেকে নিয়োগ, বদলি ও শাস্তি প্রদান ইত্যাদি ক্ষমতা পরিষদকে দেওয়া হয়েছে। 
৯- চুক্তির খ খণ্ডের ২৬ ধারায় (গ) অনুযায়ী চেইনম্যান, আমিন, সারভেয়ার, কানুনগো, সহকারী কমিশনার (ভূমি) সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা সন্তু লারমা কতৃক নিয়ন্ত্রিত (এখন পর্যন্ত সন্তু লারমাই সেটার চেয়ারম্যান, অজ্ঞাত কারণে নির্বাচন হয়নি একবারও) আঞ্চলিক পরিষদকেই দেয়া হয়েছে। এর কারণে পার্বত্য চট্টগ্রামের বাঙালিরা নিজেদের ভূমির উপর নিয়ন্ত্রণ হারানোর ঝুঁকিতে রয়েছেন।
১০- চুক্তির গ-খন্ডের ৮ ধারায় পৌরসভা, স্থানীয় বিভিন্ন পরিষদ, তিন পার্বত্য জেলার প্রশাসনের সার্বিক দায়িত্ব পরিষদকে দেওয়া হয়েছে, যা প্রজাতন্ত্রের ভেতর আরেকটি প্রজাতন্ত্র ও ইউনিটারি বাংলাদেশ কনসেপ্টের সাথে সাংঘর্ষিক।
১১- চুক্তির ৭ ধারা ও ১৬ ধারার (ঘ) অনুযায়ী শান্তি বাহিনী ও উপজাতিরা এ যাবতকাল যত ব্যাংক ঋণ নিয়েছে, তা সুদ সমেত মওকুফ করা হয়েছে। অথচ, যে সকল বাঙালি শান্তি বাহিনীর হত্যাযজ্ঞের কারণে ঋণ নিয়েও তা কাজে লাগাতে পারেনি, পারলেও শান্তি বাহিনী তা ধ্বংস করে দিয়েছে, তাঁদের ঋণ মওকুফ করা হয়নি, বরং সার্টিফিকেট মামলায় তাঁদের গ্রেফতার করা হয়েছে।
১২- বাংলাদেশ সংবিধানের ২৮(৪) অনুচ্ছেদের এবং ২৮ (১, ২, ৩) অনুচ্ছেদের কথা উল্লেখ করে ও পশ্চাৎপদ জনগণের (পাহাড়ি) ধোঁয়া তুলে চুক্তির বৈধতার সাফাই দেওয়া হচ্ছে। যদি ঐ ধারার প্রয়োগ করতেই হয়, তাহলে সেটির সুযোগ তো চাকমারা পেতে পারে না। কেননা, চাকমাদের মধ্যে ৭০% শিক্ষিত, বাঙালিরা ১০%, অন্যান্য উপজাতিরা ১০%-১২% এর বেশি নয়। চাকরি, ব্যাবসা-বাণিজ্যসহ আর্থ-সামাজিকভাবে চাকমারা এগিয়ে। সে ক্ষেত্রে ‘পশ্চাৎপদ অংশ’ তো বাঙালি ও ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র উপজাতিরা। তাছাড়া একই পাহাড়ে, একই আবহাওয়ায়, একই প্রতিকূল অবস্থায় বাঙালিরাও তো বাস করছে। সুতরাং, পশ্চাৎপদ অংশের উন্নয়নের নামে চাকমাদের উন্নয়ন নয়, বরং পার্বত্য বাঙালি ও ক্ষুদে উপজাতিদের উন্নয়নে সংবিধানে উল্লেখিত ধারা প্রয়োগ ও চুক্তি করা উচিত ছিল।

দিন দিন বাঙ্গালীদের বঞ্চনা ও উপজাতীদের আর্থ-সামাজিক উন্নতি একই রাষ্ট্রের দুই নীতিকে প্রকট করে তুলছে। যা সামাজিক ভারসাম্যে নিদারুন ক্ষতি করেছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের বাঙালিরা শান্তি চুক্তিকে নিজেদের প্রতিকূলে ভেবে নিয়েছে। সেই বিষয়টি ও বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনা করে এই সিদ্ধান্তে আসা কি যৌক্তিক নয় যে, শান্তি চুক্তি নতুন এক অশান্তির বীজ বপন করেছে? আহমদ ছফা শান্তি চুক্তি নিয়ে আশংকা প্রকাশ করেছিলেন, ‘পার্বত্য শান্তি চুক্তিতে এমন কিছু বিস্ফোরক উপাদান আছে, যা উপজাতি-অউপজাতি জনগোষ্ঠীর মধ্যে অশান্তির পরিমাণ বাড়াবে, দেশের অন্যান্য অঞ্চলে এবং নানা অংশে ছড়িয়ে দেবে অশান্তির আগুন’। আজ আমরা তাঁর কথার আক্ষরিক ফলে যাওয়া দেখতে পাই। 

উপজাতিদের রাতারাতি আদিবাসী হয়ে যাওয়াঃ
চাকমা-মারমারা নিজেদের উপজাতি হিসেবেই প্রকাশ করতো। ১৯৯৭ সালে শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরের সময়ও সন্তু লারমা নিজেকে উপজাতি পরিচয়েই পরিচিত করিয়েছিলেন। চাকমা রাজা দেবাশীষ রায় বাংলাদেশে আদিবাসী বিষয়ক প্রচারণার বেসিক পার্সন। জনসংহতি সমিতি ও সন্ত্রাসী সংগঠন শান্তি বাহিনীর নেতা সন্তু লারমাও শুরুতে আদিবাসী দাবির পক্ষে ছিলেন না। দেবাশীষ রায়ের দাবি বলে তিনি এর সাথে একমত ছিলেন না। কিন্তু পরবর্তীকালে পার্বত্য চট্টগ্রাম নিয়ে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত বিদেশী রাষ্ট্র ও দাতা সংস্থার সমর্থন এবং আর্থিক প্রলোভনে তিনি এই দাবিতে শরিক হন। বর্তমানে তিনি বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সভাপতি।

বিশ্ব আদিবাসী দিবসকে সামনে রেখে আবার নতুন করে বিতর্কটি জমে উঠেছে। বাংলাদেশে আদিবাসী কারা- এই বিতর্কটি খুব বেশী হলে এক দশকের। বিষয়টি নতুন হলেও তা ইতোমধ্যে বাংলাদেশের দেশপ্রেমিক সচেতন মহলকে বেশ আন্দোলিত করেছে। জাতীয় নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্যে এ বিতর্কের সমাধান অবিশ্যম্ভাবী। 

২০১৪ সালের ৭ আগস্ট জারী করা সরকারি এক প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, বাংলাদেশ সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী অনুযায়ী বর্তমানে দেশে আদিবাসীদের কোনো অস্তিত্ব না থাকলেও বিভিন্ন সময় বিশেষ করে জাতিসংঘ ঘোষিত আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবসে ‘আদিবাসী’ শব্দটি বারবার ব্যবহার হয়ে থাকে। পঞ্চদশ সংশোধনীতে বাংলাদেশে বসবাসরত ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীকে উপজাতি বা ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে উল্লেখ করে তথ্য বিবরণীতে বলা হয়, “আগামী ৯ আগস্ট আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস উপলক্ষে বিভিন্ন অনুষ্ঠান, আলোচনা ও টকশোতে ‘আদিবাসী’ শব্দটির ব্যবহার পরিহার করার জন্য অনুরোধ করা হয়েছে এবং সকল আলোচনা ও টকশোতে অংশগ্রহণকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, বিশেষজ্ঞ এবং সংবাদপত্রের সম্পাদকসহ সুশীল সমাজের অন্যান্য ব্যক্তিবর্গকে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে 'আদিবাসী' শব্দটির ব্যবহার পরিহারের জন্য পূর্বেই সচেতন থাকতে অনুরোধ জানানো যাচ্ছে।”

কিন্তু বেশিরভাগ গণমাধ্যম ও গণমাধ্যম ব্যক্তিগণকে আগের মতই দেদারছে 'আদিবাসী' শব্দ ব্যবহার করতে দেখা যায়। বিশেষ করে যে সরকার এই পরিপত্র জারি করে সেই সরকারেরই অনেক মন্ত্রী, এমপিসহ ঊর্ধ্বতন পদাধিকারিকগণ এই পরিপত্র অবজ্ঞা করে আদিবাসী দিবসের অনুষ্ঠানে উপস্থিত হয়ে উপজাতি সম্প্রদায়গুলোকে আদিবাসী হিসেবে স্বীকৃতিদানের জন্য জোরালো দাবি জানিয়েছেন। একই সাথে তারা সরকারি পরিপত্রের তীব্র সমালোচনা করতেও দ্বিধাবোধ করেননি।

মার্কিন সাম্রাজ্যবাদীদের অর্থপুষ্ট ও মদদপুষ্ট বিতর্কিত সিএইচটি কমিশন উপজাতিদের আদিবাসী হিসেবে চালিয়ে দেয়ার ষড়যন্ত্র করে যাচ্ছে বহু বছর জুড়ে। সাম্প্রতিক কয়েকটি সংঘর্ষের ঘটনায় এই কমিশনের প্রত্যক্ষ্য ভূমিকা লক্ষ্য করা গিয়েছে। শান্তিবাহিনীর কর্মকাণ্ডকে বৈধতা দিতেই মূলত সিএইচটি কমিশন কাজ করে গেছে। শান্তিচুক্তি হবার পর, হঠাত বেকার হয়ে পড়ে এই কমিশন। অনেকেই বলে থাকেন ফান্ডিং-এর অভাবই ছিল এর মূল কারণ। এরপর শান্তিচুক্তি বাস্তবায়ন হচ্ছে না – এই মর্মে আবার গঠিত হয় এই কমিশন। এবার সুলতানা কামাল, ইফতিখারুজ্জামান, জাফর ইকবাল, কামাল হোসেন সহ অনেক বাংলাদেশী এই কমিশনে অন্তর্ভুক্ত হন। এর প্রধান হিসেবে অবশ্য একজন বৃটিশ সংসদ সদস্য দায়িত্ব লাভ করেন, তিনি খৃষ্টান পাদ্রি লর্ড এরিক অ্যামভুরি। এটা খুব সাধারণ কথা এই কমিশন যতটা না বাংলাদেশ বা উপজাতিদের স্বার্থ দেখবে তার চাইতে বেশী দেখবে আমেরিকার স্বার্থ। এবং সেটাই তারা করে যাচ্ছে সফলভাবে। ইতিমধ্যে তারা উপজাতিদের আদিবাসী হিসেবে প্রচার করার যাবতীয় পন্থা ব্যবহার করেছে। এই বিষয়ে মিডিয়া পার্টনার হিসেবে সবচেয়ে ভালো ভূমিকা রাখছে ডেইলী স্টার, প্রথম আলো গং। যেখানে এই কমিশনের কাজ হচ্ছে মানবাধিকার রক্ষা, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ইত্যাদি মৌলিক বিষয় নিয়ে কাজ করা সেখানে তারা কিভাবে পাহাড়ী বাঙ্গালীদের অধিকার হরণ করা যায়, সেই চেষ্টায় লিপ্ত। বাঙ্গালী উচ্ছেদ ও বাঙ্গালীদের সুযোগ সুবিধা বন্ধ করার জন্য সুপারিশ করে তারা রিপোর্ট দিচ্ছে। 

তারা হঠাৎ উপজাতিদের আদিবাসী বানাতে চাচ্ছে কারণ বাংলাদেশ সরকার যদি কোনভাবে উপজাতিদের আদিবাসী স্বীকৃতি দেয় তাহলে জাতিসংঘের মাধ্যমে তাদের স্বায়ত্বশাসনের নাম করে খুব সহজেই স্বাধীন করে দিতে পারবে। যে ধারার ওপর নির্ভর করে জাতিসংঘ ও আমেরিকা 'আদিবাসী' পরিচিতি আদায়ের জোর চেষ্টা করছে। সেটি নিন্মরুপ-
আদিবাসীদের অধিকারের উপর জাতিসঙ্ঘের ঘোষণাপত্র : ধারা ৩

"United Nations Declaration on the Rights of Indigenous Peoples: 
Article 3 -- Right to Self-determination
Article 3 -- Right to Self-determination Indigenous peoples have the right of self determination. By virtue of that right they freely determine their political status and freely pursue their economic, social and cultural development."

ধারা ৩ -- আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকার
আদিবাসীদের আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকার আছে। এই অধিকারের বলে তারা স্বাধীনভাবে তাদের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করবে (অর্থাৎ তারা কি কোন দেশের মধ্যে থাকবে, না সেই দেশ থেকে আলাদা হয়ে স্বাধীন দেশ গঠন করবে -- সেটা তাদের রাজনৈতিক ইচ্ছার উপর নির্ভর করবে, যেমন জুমিয়ারা কি বাংলাদেশের মধ্যে থাকবে, না বাংলাদেশ থেকে আলাদা হয়ে পার্বত্য এলাকাকে নিয়ে স্বাধীন জুম্মল্যান্ড গঠন করবে তা জুমিয়াদের রাজনৈতিক ইচ্ছার উপর নির্ভর করবে) এবং স্বাধীনভাবে তাদের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক উন্নয়ন অনুসরণ করবে।

এই ধারার আলোকেই বিনা রক্তপাতে পশ্চিমা দেশগুলো ও জাতীসংঘের প্রত্যক্ষ সহায়তায় সম্প্রতি সময়ে স্বাধীনতা লাভ করেছে পূর্বতীমুর। যা অখন্ড ইন্দোনেশিয়ার অঞ্চল ছিলো। 'আদিবাসী' শব্দ চর্চার বিষয়ে বাংলাদেশের মানুষের অজ্ঞতাকে পুঁজি করেই এক শ্রেনীর মানুষ পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদীদের দক্ষিণ এশীয় এজেন্ট হিসেবে এদেশে সক্রিয় বলে ব্যাপক সন্দেহের আর কোন অবকাশ নাই।

আমেরিকার স্বার্থ কি? 
সোভিয়েত ইউনিয়ন পতনের পর চীন ধীরে ধীরে বর্তমান বিশ্বের একমাত্র পরাশক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে নিজকে প্রস্তুত করছে। এমতাবস্থায় চীনকে যদি ভারত মহাসাগর ও বঙ্গোপসাগরের নীল জলরাশিতে আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে হয় তাহলে সবচেয়ে যোগ্যতম স্থান হচ্ছে বাংলাদেশের পার্বত্য এলাকা কেননা এখানে চীনের সাথে আছে জনসংখ্যার মধ্যে জাতিতাত্ত্বিক মিল এবং কম দূরত্ব। এমতাবস্থায় চীন এই এলাকার ওপর প্রভাব বিস্তার করার জন্য বাংলাদেশের সাথে সুসম্পর্ক স্থাপন করবে এটাই স্বাভাবিক, কিন্তু ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র এটা কোন দিক থেকে গ্রহণ করবে সেদিকে সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে। বাংলাদেশের সরকারযন্ত্রের, সামান্য ভুলে কারণে হয়তো এই সম্ভাব্য এলাকাটি এক সময় সমগ্র জাতির দুঃখের কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে।

কেন আমেরিকা উপজাতিদের স্বাধীন করতে ভূমিকা রাখবে, এই প্রশ্নের উত্তর খুব সুন্দরভাবে দিয়েছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ভুগোল বিভাগের গবেষক জনাব কাজী বরকত আলী। তিনি বলেন একটা প্রমাণ সাইজের বিশ্ব মানচিত্র নিয়ে তার মধ্যে দুই ইঞ্চি ব্যসের অনেকগুলো বৃত্ত একটা আরেকটাকে স্পর্শ করে যদি আঁকেন তাহলে আপনি দেখতে পাবেন, প্রতিটা বৃত্তের মধ্যেই আমেরিকান ঘাঁটি রয়েছে। শুধু ব্যতিক্রম দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বৃত্তদ্বয়। আর এই বৃত্তের মধ্যেই রয়েছে দু'দুটো পরাশক্তি ভারত ও চীন। এদের নিয়ন্ত্রণ করার জন্যই এখানে একটা ঘাঁটি খুব প্রয়োজন আমেরিকার। 

এখানে দুটো পরিকল্পনাকে আবর্তিত হচ্ছে তাদের কার্যক্রম। প্রথমত উপজাতি জুমিয়াদের আদিবাসী স্বীকৃতি আদায় করে সেখানে জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে আলাদা স্বায়ত্বশাসন বা আলাদা রাষ্ট্র করার মাধ্যমে নিজেদের শক্ত ঘাঁটি প্রস্তুত করা। দ্বিতীয়ত কোন কারণে সেটি সম্ভব না হলে এই অঞ্চলের অধিকাংশ গরিব উপজাতিদের সচ্চল জীবনের লোভ দেখিয়ে খ্রীস্টান বানিয়ে তাদের মাধ্যেমে আলাদা রাষ্ট্রের দাবী উত্থাপন করা। সেই লক্ষ্যে এখন অনেকদূর তারা পৌঁছে গিয়েছে। 

যে উপজাতিরা আমাদের থেকে আলাদা হয়ে ওদের নিয়ন্ত্রনে একটা রাষ্ট্র গঠনের স্বপন দেখছে যদি আমেরিকার কূটচাল বাস্তবায়িত হয় তাহলে সবচেয়ে বেশী ক্ষতির সম্মুখিন হবে উপজাতিরাই। আর আমাদের দেশ হবে খন্ডিত। সার্বভৌমত্ব ও স্বাধীনতা হবে লঙ্গিত। আরো জঘন্য ব্যাপার হল, আল্লাহ না করুন যদি আমেরিকার কূটচাল বাস্তবায়িত হয় তাহলে বিষয়টা মোটেই ভালোভাবে নিবেনা চীন ও ভারত। সেক্ষেত্রে তারা (ভারত ও চীন) প্রতিহত করার জন্য যেকোন সামরিক পদক্ষেপ নিতে পিছপা হবে না। তখন বাংলাদেশ হবে যুদ্ধক্ষেত্র। যারা যুদ্ধ করবে তারা এখানে যুদ্ধ করতে মোটেই দ্বিধা করবে না কারণ এখানে তাদের জনগণ নেই। 

তাই সকলে সচেতন থাকুন। দেশদ্রোহী সুলতানা কামালের সিএইচটি কমিশন ও প্রথম আলো গংদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান। এখনই সময় প্রতিরোধের। এদেশে আমরাই আদিবাসী। আমাদের রয়েছে সুদীর্ঘ চার হাজারেরও বেশী বছরের ইতিহাস। এই অঞ্চলে বাঙ্গালীদের আগে আর কোন জাতি ছিল বলে কোন ইতিহাস নেই। আমরাই এই অঞ্চলের প্রতিষ্ঠাকালীন সভ্যতার ধারক ও বাহক। তাই আমাদের দেশকে আমরাই রক্ষা করার জন্য এগিয়ে আসতে হবে। আবার এর মানে এই নয় যে আমরা উপজাতিদের উচ্ছেদ করতে চাই। উপজাতিরা যেভাবেই হোক আমাদের দেশে এসেছে। আমাদের দেশের নাগরিক। আমাদের এই পর্যায়ে এসে জাতিগত বিভেদ করে আমরা আমাদের দেশকে হুমকির সম্মুখিন করতে চাই না। আমাদের বাঙ্গালী, চাকমা, মারমা, উপজাতি-অউপজাতি এসব পরিচয়ের চাইতে বড় পরিচয় হলো আমরা বাংলাদেশী। আমরা সবাই মিলে এদেশের জন্য কাজ করবো, এখানে সবার অধিকার সমান হবে। মহান আল্লাহ সুবহানাল্লাহু তায়ালা আমদের সহায় হোন। 

৫ অক্টো, ২০১৫

প্রতিশোধ



১.
পুলিশ অফিসার হিসেবে বেশ নাম-ডাক ওসি নিজাম উদ্দিনের। সরকারের নেক নজরে আছেন তিনি। কারণ সরকারের যে কোন নির্দেশ পালনে তিনি বেশ পটু। তার চাইতেও বেশী পটু তিনি শিবির পেটানোতে। তিনি সব সময় নিজেকে বলেন শিবিরের যম। মেজাজ সবসময় খিটখিটে থাকলেও আজ তিনি বেশ খুশি। কারন তার ছোট ছেলে SSC তে A+ পেয়েছে। সবাইকে মিষ্টি খাওয়াচ্ছেন তিনি।

শামীম আহমেদ। রাষ্ট্রবিজ্ঞান অনার্স ৩য় বর্ষের ছাত্র। সরকারি কলেজের ছাত্রশিবিরের সেক্রেটারী। পালিয়ে কলেজে ঢুকতে ও বের হতে হয়। কারন ওসি নিজাম। যে কোন মূল্যে গ্রেপ্তার করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তিনি। শামীম রাতে নিজের মেসে তো থাকতেই পারে না, আত্মীয় স্বজন কারো বাড়িতেই থাকতে পারে না। আজ এই কর্মীর বাসায় তো কাল ঐ কর্মীর বাসায়।

কলেজের দুজন সাধারণ কর্মীকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। উদ্দেশ্য শামীমের অবস্থান জানা। প্রচন্ড নির্যাতন করে। প্রথমে লাঠিপেটা, তারপর বাঁশডলা। বাঁশডলা মানে হচ্ছে হাত দুটো উপরে তুলে হাতকড়া পরিয়ে চিৎ করে শোয়ানো হয়। তারপর ঘাড়ের নিচে হাতের উপরে একটা লাঠি রেখে চারজন পুলিশ এর উপর দাঁড়ায়। এতে কর্মী দুজনের হাতের কার্যকারিতা হারিয়ে ফেলে। প্রচন্ড নির্যাতনে তারা বারবার রক্তবমি করছে ও বেহুঁশ হয়ে পড়ছে।

এভাবে নিজাম আরো দশ বারোজন শিবির কর্মীকে আটক করে। হতাশ নিজাম উদ্দিন। সে কারো মুখ থেকে কোন তথ্য বের করতে পারলো না। ক্রোধান্বিত হয়ে সর্বশেষ সে আটককৃত দুজন কে পায়ে গুলি করে পঙ্গু করে দেয়।

২.
অঝোরে কাঁদতে থাকে শামীম। অপরাধ বোধ তাকে গ্রাস করে। তার জন্য তার একের পর এক সহকর্মীদের নির্যাতন সইতে হচ্ছে। পঙ্গু হয়ে যাওয়া দুই ভাইয়ের গ্রামের বাড়িতে যায় সে মায়েদের সান্তনা দিতে। কিসের সান্তনা দিবে সে নিজেই কেঁদে কূল পাচ্ছে না। উল্টো তারাই শামীমকে সান্তনা দিচ্ছে। শামীম তার উর্ধ্বতনকে বারবার বলে থানায় সে আত্মসমর্পন করবে। কিন্তু উর্ধ্বতনের কড়া নির্দেশ, এমনটি করা যাবে না।

হতাশ নিজাম নতুন চাল চালে। সোজা সে শামীমের গ্রামের বাড়িতে গিয়ে তার বিধবা মাকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে আসে। এবার শামীমকে থানায় যেতে বলে তার দায়িত্বশীলেরা। ওসি নিজামের মুখে বিদ্রুপের হাসি ফুটে উঠে। তুই আমারে অনেক কষ্ট দিয়েছিস। এর মূল্য তোরে দিতে হবে। এত সহজে তোর মাকে ছাড়ছি না। পঞ্চাশ হাজার লাগবে। টাকা নিয়ে আয়, তোরে রেখে তোর মাকে ছেড়ে দেব। সন্ধ্যার মধ্যে আসবি। কোন চালাকি করবি না। বলে পকেট থেকে একটা পুটলিমত কিছু একটা বের করে বলে এই দেখ হেরোইন। তোর মাকে মাদক মামলা দিয়ে দেব। বুঝিস।

পৃথিবীতে শামীমের আছে ঐ কেবল মা। কোন ভাই বোন নেই। পিতা গত হয়েছেন শামীমের ছোটবেলায়। বাবার কোন স্মৃতিই তার মনে নেই। এই মা আজ বন্দি। কিছুই মাথায় আসছে না তার। খুব দ্রুত টাকা যোগাড় করে থানায় আসে। থানার বাইরে তার সহকর্মীরা দাঁড়িয়ে আছে। তাদের প্রানপ্রিয় শামীম ভাই হয়তো আর কোনদিন তাদের সাথে মিলিত হতে পারবে না। অজানা ভবিষ্যত কারোই জানা নেই। কেবল আল্লাহর উপর ভরসা করে পাঠিয়ে দিচ্ছে।

শামীমের মা বের হলেই অন্যান্য সহকর্মীরা তার মাকে নিয়ে পালিয়ে যায়। শামীম বলে গিয়েছে মা কে যেনো লুকিয়ে রাখা হয়। কারণ পাষন্ড নিজাম হয়তো তার থেকে কথা বলার অস্ত্র হিসেবে আবার মাকে ধরে নিয়ে আসতে পারে।

নির্যাতনের আর কোন পন্থা বাদ রাখেনি নিজাম। এক এক করে প্লাইয়ার্স দিয়ে সব নখ তুলে ফেলা, বাঁশডলা, পিঠে সিগারেটের আগুন, হাতুড়ি দিয়ে বাম হাত থেঁতলে দেয়া। দু কানে টানা কারেন্ট শক দেয়া চোখে লবণ মরিচ ইত্যাদি সব করে নিজামরা হাঁপিয়ে উঠেছে। তবুও বের করতে পারে নি অন্যান্য দায়িত্বশীলদের নাম বা ঠিকানা। বার বার হুমকি দিচ্ছে ক্রসফায়ারে মেরে ফেলবে।

শামীমের মুখ থেকে আল্লাহ ছাড়া আর কোন শব্দই বের হয় নি। উহ কিংবা আহও না। টানা পাঁচদিনের এই নির্যাতনে কেঁদেছে অনেক পুলিশ সদস্যও। অনেকে নিজামকে বলেছে, স্যার ছেড়ে দেন, মনে হয় কিছু জানে না। জানলে সব বলে দিত। আপনি যেভাবে পিটিয়েছেন সেভাবে কোন জানোয়ারকে পিটালে সেও এতক্ষনে কথা বলা শুরু করে দিত।

হাল ছাড়লেন না নিজাম। বললেন ওয়াটার ট্রিটমেন্ট দিতে হবে। না বলে কই যাবে। অসুস্থ শামীমকে চেয়ারে বসিয়ে চেয়ারের সাথে বাঁধা হলো। চেয়ার উল্টে ফেলে দেয়া হল। নাক মুখ গামছা দিয়ে বেঁধে দেয়া হল। তারপর তার মুখের উপর পানি ঢালা হল। যতক্ষন পানি দেয়া হয় ততক্ষন শামীমের মনে হয় সে পানিতে ডুবে যাচ্ছে। ফুসফুস ফুলে ফেটে যাওয়ার উপক্রম হচ্ছে। বেদনায় নীল হয়ে যাচ্ছে তার মুখ। দাঁতে দাঁত চেপে শুধু সে বলতে থাকলো হাসবুন আল্লাহ ওয়া নে’মাল ওয়াকীল, নে’মাল মাওলা, ওয়া নে’মান নাসির।

ব্যর্থ হয়েছেন নিজাম সাহেব। শামীমের মুখ থেকে কোন কথা বের করতে পারেন নি। তাকে কয়েকটি বিস্ফোরক মামলা দিয়ে কোর্টে চালান করে দিচ্ছেন। এই সময় শামীম ইশারায় নিজামকে ডাকলো। কাছে আসলে বললো, জানিনা বাঁচবো কিনা। যদি বেঁচে থাকি আমি এর প্রতিশোধ নেব ইনশাল্লাহ। ক্রোধে আগুন হয়ে শামীমের বাম গালে কঠিন একটি চড় দিলেন।

৩.
নিজাম সাহেবের বড় দুই ছেলেই নেশাগ্রস্থ। কয়েকবার মাদক নিরাময় সেন্টারে দিয়েও উপকার পাননি। পড়াশোনা তারা ঠিকভাবে কোন সময়ই করে নি। ছোট ছেলে একটু আধটু পড়াশোনায় ছিল তবে এ প্লাস পাওয়ার মত নয়, অথচ সে ছেলে A+ পেয়ে বসলো। তাই তিনি অনেক খুশি। তার মনে খটকাও লাগে। কারন এই ছেলে হটাৎ পরীক্ষার ৬ মাস আগ থেকে ভালো হয়েছে। পড়াশোনা শুরু করেছে। তার আগে সে বইয়ের কাছেও ঘেঁষতো না। তার বড় দুই সন্তানও গত কয়েক মাসে ধীরে ধীরে প্রকৃতস্থ হয়ে উঠছে। আচরণ ধীরে ধীরে ভালো হচ্ছে। নিজাম সাহেব তার তিন ছেলেকে নিয়ে নতুন করে আবার স্বপ্ন দেখতে শুরু করলেন। আর ছোট ছেলের ব্যাপারে তার চিন্তা তাকে ব্যারিস্টার বানাবেন। 

হঠাৎ ছোট ছেলের কথায় চিন্তায় ছেদ পড়ে। বাবা তুমি না বলেছিলে যিনি আমার ভালো রেজাল্টের জন্য সবচেয়ে বেশী কষ্ট করেছেন তাকে নিয়ে আসতে। তিনি এসেছেন। নিজাম সাহেব ব্যস্ত হয়ে বললেন, হ্যাঁ হ্যাঁ চল।

থমকে গেলেন নিজাম সাহেব। আরে! এ যে শামীম।
--শামীম তুমি?
-- জ্বি নিজাম সাহেব আমি। কথা দিয়েছিলাম প্রতিশোধ নেব। নিলাম। আপনার তিন ছেলেকে মানুষ করার চেষ্টা করেছি। তারা আর আপনার মত অমানুষ না।

অন্য দুই ছেলে একসাথে বলে উঠলো, বাবা আমাদের ক্ষমা কর। আমরা এতদিন নানা অন্যায় করেছি। তোমাকে কষ্ট দিয়েছি। আমরা ভুলের মধ্যে ছিলাম। শামীম ভাই আমাদের চোখ খুলে দিয়েছেন।

কয়েক ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়লো হতবিহ্বল নিজাম সাহেবের চোখ থেকে।