৬ সেপ, ২০২৫
২৩ জুল, ২০২৫
জুলাই ডায়েরি : ১৮ জুলাই
আজ ১৮ জুলাই।
১৭ জুল, ২০২৫
জুলাই ডায়েরি : ১৭ জুলাই
১৬ জুল, ২০২৫
জুলাই ডায়েরি : ১৬ জুলাই
আজ ১৬ জুলাই।
গতবছর অর্থাৎ ২০২৪ সালে এই দিন ছিল হিজরি ১০ মহররম। কারবালার দিন। বাংলাদেশেও সেদিন কারবালা শুরু হয়।
১৫ জুলাই রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে হামলার প্রতিবাদে সারা বাংলাদেশের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ক্ষোভে ফেটে পড়ে।
# রংপুরে ১ম শহীদ আবু সাঈদের শাহদাত
# সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হয়ে চট্টগ্রামে তিনজন, ঢাকায় দুজন ও রংপুরে একজন নিহত হয়েছেন। আহত চার শতাধিক।
# স্কুল–কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা, বৃহস্পতিবারের এইচএসসি পরীক্ষা স্থগিত। বিজিবি মোতায়েন
# জুলাই বিপ্লবের পক্ষে স্ট্যাটাস দেওয়ায় টেন মিনিট স্কুলের ৫ কোটি টাকার অনুদান বন্ধ করেছে পলক
# ছাত্রদের ওপর ছাত্রলীগ ও পুলিশের হামলায় অ্যামনেস্টির নিন্দা
# সরকারি হামলার প্রতিবাদে অর্ধশতাধিক ছাত্রলীগ নেতার পদত্যাগ
রংপুরে সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের সঙ্গে পুলিশ ও ছাত্রলীগের দফায় দফায় সংঘর্ষ হয়েছে। এ সময় পুলিশের রাবার বুলেটের আঘাতে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থী নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন শতাধিক শিক্ষার্থী। নিহত আবু সাঈদ (২২) রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থী। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের কোটা আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক ছিলেন। তিনিই জুলাই বিপ্লবের ১ম শহীদ।
১৫ জুলাই রাজধানী ঢাকায় বিক্ষোভ দমনে লাঠিসোঁটা, কোথাও কোথাও আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে সক্রিয় ছিলো ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগের অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীরা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে ঢাকার অন্তত ১৬ টি জায়গায় শিক্ষার্থীরা সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেন। বেলা দুইটার পর থেকে রাজধানীর সঙ্গে সারা দেশের রেল যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়। এর মধ্যে ঢাকা কলেজ থেকে সায়েন্স ল্যাব, পুরান ঢাকা, নতুন বাজার ও মিরপুর এলাকায় আন্দোলনকারীদের সঙ্গে সরকার সমর্থকদের পাল্টাপাল্টি ধাওয়া, সংঘর্ষ, গুলি ও হামলার ঘটনা ঘটে।
১৫ জুলাই ছাত্রশিবির ব্যানার ছাড়া মাঠে নামলেও ১৬ জুলাই ছাত্রশিবির ঢাকার কয়েকটি স্থানে মিছিল করেন এবং ঢাবিতে পুলিশের সাথে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েন। ঢাকা কলেজের সামনে আহত একজনের মৃত্যু হয়েছে। ঢাকা সিটি কলেজের সামনে আহত আরেকজনকে হাসপাতালে নেওয়ার পর মৃত ঘোষণা করা হয়। ঢাকায় শহীদ হওয়া দুইজনই ছিলেন শ্রমিক। সন্ধ্যা সাতটা পর্যন্ত আহত ১২৬ জন ঢাকা মেডিকেলে চিকিৎসা নিয়েছেন। এর বাইরে আহত কেউ কেউ বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন বলে জানা গেছে।
চট্টগ্রামে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে যুবলীগ-ছাত্রলীগের সংঘর্ষে তিনজন নিহত হয়েছেন। শহরের মুরাদপুরে শিক্ষার্থীদের ওপর অস্ত্রধারীরা গুলি ছুড়লে দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ বাধে। ছাত্রশিবির নেতা ফয়সল আহমেদ শান্ত, ছাত্রদল নেতা ওয়াসিম ও একজন কাঠমিস্ত্রী শহীদ হন।
গতকালও দিনভর উত্তপ্ত ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস। গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জসহ ঢাকার বিভিন্ন স্থান থেকে নেতা-কর্মীদের নিয়ে গতকাল ক্যাম্পাসে অবস্থান নেয় ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা। জঙ্গী সংগঠনটির নেতা-কর্মীদের হাতে ছিল হকিস্টিক, লাঠি, স্টাম্পসহ বিভিন্ন দেশীয় অস্ত্র। শহীদ মিনার, দোয়েল চত্বর, ঢাকা মেডিকেল, কার্জন হল, চানখাঁরপুল এলাকায় অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ করেন আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের হামলায় আহত হয়েছেন শিক্ষার্থীরা। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও ঢাকার কয়েকটি এলাকায় বিক্ষোভ করেছেন। ঢাকার বাইরে ১০টি বিশ্ববিদ্যালয়ে বিক্ষোভ করেছেন শিক্ষার্থীরা। এতে ছাত্রলীগ, যুবলীগের নেতা-কর্মীরা ও পুলিশ হামলা চালায়।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে সোমবার সন্ধ্যায় আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা করে বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা। পরে দুই পক্ষের মধ্যে পাল্টাপাল্টি ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। গভীর রাতে উপাচার্যের বাসভবন চত্বরে শিক্ষার্থীদের ওপর পেট্রলবোমা ও দেশি অস্ত্র নিয়ে হামলা এবং মারধর করে স্বাধীনতা বিরোধী ছাত্রলীগ। পরে পুলিশ এসে কাঁদানে গ্যাসের শেল ও ছররা গুলি ছোড়ে। এ ঘটনায় শতাধিক শিক্ষার্থী আহত হয়েছেন। এ ছাড়া ঘটনাস্থলে উপস্থিত চার-পাঁচজন শিক্ষক ও সাতজন সাংবাদিক আহত হন। চোখে ছররা গুলি লেগে গুরুতর আহত হয়েছেন এক শিক্ষক। আহত ব্যক্তিদের মধ্যে বেশিরভাগই বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসাকেন্দ্রে চিকিৎসা নিয়েছেন। আর গুরুতর আহত ব্যক্তিদের সাভারের বিভিন্ন বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
জুলাই বিপ্লবীরা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি হলের প্রভোস্টের কক্ষ, ছাত্রলীগ নেতাদের কক্ষসহ অন্তত ১০টি কক্ষে ভাঙচুর চালান। একপর্যায়ে তাঁরা ১৫টি মোটরসাইকেলে আগুন ধরিয়ে দেন। ছাত্রলীগের রাবিতে ছাত্রদের ধাওয়া খেয়ে ক্যাম্পাস ছাড়ে। কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করে শহরের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অন্তত দেড় হাজার শিক্ষার্থী ক্যাম্পাসে আসেন। আড়াইটায় ক্যাম্পাস থেকে লাঠি হাতে নানা স্লোগান দিয়ে মিছিল করেন তাঁরা।
রংপুরে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেটে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, দিনাজপুর প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, গোপালগঞ্জে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়েও আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ করেছেন।
বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় এবং ঢাকা ও চট্টগ্রামের বাইরে আন্দোলনকারীদের ওপর অন্তত সাতটি জেলায় ছাত্রলীগ হামলা চালিয়েছে। ফরিদপুর, বরিশাল, ঝিনাইদহ, কিশোরগঞ্জ, দিনাজপুর, রাজশাহী কলেজ ও নওগাঁ সরকারি মেডিকেল কলেজে সংঘর্ষে অন্তত ৬৮ জন আহত হয়েছেন।
বরিশাল সরকারি ব্রজমোহন (বিএম) কলেজে কোটা সংস্কার আন্দোলনের মিছিলে ছাত্রলীগের জঙ্গীরা হামলা চালিয়েছে। এ সময় দুই পক্ষের মধ্যে দফায় দফায় পাল্টাপাল্টি ধাওয়া হয়। এতে অন্তত ২০ জন আহত হয়েছেন। গুরুতর আহত সাতজনকে বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। বেলা ১১টার দিকে ফরিদপুর সরকারি বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান ফটকের সামনে আন্দোলনকারী ছাত্রছাত্রীদের ওপর হামলা করেছে ছাত্রলীগ। এ সময় আহত হয়েছেন ছয়জন আন্দোলনকারী।
রাজশাহী কলেজে শিক্ষার্থীদের ওপর অতর্কিত হামলা চালিয়েছে ছাত্রলীগ। দুপুরে বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের সামনে এ ঘটনা ঘটে। এতে অন্তত ১০ জন আহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। বেলা ১১টা থেকে কোটাবিরোধী শিক্ষার্থীরা কিশোরগঞ্জ শহরে জড়ো হতে থাকেন। বেলা সাড়ে ১১টার দিকে জেলা ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা লাঠিসোঁটা, হকিস্টিক ও রড নিয়ে কোটা আন্দোলনকারীদের ওপর অতর্কিত হামলা চালায়। পরে আন্দোলনকারীরাও লাঠিসোঁটা নিয়ে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের ধাওয়া করেন। পাল্টাপাল্টি ধাওয়ার ঘটনায় অন্তত ১০ জন আহত হয়েছেন।
ঝিনাইদহ শহরের উজির আলী স্কুল অ্যান্ড কলেজ মাঠে আন্দোলনকারীদের ওপর হামলায় ১০ শিক্ষার্থী আহত হয়েছেন। শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ শুরুর ঠিক আগমুহূর্তে শহর থেকে লাঠিসোঁটা নিয়ে ছাত্রলীগের একটি মিছিল থেকে অতর্কিত আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা চালানো হয়। দিনাজপুরে বিক্ষোভরত শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ছাত্রলীগ ও যুবলীগ নেতাদের পাল্টাপাল্টি ধাওয়ার ঘটনা ঘটেছে। এতে বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলের দুজন ক্যামেরা পারসনসহ অন্তত আটজন আহত হয়েছেন। প্রায় ঘণ্টাব্যাপী ইটপাটকেল নিক্ষেপ, পাল্টাপাল্টি ধাওয়ার পর পুলিশের উপস্থিতিতে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়। নওগাঁ সরকারি মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থীদের মানববন্ধনে হামলার ঘটনা ঘটেছে। এতে আহত হয়েছেন চার শিক্ষার্থী।
বগুড়া সরকারি পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থীরা বেলা একটায় শহরের সাতমাথা-বনানী সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ শুরু করেন। ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা হামলার চেষ্টা করলে লাঠিসোঁটা হাতে তাঁরা ছাত্রলীগকে ধাওয়া করেন। ছাত্রলীগ নেতাদের মোটরসাইকেল ভাঙচুর করা হয়। বগুড়ার সরকারি আজিজুল হক কলেজ ও শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থীরা ক্লাস বর্জন করে সড়ক-মহাসড়ক অবরোধ ও বিক্ষোভ সমাবেশ করেছেন। ঢাকা-রংপুর মহাসড়ক অবরোধ করেন শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থীরা। নরসিংদীতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা জেলখানার মোড়ে ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক অবরোধ করেন। চুয়াডাঙ্গা প্রেসক্লাবের সামনে মানববন্ধনের আয়োজন করেছেন শিক্ষার্থীরা।
বেলা ১১টার দিকে ময়মনসিংহ-টাঙ্গাইল সড়কের প্রবেশমুখ নগরের টাউন হল মোড় এলাকা অবরোধ করেন বিভিন্ন স্কুল-কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েক হাজার শিক্ষার্থী। সকাল নয়টা থেকে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজের একাডেমিক ভবন থেকে বিক্ষোভ মিছিল বের করা হয়। সকাল ১০টায় বিশ্ববিদ্যালয়টির স্থায়ী ক্যাম্পাস খড়খড়ি বাইপাসে ক্যাম্পাসের সামনে রাজশাহীর বেসরকারি বরেন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা রাস্তা অবরোধ করে বিক্ষোভ করছেন।
সকাল ১০টায় রংপুর মেডিকেল কলেজ ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ সমাবেশ করেছেন রংপুর মেডিকেল কলেজ ও বেসরকারি কমিউনিটি মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থীরা। একই সময় বেসরকারি প্রাইম মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থীরা তাঁদের ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ সমাবেশ করেন।
গতকাল বিকেলে ঢাকা-আরিচা মহাসড়ক অবরোধ করেছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। মিছিলে সংহতি জানিয়ে গণ বিশ্ববিদ্যালয়, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, সাভার মডেল কলেজ, মির্জা গোলাম হাফিজ কলেজ, সাভার ল্যাবরেটরি কলেজসহ কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা যোগ দেন। বিক্ষোভ মিছিল বের করেন ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা।
মানিকগঞ্জের কর্নেল মালেক মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ মিছিল ও মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করেছেন। মুন্সিগঞ্জ প্রেসক্লাবের সামনের সড়কে মানববন্ধন করেন সরকারি হরগঙ্গা কলেজ, মুন্সিগঞ্জ কলেজ ও রামপাল ডিগ্রি কলেজের শিক্ষার্থীরা। নারায়ণগঞ্জে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ করেছেন শিক্ষার্থীরা। জেলার সোনারগাঁয়ে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক অবরোধ করেছেন বিভিন্ন স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা।
#জুলাই_ডায়েরি
১৫ জুল, ২০২৫
জুলাই ডায়েরি : ১৫ জুলাই
২০২৪ সালের এই দিনে কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ছাত্রলীগের দফায় দফায় সংঘর্ষ হয়েছে। বেলা তিনটার দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি হল থেকে এই সংঘর্ষের সূত্রপাত হয়। এরপর আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর দফায় দফায় হামলা চালায় ছাত্রলীগ। রাত নয়টা পর্যন্ত চলা সংঘর্ষ ও পাল্টাপাল্টি ধাওয়ায় রণক্ষেত্রে পরিণত হয় বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস।
হামলা ও সংঘর্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের নেতা–কর্মীদের পাশাপাশি সংগঠনটির ঢাকা মহানগরের বিভিন্ন শাখার নেতা–কর্মীরা অংশ নেয়। তাঁদের হাতে ছিল হকিস্টিক, লাঠি, রড, জিআই পাইপসহ বিভিন্ন দেশি অস্ত্র। ক্যাম্পাসের বিভিন্ন স্থানে পিস্তল দিয়ে গুলি ছুড়তে দেখা যায় অন্তত পাঁচজন অস্ত্রধারী ছাত্রলীগ সন্ত্রাসীকে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশাপাশি গতকাল হামলার ঘটনা ঘটে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের বিভিন্ন স্থানে। এসব হামলার ঘটনাতেও ছাত্রলীগের নাম এসেছে। তবে মূল সংঘর্ষ হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ১৫ জুলাই বেলা তিনটার দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজয় একাত্তর হলের সামনে সংঘর্ষ শুরু হওয়ার পর আন্দোলনকারীদের খুঁজে খুঁজে পেটায় নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গী সংগঠন ছাত্রলীগের নেতা–কর্মীরা। পরে বিভিন্ন হলের কক্ষে তল্লাশি চালিয়ে আন্দোলনকারীদের খুঁজতে থাকেন তারা। হামলার মুখে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের বড় অংশ ক্যাম্পাস ছেড়ে আশপাশের বিভিন্ন স্থানে অবস্থান নেন।
হামলায় তিন শতাধিক শিক্ষার্থী আহত হয়েছেন। এ ছাড়া হামলার ছবি তুলতে গিয়ে মারধরের শিকার হয়েছেন কয়েকজন সাংবাদিক। সবচেয়ে ভয়ংকর ব্যাপার হলো ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগের সামনে আহত ও তাঁদের সঙ্গে থাকা শিক্ষার্থীদের ওপরও হামলা করে ছাত্রলীগের জঙ্গীরা। সন্ধ্যার পর হাসপাতালের জরুরি বিভাগের ভেতরেও মারধরের ঘটনা ঘটে। এ সময় পুরো হাসপাতালে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। অনেক রোগী ও তাঁদের স্বজনেরা ছোটাছুটি করতে থাকেন।
১৫ জুলাই সকাল থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হল থেকেও আন্দোলনকারীরা বের হয়ে রাজু ভাস্কর্যের সামনে যাওয়ার চেষ্টা করেন। দুপুর সোয়া ১২টার দিকে বিপুলসংখ্যক আন্দোলনকারী শিক্ষার্থী সেখানে অবস্থান নেন। তখন খবর আসে, বিভিন্ন হলে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের বের হতে বাধা দিচ্ছে ছাত্রলীগ। এ সময় বিজয় একাত্তর হল, জিয়াউর রহমান হল, শেখ মুজিবুর রহমান হল ও জসীমউদ্দীন হল থেকে রাজু ভাস্কর্যে থাকা শিক্ষার্থীদের সহযোগিতা চাওয়া হয়।
বেলা ২টা ২৫ মিনিটে আন্দোলনকারীদের একটি অংশ টিএসসি থেকে মিছিল নিয়ে পাশাপাশি থাকা ওই হলগুলোর দিকে যান। অন্য অংশটি টিএসসিতে অবস্থান করেন। আন্দোলনকারীরা প্রথমে মিছিল নিয়ে শেখ মুজিবুর রহমান হল প্রাঙ্গণে প্রবেশ করেন। হলের ভেতরের ফটকের সামনে গিয়ে তাঁরা রিকশায় থাকা মাইকে ‘বঙ্গবন্ধু হলের ভয় নাই, রাজপথ ছাড়ি নাই’সহ নানা স্লোগান দিতে থাকেন। কয়েকজন হলের ভেতরে ঢুকে কক্ষে থাকা শিক্ষার্থীদের আনতে যান। মিনিট কয়েক পর মিছিলটি বের হয়ে আসে।
বঙ্গবন্ধু হল থেকে বের হয়ে আন্দোলনকারীদের মাইক থেকে বলা হয়, তাঁরা খবর পেয়েছেন যে কয়েকজন আন্দোলনকারীকে পার্শ্ববর্তী মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান হলে আটকে রাখা হয়েছে। এরপর তাঁরা যান জিয়াউর রহমান হলে। হলের সামনে গিয়ে তাঁরা ‘দালালদের কালো হাত, ভেঙে দাও গুঁড়িয়ে দাও’সহ নানা স্লোগান দেন। আন্দোলনকারীদের কয়েকজন ভেতরে থাকা শিক্ষার্থীদের আনতে হলের ভেতরে প্রবেশ করেন। এ সময় বাইরে নানা স্লোগান দেওয়া হয়।
কিছুক্ষণের মধ্যেই আন্দোলনকারীদের মিছিলটি জিয়াউর রহমান হল থেকে বের হয়ে বিজয় একাত্তর হলের ফটকের দিকে যায়। মিছিলটি হলের ফটকে যাওয়ার পর মাইকে বলা হয়, আন্দোলনকারীদের কয়েকজনকে বিজয় একাত্তর হল সংসদের কক্ষে আটকে রাখা হয়েছে। একপর্যায়ে মাইকে শিক্ষার্থীদের একাত্তর হলের ভেতরে ঢোকার আহ্বান জানানো হয়। বলা হয়, সন্ত্রাসীদের ধরে নিয়ে আসুন। একপর্যায়ে আন্দোলনকারীরা হলের বাগানে ঢুকে পড়েন। তখন ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা ওপর থেকে প্লাস্টিকের বোতল ও ঢিল ছুড়ছিলো। আন্দোলনকারীরাও নিচ থেকে ইট ও পাথরের টুকরা, ছেঁড়া জুতা হলের বিভিন্ন তলায় থাকা ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের প্রতিহত করতে থাকেন।
এর মধ্যে বিজয় একাত্তর হলের বাগানে ছাত্রলীগের কয়েকজন নেতা-কর্মীর সঙ্গে আন্দোলনকারীদের মারামারি বেঁধে যায়। এ সময় ছাত্রলীগের কিছু নেতা আন্দোলনকারীদের দিকে এগিয়ে এলে পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে পড়ে। পরে ছাত্রলীগের আরও কিছু নেতা-কর্মী হলের বিভিন্ন তলা থেকে লাঠিসোঁটা, কাঠ, লোহার পাইপ ও বাঁশ নিয়ে দল বেঁধে নিচে নেমে আন্দোলনকারীদের ধাওয়া দেন। আন্দোলনকারীরা তখন ছত্রভঙ্গ হয়ে যান। অনেকে দৌড়ে জসীমউদ্দীন হলের ভেতরে প্রবেশ করেন, অনেকে মল চত্বরের দিকে দৌড় দেন। এরপর ছাত্রলীগের সঙ্গে আন্দোলনকারীদের দফায় দফায় সংঘর্ষ হয়। বিজয় একাত্তর হলে ঘটনার শুরু হলে ছাত্রলীগের আশপাশের হলগুলোর (বঙ্গবন্ধু হল ও জিয়াউর রহমান হল) নেতা-কর্মীরাও সংঘর্ষে যোগ দেয়। মল চত্বরে আন্দোলনকারীদের ধাওয়া দেয় মাস্টারদা সূর্য সেন হল শাখা ছাত্রলীগের নেতা–কর্মীরা। সংঘর্ষ চলাকালে দুই পক্ষ পরস্পরের দিকে ইট ও পাথরের টুকরা ছুড়তে থাকে।
বেলা সোয়া তিনটার দিকে টিএসসি থেকেও আন্দোলনকারীরা এসে সংঘর্ষে যোগ দেন। তাঁরা একজোট হয়ে ইট-পাথর নিক্ষেপসহ ধাওয়া দিলে ছাত্রলীগ হলের ভেতরে ঢুকে পড়ে। এ সময় উত্তেজিত আন্দোলনকারীরা বাঁশ ও কাঠ দিয়ে বিজয় একাত্তর হলের ফটকে নিরাপত্তা প্রহরীদের বসার কক্ষের জানালার কাচ ভাঙচুর করেন।
এরপর জসীমউদ্দীন হলের ছাদে থাকা ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীদের সঙ্গেও আন্দোলনকারীদের পাল্টাপাল্টি ইট-পাথর নিক্ষেপের ঘটনা ঘটে। কিছুক্ষণের জন্য থেমে সাড়ে তিনটার দিকে আবার পাল্টাপাল্টি ধাওয়া শুরু হয়। এ সময় ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা আন্দোলনকারীদের বেশ কয়েকজনকে কাঠ ও বাঁশ দিয়ে বেদম পেটান। কিছুক্ষণ পর বঙ্গবন্ধু হলের কিছু ছাত্রলীগ নেতা-কর্মী হলের ফটকে লাঠিসোঁটাসহ অবস্থান নেন। তাঁদের লক্ষ্য করে আন্দোলনকারীরা ইট-পাথরের টুকরা নিক্ষেপ করেন, তাঁরাও দু–একবার ইট ছোড়েন আন্দোলনকারীদের দিকে। এরপর আরও দুবার দুই পক্ষের মধ্যে পাল্টাপাল্টি ধাওয়া হয়। পরে বিকেল পৌনে চারটার দিকে আন্দোলনকারীরা পিছু হটেন। এর মধ্যে বঙ্গবন্ধু হলের পেছনের পকেট গেট দিয়ে ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণের কিছু ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীকে আগ্নেয়াস্ত্রসহ প্রবেশ করতে দেখা যায়।
বিকেল চারটার দিকে সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়ে পুরো ক্যাম্পাসে। মোটরসাইকেলের বহর নিয়ে বিভিন্ন এলাকা থেকে আরও নেতা–কর্মীকে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে আনে ছাত্রলীগ। তাঁরা দেশি অস্ত্রসহ পুরো ক্যাম্পাসে মহড়া দিতে থাকে। উপাচার্যের বাসভবন এলাকা (ভিসি চত্বর), মল চত্বর, ফুলার রোড, নীলক্ষেত সড়ক, টিএসসি, কলাভবন এলাকাসহ বিভিন্ন স্থানে তাঁরা শিক্ষার্থীদের খুঁজে খুঁজে মারধর করতে থাকে।
ভিসি চত্বর এলাকায় শতাধিক শিক্ষার্থীকে পিটিয়ে আহত করেন ছাত্রলীগের নেতা–কর্মীরা। যাঁদের পিটিয়ে আহত করা হয়েছে, তাঁদের বড় অংশই ছিলেন নারী শিক্ষার্থী। হামলায় যাঁরা অংশ নেন, তাঁদের বড় অংশই ছিলেন বহিরাগত। এখানে ছবি তুলতে গেলে সাংবাদিকদের একাধিক ক্যামেরা ও মুঠোফোন ভাঙচুর করে ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা। মারধর করে বেশ কয়েকজন সাংবাদিককে।
বিকেল পাঁচটার কিছু আগে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালসংলগ্ন ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ হলে গিয়ে অবস্থান নেন। আর হলের বাইরে অবস্থান নেয় ছাত্রলীগের নেতা–কর্মীরা। দুই পক্ষ নিজেদের অবস্থান থেকে প্রতিপক্ষকে লক্ষ্য করে ইটপাটকেল নিক্ষেপ করতে থাকে। পাঁচটার দিকে ওই এলাকায় অন্তত পাঁচটি বিস্ফোরণের শব্দ শোনা যায়। সন্ধ্যা পৌনে সাতটার দিকে বিপুলসংখ্যক পুলিশ সদস্য দোয়েল চত্বর হয়ে শহীদুল্লাহ হলের সামনে আসেন। পুলিশের সামনেই ইটপাটকেল নিক্ষেপ চলতে থাকে। পৌনে নয়টার দিকে ছাত্রলীগ চলে যাওয়ার পর আন্দোলনকারীরা মিছিল নিয়ে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে যেতে চাইলে পুলিশ তাঁদের আটকে দেয়।
নাহিদ ইসলাম বলেন, প্রধানমন্ত্রীর ‘অপমানজনক’ বক্তব্য প্রত্যাহার ও কোটার যৌক্তিক সংস্কারের এক দফা দাবিতে আগামীকাল (আজ) বেলা তিনটায় সারা দেশের সব ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ হবে। তিনি বলেন, ‘আমাদের বৃহত্তর গণ–আন্দোলনে যেতে হবে। শিক্ষার্থীদের ওপর হামলাকারীরা যাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলে ঢুকতে না পারে, সে জন্য হলে হলে প্রতিরোধ গড়ে তুলুন।’
কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়া আরও অন্তত তিনটি বিশ্ববিদ্যালয়ে হামলা হয়েছে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে চালানো এসব হামলার জন্য ছাত্রলীগকে দায়ী করেছেন শিক্ষার্থীরা। এ ছাড়া যশোরে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা করেছেন হেলমেটধারীরা। আন্দোলনে অংশ নেওয়ায় কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে গতকাল রাতে এক ছাত্রকে মারধর করেছেন ছাত্রলীগের কয়েকজন নেতা–কর্মী।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে গতকাল দিবাগত রাত ১২টার পর দ্বিতীয় দফায় আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা হয়েছে। এ হামলায় বহিরাগতসহ ছাত্রলীগের দেড় শতাধিক নেতা–কর্মী অংশ নেন বলে শিক্ষার্থীরা অভিযোগ করেন। তাঁরা বলেন, হামলাকারী ব্যক্তিদের অধিকাংশের মাথায় হেলমেট ও হাতে ধারালো অস্ত্র ছিল। এ সময় দুটি পেট্রলবোমা ছুড়তে দেখা যায়। হামলা থেকে বাঁচতে শিক্ষার্থীরা ফটক খুলে উপাচার্যের বাসভবনে আশ্রয় নেন। রাত সোয়া ১২টার দিকে পুলিশ ঘটনাস্থলে আসে।
২০২৪ সালের এই দিন সন্ত্রাসী ছাত্রলীগ ও আপামর সাধারণ ছাত্র পরস্পরের মুখোমুখি হয়ে যায়।
#জুলাই_ডায়েরি
জুলাই ডায়েরি : ১৪ জুলাই
আজ ঐতিহাসিক ১৪ জুলাই।
২০২৪ সালের এই দিন আমার স্বাভাবিক ব্যস্ততার দিন। অফিসেই কাজ শেষে সারাদিনের আলোচিত ঘটনা নিয়ে ডিটেইল পড়ছিলাম, ভিডিও দেখছিলাম। সেদিন ট্রাম্প গুলিবিদ্ধ হয়েছিলেন। এটাই ছিল ঐদিনের বড় সংবাদ।
কয়েকটা আন্তর্জাতিক মিডিয়া থেকে বুঝার চেষ্টা করলাম, আমেরিকায় কী হতে যাচ্ছে। কয়েকজন সহকর্মী সাথে ছিল। সন্ধ্যার পর তাদের সাথে এই নিয়ে জ্ঞানগর্ভ :) আলোচনা করছি।
দেশের বিষয়ও আমাদের আলোচনার বিষয়বস্তুতে ছিল। হাসিনা দেশে ফিরে সংবাদ সম্মেলন করলো বিকেলে। কিন্তু বরাবরের মতোই হাসিনার সংবাদ সম্মেলন নিয়ে তেমন কোনো আগ্রহ ছিল না। তবে হাসিনার চীন সফর নিয়ে আমরা কৌতুহলী ছিলাম।
চীন বিষয়ে হাসিনা থেকে কোনো ঘোষণা আসে নাই বিধায় এই সফরে হাসিনার কোনো প্রাপ্তি নেই এটাই ধরে রেখেছিলাম। তাছাড়া ভারতের বাম হাতের জন্য চীন তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন থেকে সরে গিয়েছে এমন খবরও আমরা আলোচনা করছিলাম।
কোটা আন্দোলন নিয়ে হাসিনার করা মন্তব্যে আমরা নতুনত্ব পাই নি বিধায় এটা আমাদের আলোচনার বিষয়বস্তু হয়ে ওঠে নি। আমাদের আলোচনার বিষয় ছিল আরেকটি ঘটনা। হাসিনা প্রথম আলোর রোজিনাকে উদ্দেশ্য করে বলেছে,
‘সাংবাদিকদের তথ্য জোগাড় করা এক জিনিস আর ফাইল চুরি আরেক জিনিস। আমি ভ্যাকসিন কিনব, আমার সেখানে নেগোসিয়েশন হচ্ছে। জরুরি পেপার। আপনাদের স্বনামধন্য পত্রিকার এক সাংবাদিক ঢুকে সেই কাগজ চুরি করতে গেল। অফিসার এসে ধরল। ফাইল চুরি করতে গেলে এটা কোনো অপরাধ নয়?’ সেদিন হাসিনা আরো জানিয়েছে তার পিয়ন ৪০০ কোটি টাকার মালিক। এটা আলোচনায় এসেছে।
চা-চু খেতে খেতে রাত ১০ টা বেজে গেছে। অফিস ক্লোজ করতে যাবো এমন সময় কল করেছে শিবিরের তৎকালীন সোশ্যাল মিডিয়া দায়িত্বশীল। তিনি একটি ভিডিও পাঠিয়ে বললেন, ভাই ঢাবির ছেলেরা শ্লোগান দিচ্ছে, তুমি কে? আমি কে? রাজাকার! রাজাকার!!
ব্যস! অফিস কীভাবে আর ক্লোজ করি? ল্যাপটপ আবার ওপেন করলাম। যুক্ত হয়ে গেলাম ঐতিহাসিক জুলাই আন্দোলনে। রাতেই বিশ্ববিদ্যালয় গুলোতে ছড়িয়ে গেলো এই শ্লোগান। বারুদের মতো কাজ করলো তা। সারা রাত সেই বারুদে স্পার্ক চালিয়ে গেলাম।
আমরা জামায়াত শিবির করার কারণে 'রাজাকার' শুনে অভ্যস্ত। এটা আমার মধ্যে প্রতিক্রিয়া তৈরি করে না। কিন্তু জেনজি এটা মেনে নিতে পারে নাই। তাই তারা ক্ষেপে গিয়েছে। বিদ্রোহাত্মক মনোভাব নিয়ে বলেছে আমরাই রাজাকার, যা ইচ্ছা করো!!
বন্ধুবর কবি আতিফ আবু বকর পার্ফেক্টলি বলেছেন,
তোমরা কজন 'সাহস' হলে, আমরা হলাম অংশ তার
ফ্যাসিবাদের ধ্বংস লেখার শ্লোগান হলো- রাজাকার।
#জুলাই_ডায়েরি
১০ জুল, ২০২৫
পিআর (PR) সিস্টেম কীভাবে বাংলাদেশে এপ্লাই হতে পারে?
বাংলাদেশের রাজনৈতিক মাঠে এখন একটু গুরুত্বপূর্ণ শব্দ 'পিআর'। এটি একটি নির্বাচন পদ্ধতি। এই ধরনের ব্যবস্থার মূল লক্ষ্য হলো সকল ভোটারের ভোট যাতে কাজে লাগে সেই ব্যবস্থা করা। পিআর পদ্ধতি একটি ইনসাফপূর্ণ পদ্ধতি, এখানে সকলের ভোটকে মর্যাদা দেওয়া হয়। আমি আজকের আলোচনায় পিআর (Proportional representation) বা আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব কী? এবং এটা কীভাবে বাংলাদেশে কার্যকর হতে পারে এই বিষয় নিয়ে আলোচনা করবো।
প্রথমত এটা কেন দরকার?
নির্বাচনের অর্থ যদি হয় দেশ শাসনের জন্য জনগণের প্রকৃত প্রতিনিধি বেছে নেয়া, তাহলে নির্বাচন যাতে ত্রুটিমুক্ত এবং যথার্থ হয় তার নিশ্চয়তা বিধান করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এ ক্ষেত্রে দু'টি বিষয়ের দিকে দৃষ্টি দিতে হয়।
এক. জনপ্রতিনিধিত্বের ধরণটা কেমন হবে, অর্থাৎ নির্বাচন পদ্ধতি কোন ধরণের হবে তা ঠিক করা দরকার।
দুই. নির্বাচন যাতে সুষ্ঠু, অবাধ এবং ত্রুটিমুক্ত হয় সে দিকে লক্ষ্য রেখে নির্বাচনের ব্যবস্থাপনার জন্য একটি নিশ্ছিদ্র প্রক্রিয়া উদ্ভাবন করতে হবে।
আমাদের দেশে এখন কোন পদ্ধতি চালু আছে?
বর্তমান বিশ্বে বিভিন্ন দেশে নির্বাচনের বিভিন্ন পদ্ধতি চালু রয়েছে। বাংলাদেশের তথা উপ-মহাদেশের মানুষ যে পদ্ধতির নির্বাচনের সাথে পরিচিত তা হচ্ছে বৃটেনে প্রচলিত 'গরিষ্ঠ ভোট পদ্ধতি'। ভারত, পাকিস্তান, অস্ট্রেলিয়া, শ্রীলংকা, নাইজেরিয়া, ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জ থেকে শুরু করে প্রাক্তন ব্রিটিশ উপনিবেশগুলোতেই কেবল এই পদ্ধতি এখনও বহাল দেখা যচ্ছে।
এই পদ্ধতিতে একাধিক প্রার্থীর মধ্যে যিনি সর্বাধিক ভোট পাবেন, তিনিই সকল ভোটদাতার প্রতিনিধিত্ব করবেন। এর ফলে ১০/১২ জন প্রার্থীর মধ্যে ভোট ভাগাভাগির দরুন শতকরা বিশভাগের কম ভোট পেয়েও একজন প্রার্থী 'নির্বাচিত' হয়ে যেতে পারেন। অর্থাৎ শতকরা ৮০ ভাগ ভোটার যাঁর বিরুদ্ধে রায় দিয়েছেন তিনিই হবেন সকলের প্রতিনিধি। এ জন্যে এই পদ্ধতিকে First past the post বা winner takes it all নামেও অভিহিত করা হয়ে থাকে।
FPTP বা প্রচলিত পদ্ধতির সমস্যা
যা একক সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোট পদ্ধতি নামেও পরিচিত, নির্বাচনে ব্যবহৃত একটি সাধারণ ও সবচেয়ে পুরাতন পদ্ধতি। এর কিছু উল্লেখযোগ্য সীমাবদ্ধতা রয়েছে, যা নিম্নরূপ:
১. ভোটের অপচয়: FPTP-তে শুধুমাত্র সর্বোচ্চ ভোটপ্রাপ্ত প্রার্থী জয়ী হন, ফলে অন্যান্য প্রার্থীদের জন্য দেওয়া ভোটগুলো কার্যত অপ্রয়োজনীয় হয়ে পড়ে। এটি ভোটারদের মধ্যে হতাশা সৃষ্টি করে।
২. অপ্রতিনিধিত্বমূলক ফলাফল: এই পদ্ধতিতে একটি দল সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন জিততে পারে, এমনকি যদি তাদের মোট ভোটের শতাংশ কম হয়। ফলে, জনগণের সামগ্রিক মতামত সঠিকভাবে প্রতিফলিত হয় না।
৩.ছোট দলের প্রতি অবিচার: ছোট দলগুলোর জয়ের সম্ভাবনা কম থাকে, কারণ তাদের ভোট বিভিন্ন কেন্দ্রে ছড়িয়ে থাকে। এটি বড় দলগুলোর প্রাধান্য বজায় রাখে।
৪.দ্বি-দলীয় ব্যবস্থার প্রবণতা: FPTP প্রায়শই দুটি প্রধান দলের মধ্যে প্রতিযোগিতাকে উৎসাহিত করে, যা অন্যান্য দলের জন্য সুযোগ সীমিত করে। এটি রাজনৈতিক বৈচিত্র্যকে হ্রাস করতে পারে। ৩য় বা ৪র্থ দলগুলো রাষ্ট্রে তাদের প্রয়োজনীয়তা হারায়।
৫. কৌশলগত ভোটদান: ভোটাররা প্রায়ই ভোট পঁচা থেকে বাঁচার জন্য তাদের পছন্দের প্রার্থীর পরিবর্তে এমন প্রার্থীকে ভোট দেন, যার জয়ের সম্ভাবনা বেশি। এটি ভোটারদের প্রকৃত পছন্দকে বিকৃত করে।
৬. আঞ্চলিক বিভক্তি: FPTP আঞ্চলিকভাবে শক্তিশালী দলগুলোকে অতিরিক্ত সুবিধা দেয়, যা জাতীয় ঐক্যের পরিবর্তে আঞ্চলিক বিভক্তিকে উৎসাহিত করতে পারে।
৭. নিম্ন ভোটার উপস্থিতি: ভোটের অপচয় এবং অপ্রতিনিধিত্বের কারণে ভোটাররা নির্বাচনে অংশগ্রহণে নিরুৎসাহিত হয়, যা ভোটার উপস্থিতি হ্রাস করে।
৮. কালো টাকা ও পেশী শক্তির প্রভাব: এই পদ্ধতিতে একটি আসনে প্রার্থীকে নিজ যোগ্যতায় জিতে আসতে হয় বিধায় কালো টাকা ও পেশি শক্তির প্রভাব বেশি থাকে। সাধারণত যারা শক্তি দিয়ে ভোটারদের প্রভাবিত করে তারাই জিতে যায়।
৯. স্বৈরাচারের উত্থান: FPTP পদ্ধতিতে ৩০% থেকে ৩৫% জনসমর্থন নিয়ে দুই তৃতীয়াংশ আসন পাওয়া সম্ভব। ফলশ্রুতিতে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় স্বৈরাচারের উত্থান হয়। এটাই বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে বড় সমস্যা। বাংলাদেশের অগ্রগতির পথে বড় অন্তরায় FPTP পদ্ধতি।
এই সীমাবদ্ধতাগুলোর কারণে অনেক দেশ বিকল্প নির্বাচন পদ্ধতি, যেমন আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বকে (PR)কে বেছে নিয়েছে।
পিআর পদ্ধতির সুবিধা
১. ন্যায্য প্রতিনিধিত্ব: PR পদ্ধতিতে দলগুলো তাদের প্রাপ্ত ভোটের শতাংশের সমানুপাতে আসন পায়, ফলে জনগণের মতামত আরও সঠিকভাবে প্রতিফলিত হয়।
২. ছোট দলের জন্য সুযোগ: ছোট বা আঞ্চলিক দলগুলো তাদের ভোটের অনুপাতে আসন পাওয়ার সুযোগ পায়, যা তাদের রাজনৈতিক প্রভাব বাড়ায়।
৩. ভোটের অপচয় হ্রাস: FPTP-র তুলনায় এই পদ্ধতিতে ভোটের অপচয় কম হয়, কারণ প্রায় সব ভোটই ফলাফলে প্রভাব ফেলে।
৪. রাজনৈতিক বৈচিত্র্য: PR বিভিন্ন রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি ও দলের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করে, যা রাজনৈতিক বৈচিত্র্য বাড়ায়।
৫. জাতীয় ঐক্য: এই পদ্ধতি আঞ্চলিক বিভক্তির পরিবর্তে জাতীয় স্তরে ভোটের প্রতিনিধিত্ব করে, যা ঐক্যকে উৎসাহিত করে।
৬. বেশি ভোটার উপস্থিতি: ভোটাররা অনুভব করেন যে তাদের ভোটের মূল্য আছে, ফলে ভোটদানে উৎসাহ বাড়ে এবং ভোটার উপস্থিতি বৃদ্ধি পায়।
৭. স্থিতিশীল সরকার গঠন: যদিও PR প্রায়শই জোট সরকারের দিকে নিয়ে যায়, তবে এটি বিভিন্ন দলের মধ্যে সহযোগিতা ও সমঝোতার মাধ্যমে স্থিতিশীলতা ও গণতান্ত্রিক সুস্থ পরিবেশ আনতে পারে।
৮. স্বৈরাচারের উত্থান রোধ: PR পদ্ধতিতে একটি দলের পক্ষে দুই-তৃতীয়াংশ আসন পাওয়া কষ্টসাধ্য বিধায় কোনো দলের পক্ষে স্বৈরাচার হয়ে ওঠা পসিবল হয় না। বাংলাদেশ স্বৈরাচার হতে মুক্তি চায়।
পৃথিবীর কোনো ব্যবস্থাই শতভাগ নির্ভুল বা সীমাবদ্ধতা মুক্ত নয়। পিআর পদ্ধতিরও কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে। তবে FPTP থেকে PR উত্তম বিধায় পৃথিবীর অনেক উন্নত ও সভ্য রাষ্ট্র নিজেদের নির্বাচনী ব্যবস্থায় পিআরকে আংশিক অথবা সম্পূর্ণভাবে আত্তীকরণ করেছে। এর মধ্যে নিউজিল্যান্ড অন্যতম। বিশ্বের বেশিরভাগ দেশে (প্রায় শতাধিক) বিভিন্নভাবে PR পদ্ধতি কার্যকর আছে।
বাংলাদেশে কীভাবে এপ্লাই হতে পারে?
পিআর বাংলাদেশে কীভাবে এপ্লাই হতে পারে এই নিয়ে বিস্তর আলোচনা দরকার। তবে আমি একটি মডেল উপস্থাপন করতে পারি। এটি একইসাথে পিআর বুঝার ক্ষেত্রেও সহায়ক হবে আশা করি।
১. নির্বাচনী এলাকা ও আসন সংখ্যা নির্ধারণ
বাংলাদেশে ৬৪ টি জেলা রয়েছে। প্রতিটি জেলা একটি সমন্বিত নির্বাচনী এলাকা হিসেবে নির্ধারণ হবে। একেকটি নির্বাচনী এলাকার জন্য কতটি আসন নির্ধারিত হবে তা বিবেচিত হবে ঐ জেলায় ভোটার সংখ্যা কত? উদাহরণস্বরূপ বাংলাদেশে মোট ভোটার সংখ্যা ১২ কোটি। ৩০০ আসন বিবেচনা করলে প্রতিটি আসনের জন্য ভোটার প্রয়োজন হয় ৪ লক্ষ।
এবার আসুন জেলাভিত্তিক ভোটার তালিকা দেখি, নোয়াখালী জেলায় ভোটার সংখ্যা ২৮ লক্ষ ৮০ হাজার। ফেনীতে ভোটার সংখ্যা ১১ লক্ষ ১০ হাজার। গাজীপুরে ভোটার সংখ্যা ৩৭ লক্ষ ৩০ হাজার। প্রতি আসনের জন্য ৪ লক্ষ ভোটার হিসেবে নোয়াখালী পাবে ৭ টি আসন। ফেনী পাবে ৩ টি আসন। গাজীপুর পাবে ৯ টি আসন। এভাবে প্রতিটি জেলার জন্য আমরা আসন সংখ্যা নির্ধারণ করবো।
২. প্রার্থী মনোনয়ন
নির্বাচনী এলাকা নির্ধারণের পর পরবর্তী ধাপ হলো প্রার্থী মনোনয়ন। এক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলগুলো একটি জেলায় যতগুলো আসন ঐ জেলার জন্য ততজন প্রার্থীকে মনোনয়ন দেবে। যেমন বিএনপি ফেনীর জন্য ৩ জনকে মনোনয়ন দেবে, জামায়াতও ৩ জনকে মনোনয়ন দেবে। এভাবে প্রতি জেলার জনগণ জানবে তাদের জেলার জন্য কারা সংসদে যাবে। এই প্রার্থীরা অবশ্যই নির্বাচন কমিশন থেকে বৈধতা নিবে। নির্বাচন কমিশন নিয়মানুসারে কোনো দলের কোনো প্রার্থীকে অযোগ্য বিবেচিত করলে ঐ দল আরেকজন প্রার্থী মনোনয়ন দেবে।
৩.সর্বনিন্ম ভোট সীমা
পিআর সিস্টেমে অনেকগুলো ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজনৈতিক দল এই ব্যবস্থাকে অস্থিতিশীল করে তুলতে পারে। সেক্ষেত্রে সর্বনিন্ম ভোট সীমা নির্ধারণ করা দরকার। তুরস্কে এটা ১০% ছিল, বর্তমানে ৭%। জার্মানীতে ৫%। বেশিরভাগ দেশেই ৪-৫%। বাংলাদেশেও আমরা ৫% সর্বনিন্ম ভোট সীমা নির্ধারণ করতে পারি।
৪. ভোট প্রদান ও ফলাফল নির্ধারণ
জনগণ ভোটকেন্দ্রে গিয়ে তাদের পছন্দের দলের মার্কায় ভোট দেবে। এখানে স্বতন্ত্র প্রার্থী বলে কিছু থাকবে না। আমরা উদাহরণস্বরূপ গাজীপুর নিয়ে আলোচনা করি। গাজীপূরে মোট ভোটার ৩৭ লক্ষ ৩০ হাজার। ভোট দিয়েছেন মোট ২৬ লক্ষ ২১ হাজার। এর মধ্যে ১০ লক্ষ ১০ হাজার ভোট পেয়েছে ধানের শীষ। ৮ লক্ষ ১০ হাজার পেয়েছে দাঁড়িপাল্লা, ৬ লক্ষ ১০ হাজার পেয়েছে শাপলা। আর বাকীরা ৫ টা দল মিলে ১ লক্ষ ৯১ হাজার ভোট পেয়েছে।
এখানে ৩ টি দল মূলত আসন পাবে। বাকীরা পাবে না। ৩ টি দলের মোট ভোট ২৪ লক্ষ ৩০ হাজার। এর মধ্যে বিএনপি পেয়েছে ৪১.৫৬% ভোট, জামায়াত পেয়েছে ৩৩.৩৩% এবং এনসিপি পেয়েছে ২৫.১০% ভোট। গাজীপুরে মোট আসন ৯। সেক্ষেত্রে প্রতিটি আসনের জন্য ১১.১১% ভোট লাগে। গাজীপুরের এই পরিস্থিতিতে বিএনপি পাবে ৪ টি আসন, জামায়াত পাবে ৩ টি আসন ও এনসিপি পাবে ২ টি আসন।
৫. এখানে স্বতন্ত্রপ্রার্থী না থাকাকে অনেকে অসুবিধা হিসেবে বিবেচনা করতে পারেন। তবে এটা অসুবিধা নয় বরং সুবিধা। যারা স্বতন্ত্র প্রার্থী হন তারা সাধারণত নিজ এলাকাকে প্রাধান্য দিয়ে সংসদে কথা বলেন। এটা বিভক্তি তৈরি করে। একটি রাজনৈতিক দলে সব এলাকার মানুষ থাকে বিধায় তারা কোনো একটি অঞ্চলের প্রতি দুর্বল হয়ে পড়েন না। যারা নিজ এলাকার উন্নয়নে ভূমিকা রাখতে চান তারা জাতীয় নয়, স্থানীয় নির্বাচনে অংশ নেবেন।
৬. জাতীয় নির্বাচনে নির্বাচিত প্রতিনিধিরা মূলত সরকার গঠন ও আইন প্রণয়নে ভূমিকা রাখবেন। উন্নয়ন কার্যক্রম পরিচালনা স্থানীয় সরকার নির্বাচনের মাধ্যমে বাস্তবায়িত হবে। পিআর পদ্ধতিতে একেবারে ক্ষুদ্র এলাকাভিত্তিক প্রতিনিধি নির্বাচিত হয় না বিধায় স্থানীয় সরকার শক্তিশালীভাবে পারফর্ম করতে পারে। স্থানীয় সরকারের প্রতিনিধি ও জাতীয় সরকারের প্রতিনিধির সাথে কমফ্লিক্ট করে না।
৬ জুল, ২০২৫
নির্বাচন, পিআর, খালেদা জিয়া ইত্যাদি (পর্ব ৬)
২০০৩ সালে জামায়াত যখন ক্ষমতার একটি অংশ তখন জামায়াত পিআর পদ্ধতির বিষয়টি আবারো রাজনীতিতে নিয়ে আসার চেষ্টা করে। জামায়াত মনে করেছে কেয়ারটেকার সরকার পদ্ধতি যেহেতু বাংলাদেশে কায়েম হয়েছে, এবার পিআর পদ্ধতি যদি প্রতিষ্ঠিত করা যায়, তবে একটি সুস্থ গণতান্ত্রিক পরিবেশ তৈরি হবে। আলোচনা তৈরি করার নিমিত্তে জামায়াতের তৎকালীন সহকারী সেক্রেটারি শহীদ কামারুজ্জামান বিভিন্ন পত্রিকায় পিআর নিয়ে ধারাবাহিক লেখা লিখতে থাকেন।
তবে খালেদা জিয়ার প্রবল বাধায় এটি টেবিল ওয়ার্কেই সীমাবদ্ধ ছিল। রাজনীতির মাঠে নামতে পারে নি। এরই ধারাবাহিকতায় জামায়াতের সাবেক আমীর অধ্যাপক গোলাম আযম ২০০৫ সালে ছোট একটি বই লিখে পিআর সিস্টেমের যৌক্তিকতা তুলে ধরেন। জোটবদ্ধ রাজনীতিতে লয়াল থাকতে গিয়ে জামায়াত পিআর নিয়ে আলোচনা করতেই সক্ষম হয়নি। খালেদা জিয়াকে রাজি করানো তো বহুদূর।
আমি এই সিরিজ লেখাটা লিখার একটি কারণ আছে, আর তা হলো খালেদা জিয়ার অসত্য বচন। ২০০৮ সালে ইলেকশনে নাকি জামায়াত বিএনপিকে টেনে নিয়ে গেছে। অথচ ইতিহাস সাক্ষী বিএনপি ও খালেদা জিয়া কখনোই জামায়াতের মতামতকে গুরুত্ব দেয় নাই। আওয়ামী লীগ থেকে বাঁচতে বিএনপি অনুসরণ করে যাওয়াই ছিল জামায়াতের নিয়তি।
২০০৮ সালের ইলেকশন প্রসঙ্গে আসি..
২০০৭ সালের ১১ই জানুয়ারি রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করে সেনাবাহিনী। জারী করা হয় জরুরী অবস্থা। ২২ জানুয়ারিতে অনুষ্ঠিতব্য নির্বাচন বন্ধ করে দিলো তারা। ফখরুদ্দিন আহমদের নেতৃত্বে একটি নতুন তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠিত হলেও কার্যত সেটি পরিচালনা করেছে সেনাবাহিনী। ক্ষমতা গ্রহণের কিছুদিনের মধ্যেই সরকার আভাস দিয়েছিল যে সাধারন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে দুই বছর পর্যন্ত সময় লাগতে পারে।
কারণ হিসেবে বলা হয়েছিল, নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন এবং ছবি সহ ভোটার তালিকা তৈরি। একই সাথে সেনাবাহিনীর প্রত্যক্ষ সহায়তায় তথাকথিত দুর্নীতি-বিরোধী অভিযান শুরু করেছিল দুর্নীতি দমন কমিশন। এর মূল লক্ষ্য ছিল রাজনীতিবিদ এবং ব্যবসায়ীরা। এ সময় দ্রব্যমূল্যের চরম উর্ধ্বগতি এবং রাজনৈতিক কর্মকান্ড বন্ধ থাকায় দেশের মানুষের বড় একটি অংশ চরম হতাশায় নিমজ্জিত হয়। এমন প্রেক্ষোপটে ২০০৭ সালের জুন মাসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে কয়েকজন শিক্ষার্থীকে সেনাসদস্যদের প্রহার করার ঘটনায় দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে তীব্র আন্দোলন গড়ে ওঠে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের গন্ডি পেরিয়ে সহিংস এই আন্দোলন ছড়িয়ে যায় দেশের বিভিন্ন প্রান্তে।
সেই আন্দোলনের পর সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার অনুধাবন করে যে অনির্দিষ্টকালের জন্য নির্বাচন আটকে রাখা যাবে না। ছাত্র বিক্ষোভের প্রেক্ষাপটে ২০০৭ সালের আগস্ট মাসের শেষের দিকে প্রধান নির্বাচন কমিশনার এটিএম শামসুল হুদা ঘোষণা করেন, সেপ্টেম্বর মাস থেকে রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে সংলাপ শুরু হবে। সেপ্টেম্বর মাস থেকে শুরু করে দফায়-দফায় এই সংলাপ চলেছে ২০০৮ সালেও। নির্বাচনী আইন সংস্কার নিয়ে আলাপ-আলোচনার জন্য এই সংলাপ আহবান করেছিল নির্বাচন কমিশন।
ছাত্র বিক্ষোভের প্রেক্ষাপটে তখনকার তত্ত্বাবধায়ক সরকার দেখাতে চেয়েছিল যে নির্বাচন আয়োজনের দিকে তারা এগিয়ে যাচ্ছে। সেজন্য রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে নির্বাচন কমিশন সংলাপ শুরু করেছে। রাজনৈতিক দলের সাথে যখন সংলাপ শুরু হয়, তখন বিএনপিকে সংলাপে আমন্ত্রণ জানানো নিয়ে তীব্র বিতর্কের মুখে পড়ে নির্বাচন কমিশন। এখানে বিএনপি'র আভ্যন্তরীণ কোন্দল স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
দুর্নীতির অভিযোগে খালেদা জিয়া গ্রেফতার হবার আগে বিএনপির মহাসচিব আব্দুল মান্নান ভুঁইয়া এবং যুগ্ম মহাসচিব আশরাফ হোসেনকে দল থেকে বহিষ্কার করেন। মান্নান ভুঁইয়ার বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল তিনি দল ভাঙার চেষ্টা করছেন এবং সেনা-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাথে হাত মিলিয়েছেন।
মান্নান ভুঁইয়াকে বহিষ্কার করে খন্দকার দেলোয়ার হোসেনকে মহাসচিব নিয়োগ করেন খালেদা জিয়া। কিন্তু নির্বাচন কমিশন সবাইকে অবাক করে দিয়ে সংলাপের জন্য আমন্ত্রণ জানায় সংস্কারপন্থী হিসেবে পরিচিত মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমেদকে। মান্নান ভুঁইয়ার বহিষ্কারাদেশ গঠনতন্ত্র অনুযায়ী হয়নি বলে অভিযোগ তোলেন মেজর হাফিজসহ বিএনপির আরো কিছু নেতা, যারা সংস্কারপন্থী হিসেবে পরিচিত ছিলেন।
দলের স্থায়ী কমিটির একটি অংশ খালেদা জিয়ার সিদ্ধান্ত অমান্য করে মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমেদকে মহাসচিব নিযুক্ত করে। এমন অবস্থায় বিএনপির মূলধারা হিসেবে পরিচিত মহাসচিব খন্দকার দেলোয়ার হোসেনকে সংলাপের জন্য আমন্ত্রন না জানিয়ে সংস্কারপন্থী হিসেবে মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমেদকে আমন্ত্রন জানানোর বিষয়টি বিএনপির ভেতরে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া তৈরি করে। অবশ্য পরবর্তীতে খন্দকার দোলোয়ার হোসেনের নেতৃত্বে বিএনপির মূলধারার সাথেই চূড়ান্ত সংলাপ করেছিল নির্বাচন কমিশন।
বিএনপি নির্বাচনে অংশ নেবে কিনা সেটি নিয়ে ২০০৮ সালের গোড়া থেকেই সন্দেহ শুরু হয়। নির্বাচনে অংশ নেবার বিষয়ে খালেদা জিয়ার কিছু আপত্তি ছিল। তিনি চেয়েছিলেন তার দুই ছেলে তারেক রহমান এবং আরাফাত রহমানের মুক্তি ও বিদেশে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা। কিন্তু সেনা গোয়েন্দারা শর্ত দেন যে বিএনপি নির্বাচনে অংশ নিলে খালেদা জিয়ার শর্ত মেনে নেয়া হবে। এই নিয়ে খালেদা জিয়ার সাথে সেনা কর্মকর্তাদের তীব্র দরকষাকষি চলে দীর্ঘ সময়। এক পর্যায়ে উভয় পক্ষের মধ্যে সমঝোতা হয়।
তবে খালেদা জিয়ার সাথে সরকারের কী ধরণের সমঝোতা হয়েছিল, সে সম্পর্কে বিস্তারিত বিএনপির নেতারাও জানেন না। 'বাংলাদেশ: ইমার্জেন্সি অ্যান্ড দ্যা আফটারম্যাথ (২০০৭-২০০৮)' শিরোনামের বইতে মওদুদ আহমদ বলেছেন, ছেলেদের মুক্তি এবং বিদেশ পাঠানোর বিনিময়ে খালেদা জিয়া হয়তো নির্বাচনে অংশগ্রহণের শর্ত মেনে নিয়েছিলেন।
২০০৮ সালের নভেম্বর মাসের শেষের দিকে বিএনপি নিশ্চিত করে যে তারা নির্বাচনে অংশ নেবে। নির্বাচনে অংশ নেবার বিষয়টি নিশ্চিত করেন বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়া। এর আগে নির্বাচনের তারিখ নিয়ে বিএনপির সাথে নির্বাচন কমিশনের মতপার্থক্য তৈরি হয়েছিল। খালেদা জিয়ার দাবির প্রেক্ষিতে নির্বাচন ১১ দিন পিছিয়ে ২৯শে ডিসেম্বর নির্ধারণ করা হয়।
বিএনপির তরফ থেকে একটি যুক্তি তুলে ধরা হয়েছিল যে খালেদা জিয়া কারগার থেকে ছাড়া পেয়েছেন সেপ্টেম্বর মাসে। অন্যদিকে শেখ হাসিনা প্যারোলে কারাগার থেকে বের হয়েছিলেন জুন মাসে। সেজন্য নির্বাচনের প্রস্তুতি নিতে খালেদা জিয়ার সময় প্রয়োজন বলে বিএনপির তরফ থেকে বলা হয়েছিল। নির্বাচন পিছিয়ে ২৯শে ডিসেম্বর নির্ধারন করার বিষয়টি নিয়ে আওয়ামী লীগের তরফ থেকে তীব্র আপত্তি তোলা হলেও শেষ পর্যন্ত তারা সেটি মেনে নিয়েছিল।
এখানে আমরা আরেকটি তথ্য পরে জানতে পারি তা হলো ফখরুদ্দিন-মইনুদ্দিনের দায়মুক্তি। এই বিষয়ে খালেদা ও হাসিনা উভয়েই নীরব ছিল। যদিও সেনাশাসনের সময় উপজেলা পর্যায় পর্যন্ত প্রায় সকল বিএনপি নেতার দুর্নীতি প্রকাশিত হয়েছে। এই নিয়ে বিএনপি জোট বিব্রতকর অবস্থায় ছিল। খালেদার আরো বিব্রতকর বিষয় হলো খালেদার দলের মহাসচিব থেকে শুরু করে অনেক বড় নেতা গাদ্দারি করেছে তার সাথে। সেসময় মধ্য সারির এক নেতা হান্নান শাহ মুখপাত্র হয়ে উঠেছে। বড় নেতারা প্রায় সব বিট্রে করেছে অথবা দুর্নীতির অভিযোগে গ্রেপ্তার হয়েছে।
ফখরুদ্দিন-মঈনরা দায়মুক্তি নিতে খালেদা ও হাসিনার কাছে যায়। খালেদা ডিজিএফআই কর্তৃক প্রাপ্ত দায়মুক্তির বিনিময়ে ক্ষমতায় যাওয়ার অফার প্রত্যাখ্যান করেছে। এই বিষয়ে তিনি পরে বলেছেন। অন্যদিকে ডিজিএফআই-এর এই প্রস্তাব হাসিনাকে দিলে হাসিনা সানন্দে তা গ্রহণ করে। এই তথ্যটা যদি খালেদা নির্বাচনের আগে জাতিকে জানান দিতো তবে জাতি বুঝতে পারতো একটা পাতানো নির্বাচন হবে। কিন্তু খালেদা তা না জানিয়ে নিজেদের ছেলেদের জীবন বাঁচানোর বিনিময়ে নির্বাচনে গিয়েছে। খালেদা নির্বাচনে যেতে গড়িমসি যা করেছে তা অবৈধ নির্বাচন থেকে জাতিকে বাঁচাতে নয় বরং তার ছেলেদের জীবন রক্ষা করতে। তারেক আর রাজনীতি করবে না, এই মুছলেকা নিয়ে ডিজিএফআই ও খালেদার মধ্যে সমঝোতা হয়। তারেককে বিদেশে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।
এরপর যখন পাতানো নির্বাচনে হেরে গেলো চার দলীয় জোট, তখন খালেদা জামায়াতের বিরুদ্ধে অভিযোগ করে, জামায়াত নাকি বিএনপিকে নির্বাচনে যেতে বাধ্য করেছে। অথচ জামায়াত ঐ সময় নির্বাচন চেয়েছে সেনাসরকারের হাত থেকে বাঁচার জন্য। এটা বিএনপিও চেয়েছে। নির্বাচনের জন্যই তো খন্দকার দেলাওয়ার নিয়মিত সংলাপে বসেছে। দরকষাকষি করেছে। সংস্কার আলোচনায় অংশ নিয়েছে।
২০০৮ সালে পাতানো নির্বাচনে (খালেদা-হাসিনা জানতো এটা পাতানো, বাকীরা জানতো না) খালেদা যেতে বাধ্য হয়েছে মূলত দুইটি কারণে।
১। খালেদা দুই ছেলেকে জুলুমের হাত থেকে রক্ষা করতে চেয়েছে।
২। খালেদা ইলেকশনে না গেলে বিএনপি ভেঙে যেত। বিএনপি সিনিয়র নেতারা ইলেকশনে চলে যেত।
খালেদা জামায়াতের মতামত জানতে চাইলে জামায়াত ইলেকশনে যাওয়ার পক্ষে মতামত দেয়। এর মানে এই ছিল না যে, খালেদা ইলেকশনে না গেলে জামায়াত ইলেকশনে চলে যাবে বলে হুমকি দিয়েছে।
-আর চলবে না ...



