৬ সেপ, ২০২৫

২৫ টি পয়েন্টে মুহাম্মদ সা.-এর জীবনী

 


১. রাসূল সা.-এর জন্ম ও শৈশব
তাঁর নাম মুহাম্মদ ইবনে আব্দুল্লাহ ইবনে আব্দুল মুত্তালিব ইবনে হাশেম। হাশেমের দিকে সম্পর্কযুক্ত করে নবীজীর বংশ হাশেমি বংশ হিসেবে পরিচিত। মুহাম্মদ সা. এর জন্ম ৫৭০ সালে, হস্তী বাহিনী ধ্বংসের বছর জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর জন্মের ৬ মাস পূর্বেই তার পিতা আব্দুল্লাহ ইবনে আব্দুল মুত্তালিব সফররত অবস্থায় মদিনায় ইন্তেকাল করেন । সে সময়ের ঐতিহ্য অনযায়ী সম্ভান্ত আরব পরিবারের সন্তানদেরকে অন্য গোত্রে লালন-পালন করতে দেওয়া হত। সে হিসেবে নবী করীম সা. বনী সা‘দ গোত্রে লালিত- পালিত হন এবং চার অথবা পাঁচ বছর বয়স পর্যন্ত সেখানেই বসবাস করেন।

২. জন্মের সময় কিছু অলৌকিক ঘটনা 
তাঁর জন্মের ৫০ দিন পূর্বে বায়তুল্লাহ আক্রমণকারী ইয়ামানের শক্তিশালী বাদশাহ আবরাহা তার সৈন্যসহ সমূলে ধ্বংস হয়েছিল। মক্কায় তখন মহা দুর্ভিক্ষ চলছিলো, তিনি তাঁর মায়ের গর্ভে আসার সাথেই দুর্ভিক্ষ অবসান হয়ে গিয়েছিল। হারিয়ে যাওয়া যমযম কূপের সন্ধান পাওয়া গিয়েছিল। তাঁর মা জননী আমেনা বর্ণনা করেন, মুহাম্মদ তার পেটে অবস্থান নেয়ার সাথেই সারা বিশ্বে আলোক রশ্মি ছড়িয়ে পড়েছিল, যার সাহায্যে তিনি সুদূর সিরিয়ার রাজ প্রাসাদসমূহ পরিস্কার দেখতে ছিলেন। এমনিভাবে আরো অসংখ্য ঘটনা পৃথিবীতে ঘটতেছিল। তিনি যখন জন্মগ্রহণ করলেন, মক্কায় তখন ভূ-কম্পনের দ্বারা মূর্তিগুলো ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গিয়েছিল। জ্বিনদের আসমান থেকে সংবাদ সংগ্রহ করা সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যায়। অপরদিকে পারস্য সম্রাটের রাজমহলে ভূ-কম্পনের আঘাতে রাজমহলের ১৪ টি স্তম্ভ ধ্বসে পড়েছিলো।

৩. বক্ষ বিদীর্ণ হওয়া 
রাসূল সা.-এর যখন চার কি পাঁচ বছর তখন তাঁর কাছে জিবরাঈল আ. এলেন, তখন তিনি শিশুদের সাথে খেলছিলেন। তিনি তাঁকে ধরে শোয়ালেন এবং বক্ষ বিদীর্ণ করে তাঁর হৎপিন্ডটি বের করে আনলেন। তারপর তিনি তাঁর বক্ষ থেকে একটি রক্তপিন্ড বের করলেন এবং বললেন এ অংশটি শয়তানের। এরপর হৎপিন্ডটিকে একটি স্বর্ণের পাত্রে রেখে যমযমের পানি দিয়ে ধৌত করলেন এবং তার অংশগুলো জড়ো করে আবার তা যথাস্হানে পূনঃস্থাপন করলেন। তখন তাঁর খেলার সাথী শিশুরা দৌড়ে তাঁর দুধমায়ের কাছে গেল এবং বলল, "মুহাম্মাদকে হত্যা করা হয়েছে"। কথাটি শুনে সবাই সেদিকে এগিয়ে গিয়ে দেখল তিনি ভয়ে বিবর্ণ হয়ে আছেন! আনাস রা. বলেন, আমি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম -এর বক্ষে সে সেলাই-এর চিহ্ন দেখেছি"। এটি ছিলো তাঁর প্রথম বক্ষ বিদীর্ণ হওয়ার ঘটনা।

গবেষকদের মতে, মোট চার বার রাসূল সা. এর বক্ষ বিদারণ হয়।
ক। হালিমার গৃহে অবস্থান কালে চার বছর বয়সে।
খ। ১০ বছর বয়সে।
গ। হেরা পর্বতের গুহায় ১ম ওহী নাজিলের সময়
ঘ। মিরাজের রাতে।

৪. মায়ের মৃত্যু ও দাদা-চাচার তত্ত্বাবধান 
নবী করীম সা.-এর মা আমেনা মদিনা মুনাওয়ারায় নিজ স্বামী আব্দুল্লাহ এর কবর যিয়ারতের পর ফেরার পথে মক্কা ও মদিনার মাঝে অবসি'ত আবহাওয়া নামক স্থানে ইন্তেকাল করেন। তখন নবী মুহাম্মদ সা. এর বয়স ছিল মাত্র ছয় বছর। মাতা-পিতার মৃত্যুর পর দাদা আব্দুল মুত্তালিব তাঁর লালন পালনের দায়িত্ব ভার গ্রহণ করেন। দাদার মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত তিনি তাঁর তত্ত্বাবধানেই ছিলেন। দাদা আব্দুল মুত্তালিবের মৃত্যুর পর চাচা আবু তালিব তাঁর দায়িত্ব নেন। তখন তার বয়স ছিল আট বছর। তিনি চাচাকে বকরি লালন-পালন ও শাম দেশের ব্যবসায়ে সহযোগিতা করতেন।

৫. বিয়ে এবং সন্তানাদি 
পঁচিশ বছর বয়সে খাদীজা রা.-কে বিবাহ করেন। একমাত্র ইবরাহীম ব্যতীত তাঁর সব কয়টি সন্তান খাদীজার রা. এর গর্ভ থেকেই হয়েছে। কাসেম তাঁর প্রথম সন্তান। এর নামেই তাঁর উপনাম আবুল কাসেম। অতঃপর যয়নব, রূকাইয়া, উম্মে কুলসুম, ফাতেমা ও আব্দুল্লাহর জন্ম হয়। তাঁর ছেলেরা সকলেই বাল্য বয়সে মারা যান। মেয়েদের সকলেই ইসলাম গ্রহণ করে হিযরত করার সুযোগ পান। ফাতেমা রা. ব্যতীত তাদের সকলেই নবীজীর জীবদ্দশায় মারা যান। তিনি নবীজীর ইন্তেকালের ছয় মাস পর মৃত্যুবরণ করেন। খাদিজা রা. কে ছাড়াও নবীজি আরো দশজনকে বিবাহ করেন। তাঁরা হলেন, সওদা বিনতে যাম‘আহ, আয়েশা বিনতে আবুবকর, হাফসাহ বিনতে উমার, জয়নব বিনতে খুযায়মা, উম্মে সালামাহ, জয়নব বিনতে জাহশ, জুওয়াইরিয়া বিনতুল হারেছ, উম্মে হাবীবাহ রামলাহ বিনতে আবু সুফিয়ান, সাফিয়া বিনতে হুয়াই বিন আখত্বাব, মায়মুনা বিনতুল হারেছ।

৬. ওহী নাযিলের সূচনা 
তিনি মক্কায় অবস্থিত হেরা গুহায় ইবাদত করতেন। চল্লিশ বছর বয়সে তিনি নবুয়ত প্রাপ্ত হন। জিবরাইল আ. আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে ওহী নিয়ে অবতরণ করেন। সর্ব প্রথম সূরা ‘আলাকের প্রথম পাঁচটি আয়াত নাযিল হয় : যার অর্থ- পাঠ করূন, আপনার পালন কর্তার নামে,যিনি সৃষ্টি করেছেন। সৃষ্টি করেছেন মানুষকে জমাট রক্ত থেকে। পাঠ করূন, আপনার পালনকৃত মহা দয়ালু।যিনি কলম দ্বারা শিক্ষা দিয়েছেন। শিক্ষা দিয়েছেন মানুষকে যা সে জানত না। (সূরা আলাক:১-৫) ওহী নাজিলের আগেও তিনি ছিলেন চিন্তায় সঠিক, সিদ্ধান্তে নির্ভুল, ব্যক্তিত্বে অনন্য, চরিত্রে শ্রেষ্ঠতর, প্রতিবেশী হিসেবে অতি মর্যাদাবান,সহনশীলতায় সুমহান, সত্যবাদিতায় মহত্ত্বর, সচ্চরিত্র, বদান্যতা, পুণ্যকর্মা, প্রতিশ্রুতি রক্ষা ও বিশ্বস্ততায় অনুপম আদর্শ। এসব গুণে মুগ্ধ হয়ে তার গোত্র তাঁকে আল-আমিন উপাধিতে ভূষিত করে।

৭. গোপন দাওয়াত 
আল্লাহ তাআলা রাসূল সা.-কে মানুষের মাঝে ইসলাম প্রচারের আদেশ করেন। এ মর্মে তিনি ইরশাদ করেন, হে চাদরাবৃত ব্যক্তি! ওঠ এবং সতর্ক কর। (সুরা-মুদ্দাসির:১-২)। নবী করীম (সাঃ) স্বীয় প্রতিপালকের আদেশ যথাযথ পালন করেন এবং গোপনে গোপনে মানুষের মাঝে ইসলাম প্রচার করতে শুরু করেন। যাতে করে কুরাইশদের বিরোধিতা প্রকট না হয়। তিনি সর্বপ্রথম আপন পরিবার- পরিজন ও বন্ধুদের ইসলামের দাওয়াত দেন। সর্বপ্রথম খাদীজা রা. তাঁর দাওয়াত গ্রহণ করেন। পুরুষদের মধ্যে সর্বপ্রথম আবু বকর সিদ্দীক রা., ছোটদের মধ্যে আলী ইবনে আবু তালিব রা. এবং ক্রীতদাসদের মধ্যে যায়েদ ইবনে হারেসা রা. ইসলাম গ্রহণ করেন। তিনি খাদিজা রা.-এর ক্রীতদাস ছিলেন। রাসূল সা. তিন বছর পর্যন্ত নিকটস্থ লোকদের মাঝে ইসলাম প্রচারে গোপনীয়তা অবলম্বন করেন। তিনি দারূল আরকাম তথা কুরাইশ নেতা আরকাম ইবনে আবু আরকামের বাড়িটি মুসলমানদের সম্মেলনস্থল হিসেবে নির্বাচিত করেন।

৮. প্রকাশ্যে দাওয়াত 
অতঃপর আল্লাহ তায়ালা প্রকাশ্যে দ্বীন প্রচারের আদেশ করলেন- ইরশাদ হচ্ছে, অতএব আপনি প্রকাশ্যে শুনিয়েদিন যা আপনাকে আদেশ করা হয় এবং মুশরিকদের পরোয়া করবেন না।” (সূরা হিজর : ৯৪), “আপনি নিকটাত্মীয়দেরকে সতর্ক করুন।” (সূরা শু‘আরা : ২১৪)। আল্লাহ তাআলার আদেশ পেয়ে নবী মুহাম্মদ সা. তাঁর নিকটতম আত্মীয়-স্বজনদেরকে সাফা পাহাড়ের পাদদেশে একত্রিত করেন। অতঃপর তাদেরকে মূর্তিপূজা পরিত্যাগ করে এক আল্লাহর ‘ইবাদত করতে আহ্বান করেন। সমবেত লোকদের মধ্য থেকে তাঁর চাচা আবু লাহাব বলে উঠলো, তোমার ধ্বংস হোক, এ জন্যেই কি আমাদেরকে একত্রিত করেছে? এরপর আবু লাহাব ও তার পরিবার রাসূল সা.-এর উপর নির্যাতনের পূর্ন মাত্রা প্রয়োগ করে। এর প্রেক্ষিতে আল্লাহ তা'আলা আবু লাহাব ও তার স্ত্রী উম্মে জামীল সম্পর্কে সূরা লাহাব অবতীর্ণ করেন, “আবু লাহাবের দু’হাত ধ্বংস হোক এবং ধ্বংস হোক সে নিজে। কোন কাজে আসেনি তার ধন-সম্পদ ও যা সে উপার্জন করেছে। সহসাই সে প্রবেশ করবে লেলিহান অগ্নিতে এবং তার স্ত্রীও, যে ইন্ধন বহন করে, তার গলদেশে খেজুরের পাকানো রশি নিয়ে।” (সূরা লাহাব : ১-৫)

৯. ঠাট্টা-বিদ্রূপ, অত্যাচার ও নির্যাতন 
মক্কার মুশরিকরা রাসূল সা.-কে বিভিন্ন উপায়ে উপহাস করত। কখনো কখনো তাকে পাগল ও যাদুকর বলত। আবার কখনো বলত কবি ও গণক। আগন্তুক লোকদেরকে তাঁর সাথে সাক্ষাৎ করতে অথবা কথা শুনতে বাধা দিত। তাঁর চলাচলের রাস্তায় কাঁটা বিছিয়ে রাখত এবং সালাতরত অবস্থায় তাঁর উপর ময়লা-আবর্জনা নিক্ষেপ করত। মুশরিকরা তাদের মুসলিম গোলামদের উপর কঠিন নির্যাতন চালাতো। তাদেরকে হাত-পা বেঁধে ভর দুপুরে উত্তপ্ত বালুতে শুইয়ে দিত এবং ভারী পাথর দ্বারা তাদের বুক চাপা দিত এবং ছড়ি দ্বারা প্রহার করত ও আগুনের সেঁকা দিত। নির্যাতনের এমন কোন পদ্ধতি নেই যা তারা মুসলমানদের উপর প্রয়োগ করেনি। মুসলমানগণ মুশরিকদের সকল নির্যাতন ও নিপীড়ন ধৈর্য ও দৃঢ়তার সাথে মোকাবিলা করতেন। কেননা নবী করীম সা. তাদেরকে সাওয়াব ও জান্নাত লাভের আশায় বিপদে ধৈর্য ধারণ ও অনড় থাকার পরামর্শ দেন। মুশরিকদের নির্যাতন ভোগ করেছেন এমন কয়েকজন উল্লেখযোগ্য সাহাবী হলেন, বিলাল ইবনে রাবাহ ও আম্মার ইবনে ইয়াসির রা. প্রমূখ । তাদের নির্যাতনের শিকার হয়ে শহীদ হয়েছেন ইয়াসির ও সুমাইয়া রা.। ইসলামের ইতিহাসে এরাই সর্বপ্রথম শহীদ। আবু জাহেল তাদের খুন করে।

১০. হাবশায় (আবিসিনিয়ায়) হিজরত 
রাসূল সা. কাফেরদের অনবরত নির্যাতনের কারণে সাহাবাগণের প্রতি দয়া পরবশ হয়ে হাবশাতে হিজরত করার নির্দেশ দেন। হাবশার বাদশা নাজ্জাশী ন্যায়পরায়ণ ও দয়ালু ছিলেন বলে হাবশাকেই হিজরতের জন্যে মনোনীত করা হল। নাজ্জাশী ঈসা আ.-এর অনুসারী ছিলেন। নবুয়্যাতের পঞ্চম বছর প্রথম মুহাজিরদের এ দলে ছিলেন দশ জন পুরূষ ও চার জন মহিলা। তারা কুরাইশদের অজান্তে চুপিসারে হাবশার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন। কিছুদিন পর আরো একটি মুহাজির দল তাদের সাথে মিলিত হলেন। পুরুষ, মহিলা, শিশু সহ তাদের মোট সংখ্যাছিল প্রায় একশোজন। বাদশা নাজ্জাশী তাদের সম্মান এবং সুন্দর ব্যবহার করেন পাশাপাশি সেখানে নিরাপদে বসবাস করার অনুমতি দেন।

১১. শিয়াবে আবু তালিবে আটক
মুশরিকরা ভাবলো, বনু হাশিমের সহযোগিতাই মুহাম্মাদ সা. এর শক্তির উৎস। তাই বনু হাশিমের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। সকলে মিলে বনু হাশিমকে বয়কট করার সিদ্ধান্ত নেয়। বয়কট চুক্তি অনুযায়ী সবাই বনু হাশিমের সাথে মেলামেশা বন্ধ করে দেয়। তাদের কিছু কেনা ও তাদের নিকট কিছু বেচা বন্ধ হয়ে যায়। খাদ্য ও পানীয় সরবরাহ পর্যন্ত বন্ধ করে দেয়া হয়। বলা হলো, হত্যার জন্য মুহাম্মাদকে তাদের হাতে তুলে না দেয়া পর্যন্ত এই বয়কট চলতে থাকবে।

আবু তালিব বানু হাশিমের লোকদেরকে নিয়ে শিয়াবে আবু তালিব নামক গিরি খাদে আশ্রয় নেন। আবু লাহাব ছাড়া বানু হাশিমের মুসলিম-অমুসলিম সকল সদস্যই মুহাম্মাদ সা. এর সঙ্গী হন। আটক অবস্থায় তাঁদেরকে থাকতে হয় তিন বছর। এই তিন বছরে তাঁদেরেক দুঃসহ যন্ত্রণা ভোগ করতে হয়েছে। খাদ্যাভাবে অনেক সময় গাছের পাতা ও ছাল খেতে হয়েছে। শুকনো চামড়া চিবিয়ে চিবিয়ে ক্ষুধার জ্বালা নিবারণের চেষ্টা করতে হয়েছে। পানির অভাবে অবর্ণনীয় কষ্ট পেতে হয়েছে।

তিন বছর পর আল্লাহ রাব্বুল আলামীন এই বন্দীদশা থেকে তাঁদের মুক্তির পথ করে দেন। বনু হাশিম খান্দানের এই নিদারুণ দুঃখ-কষ্ট দেখে একদল যুবকের মন বিগলিত হয়। তারা এই অমানুষিক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে উঠে। তাদের মধ্যে ছিলো মুতইম ইবনু আদি, আদি ইবনু কাইস, যামআহ ইবনুল আসওয়াদ, আবুল বুখতারী, জুহাইর এবং হিশাম ইবনু আমর। তারা অস্ত্রসজ্জিত হয়ে আবু জাহালের নিষেধ অমান্য করে বানু হাশিমকে মুক্ত করে আনে। এটা ছিলো নবুয়াতের নবম সনের ঘটনা।

১২. তায়েফ গমন
রাসূল সা.-এর আশ্রয়দাতা চাচা আবু তালিবের মৃত্যুকে কুরাইশরা সুযোগ হিসেবে গ্রহণ করল। তার উপর নির্যাতনের মাত্রা পূর্বের চেয়ে অনেক বাড়িয়ে দেয়। এ কঠিন পরিস্থিতিতে সহযোগিতা ও আশ্রয় পাওয়ার আশায় তিনি তায়েফ গমন করলেন। কিন্তু সেখানে উপহাস ও দুর্ব্যবহার ছাড়া আর কিছুই পেলেন না। তারা রাসূল সা.-কে পাথর নিক্ষেপ করে মারাত্মকভাবে আহত করে। বাধ্য হয়ে তিনি মক্কায় ফিরে আসেন।

১৩. বিভিন্ন গোত্রের নিকট রাসূল সা.-এর দাওয়াত
রাসূল সা. হজ্বের মৌসুমে মক্কায় আগত বিভিন্ন গোত্রের নিকট দাওয়াত নিয়ে উপস্থিত হন। তাদেরকে ইসলামের দাওয়াত দেন এবং শত্রুদের থেকে আত্মরক্ষা ও দাওয়াতের নিরাপত্তা বিধানে সহযোগিতা কামনা করেন। তবে কোন গোত্রই এতে সাড়া দিল না। কারণ, কুরাইশরা তাদেরকে ভয়ভীতি প্রদর্শন করে এবং তাদেরকে তার নিকট হতে দূরে রাখার কৌশল অবলম্বন করে। ইতিমধ্যে মদিনার নেতৃস্থানীয় ছয়জন লোক রাসূলের সাথে সাক্ষাৎ করেন এবং কুরাইশদের ভয়ে গোপনে তাঁর হাতে বাইয়াত গ্রহণ করেন। তারা নিজ দেশে প্রত্যাবর্তন করে মানুষের সাথে ইসলাম সম্পর্কে এবং রাসূল সা.-এর চরিত্র ও দাওয়াতের সত্যতা সম্পর্কে আলোচনা করেন এবং মদীনাবাসীদের মাঝে ইসলাম প্রচারের কাজ করেন। ফলে মদিনার অনেকেই ইসলাম গ্রহণ করেন।

১৪. মিরাজের ঘটনা
নবুয়্যাতের একাদশ বছরে মুহাম্মদ সা. প্রথমে কাবা শরিফ থেকে জেরুজালেমে অবস্থিত বায়তুল মুকাদ্দাস বা মসজিদুল আকসায় গমন করেন এবং সেখানে তিনি নবীদের জামায়াতে ইমামতি করেন। অতঃপর তিনি বোরাক নামক বিশেষ বাহনে আসীন হয়ে ঊর্ধ্বলোকে গমন করেন। ঊর্ধ্বাকাশে সিদরাতুল মুনতাহায় তিনি আল্লাহ'র সাক্ষাৎ লাভ করেন। এই সফরে ফেরেশতা জিবরাইল তার সফরসঙ্গী ছিলেন। কুরআনের সুরা বনি ইসরাঈল এর প্রথম আয়াতে এ প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, "পবিত্র মহান সে সত্তা, যিনি তাঁর বান্দাকে রাতে নিয়ে গিয়েছেন আল মাসজিদুল হারাম থেকে আল মাসজিদুল আকসা পর্যন্ত, যার আশপাশে আমি বরকত দিয়েছি, যেন আমি তাকে আমার কিছু নিদর্শন দেখাতে পারি। তিনিই সর্বশ্রোতা, সর্বদ্রষ্টা।

১৫. আকাবার শপথ
নবুয়্যাতের দ্বাদশ বছর হজ্জের মৌসুমে বারো জন লোক মদীনা হতে বের হয়ে মিনাতে আকাবার প্রথম বাইআতের সময় রাসূল সা. এর সাথে দেখা করে এবং বাইয়াতে অংশ গ্রহণ করেন। এ বাইয়াতকে ইসলামের ইতিহাসে ‘আল আকাবাতুল উলা’ প্রথম বাইয়াত বলা হয়। মদীনায় ফিরে যাবার সময় রাসূল সা. তাদের সাথে মুস‘আব ইবনে উমায়ের রা.-কে কুরআন তিলাওয়াত এবং দ্বীন শিখানোর জন্য পাঠান।

আকাবার প্রথম বাইয়াতের পরবর্তী বছর নবুয়্যাতের ত্রয়োদশ বছর হজের মৌসুমে সত্তর জন পুরুষ, দুই জন মহিলা মক্কার উদ্দেশ্যে হজ্জ পালনের লক্ষ্যে মদীনা হতে রওয়ানা হন এবং কুরাইশদের অগোচরে গোপনে মিনাতে রাসূল সা.-এর সাথে সাক্ষাত করেন। আর তারা সকলে রাসূলের চাচা আব্বাস, আবু বকর এবং আলী ইবনে আবু তালিবের উপস্থিতিতে রাসূল সা.-এর নিকট বাইয়াত গ্রহণ করেন। এ বাইয়াতকে ইসলামের ইতিহাসে ‘আল-আকবাতুস সানীয়াহ’ বলা হয়। এতে তারা জান-মালের বিনিময়ে রাসূল সা.-কে রক্ষা করার অঙ্গীকার করেন। তারা তাঁকে এ মর্মে আশ্বস্ত করলেন যে, তিনি যদি তাদের দেশে তাদের নিরাপত্তায় হিজরত করেন তাহলে তারা স্বাগত জানাবেন।

১৬. হিজরত
কুরাইশরা রাসূল সা.-কে হত্যার ষড়যন্ত্র করে। কিন্তু তারা ব্যর্থ হয় এবং আল্লাহ তাআলাকে তাঁকে হেফাযত করেন। রাসূল সা. নিজের ঘর থেকে বের হন এবং আল্লাহ তাআলা কাফেরদের চোখ অন্ধ করে দেন যাতে তারা রাসূল সা.-কে দেখতে না পারে। তিনি চলতে চলতে মক্কার বাইরে বন্ধু আবু বকর সিদ্দীক রা. এর সাথে মিলিত হন। অতঃপর তারা উভয়ে এক সাথেই পথ চলা আরম্ভ করেন। ‘সওর’ নামক পাহাড়ে পৌঁছে একটি গুহায় তিন দিন পর্যন্ত আত্মগোপন করেন। আব্দুল্লাহ বিন আবু বকর রা. তাদের নিকট কুরাইশদের সংবাদ পৌঁছাতেন এবং তার বোন আসমা রা. খাদ্য ও পানীয় পৌঁছাতেন। তারপর নবী করীম সা. ও তার সঙ্গী গুহা হতে বের হন এবং ইয়াসরিব (মদিনা) অভিমুখে যাত্রা শুরু করেন।

১৭. মদীনায় নতুন রাষ্ট্রের সূচনা 
রাসূল সা. মদীনায় পৌঁছে তাকওয়ার ভিত্তিতে ইসলামের সর্বপ্রথম মসজিদ নির্মাণ করেন। বর্তমানে মদীনা শরীফে এ মসজিদটি “মসজিদে কু’বা” নামে পরিচিত। মদীনাতে রাসূলুল্লাহ সা. সর্বপ্রথম যে পদক্ষেপ গ্রহণ করেন তা হচ্ছে মসজিদে নববী নির্মাণ এবং মুহাজির ও আনসারদের মাঝে ভ্রাতৃত্ব স্থাপন। এরপর তিনি মদিনার অপরাপর ইহুদী গোষ্ঠীদের সাথে মদিনা সনদের মাধ্যমে সার্বভৌম মদিনা রাষ্ট্র গঠন করেন। এটাই প্রথম ইসলামিক রাষ্ট্র। এখানে রাসূল সা. আল্লাহর আইন ও ইসলামের রাষ্ট্র পরিচালনা পদ্ধতি বাস্তবায়ন করেছেন।

১৮. বদর যুদ্ধ
কুরাইশদের একটি ব্যবসায়ী দল সিরিয়া থেকে বিশাল যুদ্ধসামগ্রী কিনে মক্কা প্রত্যাবর্তন করছে মর্মে সংবাদ ছড়িয়ে পড়ে। রাসূলুল্লাহ সা. এ ব্যাপারে অবগত হলে সেই কাফেলাকে বাধা দিতে চাইলেন। কারণ ইতিপূর্বে মক্কাবাসীরা মুহাজিরদের সম্পদ দখল করে নিয়েছিল। ঐ দলনেতা আবু সুফিয়ান রাসূল সা. এর সংকল্পের কথা জানতে পেরে এক লোককে কুরাইশদের নিকট পরিস্থিতি সম্পর্কে সংবাদদানের জন্য পাঠালেন। সংবাদ পেয়ে কুরাইশরা বাণিজ্যিক কাফেলা রক্ষার্থে দ্রুত বের হয়ে আসলো। এদিকে আবু সুফিয়ান আগেই কাফেলাসহ পলায়ন করতে সক্ষম হয় এবং বেঁচে যায়। কুরাইশরা মক্কায় ফিরে যেতে চাইলো কিন্তু কুরাইশ নেতারা বিশেষত আবু জাহেল মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার ঘোষণা দেয় এবং প্রায় এক হাজার যোদ্ধার একটি সেনাদল মদিনাভিমুখে পাঠায়। নবী সা. পরামর্শ করে মুহাজির ও আনসারগণের নিয়ে গঠিত প্রায় ৩১৩ জনের একটি সেনাদল নিয়ে মুশরিকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার লক্ষ্যে বের হলেন। হিজরী দ্বিতীয় সনের ১৭ রামাদান বদর নামক স্থানে উভয় দল মুখোমুখি হয় এবং সেখানেই বদর যুদ্ধ সংঘটিতহয়। এ যুদ্ধে মুসলমানরা মহা বিজয় লাভ করেন। এ যুদ্ধে মুসলমানগণ অনেক গনিমতের সম্পদ লাভ করেন। রাসূলুল্লাহ সা. তাদের মাঝে সেগুলো বণ্টন করে দেন। এ যুদ্ধে মোট সত্তর জন মুশরিক নিহত হয় এবং সত্তর জন বন্দী হয় আর মুসলমানদের শহীদের সংখ্যা মাত্র চৌদ্দজন।

১৯. উহুদ যুদ্ধ 
বদর যুদ্ধে কুরাইশরা শোচনীয় পরাজয় এবং নিজেদের বড় বড় নেতা হারিয়ে দুঃখ ভারাক্রান্ত হৃদয়ে মক্কায় প্রত্যাবর্তন করার পর তাদের ব্যবসা-বাণিজ্য মুসলমানদের পক্ষ হতে হুমকির সম্মুখীন হওয়ার আশঙ্কা করে। ফলে তারা পূর্ণ এক বছর যাবৎ সৈন্য ও সম্পদ সঞ্চয় এবং প্রতিবেশী গোত্রীয় মিত্রদেরকে সহায়তা প্রদানের আহ্বানসহ জোর প্রস্তুতি গ্রহণ করে এবং আবু সুফিয়ানের নেতৃত্বে তিন হাজারের অধিক একটি বিশাল সেনাদল গঠন করে।

রাসূল সা.-এর নিকট কুরাইশদের আগমন বার্তা পৌঁছোলে তিনি মুহাজির ও আনসার নিয়ে গঠিত এক হাজার যোদ্ধার একটি সেনাদল নিয়ে তাদের প্রতিরোধ করার জন্য বের হন এবং উহুদ পাহাড়ের ঢালুতে অবস্থান গ্রহণ করেন। পাহাড় পিছনে রেখে তিনি সৈন্যদের সুসংগঠিত ও বিন্যস্থ করেন। যে কোনো পরিস্থিতিতে স্থান ত্যাগ না করার জন্য তাদেরকে নির্দেশ প্রদান করেন। যুদ্ধের শুরুর দিকে মুসলমানদের জয় হলো এবং মুশরিকরা পিছু হটলো। কিন্তু মুসলিম তীরান্দাজগণ গনিমতের মাল সংগ্রহণ করতে গিয়ে নিজেদের স্থান ত্যাগ করে বসলেন। মুশরিকরা এ সুযোগে তীর নিক্ষেপের স্থানগুলো দখল করে নিলো এবং মুসলমানদের পিছন দিক থেকে তীর নিক্ষেপ করতে লাগল। যার কারণে মুসলমানরা ছত্রভঙ্গ হয়ে গেল। এতে অনেক মুসলমান শাহাদাত বরণ করেন। তাদের মধ্যে শহীদগণের সরদার হামযা বিন আব্দুল মুত্তালিব রা. ছিলেন। এ যুদ্ধে রাসূল সা.-এর মুখমন্ডল এবং দাঁত মারাত্মক আঘাতপ্রাপ্ত হয়। উহুদ যুদ্ধ সংঘটিত হয় হিজরী সনের তৃতীয় বছর শাওয়াল মাসের ১৫ তারিখ রোজ শনিবার।

২০. খন্দকের যুদ্ধ
মুসলমানদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা, তাদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র ও হিংসাত্মক আচরণের কারণে যে সব ইয়াহুদীদের রাসূল সা. মদীনা হতে তাড়িয়ে দেন তারা মক্কায় কুরাইশদের দলভুক্ত হয়। কুরাইশদেরকে মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার প্রেরণা জোগায় এবং তাদেরকে জনবল, টাকা-পয়সা ও অস্ত্র-শস্ত্র দিয়ে সহযোগিতা করার প্রতিশ্রুতি দেয়। মদিনার ইয়াহুদীদের পরামর্শ অনুসারে মক্কাবাসী ধন-সম্পদ জোগাড় করতে আরম্ভ করল। কুরাইশরা ও ইয়াহুদীরা তাদের স্বীয় গোত্র ও মিত্রদের সহযোগিতা করার আহ্বান জানাল। পঞ্চম হিজরিতে আবু সুফিয়ানের নেতৃত্বে দশহাজারেরও বেশি যোদ্ধা মদিনাভিমুখে রওয়ানা হয়। তাদের মূল লক্ষ্য ছিল মুসলমানদের নিশ্চিহ্ন করা।

রাসূল সা. কুরাইশদের প্রস্তুতি ও প্রতিজ্ঞা সম্পর্কে অবগত হওয়ার পর করণীয় নির্ধারণে সহাবাগণের সাথে পরামর্শ করেন। তারা সিদ্ধান্ত করেন মুসলমানগণ মদিনায় অবস্থান করে প্রতিরোধ করবে। মদিনার উত্তর পার্শ্বের সীমান্ত অরক্ষিত থাকায় সালমান ফারসী রা. মদিনায় দুশমনদের প্রবেশে বাধাগ্রস্থ করার লক্ষ্যে উত্তর পার্শ্বে পরিখা খননের পরামর্শ দেন। রাসূল সা. সালমান ফারসী রা. এর পরামর্শ গ্রহণ করেন। মুসলমানগণ পরিখা খনন আরম্ভ করেন এবং রাসূল সা. নিজেই মুসলমানগণের সাথে কাজে অংশগ্রহণ করেন। পনেরো দিনের মধ্যে পরিখা খনন সম্পন্ন হয়। রাসূল সা. মহিলা ও শিশুদের দুর্গে আশ্রয় গ্রহণের নির্দেশ দেন। মুশরিক সৈন্যরা পরিখার অদূরে মদিনার বাইরে অবস্থান করতে বাধ্য হয়। কেননা তাদের অশ্বগুলো পরিখা অতিক্রম করতে পারেনি। তারা একমাস ধরে মদিনা অবরোধ করে রাখে। অতঃপর তাদের অশ্বারোহীরা নিহত হলে এবং আল্লাহর পাঠানো ঝড়ো বাতাসে তাদের তাঁবু ও সরঞ্জাম লণ্ডভণ্ড হলে তারা পলায়ন করে।

২১. হুদাইবিয়ার সন্ধি 
যষ্ঠ হিজরিতে রাসূল সা. উমরা করার লক্ষ্যে মক্কার উদ্দেশ্যে রওয়ানা করেন। এ সফরে তাঁর যুদ্ধ করার কোন ইচ্ছা ছিল না। চৌদ্দশত আনসার ও মুহাজির সাহাবি তাঁর সফরের সাথী হন। যখন তারা হুদাইবিয়া নামক স্থানে পৌঁছেন সকলে ইহরাম বাঁধা অবস্থায় ছিলেন। কুরাইশরা এ সংবাদ জানতে পেরে শপথ করল যে, তারা নবী করীম সা. ও তার সাথীদেরকে মক্কায় প্রবেশ করতে দেবে না। রাসূল সা. উসমান রা.-কে কুরাইশদের নিকট এ খবর দিয়ে প্রেরণ করেন যে, তারা যুদ্ধের জন্য মক্কার দিকে রওয়ানা হননি। বরং তারা শুধুমাত্র উমরার উদ্দেশ্যেই মক্কায় প্রবেশ করতে চান। তারপর তারা আলোচনায় বসার জন্য সম্মত হয়। আলোচনা আরম্ভ হলে তা সন্ধির মাধ্যমে সমাপ্ত হয়। এ সন্ধিকেই হুদাইবিয়ার সন্ধি বলা হয়। সিদ্ধান্ত হয় রাসূল সা. তার উমরা পালনকে এক বছর পিছিয়ে দেবেন এবং দশ বছর যাবত যুদ্ধ বন্ধ থাকবে। আর যে কোন গোত্র তাদের ইচ্ছানুসারে যে কোন দলের অন্তর্ভুক্ত হতে পারবে। এ চুক্তির ফলে খোযাআ’ গোত্র মুসলমানদের সাথে মিলিত হল এবং বনু বকর গোত্র কুরাইশদের সাথে মিলিত হল। সন্ধি চুক্তিসম্পন্ন হওয়ার পর রাসূল সা. পশু জবেহ করেন এবং মাথা মুড়িয়ে ফেলেন। মুসলমানগণ তাঁর অনুকরণ করেন। অতঃপর তিনি মুসলমানদেরকে নিয়ে মদিনায় ফেরত আসেন। আল্লাহ তায়ালা এই সন্ধিকে বড় বিজয় হিসেবে উল্লেখ করেন।

২২. মক্কা বিজয় 
হুদায়বিয়ার সন্ধির পর নবী সা. বিভিন্ন গোত্রে তাঁর দাওয়াতী কর্মসূচী অধিক পরিমাণে বিস্তৃতি ঘটাতে সক্ষম হন। ফলে এক বছরের মাথায় মুসলমানদের সংখ্যা অধিক হারে বৃদ্ধি পেল। এরই মাঝে কুরাইশদের সাথে মৈত্রী চুক্তিতে আবদ্ধ বনু বকর মুসলমানদের মিত্র কবিলায়ে খুযা‘আর উপর আক্রমণ করল। এর অর্থ দাঁড়াল করাইশ এবং তার মিত্ররা হুদায়বিয়ার সন্ধি চুক্তি ভঙ্গ করল। রাসূল সা. এ সংবাদ পেয়ে অত্যধিক ক্ষুব্দ হন এবং মক্কা বিজয়ের উদ্দেশ্যে দশহাজার যোদ্ধার একটি বিশাল সেনাদল গঠন করেন।

তখন ছিল হিজরী অষ্টম বর্ষের রমাযান মাস। এদিকে কুরাইশরা রাসূল সা. এর মক্কাভিমুখে অভিযানের সংবাদ পেয়ে তাদের নেতা আবু সুফিয়ানকে ক্ষমা প্রার্থনা, সন্ধি চুক্তি বলবৎ এবং চুক্তির মেয়াদ আরো বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়ে নবী সা.-এর নিকট আসে। রাসূল সা. তাদের ক্ষমার আবেদন নাকচ করে দিলেন। কেননা তারা অঙ্গীকার ভঙ্গ করেছে। আবু সুফিয়ান ইসলাম গ্রহণ ভিন্ন বাঁচার আর কোন উপায় না দেখে ইসলাম গ্রহণ করেন। অতঃপর সেনাদল (মক্কাভিমুখে) রওয়ানা হয়ে মক্কার কাছাকাছি আসলে মক্কাবাসী বিশাল দল দেখে আত্মসমর্পণ করে।

এরপর সমবেত মক্কাবাসীর প্রতি লক্ষ্য করে বললেন, আমি তোমাদের সাথে কেমন আচরণ করব বলে তোমাদের ধারণা? তারা বললো, সহানুভূতিশীল, উদার ও ভ্রাতৃত্বসুলভ আচরণ। আপনি মহৎ মহানুভবের ভ্রাতুষ্পুত্র। নবী করীম সা. তাদের সকলকে ক্ষমা করে দিয়ে বললেন, তোমরা সকলেই মুক্ত। এরপর মানুষ দলে দলে আল্লাহর দ্বীনের অন্তর্ভুক্ত হতে লাগলো।

২৩. বিদায় হজ্জ
দশম হিজরী সনে রাসূল সা. মুসলমানদেরকে তাঁর সাথে হজ্জ পালন ও হজ্জের আহকাম শিক্ষা গ্রহণ করতে মক্কা যাবার আহ্বান জানান। তাঁর আহ্বানে প্রায় এক লক্ষের মত লোক সাড়া দিল। তাঁরা যিলকদ মাসের পঁচিশ তারিখ তাঁর সাথে মক্কা পানে বের হন। বাইতুল্লাহতে পৌঁছে প্রথমে তওয়াফ করেন। অতঃপর যিলহজ্জ মাসের আট তারিখ মিনার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন। এরপর নয় তারিখ জাবালে আরাফাহ অভিমুখে যাত্রা করেন। রাসূল সা. সেখানে অবস্থান করেন এবং মুসলমানদের উদ্দেশ্যে তার ঐতিহাসিক অমর ভাষণ দান করে তাদেরকে ইসলামী বিধি-বিধান ও হজের আহকাম শিক্ষা দেন এবং আল্লাহ তাআলার নিম্নোক্ত বাণী তিলাওয়াত করে শুনান- আজ আমি তোমাদের জন্যে তোমাদের দ্বীনকে পূর্ণাঙ্গ করে দিলাম। তোমাদের প্রতি আমার নিয়ামত পরিপূর্ণ করে দিলাম এবং ইসলামকে তোমাদের জন্যে একমাত্র দ্বীন হিসেবে মনোনীত করলাম।”

২৪. রাসূল সা.-এর জীবনে যুদ্ধ
রাসূল সা. সর্বমোট তেইশটি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। তন্মধ্যে মোট নয়টি যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে। বাকীগুলো শুধু অভিযান হয়েছে। যথা- (১) বদরের যুদ্ধ (২)উহুদের যুদ্ধ, (৩)আহযাবের যুদ্ধ (৪) বনী কুরাইযা যুদ্ধ (৫) মুত্তালিক যুদ্ধ (৬) খাইবার যুদ্ধ (৭) ফাতহে মক্কা যুদ্ধ (৮) হুনাইনের যুদ্ধ এবং (৯) তায়িফের যুদ্ধ। আর রাসূল সা. নিজে সশরীরে অংশগ্রহণ না করে অপর কাউকে সিপাহসালার নিযুক্ত করে সাহাবায়ে কেরামকে যে জিহাদ অভিযানে প্রেরণ করেছেন,তাকে 'সারিয়্যা' বলে। এ ধরনের যুদ্ধের সংখ্যা ৪৩টি। এসবগুলো যুদ্ধই সংঘটিত হয়েছে হিজরতের পরে দশ বছরে।

২৫. আল্লাহর সান্নিধ্যে 
বিদায় হজ্জ পরবর্তী বছর রাসূল সা. জ্বরাক্রান্ত হয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং প্রিয় সহধর্মিণী আয়েশা রা. এর ঘরে শয্যাগ্রহণ করেন। রাসূল সা. ৬৩ বছর বয়সে ১২ রবিউল আউয়াল সোমবার দুপুরের পর মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের ডাকে সাড়া দিয়ে ইহকাল ত্যাগ করে পরপারে গমন করেন। অতঃপর খলীফা নির্বাচনের কাজ সমাধা করে ১৪ রবিউল আউয়াল রাতে হযরত আয়েশা সিদ্দীকা রা.-এর গৃহে রাসূল সা.-কে সমাহিত করা হয়।

রাসূল সা.-এর ইন্তেকালে মুসলমানগণ একবারেই নিরাশ ও হতাশ হয়ে যান। এ পরিস্থিতিতে আবুবকর রা. ভাষণ দেয়ার উদ্দেশ্যে দাঁড়িয়ে বলেন, যারা মুহাম্মাদের উপাসনা করতো তারা জেনে রাখুক যে, মুহাম্মাদ সা. আজ মৃত্যুবরণ করেছেন। আর যারা আল্লাহর ইবাদত করে, নিশ্চয় আল্লাহ তা'আলা চিরঞ্জীব, কখনো মৃত্যুবরণ করবেন না। এরপর নিম্নোক্ত আয়াত তিলাওয়াত করেন : “আর মুহাম্মাদ একজন রাসূল বৈ কিছুই নন। তার পূর্বেও বহু রাসূল অতিবাহিত হয়ে গেছেন। তাহলে কি তিনি যদি মৃত্যুবরণ করেন অথবা নিহত হন, তবে তোমরা পশ্চাদপসরন করবে? বস্তুত: কেউ যদি পশ্চাদপসরন করে, তবে তাতে আল্লাহর কিছুই ক্ষতি হবেনা। আর যারা কৃতজ্ঞ আল্লাহ তাদের সাওয়াব দান করবেন।” 
(সূরা আলে ইমরান : ১৪৪)

২৩ জুল, ২০২৫

জুলাই ডায়েরি : ১৮ জুলাই

আজ ১৮ জুলাই।

২০২৪ সালের এই দিনে সারা দেশের আন্দোলন চরম আকার ধারণ করে। ঢাবিতে ছাত্রদের ওপর ছাত্রলীগের হামলার প্রতিবাদে সারাদেশের ছাত্রজনতা রাস্তায় নেমে আসে। প্রায় ২৭ জন মানুষ শাহদাতবরণ করে। হাজার হাজার মানুষ গুলিবিদ্ধ হয়।

# ঢাকায় ১৯ জন ও ঢাকার বাইরে ৮ জন শাহদাতবরণ করে। ২৭ জনের মধ্যে ১১ জন ছাত্র।
# রাজধানী সারাদেশ থেকে ছিল বিচ্ছিন্ন। ঢাকার ১৯ জনের মধ্যে উত্তরায় ১১ জন শহীদ। উত্তরার একটি মসজিদ থেকে বিপ্লবীরা নামাজের আজানের সময় ঘোষণা দেয় 'হাইয়া আলাল জিহাদ'
# সারাদেশে ইন্টারনেট ব্ল্যাকআউট
# বিক্ষুব্ধ জনতা বিটিভি-তে আগুন ধরিয়ে দেয়
# জামায়াতের সংবাদ সম্মেলন, আন্দোলনের সমর্থনে ৫ দফা দাবি উত্থাপন
# দেশজুড়ে ২২৯ প্লাটুন বিজিবি মোতায়েন
# দীপ্ত দে, ফাইয়াজ, তাহমিদ ভুঁইয়া শাহদাতবরণ করে।
# ঢাকা, চট্টগ্রাম ও সিলেটে আগ্নেয়াস্ত্র হাতে ছাত্রলীগ ও যুবলীগ ছাত্রদের ওপর হামলা করে।
# মেরুল বাড্ডায় হেলিকপ্টার দিয়ে পুলিশদের উদ্ধার
# জাবি থেকে ছাত্রলীগ ও পুলিশদের হটিয়েছে ছাত্ররা
# পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ১৪ দলের বৈঠক।

১৮ জুলাই কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের কমপ্লিট শাটডাউন (সর্বাত্মক অবরোধ) কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে গতকাল বৃহস্পতিবার ঢাকাসহ সারা দেশ প্রায় অচল হয়ে পড়ে। রাজধানী ছাড়াও দেশের ৪৭টি জেলায় গতকাল দিনভর বিক্ষোভ, অবরোধ, পাল্টাপাল্টি ধাওয়া, পুলিশের হামলা-গুলি ও সংঘাতের ঘটনা ঘটে। এসব ঘটনায় ২৭ জন শহীদ হয়েছেন বলে জানা গেছে। আহত হয়েছেন অন্তত দেড় হাজার।

কোথাও কোথাও আন্দোলনকারীদের সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের, আবার কোথাও সরকার–সমর্থক বিভিন্ন সংগঠনের নেতা-কর্মীদের সংঘর্ষ হয়। দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণার পর বুধবার রাতে নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করেন শিক্ষার্থীরা। ‘শিক্ষার্থীদের শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে পুলিশ, বিজিবি, র‍্যাব ও সোয়াটের ন্যক্কারজনক হামলা, খুনের প্রতিবাদ, খুনিদের বিচার, সন্ত্রাসমুক্ত ক্যাম্পাস নিশ্চিত করা এবং কোটাব্যবস্থার যৌক্তিক সংস্কারের দাবিতে’ বৃহস্পতিবার কমপ্লিট শাটডাউন (সর্বাত্মক অবরোধ) কর্মসূচি ঘোষণা করেন তাঁরা। এর সমর্থনে গতকাল দলে দলে রাস্তায় নেমে আসেন শিক্ষার্থীরা।

কোটা সংস্কারের দাবিতে এবার আন্দোলন শুরু হয় গত ৫ জুন। বিরতি দিয়ে জুন মাসে বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করেন শিক্ষার্থীরা। এরপর টানা আন্দোলন শুরু হয় ১ জুলাই। এটি চলে মূলত বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে। ১৫ জুলাই থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের ওপর ছাত্রলীগের হামলার পর সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে আন্দোলন। এদিন হামলা-সংঘর্ষে সারা দেশে নিহত হন ছয়জন। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে বিজিবি মোতায়েন করা হয়। তবে বুধবার সব বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণার সিদ্ধান্ত শিক্ষার্থীরা মেনে নেননি। এর আগে মঙ্গলবার সব স্কুল-কলেজ, মাদ্রাসা ও কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করে সরকার। বন্ধ করা হয় সিটি করপোরেশন এলাকার সব প্রাথমিক বিদ্যালয়ও।

গতকাল সড়ক-মহাসড়ক অবরোধের সময় সংঘাত–সংঘর্ষে ভীতি ছড়িয়ে পড়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে। কাঁদানে গ্যাসের শেল, সাউন্ড গ্রেনেড, গুলির শব্দে আতঙ্কিত হয়ে পড়ে রাজধানীর মানুষ। বিভিন্ন এলাকায় সরকারি স্থাপনা ভাঙচুর, পরিবহনে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনাও ঘটে। ঢাকার সড়কে সকালের দিকে কিছু পরিবহন থাকলেও দুপুরের পর ফাঁকা হতে থাকে সব সড়ক। ঢাকার বাইরেও বিভিন্ন এলাকায় উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। রাত ১১টায় এ প্রতিবেদন লেখার সময়ও রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে সংঘর্ষ চলছিল।

গতকাল সারা দেশে নিহতদের অনেকে শিক্ষার্থী। তাঁদের শরীরে গুলির চিহ্ন এবং কারও কারও মাথায় আঘাতের চিহ্ন পাওয়া গেছে। যাত্রাবাড়ীর কাজলা এলাকায় মারা গেছেন একজন সাংবাদিক। একই এলাকায় মারা গেছেন আরও পাঁচজন। ঢাকা রেসিডেনসিয়াল মডেল কলেজের একাদশ শ্রেণির একজন শিক্ষার্থী গুলির আঘাতে মারা গেছে ধানমন্ডি এলাকায়।

সকালে উত্তরা এলাকায় ঢাকা-ময়মনসিংহ সড়ক অবরোধ করতে গেলে আন্দোলনকারীদের বাধা দেয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এরপর শুরু হয় সংঘর্ষ, যা চলে দিনভর। এতে রাজধানীর উত্তরার তিনটি হাসপাতাল থেকে ১১ জনের মৃত্যুর খবর নিশ্চিত হওয়া গেছে। রামপুরায় একজন ও আজিমপুরে একজন মারা গেছেন। এ ছাড়া গত বুধবার রাজধানীর দনিয়া এলাকায় সংঘর্ষের মধ্যে মাথায় গুলিবিদ্ধ হয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হন ইমরান বাবুর্চি (২৬)। চিকিৎসাধীন অবস্থায় গতকাল মারা যান তিনি। এদিকে গতকাল রাত ১১টায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও রামপুরার ফরাজী হাসপাতালে আরও কয়েকজনের লাশ এসেছে। তবে তাঁদের পরিচয় জানা যায়নি।

আন্দোলনকারীদের পাশাপাশি সংঘাত-সংঘর্ষে আহত হয়েছেন সাংবাদিক, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য, পথচারী ও সরকার-সমর্থক বিভিন্ন সংগঠনের নেতা-কর্মীরা। ঢাকার বাইরে সংঘর্ষে সহস্রাধিক আহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। ঢাকায় এই সংখ্যা পাঁচ শতাধিক।

১০ জেলায় শান্তিপূর্ণভাবে সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেছেন আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা। ছয় জেলায় সরকারি কার্যালয়, থানা এবং আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের কার্যালয়ে হামলার ঘটনা ঘটেছে। হামলা-সংঘর্ষে ৩১ জেলায় পুলিশ-ছাত্রলীগসহ ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে সংঘর্ষে ১ হাজার ১১১ জন আহত হয়েছেন। ২৭ জনের মধ্যে ছয় জেলায় নিহত হয়েছেন ৮ জন, আটক হয়েছেন ২৪৭ জন।

বিক্ষোভ দমাতে রাজধানীর বিভিন্ন জায়গায় প্রস্তুতি নিয়ে ছিলেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিপুলসংখ্যক সদস্য। লাঠিসোঁটা, দেশীয় অস্ত্র ও আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে অনেক জায়গায় অবস্থান নিয়েছে আওয়ামী লীগের অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীরা। লাঠিসোঁটা নিয়ে নামেন আন্দোলনকারীরাও। দুপুর থেকেই রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় বড় সংঘাতের খবর আসতে থাকে।

রাজধানীর উত্তরা, মেরুল বাড্ডা, রামপুরা, মালিবাগ, ধানমন্ডি, মিরপুর, নীলক্ষেত, আজিমপুর, তেজগাঁও, শান্তিনগর, মহাখালী, শনির আখড়া, কাজলা, যাত্রাবাড়ীসহ বিভিন্ন এলাকায় দুই পক্ষের মধ্যে ব্যাপক সংঘর্ষ হয়। দিনভর এসব এলাকা ছিল রণক্ষেত্রের মতো। একপর্যায়ে মেরুল বাড্ডায় কানাডিয়ান ইউনিভার্সিটির মধ্যে আশ্রয় নেন পুলিশের সদস্যরা। বিকেলে তাঁদের হেলিকপ্টারে করে উদ্ধার করা হয়। সন্ধ্যার সময়ও বিভিন্ন জায়গায় ধোঁয়া উড়তে দেখা গেছে।

কয়েক দফায় হামলা হয় রাষ্ট্রায়ত্ত টেলিভিশন বিটিভির কার্যালয়ে। অগ্নিকাণ্ডের ঘটনাও ঘটে এখানে। সন্ধ্যা সাতটায় বন্ধ হয় বিটিভির সম্প্রচার। সেতু ভবন, দুর্যোগ ভবন, বিভিন্ন পুলিশ স্থাপনা, মেয়র হানিফ ফ্লাইওভারের টোল প্লাজায় হামলার খবর পাওয়া গেছে। রাজধানীজুড়ে ব্যাপক সংঘর্ষে অন্তত ১৯ জন মারা গেছেন। গতকাল সন্ধ্যা সাতটা পর্যন্ত রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে আহত ১২০ জন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা নেন। এ ছাড়া বাংলাদেশ-কুয়েত মৈত্রী হাসপাতাল, উত্তরা ক্রিসেন্ট হাসপাতাল, উত্তরা আধুনিক মেডিকেল কলেজ হাসপাতালসহ বিভিন্ন জায়গায় আরও অনেকে চিকিৎসা নেন বলে জানা গেছে।

রামপুরা ও যাত্রাবাড়ীতে হেলিকপ্টার থেকে গুলি করতে দেখা যায়।

চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, কুমিল্লার শহরের কোটবাড়ী, চাঁদপুরের হাজীগঞ্জে পুলিশ ও ছাত্রলীগ-যুবলীগের সঙ্গে আন্দোলনকারীদের হামলা ও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। এতে চট্টগ্রামে ২ জন নিহত ও ৬৩ জন আহত হয়েছেন। কুমিল্লায় পুলিশের সঙ্গে আন্দোলনকারীদের তিন ঘণ্টাব্যাপী সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে।

নরসিংদী, নারায়ণগঞ্জ, মানিকগঞ্জ, মাদারীপুর, ফরিদপুর, টাঙ্গাইল ও কিশোরগঞ্জে পুলিশ ও ছাত্রলীগ-যুবলীগের নেতা-কর্মীদের সঙ্গে আন্দোলনকারীদের সংঘর্ষ, হামলা ও পাল্টাপাল্টি ধাওয়ার ঘটনা ঘটেছে। এতে সাত জেলায় অন্তত ৩১০ জন আহত হয়েছেন। এ সময় ২০২ জনকে আটক করা হয়।

বরিশাল সদর, পটুয়াখালীর দুমকি ও বাউফল, জামালপুর সদর, নেত্রকোনার মদন, রংপুর, দিনাজপুর, নীলফামারী সদর ও সৈয়দপুর এবং লালমনিরহাটের হাতীবান্ধায় পুলিশ ও ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীদের সঙ্গে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের হামলা-সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। এতে ৫ জন গুলিবিদ্ধসহ ৩২০ জন আহত হন।

রাজশাহীর বাগমারা, নাটোর সদর, পাবনা সদর, জয়পুরহাট, বগুড়া, সিরাজগঞ্জ, মৌলভীবাজার ও হবিগঞ্জে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে আন্দোলনকারীদের সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে হবিগঞ্জ ও বগুড়ায় কয়েক ঘণ্টা সংঘর্ষ হয়েছে। কোথাও কোথাও ক্ষমতাসীন দলের লোকজন হামলা চালিয়েছেন। এতে পুলিশের ১৬ সদস্যসহ ৩৭৭ জন আহত হয়েছেন। এর মধ্যে বগুড়ায় ৩২ জন গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। এ সময় নাটোরে ১০, পাবনায় ১৫ ও মৌলভীবাজারে কয়েকজন আটক হয়েছেন।

ঢাকার বাইরে অবরোধ ঘিরে সংঘর্ষের জেরে বিভিন্ন স্থাপনায় তাণ্ডব চালিয়েছেন আন্দোলনকারীরা। সাতক্ষীরা সদর, ময়মনসিংহের ফুলপুর, মাদারীপুর শহর, রংপুর, বগুড়া শহর ও হবিগঞ্জ জেলা প্রশাসকের কার্যালয়, থানা, সরকারি কার্যালয় এবং আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের কার্যালয়ে হামলার ঘটনা ঘটেছে।

হবিগঞ্জ শহরে পুলিশের সঙ্গে কোটাবিরোধী আন্দোলনকারীদের প্রায় চার ঘণ্টার সংঘর্ষে পুলিশের ১৬ সদস্যসহ দুই শতাধিক ব্যক্তি আহত হয়েছেন। তাঁদের মধ্যে চোখে গুলিবিদ্ধ একজনকে সিলেট এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে।

কুষ্টিয়া, খুলনা, চুয়াডাঙ্গা, ঝিনাইদহ ও সাতক্ষীরায় পুলিশের সঙ্গে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। সংঘর্ষে পুলিশের ২ সদস্যসহ অন্তত ৪১ জন আহত হয়েছেন। এর মধ্যে ঝিনাইদহ-১ (শৈলকুপা) আসনের সংসদ সদস্য বীর মুক্তিযোদ্ধা নায়েব আলী জোয়ারদারের গাড়িতে হামলার ঘটনা ঘটেছে। এ ছাড়া সাতক্ষীরায় থানা ঘেরাওয়ের সময় ১৫ জনকে আটক করে পুলিশ।

যশোরের কেশবপুরে যশোর-সাতক্ষীরা মহাসড়ক, রাজবাড়ীতে রাজবাড়ী-কুষ্টিয়া ও রাজবাড়ী-ফরিদপুর আঞ্চলিক মহাসড়ক, ঝালকাঠির রাজাপুরে খুলনা-বরিশাল মহাসড়ক, গাজীপুরের শ্রীপুরে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জে ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক, বরিশালে বরিশাল-ঢাকা মহাসড়ক বিক্ষোভ করেছেন আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা।

এ ছাড়া রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে ঢাকা-রাজশাহী মহাসড়ক, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে সিলেট-সুনামগঞ্জ মহাসড়ক, পঞ্চগড় শহরে পঞ্চগড়-ঢাকা মহাসড়ক এবং কক্সবাজারে কক্সবাজার-চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার-টেকনাফ সড়ক এবং রাঙামাটি ও লক্ষ্মীপুর শহরে বিক্ষোভ করেছেন আন্দোলনকারীরা।

#জুলাই_ডায়েরি

১৭ জুল, ২০২৫

জুলাই ডায়েরি : ১৭ জুলাই

আজ সতেরো জুলাই

২০২৪ সালের এই দিনে সারা দেশের বিভিন্ন এলাকায় ছাত্র বিক্ষোভ, সড়ক-মহাসড়ক অবরোধ, গায়েবানা জানাজা, কফিনমিছিল এবং দফায় দফায় সংঘর্ষ ও পাল্টাপাল্টি ধাওয়ার ঘটনা ঘটেছে আগের দিন রংপুরের ছাত্রনেতা আবু সাঈদ, চট্টগ্রামের ছাত্রনেতা শান্ত ও ওয়াসিমসহ ৬ জন নিহত হওয়ার প্রতিবাদে আন্দোলন আরো বেগবান হয়।

১. ঢাবিতে গায়েবানা জানাজা ও কফিন মিছিল
২. ঢাবিতে হল বন্ধের ঘোষণা দেয় ভার্সিটি প্রশাসন
৩. রাতে শিবিরের নেতৃত্বে ঢাবি'র ১৭ টি হল থেকে ছাত্রলীগকে বহিষ্কার
৪. জাবিতে ছাত্রলীগ ও পুলিশের সাথে ছাত্রদের ভয়াবহ সংঘর্ষ
৫. বহু ছাত্রলীগ নেতার পদত্যাগ
৬. আদালতের রায় পর্যন্ত অপেক্ষা করার আহবান হাসিনার ও সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা
৭. ১৮ জুলাই কমপ্লিট শাটডাউনের ঘোষণা আন্দোলনকারীদের
৮. আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া ছাত্রশক্তি নেতা আখতারের গ্রেপ্তার

১৭ জুলাই বুধবার ঢাকাসহ সারা দেশের বিভিন্ন এলাকায় আন্দোলন জোরদার হয়। পুলিশের কাঁদানে গ্যাসের শেল ও সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপের মুখে গতকাল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের কফিনমিছিল ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। এ সময় পুলিশের সঙ্গে ছাত্রদের দফায় দফায় পাল্টাপাল্টি ধাওয়া ও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের হল বন্ধের ঘোষণা ও পুলিশের তৎপরতার মুখে অনেক শিক্ষার্থী সন্ধ্যা নাগাদ ক্যাম্পাস ছেড়ে যান। তবে হল বন্ধের সিদ্ধান্ত প্রত্যাখ্যান করে রাতেও অনেক ছাত্রছাত্রী হল ও ক্যাম্পাসে অবস্থান করছিলেন।

এর আগে হল ত্যাগের ঘোষণা প্রত্যাখ্যান করে এবং শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা ও ছাত্র হত্যায় জড়িতদের বিচারের দাবিতে উপাচার্যের কার্যালয়ের সামনে বিক্ষোভ করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। তাঁদের কর্মসূচিতে সাউন্ড গ্রেনেড ও কাঁদানে গ্যাসের শেল নিক্ষেপ করে পুলিশ। দেশের অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়েও দিনভর বিক্ষোভ ও গায়েবানা জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে পুলিশের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের দফায় দফায় সংঘর্ষ হয়েছে। সকাল থেকে আরও অনেক বিশ্ববিদ্যালয় ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভে নামলে পুলিশের সঙ্গে পাল্টাপাল্টি ধাওয়ার ঘটনা ঘটে।

‘শিক্ষার্থীদের শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে পুলিশ-বিজিবি-র‍্যাব ও সোয়াটের ন্যক্কারজনক হামলা, খুনের প্রতিবাদ, খুনিদের বিচার, সন্ত্রাসমুক্ত ক্যাম্পাস নিশ্চিত করা এবং কোটাব্যবস্থার যৌক্তিক সংস্কারের দাবিতে’ আজ বৃহস্পতিবার কমপ্লিট শাটডাউন (সর্বাত্মক অবরোধ) পালন করবেন আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা। এই কর্মসূচি চলাকালে শুধু হাসপাতাল, গণমাধ্যমসহ অন্যান্য জরুরি সেবা ছাড়া সবকিছু বন্ধ থাকবে বলে ঘোষণা দিয়েছেন তাঁরা।

গতকাল রাত আটটার দিকে ফেসবুকে কর্মসূচির ঘোষণা দেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক আসিফ মাহমুদ। সারা দেশের প্রতিটি স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় ও মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের কর্মসূচি সফল করার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, এই লড়াইটা শুধু ছাত্রদের নয়, দলমত-নির্বিশেষে দেশের আপামর জনসাধারণের। আন্দোলনকারীদের অন্যতম সমন্বয়ক সারজিস আলম প্রথম আলোকে বলেন, কমপ্লিট শাটডাউন বলতে তাঁরা ‘সর্বাত্মক অবরোধ’ বুঝিয়েছেন।

১৭ তারিখ দিনভর উত্তপ্ত ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস। সকাল থেকেই ক্যাম্পাসে মোড়ে মোড়ে অবস্থান ছিল আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর। দুপুর থেকে পুলিশ, র‌্যাব, বিজিবির বিপুলসংখ্যক সদস্য সাঁজোয়া যান নিয়ে ক্যাম্পাসে জড়ো হতে থাকেন। শিক্ষার্থীরা পূর্বঘোষিত কফিনমিছিল শুরু করা মাত্র হামলা করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এ সময় দুই পাশ থেকে সম্মিলিত আক্রমণের মধ্যে পড়ে আহত হন কয়েকজন নারীসহ অন্তত ২০ শিক্ষার্থী। আহত হয়েছেন ১০ জন সাংবাদিকও। এর বাইরে রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে হামলায় আহত হয়ে গতকাল রাত ১১টা পর্যন্ত ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা নেন আরও ৩৫ জন।

ঢাকা বিশ্ববিদালয়ে আন্দোলনকারীদের ক্যাম্পাস ছাড়া করতে টানা অভিযান চালিয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। দুপুরের পর তাদের টানা দুই ঘণ্টার অভিযানে ক্যাম্পাসের আশপাশের এলাকায় অবস্থান নেন আন্দোলনকারীরা। সেখানেও দফায় দফায় সংঘর্ষ হয়।

পুলিশ ও ছাত্রলীগের হামলায় শিক্ষার্থী নিহত হওয়ার ঘটনায় গতকাল বেলা দুইটায় রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে ‘গায়েবানা জানাজা ও কফিনমিছিল’ কর্মসূচি ছিল আন্দোলনকারীদের। কিন্তু পুলিশের বাধায় সেখানে গায়েবানা জানাজা হয়নি। পরে উপাচার্যের বাসভবনের সামনে গায়েবানা জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। জানাজা শেষে ক্যাম্পাসে কফিন নিয়ে মিছিল শুরু করলে একের পর এক সাউন্ড গ্রেনেড ও কাঁদানে গ্যাসের শেল নিক্ষেপ করে পুলিশ। এতে শিক্ষার্থীরা ছত্রভঙ্গ হয়ে যান। কিছুক্ষণের মধ্যেই তাঁরা আবার সূর্য সেন হলের সামনে জড়ো হন।

এরপর ঘণ্টাখানেক পুলিশের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের সংঘর্ষ চলে। পুলিশ সদস্যরা উপাচার্যের বাসভবনের সামনে অবস্থান নেন। অপরদিকে শিক্ষার্থীরা মাস্টারদা সূর্য সেন হলের সামনে অবস্থান নেন। পুলিশের সাউন্ড গ্রেনেড ও কাঁদানে গ্যাসের জবাবে ইটপাটকেল নিক্ষেপ করেন তাঁরা। পুলিশের সঙ্গে টিকতে না পেরে বিকেল সাড়ে পাঁচটার দিকে ওই এলাকার হলগুলোর ভেতরে চলে যান শিক্ষার্থীরা। একপর্যায়ে সূর্য সেন হলের সামনে এসে অবস্থান নেয় পুলিশ। তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক সাইফুল হক সেখানে গিয়ে পুলিশের সঙ্গে কথা বলেন। এরপর কাঁদানে গ্যাসের শেল নিক্ষেপ বন্ধ করে পুলিশ।

এরপর হলগুলো থেকে বেরিয়ে শিক্ষার্থীরা নীলক্ষেত মোড়ের দিকে চলে যান। সেখানে তাঁরা অবস্থান নিলে পুলিশ আবারও তাঁদের লক্ষ্য করে কাঁদানে গ্যাসের শেল নিক্ষেপ করে। জবাবে শিক্ষার্থীরা ইটপাটকেল নিক্ষেপ করেন। আধা ঘণ্টা পর সেখান থেকে চলে যান শিক্ষার্থীরা। তবে বিচ্ছিন্নভাবে ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে তাঁরা ক্যাম্পাসের বিভিন্ন প্রান্তে অবস্থান নেন।

রাত পৌনে ১০টার দিকে পুলিশের সঙ্গে আন্দোলনকারীদের আরেক দফা পাল্টাপাল্টি ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গবন্ধু টাওয়ারের সামনে থেকে ঘটনার শুরু। সেখান থেকে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও চানখাঁরপুল মোড় পর্যন্ত দফায় দফায় পাল্টাপাল্টি ধাওয়া চলে। প্রায় আধা ঘণ্টা সংঘর্ষ চলার পর আন্দোলনকারীরা পুরান ঢাকার দিকে চলে যান।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে হল ১৯টি। এর মধ্যে ১৩টি ছাত্রদের, ৫টি ছাত্রীদের এবং বাকি ১টি আন্তর্জাতিক হল। বিজ্ঞান অনুষদের তিনটি হলে সোমবার বিকেল থেকেই যেতে পারেনি সন্ত্রাসী সংগঠন ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা। মঙ্গলবার দিবাগত রাত থেকে ভোর পর্যন্ত ছাত্রীদের পাঁচটি হল এবং ছাত্রদের শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হল থেকে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের বের করে দেওয়া হয়। সকালে একে একে ছাত্রদের আটটি হলে একই ঘটনা ঘটে।

ঘটনার শুরু হয় রোকেয়া হল থেকে। মঙ্গলবার রাত ১১টার পর রোকেয়া হলের ছাত্রলীগ নেত্রীদের অবরুদ্ধ করে মারধর ও পরে হলছাড়া করা হয়। গভীর রাতে ছাত্রীদের বিক্ষোভের মুখে প্রাধ্যক্ষ রাজনীতি নিষিদ্ধের বিজ্ঞপ্তিতে সই করেন। এরপর শামসুন নাহার হল, বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব হল, কবি সুফিয়া কামাল হল ও বাংলাদেশ-কুয়েত মৈত্রী হলের ছাত্রীরা বের হয়ে এসে প্রাধ্যক্ষের কাছ থেকে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধের বিষয়ে বিজ্ঞপ্তিতে সই নেন।

রাতে জহুরুল হক হলে ছাত্রলীগকে বের করে দিয়ে ফটকের ভেতরে বিক্ষোভ করেন শিক্ষার্থীরা। পরে শিক্ষার্থীরা প্রাধ্যক্ষের কাছ থেকে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধের বিষয়ে সই নেন। এরপর একে একে হাজী মুহম্মদ মুহসীন হল, মাস্টারদা সূর্য সেন হল, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হল, মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান হলসহ সব হল থেকে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের বের করে দেওয়া হয়। শুধু জগন্নাথ হলে প্রাধ্যক্ষের কাছ থেকে বিজ্ঞপ্তির সই নেওয়া হলেও হলটিতে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা রয়েছেন।

হলগুলোতে জারি করা বিজ্ঞপ্তির ভাষা মোটামুটি একই ছিল। মুহসীন হলের বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ১. হলে সব ধরনের ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করা হলো। ২. হলকে তাৎক্ষণিক নিরস্ত্রীকৃত ও সন্ত্রাসমুক্ত ঘোষণা করা হলো এবং ভবিষ্যতেও এই অভিযান অব্যাহত থাকবে, ৩. কোনো বহিরাগত হলে অবস্থান করতে পারবেন না, ৪. হলের কোনো শিক্ষার্থী শারীরিক, মানসিকভাবে কোনো প্রকার ক্ষতির সম্মুখীন হলে হল প্রশাসন দায় নেবে এবং তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নিয়ে সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে, ৫. গণরুম ও গেস্টরুম (অতিথিকক্ষে হাজিরা দেওয়া) সংস্কৃতি বিলুপ্ত করা হলো। ৬. যদি কোনো ছাত্রসংগঠন হল দখল করার অপচেষ্টা করে, তৎক্ষণাৎ সেই ছাত্রসংগঠনের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হবে এবং এসব কাজে জড়িত সবাইকে বহিষ্কার করা হবে। ৭. ১৫ জুলাই শিক্ষার্থীদের ওপর বর্বরোচিত হামলার সঙ্গে জড়িতদের চিহ্নিত করে বহিষ্কার এবং শান্তির আওতায় আনা হবে। ৮. প্রথম বর্ষ থেকে মেধা ও চাহিদার ভিত্তিতে শিক্ষার্থীদের বৈধ সিট বুঝিয়ে দেওয়া হবে।

স্যার এ এফ রহমান হলে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সভাপতি সাদ্দাম হোসেন ও বিজয় একাত্তর হলে সাধারণ সম্পাদক শেখ ওয়ালী আসিফ ইনানের কক্ষ, সূর্য সেন হলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি মাজহারুল কবির (শয়ন), কবি জসীমউদ্‌দীন হলে ছাত্রলীগের বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাধারণ সম্পাদক তানভীর হাসান হলের কক্ষসহ ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের অনেক কক্ষ ভাঙচুর করা হয়েছে।

কোটা সংস্কার আন্দোলনের মঞ্চ বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম গতকাল ভোর চারটার দিকে ফেসবুকে লিখেছেন, এখন থেকে হল পরিচালনা করবেন সাধারণ শিক্ষার্থীরা। বাধা আসলে বাধবে লড়াই।’

পুলিশের হামলার মুখে সন্ধ্যার দিকে আন্দোলনকারী অনেক শিক্ষার্থী হল ছেড়ে যান। এ সময় শাহবাগ এলাকা দিয়ে বের হওয়া বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থীকে মারধর ও হয়রানি করার অভিযোগ ওঠে ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে। শাহবাগে জাতীয় জাদুঘরের সামনে মুক্তিযোদ্ধা, ছাত্র ও জনতার ব্যানারে গায়েবানা জানাজা কর্মসূচি পালন করেন ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীরা। জানাজার পর ছাত্রলীগ-যুবলীগের নেতা-কর্মীরা সেখানে অবস্থান নেন। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঁচটি ছাত্রী হলের অনেক শিক্ষার্থী গতকাল রাতে হলে অবস্থান করছিলেন। তাঁরা জানান, হামলাকারীদের বিচার না করে তাঁরা হল ছেড়ে যাবেন না।

রাজধানীর শনির আখড়ায় গতকাল দিনভর ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক অবরোধ করেন শিক্ষার্থীরা। সন্ধ্যার দিকে পুলিশের সঙ্গে পাল্টাপাল্টি ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। এখানে পুলিশের ছররা গুলিতে ছয়জন আহত হন। রাজধানীর শনির আখড়ায় ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক গতকাল দিনভর অবরোধ করে রাখার পর সন্ধ্যায় কোটা সংস্কার আন্দোলনে যুক্ত শিক্ষার্থীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ বাধে। এ সময় দফায় দফায় পাল্টাপাল্টি ধাওয়া হয়। সর্বশেষ রাত ১১টায় এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত সংঘর্ষ চলছিল। শনির আখড়ার কাজলায় হানিফ ফ্লাইওভারের টোল প্লাজায় আগুন দেওয়া হয়েছে বলে স্থানীয় লোকজন জানিয়েছেন। সন্ধ্যায় সেখানে সংঘর্ষের সময় পুলিশের শটগানের গুলিতে আহত ছয়জনকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়।

১৭ জুলাই রাজধানীসহ দেশের অন্তত আট জেলায় হামলা ও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। এ ছাড়া অন্তত ১০টি জায়গায় সড়ক ও মহাসড়ক এবং দুই জায়গায় রেলপথ অবরোধ করে বিক্ষোভ করেছেন আন্দোলনকারীরা। এসব ঘটনায় ৫০ জনের বেশি আহত হয়েছেন। এর বাইরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে পুলিশের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের দিনভর সংঘর্ষে শতাধিক ব্যক্তি আহত হয়েছেন।

মাদারীপুরে কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর ছাত্রলীগ লাঠিসোঁটা নিয়ে হামলা চালিয়েছে। এতে অন্তত পাঁচ শিক্ষার্থী আহত হয়েছেন। বেলা সাড়ে ১১টার দিকে ঢাকা-বরিশাল মহাসড়কের মস্তফাপুর বাসস্ট্যান্ডে এ ঘটনা ঘটে। ফরিদপুর কৃষি প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের ওপর আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীরা হামলা করেছে। এতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির উপাধ্যক্ষ এ কে এম হাসিবুল হাসানসহ পাঁচজন আহত হন। আহতদের মধ্যে দুজন ছাত্রী ও দুজন ছাত্র রয়েছেন।

চাঁদপুরের হাজীগঞ্জ বাজারে গতকাল কোটা আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ছাত্রলীগের পাল্টাপাল্টি ধাওয়ার ঘটনা ঘটেছে। প্রথমে হাজীগঞ্জ পশ্চিম বাজারে সড়কে অবস্থানরত কোটা সংস্কার আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের ছাত্রলীগ মাইকিং করে সরে যাওয়ার নির্দেশ দেয়। পরে তাঁদের ধাওয়া করলে পাল্টাপাল্টি ধাওয়া শুরু হয়। এ সময় দুই পক্ষের মধ্যে দফায় দফায় সংঘর্ষ চলে। এতে দুই পক্ষের অন্তত পাঁচজন আহত হন।

জামালপুরের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কোটা সংস্কার আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ছাত্রলীগের পাল্টাপাল্টি ধাওয়ার ঘটনাও ঘটেছে। এ সময় কয়েকটি মোটরসাইকেল ভাঙচুর করা হয়। শরীয়তপুরের জাজিরার নাওডোবায় পদ্মা সেতুর এক্সপ্রেসওয়েতে অবস্থান নেওয়ার চেষ্টাকালে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে ছাত্রলীগের সংঘর্ষ হয়। এতে পাঁচ আন্দোলনকারী আহত হন।

ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় কোটা সংস্কার আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ছাত্রলীগের পাল্টাপাল্টি ধাওয়া ও সংঘর্ষ হয়েছে। এতে আন্দোলনকারী কয়েকজন আহত হয়েছেন। ময়মনসিংহে আনন্দ মোহন কলেজ এলাকায় আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ছাত্রলীগের পাল্টাপাল্টি ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। এতে দুই শিক্ষার্থী আহত হন।

শেরপুরে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে পুলিশ ও ছাত্রলীগের দফায় দফায় সংঘর্ষ হয়েছে। এ সময় পাল্টাপাল্টি ধাওয়া, ইটপাটকেল, কাঁদানে গ্যাসের শেল ও সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপের ঘটনা ঘটে। এতে পুলিশের ১০ সদস্যসহ অন্তত ২০ জন আহত হয়েছেন।

বরিশালে মহাসড়ক অবরোধ করেন শিক্ষার্থীরা। সরকারি ব্রজমোহন কলেজ ছাড়াও বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরাও এতে অংশ নেন। বেলা দেড়টার দিকে বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীদের মহাসড়ক থেকে সরিয়ে দিতে নগরের চৌমাথা এলাকায় পুলিশ কাঁদানে গ্যাসের শেল নিক্ষেপ করে। এ সময় বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা পুলিশকে লক্ষ্য করে ইটপাটকেল নিক্ষেপ করেন। পরে সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়ে নথুল্লাবাদ কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনালসংলগ্ন এলাকায়। সেখানে রাত সাড়ে নয়টা পর্যন্ত অবরোধ চলছিল।

অন্যদিকে বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা ও আবাসিক হল ছাড়ার নির্দেশের প্রতিবাদে বিকেল চারটার দিকে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ করে বরিশাল-কুয়াকাটা মহাসড়ক অবরোধ করেন। বরিশালের উজিরপুর উপজেলার বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কয়েক হাজার শিক্ষার্থী গতকাল সকাল ১০টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত ঢাকা-বরিশাল মহাসড়কের উজিরপুরের ইচলাদী এলাকা অবরোধ করে বিক্ষোভ মিছিল করেছেন।

টাঙ্গাইলে বঙ্গবন্ধু সেতুর পূর্ব প্রান্তে মহাসড়ক অবরোধ করেন শিক্ষার্থীরা। এতে সকাল সাড়ে ১০টা থেকে প্রায় আড়াই ঘণ্টা বঙ্গবন্ধু সেতু হয়ে মহাসড়কে যানবাহন চলাচল বন্ধ থাকে। এ ছাড়া কালিহাতী বাসস্ট্যান্ড এলাকায় এবং ঘাটাইল কলেজ মোড় এলাকায় শিক্ষার্থীরা টাঙ্গাইল-ময়মনসিংহ মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেন। মুন্সিগঞ্জ শহর ও লৌহজংয়ে পদ্মা সেতু উত্তর থানার সামনে সকাল ১০টা থেকে সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেছেন আন্দোলনকারীরা। এখানে বাধা দেয় ছাত্রলীগ ও পুলিশ। এখানে আহত হন ১০-১২ জন।

নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জের জালকুড়ি এলাকায় ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ লিংক রোড অবরোধ করে বিক্ষোভ করেন বিভিন্ন কলেজের শিক্ষার্থীরা। খুলনা শহরের জিরো পয়েন্ট এলাকা অবরোধ করেন আন্দোলনকারীরা। গতকাল দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে জিরো পয়েন্ট এলাকার চারটি সড়ক বন্ধ করে এ কর্মসূচি শুরু করেন খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। বিকেল চারটা পর্যন্ত তাঁরা এলাকাটি অবরোধ করে রাখেন। পরে কর্মসূচিতে যোগ দেন খুলনার বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজের শিক্ষার্থীরা। জিরো পয়েন্ট অবরোধের ফলে সাতক্ষীরা, যশোর, ঢাকাসহ বিভিন্ন রুটের যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়।

বগুড়ার শেরপুরে বেলা ১১টা থেকে ৮০০ থেকে ৯০০ শিক্ষার্থী জড়ো হন। মহাসড়কের অন্তত তিন কিলোমিটার পর্যন্ত বিক্ষোভ মিছিল ছড়িয়ে পড়ে এ সময়। বিক্ষোভকারীরা পুলিশকে লক্ষ্য করে ইটপাটকেল ছোড়েন।

যশোর শহরের রেলগেট এলাকায় রাজশাহীগামী মহানন্দা এক্সপ্রেস ট্রেন থামিয়ে রেলপথ অবরোধ করেছেন আন্দোলনকারীরা। বেলা সাড়ে তিনটার দিকে তাঁরা জাতীয় পতাকা দেখিয়ে ও ইট-পাথর ছুড়ে ট্রেনটি থামিয়ে দেন। ট্রেনের চালক ট্রেন থামিয়ে পালিয়ে যান। এরপর যাত্রীদের নামিয়ে দিয়ে আন্দোলনকারীরা ট্রেনের ছাদে উঠে জাতীয় পতাকা ওড়ান। এ সময় যশোরের সঙ্গে সারা দেশের রেল যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়।

গাইবান্ধা শহরে সকাল সাড়ে ১০টা থেকে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা দলবেঁধে পৌর পার্কে সমবেত হন। তাঁরা বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে শহরের প্রধান প্রধান সড়ক প্রদক্ষিণ করে রেলগেটের সামনে অবস্থান নিয়ে সড়ক ও রেলপথ অবরোধ করেন।

#জুলাই_ডায়েরি

১৬ জুল, ২০২৫

জুলাই ডায়েরি : ১৬ জুলাই

 আজ ১৬ জুলাই।


গতবছর অর্থাৎ ২০২৪ সালে এই দিন ছিল হিজরি ১০ মহররম। কারবালার দিন। বাংলাদেশেও সেদিন কারবালা শুরু হয়।

১৫ জুলাই রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে হামলার প্রতিবাদে সারা বাংলাদেশের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ক্ষোভে ফেটে পড়ে।

# রংপুরে ১ম শহীদ আবু সাঈদের শাহদাত
# সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হয়ে চট্টগ্রামে তিনজন, ঢাকায় দুজন ও রংপুরে একজন নিহত হয়েছেন। আহত চার শতাধিক।
# স্কুল–কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা, বৃহস্পতিবারের এইচএসসি পরীক্ষা স্থগিত। বিজিবি মোতায়েন
# জুলাই বিপ্লবের পক্ষে স্ট্যাটাস দেওয়ায় টেন মিনিট স্কুলের ৫ কোটি টাকার অনুদান বন্ধ করেছে পলক
# ছাত্রদের ওপর ছাত্রলীগ ও পুলিশের হামলায় অ্যামনেস্টির নিন্দা
# সরকারি হামলার প্রতিবাদে অর্ধশতাধিক ছাত্রলীগ নেতার পদত্যাগ

রংপুরে সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের সঙ্গে পুলিশ ও ছাত্রলীগের দফায় দফায় সংঘর্ষ হয়েছে। এ সময় পুলিশের রাবার বুলেটের আঘাতে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থী নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন শতাধিক শিক্ষার্থী। নিহত আবু সাঈদ (২২) রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থী। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের কোটা আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক ছিলেন। তিনিই জুলাই বিপ্লবের ১ম শহীদ।

১৫ জুলাই রাজধানী ঢাকায় বিক্ষোভ দমনে লাঠিসোঁটা, কোথাও কোথাও আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে সক্রিয় ছিলো ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগের অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীরা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে ঢাকার অন্তত ১৬ টি জায়গায় শিক্ষার্থীরা সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেন। বেলা দুইটার পর থেকে রাজধানীর সঙ্গে সারা দেশের রেল যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়। এর মধ্যে ঢাকা কলেজ থেকে সায়েন্স ল্যাব, পুরান ঢাকা, নতুন বাজার ও মিরপুর এলাকায় আন্দোলনকারীদের সঙ্গে সরকার সমর্থকদের পাল্টাপাল্টি ধাওয়া, সংঘর্ষ, গুলি ও হামলার ঘটনা ঘটে।

১৫ জুলাই ছাত্রশিবির ব্যানার ছাড়া মাঠে নামলেও ১৬ জুলাই ছাত্রশিবির ঢাকার কয়েকটি স্থানে মিছিল করেন এবং ঢাবিতে পুলিশের সাথে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েন। ঢাকা কলেজের সামনে আহত একজনের মৃত্যু হয়েছে। ঢাকা সিটি কলেজের সামনে আহত আরেকজনকে হাসপাতালে নেওয়ার পর মৃত ঘোষণা করা হয়। ঢাকায় শহীদ হওয়া দুইজনই ছিলেন শ্রমিক। সন্ধ্যা সাতটা পর্যন্ত আহত ১২৬ জন ঢাকা মেডিকেলে চিকিৎসা নিয়েছেন। এর বাইরে আহত কেউ কেউ বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন বলে জানা গেছে।

চট্টগ্রামে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে যুবলীগ-ছাত্রলীগের সংঘর্ষে তিনজন নিহত হয়েছেন। শহরের মুরাদপুরে শিক্ষার্থীদের ওপর অস্ত্রধারীরা গুলি ছুড়লে দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ বাধে। ছাত্রশিবির নেতা ফয়সল আহমেদ শান্ত, ছাত্রদল নেতা ওয়াসিম ও একজন কাঠমিস্ত্রী শহীদ হন।

গতকালও দিনভর উত্তপ্ত ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস। গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জসহ ঢাকার বিভিন্ন স্থান থেকে নেতা-কর্মীদের নিয়ে গতকাল ক্যাম্পাসে অবস্থান নেয় ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা। জঙ্গী সংগঠনটির নেতা-কর্মীদের হাতে ছিল হকিস্টিক, লাঠি, স্টাম্পসহ বিভিন্ন দেশীয় অস্ত্র। শহীদ মিনার, দোয়েল চত্বর, ঢাকা মেডিকেল, কার্জন হল, চানখাঁরপুল এলাকায় অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ করেন আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের হামলায় আহত হয়েছেন শিক্ষার্থীরা। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও ঢাকার কয়েকটি এলাকায় বিক্ষোভ করেছেন। ঢাকার বাইরে ১০টি বিশ্ববিদ্যালয়ে বিক্ষোভ করেছেন শিক্ষার্থীরা। এতে ছাত্রলীগ, যুবলীগের নেতা-কর্মীরা ও পুলিশ হামলা চালায়।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে সোমবার সন্ধ্যায় আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা করে বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা। পরে দুই পক্ষের মধ্যে পাল্টাপাল্টি ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। গভীর রাতে উপাচার্যের বাসভবন চত্বরে শিক্ষার্থীদের ওপর পেট্রলবোমা ও দেশি অস্ত্র নিয়ে হামলা এবং মারধর করে স্বাধীনতা বিরোধী ছাত্রলীগ। পরে পুলিশ এসে কাঁদানে গ্যাসের শেল ও ছররা গুলি ছোড়ে। এ ঘটনায় শতাধিক শিক্ষার্থী আহত হয়েছেন। এ ছাড়া ঘটনাস্থলে উপস্থিত চার-পাঁচজন শিক্ষক ও সাতজন সাংবাদিক আহত হন। চোখে ছররা গুলি লেগে গুরুতর আহত হয়েছেন এক শিক্ষক। আহত ব্যক্তিদের মধ্যে বেশিরভাগই বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসাকেন্দ্রে চিকিৎসা নিয়েছেন। আর গুরুতর আহত ব্যক্তিদের সাভারের বিভিন্ন বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।

জুলাই বিপ্লবীরা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি হলের প্রভোস্টের কক্ষ, ছাত্রলীগ নেতাদের কক্ষসহ অন্তত ১০টি কক্ষে ভাঙচুর চালান। একপর্যায়ে তাঁরা ১৫টি মোটরসাইকেলে আগুন ধরিয়ে দেন। ছাত্রলীগের রাবিতে ছাত্রদের ধাওয়া খেয়ে ক্যাম্পাস ছাড়ে। কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করে শহরের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অন্তত দেড় হাজার শিক্ষার্থী ক্যাম্পাসে আসেন। আড়াইটায় ক্যাম্পাস থেকে লাঠি হাতে নানা স্লোগান দিয়ে মিছিল করেন তাঁরা।

রংপুরে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেটে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, দিনাজপুর প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, গোপালগঞ্জে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়েও আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ করেছেন।

বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় এবং ঢাকা ও চট্টগ্রামের বাইরে আন্দোলনকারীদের ওপর অন্তত সাতটি জেলায় ছাত্রলীগ হামলা চালিয়েছে। ফরিদপুর, বরিশাল, ঝিনাইদহ, কিশোরগঞ্জ, দিনাজপুর, রাজশাহী কলেজ ও নওগাঁ সরকারি মেডিকেল কলেজে সংঘর্ষে অন্তত ৬৮ জন আহত হয়েছেন।

বরিশাল সরকারি ব্রজমোহন (বিএম) কলেজে কোটা সংস্কার আন্দোলনের মিছিলে ছাত্রলীগের জঙ্গীরা হামলা চালিয়েছে। এ সময় দুই পক্ষের মধ্যে দফায় দফায় পাল্টাপাল্টি ধাওয়া হয়। এতে অন্তত ২০ জন আহত হয়েছেন। গুরুতর আহত সাতজনকে বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। বেলা ১১টার দিকে ফরিদপুর সরকারি বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান ফটকের সামনে আন্দোলনকারী ছাত্রছাত্রীদের ওপর হামলা করেছে ছাত্রলীগ। এ সময় আহত হয়েছেন ছয়জন আন্দোলনকারী।

রাজশাহী কলেজে শিক্ষার্থীদের ওপর অতর্কিত হামলা চালিয়েছে ছাত্রলীগ। দুপুরে বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের সামনে এ ঘটনা ঘটে। এতে অন্তত ১০ জন আহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। বেলা ১১টা থেকে কোটাবিরোধী শিক্ষার্থীরা কিশোরগঞ্জ শহরে জড়ো হতে থাকেন। বেলা সাড়ে ১১টার দিকে জেলা ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা লাঠিসোঁটা, হকিস্টিক ও রড নিয়ে কোটা আন্দোলনকারীদের ওপর অতর্কিত হামলা চালায়। পরে আন্দোলনকারীরাও লাঠিসোঁটা নিয়ে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের ধাওয়া করেন। পাল্টাপাল্টি ধাওয়ার ঘটনায় অন্তত ১০ জন আহত হয়েছেন।

ঝিনাইদহ শহরের উজির আলী স্কুল অ্যান্ড কলেজ মাঠে আন্দোলনকারীদের ওপর হামলায় ১০ শিক্ষার্থী আহত হয়েছেন। শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ শুরুর ঠিক আগমুহূর্তে শহর থেকে লাঠিসোঁটা নিয়ে ছাত্রলীগের একটি মিছিল থেকে অতর্কিত আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা চালানো হয়। দিনাজপুরে বিক্ষোভরত শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ছাত্রলীগ ও যুবলীগ নেতাদের পাল্টাপাল্টি ধাওয়ার ঘটনা ঘটেছে। এতে বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলের দুজন ক্যামেরা পারসনসহ অন্তত আটজন আহত হয়েছেন। প্রায় ঘণ্টাব্যাপী ইটপাটকেল নিক্ষেপ, পাল্টাপাল্টি ধাওয়ার পর পুলিশের উপস্থিতিতে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়। নওগাঁ সরকারি মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থীদের মানববন্ধনে হামলার ঘটনা ঘটেছে। এতে আহত হয়েছেন চার শিক্ষার্থী।

বগুড়া সরকারি পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থীরা বেলা একটায় শহরের সাতমাথা-বনানী সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ শুরু করেন। ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা হামলার চেষ্টা করলে লাঠিসোঁটা হাতে তাঁরা ছাত্রলীগকে ধাওয়া করেন। ছাত্রলীগ নেতাদের মোটরসাইকেল ভাঙচুর করা হয়। বগুড়ার সরকারি আজিজুল হক কলেজ ও শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থীরা ক্লাস বর্জন করে সড়ক-মহাসড়ক অবরোধ ও বিক্ষোভ সমাবেশ করেছেন। ঢাকা-রংপুর মহাসড়ক অবরোধ করেন শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থীরা। নরসিংদীতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা জেলখানার মোড়ে ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক অবরোধ করেন। চুয়াডাঙ্গা প্রেসক্লাবের সামনে মানববন্ধনের আয়োজন করেছেন শিক্ষার্থীরা।

বেলা ১১টার দিকে ময়মনসিংহ-টাঙ্গাইল সড়কের প্রবেশমুখ নগরের টাউন হল মোড় এলাকা অবরোধ করেন বিভিন্ন স্কুল-কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েক হাজার শিক্ষার্থী। সকাল নয়টা থেকে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজের একাডেমিক ভবন থেকে বিক্ষোভ মিছিল বের করা হয়। সকাল ১০টায় বিশ্ববিদ্যালয়টির স্থায়ী ক্যাম্পাস খড়খড়ি বাইপাসে ক্যাম্পাসের সামনে রাজশাহীর বেসরকারি বরেন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা রাস্তা অবরোধ করে বিক্ষোভ করছেন।

সকাল ১০টায় রংপুর মেডিকেল কলেজ ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ সমাবেশ করেছেন রংপুর মেডিকেল কলেজ ও বেসরকারি কমিউনিটি মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থীরা। একই সময় বেসরকারি প্রাইম মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থীরা তাঁদের ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ সমাবেশ করেন।

গতকাল বিকেলে ঢাকা-আরিচা মহাসড়ক অবরোধ করেছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। মিছিলে সংহতি জানিয়ে গণ বিশ্ববিদ্যালয়, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, সাভার মডেল কলেজ, মির্জা গোলাম হাফিজ কলেজ, সাভার ল্যাবরেটরি কলেজসহ কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা যোগ দেন। বিক্ষোভ মিছিল বের করেন ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা।

মানিকগঞ্জের কর্নেল মালেক মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ মিছিল ও মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করেছেন। মুন্সিগঞ্জ প্রেসক্লাবের সামনের সড়কে মানববন্ধন করেন সরকারি হরগঙ্গা কলেজ, মুন্সিগঞ্জ কলেজ ও রামপাল ডিগ্রি কলেজের শিক্ষার্থীরা। নারায়ণগঞ্জে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ করেছেন শিক্ষার্থীরা। জেলার সোনারগাঁয়ে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক অবরোধ করেছেন বিভিন্ন স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা।

#জুলাই_ডায়েরি

১৫ জুল, ২০২৫

জুলাই ডায়েরি : ১৫ জুলাই



আজ ১৫ জুলাই।

২০২৪ সালের এই দিনে কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ছাত্রলীগের দফায় দফায় সংঘর্ষ হয়েছে। বেলা তিনটার দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি হল থেকে এই সংঘর্ষের সূত্রপাত হয়। এরপর আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর দফায় দফায় হামলা চালায় ছাত্রলীগ। রাত নয়টা পর্যন্ত চলা সংঘর্ষ ও পাল্টাপাল্টি ধাওয়ায় রণক্ষেত্রে পরিণত হয় বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস।

হামলা ও সংঘর্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের নেতা–কর্মীদের পাশাপাশি সংগঠনটির ঢাকা মহানগরের বিভিন্ন শাখার নেতা–কর্মীরা অংশ নেয়। তাঁদের হাতে ছিল হকিস্টিক, লাঠি, রড, জিআই পাইপসহ বিভিন্ন দেশি অস্ত্র। ক্যাম্পাসের বিভিন্ন স্থানে পিস্তল দিয়ে গুলি ছুড়তে দেখা যায় অন্তত পাঁচজন অস্ত্রধারী ছাত্রলীগ সন্ত্রাসীকে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশাপাশি গতকাল হামলার ঘটনা ঘটে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের বিভিন্ন স্থানে। এসব হামলার ঘটনাতেও ছাত্রলীগের নাম এসেছে। তবে মূল সংঘর্ষ হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ১৫ জুলাই বেলা তিনটার দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজয় একাত্তর হলের সামনে সংঘর্ষ শুরু হওয়ার পর আন্দোলনকারীদের খুঁজে খুঁজে পেটায় নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গী সংগঠন ছাত্রলীগের নেতা–কর্মীরা। পরে বিভিন্ন হলের কক্ষে তল্লাশি চালিয়ে আন্দোলনকারীদের খুঁজতে থাকেন তারা। হামলার মুখে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের বড় অংশ ক্যাম্পাস ছেড়ে আশপাশের বিভিন্ন স্থানে অবস্থান নেন।

হামলায় তিন শতাধিক শিক্ষার্থী আহত হয়েছেন। এ ছাড়া হামলার ছবি তুলতে গিয়ে মারধরের শিকার হয়েছেন কয়েকজন সাংবাদিক। সবচেয়ে ভয়ংকর ব্যাপার হলো ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগের সামনে আহত ও তাঁদের সঙ্গে থাকা শিক্ষার্থীদের ওপরও হামলা করে ছাত্রলীগের জঙ্গীরা। সন্ধ্যার পর হাসপাতালের জরুরি বিভাগের ভেতরেও মারধরের ঘটনা ঘটে। এ সময় পুরো হাসপাতালে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। অনেক রোগী ও তাঁদের স্বজনেরা ছোটাছুটি করতে থাকেন।

১৫ জুলাই সকাল থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হল থেকেও আন্দোলনকারীরা বের হয়ে রাজু ভাস্কর্যের সামনে যাওয়ার চেষ্টা করেন। দুপুর সোয়া ১২টার দিকে বিপুলসংখ্যক আন্দোলনকারী শিক্ষার্থী সেখানে অবস্থান নেন। তখন খবর আসে, বিভিন্ন হলে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের বের হতে বাধা দিচ্ছে ছাত্রলীগ। এ সময় বিজয় একাত্তর হল, জিয়াউর রহমান হল, শেখ মুজিবুর রহমান হল ও জসীমউদ্‌দীন হল থেকে রাজু ভাস্কর্যে থাকা শিক্ষার্থীদের সহযোগিতা চাওয়া হয়।

বেলা ২টা ২৫ মিনিটে আন্দোলনকারীদের একটি অংশ টিএসসি থেকে মিছিল নিয়ে পাশাপাশি থাকা ওই হলগুলোর দিকে যান। অন্য অংশটি টিএসসিতে অবস্থান করেন। আন্দোলনকারীরা প্রথমে মিছিল নিয়ে শেখ মুজিবুর রহমান হল প্রাঙ্গণে প্রবেশ করেন। হলের ভেতরের ফটকের সামনে গিয়ে তাঁরা রিকশায় থাকা মাইকে ‘বঙ্গবন্ধু হলের ভয় নাই, রাজপথ ছাড়ি নাই’সহ নানা স্লোগান দিতে থাকেন। কয়েকজন হলের ভেতরে ঢুকে কক্ষে থাকা শিক্ষার্থীদের আনতে যান। মিনিট কয়েক পর মিছিলটি বের হয়ে আসে।

বঙ্গবন্ধু হল থেকে বের হয়ে আন্দোলনকারীদের মাইক থেকে বলা হয়, তাঁরা খবর পেয়েছেন যে কয়েকজন আন্দোলনকারীকে পার্শ্ববর্তী মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান হলে আটকে রাখা হয়েছে। এরপর তাঁরা যান জিয়াউর রহমান হলে। হলের সামনে গিয়ে তাঁরা ‘দালালদের কালো হাত, ভেঙে দাও গুঁড়িয়ে দাও’সহ নানা স্লোগান দেন। আন্দোলনকারীদের কয়েকজন ভেতরে থাকা শিক্ষার্থীদের আনতে হলের ভেতরে প্রবেশ করেন। এ সময় বাইরে নানা স্লোগান দেওয়া হয়।

কিছুক্ষণের মধ্যেই আন্দোলনকারীদের মিছিলটি জিয়াউর রহমান হল থেকে বের হয়ে বিজয় একাত্তর হলের ফটকের দিকে যায়। মিছিলটি হলের ফটকে যাওয়ার পর মাইকে বলা হয়, আন্দোলনকারীদের কয়েকজনকে বিজয় একাত্তর হল সংসদের কক্ষে আটকে রাখা হয়েছে। একপর্যায়ে মাইকে শিক্ষার্থীদের একাত্তর হলের ভেতরে ঢোকার আহ্বান জানানো হয়। বলা হয়, সন্ত্রাসীদের ধরে নিয়ে আসুন। একপর্যায়ে আন্দোলনকারীরা হলের বাগানে ঢুকে পড়েন। তখন ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা ওপর থেকে প্লাস্টিকের বোতল ও ঢিল ছুড়ছিলো। আন্দোলনকারীরাও নিচ থেকে ইট ও পাথরের টুকরা, ছেঁড়া জুতা হলের বিভিন্ন তলায় থাকা ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের প্রতিহত করতে থাকেন।

এর মধ্যে বিজয় একাত্তর হলের বাগানে ছাত্রলীগের কয়েকজন নেতা-কর্মীর সঙ্গে আন্দোলনকারীদের মারামারি বেঁধে যায়। এ সময় ছাত্রলীগের কিছু নেতা আন্দোলনকারীদের দিকে এগিয়ে এলে পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে পড়ে। পরে ছাত্রলীগের আরও কিছু নেতা-কর্মী হলের বিভিন্ন তলা থেকে লাঠিসোঁটা, কাঠ, লোহার পাইপ ও বাঁশ নিয়ে দল বেঁধে নিচে নেমে আন্দোলনকারীদের ধাওয়া দেন। আন্দোলনকারীরা তখন ছত্রভঙ্গ হয়ে যান। অনেকে দৌড়ে জসীমউদ্‌দীন হলের ভেতরে প্রবেশ করেন, অনেকে মল চত্বরের দিকে দৌড় দেন। এরপর ছাত্রলীগের সঙ্গে আন্দোলনকারীদের দফায় দফায় সংঘর্ষ হয়। বিজয় একাত্তর হলে ঘটনার শুরু হলে ছাত্রলীগের আশপাশের হলগুলোর (বঙ্গবন্ধু হল ও জিয়াউর রহমান হল) নেতা-কর্মীরাও সংঘর্ষে যোগ দেয়। মল চত্বরে আন্দোলনকারীদের ধাওয়া দেয় মাস্টারদা সূর্য সেন হল শাখা ছাত্রলীগের নেতা–কর্মীরা। সংঘর্ষ চলাকালে দুই পক্ষ পরস্পরের দিকে ইট ও পাথরের টুকরা ছুড়তে থাকে।

বেলা সোয়া তিনটার দিকে টিএসসি থেকেও আন্দোলনকারীরা এসে সংঘর্ষে যোগ দেন। তাঁরা একজোট হয়ে ইট-পাথর নিক্ষেপসহ ধাওয়া দিলে ছাত্রলীগ হলের ভেতরে ঢুকে পড়ে। এ সময় উত্তেজিত আন্দোলনকারীরা বাঁশ ও কাঠ দিয়ে বিজয় একাত্তর হলের ফটকে নিরাপত্তা প্রহরীদের বসার কক্ষের জানালার কাচ ভাঙচুর করেন।

এরপর জসীমউদ্‌দীন হলের ছাদে থাকা ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীদের সঙ্গেও আন্দোলনকারীদের পাল্টাপাল্টি ইট-পাথর নিক্ষেপের ঘটনা ঘটে। কিছুক্ষণের জন্য থেমে সাড়ে তিনটার দিকে আবার পাল্টাপাল্টি ধাওয়া শুরু হয়। এ সময় ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা আন্দোলনকারীদের বেশ কয়েকজনকে কাঠ ও বাঁশ দিয়ে বেদম পেটান। কিছুক্ষণ পর বঙ্গবন্ধু হলের কিছু ছাত্রলীগ নেতা-কর্মী হলের ফটকে লাঠিসোঁটাসহ অবস্থান নেন। তাঁদের লক্ষ্য করে আন্দোলনকারীরা ইট-পাথরের টুকরা নিক্ষেপ করেন, তাঁরাও দু–একবার ইট ছোড়েন আন্দোলনকারীদের দিকে। এরপর আরও দুবার দুই পক্ষের মধ্যে পাল্টাপাল্টি ধাওয়া হয়। পরে বিকেল পৌনে চারটার দিকে আন্দোলনকারীরা পিছু হটেন। এর মধ্যে বঙ্গবন্ধু হলের পেছনের পকেট গেট দিয়ে ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণের কিছু ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীকে আগ্নেয়াস্ত্রসহ প্রবেশ করতে দেখা যায়।

বিকেল চারটার দিকে সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়ে পুরো ক্যাম্পাসে। মোটরসাইকেলের বহর নিয়ে বিভিন্ন এলাকা থেকে আরও নেতা–কর্মীকে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে আনে ছাত্রলীগ। তাঁরা দেশি অস্ত্রসহ পুরো ক্যাম্পাসে মহড়া দিতে থাকে। উপাচার্যের বাসভবন এলাকা (ভিসি চত্বর), মল চত্বর, ফুলার রোড, নীলক্ষেত সড়ক, টিএসসি, কলাভবন এলাকাসহ বিভিন্ন স্থানে তাঁরা শিক্ষার্থীদের খুঁজে খুঁজে মারধর করতে থাকে।

ভিসি চত্বর এলাকায় শতাধিক শিক্ষার্থীকে পিটিয়ে আহত করেন ছাত্রলীগের নেতা–কর্মীরা। যাঁদের পিটিয়ে আহত করা হয়েছে, তাঁদের বড় অংশই ছিলেন নারী শিক্ষার্থী। হামলায় যাঁরা অংশ নেন, তাঁদের বড় অংশই ছিলেন বহিরাগত। এখানে ছবি তুলতে গেলে সাংবাদিকদের একাধিক ক্যামেরা ও মুঠোফোন ভাঙচুর করে ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা। মারধর করে বেশ কয়েকজন সাংবাদিককে।

বিকেল পাঁচটার কিছু আগে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালসংলগ্ন ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ হলে গিয়ে অবস্থান নেন। আর হলের বাইরে অবস্থান নেয় ছাত্রলীগের নেতা–কর্মীরা। দুই পক্ষ নিজেদের অবস্থান থেকে প্রতিপক্ষকে লক্ষ্য করে ইটপাটকেল নিক্ষেপ করতে থাকে। পাঁচটার দিকে ওই এলাকায় অন্তত পাঁচটি বিস্ফোরণের শব্দ শোনা যায়। সন্ধ্যা পৌনে সাতটার দিকে বিপুলসংখ্যক পুলিশ সদস্য দোয়েল চত্বর হয়ে শহীদুল্লাহ হলের সামনে আসেন। পুলিশের সামনেই ইটপাটকেল নিক্ষেপ চলতে থাকে। পৌনে নয়টার দিকে ছাত্রলীগ চলে যাওয়ার পর আন্দোলনকারীরা মিছিল নিয়ে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে যেতে চাইলে পুলিশ তাঁদের আটকে দেয়।

নাহিদ ইসলাম বলেন, প্রধানমন্ত্রীর ‘অপমানজনক’ বক্তব্য প্রত্যাহার ও কোটার যৌক্তিক সংস্কারের এক দফা দাবিতে আগামীকাল (আজ) বেলা তিনটায় সারা দেশের সব ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ হবে। তিনি বলেন, ‘আমাদের বৃহত্তর গণ–আন্দোলনে যেতে হবে। শিক্ষার্থীদের ওপর হামলাকারীরা যাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলে ঢুকতে না পারে, সে জন্য হলে হলে প্রতিরোধ গড়ে তুলুন।’

কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়া আরও অন্তত তিনটি বিশ্ববিদ্যালয়ে হামলা হয়েছে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে চালানো এসব হামলার জন্য ছাত্রলীগকে দায়ী করেছেন শিক্ষার্থীরা। এ ছাড়া যশোরে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা করেছেন হেলমেটধারীরা। আন্দোলনে অংশ নেওয়ায় কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে গতকাল রাতে এক ছাত্রকে মারধর করেছেন ছাত্রলীগের কয়েকজন নেতা–কর্মী।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে গতকাল দিবাগত রাত ১২টার পর দ্বিতীয় দফায় আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা হয়েছে। এ হামলায় বহিরাগতসহ ছাত্রলীগের দেড় শতাধিক নেতা–কর্মী অংশ নেন বলে শিক্ষার্থীরা অভিযোগ করেন। তাঁরা বলেন, হামলাকারী ব্যক্তিদের অধিকাংশের মাথায় হেলমেট ও হাতে ধারালো অস্ত্র ছিল। এ সময় দুটি পেট্রলবোমা ছুড়তে দেখা যায়। হামলা থেকে বাঁচতে শিক্ষার্থীরা ফটক খুলে উপাচার্যের বাসভবনে আশ্রয় নেন। রাত সোয়া ১২টার দিকে পুলিশ ঘটনাস্থলে আসে।

২০২৪ সালের এই দিন সন্ত্রাসী ছাত্রলীগ ও আপামর সাধারণ ছাত্র পরস্পরের মুখোমুখি হয়ে যায়।

#জুলাই_ডায়েরি




জুলাই ডায়েরি : ১৪ জুলাই


আজ ঐতিহাসিক ১৪ জুলাই। 

২০২৪ সালের এই দিন আমার স্বাভাবিক ব্যস্ততার দিন। অফিসেই কাজ শেষে সারাদিনের আলোচিত ঘটনা নিয়ে ডিটেইল পড়ছিলাম, ভিডিও দেখছিলাম। সেদিন ট্রাম্প গুলিবিদ্ধ হয়েছিলেন। এটাই ছিল ঐদিনের বড় সংবাদ। 


কয়েকটা আন্তর্জাতিক মিডিয়া থেকে বুঝার চেষ্টা করলাম, আমেরিকায় কী হতে যাচ্ছে। কয়েকজন সহকর্মী সাথে ছিল। সন্ধ্যার পর তাদের সাথে এই নিয়ে জ্ঞানগর্ভ :) আলোচনা করছি। 


দেশের বিষয়ও আমাদের আলোচনার বিষয়বস্তুতে ছিল। হাসিনা দেশে ফিরে সংবাদ সম্মেলন করলো বিকেলে। কিন্তু বরাবরের মতোই হাসিনার সংবাদ সম্মেলন নিয়ে তেমন কোনো আগ্রহ ছিল না। তবে হাসিনার চীন সফর নিয়ে আমরা কৌতুহলী ছিলাম। 


চীন বিষয়ে হাসিনা থেকে কোনো ঘোষণা আসে নাই বিধায় এই সফরে হাসিনার কোনো প্রাপ্তি নেই এটাই ধরে রেখেছিলাম। তাছাড়া ভারতের বাম হাতের জন্য চীন তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন থেকে সরে গিয়েছে এমন খবরও আমরা আলোচনা করছিলাম।  


কোটা আন্দোলন নিয়ে হাসিনার করা মন্তব্যে আমরা নতুনত্ব পাই নি বিধায় এটা আমাদের আলোচনার বিষয়বস্তু হয়ে ওঠে নি। আমাদের আলোচনার বিষয় ছিল আরেকটি ঘটনা। হাসিনা প্রথম আলোর রোজিনাকে উদ্দেশ্য করে বলেছে,  


‘সাংবাদিকদের তথ্য জোগাড় করা এক জিনিস আর ফাইল চুরি আরেক জিনিস। আমি ভ্যাকসিন কিনব, আমার সেখানে নেগোসিয়েশন হচ্ছে। জরুরি পেপার। আপনাদের স্বনামধন্য পত্রিকার এক সাংবাদিক ঢুকে সেই কাগজ চুরি করতে গেল। অফিসার এসে ধরল। ফাইল চুরি করতে গেলে এটা কোনো অপরাধ নয়?’  সেদিন হাসিনা আরো জানিয়েছে তার পিয়ন ৪০০ কোটি টাকার মালিক। এটা আলোচনায় এসেছে।  


 চা-চু খেতে খেতে রাত ১০ টা বেজে গেছে। অফিস ক্লোজ করতে যাবো এমন সময় কল করেছে শিবিরের তৎকালীন সোশ্যাল মিডিয়া দায়িত্বশীল। তিনি একটি ভিডিও পাঠিয়ে বললেন, ভাই ঢাবির ছেলেরা শ্লোগান দিচ্ছে, তুমি কে? আমি কে? রাজাকার! রাজাকার!!


ব্যস! অফিস কীভাবে আর ক্লোজ করি? ল্যাপটপ আবার ওপেন করলাম। যুক্ত হয়ে গেলাম ঐতিহাসিক জুলাই আন্দোলনে। রাতেই বিশ্ববিদ্যালয় গুলোতে ছড়িয়ে গেলো এই শ্লোগান। বারুদের মতো কাজ করলো তা। সারা রাত সেই বারুদে স্পার্ক চালিয়ে গেলাম। 


আমরা জামায়াত শিবির করার কারণে 'রাজাকার' শুনে অভ্যস্ত। এটা আমার মধ্যে প্রতিক্রিয়া তৈরি করে না। কিন্তু জেনজি এটা মেনে নিতে পারে নাই। তাই তারা ক্ষেপে গিয়েছে। বিদ্রোহাত্মক মনোভাব নিয়ে বলেছে আমরাই রাজাকার, যা ইচ্ছা করো!! 


বন্ধুবর কবি আতিফ আবু বকর পার্ফেক্টলি বলেছেন,  


তোমরা কজন 'সাহস' হলে, আমরা হলাম অংশ তার

ফ্যাসিবাদের ধ্বংস লেখার শ্লোগান হলো- রাজাকার।


#জুলাই_ডায়েরি

১০ জুল, ২০২৫

পিআর (PR) সিস্টেম কীভাবে বাংলাদেশে এপ্লাই হতে পারে?


বাংলাদেশের রাজনৈতিক মাঠে এখন একটু গুরুত্বপূর্ণ শব্দ 'পিআর'। এটি একটি নির্বাচন পদ্ধতি। এই ধরনের ব্যবস্থার মূল লক্ষ্য হলো সকল ভোটারের ভোট যাতে কাজে লাগে সেই ব্যবস্থা করা। পিআর পদ্ধতি একটি ইনসাফপূর্ণ পদ্ধতি, এখানে সকলের ভোটকে মর্যাদা দেওয়া হয়। আমি আজকের আলোচনায় পিআর (Proportional representation) বা আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব কী? এবং এটা কীভাবে বাংলাদেশে কার্যকর হতে পারে এই বিষয় নিয়ে আলোচনা করবো।

প্রথমত এটা কেন দরকার?
নির্বাচনের অর্থ যদি হয় দেশ শাসনের জন্য জনগণের প্রকৃত প্রতিনিধি বেছে নেয়া, তাহলে নির্বাচন যাতে ত্রুটিমুক্ত এবং যথার্থ হয় তার নিশ্চয়তা বিধান করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এ ক্ষেত্রে দু'টি বিষয়ের দিকে দৃষ্টি দিতে হয়।

এক. জনপ্রতিনিধিত্বের ধরণটা কেমন হবে, অর্থাৎ নির্বাচন পদ্ধতি কোন ধরণের হবে তা ঠিক করা দরকার।
দুই. নির্বাচন যাতে সুষ্ঠু, অবাধ এবং ত্রুটিমুক্ত হয় সে দিকে লক্ষ্য রেখে নির্বাচনের ব্যবস্থাপনার জন্য একটি নিশ্ছিদ্র প্রক্রিয়া উদ্ভাবন করতে হবে।

আমাদের দেশে এখন কোন পদ্ধতি চালু আছে?
বর্তমান বিশ্বে বিভিন্ন দেশে নির্বাচনের বিভিন্ন পদ্ধতি চালু রয়েছে। বাংলাদেশের তথা উপ-মহাদেশের মানুষ যে পদ্ধতির নির্বাচনের সাথে পরিচিত তা হচ্ছে বৃটেনে প্রচলিত 'গরিষ্ঠ ভোট পদ্ধতি'। ভারত, পাকিস্তান, অস্ট্রেলিয়া, শ্রীলংকা, নাইজেরিয়া, ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জ থেকে শুরু করে প্রাক্তন ব্রিটিশ উপনিবেশগুলোতেই কেবল এই পদ্ধতি এখনও বহাল দেখা যচ্ছে।

এই পদ্ধতিতে একাধিক প্রার্থীর মধ্যে যিনি সর্বাধিক ভোট পাবেন, তিনিই সকল ভোটদাতার প্রতিনিধিত্ব করবেন। এর ফলে ১০/১২ জন প্রার্থীর মধ্যে ভোট ভাগাভাগির দরুন শতকরা বিশভাগের কম ভোট পেয়েও একজন প্রার্থী 'নির্বাচিত' হয়ে যেতে পারেন। অর্থাৎ শতকরা ৮০ ভাগ ভোটার যাঁর বিরুদ্ধে রায় দিয়েছেন তিনিই হবেন সকলের প্রতিনিধি। এ জন্যে এই পদ্ধতিকে First past the post বা winner takes it all নামেও অভিহিত করা হয়ে থাকে।

FPTP বা প্রচলিত পদ্ধতির সমস্যা
যা একক সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোট পদ্ধতি নামেও পরিচিত, নির্বাচনে ব্যবহৃত একটি সাধারণ ও সবচেয়ে পুরাতন পদ্ধতি। এর কিছু উল্লেখযোগ্য সীমাবদ্ধতা রয়েছে, যা নিম্নরূপ:

১. ভোটের অপচয়: FPTP-তে শুধুমাত্র সর্বোচ্চ ভোটপ্রাপ্ত প্রার্থী জয়ী হন, ফলে অন্যান্য প্রার্থীদের জন্য দেওয়া ভোটগুলো কার্যত অপ্রয়োজনীয় হয়ে পড়ে। এটি ভোটারদের মধ্যে হতাশা সৃষ্টি করে।

২. অপ্রতিনিধিত্বমূলক ফলাফল: এই পদ্ধতিতে একটি দল সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন জিততে পারে, এমনকি যদি তাদের মোট ভোটের শতাংশ কম হয়। ফলে, জনগণের সামগ্রিক মতামত সঠিকভাবে প্রতিফলিত হয় না।

৩.ছোট দলের প্রতি অবিচার: ছোট দলগুলোর জয়ের সম্ভাবনা কম থাকে, কারণ তাদের ভোট বিভিন্ন কেন্দ্রে ছড়িয়ে থাকে। এটি বড় দলগুলোর প্রাধান্য বজায় রাখে।

৪.দ্বি-দলীয় ব্যবস্থার প্রবণতা: FPTP প্রায়শই দুটি প্রধান দলের মধ্যে প্রতিযোগিতাকে উৎসাহিত করে, যা অন্যান্য দলের জন্য সুযোগ সীমিত করে। এটি রাজনৈতিক বৈচিত্র্যকে হ্রাস করতে পারে। ৩য় বা ৪র্থ দলগুলো রাষ্ট্রে তাদের প্রয়োজনীয়তা হারায়।

৫. কৌশলগত ভোটদান: ভোটাররা প্রায়ই ভোট পঁচা থেকে বাঁচার জন্য তাদের পছন্দের প্রার্থীর পরিবর্তে এমন প্রার্থীকে ভোট দেন, যার জয়ের সম্ভাবনা বেশি। এটি ভোটারদের প্রকৃত পছন্দকে বিকৃত করে।

৬. আঞ্চলিক বিভক্তি: FPTP আঞ্চলিকভাবে শক্তিশালী দলগুলোকে অতিরিক্ত সুবিধা দেয়, যা জাতীয় ঐক্যের পরিবর্তে আঞ্চলিক বিভক্তিকে উৎসাহিত করতে পারে।

৭. নিম্ন ভোটার উপস্থিতি: ভোটের অপচয় এবং অপ্রতিনিধিত্বের কারণে ভোটাররা নির্বাচনে অংশগ্রহণে নিরুৎসাহিত হয়, যা ভোটার উপস্থিতি হ্রাস করে।

৮. কালো টাকা ও পেশী শক্তির প্রভাব: এই পদ্ধতিতে একটি আসনে প্রার্থীকে নিজ যোগ্যতায় জিতে আসতে হয় বিধায় কালো টাকা ও পেশি শক্তির প্রভাব বেশি থাকে। সাধারণত যারা শক্তি দিয়ে ভোটারদের প্রভাবিত করে তারাই জিতে যায়।

৯. স্বৈরাচারের উত্থান: FPTP পদ্ধতিতে ৩০% থেকে ৩৫% জনসমর্থন নিয়ে দুই তৃতীয়াংশ আসন পাওয়া সম্ভব। ফলশ্রুতিতে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় স্বৈরাচারের উত্থান হয়। এটাই বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে বড় সমস্যা। বাংলাদেশের অগ্রগতির পথে বড় অন্তরায় FPTP পদ্ধতি।

এই সীমাবদ্ধতাগুলোর কারণে অনেক দেশ বিকল্প নির্বাচন পদ্ধতি, যেমন আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বকে (PR)কে বেছে নিয়েছে।

পিআর পদ্ধতির সুবিধা
১. ন্যায্য প্রতিনিধিত্ব: PR পদ্ধতিতে দলগুলো তাদের প্রাপ্ত ভোটের শতাংশের সমানুপাতে আসন পায়, ফলে জনগণের মতামত আরও সঠিকভাবে প্রতিফলিত হয়।

২. ছোট দলের জন্য সুযোগ: ছোট বা আঞ্চলিক দলগুলো তাদের ভোটের অনুপাতে আসন পাওয়ার সুযোগ পায়, যা তাদের রাজনৈতিক প্রভাব বাড়ায়।

৩. ভোটের অপচয় হ্রাস: FPTP-র তুলনায় এই পদ্ধতিতে ভোটের অপচয় কম হয়, কারণ প্রায় সব ভোটই ফলাফলে প্রভাব ফেলে।

৪. রাজনৈতিক বৈচিত্র্য: PR বিভিন্ন রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি ও দলের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করে, যা রাজনৈতিক বৈচিত্র্য বাড়ায়।

৫. জাতীয় ঐক্য: এই পদ্ধতি আঞ্চলিক বিভক্তির পরিবর্তে জাতীয় স্তরে ভোটের প্রতিনিধিত্ব করে, যা ঐক্যকে উৎসাহিত করে।

৬. বেশি ভোটার উপস্থিতি: ভোটাররা অনুভব করেন যে তাদের ভোটের মূল্য আছে, ফলে ভোটদানে উৎসাহ বাড়ে এবং ভোটার উপস্থিতি বৃদ্ধি পায়।

৭. স্থিতিশীল সরকার গঠন: যদিও PR প্রায়শই জোট সরকারের দিকে নিয়ে যায়, তবে এটি বিভিন্ন দলের মধ্যে সহযোগিতা ও সমঝোতার মাধ্যমে স্থিতিশীলতা ও গণতান্ত্রিক সুস্থ পরিবেশ আনতে পারে।

৮. স্বৈরাচারের উত্থান রোধ: PR পদ্ধতিতে একটি দলের পক্ষে দুই-তৃতীয়াংশ আসন পাওয়া কষ্টসাধ্য বিধায় কোনো দলের পক্ষে স্বৈরাচার হয়ে ওঠা পসিবল হয় না। বাংলাদেশ স্বৈরাচার হতে মুক্তি চায়।

পৃথিবীর কোনো ব্যবস্থাই শতভাগ নির্ভুল বা সীমাবদ্ধতা মুক্ত নয়। পিআর পদ্ধতিরও কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে। তবে FPTP থেকে PR উত্তম বিধায় পৃথিবীর অনেক উন্নত ও সভ্য রাষ্ট্র নিজেদের নির্বাচনী ব্যবস্থায় পিআরকে আংশিক অথবা সম্পূর্ণভাবে আত্তীকরণ করেছে। এর মধ্যে নিউজিল্যান্ড অন্যতম। বিশ্বের বেশিরভাগ দেশে (প্রায় শতাধিক) বিভিন্নভাবে PR পদ্ধতি কার্যকর আছে।

বাংলাদেশে কীভাবে এপ্লাই হতে পারে?
পিআর বাংলাদেশে কীভাবে এপ্লাই হতে পারে এই নিয়ে বিস্তর আলোচনা দরকার। তবে আমি একটি মডেল উপস্থাপন করতে পারি। এটি একইসাথে পিআর বুঝার ক্ষেত্রেও সহায়ক হবে আশা করি।

১. নির্বাচনী এলাকা ও আসন সংখ্যা নির্ধারণ
বাংলাদেশে ৬৪ টি জেলা রয়েছে। প্রতিটি জেলা একটি সমন্বিত নির্বাচনী এলাকা হিসেবে নির্ধারণ হবে। একেকটি নির্বাচনী এলাকার জন্য কতটি আসন নির্ধারিত হবে তা বিবেচিত হবে ঐ জেলায় ভোটার সংখ্যা কত? উদাহরণস্বরূপ বাংলাদেশে মোট ভোটার সংখ্যা ১২ কোটি। ৩০০ আসন বিবেচনা করলে প্রতিটি আসনের জন্য ভোটার প্রয়োজন হয় ৪ লক্ষ।

এবার আসুন জেলাভিত্তিক ভোটার তালিকা দেখি, নোয়াখালী জেলায় ভোটার সংখ্যা ২৮ লক্ষ ৮০ হাজার। ফেনীতে ভোটার সংখ্যা ১১ লক্ষ ১০ হাজার। গাজীপুরে ভোটার সংখ্যা ৩৭ লক্ষ ৩০ হাজার। প্রতি আসনের জন্য ৪ লক্ষ ভোটার হিসেবে নোয়াখালী পাবে ৭ টি আসন। ফেনী পাবে ৩ টি আসন। গাজীপুর পাবে ৯ টি আসন। এভাবে প্রতিটি জেলার জন্য আমরা আসন সংখ্যা নির্ধারণ করবো।

২. প্রার্থী মনোনয়ন
নির্বাচনী এলাকা নির্ধারণের পর পরবর্তী ধাপ হলো প্রার্থী মনোনয়ন। এক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলগুলো একটি জেলায় যতগুলো আসন ঐ জেলার জন্য ততজন প্রার্থীকে মনোনয়ন দেবে। যেমন বিএনপি ফেনীর জন্য ৩ জনকে মনোনয়ন দেবে, জামায়াতও ৩ জনকে মনোনয়ন দেবে। এভাবে প্রতি জেলার জনগণ জানবে তাদের জেলার জন্য কারা সংসদে যাবে। এই প্রার্থীরা অবশ্যই নির্বাচন কমিশন থেকে বৈধতা নিবে। নির্বাচন কমিশন নিয়মানুসারে কোনো দলের কোনো প্রার্থীকে অযোগ্য বিবেচিত করলে ঐ দল আরেকজন প্রার্থী মনোনয়ন দেবে।

৩.সর্বনিন্ম ভোট সীমা
পিআর সিস্টেমে অনেকগুলো ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজনৈতিক দল এই ব্যবস্থাকে অস্থিতিশীল করে তুলতে পারে। সেক্ষেত্রে সর্বনিন্ম ভোট সীমা নির্ধারণ করা দরকার। তুরস্কে এটা ১০% ছিল, বর্তমানে ৭%। জার্মানীতে ৫%। বেশিরভাগ দেশেই ৪-৫%। বাংলাদেশেও আমরা ৫% সর্বনিন্ম ভোট সীমা নির্ধারণ করতে পারি।

৪. ভোট প্রদান ও ফলাফল নির্ধারণ
জনগণ ভোটকেন্দ্রে গিয়ে তাদের পছন্দের দলের মার্কায় ভোট দেবে। এখানে স্বতন্ত্র প্রার্থী বলে কিছু থাকবে না। আমরা উদাহরণস্বরূপ গাজীপুর নিয়ে আলোচনা করি। গাজীপূরে মোট ভোটার ৩৭ লক্ষ ৩০ হাজার। ভোট দিয়েছেন মোট ২৬ লক্ষ ২১ হাজার। এর মধ্যে ১০ লক্ষ ১০ হাজার ভোট পেয়েছে ধানের শীষ। ৮ লক্ষ ১০ হাজার পেয়েছে দাঁড়িপাল্লা, ৬ লক্ষ ১০ হাজার পেয়েছে শাপলা। আর বাকীরা ৫ টা দল মিলে ১ লক্ষ ৯১ হাজার ভোট পেয়েছে।

এখানে ৩ টি দল মূলত আসন পাবে। বাকীরা পাবে না। ৩ টি দলের মোট ভোট ২৪ লক্ষ ৩০ হাজার। এর মধ্যে বিএনপি পেয়েছে ৪১.৫৬% ভোট, জামায়াত পেয়েছে ৩৩.৩৩% এবং এনসিপি পেয়েছে ২৫.১০% ভোট। গাজীপুরে মোট আসন ৯। সেক্ষেত্রে প্রতিটি আসনের জন্য ১১.১১% ভোট লাগে। গাজীপুরের এই পরিস্থিতিতে বিএনপি পাবে ৪ টি আসন, জামায়াত পাবে ৩ টি আসন ও এনসিপি পাবে ২ টি আসন।

৫. এখানে স্বতন্ত্রপ্রার্থী না থাকাকে অনেকে অসুবিধা হিসেবে বিবেচনা করতে পারেন। তবে এটা অসুবিধা নয় বরং সুবিধা। যারা স্বতন্ত্র প্রার্থী হন তারা সাধারণত নিজ এলাকাকে প্রাধান্য দিয়ে সংসদে কথা বলেন। এটা বিভক্তি তৈরি করে। একটি রাজনৈতিক দলে সব এলাকার মানুষ থাকে বিধায় তারা কোনো একটি অঞ্চলের প্রতি দুর্বল হয়ে পড়েন না। যারা নিজ এলাকার উন্নয়নে ভূমিকা রাখতে চান তারা জাতীয় নয়, স্থানীয় নির্বাচনে অংশ নেবেন।

৬. জাতীয় নির্বাচনে নির্বাচিত প্রতিনিধিরা মূলত সরকার গঠন ও আইন প্রণয়নে ভূমিকা রাখবেন। উন্নয়ন কার্যক্রম পরিচালনা স্থানীয় সরকার নির্বাচনের মাধ্যমে বাস্তবায়িত হবে। পিআর পদ্ধতিতে একেবারে ক্ষুদ্র এলাকাভিত্তিক প্রতিনিধি নির্বাচিত হয় না বিধায় স্থানীয় সরকার শক্তিশালীভাবে পারফর্ম করতে পারে। স্থানীয় সরকারের প্রতিনিধি ও জাতীয় সরকারের প্রতিনিধির সাথে কমফ্লিক্ট করে না।

৬ জুল, ২০২৫

নির্বাচন, পিআর, খালেদা জিয়া ইত্যাদি (পর্ব ৬)

 ২০০৩ সালে জামায়াত যখন ক্ষমতার একটি অংশ তখন জামায়াত পিআর পদ্ধতির বিষয়টি আবারো রাজনীতিতে নিয়ে আসার চেষ্টা করে। জামায়াত মনে করেছে কেয়ারটেকার সরকার পদ্ধতি যেহেতু বাংলাদেশে কায়েম হয়েছে, এবার পিআর পদ্ধতি যদি প্রতিষ্ঠিত করা যায়, তবে একটি সুস্থ গণতান্ত্রিক পরিবেশ তৈরি হবে। আলোচনা তৈরি করার নিমিত্তে জামায়াতের তৎকালীন সহকারী সেক্রেটারি শহীদ কামারুজ্জামান বিভিন্ন পত্রিকায় পিআর নিয়ে ধারাবাহিক লেখা লিখতে থাকেন।


তবে খালেদা জিয়ার প্রবল বাধায় এটি টেবিল ওয়ার্কেই সীমাবদ্ধ ছিল। রাজনীতির মাঠে নামতে পারে নি। এরই ধারাবাহিকতায় জামায়াতের সাবেক আমীর অধ্যাপক গোলাম আযম ২০০৫ সালে ছোট একটি বই লিখে পিআর সিস্টেমের যৌক্তিকতা তুলে ধরেন। জোটবদ্ধ রাজনীতিতে লয়াল থাকতে গিয়ে জামায়াত পিআর নিয়ে আলোচনা করতেই সক্ষম হয়নি। খালেদা জিয়াকে রাজি করানো তো বহুদূর।

আমি এই সিরিজ লেখাটা লিখার একটি কারণ আছে, আর তা হলো খালেদা জিয়ার অসত্য বচন। ২০০৮ সালে ইলেকশনে নাকি জামায়াত বিএনপিকে টেনে নিয়ে গেছে। অথচ ইতিহাস সাক্ষী বিএনপি ও খালেদা জিয়া কখনোই জামায়াতের মতামতকে গুরুত্ব দেয় নাই। আওয়ামী লীগ থেকে বাঁচতে বিএনপি অনুসরণ করে যাওয়াই ছিল জামায়াতের নিয়তি।

২০০৮ সালের ইলেকশন প্রসঙ্গে আসি..

২০০৭ সালের ১১ই জানুয়ারি রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করে সেনাবাহিনী। জারী করা হয় জরুরী অবস্থা। ২২ জানুয়ারিতে অনুষ্ঠিতব্য নির্বাচন বন্ধ করে দিলো তারা। ফখরুদ্দিন আহমদের নেতৃত্বে একটি নতুন তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠিত হলেও কার্যত সেটি পরিচালনা করেছে সেনাবাহিনী। ক্ষমতা গ্রহণের কিছুদিনের মধ্যেই সরকার আভাস দিয়েছিল যে সাধারন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে দুই বছর পর্যন্ত সময় লাগতে পারে।

কারণ হিসেবে বলা হয়েছিল, নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন এবং ছবি সহ ভোটার তালিকা তৈরি। একই সাথে সেনাবাহিনীর প্রত্যক্ষ সহায়তায় তথাকথিত দুর্নীতি-বিরোধী অভিযান শুরু করেছিল দুর্নীতি দমন কমিশন। এর মূল লক্ষ্য ছিল রাজনীতিবিদ এবং ব্যবসায়ীরা। এ সময় দ্রব্যমূল্যের চরম উর্ধ্বগতি এবং রাজনৈতিক কর্মকান্ড বন্ধ থাকায় দেশের মানুষের বড় একটি অংশ চরম হতাশায় নিমজ্জিত হয়। এমন প্রেক্ষোপটে ২০০৭ সালের জুন মাসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে কয়েকজন শিক্ষার্থীকে সেনাসদস্যদের প্রহার করার ঘটনায় দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে তীব্র আন্দোলন গড়ে ওঠে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের গন্ডি পেরিয়ে সহিংস এই আন্দোলন ছড়িয়ে যায় দেশের বিভিন্ন প্রান্তে।

সেই আন্দোলনের পর সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার অনুধাবন করে যে অনির্দিষ্টকালের জন্য নির্বাচন আটকে রাখা যাবে না। ছাত্র বিক্ষোভের প্রেক্ষাপটে ২০০৭ সালের আগস্ট মাসের শেষের দিকে প্রধান নির্বাচন কমিশনার এটিএম শামসুল হুদা ঘোষণা করেন, সেপ্টেম্বর মাস থেকে রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে সংলাপ শুরু হবে। সেপ্টেম্বর মাস থেকে শুরু করে দফায়-দফায় এই সংলাপ চলেছে ২০০৮ সালেও। নির্বাচনী আইন সংস্কার নিয়ে আলাপ-আলোচনার জন্য এই সংলাপ আহবান করেছিল নির্বাচন কমিশন।

ছাত্র বিক্ষোভের প্রেক্ষাপটে তখনকার তত্ত্বাবধায়ক সরকার দেখাতে চেয়েছিল যে নির্বাচন আয়োজনের দিকে তারা এগিয়ে যাচ্ছে। সেজন্য রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে নির্বাচন কমিশন সংলাপ শুরু করেছে। রাজনৈতিক দলের সাথে যখন সংলাপ শুরু হয়, তখন বিএনপিকে সংলাপে আমন্ত্রণ জানানো নিয়ে তীব্র বিতর্কের মুখে পড়ে নির্বাচন কমিশন। এখানে বিএনপি'র আভ্যন্তরীণ কোন্দল স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

দুর্নীতির অভিযোগে খালেদা জিয়া গ্রেফতার হবার আগে বিএনপির মহাসচিব আব্দুল মান্নান ভুঁইয়া এবং যুগ্ম মহাসচিব আশরাফ হোসেনকে দল থেকে বহিষ্কার করেন। মান্নান ভুঁইয়ার বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল তিনি দল ভাঙার চেষ্টা করছেন এবং সেনা-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাথে হাত মিলিয়েছেন।

মান্নান ভুঁইয়াকে বহিষ্কার করে খন্দকার দেলোয়ার হোসেনকে মহাসচিব নিয়োগ করেন খালেদা জিয়া। কিন্তু নির্বাচন কমিশন সবাইকে অবাক করে দিয়ে সংলাপের জন্য আমন্ত্রণ জানায় সংস্কারপন্থী হিসেবে পরিচিত মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমেদকে। মান্নান ভুঁইয়ার বহিষ্কারাদেশ গঠনতন্ত্র অনুযায়ী হয়নি বলে অভিযোগ তোলেন মেজর হাফিজসহ বিএনপির আরো কিছু নেতা, যারা সংস্কারপন্থী হিসেবে পরিচিত ছিলেন।

দলের স্থায়ী কমিটির একটি অংশ খালেদা জিয়ার সিদ্ধান্ত অমান্য করে মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমেদকে মহাসচিব নিযুক্ত করে। এমন অবস্থায় বিএনপির মূলধারা হিসেবে পরিচিত মহাসচিব খন্দকার দেলোয়ার হোসেনকে সংলাপের জন্য আমন্ত্রন না জানিয়ে সংস্কারপন্থী হিসেবে মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমেদকে আমন্ত্রন জানানোর বিষয়টি বিএনপির ভেতরে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া তৈরি করে। অবশ্য পরবর্তীতে খন্দকার দোলোয়ার হোসেনের নেতৃত্বে বিএনপির মূলধারার সাথেই চূড়ান্ত সংলাপ করেছিল নির্বাচন কমিশন।

বিএনপি নির্বাচনে অংশ নেবে কিনা সেটি নিয়ে ২০০৮ সালের গোড়া থেকেই সন্দেহ শুরু হয়। নির্বাচনে অংশ নেবার বিষয়ে খালেদা জিয়ার কিছু আপত্তি ছিল। তিনি চেয়েছিলেন তার দুই ছেলে তারেক রহমান এবং আরাফাত রহমানের মুক্তি ও বিদেশে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা। কিন্তু সেনা গোয়েন্দারা শর্ত দেন যে বিএনপি নির্বাচনে অংশ নিলে খালেদা জিয়ার শর্ত মেনে নেয়া হবে। এই নিয়ে খালেদা জিয়ার সাথে সেনা কর্মকর্তাদের তীব্র দরকষাকষি চলে দীর্ঘ সময়। এক পর্যায়ে উভয় পক্ষের মধ্যে সমঝোতা হয়।

তবে খালেদা জিয়ার সাথে সরকারের কী ধরণের সমঝোতা হয়েছিল, সে সম্পর্কে বিস্তারিত বিএনপির নেতারাও জানেন না। 'বাংলাদেশ: ইমার্জেন্সি অ্যান্ড দ্যা আফটারম্যাথ (২০০৭-২০০৮)' শিরোনামের বইতে মওদুদ আহমদ বলেছেন, ছেলেদের মুক্তি এবং বিদেশ পাঠানোর বিনিময়ে খালেদা জিয়া হয়তো নির্বাচনে অংশগ্রহণের শর্ত মেনে নিয়েছিলেন।

২০০৮ সালের নভেম্বর মাসের শেষের দিকে বিএনপি নিশ্চিত করে যে তারা নির্বাচনে অংশ নেবে। নির্বাচনে অংশ নেবার বিষয়টি নিশ্চিত করেন বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়া। এর আগে নির্বাচনের তারিখ নিয়ে বিএনপির সাথে নির্বাচন কমিশনের মতপার্থক্য তৈরি হয়েছিল। খালেদা জিয়ার দাবির প্রেক্ষিতে নির্বাচন ১১ দিন পিছিয়ে ২৯শে ডিসেম্বর নির্ধারণ করা হয়।

বিএনপির তরফ থেকে একটি যুক্তি তুলে ধরা হয়েছিল যে খালেদা জিয়া কারগার থেকে ছাড়া পেয়েছেন সেপ্টেম্বর মাসে। অন্যদিকে শেখ হাসিনা প্যারোলে কারাগার থেকে বের হয়েছিলেন জুন মাসে। সেজন্য নির্বাচনের প্রস্তুতি নিতে খালেদা জিয়ার সময় প্রয়োজন বলে বিএনপির তরফ থেকে বলা হয়েছিল। নির্বাচন পিছিয়ে ২৯শে ডিসেম্বর নির্ধারন করার বিষয়টি নিয়ে আওয়ামী লীগের তরফ থেকে তীব্র আপত্তি তোলা হলেও শেষ পর্যন্ত তারা সেটি মেনে নিয়েছিল।

এখানে আমরা আরেকটি তথ্য পরে জানতে পারি তা হলো ফখরুদ্দিন-মইনুদ্দিনের দায়মুক্তি। এই বিষয়ে খালেদা ও হাসিনা উভয়েই নীরব ছিল। যদিও সেনাশাসনের সময় উপজেলা পর্যায় পর্যন্ত প্রায় সকল বিএনপি নেতার দুর্নীতি প্রকাশিত হয়েছে। এই নিয়ে বিএনপি জোট বিব্রতকর অবস্থায় ছিল। খালেদার আরো বিব্রতকর বিষয় হলো খালেদার দলের মহাসচিব থেকে শুরু করে অনেক বড় নেতা গাদ্দারি করেছে তার সাথে। সেসময় মধ্য সারির এক নেতা হান্নান শাহ মুখপাত্র হয়ে উঠেছে। বড় নেতারা প্রায় সব বিট্রে করেছে অথবা দুর্নীতির অভিযোগে গ্রেপ্তার হয়েছে।

ফখরুদ্দিন-মঈনরা দায়মুক্তি নিতে খালেদা ও হাসিনার কাছে যায়। খালেদা ডিজিএফআই কর্তৃক প্রাপ্ত দায়মুক্তির বিনিময়ে ক্ষমতায় যাওয়ার অফার প্রত্যাখ্যান করেছে। এই বিষয়ে তিনি পরে বলেছেন। অন্যদিকে ডিজিএফআই-এর এই প্রস্তাব হাসিনাকে দিলে হাসিনা সানন্দে তা গ্রহণ করে। এই তথ্যটা যদি খালেদা নির্বাচনের আগে জাতিকে জানান দিতো তবে জাতি বুঝতে পারতো একটা পাতানো নির্বাচন হবে। কিন্তু খালেদা তা না জানিয়ে নিজেদের ছেলেদের জীবন বাঁচানোর বিনিময়ে নির্বাচনে গিয়েছে। খালেদা নির্বাচনে যেতে গড়িমসি যা করেছে তা অবৈধ নির্বাচন থেকে জাতিকে বাঁচাতে নয় বরং তার ছেলেদের জীবন রক্ষা করতে। তারেক আর রাজনীতি করবে না, এই মুছলেকা নিয়ে ডিজিএফআই ও খালেদার মধ্যে সমঝোতা হয়। তারেককে বিদেশে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।

এরপর যখন পাতানো নির্বাচনে হেরে গেলো চার দলীয় জোট, তখন খালেদা জামায়াতের বিরুদ্ধে অভিযোগ করে, জামায়াত নাকি বিএনপিকে নির্বাচনে যেতে বাধ্য করেছে। অথচ জামায়াত ঐ সময় নির্বাচন চেয়েছে সেনাসরকারের হাত থেকে বাঁচার জন্য। এটা বিএনপিও চেয়েছে। নির্বাচনের জন্যই তো খন্দকার দেলাওয়ার নিয়মিত সংলাপে বসেছে। দরকষাকষি করেছে। সংস্কার আলোচনায় অংশ নিয়েছে।

২০০৮ সালে পাতানো নির্বাচনে (খালেদা-হাসিনা জানতো এটা পাতানো, বাকীরা জানতো না) খালেদা যেতে বাধ্য হয়েছে মূলত দুইটি কারণে।

১। খালেদা দুই ছেলেকে জুলুমের হাত থেকে রক্ষা করতে চেয়েছে।
২। খালেদা ইলেকশনে না গেলে বিএনপি ভেঙে যেত। বিএনপি সিনিয়র নেতারা ইলেকশনে চলে যেত।

খালেদা জামায়াতের মতামত জানতে চাইলে জামায়াত ইলেকশনে যাওয়ার পক্ষে মতামত দেয়। এর মানে এই ছিল না যে, খালেদা ইলেকশনে না গেলে জামায়াত ইলেকশনে চলে যাবে বলে হুমকি দিয়েছে।

-আর চলবে না ...