২২ জানু, ২০২৩

হিন্দুত্ববাদের কবলে পাঠ্যপুস্তক পর্ব ০২ (৭ম শ্রেণি)

ষষ্ঠ শ্রেণির মতো ৭ম শ্রেণীর পাঠ্যপুস্তকেও রয়েছে রাজনৈতিক ও ধর্মীয় সমস্যা। এই সমস্যাগুলো অনিচ্ছাকৃত নয় বরং টার্গেটভিত্তিক। আমরা সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখপূর্বক সেগুলো আলোচনা করবো। ৬ষ্ঠ শ্রেণির মতো ৭ম শ্রেণীতেও সবচেয়ে বেশি সমস্যা সামাজিক বিজ্ঞান ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুশীলন বইতে। সামাজিক অনুশীলন বই ১ম ১০৯ পৃষ্ঠা পড়লে মনে হবে আপনি সামাজিক বিজ্ঞান বই নয়, হিন্দু ধর্ম ও বৌদ্ধ ধর্মের কোনো ধর্মীয় বই পড়ছেন।


সামাজিক বিজ্ঞান বইয়ের প্রচ্ছদ মৌর্য সাম্রাজ্যের আমলের বৌদ্ধ সমাজের পাটলিপুত্র মন্দিরের (ভারতের বিহারে অবস্থিত) ছবি। এটা আমাদের বর্তমান সমাজ কিংবা অতীত ইতিহাস কোনোটাকেই প্রতিনিধিত্ব করে না। ধর্মীয়ভাবেও প্রতিনিধিত্ব করে না।

৭ম শ্রেণির সামাজিক বিজ্ঞান বইয়ে চারটি প্রধান অধ্যায়। প্রথম অধ্যায়ের মূল বিষয় হলো আর্যদের হরপ্পা সভ্যতা। এই সভ্যতা প্রতিষ্ঠা করেছে ব্রাহ্মণ্যবাদীরা। এই অধ্যায়ে বলা হয়েছে এই সভ্যতার ধর্ম বেদের উপর নির্ভরশীল। তারা খুবই সভ্য আর শিক্ষিত জনগোষ্ঠী ছিল। তাদের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা খুব ভালো ছিল। আধুনিক নগর সভ্যতার সব উপাদান সেখানে ছিল। নাগরিকদের সকলের সম্মানজনক অবস্থান ছিল। সবার নাগরিক স্বাধীনতা ছিল। ছিল বিস্তৃত রাস্তাঘাট, পানি সরবরাহ, ডাস্টবিন, সূক্ষ্ম পরিমাপ পদ্ধতি, শিল্পকলা ইত্যাদি সব বিষয়ে তারা পারদর্শী ছিল। মূলত তারা ছিল উৎকৃষ্ট এক জনগোষ্ঠী। তাদের ধর্ম বেদের উপর নির্ভরশীল। বেদের প্রকারভেদ নিয়েও বেশ ভালো আলোচনা কয়েকবার এসেছে। এই জনগোষ্ঠী মূলত প্রাকৃতিক কারণে ধীরে ধীরে পতিত হয়েছে।

বাংলার সবচেয়ে প্রাচীন সভ্যতা হলো একেশ্বরবাদী দ্রাবিড় সভ্যতা। নূহ আ.-এর সন্তানদের দ্বারা এই সভ্যতার সৃষ্টি। আর্যরা দ্রাবিড়দের ওপর নির্যাতন করে, হত্যা করে, ও জুলুম করে তাদের নিশ্চিহ্ন করে দিতে চেয়েছিল। দ্রাবিড়দের ব্যাপারে কোনো আলোচনা নেই। এছাড়া আর্যরা ছিল জাতভেদ ও বর্ণপ্রথার বর্বর সভ্যতা। যারা মানুষকে মানুষ মনে করতো না। সেই হিন্দুয়ানী ও ব্রাহ্ম্যণ্যাবাদী বর্বর সভ্যতাকে মহান সভ্যতা হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে।

দ্বিতীয় অধ্যায়ের বিষয় হলো বৌদ্ধ ধর্ম ও শাসনব্যবস্থা। বৌদ্ধ ধর্ম খুবই ভালো, পরম অহিংসার ধর্ম। গৌতম বুদ্ধের জীবনীর অনেক নিদর্শন নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। আগের অধ্যায়ের মতোই এই অধ্যায়েও এই সমাজের অনেক বিস্তারিত বর্ননা এসেছে। তাদের সমূহ মূর্তি, ভাস্কর্য, উপসনালয়ের বিস্তারিত বর্ণনা রয়েছে। ধর্মগ্রন্থ নিয়েও আলোচনা রয়েছে। আপনার মনে হবে ২য় অধ্যায়ে আপনি বৌদ্ধদের ধর্মীয় গ্রন্থ পড়ছেন।

তৃতীয় অধ্যায়ে দেখানো হয়েছে তৎকালীন হিন্দু ও বৌদ্ধ সভ্যতার নগরায়ন আর ধর্মীয় স্থাপনার চিত্র আর বর্ণনা। ভারত উপমহাদেশে ও বাংলায় শশাংক রাজত্ব। এখানে মুদ্রা, মন্দির, স্থাপনা, ধর্মিয় গ্রন্থ, দেব-দেবীর ছবি, বৌদ্ধ বিহার আর মন্দিরের ছবিতে সয়লাব। প্রতিমা, মূর্তি, দেব-দেবীর আলোচনাই মুখ্য এই অধ্যায়ে। ১২৪ পৃষ্ঠার বইয়ের ১০৯ পৃষ্ঠা পর্যন্ত পড়লে একে সামাজিক বিজ্ঞানের চাইতে হিন্দু ও বৌদ্ধ ধর্মের ইতিহাসের বই বললেই ভালো হবে।

এরপর ৪র্থ অধ্যায়। এই অধ্যায় মুসলিম শাসনের ইতিহাসের অধ্যায়। সুলতানী আমলের কথা বলার জন্য এই অধ্যায়ের পৃষ্ঠা সংখ্যা মাত্র ১৫। আর তাতে সামান্য প্রশংসা দেখা গেলেও মূলত এই ১৫ পৃষ্ঠায় মুসলিম শাসনের প্রতি বিদ্বেষ উপস্থাপন করা হয়েছে। এদেরকে বিদেশী শাসক হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে। অথচ আর্যরা, গুপ্তরা, সেনরা ও পালরা কারো ক্ষেত্রেই বিদেশী উল্লেখ করা হয়নি। মুসলিমরা এসে তাদের ওপর শরীয়াহ চাপিয়ে দিয়েছে। অমানবিক দাসপ্রথা চালু করেছে। নারীদের ঘরে আটকে রেখেছে এই জাতীয় বহু অপবাদে জর্জরিত করেছে। আসুন আমরা এবার পয়েন্টভিত্তিক আলোচনায় আসি।

১. সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম পরিচয়ের প্রতিনিধিত্ব নেই।

পাঠ্যপুস্তকের মাধ্যমে আমাদের মুসলিম সন্তানেরা তাদের আত্মপরিচয় জানবে এবং নিজস্ব সংস্কৃতিতে গড়ে উঠবে। দুঃখজনকভাবে ৬ষ্ঠ শ্রেণির মতো ৭ম শ্রেণির পাঠ্যপুস্তকেও আমাদের মুসলিম পরিচয় অনুপস্থিত। মুসলিম পরিচয়কে প্রতিনিধিত্ব করে এমন কোনো প্রবন্ধ, গল্প, কবিতা ও ইলাস্ট্রেশন নেই। উল্টো মুসলিম পরিচয়ের সাথে সাংঘর্ষিক কন্টেন্ট যুক্ত করা হয়েছে করা হয়েছে। বাংলাদেশ পৃথিবীর ৩য় বৃহত্তম মুসলিম জনগোষ্ঠীর দেশ। অথচ আমাদের বাচ্চাদের পাঠ্যবই দেখে মনে হবে এরা মুসলিম না, সবাই মূর্তিপূজারি।

২. হিন্দুত্ববাদের প্রশংসা করা হয়েছে।

এদেশে ব্রাহ্মণ্যবাদী আর্যরা এসেছে ইরান মতান্তরে জার্মানী থেকে। তারা এসে এই অঞ্চলের আদি বাসিন্দাদের ওপর অবর্ণনীয় অত্যাচার চালিয়েছে। তাদের এই অত্যাচারের ভিত্তি ছিল বর্ণপ্রথা। তারা নিজেদের বড় মনে করতো। স্থানীয়দের অচ্যুত, নীচু মনে করতো। স্থানীয়দের সাথে তাদের আচরণ ছিল মানবতার জন্য চরম অপমানের। জাত পাত ও বর্ণভেদ করে তারা মানুষকে মানুষের মর্যাদা দিত না। ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শুদ্র এর চার ভাগে তারা মানুষকে ভাগ করেছে। শুদ্রদের তারা ঘৃণা করতো।

৭ম শ্রেণির সামাজিক বিজ্ঞান বইতে ১-৩১ পৃষ্ঠায় আর্যদের হরপ্পা সভ্যতাকে পজেটিভলি উপস্থাপন করা হয়েছে। তাদের উন্নত, সভ্য ও মানবতাবাদী হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে। এভাবে আমাদের বাচ্চাদের কাছে মানবতাবিরোধী ব্রাহ্মণ্যবাদীদের পজেটিভলি উপস্থাপন করা হয়েছে।

৩. হিন্দুয়ানী ভাষা ও কালচারকে প্রধান্য দেওয়া হয়েছে।

বাংলায় মুসলিম ও হিন্দুদের মধ্যে ভাষাগত সামান্য কিছু প্রার্থক্য রয়েছে। যদিও সেগুলো শব্দ হিসেব ইসলামী শরিয়তে ম্যাটার করে না। কিন্তু সাংস্কৃতিক দিক থেকে ম্যাটার করে। যদি কোনো শব্দ, পোষাক ও আচরণ কোনো মু*শরিক গোষ্ঠীকে প্রতিনিধিত্ব করে তবে সেটা ব্যবহার আমাদের জন্য নিষিদ্ধ। যেমন বাংলার মুসলিমরা 'গোসল'কে 'গোসল' বলে, অন্যদিকে হিন্দুরা এটাকে 'স্নান' বলে। আমাদের ভাষাগত সংস্কৃতিতে এটা গোসল, স্নান নয়। গোসলখানাকে এই দেশের মানুষ স্নানাগার বলে না, গোসলখানা বলে। ৭ম শ্রেণির সামাজিক বিজ্ঞান বইয়ের ১৮ পৃষ্ঠায় 'গোসলখানা'কে 'স্নানাগার' বলা হয়েছে। এটা সুস্পষ্ট হিন্দুত্ববাদী সাংস্কৃতিক আগ্রাসন।

৭ম শ্রেণির বাংলা বইয়ের ৯৫ পৃষ্ঠায় আনিসুজ্জামানের একটি প্রবন্ধ উপস্থাপন করা হয়েছে 'কত কাল ধরে' নামে। এই প্রবন্ধের বেসিক বিষয় হলো বাংলার মানুষ হিসেবে আমরা কেমন ছিলাম? আমাদের আচরণ কেমন ছিল? আমাদের পোষাক কেমন ছিল ইত্যাদি।


সেখানে তিনি যা উল্লেখ করেছেন তা সবই হিন্দু*য়ানী সংস্কৃতি। যেমন আমাদের পূর্বের লোকেরা সবাই ধুতি পরতো, মেয়েরা বহরে ছোট শাড়ি পড়তো। কপালে টিপ দিত ইত্যাদি। খাদ্য সংস্কৃতিতে ছাগলের গোশতের কথা আছে। গরুর গোশতের কথা নেই। যেন সবাই এদেশে ব্রাহ্মণ্যবাদী হিন্দু ছিল। অথচ এই সভ্যতা গড়ে উঠেছে একেশ্বরাবাদী দ্রাবিড়দের মাধ্যমে। আমাদের বাচ্চাদের শেখানো হচ্ছে আমরা আগে সবাই হিন্দু*য়ানী সংস্কৃতিতে অভ্যস্ত ছিলাম।

৪. দেব-দেবী ও মন্দিরের পরিচয়গুলো হাইলাইট করা হয়েছে।

৭ম শ্রেণির সামাজিক বিজ্ঞানের পুরো বইতেই খুব দৃষ্টিকটুভাবে লক্ষ্য করা গেছে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর দেব-দেবীর নাম। সামাজিক বিজ্ঞান বই পড়ে একজন ছাত্রের স্বাভাবিকভাবে মাথায় যে বিষয়টা ইন্সটল হবে তা হলো, আমাদের দেশের ইতিহাস মানেই হলো মূর্তিপূজার ইতিহাস। দেব দেবীকে শুধু পরিচয় করিয়ে দেওয়া নয়, তাদের প্রতি যাতে ভক্তি আসে সেই ব্যবস্থাও করা হয়েছে সামাজিক বিজ্ঞান বইতে।

সামাজিক বিজ্ঞান বইয়ের প্রচ্ছদসহ ১ - ১০৯ পৃষ্ঠায় আমাদের ইতিহাস নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। পুরো আলোচনায় হিন্দু ও বৌদ্ধদের উন্নত সভ্যতা, উন্নত সংস্কৃতি, তাদের দেব-দেবী ও নগরায়ন নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে।

৫. পরিকল্পিতভাবে মুসলিম বিদ্বেষ যুক্ত করা হয়েছে।

৬ষ্ঠ শ্রেণির মতো ৭ম শ্রেণিতেও পরিকল্পিতভাবে মুসলিম সমাজ ও ইসলামের প্রতি বিষোদগার করা হয়েছে। ৭ম শ্রেণির সামাজিক বিজ্ঞান অনুশীলন বইয়ের ১২১ পৃষ্ঠায় রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের অবরোধবাসিনীর কাহিনী থেকে কিছু ঘটনা উল্লেখ করা হয়েছে। সেখানে ইচ্ছেকৃতভাবে মুসলিম সমাজের প্রতি ঘৃণা ছড়ানো হয়েছে। একইসাথে ইসলামের অত্যাবশ্যকীয় বিধান 'পর্দার' ব্যাপারেও ঘৃণা ছড়ানো হয়েছে।


সেখানে পরস্পরবিরোধী ঘটনা উল্লেখ করা হয়েছে। একবার তিনি বলেছেন সেখানে লেডিস ক্লাবের অনুষ্ঠান করছেন। যদি মেয়েরা অবরোধের মধ্যেই থাকতো তাহলে লেডিস ক্লাবের সংস্কৃতি কীভাবে গড়ে উঠলো। তিনি বলেছেন সবাই বোরকা পড়ে থাকতো। আবার তিনি গল্প করছেন, একবার এক বিয়ের অনুষ্ঠানে রোকেয়া বোরকা পরে যাওয়ায় উপস্থিত সবাই নাকি তাকে ভূত ভেবে ভয় পেয়েছে।

যদি মুসলিম সমাজে বোরকা পরার রীতি থেকেই থাকে (অবশ্যই ছিল) তবে তা দেখে মানুশ ভূত ভেবে ভয় পাবে কেন? আর যদি ভূত ভেবে ভয় পায় তবে ধরে নিতে হবে মুসলিম সমাজে বোরকা পরার রীতি ছিল না। নতুন কিছু দেখে ভয় পেয়েছে। আর বাকী যে অবাস্তব গল্পগুলো বলেছেন তা দেখেই বুঝা যাচ্ছে তিনি মিথ্যাচার করেছেন। এসব গল্প উল্লেখপূর্বক ইসলামকে কটাক্ষ করা হয়েছে। মুসলিম সমাজের সন্তানরা কেন ইসলামকে করা বিদ্রূপকে পাঠ্য হিসেবে গ্রহণ করবে?

৬. ইংরেজ লুটেরাদেরকে সম্মানিত করা হয়েছে।

অবাক বিস্ময়ের সাথে লক্ষ্য করলাম সামাজিক বিজ্ঞান বইতে ইংরেজ লুটেরা ও ডাকাতদের প্রশংসা করা হয়েছে। তাদের হাজারো অপকর্মের কথা আড়াল করে অনেকটা তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশের ভাব লক্ষ্য করা গেছে। ৭ম শ্রেণির সামাজিক বিজ্ঞান অনুশীলন বইয়ের ১৩০ নং পৃষ্ঠায় ইংরেজ আমলের চিরস্থায়ী বন্দোবস্তকে ইতিবাচক হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে।


অথচ চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত ছিল ইংরেজদের শোষণের হাতিয়ার। যেসব জমিদার প্রজাদের শোষণ করে মোটা অংকের রাজস্ব আদায় করে দিতে পারবে তাদেরকেই জমিদারী স্থায়ীভাবে দেওয়া হবে। চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত করার ফলে প্রজাদরদী জমিদাররা জমিদারি হারিয়েছে। পক্ষান্তরে নব্য শোষক শ্রেণী তৈরি হয়ে এদেশে দুর্ভিক্ষ ডেকে এনেছে।

৭. আওয়ামী লীগের দলীয় বইয়ের রূপ দেওয়া হয়েছে।

৬ষ্ঠ শ্রেণির মতো ৭ম শ্রেণির প্রতিটি বইয়ের ২য় পৃষ্ঠায় আওয়ামীলীগের উন্নয়নের ফিরিস্তি দেওয়া হয়েছে যেন এটা পাঠ্যবই নয়, আওয়ামীলীগের দলীয় বুলেটিন। নির্লজ্জ দলীয়করণের মাধ্যমে পাঠ্যবইকেও গ্রাস করেছে আওয়ামীলীগ। এমন হীনকর্ম আইয়ুব খানের মতো স্বৈরাচারও করেনি।

৮. ভ্রান্ত মুসলিম গোষ্ঠিকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে

মুসলিমদের মধ্যে যারা ভ্রান্ত ও ইসলামী শরিয়ত বিরুদ্ধ কর্মকাণ্ডে জড়িত তাদের গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। এরকম একটা গোষ্ঠি হলো মাইজভান্ডারি গোষ্ঠী। যাদের গান লিখে দিত রমেশ শীল নামের এক মুশ*রিক।


সেই মাইজভান্ডারিকে বলা হয়েছে আমাদের দেশীয় সংস্কৃতির অন্যতম নিদর্শন। ৭ম শ্রেণির শিল্প ও সংস্কৃতি বইয়ের ২৩ পৃষ্ঠায় রমেশ শীলের জীবনী বর্ণনা দিতে গিয়ে এই কথা উল্লেখ করা হয়েছে। ভ্রান্ত ও কুফরি কাজে লিপ্ত মাইজভান্ডারিদের বলা হচ্ছে আমাদের সংস্কৃতি।

৯. ইখতিয়ার উদ্দিন বখতিয়ার খলজির বিরুদ্ধে বিদ্বেষ

মুসলিম বিদ্বেষের ধারাবাহিকতায় উপমহাদেশে মুসলিম ও বৌদ্ধদের ত্রাণকর্তা ইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম্মদ বিন বখতিয়ার খলজিকে বহিরাগত লুটেরা ও ক্ষমতালিপ্সু হিসেবে দেখানো হয়েছে। সামাজিক অনুশীলন বইয়ের ৩ নং পৃষ্ঠায় আক্রমণকারী ও দখলদার হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে। অথচ মূল কথা হলো ব্রাহ্মণ্যবাদী আর্য সেন বংশের রাজাদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে বাংলার মুসলিমরা তাদের রক্ষার জন্য আহ্বান জানায়।


সেই আহ্বানে সাড়া দিয়ে বখতিয়ার খলজি আমাদের বর্বর আর্যদের হাত থেকে উদ্ধার করে। বখতিয়ার খলজি বাংলার মুসলিমদের উদ্ধার করে নিজে শাসক বনে যাননি। তিনি দিল্লির সুলতান কুতুব উদ্দিন আইবেকের কাছে বাংলাকে সমর্পন করেন। ক্ষমতালিপ্সু হলে তিনি এই কাজ করতেন না। তার বিরুদ্ধে অপবাদ দেওয়া হয়েছে তিনি বৌদ্ধদের বিহার ও পাঠাগার ধ্বংস করেছেন। এটা সর্বৈব মিথ্যে কথা। বখতিয়ার খলজিকে ওয়েলকাম করেছে বৌদ্ধরা। বখতিয়ারের অভিযানের মাধ্যমে বৌদ্ধদের ওপর চলা বহুদিনের অত্যাচার চিরতরে বন্ধ হয়েছে।

১০. সুলতানী আমল তথা মুসলিম শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ ছড়ানো হয়েছে

৭ম শ্রেণিতে সামাজিক বিজ্ঞান বইয়ের সবচেয়ে খারাপ দিক হলো উপমহাদেশের স্বর্ণযুগ মুসলিম শাসনের বিরুদ্ধে বিষোদগার করা হয়েছে। সুলতানি আমল শুরুই হয়েছে এভাবে, “তোমাদের যদি জিজ্ঞেস করি, ‘বিদেশি' বলতে তোমরা কাদের বোঝাবে? তোমরা চোখ বন্ধ করে বলবে, বিদেশি হলো তারাই যারা আমাদের দেশ অর্থাৎ বাংলাদেশের বাইরে থেকে এই দেশে এসেছে। তোমাদের উত্তর একদম সঠিক। কিন্তু সুলতানি আমলে যদি কাউকে যদি জিজ্ঞেস করা হতো ‘বিদেশি' কে? তাহলে সে কী বলত জানো? সে বলত, অপরিচিত কোনো ব্যক্তি যে আমাদের গ্রামে বা অঞ্চলে থাকে না, আমাদের সমাজ ও সংস্কৃতির অংশ নয়, সেই বিদেশি।” (সামাজিক বিজ্ঞান, পৃষ্ঠা ১১১)
অর্থাৎ, এতক্ষন পর্যন্ত যা পড়লাম সবকিছুই আমাদের দেশীয়, আমাদের সংস্কৃতির অংশ। এখন যা আসছে সব ভিনদেশি, অন্য সংস্কৃতির জিনিস। অর্থাৎ বাচ্চাদের শেখানো হচ্ছে আমাদের উপর “সুলতানি তথা ইসলামী সংস্কৃতি” চাপিয়ে দেয়া হয়েছে।


সুলতানরা একনায়ক ছিল এটা বুঝাতে গিয়ে সামাজিক বিজ্ঞান বইয়ের ১১৩ পৃষ্ঠায় বলা হয়েছে, “সুলতানগণ ছিলেন সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী। এখন মনে হতে পারে, ‘সার্বভৌম ক্ষমতা’ আবার কী? বন্ধুরা, সার্বভৌম ক্ষমতা হলো সর্বময় ক্ষমতা। যে ব্যক্তি এই ক্ষমতার অধিকারী তারা তাদের ক্ষমতার জন্য কারও কাছে জবাবদিহিতা করতে হয় না। তার ইচ্ছাতেই সবকিছু হয়। তিনি যেমন চান, তেমনই হয়।” এমনভাবে উপস্থাপন হয়েছে যেন সুলতানি আমলের আগে সবাই ছিল উদারপন্থী ও গণতান্ত্রিক। কিন্তু সুলতানগন চা ইচ্ছা তা-ই করতো। একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছিল তারা। অথচ বাস্তবতা হলো মুসলিম শাসকরাই সবচেয়ে বেশি জনগনের জন্য জনগণকে সাথে নিয়ে কাজ করেছিলেন। এই কারণেই বাংলার মানুষ দলে দলে মুসলিম হয়েছিল।


বাচ্চাদের শেখানো হচ্ছে, উপমহাদেশের ইতিহাসে সবসময়ে হিন্দু ও বৌদ্ধ শাসন থাকলেও বর্ণবাদের শুরু হয় সুলতানি আমল থেকে। সামাজিক বিজ্ঞান বইয়ের ১১৫ পৃষ্ঠায় বলা হয়েছে, “ইতিহাসবিদদের গবেষণা অনুযায়ী, এ সময়ে হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মাবলম্বীর মানুষ বসবাস করলেও মুসলমানগণ অনেক বেশি সুবিধাজনক অবস্থানে ছিল। আর এর কারণ কিন্তু একটু আগেই বলা হয়েছে। সেই কারণটা মনে আছে তো? আচ্ছা, কারণটা আরেকবার মনে করিয়ে দিচ্ছি। সুলতানি আমলের শাসকগণ সবাই ছিলেন মুসলিম এবং সে জন্যই মুসলিমরা অন্যদের থেকে সুবিধাজনক অবস্থানে ছিল। মুসলমান সমাজে মূলত দুইটি শ্রেণী ছিল। একভাগে ছিল বাইরে থেকে আসা অভিজাত সম্প্রদায় … অন্যভাগে ছিল স্থানীয় ধর্মান্তরিত সাধারণ শ্রেণী। অভিজাত শ্রেণী নিজেদের আশরাফ ও অন্যদের আতরাফ মনে করতেন। আশরাফ ও আতরাফদের মধ্যে মেলামেশা, বিয়েশাদী, দাওয়াতের আদানপ্রদান একেবারেই ছিল না। বর্তমানেও এ ধরনের বিভাজন আমরা দেখতে পাই। সমাজের ‘দলিতদেরকে' অন্ত্যজ ও অপাংক্তেয় মনে করা হয়।”

সামাজিক বিজ্ঞান বইয়ের লেখক মুসলিম সমাজে বর্ণবাদ খুঁজে পেয়েছে। অথচ আর্যদের হরপ্পা সমাজে বর্ণপ্রথা নিয়ে তারা কোনো আলোচনা তারা করে নি। অথচ মুসলিম সমাজে সবাই একসাথে বসবাস করতো, একসাথে খাবার খেত, একসাথে ধর্মীয় অনুষ্ঠান সম্পাদন করতো।


নগ্নভাবে মিথ্যা বলে মুসলিম শাসনের দোষ বের করতে গিয়ে সামাজিক বিজ্ঞানের লেখক দাবি করেছেন, “অমানবিক দাসপ্রথা” সুলতানি আমলেই চালু হয়েছিল। এই অমানবিক দাসপ্রথাও নাকি ইংরেজ লুটেরারা বন্ধ করেছিল।

সামাজিক বিজ্ঞান বইয়ের ১১৯ পৃষ্ঠায় বলা হয়েছে "ইতিহাসের এই মন্দটুকুও তোমাদের জানতে হবে। সুলতানি আমলে সমাজের বিভিন্ন স্তরে দাসপ্রথা প্রচলিত ছিল। তোমরা হয়তো জানতে চাইতে পারো দাসপ্রথা কী? দাসপ্রথা হলো অমানবিক একটি ব্যবস্থা যার মাধ্যমে বাজারে আনুষ্ঠানিকভাবে মানুষের কেনা-বেচা হতো। এই ব্যবস্থায় ধনীরা ব্যক্তিকে কিনে নিত এবং ক্রীত ব্যক্তি তার সম্পত্তি হিসেবে যেকোনো কাজ করতে বাধ্য থাকত। সুলতানি আমলেও এই দাসপ্রথার মাধ্যমে মানুষের কেনা-বেচা হতো। দাসগণ অত্যন্ত মানবেতর জীবনযাপন করত। তাদের ইচ্ছা-অনিচ্ছার কোনো মূল্য ছিল না। সুলতানি আমল ও মোগল আমল শেষে ব্রিটিশ উপনিবেশের মধ্যমভাগে আইন করে এই অমানবিক প্রথা নিষিদ্ধ করা হয়।”

অথচ বাস্তবতা হলো সুলতানী আমলের পূর্বেও দাসপ্রথা ছিল এবং দাসদের সাথে অমানবিক আচরণ করা হতো। আর মুসলিম সমাজে দাসপ্রথা চালু থাকলেও অমানবিক আচরণ করা হতো না। দাসরা যোগ্যতা অনুসারে সমাজে সম্মানিত হতেন। সেনাবাহিনী কমান্ডার হতেন, এমনকি শাসকও হতেন। দিল্লীর সুলতানদের মধ্যে প্রথম কুতুব উদ্দিন আইবেকের শাসনের অধীনে আসে বাংলা। আর কুতুব উদ্দিন আইবেক নিজেই একজন দাস ছিলেন। সুতরাং পরিস্থিতি সহজেই অনুমেয়।


সুলতানী আমলে নারীদের অবস্থা খারাপ ছিল বলে উল্লেখ করা হয়েছে সামাজিক বিজ্ঞান বইয়ের ১২০ পৃষ্ঠায়। অথচ আর্য ব্রাহ্মণ্যবাদীদের আমলে নারীদের দূরাবস্থার কথা উল্লেখ করা হয়নি। বাস্তবতা হলো, বাংলার নারীরা প্রথম মানুষ হিসেবে ট্রিট হতে থাকে সুলতানী আমল থেকে। তাদের সম্পদের অধিকার প্রতিষ্ঠা হয়। আর হিন্দুদের আমলে অধিকার তো দূরের কথা গায়ে কাপড় দেয়ার অধিকার ছিল না। তারা তাদের শরীর ঢাকতে পারতো না। শরীর ঢাকতে হলে তাদেরকে ট্যাক্স দিতে হতো।

প্রাচীন হিন্দু ও বৌদ্ধ শাসনব্যবস্থার অর্থনৈতিক আমলের বিস্তারিত বর্ননা থাকলেও সুলতানি আমলের অর্থনৈতিক অবস্থা সম্পর্কে তেমন কিছুই জানতে পারেনি ৭ম শ্রেণীর সামাজিক বিজ্ঞান বইয়ের লেখকরা। কী আজিব! ১২০ পৃষ্ঠায় তারা এটা জানিয়েছে।

বিখ্যাত পর্যটক ইবনে বতুতা সুলতানী আমলে অর্থনীতি নিয়ে ভালো মন্তব্য করেছেন তার বিরুদ্ধেও যুক্তি উপস্থাপন করা হয়েছে।


সামাজিক বিজ্ঞান বইয়ের ১২১ পৃষ্ঠায় বলা হয়েছে, "যদিও ইবনে বতুতা সুলতানি আমলে বাংলার ভূয়সী প্রসংশা করেছেন। তাঁর মতে বাংলায় যত সস্তায় জিনিসপত্র কিনতে পাওয়া যেত, তা পৃথিবীর অন্য কোথাও পাওয়া যেত না। কিন্তু সস্তায় জিনিসপত্র কেনার মতো সামর্থ্য কতজনের ছিল তা অবশ্য কোনো পর্যটকের লেখায় পাওয়া যায় না। … সে-সময়ে সোনা, রূপা এবং তামার পয়সার প্রচলন ছিল। … তবে সাধারণ মানুষ কড়ির মাধ্যমে বিনিময় করত। সমাজে শ্রেণিবৈষম্য প্রকট ছিল। সমাজের একদিকে যেমন বিত্তবানদের বিলাসী জীবন, ঠিক তেমনি উল্টো দিকে সংগামী মানুষ দুমুঠো খাবারের জন্য দিনরাত পরিশ্রম করত।”

এভাবে সামাজিক বিজ্ঞান বইয়ে ৪র্থ অধ্যায়ে সুলতানি আমলের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ দেখিয়ে মুসলিম বিদ্বেষ শেখানো হয়েছে। পক্ষান্তরে হিন্দুদের হরপ্পা সভ্যতা, বৌদ্ধদের সভ্যতা ও তাদের ধর্মীয় ইতিহাসের প্রতি মুগ্ধতা সৃষ্টির চেষ্টা করানো হচ্ছে।

১১. মুসলিমদের স্বাধীনতা সংগ্রামকে অস্বীকার করা হয়েছে
ইংরেজদের বিরুদ্ধে যারা স্বাধীনতা সংগ্রামে লিপ্ত হয়েছে তাদের মধ্যে অগ্রগণ্য ছিল মুসলিমরা। অথচ সামজিক বিজ্ঞান অনুশীলন বইয়ের ৫ নং পৃষ্ঠায় সেই ইতিহাসকে অস্বীকার করা হয়েছে। ফরায়েজী আন্দোলন, তীতুমীরের বিদ্রোহ, ফকির বিদ্রোহ, মুসলিম কৃষকদের বিদ্রোহকে অস্বীকার করে সন্ত্রাসবাদী স্বদেশী আন্দোলনকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।


১২. মুসলিম লীগের স্বাধীনতার ভূমিকাকে ষড়যন্ত্র হিসেবে দেখানো হয়েছে


হিন্দুত্ববাদী কংগ্রেসের মুসলিম বিদ্বেষের ফলে ১৯০৫ সালে ঢাকার আহসান মঞ্জিলে খাজা সলিমুল্লাহর আহবানে মুসলিম লীগ গঠিত হয়েছে। সেই থেকে মুসলিম লীগ মুসলিমদের অধিকার আদায়ে সোচ্চার ছিল। একইসাথে মুসলিমদের অভিভাবকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে। মুসলিম লীগের মাধ্যমে এদেশের মুসলিমরা একইসাথে ইংরেজ ও মুশ*রিকদের হাত থেকে রক্ষা পেয়েছিলো। অথচ আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় ৭ম শ্রেণীর সামাজিক বিজ্ঞান অনুশীলন বইয়ের ৭২ পৃষ্ঠায় মুসলিম লীগের সেই আন্দোলনকে ষড়যন্ত্র হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে। পক্ষান্তরে ব্রাহ্মণ্যবাদী নেহেরুকে বীরোচিত উদার নেতা হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে। বইয়ের টেক্সট দেখে মনে হয় এই বইটা বাংলাদেশের ছাত্রদের জন্য নয়, ভারতের ছাত্রদের জন্য লেখা হয়েছে।

১৩. না*স্তিকতার হাতেখড়ি


ষষ্ঠশ্রেণিতে না*স্তিকতার হাতেখড়ি হিসেবে বিবর্তনবাদ শেখানো হয়েছে। আর এখানে বলা হয়েছে প্রকৃতির সন্তান। বিজ্ঞান অনুশীলন বইয়ের ১১৫ পৃষ্ঠায় একটি অধ্যায়ের নাম 'রুদ্র প্রকৃতি'। এখানে মূলত প্রাকৃতিক দুর্যোগের কথা বলা হয়েছে। অধ্যায়ের শুরুতে বলা হয়েছে প্রকৃতিরই সন্তান আমরা। এটা নাস্তি*কতা শিক্ষার প্রথম ধাপ। আদম সন্তানরা নিজেদের প্রকৃতির সন্তান দাবি করবে। যাতে তারা পরবর্তীতে স্বীকার করে আদম থেকে নয়, এককোষী এমাইনো এসিড থেকে প্রাণের উৎপত্তি। এরপর ধীরে ধীরে সব প্রাণী বিবর্তনের মাধ্যমে সৃষ্টি হয়েছে।

১৪. ইসলামে নিষিদ্ধ ভাস্কর্যপ্রীতি শেখানো হচ্ছে
ভাস্কর্য, মূর্তি এগুলো বানানো ইসলামে নিষিদ্ধ। যেহেতু ইসলামে নিষিদ্ধ তাই এগুলোকে জনপ্রিয় করতে হবে এমন মিশন নিয়ে নেমেছে পাঠ্যপুস্তক রচনাকারী ইসলাম বিদ্বেষীরা। বাংলা বইয়ের ২০ নং পৃষ্ঠায় একটি প্রবন্ধ লেখা হয়েছে যার নাম 'কত দিকে কত কারিগর', লিখেছেন সৈয়দ শামসুল হক। এখানে ভাস্কর্য নির্মাতাদের গুরুত্ব দিয়ে তাদের তথাকথিত শিল্পকর্মের প্রতি আগ্রহী করে তোলা হয়েছে।


এছাড়াও বিজ্ঞান বইতে শিলা/পাথর বিষয়ে পড়ানোর সময় অপ্রাসঙ্গিক ভাবে ভাস্কর্যের ছবি উপস্থাপন করা হয়েছে। ৭ম শ্রেণির বিজ্ঞান বইয়ের ১৩১ পৃষ্ঠা ও ১৩২ পৃষ্ঠায় শিলার আলোচনায় যথাক্রমে আব্রাহাম লিংকন ও মাইকেল এঞ্জেলোর 'ডেভিডে'র ভাস্কর্যের ছবি দেওয়া হয়েছে। পুরোটাই অপ্রাসঙ্গিক তবে উদ্দেশ্য প্রণোদিত।



প্রসঙ্গক্রমে বলা যায়, শুধু পাঠ্যপুস্তকে নয়, সারা বাংলাদেশে শেখ মুজিবের ভাস্কর্য দিয়ে ভরিয়ে দেওয়া হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় তো মূর্তির হাট বসিয়ে দেওয়া হয়েছে। মনে হয় আইয়ামে জাহেলিয়ার যুগে মক্কাও এতো মূর্তি ছিল না যতটা আছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায়। এটা নিঃসন্দেহে গর্হিত ও শরিয়তবিরুদ্ধ কাজ।

আত্মঘাতী এই শিক্ষাব্যবস্থা ও পাঠ্যসূচির বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে হবে। নইলে আমাদের সন্তানেরা মুশ*রিকদের সংস্কৃতিতে অভ্যস্ত হয়ে পড়বে। প্রতিটি মানব জনগোষ্ঠীর পদস্থলনের ব্যাপারে লক্ষ্য করা যায় যে, তাওহীদবাদী মুসলিমরা নিজেদের মধ্যে তাওহীদের চর্চা একনিষ্ঠ না করার ফলে ধীরে ধীরে মুশ*রিকে পরিণত হয়েছে। আমরা যদি আমাদের পরিণতি সেরকম করতে না চাই, জাহান্নাম থেকে আমাদের ও আমাদের সন্তানদের বাঁচাতে চাই তবে এই শিক্ষাক্রমের বিরুদ্ধে কথা বলতে হবে।


২০ জানু, ২০২৩

হিন্দুত্ববাদের কবলে পাঠ্যপুস্তক পর্ব ০১ (ষষ্ঠ শ্রেণি)


আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা ও পাঠ্যপুস্তক নিয়ে দীর্ঘদিন থেকেই ষড়যন্ত্র চলছে। মাঝে মাঝেই বামপন্থী ও হিন্দুত্ববাদী সরকার শিক্ষাব্যবস্থা পরিবর্তনের নামে ক্রমেই হিন্দুত্ববাদ ও নাস্তিক্যবাদ ছড়াচ্ছে। আমাদের শিশুদের মধ্যে তাদের কু-প্রভাবকে প্রতিষ্ঠিত করছে। আজ ষষ্ঠ শ্রেণির বইগুলো নিয়ে কিছু আলোচনা করবো। মোটাদাগে পাঠ্যপুস্তকের সমস্যা হলো হিন্দুত্ববাদ ছাড়ানো, ইসলামী অনুশাসনের বিরোধীতা, মুসলিম জাতি হিসেবে পাঠ্যপুস্তকে মুসলিমদের প্রতিনিধিত্বের অভাব, ইংরেজদের আধুনিক হিসেবে উপস্থাপন ইত্যাদি। সবচেয়ে সমস্যাযুক্ত বই হলো সামাজিক বিজ্ঞান।

১. সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম পরিচয়ের প্রতিনিধিত্ব নেই।
পাঠ্যপুস্তকের মাধ্যমে আমাদের মুসলিম সন্তানেরা তাদের আত্মপরিচয় জানবে এবং নিজস্ব সংস্কৃতিতে গড়ে উঠবে। দুঃখজনকভাবে আমাদের পাঠ্যপুস্তকে আমাদের মুসলিম পরিচয় অনুপস্থিত। মুসলিম পরিচয়কে প্রতিনিধিত্ব করে এমন কোনো প্রবন্ধ, গল্প, কবিতা ও ইলাস্ট্রেশন নেই। উল্টো মুসলিম পরিচয়ের সাথে সাংঘর্ষিক কন্টেন্ট এড করা হয়েছে। ঢাকাকে বলা হয় মসজিদের শহর। অথচ পুরো সামাজিক বিজ্ঞান বইয়ে মসজিদের ছবি নেই। বিপরীতে আছে প্রচুর মন্দিরের ছবি। বাংলাদেশ পৃথিবীর ৩য় বৃহত্তম মুসলিম জনগোষ্ঠীর দেশ। অথচ আমাদের বাচ্চাদের পাঠ্যবই দেখে মনে হবে এরা মুসলিম না, সবাই মূর্তিপূজারি।

২. হিন্দুত্ববাদের প্রশংসা করা হয়েছে।
এদেশে ব্রাহ্মণ্যবাদী আর্যরা এসেছে ইরান মতান্তরে জার্মানী থেকে। তারা এসে এই অঞ্চলের আদি বাসিন্দাদের ওপর অবর্ণনীয় অত্যাচার চালিয়েছে। তাদের এই অত্যাচারের ভিত্তি ছিল বর্ণপ্রথা। তারা নিজেদের বড় মনে করতো। স্থানীয়দের অচ্যুত, নীচু মনে করতো। স্থানীয়দের সাথে তাদের আচরণ ছিল মানবতার জন্য চরম অপমানের। জাত পাত ও বর্ণভেদ করে তারা মানুষকে মানুষের মর্যাদা দিত না। ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শুদ্র এর চার ভাগে তারা মানুষকে ভাগ করেছে। শুদ্রদের তারা ঘৃণা করতো। তাদের সাথে একসাথে বসবাস, কথা বলা ইত্যাদি তো দূরের কথা। শুদ্ররা তাদের ছাড়া মাড়ালেও তারা তাদের শাস্তি দিত। বর্তমান পাঠ্যপুস্তকে আর্যদের এই বর্ণপ্রথাকে পজেটিবলি উপস্থাপন করা হয়েছে।




ষষ্ঠ শ্রেণির সামাজিক বিজ্ঞান বইতে ১২৫ পৃষ্ঠায় আর্যদের বর্ণপ্রথা সম্পর্কে বলা হয়েছে //আর্যরা যেহেতু শ্রেষ্ঠ ও সবচেয়ে ভালো, অনার্য বা অন্যান্য রেইসকে তাদের অধীনে ও শাসনে থাকলে অনার্যরাও উন্নতি করতে পারবে তাড়াতাড়ি- এই ছিল তাদের যুক্তি। অনেকে তখন তাদের এই ধারণাকে সঠিক বলে মনে করেছিলেন।//

এভাবে আমাদের বাচ্চাদের কাছে মানবতাবিরোধী ব্রাহ্মণ্যবাদীদের পজেটিবলি উপস্থাপন করা হয়েছে। এই ধরনের শয়তানি কোনো জাত হিন্দু রাজনৈতিক সভায়ও বলতে পারেনি। অথচ আমাদের পাঠ্যক্রমে তা সংযুক্ত করা হয়েছে। ইসলাম এসেছে মানুষের গোলামি থেকে মানুষকে মুক্ত করে মানবতার জয় নিশ্চিত করতে। সেখানে মুসলিমের সন্তানেরা ব্রাহ্মণ্যবাদীদের কবলে পড়ে গেল। এটা খুবই এলার্মিং।

৩. হিন্দুয়ানী ভাষা ও কালচারকে প্রধান্য দেওয়া হয়েছে।


বাংলায় মুসলিম ও হিন্দুদের মধ্যে ভাষাগত সামান্য কিছু প্রার্থক্য রয়েছে। যদিও সেগুলো শব্দ হিসেব ইসলামী শরিয়তে ম্যাটার করে না। কিন্তু সাংস্কৃতিক দিক থেকে ম্যাটার করে। যদি কোনো শব্দ, পোষাক ও আচরণ কোনো মুশরিক গোষ্ঠীকে প্রতিনিধিত্ব করে তবে সেটা ব্যবহার আমাদের জন্য নিষিদ্ধ। যেমন বাংলার মুসলিমরা 'পানি'কে 'পানি' বলে, অন্যদিকে হিন্দুরা এটাকে 'জল' বলে। আমাদের ভাষাগত সংস্কৃতিতে এটা পানি, জল নয়। এদেশের নব্বই শতাংশ মানুষের ব্যবহার করা শব্দ পানি কিন্তু পাঠ্য প্রায়ই এই পানি শব্দটাকে জল হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে। এটা হিন্দুত্ববাদী সাংস্কৃতিক আগ্রাসন। ৬ষ্ঠ শ্রেণির বিজ্ঞান অনুশীলন বইয়ের ৫২ নং পৃষ্ঠায় একটি অধ্যায়ের নাম করা হয়েছে রোদ, জল, বৃষ্টি। এটা সুস্পষ্ট হিন্দুত্ববাদী সাংস্কৃতিক আগ্রাসন।

৪. দেব-দেবীর পরিচয়গুলো হাইলাইট করা হয়েছে।
৬ষ্ঠ শ্রেণির সামাজিক বিজ্ঞানের পুরো বইতেই খুব দৃষ্টিকটুভাবে লক্ষ্য করা গেছে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর দেব-দেবীর নাম। সামাজিক বিজ্ঞান বই পড়ে একজন ছাত্রের স্বাভাবিকভাবে মাথায় যে বিষয়টা ইন্সটল হবে তা হলো, মানবজাতির সভ্যতার ইতিহাস মানেই হলো মূর্তিপূজার ইতিহাস। দেব দেবীকে শুধু পরিচয় করিয়ে দেওয়া নয়, তাদের প্রতি যাতে ভক্তি আসে সেই ব্যবস্থাও করা হয়েছে সামাজিক বিজ্ঞান বইতে।


সামাজিক বিজ্ঞান বইয়ের ৫১-৭৬ পৃষ্ঠায় মিসরীয় সভ্যতা নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। পুরো আলোচনায় মিসরের শাসক ফেরাউনদের উন্নত সভ্যতা(!), উন্নত সংস্কৃতি, তাদের দেব-দেবী ও উন্নয়ন নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। অথচ ওরা যে মানবতার দুশমন ছিল তা এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। এদেশের মুসলিমরা ফেরাউনদের বিরুদ্ধে কথা বলে তাই পাঠ্যক্রমে মূর্তিপূজারী ফেরাউনদের উন্নত ও সভ্য জাতি হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে।




সামাজিক বিজ্ঞানের ৭৭ পৃষ্ঠায় মেসোপটেমীয় সভ্যতার কথা বর্ণনা করা হয়েছে। এই সভ্যতার কথা উল্লেখ করতে গিয়ে বলা হয়েছে দেব দেবীর অংশীদারিত্বের মাধ্যমে এই সভ্যতা তৈরি হয়েছে। অথচ সভ্যতাগুলো তৈরি হয়েছে ওহীর ভিত্তিতে ও একেশ্বরবাদের ভিত্তিতে।




রোমানদের সভ্যতা বিস্তার লাভ করেছে ঈসা আ. -এর অনুসরণের মাধ্যমে। অথচ সেটাকে কম গুরুত্ব দিয়ে বহু পূর্বের মুশরিকি ধারণাকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। রোমানদের দেব দেবীর নাম মুখস্ত করানো হচ্ছে। সামাজিক বিজ্ঞান বইয়ের ১০৫ পৃষ্ঠায় এগুলো উল্লেখ রয়েছে।


গ্রিক সভ্যতার ক্ষেত্রে শুধু দেব দেবীর নাম নয়। তাদের কাজ ও ক্ষমতার বর্ণনা দেওয়া হয়েছে। মনে হবে আপনি সামাজিক বিজ্ঞান বা ইতিহাস পড়ছেন না। গ্রিক ধর্মগ্রন্থ পড়ছেন। ইলাস্ট্রেশনের মাধ্যমে তাদের চিত্রও উপস্থাপন করা হয়েছে। সামাজিক বিজ্ঞান বইয়ের ৯৯-১০০ পৃষ্ঠায় এসব বর্ণনা রয়েছে।

সামাজিক বিজ্ঞান বইটা মারাত্মকভাবে দূষণীয়। এই বই পড়লে মনে হবে মানবজাতির ইতিহাস মানেই হলো মূর্তিপূজা, দেব দেবীর ইতিহাস। পৃথিবীতে গড়ে উঠেছে মুশরিকদের ও মূর্তিপূজারীদের মাধ্যমে। এভাবে আমাদের শিশুদের মাথায় তারা বিষ ঢালছে।

৫. পরিকল্পিতভাবে মুসলিম বিদ্বেষ যুক্ত করা হয়েছে।
পাঠ্যবইয়ে মুসলিম সমাজ ও ইসলামের কোনো প্রতিনিধিত্ব তো নেইই, উল্টো পরিকল্পিতভাবে মুসলিম সমাজ ও ইসলামের প্রতি বিষোদগার করা হয়েছে। ষষ্ঠ শ্রেণির বাংলা বইয়ের ৭১ পৃষ্ঠায় সেলিনা হোসেনের একটি প্রবন্ধ রয়েছে রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন নামে। সেখানে ইচ্ছেকৃতভাবে মুসলিম সমাজের প্রতি ঘৃণা ছড়ানো হয়েছে। একইসাথে ইসলামের অত্যাবশ্যকীয় বিধান 'পর্দার' ব্যাপারেও ঘৃণা ছড়ানো হয়েছে।

অথচ বাস্তবতা হলো এই দেশে ব্রাহ্মণ্যবাদী আর্য হিন্দুরা বৈশ্য ও শুদ্রদের পড়ালেখার সুযোগ থেকে বঞ্চিত রেখেছে। ইখতিয়ার উদ্দিন মু. বিন বখতিয়ার খলজির মাধ্যমে এদেশের নির্যাতিত হিন্দু সমাজ, বৌদ্ধ ও মুসলিমরা মুক্তি পেয়েছে ব্রাহ্মণ্যবাদী সেনদের কবল থেকে।

মুসলিমদের বিজয়ের মাধ্যমে এদেশের সব মানুষের জন্য পড়ালেখার দ্বার উন্মুক্ত হয়। মুসলিম শাসকরা মাদরাসা (বিদ্যালয়), জামিয়া (বিশ্ববিদ্যালয়), খানকাহ ও মক্তবের জন্য লাখেরাজ সম্পত্তি বরাদ্দ করে। এর মানে হলো এসব প্রতিষ্ঠানকে করমুক্ত বিশাল জমি দান করা হতো। সেসব জমি থেকে আয় করে প্রতিষ্ঠানগুলো চলতো। ১৭৫৭ সাথে ইংরেজরা দখল করে নেয়ার পর সারা বাংলায় লাখেরাজ সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হয়। ইংরেজদের থাবায় বাংলার সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যায়। যারা গোপনে শিক্ষা কার্যক্রম চালু রেখেছে তাদেরকেও হত্যা করা হয়। প্রায় ১০০ বছর এভাবে চলার পর ইংরেজরা তাদের মতো করে পাশ্চাত্য শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করে। মুসলিমরা সেই পাশ্চাত্য শিক্ষানীতিকে বয়কট করে যেখানে মিথ্যা শিক্ষা দেওয়া হতো।

৬. ইংরেজ লুটেরাদেরকে সম্মানিত করা হয়েছে।
অবাক বিস্ময়ের সাথে লক্ষ্য করলাম সামাজিক বিজ্ঞান বইতে ইংরেজ লুটেরা ও ডাকাতদের প্রশংসা করা হয়েছে। তাদের হাজারো অপকর্মের কথা আড়াল করে অনেকটা তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশের ভাব লক্ষ্য করা গেছে। সামাজিক বিজ্ঞান বইয়ের ৪ নং পৃষ্ঠায় ইংরেজ আমলকে আধুনিক আমল হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। ব্রিটিশরা নাকি এখানে উপনিবেশ করে আমাদের আধুনিক কিছু শিখিয়েছে।

অথচ বাস্তবতা হলো, ব্রিটিশরা এখানে উপনিবেশ করে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দিয়েছে। সেসময় আমাদের শিল্প অনেক উন্নত ছিল। আমাদের কাপড় তাদের কাপড়ের চাইতে ভালো ছিল। তারা আমাদের কাপড়ের সকল শিল্প কারখানা বন্ধ করে দিয়েছে। আমাদের কারিগরদের হাত কেটে দিয়েছে যাতে তারা গোপনেও শিল্প কার্যক্রম চালু রাখতে না পারে। আমাদের শুধু কৃষিজীবি বানিয়ে ছেড়েছে। পৃথিবীর সম্পদশালী একটি অঞ্চল থেকে আমরা সবচেয়ে দরিদ্র অঞ্চলে পরিণত হয়েছি।

৭. আওয়ামী লীগের দলীয় বইয়ের রূপ দেওয়া হয়েছে।
প্রতিটি বইয়ের ২য় পৃষ্ঠায় আওয়ামীলীগের উন্নয়নের ফিরিস্তি দেওয়া হয়েছে যেন এটা পাঠ্যবই নয়, আওয়ামীলীগের দলীয় বুলেটিন। নির্লজ্জ দলীয়করণের মাধ্যমে পাঠ্যবইকেও গ্রাস করেছে আওয়ামীলীগ। এমন হীনকর্ম আইয়ুব খানের মতো স্বৈরাচারও করেনি।

৮. নারীদের কাজের প্রতি অশ্রদ্ধা করা হয়েছে
নারী পুরুষের শারিরীক গঠন ও মননশীলতার জন্য তাদেফ কাজের ভিন্নতা রয়েছে। একজন নারী যেভাবে ধৈর্যের পরিচয় সন্তানকে বড় করেন একজন পুরষের সেই ধৈর্য ও মন নেই। ইসলাম তাই পরিবার পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব নারীদের দিয়েছে। অন্যদিকে পুরুষদের দায়িত্ব হচ্ছে কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে আয় ও উপার্জন করে সংসারের ব্যয় নির্বাহ করবে। পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের নিরাপত্তা দেবে।

বর্তমান সেক্যুলার সমাজের অন্যতম এজেন্ডা পরিবার ভেঙ্গে দেওয়া। এটা শয়তানের প্রধান টার্গেট। পারিবারিক বন্ধনের মাধ্যমে একটি সমাজ গড়ে ওঠে। সভ্য ও উন্নত জাতি হিসেবে পৃথিবীতে কন্টিনিউ করে। পুরুষ ও নারী একে অন্যের পরিপূরক। কিন্তু শয়তান নারী ও পুরুষদের প্রতিযোগী বানিয়ে দিয়েছে।

নারীদের ঘরের কাজকে, পরিবার পরিচালনার কাজকে, সন্তানকে যোগ্য নাগরিকরূপে গড়ে তোলার মহান কাজকে হীন চোখে দেখিয়ে তাদেরকে এই দায়িত্ব থেকে সরিয়ে আনার চেষ্টা করছে। তাদেরকে পুরুষের কাজের প্রতিযোগী বানিয়ে দিচ্ছে। এই এজেন্ডার মূল টার্গেট হলো যাতে পরিবার প্রথা ভেঙ্গে যায়। জীবন ও জীবিকা বইয়ের ২৮ পৃষ্ঠায় জমি চাষ করার একটি ট্রাক্টরের ওপর একজন মহিলাকে উপস্থাপন করা হয়েছে। এটাকে আদর্শ হিসেবে দেখানো। অধ্যায়ের নাম দেওয়া হয়েছে পেশার রূপ বদল।

একই কাজ করা হয়েছে বিজ্ঞান বইতে একেবারের অপ্রাসঙ্গিকভাবে। বিজ্ঞান বইয়ের ৭৬ পৃষ্ঠায় বল ও শক্তি অধ্যায়ের কাভার পেইজে মহিলা ক্রিকেটার সানজিদার ছবি ব্যবহার করা হয়েছে। ফিজিক্সের বল ও শক্তির সাথে সানজিদার এই ছবির কোনো প্রাসঙ্গিকতা নেই। শুধুমাত্র পর্দার বিরুদ্ধে যাওয়ার জন্য ও মহিলাদের দায়িত্ব পরিবর্তনের মাধ্যমে পরিবার ভাঙ্গার এজেন্ডা নিয়ে এই ছবি ব্যবহার করা হয়েছে।

৯. জাতীয়তা ও ধর্ম পরিচয়কে উপেক্ষা করা হয়েছে।
একজন মানুষের বেসিক পরিচয় হয় ভাষা, লিঙ্গ, ধর্ম ও দেশ দিয়ে। সামাজিক অনুশীলন বইয়ের ৪ নং পৃষ্ঠায় শেখানো হয়েছে একজন মানুষ কীভাবে পরিচয় পেতে পারে! সেখানে অনেক হাবিজাবি বিষয় আনা হয়েছে, অথচ জাতীয়তা ও ধর্ম পরিচয়কে উপেক্ষা করা হয়েছে। রুমানা 'সিনেমা দেখে কাঁদে' এটা পরিচয়ের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে অথচ সে কোন ধর্মের? এর কোনো খবর নেই। শুধু তাই নয়, রুমানা যে বাংলাদেশী নাকি অন্য কোনো দেশের এটাও উল্লেখ নেই। তার মানে যারা এই রচনার সাথে জড়িত তারা বাংলাদেশকে স্বীকার করে না? তারা কি হিন্দুত্ববাদী এক ভারতে বিশ্বাসী?

১০. বিতর্কিত ও বৈজ্ঞানিকভাবে প্রত্যাখ্যাত বিবর্তনবাদ দিয়ে ঈমান নষ্ট করা হচ্ছে।
এটা দীর্ঘদিন ধরে চলে আসছে। আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় বিতর্কিত ও বৈজ্ঞানিকভাবে প্রত্যাখ্যাত বিবর্তনবাদ পড়ানো হয়। এদেশের বামপন্থীরা দেশ পরিচালনায় নানানভাবে যুক্ত থাকায় বিবর্তনবাদ আমাদের সিলেবাসে গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করেছে। ধর্মহীনতা ও ইসলাম বিদ্বেষ সৃষ্টি করার জন্য বিবর্তনবাদকে এদেশের বামপন্থীরা নিজেদের তত্ত্ব হিসেবে গ্রহণ করেছে। এর প্রচার ও প্রসারে ভূমিকা রাখছে। সামাজিক বিজ্ঞান বইয়ের ২৪ পৃষ্ঠাও এই মতবাদকে উল্লেখ করে ঈমান নষ্ট করার কাজে মেতেছে। মুসলিম দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় বিবর্তনবাদ কোনোভাবেই স্থান পেতে পারে না।

১১. বিজ্ঞান বইয়ে কুসংস্কারাচ্ছন্ন পুরাণ ও রূপকথার গল্পের প্রচলন
অত্যন্ত বিস্ময়ের লক্ষ্য করেছি বিজ্ঞান বইয়ে পুরাণ ও রূপকথার প্রচলন ঘটানো হয়েছে। বিজ্ঞান অনুশীলনের ১১ পৃষ্ঠায় তারার বিন্যাস নিয়ে আলোচনায় কুসংস্কারাচ্ছন্ন পুরানের গল্প উপস্থাপন করা হয়েছে। শুধু তাই নয়, ছাত্রদেরও কাজ দিয়েছে যাতে তারা এমন কাল্পনিক গল্প বানায়। কাল্পনিক কাহিনী বানানো এখন বিজ্ঞান বইয়ের অনুশীলন! বিজ্ঞান বইতেও তারা পুরাণকে ঢুকিয়েছে। বিজ্ঞান অনুশীলন বইয়ের ১৩৬ পৃষ্ঠায় জাফর ইকবাল একটি রূপকথার গল্প লিখেছে। এটাও দেখতে হলো! বিজ্ঞান বইকে রূপকথার বই বানানোর অপচেষ্টা।

জামায়াত ও ছাত্রশিবির দীর্ঘদিন থেকে শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে কথা বলে যাচ্ছে ও কাজ করে যাচ্ছে। সেক্যুলার শিক্ষা বাদ দিয়ে আমরা একটি সমন্বিত ধর্মীয় ও কর্মমূখী শিক্ষাব্যবস্থা চাই। যে শিক্ষা ব্যবস্থায় একজন ছাত্র আদর্শ মুসলিম, দায়িত্ববান নাগরিক ও সৃজনশীল উদ্যোক্তা হতে পারবে। এই শিক্ষাব্যবস্থার কথা বলতে গিয়ে শাহদাতবরণ করেছেন শহীদ আব্দুল মালেক রহ.।





৮ জানু, ২০২৩

খিলাফত পর্ব-৪২ : ভয়ংকর ফিতনার মধ্যে খলিফা নির্বাচিত হলেন আলী রা.

 


উসমান রা. অবরুদ্ধ থাকা অবস্থায় মদিনাবাসী বিদ্রোহীদের অবস্থানকে অন্যায্য মনে করেনি। সবাই ভেবেছিল মারওয়ানকে শাস্তি দেওয়া কিংবা বিভিন্ন প্রদেশে থাকা উমাইয়া গভর্নরদের প্রত্যাহারের মাধ্যমে এই সমস্যার সমাধান হবে। কিন্তু উসমান রা.সহ সাহাবাদের একটা অংশ ভেবেছে আন্দোলনকারীরা মিথ্যা ও জাল চিঠি দিয়ে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে চাইছে। কেউ কেউ ভেবেছেন এটা মারওয়ানের কাজ। আবার কেউ ভেবেছেন উসমান রা. নিজেই বিদ্রোহীদের হত্যার আদেশ দিয়েছেন। 

এই অচলাবস্থার মধ্যে বিদ্রোহীদের কয়েকজন উসমান রা.-কে হত্যা করে। এর ফলে বিদ্রোহীদের কেউ কেউ অনুতপ্ত হলেও মদিনা কার্যত বিদ্রোহীদের অধীনে চলে যায়। বিদ্রোহীরা আরো শক্তিশালী হয়ে ওঠে। আর মদিনার লোকেরা কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে যায়। তারা ভাবতেই পারে নি উসমান রা.-কে খুন করে ফেলা হবে। এতে মদিনাবাসী বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। 

ঘটনা খুনোখুনি পর্যন্ত গড়াতে পারে এমন আশংকা কেউ কেউ তো অবশ্যই করেছেন। এর মধ্যে আলী রা. অন্যতম। তিনি তাঁর দুই ছেলে ও ৭০০ সেনাকে উপস্থিত থেকে খলিফাকে নিরাপত্তা দেয়ার জন্য আদেশ করেছেন। এর মধ্যে হাসান রা. ও হুসাইন রা. উভয়ে উসমান রা.-এর ঘরের অভ্যন্তরে ছিলেন। উসমান রা. নিজের নিরাপত্তা বাদ দিয়ে নিজেকে বিদ্রোহীদের কাছে সমর্পন করেছেন। তিনি বুঝেছিলেন তিনি খুন হবেনই। তাই এই খুনোখুনিকে তিনি বাড়াতে চান নি। নিজের খুনের মাধ্যমেই বিশৃঙ্খলার পরিসমাপ্তি চেয়েছিলেন। 

তিনি তার বাড়ি থেকে সমস্ত প্রতিরক্ষার ব্যবস্থা তুলে দেন। এই প্রতিরক্ষা মূলত আলী রা.-এর নির্দেশে তৈরি হয়েছিল। সর্বশেষ যিনি উসমান রা.-এর বাড়ি থেকে বের হন তিনি হলেন হাসান রা.। এরপর বিদ্রোহীরা উসমান রা.-কে হত্যা করে। হত্যার ফলে মুসলিমরা মোটাদাগে দুই পক্ষ হয়ে গেল। এক পক্ষ বিদ্রোহী, যারা মিশর, কুফা ও বসরা থেকে মদিনায় এসেছে। এদের সমর্থনে মদিনার কিছু লোককেও দেখা যায়। এরা উসমান রা.-এর খুনকে বৈধ ভেবেছে। তাদের দাবি উসমান রা. প্রতারণা করে তাদের হত্যার নির্দেশ হত্যাযোগ্য অপরাধ করেছে। অন্য পক্ষ হলো যারা খলিফা উসমান রা.-এর খুনকে ভয়ংকর অপরাধ বলে বিবেচনা করেছে। তারা এর শাস্তি ও বিদ্রোহীদের দমন চেয়েছিল। বেশিরভাগ সাহাবী ও মদিনাবাসী এই পক্ষে ছিলেন। এই পক্ষের অনেকে মারওয়ান ও উসমান রা.-এর ওপর বিরক্ত থাকলেও তাকে খুন করা বরদাশত করতে পারেন নি। 

এই ফিতনার মধ্যেও দুই পক্ষ এক বিষয়ে মোটামুটি একমত হয়ে গিয়েছে। আর তা হলো আলী রা.-কে নেতা হিসেবে মেনে নেওয়া। ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় আলী রা. নিজেকে গুটিয়ে ফেলেন। তিনি ঘরের মধ্যে দরজা বন্ধ করে অবস্থান করেন। মদিনাবাসী বিশেষ করে সাহাবীদের ডাকে তিনি দরজা খুলতে বাধ্য হন। সাহাবারা তাঁর ব্যাপারে ঐক্যমত পোষণ করে বাইয়াত নিতে থাকেন। এদিকে আমরা আগ থেকেই জানি উসমান রা.-কে প্রত্যাখ্যান করে মিসরের বিদ্রোহীরা আলী রা.-কে খলিফা হিসেবে প্রস্তাব করেছিল। কুফার বিদ্রোহীরা যুবাইর রা.-কে খলিফা হিসেবে দেখতে চেয়েছে আর বসরার বিদ্রোহীরা তালহা রা.-কে খলিফা হিসেবে দেখতে চেয়েছিল। 

তালহা রা. ও যুবাইর রা. প্রথমেই আলী রা.-এর কাছে বাইয়াত নেন। ফলে বসরা ও কুফার লোকদের আলী রা.-কে নেতা মানতে কোনো অসুবিধা হয়নি। আসলে নতুন খলিফা কে হবে এই নিয়ে বিদ্রোহীদের কোনো মাথাব্যথা ছিল না। তারা উসমান রা. ও তার পরিবারের সদস্যদের ব্যাপারে ক্ষুব্ধ ছিল। সর্বসম্মতিক্রমে আলী রা.-এর কাছে মুসলিমরা আনুগত্যের বাইয়াত নিল। তালহা রা. ও যুবাইরা রা.-কে আলী রা. তাঁর পাশে থাকতে বলেছেন। তিনি বলেছেন, তোমরা আমার কাছে অবস্থান করো, আর এতে আমি স্বস্তি বোধ করবো। 

কিছু বর্ণনায় পাওয়া যায়, শুরুতে কয়েক ব্যক্তি আলী রা.-এর কাছে বাইয়াত নেন নি। তারা হলেন, হাসসান বিন সাবিত রা., কা'ব বিন মালিক রা., আসলামা ইবনে মাখলাদ, মুহাম্মদ বিন মাসলামা, নুমান ইবনে বশীর রা., যায়দ বিন সাবিত রা., রাফি বিন খাদিজ এবং কা'ব বিন উজরা রা.। তবে এই কথা কেউ কেউ অস্বীকার করেছেন। তারা বলেছেন ফিতনার সময়ে তারা আলী রা.-কে সাহায্য করেন নি তবে আনুগত্যের বাইয়াত নিয়েছেন। তবে এই কথা নিশ্চিত আলী রা.-এর প্রতি বাইয়াতের ব্যাপারে কেউ বিরোধীতা করেননি। 

সাহাবাদের বাইয়াত গ্রহণের পর আলী রা. জনগণের রায় নিতে চান। এই কারণে তিনি জনগণের উদ্দেশে ভাষণ দেন। তাঁর এই ভাষণ মদিনাবাসী ও তিন প্রদেশ থেকে আগত বিদ্রোহীরা একইসাথে শুনেছে। এর আগে তাঁরা একইসাথে বাইয়াত গ্রহণ করেছেন। আলী রা.-এর খিলাফত গ্রহণ মূলত একটি সমাধানমূলক ও রাষ্ট্রকে স্থিতিশীলতার দিকে নিয়ে গিয়েছিল। 

ভাষণে আলী রা. প্রথমে আল্লাহর প্রশংসামূলক বাক্য উচ্চারণ করেন। যেসব সাহাবী তাঁকে খিলাফত গ্রহণের ব্যাপারে পীড়াপীড়ি করেছিলেন তাদের কথা উল্লেখ করে বলেন, আমি খিলাফতের দায়িত্ব নিতে মোটেই আগ্রহী ছিলাম না। তোমরাই আমাকে এই পদে আসিন হতে বাধ্য করেছ। তোমাদের সাহায্য ছাড়া আমি কোনো কাজই সঠিকভাবে করতে পারবো না। 

হে লোকসকল! খলিফা নির্বাচনের ব্যাপারটি কেবলই তোমাদের নিজস্ব ব্যাপার! তোমাদের মনোনয়ন ছাড়া এতে কারো হস্তক্ষেপ নেই। যে সিদ্ধান্তের ওপর সাহাবাদের বৈঠক শেষ হয়েছে, তোমরা যদি রাজি থাকো তবে সেই সিদ্ধান্ত বহাল থাকতে পারে। অন্যথায় আমার কারো প্রতি কোনো অভিযোগ নেই। তোমরা তোময়াদের নেতা অন্য কাউকে নির্ধারণ করতে পারো। এরপর তিনি সবার উদ্দেশে বলেন, তোমরা কি আমার প্রতি রাজি আছো? উপস্থিত জনগণ সমস্বরে উত্তর করলো, হ্যাঁ। আমরা আপনার ওপর রাজি। 

আলী রা. বললেন। হে আল্লাহ! তুমি সাক্ষী থাকো। 

এরপর সর্বস্তরের জনগণ দলে দলে বাইয়াত নিতে থাকলো। বাইয়াত শেষ হলে তিনি বলেন, তোমরা আমার কাছ থেকে এমন বিষয়ের ওপর বাইয়াত গ্রহণ করেছ যে বিষয়ে তোমরা আমার পূর্বে আমার তিন সুহৃদের (পূর্বের তিন খলিফা) কাছ থেকে নিয়েছ। যেহেতু তোমরা আমার কাছে বাইয়াত নিয়েছ অতএব আমার ব্যাপারে আনুগত্যহীনতার অধিকার নেই তোমাদের। ইমামের জন্য অবিচলতা জরুরি। আর জনগণের জন্য আনুগত্য জরুরি। 

তারপর তিনি তার ভাষণে বলেন, 
নিঃসন্দেহে আল্লাহ তায়ালা এক পথপ্রদর্শক কিতাব নাজিল করেছেন এবং তাতে ভালো-মন্দ স্পষ্ট করে দিয়েছেন। সুতরাং তোমরা ভালোটা গ্রহণ করবে ও মন্দ পরিত্যাগ করবে। আল্লাহ তায়ালা কিছু জিনিস হারাম করেছেন তা স্পষ্ট। মুসলিমদের মর্যাদা ও পবিত্রতাকে হারামের ওপর প্রাধান্য দিয়েছেন। আর মুসলিমদের অধিকারকে বেঁধে দিয়েছেন ইসলাম ও তাওহীদের সঙ্গে। 

আর মুসলিম তো সে ব্যক্তি যার হাত ও জিহবা থেকে অপর মুসলমান নিরাপদ থাকে। অবশ্য সত্য ও ন্যায়ের জন্য তা লঙ্ঘিত হতে পারে।  কোনো মুসলিমকে কষ্ট দেওয়া অপর মুসলিমের জন্য বৈধ নয়। কষ্ট দেওয়া অপরিহার্য হলে ভিন্ন কথা। তোমরা মৃত্যুর কথা বেশি করে চিন্তা করবে। লোকেরা রয়েছে তোমাদের সম্মুখে আর তোমাদের পেছনে রয়েছে কিয়ামত। কিয়ামতই তোমাদের পেছন থেকে হাঁকিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। তোমরা হালকা থাকবে, তাহলে মিলিত হয়ে যাবে। কারণ মানুষের শেষ ঠিকানা তার প্রতিক্ষায় রয়েছে। 

মানুষের (হকের) ব্যাপারে আল্লাহকে ভয় করে চলবে। তাদের (হকের) ব্যাপারে তোমাদের জিজ্ঞাসা করা হবে। এমনকি চতুষ্পদ জন্তু ও জায়গা-জমির ব্যাপারেও জিজ্ঞাসিত হবে তোমরা। অতএব তোমরা আল্লাহর আনুগত্য করবে তার অবাধ্যতা করবে না। ভালো কিছু দেখলে গ্রহণ করবে আর মন্দ দেখলে তা পরিত্যাগ করবে। 

স্মরণ করো, যখন তোমরা ছিলে অল্প। পরাজিত অবস্থায় ছিলে, ভীত সন্ত্রস্ত ছিলে। বিভিন্ন অন্যায় তোমাদের ছোঁ মেরে নিয়ে যেত। তারপর আল্লাহ তোমাদের আশ্রয়ের ঠিকানা দিয়েছেন। স্বীয় সাহায্য দ্বারা তোমাদের শান্তি দিয়েছেন। পরিচ্ছন্ন জীবিকা দিয়েছেন, যাতে তোমরা শুকরিয়া আদায় করো। 

এরপর আলী রা. আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করে ভাষণ শেষ করেন। অস্বস্তিকর মদিনায় স্বস্তির হাওয়া বইতে শুরু করলো। মুসলিমদের মধ্যে যুদ্ধংদেহী মনোভাব দূর হলো। কিন্তু এরপরও স্বস্তির মধ্যে খচ খচ করছে উসমান রা.-এর শাহদাত। হত্যাকারীরা তো নিরাপদে পার পেয়ে যাচ্ছে। উসমান রা.-এর হত্যার বদলা নেওয়ার কথা সাহাবাদের কেউ কেউ উচ্চারণ করছিলেন। উমাইয়া বংশের লোকেরা আলী রা.-কাছে বাইয়াত নিয়েছে। কিন্তু তারা দ্রুতই বিদ্রোহীদের শাস্তি ও হত্যাকারীদের কিসাসের জন্য দাবি তুলেছিল।  

৪ জানু, ২০২৩

মুজিবের ছাত্রলীগ : বাঙালি জাতির ক্যান্সার

 

১৯৩২ সালের কথা। মুসলিম লীগের সাথে কংগ্রেসের একের পর চুক্তি ভঙ্গ ও সকল ঐক্য প্রচেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার প্রেক্ষিতে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দি মুসলিম ছাত্রদের নিয়ে মুসলিম লীগের অধীনে ছাত্রদের একটি সংগঠন অল বেঙ্গল মুসলিম স্টুডেন্টস লীগ গঠন করেন। সভাপতি হন ঢাকার আব্দুল ওয়াসেক, সাধারন সম্পাদক হন যশোরের শামসুর রহমান। ১৯৩৭ সালের নির্বাচনকে কেন্দ্র করে এই দলটি তিন মুসলিম নেতার অনুসারীদের মধ্যে বিভক্ত হয়ে যায়। কলকাতা, হুগলি তথা পশ্চিমবঙ্গ কেন্দ্রীক প্রাধান্য থাকে সোহরাওয়ার্দি ও শেরে বাংলার স্টুডেন্টস লীগ। আবার ঢাকায় থাকে খাজা নাজিমুদ্দিনের স্টুডেন্টস লীগ। 

সেসময় স্টুডেন্টস লীগের সভাপতি পদ ছাত্রদের কাছে থাকতো না। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকরা সভাপতির দায়িত্ব পালন করতেন। সেক্রেটারি হতো মূল ছাত্রদের নেতা। এখন যেরকম ডাকসুতে হয়। ডাকসুর সভাপতি হন ইউনিভার্সিটির ভিসি। আর ভিপি বা ভাইস প্রেসিডেন্ট হলো ছাত্রদের মূল নেতা। ১৯৪৫ সালে অল বেঙ্গল মুসলিম স্টুডেন্টস লীগ তথা ছাত্রলীগের সেক্রেটারি ছিলেন শাহ আজিজুর রহমান। তিনি পরবর্তীতে ১৯৭৯ সালে বাংলাদেশের ৫ম প্রধানমন্ত্রী হন।

১৯৪৭ সালেও অল বেঙ্গল মুসলিম স্টুডেন্টস লীগের নেতা ছিলেন শাহ আজিজুর রহমান। এদিকে শেখ মুজিব ছাত্রলীগে কখনোই যুক্ত ছিলেন না। তিনি মূল সংগঠন মুসলিম লীগে সক্রিয় ছিলেন সোহরাওয়ার্দির অনুসারী হিসেবে। শাহ আজিজ সত্যিকার অর্থেই ছাত্রনেতা ছিলেন। তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্র ছিলেন। তার কারণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা তাকে নেতা হিসেবে মেনে নিতে অসুবিধা হয় নি। 

১৯৪৭ সালে কলকাতা যাতে পাকিস্তানের অংশ হয় এজন্য সোহরাওয়ার্দি চেষ্টা করেছিলেন। শাহ আজিজ ও শেখ মুজিবও একই পক্ষে ছিলেন। কারণ তারা কলকাতার নেতা। ঢাকায় তাদের অবস্থান দুর্বল। কিন্তু বাঙালিদের মধ্যে শেরে বাংলা ফজলুল হক কলকাতাকে পূর্ব-পাকিস্তানের অংশ হতে বিরোধীতা করেছিলেন। অন্যদিকে কংগ্রেস ও হিন্দুরা তো আছেই। অবশেষে মুসলিমদের একটি শহর হিন্দুদের কাছে চলে গেলো। কলকাতাকে মুসলিমদের শহর বলেছি ১৯৩৫ সাল থেকে কলকাতার সব নির্বাচনে মুসলিমরা বিজয়ী হয়েছে। 

১৯৪৭ সালের আগস্টে পাকিস্তান স্বাধীন হলো। কলকাতা হয়ে হিন্দুস্থানের অংশ। কলকাতার মুসলিম নেতারা কলকাতা থেকে ঢাকায় চলে আসলো। সোহরাওয়ার্দি প্রথমে ঢাকায় আসার চেষ্টা করেন। কিন্তু এতদিন সোহরাওয়ার্দির বাধায় কলকাতায় মুসলিমদের নেতা হতে না পারার দুঃখে খাজা নাজিমুদ্দিন সোহরাওয়ার্দিকে ঢাকায় উঠতে দেয়নি। বিশাল জাহাজসমেত সোহরাওয়ার্দি সদরঘাট থেকে ফিরে যেতে বাধ্য হন। তিনি চলে যান করাচি। 

তার অধীনস্ত দুই নেতা শাহ আজিজ ও শেখ মুজিবকে তিনি ঢাকায় পাঠান। শাহ আজিজ যেহেতু পুরো ছাত্রলীগের নেতা ছিলেন তিনি দ্রুতই ঢাকার ছাত্রদের নেতা হয়ে গেলেন। অল্প সময়ের মধ্যে তিনি ঢাকার ছাত্রদের নিয়ন্ত্রণ শুরু করলেন। শাহ আজিজ ও শেখ মুজিব একই নেতার অনুসারী হলেও তারা পরষ্পরের প্রতি সৌহার্দপূর্ণ ছিলেন না। শাহ আজিজ ছাত্রনেতা হিসেবে খ্যাতিমান হলেও শেখ মুজিব মারদাঙ্গা অর্থাৎ সোহওয়ার্দির পেয়াদা হিসেবে খ্যাতিমান ছিলেন। বিশেষত কলকাতায় হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গায় তিনি মুসলিমদের পক্ষে ভূমিকা রেখে নাম করেন। 

শেখ মুজিব শাহ আজিজের এই উত্থান মেনে নিতে পারেনি। শাহ আজিজের মতো তিনিও ঢাবিতে ভর্তি হন। এরপর ফজলুল হক হলে তার মতো মারদাঙ্গাদের একত্র করেন। ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি তিনি তার অনুসারীদের মধ্যে ঘোষণা করেন, যেহেতু পাকিস্তান গঠন হয়েছে। বাংলা ভাগ হয়ে গেছে। তাই আমরা এখন আর অল বেঙ্গল মুসলিম স্টুডেন্টস লীগ দলের নাম থাকতে পারে না। আমাদের দলের নাম হবে ইস্ট পাকিস্তান মুসলিম স্টুডেন্টস লীগ। ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠা বলা হলেও মূলত তা ছিল ছাত্রলীগের ভাঙন। এই দিন ছাত্রলীগ থেকে সন্ত্রাসী ও জঙ্গী ভাবাপন্নরা আলাদা হয়েছিল। শেখ মুজিবের ছাত্রলীগ ১৯৪৮ সালে শাহ আজিজের ছাত্রলীগের সাথে টেক্কা দিতে পারেনি। তারা কয়েকটি দাঙ্গা-হাঙ্গামায় যুক্ত হয়ে পড়ে এবং মুজিবসহ সবাই এরেস্ট হয়। এটা কার্যত মুখ থুবড়ে পড়ে। 

কিন্তু পরের বছর ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন ঢাকার টিকাটুলীর কেএম দাস লেন রোডের রোজ গার্ডেন প্যালেসে 'পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ' প্রতিষ্ঠিত হয়, যার সভাপতি ছিলেন টাঙ্গাইলের আবদুল হামিদ খান ভাসানী আর সেক্রেটারি শামসুল হক। সহ-সভাপতি হন আতাউর রহমান খান, শাখাওয়াত হোসেন ও আলী আহমদ। শেখ মুজিবুর রহমান, খন্দকার মোশতাক আহমদ ও এ কে রফিকুল হোসেনকে যুগ্ম সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব দেওয়া হয়। কোষাধ্যক্ষ হন ইয়ার মোহাম্মদ খান। এসময় শেখ মুজিব কারাগারে অন্তরীণ ছিলেন। অন্যদিকে, পুরো পাকিস্তানের ক্ষেত্রে সংগঠনটির নাম রাখা হয় নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগ। আর এর সভাপতি হন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী।   

এর মাধ্যমে সোহরাওয়ার্দি-ভাসানীর নেতৃত্বে মুসলিম লীগ ভেঙে আওয়ামী মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠা হয়। মুজিব এর সাথে সম্পর্কিত হয়ে যায়। শাহ আজিজ আওয়ামী মুসলিম লীগে যোগ দিতে অস্বীকার করে। আওয়ামী লীগে গণজোয়ার তৈরি হয়। আওয়ামী লীগের ছাত্র সংগঠন হয় শেখ মুজিবের ছাত্রলীগ। ভাসানী ও সোহরাওয়ার্দির জনপ্রিয়তার কারণে শাহ আজিজের ছাত্রলীগ অল্প সময়ের মধ্যে বিলুপ্ত হয়। কারণ ছাত্রলীগের বেসিক পৃষ্ঠপোষক ছিলেন সোহরাওয়ার্দি। তাই শেখ মুজিবের ছাত্রলীগে অন্যান্য ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা সমবেত হয়।

শেখ মুজিবের ছাত্রলীগের ১ম সভাপতি হন দবিরুল ইসলাম এবং সেক্রেটারি হন খালেক নেওয়াজ খান। এরা দুজন ছাত্রলীগের নেতৃত্ব দেন ৫২ সাল পর্যন্ত। শেখ মুজিবের সাথে মতবিরোধ করে তারা ইস্ট পাকিস্তান মুসলিম স্টুডেন্টস লীগ ও অল পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ ত্যাগ করে শেরে বাংলার কৃষক-শ্রমিক পার্টিতে যোগদান করেন। 

১৯৫৬ সালে মাওলানা ভাসানী ও বামপন্থীদের চাপে 'ইস্ট পাকিস্তান মুসলিম স্টুডেন্টস লীগ' ও 'অল পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ' উভয় সংগঠনের নাম থেকে 'মুসলিম' শব্দটি বাদ দেওয়া হয়। ১৯৭১ সালের পর 'ইস্ট পাকিস্তান স্টুডেন্টস লীগ' নাম পরিবর্তন করে হয় 'বাংলাদেশ ছাত্রলীগ'। 

১৯৩২ সালে প্রতিষ্ঠিত ছাত্রলীগ ১৯৪৮ সালের আগ পর্যন্ত দাঙ্গাবাজী আচরণ করার রেকর্ড নেই। তাদের কাজ ছিল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মুসলিম ছাত্রদের অধিকার আদায়। ১৯৪৮ সালে শেখ মুজিবের ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠা হলে শুরু হয় দাঙ্গা হাঙ্গামা। প্রথমে তারা চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের দাবি দাওয়া নিয়ে ঢাবি শিক্ষকদের ওপর আক্রমণ করে। তাদের ক্যম্পাসে ও কোয়াটারে হেনস্তা করে। এর প্রেক্ষিতে একাংশ গ্রেপ্তার হয়। ভাষা আন্দোলন নিয়েও তারা বাড়িবাড়ি করে। উর্দুপক্ষীয়দের ওপর আক্রমণ করে। সচিবালয়ে আক্রমণ করে। 

এর ধারাবাহিকতা বিদ্যমান থাকে আজ পর্যন্ত। পাকিস্তান আমল থেকেই ছাত্রলীগ সন্ত্রাসী কার্যক্রমে যুক্ত। বিপক্ষীদের মারধর, ফাও খাওয়া ও চাঁদাবাজি করা ছিল তাদের আইকনিক কাজ। শেখ মুজিবকে আওয়ামী লীগের সভাপতি বানাতে তারা আওয়ামী লীগ সভাপতি আব্দুর রশিদ তর্কবাগীশকে মারধর করে অফিস থেকে বের করে দেয়। তর্কবাগীশকে বের করে দিয়ে ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীদের ওপর ভর করে শেখ মুজিব জোরপূর্বক নিজেকে আওয়ামীলীগের সভাপতি ঘোষণা করে।     
 
১৯৬৮ সালে আইয়ুবপন্থী ছাত্রনেতা সাইদুর রহমানকে (পাচপাত্তু) খুন করে ছাত্রলীগ ঢাবিতে খুনের রাজনীতি শুরু করে। স্বাধীনতার পর ৭২ সাল থেকে সকল অপকর্ম শুরু করে ছাত্রলীগ। এর মধ্যে ছাত্র ধর্ষণ, চাঁদাবাজী, টেন্ডারবাজী, মাদক সেবন ও ব্যবসা এবং খুনের মতো সব জঘন্য অপরাধ শুরু করে। এটা এখনো চলমান। ৭৪ সালে ছাত্রলীগ আভ্যন্তরীণ কোন্দলে মহসিন হলে একসাথে ৭ জনকে খুন করে বৃহৎ খুনের নজির স্থাপন করে। ৯৯ সালে জাবিতে শত নারী ধর্ষণ করে ধর্ষণের সেঞ্চুরি উদযাপনের মতো ভয়ংকর কাজ করে ছাত্রলীগ নেতা মানিক।  

ইডেন মহিলা কলেজের মেয়েদের মধ্যে যাদের ঢাকায় থাকার ব্যবস্থা নেই এবং যারা বাসা ভাড়া করে থাকার সামর্থ রাখে না তারাই বাধ্য হয়ে কলেজের হোস্টেলে থাকতে হয়। হোস্টেলে থাকতে বাধ্য হওয়া মেয়েদের ছাত্রলীগের কাছে জিম্মি হয়ে থাকতে হয়। ছাত্রলীগের কথামত না চললে তারা হোস্টেলে থাকতে পারে না।

ছাত্রলীগের নেত্রীরা প্রথমত নতুন ছাত্রীদের থেকে চাঁদা কালেকশন করে। বিভিন্ন মিছিল সমাবেশে তাদের যেতে বাধ্য করে। দ্বিতীয়ত তাদের মধ্যে যাদের চেহারা ভালো তাদেরকে ছাত্রলীগ, যুবলীগ ও আওয়ামীলীদের নেতাদের বাসায় এবং আবাসিক হোটেলে যেতে বাধ্য করে। তৃতীয়ত নতুন ছাত্রীদের মধ্যে যারা রাজনৈতিক সচেতন তাদেরকে বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা ও দেহব্যবসার লভ্যাংশ দিয়ে লাঠিয়াল বানায়। এই লাঠিয়ালরাই কয়েকবছর পর নেত্রী হয়ে যায় ও উপরোক্ত কাজগুলো করে। এভাবে জঘন্য দেহব্যবসা ও এর নেটওয়ার্ক তৈরি করেছে মুজিবের ছাত্রলীগ। 

বাংলাদেশে এমন কোনো পাবলিক উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নেই যেখানে ছাত্রলীগের সন্ত্রাসী নেটওয়ার্ক পৌঁছে নি। প্রত্যেকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের খুনের নজির রয়েছে। এছাড়াও মাদক নেটওয়ার্ক তৈরি, পরীক্ষায় অবৈধ সুবিধা নেওয়া, শিক্ষকদের লাঞ্ছনাসহ হেন কোনো অপরাধ বাকী নেই যা ছাত্রলীগ করে নি। দেশের মেধাবী ছাত্রদের অপরাধ কার্যক্রমে বাধ্য করে তাদের শীর্ষ সন্ত্রাসীতে পরিণত করছে মুজিবের ছাত্রলীগ। 

এভাবে শেখ মুজিব একটি ক্যান্সারের জন্ম দিয়ে এদেশের তরুণদের সন্ত্রাসী বানিয়ে যাচ্ছে। প্রতিনয়ত তরুণরা প্রথমে বাধ্য হয়ে ছাত্রলীগ করে পরে একজন দাগী সন্ত্রাসী হিসেবে আবির্ভূত হয়।

৩ জানু, ২০২৩

সুদী লেনদেনে জড়িয়েছে ইসলামী ব্যাংক

 


পৃথিবীজুড়ে লেনদেনকে সহজ করার জন্য ব্যাংকব্যবস্থা চালু হওয়ার মাধ্যমে সারা পৃথিবীতে মুসলিমরাও ব্যবসায়ের কাজে সুদী লেনদেনে জড়িত হতে বাধ্য হয়েছে। সেই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য পৃথিবীর বিখ্যাত ইসলামী স্কলাররা ইসলামী ব্যংকিং সিস্টেম চালু করেছেন। এরই ধারাবাহিকতায় প্রথমে মিশরে 'মিটগামার ব্যাংক' নামে ইসলামী ব্যংক চালু হয়।

জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশের প্রচেষ্টায় এদেশের ইসলামপন্থী মানুষদের সহায়তায় ১৯৮৩ সালের ৩০ মার্চ বাংলাদেশে ইসলামী ব্যাংকিং ধারার ১ম ব্যাংক ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড চালু হয়। ইসলামী ব্যাংকের বেসিক উদ্দেশ্য ছিল বাংলাদেশের জনগণকে সুদের জাল থেকে রক্ষা করা। সুদকে বাদ দিয়ে ব্যাংকিং-এর যাবতীয় সুবিধা পাওয়ার ব্যবস্থা করা।

১৯৭১ সালে পটপরিবর্তনের মাধ্যমে মুক্তিযোদ্ধারা বাংলাদেশকে সেক্যুলার/ ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হিসেবে চালু করায় বাংলাদেশ ইসলামকে বাদ দিয়েছে। সুদী ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। বাংলাদেশ ব্যাংক তাই ইসলামী ব্যাংকগুলোর জন্য আলাদা নীতি প্রবর্তন করেনি। বাংলাদেশের মানুষ ইসলামপ্রিয় হওয়ায় ও এর পরিচালনায় জামায়াত সংশ্লিষ্ট মানুষরা যুক্ত থাকায় ইসলামী ব্যাংক জনগণের আস্থা অর্জন করেছে। ফলশ্রুতিতে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশের সেরা ব্যাংকে পরিণত হয়েছে। এর আমানত, রেমিটেন্স, বিনিয়োগ এবং লাভ সবচেয়ে বেশি।

২০০৮ সালে পাতানো নির্বাচনের মাধ্যমে স্বৈরাচার হাসিনা ক্ষমতায় এসে জামায়াতের ওপর নির্যাতনের স্টিমরোলার চালিয়েছে। শীর্ষ নেতাদের খুন করেছে। জামায়াত সংশ্লিষ্ট সকল আর্থিক প্রতিষ্ঠান দখল করেছে। এর ধারাবাহিকতায় ২০১৭ সালের জানুয়ারিতে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর গোয়েন্দা সংস্থা ডিজিএফআই ইসলামী ব্যাংকের চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যান এবং এমডিকে বাসা থেকে তুলে নিয়ে ডিজিএফআই সদর দপ্তর ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে আসে।

সেখানে একজন গোয়েন্দা কর্মকর্তা তাদের পদত্যাগ পত্র এগিয়ে দিয়ে তাতে স্বাক্ষর করতে বলেন। বাধ্য হয়ে তারা পদত্যাগ পত্রে স্বাক্ষর করে চলে আসেন। এরপর গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের উপস্থিতিতেই সেনাবাহিনী পরিচালিত একটি হোটেলে (হোটেল রেডিসন ব্লু ) সভা ডেকে ইসলামী ব্যাংকের নতুন পরিচালনা পরিষদ গঠন করা হয়।

এভাবেই শুরু হয় বাংলাদেশের সবচেয়ে ব্যবসাসফল ও বড় ব্যাংক ইসলামী ব্যাংকের দুর্ভাগ্যের সূচনা। ৭ বছর আগে সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় এস আলম গ্রুপ যখন ইসলামী ব্যাংক দখল করে তখন ইসলামী ব্যাংকে মানুষের আমানত সবচেয়ে বেশি ছিল। মালিকানা দখল করে এস আলম গ্রুপ নামে বেনামে ভুয়া কাগজপত্র দেখিয়ে জামানত ছাড়াই হাজার হাজার কোটি টাকা ঋণ নেয় ইসলামী ব্যাংক থেকে।

বিধি বহির্ভূতভাবে ঋণ বিতরণ করে ইসলামী ব্যাংক তারল্য সংকটে পড়ে। এর মধ্যে জনগণ বিভিন্ন গণমাধ্যমে এস আলম গ্রুপের আগ্রাসী ভূমিকার কথা জেনে তাদের আমানত তুলে নিচ্ছে। এতে সংকট আরো ঘণীভূত হয়েছে। এখন ইসলামী ব্যাংক তারল্য ঘাটতি কাটাতে বাধ্য হয়ে সুদের ভিত্তিতে আমানত নিচ্ছে। এর মাধ্যমে ইসলামী ব্যাংক তার লক্ষ্যচ্যুত হয়েছে। তার লক্ষ্যই ছিল সুদ এড়ানো। এখন তারা তাদের লেনদেনে সুদকে জড়িত করেছে। অর্থাৎ ইসলামী ব্যাংক এখন সুদী ব্যাংকে পরিণত হয়েছে।

ইসলামী ব্যাংক এতদিন আমানত গ্রহণ করতো মুদারাবা সিস্টেমে। মুদারাবা হল ইসলামি শরীয়াহ সম্মত এক ধরনের অংশীদারি ব্যবসায় পদ্ধতি, যেখানে একপক্ষ মূলধন সরবরাহ করে এবং অপর পক্ষ মেধা ও শ্রম দিয়ে উক্ত মূলধন দ্বারা ব্যবসা পরিচালনা করে। যে পক্ষ মূলধন সরবরাহ করে তাকে সাহিব-আল-মাল বলে এবং ব্যবসায় পরিচালনাকারীকে বলা হয় মুদারিব বলে। এক্ষেত্রে, ব্যবসায়ে মুনাফা হলে পূর্ব চুক্তি অনুসারে বা আনুপাতিক হারে উভয়পক্ষের মাঝে মুনাফা বণ্টিত হয় এবং ব্যবসায় লোকসান হলে মূলধন সরবরাহকারী বা সাহিব-আল-মাল উক্ত লোকসান বহন করে। অন্যদিকে, ব্যবসায় পরিচালনাকারী বা মুদারিব তার মেধা ও শ্রমের বিনিময়ে কোনো পারিশ্রমিক পায় না, যা তার লোকসান হিসেবে গণ্য হয়। তবে যদি মুদারিব কর্তৃক নিয়ম লঙ্ঘন, অবহেলা বা চুক্তিভঙ্গের কারণে লোকসান হয় তাহলে মুদারিবকেই লোকসানের দায় বহন করতে হয়।

তারল্য সংকট এড়াতে ইসলামী ব্যাংক গত মাসে অর্থাৎ ২০২২ সালের ডিসেম্বরে 'নগদ'-এর কাছ থেকে ৮% সুদে ৮ হাজার কোটি টাকা ঋণ চেয়েছে। অন্যদিকে নগদও তা দিতে রাজি হয়েছে। শুধু তাই নয়, বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র মো. মেজবাউল হক জানিয়েছেন, গত ২৮ ডিসেম্বর ৫ হাজার ১০১ কোটি টাকা ঘাটতিতে পড়ে ইসলামী ব্যাংক। সেজন্য তারা ৮.৭৫% সুদে জরুরি ভিত্তিতে ৮ হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে ইসলামী ব্যাংক।

এই ঘটনা ইসলামী ব্যাংকের জন্য প্রথম। প্রতিষ্ঠার পর থেকে তাদের কখনোই অন্যান্য ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়ার প্রয়োজন হয় নাই। কারণ এই ব্যাংকের আমানতদাতা ছিল বেশি। আর সুদের ভিত্তিতে ঋণ নেয়ার তো প্রশ্নই আসে না। সুদ রিলেটেড ইসলামী ব্যাংকের প্রবলেম ছিল ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ ব্যাংকে যে টাকা পরিশোধিত মূলধন হিসেবে জমা রাখতো সেখান থেকে সুদ পেত। এই সুদের টাকা তারা মূল ব্যবসার সাথে না জড়িয়ে বিভিন্ন দান-খয়রাত ও দাতব্য কাজে ব্যয় করতো। এখন ইসলামী ব্যাংক নতুনভাবে সুদের জালে জড়িয়ে পড়েছে। তারা সুদের ভিত্তিতে আমনত নিয়েছে।

ইসলামী ব্যাংকের নানা অনিয়ম আলোচনায় আসার পর ব্যাংকটিতে আমানত কমতে থাকে। এ জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক ইসলামি ধারার ব্যাংকগুলোকে টাকা ধার দিতে বিশেষ উদ্যোগ নেয়। ইসলামী ব্যাংক এত দিন বাংলাদেশ গভর্নমেন্ট ইসলামিক বিনিয়োগ বন্ড ও সুকুক বন্ড জমা দিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে টাকা ধার করলেও এখন সেই সুযোগও শেষ হয়ে এসেছে। কারণ, টাকা ধার করতে ব্যাংকটির হাতে আর বন্ড ও সুকুক নেই। ফলে ব্যাংকটির তারল্য জোগানে উচ্চ সুদে আমানত সংগ্রহের বিকল্প নেই।

এদিকে ইসলামী ব্যাংক ইসলামি ধারার অন্য ব্যাংকগুলোকে ৮ হাজার কোটি টাকা ধার দিয়ে রাখলেও সেই টাকা এখন ফেরত পাচ্ছে না। কারণ, যেসব ব্যাংককে টাকা ধার দিয়েছে সেগুলোও একই মালিকানার প্রতিষ্ঠান। এই ব্যাংকগুলো হলো ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী, গ্লোবাল ইসলামী, ইউনিয়ন ও সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক। সাম্প্রতিক পরিস্থিতিতে এসব ব্যাংকও তারল্যসংকটে পড়েছে। এসব ব্যাংকও বাংলাদেশ ব্যাংকে নিয়মিত সিআরআরের অর্থ রাখতে ব্যর্থ হচ্ছে।

২০১৭ সালের পর থেকে ইসলামী ব্যাংকে আমানত রাখার ব্যাপারে আস্থার সংকট তৈরি হয়েছে এবং এটা অব্যাহত রয়েছে। ২০২২ সাথে আস্থার সংকট প্রকট আকারে দেখা দিয়েছে। ২০২৩ সাল থেকে ইসলামী ব্যাংক ইসলামী শরিয়তের দৃষ্টিতে বৈধতার সংকটে পড়েছে। সুদের ভিত্তিতে ঋণ নেয়ার পর এই ব্যাংককে আর 'ইসলামী শরীয়াহ মোতাবেক পরিচালিত ব্যাংক' বলার সুযোগ নেই। এটি সাধারণ সুদী ব্যাংকে পরিণত হয়েছে। শেখ হাসিনা সরকার একটি প্রতিষ্ঠিত লাভজনক ইসলামী ব্যাংককে সুদী ব্যাংক বানিয়ে ছাড়লো।