২৩ জুন, ২০১৯

'শহীদ' বলা ও না বলা নিয়ে কিছু কথা



খারেজি মানসিকতার কিছু মানুষের অব্যাহত প্রচারণার কারণে মুসলিমদের মধ্যে বিভ্রান্তি ছড়িয়ে পড়েছে। আব্দুর রাজ্জাক বিন ইউসুফসহ কিছু আলিম বলতে চাইছেন কাউকে শহীদ বলা যাবে না। আমরা যখন শহীদ ড. হাফেয মুহাম্মদ মুরসির শাহাদাতের ব্যাপারে আলোচনা করছিলাম তখন তিনি তার একটি ভিডিও বক্তব্য উপস্থাপন করেছেন এবং সেখানে বলতে চেয়েছেন শহীদ বলা যাবে না কারণ আমরা জানি না তিনি সত্যিই শহীদ হয়েছেন কিনা। এই জাতীয় আরো কিছু বক্তব্য আমরা পেয়েছি যখন এদেশের মুসলিমদের নেতা, সর্বজন শ্রদ্ধেয় ইসলামী আন্দোলনের পুরোধা ব্যক্তিত্বদের জালিম সরকার অন্যায়ভাবে ফাঁসীতে ঝুলিয়ে খুন করেছিলো।

আসুন আমরা প্রথমে জানার চেষ্টা করি শহীদ মানে কী? 
‘শহীদ’ আরবি শব্দ। এটি ‘শাহাদত’ শব্দ থেকে এসেছে। ‘শাহাদত’ অর্থ হলো, সাক্ষ্য, সনদ, সার্টিফিকেট, প্রত্যয়নপত্র ইত্যাদি। ‘শহীদের’ পারিভাষিক অর্থ হলো, ‘শহীদ ব্যক্তি মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের সফলতায় তার জীবন কুরবানীর মাধ্যমে তার ঈমানের দাবি পূরণের সত্যতার সাক্ষ্য, সনদ, সার্টিফিকেট বা প্রত্যয়ন প্রদান করলো।’

কারা শহীদ? 
এই প্রশ্নের উত্তর আমরা আমাদের প্রিয় নবী মুহাম্মদ সা.-এর থেকে জানতে থেকে জানতে পারি।

আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, তোমরা তোমাদের মধ্যকার কাদেরকে শহীদ বলে গণ্য কর? তারা বললেন, "ইয়া রাসূলাল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যে ব্যক্তি আল্লাহর রাহে নিহত হয় সেই তো শহীদ। " তিনি বললেনঃ তবে তো আমার উম্মাতের শহীদের সংখ্যা অতি অল্প হবে। তখন তারা বললেন, তা হলে তারা কারা ইয়া রাসূলাল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, যে ব্যক্তি আল্লাহ রাহে নিহত হয় সে শহীদ। যে ব্যক্তি আল্লাহর রাহে স্বাভাবিক মৃত্যুবরণ করে সেও শহীদ। যে ব্যক্তি প্লেগে মারা যায় সে শহীদ যে ব্যক্তি উদরাময়ে মারা যায় সেও শহীদ। ইব্‌ন মিকসাম (রাঃ) বলেন, আমি তোমার পিতার উপর এ হাদীসের ব্যাপারে সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, তিনি আরও বলেছেন, এবং পানিতে ডুবে মারা যায় এমন ব্যক্তিও শহীদ। (মুসলিম ৪৮৩৫)

আবদুল্লাহ্‌ ইবনু আমর (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রসূলুল্লাহ্‌ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে বলতে শুনেছি, যে ব্যক্তি তার সম্পদ রক্ষা করতে গিয়ে নিহত হয়, সে শহীদ। (বুখারি ২৪৮০)

সাহ্‌ল ইবনু হুনায়ফ (রাঃ) থেকে বর্ণিত, নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন, যে ব্যক্তি আন্তরিকতার সাথে আল্লাহর নিকট শাহাদাত প্রার্থনা করে আল্লাহ তা’আলা তাকে শহীদের মর্যাদায় অভিষিক্ত করবেন যদিও সে আপন শয্যায় ইন্তিকাল করে। (মুসলিম ৪৮২৪)

শহীদ বলার ব্যাপারে ইসলাম কী বলে? 
আল্লাহ্‌ তায়ালা বলেন, আর যারা আল্লাহর পথে জীবন দিয়েছে তাদের তোমরা মৃত বলো না, বরং তারা তাদের রবের নিকট জীবিত। তাদেরকে রিজিক দেয়া হয়। (সূরা ইমরান ১৬৯)

আল্লাহ্‌ তায়ালা অযথা কোনো কথা বলেন না। যখন কোনো ব্যক্তি আল্লাহর পথে জীবন দেন তখন তাঁকে মৃত মনে করা ও বলা যাবে না। এটা আমাদের প্রতি নির্দেশ। তাহলে কী বলতে হবে? এর উত্তর আমরা পাই আল্লাহর রাসুল সা. ও সাহাবীদের আমল থেকে।

সাহাবারা ও আল্লাহর রাসূল সা. যখন কোনো আল্লাহর পথে জীবন দেয়া ব্যক্তির ব্যাপারে কথা বলতেন তখন তাদের শহীদ হিসেবে সম্বোধন করতেন। সিহাহ সিত্তাহ'র হাদীসগুলোতে 'শহীদ' শব্দটি এসেছে প্রায় ৪০০ বারের কাছাকাছি। এর মধ্যে তিন শতাধিকবার এসেছে ঘটনা বর্ণনায়। যখনই সাহাবারা আল্লাহর পথে জীবন দেয়ার ঘটনা বা যুদ্ধের ঘটনা উল্লেখ তখন সেখানে শহীদ হিসেবে উল্লেখ করতেন। এই থেকে আমরা সহজে বুঝতে আল্লাহর পথে জীবন দেয়া ব্যক্তিকে বলতে হবে শহীদ। যেমন ড. মুরসি শহীদ হয়েছেন। কেউ যদি বলেন ড. মুরসি মৃত্যুবরণ করেছেন, তিনি মৃত, তাহলে তিনি আল্লাহর প্রেরিত আয়াতের সাথে সাংঘর্ষিক আচরণ করেছেন।

অনেকেই প্রশ্ন তুলেন তার শাহদাত কি কবুল হয়েছে? অথবা আমরা কীভাবে বলতে পারি কোন ব্যক্তি শহীদ হয়েছেন? আমাদের কাছে তো ওহী নাযিল হয়নি কারো ব্যাপারে।

আমাদের করণীয় নির্ধারিত হবে আমরা যা দেখি তার উপরে। আমরা গায়েব জানিনা। কারো অন্তরের খবর জানি না। আমরা যখন দেখবো কোন ব্যক্তি ইসলাম প্রতিষ্ঠার কাজ করতে গিয়ে জীবন দিয়েছেন তখন আমরা তাকে শহীদ বলবো। আল্লাহর রাসুলের শিক্ষাই তাই। বাকী তার অন্তরের ব্যাপারে ফয়সালা আল্লাহ্‌ করবেন। ওটা আমাদের বিষয় নয়। যে ব্যক্তি ইসলামের জন্য নিজের জীবন বিলিয়ে দিবেন তিনি আমাদের কাছে সাক্ষ্য হয়ে থাকবেন সেজন্যই তিনি শহীদ। তার শাহদাত কবুলিয়্যতের বিষয় আল্লাহর। আমরা সেজন্য দোয়া করতে পারি।

যারা শহীদ বলার ব্যাপারে বিরোধীতা করেন তারা কীসের ভিত্তিতে করেন? 
একটি হাদীসকে পুঁজি করে তারা এসব কথা বলেন। ইবনু আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, ওমর (রা.) আমাকে বললেন, ‘খায়বারের যুদ্ধের দিন সাহাবীগণের একটি দল বাড়ী ফিরে আসছিলেন। ঐ সময় সাহাবীগণ বললেন, অমুক অমুক শহীদ, শেষ পর্যন্ত এমন এক ব্যক্তিকে সাহাবীগণ শহীদ বললেন, যার ব্যাপারে রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, কখনো নয়, আমি তাকে জাহান্নামে দেখছি সে একটি চাদর আত্মসাৎ করেছে’ (মুসলিম, মিশকাত হা/৪০৩৪; বাংলা ৮ম খণ্ড, হা/৩৮৫৭)।

এই হাদিসকে সামনে এনে তারা বলতে চান আপনিই বললেই কেউ শহীদ হয়ে যাবে না। এটা আমরাও মনে করি। কিন্তু রাসুল সা. আমাদের শিখিয়েছেন আল্লাহর পথে জীবন দেয়া লোকদের শহীদ বলতে। তাহলে এই হাদিসের কথা কেন এসেছে? এটা দ্বারা আল্লাহর রাসূল আমাদের জানাতে চেয়েছেন কোনো ব্যক্তি যদি কারো হক নষ্ট করে তবে তিনি আল্লাহর পথে জীবন দিলেও তাকে ক্ষমা করা হবে না।

এখানে দ্রষ্টব্য যে আল্লাহর রাসুল সা. শুধু একজনের ব্যপারে না করেছেন যিনি আত্মসাৎকারী। বাকীরা সবাই ঢালাওভাবে শহীদ।

এই প্রসঙ্গে আরেকটি হাদীস এসেছে, ‘আবদুল্লাহ ইবনু ‘আমর ইবনু ‘আস (রা.) থেকে বর্ণিত, রসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেন, ঋণ ব্যতীত শহীদের সকল গুনাহই ক্ষমা করে দেয়া হবে। (মুসলিম ৪৭৭৭)। এর মানে কোনো শহীদের কাছে যদি কারো হক থাকে তবে ক্ষমাপ্রাপ্ত হবেন না। হাদীসে কয়েকটি ঘটনা এমন এসেছে কোনো ব্যক্তি শহীদ হয়েছেন আল্লাহর রাসূল সা. তার ঋণ পরিশোধের ব্যবস্থা করেছেন তার ক্ষমাপ্রাপ্তির জন্য।

আরেকটি হাদিস নিয়েও তারা কথা বলেন সেটা হলো, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, কিয়ামতের দিন সর্বপ্রথম যার বিচার করা হবে, সে হচ্ছে এমন একজন যে শহীদ হয়েছিল। তাকে হাযির করা হবে এবং আল্লাহ তার নিয়ামত রাশির কথা তাকে বলবেন এবং সে তাঁর সবটাই চিনতে পারবে (এবং যথারীতি তার স্বীকারোক্তিও করবে।) তখন আল্লাহ তা’আলা বলবেন, এর বিনিময়ে কি আমল করেছিলে?

সে বলবে, আমি আপনার (সন্তুষ্টির) জন্য যুদ্ধ করেছি এমন কি শেষ পর্যন্ত শহীদ হয়েছি। তখন আল্লাহ তাআলা বলবেনঃ তুমি মিথ্যা বলেছো। তুমি বরং এ জন্যেই যুদ্ধ করেছিলে যাতে লোকে তোমাকে বলে তুমি বীর। তা তো বলা হয়েছে। এরপর নির্দেশ দেওয়া হবে। সে মতে তাকে উপুড় করে হেঁচড়িয়ে নিয়ে যাওয়া হবে এবং জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে।

এই হাদিসেও স্বীকার করা হয়েছে আল্লাহর পথে জীবন দেয়া ব্যক্তি শহীদ হিসেবে স্বীকৃতি পাবে। এটাই নিয়ম। এখানে ব্যক্তি তার অন্তরের রোগের কারণে জাহান্নামী হবে। এই হাদীস উল্লেখ করে তারা কোনো ব্যক্তিকে শহীদ বলা থেকে বিরত থাকতে বলেন অথচ একই হাদীসে আলিম ও দানশীল ব্যক্তির ব্যাপারেও সেইম কথা বলা হয়েছে। কিন্তু তাদের বলতে শুনিনি কাউকে আলিম বলা যাবে না বা দানশীল বলা যাবে না।

আবু বকর জাকারিয়াসহ কিছু আলিম বলেছেন, তাকে শহীদ বলা যাবে যার ব্যাপারে আপনি নিশ্চিত তাকে আল্লাহ শহীদের মর্যাদা দিয়েছেন। যেহেতু আমরা কেউ নিশ্চিতভাবে জানি না তাই আমরা এভাবে বলবো আল্লাহ্‌ তাঁকে শহীদ হিসেবে কবুল করুন, ইনশাআল্লাহ তিনি শহীদ, আল্লাহ চাইলে তিনি শহীদ। এই যে কথাগুলো তিনি বললেন, এগুলো শুনতে ভালোই মনে হয়, খারাপ কথা না। তবে এগুলো মনগড়া কথা। সহীহ হাদিসে শহীদ সম্পর্কে শত শত হাদিস এসেছে, সেখানে এই জাতীয় কথার কোনো অস্তিত্ব নেই। এসব মনগড়া কথা থেকে দূরে থাকা উচিত সবার।

সাহাবার অবলীলায় বলতেন, আমার ভাই শহীদ হয়েছেন, আমার বাবা শহীদ হয়েছেন। অমুন যুদ্ধে অমুক অমুক শহীদ হয়েছেন। সাহাবাদের কেউ নিশ্চিত জানতেন না কে শহীদ আর কে শহীদ না। এমনকি আল্লাহর রাসূল সা.-এর ওফাত পরবর্তী ঘটনাগুলোর ক্ষেত্রেও তারা শহীদ শব্দ ব্যবহার করতেন। যেমন আলী রা.-এর সাথে খারেজীদের যুদ্ধ, আলী রা. সাথে মুয়াবিয়া রা.-এর যুদ্ধ, আলী রা. এর সাথে আয়েশা রা.-এর যুদ্ধ ইত্যাদি।

শুধু সাহাবারা নন, ইসলামের শুরু থেকে নিয়ে এই পর্যন্ত প্রত্যেকটি যুগেই আল্লাহর পথে জীবন দানকারীকে অবলীলায় নিঃসংকোচে শহীদ বলা হয়েছে। অতএব এই নিয়ে বিভ্রান্তির কিছু নেই। যিনি আল্লাহর পথে জীবন দিয়েছে তাকেই আমরা শহীদ হিসেবে আখ্যায়িত করবো, স্বীকৃতি দেব যদি তিনি কারো হক আত্মসাৎ না করেন। আল্লাহ্‌ তায়ালা আমাদের সহীহ বুঝ দান করুন।

২২ জুন, ২০১৯

বঙ্গকথা পর্ব-০৮ : বাংলায় বৌদ্ধদের পুনরায় উত্থান ও কবর রচনার ইতিহাস

পাল সাম্রাজ্যের মানচিত্র 
গত পর্বে আমরা গোপালের নাম নিয়েছি। গোপাল ছিলেন পাল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা। দীর্ঘ এক শতাব্দীর মাৎস্যন্যায় যুগের অবসান ঘটিয়ে আট শতকের মধ্যভাগে গৌড়-বঙ্গ-বিহারে বৌদ্ধ মতাবলম্বী পাল শাসনের সূচনা হয়। পাল শাসনের চারশ’ বছর ছিল এদেশের মানুষের গৌরব পুনরুদ্ধার, আত্ম-আবিষ্কার ও আত্মপ্রতিষ্ঠার যুগ। এ আমলে গড়ে ওঠা বাংলাদেশের বিভিন্ন বৌদ্ধ বিহার ও সংঘারাম ছিল জ্ঞান-বিজ্ঞান ও শিক্ষা-দীক্ষার কেন্দ্র। কয়েকটি ছাড়া সকল মহাবিহারই ছিল বাংলাদেশে।

রাজ কুমার লিখেছেন, পাল সম্রাটরা ছিলেন ভালো যোদ্ধা। তাদের সেনাবাহিনীর বৈশিষ্ট্য ছিল একটি বিশাল হাতি বাহিনী। তাদের নৌবাহিনী বঙ্গোপসাগরে বাণিজ্যিক ও প্রতিরক্ষামূলক ভূমিকা পালন করতো। পাল সম্রাটরা ছিলেন ধ্রুপদি ভারতীয় দর্শন, সাহিত্য, চিত্রকলা ও ভাস্কর্যশিল্পের বিশিষ্ট পৃষ্ঠপোষক। তারা একাধিক বৃহদায়তন মন্দির ও মঠ নির্মাণ করিয়েছিলেন। এগুলির মধ্যে অন্যতম ছিল সোমপুর মহাবিহার। তাঁরা নালন্দা ও বিক্রমশিলা মহাবিহারের পৃষ্ঠপোষকতাও করতেন। তাদের রাজত্বকালেই বাংলা ভাষার বিকাশ ঘটে। শ্রীবিজয় সাম্রাজ্য, তিব্বতি সাম্রাজ্য ও আরব আব্বাসীয় খিলাফতের সঙ্গে পাল সাম্রাজ্যের সুসম্পর্ক বজায় ছিল। বাংলা ও মধ্যপ্রাচ্যের মধ্যে বাণিজ্য বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে পাল যুগেই বাংলায় প্রথম ইসলামের আবির্ভাব ঘটে। পাল আমলের স্থাপনাগুলোতে আব্বাসিয় মুদ্রা পাওয়া গিয়েছে। তাছাড়া আরব ইতিহাসবিদদের রচিত নথিপথেও পাল সাম্রাজ্যের সঙ্গে তাঁদের দেশের বাণিজ্যিক ও বৌদ্ধিক যোগাযোগের উল্লেখ পাওয়া যায়। বাগদাদের বাইতুল হিকমাহ এই যুগেই ভারতীয় সভ্যতার গাণিতিক ও জ্যোতির্বিজ্ঞান-সংক্রান্ত কীর্তিগুলির সঙ্গে পরিচিত হয়েছিল। ( Essays on Ancient India পৃষ্ঠা ১৯৯)

আব্দুল মান্নান তার জাতিসত্তার বিকাশধারা বইতে উল্লেখ করেন, বাংলার পাল-রাজত্ব চারশ’ বছর স্থায়ী হয়। গৌড়-বঙ্গে পাল শাসন চলাকালে ভারতের পশ্চিম সীমান্তে সমসাময়িক আর্য-ব্রাহ্মণ্য শক্তিপুঞ্জ সুলতান মাহমুদের হামলায় বিব্রত ও বিপর্যস্ত ছিল। ফলে পাল শাসন তার ভৌগোলিক সীমান্তে দীর্ঘদিন নিরুপদ্রব থাকে। আট শতক থেকে এগারো শতক পর্যন্ত পাল শাসনে বাংলায় বৌদ্ধধর্মের প্রসার ঘটে। বাংলা ও বিহার ছাড়িয়ে এ ধর্ম এ সময় আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠা ও মর্যাদা অর্জন করে। পূর্ব ভারত ভারতীয় বৌদ্ধধর্মের শেষ আশ্রয়স্থলে পরিণত হয়। ফলে বাংলায় বৌদ্ধ ধর্মের বয়স আরো চার-পাঁচশ বছর বৃদ্ধি পায়।

খ্রিস্টীয় ৯ম শতাব্দীর প্রথম ভাগে পাল সাম্রাজ্য সর্বাধিক সমৃদ্ধি লাভ করেছিল। এই সময় পাল সাম্রাজ্যই ছিল ভারতীয় উপমহাদেশের উত্তরাঞ্চলের প্রধান রাজনৈতিক শক্তি। সেই যুগে এই সাম্রাজ্য আধুনিক পূর্ব-পাকিস্তান, উত্তর ও উত্তরপূর্ব ভারত, নেপাল ও বাংলাদেশ রাষ্ট্রের ভূখণ্ডে প্রসারিত হয়। পাল সাম্রাজ্য সর্বাধিক সমৃদ্ধি ঘটেছিল সম্রাট ধর্মপাল ও দেবপালের রাজত্বকালে। তিব্বতে অতীশের মাধ্যমে পাল সাম্রাজ্য প্রভূত সাংস্কৃতিক প্রভাব বিস্তার করেছিল। পাল সাম্রাজ্যের সাংস্কৃতিক প্রভাব পড়েছিল দক্ষিণপূর্ব এশিয়াতেও। উত্তর ভারতে পাল শাসন ছিল ক্ষণস্থায়ী। কারণ কনৌজের আধিপত্য অর্জনের জন্য গুর্জর-প্রতিহার ও রাষ্ট্রকূটদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে গিয়ে পাল সম্রাটরা পরাজিত হন। কিছুকালের জন্য পাল সাম্রাজ্যের পতন ঘটেছিল। তারপর সম্রাট প্রথম মহীপাল বাংলা ও বিহার অঞ্চলে দক্ষিণ ভারতীয় চোল অনুপ্রবেশ প্রতিহত করেন। সম্রাট রামপাল ছিলেন সর্বশেষ শক্তিশালী পাল সম্রাট। তিনি কামরূপ ও কলিঙ্গে আধিপত্য বিস্তার করেছিলেন। খ্রিস্টীয় ১১শ শতাব্দীতে পাল সাম্রাজ্যের নানা অঞ্চলে বিদ্রোহ মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে। এর ফলে সাম্রাজ্যের শক্তি অনেকটাই হ্রাস প্রাপ্ত হয়।

পাল আমলে ব্রাহ্মণ্যবাদীরা বৌদ্ধ-ধর্ম-সংস্কৃতির সাথে বৈদিক ধর্ম-সংস্কৃতির মিল-সমন্বয়ের স্লোগান দেয়। বহিঃসীমান্তে তাদের মিত্ররা সামরিকভাবে সুবিধা করতে না পারলেও ব্রাহ্মণদের এই চতুর কৌশল বিশেষ ফলদায়ক হয়েছিল। ড. নীহাররঞ্জন রায় তারই বিবরণ দিয়ে জানাচ্ছেন, “পাল রাজাদের অনেকেই ব্রাহ্মণ রাজ-পরিবারের মেয়ে বিয়ে করছিলেন। ফলে বৌদ্ধ ও ব্রাহ্মণ্য ধর্মের একটা পারস্পরিক সম্বন্ধ গড়ে উঠেছিল”। (বাঙালির ইতিহাস, পৃষ্ঠা ১৩৯)

এ সময় পাল রাজারা অনেকেই ব্রাহ্মণ, ব্রাহ্মণ্য মূর্তি আর তাদের মন্দিরের পৃষ্ঠপোষক হয়ে উঠেছিলেন। তাদের চিন্তা-চেতনা ও ক্রিয়াকর্মে নিজ সংস্কৃতির স্বাতন্ত্র্য মুছে গিয়ে ব্রাহ্মণ্য প্রভাব স্পষ্ঠ হয়ে ফুটে উঠেছিল। বিশেষত দশ শতক থেকে বৌদ্ধ ধর্মে পূজাচারের প্রভাব দেখা দেয়। এ প্রসঙ্গে লক্ষ্যণীয় হলো, পাল-পূর্ব যুগের বৌদ্ধ মূর্তি বিশেষ পাওয়া যায় না। যা কিছু পাওয়া যায় নয় শতক থেকে এগারো শতকের মধ্যেকার। এই সমন্বয় ছিল এক তরফা। আর্য-ব্রাহ্মণ্য সংস্কৃতির ছাঁচেই গড়ে উঠেছিল সবকিছু। নীহাররঞ্জন রায়ের ভাষায়, “এই মিল-সমন্বয় সত্ত্বেও বৌদ্ধ ধর্ম তার দেবায়তন ব্রাহ্মণ্য ধর্মের কুক্ষগত হয়ে পড়ছিল।…… বৌদ্ধ ও ব্রাহ্মণ্য ধর্মের বাহ্য ব্যবধান ঘুচে যাওয়ায় লোকের মধ্যে বৌদ্ধ ধর্মের প্রতি আকর্ষণ কমে এসেছিল”। (বাঙালির ইতিহাস, ১৫১)

আব্দুল মান্নান বলেন, তথাকথিত এই মিল-সমন্বয়ের আদর্শ বাংলাদেশের জনগণের ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক জীবনের খোল-নলচে পাল্টে দিচ্ছিল, তাদের জাতিসত্তাকে করে তুলেছিল অন্তঃসারশূন্য, আার রাষ্ট্রসত্তাকে করে তুলেছিল বিপন্ন। রাষ্ট্রের ভৌগোলিক সীমানা পাহারা দেওয়ার পাশাপাশি সাংস্কৃতির সীমানা হেফাযত করতে না পারলে সে জাতির ভবিষ্যৎ পরিণতি কত মারাত্মক হতে পারে, তার প্রমাণ পাল শাসকেরা রেখে গেছেন।

খ্রিস্টীয় ১২শ শতাব্দীতে হিন্দু সেন রাজবংশের পুনরুত্থানের ফলে পাল সাম্রাজ্যের পতন ঘটে। সেই সঙ্গে ভারতীয় উপমহাদেশের সর্বশেষ প্রধান বৌদ্ধ সাম্রাজ্যের অবসান ঘটে। বাংলার ইতিহাসে পাল যুগকে অন্যতম সুবর্ণযুগ মনে করা হয়। বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলের মধ্যে কয়েক শতাব্দীব্যাপী গৃহযুদ্ধের অবসান ঘটিয়ে পাল সম্রাটরা বাংলায় স্থিতাবস্থা ও সমৃদ্ধি আনয়ন করেছিলেন। পূর্বতন বঙ্গীয় সভ্যতাকে তাঁরা উন্নত করে তোলেন। সেই সঙ্গে শিল্পকলা ও স্থাপত্যের ক্ষেত্রে অসামান্য কীর্তি রেখে যান। তাঁরা বাংলা ভাষার ভিত্তি রচনা করেছিলেন। বাংলার প্রথম সাহিত্যকীর্তি চর্যাপদ পাল যুগেই রচিত হয়েছিল।

পাল-রাজত্বের অবসানের পর কর্ণাটদেশীয় চন্দ্র-বংশীয় ক্ষত্রিয় বর্ণের সেনরা বাংলাদেশ শাসন করে। দ্বিতীয় মহীপালের রাজত্বকালে সামন্ত বিদ্রোহ ও ভ্রাতৃবিরোধের সুযোগ নিয়ে সামন্ত সেনের পুত্র হেমন্ত সেন বারো শতকের শুরুতে রাঢ়-এর একটি ক্ষুদ্র অঞ্চল দখল করে সামন্তরূপে জেঁকে বসেন। পাল বংশের শেষ রাজা রামপালের মৃত্যুর পর পাল-রাজ্যের গোলযোগ দেখা দেয়। বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় ভগ্নাদশার এই সুযোগে হেমন্ত সেনের পুত্র বিজয় সেন এখানে প্রভুত্ব কায়েমের চেষ্টা করেন। তার রাজধানী ছিল বিজয়পুর। বঙ্গের বিক্রমপুরে ছিল তার দ্বিতীয় রাজধানী । শিব-এর পূজারী বিজয় সেন ও তার পুত্র বল্লাল সেন বাংলাদেশে ব্রাহ্মণ্যধারায় কুলীনপ্রথাভিত্তিক বর্ণশ্রমবাদী সমাজের ভিত রচনা করেন।

তখনকার অবস্থা সম্পর্কে ড. নীহাররঞ্জন রায় বলেন, “সেন শাসনামলে দেখতে দেখতে যাগযজ্ঞের ধুম পড়ে গেল। নদ-নদীর ঘাটে-ঘাটে শোনা গেল বিচিত্র পুণ্য-স্নানার্থীর মন্ত্র-গুঞ্জরণ, ব্রাহ্মণ্য দেবদেবীর পূজা, বিভিন্ন পৌরাণিক ব্রতের অনুষ্ঠান, জনগণের দৈনন্দিন কাজর্ম, বিবাহ, জন্ম, মৃত্যু, শ্রাদ্ধ, আহার-বিহার, বিভিন্ন বর্ণের নানা স্তর-উপস্তর বিভাগের সীমা-উপসীমা- এক কথায় সমস্ত রকম সমাজ-কর্মের রীতি-পদ্ধতি ব্রাহ্মণ্য নিয়ম অনুযায়ী বেঁধে দেওয়া হলো। এক বর্ণ, এক ধর্ম ও এক সমাজাদর্শের একাধিপত্যই সেন-বর্মন যুগের একমাত্র লক্ষ্য হয়ে দাঁড়াল। সে সমাজাদর্শ পৌরণিক ব্রাহ্মণ্য সমাজের আদর্শ। সে আদর্শই হলো সমাজের মাপকাঠি। রাষ্ট্রের মাথায় রাজা, তার প্রধান খুঁটি ব্রাহ্মণেরা। কাজেই মূর্তিতে, মন্দিরে, রাজকীয় লিপিমালায়, স্মৃতি-ব্যবহারে ও ধর্মশাস্ত্রে সমস্ত রকম উপায়ে এই আদর্শ ও মাপকাঠির ঢাক পিটানো হতে লাগল। রাষ্ট্রের ইচ্ছায় ও নির্দেশে সর্বময় ব্রাহ্মণ্য একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠিত হলো”। (বাঙালির ইতিহাস, পৃষ্ঠা ৫৬-৫৭)

সেন আমলে বর্ণাশ্রম প্রথা পুরোপুরি চালু হলো। উৎপত্তি হলো ছত্রিশ জাতের। যারা উৎপাদনের সাথে যত বেশি সম্পর্কযুক্ত, তাদের স্থান হলো সমাজে ততো নীচুস্তরে। যারা যতো বেশি উৎপাদন-বিমুখ, অন্যের শ্রমের ওপর যত বেশি নির্ভরশীল, যত বেশি পরভোজী ও পরাশ্রয়ী, সমাজে তাদের মার্যাদা হলো তত উপরে। ব্রাহ্মণ্য বর্ণ বিন্যাসের এই ছিল বৈশিষ্ট্য। এভাবে সেন-বর্মন শাসিত বাংলাদেশে একটি সর্বভুক পরগাছাশ্রেণীর স্বৈরাচার কায়েম হয়।

পাল আমলে সাংস্কৃতিক আধিপত্য কায়েমের ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে ব্রাহ্মণেরা তথাকথিত মিল-সমন্বয়ের কৌশল গ্রহণ করেছিল। কিন্তু সেন-বর্মন পর্বে ব্রাহ্মণ্য সমাজ তথাকথিত সমন্বয়ের মুখোশ আর রাখল না। তারা স্বমূর্তিতে উন্মোচিত হলো, নিজেদের আসল রূপ জনগণের সামনে প্রকাশ করলো। পাল আমলে ব্রাহ্মণ্য ধর্ম-সংস্কৃতির প্রতি যে উদারতা দেখান হয়েছিল, তার বদলা হিসেবে ব্রাহ্মণবাদী সেনরা বৌদ্ধ ধর্ম, সংস্কৃতি ও জাতিসত্তার বিরুদ্ধে পরিচালনা করল নিষ্ঠুর নির্মূল অভিযান। সে নিষ্ঠুরতা সম্পর্কে ড. দীনেশচন্দ্র সেন বলেন, “যে জনপদে (পূর্ববঙ্গ) এক কোটির অধিক বৌদ্ধ এবং ১৫৫০ ঘর ভিক্ষু বাস করিত, সেখানে একখানি বৌদ্ধ গ্রন্হ ত্রিশ বছরের চেষ্টায় পাওয়া যায় নাই। যে পূর্ব ভারত বৌদ্ধ ধর্মের প্রধান লীলাকেন্দ্র ছিল, তথায় বৌদ্ধ ধর্মের যে অস্তিত্ব ছিল, তাহাও ইউরোপীয় প্রত্নতাত্ত্বিক চেষ্টায় অধুনা আবিস্কৃত হইতেছে”। (প্রাচীন বাংলা সাহিত্যে মুসলমানদের অবদান, পৃষ্ঠা ১‌১-১২)

ব্রাহ্মণ্যবাদী সেনদের অত্যাচারের কারণে বাংলা সাহিত্যেরও ক্ষতি হয় ব্যাপক। এই নিয়ে অধ্যাপক দেবেন্দ্রকুমার ঘোষ লিখেছেন, “পাল বংশের পরে এতদ্দেশে সেন বংশের রাজত্বকালে ব্রাহ্মণ্য ধর্মের চিন্তা অতিশয় ব্যাপক হইয়া ওঠে ও বৌদ্ধ ধর্মের প্রবাহ বিশুষ্ক হইয়া পড়ে। সেন বংশের রাজারা সবাই ব্রাহ্মণ্যধর্মী, তাহাদের রাজত্বকালে বহু ব্রাহ্মণ বঙ্গদেশে আসিয়া বসতি স্থাপন করে ও অধিকাংশ প্রজাবৃন্দ তাহাদের শিষ্যত্ব গ্রহণ করিতে বাধ্য হয়। এভাবে রাজ ও রাষ্ট্র উভয়ই বৌদ্ধ ধর্মের প্রতি বিরূপ হইলে বাংলার বৌদ্ধরা স্বদেশ ছাড়িয়া নেপাল, তিব্বত প্রভৃতি পার্বত্য প্রদেশে গিয়া আশ্রয় গ্রহণ করে। বাংগালার বৌদ্ধ সাধক কবিদের দ্বারা সদ্যজাত বাংগালা ভাষায় রচিত গ্রন্হগুলিও তাহাদের সঙ্গে বাংগালার বাহিরে চলিয়া যায়। তাই আদি যুগের বাংগালা গ্রন্হ নিতান্ত দুষ্প্রাপ্য”। (প্রাচীন বাংগালা সাহিত্যের প্রাঞ্জল ইতিহাস, পৃষ্ঠা ৯-১০)

সেনদের এই বর্বর শাসন থেকে দেশ ও জাতিকে উদ্ধারে এগিয়ে আসে মুসলিমরা। তখন সারাবিশ্বে মুসলিমদের জয়জয়কার। এমনকি উত্তর ভারতের কিছু অংশ, মুলতানসহ পাকিস্তানের বেশ কিছু অংশ মুসলিমদের অধিকারে চলে আসে। ব্রাহ্মণ্যবাদী আর্যদের দ্বারা নির্যাতিত, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক নিপীড়ন এবং অর্থনৈতিক শোষণে দেশবাসীর জীবন যখন বিপন্ন, সে সময় মজলুম জনগণের পক্ষের শক্তির হিসেবে তাদের পাশে এসে দাঁড়ান ইসলাম প্রচারক আলেক, সূফী ও মুজাহিদগণ। ইসলাম প্রচারকগণ নিপীড়িত জনগণকে সংগঠিত করে রুখে দাঁড়ান বিক্রমপুরে, বগুড়া বা পুন্ড্রবর্ধনে, রামপুর বোয়ালিয়া বা রাজশাহীতে, গৌড় না চাঁপাইনবাবগঞ্জে।

আব্দুল মান্নান বলেন, দ্বাদশ শতকের শেষ নাগাদ বাংলার প্রায় প্রতিটি বিখ্যাত শহরে-বন্দরে এবং দেশের অভ্যন্তরভাগে বিখ্যাত গ্রামে সত্য ও মিথ্যা, হক ও বাতিল এবং ইসলাম ও কুফরের মধ্যে দ্বন্দ্ব শুরু হয়ে যায়। এই দীর্ঘকালীন দ্বন্দ্বে সাধারণ মানুষের কাছে সত্যের চেহারা সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে। গাঙ্গেয় উত্যকার অভ্যন্তরে এক নীরব বিপ্লবের ধারা এগিয়ে চলে। আর্যদের বৈদিক ও পৌরণিক ধর্মের বিরুদ্ধে বাংলার অধিবাসীরা হাজার বছর ধরে যে প্রতিরোধ গড়ে আসছিল, ইসলামের দ্রোহাত্মক বানী তাদের সে প্রতিরোধ ক্ষমতাকে বহুগুণে বাড়িয়ে তুলল।

একেকজন ইসলাম প্রচারক জনগণের কাছে আবির্ভূত হন তাদের মুক্তি সংগ্রামের মহানায়করূপে। প্রচারকদের গড়ে তোলা মসজিদ, মাদরাসা ও খানকাগুলো নির্যাতিতের আশ্রয়স্থল, অভুক্তের লঙ্গরখানা, ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক মতবিনিময় ও চাহিদা পূরণের কেন্দ্র এবং মুক্তি সংগ্রামের দুর্গ হিসেবে পরিচিত হয়।

বঙ্গকথা পর্ব-০৭ : বঙ্গাব্দের শশাঙ্ক, মাৎস্যন্যায় এবং পাল রাজাদের উত্থান

শশাঙ্ক আমলের মুদ্রা

যখন আরবে আল্লাহর রাসূল সা. দাওয়াতি কাজ করছেন তখন আমাদের বাংলায় শাসক ছিলেন শশাঙ্ক। আমাদের আজকের বঙ্গকথা শুরু হবে শশাঙ্ককে দিয়ে। গত পর্বে আমরা গুপ্ত সাম্রাজ্য নিয়ে আলোচনা করেছিলাম। গুপ্ত সাম্রাজ্যের শেষ দিকে এই সাম্রাজ্যের শক্তি দিন দিন ক্ষয় হতে থাকে। একের পর এক এলাকা তাদের হাতছাড়া হতে থাকে। গুপ্ত রাজাদের একজন সামন্ত রাজা ছিলেন শশাঙ্ক। ততদিনে এই অঞ্চলে দ্রাবিড়দের ভাষা থেকে নানারূপ পরিবর্তিত হয়ে বাংলা ভাষা সৃষ্টি হয়। শশাঙ্ক বাংলা ভাষার একজন রাজা। ধারণা করা হয় তিনিই প্রথম বাঙালি শাসক।

গুপ্ত সাম্রাজ্যের দূর্বলতার প্রেক্ষিতে তিনি বাংলার বিভিন্ন ক্ষুদ্র রাজ্যকে একত্র করে গৌড় নামের জনপদ গড়ে তোলেন। তিনি ৫৯০ হতে ৬২৫ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে রাজত্ব করেন। তাঁর রাজধানীর নাম ছিল কর্ণসুবর্ণ বা কানসোনা। কর্ণসুবর্ণ নগরী মানে বর্তমান পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ জেলায় রাজবাড়িডাঙ্গার সন্নিকটে চিরুটি রেল স্টেশনের কাছে। এটা বহরমপুর থেকে প্রায় ১০ কিলোমিটার দূরে। এটাই ছিলো গৌড় রাজার রাজধানী। গৌড় অঞ্চল বলতে যা বুঝানো হয় তা হলো ভারতের বিহার, উড়িষ্যা, মুর্শিদাবাদ ও বাংলাদেশের চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে বগুড়া পর্যন্ত।

শশাঙ্ক সিংহাসনে আরোহন করে বঙ্গাব্দ চালু করেন। কিন্তু গৌড়ের রাজার শক্তিশালী শাসনের অভাবে এই ক্যালেন্ডার হারিয়ে যায়। বর্তমানে যে বঙ্গাব্দ বা বাংলা সন আমরা ব্যবহার করি তা তৈরি হয়েছে মুঘল সম্রাট আকবরের শাসনামলে। ইরানি গবেষক আমীর ফতুল্লাহ শিরাজী চান্দ্র হিজরি সনকে বাংলা সনে রূপান্তরিত করেন। এখানে উল্লেখযোগ্য যে বিশাল হিন্দুস্থানের জন্য তৈরিকৃত ক্যালেন্ডারের নাম বঙ্গাব্দ কেন হলো। ঐতিহাসিকরা যা বলতে চান তা হলো আমীর ফতুল্লাহ শিরাজী আগের প্রচলিত বঙ্গাব্দকে ঘষে মেজে ঠিক করেছেন ভারতবর্ষের জন্য। রাজা শশাঙ্কের তৈরি ক্যালেন্ডারকে আকবরের আগেও ব্যবহার করেছেন বাংলা বিখ্যাত সুলতান আলাউদ্দিন হুসেন শাহ। তিনিও কিছু সংস্কার করেছেন সেই ক্যালেন্ডারকে।

আমীর ফতুল্লাহ শিরাজী সবচেয়ে বেশি অবদান রাখেন এই ক্যালেন্ডারকে সঠিক অবস্থানে আনতে। তার ক্যালেন্ডার প্রায় নির্ভুল ছিলো। আকবরের নির্দেশে এই ক্যালেন্ডার তৈরির মূল কারণ ছিলো ফসলের হিসাবগুলো ঠিক করার জন্য। এটা চাষিদের জন্য প্রয়োজনীয় বিষয় ছিলো। আমীর ফতুল্লাহ শিরাজী কোন ফসল কবে রোপণ করতে হবে কবে উত্তোলন করতে হবে সবই ঠিক করে দেন। এর ফলে শাসক ও প্রজা উভয়েরই উপকার হয়। শাসকরা এমন সময়ে খাজনা আদায় করতে যেতেন যখন চাষিরা খাজনা দিতে সক্ষম। আমরা বাংলাদেশে এখন যে ক্যালেন্ডার ব্যবহার করি তা আরেকদফা সংশোধিত হয় ১৯৬৬ সালে পাকিস্তান আমলে ড. মুহাম্মদ শহিদুল্লাহর নেতৃত্বে। শিরাজীর ক্যালেন্ডার এখনো হুবুহু ব্যবহার করেন ভারতের বাঙালিরা।

আমরা বঙ্গাব্দ থেকে আবার শশাঙ্কের কাছে ফিরে যাই। শশাঙ্ক থানেসোরের রাজা হর্ষবর্ধনের কাছে পরাজিত হন ও মৃত্যবরণ করেন। থানেসোর মানে হলো উত্তর ভারতের হরিয়ানা রাজ্যের কুরুক্ষেত্র জেলার একটি শহর। হর্ষবর্ধন বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বি ছিলেন বলে জানা যায়। তিনি নালন্দায় বৌদ্ধ বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করেন। যা নালন্দা মহাবিহার নামে পরিচিত। বানভট্ট এবং হিউয়েন সাঙ থেকে জানা যায় হর্ষবর্ধন এই অঞ্চলের ব্রাহ্মনদের উপর অত্যাচার চালিয়েছেন।

হর্ষবর্ধনের পর পাল আমল পর্যন্ত আর কোনো শক্তিশালী শাসক পায়নি বাংলা। ফলে এই অঞ্চলে একতি অরাজক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। এই অবস্থাকে মাৎস্যন্যায়। মাৎস্যন্যায় মানে মাছের ন্যায়। মাছ যেভাবে একটি আরেকটিকে গিলে ফেলে এভাবে এই অঞ্চলে একে অপরকে ঘায়েল করার নেশা চেপে বসেছে। বাংলাপিডিয়ায় এই অরাজক পরিস্থিতি নিয়ে যা জানা যায় তা হলো, ৬৪৭ সালে হর্ষবর্ধনের মৃত্যুর পর নৈরাজ্য ও সংশয় দেখা দিলে, মন্ত্রীরা বলপূর্বক রাজ্য দখল করে নেয়। আনুমানিক ৬৫০ খ্রিস্টাব্দ থেকে ৭৫০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত এক শতক কালেরও বেশি সময় ধরে গৌড়ের ইতিহাস অস্পষ্ট ছিলো। তিব্বতের রাজা শ্রং-ছান-গেমপো বাংলায় পরপর কয়েকটি অভিযান পরিচালনা করেন। সাত শতকের দ্বিতীয়ার্ধে বাংলায় দুটি নতুন রাজবংশ আত্মপ্রকাশ করে:গৌড় ও মগধে (পশ্চিম বাংলা ও দক্ষিণ বিহার) পরবর্তী গুপ্তগণ এবং বঙ্গ ও সমতট (দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব বাংলা) খড়গ রাজবংশ। কিন্তু এ রাজবংশের কোনোটিই বাংলায় ঐক্যবদ্ধ ও শক্তিশালী শাসন প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়নি।

অষ্টম শতকের শুরুর দিকে বার বার বৈদেশিক আক্রমণে বাংলা বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। এর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ছিল কনৌজ রাজ যশোবর্মণের (৭২৫-৭৫২ খ্রি.) আক্রমণ। কাশ্মীরের ললিতাদিত্য যশোবর্মণের গৌরবকে ম্লান করে দেন। গৌড়ের পাঁচ জন রাজা ললিতাদিত্য কর্তৃক পরাজিত হয়েছিলেন বলে কাশ্মীরের ঐতিহাসিক কলহন উল্লেখ করেন। এ থেকে গৌড়ের রাজনৈতিক বিচ্ছিন্নতা সম্পর্কে সুস্পষ্ট ইঙ্গিত পাওয়া যায়। কেন্দ্রীয় শক্তির অভাবে স্থানীয় প্রধানগণ স্বাধীন হয়ে ওঠেন এবং নিজেদের মধ্যে প্রাধান্য প্রতিষ্ঠার লড়াই-এ লিপ্ত হন। বার বার বৈদেশিক আক্রমণ রাজনৈতিক ভারসাম্য বিনষ্ট করে এবং তাতে বিচ্ছিন্নতার প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত হয়। তাই শশাঙ্কের মৃত্যুর পরবর্তী একশ বছর বাংলায় কোনো স্থায়ী সরকার ব্যবস্থা গড়ে উঠতে পারেনি বলা চলে। তিব্বতি সন্ন্যাসী তারনাথ ১৬০৮ খ্রিস্টাব্দে ’ভারতে বৌদ্ধ ধর্মের ইতিহাস’ নামক একটি গ্রন্থ রচনা করেন। তিনি এ মত সমর্থন করে লিখেন: ‘প্রত্যেক ক্ষত্রিয়, সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি, ব্রাহ্মণ ও বণিক স্ব স্ব গৃহে অথবা প্রভাবাধীন এলাকায় ছিলেন এক এক জন রাজা, কিন্তু সমগ্র দেশে কোনো রাজা ছিলেন না’।

সংস্কৃত শব্দ মাৎস্যন্যায়ম বিশেষ অর্থবহ। যখন দন্ডদানের আইন স্থগিত বা অকার্যকর থাকে তখন এমন অরাজক অবস্থার সৃষ্টি হয় যা মাছের রাজ্য সম্পর্কে প্রচলিত প্রবচনের মধ্যে পরিস্ফুট। অর্থাৎ অপেক্ষাকৃত বড় মাছ ছোটটিকে গ্রাস করে, কারণ আইন প্রয়োগকারী সংস্থার অবর্তমানে সবল দুর্বলকে গ্রাস করবেই। সমসাময়িক পাল লিপিতে এ অর্থবহ শব্দটির প্রয়োগ করে বাংলার তৎকালীন রাজনৈতিক অবস্থা বর্ণনা করা হয়েছে। আইন-শৃঙ্খলা বজায় রাখার মতো শক্তিশালী শাসন ক্ষমতার অভাবে সম্পূর্ণ অরাজক অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল।

গোপাল ছিলেন পাল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা। তার উত্থানের মাধ্যমেই অরাজক পরিস্থিতির অবসান হয়। তিনি ৭৫০ থেকে ৭৭০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত রাজত্ব করেন। পাল রাজাদের নামের শেষে "পাল" শব্দাংশটির অর্থ "রক্ষাকর্তা"। তাদের সঠিক জাতি-পরিচয় জানা যায় নি। গোপাল কিভাবে ক্ষমতায় আসেন তা নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতভেদ আছে। কেউ কেউ যুক্তি দেখান যে, জনগণই গোপালকে রাজা নির্বাচিত করেন। তিনি কিছু সংখ্যক প্রভাবশালী ব্যক্তি বা নেতার সমর্থন লাভ করেই রাজা হন ও মাৎস্যন্যায়ের অবসান ঘটিয়ে জনসমর্থন লাভ করেন। পাল লিপিতে দাবি করা হয়েছে যে, গোপাল ‘বেপরোয়া ও স্বেচ্ছাচারী লোকদের পরাভূত করে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠা করেন’।

অন্য কথায় বলা যায়, যারা বাংলায় মাৎস্যন্যায় অবস্থার সৃষ্টি করেছিল তাদের তিনি সমূলে উৎপাটন করেন। মাৎস্যন্যায় সময়ে আসলে কী ধরণের সামাজিক অবস্থা বিরাজ করেছিলো তার প্রত্যক্ষ কোনো সাক্ষ্য ইতিহাসে পাওয়া যায় না। আমরা একথা বলতে পারি গোপালের উত্থানের মাধ্যমে এই অঞ্চল শাসক পেয়েছিলো। প্রতিষ্ঠিত হয়েছে প্রায় সাড়ে চারশত বছরের পাল সাম্রাজ্য। পাল সাম্রাজ্যের রাজারা যখন বাংলা শাসন করে তখন পৃথিবীতে সবচেয়ে ক্ষমতাবান গোষ্ঠী ছিলো মুসলিমরা। আগামী পর্বে পাল সাম্রাজ্য নিয়ে আলোচনা হবে ইনশাআল্লাহ।

২১ জুন, ২০১৯

আল্লাহর রাসূল সা.-এর দৃষ্টিতে 'খারেজি'



আবু বকর জাকারিয়াসহ কিছু সালাফী কথিত আলিম তবে তাদের ভূমিকা জালিমের মতো তারা ইখওয়ানুল মুসলেমিন ও জামায়াতে ইসলামীর লোকদের খারেজী বলে আখ্যায়িত করেছেন। এই প্রসঙ্গে আমি কিছু বলবো না। তবে আমাদের প্রিয় রাসুল সা. এর কথা অনুসারে খারেজীদের কিছু বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করার চেষ্টা করবো। এতে আপনারা বুঝতে পারবেন কারা খারেজী হতে পারে এবং জামায়াত-ইখওয়ান আসলে খারেজী দল কিনা।

শাব্দিক অর্থে ‘খারেজী’ শব্দটি আরবী ‘খুরূজ’ (الخروج) শব্দ হ’তে এসেছে, যার অর্থ ‘বের হওয়া বা বেরিয়ে যাওয়া’। বহুবচনে ‘খাওয়ারিজ’ ব্যবহৃত হয়। পারিভাষিক খারেজী হ’ল- ‘এমন ব্যক্তি বা দল যে বা যারা এমন হক ইমামের (শাসক) বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে, যাকে লোকেরা ইমাম হিসাবে স্বীকার করে নিয়েছে। ইবনু হাযম আন্দালুসী (রহ.)-এর সংজ্ঞা অনুযায়ী ‘খারেজী বলতে প্রত্যেক এমন সম্প্রদায়কে বুঝায় যারা চতুর্থ খলীফা আলী (রা.)-এর বিরুদ্ধে বিদ্রোহকারীদের মতামত কিংবা তাদের রায় অবলম্বনকারী, তা যেকোন যুগেই হোক না কেন’।

খারেজীদের ব্যাপারে রাসূল সা. যা বলেছেন :
‘আলী (রা) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি নবী (সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম)- কে বলতে শুনেছি যে, শেষ যামানায় এমন একদল মানুষের আবির্ভাব হবে, যারা হবে কমবয়স্ক এবং যাদের বুদ্ধি হবে স্বল্প। ভাল ভাল কথা বলবে, কিন্তু তারা ইসলাম থেকে এমনভাবে বের হয়ে যাবে যেমন তীর ধনুক থেকে বেরিয়ে যায়। তাদের ঈমান গলার নিচে পৌঁছবে না। (বুখারী- ৫০৫৭)

১- বয়স কম। 
২- প্রজ্ঞা, বুদ্ধি ও হিকমাহ থাকবে না। 
৩- উত্তম কথা বলবে, হক কথা বলবে। 
৪- তারা পরিপূর্ণ ঈমানদার হতে পারবে না। তারা কিছু অংশ মানবে কিছু মানবে না।

আবূ সা’ঈদ খুদরী (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রসূলুল্লাহ্ (সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম)- কে বলতে শুনেছি, ভবিষ্যতে এমন সব লোকের আগমন ঘটবে, যাদের সলাতের তুলনায় তোমাদের সলাতকে, তাদের সওমের তুলনায় তোমাদের সওমকে এবং তাদের ‘আমালের তুলনায় তোমাদের ‘আমালকে তুচ্ছ মনে করবে। তারা কুরআন পাঠ করবে, কিন্তু তা তাদের কণ্ঠনালীর নিচে (অর্থাৎ অন্তরে) প্রবেশ করবে না। এরা দ্বীন থেকে এমনভাবে বেরিয়ে যাবে যেমনভাবে নিক্ষিপ্ত তীর ধনুক থেকে বেরিয়ে যায়। (বুখারী-৫০৫৮)
এখানে কিছু বৈশিষ্ট্য পাওয়া যায়।

৫- তাদের সালাত ও সিয়াম সুন্দর হবে। তারা ইবাদতে খুব নিষ্ঠাবান হবে।
৬- তারা কুরআন পাঠকারী হবে, তবে কুরআন বুঝতে তারা সক্ষম হবে না। ইলমগত দৈন্যতা থাকবে।

আবূ সা’ঈদ (রা.) থেকে বর্ণিত, একবার রাসূল সা. কিছু গনিমতের মাল বন্টন করছিলেন। তখন এক ব্যক্তি এসে বললো, হে মুহাম্মাদ! আল্লাহকে ভয় করুন। ইনসাফ করুন। তখন তিনি বললেন, আমিই যদি নাফারমানী করি তাহলে আল্লাহর আনুগত্য করবে কে? আল্লাহ আমাকে পৃথিবীবাসীর উপর আমানতদার বানিয়েছেন আর তোমরা আমাকে আমানতদার মনে করছ না। তখন এক ব্যক্তি তাঁর নিকট তাকে হত্যা করার অনুমতি চাইল। [আবূ সা’ঈদ (রাঃ) বলেন] আমি তাকে খালিদ ইবনু ওয়ালিদ (রাঃ) বলে ধারণা করছি। কিন্তু নবী‎ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাকে নিষেধ করলেন। অতঃপর অভিযোগকারী লোকটি যখন ফিরে গেল, তখন নবী‎ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, এ ব্যক্তির বংশ হতে বা এ ব্যক্তির পরে এমন কিছু সংখ্যক লোক হবে তারা কুরআন পড়বে কিন্তু তা তাদের কণ্ঠনালী অতিক্রম করবে না। দ্বীন হতে তারা এমনভাবে বেরিয়ে পড়বে যেমনি ধনুক হতে তীর বেরিয়ে যায়। তারা ইসলামের অনুসারীদেরকে (মুসলিমদেরকে) হত্যা করবে আর মূর্তি পূজারীদেরকে হত্যা করা হতে বাদ দেবে। আমি যদি তাদের পেতাম তাহলে তাদেরকে আদ জাতির মত অবশ্যই হত্যা করতাম। (বুখারী- ৩৩৪৪) ইবনে তাইমিয়্যাহ বলেনঃ খারেজীদের সবচেয়ে মারাত্মক যে দোষ মহানবী (সা) বর্ণনা করেছেন তা হলো তারা ইসলাম পন্থীদের হত্যা করবে, এবং মূর্তিপূজকদের ছেড়ে কথা কথা বলবে। (মাজমূ’, ২৮/৫২৮) ইমাম কুরতবী বলেনঃ তারা মুসলিমদের কাফির সাব্যস্ত করে যখন তাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করবে, তাদের রক্ত তখন তারা হালাল মনে করবে, আর ঐ দেশের কাফির জনশক্তিকে ছেড়ে দেবে। (আল মুফহিম, ৩/১১৪)

৭- তাদের আদব জ্ঞান থাকবে না। যার তার ভুল ধরবে অযথা। সবসময় নিজেদের সহীহ মনে করবে। অন্যদের বাতিল মনে করবে। 
৮- তারা ইসলামের অনুসারীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হবে। মুরশিকদের বিরুদ্ধে তাদের কোনো বক্তব্য থাকবে না।

আনাস বিন মালিক (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, শেষ যমানায় এ উম্মাতের মধ্যে একটি সম্প্রদায় আবির্ভূত হবে, যারা কুরআন পড়বে কিন্তু তা তাদের কণ্ঠনালীর নিচে যাবে না। তাদের চিহ্ন হবে মুণ্ডিত মাথা। ইবনে মাজাহ- ১৭৫

৯- তাদের অনেকের মাথা মুন্ডানো থাকবে।

মহানবী (সঃ) বলেছেনঃ এরা এমন হবে যে মানুষদের বিস্মিত করাবে, এবং তারা নিজদের নিয়েই গর্ব বোধ করবে। (আহমাদ, ১২৯৭২, আলবানী হাদীসকে সাহীহ বলেছেন)।

১০- তাদের মধ্যে ইবাদতের অহংকার থাকবে।


আল্লাহর রাসূলের ভাষা অনুসারে এখানে প্রায় দশটি বৈশিষ্ট্য পাওয়া যায়। এখানে কিছু ভালো গুণ রয়েছে। এর মানে এই না যে আমরা ভালো গুণগুলো অর্জন করবো না। যখন কোন ব্যক্তি বা গোষ্ঠী উম্মাহর মধ্যে ফিতনা সৃষ্টি করবে, নিজেদের ছাড়া সবাইকে বাতিল বলবে, জাহান্নামী বলবে তখন আমরা খেয়াল করবো তাদের মধ্যে উপরোক্ত ভালো গুণগুলো আছে কিনা। যদি সব মিলে যায় তাহলে আমরা তাদের খারেজি হিসেবে ধারণা করতে পারবো।


খারেজী যেভাবে সৃষ্টি হয়েছিলো
আলী (রা.)-এর শাসনামলে খলীফা নির্বাচনকে কেন্দ্র করে মুনাফিক ও খারেজীদের চক্রান্তে মুসলমানরা দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। এক দল আলী (রা.)-এর এবং অন্য দল মু‘আবিয়া (রা)-এর পক্ষাবলম্বন করে। ক্রমে অবস্থা রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের দিকে এগিয়ে যায়। অবশেষে ৬৫৭ সালের জুলাই মাসে ‘সিফ্ফীন’ নামক স্থানে আলী (রা.)-এর সাথে মু‘আবিয়া (রা.)-এর যুদ্ধ শুরু হয়। যুদ্ধকালে সমস্যার সমাধানের লক্ষে দু’জন বিচারক নির্ধারণ করা হয় এই মর্মে যে, তারা দু’জনে মুসলিম উম্মাহর কল্যাণের জন্য যে সিদ্ধান্ত দিবেন তা উভয় পক্ষ মেনে নিবে। আলী (রা.)-এর পক্ষ থেকে আবু মূসা আশ‘আরী (রা.) এবং মু‘আবিয়া (রা.)-এর পক্ষ থেকে আমর ইবনুল আস (রা.)-কে নির্ধারণ করা হয়। ঘটনাটি ইসলামের ইতিহাসে ‘তাহকীম’ বা সালিস নির্ধারণ নামে পরিচিত। 

যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর শাম ও ইরাকের সকল সাহাবীর ঐক্যমতে বিচার ব্যবস্থা পৃথকীকরণ এবং আলী (রা.)-এর কুফায় ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এই সিদ্ধান্তকে অমান্য করে তখনই আলী (রা.)-এর দল থেকে কিছু লোক বের হয়ে যায় এবং ‘হারুরা’ নামক প্রান্তরে এসে অবস্থান করে। তাদের সংখ্যা মতান্তরে ৬, ৮, ১২ অথবা ১৬ হাজার হবে। বিচ্ছিন্নতার সংবাদ পেয়ে আলী (রা.) দূরদর্শী সাহাবী আব্দুল্লাহ ইবনু আব্বাস (রা.)-কে তাদের নিকট প্রেরণ করেন। তিনি তাদের সংশয়গুলিকে বিচক্ষণতার সাথে খন্ডন করায় বেরিয়ে যাওয়াদের মধ্য থেকে প্রায় ৪ অথবা ৬ হাযার লোক আলী (রা.)-এর আনুগত্যে ফিরে আসেন। অতঃপর আলী (রা.) কুফার মসজিদে দাঁড়িয়ে ভাষণ দিলে মসজিদের এক কোনায় ‘লা হুকমা ইল্লা লিল্লাহ’ ‘আল্লাহর হুকুম ছাড়া কারো হুকুম মানি না’ স্লোগানে তারা মসজিদ প্রকম্পিত করে তুলে। তারা আলী (রা.)-কে উদ্দেশ্য করে বলে যে, আপনি বিচার ব্যবস্থা মানুষের হাতে তুলে দিয়েছেন! অথচ বিচারের মালিক হচ্ছেন আল্লাহ্। আপনি সূরা আন‘আমের ৫৭নং আয়াত (ان الحكم الا لله) ‘আল্লাহ ব্যতীত কারো ফায়সালা গ্রহণযোগ্য নয়’-এর হুকুম ভঙ্গ করেছেন। আল্লাহর বিধানের প্রতি অবজ্ঞা প্রদর্শনের জন্য আপনি মুশরিক হয়ে গেছেন ইত্যাদি।

তাদের মতে আলী, মু‘আবিয়া, আমর ইবনুল আসসহ সালিশ সমর্থনকারী সকল সাহাবী কুফরী করেছেন এবং কাফের হয়ে গেছেন। অথচ সত্য হ’ল, মানুষের বিচারের জন্য মানুষকেই বিচারক হতে হবে। আর বিচার হবে আল্লাহর আইন অনুসারে।

খারেজীরা নিজেদের এই নির্বুদ্ধিতাকে ধর্মীয় গোঁড়ামিতে রূপ দান করে এবং মুসলমানদের মাঝে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের সূচনা করে। আলী (রা.) তাদের উদ্দেশ্যে বলেন, ‘তোমাদের ব্যাপারে আমরা তিনটি সিদ্ধান্ত নিয়েছি। ১. তোমাদেরকে মসজিদে আসতে আমরা নিষেধ করব না ২. রাষ্ট্রীয় সম্পদ হ’তে আমরা তোমাদের বঞ্চিত করব না ৩. তোমরা আগে ভাগে কিছু না করলে আমরা তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করব না।

কিছুদিন পর তারা সাধারণ মুসলমানদের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করতে শুরু করে। তখন আব্দুল্লাহ বিন খাব্বাব (রা.) রাসূল (সা.)-এর ফিতনা সংক্রান্ত হাদীস শুনালে তারা তাঁকে হত্যা করে। তাঁর গর্ভবতী স্ত্রীকেও হত্যা করে। আলী (রা.) জিজ্ঞেস করেন, ‘আব্দুল্লাহকে কে হত্যা করেছে? জবাবে তারা ঔদ্ধত্য প্রদর্শন করে বলে, আমরা সবাই মিলে হত্যা করেছি। এরপর আলী (রাঃ) তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের প্রস্ত্ততি নেন। যুদ্ধের আগে তিনি নিজে ইবনু আববাস ও আবু আইয়ূব (রা.) সহ তাদের সাথে কয়েক দফা আলোচনা করেন এবং তাদের বিভ্রান্তিগুলো দূর করে সঠিক পথে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করেন।

নাহরাওয়ানের যুদ্ধে বেঁচে যাওয়া খারেজীরা প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য দীর্ঘদিন যাবৎ প্রস্ত্ততি গ্রহণ করে। অতঃপর তারা আলী (রা.)-কে হত্যা করার জন্য গোপনে আব্দুর রহমান বিন মুলজামকে ঠিক করে। অনুরূপভাবে মু‘আবিয়া (রা.)-এর কে হত্যা করার জন্য বারাক বিন আব্দুল্লাহকে এবং আমর ইবনুল আস (রা.)-কে হত্যা করার জন্য আমর বিন বাকরকে নির্বাচন করে। এভাবে তারা একইদিনে হত্যা করার জন্য অঙ্গীকারাবদ্ধ হয়ে বেরিয়ে পড়ে। আব্দুর রহমান বিন মুলজাম তার দু’জন সহযোগী ওরদান ও শাবীবকে সঙ্গে নিয়ে ৪০ হিজরীর ১৭ রামাযান জুম‘আর রাতে কুফায় গমন করে। ফজরের সময় আলী (রা.)-এর বাড়ীর দরজার আড়ালে অস্ত্র নিয়ে ওঁৎ পেতে থাকে। তিনি বাড়ী থেকে বের হয়ে যখন ‘সালাত’ ‘সালাত’ বলে মানুষকে ডাকতে ডাকতে মসজিদের দিকে যাচ্ছিলেন, তখনই তারা আলী (রাঃ)-এর মাথায় অস্ত্র দিয়ে আঘাত করে। এতে তাঁর দাড়ি রক্তে রঞ্জিত হয়ে যায়। তৎক্ষণাৎ তিনি মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। এ সময় আলী (রা.)-কে লক্ষ্য করে ঐ রক্তপিপাসু বলেছিল,لا حكم إلا لله ليس لك يا علي ولا لأصحابك، ‘হে আলী! আল্লাহ ছাড়া কারো বিধান নেই। তোমার জন্যও নেই এবং তোমার সাথীদের জন্যও নেই হে আলী’। তাকে হত্যা করার কারণ জিজ্ঞেস করলে সে বলে উঠে,شحذته أربعين صباحا وسألت الله أن أقتل به شر خلقه ‘আমি চল্লিশ দিন যাবৎ তরবারিকে ধার দিয়েছি এবং আল্লাহর নিকট প্রার্থনা করেছি, আমি যেন এই অস্ত্র দ্বারা তাঁর সৃষ্টির মধ্যে সর্বনিকৃষ্ট ব্যক্তিকে হত্যা করতে পারি’ (নাঊযুবিল্লাহ্)।

আলী (রা.) বলেছিলেন, আমি মারা গেলে তোমরা তাকে হত্যা করবে। আর বেঁচে থাকলে আমিই যা করার করব। কিন্তু তিনদিন পর ৪০ হিজরীর ২১শে রামাযান ৬৩ বা ৬৪ বছর বয়সে তিনি শাহাদতবরণ করেন। ঐ দিন একই সময় মু‘আবিয়া (রা.)-কে আঘাত করলে তিনি প্রাণে বেঁচে যান। আমর ইবনুল আস (রা.) ভীষণ অসুস্থ থাকায় তিনি সেদিন মসজিদে আসতে পারেননি। ফলে তিনি বেঁচে যান। তবে তাঁর স্থলাভিষিক্ত ইমাম খারেজাহ ইবনু আবী হাবীবাকে ঐ ঘাতক হত্যা করে। এভাবেই খারেজীরা খুলাফায়ে রাশেদার মত জান্নাতী ও বিশিষ্ট ছাহাবীগণের প্রাণনাশ ঘটিয়ে ইসলামের সোনালী ইতিহাসকে কলংকিত করে।



বাংলাদেশের ক্ষেত্রে যেসব আলেম মুসলিমদের বিভিন্ন গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে ফতোয়া দিবে অথচ ভারতীয় মুশরিকদের হত্যাকাণ্ড, অন্যায় ও আগ্রাসনের ব্যাপারে তাদের কোনো বক্তব্য থাকবে না তখন আপনারা সহজে বুঝে নিবেন তারা খারেজি।

তবে আমরা কখনোই কাউকে খারেজি বলবো না। আমরা চেষ্টায় রত থাকবো যাতে করে তারা ফিরে আসে। উম্মাহর অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়। আল্লাহ্‌ আমাদের তার অনুগত গোলামদের অন্তর্ভুক্ত রাখুন। আমীন।

২০ জুন, ২০১৯

বঙ্গকথা পর্ব-০৬ : শোষণের যে যুগকে স্বর্ণযুগ বলা হয়

গুপ্ত সাম্রাজ্যের অধিকৃত এলাকা
উত্তর ভারতে কুষাণরা ও দাক্ষিণাত্যে সাতবাহন রাজারা কিছুটা রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি স্থাপনে সক্ষম হয়েছিল। কিন্তু খ্রিস্টীয় তৃতীয় শতকের মধ্যভাগে উভয় সাম্রাজ্যের পতন হয়। এর জন্য উল্লেখযোগ্য কারণ হলো শাসকদের ব্যর্থতা ও বৈদেশিক আক্রমণ। এরপর এই অঞ্চলে গুপ্ত শাসন প্রতিষ্ঠা হয়। গুপ্ত সাম্রাজ্যকে এদেশের বাহ্মণ্যবাদীরা ও বর্তমান প্রতিষ্ঠিত ইতিহাসে গুপ্ত যুগকে স্বর্ণযুগ বলা হয়। কিন্তু আসলে সেটা ছিলো একটি শোষণের যুগ।

৩২০ খ্রিস্টাব্দে রাজা ১ম চন্দ্রগুপ্তের অভ্যুত্থানের ফলে এই রাজনৈতিক শুন্যতার অবসান হয় । কুষাণ ও সাতবাহন উভয় সাম্রাজ্যের বেশ কিছু অংশ গুপ্ত সাম্রাজ্যের অন্তর্ভূক্ত হলেও অয়তনের দিক থেকে গুপ্ত সাম্রাজ্য মৌর্য সাম্রাজের তুলনায় ছোটো ছিল । গুপ্ত সাম্রাজ্য প্রধানত বিহার ও উত্তর প্রদেশেই সীমাবদ্ধ ছিল । বিহার অপেক্ষা উত্তর প্রদেশই ছিল এই সভ্যতার প্রাণকেন্দ্র। গুপ্ত সাম্রাজ্যের মুদ্রা ও শিলালিপি প্রধানত এখান থেকেই পাওয়া গেছে। গুপ্ত রাজারা সম্ভবত আর্য তথা ব্রাহ্মন্যবাদী ছিলো। এরা কুষাণ রাজাদের সামন্ত হিসাবে উত্তর প্রদেশে শাসন করতেন। গুপ্ত সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন শ্রীগুপ্ত । তিনি ২৭৫ খ্রিস্টাব্দে সিংহাসনে আরোহণ করেন। গুপ্ত সাম্রাজ্য ২৭৫ সালে প্রতিষ্ঠিত হলেও মূলত ৩২০ খ্রিস্টাব্দেই এটি এই অঞ্চলে সাম্রাজ্য হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে এবং কুষাণদের অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যায়।

প্রথম চন্দ্রগুপ্ত গুপ্ত সাম্রাজ্যের প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন প্রথম চন্দ্রগুপ্ত । তিনি লিচ্ছবি রাজকন্যা কুমারদেবীকে বিবাহ করে গাঙ্গেও উপত্যকায় নিজ প্রাধান্য স্থাপন করেন । তাঁর রাজ্য উত্তর প্রদেশের পূর্বাংশ, বিহার, এমনকি বাংলা পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল । মৃত্যুর পূর্বে তিনি পুত্র সমুদ্রগুপ্তকে নিজ উত্তরাধিকারী বলে ঘোষণা করে যান ।

গুপ্ত রাজাদের মধ্যে সমুদ্রগুপ্ত ছিলেন শ্রেষ্ঠ ও শক্তিশালী। তিনি ৩৮০ সাল পর্যন্ত শাসন করেন। শৌর্য-বীর্য, চারিত্রিক দৃঢ়তা ও সংস্কৃতির প্রতি পৃষ্ঠপোষকতার জন্য তিনি ভারত ইতিহাসে একটি অত্যন্ত মর্যাদাপূর্ণ স্থান অধিকার করে আছেন। তিনি ৩৩৫ সালে পিতৃ সিংহাসন লাভ করেন। তার আমলে নোয়াখালী ও কুমিল্লা (সমতট) অঞ্চল ছাড়া পুরো বাংলা গুপ্ত শাসনের অধীনে চলে আসে। কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র এই রাজার প্রশংসা করেছে তাকে বলেছেন–বিজিগীষু, অর্থাৎ যে আশপাশের রাজ্যগুলোর সঙ্গে যুদ্ধ করে সেগুলো নিজের দখলে আনতে পারে। সমুদ্রগুপ্ত ছিলেন এমনই এক বিজিগীষু রাজা যিনি অনেক রাজার ও অনেক জাতের মানুষের সঙ্গে অনেক দিন ধরে যুদ্ধ করেন ও জয়লাভ করেন। সেই কাহিনি এলাহাবাদের একটি প্রকাণ্ড পাথরের থামে তিনি খোদাই করিয়ে রাখেন। সেটি আজও আছে।

সমুদ্রগুপ্তের পুত্ৰ দ্বিতীয় চন্দ্ৰগুপ্ত (৩৮০-৪১২ খ্রিস্টাব্দ) গুপ্তবংশের বিখ্যাত রাজা। ইনি সরাসরি যুদ্ধ না করে বরং বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন করে নিজের রাজপ্রতাপ প্রতিষ্ঠিত করেন। নিজের মেয়ে প্রভাবতীর বিয়ে দেন মধ্যভারতের ব্রাহ্মণ বাকাটক রাজপুত্রের সঙ্গে, এতে জগতে ওঠাও হল আবার বাক্যটকদের মধ্যে নিজের প্রভাব বিস্তার করাও হল। বাকাটক রাজপুত্রের মৃত্যুর পরে প্রভাবতীই বাকাটক মহিষী হয়ে রাজত্ব করেন।

গুপ্ত আমলে কেন্দ্রীয় শাসন সারা রাজ্যে সমান ছিল না। রাজধানী থেকে যে অঞ্চল যত দূরে, শাসনব্যবস্থা সেখানে ততই শিথিল। রাজস্ব আদায় গুপ্তরা খুবই অত্যাচারী ছিলো। ফসলের এক চতুর্থাংশ রাজস্ব বলে আদায় করা হতো। সৈন্যদল খুব শক্তিশালী ছিল, রাজকোষ থেকে প্রতিরক্ষা খাতে বিস্তর খরচ হত। যুদ্ধে রথ ক্রমে অপ্রচলিত হয়ে পড়ছিল, তার বদলে অশ্বারোহী সৈন্যই প্রাধান্য পাচ্ছিল। ঘোড়সওয়ার তীরন্দাজরাই এ সময়ে সৈন্যদলে যোদ্ধা ছিল। রাজার সৈন্যদল রাজ্যের যে অঞ্চল দিয়ে যাত্রা করত, সেই সব স্থানীয় লোকজনদের সৈন্যদল এবং ঘোড়াদের খাবারের ব্যবস্থা করতে হত। সেনাপতি এবং উচ্চপদস্থ কর্মচারীদের খাওয়াদাওয়া, বিশ্রাম ও বিলাসের সব ব্যবস্থাই করতে হত সাধারণ গ্রামবাসীদের। রাজার সৈন্যদল ও কর্মচারীদের পরিচর্যা করতে হত জনগণের। চাষিদের আর্যদের ক্ষেতখামারে কাজ করতে হতো বাধ্যতামূলকভাবে এবং বিনা পারিশ্রমিক বা যৎসামান্য বেতনে।

গুপ্ত আমল ছিলো দ্রাবিড় নির্মূলের স্বর্ণযুগ। গুপ্ত আমলের পরে দ্রাবিড়রা তাদের জাতিসত্তা হারিয়ে ফেলে। জাতিসত্তার বিকাশধারা বইয়ে মোহাম্মদ আব্দুল মান্নান বলেন, বাংলায় দ্রাবিড়দের প্রতিরোধের ফলে দীর্ঘ দিন আর্য-প্রভাব ঠেকিয়ে রাখা সম্ভব হয়। এরপর খ্রিস্টীয় চার ও পাঁচ শতকে গুপ্ত শাসনে আর্য ধর্ম, আর্য ভাষা ও আর্য সংস্কৃতি বাংলাদেশে প্রত্যক্ষভাবে শিকড় গাড়ে। তৃতীয় ও চতুর্থ শতক পর্যন্ত বাংলাদেশে আর্য বৈদিক হিন্দু ধর্মের কিছুই প্রসার হয়নি। ষষ্ঠ শতকের আগে বঙ্গ বা বাংলার পূর্ব-দক্ষিণাঞ্চলে ব্রাহ্মণ্য ধর্ম ঢুকতেই পারেনি। উত্তর-পূর্ববাংলায় ষষ্ঠ শতকের গোড়াতেই ব্রাহ্মণ্য সমাজ গড়ে ওঠে। পঞ্চম ও অষ্টম শতকের মধ্যে ব্যক্তি ও জায়াগার সংস্কৃতি নাম পাওয়া যায়।

এই প্রসঙ্গে ড. নীহাররঞ্জন রায় অনুমান করেন যে, গুপ্ত আমলে বাংলার আর্যকরণ দ্রুত এগিয়ে চলছিল। বাঙালি সমাজ উত্তর ভারতীয় আর্য-ব্রাহ্মণ্য বর্ণ-ব্যবস্থার অন্তর্ভূক্ত হচ্ছিল। অযোধ্যাবাসী ভিণ প্রদেশী বাহ্মণ, শর্মা বা স্বামী, বন্দ্য, চট্ট, ভট্ট, গাঙি নামে ব্রাহ্মণেরা জেঁকে বসেছিল। তিনি বলেন,

“বাংলাদেশের নানা জায়গায় ব্রাহ্মণেরা এসে স্থায়ী বাসিন্দা হতে লাগলেন, এরা কেই ঋগ্বেদীয়, কেই বাজসনেয়ী, কেউ শাখাব্যয়ী, যাজুর্বেদীয়, কেই বা সামবেদীয়, কারও গোত্র কান্ব বা ভার্গব, বা কাশ্বপ, কারও ভরদ্বাজ বা অগস্ত্য বা বাৎসা বা কৌন্ডিন্য। এমনি করে ষষ্ঠ শতকে আর্যদের বৈদিক ধর্ম ও সংস্কৃতির ঢেউ বাংলার পূর্বতম প্রান্তে গিয়ে পৌঁছল”। (ডক্টর নীহাররঞ্জন রায় : বাঙালির ইতিহাস, আদি পর্ব, পৃষ্ঠা ১৩২)

ঐতিহাসিক সুকুমারী ভট্টাচার্যের 'প্রাচীন বাংলা' বইয়ে সেসময়ের সমাজচিত্র, নারী ও ধর্মীয় বিদ্বেষ নিয়ে যে চিত্র ফুটে উঠেছে তা উল্লেখ করা হলো, এই সময়ে বহিরাগত আগস্তুক গোষ্ঠী বিজয়ী হলে যেমন সমাজে ‘ক্ষত্রিয়’ পরিচয় পাচ্ছিল, তেমনি প্ৰাস্তিক দ্রাবিড় আদিবাসীরা ব্ৰাহ্মাণ্য সমাজে নিম্নবর্ণের মানুষ হিসাবে ঠাঁই পেয়েছিল। জাতি-উপজাতির সংখ্যা বেড়েই চলেছে। এদের মধ্যে নতুন নতুন গোষ্ঠীকে আঙ্গুত বা অস্পৃশ্য নাম দেওয়া হচ্ছে। সাধারণ ভাবে এদের চণ্ডাল বলা হয়। পঞ্চম শতকে ফাক শিয়েন এ দেশের সমাজে বিপুল সংখ্যক চণ্ডাল দেখেছিলেন। এরা মাছ মাংস বিক্রি করত, অন্যান্য নিচু কাজ করত এবং সমাজে এদের ঠাঁই ছিল না; তাই এদের গ্রামের বাইরে থাকতে হত। শহরে এলে উচ্চবর্ণের মানুষ এদের ছোঁয়া বঁচিয়ে রাস্তায় হাঁটত, যাতে এদের অশুচিতা কোনওভাবেই তাদের স্পর্শ না করে।

সমাজে রাজা ও রাজন্যদের প্রসাদে ব্ৰাহ্মণদের আধিপত্য প্রবল ছিল, দানে পাওয়া নিষ্কর জমিতে নিচু বর্ণের প্রজাদের কাছে খাজনা আদায় করে তাদের দণ্ডমুণ্ডের কর্তা হয়ে ব্রাহ্মণরা নিজেদের প্রতিপত্তি ঘোষণা করত। দেশে এবং বিদেশে বাণিজ্যের দরুণ বৈশ্যদের হাতে বিস্তর টাকা জমত। ফলে সমাজে তাদের প্রতিপত্তিও যথেষ্ট ছিল। এ সময়ে নারী ও শূদ্রদের বেদে কোনও অধিকার ছিল না। গুপ্ত যুগে সমাজ ক্রমশই রক্ষণশীল হয়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে নারী ও শূদ্রের স্বাধীনতা ক্রমে সংকুচিত হয়ে এল।

কৃষ্ণ-কেন্দ্ৰিক উপাসনার চল হওয়াতে আগে শূদ্র সম্প্রদায় বৈষ্ণব ধর্মে ধর্মাচরণে একটা অধিকার পেল, কিন্তু তাও অধিকাংশ ক্ষেত্রে ব্রাহ্মণদের নিয়ন্ত্রণে শাস্ত্রকার পুরোহিতের নির্দেশ অনুসারে তাদের অধিকার নির্ধারিত হত। সংখ্যায় অর্ধেক হলেও নারীর অধিকার, সমস্ত শাস্ত্রে ক্রমশই খর্ব করার চেষ্টা হয়েছে। নানা কাহিনি ও তত্ত্বকথা শোনানো হল সাধারণ মানুষকে, যাতে দেখানো হয়েছে নারী স্বভাবত পাপিষ্ঠ, পুরুষের অধঃপতনের হেতু, তার প্রকৃতিইহীন, তার একমাত্র কর্তব্য স্বামী ও শ্বশুরবাড়ির দাস্য। এই সময়ে রচিত নাটক অভিজ্ঞানশকুন্তলম-এ পড়ি, দুষ্যন্ত শকুন্তলাকে অকারণে পরিত্যাগ করবার পর কণ্বের শিষ্য শার্ঙ্গরব রাজাকে বলছে: ‘এ তোমার স্ত্রী, একে ত্যাগ কর বা গ্রহণ কর (যা তোমার ইচ্ছা), কারণ স্ত্রীর ওপরে স্বামীর সর্বতোমুখী প্ৰভুত্ব আছে।’

একেবারে ওপরতলার মেয়েরা অলংকার, সম্পত্তি ও জমির মালিকানা পেত; শ্বশুরবাড়ির লোকেরা সজন হলে স্ত্রীধান, যৌতুক ও অন্যান্য সম্পত্তিতেও নারীরা অধিকারও পেত। কিন্তু শাস্ত্র বলেছে, দেহ বা ধনের ওপরে নারীর কোনও অধিকার থাকবে না। ফলে নারীর নিগ্রহ শাস্ত্রসম্মত, পুরোপুরি মানুষের মর্যাদা না পাওয়াই গুপ্ত সমাজে নারীর অবস্থানের যথার্থ চিত্র।

গুপ্ত যুগের শাস্ত্রে ও সাহিত্যে আবার নতুন করে ব্ৰাহ্মণ্য ধর্মের পুনরুজ্জীবনের এক সক্রিয় চেষ্টা চোখে পড়ে। যাগযজ্ঞ নতুন করে বিস্তর জাঁকজমকের সঙ্গে অনুষ্ঠিত হত। বৌদ্ধ, জৈন ও আজীবিক প্রভাবে বৈদিক ধর্ম যেটুকু প্রতিহত হয়েছিল সেই সব ক্ষতিপূরণ করে যজ্ঞ নতুন করে সমাজে এল। এর একটা কারণ হল রাজা ও ধনীদের হাতে বিস্তর সম্পত্তি জন্মেছিল যাতে তাদের এ সব খরচ বহন করবার সামর্থ হয়েছিল। এরই সঙ্গে বৈদিক যুগেরও আগেকার সমাজে যে সব আঞ্চলিক পূজা প্রচলিত ছিল সেগুলো এখন মাথা তুলল। এর সঙ্গে যুক্ত হল নানা আঞ্চলিক দেবতার উপাসনার পদ্ধতি, তৈরি হতে লাগল বিভিন্ন পুরাণ। বিভিন্ন দেবতাকে কেন্দ্র করে নতুন নতুন দেবতার অভ্যুত্থান ঘটল, পূজার বিস্তার হল বৃহৎ গুপ্ত সাম্রাজ্যের পরিসরে।

১৫ জুন, ২০১৯

বঙ্গকথা পর্ব-০৫ : কুষাণ সাম্রাজ্য ও বৌদ্ধধর্মের বিকৃতির ইতিহাস

কুষাণ ও সাতবাহন সাম্রাজ্যের মানচিত্র
গত পর্বে সাতবাহন সাম্রাজ্য পর্যন্ত এসেছিলাম। সাতবাহনরা মূলত অন্ধ্রপ্রদেশ ভিত্তিক হিন্দুস্থানের দক্ষিণ অংশে শাসন করতো। তারা বাংলা অধিকার করলেও বাংলায় তাদের ভালো প্রভাব কখনোই স্থায়ী হয়নি। তবে তারা ভারতের দক্ষিণ অংশে বহু বছর শাসন করেছে। এই অংশে যাতায়াতের ভালো সুবিধে না থাকায় বিদেশী কোনো গোষ্ঠীই সাতবাহনদের পরাজিত করতে সক্ষম হয়নি বহু বছর। ঈশা আ. জন্মের ২৩০ বছর আগে থেকে শুরু হওয়া এই সাম্রাজ্য ইশা আ. জন্মের পরে আরো ২২০ বছর রাজত্ব করে। তাদের ইতিহাস প্রায় সাড়ে পাঁচশত বছরের ইতিহাস। আমরা যেহেতু বাংলার শাসকদের নিয়ে আলোচনা করবো তাই তাদের নিয়ে আর বিস্তারিত বলতে আগ্রহী নই। তবে ভারতের দক্ষিণ অঞ্চলের দ্রাবিড় গোষ্ঠীর কৃষ্টি কালচার ভুলিয়ে দিতে এই সাম্রাজ্য ভালো ভূমিকা রেখেছিলো।

সাতবাহনের পাশাপাশি বাংলার শাসক হিসেবে কুষাণ সাম্রাজ্যের কথাও শোনা যায়। মৌর্য সম্রাজ্যের পতনের পর যে সমস্ত বৈদেশিক জাতি ভারতে অনুপ্রবেশ করে ছিল, তাদের মধ্যে কুষাণরাই ছিল একমাত্র আলোচনাযোগ্য। চিনের উত্তর-পশ্চিম অংশে ইউ-চি নামে এক যাযাবর জাতি বাস করতো। হিউঙ-নু নামে অপর এক যাযবর জাতির তাড়া খেয়ে তারা সির দরিয়া নদী তীরবর্তী অঞ্চলে এসে সেখান থেকে শকদের বিতাড়িত করে বসবাস করতে শুরু করে । কিন্তু হিউঙ-নুরা এই অঞ্চল থেকেও তাদের উৎখাত করায় তারা আবার শকদের যারা ইতিপূর্বে তাদের তাড়া খেয়ে ব্যাকট্রিয়ায় বসতি স্থাপন করেছিল তাদের উৎখাত করে। পূর্বের সেই ব্যাকট্রিয়ার বর্তমান নাম বলখ। এটি বর্তমানে আফগানিস্তানের উত্তর দিকের একটি প্রদেশ।

ব্যাকট্রিয়ায় আসার পর ইউ-চিদের দলগত সংহতি বিনষ্ট হয় ও তারা পাঁচটি পৃথক শাখায় বিভক্ত হয়ে যায়। কুষাণরা ছিল এই পাঁচ গোষ্ঠীর অন্যতম । চৈনিক ঐতিহাসিক সুমা-কিয়েনের মত অনুযায়ী কুজল কদফিসেস নামে জনৈক ইউ-চি ঐ পাঁচটি গোষ্ঠীকে পুনরায় ঐক্যবদ্ধ করেন ও ভারতে প্রবেশ করে কাবুল ও কাশ্মীর দখল করেন । এই কুজুল কদফিসেস ছিলেন কুষাণ সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা । কুজুল কদফিসেস মারা গেলে তাঁর পুত্র বিম কদফিসেস রাজা হন ।

কণিষ্ক ছিলেন কুষাণ বংশের শ্রেষ্ঠ রাজা। তাঁর সঙ্গে কুজুল ও বিম কদফিসেসের কী সম্পর্ক ছিল, তা সঠিকভাবে জানা যায় না। অনেকে মনে করেন তাঁর সঙ্গে এই বংশের প্রথম দুটি রাজার সঙ্গে কোনো রক্তের সম্পর্ক ছিল না। কণিষ্কের আমলেই কুষাণ সাম্রাজ্য সর্বাপেক্ষা বেশি বিস্তার লাভ করে ও উত্তর ভারতের ইতিহাসে এক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে । কণিষ্কের সিংহাসন আরোহণের তারিখ সম্পর্কে ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতপার্থক্য আছে। তবে অধিকাংশ পণ্ডিতই মনে করেন ৭৮ খ্রিস্টাব্দে “শকাব্দ” নামে যে বর্ষগণনা শুরু হয়, কণিষ্ক ছিলেন তার প্রবর্তক। এই সূত্র অনুসারে কণিষ্ক ৭৮ খ্রিস্টাব্দেই সিংহাসনে আরোহণ করেন।

কণিষ্কের শাসনের সময়ই বাংলা কুষাণদের অধিকারে আসে। হিউয়েন সাঙের মতে কণিষ্কের বিশাল সাম্রাজ্যের রাজধানী ছিল পুরুষপুর বা বর্তমান পেশোয়ার এবং এর বিস্তৃতি ছিলো উত্তরে কাশ্মীর থেকে দক্ষিণে সাঁচী ও পশ্চিমে সিন্ধু উপত্যকা থেকে পূর্বে বারাণসী পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল।

বলা চলে সাতবাহন সাম্রাজ্য ও কুষাণ সাম্রাজ্যের মাঝামাঝি অবস্থান করেছে বাংলা অঞ্চল। ফলশ্রুতিতে কোনো সাম্রাজ্যেরই ভালো প্রভাব বিস্তার হয়নি এখানে। কেন্দ্রীয় শাসনের দূর্বলতার সুযোগে এখানে স্থানীয় জমিদার প্রথা চালু হয়েছে। কিছু অংশ প্রাচীন দ্রাবিড় গোষ্ঠী, কিছু বৌদ্ধরা ও কিছু অংশ ব্রাহ্মণ জমিদাররা শাসন করতো।

ভারতের ইতিহাসে কণিষ্কের স্থান ও গুরুত্ব অবশ্য কেবল মাত্র একজন কৃতি ও দক্ষ সেনানায়ক হিসাবে নয়। বৌদ্ধধর্মের পৃষ্ঠপোষক হিসাবে ও ভারতীয় সংস্কৃতিতে তাঁর অবদানের জন্যই কণিষ্ক চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন । তিনি নিজে বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করেন ও পুরুষপুরে একটি বহতল চৈত্য নির্মাণ করেন। অশোকের পর তার সময়েই বৌদ্ধধর্ম পুনরায় রাজানুগ্রহ লাভ করে। এর ঢেউ পড়ে বাংলাতেও। শুঙ্গ ও কাণ্ব শাসনের সময় পালিয়ে যাওয়া বৌদ্ধরা আবার বাংলায় ফিরে আসে এবং বগুড়ার মহাস্থানগড় তথা পুন্ড্রনগরে পুনরায় শক্তিশালী হয়ে ওঠে।

ভারতের বাইরে বৌদ্ধধর্ম প্রচারে কণিষ্ক সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। তাঁর প্রচেষ্টায় বৌদ্ধধর্ম খোটান, চিন, জাপান ও কোরিয়ায় ছড়িয়ে পড়ে। বৌদ্ধধর্মের ইতিহাসে কণিষ্ক ছিলেন দ্বিতীয় অশোক। এর প্রভাব বৌদ্ধধর্মের পৃষ্ঠপোষক হলেও কণিষ্ক অন্য ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ও সহনশীল ছিলেন বলে ইতিহাসে স্বীকৃত।

সাহিত্য ও সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষক হিসেবে কণিষ্ক উল্লেখযোগ্য কৃতিত্ব দাবি করতে পারেন। বুদ্ধচরিত রচয়িতা অশ্বঘোষ, বৌদ্ধ দার্শনিক নাগার্জুন, বৌদ্ধ সাহিত্যিক বসুমিত্র, স্বনামধন্য চিকিৎসক চরক, স্থপতি এজেসিলাস রাজনীতিবিদ মাথর প্রভৃতি মনীষীগণ তাঁর রাজত্ব কালেই আবির্ভুত হয়েছিলেন। তিনি অসংখ্য বৌদ্ধ বিহার, স্তুপ ও চৈত্য নির্মাণে উদ্যোগী হয়েছিলেন। তাঁরই সময়ে সারনাথ, মথুরা, গান্ধার ও অমরাবতীতে চারটি পৃথক শিল্পরীতির আবির্ভাব ঘটেছিল। তবে বৌদ্ধ ধর্মের বিকৃতিও ঘটে কুষাণদের সময়ে। একেশ্বরবাদে বিশ্বাসী কিছু কিছু বৌদ্ধ গোষ্ঠী বহু-ঈশ্বরবাদে বিশ্বাসী হয়ে পড়ে। কুষাণ আমলেই বুদ্ধের প্রতিমা তৈরির রীতি শুরু হয়।

কুষাণ আমলে মানবপুত্র বুদ্ধকে বসানো হয় ভগবানের আসনে। বুদ্ধের মূল দর্শনে আনা হয় দেবতা এবং মিথের সমষ্টি। বুদ্ধের দর্শন বিকৃতিতে যোগ হল স্বর্গ নরক, জাতক, বুদ্ধের জন্ম মৃত্যুর নানা কাহিনী নিয়ে হাজারো মিথ। তৎকালীন মানুষ ধ্যান সাধনা পরিত্যাগ করে জাঁকজমকভাবে বুদ্ধের পূজায় লিপ্ত হলেন। শুরু হল মহাজন এবং তন্ত্রজান বুদ্ধ ধর্মের ধারনি, মঞ্জুশ্রী মূল কল্প, গুহ্য সমাজ, চক্র সংবর, তৎকালীন ব্রতশ্চারন, বলি পূজা, পুরশ্চরন ইত্যাদি তপ-জপ ও তন্ত্র-মন্ত্রের প্রভাবে বৌদ্ধ ধর্ম আজকের রূপে এসে পৌছাল। যাতে হারিয়েছে গেছে বৌদ্ধ দর্শনের প্রকৃত সত্তা। সেখান থেকে উদ্ভব হয় স্তবিরবাদ এবং মহাসঙ্ঘবাদ। যে কারনে রচিত হয় বুদ্ধের নামে নানা সূত্র এবং পার্থক্য দেখা যায় সূত্র-পিটক এবং বিনয়-পিটকের মাঝে।

ধারণা করা হয় এই বিকৃতির কারণ বৌদ্ধদের কিছু পণ্ডিত ব্যক্তি যারা আর্য দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন এবং ব্রাহ্মণদের সেরা মানুষ বা অভিজাত শ্রেণীর মানুষ মনে করতেন। আর এসব পণ্ডিতরা কুষাণ সাম্রাজ্যের রাজাদের আনুকূল্য পেয়েছিলেন।

১৪ জুন, ২০১৯

বঙ্গকথা পর্ব-০৪ : বাংলায় ব্রাহ্মণ্যবাদীদের শাসন শুরু হয়েছিলো যেভাবে

শুঙ্গ ও সাতবাহন সাম্রাজ্যের মানচিত্র
গতকাল সম্রাট অশোক পর্যন্ত বলেছিলাম। তিনি ছিলেন মৌর্য্য সাম্রাজ্যের শেষ শক্তিশালী শাসক। তার মৃত্যুর পর মৌর্য্য সাম্রাজ্য ভেঙে যায়। বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন শাসক শাসন করতে থাকেন। বাংলা, বিহার, নেপাল এই অঞ্চল শেষ পর্যন্ত মৌর্য্যদের অধীনে ছিলো। মৌর্য্যদের শেষ শাসক ছিলেন বৃহদ্রথ। 

১৮৫ খ্রিস্টপূর্বাব্দে মৌর্য্য রাজবংশের নবম সম্রাট বৃহদ্রথের প্রধান সেনাপতি পুষ্যমিত্র শুঙ্গ মৌর্য্য সেনাবাহিনীর কুচকাওয়াজে শক্তি প্রদর্শনের সময় তাঁকে হত্যা করে মৌর্য্য সাম্রাজ্যের পতন ঘটান ও শুঙ্গ রাজবংশের প্রতিষ্ঠা করেন। পুষ্যমিত্র শুঙ্গ মৌর্য্যদের সেনাপতি থাকলেও তিনি ছিলেন একজন আর্য ও ব্রাহ্মণ। মৌর্য্যদের সাথে তার বিবাদের মূল কারণ তার ধর্মীয় প্রার্থক্য। শেষদিকের সব মৌর্য্য সম্রাটরাই বৌদ্ধ ধর্মের অনুসারী ছিলেন যেটা আর্য তথা ব্রাহ্মণদের চক্ষুশূল ছিলো। 

মৌর্য্য সাম্রাজ্যের নয়জন শাসক ছিলেন। তারা হলেন, চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য্য, বিন্দুসার, অশোক, দশরথ, সম্প্রতি, শালিশুক, দেববর্মণ, শতধনবান, বৃহদ্রথ। মৌর্য্য সাম্রাজ্যের পতনের মধ্য দিয়ে বাংলায় খৃস্টপূর্ব ১৮৫ সাল থেকে সরাসরি আর্য শাসন তথা ব্রাহ্মণ্যবাদী শাসন শুরু হয়। পুষ্যমিত্র শুঙ্গ ছিলেন শুঙ্গ সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা। শুঙ্গ সাম্রাজ্যের প্রথম রাজধানী পাটালিপুত্রে (বিহার)। পরে তারা তাদের রাজধানী বিদিশাতে স্থানান্তর করেন। বিদিশা ভারতের মধ্য প্রদেশের একটি জেলার নাম। 

শুঙ্গ সাম্রাজ্য প্রায় ১১০ বছর স্থায়ী হয়। এই সময়ে তারা বৌদ্ধদের উপর ভয়ংকর নির্যাতন করে। মৌর্য বংশের পর প্রথম ব্রাহ্মণ সম্রাট ছিলেন পুষ্যমিত্র শুঙ্গ এবং প্রায় সব ঐতিহাসিক মনে করেন তিনি বৌদ্ধদের ওপর অত্যাচার করতেন এবং ব্রাহ্মণ্যবাদের পুনরুত্থানের মাধ্যমে এই সময় বৌদ্ধধর্মকে কাশ্মীর, গান্ধার ও ব্যাকট্রিয় অঞ্চলে তাড়িয়ে দেন। দিব্যবদান গ্রন্থের অশোকবদান, প্রাচীন তিব্বতী ঐতিহাসিক তারানাথের রচনা প্রভৃতি বৌদ্ধশাস্ত্রের মাধ্যমে বৌদ্ধদের ওপর অত্যাচারের কাহিনী পাওয়া যায়। শুঙ্গ রাজারা বৌদ্ধ মঠ পুড়িয়ে দেন, বৌদ্ধস্তুপগুলি ধ্বংস করেন, বৌদ্ধ সন্ন্যাসীদের নির্বিচারে হত্যা করেন এবং তাদের মাথার জন্য পুরস্কার ধার্য করেন।

অশোকবদানে উল্লেখ রয়েছে, পুষ্যমিত্র চারশ্রেণীর সেনা সজ্জিত করেছিলেন, এবং বৌদ্ধধর্মকে ধ্বংস করবার জন্যে তিনি কুক্কুতরম (পাটলিপুত্রে) যাত্রা করেছিলেন....অতঃপর পুষ্যমিত্র সংঘরম ধ্বংস করলেন, সেখানকার সন্ন্যাসীদের হত্যা করলেন, এবং সেখান থেকে প্রস্থান করলেন....কিছু সময় পর, তিনি শাকলে উপনীত হলেন এবং ঘোষণা করলেন যে ব্যক্তি তাঁকে একজন বৌদ্ধ সন্ন্যাসীর মাথা উপহার দিতে পারবে তিনি তাকে পুরস্কৃত করবেন।” (দিব্যবদান গ্রন্থের অশোকবদান : ২৯৩)

ভারতীয় পৌরাণিক সূত্রও, যেমন, ভবিষ্য পুরাণের প্রতিসর্গ পর্বে মৌর্য যুগের পর ব্রাহ্মণ্যবাদের পুনরুত্থানের কথা বলা হয়েছে এবং সেখানে লক্ষ লক্ষ বৌদ্ধধর্মাবলম্বীকে হত্যার কাহিনীও বর্ণিত হয়েছে। “এই সময়ে (চন্দ্রগুপ্ত, বিন্দুসার ও অশোকের শাসনের পর) কাণ্বকুব্জ নামক সর্বশ্রেষ্ঠ এক ব্রাহ্মণ অর্বুদ পর্বতের শিখরে বলিযজ্ঞের অনুষ্ঠান সম্পন্ন করেন। বৈদিক মন্ত্রের প্রভাবে যজ্ঞানুষ্ঠান (বলি) থেকে চারজন ক্ষত্রিয়ের আবির্ভাব হয়। (...) তাঁরা অশোককে তাঁদের অধীনে রাখেন এবং সকল বৌদ্ধদের নির্মুল করেন। মনে করা হয়, সেখানে ৪০ লক্ষ বৌদ্ধ ছিলেন এবং তাঁদের সকলকে বিরল অস্ত্রের সাহায্যে হত্যা করা হয়।
- প্রতিসর্গ পর্ব।

পুষ্যমিত্র ব্রাহ্মণ্যতন্ত্রের আধিপত্য এবং পশুবলি (যজ্ঞ) পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করেন বলে জানা যায়; এই পশুবলি অশোকের সময় থেকে নিষিদ্ধ ছিলো করেছিলেন। শুঙ্গ রাজবংশের সময় আর্যরা তাদের সংস্কৃতি ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য বাংলা অঞ্চলে দ্রাবিড় ও বৌদ্ধদের সকল পাঠশালা বন্ধ ও ধ্বংস করে। সেখানে তারা তাদের বিদ্যালয় স্থাপন করে। বাংলা থেকে একেশ্বরবাদের অনুসারীদের নিশ্চিহ্ন করার প্রক্রিয়া শুঙ্গ আমল থেকে শুরু হয়।  

দেবভূতি ছিলেন শুঙ্গ রাজবংশের শেষ সম্রাট। শুঙ্গ সম্রাট ভগভদ্রের পরে তিনি ৮৩ খ্রিস্টপূর্বাব্দে সিংহাসন করেন। দেবভূতি একজন দুশ্চরিত্র শাসক ছিলেন বলে জানা যায়। তিনি বেদ অনুসারে চলতেন না। ফলে তার ব্রাহ্মণ মন্ত্রী বাসুদেব কাণ্ব তাঁকে হত্যা করে শাসনক্ষমতা দখল করেন। যার ফলে শুঙ্গ রাজবংশের শাসনের অবসান ঘটে ও কাণ্ব রাজবংশের শাসন শুরু হয়। শাসনের প্রকৃতি অনুসারে শুঙ্গ ও কাণ্ব রাজাদের মধ্যে কোনো প্রার্থক্য ছিলো না। তারা উভয়েই বেদ অনুসরণ করতেন এবং ব্রাহ্মণ ছিলেন। কাণ্ব বংশে ৪ জন রাজা ছিলেন। তারা খৃস্টপূর্ব ৩০ সাল পর্যন্ত শাসন করেছিলেন। সাতবাহন শাসক দ্বারা তাদের পরাজয় হয়।  

মৌর্য্য শাসনামলে ভারতের অন্ধ্রপ্রদেশ ভিত্তিক সামন্তরাজা সাতবাহনরা মৌর্য্যদের অনুগত ছিলো। অশোকের মৃত্যুর পর তারা স্বাধীনভাবে দক্ষিণ ভারত শাসন করতো। তাদের হাতে বাংলা দখল হয় খৃস্টপূর্ব ৩০ সালে এবং কাণ্বরা পরাজিত হয়। সাতবাহনের রাজারা নিজেদের হিন্দু ধর্মের দাবি করলেও তারা বৌদ্ধধর্মের অনুসারীদের ব্যাপারে ছিলো বেশ উদার।

বঙ্গকথা পর্ব-০৩ : মৌর্য্য শাসনামলে বাংলাদেশ

মৌর্য্য সাম্রাজ্যের অধিভুক্ত অঞ্চল

গতকাল মহাপদ্ম নন্দ পর্যন্ত আলোচনা করেছিলাম। মহাপদ্ম নন্দ দ্রাবিড় জাতির লোক ছিলেন। আর্যদের তিনি বাংলা থেকে তাড়িয়ে দিয়েছিলেন। মহাপদ্ম নন্দ মগধ অঞ্চলের শাসক ছিলেন। মগধ প্রাচীন ভারতে ষোলটি মহাজনপদ বা অঞ্চলের মধ্যে অন্যতম। ষোলটি মহাজনপদের মধ্যে মগধ বেশ শক্তিশালী হয়ে ওঠে। এই রাজ্য বর্তমানের বিহারের পাটনা, গয়া আর বাংলার কিছু অংশ নিয়ে গঠিত ছিল। রাজগৃহ ছিল মগধের রাজধানী। পরে এর রাজধানী পাটালিপুত্রে স্থানান্তরিত হয় রাজা অজাতশত্রুর সময়ে।

মহাপদ্ম নন্দ নন্দ বংশের প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি সমস্ত ক্ষত্রিয় রাজাদের তথা আর্যদের পরাজিত করে বিন্ধ্য পর্বত পর্যন্ত সামাজ্য বিস্তার করেন। তাকে ভারতের প্রথম সামাজ্যের প্রতিষ্ঠাতাও বলা হয়। সামাজ্য বিস্তারের জন্য তিনি ২,০০,০০০ পদাতিক, ২০,০০০ অশ্বারোহী, ২,০০০ রথ ও ৩,০০০ হস্তীবিশিষ্ট সুবিশাল বাহিনী গড়ে তোলেন। গ্রিক ঐতিহাসিক প্লুটার্কের মতে তার বাহিনী আরো বড় ছিল। এই বংশের শেষ রাজা ছিলেন মহাপদ্ম নন্দের ছেলে ধননন্দ। তিনিই ছিলেন নন্দ বংশের শেষ রাজা।

আর্যদের মধ্যে এক ব্রাহ্মণ পণ্ডিত ব্যক্তি চাণক্য এই নন্দ রাজবংশকে ধ্বংস করার জন্য কাজ শুরু করেন। তিনি ক্ষত্রিয় রাজাদের একত্রিত করার চেষ্টা করেন। কিন্তু খুব একটা সুবিধে করতে সক্ষম হননি। তিনি এক ক্ষত্রিয়কে অর্থশাস্ত্র, যুদ্ধনীতি, রাজনীতির জ্ঞান দেন এবং তাকে মগধ এর বিরুদ্ধে যুদ্ধ এর জন্য গড়ে তোলেন তক্ষশীলা বিদ্যালয়ে। তক্ষশীলা হলো বর্তমান পাকিস্তানে পাঞ্জাবের রাওয়ালপিন্ডিতে। চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য্য সমস্ত জ্ঞান লাভ করে।

চন্দ্রগুপ্তকথা নামক গ্রন্থানুসারে, চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য্য ও চাণক্যের সেনাবাহিনী প্রথমদিকে নন্দ সাম্রাজ্যের কর্তৃক পরাজিত হয়। কিন্তু চন্দ্রগুপ্ত এরপর বেশ কয়েকটি যুদ্ধে ধননন্দ ও তাঁর সেনাপতি ভদ্রশালাকে পরাজিত করতে সক্ষম হন এবং অবশেষে পাটলিপুত্র নগরী অবরোধ করে ৩২১ খ্রিটপূর্বাব্দে মাত্র কুড়ি বছর বয়সে নন্দ সাম্রাজ্য অধিকার করেন। এভাবেই চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য্য মৌর্য্য শাসনামল শুরু করেন।

চন্দ্রগুপ্ত তাঁর রাজত্বের শেষ পর্যন্ত তামিল ও কলিঙ্গ অঞ্চল ব্যতিরেকে ভারতীয় উপমহাদেশের অধিকাংশ স্থান অধিকার করতে বা পদানত করতে সক্ষম হয়েছিলেন। পূর্বে বাংলা থেকে পশ্চিমে আফগানিস্তান ও বেলুচিস্তান, উত্তরে কাশ্মীর থেকে দক্ষিণে দাক্ষিণাত্য মালভূমি পর্যন্ত তার শাসন প্রতিষ্ঠিত ছিল। ভারতের ইতিহাসে ইতিপূর্বে এর চেয়ে বৃহৎ সাম্রাজ্য নির্মিত হয়নি।

চন্দ্রগুপ্ত ও তাঁর প্রধান পরামর্শদাতা চাণক্য বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংস্কার সাধন করেন। চাণক্য রচিত অর্থশাস্ত্রের ওপর নির্ভর করে চন্দ্রগুপ্ত একটী শক্তিশালী কেন্দ্রীয় প্রশাসন গড়ে তোলেন। অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক বাণিজ্য ও কৃষির উন্নতির সাথে সাথে এই সাম্রাজ্যের কেন্দ্রীয় শাসনব্যবস্থার ফলস্বরূপ একটি শক্রিশালী অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে ওঠে। মেগাস্থিনিসের বর্ণনা অনুসারে, চন্দ্রগুপ্তের মৌর্য্যের বিশাল সেনাবাহিনীতে ৪ লক্ষ সৈন্য ছিল।

ভারত উপমহাদেশে সবচেয়ে বড় এলাকাজুড়ে শাসন করেছে মৌর্য বংশের রাজারা। এই মৌর্যদের সময়েই আর্যরা সবচেয়ে বেশি সংখ্যায় বাংলায় প্রবেশ করেছিল। এখনকার বাংলা অঞ্চল তখন একটি প্রদেশ ছিলো। প্রদেশকে তখন বলা হতো, 'ভুক্তি'। বাংলা অঞ্চলের এই ভুক্তিটির নাম হয় 'পুণ্ড্রবর্ধন ভুক্তি'। এই ভুক্তিটির রাজধানী করা হয় আজকের বগুড়া জেলার মহাস্থানগড়। মৌর্য্য শাসনামলে এর নাম ছিল 'পুণ্ড্রনগর'।

মৌর্যবংশের রাজাদের মধ্যে চন্দ্রগুপ্ত (খ্রিষ্টপূর্ব ৩২১-২৯৮ অব্দ), বিন্দুসার (খ্রিষ্টপূর্ব ২৯৮-২৭২ অব্দ) এবং অশোক (খ্রিষ্টপূর্ব ২৭২-২৩২ অব্দ) ছিলো উল্লেখযোগ্য। অশোকের মৃত্যুর পর উল্লেখযোগ্য কোনো রাজা মৌর্য বংশে আসেনি।

২৯৮ খ্রিস্টপূর্বাব্দে চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য্যের জৈন ধর্ম গ্রহন ও রাজ্য শাসন থেকে স্বেচ্ছা অবসরের পর তাঁর পুত্র বিন্দুসার মাত্র বাইশ বছর বয়সে সিংহাসন লাভ করেন। বিন্দুসার মৌর্য্য সাম্রাজ্যকে তিনি দক্ষিণ দিকে আরো প্রসারিত করেন এবং কলিঙ্গ, চের, পাণ্ড্য ও চোল রাজ্য ব্যতিরেকে সমগ্র দক্ষিণ ভারত ছাড়াও উত্তর ভারতের সমগ্র অংশ তাঁর করায়ত্ত হয়। তাঁর রাজত্বকালে তক্ষশীলার অধিবাসীরা দুইবার বিদ্রোহ করেন কিন্তু বিন্দুসারের পক্ষে তা দমন করা সম্ভব হয়নি। তক্ষশীলার বিদ্রোহের মূল কারণ আর্যরা। ব্রাহ্মণ্যবাদীরা মৌর্য্য শাসকদের নিজেদের মতো করে চালাতে চাইলেন কিন্তু তারা আর্যদের সব পরামর্শ মানতেন না বিশেষ করে জাতিভেদ মানতে চাইতেন না। এই নিয়ে আর্যরা বিদ্রোহ করে।

২৭২ খ্রিস্টপূর্বাব্দে বিন্দুসারের মৃত্যু হলে উত্তরাধিকারের প্রশ্নে যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। বিন্দুসার তাঁর অপর পুত্র সুসীমকে উত্তরাধিকারী হিসেবে চেয়েছিলেন, কিন্তু সুসীমকে উগ্র ও অহঙ্কারী চরিত্রের মানুষ হিসেবে বিবেচনা করে বিন্দুসারের মন্ত্রীরা তাঁর অপর পুত্র অশোককে সমর্থন করেন। রাধাগুপ্ত নামক এক মন্ত্রী অশোকের সিংহাসনলাভের পক্ষে প্রধান সহায়ক হয়ে ওঠেন এবং পরবর্তীকালে তাঁর প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। অশোক শঠতা করে সুসীমকে একটি জ্বলন্ত কয়লা ভর্তি গর্তে ফেলে দিয়ে হত্যা করেন।

সিংহাসনে আরোহণ করে অশোক পরবর্তী আট বছর তাঁর সাম্রাজ্য বিস্তারে মনোনিবেশ করেন। উত্তরে হিন্দুকুশ পর্বতমালা থেকে শুরু করে দাক্ষিণাত্যের কিছু অংশ বাদ দিয়ে সমগ্র ভারতবর্ষ তাঁর করায়ত্ত হয়। তাঁর রাজত্বকালের অষ্টম বর্ষে তিনি কলিঙ্গ আক্রমণ করেন। এই ভয়াবহ যুদ্ধে প্রায় এক লক্ষ মানুষ নিহত হন এবং দেড় লক্ষ মানুষ নির্বাসিত হন। অশোকের ত্রয়োদশ শিলালিপিতে বর্ণিত হয়েছে যে কলিঙ্গের যুদ্ধে প্রচুর মানুষের মৃত্যু ও তাঁদের আত্মীয় স্বজনদের অপরিসীম কষ্ট লক্ষ্য করে অশোক দুঃখে ও অনুশোচনায় দগ্ধ হন। এই ভয়ানক যুদ্ধের কুফল লক্ষ্য করে যুদ্ধপ্রিয় অশোক একজন শান্তিকামী ও প্রজাদরদী সম্রাট এবং বৌদ্ধ ধর্মের একজন পৃষ্ঠপোষকে পরিণত হন। অশোকের পৃষ্ঠপোষকতায় শুধুমাত্র মৌর্য্য সাম্রাজ্য নয়, এশিয়ার বিভিন্ন রাজ্যে বৌদ্ধ ধর্ম প্রচারিত হয়। তাঁর পুত্র মহিন্দ ও কন্যা সংঘমিত্রা সিংহলে বৌদ্ধ ধর্ম প্রচার করেন।

সম্রাট অশোকের সময় বর্তমান বাংলা তৎকালীন পুণ্ড্রনগরের শাসকরা প্রজাদের প্রতি ভাল আচরণ করতেন। তাদের সুখে রাখার চেষ্টা করতেন। কিন্তু তবুও স্বস্তি ছিল না বাংলার মানুষের। স্বাধীনতা প্রিয় বাংলার মানুষের এই পরাধীনতা ভাল লাগেনি। বাংলার কোনো কোনো অংশে সুযোগ পেলেই তারা স্বাধীনতা ঘোষণা করতো। এর প্রমাণ হচ্ছে গঙ্গা নদীর তীরে গড়ে ওঠা একটি স্বাধীন রাজ্য। গ্রিক লেখকরা এই রাজ্যটির নাম লিখেছেন 'গঙ্গারিডি'। হিসেব মতে বাঙালির এই স্বাধীন রাজ্যটি গড়ে উঠেছিল মৌর্য যুগে। এই শক্তিশালী রাজ্যের সৈন্যবাহিনীতে চার হাজার হাতির এক বিশাল বাহিনী ছিল।

অশোকের মৃত্যুর পরবর্তী পঞ্চাশ বছর দশরথ, সম্প্রতি, শালিশুক, দেববর্মণ, শতধনবান ও বৃহদ্রথ এই ছয় জন সম্রাটের রাজত্বকালে মৌর্য্য সাম্রাজ্য দুর্বল হতে থাকে।

মৌর্য্য শাসকেরা মূলত জৈন ধর্ম ও বৌদ্ধ ধর্মের অনুসারী। জৈন ধর্মের প্রচারক মহাবীর আর বৌদ্ধ ধর্মের প্রচারক গৌতমের জীবনধারা এবং তাদের সত্য-সন্ধানের প্রক্রিয়া লক্ষ্য করে মওলানা আবুল কালাম আযাদসহ অনেক গবেষক মনে করেন যে, তারা হয়তো বিশুদ্ধ সত্য ধর্মই প্রচার করেছেন। কিন্তু ষড়যন্ত্র ও বিকৃতি তাদের সে সত্য ধর্মকে পৃথিবীর বুক থেকে এমনভাবে নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছে যে, তার কোন চিহ্ন খুঁজে পাওয়া আজ অসম্ভব।

এ প্রসঙ্গে মান্নান তালিব লিখেছেন, “জৈন ও বৌদ্ধ ধর্মের ইতিহাস আলোচনা করলে এ ষড়যন্ত্রের বহু ইঙ্গিত পাওয়া যাবে। এ উভয় ধর্মই আর্যদের ধর্মীয় গ্রন্হ বেদকে ঐশী গ্রন্হ হিসেবে মেনে নিতে অস্বীকার করে। তপস্যা, যাগযজ্ঞ ও পশুবলিকে অর্থহীন গণ্য করে। ব্রাহ্মণদের পবিত্রাত্মা ও নরশ্রেষ্ঠ হওয়ার ধারণাকে সমাজ থেকে নির্মূল করে দেয়। ফলে বর্ণাশ্রমভিত্তিক সমাজব্যবস্থার ভিত্তি নড়ে উঠে। স্বাভাবিকভাবে জনসাধারণ এ ধর্মদ্বয়ের আহ্বানে বিপুলভাবে সাড়া দেয়। দ্রাবিড় ও অন্যান্য অনার্য ছাড়া বিপুল সংখ্যক আর্যও এ ধর্ম গ্রহণ করে। এ পরিস্থিতি মোকাবিলা করার জন্য আর্য ব্রাহ্মণ্য ধর্ম বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মদ্বয়কে প্রথমে নাস্তিক্যবাদের অন্তর্ভুক্ত করে। নাস্তিক্যবাদের সংজ্ঞা তারা এভাবেই নিরুপণ করে যে, বেদবিরোধী মাত্রই নাস্তিক। কাজেই জৈন ও বৌদ্ধরাও নাস্তিক। অতঃপর উভয় ধর্মীয়দের নিরীশ্বরবাদী প্রবণতা প্রমাণ করার চেষ্টা চলে”। (বাংলাদেশে ইসলাম, পৃষ্ঠা ৩৭-৩৮)

মৌর্য্যরা সরাসরি আর্যদের প্রতিনিধিত্ব না করলেও প্রচুর আর্য এসময় বাংলায় প্রবেশ করে। তারা তাদের কৃষ্টি, কালচার ও ধর্ম দিয়ে দ্রাবিড়দের প্রভাবিত করে। পরবর্তী গুপ্ত আমলে আর্যরা পুরোপুরিভাবে দ্রাবিড়দের সংস্কৃতি ও ধর্ম বিশ্বাস নষ্ট করে দেয়।

বঙ্গকথা পর্ব-০২ : আর্যদের সামরিক ও সাংস্কৃতিক আগ্রাসন



এখন থেকে প্রায় চার হাজার বছর আগের কথা। আর্য নামের এক জাতি ধ্বংসপ্রবণ জাতি প্রবেশ করেছিল উত্তর ভারতে। তবে বাংলা দখল করতে তাদের আরো এক হাজার বছর প্রয়োজন হয়। দ্রাবিড় অধ্যুষিত সিন্ধু, পাঞ্জাব ও উত্তর ভারত আর্যদের দখলে চলে যাওয়ার পর এই যাযাবরদের অত্যাচারে টিকতে না পেরে অধিকাংশ দ্রাবিড় দক্ষিণ ভারত, শ্রীলংকা ও বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। আর্যরা তাদের দখল বাড়াতে আরো পূর্বদিকে অগ্রসর হয়। সামরিক বিজয়ের সাথে সাথে বৈদিক আর্যরা তাদের ধর্ম-সংস্কৃতির বিজয় অর্জনেও সকল শক্তি নিয়োগ করে। পুরো উত্তর ভারত আর্যদের অধীনতা স্বীকার করে নেয়। কিন্তু স্বাধীন মনোভাব ও নিজ কৃষ্টির গর্বে গর্বিত বঙ্গবাসীরা আর্য আগ্রাসনের বিরুদ্ধে প্রবলভাবে রুখে দাঁড়ায়। ফলে করতোয়ার তীর পর্যন্ত এসে সামরিক অভিযান বন্ধ হয়ে যায় আর্যদের।

বাংলাদেশের পূর্বপুরুষদের এই প্রতিরোধ-যুদ্ধ সম্পর্কে অধ্যাপক মন্মথমোহন বসু বলেন, “প্রায় সমস্ত উত্তর ভারত যখন বিজয়ী আর্য জাতির অধীনতা স্বীকার করিয়াচিল, বঙ্গবাসীরা তখন সগর্বে মস্তক উত্তোলন করিয়া তাহাদের বিরুদ্ধে দাঁড়াইয়াছিল। শতপথ ব্রাহ্মণ বলেন, আর্যদের হোমাগ্নি সরস্বতী তীর হইতে ভাগলপুরের সদানীরা (করতোয়া) নদীর পশ্চিম তীর পর্যন্ত আসিয়া নিভিয়া গিয়াছিল। অর্থাৎ সদানীরার অপর পারে অবস্থিত বঙ্গদেশের মধ্যে তাঁহারা প্রবেশ করিতে পারেন নাই”। (বাংলা নাটকের উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ, দ্বিতীয় সংস্করণ, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, ১৯৫৯, পৃষ্ঠা ২১)

জাবি অধ্যাপক ড. এ কে এম শাহনাওয়াজ বলেন, আর্যদের আদিবাস ছিল ইরানের শেষ উত্তরে। কাস্পিয়ান সাগরের তীরে। কৃষিকাজ ছিল তাদের প্রধান পেশা। জনসংখ্যা বেড়ে যাওয়ার পাশাপাশি তাদের কৃষি জমির সংকট দেখা দেয়। ফলে তাদের খাদ্যের অভাব প্রকট হয়। বাধ্য হয়ে এরা নতুন জমির খোঁজে ছড়িয়ে পড়ে নানা দেশে। এদেরই একটি দল দক্ষিণে এসে ইরানের মূল ভূমিতে বসতি গড়ে। এখানে বসবাস করতে করতে এক সময় খোঁজ পায় ভারত আর বাংলার। জানতে পারে সম্পদশালী এই দেশগুলোর মাটি খুব উর্বর। প্রচুর ফসল ফলে ওখানে। কৃষিজমির লোভে একসময় আর্যরা ভারতের দিকে অগ্রসর হয়। প্রথমে বসতি স্থাপন করে ভারতে। তারপর সুযোগ মত চলে আসে বাংলায়।

তবে যত সহজে ভারতে আসতে পেরেছিল— বাংলায় প্রবেশ করা ততটা সোজা ছিল না। প্রথমদিকে বাংলার বীর যোদ্ধারা রুখে দিয়েছিল আর্য আগমন। আর্যদের এসময়ের ইতিহাস জানার একমাত্র উপায় আর্যদের লেখা ধর্মগ্রন্থ। এই গ্রন্থের মূল নাম বেদ। একারণে আর্যদের ধর্মকে বলা হয় ‘বৈদিক ধর্ম’। এই বৈদিক ধর্ম থেকেই '‘সনাতন ধর্মে’র জন্ম হয়। সনাতন ধর্মকে আমরা সাধারণভাবে ‘হিন্দু ধর্ম’ বলে থাকি। বেদগ্রন্থের অনেক খণ্ড ছিল। যেমন ঋগবেদ, যযুর্বেদ, অথর্ববেদ, ব্রাহ্মণ ইত্যাদি। বেদের লেখা থেকে জানা যায়, খুব নাক উঁচু জাতি ছিল আর্যরা। অর্থাৎ নিজেদের সকল জাতি থেকে অনেক বড় মনে করতো। অন্যায়ভাবে ভারত দখল করেছিল তারা। কিন্তু নিজেদের অন্যায়কে আড়াল করতে চেয়েছে বেদগ্রন্থে।

মোহাম্মদ আবদুল মান্নান তাঁর জাতিসত্তার বিকাশধারা বইতে লিখেন, সামরিক অভিযান ব্যাহত হওয়ার পর আর্যরা অগ্রসর হয় বুদ্ধির আশ্রয় নেয়। তারা বাংলাদেশে দীর্ঘদিন ধরে ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক অভিযান পরিচালনা করে। তাই দেখা যায়, আর্য সামাজের ক্ষত্রিয় ও বৈশ্যরা এ দেশে প্রথম আসেনি, আগে এসেছে ব্রাহ্মণেরা। তারা এসেছে বেদান্ত দর্শন প্রচারের নামে। কেননা, ধর্ম-কৃষ্টি-সংস্কৃতি-সভ্যতার বিজয় সম্পন্ন হয়ে গেলে সামরিক বিজয় সহজেই হয়ে যাবে। এ এলাকার জনগণ ব্রাহ্মণ্যবাদী আগ্রাসনের বিরুদ্ধে যে সংগ্রাম পরিচালনা করেন, তা ছিল মূলত তাদের ধর্ম-কৃষ্টি-সভ্যতা হেফাযত করার লড়াই। তাদের এই প্রতিরোধ সংগ্রাম শত শত বছর স্থায়ী হয়। ‘স্বর্গ রাজ্যে’ প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা নিয়ে দেবতা ও অসুরদের মধ্যে দীর্ঘকাল দ্বন্দ্ব-সংঘাত-সংগ্রামের যে অসংখ্য কাহিনী ঋগ্বেদ, সামবেদ, যজুর্বেদ প্রভৃতি আর্য সাহিত্যে ছড়িযে আছে, সেগুলো আসলে আমাদের পূর্বপুরুষদের প্রতিরোধ ও মুক্তি সংগ্রামেরই কাহিনী। আমাদের পূর্ব পুরুষদের গৌরবদীপ্ত সংগ্রামের কাহিনীকে এসব আর্য সাহিত্যে যেভাবে চিহ্নিত করা হয়েছে, পৃথিবীর অন্য কোন জাতির ধর্মশাস্ত্রে কোন মানবগোষ্ঠীকে এমন নোংরা ভাষায় চিহ্নিত করার নজির পাওয়া যাবে না।

একই কথা বলেছেন কামরুদ্দীন আহমদ তাঁর ‘সোশ্যাল হিস্ট্রি অব বেঙ্গল’ বইয়ে, "তিন স্তরে বিভক্ত আর্য সমাজের ক্ষত্রিয় ও বৈশ্যরা প্রথমে বাংলায় আসেনি। এদেশে প্রথমে এসেছে ব্রাহ্মণেরা। তারা এসেছে বেদান্ত দর্শন প্রচারের নামে। বাংলা ও বিহারের জনগণ আর্য-অধিকারের বিরুদ্ধে যে আন্দোলন পরিচালনা করেন, তাও ছিল ধর্মভিত্তিক তথা সাংস্কৃতিক।

বেদগ্রন্থগুলোকে সাধারণভাবে বৈদিক সাহিত্য বলা হয়। এমন একটি বৈদিক সাহিত্যের নাম ‘শতপথ ব্রাহ্মণ’। কিভাবে আর্যরা ভারতে এসেছে তা বলতে গিয়ে একটি গল্প সাজিয়েছিলেন আর্য লেখক। বলেছেন ভারত একটি অপবিত্র দেশ। নিচু জাতির মানুষেরা বাস করে এখানে। অগ্নি উপাসক উঁচু জাতির আর্যরা অমন দেশে বাস করতে পারে না। তারপরও তারা ভারতে এসেছে কেন? বলেছে এই সমস্যাটির সমাধান করে নিয়েছিল আর্যরা। বইতে লেখা আছে, আর্যদের একজন মুনি অর্থাৎ ধর্মগুরু ছিলেন, যার নাম বিদেঘ। বিদেঘের ছিল একটি বিশেষ গুণ ছিলো তাঁর মুখ দিয়ে আগুন বেরুতো। সে আগুনে পুড়ে পবিত্র হয়েছিল ভারত ভূমি। আর সেই পবিত্র মাটিতেই বসতি গড়েছিল আর্যরা। তবে বাংলায় পৌঁছতে তখনো অনেকটা বাকি ছিল।

বঙ্গ-দ্রাবিড়দের প্রতিরোধের ফলে অন্তত খ্রিস্টপূর্ব চার শতক পর্যন্ত এদেশে আর্য-প্রভাব রুখে দেওয়া সম্ভব হয়। খ্রিস্টপূর্ব চার শতকে মৌর্য এবং তার পর গুপ্ত রাজবাংশ প্রতিষ্ঠার আগে বাংলায় আর্য ধর্মের প্রভাব বিস্তৃত হয়নি। মৌর্যদের বিজয়কাল থেকেই বাংলাদেশে আর্য প্রভাব বাড়তে থাকে। তারপর চার ও পাঁচ খ্রিস্টাব্দের গুপ্ত শাসনামলে আর্য ধম, আর্য ভাষা ও আর্য সংস্কৃতি বাংলাদেশে প্রত্যক্ষভাবে শিকড় গাড়ে।

মৌর্য বংশের শাসনকাল পর্যন্ত বৌদ্ধ-ধর্ম ব্রাহ্মণ্যবাদের সাংস্কৃতিক আগ্রাসন থেকে আত্মরক্ষা করতে সমর্থ হয়। আশোকের যুগ পর্যন্ত এই ধর্মে মূর্তির প্রচলন ছিল না। কিন্তু তারপর তথাকথিত সমন্বয়ের নামে বৌদ্ধ ধর্মে ব্রাহ্মণ্যবাদী হিন্দু তান্ত্রিকতার প্রবেশ ঘটে। হিন্দু দেব-দেবীরা বৌদ্ধ মূর্তির রূপ ধারণ করে বৌদ্ধদের পূজা লাভ করতে শুরু করে। বৌদ্ধ ধর্মের এই বিকৃতি সম্পর্কে মাইকেল এডওয়ার্ডট ‘এ হিস্ট্রি অব ইন্ডিয়া’ বইয়ে লিখেছেন,

“Buddhism had, for a variety of reasons, declined and many of its ideas and forms had been absorbed into Hinduism. The Hinduization of the simple teachings of Gautama was reflected in the elevation of th Buddha into a Divine being surrounded, in sculptural representations, by the gods of the Hindu partheon. The Buddha later came to be shown as an incarnation of Vishnu.”

সতিশচন্দ্র মিত্র তাঁর ‘যশোর খুলনার ইতিহাস’ গ্রন্হে লিখেছেনঃ

“যোগীরা এখন হিন্দুর মত শবদেহ পোড়াইয়া থাকেন, পূর্বে ইহা পুঁতিয়া রাখিতেন। …….. উপবিষ্ট অবস্থায় পুঁতিয়া রাখা হিন্দুদের চোখে বিসদৃশ লাগিত, তাঁহারা মনে করিতেন, উহাতে যেন শবদেহ কষ্ট পায়”।

অর্থাৎ হিন্দুদের চোখে বিসদৃশ লাগার কারণে এভাবে বৌদ্ধদেরকে পর্যায়ক্রমে তাদের ধর্ম-সংস্কৃতি তথা জীবনাচরণের অনেক বৈশিষ্ট্যই মুছে ফেলতে হয়েছিল। অশোকের সময় পর্যন্ত বুদ্ধের প্রতিমা-পূজা চালু ছিল না। পরে বুদ্ধের শূন্য আসনে শোভা পেল নিলোফার বা পদ্ম ফুল। তারপর বুদ্ধের চরণ দেখা গেল। শেষে বুদ্ধের গোটা দেহটাই পূজার মণ্ডপে জেঁকে বসল। এভাবে ধীরে ধীরে এমন সময় আসল, যখন বৌদ্ধ ধর্মকে হিন্দু ধর্ম থেকে আলাদা করে দেখার সুযোগ লোপ পেতে থাকল।

গুপ্ত আমলে বাংলাদেশে আর্য ব্রাহ্মণ্যবাদীদের দোর্দন্ড প্রতাপ শুরু হয়। আর্য ভাষা ও সংস্কৃতির স্রোত প্রবল আছড়ে পড়ে এখানে। এর মোকাবিলায় জনগণের প্রতিরোধ সংগ্রাম পরিচালিত হয় জৈন ও বৌদ্ধ ধর্মকে আশ্রয় করে। জৈন ও বৌদ্ধ ধর্ম ও সংস্কৃতি বাংলা ও বিহারের জনগণের আত্মরক্ষার সংগ্রামে এ সময় প্রধান ভূমিকা পালন করে। আর জনগণের আর্য-আগ্রাসনবিরোধী প্রতিরোধ শক্তিকে অবলম্বন করেই বৌদ্ধ ধর্ম ও সংস্কৃতি দীর্ঘদিন এ এলাকার প্রধান ধর্ম ও সংস্কৃতিরূপে অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে সক্ষম হয়। রাখালদাস বন্দোপাধ্যায়ের মতে ঐতিহাসিকও স্বীকার করেছেন,

“আর্যরাজগণের অধঃপতনের পূর্বে উত্তরাপথের পূর্বাঞ্চলে আর্য ধর্মের বিরুদ্ধে দেশব্যাপী আন্দোলন উপস্থিত হইয়াছিল। জৈন ধর্ম ও বৌদ্ধ ধর্ম এই আন্দোলনের ফলাফল”।(বাঙ্গালার ইতিহাস, পৃষ্ঠা ২৭-২৮)

এ আন্দোলনের তোড়ে বাংলা ও বিহারে আর্য রাজত্ব ভেসে গিয়েছিল। আর্য-দখল থেকে এ সময় উত্তরাপথের পুব-সীমানার রাজ্যগুলো শুধু মুক্তই হয়নি, শতদ্র নদী পর্যন্ত সমস্ত এলাকা অনার্য রাজাদের অধীনতা স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছিল। ব্রাহ্মণ্যবাদী ধর্ম ও সংস্কৃতির অনাচারের বিরুদ্ধে সৃষ্ট গণজোয়ারের শক্তিতেই আর্যরা পরাজিত হয় বাংলায়।

এই আন্দোলনের নেতা শিশুনাগবাংশীয় মহানন্দের শূদ্র-পুত্র মহাপদ্মনন্দ ভারত ভূমিকে নিঃক্ষত্রিয় করার শপথ নিয়েছিলেন এবং ক্ষত্রিয় শাসকদের নির্মূল করে সমগ্র ভারতকে অনার্য অধিকারে আনার শপথ করেছিলেন। তিনি এজন্য ‘একরাট’ উপাধি ধারণ করেছিলেন।

বঙ্গকথা পর্ব-০১ : প্রাচীন বাংলার বুনিয়াদ তাওহীদবাদীদেরই হাতে



বাঙালি বহু জাতির মিশ্রণে তৈরি একটি সংকর জাতি। অনেক আগ থেকেই প্রাচীন বাংলার অধিবাসীদের দেহে বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর রক্তের সংমিশ্রণ ঘটেছিল বলেই কালক্রমে বাঙালি একটি সংকর জাতিতে পরিনত হয়েছে। বাঙালি তার গঠনে ও চেহারায় বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর বৈশিষ্ট্যচিহ্ন বহন করে চলেছে বলেই বাঙালিদের মধ্যে আর্য-সুলভ গৌড়বর্ণ যেমন দেখতে পাওয়া যায়, তেমনি নিগ্রোয়েড-সুলভ মোটা কোঁকড়া চুল ও পুরু ঠোঁটও দেখা যায়। 

ঐতিহাসিকদের মতে, অস্ট্রিকভাষী আদি-অস্ট্রেলীয়রাই বাংলার প্রাচীনতম জাতি। অস্ট্রেলিয়া মহাদেশের আদিবাসীদের সঙ্গে অস্ট্রিকভাষী আদি-অস্ট্রেলীয়দের নৃতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য ও ভাষার মিল রয়েছে বলেই ওই নাম। তবে এরা যে কেবল মাত্র বাংলায় ছিল তা কিন্তু নয়। প্রায় তিরিশ হাজার বছর আগেই অস্ট্রিকভাষী আদি-অস্ট্রেলীয় ভারতীয় উপমহাদেশে ছড়িয়েছিল বলে জানা যায়। 

প্রাচীন বাংলায় অস্ট্রিকভাষী আদি-অস্ট্রেলীয়দের আরও এক নিকটতম প্রতিবেশি ছিল। এরা কিরাত নামে পরিচিত। কিরাতরা ছিল মঙ্গোলয়েড জনগোষ্ঠীর মানুষ। এবং এরাও প্রাচীন বাংলায় অস্ট্রিকভাষী আদি-অস্ট্রেলীয়দের পাশাপাশি অরণ্যচারী জীবন যাপন করত। পরবর্তীকালে আর্যরা তাদের বৈদিক সাহিত্যে অস্ট্রিক ও কিরাতদের অনেকটা ঘৃনাসূচক ‘নিষাদ’ বলে অবহিত করেছিল। তবে প্রকৃতিপ্রেমি বাঙালি আজও নিজেদের ‘নিষাদ’ বলে পরিচয় দিতে তীব্র আকর্ষন বোধ করে। যাই হোক, অস্ট্রিক ও কিরাতদের পর, দ্রাবিড়ভাষী জনগোষ্ঠী প্রাচীন বাংলায় এসেছিল। বাংলার ভাষা ও সভ্যতায় এই দ্রাবিড়ভাষী জনগোষ্ঠীর গভীর অবদান রয়েছে। 

দ্রাবিড় বলতে ঐতিহাসিকগণ দক্ষিণ, মধ্য এবং পশ্চিম ভারতে অবস্থিত একটি বিশাল জাতিগোষ্ঠীর ভাষা ও সেই ভাষাগোষ্ঠীর মানুষকে বুঝিয়ে থাকেন। আর্যরা ভারতবর্ষে আসার আগেই ভারতীয় উপমহাদেশ দ্রাবিড়-অধ্যুষিত ছিল। আর্যরা ইরান থেকে প্রাচীন ভারতে এসেছিল ১৫০০ খ্রিস্টপূর্বে। আর্যরা ভারতবর্ষে আসার আগেই ভারতীয় উপমহাদেশ দ্রাবিড় অধ্যুষিত ছিল। এখানে উল্লেখ্য যে, বহিরাগত আর্যদের তুলনায় দ্রাবিড় সভ্যতা ছিল উন্নত। ঐতিহাসিক শ্রীনিবাস আয়েঙ্গার লিখেছেন, ‘প্রাচীন দ্রাবিড়গণ বৈদিক আর্যদের অপেক্ষা সভ্যতায় কোনও অংশে পশ্চাৎপদ ছিল না। বরং ক্ষেত্রবিশেষে আর্যগণ অপেক্ষা তাহারা অধিকতর উন্নত ছিল। বিজ্ঞানে, শিল্পে, যুদ্ধবিদ্যা ও বুদ্ধি কৌশলে তাহারা আর্যদের সম্যক প্রতিদ্বন্দী ছিল।’ 

এখন প্রশ্ন হল-দাবিড়রা কি ভারতবর্ষে সব সময়ই ছিল? নাকি তারাও কোনও এক সময়ে আর্যদের মতোই বাইরে থেকে ভারতবর্ষে এসেছিল? এই প্রশ্নে পন্ডিতেরা দু ভাগে বিভক্ত। 

(ক) একদল পন্ডিত মনে করেন যে দ্রাবিড় জনগোষ্ঠী ভারতবর্ষের বাইরে থেকে এসেছে । এদের আদি বাসভূমি ছিল ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চল। 

(খ) আরেক দল পন্ডিত মনে করেন- দ্রাবিড় জনগোষ্ঠী ভারতবর্ষের আদি অধিবাসী। 

তবে প্রথম মতটিই অধিকতরো গ্রহনযোগ্য। অবশ্য এর যথার্থ কারণও আছে। দ্রাবিড় জনগোষ্ঠীর বর্তমান বাসস্থান দক্ষিণ ভারত। সেখানকার সমাধিক্ষেত্রে যে কঙ্কাল পাওয়া গেছে তার সঙ্গে ভূমধ্যসাগরীয় নরগোষ্ঠীর (ডিএনএ ইত্যাদির) মিল রয়েছে। তাছাড়া মিশরীয়দের সঙ্গেও দ্রাবিড়দের নৃতাত্ত্বিক মিল রয়েছে। এসব কারণে দ্রাবিড়ভাষী জনগোষ্ঠী কে ভূমধ্যসাগরীয় নরগোষ্ঠীর মানুষ বলে মনে করা হয়।

প্রাচীন বাংলায় অস্ট্রিকভাষী আদি অস্ট্রেলীয়দের অবদান যেমন গ্রামীণ সভ্যতা তেমনি প্রাচীন বাংলায় দ্রাবিড়ভাষী জনগোষ্ঠীর অবদান হল- নগরসভ্যতা। দ্রাবিড়ভাষী জনগোষ্ঠীই প্রাচীন ভারতবর্ষে নগরসভ্যতার সূত্রপাত করেছিল। দ্রাবিড়ভাষী জনগোষ্ঠী ছিল অস্ট্রিকদের তুলনায় সভ্য এবং তাদের সাংগঠনিক শক্তিও ছিল বেশি । যে কারণে নগরকে কেন্দ্র করে দ্রাবিড় সভ্যতা গড়ে উঠেছিল। আসলে মিশর থেকে ভূমধ্যসাগর অবধি দ্রাবিড়ভাষী জনগোষ্ঠীর সভ্যতায় নরগকেন্দ্রিক উপাদানই বেশি। বিশিষ্ট বাঙালি ঐতিহাসিক নীহাররঞ্জন রায় লিখেছেন, ‘নব্যপ্রস্তরযুগের এই দ্রাবিড়ভাষাভাষী লোকেরাই ভারতবর্ষের নগর সভ্যতার সৃষ্টিকর্তা।’ ( বাঙালির ইতিহাস। আদিপর্ব। পৃষ্ঠা; ৭৫)

ঐতিহাসিকদের বর্ণনা অনুসারে সেমিটিক দ্রাবিড়রা তৌহিদবাদী ধর্মমতের উত্তর-পুরুষ। এই দ্রাবিড়রা কারা এই প্রসঙ্গে ঐতিহাসিক গোলাম হোসেন সলিম তার বিখ্যাত রিয়াজুস সালাতিন গ্রন্থে বলেন দ্রাবিড়রা মূলত নূহ আ. এর বংশধর। মহাপ্লাবণের পর নুহ আ. তিন ছেলে ছিলেন, হাম, সাম ও ইয়াফিস। নুহ আ. বড় ছেলে হামের ছিলো ছয় ছেলে। তারা হলো, হিন্দ, সিন্দ, হাবাস, জানাস, বার্বার ও নিউবাহ

এদের মধ্যে হিন্দের মাধ্যমে ভারতবর্ষ আবাদ হয়েছিলো। হিন্দের সন্তানরা এ অঞ্চলে বসতি স্থাপন করেছিলো বলেই এ ভুখন্ড ‘হিন্দুস্তান’ নামে পরিচিত। আল্লাহর নবী নুহ (আঃ) ছেলে ও নাতিদের সকলেই ছিলেন ঈমানদার ও ধর্মপ্রচারক। তাঁরা ছিলেন তাওহীদবাদের পূর্ণ বিশ্বাসী। হামের বড় ছেলে হিন্দের ছিলো চার ছেলে। তারা হলেন পূরব, বঙ্গ, দাখিন ও নাহরাওয়াল।

বড় ছেলে পূরবের মোট বিয়াল্লিশজন ছেলে ছিলো। তারা ভারতবর্ষ ও এর আশেপাশে বসতি স্থাপন করে এবং অল্পকালের মধ্যেই তাদের বংশবিস্তার হয়। তারা ভারতের বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে। হিন্দের উল্লেখিত দ্বিতীয় ছেলে বঙ্গ ভারত উপমহাদেশের পূর্বাঞ্চলে বসতি স্থাপন করেন। তাঁর বংশধরের আবাসস্থলই তাঁর নামে অর্থাৎ ‘বঙ্গ’ নামে পরিচিত হয়ে

বহিরাগত আর্যরা ১৫০০ খ্রিস্টপূর্বে সিন্ধুসভ্যতার যে সব উন্নত নগরসমূহ ধ্বংস করেছিল সে সসব নগরের নির্মাতা ছিল দ্রাবিড়গণ। তবে নগর জীবনের পাশাপাশি দ্রাবিড়রা বাংলায় কৃষি কাজও করত। প্রাচীন বাংলায় দ্রাবিড়রা ধান চাষ করত। ধান ছাড়াও দ্রাবিড়রা গম ও যব এর আবাদও করত। দ্রাবিড়রা অস্ট্রিক-ভাষী আদি-অস্ট্রেলীয়দের মতোই মাছ খেত। মাছ ধরা ছাড়াও তারা নদীতে কিংবা সমুদ্রের ধারে মুক্তা ও প্রবাল আরোহন করত । সংস্কৃত ভাষায় মুক্তা, নীর (পানি), মীন (মাছ) এসব শব্দের মূলে রয়েছে দ্রাবিড় শব্দ। 

এ উপমহাদেশে দ্রাবিড়দের আগমন ঘটেছে প্রাগৈতিহাসিক যুগে। তারা এসেছে সেমিটিকদের আদি বাসভূমি পশ্চিম এশিয়া থেকে। ব্যাবিলন বা মেসোপটেমিয়া দ্রাবিড়দের উৎপত্তিস্থল। এই সেমিটিকরাই পৃথিবীতে প্রথম সভ্যতার আলো ছড়িয়েছে। তারাই ইয়েমেন ও ব্যাবিলনকে সভ্যতার আদি বিকাশভূমিরূপে নির্মাণ করেছে। পৃথিবীতে প্রথম লিপি বা বর্ণমালা উদ্ভাবন দ্রাবিড় জাতিরই অবদান। সুপ্রাচীন এক গর্বিত সভ্যতার অধিকারী এই দ্রাবিড় জাতির লোকেরা ভারতবর্ষে আর্য আগমনের হাজার হাজার বছর আগে মহেঞ্জোদাড়ো ও হরপ্পা সভ্যতা নির্মাণ করেছিল। অনুরূপ সভ্যতার পত্তন হয়তো তারা বাংলাদেশেও করেছিল। কিন্তু প্রাকৃতিক কারণে সেগুলোর চিহ্ন এখন নেই। 

এ প্রসঙ্গে আবুল মনসুর আহমদ লিখেছেন : তারা মহেঞ্জোদাড়ো ও হরপ্পার মতো সুন্দর নগরী পাক-বাংলায় নিশ্চয়ই নির্মাণ করিয়াছিলেন। অবশ্য স্থানীয় নির্মাণ উপকরণের পার্থক্যহেতু স্থপতিতেও নিশ্চয় পার্থক্য ছিল। কিন্তু আজ সে সবের কোন চিহ্ন নাই। প্রাকৃতিক কারণে পাকবাংলায় চিরস্থায়ী প্রাসাদ-দুর্গ-অট্টালিকা নির্মাণের উপযোগী মাল-মশলা যেমন দুষ্প্রাপ্য, নির্মিত দালান-কোঠা ইমারত রক্ষা করাও তেমনি কঠিন। প্রাকৃতিক দুর্যোগের এরা নিশ্চিত শিকার। ময়নামতি, মহাস্থানগড়ের ভগ্নাবশেষ দেখিয়া পাকবাংলার সভ্যতার প্রাচীনত্ব ও স্থপতির চমৎকারিত্ব আন্দায করা যায় মাত্র, বিচার করা যায় না।' (আমাদের কৃষ্টিক পটভূমি, পূর্বদেশ, ঈদ সংখ্যা-১৯৬৯)।

উন্নততর সংস্কৃতির ধারক দ্রাবিড়রা আর্যদের শির্কবাদী ধর্ম, তাদের ধর্মগ্রন্থ, তাদের তপস্যা ও যাগযজ্ঞ এবং তাদের ব্রাহ্মণদের পবিত্র ও নরশ্রেষ্ঠ হওয়ার ধারণাকে কখনো মেনে নেয়নি। রাজশক্তির প্রচণ্ড দাপট, নজিরবিহীন জুলুম-সন্ত্রাস চালিয়েও এ এলাকার সাধারণ মানুষকে বৈদিক আর্য-সংস্কৃতির বশীভূত করা যায়নি। অথচ বিশ্বাস, শিক্ষা, সৎকর্মশীলতা ও অহিংসার বাণীবাহী জৈন ধর্ম এ এলাকায় প্রচারিত হওয়ার সাথে সাথেই এখানকার মানুষের চিত্ত জুড়ে গভীর আসন গেড়েছে। জীবাত্মার নির্বাণ লাভের বুদ্ধ-বাণী তাদেরকে উন্নত জীবনবোধে সঞ্জীবিত করেছে। জৈন ও বৌদ্ধ প্রচারকদের আহ্বানে এখানকার মানুষ স্বতস্ফূর্তভাবে সাড়া দিয়েছে। সবশেষে মানব-মুক্তির মহাসনদ ইসলাম চিহ্নিত হয়েছে এ জনগোষ্ঠীর চূড়ান্ত মঞ্জিলরূপে।

তবে দ্রাবিড়দের সবচে বড় অবদান হল বাংলা ভাষার ক্ষেত্রে। বাংলা ব্যকরণ অনেক নিয়ম দ্রাবিড় ভাষাতত্ত্বের ওপর গড়ে উঠেছে । তা ছাড়া দ্রাবিড় ভাষার প্রচুর শব্দ বাংলা শব্দ ভান্ডারকে সমৃদ্ধ করেছে। একটা সময় ছিল যখন- ভারতীয় উপমহাদেশে দ্রাবিড়ভাষাই ছিল সর্বসাধারণের ভাষা। এ কারণেই প্রাচীন বাংলার অধিবাসীদের ভাষায় দ্রাবিড় ভাষার প্রভাব পড়াই ছিল স্বাভাবিক। দ্রাবিড় ভাষা থেকে এসেছে বাংলা ভাষায় এমন কিছু শব্দ হল: অণু, অরণি, অগুরু, অনল, কাল (সময়), কলা, পুষ্প, মুকুল, মল্লিকা, পূজা, গণ, কোণ, নীল, পন্ডিত, শব, অর্ক, অলস, ফল, বীজ, উলু, রাত্রি, অটবী, আড়ম্বর, তন্ডুল, খড়গ, কুন্ড, চন্দন, দন্ড, খাল, বিল, ময়ূর, কাক, কাজল, কোদাল, কেয়া, বালা, পল্লী, বেল, তাল, চিকণ, চুম্বন, কুটির, খাট, ঘুণ, কুটুম্ব ...ইত্যাদি।

ভাষাই তো একটি জাতির আসল পরিচয়। সেই অনুসারে বলা যায় দ্রাবিড়রাই বাঙালি জাতির পূর্বসূরী।

আর্যরা এসে বঙ্গ বা বাংলাকে দমিয়ে রেখেছে। বঙ্গের শৌর্য ও সভ্যতা আর্য তথা বাহ্মন্যবাদীদের হাতে ধ্বংস হওয়ার পর বহুদিন বাংলা অবনত ছিলো। এরপর এই অঞ্চলে নতুন দাওয়াত নিয়ে আসেন গৌতম বুদ্ধ। দ্রাবিড়রা বেশিরভাগ বৌদ্ধ ধর্মের অনুসারী হয়ে যান। এই অঞ্চলে বৌদ্ধ শাসন শুরু হয়। বঙ্গের নাম দিন দিন আরো মলিন হতে থাকে।

এরপর ধীরে ধীরে এই অঞ্চলের মানুষ মুশরিক হতে শুরু করে। নানান দেব দেবীর পূজা শুরু করে দেয়। বাহ্মন্যবাদী ও বৌদ্ধদের আচার আচরণের মিশেলে হিন্দু ধর্মের উদ্ভব হয়। এরা আর্যদের ধর্মীয় সাহিত্য 'বেদ'কেই ধর্মীয় গ্রন্থ হিসেবে সম্মান করে। যদিও তারা বেদ পড়তে পারতো না বা অনুমতি ছিলো না। এই অঞ্চলের মানুষ মুশরিক হয়ে যাওয়ার কারণ এটাও যে আর্যরা আবার বৌদ্ধদের পরাজিত করে ক্ষমতায় আসীন হয়েছে।

এরপর আবার মুসলিমরা এদেশে ইসলামের দাওয়াত নিয়ে আসে। দ্রাবিড়দের উত্তরসূরী শূদ্ররা দলে দলে মানবতার ধর্ম ইসলামে দাখিল হতে থাকে। এরপর বখতিয়ার খিলজির মাধ্যমে হিন্দু/আর্য রাজবংশের পতন হয়।

বঙ্গের বেশিরভাগ মানুষ ইসলাম গ্রহণ করে। এই অঞ্চলে মুসলিমদের সালতানাত প্রতিষ্ঠিত হয়। বাংলার স্বাধীন মুসলিম সুলতান হাজী শামসউদ্দীন ইলিয়াস শাহ (শাসন ১৩৩৯-৫৮ সালে) আবার দ্রাবিড়দের সেই বঙ্গকে তুলে নিয়ে আসেন।

প্রথমবারের মতো গঙ্গা ও ব্রহ্মাপুত্রের নিম্ন অববাহিকার ব্যাপকতর এলাকাকে বাঙ্গালাহ নাম অভিহিত করেন। লখনৌতি ও বাঙ্গালাহকে তিনিই স্বাধীন সুলতানী শাসনের অধীনে ঐক্যবদ্ধ করেন। সমগ্র বাংলাভাষী অঞ্চল তার আমলেই প্রথম বাঙ্গালাহ নামে পরিচিত হয় এবং তিনি প্রথমবারের মতো শাহ-ই-বাঙ্গালাহ নাম ধারণ করে নিজেকে বৃহৎ বাংলার জাতীয় শাসকরূপে ঘোষণা করেন। এর ফলে এখানে রাজনৈতিক, ভৌগোলিক ও ভাষাগত ঐক্যের সূচনা হয়। বাংলা আবার পৃথিবীর বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়ায়।

ডক্টর নীহাররঞ্জন রায় ও প্রসঙ্গে লিখেছেন, “যে বঙ্গ ছিল আর্য সভ্যতার ও সংস্কৃতির দিক থেকে ঘৃণিত ও অবজ্ঞাত, যা ছিল পাল ও সেনদের আমলে কম গৌরবের ও (কম) আদরের- সেই বঙ্গ নামেই শেষ পর্যন্ত তথাকথিত পাঠান (মুসলিম) আমলে বাংলার সমস্ত জনপদ ঐক্যবদ্ধ হল”। (বাঙালির ইতিহাস, আদিপর্ব- সূভাষ মুখোপাধ্যায় কর্তৃক সংক্ষেপিত, পৃষ্ঠা ২২)